মা'আরিফুল হাদীস

معارف الحديث

কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায় - এর পরিচ্ছেদসমূহ

মোট হাদীস ৩২১ টি

হাদীস নং: ১
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ يٰأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اذْكُرُو اللّٰهَ ذِكْرًا كَثِيْرًا وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وأصِيْلاً.

"হে ঈমানদারগণ! (অন্তর ও রসনার মাধ্যমে) আল্লাহকে বহুলভাবে স্মরণ কর এবং (বিশেষত) সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা কর।"

وَادْعُوْهُ خَوْفًا وَطَمَعًا إِنَّ رَحْمَتَ اللّٰهِ قَرِيْبٌ مِّنَ الْمُحْسِنِيْنَ.

"(নিজেদের ভুল-ত্রুটির জন্যে আল্লাহর ধরপাকড় ও শাস্তি থেকে) ভীতির সাথে এবং (তাঁর রহম ও করমের) আশায় আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাও! আল্লাহর রহমত নিঃসন্দেহে সৎকর্মশীল বান্দাদের নিকটেই রয়েছে।" (আল-আ'রাফ: ৫৬)

'মা'আরিফুল হাদীছ' 'কিতাবুৎ-তাহারাত'-এর একেবারে শুরুতেই 'হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা'-এর বরাতে এ বক্তব্যটি উদ্ধৃত করা হয়েছে:

আল্লাহ তা'আলা তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে আমাকে এই তত্ত্ব জানিয়ে দিয়েছেন যে, কল্যাণ ও সৌভাগ্যের যে রাজপথের দিকে আহ্বানের জন্যে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম প্রেরিত হয়েছিলেন, (যার নাম হচ্ছে শরীয়ত) যদিও তার অনেক তোরণদ্বার রয়েছে এবং প্রত্যেক তোরণদ্বারের অধীন শত শত হাজার হাজার আহকাম রয়েছে, কিন্তু এগুলোর এ প্রাচুর্য সত্ত্বেও এসব নীতিগতভাব মোটামুটি চারটি শিরোনামের অধীনে এসে যায়: ১. তাহারাত ২. ইখবাত ৩. সামাহাত ৪. আদালত।

এতটুকু লেখার পর শাহ সাহেব (র) এ চারটির প্রত্যেকটির গূঢ়তত্ত্ব বর্ণনা করেছেন। তা পাঠ করলে একথা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নিঃসন্দেহে শরীয়ত ঐ চারটি শাখায়ই বিভক্ত।

মা'আরিফুল হাদীছ তৃতীয় জিলদে 'কিতাবুৎ তাহারাত' এর শুরুতে হযরত শাহ্ সাহেব (র)-এর সেই বক্তব্যের শুধু ততটুকু অংশই সংক্ষিপ্তভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছিল-যাতে তিনি তাহারাত বা পবিত্রতার মূলতত্ত্ব বর্ণনা করেছিলেন।

ইখবাত-এর মৌলতত্ত্ব সম্পর্কে তিনি যা কিছু লিখেছেন, তা সংক্ষিপ্তাকারে এভাবে বলা যায়:
"বিস্ময়, ভীতি ও মহব্বত এবং সন্তুষ্টি কামনা ও অনুগ্রহ প্রার্থনার স্পীরিটের সাথে আল্লাহ যুল-জালাল ও জাবারুতের হুযুরে যাহির ও বাতিনের দ্বারা নিজের বন্দেগী, দীনতা, মুখাপেক্ষিতা ও ভিখারীপনার অভিব্যক্তি ঘটানোই হচ্ছে ইখবাত।”

এরই অপর বিখ্যাত শিরোনাম বা পরিচিতি হচ্ছে ইবাদত। আর এটাই হচ্ছে
মানব সৃষ্টির বিশেষ উদ্দিষ্ট:

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنَ

"জিন ও ইনসানকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যেই সৃষ্টি করেছি।"

হযরত শাহ্ সাহেব (র) সৌভাগ্যের উক্ত চারটি শাখা সম্পর্কে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা-এর মকসদ ২-এ 'আবওয়াবুল ইহসান' অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন। এ আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেন:

"ঐগুলির প্রথমটি অর্থাৎ তাহারাত অর্জনের জন্যে ওযু-গোসল প্রভৃতির হুকুম দেওয়া হয়েছে এবং দ্বিতীয়টা অর্থাৎ 'ইখবাত' হাসিলের ওসীলা হচ্ছে নামায, আযকার ও কুরআন মজীদ তিলাওয়াত।" (আবওয়াবুল ইহসান, হুজ্জাতুল্লাহি বালিগা, জিলদ ২, পৃ. ৬৭)

বরং বলা যায়, যিকরুল্লাহ তথা আল্লাহর স্মরণই ইখবাতের বিশেষ ওসীলা স্বরূপ আর নামায, তিলাওয়াত এবং অনুরূপভাবে দু'আও এর বিশেষ বিশেষ রূপ।

মোদ্দা কথা, নামায, যিকরুল্লাহ, কুরআন মজীদ তিলাওয়াত এ সবের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই মুবারক গুণ অর্জন ও তার পূর্ণতা বিধান, যাকে হযরত শাহ ওলীউল্লাহ (র) 'ইখবাত' বলে অভিহিত করেছেন। এজন্যে এ সবই একই পর্যায়ভুক্ত।

নামায সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হাদীসসমূহ এবং তাঁর বাণী ও অভ্যাস বা আচরিত পন্থা সম্পর্কে আল্লাহর তওফীক অনুযায়ী এ সিরিজের তৃতীয় জিলদে উপস্থাপিত হয়েছে। যিকির, দু'আ ও তিলাওয়াত সংক্রান্ত হাদীসসমূহ এখন এই পঞ্চম জিলদে পেশ করা হচ্ছে।
আল্লাহ তা'আলা এ গুনাহগার লিখককে, সহৃদয় পাঠকবর্গকে তার উপর আমল করার এবং এগুলো থেকে পুরোপুরি উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন।


আল্লাহর যিকিরের মাহাত্ম্য এবং এর বরকতসমূহ
যেমনটি উপরে বলা হয়েছে, যিকরুল্লাহ বা আল্লাহর যিকির শব্দটি ব্যাপক অর্থে সালাত (নামায), কুরআন তিলাওয়াত, দু'আ ও ইস্তিগফার সবকিছুর ব্যাপারেই প্রযোজ্য এবং এসব হচ্ছে যিকরুল্লাহরই বিশেষ বিশেষ রূপ। কিন্তু বিশেষ অর্থে যিকরুল্লাহ হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার তাসবীহ-তাকদীস তথা মাহাত্ম্য বর্ণনা তাওহীদ-তামজীদ, তাঁর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা এবং তাঁর পূর্ণতার গুণ বর্ণনা ও ধ্যান করা। পারিভাষিক অর্থে একেই যিকরুল্লাহ বা আল্লাহর যিকির বলা হয়ে থাকে। সম্মুখে বর্ণিতব্য কোন কোন হাদীছের দ্বারা স্পষ্টভারে জানা যাবে যে, এই যিকরুল্লাহ হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি এবং মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং ঊর্ধ্বজগতের সাথে তার সম্পর্কের খাস ওসীলা স্বরূপ।

