রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين

ভূমিকা অধ্যায় - এর পরিচ্ছেদসমূহ

মোট হাদীস ৬৭৯ টি

হাদীস নং: ৫৬১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৬০ উদারতা ও দানশীলতা প্রসঙ্গ এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে কল্যাণকর খাতসমূহে অর্থব্যয় করার ফযীলত
আল্লাহর পথে খরচকারীর জন্য অলৌকিক সাহায্য
হাদীছ নং: ৫৬১

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, এক ব্যক্তি মরুভূমির উপর দিয়ে চলছিল। এ অবস্থায় সে একখণ্ড মেঘের মধ্যে আওয়াজ শুনতে পেল- অমুকের বাগানে পানি সিঞ্চন করো। মেঘখণ্ডটি সেখান থেকে সরে গেল। তারপর তার পানি একখণ্ড পাথুরে ভূমিতে ঢেলে দিল। সেই পানির সবটা (ওই বাগানের) নালাসমূহের মধ্য থেকে একটি নালা ধারণ করল। লোকটি ওই পানির অনুসরণ করল। হঠাৎ দেখতে পেল এক ব্যক্তি তার বাগানে দাঁড়িয়ে আছে, যে নিজ বেলচা দিয়ে সেই পানি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে। লোকটি তাকে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আপনার নাম কী? সে বলল, অমুক, লোকটি মেঘের মধ্যে যে নাম শুনেছিল। সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আপনি আমার কাছে আমার নাম জানতে চাচ্ছেন কেন? লোকটি বলল, যেই মেঘ থেকে এই পানি বর্ষিত হয়েছে তাতে আমি আওয়াজ শুনেছি যে, কেউ আপনার নাম নিয়ে বলছে, অমুকের বাগানে পানি সিঞ্চন করো। তা আপনি এ বাগানে কী করেন? সে বলল, আপনি যখন জানতে চাইলেন তখন বলছি, আমি লক্ষ করি এ বাগানে কী উৎপন্ন হয়। তারপর তার তিনভাগের একভাগ দান করি। তিনভাগের একভাগ আমি ও আমার পরিবারবর্গ খাই। আর তিনভাগের একভাগ এ বাগানে ফিরিয়ে দিই (অর্থাৎ বপন করি)। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম : ২৯৮৪; মুসনাদে আহমাদ: ৭৯৪১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৩৩৫৫; বায়হাকী, আস সনানল কবরা : ৭৫১২; শু'আবুল ঈমান : ৩১৩৪)
مقدمة الامام النووي
60 - باب الكرم والجود والإنفاق في وجوه الخير ثقةً بالله تعالى
561 - وعنه، عن النبيِّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «بَيْنَمَا رَجُلٌ يَمْشِي بِفَلاَةٍ مِنَ الأَرْضِ، فَسَمِعَ صَوْتًا في سَحَابَةٍ، اسقِ حَدِيقَةَ فُلانٍ، فَتَنَحَّى ذَلِكَ السَّحَابُ فَأَفْرَغَ مَاءَهُ فِي حَرَّةٍ، فإِذَا شَرْجَةٌ مِنْ تِلْكَ الشِّرَاجِ قَدِ اسْتَوْعَبَت ذَلِكَ الماءَ كُلَّهُ، فَتَتَبَّعَ المَاءَ، فإذَا رَجُلٌ قَائمٌ في حَدِيقَتِهِ يُحَوِّلُ الماءَ بِمسَحَاتِهِ، فَقَالَ لَهُ: يَا عَبْدَ اللهِ، ما اسمُكَ؟ قال: فُلانٌ للاسم الذي سَمِعَ في السَّحابةِ، فقال له: يا عبدَ الله، لِمَ تَسْألُنِي عَنِ اسْمِي؟ فَقَالَ: إنِّي سَمِعْتُ صَوْتًا في السَّحابِ الَّذِي هَذَا مَاؤُهُ، يقولُ: اسْقِ حَدِيقَةَ فُلاَنٍ لاسمِكَ، فَمَا تَصْنَعُ فِيهَا، فَقَالَ: أمَا إذ قلتَ هَذَا، فَإنِّي أَنْظُرُ إِلَى مَا يَخْرُجُ مِنْهَا، فَأَتَصَدَّقُ بِثُلُثِهِ، وَآكُلُ أنَا وَعِيَالِي ثُلُثًا، وَأَردُّ فِيهَا ثُلُثَهُ». رواه مسلم. (1) [ص:190]
«الحَرَّةُ» الأَرْضُ المُلَبَّسَةُ حِجَارَةً سَوْدَاءَ. وَ «الشَّرْجَةُ» بفتح الشين المعجمة وإسكان الراءِ وبالجيم: هي مَسِيلُ الماءِ.
হাদীস নং: ৫৬২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ কৃপণতা ও লোভ-লালসার প্রতি নিষেধাজ্ঞা
بخل ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি البُخْلُ থেকে। এর অর্থ কৃপণতা করা। শরী'আতের পরিভাষায় আবশ্যিক ক্ষেত্রে অর্থব্যয় করা হতে বিরত থাকাকে البُخْلُ বা কৃপণতা বলা হয়। যে ব্যক্তি অর্থসাহায্য প্রার্থনা করে, উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে তাকে কিছু না দিয়ে খালিহাতে ফেরানোর ক্ষেত্রেও এ শব্দের ব্যবহার আছে। যে ব্যক্তি কৃপণতা করে, আরবীতে তাকে البخيل বলে। বাংলায়ও 'বখিল' শব্দটি চালু আছে। আরবীতে এর পাশাপাশি আরেকটি শব্দ হচ্ছে الشح । এ শব্দটি ব্যবহার হয় অতিরিক্ত কৃপণতার ক্ষেত্রে। কারও কারও মতে কৃপণতার সঙ্গে যদি লোভও থাকে, তবে সেই ক্ষেত্রে الشح শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কারও মতে البُخْلُ ব্যবহৃত হয় অর্থ-সম্পদে কৃপণতার ক্ষেত্রে, আর الشح ব্যবহৃত হয় অর্থ-সম্পদ ও অন্যান্য বিষয়ে কৃপণতার ক্ষেত্রে। আবার কেউ এমনও বলেছেন যে, নিজের কাছে যা নেই, তাতে লোভ করাকে الشح বলা হয়। আর নিজের কাছে যা আছে, লোভের বশবর্তীতে তাতে কৃপণতা করা হচ্ছে الشح।
কৃপণতা ও লোভ-লালসা মানুষের আত্মিক ব্যাধি। এ ব্যাধি মানুষকে নানাবিধ পাপে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে। এর ফলে মানুষ স্বার্থান্ধ হয়ে যায়। এ ব্যাধি যার অন্তরে আছে, সে তার কাছে অন্যের যে অধিকার আছে তা তো আদায় করেই না, উল্টো ছলেবলে অন্যের অধিকার হরণ করে নেয়। তার দ্বারা আল্লাহর হকও আদায় করা হয় না এবং বান্দার হকও নয়। এরূপ ব্যক্তি একদিক থেকে ছাওয়াবের কাজ করতে সক্ষম হয় না, অন্যদিক থেকে পাপের বোঝা বাড়াতে থাকে। এ ব্যাধি যার অন্তরে আছে, সে কখনও মানুষের দুঃখ মোচন করতে পারে না; বরং অন্যের কষ্টই বাড়ায়। আর এতে করে সে কখনও মানুষের আপন হতে পারে না; তার কেবল শত্রুসংখ্যাই বাড়ে। এমনকি এরূপ লোক নিজ পরিবারের পক্ষেও প্রীতিকর হয় না। সে হয় না নিজের পক্ষেও শান্তিদায়ী। সে তার দুনিয়া ও আখিরাত সবই হারায়।
প্রকৃতপক্ষে কৃপণতা ইসলামের মর্মবাণীরই পরিপন্থী। ইসলাম অর্থ নিজের জান ও মাল আল্লাহ তা'আলার জন্য নিবেদন করা। কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নিজের জান কী উৎসর্গ করবে, মালই তো উৎসর্গ করতে পারে না। ফলে তার অন্তরে ঈমান ও ইসলামের আবেদন দুর্বল হয়ে পড়ে।
‘প্রকৃত মুসলিম জান-মালের বিষয়ে নিজ ক্ষমতা ও সামর্থের উপর নয়; বরং আল্লাহ তা'আলার উপরই নির্ভরশীল থাকে। কিন্তু কৃপণ ব্যক্তির নির্ভরতা থাকে নিজ সামর্থ্যের উপর। কেমন যেন আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে তার অন্তরে এই কুধারণা সক্রিয় থাকে যে, তাঁর পথে দান-খয়রাত করলে তিনি তার সম্পদ কমিয়ে দেবেন। তাই সে দান করতে পারে না। এজন্যই বলা হয়, কৃপণতা ব্যক্তির ইসলামকে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত করে, অতটা ক্ষতিগ্রস্ত আর কোনওকিছুই করতে পারে না। তাই কৃপণতার সবটাই মন্দ, যেমন বদান্যতার সবটাই উৎকৃষ্ট। হযরত আলী রাযি. বলেন- 'কৃপণতা সর্বপ্রকার দোষের সমষ্টি। এটা এমন এক লাগাম, যা দ্বারা সকল মন্দের দিকে টেনে নেওয়া হয়।'
বস্তুত কৃপণতা ও লোভ-লালসা মানুষের স্বভাবগত বিষয়। সেই হিসেবে অন্তরে এ রিপু থাকাটা স্বাভাবিক এবং থাকাটা দোষের নয়; দোষ হল এর চর্চা করা অর্থাৎ কাজে কর্মে কৃপণতা প্রকাশ করা এবং লোভের বশবর্তী হয়ে কোনও কাজ করা। অন্তরে কৃপণতা ও লোভ প্রবল হলে সে অনুযায়ী সাধারণত কাজও করা হয়। তাই প্রয়োজন এ ব্যাধির চিকিৎসা এবং এ ব্যাধি যাতে প্রবল হয়ে উঠতে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা যদি জানতে পারি এটা কত খারাপ রোগ এবং এর ফলে কত কঠিন কঠিন পাপ হয়ে যায়, তবেই আমাদের পক্ষে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। তাই কুরআন ও হাদীছে বারবার এ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে এবং এর ক্ষতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
الَّذِينَ يَبْخَلُونَ وَيَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ وَيَكْتُمُونَ مَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ ۗ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا (37)
‘যারা নিজেরা কৃপণতা করে এবং মানুষকেও কৃপণতার নির্দেশ দেয়, আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহ হতে তাদের যা দান করেছেন তা গোপন করে, আমি (এরূপ) অকৃতজ্ঞদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।(সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩৭)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَأَيُّ دَاء أَدْوَأُ مِنَ البُخْلِ؟
‘কৃপণতার চেয়ে কঠিন রোগ আর কী আছে'?(সহীহ বুখারী: ৪৩৮২; মুসনাদে আহমাদ: ১৪৩০১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ২৬৬১০: তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৬৩; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৫৪)
অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ خِبُّ وَلَا مَنَّانٌ وَلَا بَخِيْلٌ
‘প্রতারক, খোঁটাদাতা ও কৃপণ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।(জামে' তিরমিযী: ১৯৬৩; মুসনাদে আহমাদ: ১৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৯৫; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ১৭৩; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৩৬৪; ফাওয়াইদু তাম্মাম: ১৭৬)
আরও এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
السَّخِيُّ قَرِيبٌ مِنَ اللهِ، بَعِيدٌ مِنَ النَّارِ، قَرِيبٌ مِنَ الْجَنَّةِ، قَرِيبٌ مِنَ النَّاسِ، وَالْبَخِيلُ بَعِيدٌ مِنَ اللَّهِ ، بَعِيدٌ مِنَ الْجَنَّةِ، بَعِيدٌ مِنَ النَّاسِ، قَرِيبٌ مِنَ النَّارِ، وَالْجَاهِلُ السَّخِيُّ أَحَبُّ إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنَ الْعَابِدِ الْبَخِيْلِ
‘দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী, জাহান্নাম থেকে দূরবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী এবং মানুষেরও নিকটবর্তী। আর কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহর থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে এবং মানুষের থেকেও দূরে, কিন্তু জাহান্নামের কাছে। অজ্ঞ দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকট কৃপণ আবেদ অপেক্ষা প্রিয়।(তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ২৩৬৩; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ৩৬০; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৩৫২; ফাওয়াইদু তাম্মাম: ২৮৪
قال الإمام أبو حاتم: هذا حديث باطل، وسعيد (بن مسلمة الراوي عن يحي بن سعيد) ضعيف الحديث، أخاف أن يكون أدخل له. (علل ابن أبي حاتم ٩٧/٦ (٣٢٥٢). وقال أيضا (٢٣٥٣) هذا حديث منكر فيه سعيد بن محمد الوراق. (الراوي عن يحي بن سعيد) قال الدارقطني متروك. قال العقيلي : ليس لهذا الحديث أصل من حديث يحي ولا غيره..)
এটা এমনই এক কঠিন ব্যাধি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রীতিমতো এর থেকে আল্লাহ তা'আলার কাছে পানাহ চাইতেন। তাঁর থেকে দু'আ বর্ণিত আছে-
اللَّهمَّ إنِّي أعوذُ بِكَ منَ البُخلِ ، وأعوذُ بِكَ منَ الجُبنِ وأعوذُ بِكَ أن أَرَدَّ إلى أرذلِ العمرِ ، وأعوذُ بِكَ مِن فتنةِ الدُّنيا ، وأعوذُ بِكَ مِن عذابِ القبرِ
‘হে আল্লাহ! আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি কৃপণতা হতে। আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি ভীরুতা হতে। আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি জরাজীর্ণ হয়ে যাওয়া বার্ধক্য হতে। আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি দুনিয়ার ফিতনা হতে এবং আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি কবরের আযাব হতে।’(সহীহ বুখারী: ৬৩৬৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ২৯১৩০; মুসনাদে আহমাদ: ১৫৮৪; সহীহ মুসলিম: ২৭০৬; সুনানে আবু দাউদ: ৩৯৭২; জামে' তিরমিযী: ৩৫৬৭; সুনানে নাসাঈ : ৫৪৪৫; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৭১৬; সহীহ ইবন খুযায়মা : ৭৪৬; সহীহ ইবন হিব্বান : ১০০৪)
ইমাম নাওয়াবী রহ. এ অধ্যায়ে কৃপণতা ও লোভ-লালসা সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি।

‘কৃপণতা ও লোভ-লালসা করার প্রতি নিষেধাজ্ঞা’ সম্পর্কিত দু’টি আয়াত

এক নং আয়াত
وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى (8) وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى (9) فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى (10) وَمَا يُغْنِي عَنْهُ مَالُهُ إِذَا تَرَدَّى (11)
অর্থ: পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করল এবং (আল্লাহর প্রতি) বেপরোয়াভাব দেখাল এবং সর্বোত্তম বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করল, আমি তার যাতনাময় স্থানে পৌছার ব্যবস্থা করে দেব। সে যখন ধ্বংস-গহ্বরে পতিত হবে, তখন তার সম্পদ তার কোনও কাজে আসবে না।
(সূরা লায়ল (৯২), আয়াত ৮-১১
‘যাতনাময় স্থানে’ পৌছার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অর্থ যেসব গুনাহ করলে জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যায়, সেগুলো করার অবকাশ দেওয়া এবং সৎকাজের তাওফীক না দেওয়া।
প্রকাশ থাকে যে, কুরআন মাজীদে ব্যবহৃত نُيَسِّرُهُ শব্দের অর্থ যে করা হয়েছে ‘ব্যবস্থা করে দেওয়া’, তা করা হয়েছে আল্লামা আলুসী (রহ.)-এর ব্যাখ্যার অনুসরণে। দেখুন (রহুল মাআনী, ৩০ : ৫১২)। -তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন থেকে সংগৃহীত।)

ব্যাখ্যা
এখানে সূরা লায়লের পাশাপাশি চারটি আয়াত উদ্ধৃত করা হয়েছে। এ আয়াতসমূহে যে ব্যক্তির মধ্যে তিনটি খাসলাত পাওয়া যায়, তার অশুভ পরিণাম বর্ণিত হয়েছে। প্রথম আয়াত হচ্ছে- وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى ‘পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করল এবং (আল্লাহর প্রতি) বেপরোয়াভাব দেখাল'। এ আয়াতে দু'টি খাসলাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হল কৃপণতা, আরেকটি হল আল্লাহর প্রতি বেপরোয়াভাব। বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কৃপণতা করে অর্থাৎ কল্যাণকর খাতে অর্থব্যয় করা হতে বিরত থাকে, যেসকল ক্ষেত্রে ব্যয় করা অবশ্যকর্তব্য ছিল তাতে ব্যয় করে না, আর তা না করার কারণ কেবল আল্লাহ তা'আলার প্রতি বেপরোয়াভাব। অর্থাৎ তার লক্ষ্যবস্তু শুধুই দুনিয়ার অর্থবিত্ত। সে অর্থবিত্ত অর্জিত হয়ে যাওয়ায় নিজেকে সফল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে। তাই আখিরাতের ছাওয়াব ও প্রতিদান লাভের কোনও ইচ্ছা সে করে না। আর তা করে না বলে সর্বশক্তিমান ও মহান আল্লাহর সামনে সে নতিস্বীকার করে না এবং তাঁর আদেশ- নিষেধের কোনও তোয়াক্কা করে না।
দ্বিতীয় আয়াত হল- وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى (এবং সর্বোত্তম বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করল)। এটা তৃতীয় খাসলাত। الْحُسْنی-এর অর্থ সর্বোত্তম বিষয়। এর দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য,তা নিয়ে তাফসীরকারকদের মধ্যে সামান্য মতভিন্নতা আছে। কেউ বলেন এর দ্বারা কালেমা তায়্যিবা বোঝানো হয়েছে। কারও মতে বোঝানো হয়েছে জান্নাত। কেউ বলেন কাখিরাতের প্রতিদান। তবে সবগুলোই কাছাকাছি। কেননা কালেমা পাঠ ও দাবি অনুযায়ী চলার দ্বারা আখিরাতের প্রতিদান মেলে। আর আখিরাতের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। সুতরাং আয়াতটির মর্মার্থ দাঁড়ায়- যে ব্যক্তি কালেমা তায়্যিবা তথা আল্লাহ তা'আলা মানুষের কল্যাণার্থে যে দীন ও শরী'আত প্রদান করেছেন তার প্রতি কোনও বিশ্বাস রাখে না, আখিরাতের প্রতিদানকে সত্য বলে স্বীকার করে না এবং জান্নাতের প্রতিশ্রুতিকে মিথ্যা ঠাওরায়। তো এই তিন খাসলাতবিশিষ্ট লোক সম্পর্কে পরের আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে-
فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى (আমি তার জন্য যাতনাময় স্থানে পৌঁছাকে সহজ করে দেব)। العُسْری-এর অর্থ যাতনাময় স্থান, কঠোর ও কঠিন পরিণাম। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য জাহান্নাম। আয়াতটিতে বলা হচ্ছে- উল্লিখিত খাসলাত ও চরিত্রসমূহ যার মধ্যে থাকবে, আল্লাহ তা'আলা তার জন্য এমনসব কাজ সহজ করে দেবেন, যা করার দ্বারা তার শেষ পরিণাম হবে জাহান্নাম। তার মানে শরী'আতবিরোধী কাজকর্ম করার প্রতি তার অন্তরে আগ্রহ সৃষ্টি করে দেওয়া হবে এবং সে আগ্রহ পূরণ করা তার পক্ষে সহজ হয়ে যাবে। পাপকাজের প্রতি মনে আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া ও তা করতে ভালো লাগা মূলত অনবরত দীন ও শরী'আতবিরুদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করতে থাকার কুফল। যে ব্যক্তি শরী'আত মোতাবেক চলতে সচেষ্ট থাকে, আল্লাহ তা'আলা এক পর্যায়ে তার জন্য সে চলাটাকে সহজ করে দেন। ফলে তার পক্ষে সৎকর্ম করতে ভালো লাগে, তা করা তার পক্ষে সহজ মনে হয় এবং সে তাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। অনুরূপ যে ব্যক্তি শরী'আতবিরোধী কাজকর্ম নিয়মিত করতে থাকে, তার সেসব কাজ করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। ফলে তার পক্ষে অসৎকর্ম করতে ভালো লাগে এবং তা করা তার পক্ষে সহজ মনে হয়। বলাবাহুল্য, শরী'আতবিরোধী কাজকর্ম করতে ভালো লাগাটা ও তা সহজ মনে হওয়াটা আল্লাহ তা'আলার এক রকম আযাব। এ আযাব আসার আগেই বান্দার কর্তব্য মনের খেয়ালখুশি উপেক্ষা করে শরী'আত মোতাবেক চলতে সচেষ্ট থাকা। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
চতুর্থ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন- وَمَا يُغْنِي عَنْهُ مَالُهُ إِذَا تَرَدَّى (সে যখন ধ্বংস-গহ্বরে পতিত হবে, তখন তার সম্পদ তার কোনও কাজে আসবে না)। অর্থাৎ উল্লিখিত তিনটি বদ খাসলাতের কারণে আখিরাতে যখন তাকে জাহান্নামের গর্তে নিক্ষেপ করা হবে, তখন শরী'আতের হুকুম অমান্য করে দুনিয়ায় সে যে সম্পদের আসক্তিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল, আল্লাহর পথে অর্থব্যয় হতে বিমুখ হয়ে কৃপণতা অবলম্বন করেছিল, সে সম্পদ তার কোনও উপকারে আসবে না। জাহান্নামের আযাব থেকে তাকে তা রক্ষা করতে পারবে না। উল্টো কৃপণতার কারণে এ সম্পদই আখিরাতে তার মহামসিবতের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘আল্লাহপ্রদত্ত অনুগ্রহে (সম্পদে) যারা কৃপণতা করে, তারা যেন কিছুতেই মনে না করে, এটা তাদের জন্য ভালো কিছু। বরং এটা তাদের পক্ষে অতি মন্দ। যে সম্পদের ভেতর তারা কৃপণতা করে, কিয়ামতের দিন তাকে তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৮০)

আয়াতটির শিক্ষা
ক. কৃপণতা নেহাৎ মন্দ গুণ। এর ইসলাহ জরুরি।
খ. অর্থবিত্তের মোহে দীন ও শরী'আতের দাবি উপেক্ষা করতে নেই।
গ. কালেমা তায়্যিবা সর্বোত্তম বাণী। এ বাণীর অস্বীকৃতি কুফর।
ঘ. জান্নাত সর্বোত্তম স্থান। তা মুমিনদের ঠিকানা।
ঙ. অনবরত পাপকর্ম করতে থাকার পরিণামে পাপকর্ম করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। তাতে পাপকর্ম করা সহজ হয় ও জাহান্নামের পথ সুগম হয়।
চ. সম্পদের মোহে পড়তে নেই। আখিরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তিতে তা কোনও কাজে আসবে না।

দুই নং আয়াত
وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (16)
অর্থ : যারা তাদের অন্তরের লোভ-লালসা থেকে মুক্তি লাভ করেছে, তারাই সফলকাম।(সূরা তাগাবুন (৬৪), আয়াত ১৬)

ব্যাখ্যা
অন্তর লোভ-লালসা থেকে মুক্ত থাকলে অন্যায়ভাবে উপার্জন করা ও অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়। এরূপ ব্যক্তি সহজেই দীনের কাজে অর্থ-সম্পদ খরচ করতে পারে। যে ক্ষেত্রে অন্যরা ব্যয় করতে কুণ্ঠাবোধ করে, সেখানে সে অনায়াসে দান-খয়রাত করে। সারকথা নির্লোভ ব্যক্তি সাধারণত কৃপণ হয় না। আর তা হয় না বলে সে আল্লাহর দেওয়া মাল আল্লাহর পথে খরচ করে দোজাহানের সফলতা অর্জন করে নেয়। বোঝা গেল, যে ব্যক্তি الشُّحَّ বা লোভ-লালসার শিকার হয়ে যায়, সে সফলতা অর্জন করতে পারে না; বরং সে হয় ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত। বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি.-কে বলেছিল, ভয় হয়-বুঝি বা আমি ধ্বংস হয়ে যাব। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এর কারণ? সে বলল, আল্লাহ তা'আলা তো বলেছেন, যারা নিজেদের الشُّحَّ থেকে মুক্ত করেছে তারাই সফলকাম। আমি তো একজন কৃপণ লোক। আমার হাত থেকে কিছুই বের হয় না। হযরত ইবন মাস'ঊদ রাযি. বললেন, আল্লাহ তা'আলা যে الشُّحَّ -এর কথা বলেছেন, তোমার এটা তা নয়। তুমি যদি তোমার ভাইয়ের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ কর, তবে সেটাই । (লোভ-লালসা)। আর তোমার মধ্যে যা আছে তা হল اَلْبُخْلُ (কৃপণতা)।
হযরত উমর রাযি. বলেন, কেউ যদি নিজ সম্পদ ব্যয় না করে, তবে তা الشُّحَّ নয়; বরং কেউ অন্যের সম্পদের প্রতি লোভের দৃষ্টিতে তাকালে সেটাই الشُّحَّ।
হযরত সা‘ঈদ ইবন জুবায়র রহ. বলেন, الشُّحَّ -এর অর্থ হারাম গ্রহণ করা ও যাকাত দেওয়া হতে বিরত থাকা।
কারও মতে যে তীব্র লালসা মানুষকে অবৈধ উপার্জনে লিপ্ত করে, তাকেই الشُّحَّ বলে।
হযরত ইবন যায়দ রহ. বলেন, যে ব্যক্তি অবৈধ সম্পদ স্পর্শ করে না এবং আল্লাহর আদেশ পালনে কার্পণ্য যার পক্ষে বাধা হতে পারে না, সেই মূলত নিজেকে الشُّحَّ হতে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে লোভ ও কৃপণতা মারাত্মক আত্মিক ব্যাধি। এ ব্যাধি যার অন্তরে আছে, সে সবদিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে এক মিসকীন, তাতে তার যত বেশিই টাকা- পয়সা থাকুক না কেন। ইবন আতিয়্যাহ রহ. বলেন, মনের লোভ ও কৃপণতা এমন এক দারিদ্র্য, যা কখনও অর্থ-সম্পদ দিয়ে ঘোচে না; বরং যত বেশি সম্পদ হয় তত বেশি তা বাড়ে ও পাকাপোক্ত হয়। সুতরাং এ ব্যাধি থেকে নিজেকে মুক্ত করা অতীব জরুরি। তা থেকে মুক্ত হওয়ার একটা উপায় হচ্ছে হারাম অর্থ-সম্পদ থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং যাকাত ফরয হয়ে থাকলে তা পরিপূর্ণরূপে আদায় করা।
ইবন যায়দ রহ., সা‘ঈদ ইবন জুবায়র রহ, প্রমুখ বলেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার নিষেধকৃত কোনওকিছু স্পর্শ করে না এবং ফরয যাকাত আদায় হতে বিরত থাকে না, সে মনের লোভ ও কৃপণতা থেকে মুক্ত'। আমাদেরকে এ ব্যাধি থেকে মুক্ত হতেই হবে। কেননা এটা প্রকৃত ঈমানেরও পরিপন্থী। প্রকৃত ঈমানের সঙ্গে এটা সহাবস্থান করতে পারে না।
এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا يجتمعُ غبارٌ في سبيلِ اللَّهِ ودُخانُ جَهَنَّمَ في جوفِ عبدٍ أبدًا ، ولا يجتَمعُ الشُّحُّ والإيمانُ في قلبِ عبدٍ أبدًا
‘আল্লাহর পথের ধুলা ও জাহান্নামের ধোঁয়া কখনও কোনও বান্দার উদরে একত্র হতে পারে না। এমনিভাবে লোভ-কৃপণতা ও ঈমান কোনও বান্দার অন্তরে একত্র হতে পারে না।(সুনানে নাসাঈ ৩১১০; মুসনাদে আহমাদ: ৯৬৯৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১৯৪৮২ মুসনাদুল বাযযার: ৮২২৫; সহীহ ইবন হিব্বান ৩২৫১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৮৫০৮)

আয়াতটির শিক্ষা
লোভ ও কৃপণতা মারাত্মক আত্মিক ব্যাধি। এ ব্যাধি দোজাহানের সফলতা লাভের পক্ষে কঠিন বাধা। তাই আমাদেরকে এর থেকে মুক্তিলাভের সাধনা করতে হবে।
হাদীছ নং: ৫৬২

হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা জুলুম করা হতে বিরত থেকো, কেননা জুলুম কিয়ামতের দিন ঘোর অন্ধকারে পরিণত হবে। এবং তোমরা লোভ-লালসা হতে বিরত থেকো, কেননা লোভ-লালসা তোমাদের পূর্বের লোকদেরকে ধ্বংস করেছে। তা তাদেরকে তাদের রক্তপাত করতে এবং তাদের জন্য নিষিদ্ধ বিষয়সমূহকে হালাল করতে প্ররোচিত করেছিল। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৫৭৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৩৩৮; আল-আদাবুল মুফরাদ: ৪৮৩; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত: ৮৫৬১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪১৬১)
مقدمة الامام النووي
61 - باب النهي عن البخل والشح
قَالَ الله تَعَالَى: {وَأَمَا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى وَكَذَّبَ بِالحُسْنَى فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى وَمَا يُغْنِي عَنْهُ مَالُهُ إِذَا تَرَدَّى} [الليل: 8 - 11]، وقال تَعَالَى: {وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفسِهِ فَأولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ} [التغابن: 16].
562 - وعن جابر - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «اتَّقُوا الظُّلْمَ؛
فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ القِيَامَةِ. وَاتَّقُوا الشُّحَّ؛ فَإنَّ الشُّحَّ أهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، حَمَلَهُمْ عَلَى أَنْ سَفَكُوا دِمَاءهُمْ وَاسْتَحَلُّوا مَحَارِمَهُمْ». رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ৫৬৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অন্যের জন্য স্বার্থত্যাগ ও সহমর্মিতা
الايثار এর অর্থ নিজ স্বার্থের উপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। الْمُؤَاسَاةُ এর অর্থ অন্যের দুঃখ-কষ্টে সহমর্মিতা প্রকাশ করা। নিজ উদ্বৃত্ত অর্থ দ্বারা যা করা হয় তা দান-খয়রাত বটে, কিন্তু اَلْمُؤَاسَاةُ বা সহমর্মিতা আরও বেশি কিছু। অন্যের কষ্টকে যদি নিজ কষ্টের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়, তথা নিজ প্রয়োজন দমিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থের একটা অংশ বা পুরোটাই অন্য অভাবগ্রস্তকে দিয়ে দেওয়ার নাম الْمُؤَاسَاةُ বা সহমর্মিতা। সে হিসেবে এটাও الايثار বা স্বার্থত্যাগই বটে। এ স্বার্থত্যাগ হতে পারে একান্তভাবে নিজের ক্ষেত্রেও এবং নিজ পরিবার-পরিজনের ক্ষেত্রেও। তবে বিষয়টি কিছুটা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ।
অর্থ-সম্পদ ব্যয়ের মূলনীতি হল তা দ্বারা সর্বপ্রথম নিজ জরুরি প্রয়োজন মেটানো। তারপর কিছু উদ্বৃত্ত থাকলে তা দ্বারা নিজ পোষ্যবর্গের প্রয়োজন মেটানো। নিজ জরুরত বলতে এমন প্রচণ্ড ক্ষুধা, যা সহ্য করা সম্ভব হয় না, নিজ সতর ঢাকা কিংবা নিজের অন্য কোনও দুর্বিষহ কষ্ট দূর করা। যে টাকা-পয়সা দ্বারা কেবল এ পরিমাণ প্রয়োজন মেটানো যায়, তা দ্বারা প্রথম কাজ হল নিজের এসব প্রয়োজন মেটানো। এ ক্ষেত্রে নিজ প্রয়োজন উপেক্ষা করে অন্যের প্রয়োজন মেটানো জায়েয নয়। কেননা এটা আত্মহত্যা করা বা নিজ ইজ্জত-সম্মান ধ্বংস করার নামান্তর, যা শরী'আত অনুমোদন করে না। সুতরাং এরূপ ক্ষেত্রে নিজের হক আদায় করাই অগ্রগণ্য।
টাকা-পয়সা যদি এরচে' কিছু বেশি থাকে, তবে তা দ্বারা কর্তব্য প্রথমে নিজ পরিবার-পরিজনের এ জাতীয় জরুরি প্রয়োজন মেটানো। তাদের এরূপ জরুরি প্রয়োজন পাশ কাটিয়ে সে অর্থ দ্বারা অন্যের প্রয়োজন পূরণ করা জায়েয নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
كَفَى بِالْمَرْءِ إِثْمًا أَنْ يُضَيِّعَ مَنْ يَقُوْتُ
কোনও ব্যক্তির গুনাহগার হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, যার খাবার তার দায়িত্বে, সে তাকে (বঞ্চিত করে) ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে।(সুনানে আবু দাউদ: ৯১৩২; মুসনাদে আহমাদ: ৬৪৯৫; সহীহ ইবনে হিব্বান : ২৪৩৫৪; তাবারানী, আল্-মুজামুল কাবীর: ১৩৪১৪; শুআবুল ঈমান: ৮৩৩৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ; ২৪০৪)
এ জাতীয় প্রয়োজন মেটানোর পরও যদি কিছু সম্পদ উদ্বৃত্ত থাকে, সে ক্ষেত্রে নিজের উপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া উত্তম; বরং অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। পরিবার-পরিজন যদি কষ্ট-ক্লেশে ধৈর্যধারণ করতে প্রস্তুত থাকে, তবে তাদের উপরও অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে, অন্যথায় নয়।
কখনও কখনও অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া অবশ্যকর্তব্যও হয়ে যায়। যেমন অতিথি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত হলে নিজে না খেয়ে তাকে খাওয়ানো, ক্ষুধায় মরণাপন্ন কোনও ব্যক্তি নজরে আসলে নিজের খাবার তাকে দিয়ে দেওয়া, যে মায়্যিতের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করার মতো কেউ নেই, নিজ জরুরি প্রয়োজন মেটানোর পর কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকলে তা তার দাফন-কাফনে খরচ করা চাই। এ জাতীয় সহমর্মিতা প্রদর্শন ফরয ও অবশ্যকর্তব্য।
সহমর্মিতা ও স্বার্থত্যাগ ইসলামের সুমহান চারিত্রিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। ইসলামের শিক্ষা হল তুমি নিজের জন্য যা ভালোবাস, অন্যের জন্যও তা ভালোবাসবে। নিজে ক্ষুধার্ত থেকে অন্যকে খাওয়াবে। নিজ সতর ঢাকার পর উদ্বৃত্ত পোশাক দ্বারা অন্যের সতর ঢাকার ব্যবস্থা করবে। প্রথমদিকের মুসলিমগণ এ শিক্ষা নিজেদের জীবনে রূপায়িত করেছিল। মহান সাহাবীগণ তো ছিলেন এর সর্বোচ্চ ধাপে। ইয়ারমুকের যুদ্ধের সে ঘটনা কে না জানে যে, হযরত হুযায়ফা আল-আদাবী রাযি. তাঁর মুমূর্ষু ও ক্ষতবিক্ষত চাচাতো ভাইয়ের কাছে পানি নিয়ে গেলেন। তিনি যেই না পানি পান করতে যাবেন, অমনি খানিকটা দূর থেকে এক ব্যক্তি ‘আহ্’ বলে আর্তনাদ করল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, তুমি ওর কাছে পানি নিয়ে যাও। তিনি তার কাছে পানি নিয়ে গেলেন। দেখা গেল তিনি বিখ্যাত সাহাবী হিশাম ইবনুল আস রাযি.। তাঁর সামনে পানি তুলে ধরতেই খানিকটা দূরে আরেক ব্যক্তি আর্তনাদ করে উঠল। হিশাম রাযি. সে পানি তার কাছে নিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু নিয়ে যেতে যেতেই তার প্রাণবায়ু উড়ে গেল। হযরত হুযায়ফা রাযি. ফিরে আসলেন হিশাম রাযি.-এর কাছে। ততক্ষণে তারও প্রাণবায়ু উড়ে গেছে। শেষে ফিরে আসলেন চাচাতো ভাইয়ের কাছে। এসে দেখেন তিনিও চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন। এভাবে সেই তিন মহান সাহাবী রণক্ষেত্রে শাহাদাত বরণ করেন আর সেই সন্ধিক্ষণেও রেখে যান স্বার্থত্যাগ ও সহমর্মিতার অভাবনীয় দৃষ্টান্ত।
কেবল কি সাহাবায়ে কেরাম? তাদের পরবর্তীদের মধ্যেও এরূপ হাজারও দৃষ্টান্ত আছে। আবুল হাসান আনতাকী রহ. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, একদা ৩০ জনেরও বেশি মেহমান তার কাছে উপস্থিত। খাবার জন্য ছিল মাত্র কয়েকটি রুটি। তা তাদের ক্ষুধা মেটানোর জন্য মোটেই যথেষ্ট ছিল না। এ অবস্থায় রুটিগুলো ছিড়ে টুকরো টুকরো করা হল। বাতি নিভিয়ে দেওয়া হল। সবাই খেতে বসলেন। কিছুক্ষণ পর যখন দস্তরখান তোলা হবে, দেখা গেল সবগুলো রুটি যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। এক টুকরোও কমেনি। প্রত্যেকেই মনে করেছিলেন আমি এতে ভাগ না বসিয়ে অন্যদের খেতে দিই। সকলেরই স্বার্থত্যাগের মনোভাব। ফলে কারওই খাওয়া হয়নি। রুটিগুলো যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে।

বিখ্যাত বুযুর্গ বিশর ইবনুল হারিছ রহ.-এর কথা। তিনি তখন মুমূর্ষু রোগী। এ অবস্থায় এক অভাবগ্রস্ত হাজির। তিনি নিজ গায়ের জামাটি খুলে তাকে দিয়ে দিলেন। পরার জন্য তার আর কোনও জামা ছিল না। আরেকজনের কাছ থেকে একটি জামা ধার নিয়ে শরীর ঢাকেন আর সে অবস্থায়ই তাঁর ইন্তিকাল হয়ে যায়।
বস্তুত আমাদের মহান পূর্বসুরীদের সামনে ছিল আখিরাতের মুক্তি ও নাজাতের ভাবনা। দুনিয়ার সর্বস্ব দিয়ে হলেও তারা সে লক্ষ্যই অর্জন করতে চাইতেন। তাই তারা কৃষ্ণতাকে বেছে নিয়েছেন। যা-কিছু অর্থ-সম্পদ অর্জিত হতো, তা অকাতরে আল্লাহ তা'আলার পথে খরচ করেছেন। সর্বদা নিজের স্বার্থ উপেক্ষা করে অন্যের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তারা জীবনভর সহমর্মিতার প্রতিযোগিতায় লেগে থেকেছেন। তারা এ মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন কুরআন-সুন্নাহের শিক্ষা দ্বারা। কুরআন-হাদীছ মানুষকে এ মহান নীতির উপর নানাভাবে উৎসাহদান করেছে। এ অধ্যায়ে ইমাম নাওয়াবী রহ. সেরকমই কিছু আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন।

‘অন্যের জন্য স্বার্থত্যাগ ও সহমর্মিতা’ সম্পর্কিত দু’টি আয়াত

এক নং আয়াত
وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ
অর্থ: এবং তাদেরকে তারা নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের অভাব- অনটন থাকে।(সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ৯)

ব্যাখ্যা
এটি সূরা হাশরের ৯ নং আয়াতের অংশবিশেষ। এ আয়াতে মদীনার আনসারদের প্রশংসা করা হয়েছে। শুরুতে বলা হয়েছে- وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا ‘যারা পূর্ব থেকেই এ নগরে (অর্থাৎ মদীনায়) ঈমানের সাথে অবস্থানরত আছে, যে-কেউ হিজরত করে তাদের কাছে আসে, তাদেরকে তারা ভালোবাসে এবং যা-কিছু তাদেরকে (অর্থাৎ মুহাজিরদেরকে) দেওয়া হয়, তার জন্য নিজেদের অন্তরে কোনও চাহিদা বোধ করে না'। এতে আনসার সাহাবীদের দু'টি গুণ বলা হয়েছে। এক তো তারা ঈমানের উপর স্থিতিশীল। দ্বিতীয়ত তারা নিঃস্বার্থ। মুহাজিরদের বিশেষ মর্যাদার কারণে তাদের প্রতি তারা ঈর্ষাবোধও করে না এবং গনীমতের সম্পদ থেকে তাদেরকে যা দেওয়া হয় তার প্রতিও চাহিদা বোধ করে না। তারপর বলা হয়েছে-
وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ (এবং তাদেরকে তারা নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের অভাব-অনটন থাকে)। এটা আনসারদের তৃতীয় বিশেষত্ব। তারা কেবল নিঃস্বার্থই নয়; বরং নিজের উপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। এমনকি তারা নিজেদের অর্থ-সম্পদ ও ঘরবাড়িতেও মুহাজিরদের প্রাধান্য দেয়। তাছাড়া যুদ্ধে যে গনীমত অর্জিত হয় তাতেও নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে মুহাজিরদের অগ্রাধিকার দেয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা মুকাররামা ত্যাগ করে যখন মদীনা মুনাউওয়ারায় চলে আসেন, তখন মুহাজিরদেরকে গ্রহণ করার ব্যাপারে আনসারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে যায়। শেষপর্যন্ত লটারী ধরা হয়। তাতে যে মুহাজিরের নাম যে আনসারের ভাগে পড়ে, কেবল তিনিই তার অতিথি হন। এভাবে মুহাজিরগণ আনসারদের বাড়িতে বাড়িতে ভাগ হয়ে যান। আনসারগণ নিজেদের ধন-সম্পত্তিতে তাদেরকে শরীক করে নেন। পরে যখন ইহুদীগোত্র বনু নাযীরের রেখে যাওয়া সম্পদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হস্তগত হয়, তখন তিনি সমস্ত আনসার সাহাবীকে ডাকিয়ে আনেন। প্রথমে তিনি মুহাজিরদের প্রতি আনসারদের ভালোবাসা ও সহমর্মিতার প্রশংসা করেন। তারপর তাদের বলেন, হে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা যদি চাও তবে আমি বনু নাযীরের থেকে প্রাপ্ত সম্পদ তোমাদের ও মুহাজিরদের মধ্যে ভাগ করে দিই। সে ক্ষেত্রে তোমরা তাদেরকে তোমাদের ঘরবাড়ি ও অর্থ-সম্পদের যে অংশ দিয়েছিলে তা যথারীতি তাদের থাকবে। আর তোমরা চাইলে এ সম্পদ তাদের মধ্যেই বণ্টন করে দেব আর তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছিলে তা তারা তোমাদের ফিরিয়ে দেবে। এর উত্তরে আনসারগণ জানান যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ওই সম্পদ মুহাজিরদের মধ্যেই বণ্টন করে দিন। আর আমরা তাদের যা দিয়েছিলাম তাও তাদেরই থাকুক। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়। এতে বলা হয়েছে যে, আনসারগণ নিজেদের অর্থ-সম্পদ ও ঘরবাড়িতে মুহাজিরদের প্রাধান্য দেয়। এমনও বর্ণিত আছে যে, যে আনসারী সাহাবীর দু'জন স্ত্রী ছিল, তিনি তার এক স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে মুহাজির ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন।
বলা হয়েছে- وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ (যদিও তাদের অভাব-অনটন থাকে)। অর্থাৎ যে বিষয়ে আনসারগণ মুহাজিরদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেন, তার অভাব ও প্রয়োজন নিজেদের বেশি থাকলেও তা উপেক্ষা করে মুহাজিরদেরকেই অগ্রাধিকার দেন। হাদীছ ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে এ জাতীয় বহু ঘটনা বর্ণিত আছে। এক বর্ণনায় আছে, একবার এক সাহাবীকে একটি ছাগলের মাথা হাদিয়া দেওয়া হল। সে সাহাবী বললেন, আমার চেয়ে আমার অমুক ভাই ও তার পরিবারেরই প্রয়োজন বেশি। এ বলে তিনি সে মাথাটি তাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেই সাহাবীও একই কথা বলে তৃতীয় এক সাহাবীর বাড়িতে সেটি পাঠিয়ে দেন। এভাবে ছাগলের মাথাটি একের পর এক বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হতে থাকে। সর্বমোট সাতটি বাড়িতে সেটি ঘুরতে থাকে। সবশেষে প্রথম যে সাহাবীকে দেওয়া হয়েছিল তার কাছেই সেটি ফিরে আসে।
অপর এক বর্ণনায় আছে, বাহরায়ন জয় হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানকার ভূ-সম্পত্তি আনসারদের লিখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাতে রাজি হননি। তারা বলেছিলেন, যাবৎ না আমাদের মুহাজির ভাইদেরকেও আমাদের মতো দেবেন, আমরা এতে রাজি হব না।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. ঈমান কেবল আনাই যথেষ্ট নয়, তাকে স্থিতিশীল করাও জরুরি। নিজ ঘরবাড়ির মতো ঈমান হতে হবে মুমিনের স্থায়ী ঠিকানা।
খ. অন্যের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব দেখে ঈর্ষান্বিত হতে নেই।
গ. প্রকৃত মুমিন নিজ স্বার্থের উপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
ঘ. এক মুমিনের কর্তব্য অপর মুমিনের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা এবং তার প্রতি ভ্রাতৃসুলভ আচরণ করা।
ঙ. মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের প্রতি ভালোবাসা রাখা ঈমানের দাবি।

দুই নং আয়াত
وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا (8)
অর্থ : তারা তাঁর (আল্লাহর) ভালোবাসায় মিসকীন, এতিম ও বন্দীদেরকে খাবার দান করে।(সূরা দাহর (৭৬), আয়াত ৮)

ব্যাখ্যা
এর আরেক অর্থ হতে পারে- তারা তার (অর্থাৎ খাদ্যের) প্রতি নিজেদের আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকীন, এতিম ও বন্দীদেরকে তা খাওয়ায়। উভয় অর্থ হিসেবেই আয়াতের সারকথা হল, সাহাবীগণ গরীব-দুঃখী ও আর্তমানবতার প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করতেন।
এখানে যে أَسِير (বন্দী)-এর কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা অমুসলিম বন্দী বোঝানো হয়েছে। ইবন জুরায়জ রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও কোনও মুসলিমকে বন্দী করতেন না। এ আয়াত নাযিল হয়েছে মুশরিকদের সম্পর্কে। তারা যুদ্ধে মুমিনদের হাতে বন্দী হতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিনদের আদেশ করতেন তারা যেন সেই অমুসলিম বন্দীদের প্রতি সদয় আচরণ করেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, এ আয়াত নাযিল হয়েছে হযরত আলী রাযি. সম্পর্কে। তিনি একদিন এক ইহুদীর কাজ করে দিয়ে বিনিময়ে কিছু যব পেয়েছিলেন। সেই যবের এক-তৃতীয়াংশ পিষে পরিবারের সদস্যদের জন্য রুটি তৈরি করেন। রুটি তৈরি হতেই এক মিসকীন উপস্থিত। রুটিগুলো তাকে দিয়ে দিলেন। তারপর যবের দ্বিতীয় অংশ দিয়ে আবার রুটি বানানো হল। অমনি এক এতিম এসে হাজির। এবার সে রুটিগুলো সেই এতিমকে দিয়ে দেওয়া হল। তারপর যবের বাকি অংশ দিয়ে আবার রুটি বানানো হল। এবার এক মুশরিক বন্দী খাবার চাইল। রুটিগুলো তাকে দিয়ে দেওয়া হল। সেদিন এ পরিবারের সকলের উপোস দিন কাটল। হযরত আলী রাযি, সম্পর্কে এরকম আরও ঘটনা বর্ণিত আছে।
যাহোক অন্যের প্রতি সহমর্মিতার এ গুণ কেবল হযরত আলী রাযি.-এরই বৈশিষ্ট্য নয়: সব সাহাবীই এরকম ছিলেন। আয়াতে বহুবচনের সঙ্গে বলা হয়েছে যে, তারা অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দীকে আহার্য দান করে।
তাদের এ সহমর্মিতা ছিল কেবলই আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসায়, অন্য কোনও উদ্দেশ্যে নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টিই ছিল তাদের একমাত্র কাম্যবস্তু। এর পরের আয়াতে সে কথা আরও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে- إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا (9) (আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। আমরা তোমাদের কাছে কোনও প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও না)।
প্রকাশ থাকে যে, আয়াতে কেবল খাবার খাওয়ানোর কথা বলা হলেও এর নির্দেশনাটি ব্যাপক। সাহাবীগণ গরীব-দুঃখীকে কেবল আহার্যই দান করতেন না, তাদের অন্য প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ রাখতেন। যার কাপড় নেই তাকে কাপড় দিতেন। যার মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকত না, তার বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিতেন। রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। এমনিভাবে যার যা প্রয়োজন হতো, তারা তা মেটানোর চেষ্টা করতেন। সুতরাং আমাদের কাছে আয়াতটির বার্তা হল, আমরা যেন গরীব-দুঃখী ও আর্তমানবতার প্রতি সহমর্মী হয়ে তাদের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট মোচনে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী ভূমিকা রাখি।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. এতিম, মিসকীন ও অসহায়ের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন ঈমানের দাবি।
খ. বন্দীর প্রতি সদয় আচরণ করা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ।
গ. বিপন্ন-অসহায় ব্যক্তি অমুসলিম হলেও তার প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা চাই।
ঘ. অভুক্তকে খাবার খাওয়ানো অনেক বড় নেকীর কাজ।
ঙ. অন্যকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্য হতে হবে কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন, পার্থিব কোনও স্বার্থ হাসিল করা নয়।
এক আনসারী দম্পতির অপূর্ব আতিথেয়তা
হাদীছ নং: ৫৬৩

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, আমি খুব ক্ষুধার্ত। এ কথা শুনে তিনি তাঁর এক স্ত্রীর কাছে কাউকে পাঠালেন। স্ত্রী বললেন, যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম! আমার কাছে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। তারপর তিনি অপর এক স্ত্রীর কাছে পাঠালেন। তিনিও অনুরূপ বললেন। এভাবে তাঁদের সকলেই একই রকম বললেন যে, যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম! আমার কাছে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ রাতে কে এই ব্যক্তির মেহমানদারি করবে? এক আনসারী ব্যক্তি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি। তারপর তিনি তাকে সঙ্গে নিয়ে নিজ বাড়িতে গেলেন। গিয়ে স্ত্রীকে বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অতিথির সম্মান করো।
অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, তোমার কাছে কিছু আছে কি? স্ত্রী বললেন, না, কেবল আমার বাচ্চাদের খাবারই আছে। আনসারী সাহাবী বললেন, কাদেরকে কোনওকিছু দিয়ে ভুলিয়ে রেখো। আর যখন রাতের খাবার চাবে, তখন ঘুম পাড়িয়ে দিয়ো। যখন আমাদের অতিথি প্রবেশ করবে, বাতি নিভিয়ে দিয়ো আর তাকে দেখিয়ো যেন আমরা খানা খাচ্ছি। তারপর সকলে বসে গেলেন। অতিথি খেলেন আর তারা দু'জন ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত কাটালেন। ভোরবেলা সেই আনসারী সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলে তিনি বললেন, আজ রাতে অতিথির প্রতি তোমাদের আচরণে আল্লাহ খুব খুশি হয়েছেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী : ৩৭৯৮; সহীহ মুসলিম: ২০৫৪; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৬১৬৮; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫২৮৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৭৮০২)
مقدمة الامام النووي
62 - باب الإيثار والمواساة
قَالَ الله تَعَالَى: {وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ} [الحشر: 9]، وقال تَعَالَى: {وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا} [الدهر: 8].
563 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النبيِّ - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: إنِّي مَجْهُودٌ (1)، فَأرسَلَ إِلَى بَعْضِ نِسَائِهِ، فَقالت: وَالَّذي بَعَثَكَ بِالحَقِّ مَا عِنْدِي إِلاَّ مَاءٌ، ثُمَّ أرْسَلَ إِلَى أُخْرَى، فَقَالَتْ مِثلَ ذَلِكَ، حَتَّى قُلْنَ كُلُّهُنَّ مِثلَ ذَلِكَ: لا وَالَّذِي بَعَثَكَ بالحَقِّ مَا عِنْدِي إِلاَّ مَاءٌ. فَقَالَ النبي - صلى الله عليه وسلم: «مَنْ يُضيفُ هَذَا اللَّيْلَةَ؟» فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الأنْصَارِ: أنَا يَا رسولَ الله، فَانْطَلَقَ بِهِ إِلَى رَحْلِهِ، فَقَالَ لامْرَأَتِهِ: أكرِمِي ضَيْفَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم.
وفي روايةٍ قَالَ لامْرَأَتِهِ: هَلْ عِنْدَكِ شَيْءٌ؟ فقَالَتْ: لاَ، إِلاَّ قُوتَ صِبيَانِي. قَالَ: فَعَلِّليهم بِشَيْءٍ وَإذَا أرَادُوا العَشَاءَ فَنَوِّمِيهمْ، وَإِذَا دَخَلَ ضَيْفُنَا فَأطْفِئي السِّرَاجَ، وَأريهِ أنَّا نَأكُلُ. فَقَعَدُوا وَأكَلَ الضَّيْفُ وَبَاتَا طَاوِيَيْنِ، فَلَمَّا أصْبَحَ غَدَا عَلَى النَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: «لَقَدْ عَجبَ الله مِنْ صَنِيعِكُمَا بِضَيْفِكُمَا اللَّيْلَةَ». متفقٌ عَلَيْهِ. (2)
হাদীস নং: ৫৬৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৬২ অন্যের জন্য স্বার্থত্যাগ ও সহমর্মিতা
অল্পজনের খাবার বেশিজনে মিলেমিশে খাওয়া
হাদীছ নং: ৫৬৪

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দু'জনের খাবার তিনজনের জন্য যথেষ্ট এবং তিনজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী : ৫৩৯২; সহীহ মুসলিম: ২০৫৮; জামে' তিরমিযী: ১৮২০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৬৯৬৩; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৫২৪৫; মুআত্তা মালিক: ২০)
সহীহ মুসলিমের এক রেওয়ায়েতে হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, একজনের খাবার দু'জনের জন্য যথেষ্ট। দু'জনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট। আর চারজনের খাবার আটজনের জন্য যথেষ্ট।
(সহীহ মুসলিম: ২০৫৯; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৪৫৫১; মুসনাদে আহমাদ: ৯২৭৭; জামে' তিরমিযী: ১৮২০; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫২৩৭; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৬৯৫৮)
مقدمة الامام النووي
62 - باب الإيثار والمواساة
564 - وعنه، قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «طَعَامُ الاثْنَيْنِ كَافِي الثَّلاَثَةِ، وَطَعَامُ الثَّلاَثَةِ كَافِي الأربَعَةِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
وفي رواية لمسلمٍ عن جابر - رضي الله عنه - عن النبي - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «طَعَامُ الوَاحِدِ يَكْفِي الاثْنَيْنِ، وَطَعَامُ الاثْنَيْنِ يَكْفِي الأَرْبَعَةَ، وَطَعَامُ الأَرْبَعَة يَكْفِي الثَّمَانِية».
হাদীস নং: ৫৬৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৬২ অন্যের জন্য স্বার্থত্যাগ ও সহমর্মিতা
উদ্বৃত্ত সম্পদ দ্বারা অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ
হাদীছ নং: ৫৬৫

হযরত আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে কোনও এক সফরে ছিলাম। এ অবস্থায় উষ্ট্রারোহী এক ব্যক্তি হাজির হল। সে ডানে-বামে তার দৃষ্টি ঘোরাতে থাকল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যার কাছে অতিরিক্ত বাহন আছে সে যেন তা যার বাহন নেই তাকে দিয়ে দেয়। যার অতিরিক্ত রসদ আছে সে যেন যার রসদ নেই তাকে তা দিয়ে দেয়। এভাবে তিনি বিভিন্ন প্রকার মালের কথা উল্লেখ করতে থাকেন। তাতে আমাদের মনে হল আমাদের কারওই অতিরিক্ত মালে কোনও অধিকার নেই। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ১৭২৮; সুনানে আবূ দাউদ: ১৬৬৩; মুসনাদে আহমাদ : ১১২৯৩; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫৪১৯; শু'আবুল ঈমান: ৩১১৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৬৮৬)
مقدمة الامام النووي
62 - باب الإيثار والمواساة
565 - وعن أَبي سعيد الخدري - رضي الله عنه - قَالَ: بَيْنَمَا نَحْنُ فِي سَفَرٍ مَعَ النَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - إذْ جَاءَ رَجُلٌ عَلَى رَاحِلَةٍ لَهُ، فَجَعَلَ يَصرِفُ بَصَرَهُ يَمينًا وَشِمَالًا، فَقَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «مَنْ كَانَ مَعَهُ فَضْلُ ظَهْرٍ فَليَعُدْ بِهِ عَلَى مَنْ لاَ ظَهرَ لَهُ، وَمَنْ كَانَ لَهُ فَضْلٌ مِنْ زَادٍ، فَلْيَعُدْ بِهِ عَلَى مَنْ لاَ زَادَ لَهُ»، فَذَكَرَ مِنْ أصْنَافِ المالِ مَا ذكر حَتَّى رَأيْنَا أنَّهُ لاَ حَقَّ لأحَدٍ مِنَّا في فَضْلٍ. رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ৫৬৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৬২ অন্যের জন্য স্বার্থত্যাগ ও সহমর্মিতা
নিজ পসন্দের ও প্রয়োজনের বস্তু অন্যকে দান করা
হাদীছ নং: ৫৬৬

