রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৬৩
ভূমিকা অধ্যায়
অন্যের জন্য স্বার্থত্যাগ ও সহমর্মিতা
الايثار এর অর্থ নিজ স্বার্থের উপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। الْمُؤَاسَاةُ এর অর্থ অন্যের দুঃখ-কষ্টে সহমর্মিতা প্রকাশ করা। নিজ উদ্বৃত্ত অর্থ দ্বারা যা করা হয় তা দান-খয়রাত বটে, কিন্তু اَلْمُؤَاسَاةُ বা সহমর্মিতা আরও বেশি কিছু। অন্যের কষ্টকে যদি নিজ কষ্টের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়, তথা নিজ প্রয়োজন দমিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থের একটা অংশ বা পুরোটাই অন্য অভাবগ্রস্তকে দিয়ে দেওয়ার নাম الْمُؤَاسَاةُ বা সহমর্মিতা। সে হিসেবে এটাও الايثار বা স্বার্থত্যাগই বটে। এ স্বার্থত্যাগ হতে পারে একান্তভাবে নিজের ক্ষেত্রেও এবং নিজ পরিবার-পরিজনের ক্ষেত্রেও। তবে বিষয়টি কিছুটা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ।
অর্থ-সম্পদ ব্যয়ের মূলনীতি হল তা দ্বারা সর্বপ্রথম নিজ জরুরি প্রয়োজন মেটানো। তারপর কিছু উদ্বৃত্ত থাকলে তা দ্বারা নিজ পোষ্যবর্গের প্রয়োজন মেটানো। নিজ জরুরত বলতে এমন প্রচণ্ড ক্ষুধা, যা সহ্য করা সম্ভব হয় না, নিজ সতর ঢাকা কিংবা নিজের অন্য কোনও দুর্বিষহ কষ্ট দূর করা। যে টাকা-পয়সা দ্বারা কেবল এ পরিমাণ প্রয়োজন মেটানো যায়, তা দ্বারা প্রথম কাজ হল নিজের এসব প্রয়োজন মেটানো। এ ক্ষেত্রে নিজ প্রয়োজন উপেক্ষা করে অন্যের প্রয়োজন মেটানো জায়েয নয়। কেননা এটা আত্মহত্যা করা বা নিজ ইজ্জত-সম্মান ধ্বংস করার নামান্তর, যা শরী'আত অনুমোদন করে না। সুতরাং এরূপ ক্ষেত্রে নিজের হক আদায় করাই অগ্রগণ্য।
টাকা-পয়সা যদি এরচে' কিছু বেশি থাকে, তবে তা দ্বারা কর্তব্য প্রথমে নিজ পরিবার-পরিজনের এ জাতীয় জরুরি প্রয়োজন মেটানো। তাদের এরূপ জরুরি প্রয়োজন পাশ কাটিয়ে সে অর্থ দ্বারা অন্যের প্রয়োজন পূরণ করা জায়েয নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
كَفَى بِالْمَرْءِ إِثْمًا أَنْ يُضَيِّعَ مَنْ يَقُوْتُ
কোনও ব্যক্তির গুনাহগার হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, যার খাবার তার দায়িত্বে, সে তাকে (বঞ্চিত করে) ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে।(সুনানে আবু দাউদ: ৯১৩২; মুসনাদে আহমাদ: ৬৪৯৫; সহীহ ইবনে হিব্বান : ২৪৩৫৪; তাবারানী, আল্-মুজামুল কাবীর: ১৩৪১৪; শুআবুল ঈমান: ৮৩৩৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ; ২৪০৪)
এ জাতীয় প্রয়োজন মেটানোর পরও যদি কিছু সম্পদ উদ্বৃত্ত থাকে, সে ক্ষেত্রে নিজের উপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া উত্তম; বরং অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। পরিবার-পরিজন যদি কষ্ট-ক্লেশে ধৈর্যধারণ করতে প্রস্তুত থাকে, তবে তাদের উপরও অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে, অন্যথায় নয়।