শায়খ ইবনুল কাইয়েম (র) তাঁর 'মাদারিজুস সালিকীন' (مدارج السالكين) নামক গ্রন্থে যিকরুল্লাহর মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব এবং তার বরকতসমূহ সম্পর্কে অত্যন্ত শিক্ষণীয় এবং আত্মার উৎকর্ষ বিধায়ক বর্ণনা দিয়েছেন। তার একাংশের সংক্ষিপ্ত সার আমরা এখানে উদ্ধৃত করছি। বর্ণিতব্য হাদীসসমূহে যিকরুল্লাহর যে মাহাত্ম্য বর্ণিত হবে, শায়খ ইব্‌ন কাইয়েম (র) লিখিত উক্ত বক্তব্যটি পাঠের পর তা অনুধাবন করা ইনশাআল্লাহ অনেকটা সহজ হবে। তিনি লিখেন:
"কুরআন মজীদে যিকরুল্লাহর তাকিদ ও উৎসাহদানের যে দশটি শিরোনাম পাওয়া যায়, তা নিম্নরূপ:

১. কোন কোন আয়াতে ঈমানদারগণকে তাকিদসহকারে তার আদেশ দান করা
হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে:

يٰأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اذْكُرُو اللّٰهَ ذِكْرًا كَثِيرًا وَسَبِّحُوْهُ بُكْرَةً وأَصِيْلاً

“হে ঈমানদারগণ, বহুল পরিমাণে আল্লাহর যিকির করবে এবং সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করবে।" (সূরা আহযাব, ষষ্ঠ রুকূ')

অন্য আয়াতে আছে:

وَاذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيْفَةً (الأعراف (٢٤)

মনে মনে এবং কান্নাকাটি করে ও ভয়ের সাথে তোমার প্রভুর যিকির করবে।"
(আ'রাফ রুকু' ২৪)

২. কোন কোন আয়াতে আল্লাহকে বিস্মৃত হতে এবং তাঁর স্মরণ থেকে গাফেল হতে কঠোরভাবে মানা করা হয়েছে। এটাও যিকরুল্লাহর তাকিদেরই একটা ধরন।
বলা হয়েছে:

وَلَا تَكُنْ مِّنَ الْغَافِلِيْنَ

"এবং তোমরা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।" (আল আ'রাফ: ২৪তম রুকূ')

অন্যত্র বলা হয়েছে:

وَلَا تَكُونُوْا كَالَّذِيْنَ نَسُوا اللّٰهَ فَانْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ (الحشر (٢٤)

"এবং তোমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়োনা, যারা আল্লাহকে বিস্মৃত হয়েছে (ফলশ্রুতিতে) আল্লাহরও বিস্তৃত করিয়ে দিয়েছেন তাদের নিজেদেরকে" অর্থাৎ আল্লাহ বিস্মৃতির পরিণতিতে তারা হয়েছে আত্মবিস্মৃত। (আল-হাশর ৩য় রুকু)

৩. কোন কোন আয়াতে বলা হয়েছে যে, সাফল্য নিহিত রয়েছে আল্লাহর প্রচুর যিকিরের সাথে। বলা হয়েছে:

وَاذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ.

"বহুল পরিমাণে আল্লাহর যিকির করবে, যাতে করে তোমরা সাফল্যমণ্ডিত হতে পারো।"
(সূরা জুমুআ ২য় রুকু)

৪. কোন কোন আয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে যিকির ওয়ালা বান্দাদের প্রশংসা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, যিকিরের বিনিময়ে তাদের সাথে রহমত ও মাগফিরাতের খাস মুআমেলা করা হবে এবং তাদেরকে বিপুল বিনিময় প্রদানে ধন্য করা হবে। তাই সূরা আহযাবে ঈমান ওয়ালা নারী-পুরুষ বান্দাহদের অন্যান্য গুণাবলীর সাথে সাথে বলা হয়েছে:

والذّٰكِرِينَ اللّٰهَ كَثِيْرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللّٰهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عظِيمًا.

"আর আল্লাহর প্রচুর পরিমাণে যিকিরকারী নারী-পুরুষ বান্দাগণ-আল্লাহর তা'আলা তাদের জন্যে তৈরি করে রেখেছেন মাগফিরাত ও বিরাট ছওয়াব।"

৫. অনুরূপভাবে কোন কোন আয়াতে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, যারা দুনিয়ার বাহার ও স্বাদে-ভোগে নিমগ্ন হয়ে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে যাবে, তারা ব্যর্থকাম হবে। যেমন সূরা মুনাফিকুনে ইরশাদ হয়েছে:

يٰأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللّٰهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَالِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ (المنافقون ع (۲)

"হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ধন-সম্পদ এবং তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল করে না দেয়। যারা এরূপ গাফলতে নিমগ্ন হবে, তারাই হলো ক্ষতিগ্রস্ত।"
(আল-মুনাফিকূন রুকূ'-২)

এই তিনটি শিরোনামও যিকরুল্লাহর তাগিদ ও উৎসাহ প্রদানের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কার্যকরী।

৬. কোন কোন আয়াতে বলা হয়েছে যে, যে বান্দারা আমাকে স্মরণ করবে, আমিও তাদেরকে স্মরণ করবো:

فَاذْكُرُوْنِيْ أَذْكُرُكُمْ وَاشْكُرُوْا لِيْ وَلَا تَكْفُرُوْنِ (بقرة ع (۱۸)

"হে আমার বান্দারা, তোমরা আমাকে স্মরণ কর, তা হলে আমিও তোমাদেরকে স্মরণ রাখবো, তোমরা আমার শুকরিয়া আদায় করবে এবং না-শুকরী করবে না।"
(বাকারা ১৮তম রুকূ')

সুবহানাল্লাহি ও বিহামদিহী! বান্দার জন্য এর চাইতে বড় সাফল্য ও সৌভাগ্য আর কী হতে পারে যে, স্বয়ং বিশ্বজাহানের স্রষ্টা ও প্রতিপালক তাকে স্মরণ করবেন ও স্মরণ রাখবেন।

৭. কোন কোন আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর যিকির প্রত্যেক বস্তুর মুকাবিলায় গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব রাখে এবং তা এ বিশ্বজগতের সবকিছু থেকে উচ্চতর ও মর্যাদা সম্পন্ন।

وَلَذِكْرُ اللّٰهِ أَكْبَرُ ( عنكبوت ع (٥)

"নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর যিকির প্রত্যেক বস্তু থেকেই উচ্চতর।"
(আনকাবূত রুকূ'-৫)

নিঃসন্দেহে বান্দাহর ভাগ্যে যদি প্রতীতি জুটে তাহলে তার জন্য আল্লাহর যিকির বিশ্বের সবকিছু থেকে উচ্চতর।