হযরত সাহল ইবন সা‘দ রাযি. থেকে বর্ণিত, এক মহিলা একটি হাতেবোনা চাদর নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসল। সে বলল, আপনাকে পরানোর জন্য এ চাদরটি আমি নিজ হাতে বুনেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটি এমনভাবে গ্রহণ করলেন, যেন তাঁর সেটির প্রয়োজন ছিল। তারপর তিনি সেটিকে লুঙ্গিরূপে পরিধান করে আমাদের কাছে আসলেন। এক ব্যক্তি বলল, এটি আমাকে দিয়ে দিন। কী সুন্দর এটি! তিনি বললেন, আচ্ছা। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মজলিসে বসে পড়লেন। তারপর ফিরে গেলেন এবং চাদরটি ভাঁজ করে সেই ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তখন উপস্থিত লোকজন তাকে বলল, তুমি ভালো করনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাদরটি এমনভাবে পরেছিলেন, যেন তাঁর সেটির প্রয়োজন রয়েছে। তারপর তুমি সেটি তাঁর কাছে চাইলে। অথচ তোমার জানা আছে, কেউ কিছু চাইলে তিনি তাকে ফিরিয়ে দেন না। লোকটি বলল, আল্লাহর কসম! আমি চাদরটি পরিধান করার জন্য তাঁর কাছে চাইনি। আমি এটি চেয়েছি কেবল এজন্য, যাতে (মৃত্যুর পর) এটি আমার কাফন হয়। হযরত সাহল রাযি. বলেন, সেটি তার কাফনই হয়েছিল। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ১২৭৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১১৬; মুসনাদে আহমাদ: ২২৮২৫: সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৫৫৫; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ৯৫৮০: খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ৬০৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৮৮৭: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৫৮২৪)
مقدمة الامام النووي
62 - باب الإيثار والمواساة
566 - وعن سهل بن سعدٍ - رضي الله عنه: أنَّ أمْرَأةً جَاءَتْ إِلَى رسول الله - صلى الله عليه وسلم - بِبُرْدَةٍ مَنْسُوجَةٍ، فَقَالَتْ: نَسَجْتُها بِيَدَيَّ لأَكْسُوكَهَا، فَأَخَذَهَا النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم - مُحْتَاجًا إِلَيْهَا، فَخَرَجَ إِلَيْنَا وَإنَّهَا إزَارُهُ، فَقَالَ فُلانٌ: اكْسُنِيهَا مَا أحْسَنَهَا! فَقَالَ: «نَعَمْ» فَجَلَسَ النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم - في المَجْلِسُ، ثُمَّ رَجَعَ فَطَواهَا، ثُمَّ أرْسَلَ بِهَا إِلَيْهِ: فَقَالَ لَهُ الْقَومُ: مَا أحْسَنْتَ! لَبِسَهَا النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم - مُحتَاجًا إِلَيْهَا، ثُمَّ سَألْتَهُ وَعَلِمْتَ أنَّهُ لا يَرُدُّ سَائِلًا، فَقَالَ: إنّي وَاللهِ مَا سَألْتُهُ لألْبِسَهَا، إنَّمَا سَألْتُهُ لِتَكُونَ كَفنِي. قَالَ سَهْلٌ: فَكَانَتْ كَفَنَهُ. رواه البخاري. (1)
হাদীস নং: ৫৬৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৬২ অন্যের জন্য স্বার্থত্যাগ ও সহমর্মিতা
পারস্পরিক সহমর্মিতা প্রকাশের এক উত্তম পন্থা
হাদীছ নং: ৫৬৭

হযরত আবূ মূসা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আশ‘আর গোত্রীয় লোকজন যুদ্ধকালে তাদের রসদ ফুরিয়ে গেলে কিংবা মদীনায় তাদের পরিবার-পরিজনের খাদ্য কমে গেলে তাদের যার কাছে যা থাকে তা একটি কাপড়ে একত্র করে। তারপর একটি পাত্র দ্বারা মেপে তা সকলের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করে নেয়। তারা আমার এবং আমি তাদের। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী : ২৪৮৬; সহীহ মুসলিম: ২৫০০; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৮৭৪৭; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৭৩০৯: বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০৪৩৬)
مقدمة الامام النووي
62 - باب الإيثار والمواساة
567 - وعن أَبي موسى - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «إنَّ الأشْعَرِيِّينَ إِذَا أرْمَلُوا في الغَزْوِ، أَوْ قَلَّ طَعَامُ عِيَالِهِمْ بالمَديِنَةِ، جَمَعُوا مَا كَانَ عِنْدَهُمْ في ثَوْبٍ وَاحِدٍ، ثُمَّ اقْتَسَمُوهُ بَيْنَهُمْ في إنَاءٍ وَاحدٍ بالسَّوِيَّةِ، فَهُمْ مِنِّي وَأنَا مِنْهُمْ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
«أرْمَلُوا»: فَرَغَ زَادُهُمْ أَوْ قَارَبَ الفَرَاغَ.
হাদীস নং: ৫৬৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ পরকালীন বিষয়ে প্রতিযোগিতা করা এবং বরকতপূর্ণ জিনিস যত বেশি পারা যায় অর্জনের চেষ্টা করা
اَلتّنافُسُ শব্দটির উৎপত্তি اَلْمُنافَسَةُ থেকে, যার অর্থ কোনও বস্তুর প্রতি আগ্রহ এবং একা তা অর্জন করতে চাওয়া। উৎকৃষ্ট ও দামি বস্তুর ক্ষেত্রেই এটা হয়ে থাকে। সত্যিকারের উৎকৃষ্ট ও দামি বস্তু হল আখিরাতের নি‘আমতসমূহ। সে তুলনায় দুনিয়ার বস্তুরাজি লোকে যতই দামি মনে করুক, প্রকৃতপক্ষে তা নিতান্তই তুচ্ছ। প্রকৃত দামি ও উৎকৃষ্ট যখন আখিরাতের নি'আমত, তখন সে নি'আমত অর্জনের জন্য যা-কিছু করা হয় তাও দামি হয়ে যায়। সুতরাং প্রতিটি সৎকর্মই অত্যন্ত দামি। তাহলে দামি বিষয় দাঁড়াল দু'টি- এক হচ্ছে আখিরাতের নি'আমত, আর দ্বিতীয় সে নি'আমত অর্জনের উপায়সমূহ। এ দু'টি বিষয়ই যখন উৎকৃষ্ট ও দামি, তখন মানুষের কর্তব্য কেবল এরই প্রতি আকৃষ্ট থাকা এবং যতবেশি সম্ভব এসব অর্জনের চেষ্টা করা।
এ অধ্যায়টির মূল উদ্দেশ্য আখিরাতের নি'আমত তথা জান্নাতলাভের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করা এবং যেসব উপায়ে তা অর্জন করা যায় তার প্রতি উৎসাহ যোগানো। অর্থাৎ মানুষের কর্তব্য আখিরাতের বিষয়াবলি অর্জনের জন্য লালায়িত হওয়া। তা যেহেতু লাভ করা যায় সৎকর্ম দ্বারা, তাই মানুষের আরও কর্তব্য কে কারচে' বেশি সৎকর্ম করতে পারে সে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া।
প্রকাশ থাকে যে, জান্নাতলাভ ও সৎকর্মের প্রতি উৎসাহ-উদ্দীপনার প্রাণবস্তু হল আল্লাহপ্রেম। আল্লাহ তা'আলার প্রকৃত বান্দাদের প্রাণের ভালোবাসা কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই নিবেদিত থাকে। আর তা থাকে বলে আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে যা-কিছুর সম্পর্ক আছে, সেগুলোকেও তারা ভালোবাসে। সে ভালোবাসা আল্লাহপ্রেমের কারণেই। সুতরাং তারা ভালোবাসে নবী-রাসূলগণকে। ভালোবাসে আল্লাহর ঘর কা'বা ও মসজিদসমূহকে। ভালোবাসে আল্লাহর ওলীদেরকে। তারা ভালোবাসে আল্লাহর কালাম। এমনকি তারা ভালোবাসে আল্লাহর কুলমাখলুককেও। তারা আল্লাহর মাখলুক বলেই সে ভালোবাসা। তারা আল্লাহকে ভালোবাসে বলে যা-কিছুর প্রতি আল্লাহ তা'আলার বিশেষ দৃষ্টি থাকে, যা-কিছুতে তাঁর রহমতের স্পর্শ থাকে, সেগুলোকেও তারা ভালোবাসে এবং সেগুলোকে আলাদা মর্যাদার চোখে দেখে। একে আমরা 'বরকত' শব্দেও ব্যক্ত করে থাকি। এ বরকত বলতে কল্যাণময়তা ও মর্যাদাসম্পন্নতা বোঝানো উদ্দেশ্য। যা-কিছুতে এ জাতীয় বরকত থাকে, তা যতবেশি সম্ভব অর্জন করে নেওয়া চাই। এতে দোষ তো নেই-ই; বরং ইসলামের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয় কাজ বলেই গণ্য। এ অধ্যায়ে বরকতপূর্ণ বিষয় বেশি বেশি অর্জনে উৎসাহ দেওয়াও উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে ইমাম নাওয়াবী রহ. একটি আয়াত ও দু'টি হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন, যদিও এ বিষয়ে বহু আয়াত ও হাদীছ আছে।

‘পরকালীন বিষয়ে প্রতিযোগিতা…’ সম্পর্কিত একটি আয়াত

وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ (26)
অর্থ: এটাই এমন জিনিস, লুব্ধজনদের উচিত এর প্রতি অগ্রগামী হয়ে লোভ প্রকাশ করা।(সূরা মুতাফফীফীন (৮৩), আয়াত ২৬)

ব্যাখ্যা
এর আগের আয়াতসমূহে পুণ্যবানদের স্থায়ী ঠিকানা জান্নাত ও জান্নাতের নি'আমতসমূহের খানিকটা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তারপর এ আয়াতে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, যারা কোনও লোভনীয় বিষয়ে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে চায়, তারা এ জান্নাত ও তার নি'আমতসমূহ লাভের লক্ষ্যে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হোক।
পার্থিব ভোগসামগ্রীতে প্রতিযোগিতা নিষেধ। তাতে প্রতিযোগিতা করার দ্বারা আমল-আখলাক নষ্ট হয়। মানুষের লোভ ও চাহিদা অনেক বড়। সে তুলনায় ভোগসামগ্রী নিতান্তই কম। সেই অল্প ভোগসামগ্রীতে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলে কাড়াকাড়ি-হানাহানি অনিবার্য। নিজের ভোগলালসা মেটানোর জন্য প্রত্যেকেই চাইবে সবটা সম্পদ একা হস্তগত করতে। আর তাতে যখন বাধা আসবে, তখন জোরজুলুমের আশ্রয় নেবে। বাস্তবে তাই হচ্ছে। দুনিয়ায় হাজারও পাপাচার এ প্রতিযোগিতার পথ ধরেই বিস্তার লাভ করছে। তাই এ প্রতিযোগিতা নিন্দনীয়। এটা আল্লাহ তা'আলা পসন্দ করেন না। কুরআন ও হাদীছ মানুষকে এর থেকে বিরত থাকতে আদেশ করেছে।
পক্ষান্তরে পরকালীন নাজাত ও মুক্তি এবং জান্নাতলাভের উদ্দেশ্যে যে প্রতিযোগিতার কথা বলা হয়েছে তা একটি প্রশংসনীয় কাজ। কেননা তা হানাহানি সৃষ্টি করে না। তা মানুষকে স্বার্থত্যাগে উৎসাহ যোগায়। সে প্রতিযোগিতা মানুষকে পরোপকারী করে তোলে। তা মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিকাশ ঘটায়। তাতে মানুষ সৎকর্মে অনুপ্রাণিত হয়। তাই আয়াত হুকুম করছে- তোমরা জান্নাতলাভের জন্য লালায়িত হও। সে লোভ পূরণে বেশি বেশি সৎকর্ম করো। কে কারচে' বেশি সৎকর্ম করতে পার, সে প্রতিযোগিতায় লেগে পড়ো। প্রতিযোগিতা যদি কোনওকিছু নিয়ে করতে চাও, তবে এ নিয়েই করো। এটাই সত্যিকারের প্রতিযোগিতার বিষয়।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. পার্থিব ভোগসামগ্রী অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে নেই।
খ. পরকালীন সাফল্য লাভে প্রতিযোগিতা করা প্রশংসনীয় কাজ।
গ. পরকালীন সাফল্য লাভ হয় সৎকর্ম দ্বারা। তাই দরকার সৎকর্মে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা।
বরকতপূর্ণ বিষয় অর্জনে নিজ অধিকার রক্ষা করতে চাওয়া
হাদীছ নং: ৫৬৮

হযরত সাহল ইবন সা‘দ রাযি. থেকে বর্ণিত, (একবার) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিছু পানীয় নিয়ে আসা হল। তিনি তা থেকে পান করলেন। তাঁর ডানদিকে ছিল এক বালক এবং তাঁর বামদিকে ছিল কয়েকজন বৃদ্ধ। তিনি বালকটিকে বললেন, তুমি কি এদেরকে দেওয়ার অনুমতি আমাকে দেবে? বালকটি বলল, না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম! আপনার কাছ থেকে পাওয়া আমার অংশে আমি কাউকে অগ্রাধিকার দেব না। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাতে সজোরে তা রাখলেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৫৬২০; সহীহ মুসলিম: ২০৩০; মুআত্তা মালিক: ৩৪২৯; মুসনাদে আহমাদ: ২২৮২৪; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৬৮৩৯; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫৩৩৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৭৬৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৪৬৬৮)
مقدمة الامام النووي
63 - باب التنافس في أمور الآخرة والاستكثار مما يتبرك بِهِ
قَالَ الله تَعَالَى: {وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ} [المطففين: 26].
568 - وعن سَهْلِ بن سَعدٍ - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - أُتِيَ بِشَرابٍ، فَشَرِبَ مِنْهُ وَعَنْ يَمِينِهِ غُلاَمٌ، وَعَنْ يَسَارِهِ الأشْيَاخُ، فَقَالَ لِلغُلاَمِ: «أتَأَذَنُ لِي أَنْ أُعْطِيَ هؤُلاء؟» فَقَالَ الغُلامُ: لاَ وَاللهِ يَا رسولَ الله، لاَ أُوْثِرُ بِنَصِيبي مِنْكَ أحَدًا. فَتَلَّهُ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - في يَدِهِ. متفقٌ عَلَيْهِ (1).
«تَلَّهُ» بالتاءِ المثناة فوق: أيْ وَضَعَهُ. وَهذَا الغُلامُ هُوَ ابنُ عَبَّاسٍ رضي الله عنهما.
হাদীস নং: ৫৬৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৬৩ পরকালীন বিষয়ে প্রতিযোগিতা করা এবং বরকতপূর্ণ জিনিস যত বেশি পারা যায় অর্জনের চেষ্টা করা
হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম ও সোনার ফড়িং
হাদীছ নং: ৫৬৯

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম বিবস্ত্র হয়ে গোসল করছিলেন। এ অবস্থায় তাঁর উপর সোনার ফড়িং পতিত হয়। তিনি তা নিজ কাপড়ের ভেতর কুড়িয়ে নিতে লাগলেন। তখন তাঁর মহান প্রতিপালক তাঁকে ডেকে বললেন, হে আইয়ূব! তুমি যা দেখছ তা থেকে আমি কি তোমাকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করিনি? তিনি বললেন, আপনার মহিমার শপথ! অবশ্যই করেছেন। কিন্তু আপনার বরকত থেকে আমার প্রয়োজন মিটে যাওয়ার নয়। -বুখারী
(সহীহ বুখারী : ২৭৯: সুনানে নাসাঈ: ৪০৯; মুসনাদে আহমাদ: ৮১৫৯; সহীহ ইবন হিব্বান: ৬২২৯: বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৯৫৮)
مقدمة الامام النووي
63 - باب التنافس في أمور الآخرة والاستكثار مما يتبرك بِهِ
569 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - عن النبي - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «بَيْنَا أيُّوبُ - عليه السلام - يَغْتَسِلُ عُرْيَانًا، فَخَرَّ عَلَيْهِ جَرَادٌ مِنْ ذَهَبٍ، فَجَعَلَ أيُّوبُ يَحْثِي في ثَوْبِهِ، فَنَادَاهُ رَبُّهُ - عز وجل: يَا أيُّوبُ، ألَمْ أكُنْ أَغْنَيتُكَ عَمَّا تَرَى؟! قَالَ: بَلَى وَعِزَّتِكَ وَلَكِنْ لاَ غِنى بِي عن بَرَكَتِكَ». رواه البخاري. (1)
হাদীস নং: ৫৭০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ কৃতজ্ঞ ধনীর মর্যাদা, যে কিনা সম্পদ অর্জন করে শরী‘আত-নির্দেশিত পন্থায় এবং ব্যয়ও করে শরী‘আত-নির্দেশিত স্থানসমূহে
এ অধ্যায়টি কৃতজ্ঞ ধনীর মর্যাদা সম্পর্কে। কৃতজ্ঞ ধনীর মূল বৈশিষ্ট্য দু'টি। প্রথমত সে অর্থ উপার্জন করে বৈধ পন্থায়। দ্বিতীয়ত সে অর্থব্যয় করে কেবল এমনসব খাতে, যা শরী'আত অনুমোদন করে। অর্থ বৈধ পন্থায় উপার্জন করা জরুরি। কেননা তার প্রকৃত মালিক আল্লাহ তা'আলা। মালিক যেহেতু আল্লাহ তা'আলা, তাই তাঁর কাছ থেকে নিতে হবে তাঁর অনুমতিক্রমেই। দুনিয়াবী দৃষ্টিতেও কোনও সম্পদ তার মালিকের অনুমতি ছাড়া নেওয়া যায় না। নেওয়াটা অপরাধ। তেমনি সারা জাহানের সবকিছুর মালিক যেহেতু আল্লাহ তা'আলা, তাই তা থেকে যে যা নিতে চাইবে তা আল্লাহ তা'আলার অনুমতিক্রমেই নিতে হবে। শরী'আতের বিধান হল আল্লাহ তা'আলার অনুমতিপত্র। শরী'আত মোতাবেক অর্থ উপার্জন করাই আল্লাহ তা'আলার অনুমতিক্রমে উপার্জন করা। এভাবে উপার্জন করার দ্বারা আল্লাহ তা'আলার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। তাঁর থেকে নেওয়া হয় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। এ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে বান্দা যেন মনের এই ভাব প্রকাশ করছে যে, হে আল্লাহ! তুমি কতইনা দয়াময়! তুমি আমার প্রয়োজনে এতকিছুর আয়োজন করেছ, আবার এসব গ্রহণ ও ভোগ করার জন্য অতি সুন্দর ব্যবস্থাও আমাকে দান করেছ! তোমাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।
বৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জনের পর তা ব্যয়ও করতে হবে বৈধ খাতে। এটা কৃতজ্ঞতার দ্বিতীয় ধাপ। আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দাবি হল সে সম্পদ কোনও অবৈধ কাজে ব্যবহার করা হবে না। সে সম্পদকে কোনও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণ বানানো হবে না। বরং তাকে আল্লাহ তা'আলার মর্জিমতো খরচ করা হবে এবং তার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা হবে। তা সম্ভব হয় কেবল তখনই, যখন সম্পদকে শরী'আতসম্মত খাতে ব্যয় করা হয়। যে ব্যক্তি তার অর্জিত সম্পদ এভাবে ব্যয় করে, সম্পদের ক্ষেত্রে সে কৃতজ্ঞ বলে গণ্য হয়। এরূপ ব্যক্তিকে আল্লাহ পসন্দ করেন। আল্লাহ তা'আলা চান বান্দা তাঁর দেওয়া নি'আমতের কৃতজ্ঞতা আদায় করুক। কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে এর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অকৃতজ্ঞদের জন্য ঘোষিত হয়েছে কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী।
সম্পদ সকলেরই কিছু না কিছু থাকে। তাই এ ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কর্তব্যও সকলের উপরই বর্তায়। যার সম্পদ যত বেশি, কৃতজ্ঞতাও তার ততো বেশিই আদায় করা কর্তব্য। যে ব্যক্তি তা আদায় করতে সক্ষম হয়, সে আল্লাহ তা'আলার কাছে অতি উচ্চমর্যাদার অধিকারী হয়। বলাবাহুল্য যার সম্পদ যত বেশি, তার পক্ষে উচ্চমর্যাদা অর্জনের সুযোগও ততো বেশি। সে অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগীর পাশাপাশি যদি তার সম্পদের যথার্থ ব্যবহার করে, তবে তার পক্ষে এত উচ্চতায় পৌঁছা সম্ভব, যেখানে কোনও গরীবের পক্ষে পৌঁছা সম্ভব নয়। এটা কঠিন বটে, যেহেতু মানবকল্যাণ ও দীনের চাহিদাপূরণে অকৃপণভাবে অর্থব্যয় করতে গেলে লোভ সংবরণ করতে হয় এবং নিজের নফসকে দমন করতে হয়। নিঃসন্দেহে তা কঠিন সাধনা ও মুজাহাদার বিষয়। তা যতই কঠিন হোক না কেন, আল্লাহ তা'আলার প্রতি যারা কৃতজ্ঞ, সেই মহান ব্যক্তিবর্গ সে সাধনায় ঠিকই উতরে যায়। আমাদের ইতিহাসে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি., হযরত উছমান ইবন আফফান রাযি., হযরত আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযি., হযরত যুবায়র ইবনুল আউওয়াম রাযি. প্রমুখ মহান সাহাবীগণ তো বটেই, তাঁদের পরেও তাবি'ঈন, তাবে-তাবি'ঈন এবং তাদেরও পরবর্তীকালের বহু আল্লাহপ্রেমিক ও শোকরগুযার ধনী লোক ছিলেন, যাঁরা নিজ অর্থ-সম্পদ আল্লাহর পথে অকাতরে বিলিয়ে দেওয়ার নজির স্থাপন করে গেছেন। তাঁরা সর্বকালের বিত্তবানদের জন্য আল্লাহর পথে অর্থব্যয়ের অনুপ্রেরণা। সম্পদ তো মানবজীবনের কল্যাণের জন্যই। পরকালের কল্যাণই প্রকৃত কল্যাণ। সে লক্ষ্যে যে ব্যক্তি নিজ সম্পদ ব্যয় করে, সে প্রকৃত শোকরগুযার। মানুষ যাতে সেরকম শোকরগুযার বান্দারূপে গড়ে ওঠে, সে লক্ষ্যে কুরআন মাজীদের বহু আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু হাদীছে অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়েছে। এ অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই।

‘কৃতজ্ঞ ধনীর মর্যাদা…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত
فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى (5) وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى (6) فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى (7)
অর্থ: সুতরাং যে ব্যক্তি (আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ) দান করেছে ও তাকওয়া অবলম্বন করেছে এবং সর্বোত্তম বিষয় মনে-প্রাণে স্বীকার করে নিয়েছে, আমি তাকে স্বস্তিময় গন্তব্যে পৌঁছার ব্যবস্থা করে দেব।(সূরা লায়ল (৯২), আয়াত ৫-৭)
‘ব্যবস্থা করে দেওয়া’-এর অর্থ, আল্লাহ তাআলা এমন আমলের তাওফীক দেবেন, যার বদৌলতে জান্নাতে পৌছা যাবে।
প্রকাশ থাকে যে, কুরআন মাজীদে ব্যবহৃত نُيَسِّرُهُ শব্দের অর্থ যে করা হয়েছে ‘ব্যবস্থা করে দেওয়া’, তা করা হয়েছে আল্লামা আলুসী (রহ.)-এর ব্যাখ্যার অনুসরণে। দেখুন (রূহুল মাআনী, ৩০ : ৫১২)। -তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন থেকে সংগৃহীত।

ব্যাখ্যা
এগুলো সূরা লায়লের আয়াত। এ আয়াত তিনটিতে দান-খয়রাত, তাকওয়া- পরহেযগারী ও ঈমানের পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি দান-খয়রাত করে ও তাকওয়া অবলম্বন করে। দান-খয়রাত বলতে যেমন অর্থ-সম্পদ দান করাকে বোঝায়, তেমনি আল্লাহ তা'আলাকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে শারীরিক শক্তি দ্বারা মানুষের উপকার করা, মানুষকে সুপরামর্শ দেওয়া, ইলম ও বিদ্যা-বুদ্ধি বিস্তার করা সবই এর অন্তর্ভুক্ত। যার যে সামর্থ্য আছে, সে যদি তা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে উপযুক্ত স্থানে ব্যয় করে, তার ক্ষেত্রেই এ আয়াত প্রযোজ্য হবে।
তাকওয়া অবলম্বনের অর্থ হল আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা হতে বিরত থাকা। কাজেই কুফর ও শিরক পরিহার করা, সগীরা ও কবীরা গুনাহ বর্জন করা, প্রকাশ্য ও গুপ্ত সকল পাপ থেকে বেঁচে থাকা, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার প্রভৃতি আত্মিক ব্যাধি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা- এ সবই তাকওয়ার অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয় আয়াতে সর্বোত্তম বিষয় মনে-প্রাণে স্বীকার করে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সর্বোত্তম বিষয় (الْحُسْنَى) বলতে কী বোঝানো হয়েছে, এ সম্পর্কে মুফাসসিরগণ বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। কেউ বলেন এর মানে কালেমা তায়্যিবা। কেউ বলেন জান্নাত। কেউ বলেন, আল্লাহ তা'আলার প্রতিশ্রুত পুরস্কার। সবগুলোই কাছাকাছি। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কেননা কালেমা তায়্যিবার বিশ্বাস জান্নাতলাভের উপায়। আর জান্নাত আল্লাহ তা'আলার প্রতিশ্রুত পুরস্কার। কালেমা, জান্নাত ও পরকালীন পুরস্কারে উপর বিশ্বাস রাখার অর্থ ঈমানওয়ালা হওয়া। তো যে ব্যক্তি ঈমানের অধিকারী হবে আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করবে এবং তাকওয়ার পথে চলবে, তার জন্য তৃতীয় আয়াতে পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে-
فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى (আমি তাকে স্বস্তিময় গন্তব্যে পৌঁছার ব্যবস্থা করে দেব)। الْيُسْرَى -এর দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে, তা নিয়েও বিভিন্ন মত আছে। অনেকের মতে এর দ্বারা জান্নাত বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ যে ব্যক্তি উপরিউক্ত তিন গুণের অধিকারী হবে, আল্লাহ তা'আলা তাকে জান্নাতে পৌঁছে দিবেন, যা সকল দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত স্বস্তিময় ও চিরসুখের গন্তব্যস্থান। কেউ বলেন এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য জান্নাতলাভের উপায়- উপকরণ। অর্থাৎ উল্লিখিত তিন গুণ যে ব্যক্তি অর্জন করতে সক্ষম হবে, তার জন্য আল্লাহ তা'আলা সৎকর্মসমূহ সহজ করে দেবেন। তার অন্তরে সৎকাজের প্রতি আগ্রহ জন্মাবে এবং সৎকর্ম করতে তার ভালো লাগবে। ফলে সে ব্যক্তি নিরবচ্ছিন্নভাবে সৎকর্মে নিয়োজিত থেকে চিরসুখের জান্নাতের অধিকারী হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে উভয় ব্যাখ্যার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই।
আয়াতে জান্নাতকে পরকালীন পুরস্কাররূপে ঘোষণা করা হয়েছে এবং কীভাবে তা পাওয়া যাবে তার উপায়ও শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় বান্দা জান্নাতলাভে উৎসাহী হোক, এটা আল্লাহ তা'আলার কাম্য। আল্লাহ তা'আলা বিভিন্ন আয়াতে আরও পরিষ্কারভাবেও এটা বলে দিয়েছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ (133)
‘এবং নিজ প্রতিপালকের পক্ষ হতে মাগফিরাত ও সেই জান্নাত লাভের জন্য একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও, যার প্রশস্ততা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতুল্য। তা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৩৩)

আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলা যাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন, তার কর্তব্য সে ক্ষমতাকে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে মানবকল্যাণে ব্যয় করা।
খ. তাকওয়া অবলম্বন করা তথা সর্বপ্রকার নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বেঁচে থাকা জান্নাতলাভের জন্য জরুরি।
গ. জান্নাতসহ যাবতীয় গায়েবী বিষয়ে বিশ্বাস রাখাই ঈমান। ঈমান জান্নাতের চাবিকাঠি।
ঘ. এ আয়াতসমূহে জান্নাতলাভের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যাবতীয় নেক আমলের বিনিময়ে অন্তরে জান্নাতলাভের আশা রাখা চাই।

দুই নং আয়াত
وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى (17) الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّى (18) وَمَا لِأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى (19) إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَى (20) وَلَسَوْفَ يَرْضَى (21)
অর্থ: এবং তা থেকে দূরে রাখা হবে পরম মুত্তাকীকে, যে আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য নিজ সম্পদ (আল্লাহর পথে) দান করে অথচ তার উপর কারও অনুগ্রহ ছিল না, যার প্রতিদান দিতে হতো। বরং সে (দান করে) কেবল তার মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টির প্রত্যাশায়। নিশ্চয়ই সে অচিরেই খুশি হয়ে যাবে।(সূরা লায়ল (৯২), আয়াত ১৭-২১)

