রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৬২
ভূমিকা অধ্যায়
কৃপণতা ও লোভ-লালসার প্রতি নিষেধাজ্ঞা
بخل ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি البُخْلُ থেকে। এর অর্থ কৃপণতা করা। শরী'আতের পরিভাষায় আবশ্যিক ক্ষেত্রে অর্থব্যয় করা হতে বিরত থাকাকে البُخْلُ বা কৃপণতা বলা হয়। যে ব্যক্তি অর্থসাহায্য প্রার্থনা করে, উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে তাকে কিছু না দিয়ে খালিহাতে ফেরানোর ক্ষেত্রেও এ শব্দের ব্যবহার আছে। যে ব্যক্তি কৃপণতা করে, আরবীতে তাকে البخيل বলে। বাংলায়ও 'বখিল' শব্দটি চালু আছে। আরবীতে এর পাশাপাশি আরেকটি শব্দ হচ্ছে الشح । এ শব্দটি ব্যবহার হয় অতিরিক্ত কৃপণতার ক্ষেত্রে। কারও কারও মতে কৃপণতার সঙ্গে যদি লোভও থাকে, তবে সেই ক্ষেত্রে الشح শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কারও মতে البُخْلُ ব্যবহৃত হয় অর্থ-সম্পদে কৃপণতার ক্ষেত্রে, আর الشح ব্যবহৃত হয় অর্থ-সম্পদ ও অন্যান্য বিষয়ে কৃপণতার ক্ষেত্রে। আবার কেউ এমনও বলেছেন যে, নিজের কাছে যা নেই, তাতে লোভ করাকে الشح বলা হয়। আর নিজের কাছে যা আছে, লোভের বশবর্তীতে তাতে কৃপণতা করা হচ্ছে الشح।
কৃপণতা ও লোভ-লালসা মানুষের আত্মিক ব্যাধি। এ ব্যাধি মানুষকে নানাবিধ পাপে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে। এর ফলে মানুষ স্বার্থান্ধ হয়ে যায়। এ ব্যাধি যার অন্তরে আছে, সে তার কাছে অন্যের যে অধিকার আছে তা তো আদায় করেই না, উল্টো ছলেবলে অন্যের অধিকার হরণ করে নেয়। তার দ্বারা আল্লাহর হকও আদায় করা হয় না এবং বান্দার হকও নয়। এরূপ ব্যক্তি একদিক থেকে ছাওয়াবের কাজ করতে সক্ষম হয় না, অন্যদিক থেকে পাপের বোঝা বাড়াতে থাকে। এ ব্যাধি যার অন্তরে আছে, সে কখনও মানুষের দুঃখ মোচন করতে পারে না; বরং অন্যের কষ্টই বাড়ায়। আর এতে করে সে কখনও মানুষের আপন হতে পারে না; তার কেবল শত্রুসংখ্যাই বাড়ে। এমনকি এরূপ লোক নিজ পরিবারের পক্ষেও প্রীতিকর হয় না। সে হয় না নিজের পক্ষেও শান্তিদায়ী। সে তার দুনিয়া ও আখিরাত সবই হারায়।
প্রকৃতপক্ষে কৃপণতা ইসলামের মর্মবাণীরই পরিপন্থী। ইসলাম অর্থ নিজের জান ও মাল আল্লাহ তা'আলার জন্য নিবেদন করা। কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নিজের জান কী উৎসর্গ করবে, মালই তো উৎসর্গ করতে পারে না। ফলে তার অন্তরে ঈমান ও ইসলামের আবেদন দুর্বল হয়ে পড়ে।
‘প্রকৃত মুসলিম জান-মালের বিষয়ে নিজ ক্ষমতা ও সামর্থের উপর নয়; বরং আল্লাহ তা'আলার উপরই নির্ভরশীল থাকে। কিন্তু কৃপণ ব্যক্তির নির্ভরতা থাকে নিজ সামর্থ্যের উপর। কেমন যেন আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে তার অন্তরে এই কুধারণা সক্রিয় থাকে যে, তাঁর পথে দান-খয়রাত করলে তিনি তার সম্পদ কমিয়ে দেবেন। তাই সে দান করতে পারে না। এজন্যই বলা হয়, কৃপণতা ব্যক্তির ইসলামকে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত করে, অতটা ক্ষতিগ্রস্ত আর কোনওকিছুই করতে পারে না। তাই কৃপণতার সবটাই মন্দ, যেমন বদান্যতার সবটাই উৎকৃষ্ট। হযরত আলী রাযি. বলেন- 'কৃপণতা সর্বপ্রকার দোষের সমষ্টি। এটা এমন এক লাগাম, যা দ্বারা সকল মন্দের দিকে টেনে নেওয়া হয়।'
বস্তুত কৃপণতা ও লোভ-লালসা মানুষের স্বভাবগত বিষয়। সেই হিসেবে অন্তরে এ রিপু থাকাটা স্বাভাবিক এবং থাকাটা দোষের নয়; দোষ হল এর চর্চা করা অর্থাৎ কাজে কর্মে কৃপণতা প্রকাশ করা এবং লোভের বশবর্তী হয়ে কোনও কাজ করা। অন্তরে কৃপণতা ও লোভ প্রবল হলে সে অনুযায়ী সাধারণত কাজও করা হয়। তাই প্রয়োজন এ ব্যাধির চিকিৎসা এবং এ ব্যাধি যাতে প্রবল হয়ে উঠতে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা যদি জানতে পারি এটা কত খারাপ রোগ এবং এর ফলে কত কঠিন কঠিন পাপ হয়ে যায়, তবেই আমাদের পক্ষে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। তাই কুরআন ও হাদীছে বারবার এ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে এবং এর ক্ষতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
الَّذِينَ يَبْخَلُونَ وَيَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ وَيَكْتُمُونَ مَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ ۗ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا (37)
‘যারা নিজেরা কৃপণতা করে এবং মানুষকেও কৃপণতার নির্দেশ দেয়, আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহ হতে তাদের যা দান করেছেন তা গোপন করে, আমি (এরূপ) অকৃতজ্ঞদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।(সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩৭)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَأَيُّ دَاء أَدْوَأُ مِنَ البُخْلِ؟
‘কৃপণতার চেয়ে কঠিন রোগ আর কী আছে'?(সহীহ বুখারী: ৪৩৮২; মুসনাদে আহমাদ: ১৪৩০১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ২৬৬১০: তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৬৩; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৫৪)
অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ خِبُّ وَلَا مَنَّانٌ وَلَا بَخِيْلٌ
‘প্রতারক, খোঁটাদাতা ও কৃপণ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।(জামে' তিরমিযী: ১৯৬৩; মুসনাদে আহমাদ: ১৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৯৫; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ১৭৩; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৩৬৪; ফাওয়াইদু তাম্মাম: ১৭৬)
আরও এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
السَّخِيُّ قَرِيبٌ مِنَ اللهِ، بَعِيدٌ مِنَ النَّارِ، قَرِيبٌ مِنَ الْجَنَّةِ، قَرِيبٌ مِنَ النَّاسِ، وَالْبَخِيلُ بَعِيدٌ مِنَ اللَّهِ ، بَعِيدٌ مِنَ الْجَنَّةِ، بَعِيدٌ مِنَ النَّاسِ، قَرِيبٌ مِنَ النَّارِ، وَالْجَاهِلُ السَّخِيُّ أَحَبُّ إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنَ الْعَابِدِ الْبَخِيْلِ
‘দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী, জাহান্নাম থেকে দূরবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী এবং মানুষেরও নিকটবর্তী। আর কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহর থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে এবং মানুষের থেকেও দূরে, কিন্তু জাহান্নামের কাছে। অজ্ঞ দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকট কৃপণ আবেদ অপেক্ষা প্রিয়।(তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ২৩৬৩; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ৩৬০; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৩৫২; ফাওয়াইদু তাম্মাম: ২৮৪
قال الإمام أبو حاتم: هذا حديث باطل، وسعيد (بن مسلمة الراوي عن يحي بن سعيد) ضعيف الحديث، أخاف أن يكون أدخل له. (علل ابن أبي حاتم ٩٧/٦ (٣٢٥٢). وقال أيضا (٢٣٥٣) هذا حديث منكر فيه سعيد بن محمد الوراق. (الراوي عن يحي بن سعيد) قال الدارقطني متروك. قال العقيلي : ليس لهذا الحديث أصل من حديث يحي ولا غيره..)