৮. কোন কোন আয়াতে অনেক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন আমল প্রসঙ্গে আল্লাহর যিকির করার হিদায়াত করা হয়েছে, যেন যিকরুল্লাহই সে সব আমলের উপসংহার স্বরূপ হয়। যেমন নামায সম্পর্কে বলা হয়েছে:

فَإِذَا قَضَيْتُمُ الصَّلٰوةَ فَاذْكُرُوْا اللّٰهَ قِيَامًا وَقُعُوْدًا وَعَلٰى جُنُوبِكُمْ (النساء ع (١٥)

"ফলে তোমরা যখন সালাত সম্পন্ন করবে, তখন আল্লাহর যিকির করবে দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায় এবং পার্শ্বদেশের উপর শায়িত অবস্থায়।"
(আন্ নিসা: রুকূ-১৫)

এবং বিশেষত জুমার নামায সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে:

فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلٰوةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللّٰهِ وَاذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ. (الجمعة ٤-٢)

যখন জুমার নামায সম্পন্ন করবে, তখন (অনুমতি রয়েছে যে,) তোমরা (মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজেদের কাজকর্ম উপলক্ষে) পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) অনুসন্ধানে লিপ্ত হবে এবং সে অবস্থায়ও আল্লাহর যিকির বহুল পরিমাণে করবে- যাতে করে তোমরা সাফল্যমণ্ডিত হতে পারো।" (জুমুআ রুকু-২)

এবং হজ্জ সম্পর্কে বলা হয়েছে:

فَإِذَا قَضَيْتُمْ مَنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُوا اللّٰهَ كَذِكْرِكُمْ آبَائَكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْرًا . (بقرة ع ٢٥)

"তারপর যখন হজ্জের মানাসিক বা রীতিসমূহ পালন করে ফারেগ হয়ে যাবে তখন আল্লাহর যিকির বা স্মরণ করবে যেমনটি তোমরা (পারস্পরিক বড়াই করতে গিয়ে) তোমাদের পিতৃপুরুষের কথা স্মরণ ও উল্লেখ করে থাকো অথবা তার চাইতে ও বেশি আল্লাহর যিকির করবে।" (বাকারা ২৫তম রুকূ)

উক্ত আয়াতগুলো দ্বারা জানা গেল যে, নামায ও হজ্জের মত উচ্চ দর্জার ইবাদতসমূহ থেকে ফারেগ হওয়ার পরও তার অন্তরে ও রসনায় আল্লাহর যিকির থাকা চাই এবং যিকিরই হবে তার আমলের ইতি স্বরূপ।

৯. কোন কোন আয়াতে যিকরুল্লাহর তাকিদ দেয়া হয়েছে এভাবে যে, বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ব্যক্তি তারাই, যারা আল্লাহর যিকির থেকে গাফিল হয় না। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো, যারা আল্লাহর যিকির থেকে গাফিল হয়, তারা দূরদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত। যেমন সূরা আলে ইমরানের শেষ রুকুতে ইরশাদ করা হয়েছে:

إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لأُولِي الْأَلْبَابِ الَّذِيْنَ يَذْكُرُوْنَ اللّٰهَ قِيَامًا وَقُعُوْدًا وَعَلٰى جُنُوبِهِمْ. ال عمران ع (۲۰)

নিঃসন্দেহে আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং দিন-রাত্রির আবর্তনে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে বুদ্ধিমানদের জন্যে যারা স্মরণ (যিকির) করে আল্লাহকে দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায় এবং তাদের পার্শ্ব দেশে শায়িত অবস্থায়।
(সূরা আলে ইমরান রুকু-২০)

১০. কোন কোন আয়াত থেকে জানা যায় আমল যতই উচ্চ হোক না কেন, তার প্রাণ হচ্ছে যিকরুল্লাহ। যেমন নামায সম্পর্কে বলা হয়েছে:

أقِمِ الصَّلٰوةَ لِذِكْرِى (طه ع (۱)

"আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর।" (সূরা তাহা রুকু-১)

মানাসিকে হজ্জ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন:

إنما جعل الطواف بالبيت والسعي بين الصفا والمروة ورمي الجمار لإقامة ذكر اللّٰه

বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ এবং কঙ্কর নিক্ষেপ- এ সব যিকরুল্লাহর উদ্দেশ্যেই নির্ধারণ করা হয়েছে।

জিহাদ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা'আলার ঘোষণা:

يَأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا لَقِيْتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوْا وَاذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِيْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ . (انفال ع (٦)

“হে ঈমানদারগণ! যখন দুশমনদের সাথে তোমাদের মুকাবিলা হয় তখন তোমরা ধৈর্য-স্থৈর্য অবলম্বন করবে এবং আল্লাহর অধিক যিকির করবে (আল্লাহকে স্মরণ করবে) যাতে করে তোমরা সফলকাম হতে পার।
(আনফাল রুকূ-৬)

একটি হাদীছে কুদসীতে আছে:

إن عبدي كل عبدي الذي يذكرني وهو ملاق قرنه

"আমার বান্দা এবং পূর্ণ বান্দা সে-ই, যে তার শত্রুর সাথে যুদ্ধরত অবস্থায়ও আমাকে স্মরণ করে।"

কুরআন ও হাদীছের এ সুস্পষ্ট বাণীগুলো দ্বারা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হলো যে, সালাত থেকে নিয়ে জিহাদ পর্যন্ত সমস্ত সৎ কর্ম বা আমালে সালেহের প্রাণ হচ্ছে যিকরুল্লাহ বা আল্লাহর যিকির। আর এই যিকির তথা অন্তর ও রসনার দ্বারা আল্লাহর স্মরণই হচ্ছে বেলায়েতের পরওয়ানা স্বরূপ। যে এ পরওয়ানা লাভ করলো, সে সব পেয়েছি-এর পাওয়াটিই পেয়ে গেল আর যে এথেকে বঞ্চিত হলো, সে চিরবঞ্চিত ও পরিত্যক্তই রয়ে গেল। এই যিকরুল্লাহই হচ্ছে আল্লাহওয়ালাদের কালবের খোরাক এবং জীবন ধারণের অবলম্বন। যদি তাই তাদের না জুটে তা হলে তাদের দেহ তাদের কালবের জন্যে কবর স্বরূপ হয়ে যায়। যিকির-এর দ্বারাই হৃদয়ের জগত আবাদ হয়েছে। যিকির বিহনে হৃদয়ের সে জগত বিলকুল বিরান হয়ে যায়। যিকরের অস্ত্র দিয়েই তারা আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রের দস্যু-তস্করদের সাথে যুদ্ধ করে থাকেন। এই যিকিরই তাদের জন্যে শীতল পানি স্বরূপ, যদ্বারা তারা বাতেনের আগুন নির্বাপিত করে থাকেন। এই যিকিরই তাদের ব্যাধির ওষুধ স্বরূপ। এ ওষুধ বিহনে তাদের অন্তর নির্জীব হয়ে যায়। এই যিকিরই তাদের এবং তাদের প্রভু পরোয়ারদিগারের মধ্যকার সেতুবন্ধন স্বরূপ। কী চমৎকারই না বলেছেন কবি:

إِذَا مَرِضْنَا تَدَاوَيْنَا بِذِكْرِكُمْ
فَنْتَرُكُ الذِّكْرَ أَحْيَانًا فَنَتَكَّسُ

যখন আমি হই পীড়িত ওষুধ হলো যিকির তোমার
যখন যিকির দেই কো ছেড়ে নামান্তর তা মরতে বসার।
আল্লাহ তা'আলা যেমন দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন চোখের সৌন্দর্য ও সৌষ্ঠব নিহিত রেখেছেন দৃষ্টি শক্তির মধ্যে, ঠিক তেমনি যিকিরকারী রসনা সমূহের সৌষ্ঠব ও সৌন্দর্যও নিহিত রেখেছেন যিকিরের মধ্যে। সুতরাং আল্লাহ তা'আলার যিকির থেকে গাফেল রসনা দৃষ্টিশক্তি হারা চোখ, শ্রবণশক্তি বঞ্চিত কান এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাতের মতই নিষ্ক্রিয় ও বেকার।

যিকরুল্লাহই সেই একমাত্র খোলা দরজা পথ, যে দরজা দিয়ে বান্দা হক তা'আলা জাল্লা শানুহুর দরবার পর্যন্ত অবলীলাক্রমে পৌঁছে যেতে পারে। আর যখন বান্দা আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল হয়ে যায়, তখন এ দরজাটি বন্ধ হয়ে যায়। কী চমৎকারই না বলেছেন আরবী কবি:

فَنِسْيَانُ ذِكْرِ اللّٰهِ مَوْتُ قُلُوبِهِمْ
وَأَجْسَامُهُمْ قَبْلَ الْقَبُورِ قُبُوْرٌ
وَأَرْوَاحُهُمْ فِيْ وَحْشَةٍ مِّنْ جُسُوْمِهِمْ
وَلَيْسَ لَهُمْ حَتّٰى النُّشُوْرِ نُشُوْرٌ

আল্লাহর যিকির থেকে গাফলতি মৃত্যু তাদের
কবরের আগেই দেহ সাজে যে কবর গহ্বর
দেহ মাঝে হৃদি তখন উসুখস্ করে নিরন্তর
পুনরুত্থান পূর্বে যেন জীবন আর নাই কেহ তাদের।
[মাদারিজুস সালিকীনে লিখিত শায়খ ইবনুল কাইয়েমের বক্তব্যের সার সংক্ষেপ]

এ দীন লেখকের আরয হচ্ছে উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে যিকরুল্লাহর তাকিদ ও উৎসাহ ব্যঞ্জক যে দশটি শিরোনাম বা ধারার বর্ণনা রয়েছে, কুরআন মজীদে এগুলো ছাড়াও অন্যভাবেও যিকরুল্লাহর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে:

অন্তরসমূহ (অর্থাৎ আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা রক্ষাকারী দেল ও রূহসমূহ)
আল্লাহর যিকিরেই প্রশান্তি লাভ করে থাকে:

اَلَا بِذِكْرِ اللّٰهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوْبُ

যিকরুল্লাহর তাছীর ও বরকত সম্পর্কে অপর একজন রব্বানী মুহাক্কিক ও সূফী ترصيع الجواهر المكية এর লেখক-এর কয়েকটি বাক্যের তরজমাও এর সাথে পড়ে নিন, তাহলে এ অধ্যায়ে আলোচিতব্য হাদীছগুলো অনুধাবনে তা বেশ সহায়ক প্রতিপন্ন হবে। তিনি বলেন:
"কালবসমূহকে নূরানী বানানোর ব্যাপারে এবং মন্দ স্বভাবসমূহকে উত্তম স্বভাবে রূপান্তরিত করার ব্যাপারে সমস্ত ইবাদত-বন্দেগীর চাইতে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী হচ্ছে আল্লাহর তা'আলার যিকির।"

স্বয়ং আল্লাহ তা'আলার ইরশাদ:

إِنَّ الصَّلٰوةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللّٰهِ أَكْبَرُ. عنكبوت (٥)

"সালাত নিঃসন্দেহে অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বারণ করে থাকে এবং আল্লাহর যিকির নিশ্চিতভাবেই সর্বশ্রেষ্ঠ।" (আনকাবূত: রুকু-৫)