ব্যাখ্যা
এখানে পাঁচটি আয়াত আছে। এগুলো সূরা লায়লের শেষের আয়াত। এ আয়াতগুলোতে উচ্চস্তরের মুত্তাকীর পরিচয় দান করা হয়েছে এবং আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তার জন্য যে পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে সেদিকেও ইশারা করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন- وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى (এবং তা থেকে দূরে রাখা হবে পরম মুত্তাকীকে)। অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এমন ব্যক্তিকে, যে আত্মার পরিশুদ্ধি ও প্রশান্তি অর্জন করেছে, প্রকাশ্য ও গুপ্ত শিরক থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছে, দৈহিক ও আত্মিক অবাধ্যতা পরিহার করেছে এবং মনের খেয়াল-খুশির বিরুদ্ধাচরণে কঠোরতা অবলম্বন করেছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, এর দ্বারা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-কে বোঝানো উদ্দেশ্য। তাফসীরকারকদের মতে তাঁকে উপলক্ষ্য করেই এ আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়েছে। এর দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, নবীগণের পর সমস্ত মানুষের মধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. শ্রেষ্ঠতম মুত্তাকী।
الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّى ‘যে আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য নিজ সম্পদ (আল্লাহর পথে) দান করে'। অর্থাৎ গরীব-দুঃখীর সাহায্য, দাসমুক্তি ও অন্যান্য কল্যাণকর খাতে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে কেবলই আত্মশুদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে। এই উদ্দেশ্যে, যাতে আল্লাহ তা'আলা তাকে প্রকাশ্য ও গুপ্ত সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র করে দেন। এসব কাজের পেছনে তার পার্থিব কোনও চাহিদা থাকে না। আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনই তার মুখ্য উদ্দেশ্য।
বর্ণিত আছে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. খুঁজে খুঁজে দুর্বল দাস ও দাসীদেরকে তাদের মনিবদের কাছ থেকে কিনে আযাদ করে দিতেন। একদিন তাঁর পিতা আবু কুহাফা রাযি. বলেছিলেন, তুমি তো শুধু দুর্বল দাস-দাসীদের মুক্ত করছ। যদি সবল দাসদের মুক্ত করতে, তবে তারা তোমার সাহায্য করতে পারত ও তোমার পাশে দাঁড়াতে পারত! তিনি এর উত্তর দিয়েছিলেন যে, আমি তো আল্লাহর নিকট যা আছে কেবল তাই কামনা করি।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. যেসকল গোলাম কিনে আযাদ করেছিলেন, তাদের মধ্যে হযরত বিলাল রাযি. সর্বাপেক্ষা বেশি পরিচিত। তিনি ছিলেন কুরায়শ সর্দার উমায়্যার মালিকানাধীন। ইসলামগ্রহণের অপরাধে উমায়্যা তাঁকে নির্মমভাবে শাস্তি দিত। দুপুরের প্রচণ্ড রোদে উত্তপ্ত বালুর উপর শুইয়ে দিত। বুকের উপর ভারী পাথর চাপা দিত। তারপর বলত, তুমি মুহাম্মাদকে অস্বীকার করলে ছাড়া পাবে, নয়তো মৃত্যু পর্যন্ত এরূপ শাস্তি দেওয়া হতে থাকবে। কিন্তু তাঁর মুখ থেকে কেবল 'আহাদ' 'আহাদ' উচ্চারিত হতো। একদিন হযরত বিলাল রাযি.-কে এভাবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছিল। এ অবস্থায় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি উমায়্যাকে বললেন, তুমি কি এই নিরীহ লোকটিকে রেহাই দেবে না? উমায়্যা বলল, তুমি চাইলে একে নিয়ে যেতে পার। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. বললেন, আচ্ছা, আমার কাছে আরেকটি গোলাম আছে। সে বেলালের চেয়ে হৃষ্টপুষ্ট ও শক্তিশালী। আমি তাকে দিয়ে বিলালকে তোমার কাছ থেকে নিয়ে নেব। উমায়্যা তাতে সম্মতি জানাল। 'নিসতাস' নামে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর একটি গোলাম ছিল। তিনি তাকে ইসলামগ্রহণের দাওয়াত দিয়েছিলেন। কিন্তু সে তাঁর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে ইসলামগ্রহণে রাজি করানো যায়নি। এ কারণে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তার প্রতি অসন্তোষ ছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. তাঁর সেই নিসতাস নামক গোলামটি উমায়্যাকে দিয়ে দিলেন এবং তার বিনিময়ে হযরত বিলাল রাযি.-কে নিয়ে নিলেন। তারপর তাঁকে মুক্ত করে দিলেন। তিনি এর আগে আরও ৬ জন গোলাম আযাদ করেছিলেন। হযরত বিলাল রাযি. ছিলেন ৭ম ব্যক্তি।
হযরত বিলাল রাযি.-কে আযাদ করে দিলে মুশরিকগণ বলতে লাগল, নিশ্চয়ই আবু বকরের প্রতি বিলালের কোনও অনুগ্রহ ছিল। তার প্রতিদানেই তিনি বিলালকে কিনে মুক্তিদান করেছেন। পরবর্তী আয়াতে এর জবাব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا لِأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى (অথচ তার উপর কারও অনুগ্রহ ছিল না, যার প্রতিদান দিতে হতো)। অর্থাৎ আবু বকর রাযি.-এর উপর বিলাল রাযি.-এর বা অন্য কোনও গোলামের কোনও অনুগ্রহ ছিল না যে, সেই অনুগ্রহের প্রতিদানস্বরূপ তাদেরকে মুক্তিদান করেছেন। বরং এ মুক্তিদানের উদ্দেশ্য কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভ। এটা ভিন্ন কথা যে, কেউ যদি কারও প্রতি অনুগ্রহ করে, তবে যথাসম্ভব তার প্রতিদান দেওয়া চাই। আর কিছু না পারলে অন্ততপক্ষে جَزَاكَ اللهُ (আল্লাহ তোমাকে এর বদলা দিন) বলে দু'আ করা চাই। কিন্তু যারা উচ্চস্তরের মুত্তাকী, তারা এ অপেক্ষায় থাকে না যে, কে কখন তার কোনও উপকার করবে এবং পরে সে তার বদলা দেবে। বরং তারা শুরুতেই পরোপকার করে থাকে। তাদের পরোপকার কোনওকিছুর বিনিময়ে নয়; বরং তা হয় স্বতঃস্ফূর্ত মহানুভবতা। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. এরকমেরই ছিলেন।
إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَى ‘বরং সে (দান করে) কেবল তার মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টির প্রত্যাশায়'। অর্থাৎ কোনও অনুগ্রহের প্রতিদানস্বরূপ নয়; বরং তিনি গরীব-দুঃখীর সাহায্য করেন কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের আশায়।
উল্লেখ্য, যদিও এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে উপলক্ষ্য করে, কিন্তু এর ভাষা ব্যাপক। যে-কোনও মুমিন-মুত্তাকীই এর আওতাভুক্ত। এতে যেসকল গুণের উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যেই তা পাওয়া যাবে তার জন্যই এর বক্তব্যসমূহ প্রযোজ্য হবে এবং শেষের আয়াতে যে পুরস্কারের প্রতি ইশারা করা হয়েছে তা লাভেরও সে উপযুক্ত বলে গণ্য হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَلَسَوْفَ يَرْضَى (নিশ্চয়ই সে অচিরেই খুশি হয়ে যাবে)। অর্থাৎ তার আমলের প্রতিদানে আল্লাহ তা'আলা আখিরাতে তাকে যে জান্নাত ও জান্নাতের অফুরন্ত নি'আমত দান করবেন, তাতে সে আল্লাহর প্রতি খুশি হয়ে যাবে। আয়াতটির এরকম অর্থও করা যায় যে, আল্লাহ তা'আলা তার আমলের বদৌলতে তার প্রতি খুশি হয়ে যাবেন এবং পুরস্কারস্বরূপ তাকে জান্নাতের অপরিমেয় নি'আমত দান করবেন।
প্রকাশ থাকে যে, শানে নুযূল হিসেবে এ আয়াতসমূহ সরাসরি প্রযোজ্য হয় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর প্রতি। এতে তাঁকে الْأَتْقَى (পরম মুত্তাকী বা শ্রেষ্ঠতম মুত্তাকী) বলা হয়েছে। অপরদিকে সূরা হুজুরাতে ইরশাদ হয়েছে- إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ (তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী)। উভয় আয়াত মেলানোর দ্বারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যেহেতু তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী। উম্মতের মধ্যে তিনি যে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান, এ বিষয়ে সকলের ইজমা' ও ঐকমত্য রয়েছে। হযরত উমর রাযি. বলতেন, আবূ বকর আমাদের নেতা। তিনি আমাদের আরেক নেতা (বিলাল রাযি.)-কে আযাদ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কাউকেই আবু বকরের সমতুল্য মনে করতাম না। হযরত আলী রাযি.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর শ্রেষ্ঠ মানুষ কে? তিনি উত্তরে বললেন, আবূ বকর। জিজ্ঞেস করা হল, তারপর? তিনি বললেন, উমর।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. তাকওয়া অবলম্বন করা জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়।
খ. প্রকৃত মুত্তাকী ব্যক্তি নিজ অর্থ-সম্পদ দীনের খেদমত ও মানবসেবায় ব্যয় করে।
গ. আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার দ্বারা আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয়।
ঘ. দীনের খেদমত ও মানবসেবায় অর্থব্যয়ের উদ্দেশ্য হতে হবে কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন।
ঙ. সঠিক খাতে অর্থব্যয় করলে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন এবং তার প্রতিদানে আল্লাহ তা'আলা বান্দাকেও খুশি করেন।
চ. হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. এ উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি।

তিন নং আয়াত
إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيِّئَاتِكُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ (271)
অর্থ : তোমরা দান-সদাকা যদি প্রকাশ্যে দাও, সেও ভালো। আর যদি তা গোপনে গরীবদেরকে দান কর তবে তা তোমাদের পক্ষে কতইনা শ্রেয়! এবং আল্লাহ তোমাদের মন্দকর্মসমূহের প্রায়শ্চিত্ত করে দেবেন। বস্তুত আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৭১)

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে দান-খয়রাত করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। জানানো হয়েছে, তা প্রকাশ্যেও করা যায়, গোপনেও করা যায়। উভয় অবস্থারই প্রশংসা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে এর উপকারিতাও তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমে ইরশাদ হয়েছে-
إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ (তোমরা দান-সদাকা যদি প্রকাশ্যে দাও, সেও ভালো)। অর্থাৎ উদ্দেশ্য যদি হয় কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন করা, মানুষকে দেখানো উদ্দেশ্য না থাকে, তবে প্রকাশ্যে দান করাতে কোনও দোষ নেই। বরং বিভিন্ন কারণে তা ভালো। যেমন এক কারণ হতে পারে তা দেখে অন্যরাও দান করতে উৎসাহী হবে। তাতে তাদের যেমন ছাওয়াব হবে, তেমনি যার দেখাদেখি তারা দান করল, সেও তাদের সমান ছাওয়াবের অধিকারী হবে। এমনিভাবে প্রকাশ্যে দান করার দ্বারা ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের কুধারণা থেকেও বাঁচা যায়। কেননা যাকাত যদি প্রকাশ্যে দেওয়া না হয়, তবে কেউ সন্দেহ করতে পারে সে বুঝি যাকাত দেয়ই না। এতে নিজের দীনী মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। নিজ মর্যাদা রক্ষা করাও জরুরি। তারপর গোপনে দান করা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ (আর যদি তা গোপনে গরীবদেরকে দান কর তবে তা তোমাদের পক্ষে কতইনা শ্রেয়)! বোঝা যাচ্ছে গোপনে দান করাটাই বেশি ভালো। এর দ্বারা রিয়া থেকে বাঁচা যায়। আমলে ইখলাস রক্ষা করা খুব জরুরি। কিন্তু কাজটা খুব সহজ নয়। মন খুব চায় মানুষ জানুক। মানুষ জানলে সুনাম-সুখ্যাতিলাভের আগ্রহ জন্মায়। সুনাম-সুখ্যাতির উদ্দেশ্যে আমল করাটা ইখলাসের পরিপন্থী। আমলে ইখলাস না থাকলে আল্লাহ তা'আলার কাছে তার কোনও মূল্য থাকে না। এ হিসেবে প্রকাশ্যে দান করার চেয়ে গোপনে দান করাটা বেশি নিরাপদ। ইখলাসের অনুকূল হওয়ায় এটাই বেশি ভালো। তাছাড়া গোপনে দান করার দ্বারা যাকে দেওয়া হয় তার পক্ষেও ভালো। কেননা তাতে তার সম্মান রক্ষা পায়। প্রকাশ্যে অন্যের দান-খয়রাত গ্রহণ করার দ্বারা সম্মানহানি ঘটে। সুতরাং বহু হাদীছে গোপনে দান করার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেমন এক হাদীছে হাশরের ময়দানে যে সাত ব্যক্তি আল্লাহর রহমতের ছায়া পাবে, তাদের মধ্যে একজন হল-
وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ
‘ওই ব্যক্তি, যে কোনও দান-সদাকা করে, আর সে তা এমনভাবে গোপন করে যে, তার বাম হাত জানে না ডান হাত কী ব্যয় করে।(সহীহ বুখারী: ৬৬০; সহীহ মুসলিম: ১০৩১; সুনানে নাসাঈ: ৫৩৮০; জামে তিরমিযী: ২৩৯১; মুসনাদে আহমাদ: ৯৬৬৫; সহীহ ইবনে খুজায়মা ৩৫৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৪৮৬)
অপর এক হাদীছে তিন ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তাদেরকে আল্লাহ তা'আলা ভালোবাসেন। তাদের মধ্যে একজন হল-
فرجل أتى قوما فسألهم بالله ولم يسألهم بقرابة بينه وبينهم فمنعوه فتخلف رجل بأعيانهم فأعطاه سرا لا يعلم بعطيته إلا الله والذي أعطاه
‘এক ব্যক্তি কোনও একদল লোকের কাছে গিয়ে আল্লাহর নামেই সাহায্য চাইল, তার এবং তাদের মধ্যকার কোনও আত্মীয়তার ভিত্তিতে নয়। কিন্তু তারা তাকে দিল না। তখন তাদের মধ্য হতে এক ব্যক্তি পেছনে সরে আসল এবং গোপনে তাকে দিল, যা আল্লাহ এবং যাকে সে দিল সে ছাড়া কেউ জানে না।(জামে' তিরমিযী: ২৫৬৮; সুনানে নাসাঈ ১৬১৫; মুসনাদুল বাযযার: ৪০২৭; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১৩১৬; সহীহ ইবন খুযায়মা ২৪৫৬; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩৩৪৯)
এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোপনে দান করার ফযীলত সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-
صَدَقَةُ السِّرِّ تُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ، وَصِلَةُ الرَّحِمِ تَزِيدُ فِي الْعُمُرِ، وَفِعْلُ الْمَعْرُوْفِ بَقِي مَصَارِعَ السُّوْءِ
‘গোপন দান রাব্বুল আলামীনের ক্রোধ নিভিয়ে দেয়। আত্মীয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার আয়ু বৃদ্ধি করে। জনকল্যাণমূলক কাজ অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে।(শু'আবুল ঈমান: ৩১৬৮; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৯৪৩)
উলামায়ে কেরামের অনেকেই বলেন, নফল দান-খয়রাত গোপনে করা ভালো এবং ফরয দান প্রকাশ্যে করা ভালো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, নফল দান-খয়রাত প্রকাশ্যে করা অপেক্ষা গোপনে করলে সত্তর গুণ বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়। আর ফরয দান (যেমন যাকাত) গোপনে না করে প্রকাশ্যে করলে পঁচিশ গুণ বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়। সকল ফরয ও নফল ইবাদতের বেলায়ই এ নিয়ম। এক হাদীছ দ্বারাও এর সমর্থন মেলে। ইরশাদ হয়েছে-
فَصَلُّوا أَيُّهَا النَّاسُ فِي بُيُوتِكُمْ، فَإِنَّ أَفْضَلَ الصَّلَاةِ صَلَاةُ الْمَرْءِ فِي بَيْتِهِ إِلَّا الْمَكْتُوبَةَ
‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের ঘরে নামায পড়ো। কেননা শ্রেষ্ঠ নামায ওই নামায, ব্যক্তি যা নিজ ঘরে পড়ে। তবে ফরয নামায ছাড়া।(সহীহ বুখারী: ৭৩১; সহীহ মুসলিম: ৭৮১; সুনানে আবূ দাউদ: ১০৪৪; সুনানে নাসাঈ: ১৫৯৯; তহাবী, শারহু মাআনিল আছার: ২০৫৭; সহীহ ইবন হিব্বান: ২৪৯১)

অতঃপর আল্লাহ তা'আলা দান-খয়রাত করার উপকার সম্পর্কে ইরশাদ করেন- وَيُكَفِّرُ عَنكُم مِّن سَيِّئَاتِكُمْ (এবং আল্লাহ তোমাদের মন্দকর্মসমূহের প্রায়শ্চিত্ত করে দেবেন)। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে দান-খয়রাত করলে আল্লাহ তা'আলা তার বিনিময়ে বান্দার পাপ ক্ষমা করেন, তাতে দান-খয়রাত প্রকাশ্যে করা হোক বা গোপনে। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الْخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ الْمَاءُ النَّارَ
‘দান-খয়রাত গুনাহ (-এর আগুন) নিভিয়ে দেয়, যেমন পানি আগুন নেভায়।’(জামে' তিরমিযী: ৬১৪; সুনানে ইবন মাজাহ ৩৯৭৩; জামে' মা'মার ইবন রাশিদ: ২১০১৭; মুসনাদুল বাযযার: ৬২১২; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ১১৩৩০; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ১৯৯৯)
وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ (বস্তুত আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে পূর্ণ অবগত)। অর্থাৎ তোমরা গোপনে দান করলে আর কেউ না জানলেও আল্লাহ তা'আলা ঠিকই জানেন। এমনিভাবে তোমরা যে দান-খয়রাত কর, তা কী মনোভাব নিয়ে কর, তাও আল্লাহ তা'আলা জানেন। তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী দানের পরিমাণ সম্পর্কেও তিনি পূর্ণ অবহিত। মোটকথা দান-খয়রাত সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে তিনি সম্যক জ্ঞাত। সেই হিসেবে তিনি তোমাদেরকে দান-খয়রাতের প্রতিদান দেবেন।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. ইখলাসের সঙ্গে প্রকাশ্যে দান করাও ভালো। তার বহুবিধ ফায়দা আছে।
খ. গোপনে দান করা ইখলাস রক্ষার পক্ষে বেশি নিরাপদ। তাই এটাই শ্রেয়।
গ. গোপনে দান করার দ্বারা গ্রহীতার সম্মান রক্ষা হয়। এটা বিবেচনায় রাখা দরকার।
ঘ. দান-খয়রাতের একটা বড় ফায়দা হল এর দ্বারা গুনাহ মাফ হয়।
ঙ. আল্লাহ তা'আলা বান্দার আমল সম্পর্কে পূর্ণ খবর রাখেন। তাই আমল সর্বপ্রযত্নে করা চাই।

চার নং আয়াত
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ (92)
অর্থ: তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে। তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ৯২)

ব্যাখ্যা
الْبِرّ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন সদ্ব্যবহার, অনুগ্রহ, সৎকর্ম, পুণ্য, জান্নাত, পুরস্কার, সততা ও আনুগত্য। সাধারণত এর দ্বারা পরিপূর্ণরূপে অন্যের হক আদায় করা বোঝানো হয়, যা দ্বারা নিজ দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গরূপে সম্পন্ন হয়ে যায়। এভাবে দায়িত্ব পালনকারীকে بر এবং বহুবচনে أَبْرَارٌ বলা হয়। শব্দটি কখনও বান্দার কাজ হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এবং কখনও আল্লাহর কাজ হিসেবেও। বান্দার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে তখন এর অর্থ হবে আনুগত্য, সততা, অনুগ্রহ ইত্যাদি। আর আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে অর্থ হবে সন্তুষ্টি, রহমত ও জান্নাত। কুরআন মাজীদে এ শব্দের বহুল ব্যবহার আছে। এখানে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ (তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না)। এস্থলে الْبِرّ দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য, সে সম্পর্কে মুফাস্সিরগণ বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কারও মতে এর দ্বারা পূর্ণাঙ্গ ছাওয়াব ও প্রতিদান বোঝানো হয়েছে। কেউ বলেন রহমত, কেউ বলেন জান্নাত। এছাড়া যে-কোনও কল্যাণ, আনুগত্য, তাকওয়া, আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি, সত্য ও সততা ইত্যাদি ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। এর সবগুলোই সৎকর্ম বা সৎকর্মের প্রতিদান।
তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না... কথাটির মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে- পুণ্যলাভের চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়; বরং তাই হওয়া উচিত ইহজীবন যাপনের মূল লক্ষ্যবস্তু। বোঝানো হচ্ছে যে, তোমরা তো পুণ্য অর্জন করতে চাওই এবং তা চাওয়াই উচিত। কিন্তু যে-কোনওভাবে দান-খয়রাত করলেই তা পাওয়া যায় না। তা পাওয়া যাবে কেবল তখনই, যখন আল্লাহ তা'আলার নির্দেশিত পন্থায় দান-খয়রাত করবে। কী সে পন্থা, তা পরের বাক্যে শেখানো হয়েছে।
حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ ‘যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে'। অর্থাৎ তোমাদের দ্বারা দান-সদাকার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সৎকর্ম সংঘটিত হবে না, ফলে তার পরিপূর্ণ প্রতিদানও আল্লাহ তা'আলার কাছে লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয়বস্তু থেকে দান কর।
বলা হয়েছে مِمَّا تُحِبُّونَ অর্থাৎ তোমরা যা-কিছু ভালোবাস, যা-কিছুই তোমাদের প্রিয় তা থেকে। বোঝা গেল কেবল প্রিয় অর্থ-সম্পদই নয়, যাবতীয় প্রিয়বস্তু থেকেই দান করতে বলা হয়েছে। সুতরাং অর্থ-সম্পদ দান করা, শক্তি ব্যয় করা, বিদ্যা-বুদ্ধি খরচ করা, মাখলুকের সেবায় নিজ প্রভাব ও ক্ষমতার বৈধ ব্যবহার করা ইত্যাদি সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা'আলার পথে যার যা ব্যয় করার সামর্থ্য আছে, তার মধ্যে সর্বোত্তমটি পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যয় করলেই পূর্ণাঙ্গ প্রতিদান পাওয়া যাবে। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ وَلَسْتُمْ بِآخِذِيهِ إِلَّا أَنْ تُغْمِضُوا فِيهِ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ (267)
‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা-কিছু উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা-কিছু উৎপন্ন করেছি, তার উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ থেকে একটি অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় করো। আর এরূপ মন্দ জিনিস (আল্লাহর নামে) দেওয়ার নিয়ত করো না, যা (অন্য কেউ তোমাদেরকে দিলে ঘৃণার কারণে) তোমরা চক্ষু বন্ধ না করে তা গ্রহণ করবে না। মনে রেখো, আল্লাহ বেনিয়ায়, সর্বপ্রকার প্রশংসা তাঁরই দিকে ফেরে।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৬৭)
প্রিয়বস্তু ব্যয়ের হুকুমের ভেতর ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যে বস্তু যতবেশি প্রিয়, তার দান-খয়রাত ততবেশি উত্তম হবে এবং ততবেশি ছাওয়াব পাওয়া যাবে।
প্রকাশ থাকে যে, এ আয়াতে পরিপূর্ণ প্রতিদানের জন্য প্রিয়বস্তু ব্যয়ের শর্ত করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় যদি প্রিয়বস্তু খরচ করা না হয়, তবু একরকম খরচেরও প্রতিদান অবশ্যই পাওয়া যাবে। কেননা আল্লাহর পথে কোনও খরচই বৃথা যায় না, যদি তা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে।
অবশ্য আল্লাহ চান তাঁর বান্দা তাঁর কাছে সর্বোৎকৃষ্ট পুরস্কার লাভ করুক। সেজন্যই এ আয়াতে প্রিয়বস্তু দান করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
মোটকথা ইখলাসভিত্তিক কোনও দানই বৃথা যায় না। হাঁ, যার দানের মান ও পরিমাণ যেমন হবে, সে সেই অনুপাতেই প্রতিদান লাভ করবে। তাই তো আয়াতের শেষে আছে - وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيْمٌ (তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত)। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর পথে যা ব্যয় কর, তার মান ও পরিমাণ তিনি জানেন এবং সে দানের ক্ষেত্রে তোমাদের আন্তরিকতা কতটুকু, সে সম্পর্কেও তিনি অবগত। তিনি সে অনুসারেই তোমাদেরকে প্রতিদান দেবেন। আবার তিনি যেহেতু সব জানেন, তাই তা প্রকাশ করার কোনও প্রয়োজন নেই। বরং ক্ষতি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্য। গোপনীয়তা রক্ষা করাই শ্রেয়।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. ছাওয়াব ও পুণ্য অর্জন করাই হওয়া উচিত ইহজীবনের যাবতীয় কাজের মুখ্য উদ্দেশ্য।
খ. আল্লাহর দেওয়া অর্থ-সম্পদসহ যাবতীয় নি'আমত থেকে তাঁর পথে খরচ করা চাই।
গ. আল্লাহর পথে যাই খরচ করা হবে, তাতে সর্বোৎকৃষ্ট মান রক্ষা করা চাই।
ঘ. ইখলাসের সঙ্গে যা আল্লাহর পথে দান করা হয়, তার কিছুই বৃথা যায় না।
ঙ. আল্লাহ তা'আলা সর্বজ্ঞানী। তাই ছাওয়াব পাওয়ার জন্য প্রকাশ্যে দান করার কোনও প্রয়োজন নেই।
ঈর্ষণীয় দুই ব্যক্তি
হাদীছ নং: ৫৭০

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দু'টি ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনও ক্ষেত্রে হাসাদ (ঈর্ষা পোষণ) করা যায় না। এক ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং তাকে তা ন্যায় খাতে উজাড় করে দেওয়ার ক্ষমতাও দিয়েছেন। আর ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দিয়েছেন, তারপর সে তার সাহায্যে বিচার-আচার করে এবং তা অন্যকে শিক্ষা দেয়। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭৩; সহীহ মুসলিম: ৮১৫; জামে' তিরমিযী: ১৯৩৬; মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৫১; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২০৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩০২৮১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৩১৬২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা ৭৮২৬; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৩৮)
مقدمة الامام النووي
64 - باب فضل الغَنِيّ الشاكر وهو من أخذ المال من وجهه وصرفه في وجوهه المأمور بِهَا
قَالَ الله تَعَالَى: {فَأَمَّا مَنْ أعْطَى وَاتَّقَى وَصَدَّقَ بِالحُسْنَى فَسَنُيَسِّرُهُ لِليُسْرَى} [الليل: 5 - 7]، وقال تَعَالَى: {وَسَيُجَنَّبُهَا الأَتْقَى الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّى وَمَا لأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى إِلاَّ ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الأَعْلَى وَلَسَوْفَ يَرْضَى} [الليل: 17 - 21]، وقال تَعَالَى: {إنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِي وَإنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الفُقراءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيِّئَاتِكُمْ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ} [البقرة: 271]، وقال تَعَالَى: {لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللهَ بِهِ عَلِيمٌ} [آل عمران: 92] والآيات في فضلِ الإنفاقِ في الطاعاتِ كثيرة معلومة.
570 - وعن عبدِ الله بن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «لاَ حَسَدَ إِلاَّ في اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالًا، فَسَلَّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ فِي الحَقِّ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ حِكْمَةً فَهُوَ يَقضِي بِهَا وَيُعَلِّمُهَا». متفقٌ عَلَيْهِ. (1) وتقدم شرحه قريبًا.
হাদীস নং: ৫৭১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৬৪ কৃতজ্ঞ ধনীর মর্যাদা, যে কিনা সম্পদ অর্জন করে শরী‘আত-নির্দেশিত পন্থায় এবং ব্যয়ও করে শরী‘আত-নির্দেশিত স্থানসমূহে
ঈর্ষণীয় দুই ব্যক্তি
হাদীছ নং: ৫৭১

হযরত ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দুই অবস্থা ছাড়া অন্য কোনও অবস্থার প্রতি হাসাদ (ঈর্ষা পোষণ) করা যায় না। এক ওই ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ কুরআন দিয়েছেন, আর সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তাতে লিপ্ত থাকে। আর ওই ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তা (আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে) খরচ করে।
(সহীহ বুখারী: ৭৫২৯; সহীহ মুসলিম: ৮১৫; জামে তিরমিযী: ১৯৩৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২০৯; মুসনাদে আহমাদ: ৪৫৫০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৩০২৮২; সহীহ ইবন হিব্বান: ১২৫; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর: ১৩১৬২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৩৭)
مقدمة الامام النووي
64 - باب فضل الغَنِيّ الشاكر وهو من أخذ المال من وجهه وصرفه في وجوهه المأمور بِهَا
571 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما، عن النبي - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لاَ حَسَدَ إِلاَّ في اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ القُرْآنَ، فَهُوَ يَقُومُ بِهِ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالًا، فَهُوَ يُنْفِقُهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
«الآناء»: السَّاعاتُ.
হাদীস নং: ৫৭২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৬৪ কৃতজ্ঞ ধনীর মর্যাদা, যে কিনা সম্পদ অর্জন করে শরী‘আত-নির্দেশিত পন্থায় এবং ব্যয়ও করে শরী‘আত-নির্দেশিত স্থানসমূহে
ধনী দানশীলদের শ্রেষ্ঠত্ব
হাদীছ নং: ৫৭২