কখনও কখনও অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া অবশ্যকর্তব্যও হয়ে যায়। যেমন অতিথি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত হলে নিজে না খেয়ে তাকে খাওয়ানো, ক্ষুধায় মরণাপন্ন কোনও ব্যক্তি নজরে আসলে নিজের খাবার তাকে দিয়ে দেওয়া, যে মায়্যিতের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করার মতো কেউ নেই, নিজ জরুরি প্রয়োজন মেটানোর পর কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকলে তা তার দাফন-কাফনে খরচ করা চাই। এ জাতীয় সহমর্মিতা প্রদর্শন ফরয ও অবশ্যকর্তব্য।
সহমর্মিতা ও স্বার্থত্যাগ ইসলামের সুমহান চারিত্রিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। ইসলামের শিক্ষা হল তুমি নিজের জন্য যা ভালোবাস, অন্যের জন্যও তা ভালোবাসবে। নিজে ক্ষুধার্ত থেকে অন্যকে খাওয়াবে। নিজ সতর ঢাকার পর উদ্বৃত্ত পোশাক দ্বারা অন্যের সতর ঢাকার ব্যবস্থা করবে। প্রথমদিকের মুসলিমগণ এ শিক্ষা নিজেদের জীবনে রূপায়িত করেছিল। মহান সাহাবীগণ তো ছিলেন এর সর্বোচ্চ ধাপে। ইয়ারমুকের যুদ্ধের সে ঘটনা কে না জানে যে, হযরত হুযায়ফা আল-আদাবী রাযি. তাঁর মুমূর্ষু ও ক্ষতবিক্ষত চাচাতো ভাইয়ের কাছে পানি নিয়ে গেলেন। তিনি যেই না পানি পান করতে যাবেন, অমনি খানিকটা দূর থেকে এক ব্যক্তি ‘আহ্’ বলে আর্তনাদ করল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, তুমি ওর কাছে পানি নিয়ে যাও। তিনি তার কাছে পানি নিয়ে গেলেন। দেখা গেল তিনি বিখ্যাত সাহাবী হিশাম ইবনুল আস রাযি.। তাঁর সামনে পানি তুলে ধরতেই খানিকটা দূরে আরেক ব্যক্তি আর্তনাদ করে উঠল। হিশাম রাযি. সে পানি তার কাছে নিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু নিয়ে যেতে যেতেই তার প্রাণবায়ু উড়ে গেল। হযরত হুযায়ফা রাযি. ফিরে আসলেন হিশাম রাযি.-এর কাছে। ততক্ষণে তারও প্রাণবায়ু উড়ে গেছে। শেষে ফিরে আসলেন চাচাতো ভাইয়ের কাছে। এসে দেখেন তিনিও চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন। এভাবে সেই তিন মহান সাহাবী রণক্ষেত্রে শাহাদাত বরণ করেন আর সেই সন্ধিক্ষণেও রেখে যান স্বার্থত্যাগ ও সহমর্মিতার অভাবনীয় দৃষ্টান্ত।
কেবল কি সাহাবায়ে কেরাম? তাদের পরবর্তীদের মধ্যেও এরূপ হাজারও দৃষ্টান্ত আছে। আবুল হাসান আনতাকী রহ. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, একদা ৩০ জনেরও বেশি মেহমান তার কাছে উপস্থিত। খাবার জন্য ছিল মাত্র কয়েকটি রুটি। তা তাদের ক্ষুধা মেটানোর জন্য মোটেই যথেষ্ট ছিল না। এ অবস্থায় রুটিগুলো ছিড়ে টুকরো টুকরো করা হল। বাতি নিভিয়ে দেওয়া হল। সবাই খেতে বসলেন। কিছুক্ষণ পর যখন দস্তরখান তোলা হবে, দেখা গেল সবগুলো রুটি যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। এক টুকরোও কমেনি। প্রত্যেকেই মনে করেছিলেন আমি এতে ভাগ না বসিয়ে অন্যদের খেতে দিই। সকলেরই স্বার্থত্যাগের মনোভাব। ফলে কারওই খাওয়া হয়নি। রুটিগুলো যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে।
বিখ্যাত বুযুর্গ বিশর ইবনুল হারিছ রহ.-এর কথা। তিনি তখন মুমূর্ষু রোগী। এ অবস্থায় এক অভাবগ্রস্ত হাজির। তিনি নিজ গায়ের জামাটি খুলে তাকে দিয়ে দিলেন। পরার জন্য তার আর কোনও জামা ছিল না। আরেকজনের কাছ থেকে একটি জামা ধার নিয়ে শরীর ঢাকেন আর সে অবস্থায়ই তাঁর ইন্তিকাল হয়ে যায়।