এবং অন্যান্য বুযুর্গগণ বলেন:
"যিকির অন্তর পরিষ্কার করার ব্যাপারে ঠিক সেরূপ কার্যকর, যেরূপ তামা পরিষ্কার ও ঘষা-মাজার ব্যাপারে বালু অত্যন্ত কার্যকর। আর অন্যান্য আমল এ ব্যাপারে তামা পরিষ্কারে সাবানের মত।" (তারসীউল জাওয়াহিরিল মক্কীয়া)
১. হযরত আবূ হুরায়রা ও আবূ সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: আল্লাহর বান্দারা যখন এবং যেখানে বসেই আল্লাহর যিকির করুক না কেন, তখন সেখানেই ফেরেশতাগণ সর্বদিক থেকে এসে তাদেরকে ঘিরে ফেলেন, রহমত তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে আর তাদের উপর শান্তিধারা নেমে আসে এবং আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাগণের কাছে তাদের কথা উল্লেখ করেন। (সহীহ্ মুসলিম)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ وَأَبِي سَعِيدٍ قَالَا: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يَقْعُدُ قَوْمٌ يَذْكُرُونَ اللهَ إِلَّا حَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَنَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السَّكِينَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ. (رواه ومسلم)
হাদীস নং: ২
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ যিকরুল্লাহর মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব
২. হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। একদা হযরত মুআবিয়া (রা) মসজিদে বসা একটি হলকার কাছে এসে সে হলকায় বসা লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেন: তোমাদেরকে কিসে বসিয়েছে? জবাবে তাঁরা বললেন: আমরা আল্লাহর যিকির করতে বসেছি। হযরত মুআবিয়া (রা) বললেন: আল্লাহর কসম, তোমরা কেবল এ যিকিরের উদ্দেশ্যেই বসেছো- আর কোন উদ্দেশ্য নাই? জবাবে তাঁরা বললেন: আল্লাহর কসম! আল্লাহর যিকির ব্যতীত আমাদের বসার আর কোন উদ্দেশ্য নেই। হযরত মুআবিয়া (রা) বললেন: তোমাদের প্রতি কোন ভুল ধারণার বসে আমি তোমাদেরকে কসম দেইনি। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে আমার যে পরিমাণ ঘনিষ্ঠতা ও নিকট সম্পর্ক, এমন কেউ তাঁর বরাতে আমার চাইতে কম হাদীস বর্ণনাকারী নেই, (অর্থাৎ হাদীস বর্ণনায় আমি সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করে থাকি বিধায় আমার পর্যায়ের অন্যান্যদের তুলনার আমি অনেক কম হাদীস বর্ণনা করে থাকি। এখন আমি তাঁর একটি হাদীস বর্ণনা করছি এবং সে সতর্কতা অবলম্বন করতে গিয়েই তোমাদের নিকট থেকে কসম নিচ্ছি। হাদীসটি হচ্ছে এই যে,) রাসূলুল্লাহ ﷺ একদা তাঁর সাহাবীদের একটি হলকার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন: আপনারা এখানে কেন একত্রিত হয়ে বসেছেন? তাঁরা বললেন: আমরা আল্লাহকে স্মরণ করছি এবং তিনি যে আমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন এবং ঈমান-ইসলামের তাওফীক দিয়ে আমাদেরকে ধন্য করেছেন, সে জন্য আমরা তাঁর স্তুতিবাদ করছি। তিনি বললেন: আল্লাহর কসম, আপনারা কি কেবল এজন্যেই বসেছেন? জবাবে তাঁরা বললেন: আমি আপনাদের প্রতি কোন সন্দেহের বশে কসম দেইনি, বরং আমার কাছে এইমাত্র জিবরাঈল (আ) এসে আমাকে জানালেন যে, আল্লাহ তা'আলা অত্যন্ত গর্বের সাথে ফেরেশতাদের কাছে আপনাদের কথা উল্লেখ করছেন। (সহীহ্ মুসলিম)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ: خَرَجَ مُعَاوِيَةُ عَلَى حَلْقَةٍ فِي الْمَسْجِدِ، فَقَالَ: مَا أَجْلَسَكُمْ؟ قَالُوا: جَلَسْنَا نَذْكُرُ اللهَ، قَالَ آللَّهِ مَا أَجْلَسَكُمْ إِلَّا ذَاكَ؟ قَالُوا: وَاللهِ مَا أَجْلَسَنَا إِلَّا ذَاكَ، قَالَ: أَمَا إِنِّي لَمْ أَسْتَحْلِفْكُمْ تُهْمَةً لَكُمْ، وَمَا كَانَ أَحَدٌ بِمَنْزِلَتِي مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَقَلَّ عَنْهُ حَدِيثًا مِنِّي، وَإِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَرَجَ عَلَى حَلْقَةٍ مِنْ أَصْحَابِهِ، فَقَالَ: «مَا أَجْلَسَكُمْ؟» قَالُوا: جَلَسْنَا نَذْكُرُ اللهَ وَنَحْمَدُهُ عَلَى مَا هَدَانَا لِلْإِسْلَامِ، وَمَنَّ بِهِ عَلَيْنَا، قَالَ: «آللَّهِ مَا أَجْلَسَكُمْ إِلَّا ذَاكَ؟» قَالُوا: وَاللهِ مَا أَجْلَسَنَا إِلَّا ذَاكَ، قَالَ: «أَمَا إِنِّي لَمْ أَسْتَحْلِفْكُمْ تُهْمَةً لَكُمْ، وَلَكِنَّهُ أَتَانِي جِبْرِيلُ فَأَخْبَرَنِي، أَنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يُبَاهِي بِكُمُ الْمَلَائِكَةَ»
হাদীস নং: ৩
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ যিকরুল্লাহর মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব
৩. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: আল্লাহ তা'আলা বলেন: বান্দা যখন আমার যিকির করে এবং তার ওষ্ঠদ্বয় আমার স্মরণে নড়াচড়া করে, তখন আমি তার সাথেই থাকি। (সহীহ বুখারী)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللهَ تَعَالَى يَقُولُ أَنَا مَعَ عَبْدِي إِذَا ذَكَرَنِي، وَتَحَرَّكَتْ بِي شَفَتَاهُ. (رواه البخارى)
হাদীস নং: ৪
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ যিকরুল্লাহর মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব
৪. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আল্লাহ তা'আলা বলেন: বান্দা আমার প্রতি যেরূপ ধারণা পোষণ করে, আমি তার প্রতি সেরূপই করে থাকি। সে যখন আমাকে স্মরণ করে তখন আমি তার একেবারে নিকট সঙ্গী হয়ে যাই, সে যদি মনে মনে আমাকে স্মরণ করে তাহলে আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি। আর সে যদি অন্যদের সম্মুখে অর্থাৎ মজলিসে আমাকে স্মরণ করে, তাহলে আমিও তাকে তার চাইতে উত্তম বান্দাদের মজলিসে স্মরণ করি। অর্থাৎ ফেরেশতাদের সম্মুখে বা তাদের মজলিসে -(সহীহ বুখারী ও সহীহ্ মুসলিম)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى: أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي، فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي، وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلَإٍ ذَكَرْتُهُ فِي مَلَإٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ. (رواه البخارى ومسلم)
হাদীস নং: ৫
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ যিকরুল্লাহর মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব
৫. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এক সফরে মক্কা মুকাররমার দিকে যাচ্ছিলেন। পথে জামদান নামক পাহাড়টি পড়লে তিনি বললেন: এটি জামদান পাহাড়, মুফাররিদগণ বাজীমাত করে ফেললো। লোকজন জিজ্ঞেস করলো, মুফাররিদগণ কারা (ইয়া রাসূলাল্লাহ!)? জবাবে তিনি বললেন: বহুল পরিমাণে আল্লাহর যিকিরকারী পুরুষ ও যিকিরকারী নারীগণ। (সহীহ্ মুসলিম)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَسِيرُ فِي طَرِيقِ مَكَّةَ فَمَرَّ عَلَى جَبَلٍ يُقَالُ لَهُ جُمْدَانُ، فَقَالَ: «سِيرُوا هَذَا جُمْدَانُ سَبَقَ الْمُفَرِّدُونَ» قَالُوا: وَمَا الْمُفَرِّدُونَ؟ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: «الذَّاكِرُونَ اللهَ كَثِيرًا، وَالذَّاكِرَاتُ» (رواه مسلم)
হাদীস নং: ৬
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অন্যান্য আমলের মুকাবিলায় যিকরুল্লাহ উত্তম
৬. হযরত আবূদ্দারদা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: আমি কি তোমাদেরকে এমন আমলের সংবাদ দেবো না, যা তোমাদের সকল আমল থেকে উত্তম, তোমাদের মালিক মনিবের দৃষ্টিতে পবিত্রতম, তোমাদের মর্যাদা সর্বাধিক পর্যায়ে উন্নীতকারী এবং তোমাদের স্বর্ণ-রৌপ্য ব্যয় করার চাইতেও উত্তম এবং এর চাইতেও উত্তম যে, তোমরা তোমাদের শত্রুদের মুখোমুখি হবে এবং তোমরা তাদের গর্দান মারবে আর তারা তোমাদের গর্দান মারবে? তাঁরা বললেন: জ্বী হাঁ, তিনি বললেন: আল্লাহর যিকির। (আহমদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজা)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرِ أَعْمَالِكُمْ، وَأَزْكَاهَا عِنْدَ مَلِيكِكُمْ، وَأَرْفَعِهَا فِي دَرَجَاتِكُمْ وَخَيْرٌ لَكُمْ مِنْ إِنْفَاقِ الذَّهَبِ وَالوَرِقِ، وَخَيْرٌ لَكُمْ مِنْ أَنْ تَلْقَوْا عَدُوَّكُمْ فَتَضْرِبُوا أَعْنَاقَهُمْ وَيَضْرِبُوا أَعْنَاقَكُمْ؟ قَالُوا: بَلَى. قَالَ: ذِكْرُ اللهِ. (رواه احمد والترمذى وابن ماجة)
হাদীস নং: ৭
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অন্যান্য আমলের মুকাবিলায় যিকরুল্লাহ উত্তম
৭. হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করা হলো, বান্দাদের মধ্যে সর্বোত্তম এবং কিয়ামতের দিন সর্বাধিক মর্যাদা সম্পন্ন কে অর্থাৎ কোন আমলকারী হবে? জবাবে তিনি বললেন: আল্লাহকে সর্বাধিক স্মরণকারী বান্দা ও তাঁকে সর্বাধিক স্মরণকারী নারীরা। অর্থাৎ সর্বোত্তম এবং কিয়ামতের দিন সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী এরাই হবে। আরয করা হলো, প্রাণপণ করে যারা আল্লাহর রাহে লড়াই করে, সেই গাজীদের চাইতেও? জবাবে তিনি বললেন: কেউ যদি সত্যের শত্রু কাফির-মুশরিকদের ব্যুহের মধ্যে তলোয়ার সহ ঢুকে পড়ে এবং তার তলোয়ার টুটেও যায় এবং সে শত্রুদের হাতে যখমী হয়ে রক্তাপ্লুতও হয়ে যায়, তবুও আল্লাহর যিকিরকারী বান্দার মর্যাদা তার চাইতে বেশি হবে। (মুসনাদে আহমদ ও জামে তিরমিযী)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُئِلَ أَيُّ العِبَادِ أَفْضَلُ دَرَجَةً عِنْدَ اللهِ يَوْمَ القِيَامَةِ؟ قَالَ: الذَّاكِرُونَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتُ. قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ وَمِنَ الغَازِي فِي سَبِيلِ اللهِ؟ قَالَ: لَوْ ضَرَبَ بِسَيْفِهِ فِي الكُفَّارِ وَالمُشْرِكِينَ حَتَّى يَنْكَسِرَ وَيَخْتَضِبَ دَمًا لَكَانَ الذَّاكِرَ لِلَّهَ كَثِيرًا أَفْضَلَ مِنْهُ دَرَجَةً. (رواه احمد والترمذى)
হাদীস নং: ৮
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অন্যান্য আমলের মুকাবিলায় যিকরুল্লাহ উত্তম
৮. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রায়ই বলতেন: প্রতিটি বস্তুরই শান দেয়ার জন্য রেতের ব্যবস্থা আছে; আর অন্তরসমূহের শানের ব্যবস্থা হচ্ছে আল্লাহর যিকির। আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তিদানের ব্যাপারে আল্লাহর যিকির থেকে অধিকতর কার্যকর আর কিছুই নেই।