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, গরীব মুহাজিরগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, সম্পদশালীগণ উচ্চমর্যাদা ও স্থায়ী নি'আমত নিয়ে গেল। তিনি বললেন, তা কী করে? তারা বললেন, তারা নামায পড়ে, যেমন আমরা নামায পড়ি। তারা রোযা রাখে, যেমন আমরা রোযা রাখি। তারা দান- খয়রাত করে, অথচ আমরা দান-খয়রাত করতে পারি না। তারা গোলাম আযাদ করে, অথচ আমরা আযাদ করতে পারি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি কি তোমাদের এমন একটা বিষয় শেখাব না, যা দ্বারা তোমরা তাদের ধরতে পারবে, যারা তোমাদের অগ্রগামী হয়ে গেছে এবং যারা তোমাদের পরের, তোমরা তাদের অগ্রগামী থাকতে পারবে, আর কেউ তোমাদের থেকে উত্তম হতে পারবে না কেবল তাদের ছাড়া, যারা তোমাদের মতো আমল করবে? তারা বললেন, অবশ্যই ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, তোমরা প্রত্যেক নামাযের পর ৩৩ বার করে সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও আলহামদুলিল্লাহ বলবে। পরে আবার গরীব মুহাজিরগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, আমাদের সম্পদশালী ভাইয়েরা আমরা যে আমল করি তা শুনে ফেলেছে। ফলে তারাও অনুরূপ আমল করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে চান তাকে দান করেন। বুখারী ও মুসলিম। এটা মুসলিমের ভাষা।
(সহীহ বুখারী : ৮৪৩; সহীহ মুসলিম: ৫৯৫; সুনানে ইবন মাজাহ : ৯২৭; সুনানে আবু দাউদ: ১৫০৪; সহীহ ইবন হিব্বান: ২০১৪; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ২৯৯; শু'আবুল ঈমান: ৬০৮)
مقدمة الامام النووي
64 - باب فضل الغَنِيّ الشاكر وهو من أخذ المال من وجهه وصرفه في وجوهه المأمور بِهَا
572 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ فُقَراءَ المُهَاجِرينَ أتَوْا رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فَقَالُوا: ذَهَبَ أهْلُ الدُّثُورِ بِالدَّرَجَاتِ العُلَى، وَالنَّعِيم المُقيم، فَقَالَ: «وَمَا ذَاك؟» فَقَالوا: يُصَلُّونَ كَمَا نُصَلِّي، وَيَصُومُونَ كَمَا نَصُومُ، وَيَتَصَدَّقُونَ وَلاَ نَتَصَدَّقُ، وَيَعْتِقُونَ وَلاَ نَعْتِقُ، فَقَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «أفَلا أُعَلِّمُكُمْ شَيْئًا تُدْرِكُونَ بِهِ مَنْ سَبَقَكُمْ، وَتَسْبِقُونَ بِهِ مَنْ بَعْدَكُمْ، وَلاَ يَكُونُ أحَدٌ أفْضَلَ مِنْكُمْ إِلاَّ مَنْ صَنَعَ مِثْلَ مَا صَنَعْتُمْ؟» قالوا: بَلَى يَا رسول الله، قَالَ: «تُسَبِّحُونَ وَتُكَبِّرُونَ وَتَحْمِدُونَ، دُبُرَ كُلِّ صَلاَةٍ ثَلاثًا وَثَلاثِينَ مَرَّةً» فَرَجَعَ فُقَرَاء المُهَاجِرِينَ إِلَى رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فقالوا: سَمِعَ إخْوَانُنَا أهلُ الأمْوالِ بِمَا فَعَلْنَا، فَفَعَلُوا مِثلَهُ؟ فَقَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «ذَلِكَ فَضْلُ اللهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ». متفقٌ عَلَيْهِ، وَهَذا لفظ رواية مسلم. (1)
«الدُّثُور»: الأمْوَالُ الكَثِيرَةُ، وَالله أعلم.
হাদীস নং: ৫৭৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ মৃত্যুকে স্মরণ করা এবং লম্বা-চওড়া আশা না রাখা
প্রত্যেক প্রাণীই মরণশীল। মৃত্যু বড় কঠিন জিনিস। শরীর ও রূহ একসঙ্গে থাকায় পরস্পরের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উভয়ে মিলে একই বস্তুতে পরিণত হয়ে যায়। তাই কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে চায় না। কিন্তু মরণে বিচ্ছেদ অনিবার্য। ফলে দেহ ও রূহ উভয়ের অবর্ণনীয় কষ্ট হয়। কোনও মানুষ জীবনলাভের পর মৃত্যুতে যে কষ্ট পায়, অতটা কষ্ট এ দুনিয়ায় আর কখনও কোনওকিছুতে পায় না। এ কষ্ট আরও বেড়ে যায় যখন মুমূর্ষু ব্যক্তি উপলব্ধি করে রূহ চলে যাওয়ার পর তার দেহ পচে-গলে যাবে, তা পোকা-মাকড়ের খাদ্যে পরিণত হবে। কষ্ট আরও বাড়ে যখন ভাবে তার রূহের স্থান কোথায় হবে- পাপিষ্ঠদের স্থান জাহান্নামে, না নেককারদের ঠিকানা জান্নাতে। জীবনভর পাপকর্ম করতে থাকলে মৃত্যুর সময় এ ধারণা প্রবল হয়ে ওঠে যে, হয়তো তার রূহকে জাহান্নামেই নিয়ে যাওয়া হবে। তখন কষ্ট আরও বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে বিখ্যাত তাবি'ঈ রাবী' ইবন খুছায়ম রহ. বলতেন, তোমরা মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করো। কারণ তোমরা এর আগে কখনও এরূপ কঠিন কষ্ট ভোগ করনি।
মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করলে বহুবিধ উপকার পাওয়া যায়। এতে মানুষের লম্বা-চওড়া আশা করার মাত্রা কমে আসে। অতি আশা ভীষণ ক্ষতিকর। তাতে নেক আমলে গড়িমসি করার মনোভাব জন্মায়। আশা পূরণের ব্যতিব্যস্ততা নেক আমলকে পিছিয়ে দেয়। মনে করা হয় এখনই তাড়াহুড়ার কী আছে। সামনে আরও কত সময় রয়েছে। তখন তাওবাতিল্লা করে ঠিক হয়ে যাব। তখন দান-খয়রাত করব, হজ্জ করব এবং পুরোপুরি মুসল্লি-পরহেযগার হয়ে যাব। এখন ব্যবসা-বাণিজ্য জমিয়ে নিই। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি। এছাড়া আরও যেসব পরিকল্পনা আছে সেগুলো গুছিয়ে নিই। কিন্তু গোছানো আর হয় না। যত গোছায়, পরিকল্পনাও ততো লম্বা হয়। তাতে নিত্য-নতুন শাখা-প্রশাখা জন্ম নেয়। এভাবে বিচিত্র আশা-আকাঙ্ক্ষার এমন জটাজালে সে জড়িয়ে যায়, যা থেকে উদ্ধার পাওয়া খুব সহজ হয় না। অপ্রস্তুত অবস্থায়ই মালাকুল মাওত তার প্রাণ সংহার করে নেয়। দীর্ঘ আশা-আকাঙ্ক্ষার এ অশুভ পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করা। মৃত্যুর স্মরণ আশা-আকাঙ্ক্ষার রশি টেনে ধরে। অন্তরে অল্পেতুষ্টির সদগুণ জন্ম দেয়। যে ব্যক্তি মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করে, তার অন্তর থেকে লোভ-লালসা দূর হয়ে যায়। সে দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ হয়ে ওঠে। আখিরাতের প্রতি আগ্রহী হয়। তার পক্ষে দুনিয়ার বালা-মসিবত তুচ্ছ মনে হয়। তুচ্ছ মনে হয় ধন-সম্পদও। ক্ষমতার প্রতিও কোনও আগ্রহ থাকে না। এভাবে অন্তর থেকে অহংকার-অহমিকাও লোপ পেয়ে যায়। মোটকথা মৃত্যুচিন্তা সর্বাংশে কল্যাণই কল্যাণ। তাই কুরআন ও হাদীছে মানুষকে বারবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ যাতে মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করে, সে তাগাদাও দেওয়া হয়েছে। এ অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছগুলো সে সম্পর্কেই।

‘মৃত্যুকে স্মরণ করা…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ (185)
অর্থ: প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এবং তোমাদের সকলকে (তোমাদের কর্মের) পুরোপুরি প্রতিদান কিয়ামতের দিনই দেওয়া হবে। অতঃপর যাকেই জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে ও জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হবে, সে-ই প্রকৃত অর্থে সফলকাম হবে। আর (জান্নাতের বিপরীতে) পার্থিব জীবন তো প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৮৫)

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম হল মৃত্যু। যা-কিছুরই প্রাণ আছে, মৃত্যু তার জন্য অবধারিত। এর থেকে নিস্তার নেই কারও। এ দুনিয়ায় কেউ অনন্তকাল বাঁচে না। না কোনও মানুষ, না অন্য কোনও জীবজন্তু। এটা সর্বাপেক্ষা চরম সত্য। আজ পর্যন্ত কেউ এটা অস্বীকার করতে পারেনি। কেউ অস্বীকার করেও না। সুতরাং মৃত্যু যখন অবধারিত, তখন প্রত্যেকেরই এর জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার। নিজের জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার, অন্যের ক্ষেত্রেও মেনে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। তাই কারও মৃত্যুতে অভিযোগ না তুলে বা হতাশ না হয়ে তার থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং নিজ করণীয় কাজে অবিচল থাকা উচিত।
‘মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’ বলার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে, মৃত্যু যতই স্বাভাবিক হোক না কেন, তার একটা যন্ত্রণা আছে। মৃত্যুকালে সে যন্ত্রণা কিছু না কিছু সকলকেই ভোগ করতে হয়। সে এক কঠিন পরিস্থিতি। সকল কাজে সে কথা মাথায় রাখা উচিত। তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
তারপর কিয়ামত দিবসের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। একদিন এ বিশ্বজগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় তা থাকবে দীর্ঘকাল। তারপর সকলকে পুনর্জীবিত করা হবে। সকল মানুষ আপন আপন স্থান থেকে জীবিত হয়ে বিচারের মাঠে সমবেত হবে। সকলের ধ্বংস হয়ে যাওয়া, তারপর পুনরায় জীবিত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হওয়া- এই সবটার সমষ্টির নাম কিয়ামত। এটা হবেই হবে। এর উপর বিশ্বাস রাখা ফরয। এর সারকথা হল মৃত্যুতেই মানবজীবনের চূড়ান্ত সমাপ্তি নয় বরং এর পর আরেক জীবন আছে। তার নাম আখিরাত। সেই জীবনে সকলকেই ফিরতে হবে এবং এ জীবনের যাবতীয় কাজ সে জীবনের সফলতার লক্ষ্যেই আঞ্জাম দিতে হবে। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
يَاعِبَادِيَ الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ أَرْضِي وَاسِعَةٌ فَإِيَّايَ فَاعْبُدُونِ (56) كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ثُمَّ إِلَيْنَا تُرْجَعُونَ (57)
‘হে আমার মুমিন বান্দাগণ! নিশ্চয়ই আমার ভূমি অতি প্রশস্ত। সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত করো। জীব মাত্রকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তারপর তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরিয়ে আনা হবে।’(সূরা আনকাবুত (২৯), আয়াত ৫৬-৫৭)
কিয়ামতের দিন তথা বিচারসভায় প্রত্যেককে আপন আপন কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে। দুনিয়ায় যে ব্যক্তি ভালো কাজ করেছে, সেদিন সে ভালো ফল পাবে। যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করেছে, সে পাবে মন্দ ফল। আল্লাহ তা'আলা ন্যায়বিচারক। সেদিন কারও প্রতি কোনও অন্যায় করা হবে না। এটা সুস্পষ্ট করার জন্য আমলনামা খুলে দেওয়া হবে। প্রত্যেকে তার ভেতর আপন আপন কাজের পূর্ণ বিবরণ দেখতে পাবে। ছোটবড় যাই করেছে, তার কোনওটারই অনুল্লেখ পাবে না। যে যা করেছে, সে সম্পর্কে সাক্ষীও পেশ করা হবে। সে সাক্ষীদের মধ্যে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও থাকবে। প্রত্যেক অঙ্গ সাক্ষ্য দেবে তাকে দিয়ে কি কি কাজ করানো হয়েছে। তদুপরি আমলের ওজন করা হবে। দেখা হবে কার নেক আমলের ওজন বেশি, কার ওজন বেশি বদ আমলের। যার যে আমলের ওজন বেশি হবে, সেই অনুযায়ী ফয়সালা হবে।
কর্মের পুরোপুরি প্রতিফল যেহেতু আখিরাতেই দেওয়া হবে, তাই ইহজগতে তা দেখার আশা বৃথা। অর্থাৎ যে ব্যক্তি মন্দকাজ করে, তাকে দুনিয়ায় শাস্তি পেতে না দেখায় এ কথা মনে করা ঠিক না যে, সে বেঁচে গেল। তার শাস্তি আখিরাতের জন্য জমা রাখা হয়েছে। সেখানে তাকে তা ভোগ করতে হবে। তাই পাপকর্ম সত্ত্বেও আরামে জীবন কাটতে থাকলে তার নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া উচিত নয়; বরং আখিরাতে কঠিন শাস্তিভোগের ভয়ে নিজেকে সংশোধন করে ফেলা উচিত। এমনিভাবে যে ব্যক্তি ভালো কাজ করে, তাকে সুফল পেতে না দেখে এ কথা মনে করা ভুল যে, তার চেষ্টা বৃথা গেল। তার তো আখিরাতই লক্ষ্যবস্তু। তাই সে দুনিয়ায় বিনিময়লাভের আশাই করবে না। সে তার নেককাজ দ্বারা জাহান্নাম থেকে বাঁচা ও জান্নাতলাভের প্রত্যাশায় থাকবে।
আয়াতে তারপর জান্নাত ও জাহান্নামের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। জান্নাত মুমিনদের ঠিকানা। জাহান্নাম কাফের ও ফাসেকদের। যার নেক আমলের ওজন বেশি হবে, সে জান্নাত লাভ করবে। যার বদ আমলের ওজন বেশি হবে, সে জাহান্নামে যাবে। শেষগতি যদি হয় জাহান্নাম, তবে তা মানবজীবনের চরম ব্যর্থতা। সফল সেই ব্যক্তি, যে জান্নাত লাভ করবে। আয়াতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, তোমরা জাহান্নাম থেকে রেহাই পেয়ে যাতে জান্নাতবাসী হতে পার আর এভাবে মানব হয়ে জন্মানোকে সাফল্যমণ্ডিত করতে পার, সেটাকেই জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নাও এবং সে লক্ষ্যবস্তু সামনে রেখেই ইহজীবন নির্বাহ করো।
সবশেষে সতর্ক করা হয়েছে, পার্থিব জীবনের ধোঁকা ও প্রতারণা সম্পর্কে। অর্থাৎ ইহজীবন নির্বাহের লক্ষ্যবস্তু তো থাকবে পরকালীন জীবনের সফলতা লাভ। তবে সেই লক্ষ্যে উত্তীর্ণ হতে হলে সতর্কতা অবলম্বন খুব জরুরি। কেননা দুনিয়া বড় প্রতারণাময়। এর সবকিছুতে প্রচণ্ড আকর্ষণ। এর প্রতিটি বস্তু আখিরাত ভুলিয়ে মানুষকে নিজের মধ্যে লিপ্ত রাখতে চায়। এর প্রতিটি বস্তু বড় আকর্ষণীয়রূপে মানুষকে হাতছানি দেয়। সে হাতছানি যে উপেক্ষা করতে পারে, কেবল সেই পরকালীন সফলতা লাভের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারে। তা উপেক্ষা করা সহজ হয় মন ও মস্তিষ্কে মৃত্যুচিন্তা জাগ্রত রাখার দ্বারা। তাই এ আয়াত মানুষকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এবং তাকে আহ্বান জানাচ্ছে যেন কোনও অবস্থায়ই সে তার এ অবধারিত পরিণতির কথা ভুলে না যায়।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. মৃত্যু প্রত্যেক প্রাণীর অবধারিত পরিণতি। কোনও অবস্থায়ই এ কথা ভুলতে নেই।
খ. মৃত্যু বড় যন্ত্রণাময় ও এক কঠিন পরীক্ষা। তখন যাতে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায়, জীবনের যাবতীয় কাজে সে আশার স্পর্শ থাকা উচিত।
গ. কিয়ামত সত্য। এ বিশ্বাস ঈমানের অঙ্গ।
ঘ. কিয়ামতে মানুষের ইহজীবনের যাবতীয় কাজের পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে।
ঙ. কর্মফল ভোগের আসল জায়গা যেহেতু আখিরাত, তাই দুনিয়ায় পাপীকে পাপের শাস্তি ভোগ করতে না দেখলে মনে করা উচিত নয় সে বেঁচে গেল।
চ. নেককার ব্যক্তিকে দুনিয়ায় তার নেককাজের সুফল পেতে না দেখলে ভাবা উচিত নয় তার কর্ম বৃথা গেল।
ছ. পরকালের প্রতিদান লাভ করাই হওয়া উচিত যাবতীয় নেককাজের লক্ষ্যবস্তু।
জ. জান্নাত ও জাহান্নাম সত্য। জাহান্নাম থেকে রেহাই পেয়ে জান্নাত লাভ করতে পারাই মানবজীবনের সফলতা।
ঝ. ইহজীবন বড় প্রতারণাময়। এর মোহে পড়তে নেই।

দুই নং আয়াত
وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ
অর্থ : কোনও প্রাণী জানে না সে আগামীকাল কী অর্জন করবে এবং কোনও প্রাণী এটাও জানে না যে, কোন ভূমিতে তার মৃত্যু হবে।(সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ৩৪)

ব্যাখ্যা
এটা সূরা লুকমানের সর্বশেষ আয়াতের একটি অংশ। এ আয়াতে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, তার প্রকৃত ও পরিপূর্ণ জ্ঞান কেবল আল্লাহ তা'আলারই আছে। পূর্ণ আয়াতটি এরকম-
إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ (34)
‘নিশ্চয়ই কিয়ামত (-এর ক্ষণ) সম্পর্কিত জ্ঞান কেবল আল্লাহরই কাছে আছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনিই জানেন মাতৃগর্ভে কী আছে। কোনও প্রাণী জানে না সে আগামীকাল কী অর্জন করবে এবং কোনও প্রাণী এটাও জানে না যে, কোন ভূমিতে তার মৃত্যু হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত, সবকিছু সম্পর্কে পরিপূর্ণ খবর রাখেন।’
প্রথমে বলা হয়েছে, কিয়ামতের সুনির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ সম্পর্কে কেবল আল্লাহ তা'আলাই জানেন, অন্য কেউ জানে না। কিয়ামত হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কবে হবে, সেই জ্ঞান আল্লাহ তা'আলা নিজের কাছে গোপন রেখেছেন। তবে তিনি তার কিছু আলামত বলে দিয়েছেন। সে আলামতগুলো প্রকাশ পেতে থাকলে মনে করতে হবে কিয়ামত দিন দিন কাছে আসছে। কিয়ামতের একটি আলামত সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন। তাঁর পর আর কোনও নবী আসবে না। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর নিয়ে আসা দীনই কার্যকর থাকবে। সুতরাং এ উম্মতই সর্বশেষ উম্মত এবং এর পরে কিয়ামত। যত দিন যেতে থাকবে, ততোই এক এক করে কিয়ামতের নানা আলামত প্রকাশ পেতে থাকবে। সর্বশেষ বড় বড় আলামতগুলোর মধ্যে রয়েছে ইমাম মাহদীর আগমন, আসমান থেকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দুনিয়ায় নেমে আসা, দাজ্জালের আবির্ভাব, ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাব, সবশেষে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য ওঠা। তারপর তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে এবং তারপর কিয়ামত সংঘটিত হবে।
দ্বিতীয় বিষয় হল বৃষ্টিবর্ষণ। বৃষ্টি মানুষের জন্য আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি‘আমত। এর দ্বারা মানুষ বহুবিধ উপকার লাভ করে। কোথায় কখন কী পরিমাণ বৃষ্টি হবে, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। বিভিন্ন আলামত দেখে মানুষ এ সম্পর্কে কিছুটা অনুমানমাত্র করতে পারে। কিন্তু পরিপূর্ণ জ্ঞান কেউই লাভ করতে পারে না। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে যা ধারণা হয় তা অনুমানমাত্র, নিশ্চিতসত্য নয়। অনেক সময়ই তা ভুলও প্রমাণিত হয়। সঠিক হলেও ঠিক কতক্ষণ কী পরিমাণ বৃষ্টি হবে, তা আগেভাগে কারও পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। তা জানেন কেবলই আল্লাহ তা'আলা।
তৃতীয় বিষয় হল মাতৃগর্ভে কী আছে? যা আছে তা পূর্ণ আকৃতির মানবশিশুরূপে দুনিয়ায় আগমন করবে, নাকি আগেই ঝরে পড়বে? তার রং ও রূপ কী হবে? তার শারীরিক শক্তি কেমন হবে? মেধা ও মননশীলতা কী মানের হবে? লম্বা হবে না খাটো? কী আয়ু লাভ করবে? সৎকর্মশীল হবে না পাপী? তার পেশা হবে কী? এরকম আরও কত কী প্রশ্ন! এই যাবতীয় বিষয় গর্ভস্থ ভ্রুণের মধ্যে নিহিত আছে। এমনকি তা লুক্কায়িত রয়েছে গর্ভাশয়ে স্থিত মিশ্র এক বিন্দুর মধ্যে। আল্লাহ ছাড়া এসব বিষয়ের পরিপূর্ণ জ্ঞান আর কার আছে? কোনও একটি শিশুর নয়; বরং জগতে যত মানবশিশু এসেছে ও আসবে, তাদের সকলের এ যাবতীয় বিষয় আল্লাহ তা'আলার জ্ঞানে পরিপূর্ণরূপে অনাদিকাল থেকে বিদ্যমান। অপরদিকে কোনও একটি শিশু সম্পর্কেও এই যাবতীয় বিষয়ের জ্ঞান কোনও একজন মাখলুকেরও নেই।
চতুর্থত বলা হয়েছে- وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا (কোনও প্রাণী জানে না আগামীকাল সে কী করবে)। একজন মানুষ প্রতিদিন কত রকম কাজ করে থাকে! একেক অঙ্গের কত বিচিত্র ব্যবহার সে করে! চোখ দিয়ে কত দেখা, কান দিয়ে কত শোনা, মুখের কত বলা, হাতের কত স্পর্শ, পায়ের কত চলা, রয়েছে পেশাগত কাজ, সে কাজের পরিমাণ-পরিমাপ, সময়-স্থান, ধরন-প্রকৃতি, আছে আকস্মিক এসে পড়া কাজ, যা কল্পনায়ও থাকে না, আছে করণীয় কাজ, আছে বর্জনীয় কাজ, বহু বৈচিত্র্যের সমাহারে ঠাসা যে কাজের ফিরিস্তি, সে সম্পর্কে পুরোপুরি তো দূরের কথা, এক-শতাংশও কি আগাম কারও জানা থাকে? কিন্তু মহান আল্লাহ কেবল প্রত্যেকের নয়; সমস্ত সৃষ্টির যাবতীয় কাজ সম্পর্কে আগাম সবকিছু জানেন। সেই অনাদিকাল থেকেই তিনি জানেন কোন গাছের কোন পাতাটি ঠিক কখন ঝরে পড়বে। আল্লাহু আকবার! কী বিপুল ও কী অসীম তাঁর জ্ঞান!
সবশেষে আছে- وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ (কেউ জানে না সে কোন ভূমিতে মারা যাবে)। যেমন জানে না কোথায় মারা যাবে, তেমনি কখন মারা যাবে তাও তার অজানা। ভাবে মারা যাবে এক জায়গায়, কিন্তু সকল ভাবনা-কল্পনা মিথ্যা প্রমাণ করে মারা যায় অন্য কোথাও। এটা যেমন নিজের বেলায় সত্য, তেমনি সত্য অন্যের বেলায়ও। কারও মৃত্যুর স্থান-কাল সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে আগাম কেউ কিছুই বলতে পারে না। এ সম্পর্কে একটা চমৎকার ঘটনা আছে। ঘটনা তো আছে হাজারও। তবে আব্বাসীয় যুগের দুর্দান্ত খলীফা আবূ জা'ফর মানসূরের বড় আগ্রহ ছিল- যদি জানতে পারতেন ঠিক কবে তিনি মারা যাবেন! একবার তিনি স্বপ্নে দেখেন সাগর থেকে কোনও এক ছায়ামূর্তি হাতের পাঁচ আঙ্গুল দেখিয়ে কী ইশারা করছে। পরের দিন তিনি বিজ্ঞজনদের কাছে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাইলেন। কেউ বলল, এর দ্বারা পাঁচ বছর বোঝানো হয়েছে। কেউ বলল, পাঁচ মাস। কেউ বলল, পাঁচ দিন। নানা জনে নানা কথা বলল। কিন্তু খলীফা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। শেষে জিজ্ঞেস করলেন, ইমাম আবূ হানীফা রহ.- কে। তিনি বললেন, এর দ্বারা কুরআন মাজীদের এ আয়াতে বর্ণিত পাঁচটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। অর্থাৎ আপনি কবে মারা যাবেন তা এ পাঁচটি বিষয়েরই অন্তর্ভুক্ত। কেউ আগাম তা বলতে পারবে না।
হযরত আবূ আযযাহ (ইয়াসার ইবন আব্দ) হুযালী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِذَا قَضَى اللَّهُ لِعَبْد أَنْ يَمُوْتَ بِأَرْضِ جَعَلَ لَهُ إِلَيْهَا حَاجَةً، أَوْ قَالَ: بِهَا حَاجَةً
‘আল্লাহ তা'আলা যে বান্দার মৃত্যু যে স্থানে নির্ধারণ করে রাখেন, সে স্থানে তার কোনও প্রয়োজন দাঁড় করিয়ে দেন (ফলে সেখানে সে পৌঁছে যায়, আর তখন তার জান কবজ করে নেওয়া হয়)।(জামে তিরমিযী: ২১৪৭; মুসনাদুল বাযযার: ১৮৮৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর : ৭০৬; হাকিম, আল মুসতাদরাক: ১২৭: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৪২৪)
প্রকাশ থাকে যে, যেসকল বিষয় কেবল আল্লাহ তা'আলাই জানেন, অন্য কেউ জানে না, তা এ পাঁচটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর বাইরেও আছে। যেমন আল্লাহ তা'আলার ফিরিশতার সংখ্যা কত, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا يَعْلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ
‘তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানে না।’( সূরা মুদ্দাচ্ছির (৭৪), আয়াত ৩১)
সূরা লুকমানের আলোচ্য আয়াতে বিশেষভাবে পাঁচটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে শানে নুযূলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ পাঁচটি বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। সে বলেছিল, আমার স্ত্রী গর্ভবতী। আপনি বলুন সে কী সন্তান জন্ম দেবে? আমাদের এলাকায় খরা চলছে। বলুন কখন বৃষ্টি হবে? আমি কবে জন্ম নিয়েছি তা তো জানি। আপনি বলুন কবে মারা যাব? আজ আমি কী করেছি তা আমার জানা আছে। আপনি বলুন আগামীকাল কী করব? আর বলুন কিয়ামত কবে হবে? সে পরিপ্রেক্ষিতেই আয়াতটি নাযিল হয়েছে।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. কিয়ামতের সুনির্দিষ্ট তারিখ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
খ. কোথায় কখন কী পরিমাণ বৃষ্টি হবে, তার পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান কেবল আল্লাহরই আছে।
গ. গর্ভস্থ সন্তান সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান আল্লাহ তা'আলারই আছে। মানুষ যা জানতে পারে তা আংশিক জ্ঞান বা অনুমান মাত্র।
ঘ. আগামীকাল কে কী করতে পারবে, তা আগাম কেউ বলতে পারে না।
ঙ. কে কখন কোথায় মারা যাবে, কারও পক্ষেই তা আগাম বলা সম্ভব নয়।
চ. আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান অসীম। আপন সৃষ্টির যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে তাঁর পরিপূর্ণরূপে জানা আছে। খুঁটিনাটি কোনওকিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়।

তিন নং আয়াত
فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ (61)
অর্থ: তারপর যখন তাদের নির্দিষ্ট কাল এসে পড়বে, তখন তারা মুহূর্তকালও পেছনে যেতে পারে না এবং সামনেও যেতে পারে না।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৬১)