এটা এমনই এক কঠিন ব্যাধি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রীতিমতো এর থেকে আল্লাহ তা'আলার কাছে পানাহ চাইতেন। তাঁর থেকে দু'আ বর্ণিত আছে-
اللَّهمَّ إنِّي أعوذُ بِكَ منَ البُخلِ ، وأعوذُ بِكَ منَ الجُبنِ وأعوذُ بِكَ أن أَرَدَّ إلى أرذلِ العمرِ ، وأعوذُ بِكَ مِن فتنةِ الدُّنيا ، وأعوذُ بِكَ مِن عذابِ القبرِ
‘হে আল্লাহ! আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি কৃপণতা হতে। আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি ভীরুতা হতে। আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি জরাজীর্ণ হয়ে যাওয়া বার্ধক্য হতে। আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি দুনিয়ার ফিতনা হতে এবং আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি কবরের আযাব হতে।’(সহীহ বুখারী: ৬৩৬৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ২৯১৩০; মুসনাদে আহমাদ: ১৫৮৪; সহীহ মুসলিম: ২৭০৬; সুনানে আবু দাউদ: ৩৯৭২; জামে' তিরমিযী: ৩৫৬৭; সুনানে নাসাঈ : ৫৪৪৫; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৭১৬; সহীহ ইবন খুযায়মা : ৭৪৬; সহীহ ইবন হিব্বান : ১০০৪)
ইমাম নাওয়াবী রহ. এ অধ্যায়ে কৃপণতা ও লোভ-লালসা সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি।
‘কৃপণতা ও লোভ-লালসা করার প্রতি নিষেধাজ্ঞা’ সম্পর্কিত দু’টি আয়াত
এক নং আয়াত
وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى (8) وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى (9) فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى (10) وَمَا يُغْنِي عَنْهُ مَالُهُ إِذَا تَرَدَّى (11)
অর্থ: পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করল এবং (আল্লাহর প্রতি) বেপরোয়াভাব দেখাল এবং সর্বোত্তম বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করল, আমি তার যাতনাময় স্থানে পৌছার ব্যবস্থা করে দেব। সে যখন ধ্বংস-গহ্বরে পতিত হবে, তখন তার সম্পদ তার কোনও কাজে আসবে না।
(সূরা লায়ল (৯২), আয়াত ৮-১১
‘যাতনাময় স্থানে’ পৌছার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অর্থ যেসব গুনাহ করলে জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যায়, সেগুলো করার অবকাশ দেওয়া এবং সৎকাজের তাওফীক না দেওয়া।
প্রকাশ থাকে যে, কুরআন মাজীদে ব্যবহৃত نُيَسِّرُهُ শব্দের অর্থ যে করা হয়েছে ‘ব্যবস্থা করে দেওয়া’, তা করা হয়েছে আল্লামা আলুসী (রহ.)-এর ব্যাখ্যার অনুসরণে। দেখুন (রহুল মাআনী, ৩০ : ৫১২)। -তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন থেকে সংগৃহীত।)
ব্যাখ্যা
এখানে সূরা লায়লের পাশাপাশি চারটি আয়াত উদ্ধৃত করা হয়েছে। এ আয়াতসমূহে যে ব্যক্তির মধ্যে তিনটি খাসলাত পাওয়া যায়, তার অশুভ পরিণাম বর্ণিত হয়েছে। প্রথম আয়াত হচ্ছে- وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى ‘পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করল এবং (আল্লাহর প্রতি) বেপরোয়াভাব দেখাল'। এ আয়াতে দু'টি খাসলাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হল কৃপণতা, আরেকটি হল আল্লাহর প্রতি বেপরোয়াভাব। বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কৃপণতা করে অর্থাৎ কল্যাণকর খাতে অর্থব্যয় করা হতে বিরত থাকে, যেসকল ক্ষেত্রে ব্যয় করা অবশ্যকর্তব্য ছিল তাতে ব্যয় করে না, আর তা না করার কারণ কেবল আল্লাহ তা'আলার প্রতি বেপরোয়াভাব। অর্থাৎ তার লক্ষ্যবস্তু শুধুই দুনিয়ার অর্থবিত্ত। সে অর্থবিত্ত অর্জিত হয়ে যাওয়ায় নিজেকে সফল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে। তাই আখিরাতের ছাওয়াব ও প্রতিদান লাভের কোনও ইচ্ছা সে করে না। আর তা করে না বলে সর্বশক্তিমান ও মহান আল্লাহর সামনে সে নতিস্বীকার করে না এবং তাঁর আদেশ- নিষেধের কোনও তোয়াক্কা করে না।
দ্বিতীয় আয়াত হল- وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى (এবং সর্বোত্তম বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করল)। এটা তৃতীয় খাসলাত। الْحُسْنی-এর অর্থ সর্বোত্তম বিষয়। এর দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য,তা নিয়ে তাফসীরকারকদের মধ্যে সামান্য মতভিন্নতা আছে। কেউ বলেন এর দ্বারা কালেমা তায়্যিবা বোঝানো হয়েছে। কারও মতে বোঝানো হয়েছে জান্নাত। কেউ বলেন কাখিরাতের প্রতিদান। তবে সবগুলোই কাছাকাছি। কেননা কালেমা পাঠ ও দাবি অনুযায়ী চলার দ্বারা আখিরাতের প্রতিদান মেলে। আর আখিরাতের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। সুতরাং আয়াতটির মর্মার্থ দাঁড়ায়- যে ব্যক্তি কালেমা তায়্যিবা তথা আল্লাহ তা'আলা মানুষের কল্যাণার্থে যে দীন ও শরী'আত প্রদান করেছেন তার প্রতি কোনও বিশ্বাস রাখে না, আখিরাতের প্রতিদানকে সত্য বলে স্বীকার করে না এবং জান্নাতের প্রতিশ্রুতিকে মিথ্যা ঠাওরায়। তো এই তিন খাসলাতবিশিষ্ট লোক সম্পর্কে পরের আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে-
فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى (আমি তার জন্য যাতনাময় স্থানে পৌঁছাকে সহজ করে দেব)। العُسْری-এর অর্থ যাতনাময় স্থান, কঠোর ও কঠিন পরিণাম। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য জাহান্নাম। আয়াতটিতে বলা হচ্ছে- উল্লিখিত খাসলাত ও চরিত্রসমূহ যার মধ্যে থাকবে, আল্লাহ তা'আলা তার জন্য এমনসব কাজ সহজ করে দেবেন, যা করার দ্বারা তার শেষ পরিণাম হবে জাহান্নাম। তার মানে শরী'আতবিরোধী কাজকর্ম করার প্রতি তার অন্তরে আগ্রহ সৃষ্টি করে দেওয়া হবে এবং সে আগ্রহ পূরণ করা তার পক্ষে সহজ হয়ে যাবে। পাপকাজের প্রতি মনে আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া ও তা করতে ভালো লাগা মূলত অনবরত দীন ও শরী'আতবিরুদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করতে থাকার কুফল। যে ব্যক্তি শরী'আত মোতাবেক চলতে সচেষ্ট থাকে, আল্লাহ তা'আলা এক পর্যায়ে তার জন্য সে চলাটাকে সহজ করে দেন। ফলে তার পক্ষে সৎকর্ম করতে ভালো লাগে, তা করা তার পক্ষে সহজ মনে হয় এবং সে তাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। অনুরূপ যে ব্যক্তি শরী'আতবিরোধী কাজকর্ম নিয়মিত করতে থাকে, তার সেসব কাজ করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। ফলে তার পক্ষে অসৎকর্ম করতে ভালো লাগে এবং তা করা তার পক্ষে সহজ মনে হয়। বলাবাহুল্য, শরী'আতবিরোধী কাজকর্ম করতে ভালো লাগাটা ও তা সহজ মনে হওয়াটা আল্লাহ তা'আলার এক রকম আযাব। এ আযাব আসার আগেই বান্দার কর্তব্য মনের খেয়ালখুশি উপেক্ষা করে শরী'আত মোতাবেক চলতে সচেষ্ট থাকা। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
চতুর্থ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন- وَمَا يُغْنِي عَنْهُ مَالُهُ إِذَا تَرَدَّى (সে যখন ধ্বংস-গহ্বরে পতিত হবে, তখন তার সম্পদ তার কোনও কাজে আসবে না)। অর্থাৎ উল্লিখিত তিনটি বদ খাসলাতের কারণে আখিরাতে যখন তাকে জাহান্নামের গর্তে নিক্ষেপ করা হবে, তখন শরী'আতের হুকুম অমান্য করে দুনিয়ায় সে যে সম্পদের আসক্তিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল, আল্লাহর পথে অর্থব্যয় হতে বিমুখ হয়ে কৃপণতা অবলম্বন করেছিল, সে সম্পদ তার কোনও উপকারে আসবে না। জাহান্নামের আযাব থেকে তাকে তা রক্ষা করতে পারবে না। উল্টো কৃপণতার কারণে এ সম্পদই আখিরাতে তার মহামসিবতের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘আল্লাহপ্রদত্ত অনুগ্রহে (সম্পদে) যারা কৃপণতা করে, তারা যেন কিছুতেই মনে না করে, এটা তাদের জন্য ভালো কিছু। বরং এটা তাদের পক্ষে অতি মন্দ। যে সম্পদের ভেতর তারা কৃপণতা করে, কিয়ামতের দিন তাকে তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৮০)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. কৃপণতা নেহাৎ মন্দ গুণ। এর ইসলাহ জরুরি।