সাহাবীগণ বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? জবাবে তিনি বললেন: সেই জিহাদও আল্লাহর আযাব থেকে নাজাত প্রাপ্তির ব্যাপারে বেশি সহায়ক ও কার্যকর নয়, যার আমলকারী মুজাহিদ প্রাণান্তকর জিহাদ করে, এমন কি যুদ্ধের প্রচণ্ডতায় তার তলোয়ার ভেঙ্গেচুরে যায়। (বায়হাকীর দাওয়াতে কবীর)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ: «إِنَّ لِكُلِّ شَيْءٍ صِقَالَةً، وَإِنَّ صِقَالَةَ الْقُلُوبِ ذِكْرُ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَمَا مِنْ شَىْءٍ أَنْجَى مِنْ عَذَابِ اللَّهِ مِنْ ذِكْرِ اللَّهِ " قَالُوا: وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ؟ قَالَ: «وَلَا الْجِهَادُ، إِلَّا أَنْ يَضْرِبَ بِسَيْفِهِ حَتَّى يَنْقَطِعَ» (رواه البيهقى فى الدعوات الكبير)
হাদীস নং: ৯
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ রসনার যিকিরের ফযীলত
৯. হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন বুসর (রা) থেকে বর্ণিত। জনৈক বেদুইন সাহাবী রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম কে? (অর্থাৎ কোন্ ধরনের লোকের পরিণাম সর্বোত্তম হবে?) জবাবে তিনি বললেন: যার আয়ু দীর্ঘ ও আমল উত্তম। তারপর প্রশ্নকারী জিজ্ঞেস করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! সর্বোত্তম আমল কোনটি? জবাবে তিনি বললেন: তুমি এমন অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় হবে যে, তোমার রসনা আল্লাহর যিকিরে সিক্ত থাকবে। (মুসনাদে আহমদ ও জামে তিরমিযী)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُسْرٍ قَالَ: جَاءَ أَعْرَابِيٌّ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: أَيُّ النَّاسِ خَيْرٌ، فَقَالَ: طوبى لمن مَنْ طَالَ عُمُرُهُ، وَحَسُنَ عَمَلُهُ، قَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ أَيُّ الْأَعْمَالِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «أَنْ تُفَارِقَ الدُّنْيَا وَلِسَانُكَ رَطْبٌ مِنْ ذِكْرِ اللهِ. (رواه احمد والترمذى)
হাদীস নং: ১০
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ রসনার যিকিরের ফযীলত
১০. হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন বুসর (রা) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর খিদমতে আরয করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নেকীর দরজা তো অনেক (অর্থাৎ পুণ্য কাজের তো কোন শেষ নেই) আর এটা আমার সাধ্যে কুলাবে না যে, এর সবগুলোই আমি লাভ করবো। সুতরাং আপনি আমাকে এমন কোন একটি ব্যাপার শিখিয়ে দিন, যা আমি শক্তভাবে ধারণ করবো (আর আমার জন্যে যথেষ্ট প্রতিপন্ন হবে)। আর আপনি যা শিখাবেন তা যেন খুব বেশি না হয়। কেননা, তা আমার ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: তাহলে (তুমি সর্বপ্রথমে সচেষ্ট থাকবে যেন) তোমার রসনা সর্বদা আল্লাহর যিকির দ্বারা সিক্ত থাকে। - (জামে তিরমিযী)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُسْرٍ، أَنَّ رَجُلاً قَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّ اَبْوَابَ الْخَيْرِ كَثِيْرَةٌ وَلَا اَسْتَطِيْعُ الْقِيَامَ بِكُلِّهَا فَأَخْبِرْنِي عَنْ شَيْءٍ أَتَشَبَّثُ بِهِ، وَلَا تُكْثِرْ عَلَىَّ فَاَنْسَى قَالَ: لاَ يَزَالُ لِسَانُكَ رَطْبًا مِنْ ذِكْرِ اللَّهِ. (رواه الترمذى)
হাদীস নং: ১১
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ রসনার যিকিরের ফযীলত
১১. হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহর যিকির এত বেশি পরিমাণে কর, যাতে লোকে পাগল বলে। - (মুসনাদে আহমদ)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَكْثِرُوا ذِكْرَ اللَّهِ حَتَّى يَقُولُوا مَجْنُونٌ. (رواه احمد وابو يعلى)
হাদীস নং: ১২
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল থাকার পরিণাম: বঞ্চনা ও হৃদয় শক্ত হয়ে যাওয়া
১২. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: যে ব্যক্তি কোথাও বসলো এবং সে বসার মধ্যে সে আল্লাহকে স্মরণ করলো না, তাহলে সে বসাটা তার জন্যে আফসোস ও ক্ষতির কারণ হবে। আর যে ব্যক্তি কোথাও শয়ন করলো আর সে শয়নে সে আল্লাহকে স্মরণ করলো না তা হলে এ শয়ন তার জন্যে আফসোস ও ক্ষতির কারণ হবে। (সুনানে আবু দাউদ)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ قَعَدَ مَقْعَدًا لَمْ يَذْكُرِ اللَّهَ فِيهِ كَانَتْ عَلَيْهِ مِنَ اللَّهِ تِرَةٌ، وَمَنْ اضْطَجَعَ مَضْجَعًا، لَا يَذْكُرُ اللَّهَ فِيهِ كَانَتْ عَلَيْهِ مِنَ اللَّهِ تِرَةٌ. (رواه ابوداؤد)
tahqiq