ব্যাখ্যা
এ আয়াত জানাচ্ছে, প্রত্যেকের আয়ু নির্ধারিত। আয়ু ফুরালে মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যুর সে নির্ধারিত ক্ষণ কেউ টলাতে পারে না। এক মুহূর্ত আগেও আনতে পারে না, এক মুহূর্ত পেছাতেও পারে না। সুতরাং প্রত্যেকের মৃত্যু তার নির্ধারিত সময়েই হয়ে থাকে, তা দুর্ঘটনায় মারা যাক কিংবা কারও হাতে নিহত হোক। যে ব্যক্তি কারও হাতে নিহত হয়, তার মৃত্যু আগে হয়ে যায় এমন নয়। স্বাভাবিক সময়েই হয়। ঘাতককে যে দায়ী করা হয় এবং এজন্য তাকে শাস্তিও দেওয়া হয় তা এ কারণে নয় যে, সে নির্ধারিত সময়ের আগে তার মৃত্যু ঘটিয়েছে। সে হত্যা না করলেও ওই সময়ে তার মৃত্যু হতোই। তার শাস্তি এ কারণে যে, সে তার উপর সীমালঙ্ঘন করল কেন? সে তার উপর প্রাণঘাতী হামলা কেন চালাল, যা কিনা তার জন্য জায়েয ছিল না?
আয়াতটি দ্বারা বোঝা যায় কারও আয়ু বাড়েও না কমেও না। এর উপর প্রশ্ন আসে, কোনও কোনও হাদীছ দ্বারাও তো জানা যায় বিশেষ আমল দ্বারা আয়ু বাড়ে, যেমন আত্মীয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার, পিতা-মাতার সেবাযত্ন ইত্যাদি, এর উত্তর কী?
এর উত্তর হচ্ছে, আয়ু বাড়া দ্বারা আয়ুতে বরকত হওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ যে ব্যক্তি পিতা-মাতার সেবাযত্ন করবে, আত্মীয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে, আল্লাহ তা'আলা তার আয়ুতে বরকত দেবেন। সে তার নির্ধারিত আয়ুতে এত বেশি কাজ করতে পারবে, যা অন্যরা অনেক বেশি দীর্ঘ আয়ুতেও করতে পারে না।
অনেক আলেম এরকম উত্তরও দিয়েছেন যে, আয়ু বাড়া-কমার বিষয়টা আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান হিসেবে নয়; বরং ফিরিশতাদের জ্ঞান হিসেবে হয়ে থাকে। অর্থাৎ কার মৃত্যু ঠিক কখন হবে তার চূড়ান্ত জ্ঞান আল্লাহ তা'আলারই আছে। সংশ্লিষ্ট ফিরিশতাদেরও এ সম্পর্কে একটা জ্ঞান আছে। তবে তা চূড়ান্ত জ্ঞান নয়। তাদেরকে এভাবে জানিয়ে রাখা হয়েছে যে, অমুক বান্দার আয়ু এত বছর। যদি সে এই এই কাজ করে, তবে তার আয়ু এত বছর বাড়বে। যদি না করে, তবে এরকমই থাকবে। কিন্তু সে তা করবে কি করবে না, তা আল্লাহ তা'আলারই জানা আছে, অন্য কারও নয়। যখন সে ওই কাজটি করে, তখন তার আয়ু বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ বাড়াটা হয় ফিরিশতাদের জ্ঞান হিসেবে। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা তো জানেন যে, এ কাজটি সে করবে এবং তার আয়ু হবে এই। তাঁর হিসেবে কিছুই বাড়ল না। সে কথাই আয়াতে বলা হয়েছে যে, কারও আয়ু নির্ধারিত সময় থেকে কিছু বাড়ে-কমে না। আর হাদীছে যে বাড়া-কমার কথা বলা হয়েছে, তা আল্লাহর জ্ঞান হিসাবে নয়; ফিরিশতাদের জ্ঞান হিসাবে।

আয়াতটির শিক্ষা
প্রত্যেকের মৃত্যুর একটা নির্ধারিত সময় আছে। সেই নির্ধারিত সময়ে মৃত্যু হবেই হবে। আগে বা পরে হবে না। কিন্তু তা ঠিক কখন হবে তা কেউ জানে না। সুতরাং প্রত্যেকের প্রতিটি মুহূর্তেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।

চার নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ (9) وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَّرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُنْ مِنَ الصَّالِحِينَ (10) وَلَنْ يُؤَخِّرَ اللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (11)
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে। যারা এরকম করবে (অর্থাৎ গাফেল হবে) তারাই (ব্যবসায়) ক্ষতিগ্রস্ত। আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) ব্যয় করো, এর আগে যে, তোমাদের কারও মৃত্যু এসে যাবে আর তখন বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে কিছু কালের জন্য সুযোগ দিলে না কেন, তাহলে আমি দান-সদাকা করতাম এবং নেক লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম। যখন কারও নির্ধারিত কাল এসে যাবে তখন আল্লাহ তাকে কিছুতেই অবকাশ দেবেন না। আর তোমরা যা-কিছু কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবহিত।(সূরা মুনাফিকুন (৬৩), আয়াত ৯-১১)

ব্যাখ্যা
এগুলো সূরা মুনাফিকূনের শেষ তিন আয়াত। এ সূরায় মুনাফিকের স্বভাব বর্ণিত হয়েছে। পরিশেষে মুমিনদের লক্ষ্য করে বলা হয়েছে, তারা যেন মুনাফিকদের মতো না হয়। মুনাফিকরা শরী'আতের হুকুমের উপর সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদের আসক্তিকে প্রাধান্য দিত। আল্লাহর হুকুম পালনে গড়িমসি করত। কিন্তু পার্থিব কোনও ক্ষতি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের লক্ষ্য করে বলেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ (হে মুমিনগণ! তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে)। অর্থাৎ অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির খাতিরে নামায আদায়ে গাফলতি করো না। হজ্জ করতে গড়িমসি করো না। যাকাত দিতে টালবাহানা করো না। মোটকথা আল্লাহ তা'আলার কোনও আদেশ-নিষেধ পালনে সন্তান-সন্ততি ও মালের মহব্বত যেন বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থেকো। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা হুকুম করেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ وَإِنْ تَعْفُوا وَتَصْفَحُوا وَتَغْفِرُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ (14) إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَاللَّهُ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ (15)
‘হে মুমিনগণ! তোমাদের স্ত্রী ও তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। সুতরাং তাদের ব্যাপারে সাবধান থেকো। যদি তোমরা মার্জনা কর ও উপেক্ষা কর এবং ক্ষমা কর, তবে আল্লাহ তো অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। আল্লাহরই কাছে আছে মহা প্রতিদান।(সূরা তাগাবুন (৬৪), আয়াত ১৪-১৫)
অর্থাৎ স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদ মানুষের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। দেখা হয় মানুষ এসবের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যায় কি না। অন্ধ হওয়ার মানে বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলা, ফ লে শরী‘আতের উপর এদের ভালোবাসাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এরূপ হলে সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী, অর্থ-সম্পদ মানুষের পক্ষে শত্রুতুল্য হয়ে যায়। কারণ এরূপ ক্ষেত্রে তাদের কারণে দীন ও ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিণামে আখিরাতের জীবন ধ্বংস হয়। কোনও কোনও স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দীনদার না হওয়ায় দীন ও ঈমানের ক্ষতিতে সক্রিয় ভূমিকাও রাখে। তাই তাদের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা প্রয়োজন। অবশ্য সব স্ত্রী ও সকল সন্তান-সন্ততিই এ রকম নয়। এমন বহু নারী আছে, যারা তাদের স্বামীদের দীন ও ঈমান হেফাজত করে এবং নেককাজে তাদের সৎ পরামর্শক ও উত্তম সহযোগী হয়। এমনিভাবে অনেক সৌভাগ্যবান সন্তানও আছে, যারা তাদের পিতা-মাতার দীন ও ঈমানের উন্নতির কারণ হয় এবং তাদের জন্য হয়ে থাকে ‘সদাকায়ে জারিয়া’স্বরূপ।
وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ ‘যারা এরকম করবে (অর্থাৎ গাফেল হবে( তারাই (ব্যবসায়) ক্ষতিগ্রস্ত'। অর্থাৎ যারা সন্তান-সন্ততি ও অর্থ-সম্পদের মোহে আল্লাহর আনুগত্য ভুলে যাবে, আর এভাবে আখিরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দেবে ও নশ্বর জগতের ভোগ-উপভোগে লিপ্ত হয়ে অনন্ত স্থায়ী জগতের অকল্পনীয় নি'আমত হাতছাড়া করবে, তারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত, তাতে তাদের অর্থ-সম্পদ যত বিপুলই হোক এবং সন্তান- সন্ততির সংখ্যা যত বেশিই হোক আর তারা যত খ্যাতিমানই হোক। কেননা মানবজীবনের সফলতা ধনবান হতে পারার মধ্যেও নয় এবং ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠালাভের মধ্যেও নয়। মানবজীবনের সফলতা হল আখিরাতের নাজাত ও মুক্তিলাভের ভেতর। তা যদি লাভ না হয়, তবে সবকিছুই কেবল ক্ষতিই ক্ষতি। সুতরাং হে মুমিনগণ সতর্ক থেকো, তোমরা যেন সেই ক্ষতির মধ্যে পড়ে না যাও। সে ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় কী? পরের আয়াতে সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে-
وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ ‘আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) ব্যয় করো, এর আগে যে, তোমাদের কারও মৃত্যু এসে যাবে'। অর্থাৎ মৃত্যুর আলামত শুরু হয়ে যাওয়ার আগে আগেই আমার দেওয়া জীবিকা থেকে আমার পথে ব্যয় করো। তোমাদের ধন-সম্পদ তো আমারই দেওয়া। আমি তা এজন্য দিইনি যে, তোমরা তার মোহে পড়ে যাবে, তা দ্বারা বিলাসিতা করবে এবং তার সঞ্চয়ে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। বরং দিয়েছি এজন্য যে, আমার দেওয়া নির্দেশনা মোতাবেক সঠিক খাতে খরচ করবে এবং তা দ্বারা কে কতবেশি ছাওয়াব হাসিল করতে পার, পরস্পরে সেই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে। সুতরাং তোমরা তা-ই করতে থাকো। গড়িমসি করো না। যে-কোনওদিন মৃত্যু এসে পড়বে। কবে আসবে তা কেউ জানে না। তাই আগে আগেই আল্লাহর পথে খরচ করে তা দ্বারা পুণ্য সঞ্চয় করতে থাকো। মৃত্যু এসে গেলে তখন কেবল আক্ষেপই করতে পারবে। কিন্তু সে আপেক্ষ কোনও কাজে আসবে না। তখন আল্লাহকে ডেকে সময় চাবে আর বলবে, একটু সময় পেলে আমি তোমার পথে দান-খয়রাত করব এবং নেককার লোকদের মতো কাজকর্ম করে আমিও তাদের একজন হয়ে যাব। কিন্তু আল্লাহর বিধান অটল।তিনি যার জন্য মৃত্যুর যে সময় নির্দিষ্ট করে রখেছেন, তার কোন ব্যতিক্রম হবে না। ফলে আক্ষেপ নিয়েই তোমাদের কবরে যেতে হবে। তারচে' এখনই সাবধান হও এবং সমস্ত উদাসীনতা পরিত্যাগ করে আখিরাতের জন্য পুণ্য সঞ্চয়ে সচেষ্ট হও।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মোহে পড়ে আল্লাহর আনুগত্যে অবহেলা করা প্রকৃত মুমিনের কাজ নয়।
খ. অর্থের প্রাচুর্য ও সন্তান-সন্ততির প্রতিষ্ঠালাভের মধ্যে কোনও সফলতা নেই, যদি না তা দীনী উন্নতিলাভে সহায়ক হয়।
গ. ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মোহে আল্লাহর আনুগত্যে অবহেলার করতে নেই। কেননা তা মানবজীবনের চরম ক্ষতি বয়ে আনে।
ঘ. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির খাতসমূহে অর্থ-সম্পদ খরচ করতে হবে এখনই। ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকা যাবে না।
ঙ. মৃত্যু যে-কোনও সময় হাজির হয়ে যেতে পারে। তাই আখিরাতের জন্য যা-কিছু করার তা করতে হবে এখনই।
চ. আল্লাহর পথে খরচ করাসহ যে-কোনও দীনী কাজে বিলম্ব করলে তা মৃত্যুকালে আক্ষেপের কারণ হবে।
ছ. মৃত্যু তার নির্ধারিত সময়ে হবেই। কোনওরূপ আবেদন-নিবেদনে তা পেছাবে না।

পাঁচ নং আয়াত
حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ (99) لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ كَلَّا إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ (100) فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلَا أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُونَ (101) فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (102) وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ (103) تَلْفَحُ وُجُوهَهُمُ النَّارُ وَهُمْ فِيهَا كَالِحُونَ (104) أَلَمْ تَكُنْ آيَاتِي تُتْلَى عَلَيْكُمْ فَكُنْتُمْ بِهَا تُكَذِّبُونَ (105) قَالُوا رَبَّنَا غَلَبَتْ عَلَيْنَا شِقْوَتُنَا وَكُنَّا قَوْمًا ضَالِّينَ (106) رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْهَا فَإِنْ عُدْنَا فَإِنَّا ظَالِمُونَ (107) قَالَ اخْسَئُوا فِيهَا وَلَا تُكَلِّمُونِ (108) إِنَّهُ كَانَ فَرِيقٌ مِنْ عِبَادِي يَقُولُونَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ (109) فَاتَّخَذْتُمُوهُمْ سِخْرِيًّا حَتَّى أَنْسَوْكُمْ ذِكْرِي وَكُنْتُمْ مِنْهُمْ تَضْحَكُونَ (110) إِنِّي جَزَيْتُهُمُ الْيَوْمَ بِمَا صَبَرُوا أَنَّهُمْ هُمُ الْفَائِزُونَ (111) قَالَ كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الْأَرْضِ عَدَدَ سِنِينَ (112) قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ فَاسْأَلِ الْعَادِّينَ (113) قَالَ إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (114) أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ (115)
অর্থ : পরিশেষে যখন তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়ে যাবে, তখন তারা বলবে,হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ওয়াপেস পাঠিয়ে দিন, যাতে আমি যা (অর্থাৎ যে দুনিয়া) ছেড়ে এসেছি সেখানে গিয়ে সৎকাজ করতে পারি। কখনও না। এটা একটা কথার কথা, যা সে মুখে বলছে মাত্র। তাদের (অর্থাৎ মৃতদের) সামনে রয়েছে ‘বরযখ’, যা তাদেরকে পুনরুত্থিত করার দিন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। অতঃপর যখন শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে, তখন তাদের মধ্যকার কোনও আত্মীয়তা বাকি থাকবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না। তখন যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে। আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই এমন, যারা নিজেদের জন্য লোকসানের ব্যবসা করেছিল। তারা সদা-সর্বদা জাহান্নামে থাকবে। আগুন তাদের চেহারা ঝলসে দেবে এবং তাতে তাদের আকৃতি বিকৃত হয়ে যাবে। (তাদেরকে বলা হবে) তোমাদেরকে কি আমার আয়াতসমূহ পড়ে শোনানো হতো না? কিন্তু তোমরা তা অবিশ্বাস করতে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর আমাদের দুর্ভাগ্য ছেয়ে গিয়েছিল এবং আমরা ছিলাম বিপথগামী সম্প্রদায়। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করুন। অতঃপর পুনরায় যদি আমরা সেই কাজই করি, তবে অবশ্যই আমরা জালেম হব। আল্লাহ বলবেন, এরই মধ্যে তোমরা হীন অবস্থায় পড়ে থাকো এবং আমার সাথে কথা বলো না। আমার বান্দাদের একটি দল দু'আ করত, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ঈমান এনেছি। সুতরাং আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন। আপনি দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু। তোমরা তখন তাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছিলে। এমনকি তা (অর্থাৎ তাদেরকে উত্ত্যক্তকরণ) তোমাদেরকে আমার স্মরণ পর্যন্ত ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর তোমরা তাদেরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় লিপ্ত থাকতে। তারা যে সবর করেছিল সে কারণে আজ আমি তাদেরকে এমন প্রতিদান দিলাম যে, তারাই হয়ে গেল কৃতকার্য। (তারপর) আল্লাহ (জাহান্নামীদেরকে) বলবেন, তোমরা পৃথিবীতে বছরের গণনায় কত কাল থেকেছ? তারা বলবে, আমরা এক দিন বা এক দিনেরও কম থেকেছি। (আমাদের ভালো মনে নেই) কাজেই যারা (সময়) গুনেছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন। আল্লাহ বলবেন, তোমরা অল্পকালই থেকেছিলে। কতইনা ভালো হতো যদি এ বিষয়টা তোমরা (আগেই) বুঝতে! তবে কি তোমরা মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অহেতুক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না?(সূরা মুমিনূন (২৩), আয়াত ৯৯-১১৫)

ব্যাখ্যা
এখানে সূরা মুমিনূনের ৯৯ থেকে ১১৫ পর্যন্ত মোট ১৭টি আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মৃত্যুকালীন অবস্থা, বরযখের বর্ণনা, কিয়ামতের পরিস্থিতি, মীযানে আমল ওজন করার বর্ণনা, জাহান্নামের বিভীষিকাময় শাস্তির বিবরণ, জাহান্নামে জাহান্নামীদের আক্ষেপ ও সেখান থেকে তাদের মুক্তিদানের আবেদন এবং আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তার উত্তর ও তাদের কৃতকর্মের জন্য তিরস্কার প্রভৃতি বিষয়ের বর্ণনা। সর্বপ্রথম মৃত্যুকালে পাপীগণ আক্ষেপ করে যা বলবে সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ (পরিশেষে যখন তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়ে যাবে, তখন তারা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ওয়াপস পাঠিয়ে দিন)। এ বাক্যটির সম্পর্ক এর আগের ৯০ বা ৯১ নং আয়াতের সঙ্গে। তাতে বলা হয়েছিল, অবিশ্বাসীগণ অনবরত সত্য অস্বীকার করে ও মিথ্যাচার করে এবং তারা আল্লাহ সম্পর্কে নানা অবান্তর ও অসত্য কথাবার্তা বলে। তারা তা থেকে কোনওক্রমেই ক্ষান্ত হয় না। সারাটা জীবন এভাবে অবাধ্যতার মধ্যে কাটিয়ে দেয়। তারপর এ আয়াতে বলা হচ্ছে যে, পরিশেষে যখন তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়, মৃত্যুর ফিরিশতাদের দেখতে পায় এবং কঠিন মৃত্যুযন্ত্রণার সম্মুখীন হয়, তখন তাদের হুঁশ হয়। তখন বুঝতে পারে নবী- রাসূলগণ যা বলেছেন তাই সত্য। সে সত্য অস্বীকার করে তারা চরম ভুল করেছে। তখন তারা সে ভুলের প্রতিকার করার পথ খোঁজে। তাই আল্লাহ তা'আলার কাছে আবেদন জানায় যে, আমাকে ফিরিয়ে দিন। আমার মৃত্যু পিছিয়ে দিন। শেষবারের মতো সুযোগ দিন।
لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ ‘যাতে আমি যা (অর্থাৎ যে দুনিয়া) ছেড়ে এসেছি সেখানে গিয়ে সৎকাজ করতে পারি'। এর আরেক অর্থ হতে পারে- আমি যে ঈমান ও সৎকর্ম পরিত্যাগ করেছি, যাতে তা অবলম্বন করতে পারি। অর্থাৎ সময় দিলে আমি ঈমান আনব এবং সৎকর্ম করব। আরেক অর্থ হতে পারে- আমি দুনিয়ায় যে সম্পদ ছেড়ে এসেছি, যা আমি আপনার মর্জি মোতাবেক খরচ করিনি এবং তা দ্বারা কোনও পুণ্য কামাই করিনি, এবার সময় পেলে আমি সে সম্পদ দ্বারা সৎকাজ করব। তা আপনার সন্তুষ্টির পথে খরচ করব। মোটকথা মৃত্যু অবস্থা দেখে পাপী ব্যক্তি তার পরবর্তী অশুভ পরিণাম আঁচ করতে পারে। তাই সে মৃত্যু থেকে বাঁচতে চায়। সামনে অগ্রসর হতে চায় না। পেছনের জীবনে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু মুমিনদের অবস্থা হয় এর বিপরীত। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
«مَنْ أَحَبَّ لِقَاءَ اللَّهِ أَحَبَّ اللَّهُ لِقَاءَهُ، وَمَنْ كَرِهَ لِقَاءَ اللَّهِ كَرِهَ اللَّهُ لِقَاءَهُ» قَالَتْ عَائِشَةُ أَوْ بَعْضُ أَزْوَاجِهِ: إِنَّا لَنَكْرَهُ المَوْتَ، قَالَ: «لَيْسَ ذَاكِ، وَلَكِنَّ المُؤْمِنَ إِذَا حَضَرَهُ المَوْتُ بُشِّرَ بِرِضْوَانِ اللَّهِ وَكَرَامَتِهِ، فَلَيْسَ شَيْءٌ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا أَمَامَهُ، فَأَحَبَّ لِقَاءَ اللَّهِ وَأَحَبَّ اللَّهُ لِقَاءَهُ، وَإِنَّ الكَافِرَ إِذَا حُضِرَ بُشِّرَ بِعَذَابِ اللَّهِ وَعُقُوبَتِهِ، فَلَيْسَ شَيْءٌ أَكْرَهَ إِلَيْهِ مِمَّا أَمَامَهُ، كَرِهَ لِقَاءَ اللَّهِ وَكَرِهَ اللَّهُ لِقَاءَهُ»
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পসন্দ করে, আল্লাহ তা'আলাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পসন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অপসন্দ করে, আল্লাহ তা'আলাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অপসন্দ করেন। এ সময় উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্য কোনও স্ত্রী বলে ওঠেন, আমরা তো অবশ্যই মৃত্যুকে অপসন্দ করি (তাহলে তো আল্লাহও আমাদের সাক্ষাৎকে অপসন্দ করে থাকবেন)! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বিষয়টা তা নয়। বস্তুত যখন কোনও মুমিনের মৃত্যু হাজির হয়, তখন তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর পক্ষ থেকে সম্মান দেওয়ার সুসংবাদ শোনানো হয়। তখন তার কাছে তার সামনে যা আছে (মৃত্যু ও তার পরবর্তী ধাপসমূহ) তার চেয়ে বেশি প্রিয় আর কিছু হয় না। তখন সে আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে পসন্দ করে। আর আল্লাহ তা'আলাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে পসন্দ করেন। অপরদিকে যখন কোনও কাফের ব্যক্তির মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন তাকে আল্লাহর আযাব ও অশুভ পরিণামের সংবাদ দেওয়া হয়। তখন তার কাছে তার সামনে যা-কিছু আছে তারচে' বেশি অপসন্দনীয় আর কিছুই থাকে না। ফলে সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অপসন্দ করে এবং আল্লাহ তা'আলাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অপসন্দ করেন।’(সহীহ বুখারী: ৬৫০৭; সহীহ মুসলিম: ২৬৮৩; জামে' তিরমিযী : ২৩০৯; সুনানে নাসাঈ : ১৮৩৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২৬৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৪৪৯; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩০০৯)

কাফেরগণ যখন উল্লিখিত ফরিয়াদ করবে, তখন আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে উত্তর দেওয়া হবে-كَلَّا إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا (কখনও না। এটা একটা কথার কথা, যা সে মুখে বলছে মাত্র)। অর্থাৎ তারা শাস্তির ভয়ে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ তা'আলার কাছে ফরিয়াদ করে যে বলবে 'আমাকে ফিরিয়ে দিন, আমি সৎকর্ম করব', এটা কখনও ঘটার নয়। কেননা মৃত্যুর যে সময় নির্ধারিত করা আছে তা কিছুতেই টলার নয় এবং মৃত্যুর পর দুনিয়ায় ফিরে আসারও কোনও অবকাশ নেই। আর তারা যে ভালো হয়ে যাওয়ার কথা বলছে, তাও সত্য নয়। সারকথা এটা তাদের একটা কথা মাত্র, যা কোনওভাবেই পূর্ণ হওয়ার নয়।
وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ ‘তাদের (অর্থাৎ মৃতদের) সামনে রয়েছে ‘বরযখ’, যা তাদেরকে পুনরুত্থিত করার দিন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে'। ‘বরযখ’ বলা হয় কবরকে। কারও মতে মৃত্যু হতে কিয়ামত পর্যন্ত সময়কে। উভয় মতের মধ্যে মূলত কোনও পার্থক্য নেই। বোঝানো উদ্দেশ্য তারা যে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছে, এটা ঘটবেই এবং এর পর পুনরুত্থান দিবস তথা কিয়ামত পর্যন্ত তাদেরকে কবরেই অবস্থান করতে হবে। সেখান থেকে দুনিয়ায় ফিরে আসার কোনও অবকাশ নেই। এ বরযখের জগৎও বড় কঠিন। সেখানে ইহজগতের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকবে না। আবার আখিরাতের আযাবেরও কিছু নমুনা সেখানে প্রকাশ পায়। পুনরুত্থান না হওয়া পর্যন্ত সে আযাবের মধ্যেই কাটাতে হবে। এখন এ মৃত্যুতেই তোমরা এমন ঘাবড়াচ্ছ। তাহলে সেই বরযখের জগতে তোমাদের কেমন অবস্থা হবে? তারপর সেখান থেকে জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হতে হবে। সেখানকার পরিস্থিতি আরও কঠিন। ইরশাদ হয়েছে-
فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلَا أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُونَ (অতঃপর যখন সিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে, তখন তাদের মধ্যকার কোনও আত্মীয়তা বাকি থাকবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. এর ব্যাখ্যা করেন যে, আখিরাতে মানুষ বংশ-গোত্র নিয়ে গৌরব করবে না, যেমন দুনিয়ায় করে থাকে। এবং সেখানে কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করবে না যে, তুমি কোন গোত্রের, তোমার বংশতালিকা কী, যেমন দুনিয়ায় জিজ্ঞেস করে থাকে। কিয়ামত বড় বিভীষিকাময়। সে বিভীষিকা মানুষকে সবকিছু ভুলিয়ে দেবে। হযরত ইবন আব্বাস রাযি. আরও বলেন, এটা শিঙ্গায় প্রথম ফুৎকারের সময়কার কথা। সে ফুৎকারে মহাপ্রলয় সংঘটিত হবে। আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সকলেই বেহুঁশ হয়ে পড়বে। আল্লাহ তা'আলা যাকে চান কেবল সেই ব্যতিক্রম থাকবে। তারপর শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুঁ দেওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকে আপন স্থান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যাবে এবং হয়রান হয়ে তাকিয়ে থাকবে। সে সময় সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ (27)
‘তারা একে অন্যের অভিমুখী হয়ে পরস্পরে সওয়াল-জওয়াব করবে।(সূরা সাফ্ফাত (৩৭), আয়াত ২৭)
তবে বিশুদ্ধ মত হল আলোচ্য আয়াতে শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুঁ দেওয়ার পরের কথা বলা হয়েছে, যে ফুঁকের পর সকলেই জীবিত হয়ে উঠবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাযি. বলেন, কিয়ামতের দিন বান্দা বা বান্দীর হাত ধরে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত মানুষের সামনে দাঁড় করানো হবে। তারপর একজন ঘোষক ঘোষণা করবে, এ ব্যক্তি অমুকের পুত্র অমুক। এর কাছে কারও কিছু পাওনা থাকলে সে যেন এসে তার পাওনা নিয়ে নেয়। তখন সে ব্যক্তি বড় খুশি হবে। কারণ তার প্রাপ্য রয়েছে তার পিতার কাছে, তার সন্তানের কাছে, তার স্ত্রীর কাছে বা তার ভাইয়ের কাছে। সে তার হক আদায় করে নেবে। তারপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. পাঠ করেন- فَلَا أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُونَ (তখন তাদের মধ্যকার কোনও আত্মীয়তা বাকি থাকবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না)।(ইবনুল মুবারক, আয-যুহদ ওয়ার-রাকাইক: ১৪১৬)
সূরা ‘আবাসায় ইরশাদ হয়েছে-
يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ (34) وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ (35) وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ (36) لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ (37)
‘যেদিন মানুষ তার ভাই থেকেও পালাবে এবং নিজ পিতা-মাতা থেকেও এবং নিজ স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি থেকেও। (কেননা) সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন দুশ্চিন্তা দেখা দেবে, যা তাকে অন্যের থেকে ব্যস্ত করে রাখবে।’(সূরা ‘আবাসা (৮০), আয়াত ৩৪-৩৭)
উল্লেখ্য, এটা কাফেরদের অবস্থা। মুমিনদের অবস্থা এর থেকে ভিন্ন। মুমিনদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُم بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ
‘যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের সন্তান-সন্ততিগণ ঈমানের ক্ষেত্রে তাদের অনুগামী হয়েছে, আমি তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে তাদের সাথে মিলিয়ে দেব।’(সূরা তৃর (৫২), আয়াত ২১)
বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কিয়ামতের দিন মুসলিম সন্তানগণ তাদের পিতা- মাতাকে পানি পান করাবে। এমনকি মায়ের পেট থেকে যে শিশু অসম্পূর্ণরূপে জন্ম নেয়, সেও সেদিন আল্লাহর কাছে আরয করবে যে, আমি আমার পিতা-মাতা ছাড়া জান্নাতে যাব না। এর দ্বারা বোঝা যায় মুমিনদের মধ্যকার বংশীয় সম্পর্ক ছিন্ন হবে না।
এ আয়াতে যে বলা হয়েছে 'সেদিন কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না', অপরদিকে সূরা সাফ্ফাতে বলা হয়েছে- وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ (তারা একে অন্যের অভিমুখী হয়ে পরস্পরে সওয়াল-জওয়াব করবে), এর মধ্যে বাহ্যত বিরোধ মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে কোনও বিরোধ নেই। কেননা কিয়ামতের দিন বিভিন্ন রকম অবস্থা হবে। কখনও এমন কঠিন অবস্থার সৃষ্টি হবে যে, মানুষ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা তো দূরের কথা, ভয়ে আতঙ্কে কারও দিকে ফিরে তাকানোরও অবকাশ পাবে না। প্রত্যেকে নিজের চিন্তায় বিভোর থাকবে। আবার কখনও ভয়-ভীতি কিছুটা হালকা হবে। তখন একে অন্যের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে এবং খোঁজখবর নেবে।
فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (তখন যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে)। অর্থাৎ সেদিন মীযান ও দাড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। মানুষের আমল পরিমাপ করা হবে। যার নেক আমলের ওজন বেশি হবে, সে মুক্তিলাভ করবে এবং জান্নাতের অধিকারী হবে। যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে রক্ষা পায় ও জান্নাতের অধিকারী হয়, সেই প্রকৃত সফলকাম।
وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ (আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই এমন, যারা নিজেদের জন্য লোকসানের ব্যবসা করেছিল। তারা সদা-সর্বদা জাহান্নামে থাকবে)। অর্থাৎ যারা ঈমান আনেনি; বরং কুফর অবলম্বন করেছিল, তারা জান্নাতের বদলে জাহান্নাম খরিদ করেছে। নিঃসন্দেহে জান্নাতের বিনিময়ে জাহান্নাম গ্রহণ করাটা ভয়ানক লোকসানের ব্যবসা। তাদেরকে চিরদিন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। কোনওদিন তারা মুক্তি পাবে না।
প্রকাশ থাকে যে, এ আয়াতে কাফেরদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, আর এর আগের আয়াতে সৎকর্মশীল মুমিনদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছিল। গুনাহগার মুমিনদের অবস্থা এখানে বর্ণনা করা হয়নি। অন্যান্য আয়াত ও হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, তাদের বিষয়টা আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাধীন থাকবে। তিনি ক্ষমা করলে শুরুতেই তারা জান্নাতে যাবে। অন্যথায় তারা তাদের পাপ অনুপাতে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। শাস্তিভোগের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ঈমানের বদৌলতে তারা মুক্তি পাবে। পরিশেষে তারাও জান্নাতের বাসিন্দা হয়ে যাবে। সেখানে তারা অনন্তকাল বাস করবে।
تَلْفَحُ وُجُوهَهُمُ النَّارُ وَهُمْ فِيهَا كَالِحُونَ (আগুন তাদের চেহারা ঝলসে দেবে এবং তাতে তাদের আকৃতি বিকৃত হয়ে যাবে)। এরূপ অবস্থা হবে কাফেরদের। পাপী মুমিনদের চেহারা আগুনে দগ্ধ হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ قَوْمًا يُخْرَجُوْنَ مِنَ النَّارِ يَحْتَرِقُوْنَ فِيْهَا، إِلَّا دَارَاتِ وُجُوهِهِمْ حَتَّى يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ
‘একদল লোককে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে, যারা জাহান্নামে দগ্ধীভূত হবে, তবে তাদের মুখমণ্ডল নয়। পরিশেষে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে।(সহীহ মুসলিম : ১৯১; ইবন মান্দাহ, আল-ঈমান: ৮৫৯)
আয়াতে বলা হয়েছে, জাহান্নামে তাদের চেহারা বীভৎস হয়ে যাবে। এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
تَشْوِيهِ النَّارُ فَتَقَلَّصُ شَفَتُهُ العُلْيَا حَتَّى تَبْلُغَ وَسَطَ رَأْسِهِ وَتَسْتَرْخِي شَفَتُهُ السُّفْلَى حَتَّى تَضْرِبَ سُرَّتَهُ

