রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৬৬
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায় : ৬২ অন্যের জন্য স্বার্থত্যাগ ও সহমর্মিতা
নিজ পসন্দের ও প্রয়োজনের বস্তু অন্যকে দান করা
হাদীছ নং: ৫৬৬
হযরত সাহল ইবন সা‘দ রাযি. থেকে বর্ণিত, এক মহিলা একটি হাতেবোনা চাদর নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসল। সে বলল, আপনাকে পরানোর জন্য এ চাদরটি আমি নিজ হাতে বুনেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটি এমনভাবে গ্রহণ করলেন, যেন তাঁর সেটির প্রয়োজন ছিল। তারপর তিনি সেটিকে লুঙ্গিরূপে পরিধান করে আমাদের কাছে আসলেন। এক ব্যক্তি বলল, এটি আমাকে দিয়ে দিন। কী সুন্দর এটি! তিনি বললেন, আচ্ছা। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মজলিসে বসে পড়লেন। তারপর ফিরে গেলেন এবং চাদরটি ভাঁজ করে সেই ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তখন উপস্থিত লোকজন তাকে বলল, তুমি ভালো করনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাদরটি এমনভাবে পরেছিলেন, যেন তাঁর সেটির প্রয়োজন রয়েছে। তারপর তুমি সেটি তাঁর কাছে চাইলে। অথচ তোমার জানা আছে, কেউ কিছু চাইলে তিনি তাকে ফিরিয়ে দেন না। লোকটি বলল, আল্লাহর কসম! আমি চাদরটি পরিধান করার জন্য তাঁর কাছে চাইনি। আমি এটি চেয়েছি কেবল এজন্য, যাতে (মৃত্যুর পর) এটি আমার কাফন হয়। হযরত সাহল রাযি. বলেন, সেটি তার কাফনই হয়েছিল। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ১২৭৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১১৬; মুসনাদে আহমাদ: ২২৮২৫: সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৫৫৫; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ৯৫৮০: খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ৬০৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৮৮৭: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৫৮২৪)
হাদীছ নং: ৫৬৬
হযরত সাহল ইবন সা‘দ রাযি. থেকে বর্ণিত, এক মহিলা একটি হাতেবোনা চাদর নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসল। সে বলল, আপনাকে পরানোর জন্য এ চাদরটি আমি নিজ হাতে বুনেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটি এমনভাবে গ্রহণ করলেন, যেন তাঁর সেটির প্রয়োজন ছিল। তারপর তিনি সেটিকে লুঙ্গিরূপে পরিধান করে আমাদের কাছে আসলেন। এক ব্যক্তি বলল, এটি আমাকে দিয়ে দিন। কী সুন্দর এটি! তিনি বললেন, আচ্ছা। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মজলিসে বসে পড়লেন। তারপর ফিরে গেলেন এবং চাদরটি ভাঁজ করে সেই ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তখন উপস্থিত লোকজন তাকে বলল, তুমি ভালো করনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাদরটি এমনভাবে পরেছিলেন, যেন তাঁর সেটির প্রয়োজন রয়েছে। তারপর তুমি সেটি তাঁর কাছে চাইলে। অথচ তোমার জানা আছে, কেউ কিছু চাইলে তিনি তাকে ফিরিয়ে দেন না। লোকটি বলল, আল্লাহর কসম! আমি চাদরটি পরিধান করার জন্য তাঁর কাছে চাইনি। আমি এটি চেয়েছি কেবল এজন্য, যাতে (মৃত্যুর পর) এটি আমার কাফন হয়। হযরত সাহল রাযি. বলেন, সেটি তার কাফনই হয়েছিল। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ১২৭৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১১৬; মুসনাদে আহমাদ: ২২৮২৫: সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৫৫৫; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ৯৫৮০: খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ৬০৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৮৮৭: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৫৮২৪)
مقدمة الامام النووي
62 - باب الإيثار والمواساة
566 - وعن سهل بن سعدٍ - رضي الله عنه: أنَّ أمْرَأةً جَاءَتْ إِلَى رسول الله - صلى الله عليه وسلم - بِبُرْدَةٍ مَنْسُوجَةٍ، فَقَالَتْ: نَسَجْتُها بِيَدَيَّ لأَكْسُوكَهَا، فَأَخَذَهَا النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم - مُحْتَاجًا إِلَيْهَا، فَخَرَجَ إِلَيْنَا وَإنَّهَا إزَارُهُ، فَقَالَ فُلانٌ: اكْسُنِيهَا مَا أحْسَنَهَا! فَقَالَ: «نَعَمْ» فَجَلَسَ النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم - في المَجْلِسُ، ثُمَّ رَجَعَ فَطَواهَا، ثُمَّ أرْسَلَ بِهَا إِلَيْهِ: فَقَالَ لَهُ الْقَومُ: مَا أحْسَنْتَ! لَبِسَهَا النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم - مُحتَاجًا إِلَيْهَا، ثُمَّ سَألْتَهُ وَعَلِمْتَ أنَّهُ لا يَرُدُّ سَائِلًا، فَقَالَ: إنّي وَاللهِ مَا سَألْتُهُ لألْبِسَهَا، إنَّمَا سَألْتُهُ لِتَكُونَ كَفنِي. قَالَ سَهْلٌ: فَكَانَتْ كَفَنَهُ. رواه البخاري. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটিতে হযরত সাহল ইবন সা‘দ রাযি. যে মহিলা সম্পর্কে বলেছেন যে তিনি একটি হাতেবোনা চাদর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে এসেছিলেন, সে মহিলা কে ছিলেন তা জানা যায় না। ইবন হাজার আসকালানী রহ বলেন, আমি তার নাম জানতে পারিনি। হযরত সাহল ইবন সা'দ রাযি. বলেছেন-
جَاءَتْ إِلَى رَسُوْلِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ بِبُرْدَةٍ مَنْسُوْجَةٍ (একটি হাতেবোনা চাদর নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসল)। আরবী শব্দ হচ্ছে بُرْدَة। অর্থ চাদর। কিন্তু কী রকমের চাদর, সে নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। যেমন দাউদী রহ. বলেন, بُرْدَة (বুরদা) পশম, কাতান ও তুলা দিয়ে তৈরি হয়। তা লুঙ্গির মতো ছোটও হয় এবং গায়ের চাদরের মতো বড়ও হয়। তবে স্বয়ং হযরত সাহল ইবন সা‘দ রাযি. থেকেই এর ব্যাখ্যা বর্ণিত আছে। তাঁর ব্যাখ্যাই অগ্রগণ্য। তিনি বলেন-
هِيَ شَمْلَةٌ مَنْسُوْجَةٌ فِيهَا حَاشِيَتُهَا
‘ঝালরযুক্ত হাতেবোনা শামলা (গায়ে জড়ানোর চাদর)।’(সহীহ বুখারী: ৬০৩৬; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৭৮৫)
فَأَخَذَهَا النَّبِيُّ ﷺ مُحْتَاجًا إِلَيْهَا (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটি এমনভাবে গ্রহণ করলেন, যেন তাঁর সেটির প্রয়োজন ছিল)। অর্থাৎ মহিলা যখন নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে চাদরটি পেশ করলেন, তখন তিনি আগ্রহের সঙ্গে সেটি গ্রহণ করলেন। যেন সেটি তাঁর প্রয়োজন ছিল। এর দ্বারা তিনি সে মহিলাকে খুশি করতে চাইলেন। এটা হাদিয়া গ্রহণের একটি আদব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। কেউ কোনও হাদিয়া দিলে তা আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করা চাই, যাতে হাদিয়াদাতা খুশি হয়। সে যেন বুঝতে পারে আমার হাদিয়া দেওয়াটা যথার্থ হয়েছে। আমি এটা ঠিক জায়গাতেই দিয়েছি।