তাহকীক:

হাদীস নং: ১৩
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল থাকার পরিণাম: বঞ্চনা ও হৃদয় শক্ত হয়ে যাওয়া
১৩. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: আল্লাহর যিকির ব্যতীত অধিক বাক্যালাপ করো না। কেননা আল্লাহর যিকির ব্যতীত অধিক বাক্যালাপে হৃদয় শক্ত হয়ে যায় (অনুভব শক্তি হ্রাস পায়) এবং লোকজনের মধ্যে সে-ই আল্লাহর থেকে অধিকতর দূরবর্তী, যার হৃদয় শক্ত। (জামে তিরমিযী)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لاَ تُكْثِرُوا الكَلاَمَ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللهِ فَإِنَّ كَثْرَةَ الكَلاَمِ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللهِ قَسْوَةٌ لِلْقَلْبِ، وَإِنَّ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنَ اللهِ القَلْبُ القَاسِي. (رواه الترمذى)
হাদীস নং: ১৪
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ যিকিরের কালেমাসমূহ: সেগুলোর বরকত-ফযীলত

রাসূলুল্লাহ ﷺ যেভাবে যিকিরের উৎসাহ ও তাগিদ দিয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে তিনি তার বিশেষ বিশেষ কালিমাও শিক্ষা দিয়েছেন। তা না হলে এ আশঙ্কা পুরো মাত্রায় বিদ্যমান থাকতো যে, ইলম ও মা'রিফতের অভাবে অনেকে আল্লাহর যিকির এমনভাবে করতো, যা তাঁর শানের সাথে সামঞ্জস্যশীল হতো না। অথবা তাতে তাঁর স্তুতিবাদ না হয়ে বরং তাঁর অমর্যাদাই হতো। আরিফ রুমী তাঁর মছনবীতে হযরত মূসা (আ) ও জনৈক রাখালের যে কাহিনী বর্ণনা করেছেন, তাই এর একটি উদাহরণ।

রাসূলুল্লাহ ﷺ যিকিরের যে সব কালিমা শিক্ষা দিয়েছেন, তা অর্থের দিক থেকে নিম্নে বর্ণিত কোন না কোন প্রকারের:

১. আল্লাহ তা'আলার পবিত্রতার বর্ণনামূলক কালিমা- অর্থাৎ যে কালিমাসমূহের দ্বারা সমস্ত দোষ ও অপূর্ণতা থেকে আল্লাহ তা'আলার পবিত্র থাকার কথা বুঝানো হয়েছে। سُبْحَانَ اللّٰهِ (সুবহানাল্লাহ) বলতে ঠিক এ অর্থটিই বুঝানো হয়েছে। (অর্থাৎ এর মর্মার্থ হচ্ছে সমস্ত পূর্ণতা ও কৃতিত্ব আল্লাহ তা'আলার)।

২. তাতে আল্লাহ তা'আলার হামদ বা স্তুতিবাদ থাকবে (অর্থাৎ হামদ ও ছানা তথা স্তুতিবাদ তাঁরই জন্যে শোভা পায়।) اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ (আলহামদুলিল্লাহ)-এরও ঐ একই বৈশিষ্ট্য।

৩. তাতে আল্লাহ তা'আলার তাওহীদ বা একত্ববাদের শানের বর্ণনা থাকবে। لَا اِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ এর শান তাই।

৪. আল্লাহ তা'আলার সেই উচ্চ মর্যাদার বর্ণনা তাতে থাকবে যে, আমরা ইতিবাচক ও নেতিবাচকভাবে তাঁর সম্পর্কে যা কিছু জেনেছি বুঝেছি, তিনি তারও অনেক ঊর্ধ্বে। اللّٰهُ أَكْبَرُ (আল্লাহু আকবার)-এর মর্মার্থ এটাই।

৫. সে সব কালিমার মধ্যে এ সত্যের বহিঃপ্রকাশ থাকব যে, সবকিছু করার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা'আলা। তাঁর হাতেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। তিনি ছাড়া আর কারো হাতে কোন ক্ষমতা নেই। সুতরাং তিনিই একথার হকদার যে, আমরা সর্বাবস্থায় তারই সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তাঁরই উপর ভরসা করি। لَاَ حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللّٰهِ এর তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্য তা-ই।

এ জাতীয় যিকিরের কালিমাসমূহ ছাড়াও বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দু'আ নবী করীম ﷺ শিক্ষা দিয়েছেন। পরবর্তীতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা হবে ইনশাআল্লাহ।

পরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহে উক্ত হাদীসসমূহে যিকিরের যে সমস্ত কালিমা রাসূলুল্লাহ ﷺ শিক্ষা দিয়েছেন, অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা'আলার পবিত্রতা বর্ণনা ও মাহাত্ম্য ঘোষণার প্রেক্ষিতে এগুলো অবশ্য মু'জেযা স্থানীয়। এগুলোতে আল্লাহ তা'আলার পবিত্রতা, প্রশংসা, একত্ববাদ এবং তাঁর কিবরিয়াই ও সমদিয়তের এমন চমৎকার বর্ণনা রয়েছে যে, এগুলো যেন তাঁর মা'রিফতের তোরণদ্বার স্বরূপ।