বস্তুত আমাদের মহান পূর্বসুরীদের সামনে ছিল আখিরাতের মুক্তি ও নাজাতের ভাবনা। দুনিয়ার সর্বস্ব দিয়ে হলেও তারা সে লক্ষ্যই অর্জন করতে চাইতেন। তাই তারা কৃষ্ণতাকে বেছে নিয়েছেন। যা-কিছু অর্থ-সম্পদ অর্জিত হতো, তা অকাতরে আল্লাহ তা'আলার পথে খরচ করেছেন। সর্বদা নিজের স্বার্থ উপেক্ষা করে অন্যের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তারা জীবনভর সহমর্মিতার প্রতিযোগিতায় লেগে থেকেছেন। তারা এ মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন কুরআন-সুন্নাহের শিক্ষা দ্বারা। কুরআন-হাদীছ মানুষকে এ মহান নীতির উপর নানাভাবে উৎসাহদান করেছে। এ অধ্যায়ে ইমাম নাওয়াবী রহ. সেরকমই কিছু আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন।
‘অন্যের জন্য স্বার্থত্যাগ ও সহমর্মিতা’ সম্পর্কিত দু’টি আয়াত
এক নং আয়াত
وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ
অর্থ: এবং তাদেরকে তারা নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের অভাব- অনটন থাকে।(সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ৯)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা হাশরের ৯ নং আয়াতের অংশবিশেষ। এ আয়াতে মদীনার আনসারদের প্রশংসা করা হয়েছে। শুরুতে বলা হয়েছে- وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا ‘যারা পূর্ব থেকেই এ নগরে (অর্থাৎ মদীনায়) ঈমানের সাথে অবস্থানরত আছে, যে-কেউ হিজরত করে তাদের কাছে আসে, তাদেরকে তারা ভালোবাসে এবং যা-কিছু তাদেরকে (অর্থাৎ মুহাজিরদেরকে) দেওয়া হয়, তার জন্য নিজেদের অন্তরে কোনও চাহিদা বোধ করে না'। এতে আনসার সাহাবীদের দু'টি গুণ বলা হয়েছে। এক তো তারা ঈমানের উপর স্থিতিশীল। দ্বিতীয়ত তারা নিঃস্বার্থ। মুহাজিরদের বিশেষ মর্যাদার কারণে তাদের প্রতি তারা ঈর্ষাবোধও করে না এবং গনীমতের সম্পদ থেকে তাদেরকে যা দেওয়া হয় তার প্রতিও চাহিদা বোধ করে না। তারপর বলা হয়েছে-
وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ (এবং তাদেরকে তারা নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের অভাব-অনটন থাকে)। এটা আনসারদের তৃতীয় বিশেষত্ব। তারা কেবল নিঃস্বার্থই নয়; বরং নিজের উপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। এমনকি তারা নিজেদের অর্থ-সম্পদ ও ঘরবাড়িতেও মুহাজিরদের প্রাধান্য দেয়। তাছাড়া যুদ্ধে যে গনীমত অর্জিত হয় তাতেও নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে মুহাজিরদের অগ্রাধিকার দেয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা মুকাররামা ত্যাগ করে যখন মদীনা মুনাউওয়ারায় চলে আসেন, তখন মুহাজিরদেরকে গ্রহণ করার ব্যাপারে আনসারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে যায়। শেষপর্যন্ত লটারী ধরা হয়। তাতে যে মুহাজিরের নাম যে আনসারের ভাগে পড়ে, কেবল তিনিই তার অতিথি হন। এভাবে মুহাজিরগণ আনসারদের বাড়িতে বাড়িতে ভাগ হয়ে যান। আনসারগণ নিজেদের ধন-সম্পত্তিতে তাদেরকে শরীক করে নেন। পরে যখন ইহুদীগোত্র বনু নাযীরের রেখে যাওয়া সম্পদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হস্তগত হয়, তখন তিনি সমস্ত আনসার সাহাবীকে ডাকিয়ে আনেন। প্রথমে তিনি মুহাজিরদের প্রতি আনসারদের ভালোবাসা ও সহমর্মিতার প্রশংসা করেন। তারপর তাদের