فَخَرَجَ إِلَيْنَا وَإِنَّهَا إِزَارُهُ (তারপর তিনি সেটিকে লুঙ্গিরূপে পরিধান করে আমাদের কাছে আসলেন)। অর্থাৎ চাদরটি তিনি ব্যবহার করলেন। হাদিয়ার বিষয়ে এটাও এক শিক্ষা। হাদিয়ার বস্তুটি যে কাজের, সেই কাজে তা ব্যবহার করলে হাদিয়াদাতা খুশি হয়। তাকে খুশি করাটাও এক রকম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
فَقَالَ فُلَانٌ: أكْسُنِيْهَا، مَا أَحْسَنَهَا (এক ব্যক্তি বলল, এটি আমাকে দিয়ে দিন। কী সুন্দর এটি)! কে সেই ব্যক্তি, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কেউ বলেছেন তিনি হযরত আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযি.। কেউ বলেন হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি.। কেউ হযরত সাহল ইবন সা'দ রাযি.-এর নামও বলেছেন। আবার কারও মতে তিনি ছিলেন একজন বেদুঈন। তিনি যেই হোন না কেন, চাদরটি তার কাছে বড় সুন্দর লেগেছিল। তাই তিনি সেটির প্রশংসা করলেন এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দরখাস্ত করলেন যেন সেটি তাকে দিয়ে দেওয়া হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সেটি দেওয়ার ওয়াদা করলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি নিজ ঘরে ফিরে গেলেন এবং চাদরটি ভাঁজ করে সে ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
فَقَالَ لَهُ الْقَوْمُ: مَا أَحْسَنْتَ (তখন উপস্থিত লোকজন তাকে বলল, তুমি ভালো করনি)। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, এ কথা বলেছিলেন হযরত সাহল রাযি. নিজে। তিনি এই বলে তাকে তিরস্কার করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগ্রহের সঙ্গে যে কাপড়টি গ্রহণ করলেন, সেটি তুমি চাইলে কেন? তোমার এ কাজটি ঠিক হয়নি।
وَعَلِمْتَ أَنَّهُ لَا يَرُدُّ سَائِلًا (অথচ তোমার জানা আছে, কেউ কিছু চাইলে তিনি তাকে ফিরিয়ে দেন না)। অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিশয় দানশীল। তাঁর দানশীলতার কথা সকলেরই জানা। সবাই জানে তাঁর কাছে কেউ কিছু চাইলে খালিহাতে ফেরান না। তোমারও এটা জানা। তা সত্ত্বেও কেন চাইলে? সেই সাহাবী বললেন-
إِنِّي وَاللهِ مَا سَأَلْتُهُ لِأَلْبِسَهَا، إِنَّمَا سَأَلْتُهُ لِتَكُوْنَ كَفَنِيْ ‘আল্লাহর কসম! আমি চাদরটি পরিধান করার জন্য তাঁর কাছে চাইনি। আমি এটি চেয়েছি কেবল এজন্য, যাতে (মৃত্যুর পর) এটি আমার কাফন হয়'। অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছিলেন-
رَجَوْتُ بَرَكَتَهَا حِيْنَ لَبِسَهَا النَّبِيُّ ، لَعَلِّي أكَفَّنُ فِيهَا
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিধান করায় আমি এর বরকতলাভের আশা করেছি। আর আমার আশা এটি দিয়ে আমার কাফন দেওয়া হবে।(সহীহ বুখারী : ৬০৩৬; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর: ৫৭৮৫)