খ. অর্থবিত্তের মোহে দীন ও শরী'আতের দাবি উপেক্ষা করতে নেই।
গ. কালেমা তায়্যিবা সর্বোত্তম বাণী। এ বাণীর অস্বীকৃতি কুফর।
ঘ. জান্নাত সর্বোত্তম স্থান। তা মুমিনদের ঠিকানা।
ঙ. অনবরত পাপকর্ম করতে থাকার পরিণামে পাপকর্ম করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। তাতে পাপকর্ম করা সহজ হয় ও জাহান্নামের পথ সুগম হয়।
চ. সম্পদের মোহে পড়তে নেই। আখিরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তিতে তা কোনও কাজে আসবে না।
দুই নং আয়াত
وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (16)
অর্থ : যারা তাদের অন্তরের লোভ-লালসা থেকে মুক্তি লাভ করেছে, তারাই সফলকাম।(সূরা তাগাবুন (৬৪), আয়াত ১৬)
ব্যাখ্যা
অন্তর লোভ-লালসা থেকে মুক্ত থাকলে অন্যায়ভাবে উপার্জন করা ও অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়। এরূপ ব্যক্তি সহজেই দীনের কাজে অর্থ-সম্পদ খরচ করতে পারে। যে ক্ষেত্রে অন্যরা ব্যয় করতে কুণ্ঠাবোধ করে, সেখানে সে অনায়াসে দান-খয়রাত করে। সারকথা নির্লোভ ব্যক্তি সাধারণত কৃপণ হয় না। আর তা হয় না বলে সে আল্লাহর দেওয়া মাল আল্লাহর পথে খরচ করে দোজাহানের সফলতা অর্জন করে নেয়। বোঝা গেল, যে ব্যক্তি الشُّحَّ বা লোভ-লালসার শিকার হয়ে যায়, সে সফলতা অর্জন করতে পারে না; বরং সে হয় ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত। বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি.-কে বলেছিল, ভয় হয়-বুঝি বা আমি ধ্বংস হয়ে যাব। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এর কারণ? সে বলল, আল্লাহ তা'আলা তো বলেছেন, যারা নিজেদের الشُّحَّ থেকে মুক্ত করেছে তারাই সফলকাম। আমি তো একজন কৃপণ লোক। আমার হাত থেকে কিছুই বের হয় না। হযরত ইবন মাস'ঊদ রাযি. বললেন, আল্লাহ তা'আলা যে الشُّحَّ -এর কথা বলেছেন, তোমার এটা তা নয়। তুমি যদি তোমার ভাইয়ের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ কর, তবে সেটাই । (লোভ-লালসা)। আর তোমার মধ্যে যা আছে তা হল اَلْبُخْلُ (কৃপণতা)।
হযরত উমর রাযি. বলেন, কেউ যদি নিজ সম্পদ ব্যয় না করে, তবে তা الشُّحَّ নয়; বরং কেউ অন্যের সম্পদের প্রতি লোভের দৃষ্টিতে তাকালে সেটাই الشُّحَّ।
হযরত সা‘ঈদ ইবন জুবায়র রহ. বলেন, الشُّحَّ -এর অর্থ হারাম গ্রহণ করা ও যাকাত দেওয়া হতে বিরত থাকা।
কারও মতে যে তীব্র লালসা মানুষকে অবৈধ উপার্জনে লিপ্ত করে, তাকেই الشُّحَّ বলে।
হযরত ইবন যায়দ রহ. বলেন, যে ব্যক্তি অবৈধ সম্পদ স্পর্শ করে না এবং আল্লাহর আদেশ পালনে কার্পণ্য যার পক্ষে বাধা হতে পারে না, সেই মূলত নিজেকে الشُّحَّ হতে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে লোভ ও কৃপণতা মারাত্মক আত্মিক ব্যাধি। এ ব্যাধি যার অন্তরে আছে, সে সবদিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে এক মিসকীন, তাতে তার যত বেশিই টাকা- পয়সা থাকুক না কেন। ইবন আতিয়্যাহ রহ. বলেন, মনের লোভ ও কৃপণতা এমন এক দারিদ্র্য, যা কখনও অর্থ-সম্পদ দিয়ে ঘোচে না; বরং যত বেশি সম্পদ হয় তত বেশি তা বাড়ে ও পাকাপোক্ত হয়। সুতরাং এ ব্যাধি থেকে নিজেকে মুক্ত করা অতীব জরুরি। তা থেকে মুক্ত হওয়ার একটা উপায় হচ্ছে হারাম অর্থ-সম্পদ থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং যাকাত ফরয হয়ে থাকলে তা পরিপূর্ণরূপে আদায় করা।
ইবন যায়দ রহ., সা‘ঈদ ইবন জুবায়র রহ, প্রমুখ বলেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার নিষেধকৃত কোনওকিছু স্পর্শ করে না এবং ফরয যাকাত আদায় হতে বিরত থাকে না, সে মনের লোভ ও কৃপণতা থেকে মুক্ত'। আমাদেরকে এ ব্যাধি থেকে মুক্ত হতেই হবে। কেননা এটা প্রকৃত ঈমানেরও পরিপন্থী। প্রকৃত ঈমানের সঙ্গে এটা সহাবস্থান করতে পারে না।
এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا يجتمعُ غبارٌ في سبيلِ اللَّهِ ودُخانُ جَهَنَّمَ في جوفِ عبدٍ أبدًا ، ولا يجتَمعُ الشُّحُّ والإيمانُ في قلبِ عبدٍ أبدًا
‘আল্লাহর পথের ধুলা ও জাহান্নামের ধোঁয়া কখনও কোনও বান্দার উদরে একত্র হতে পারে না। এমনিভাবে লোভ-কৃপণতা ও ঈমান কোনও বান্দার অন্তরে একত্র হতে পারে না।(সুনানে নাসাঈ ৩১১০; মুসনাদে আহমাদ: ৯৬৯৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১৯৪৮২ মুসনাদুল বাযযার: ৮২২৫; সহীহ ইবন হিব্বান ৩২৫১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৮৫০৮)
আয়াতটির শিক্ষা
লোভ ও কৃপণতা মারাত্মক আত্মিক ব্যাধি। এ ব্যাধি দোজাহানের সফলতা লাভের পক্ষে কঠিন বাধা। তাই আমাদেরকে এর থেকে মুক্তিলাভের সাধনা করতে হবে।
بخل ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি البُخْلُ থেকে। এর অর্থ কৃপণতা করা। শরী'আতের পরিভাষায় আবশ্যিক ক্ষেত্রে অর্থব্যয় করা হতে বিরত থাকাকে البُخْلُ বা কৃপণতা বলা হয়। যে ব্যক্তি অর্থসাহায্য প্রার্থনা করে, উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে তাকে কিছু না দিয়ে খালিহাতে ফেরানোর ক্ষেত্রেও এ শব্দের ব্যবহার আছে। যে ব্যক্তি কৃপণতা করে, আরবীতে তাকে البخيل বলে। বাংলায়ও 'বখিল' শব্দটি চালু আছে। আরবীতে এর পাশাপাশি আরেকটি শব্দ হচ্ছে الشح । এ শব্দটি ব্যবহার হয় অতিরিক্ত কৃপণতার ক্ষেত্রে। কারও কারও মতে কৃপণতার সঙ্গে যদি লোভও থাকে, তবে সেই ক্ষেত্রে الشح শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কারও মতে البُخْلُ ব্যবহৃত হয় অর্থ-সম্পদে কৃপণতার ক্ষেত্রে, আর الشح ব্যবহৃত হয় অর্থ-সম্পদ ও অন্যান্য বিষয়ে কৃপণতার ক্ষেত্রে। আবার কেউ এমনও বলেছেন যে, নিজের কাছে যা নেই, তাতে লোভ করাকে الشح বলা হয়। আর নিজের কাছে যা আছে, লোভের বশবর্তীতে তাতে কৃপণতা করা হচ্ছে الشح।
কৃপণতা ও লোভ-লালসা মানুষের আত্মিক ব্যাধি। এ ব্যাধি মানুষকে নানাবিধ পাপে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে। এর ফলে মানুষ স্বার্থান্ধ হয়ে যায়। এ ব্যাধি যার অন্তরে আছে, সে তার কাছে অন্যের যে অধিকার আছে তা তো আদায় করেই না, উল্টো ছলেবলে অন্যের অধিকার হরণ করে নেয়। তার দ্বারা আল্লাহর হকও আদায় করা হয় না এবং বান্দার হকও নয়। এরূপ ব্যক্তি একদিক থেকে ছাওয়াবের কাজ করতে সক্ষম হয় না, অন্যদিক থেকে পাপের বোঝা বাড়াতে থাকে। এ ব্যাধি যার অন্তরে আছে, সে কখনও মানুষের দুঃখ মোচন করতে পারে না; বরং অন্যের কষ্টই বাড়ায়। আর এতে করে সে কখনও মানুষের আপন হতে পারে না; তার কেবল শত্রুসংখ্যাই বাড়ে। এমনকি এরূপ লোক নিজ পরিবারের পক্ষেও প্রীতিকর হয় না। সে হয় না নিজের পক্ষেও শান্তিদায়ী। সে তার দুনিয়া ও আখিরাত সবই হারায়।
প্রকৃতপক্ষে কৃপণতা ইসলামের মর্মবাণীরই পরিপন্থী। ইসলাম অর্থ নিজের জান ও মাল আল্লাহ তা'আলার জন্য নিবেদন করা। কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নিজের জান কী উৎসর্গ করবে, মালই তো উৎসর্গ করতে পারে না। ফলে তার অন্তরে ঈমান ও ইসলামের আবেদন দুর্বল হয়ে পড়ে।