বলেন, হে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা যদি চাও তবে আমি বনু নাযীরের থেকে প্রাপ্ত সম্পদ তোমাদের ও মুহাজিরদের মধ্যে ভাগ করে দিই। সে ক্ষেত্রে তোমরা তাদেরকে তোমাদের ঘরবাড়ি ও অর্থ-সম্পদের যে অংশ দিয়েছিলে তা যথারীতি তাদের থাকবে। আর তোমরা চাইলে এ সম্পদ তাদের মধ্যেই বণ্টন করে দেব আর তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছিলে তা তারা তোমাদের ফিরিয়ে দেবে। এর উত্তরে আনসারগণ জানান যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ওই সম্পদ মুহাজিরদের মধ্যেই বণ্টন করে দিন। আর আমরা তাদের যা দিয়েছিলাম তাও তাদেরই থাকুক। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়। এতে বলা হয়েছে যে, আনসারগণ নিজেদের অর্থ-সম্পদ ও ঘরবাড়িতে মুহাজিরদের প্রাধান্য দেয়। এমনও বর্ণিত আছে যে, যে আনসারী সাহাবীর দু'জন স্ত্রী ছিল, তিনি তার এক স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে মুহাজির ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন।
বলা হয়েছে- وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ (যদিও তাদের অভাব-অনটন থাকে)। অর্থাৎ যে বিষয়ে আনসারগণ মুহাজিরদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেন, তার অভাব ও প্রয়োজন নিজেদের বেশি থাকলেও তা উপেক্ষা করে মুহাজিরদেরকেই অগ্রাধিকার দেন। হাদীছ ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে এ জাতীয় বহু ঘটনা বর্ণিত আছে। এক বর্ণনায় আছে, একবার এক সাহাবীকে একটি ছাগলের মাথা হাদিয়া দেওয়া হল। সে সাহাবী বললেন, আমার চেয়ে আমার অমুক ভাই ও তার পরিবারেরই প্রয়োজন বেশি। এ বলে তিনি সে মাথাটি তাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেই সাহাবীও একই কথা বলে তৃতীয় এক সাহাবীর বাড়িতে সেটি পাঠিয়ে দেন। এভাবে ছাগলের মাথাটি একের পর এক বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হতে থাকে। সর্বমোট সাতটি বাড়িতে সেটি ঘুরতে থাকে। সবশেষে প্রথম যে সাহাবীকে দেওয়া হয়েছিল তার কাছেই সেটি ফিরে আসে।
অপর এক বর্ণনায় আছে, বাহরায়ন জয় হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানকার ভূ-সম্পত্তি আনসারদের লিখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাতে রাজি হননি। তারা বলেছিলেন, যাবৎ না আমাদের মুহাজির ভাইদেরকেও আমাদের মতো দেবেন, আমরা এতে রাজি হব না।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ঈমান কেবল আনাই যথেষ্ট নয়, তাকে স্থিতিশীল করাও জরুরি। নিজ ঘরবাড়ির মতো ঈমান হতে হবে মুমিনের স্থায়ী ঠিকানা।
খ. অন্যের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব দেখে ঈর্ষান্বিত হতে নেই।
গ. প্রকৃত মুমিন নিজ স্বার্থের উপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
ঘ. এক মুমিনের কর্তব্য অপর মুমিনের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা এবং তার প্রতি ভ্রাতৃসুলভ আচরণ করা।
ঙ. মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের প্রতি ভালোবাসা রাখা ঈমানের দাবি।
দুই নং আয়াত
وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا (8)