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিধান করলে এটি একটি বরকতপূর্ণ কাপড় হয়ে যাবে। আর আমার আশা সেই বরকতপূর্ণ কাপড়কে আমার কাফন বানানো হবে। এ উদ্দেশ্যেই আমি কাপড়টি তাঁর কাছে চেয়েছি; জীবদ্দশায় পরার জন্য চাইনি। এর দ্বারা বোঝা গেল, বুযুর্গানে দীনের ব্যবহৃত বস্তুকে তাবাররুকরূপে গ্রহণ করাতে কোনও বাধা নেই। নবী-রাসুল ও আল্লাহওয়ালাদের স্পর্শ দ্বারা কোনও বস্তু বরকতপূর্ণ হতে পারে। এটা অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই। আরও বোঝা গেল, কেউ চাইলে মৃত্যুর আগেই নিজ দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করে যেতে পারে, যদিও তা রক্ষা করা ওয়ারিছদের জন্য জরুরি নয়, যেহেতু কারও মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পদ ওয়ারিছদের মালিকানায় চলে যায়।
فَكَانَتْ كَفَنهُ (সেটি তার কাফনই হয়েছিল)। এটি হযরত সাহল রাযি.-এর কথা যে, সেই ব্যক্তির মৃত্যুর পর এ চাদরটিকে তার কাফনে ব্যবহার করা হয়েছিল। বোঝা গেল হযরত সাহল রাযি.-এর আগেই সেই সাহাবী ইন্তিকাল করেছিলেন। আল্লাহ তা'আলা তার মনোবাসনা পূরণ করেছিলেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির খেদমত করতে পারাটা একটা সৌভাগ্য।
খ. সাধারণ কোনও ব্যক্তির পক্ষ থেকে কিছু হাদিয়া আসলে তা উপেক্ষা করতে নেই।
গ. কাউকে কিছু হাদিয়া দিতে চাইলে তার বিশেষ কী প্রয়োজন সেদিকে লক্ষ রেখেই তা নির্বাচন করা চাই।
ঘ. হাদিয়ার বস্তু এমনভাবে গ্রহণ করা চাই, যাতে হাদিয়াদাতা খুশি হয় এবং সে বুঝতে পারে যে, তার হাদিয়াটি জায়গামতো পড়েছে।
ঙ. বরকতলাভের উদ্দেশ্যে আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির কাছে তার ব্যবহৃত কোনও বস্তু চাওয়া যেতে পারে।
চ. বুযুর্গানে দীনের ব্যবহৃত বস্তুকে বরকতপূর্ণ মনে করা দূষণীয় নয়।
ছ. কারও পোশাক বা অন্য কোনও ব্যবহারের বস্তুর প্রশংসা করা ভদ্রোচিত কাজ।
জ. নিজের প্রয়োজনীয় বস্তুও যদি কেউ চায়, তবে তার চাওয়াকে সম্মান জানিয়ে সেটি তাকে দিয়ে দেওয়া মহত্বের পরিচায়ক।
ঝ. কারও কোনও কাজ অসমীচীন বোধ হলে সে বিষয়ে তাকে সতর্ক করা ভালো।
ঞ. নিজের কোনও কাজ অন্যের কাছে আপত্তিকর মনে হলে যদি তার কোনও যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকে, তবে সে ব্যাখ্যা দ্বারা অন্যের আপত্তির নিরসন করে দেওয়া চাই।
ট. মৃত্যুর আগেই যদি কেউ নিজ দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করে রেখে যেতে চায়, তবে তার অবকাশ আছে।
ঠ. বরকতপূর্ণ মনে করে কোনও বুযুর্গের ব্যবহৃত কাপড়কে যদি কেউ নিজ কাফনের জন্য সংরক্ষণ করে, তবে তা নাজায়েয হবে না।
جَاءَتْ إِلَى رَسُوْلِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ بِبُرْدَةٍ مَنْسُوْجَةٍ (একটি হাতেবোনা চাদর নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসল)। আরবী শব্দ হচ্ছে بُرْدَة। অর্থ চাদর। কিন্তু কী রকমের চাদর, সে নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। যেমন দাউদী রহ. বলেন, بُرْدَة (বুরদা) পশম, কাতান ও তুলা দিয়ে তৈরি হয়। তা লুঙ্গির মতো ছোটও হয় এবং গায়ের চাদরের মতো বড়ও হয়। তবে স্বয়ং হযরত সাহল ইবন সা‘দ রাযি. থেকেই এর ব্যাখ্যা বর্ণিত আছে। তাঁর ব্যাখ্যাই অগ্রগণ্য। তিনি বলেন-
هِيَ شَمْلَةٌ مَنْسُوْجَةٌ فِيهَا حَاشِيَتُهَا