‘প্রকৃত মুসলিম জান-মালের বিষয়ে নিজ ক্ষমতা ও সামর্থের উপর নয়; বরং আল্লাহ তা'আলার উপরই নির্ভরশীল থাকে। কিন্তু কৃপণ ব্যক্তির নির্ভরতা থাকে নিজ সামর্থ্যের উপর। কেমন যেন আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে তার অন্তরে এই কুধারণা সক্রিয় থাকে যে, তাঁর পথে দান-খয়রাত করলে তিনি তার সম্পদ কমিয়ে দেবেন। তাই সে দান করতে পারে না। এজন্যই বলা হয়, কৃপণতা ব্যক্তির ইসলামকে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত করে, অতটা ক্ষতিগ্রস্ত আর কোনওকিছুই করতে পারে না। তাই কৃপণতার সবটাই মন্দ, যেমন বদান্যতার সবটাই উৎকৃষ্ট। হযরত আলী রাযি. বলেন- 'কৃপণতা সর্বপ্রকার দোষের সমষ্টি। এটা এমন এক লাগাম, যা দ্বারা সকল মন্দের দিকে টেনে নেওয়া হয়।'
বস্তুত কৃপণতা ও লোভ-লালসা মানুষের স্বভাবগত বিষয়। সেই হিসেবে অন্তরে এ রিপু থাকাটা স্বাভাবিক এবং থাকাটা দোষের নয়; দোষ হল এর চর্চা করা অর্থাৎ কাজে কর্মে কৃপণতা প্রকাশ করা এবং লোভের বশবর্তী হয়ে কোনও কাজ করা। অন্তরে কৃপণতা ও লোভ প্রবল হলে সে অনুযায়ী সাধারণত কাজও করা হয়। তাই প্রয়োজন এ ব্যাধির চিকিৎসা এবং এ ব্যাধি যাতে প্রবল হয়ে উঠতে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা যদি জানতে পারি এটা কত খারাপ রোগ এবং এর ফলে কত কঠিন কঠিন পাপ হয়ে যায়, তবেই আমাদের পক্ষে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। তাই কুরআন ও হাদীছে বারবার এ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে এবং এর ক্ষতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
الَّذِينَ يَبْخَلُونَ وَيَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ وَيَكْتُمُونَ مَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ ۗ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا (37)
‘যারা নিজেরা কৃপণতা করে এবং মানুষকেও কৃপণতার নির্দেশ দেয়, আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহ হতে তাদের যা দান করেছেন তা গোপন করে, আমি (এরূপ) অকৃতজ্ঞদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।(সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩৭)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَأَيُّ دَاء أَدْوَأُ مِنَ البُخْلِ؟
‘কৃপণতার চেয়ে কঠিন রোগ আর কী আছে'?(সহীহ বুখারী: ৪৩৮২; মুসনাদে আহমাদ: ১৪৩০১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ২৬৬১০: তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৬৩; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৫৪)
অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ خِبُّ وَلَا مَنَّانٌ وَلَا بَخِيْلٌ
‘প্রতারক, খোঁটাদাতা ও কৃপণ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।(জামে' তিরমিযী: ১৯৬৩; মুসনাদে আহমাদ: ১৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৯৫; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ১৭৩; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৩৬৪; ফাওয়াইদু তাম্মাম: ১৭৬)
আরও এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
السَّخِيُّ قَرِيبٌ مِنَ اللهِ، بَعِيدٌ مِنَ النَّارِ، قَرِيبٌ مِنَ الْجَنَّةِ، قَرِيبٌ مِنَ النَّاسِ، وَالْبَخِيلُ بَعِيدٌ مِنَ اللَّهِ ، بَعِيدٌ مِنَ الْجَنَّةِ، بَعِيدٌ مِنَ النَّاسِ، قَرِيبٌ مِنَ النَّارِ، وَالْجَاهِلُ السَّخِيُّ أَحَبُّ إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنَ الْعَابِدِ الْبَخِيْلِ
‘দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী, জাহান্নাম থেকে দূরবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী এবং মানুষেরও নিকটবর্তী। আর কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহর থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে এবং মানুষের থেকেও দূরে, কিন্তু জাহান্নামের কাছে। অজ্ঞ দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকট কৃপণ আবেদ অপেক্ষা প্রিয়।(তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ২৩৬৩; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ৩৬০; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৩৫২; ফাওয়াইদু তাম্মাম: ২৮৪
قال الإمام أبو حاتم: هذا حديث باطل، وسعيد (بن مسلمة الراوي عن يحي بن سعيد) ضعيف الحديث، أخاف أن يكون أدخل له. (علل ابن أبي حاتم ٩٧/٦ (٣٢٥٢). وقال أيضا (٢٣٥٣) هذا حديث منكر فيه سعيد بن محمد الوراق. (الراوي عن يحي بن سعيد) قال الدارقطني متروك. قال العقيلي : ليس لهذا الحديث أصل من حديث يحي ولا غيره..)
এটা এমনই এক কঠিন ব্যাধি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রীতিমতো এর থেকে আল্লাহ তা'আলার কাছে পানাহ চাইতেন। তাঁর থেকে দু'আ বর্ণিত আছে-
اللَّهمَّ إنِّي أعوذُ بِكَ منَ البُخلِ ، وأعوذُ بِكَ منَ الجُبنِ وأعوذُ بِكَ أن أَرَدَّ إلى أرذلِ العمرِ ، وأعوذُ بِكَ مِن فتنةِ الدُّنيا ، وأعوذُ بِكَ مِن عذابِ القبرِ
‘হে আল্লাহ! আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি কৃপণতা হতে। আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি ভীরুতা হতে। আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি জরাজীর্ণ হয়ে যাওয়া বার্ধক্য হতে। আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি দুনিয়ার ফিতনা হতে এবং আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি কবরের আযাব হতে।’(সহীহ বুখারী: ৬৩৬৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ২৯১৩০; মুসনাদে আহমাদ: ১৫৮৪; সহীহ মুসলিম: ২৭০৬; সুনানে আবু দাউদ: ৩৯৭২; জামে' তিরমিযী: ৩৫৬৭; সুনানে নাসাঈ : ৫৪৪৫; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৭১৬; সহীহ ইবন খুযায়মা : ৭৪৬; সহীহ ইবন হিব্বান : ১০০৪)
ইমাম নাওয়াবী রহ. এ অধ্যায়ে কৃপণতা ও লোভ-লালসা সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি।
‘কৃপণতা ও লোভ-লালসা করার প্রতি নিষেধাজ্ঞা’ সম্পর্কিত দু’টি আয়াত
এক নং আয়াত
وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى (8) وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى (9) فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى (10) وَمَا يُغْنِي عَنْهُ مَالُهُ إِذَا تَرَدَّى (11)
অর্থ: পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করল এবং (আল্লাহর প্রতি) বেপরোয়াভাব দেখাল এবং সর্বোত্তম বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করল, আমি তার যাতনাময় স্থানে পৌছার ব্যবস্থা করে দেব। সে যখন ধ্বংস-গহ্বরে পতিত হবে, তখন তার সম্পদ তার কোনও কাজে আসবে না।
(সূরা লায়ল (৯২), আয়াত ৮-১১
‘যাতনাময় স্থানে’ পৌছার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অর্থ যেসব গুনাহ করলে জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যায়, সেগুলো করার অবকাশ দেওয়া এবং সৎকাজের তাওফীক না দেওয়া।
প্রকাশ থাকে যে, কুরআন মাজীদে ব্যবহৃত نُيَسِّرُهُ শব্দের অর্থ যে করা হয়েছে ‘ব্যবস্থা করে দেওয়া’, তা করা হয়েছে আল্লামা আলুসী (রহ.)-এর ব্যাখ্যার অনুসরণে। দেখুন (রহুল মাআনী, ৩০ : ৫১২)। -তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন থেকে সংগৃহীত।)
ব্যাখ্যা