অর্থ : তারা তাঁর (আল্লাহর) ভালোবাসায় মিসকীন, এতিম ও বন্দীদেরকে খাবার দান করে।(সূরা দাহর (৭৬), আয়াত ৮)
ব্যাখ্যা
এর আরেক অর্থ হতে পারে- তারা তার (অর্থাৎ খাদ্যের) প্রতি নিজেদের আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকীন, এতিম ও বন্দীদেরকে তা খাওয়ায়। উভয় অর্থ হিসেবেই আয়াতের সারকথা হল, সাহাবীগণ গরীব-দুঃখী ও আর্তমানবতার প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করতেন।
এখানে যে أَسِير (বন্দী)-এর কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা অমুসলিম বন্দী বোঝানো হয়েছে। ইবন জুরায়জ রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও কোনও মুসলিমকে বন্দী করতেন না। এ আয়াত নাযিল হয়েছে মুশরিকদের সম্পর্কে। তারা যুদ্ধে মুমিনদের হাতে বন্দী হতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিনদের আদেশ করতেন তারা যেন সেই অমুসলিম বন্দীদের প্রতি সদয় আচরণ করেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, এ আয়াত নাযিল হয়েছে হযরত আলী রাযি. সম্পর্কে। তিনি একদিন এক ইহুদীর কাজ করে দিয়ে বিনিময়ে কিছু যব পেয়েছিলেন। সেই যবের এক-তৃতীয়াংশ পিষে পরিবারের সদস্যদের জন্য রুটি তৈরি করেন। রুটি তৈরি হতেই এক মিসকীন উপস্থিত। রুটিগুলো তাকে দিয়ে দিলেন। তারপর যবের দ্বিতীয় অংশ দিয়ে আবার রুটি বানানো হল। অমনি এক এতিম এসে হাজির। এবার সে রুটিগুলো সেই এতিমকে দিয়ে দেওয়া হল। তারপর যবের বাকি অংশ দিয়ে আবার রুটি বানানো হল। এবার এক মুশরিক বন্দী খাবার চাইল। রুটিগুলো তাকে দিয়ে দেওয়া হল। সেদিন এ পরিবারের সকলের উপোস দিন কাটল। হযরত আলী রাযি, সম্পর্কে এরকম আরও ঘটনা বর্ণিত আছে।
যাহোক অন্যের প্রতি সহমর্মিতার এ গুণ কেবল হযরত আলী রাযি.-এরই বৈশিষ্ট্য নয়: সব সাহাবীই এরকম ছিলেন। আয়াতে বহুবচনের সঙ্গে বলা হয়েছে যে, তারা অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দীকে আহার্য দান করে।
তাদের এ সহমর্মিতা ছিল কেবলই আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসায়, অন্য কোনও উদ্দেশ্যে নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টিই ছিল তাদের একমাত্র কাম্যবস্তু। এর পরের আয়াতে সে কথা আরও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে- إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا (9) (আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। আমরা তোমাদের কাছে কোনও প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও না)।
প্রকাশ থাকে যে, আয়াতে কেবল খাবার খাওয়ানোর কথা বলা হলেও এর নির্দেশনাটি ব্যাপক। সাহাবীগণ গরীব-দুঃখীকে কেবল আহার্যই দান করতেন না, তাদের অন্য প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ রাখতেন। যার কাপড় নেই তাকে কাপড় দিতেন। যার মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকত না, তার বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিতেন। রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। এমনিভাবে যার যা প্রয়োজন হতো, তারা তা মেটানোর চেষ্টা করতেন। সুতরাং আমাদের কাছে আয়াতটির বার্তা হল, আমরা যেন গরীব-দুঃখী ও আর্তমানবতার প্রতি সহমর্মী হয়ে তাদের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট মোচনে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী ভূমিকা রাখি।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. এতিম, মিসকীন ও অসহায়ের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন ঈমানের দাবি।