‘জাহান্নাম তাকে এমনভাবে দগ্ধ করবে যে, তার উপরের ঠোঁট সংকুচিত হয়ে যাবে। এমনকি তা মাথার তালু পর্যন্ত পৌছে যাবে। আর নিচের ঠোঁট যাবে ঢিলা হয়ে। এমনকি তা নাভি স্পর্শ করবে।’(জামে' তিরমিযী: ২৫৮৭; মুসনাদ আবূ ইয়া'লা: ১৩৬৭;; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪৪১৭)
أَلَمْ تَكُنْ آيَاتِي تُتْلَى عَلَيْكُمْ فَكُنْتُمْ بِهَا تُكَذِّبُونَ (তাদেরকে বলা হবে) তোমাদেরকে কি আমার আয়াতসমূহ পড়ে শোনানো হতো না? কিন্তু তোমরা তা অবিশ্বাস করতে'। অর্থাৎ কাফেরদের তিরস্কার করে বলা হবে যে, তোমাদের কাছে তো আমার আয়াতসমূহ পৌঁছানো হয়েছিল। তোমাদের সামনে তা পাঠ করা হয়েছিল। কিন্তু তোমরা তা অস্বীকার করেছিলে। তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলে। এখন দেখো তা কতটা সত্য ছিল। যদি তখন তোমরা এতে বিশ্বাস করতে, তবে আজ তোমাদের এ পরিণতি হতো না।
قَالُوا رَبَّنَا غَلَبَتْ عَلَيْنَا شِقْوَتُنَا وَكُنَّا قَوْمًا ضَالِّينَ (তারা বলবে,হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর আমাদের দুর্ভাগ্য ছেয়ে গিয়েছিল এবং আমরা ছিলাম বিপথগামী সম্প্রদায়)। দুর্ভাগ্য বলে সম্ভবত তাদের কুপ্রবৃত্তি ও মনের খেয়াল-খুশি বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আমরা আমাদের খেয়াল-খুশির কাছে হেরে গিয়েছিলাম। মন যখন যা চাইত তাই করতাম। মনের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে আপনার আয়াত অস্বীকার করেছিলাম। আর এভাবে আমরা সত্য-সঠিক পথ গ্রহণ না করে ভুল পথে চলেছিলাম।
رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْهَا فَإِنْ عُدْنَا فَإِنَّا ظَالِمُونَ (হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করুন। অতঃপর পুনরায় যদি আমরা সেই কাজই করি, তবে অবশ্যই আমরা জালেম হব)। অর্থাৎ আপনি আমাদেরকে আরেকবার সুযোগ দিন। আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিন। আমরা ওয়াদা করছি এবার আমরা আপনার অনুগত হয়ে চলব। আপনার অবাধ্যতা করব না। যদি পুনরায় সেরকম করি, তবে আমরা জালেম ও সীমালঙ্ঘনকারী সাব্যস্ত হব। নিজেদের প্রতি অবিচারকারী বলে গণ্য হব। তখন আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি দিলে আমরা মুক্তিলাভের জন্য আপনার কাছে ফরিয়াদ করব না। এর উত্তরে আল্লাহ বলবেন-
اخْسَئُوا فِيهَا وَلَا تُكَلِّمُونِ (এরই মধ্যে তোমরা হীন অবস্থায় পড়ে থাকো এবং আমার সাথে কথা বলো না)। অর্থাৎ আবেদন-নিবেদনের স্থান ছিল দুনিয়া। তোমরা সে জায়গা পার হয়ে এসেছ। এটা শাস্তিভোগের জায়গা। কাজেই আর কোনও অনুনয়-বিনয় নয়, এখানে লাঞ্ছিত অবস্থায় পড়ে থাকো। তোমরা এ শাস্তি হতে নিষ্কৃতি পাবে না। অতঃপর জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে তারা মুক্তিলাভের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে যাবে।
হাসান বসরী রহ. বলেন, এটাই হবে দোযখবাসীদের সঙ্গে আল্লাহ তা'আলার সর্বশেষ কথা। তারপর তারা অনুতাপে কুকুরের মতো চিৎকার করতে থাকবে, যা তারা নিজেরাও বুঝবে না, অন্য কাউকেও বোঝাতে পারবে না।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাযি. বলেন, জাহান্নামবাসীরা (জাহান্নামের দায়িত্বে নিযুক্ত ফিরিশতাদের প্রধান) মালেককে ডেকে বলবে, হে মালেক! তোমার রব্ব আমাদের কাজ শেষ করে দিন। মালেক ৪০ বছর তাদের উপেক্ষা করবেন, কোনও উত্তর দেবেন না। তারপর এই বলে উত্তর দেবেন যে, তোমাদেরকে এখানেই থাকতে হবে। তারপর তারা তাদের রব্বকে ডেকে বলবে, হে আমাদের রব্ব! আমাদেরকে এখান থেকে বের করুন। আমরা যদি আবারও আগের মতো করি, তবে আমরা অবশ্যই জালেম ও সীমালঙ্ঘনকারী সাব্যস্ত হব। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে দুনিয়ার বয়সের দ্বিগুণকাল পরিমাণ উপেক্ষা করবেন। কোনও উত্তর দেবেন না। তারপর এই বলে উত্তর দেবেন যে, তোরা লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামের ভেতর থাক। আমার সঙ্গে কোনও কথা বলিস না। ফলে তারা নিরাশ হয়ে যাবে। এরপর আর তারা একটি কথাও বলবে না। কেবল তাদের চিৎকার ও আর্তনাদ শোনা যাবে।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন- إِنَّهُ كَانَ فَرِيقٌ مِنْ عِبَادِي يَقُولُونَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ (আমার বান্দাদের একটি দল দু'আ করত, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ঈমান এনেছি। সুতরাং আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন। আপনি দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু)। অর্থাৎ আমার বান্দাদের এক দল আমার প্রতি বিশ্বাস রাখত। তারা আমার আনুগত্য করত। আমার আদেশ-নিষেধ মেনে চলত। কখনও ভুল-ত্রুটি হয়ে গেলে সেজন্য ইস্তিগফার ও ক্ষমাপ্রার্থনা করত। তারা আমার দয়া ও রহমতের আশাবাদী ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল আমি পরম দয়ালু, তাদের প্রতি দয়ার আচরণ করব। সে বিশ্বাসে তারা আমার কাছে রহমত প্রার্থনা করত এবং রহমতলাভের উপযুক্ত আমল করতে সচেষ্ট থাকত (বলাবাহুল্য রহমত পাওয়ার উপযুক্ত আমল হচ্ছে শরী'আত অনুযায়ী আমল করা)। তাদের সে আমল ছিল তোমাদের আমলের সম্পূর্ণ বিপরীত। আর এ কারণে তোমরা তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে। আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
فَاتَّخَذْتُمُوهُمْ سِخْرِيًّا حَتَّى أَنْسَوْكُمْ ذِكْرِي وَكُنْتُمْ مِنْهُمْ تَضْحَكُونَ (তোমরা তখন তাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছিলে। এমনকি তা তোমাদেরকে আমার স্মরণ পর্যন্ত ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর তোমরা তাদেরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় লিপ্ত থাকতে)। অর্থাৎ তারা দীন ও শরী'আত মানত বলে তোমরা তাদেরকে নানাভাবে উপহাস করতে। তাদেরকে পাগল বলতে। নির্বোধ ঠাওরাতে। সেকেলে ও পশ্চাদপদ গণ্য করতে। তার বিপরীতে নিজেদেরকে মনে করতে সভ্য ও প্রগতিশীল। তোমরা তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ও নিজেদের অহংকার-অহমিকায় মত্ত থাকার কারণে আমাকে ভুলে গিয়েছিলে। আমি যে তোমাদের সৃষ্টিকর্তা, তোমাদের পালনকর্তা আর এ কারণে আমার আনুগত্য করা তোমাদের অবশ্যকর্তব্য, সে কথা একবারও মনে করনি। উল্টো আমার অবাধ্যতায় লিপ্ত থেকেছিলে। আর এভাবে তোমরা আমার হকও নষ্ট করেছিলে এবং বান্দার হকও নষ্ট করেছিলে। ফলে তোমরা ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত থাকনি। এখন জাহান্নামে চিরদিন শাস্তি ভোগ করতে থাকো।
إِنِّي جَزَيْتُهُمُ الْيَوْمَ بِمَا صَبَرُوا أَنَّهُمْ هُمُ الْفَائِزُونَ (তারা যে সবর করেছিল সে কারণে আজ আমি তাদেরকে এমন প্রতিদান দিলাম যে, তারাই হয়ে গেল কৃতকার্য)। অর্থাৎ তোমরা যে আমার অনুগত বান্দাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে ও নানাভাবে কষ্ট দিতে, তাতে তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। তারা ধৈর্যের সঙ্গে নিয়মিত আমার ইবাদত-বন্দেগীও আঞ্জাম দিয়েছিল। আজ আমি তাদেরকে সে ধৈর্যের সুফল দিয়েছি। আমি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত রেখে জান্নাতের বাসিন্দা করে দিয়েছি। সুতরাং আজ তারাই সফল আর তোমরা ব্যর্থ।
قَالَ كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الْأَرْضِ عَدَدَ سِنِينَ (আল্লাহ বলবেন, তোমরা পৃথিবীতে বছরের গণনায় কত কাল থেকেছ)? অর্থাৎ তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই সবকিছু মনে করেছিলে। আখিরাতের কথা ভুলে দুনিয়া নিয়েই মত্ত থেকেছিলে। তারপর তোমাদের মৃত্যু হল। তোমরা কবরে একটা দীর্ঘকাল কাটালে। হাশরের ময়দানে বিচারের অপেক্ষায়ও থাকলে দীর্ঘ সময়। তারপর এখন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করছ। তা যেই দুনিয়াকে সবকিছু মনে করেছিলে এবং যার জন্য কবরের আযাব, হাশরের বিভীষিকা ও জাহান্নামের শাস্তি সবই গ্রহণ করে নিলে, এবার বলো সেই দুনিয়ায় তোমরা কতদিন কাটিয়েছিলে? দুনিয়ার তুচ্ছ ভোগ-উপভোগ কতদিনের জন্য পেয়েছিলে?
قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ فَاسْأَلِ الْعَادِّينَ ‘তারা বলবে, আমরা এক দিন বা এক দিনেরও কম থেকেছি। (আমাদের ভালো মনে নেই) কাজেই যারা (সময়) গুনেছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন'। অর্থাৎ কাফেরগণ পৃথিবীতে তাদের অবস্থানকালকে খুবই অল্প মনে করবে। একদিন বা তারও কম। এত অল্প মনে করবে এ কারণে যে, কবর-হাশর ও জাহান্নামবাসের কালটা অনেক দীর্ঘ। সে তুলনায় দুনিয়ার জীবন এমনিতেই অতি অল্প। তারপর আবার শাস্তি ও দুঃখ-কষ্টের সময়টা বাস্তব অপেক্ষাও দীর্ঘ মনে হয়। যে ব্যক্তি সে কষ্টের মধ্যে থাকে, সে তার আগের সুখের কালটাকে অতি সংক্ষিপ্ত মনে করে। তাছাড়া তাদের পার্থিব জীবন তো অতীতের কথা। তা শেষ হয়ে গেছে। এখন আখিরাতের জীবন ভোগ করছে, যার কোনও শেষ নেই। অনন্ত অশেষ কালের তুলনায় সীমিত ও শেষ হয়ে যাওয়া কালের কোনও তুলনা চলে কি?
যাহোক চরম কষ্টের মধ্যে থাকার কারণে তারা দুনিয়ার জীবনের পরিমাণটা সঠিক মনে করতে পারবে না। তাই তারা বলবে, আপনি গণনাকারীদের জিজ্ঞেস করুন। অর্থাৎ সেসব ফিরিশতাদেরকে, যারা মানুষের আমল ও কাজকর্মের হিসাব রাখে। তারা পৃথিবীতে আমাদের অবস্থানকাল সম্পর্কে ভালো জানে। তারাই এর সঠিক হিসাব দিতে পারবে।
قَالَ إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘আল্লাহ বলবেন, তোমরা অল্পকালই থেকেছিলে। কতইনা ভালো হতো যদি এ বিষয়টা তোমরা (আগেই) বুঝতে'। অর্থাৎ এই আখিরাতের দৈর্ঘ্য ও স্থায়িত্বের তুলনায় দুনিয়ার জীবন ছিল অতি ক্ষণস্থায়ী। তোমরা যদি দুনিয়ায় থাকা অবস্থায়ই বুঝতে যে, তা অতি সংক্ষিপ্ত জীবন, অল্পদিন পরেই শেষ হয়ে যাবে, তারপর এই অনন্ত জীবনের পথে পা বাড়াতে হবে, তবে তা তোমাদের জন্য কতইনা কল্যাণকর হতো! তখন তোমরা আমার অবাধ্যতা করতে না। মনের কামনা-বাসনা পূরণের পেছনে পড়ে জীবন নষ্ট করতে না। বরং আখিরাতের এ জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে। ফলে আজ জাহান্নাম থেকে রক্ষা পেয়ে মুমিনদের মতো জান্নাতবাসী হয়ে যেতে। কিন্তু আফসোস! তোমরা এসব চিন্তা করনি। দুনিয়া নিয়েই বিভোর ছিলে। ফলে আজ তোমাদেরকে তার খেসারত তো দিতেই হবে।
আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন যে কত সংক্ষিপ্ত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীছে সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ করেছেন-
واللَّهِ ما الدُّنْيا في الآخِرَةِ إلَّا مِثْلُ ما يَجْعَلُ أحَدُكُمْ إصْبَعَهُ هذِه -وأَشارَ يَحْيَى بالسَّبَّابَةِ- في اليَمِّ، فَلْيَنْظُرْ بمَ تَرْجِعُ؟
‘আল্লাহর কসম! আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া এরকম, যেমন তোমাদের কেউ তার তর্জনী আঙ্গুল সাগরে রাখল, তারপর উঠিয়ে নিল, এবার দেখুক আঙ্গুলটি কী পরিমাণ পানি নিয়ে এসেছে।’(সহীহ মুসলিম : ২৮৫৮; জামে' তিরমিযী : ২৩২৩; সুনানে ইবন মাজাহ : ৪১০৮; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ১১৭৯৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৩৪৩০৬; সহীহ ইবন হিব্বান। ৪৩৩০)
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ (তবে কি তোমরা মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অহেতুক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না)? অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
أَيَحْسَبُ الْإِنسَانُ أَن يُتْرَكَ سُدًى (36)
‘মানুষ কি মনে করে তাকে এমনিই ছেড়ে দেওয়া হবে?(সূরা কিয়ামাহ (৭৫), আয়াত ৩৬)
অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে মোটেই অনর্থক সৃষ্টি করিনি। বরং আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এজন্য যে, তোমরা আমাকে চিনবে এবং আমার আনুগত্য ও ইবাদত-বন্দেগী করবে। তোমরা তার ঠিক কতখানি কর, তা লক্ষ রাখা হবে। এটা তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। দুনিয়ার গোটা জীবনই তো তোমাদের জন্য পরীক্ষা। একসময় তোমাদের মৃত্যু হবে। তারপর তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন তোমাদেরকে পার্থিব জীবনের যাবতীয় বিষয়ের হিসাব দিতে হবে। তোমরা আমার কতটুকু আনুগত্য করেছ এবং কতটুকু অবাধ্যতা করেছ, কতটুকু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছ এবং কতটুকু অকৃতজ্ঞতা করেছ, তার পরিপূর্ণ হিসাব তোমাদের থেকে নেওয়া হবে। তোমাদেরকে এমনি এমনিই ছেড়ে দেওয়া হবে না। হিসাব দেওয়ায় উত্তীর্ণ হতে পারলে পুরস্কারস্বরূপ তোমরা জান্নাত লাভ করবে। আর হিসাব দিতে ব্যর্থ হলে তোমাদের পরিণাম হবে জাহান্নামের শাস্তি। সুতরাং এসব বিষয় স্মরণ রেখেই তোমাদের ইহজীবন যাপন করা উচিত। হাকীম তিরমিযী রহ. বলেন, আল্লাহ তা'আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর বান্দা ও দাসরূপে। তাদের কর্তব্য তাঁর বন্দেগী ও দাসত্ব করা। তা করলে তিনি তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন আর না করলে শাস্তি দেবেন। তারা তাঁর বন্দেগী করলে একদিকে তারা হবে আল্লাহর গোলাম, অন্যদিকে দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছু হতে থাকবে মুক্ত ও স্বাধীন এবং থাকবে সম্মানিত ও ইসলামী জগতের বাদশা হয়ে। আর যদি তাঁর বন্দেগী পরিহার করে, তবে তারা সাব্যস্ত হবে পলাতক গোলাম। থাকবে হীন ও লাঞ্ছিত। আর আখিরাতে তারা আল্লাহর দুশমনরূপে বহুস্তরবিশিষ্ট আগুনের কারাগারে বন্দি থাকবে।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. মৃত্যু মানুষের অবধারিত পরিণতি। সে কথা ভুলতে নেই।
খ. মৃত্যুকালে পাপী বান্দাগণ আক্ষেপ করবে। কিন্তু সে আক্ষেপ কোনও কাজে আসবে না।
গ. যা-কিছু সৎকর্ম করার, তা এখনই করা চাই। যে-কোনও সময় মৃত্যু হাজির হয়ে যাবে। তখন কিছু করার অবকাশ থাকবে না।
ঘ. আল্লাহর দেওয়া জীবন, ধন-সম্পদ ও অন্যসব নি'আমত সৎকর্মে ব্যবহার করা চাই।
ঙ. মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্যবর্তী সময়কে বরযখের জগৎ বলা হয়। সুদীর্ঘ সে সময়টা যাতে আযাব থেকে নিরাপদ থাকা যায়, তাই নেক আমলের মধ্যে জীবন কাটানো চাই।
চ. কিয়ামত হবে হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম কর্তৃক শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার দ্বারা। এটা সত্য। এতে বিশ্বাস রাখা জরুরি।
ছ. আখিরাতে দুনিয়ার বংশপরিচয় ও বংশগৌরব কোনও কাজে আসবে না।
জ. হাশরের ময়দান বড় বিভীষিকাময়। সেখানে কেউ কারও দিকে ফিরে তাকাবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না।
ঝ. মীযানে মানুষের আমল পরিমাপ করা হবে। এটা সত্য। এতে বিশ্বাস রাখা ফরয।
ঞ. যার নেক আমলের ওজন বেশি হবে, সে হবে জান্নাতবাসী। আর যার বদ আমলের ওজন বেশি হবে, তাকে জাহান্নামে যেতে হবে।
ট. জাহান্নামের আযাবে পাপীদের চেহারা বীভৎস হয়ে যাবে।
ঠ. আল্লাহ তা'আলার প্রতিটি আয়াতকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা এবং আয়াত পাঠকালে তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া ও বিনয় প্রদর্শন করা কর্তব্য।
ড. শরী'আত উপেক্ষা করে মনের খেয়াল-খুশিমতো চলা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ।
ঢ. কাফের ব্যক্তিকে চিরকাল জাহান্নামে থাকতে হবে। কখনও সেখান থেকে মুক্তি পাবে না।
ণ. মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করা, তাঁর কাছে দু'আ করা, তাওবা ও ইস্তিগফার করা এবং আল্লাহ তা'আলার রহমতের আশাবাদী থাকা।
ত. দীনদার ও গরীব-দুঃখীকে উপহাস করা কাফের ও ফাসেকদের কাজ। মুমিনদেরকে এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে।
থ. যে ব্যক্তি অন্যকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, সে আল্লাহ তা'আলার যিকির ও স্মরণ ভুলে যায়।
দ. অন্যের ঠাট্টা-বিদ্রুপে সবর করা চাই। এটা আখিরাতে সফলতালাভের একটি উপায়।
ধ. আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন নিতান্তই অল্প।
ন. আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার নগণ্যতা স্মরণ রাখা নেক আমলে মশগুল থাকার পক্ষে সহায়ক।
প. মানুষকে সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্য আল্লাহ তা'আলার ইবাদত-বন্দেগী। এটা না করার দ্বারা মানবজীবন বৃথা হয়ে যায়।
ফ. বেহুদা কাজ করা আল্লাহ তা'আলার শান নয়। মানুষেরও কোনও বেহুদা কাজ করা উচিত নয়।
ব. পুনরুত্থান ও আল্লাহ তা'আলার কাছে প্রত্যাবর্তন মানুষের জন্য আল্লাহর অবধারিত বিধান।

ছয় নং আয়াত
أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ (16)
অর্থ: যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য কি এখনও সেই সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তাদের অন্তর বিগলিত হবে? এবং তারা তাদের মতো হবে না, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল অতঃপর যখন তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল এবং (আজ) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য।(সূরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ১৬)