এখানে সূরা লায়লের পাশাপাশি চারটি আয়াত উদ্ধৃত করা হয়েছে। এ আয়াতসমূহে যে ব্যক্তির মধ্যে তিনটি খাসলাত পাওয়া যায়, তার অশুভ পরিণাম বর্ণিত হয়েছে। প্রথম আয়াত হচ্ছে- وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى ‘পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করল এবং (আল্লাহর প্রতি) বেপরোয়াভাব দেখাল'। এ আয়াতে দু'টি খাসলাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হল কৃপণতা, আরেকটি হল আল্লাহর প্রতি বেপরোয়াভাব। বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কৃপণতা করে অর্থাৎ কল্যাণকর খাতে অর্থব্যয় করা হতে বিরত থাকে, যেসকল ক্ষেত্রে ব্যয় করা অবশ্যকর্তব্য ছিল তাতে ব্যয় করে না, আর তা না করার কারণ কেবল আল্লাহ তা'আলার প্রতি বেপরোয়াভাব। অর্থাৎ তার লক্ষ্যবস্তু শুধুই দুনিয়ার অর্থবিত্ত। সে অর্থবিত্ত অর্জিত হয়ে যাওয়ায় নিজেকে সফল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে। তাই আখিরাতের ছাওয়াব ও প্রতিদান লাভের কোনও ইচ্ছা সে করে না। আর তা করে না বলে সর্বশক্তিমান ও মহান আল্লাহর সামনে সে নতিস্বীকার করে না এবং তাঁর আদেশ- নিষেধের কোনও তোয়াক্কা করে না।
দ্বিতীয় আয়াত হল- وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى (এবং সর্বোত্তম বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করল)। এটা তৃতীয় খাসলাত। الْحُسْنی-এর অর্থ সর্বোত্তম বিষয়। এর দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য,তা নিয়ে তাফসীরকারকদের মধ্যে সামান্য মতভিন্নতা আছে। কেউ বলেন এর দ্বারা কালেমা তায়্যিবা বোঝানো হয়েছে। কারও মতে বোঝানো হয়েছে জান্নাত। কেউ বলেন কাখিরাতের প্রতিদান। তবে সবগুলোই কাছাকাছি। কেননা কালেমা পাঠ ও দাবি অনুযায়ী চলার দ্বারা আখিরাতের প্রতিদান মেলে। আর আখিরাতের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। সুতরাং আয়াতটির মর্মার্থ দাঁড়ায়- যে ব্যক্তি কালেমা তায়্যিবা তথা আল্লাহ তা'আলা মানুষের কল্যাণার্থে যে দীন ও শরী'আত প্রদান করেছেন তার প্রতি কোনও বিশ্বাস রাখে না, আখিরাতের প্রতিদানকে সত্য বলে স্বীকার করে না এবং জান্নাতের প্রতিশ্রুতিকে মিথ্যা ঠাওরায়। তো এই তিন খাসলাতবিশিষ্ট লোক সম্পর্কে পরের আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে-
فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى (আমি তার জন্য যাতনাময় স্থানে পৌঁছাকে সহজ করে দেব)। العُسْری-এর অর্থ যাতনাময় স্থান, কঠোর ও কঠিন পরিণাম। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য জাহান্নাম। আয়াতটিতে বলা হচ্ছে- উল্লিখিত খাসলাত ও চরিত্রসমূহ যার মধ্যে থাকবে, আল্লাহ তা'আলা তার জন্য এমনসব কাজ সহজ করে দেবেন, যা করার দ্বারা তার শেষ পরিণাম হবে জাহান্নাম। তার মানে শরী'আতবিরোধী কাজকর্ম করার প্রতি তার অন্তরে আগ্রহ সৃষ্টি করে দেওয়া হবে এবং সে আগ্রহ পূরণ করা তার পক্ষে সহজ হয়ে যাবে। পাপকাজের প্রতি মনে আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া ও তা করতে ভালো লাগা মূলত অনবরত দীন ও শরী'আতবিরুদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করতে থাকার কুফল। যে ব্যক্তি শরী'আত মোতাবেক চলতে সচেষ্ট থাকে, আল্লাহ তা'আলা এক পর্যায়ে তার জন্য সে চলাটাকে সহজ করে দেন। ফলে তার পক্ষে সৎকর্ম করতে ভালো লাগে, তা করা তার পক্ষে সহজ মনে হয় এবং সে তাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। অনুরূপ যে ব্যক্তি শরী'আতবিরোধী কাজকর্ম নিয়মিত করতে থাকে, তার সেসব কাজ করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। ফলে তার পক্ষে অসৎকর্ম করতে ভালো লাগে এবং তা করা তার পক্ষে সহজ মনে হয়। বলাবাহুল্য, শরী'আতবিরোধী কাজকর্ম করতে ভালো লাগাটা ও তা সহজ মনে হওয়াটা আল্লাহ তা'আলার এক রকম আযাব। এ আযাব আসার আগেই বান্দার কর্তব্য মনের খেয়ালখুশি উপেক্ষা করে শরী'আত মোতাবেক চলতে সচেষ্ট থাকা। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
চতুর্থ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন- وَمَا يُغْنِي عَنْهُ مَالُهُ إِذَا تَرَدَّى (সে যখন ধ্বংস-গহ্বরে পতিত হবে, তখন তার সম্পদ তার কোনও কাজে আসবে না)। অর্থাৎ উল্লিখিত তিনটি বদ খাসলাতের কারণে আখিরাতে যখন তাকে জাহান্নামের গর্তে নিক্ষেপ করা হবে, তখন শরী'আতের হুকুম অমান্য করে দুনিয়ায় সে যে সম্পদের আসক্তিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল, আল্লাহর পথে অর্থব্যয় হতে বিমুখ হয়ে কৃপণতা অবলম্বন করেছিল, সে সম্পদ তার কোনও উপকারে আসবে না। জাহান্নামের আযাব থেকে তাকে তা রক্ষা করতে পারবে না। উল্টো কৃপণতার কারণে এ সম্পদই আখিরাতে তার মহামসিবতের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘আল্লাহপ্রদত্ত অনুগ্রহে (সম্পদে) যারা কৃপণতা করে, তারা যেন কিছুতেই মনে না করে, এটা তাদের জন্য ভালো কিছু। বরং এটা তাদের পক্ষে অতি মন্দ। যে সম্পদের ভেতর তারা কৃপণতা করে, কিয়ামতের দিন তাকে তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৮০)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. কৃপণতা নেহাৎ মন্দ গুণ। এর ইসলাহ জরুরি।
খ. অর্থবিত্তের মোহে দীন ও শরী'আতের দাবি উপেক্ষা করতে নেই।
গ. কালেমা তায়্যিবা সর্বোত্তম বাণী। এ বাণীর অস্বীকৃতি কুফর।
ঘ. জান্নাত সর্বোত্তম স্থান। তা মুমিনদের ঠিকানা।
ঙ. অনবরত পাপকর্ম করতে থাকার পরিণামে পাপকর্ম করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। তাতে পাপকর্ম করা সহজ হয় ও জাহান্নামের পথ সুগম হয়।
চ. সম্পদের মোহে পড়তে নেই। আখিরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তিতে তা কোনও কাজে আসবে না।
দুই নং আয়াত
وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (16)
অর্থ : যারা তাদের অন্তরের লোভ-লালসা থেকে মুক্তি লাভ করেছে, তারাই সফলকাম।(সূরা তাগাবুন (৬৪), আয়াত ১৬)
ব্যাখ্যা
অন্তর লোভ-লালসা থেকে মুক্ত থাকলে অন্যায়ভাবে উপার্জন করা ও অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়। এরূপ ব্যক্তি সহজেই দীনের কাজে অর্থ-সম্পদ খরচ করতে পারে। যে ক্ষেত্রে অন্যরা ব্যয় করতে কুণ্ঠাবোধ করে, সেখানে সে অনায়াসে দান-খয়রাত করে। সারকথা নির্লোভ ব্যক্তি সাধারণত কৃপণ হয় না। আর তা হয় না বলে সে আল্লাহর দেওয়া মাল আল্লাহর পথে খরচ করে দোজাহানের সফলতা অর্জন করে নেয়। বোঝা গেল, যে ব্যক্তি الشُّحَّ বা লোভ-লালসার শিকার হয়ে যায়, সে সফলতা অর্জন করতে পারে না; বরং সে হয় ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত। বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি.-কে বলেছিল, ভয় হয়-বুঝি বা আমি ধ্বংস হয়ে যাব। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এর কারণ? সে বলল, আল্লাহ তা'আলা তো বলেছেন, যারা নিজেদের الشُّحَّ থেকে মুক্ত করেছে তারাই সফলকাম। আমি তো একজন কৃপণ লোক। আমার হাত থেকে কিছুই বের হয় না। হযরত ইবন মাস'ঊদ রাযি. বললেন, আল্লাহ তা'আলা যে الشُّحَّ -এর কথা বলেছেন, তোমার এটা তা নয়। তুমি যদি তোমার ভাইয়ের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ কর, তবে সেটাই । (লোভ-লালসা)। আর তোমার মধ্যে যা আছে তা হল اَلْبُخْلُ (কৃপণতা)।
হযরত উমর রাযি. বলেন, কেউ যদি নিজ সম্পদ ব্যয় না করে, তবে তা الشُّحَّ নয়; বরং কেউ অন্যের সম্পদের প্রতি লোভের দৃষ্টিতে তাকালে সেটাই الشُّحَّ।
হযরত সা‘ঈদ ইবন জুবায়র রহ. বলেন, الشُّحَّ -এর অর্থ হারাম গ্রহণ করা ও যাকাত দেওয়া হতে বিরত থাকা।
কারও মতে যে তীব্র লালসা মানুষকে অবৈধ উপার্জনে লিপ্ত করে, তাকেই الشُّحَّ বলে।