খ. বন্দীর প্রতি সদয় আচরণ করা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ।
গ. বিপন্ন-অসহায় ব্যক্তি অমুসলিম হলেও তার প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা চাই।
ঘ. অভুক্তকে খাবার খাওয়ানো অনেক বড় নেকীর কাজ।
ঙ. অন্যকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্য হতে হবে কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন, পার্থিব কোনও স্বার্থ হাসিল করা নয়।
الايثار এর অর্থ নিজ স্বার্থের উপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। الْمُؤَاسَاةُ এর অর্থ অন্যের দুঃখ-কষ্টে সহমর্মিতা প্রকাশ করা। নিজ উদ্বৃত্ত অর্থ দ্বারা যা করা হয় তা দান-খয়রাত বটে, কিন্তু اَلْمُؤَاسَاةُ বা সহমর্মিতা আরও বেশি কিছু। অন্যের কষ্টকে যদি নিজ কষ্টের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়, তথা নিজ প্রয়োজন দমিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থের একটা অংশ বা পুরোটাই অন্য অভাবগ্রস্তকে দিয়ে দেওয়ার নাম الْمُؤَاسَاةُ বা সহমর্মিতা। সে হিসেবে এটাও الايثار বা স্বার্থত্যাগই বটে। এ স্বার্থত্যাগ হতে পারে একান্তভাবে নিজের ক্ষেত্রেও এবং নিজ পরিবার-পরিজনের ক্ষেত্রেও। তবে বিষয়টি কিছুটা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ।
অর্থ-সম্পদ ব্যয়ের মূলনীতি হল তা দ্বারা সর্বপ্রথম নিজ জরুরি প্রয়োজন মেটানো। তারপর কিছু উদ্বৃত্ত থাকলে তা দ্বারা নিজ পোষ্যবর্গের প্রয়োজন মেটানো। নিজ জরুরত বলতে এমন প্রচণ্ড ক্ষুধা, যা সহ্য করা সম্ভব হয় না, নিজ সতর ঢাকা কিংবা নিজের অন্য কোনও দুর্বিষহ কষ্ট দূর করা। যে টাকা-পয়সা দ্বারা কেবল এ পরিমাণ প্রয়োজন মেটানো যায়, তা দ্বারা প্রথম কাজ হল নিজের এসব প্রয়োজন মেটানো। এ ক্ষেত্রে নিজ প্রয়োজন উপেক্ষা করে অন্যের প্রয়োজন মেটানো জায়েয নয়। কেননা এটা আত্মহত্যা করা বা নিজ ইজ্জত-সম্মান ধ্বংস করার নামান্তর, যা শরী'আত অনুমোদন করে না। সুতরাং এরূপ ক্ষেত্রে নিজের হক আদায় করাই অগ্রগণ্য।
টাকা-পয়সা যদি এরচে' কিছু বেশি থাকে, তবে তা দ্বারা কর্তব্য প্রথমে নিজ পরিবার-পরিজনের এ জাতীয় জরুরি প্রয়োজন মেটানো। তাদের এরূপ জরুরি প্রয়োজন পাশ কাটিয়ে সে অর্থ দ্বারা অন্যের প্রয়োজন পূরণ করা জায়েয নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
كَفَى بِالْمَرْءِ إِثْمًا أَنْ يُضَيِّعَ مَنْ يَقُوْتُ
কোনও ব্যক্তির গুনাহগার হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, যার খাবার তার দায়িত্বে, সে তাকে (বঞ্চিত করে) ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে।(সুনানে আবু দাউদ: ৯১৩২; মুসনাদে আহমাদ: ৬৪৯৫; সহীহ ইবনে হিব্বান : ২৪৩৫৪; তাবারানী, আল্-মুজামুল কাবীর: ১৩৪১৪; শুআবুল ঈমান: ৮৩৩৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ; ২৪০৪)