‘ঝালরযুক্ত হাতেবোনা শামলা (গায়ে জড়ানোর চাদর)।’(সহীহ বুখারী: ৬০৩৬; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৭৮৫)
فَأَخَذَهَا النَّبِيُّ ﷺ مُحْتَاجًا إِلَيْهَا (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটি এমনভাবে গ্রহণ করলেন, যেন তাঁর সেটির প্রয়োজন ছিল)। অর্থাৎ মহিলা যখন নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে চাদরটি পেশ করলেন, তখন তিনি আগ্রহের সঙ্গে সেটি গ্রহণ করলেন। যেন সেটি তাঁর প্রয়োজন ছিল। এর দ্বারা তিনি সে মহিলাকে খুশি করতে চাইলেন। এটা হাদিয়া গ্রহণের একটি আদব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। কেউ কোনও হাদিয়া দিলে তা আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করা চাই, যাতে হাদিয়াদাতা খুশি হয়। সে যেন বুঝতে পারে আমার হাদিয়া দেওয়াটা যথার্থ হয়েছে। আমি এটা ঠিক জায়গাতেই দিয়েছি।
فَخَرَجَ إِلَيْنَا وَإِنَّهَا إِزَارُهُ (তারপর তিনি সেটিকে লুঙ্গিরূপে পরিধান করে আমাদের কাছে আসলেন)। অর্থাৎ চাদরটি তিনি ব্যবহার করলেন। হাদিয়ার বিষয়ে এটাও এক শিক্ষা। হাদিয়ার বস্তুটি যে কাজের, সেই কাজে তা ব্যবহার করলে হাদিয়াদাতা খুশি হয়। তাকে খুশি করাটাও এক রকম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
فَقَالَ فُلَانٌ: أكْسُنِيْهَا، مَا أَحْسَنَهَا (এক ব্যক্তি বলল, এটি আমাকে দিয়ে দিন। কী সুন্দর এটি)! কে সেই ব্যক্তি, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কেউ বলেছেন তিনি হযরত আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযি.। কেউ বলেন হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি.। কেউ হযরত সাহল ইবন সা'দ রাযি.-এর নামও বলেছেন। আবার কারও মতে তিনি ছিলেন একজন বেদুঈন। তিনি যেই হোন না কেন, চাদরটি তার কাছে বড় সুন্দর লেগেছিল। তাই তিনি সেটির প্রশংসা করলেন এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দরখাস্ত করলেন যেন সেটি তাকে দিয়ে দেওয়া হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সেটি দেওয়ার ওয়াদা করলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি নিজ ঘরে ফিরে গেলেন এবং চাদরটি ভাঁজ করে সে ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
فَقَالَ لَهُ الْقَوْمُ: مَا أَحْسَنْتَ (তখন উপস্থিত লোকজন তাকে বলল, তুমি ভালো করনি)। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, এ কথা বলেছিলেন হযরত সাহল রাযি. নিজে। তিনি এই বলে তাকে তিরস্কার করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগ্রহের সঙ্গে যে কাপড়টি গ্রহণ করলেন, সেটি তুমি চাইলে কেন? তোমার এ কাজটি ঠিক হয়নি।
وَعَلِمْتَ أَنَّهُ لَا يَرُدُّ سَائِلًا (অথচ তোমার জানা আছে, কেউ কিছু চাইলে তিনি তাকে ফিরিয়ে দেন না)। অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিশয় দানশীল। তাঁর দানশীলতার কথা সকলেরই জানা। সবাই জানে তাঁর কাছে কেউ কিছু চাইলে খালিহাতে ফেরান না। তোমারও এটা জানা। তা সত্ত্বেও কেন চাইলে? সেই সাহাবী বললেন-