হযরত ইবন যায়দ রহ. বলেন, যে ব্যক্তি অবৈধ সম্পদ স্পর্শ করে না এবং আল্লাহর আদেশ পালনে কার্পণ্য যার পক্ষে বাধা হতে পারে না, সেই মূলত নিজেকে الشُّحَّ হতে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে লোভ ও কৃপণতা মারাত্মক আত্মিক ব্যাধি। এ ব্যাধি যার অন্তরে আছে, সে সবদিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে এক মিসকীন, তাতে তার যত বেশিই টাকা- পয়সা থাকুক না কেন। ইবন আতিয়্যাহ রহ. বলেন, মনের লোভ ও কৃপণতা এমন এক দারিদ্র্য, যা কখনও অর্থ-সম্পদ দিয়ে ঘোচে না; বরং যত বেশি সম্পদ হয় তত বেশি তা বাড়ে ও পাকাপোক্ত হয়। সুতরাং এ ব্যাধি থেকে নিজেকে মুক্ত করা অতীব জরুরি। তা থেকে মুক্ত হওয়ার একটা উপায় হচ্ছে হারাম অর্থ-সম্পদ থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং যাকাত ফরয হয়ে থাকলে তা পরিপূর্ণরূপে আদায় করা।
ইবন যায়দ রহ., সা‘ঈদ ইবন জুবায়র রহ, প্রমুখ বলেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার নিষেধকৃত কোনওকিছু স্পর্শ করে না এবং ফরয যাকাত আদায় হতে বিরত থাকে না, সে মনের লোভ ও কৃপণতা থেকে মুক্ত'। আমাদেরকে এ ব্যাধি থেকে মুক্ত হতেই হবে। কেননা এটা প্রকৃত ঈমানেরও পরিপন্থী। প্রকৃত ঈমানের সঙ্গে এটা সহাবস্থান করতে পারে না।
এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا يجتمعُ غبارٌ في سبيلِ اللَّهِ ودُخانُ جَهَنَّمَ في جوفِ عبدٍ أبدًا ، ولا يجتَمعُ الشُّحُّ والإيمانُ في قلبِ عبدٍ أبدًا
‘আল্লাহর পথের ধুলা ও জাহান্নামের ধোঁয়া কখনও কোনও বান্দার উদরে একত্র হতে পারে না। এমনিভাবে লোভ-কৃপণতা ও ঈমান কোনও বান্দার অন্তরে একত্র হতে পারে না।(সুনানে নাসাঈ ৩১১০; মুসনাদে আহমাদ: ৯৬৯৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১৯৪৮২ মুসনাদুল বাযযার: ৮২২৫; সহীহ ইবন হিব্বান ৩২৫১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৮৫০৮)
আয়াতটির শিক্ষা
লোভ ও কৃপণতা মারাত্মক আত্মিক ব্যাধি। এ ব্যাধি দোজাহানের সফলতা লাভের পক্ষে কঠিন বাধা। তাই আমাদেরকে এর থেকে মুক্তিলাভের সাধনা করতে হবে।
হাদীছ নং: ৫৬২
হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা জুলুম করা হতে বিরত থেকো, কেননা জুলুম কিয়ামতের দিন ঘোর অন্ধকারে পরিণত হবে। এবং তোমরা লোভ-লালসা হতে বিরত থেকো, কেননা লোভ-লালসা তোমাদের পূর্বের লোকদেরকে ধ্বংস করেছে। তা তাদেরকে তাদের রক্তপাত করতে এবং তাদের জন্য নিষিদ্ধ বিষয়সমূহকে হালাল করতে প্ররোচিত করেছিল। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৫৭৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৩৩৮; আল-আদাবুল মুফরাদ: ৪৮৩; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত: ৮৫৬১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪১৬১)
হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা জুলুম করা হতে বিরত থেকো, কেননা জুলুম কিয়ামতের দিন ঘোর অন্ধকারে পরিণত হবে। এবং তোমরা লোভ-লালসা হতে বিরত থেকো, কেননা লোভ-লালসা তোমাদের পূর্বের লোকদেরকে ধ্বংস করেছে। তা তাদেরকে তাদের রক্তপাত করতে এবং তাদের জন্য নিষিদ্ধ বিষয়সমূহকে হালাল করতে প্ররোচিত করেছিল। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৫৭৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৩৩৮; আল-আদাবুল মুফরাদ: ৪৮৩; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত: ৮৫৬১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪১৬১)
مقدمة الامام النووي
61 - باب النهي عن البخل والشح
قَالَ الله تَعَالَى: {وَأَمَا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى وَكَذَّبَ بِالحُسْنَى فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى وَمَا يُغْنِي عَنْهُ مَالُهُ إِذَا تَرَدَّى} [الليل: 8 - 11]، وقال تَعَالَى: {وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفسِهِ فَأولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ} [التغابن: 16].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَأَمَا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى وَكَذَّبَ بِالحُسْنَى فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى وَمَا يُغْنِي عَنْهُ مَالُهُ إِذَا تَرَدَّى} [الليل: 8 - 11]، وقال تَعَالَى: {وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفسِهِ فَأولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ} [التغابن: 16].
562 - وعن جابر - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «اتَّقُوا الظُّلْمَ؛
فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ القِيَامَةِ. وَاتَّقُوا الشُّحَّ؛ فَإنَّ الشُّحَّ أهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، حَمَلَهُمْ عَلَى أَنْ سَفَكُوا دِمَاءهُمْ وَاسْتَحَلُّوا مَحَارِمَهُمْ». رواه مسلم. (1)
فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ القِيَامَةِ. وَاتَّقُوا الشُّحَّ؛ فَإنَّ الشُّحَّ أهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، حَمَلَهُمْ عَلَى أَنْ سَفَكُوا دِمَاءهُمْ وَاسْتَحَلُّوا مَحَارِمَهُمْ». رواه مسلم. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এটি অতি মূল্যবান এক হাদীছ। এর মধ্যে রয়েছে দু'টি ধ্বংসাত্মক ব্যাধি সম্পর্কে কঠোর সতর্কবাণী এবং তার মধ্য দিয়ে জীবন গড়ার কার্যকর নির্দেশনা। ব্যাধিদু'টি হচ্ছে জুলুম ও লোভ।
হাদীছটিতে জুলুম সম্পর্কে বলা হয়েছে যে- اتَّقُوا الظُّلمَ ؛ فإنَّ الظُّلمَ ظُلُماتٌ يومَ القيامةِ (তোমরা জুলুম করা হতে বিরত থেকো, কেননা জুলুম কিয়ামতের দিন ঘোর অন্ধকারে পরিণত হবে)। প্রথমে জুলুম করতে নিষেধ করা হয়েছে, তারপর জুলুম করার পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। কী তার পরিণাম? বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন তা ঘোর অন্ধকারে পরিণত হবে। দুনিয়ায় যে ব্যক্তি জুলুম করেছে, সে কিয়ামতের দিন আলো পাবে না। অথচ সেদিন জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করে জান্নাতে পৌছার জন্য আলোর প্রয়োজন হবে।
আরবীতে অন্ধকারকে ظلمة وظلام (জুলমাত ও জলাম) বলা হয়। এমনিভাবে অবিচার-অত্যাচারকে বলা হয় الظُّلْمُ। উভয়টি একই মূলধাতু থেকে নির্গত। ধাতুগতভাবে যেমন উভয়ের মধ্যে মিল আছে, তেমনি মিল আছে তাত্ত্বিকভাবেও। কেননা যার অন্তর থেকে মনুষ্যত্বের আলো ঘুচে গিয়ে পাশবিকতার অন্ধকার ছেয়ে গেছে এবং সেখানে দয়ামায়ার পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে নিষ্ঠুরতা, কেবল সে ব্যক্তিই জুলুম, অত্যাচারের মতো ঘৃণ্য ও জঘণ্য কাজ করতে পারে। দুনিয়ায় যেহেতু দুর্বলের প্রতি জালেম ব্যক্তির আচরণ হয় তার অন্ধকারাচ্ছন্ন মন থেকে, সেহেতু আখিরাতে তার শাস্তিও অনুরূপই হবে। অর্থাৎ তার অন্তরের অন্ধকারপ্রসূত আচরণকে আখিরাতে বাস্তবিক অন্ধকারের রূপ দিয়ে দেওয়া হবে। যেমন কর্ম তেমন ফল।
এ হাদীছে দ্বিতীয়ত নিষেধ করা হয়েছে লোভ-লালসা করতে। বলা হয়েছে- وَاتَّقُوا الشُّحَّ ؛ فَإِنَّ الشُّحَّ أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ (তোমরা লােভ-লালসা হতে বিরত থেকো, কেননা লোভ-লালসা তোমাদের পূর্বের লোকদেরকে ধ্বংস করেছে)। অর্থাৎ লোভ-লালসা অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক বিষয়। এর পরিণামে মানুষ নিজ দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংস করে। তা ধ্বংস হয় নানা পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে। লোভ মানুষকে পাপাচারে লিপ্ত হতে উৎসাহ যোগায়। অতীতকালে বহু জাতিই লোভের বশবর্তীতে বড় বড় পাপে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তাদের জন্য আখিরাতের যে শাস্তি নির্ধারিত আছে তা তো আছেই, দুনিয়ায়ও তারা ধ্বংস হয়ে গেছে।