এ সংক্ষিপ্ত ভূমিকা বর্ণনার পর এ সংক্রান্ত রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কতিপয় বাণী নিম্নে পাঠ করুন।
১৪. হযরত সামুরা ইব্‌ন জুনদুব (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
চারটি কালিমা সর্বোত্তম:
১. সুবহানাল্লাহ ২. আলহামদুলিল্লাহ ৩. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ৪. আল্লাহু আকবর। (সহীহ্ মুসলিম)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ سَمُرَةَ بْنِ جُنْدَبٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَفْضَلُ الْكَلَامِ أَرْبَعٌ سُبْحَانَ اللَّهِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ. (رواه مسلم)
হাদীস নং: ১৫
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ যিকিরের কালেমাসমূহ: সেগুলোর বরকত-ফযীলত
১৫. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: এ পৃথিবীর যত কিছুর উপর সূর্যালোক পতিত হয়ে থাকে, সে সবের তুলনায় আমার নিকট প্রিয়তর হচ্ছে আমি একবার বলি: সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইলাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর। -(মুসলিম)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَأَنْ أَقُولَ سُبْحَانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا طَلَعَتْ عَلَيْهِ الشَّمْسُ» (رواه مسلم)
হাদীস নং: ১৬
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ যিকিরের কালেমাসমূহ: সেগুলোর বরকত-ফযীলত
১৬. হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ একদা এমন একটি বৃক্ষের নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, যার পাতাগুলো ছিল শুকনো। তিনি বৃক্ষের উপর লাঠি দ্বারা আঘাত করলে তার শুকনো পাতাগুলো ঝরে পড়লো। তখন তিনি বললেন: নিঃসন্দেহে আলহামদু লিল্লাহ সুবহানাল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ও আল্লাহু আকবর বান্দার গুনাহরাশিকে এভাবে ঝরিয়ে দেয়, যেভাবে তোমরা এ গাছের পাতাগুলো ঝরে পড়তে দেখতে পেলে। -(জামে তিরমিযী)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَنَسٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ عَلَى شَجَرَةٍ يَابِسَةِ الوَرَقِ فَضَرَبَهَا بِعَصَاهُ فَتَنَاثَرَ الوَرَقُ، فَقَالَ: إِنَّ الحَمْدُ لِلَّهِ وَسُبْحَانَ اللهِ وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ لَتُسَاقِطُ مِنْ ذُنُوبِ العَبْدِ كَمَا تَسَاقَطَ وَرَقُ هَذِهِ الشَّجَرَةِ. (رواه الترمذى)
হাদীস নং: ১৭
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ যিকিরের কালেমাসমূহ: সেগুলোর বরকত-ফযীলত
১৭. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: যে ব্যক্তি দৈনিক ১০০ বার সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী বলবে, তার গুনাহরাশি মোচন করে দেয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনারাশির মত অধিকও হয়ে থাকে। -(সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ قَالَ: سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ، فِي يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ، حُطَّتْ خَطَايَاهُ، وَإِنْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ البَحْرِ " (رواه البخارى ومسلم)
হাদীস নং: ১৮
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ যিকিরের কালেমাসমূহ: সেগুলোর বরকত-ফযীলত
১৮. হযরত আবু যর গেফারী (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে প্রশ্ন করা হলো: সর্বোত্তম কথা কোনটি? জবাবে বললেন: সেই কথাটি, যা আল্লাহ তা'আলা তাঁর ফেরেশতাকূলের জন্যে নির্বাচিত করেছেন- সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী। (সহীহ্ মুসলিম)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي ذَرٍّ قَالَ: سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ الْكَلَامِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: " مَا اصْطَفَى اللهُ لِمَلَائِكَتِهِ: سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ " (رواه مسلم)
হাদীস নং: ১৯
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ যিকিরের কালেমাসমূহ: সেগুলোর বরকত-ফযীলত
১৯. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: দু'টি কালিমা রসনার জন্যে (উচ্চারণে) হাল্কা, আমলনামা ওযনের পাল্লায় ভারী, পরম দয়ালু আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয়, তা হলো: ১. সুবহানাল্লাহি ও বিহামদিহী ২. সুবহানাল্লাহিল আযীম। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " كَلِمَتَانِ خَفِيفَتَانِ عَلَى اللِّسَانِ، ثَقِيلَتَانِ فِي المِيزَانِ، حَبِيبَتَانِ إِلَى الرَّحْمَنِ: سُبْحَانَ اللَّهِ العَظِيمِ، سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ " (رواه البخارى ومسلم)
হাদীস নং: ২০
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ যিকিরের কালেমাসমূহ: সেগুলোর বরকত-ফযীলত
২০. উম্মুল মু'মিনীন হযরত জুয়াইরিয়া (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ একদা ফজরের সালাতান্তে তাঁর নিকট থেকে বেরিয়ে যান। তিনি তখন তাঁর সালাতের স্থানে বসে কিছু পড়ছিলেন। তারপর দীর্ঘক্ষণ পর চাশতের সময় হলে তিনি ফিরে আসলেন, তখনো তিনি পূর্ববৎ ওযীফা পাঠরত ছিলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন: আমি যখন তোমার নিকট থেকে উঠে গিয়েছি তখন থেকেই কি একই অবস্থায় এক নাগাড়ে তুমি বসে রয়েছ? জবাবে তিনি বললেন: জ্বী হাঁ।

তখন নবী করীম ﷺ বললেন: তোমার নিকট থেকে যাওয়ার পর আমি তিনটি কালিমা চারবার পড়েছি। তুমি দিন ভর যা পড়েছো, তার সাথে এর ওজন করলে তার ওজন তা থেকে ভারী হবে।

সে কালিমাগুলো হচ্ছে:
১. সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী ২. আদাদা খালকিহী ৩. ও যিনাতা আরশিহী ৪. ও রিযা নাফসিহী ৫. ও মিদাদা কালিমাতিহী।
অর্থাৎ ১. আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা ও প্রশংসা করছি তাঁর সৃষ্টির সংখ্যা অনুপাতে ২. তাঁর আরশের ওজন অনুপাতে ৩. তাঁর সত্তার সন্তুষ্টি অনুযায়ী এবং তাঁর কালিমার সংখ্যা অনুপাতে।" (মুসলিম)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ جُوَيْرِيَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَرَجَ مِنْ عِنْدِهَا بُكْرَةً حِينَ صَلَّى الصُّبْحَ، وَهِيَ فِي مَسْجِدِهَا، ثُمَّ رَجَعَ بَعْدَ أَنْ أَضْحَى، وَهِيَ جَالِسَةٌ، فَقَالَ: «مَا زِلْتِ عَلَى الْحَالِ الَّتِي فَارَقْتُكِ عَلَيْهَا؟» قَالَتْ: نَعَمْ، قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " لَقَدْ قُلْتُ بَعْدَكِ أَرْبَعَ كَلِمَاتٍ، ثَلَاثَ مَرَّاتٍ، لَوْ وُزِنَتْ بِمَا قُلْتِ مُنْذُ الْيَوْمِ لَوَزَنَتْهُنَّ: سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ، عَدَدَ خَلْقِهِ وَرِضَا نَفْسِهِ وَزِنَةَ عَرْشِهِ وَمِدَادَ كَلِمَاتِهِ " (رواه مسلم)