إِنِّي وَاللهِ مَا سَأَلْتُهُ لِأَلْبِسَهَا، إِنَّمَا سَأَلْتُهُ لِتَكُوْنَ كَفَنِيْ ‘আল্লাহর কসম! আমি চাদরটি পরিধান করার জন্য তাঁর কাছে চাইনি। আমি এটি চেয়েছি কেবল এজন্য, যাতে (মৃত্যুর পর) এটি আমার কাফন হয়'। অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছিলেন-
رَجَوْتُ بَرَكَتَهَا حِيْنَ لَبِسَهَا النَّبِيُّ ، لَعَلِّي أكَفَّنُ فِيهَا
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিধান করায় আমি এর বরকতলাভের আশা করেছি। আর আমার আশা এটি দিয়ে আমার কাফন দেওয়া হবে।(সহীহ বুখারী : ৬০৩৬; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর: ৫৭৮৫)
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিধান করলে এটি একটি বরকতপূর্ণ কাপড় হয়ে যাবে। আর আমার আশা সেই বরকতপূর্ণ কাপড়কে আমার কাফন বানানো হবে। এ উদ্দেশ্যেই আমি কাপড়টি তাঁর কাছে চেয়েছি; জীবদ্দশায় পরার জন্য চাইনি। এর দ্বারা বোঝা গেল, বুযুর্গানে দীনের ব্যবহৃত বস্তুকে তাবাররুকরূপে গ্রহণ করাতে কোনও বাধা নেই। নবী-রাসুল ও আল্লাহওয়ালাদের স্পর্শ দ্বারা কোনও বস্তু বরকতপূর্ণ হতে পারে। এটা অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই। আরও বোঝা গেল, কেউ চাইলে মৃত্যুর আগেই নিজ দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করে যেতে পারে, যদিও তা রক্ষা করা ওয়ারিছদের জন্য জরুরি নয়, যেহেতু কারও মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পদ ওয়ারিছদের মালিকানায় চলে যায়।
فَكَانَتْ كَفَنهُ (সেটি তার কাফনই হয়েছিল)। এটি হযরত সাহল রাযি.-এর কথা যে, সেই ব্যক্তির মৃত্যুর পর এ চাদরটিকে তার কাফনে ব্যবহার করা হয়েছিল। বোঝা গেল হযরত সাহল রাযি.-এর আগেই সেই সাহাবী ইন্তিকাল করেছিলেন। আল্লাহ তা'আলা তার মনোবাসনা পূরণ করেছিলেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির খেদমত করতে পারাটা একটা সৌভাগ্য।
খ. সাধারণ কোনও ব্যক্তির পক্ষ থেকে কিছু হাদিয়া আসলে তা উপেক্ষা করতে নেই।
গ. কাউকে কিছু হাদিয়া দিতে চাইলে তার বিশেষ কী প্রয়োজন সেদিকে লক্ষ রেখেই তা নির্বাচন করা চাই।
ঘ. হাদিয়ার বস্তু এমনভাবে গ্রহণ করা চাই, যাতে হাদিয়াদাতা খুশি হয় এবং সে বুঝতে পারে যে, তার হাদিয়াটি জায়গামতো পড়েছে।
ঙ. বরকতলাভের উদ্দেশ্যে আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির কাছে তার ব্যবহৃত কোনও বস্তু চাওয়া যেতে পারে।
চ. বুযুর্গানে দীনের ব্যবহৃত বস্তুকে বরকতপূর্ণ মনে করা দূষণীয় নয়।
ছ. কারও পোশাক বা অন্য কোনও ব্যবহারের বস্তুর প্রশংসা করা ভদ্রোচিত কাজ।
জ. নিজের প্রয়োজনীয় বস্তুও যদি কেউ চায়, তবে তার চাওয়াকে সম্মান জানিয়ে সেটি তাকে দিয়ে দেওয়া মহত্বের পরিচায়ক।
ঝ. কারও কোনও কাজ অসমীচীন বোধ হলে সে বিষয়ে তাকে সতর্ক করা ভালো।
ঞ. নিজের কোনও কাজ অন্যের কাছে আপত্তিকর মনে হলে যদি তার কোনও যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকে, তবে সে ব্যাখ্যা দ্বারা অন্যের আপত্তির নিরসন করে দেওয়া চাই।
ট. মৃত্যুর আগেই যদি কেউ নিজ দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করে রেখে যেতে চায়, তবে তার অবকাশ আছে।
ঠ. বরকতপূর্ণ মনে করে কোনও বুযুর্গের ব্যবহৃত কাপড়কে যদি কেউ নিজ কাফনের জন্য সংরক্ষণ করে, তবে তা নাজায়েয হবে না।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)