বস্তুত লোভ-লালসা এক মারাত্মক আত্মিক রিপু। এর আওতা অনেক বিস্তৃত। টাকা-পয়সা, ক্ষমতা, সুনাম-সুখ্যাতি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, নারী, বাড়ি, গাড়ি প্রভৃতি ভোগ- উপভোগের যত উপকরণ আছে, তার প্রত্যেকটির উপরই লোভ-লালসা জন্মাতে পারে। কেউ যখন এর কোনও একটির লোভে পড়ে যায়, তখন তা অর্জনের জন্য বৈধ-অবৈধ নির্বিচারে সবরকম পন্থা অবলম্বন করে থাকে। এমনকি এর জন্য মানবহত্যার মতো মহাপাপ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। অতীতে এমন বহু ঘটনা ঘটেছে। সেদিকে ইঙ্গিত করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
حَمَلَهُمْ عَلَى أَنْ سَفَكُوْا دِمَاءَهُمْ (তা তাদেরকে প্ররোচিত করেছিল তাদের রক্তপাত করতে)। অর্থাৎ ক্ষমতা হস্তগত করা, সম্পদ গ্রাস করা বা অন্য কোনও অবৈধ কামনা পূরণের লোভে তারা একে অন্যকে হত্যা করেছিল। মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম হত্যার ঘটনা তো এভাবেই ঘটেছিল। কাবিল হাবিলকে হত্যা করেছিল নারীর লোভে পড়ে। বনী ইসরাঈলে যে এক ব্যক্তি তার চাচাকে হত্যা করেছিল, তারও কারণ ছিল সম্পদের লোভ। সে ঘটনা সংক্ষেপে সূরা বাকারায় বর্ণিত হয়েছে। বর্তমানেও আমরা দেখছি কীভাবে মানুষ ক্ষমতার জন্য খুনাখুনিতে লিপ্ত হয়। অন্যের সম্পদ গ্রাস করার জন্যও একে অন্যকে হত্যা করছে।
হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু'টি মহাপাপের উল্লেখ করে বলেছেন যে, লোভের বশবর্তীতে তারা সে পাপে লিপ্ত হয় এবং পরিণামে ধ্বংস হয়ে যায়। তার একটি তো হল মানবহত্যা। আর দ্বিতীয় মহাপাপ হল হারাম সম্পদকে হালাল করে নেওয়া। সুতরাং তিনি ইরশাদ করেন-
واستَحَلُّوا مَحارِمَهم ‘এবং (লোভ তাদেরকে প্ররোচিত করেছিল) তাদের জন্য নিষিদ্ধ বিষয়সমূহকে হালাল করতে'। مَحَارِمُ (মাহারিম) শব্দটি مَحْرَمٌ (মাহরাম)-এর বহুবচন। এর অর্থ নিষিদ্ধ বিষয় বা বস্তু। যেসকল নর-নারীর মধ্যে বিবাহ হারাম, তাদেরকেও একে অপরের মাহরাম বলা হয়ে থাকে। পূর্বের জাতিসমূহ লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে সর্বপ্রকার হারাম ও নিষিদ্ধ কাজকে হালাল করে ফেলেছিল। তাদের অনেকে মাহরামকে বিবাহ করত, অনেকে ছলচাতুরী করে হারাম বস্তু হালাল বানিয়ে নিত। এর পরিণামে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
তাদেরকে ধ্বংস করার দুই অর্থ হতে পারে।
ক. আযাব ও গযব দ্বারা দুনিয়া থেকে নির্মূল করে ফেলা। আল্লাহ তা'আলা বহু জাতিকে এমনভাবে ধ্বংস করে দিয়েছেন যে, দুনিয়ায় তাদের কোনও চিহ্নমাত্রও অবশিষ্ট নেই।
খ. দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে আদর্শগত বিলুপ্তি। অর্থাৎ রক্তপাত ও হালালকে হারাম করতে থাকার পরিণামে তাদের দীন-ধর্ম এমনভাবে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, শুরুতে তারা যে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, একপর্যায়ে সেই ধর্মের সাথে তাদের বিশ্বাস ও জীবনাচারের কোনও সম্পর্ক ও মিল থাকেনি। তারা যেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জাতিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে মুসলিম জাতি ছাড়া অন্য যারা নিজেদেরকে আসমানী ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করে, তাদের অবস্থা তো এরকমই।
কেউ কেউ তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে, লোভ-লালসার কারণে খুন-খারাবিতে লিপ্ত হওয়া ছিল তাদের দৈহিক ধ্বংস আর হারাম বস্তুকে হালাল বানিয়ে ভোগ করা ছিল নৈতিক ধ্বংস। লোভ-লালসা এমনই এক খাসলাত, যার পরিণামে মানুষ এ উভয়বিধ ধ্বংসের শিকার হয়ে যায়। বলাবাহুল্য দৈহিক ও নৈতিক সে ধ্বংসের ভেতর দিয়েই তাদের পাপের পরিণামভোগ শেষ হয়ে যায়নি। তাদের জন্য রয়েছে আরও চরম ধ্বংসের ব্যবস্থা। তা হল জাহান্নামের শাস্তি। এভাবে লোভজনিত পাপের দরুন মানুষ দুনিয়ায়ও বরবাদির সম্মুখীন হয়, আর আখিরাতেও হয় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
পূর্ববর্তী জাতিসমূহের সে ধ্বংসকর পরিণামের কথা উল্লেখ করে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সতর্ক করছেন যে, আমরাও যদি লোভের শিকার হয়ে যাই, তবে আমাদেরকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হবে। সুতরাং অপর এক হাদীছে ধন-সম্পদের লালসায় পড়ার পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ولَكِنْ أَخَشَى علَيْكُم أَنْ تُبْسَطَ عَلَيْكُمُ الدُّنْيَا كما بُسِطَتْ علَى مَن كانَ قَبْلَكُمْ، فَتَنَافَسُوهَا كما تَنَافَسُوهَا وتُهْلِكَكُمْ كما أَهْلَكَتْهُمْ
‘বরং আমি ভয় করি যে, তোমাদের জন্য দুনিয়া (এর ধন-সম্পদ) প্রশস্ত করে দেওয়া হবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের জন্য প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর তোমরা এর আসক্তিতে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে, যেমন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল তারা। ফলে এ দুনিয়া তোমাদের ধ্বংস করে দেবে, যেমন ধ্বংস করে দিয়েছিল তাদেরকে।’(সহীহ বুখারী : ৩১৫৮; সহীহ মুসলিম: ২৯৬১; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৯৯৮; জামে তিরমিযী: ২৪৬২; বায়হাকী : ১৮৬৫৮; মুসনাদে আহমাদ: ১০৯৫৮)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. জুলুম করা কঠিন পাপ। আমাদের দ্বারা যাতে কারও প্রতি কোনওভাবেই জুলুম না হয়ে যায়, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
খ. লোভ-লালসা ও কৃপণতা এমনিতেও কঠিন পাপ। সেইসঙ্গে তা অন্যান্য নৈতিক অবক্ষয়েরও কারণ। সুতরাং এর থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেকের অবশ্যকর্তব্য।
গ. অন্যায় নরহত্যা যেমন কঠিন পাপ, তেমনি আল্লাহ যা হারাম করেছেন, নিজেদের পক্ষ থেকে তা হালাল করে নেওয়াও মহাপাপ। এর থেকে বিরত থাকা জরুরি।
ঘ. পূর্ববর্তী জাতিসমূহের পরিণাম থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। সে লক্ষ্যেই কুরআন ও হাদীছে তাদের পরিণাম বর্ণিত হয়ে থাকে।
হাদীছটিতে জুলুম সম্পর্কে বলা হয়েছে যে- اتَّقُوا الظُّلمَ ؛ فإنَّ الظُّلمَ ظُلُماتٌ يومَ القيامةِ (তোমরা জুলুম করা হতে বিরত থেকো, কেননা জুলুম কিয়ামতের দিন ঘোর অন্ধকারে পরিণত হবে)। প্রথমে জুলুম করতে নিষেধ করা হয়েছে, তারপর জুলুম করার পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। কী তার পরিণাম? বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন তা ঘোর অন্ধকারে পরিণত হবে। দুনিয়ায় যে ব্যক্তি জুলুম করেছে, সে কিয়ামতের দিন আলো পাবে না। অথচ সেদিন জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করে জান্নাতে পৌছার জন্য আলোর প্রয়োজন হবে।