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে মুমিনদের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে- তারা যেন অলসতা ছেড়ে আমলে যত্নবান হয়। যেন গুনাহ পরিহার করে সৎকর্মে মনোযোগী হয়। মনের খেয়াল-খুশি দমন করে শরী'আতের অনুসরণে বদ্ধপরিকর হয়। যে-কোনও সময় মৃত্যু এসে যাবে। আত্মসংশোধনের এখনই সময়। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা বলেন-
أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ (যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য কি এখনও সেই সময় আসেনি যে, তাদের অন্তর বিগলিত হবে আল্লাহর স্মরণে)? যিকির অর্থ স্মরণ। আল্লাহর স্মরণ মানে আল্লাহ তা'আলা যে আমাদের খালেক ও মালিক, এ কথা চিন্তা করা। আরও চিন্তা করা যে, তিনি সর্বশক্তিমান ও অন্তর্জামী এবং তিনি দয়াময় ও শাস্তিদাতা। সুতরাং তিনি মানুষকে তাদের ভালোমন্দ কর্ম অনুযায়ী প্রতিফল দেবেন। যারা ভালো কাজ করবে তাদেরকে জান্নাতে পুরস্কৃত করবেন এবং যারা মন্দ কাজ করবে তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি দেবেন। এসব কথা চিন্তা করে আল্লাহ তা'আলার শাস্তির ভয়ে মনে মনে কেঁপে ওঠা আর তার ফলশ্রুতিতে যাবতীয় পাপকর্ম ছেড়ে দেওয়া। এমনিভাবে তাঁর রহমতের আশায় মন মাতানো আর তার ফলশ্রুতিতে সৎকর্মে লেগে পড়া। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا
‘মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে।(সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২)
যিকিরের আরেক অর্থ উপদেশ। সে হিসেবে এর অর্থ হবে- মুমিনদের কি সে সময় আসেনি যে, আল্লাহর উপদেশ শুনে তাদের মন গলবে? অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা কুরআন মাজীদে মানুষকে নানাভাবে যে উপদেশ দিয়েছেন এবং তা ছাড়াও জগতের বিচিত্র ঘটনাবলি দ্বারা যে উপদেশগ্রহণের ব্যবস্থা করেছেন, মানুষের উচিত সময় ক্ষেপণ না করে এখনই সেসব উপদেশ গ্রহণ করা আর তার ফলস্বরূপ অলসতা ছেড়ে শরী'আতের আদেশ-নিষেধ মানায় তৎপর হয়ে যাওয়া। কারণ অলসতার সময় একদম নেই। যে- কোনও সময় মৃত্যু হাজির হয়ে যাবে। তখন আর কোনওকিছু করার সুযোগ থাকবে না।
وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ ‘এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে (তাদের অন্তর বিগলিত হবে)'? 'সত্য' দ্বারা কুরআন মাজীদ বোঝানো হয়েছে। কুরআন মাজীদ আল্লাহ তা'আলার সত্য কিতাব। এটা কোনও মানুষের রচনা নয়। কুরআনের ভাষার সৌন্দর্য ও শক্তি, ভাবের গভীরতা ও ব্যপ্তি, এর দুর্দান্ত প্রভাব ও তাছির এবং তত্ত্ব ও তথ্যের ঐশ্বর্যের ভেতর দৃষ্টিপাত করলেই এ সত্য পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। সুতরাং সত্যগ্রহণের মনোভাবে যে ব্যক্তি এ পবিত্র গ্রন্থ পড়বে বা শুনবে আর এর আয়াতসমূহে চিন্তা করবে, সে অবশ্যই মহাসত্যের সন্ধান পেয়ে যাবে। এর প্রতিটি শব্দ ও বাক্য তার হৃদয় স্পর্শ করবে। সে রোমাঞ্চিত হবে। তার দেহমন কেঁপে উঠবে এবং অবিলম্বে আল্লাহর কাছে সমর্পিত হয়ে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালনে বদ্ধপরিকর হয়ে যাবে।
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহর স্মরণে মন নরম হওয়া ও মন গলে যাওয়ার গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। মনের এ গুণ ঈমান-আমলে অগ্রগতির পক্ষে খুব সহায়ক। তাই এ গুণ অর্জনের চেষ্টা করা জরুরি। অন্যথায় ক্ষতির আশঙ্কা যথেষ্ট। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أَوَّلُ مَا يُرْفَعُ مِنَ النَّاسِ الْخُشُوعُ
‘মানুষের ভেতর থেকে সর্বপ্রথম যে জিনিস তুলে নেওয়া হবে তা হল খুশু' (মনের ভয় ও বিগলন)।(তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৭১৮৩; সহীহ ইবন হিব্বান : ৪৫৭২)
وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ ‘এবং তারা তাদের মতো হবে না, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল অতঃপর যখন তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল এবং (আজ) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য'। অতীতের কিতাবী জাতিসমূহ নিজ নিজ কিতাবের নির্দেশনা ভুলে মনের খেয়াল-খুশিমতো চলতে শুরু করে। তারা ধরে নিয়েছিল দুনিয়ায় অনেক দিন বাঁচব। তাই কিছুদিন ফুর্তি করে নিই। এভাবে তারা পাপকর্মে মগ্ন হয়ে যায়। এর ফলে তাদের অন্তর আস্তে আস্তে শক্ত হতে থাকে। অন্তর যখন শক্ত হয়ে যায়, তখন কোনও উপদেশ কাজে আসে না। শাস্তির ধমক শুনলেও মনে কোনও পরিবর্তন দেখা দেয় না। শেষপর্যন্ত বেঈমানরূপে কবরে যেতে হয়। অতীত জাতিসমূহের তাই হয়েছিল। আল্লাহ তা'আলা তাদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ উম্মতকে সতর্ক করছেন যে, তোমরা তাদের মতো হয়ো না। ইহজীবনকে লম্বা মনে করো না। তা মনে করলে মন শক্ত হয়ে যাবে। তখন কোনও আদেশ-উপদেশের তাছির তোমাদের অন্তরে পড়বে না। মৃত্যুর কথা স্মরণ করো। তাতে মন নরম থাকবে। দুনিয়ার সময় বড় সংক্ষিপ্ত। যে-কোনও সময় মৃত্যু এসে যেতে পারে। তাই গড়িমসি না করে দ্রুত নেককাজে লেগে পড়ো।
এ আয়াত দ্বারা মন শক্ত হয়ে যাওয়ার কুফল সম্পর্কে জানা গেল। তাই এ সম্পর্কে খুব সতর্ক থাকা দরকার। যেসব কাজে মন শক্ত হয়, কিছুতেই তাতে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا تُكْثِرُوا الْكَلَامَ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللهِ، فَإِنَّ كَثْرَةَ الْكَلَامِ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللَّهِ قَسْوَةٌ لِلْقَلْبِ، وَإِنَّ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنَ اللَّهِ الْقَلْبُ الْقَاسِي
‘আল্লাহর যিকির ছাড়া অন্য কথা বেশি বলো না। কেননা আল্লাহর যিকির ছাড়া বেশি কথা বললে মন শক্ত হয়ে যায়। আর মানুষের মধ্যে আল্লাহ হতে সর্বাপেক্ষা দূরে থাকে ওই ব্যক্তি, যার মন শক্ত।’(জামে' তিরমিযী: ২৪১১; মুআত্তা মালিক: ২০৭৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩১৮৭৯)
হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. একবার বসরাবাসীদের সামনে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁর সে বক্তৃতায় তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
وَلَا يَطُولَنَّ عَلَيْكُمُ الأمَدُ فَتَقْسُوَ قُلُوبُكُمْ، كما قَسَتْ قُلُوبُ مَن كانَ قَبْلَكُمْ،
‘সাবধান! তোমরা কিছুতেই তোমাদের আয়ুকে দীর্ঘ মনে করো না। তাহলে তোমাদের অন্তর শক্ত হয়ে যাবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের মন শক্ত হয়ে গিয়েছিল।(সহীহ মুসলিম: ১০৫০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ৩৪৮২৩; তহাবী: ২০৩৫)
উল্লেখ্য, আলোচ্য এ আয়াত অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। মনোযোগের সঙ্গে পড়লে বা শুনলে অন্তরে এর দারুণ প্রভাব পড়ে। আয়াতটি বহু লোকের জীবন বদলের কারণ হয়েছিল। বুযুর্গ ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ. ও ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. উল্লেখযোগ্য। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. শুরুতে এক আয়েশী ও ফুর্তিবাজ যুবক ছিলেন। গানবাদ্য করে বেড়াতেন। এক রাতে তিনি তাঁর ফলের বাগানে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। খুব পানাহার চলছিল। এক পর্যায়ে তিনি তাঁর তানপুরা(বীণাসদৃশ তারযন্ত্র) ও বেহালা নিয়ে গান গাইতে শুরু করলেন। কিন্তু কিছুতেই সুর ওঠে না। তিনি আনমনা হয়ে যান। এমন তো কখনও হয় না! সহসা তিনি হাতের বাদ্যযন্ত্র থেকে এক অপূর্ব ধ্বনি শুনতে পান। তিনি কান পাতেন। লক্ষ করে দেখেন তাতে ধ্বনিত হচ্ছে- …أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য কি এখনও সেই সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তাদের অন্তর বিগলিত হবে?...’। অমনি তিনি বলে উঠেন, অবশ্যই সেই সময় এসে গেছে হে আল্লাহ! এই বলে তিনি বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলেন। বন্ধুদের বিদায় করে দেন। তারপর তাওবা করে নতুন জীবন শুরু করে দেন। অতঃপর তিনি ইলম, আমল, আখলাক তথা মানবীয় উৎকর্ষে কত উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন, তা দীনদার মুসলিমমাত্রই জানে।
ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ.-এরও জীবনবদলে এ আয়াতখানি ভূমিকা রেখেছিল। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন এক দস্যু। এক তরুণীর জন্য পাগল ছিলেন। কোনও এক রাতে সেই তরুণীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। তিনি দেয়াল টপকে যেই না বাড়ির ভেতর ঢুকবেন, অমনি শুনতে পান কোথা এক পাঠক পাঠ করছে - …أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ ‘যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য কি এখনও সেই সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তাদের অন্তর বিগলিত হবে?...’। আয়াতখানি যেন তাঁর বুকের উপর এক চাপড় মারল। বুকের দেয়াল ভেদ করে সে চাপড়ে তাঁর হৃদয় কেঁপে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, অবশ্যই হে আল্লাহ! আমার সেই সময় এসে গেছে। এই বলে তিনি দৌড় দিলেন এবং পাশের এক জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। এরই মধ্যে সেখান থেকে এক যাত্রীদল যাচ্ছিল। তাদের একজন বলছিল, সাবধান হও! দস্যু ফুযায়লের দল কিন্তু এরই আশেপাশে থাকে। কথাটি ফুযায়ল রহ, শুনে ফেললেন। তিনি নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বললেন, ওহে কুযায়ল! রাতের বেলা পাপ করতে বের হয়েছ। আবার তুমি এতটাই বরবাদ হয়েছ যে, মুসলিম যাত্রীদল তোমার ভয়ে তটস্থ থাকে। তিনি আর সময় নিলেন না। তখনই তাওবা করলেন। তারপর চলে গেলেন বায়তুল্লাহ শরীফে। সারাটা জীবন সেখানেই কাটিয়ে দিলেন। আজ মহান বুযুর্গ ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ.-কে কে না চেনে?

আয়াতটির শিক্ষা
ক. সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। যে-কোনও সময় মৃত্যু হাজির হয়ে যাবে। কাজেই নিজেকে শোধরানোর এখনই সময়।
খ. আল্লাহর স্মরণে মন নরম ও বিগলিত হওয়া ঈমানের দাবি।
গ. কুরআন আল্লাহর নাযিল করা কিতাব ও পরম সত্য বাণী।
ঘ. দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার আশা ও মৃত্যুকে দূরবর্তী মনে করার দ্বারা মন শক্ত হয়ে যায়।
ঙ. পক্ষান্তরে আল্লাহর যিকির, মৃত্যুর স্মরণ ও আয়কে স্বল্প মনে করার দ্বারা মন নরম ও বিগলিত হয়।
চ. শক্ত মন নেক আমলে আগ্রহী হয় না এবং তা আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকে।
ছ. ঈমানদারদের অতীত জাতিসমূহের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।
ইহজীবন যাপন করতে হবে যে দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে
হাদীছ নং: ৫৭৩

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার দুই কাঁধ ধরে বললেন, তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে থেকো, যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথিক।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বলতেন, তুমি যখন সন্ধ্যায় উপনীত হও, তখন আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং যখন ভোরে উপনীত হও, তখন আর সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। তুমি তোমার সুস্থকালীন সময়ে অর্জন করে নাও অসুস্থতাকালীন সময়ের জন্য এবং তোমার জীবনকালে (অর্জন করে নাও) মৃত্যুর জন্য। -বুখারী
(সহীহ বুখারী : ৬৪১৬; জামে তিরমিযী: ২৩৩৩; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১১৪; মুসনাদে আহমাদ: ৪৭৬৪; সহীহ ইবন হিব্বান: ৬৯৮; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৫১২)
مقدمة الامام النووي
65 - باب ذكر الموت وقصر الأمل
قَالَ الله تَعَالَى: {كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الحَياةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الْغُرُورِ} [آل عمران: 185]، وقال تَعَالَى: {وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْري نَفْسٌ بأيِّ أرْضٍ تَمُوتُ} [لقمان: 34]، وقال تَعَالَى: {فَإذَا جَاءَ أجَلُهُمْ لاَ يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلاَ يَسْتَقْدِمُونَ} [النحل: 61]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تُلْهِكُمْ أمْوَالُكُمْ وَلاَ أوْلاَدُكُمْ عَنْ ذِكْرِ الله وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولئِكَ هم الْخَاسِرُونَ وَأنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأتِيَ أَحَدَكُمُ المَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلاَ أخَّرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَريبٍ فَأصَّدَّقَ وأَكُنْ مِنَ الصَّالِحِينَ وَلَنْ يُؤَخِّرَ اللهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا وَاللهُ خَبيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ} [المنافقون: 9 - 11]، وقال تَعَالَى: {حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ المَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ لَعَلّي أعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ كَلاَّ إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يبْعَثُونَ فَإذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلاَ أنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَومَئِذٍ وَلاَ يَتَسَاءلُونَ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأولئِكَ الَّذِينَ خَسرُوا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ تَلْفَحُ وَجَوهَهُمُ النَّارُ وَهُمْ فِيهَا كَالِحُونَ أَلَمْ تَكُنْ آيَاتِي [ص:194] تُتْلَى عَلَيْكُمْ فَكُنْتُمْ بِهَا تُكَذِّبُونَ} إِلَى قَوْله تَعَالَى: { ... كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الأَرْضِ عَدَدَ سِنِينَ قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ فَاسْئَلِ العَادِّينَ قَالَ إنْ لَبِثْتُمْ إِلاَّ قَلِيلًا لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُم تَعْلَمُونَ أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لاَ تُرْجَعُونَ} [المؤمنون: 99 - 115]، وقال تَعَالَى: {أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلاَ يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِم الأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ} [الحديد: 16]، وَالآيات في الباب كَثيرةٌ معلومة.
573 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما، قَالَ: أخذ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - بِمِنْكَبي، فَقَالَ: «كُنْ في الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ».
وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ رضي الله عنهما، يقول: إِذَا أمْسَيْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الصَّبَاحَ، وَإِذَا أصْبَحتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ المَسَاءَ، وَخُذْ مِنْ صِحَّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ. رواه البخاري. (1)
হাদীস নং: ৫৭৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৬৫ মৃত্যুকে স্মরণ করা এবং লম্বা-চওড়া আশা না রাখা
অসিয়তনামা সঙ্গে রাখার গুরুত্ব
হাদীছ নং: ৫৭৪

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এমন কোনও মুসলিম ব্যক্তিরই নিজের কাছে লিখিত অসিয়তপত্র রাখা ছাড়া দু’রাতও কাটানো উচিত নয়, যার কাছে অসিয়ত করার মতো কিছু আছে। -বুখারী ও মুসলিম। এটা বুখারীর ভাষা।
(সহীহ বুখারী: ২৭৩৮; সহীহ মুসলিম: ১৬২৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৭০০; সুনানে আবু দাউদ: ২৮৬২; জামে' তিরমিযী: ৯৯৬; সুনানে নাসাঈ ৩৬১৫; মুআত্তা মালিক: ২৮১৮; মুসনাদে আহমাদ: ৪৪৬৯; সহীহ ইবন হিব্বান ৬০২৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১২৫৮৮)
মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, তিন রাত কাটানো।
ইবন উমর রাযি. বলেন, আমি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ কথা বলতে শুনেছি, তখন থেকে আমার এমন এক রাতও কাটেনি, যখন আমার কাছে আমার অসিয়তপত্র ছিল না।
مقدمة الامام النووي
65 - باب ذكر الموت وقصر الأمل
574 - وعنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «مَا حَقُّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ، لَهُ شَيْءٌ يُوصِي فِيهِ، يَبيتُ لَيْلَتَيْنِ إِلاَّ وَوَصِيَّتُهُ مَكْتُوبَةٌ عِنْدَهُ». متفقٌ عَلَيْهِ، هَذَا لفظ البخاري. (1)
وفي روايةٍ لمسلمٍ: «يَبِيتُ ثَلاَثَ لَيَالٍ» قَالَ ابن عمر: مَا مَرَّتْ عَلَيَّ لَيْلَةٌ مُنْذُ سَمِعْتُ رسولَ الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ ذَلِكَ إِلاَّ وَعِنْدِي وَصِيَّتِي.
হাদীস নং: ৫৭৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৬৫ মৃত্যুকে স্মরণ করা এবং লম্বা-চওড়া আশা না রাখা
সীমাবদ্ধ আয়ু ও সুদীর্ঘ আশা
হাদীছ নং: ৫৭৫

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েকটি রেখা টানলেন। তারপর বললেন, এটা মানুষ আর এটা তার মৃত্যু। মানুষ এভাবে থাকে। সহসা নিকটবর্তী রেখা এসে উপস্থিত হয়। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ৬৪১৮; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১১৭৬২)
مقدمة الامام النووي
65 - باب ذكر الموت وقصر الأمل
575 - وعن أنس - رضي الله عنه - قَالَ: خَطَّ النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم - خُطُوطًا، فَقَالَ: «هَذَا الإنْسَانُ، وَهَذَا أجَلُهُ، فَبَيْنَمَا هُوَ كَذَلِكَ إذْ جَاءَ الخَطُّ الأَقْرَبُ». رواه البخاري. (1)
হাদীস নং: ৫৭৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৬৫ মৃত্যুকে স্মরণ করা এবং লম্বা-চওড়া আশা না রাখা
সীমাবদ্ধ আয়ু ও সুদীর্ঘ আশা
হাদীছ নং: ৫৭৬

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাযি. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি চতুর্ভুজ আঁকলেন। তার মাঝবরাবর আরেকটি সরলরেখা টানলেন, যা তার বাইরে চলে গেছে। আরও কতগুলো ছোট রেখা টানলেন চতুর্ভুজের প্রান্ত থেকে মধ্যবর্তী রেখাটির দিকে। তারপর বললেন, এটা হল মানুষ। এই তার আয়ু, যা তাকে বেষ্টন করে রেখেছে। আর এই যে, বের হয়ে আসা রেখাটি, এটি তার আশা। আর এই ছোট ছোট রেখাগুলো বালা-মসিবত। এইটি যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, ওইটি এসে তাকে বিদ্ধ করে। আবার ওইটি যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, এইটি এসে তাকে বিদ্ধ করে। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ৬৪১৭; জামে তিরমিযী: ২৬২২; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ১১৭৬৪)
مقدمة الامام النووي
65 - باب ذكر الموت وقصر الأمل
576 - وعن ابن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: خَطَّ النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم - خَطًّا مُرَبَّعًا، وَخَطَّ خَطًّا في الوَسَطِ خَارِجًا مِنْهُ، وَخَطَّ خُطَطًا صِغَارًا إِلَى هَذَا الَّذِي في الْوَسَطِ مِنْ جَانِبهِ الَّذِي في الوَسَط، فَقَالَ: «هَذَا الإنْسَانُ، وَهذَا أجَلُهُ مُحيطًا بِهِ - أَوْ قَدْ أحَاطَ بِهِ - وَهذَا الَّذِي هُوَ خَارِجٌ أمَلُهُ، وَهذِهِ الْخُطَطُ الصِّغَارُ الأَعْرَاضُ، فَإنْ أخْطَأَهُ هَذَا، نَهَشَهُ هَذَا، وَإنْ أخْطَأَهُ هَذَا، نَهَشَهُ هَذَا». رواه البخاري (1). وَهذِهِ صُورَتُهُ: [ص:195]
............ الأجل
... الأعراض
হাদীস নং: ৫৭৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৬৫ মৃত্যুকে স্মরণ করা এবং লম্বা-চওড়া আশা না রাখা
সাতটি জিনিস আসার আগে আগে সৎকর্ম করার তাগিদ
হাদীছ নং: ৫৭৭

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা সাতটি জিনিস আসার আগে আগে দ্রুত আমলে লিপ্ত হও। তোমরা কি অপেক্ষা করছ এমন দারিদ্র্যের, যা সবকিছু ভুলিয়ে দেয়? না এমন প্রাচুর্যের, যা অবাধ্য করে তোলে? না এমন রোগ-ব্যাধির, যা অথর্ব করে তোলে? না এমন বার্ধক্যের, যা বুদ্ধি লোপ করে দেয়? না আকস্মিক আগত মৃত্যুর? না দাজ্জালের- সে তো এমন নিকৃষ্টতম অনুপস্থিত, যার আত্মপ্রকাশের অপেক্ষা করা হচ্ছে? না কিয়ামতের, যে কিয়ামত কিনা অত্যন্ত বিভীষিকাময় ও অতি তিক্ত?। -তিরমিযী
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি একটি হাসান হাদীছ।
(জামে তিরমিযী: ২৩০৬; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০০৮৮)
مقدمة الامام النووي
65 - باب ذكر الموت وقصر الأمل
577 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «بَادِرُوا بِالأعْمَالِ سَبْعًا، هَلْ تَنْتَظِرُونَ إِلاَّ فَقْرًا مُنْسِيًا، أَوْ غِنَىً مُطْغِيًا، أَوْ مَرَضًا مُفْسدًا، أَوْ هَرَمًا مُفَنِّدًا، أَوْ مَوْتًا مُجْهِزًا، أَوْ الدَّجّالَ، فَشَرُّ غَائِبٍ يُنْتَظَرُ، أَوْ السَّاعَةَ وَالسَّاعَةُ أدْهَى وَأمَرُّ؟!». رواه الترمذي، (1) وقال: «حديث حسن».
হাদীস নং: ৫৭৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৬৫ মৃত্যুকে স্মরণ করা এবং লম্বা-চওড়া আশা না রাখা
মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করার হুকুম
হাদীছ নং: ৫৭৮

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা স্বাদ-আহ্লাদ বিনাশক মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করো। -তিরমিযী
(জামে' তিরমিযী: ২৩০৭; সুনানে নাসাঈ ১৮২৪; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২৫৮; মুসনাদুল বাযযার: ৬৯৮৭; সহীহ ইবন হিব্বান ২৯৯২; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৫৭৮০)
مقدمة الامام النووي
65 - باب ذكر الموت وقصر الأمل
578 - وعنه، قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «أكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ» يَعْنِي: المَوْتَ. رواه الترمذي، (1) وقال: «حديث حسن».
হাদীস নং: ৫৭৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৬৫ মৃত্যুকে স্মরণ করা এবং লম্বা-চওড়া আশা না রাখা
মৃত্যুর আগমন সম্পর্কে সতর্কবাণী ও দরূদ পাঠের ফায়দা
হাদীছ নং: ৫৭৯

হযরত উবাঈ ইবন কা‘ব রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের এক-তৃতীয়াংশ পার হয়ে গেলে উঠে পড়তেন। তারপর বলতেন, হে মানুষ! আল্লাহকে স্মরণ করো। প্রথম ফুৎকার এসেই পড়ল। তার অনুগামী হয়ে আসছে পরের ফুৎকার। মৃত্যু আসছে তার ভেতর যা (অর্থাৎ যে ভয়ংকর অবস্থা) আছে তা সহ। মৃত্যু আসছে তার ভেতর যা (অর্থাৎ যে ভয়ংকর অবস্থা) আছে তা সহ। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার প্রতি বেশি বেশি সালাত (দরূদ) পাঠ করি। তা আমার ইবাদতের মধ্যে আপনার (প্রতি দরূদপাঠের) জন্য কতটুকু সময় বরাদ্দ করব? তিনি বললেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা। আমি বললাম, চার ভাগের একভাগ? তিনি বললেন, তুমি যা চাও। যদি বাড়াও, সেটা তোমার জন্য কল্যাণকর। আমি বললাম, অর্ধেক? তিনি বললেন, তুমি যা চাও। যদি বাড়াও, সেটা তোমার জন্য কল্যাণকর। বললাম, তিন ভাগের দুই ভাগ? বললেন, তুমি যা চাও। যদি বাড়াও, সেটা তোমার জন্য কল্যাণকর। আমি বললাম, আমার নফল ইবাদতের সবটা (সময়)-ই আপনার প্রতি সালাতের জন্য বরাদ্দ করব? তিনি বললেন, তাহলে সেটা তোমার যাবতীয় দুশ্চিন্তা মেটানোর জন্য যথেষ্ট হবে এবং তোমার পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হবে। -তিরমিযী
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি একটি হাসান হাদীছ।
(জামে তিরমিযী: ২৪৫৭; হাকিম, আল মুসতাদরাক: ৩৫৭৮; শুআবুল ঈমান: ১৪১৮)
مقدمة الامام النووي
65 - باب ذكر الموت وقصر الأمل
579 - وعن أُبَيِّ بن كعبٍ - رضي الله عنه: كَانَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - إِذَا ذَهَبَ ثُلُثُ اللَّيْلِ قَامَ، فَقَالَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ، اذْكُرُوا اللهَ، جَاءتِ الرَّاجِفَةُ، تَتْبَعُهَا الرَّادِفَةُ، جَاءَ المَوْتُ بِمَا فِيهِ، جَاءَ المَوْتُ بِمَا فِيهِ» قُلْتُ: يَا رسول الله، إنِّي أُكْثِرُ الصَّلاَةَ عَلَيْكَ، فَكَمْ أجْعَلُ لَكَ مِنْ صَلاَتِي؟ فَقَالَ: «مَا شِئْتَ» قُلْتُ: الرُّبُع، قَالَ: «مَا شِئْتَ، فَإنْ زِدْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ» قُلْتُ: فَالنِّصْف؟ قَالَ: «مَا شِئْتَ، فَإنْ زِدْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ» قُلْتُ: فالثُّلُثَيْنِ؟ قَالَ: «مَا شِئْتَ، فَإنْ زِدْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ» قُلْتُ: أجعَلُ لَكَ صَلاَتِي كُلَّهَا؟ قَالَ: «إذًا تُكْفى هَمَّكَ، وَيُغْفَر لَكَ ذَنْبكَ». رواه الترمذي، (1) وقال: «حديث حسن».
হাদীস নং: ৫৮০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ পুরুষদের জন্য কবর যিয়ারত মুস্তাহাব হওয়া প্রসঙ্গ এবং কবর যিয়ারতের দু‘আ
মানুষ মারা গেলে মাটির ভেতর দাফন করার নিয়ম প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এটা মানুষের জন্য আল্লাহ তা'আলার বিশেষ সম্মাননা। অন্যসব প্রাণী মারা গেলে যেখানে-সেখানে পড়ে থাকে। কিন্তু মানুষকে মাটির ভেতর ঘর বানিয়ে ইজ্জতের সঙ্গে তাতে শুইয়ে রাখা হয়। এর সূচনা হয়েছে হযরত আদম আলাইহিস সালামের পুত্র হাবীল থেকে। হাবীল তার ভাই কাবীলের হাতে নিহত হয়েছিলেন। কাবীল বুঝতে পারছিল না হাবীলের লাশ কী করবে। এর আগে কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি বলে তার জানা ছিল না এ ক্ষেত্রে কী করণীয়। তার মধ্যে অপরাধবোধও কাজ করছিল। তাই লাশটি তার লুকানোর প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে কোথায় লুকাবে? সুতরাং এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ তা'আলা এক কৌতূহলোদ্দীপক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ব্যবস্থাটি ছিল এরকম যে, কাবীল দেখতে পেল একটি কাক এসে মাটি খুঁড়ছে। এভাবে সে একটি গর্ত তৈরি করল। তারপর একটি মরা কাক সেই গর্তে রেখে মাটি দ্বারা ঢেকে দিল। অমনি কাবীলের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমিও তো এরকম করতে পারি! সুতরাং কাকটির দেখাদেখি সেও মাটি খুঁড়ে একটি গর্ত বানাল। তারপর ভাইয়ের লাশ তার ভেতর রেখে মাটি দ্বারা ঢেকে দিল। কুরআন মাজীদে সে ঘটনা এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
فَبَعَثَ اللَّهُ غُرَابًا يَبْحَثُ فِي الْأَرْضِ لِيُرِيَهُ كَيْفَ يُوَارِي سَوْءَةَ أَخِيهِ قَالَ يَاوَيْلَتَا أَعَجَزْتُ أَنْ أَكُونَ مِثْلَ هَذَا الْغُرَابِ فَأُوَارِيَ سَوْءَةَ أَخِي فَأَصْبَحَ مِنَ النَّادِمِينَ (31)
‘অতঃপর আল্লাহ একটি কাক পাঠালেন, যে তার ভাইয়ের লাশ কীভাবে গোপন করবে তা তাকে দেখানোর লক্ষ্যে মাটি খনন করতে লাগল। (এটা দেখে) সে বলে উঠল, হায় আফসোস! আমি কি এই কাকটির মতোও হতে পারলাম না, যাতে আমার ভাইয়ের লাশ গোপন করতে পারি! এভাবে পরিশেষে সে অনুতপ্ত হল।’(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৩১)
সুতরাং শুরু থেকে মানবজাতির মধ্যে এ নিয়মই চলে আসছে। এ নিয়ম সবদিক থেকেই সুন্দর। এর দ্বারা যেমন মৃতব্যক্তির মর্যাদা রক্ষা হয়, তেমনি পরিবেশও দূষণ থেকে রক্ষা পায়। তাছাড়া কবর দ্বারা মানুষের উপদেশগ্রহণেরও সুযোগ হয়। সামনে কবর পড়লে অন্তরে এ চিন্তা জাগ্রত করা সহজ হয় যে, ইহজীবন স্থায়ী নয়। সকলকেই এ জগৎ ছেড়ে চলে যেতে হয়। একদিন আমারও মরণ হবে। তারপর আমাকেও এভাবে মাটির ভেতর অন্ধকার ও সংকীর্ণ স্থানে রেখে দেওয়া হবে। এ পরিণতির কথা ভুলে আমি কিসের মোহে পড়ে আছি? এর জন্য আমার প্রস্তুতি কই? কেন আমি ইহজীবনের ক্ষণিকের ফুর্তিতে মাতোয়ারা হয়ে নিজ পরিণতির কথা বিস্মৃত হয়ে আছি? এভাবে কবর মানুষের সম্বিৎ ফিরিয়ে আনে। তাকে তার পরিণাম সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন করে। ফলে আল্লাহ তা'আলার আনুগত্যের দিকে ঝোঁকে এবং ইহজীবন শুদ্ধ ও সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সচেষ্ট হয়।
কবর দেখার মধ্যে এরূপ ফায়দা নিহিত আছে বলে ইসলাম মানুষকে কবর যিয়ারত করতে উৎসাহ দিয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও কবর যিয়ারত করতেন। উম্মতকেও তা করতে বলেছেন। এর জন্য তিনি কিছু নির্দেশনাও দান করেছেন, যেমন কবরের সামনে কীভাবে দাঁড়াতে হবে, কী বলতে হবে, কেন কবর যিয়ারত করতে হবে ইত্যাদি।
কবর যিয়ারত দ্বারা যেমন নিজের নসীহত লাভ হয়, তেমনি দু'আ করলে কবরবাসীরও ফায়দা হয়। এ কারণে বিশেষভাবে পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের কবর মাঝেমধ্যে যিয়ারত করা উচিত।
ইমাম নাওয়াবী রহ. এ অধ্যায়ে কবর যিয়ারত সম্পর্কে কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
পরকালচিন্তা বাড়ানোর লক্ষ্যে কবর যিয়ারত
হাদীছ নং: ৫৮০

হযরত বুরায়দা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা তা যিয়ারত করো। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ৯৭৭; সুনানে আবু দাউদ: ৩২৩৫; জামে তিরমিযী: ১০৫৪; সুনানে নাসাঈ: ২০৩২; সুনানে ইবন মাজাহ ১৫৭২; সহীহ ইবন হিব্বান: ৯৮১; মুআত্তা মালিক: ১৭৬৭)
অপর এক বর্ণনায় আছে, অতএব যে ব্যক্তি কবর যিয়ারত করতে চায় সে যিয়ারত করুক। কারণ তা আমাদেরকে আখিরাত স্মরণ করিয়ে দেয়।
مقدمة الامام النووي
66 - باب استحباب زيارة القبور للرجال وما يقوله الزائر
580 - عن بُرَيْدَة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عن زِيَارَةِ القُبُورِ فَزُوروها». رواه مسلم. (1)
وفي رواية: «فَمَنْ أرَادَ أَنْ يَزُورَ القُبُورَ فَلْيَزُرْ؛ فإنَّهَا تُذَكِّرُنَا الآخِرَةَ».