আরবীতে অন্ধকারকে ظلمة وظلام (জুলমাত ও জলাম) বলা হয়। এমনিভাবে অবিচার-অত্যাচারকে বলা হয় الظُّلْمُ। উভয়টি একই মূলধাতু থেকে নির্গত। ধাতুগতভাবে যেমন উভয়ের মধ্যে মিল আছে, তেমনি মিল আছে তাত্ত্বিকভাবেও। কেননা যার অন্তর থেকে মনুষ্যত্বের আলো ঘুচে গিয়ে পাশবিকতার অন্ধকার ছেয়ে গেছে এবং সেখানে দয়ামায়ার পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে নিষ্ঠুরতা, কেবল সে ব্যক্তিই জুলুম, অত্যাচারের মতো ঘৃণ্য ও জঘণ্য কাজ করতে পারে। দুনিয়ায় যেহেতু দুর্বলের প্রতি জালেম ব্যক্তির আচরণ হয় তার অন্ধকারাচ্ছন্ন মন থেকে, সেহেতু আখিরাতে তার শাস্তিও অনুরূপই হবে। অর্থাৎ তার অন্তরের অন্ধকারপ্রসূত আচরণকে আখিরাতে বাস্তবিক অন্ধকারের রূপ দিয়ে দেওয়া হবে। যেমন কর্ম তেমন ফল।
এ হাদীছে দ্বিতীয়ত নিষেধ করা হয়েছে লোভ-লালসা করতে। বলা হয়েছে- وَاتَّقُوا الشُّحَّ ؛ فَإِنَّ الشُّحَّ أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ (তোমরা লােভ-লালসা হতে বিরত থেকো, কেননা লোভ-লালসা তোমাদের পূর্বের লোকদেরকে ধ্বংস করেছে)। অর্থাৎ লোভ-লালসা অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক বিষয়। এর পরিণামে মানুষ নিজ দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংস করে। তা ধ্বংস হয় নানা পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে। লোভ মানুষকে পাপাচারে লিপ্ত হতে উৎসাহ যোগায়। অতীতকালে বহু জাতিই লোভের বশবর্তীতে বড় বড় পাপে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তাদের জন্য আখিরাতের যে শাস্তি নির্ধারিত আছে তা তো আছেই, দুনিয়ায়ও তারা ধ্বংস হয়ে গেছে।
বস্তুত লোভ-লালসা এক মারাত্মক আত্মিক রিপু। এর আওতা অনেক বিস্তৃত। টাকা-পয়সা, ক্ষমতা, সুনাম-সুখ্যাতি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, নারী, বাড়ি, গাড়ি প্রভৃতি ভোগ- উপভোগের যত উপকরণ আছে, তার প্রত্যেকটির উপরই লোভ-লালসা জন্মাতে পারে। কেউ যখন এর কোনও একটির লোভে পড়ে যায়, তখন তা অর্জনের জন্য বৈধ-অবৈধ নির্বিচারে সবরকম পন্থা অবলম্বন করে থাকে। এমনকি এর জন্য মানবহত্যার মতো মহাপাপ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। অতীতে এমন বহু ঘটনা ঘটেছে। সেদিকে ইঙ্গিত করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
حَمَلَهُمْ عَلَى أَنْ سَفَكُوْا دِمَاءَهُمْ (তা তাদেরকে প্ররোচিত করেছিল তাদের রক্তপাত করতে)। অর্থাৎ ক্ষমতা হস্তগত করা, সম্পদ গ্রাস করা বা অন্য কোনও অবৈধ কামনা পূরণের লোভে তারা একে অন্যকে হত্যা করেছিল। মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম হত্যার ঘটনা তো এভাবেই ঘটেছিল। কাবিল হাবিলকে হত্যা করেছিল নারীর লোভে পড়ে। বনী ইসরাঈলে যে এক ব্যক্তি তার চাচাকে হত্যা করেছিল, তারও কারণ ছিল সম্পদের লোভ। সে ঘটনা সংক্ষেপে সূরা বাকারায় বর্ণিত হয়েছে। বর্তমানেও আমরা দেখছি কীভাবে মানুষ ক্ষমতার জন্য খুনাখুনিতে লিপ্ত হয়। অন্যের সম্পদ গ্রাস করার জন্যও একে অন্যকে হত্যা করছে।
হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু'টি মহাপাপের উল্লেখ করে বলেছেন যে, লোভের বশবর্তীতে তারা সে পাপে লিপ্ত হয় এবং পরিণামে ধ্বংস হয়ে যায়। তার একটি তো হল মানবহত্যা। আর দ্বিতীয় মহাপাপ হল হারাম সম্পদকে হালাল করে নেওয়া। সুতরাং তিনি ইরশাদ করেন-
واستَحَلُّوا مَحارِمَهم ‘এবং (লোভ তাদেরকে প্ররোচিত করেছিল) তাদের জন্য নিষিদ্ধ বিষয়সমূহকে হালাল করতে'। مَحَارِمُ (মাহারিম) শব্দটি مَحْرَمٌ (মাহরাম)-এর বহুবচন। এর অর্থ নিষিদ্ধ বিষয় বা বস্তু। যেসকল নর-নারীর মধ্যে বিবাহ হারাম, তাদেরকেও একে অপরের মাহরাম বলা হয়ে থাকে। পূর্বের জাতিসমূহ লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে সর্বপ্রকার হারাম ও নিষিদ্ধ কাজকে হালাল করে ফেলেছিল। তাদের অনেকে মাহরামকে বিবাহ করত, অনেকে ছলচাতুরী করে হারাম বস্তু হালাল বানিয়ে নিত। এর পরিণামে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
তাদেরকে ধ্বংস করার দুই অর্থ হতে পারে।
ক. আযাব ও গযব দ্বারা দুনিয়া থেকে নির্মূল করে ফেলা। আল্লাহ তা'আলা বহু জাতিকে এমনভাবে ধ্বংস করে দিয়েছেন যে, দুনিয়ায় তাদের কোনও চিহ্নমাত্রও অবশিষ্ট নেই।
খ. দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে আদর্শগত বিলুপ্তি। অর্থাৎ রক্তপাত ও হালালকে হারাম করতে থাকার পরিণামে তাদের দীন-ধর্ম এমনভাবে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, শুরুতে তারা যে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, একপর্যায়ে সেই ধর্মের সাথে তাদের বিশ্বাস ও জীবনাচারের কোনও সম্পর্ক ও মিল থাকেনি। তারা যেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জাতিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে মুসলিম জাতি ছাড়া অন্য যারা নিজেদেরকে আসমানী ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করে, তাদের অবস্থা তো এরকমই।
কেউ কেউ তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে, লোভ-লালসার কারণে খুন-খারাবিতে লিপ্ত হওয়া ছিল তাদের দৈহিক ধ্বংস আর হারাম বস্তুকে হালাল বানিয়ে ভোগ করা ছিল নৈতিক ধ্বংস। লোভ-লালসা এমনই এক খাসলাত, যার পরিণামে মানুষ এ উভয়বিধ ধ্বংসের শিকার হয়ে যায়। বলাবাহুল্য দৈহিক ও নৈতিক সে ধ্বংসের ভেতর দিয়েই তাদের পাপের পরিণামভোগ শেষ হয়ে যায়নি। তাদের জন্য রয়েছে আরও চরম ধ্বংসের ব্যবস্থা। তা হল জাহান্নামের শাস্তি। এভাবে লোভজনিত পাপের দরুন মানুষ দুনিয়ায়ও বরবাদির সম্মুখীন হয়, আর আখিরাতেও হয় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
পূর্ববর্তী জাতিসমূহের সে ধ্বংসকর পরিণামের কথা উল্লেখ করে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সতর্ক করছেন যে, আমরাও যদি লোভের শিকার হয়ে যাই, তবে আমাদেরকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হবে। সুতরাং অপর এক হাদীছে ধন-সম্পদের লালসায় পড়ার পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ولَكِنْ أَخَشَى علَيْكُم أَنْ تُبْسَطَ عَلَيْكُمُ الدُّنْيَا كما بُسِطَتْ علَى مَن كانَ قَبْلَكُمْ، فَتَنَافَسُوهَا كما تَنَافَسُوهَا وتُهْلِكَكُمْ كما أَهْلَكَتْهُمْ
‘বরং আমি ভয় করি যে, তোমাদের জন্য দুনিয়া (এর ধন-সম্পদ) প্রশস্ত করে দেওয়া হবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের জন্য প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর তোমরা এর আসক্তিতে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে, যেমন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল তারা। ফলে এ দুনিয়া তোমাদের ধ্বংস করে দেবে, যেমন ধ্বংস করে দিয়েছিল তাদেরকে।’(সহীহ বুখারী : ৩১৫৮; সহীহ মুসলিম: ২৯৬১; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৯৯৮; জামে তিরমিযী: ২৪৬২; বায়হাকী : ১৮৬৫৮; মুসনাদে আহমাদ: ১০৯৫৮)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. জুলুম করা কঠিন পাপ। আমাদের দ্বারা যাতে কারও প্রতি কোনওভাবেই জুলুম না হয়ে যায়, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
খ. লোভ-লালসা ও কৃপণতা এমনিতেও কঠিন পাপ। সেইসঙ্গে তা অন্যান্য নৈতিক অবক্ষয়েরও কারণ। সুতরাং এর থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেকের অবশ্যকর্তব্য।
গ. অন্যায় নরহত্যা যেমন কঠিন পাপ, তেমনি আল্লাহ যা হারাম করেছেন, নিজেদের পক্ষ থেকে তা হালাল করে নেওয়াও মহাপাপ। এর থেকে বিরত থাকা জরুরি।
ঘ. পূর্ববর্তী জাতিসমূহের পরিণাম থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। সে লক্ষ্যেই কুরআন ও হাদীছে তাদের পরিণাম বর্ণিত হয়ে থাকে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)