এ জাতীয় প্রয়োজন মেটানোর পরও যদি কিছু সম্পদ উদ্বৃত্ত থাকে, সে ক্ষেত্রে নিজের উপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া উত্তম; বরং অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। পরিবার-পরিজন যদি কষ্ট-ক্লেশে ধৈর্যধারণ করতে প্রস্তুত থাকে, তবে তাদের উপরও অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে, অন্যথায় নয়।
কখনও কখনও অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া অবশ্যকর্তব্যও হয়ে যায়। যেমন অতিথি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত হলে নিজে না খেয়ে তাকে খাওয়ানো, ক্ষুধায় মরণাপন্ন কোনও ব্যক্তি নজরে আসলে নিজের খাবার তাকে দিয়ে দেওয়া, যে মায়্যিতের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করার মতো কেউ নেই, নিজ জরুরি প্রয়োজন মেটানোর পর কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকলে তা তার দাফন-কাফনে খরচ করা চাই। এ জাতীয় সহমর্মিতা প্রদর্শন ফরয ও অবশ্যকর্তব্য।
সহমর্মিতা ও স্বার্থত্যাগ ইসলামের সুমহান চারিত্রিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। ইসলামের শিক্ষা হল তুমি নিজের জন্য যা ভালোবাস, অন্যের জন্যও তা ভালোবাসবে। নিজে ক্ষুধার্ত থেকে অন্যকে খাওয়াবে। নিজ সতর ঢাকার পর উদ্বৃত্ত পোশাক দ্বারা অন্যের সতর ঢাকার ব্যবস্থা করবে। প্রথমদিকের মুসলিমগণ এ শিক্ষা নিজেদের জীবনে রূপায়িত করেছিল। মহান সাহাবীগণ তো ছিলেন এর সর্বোচ্চ ধাপে। ইয়ারমুকের যুদ্ধের সে ঘটনা কে না জানে যে, হযরত হুযায়ফা আল-আদাবী রাযি. তাঁর মুমূর্ষু ও ক্ষতবিক্ষত চাচাতো ভাইয়ের কাছে পানি নিয়ে গেলেন। তিনি যেই না পানি পান করতে যাবেন, অমনি খানিকটা দূর থেকে এক ব্যক্তি ‘আহ্’ বলে আর্তনাদ করল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, তুমি ওর কাছে পানি নিয়ে যাও। তিনি তার কাছে পানি নিয়ে গেলেন। দেখা গেল তিনি বিখ্যাত সাহাবী হিশাম ইবনুল আস রাযি.। তাঁর সামনে পানি তুলে ধরতেই খানিকটা দূরে আরেক ব্যক্তি আর্তনাদ করে উঠল। হিশাম রাযি. সে পানি তার কাছে নিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু নিয়ে যেতে যেতেই তার প্রাণবায়ু উড়ে গেল। হযরত হুযায়ফা রাযি. ফিরে আসলেন হিশাম রাযি.-এর কাছে। ততক্ষণে তারও প্রাণবায়ু উড়ে গেছে। শেষে ফিরে আসলেন চাচাতো ভাইয়ের কাছে। এসে দেখেন তিনিও চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন। এভাবে সেই তিন মহান সাহাবী রণক্ষেত্রে শাহাদাত বরণ করেন আর সেই সন্ধিক্ষণেও রেখে যান স্বার্থত্যাগ ও সহমর্মিতার অভাবনীয় দৃষ্টান্ত।
কেবল কি সাহাবায়ে কেরাম? তাদের পরবর্তীদের মধ্যেও এরূপ হাজারও দৃষ্টান্ত আছে। আবুল হাসান আনতাকী রহ. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, একদা ৩০ জনেরও বেশি মেহমান তার কাছে উপস্থিত। খাবার জন্য ছিল মাত্র কয়েকটি রুটি। তা তাদের ক্ষুধা মেটানোর জন্য মোটেই যথেষ্ট ছিল না। এ অবস্থায় রুটিগুলো ছিড়ে টুকরো টুকরো করা হল। বাতি নিভিয়ে দেওয়া হল। সবাই খেতে বসলেন। কিছুক্ষণ পর যখন দস্তরখান তোলা হবে, দেখা গেল সবগুলো রুটি যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। এক টুকরোও কমেনি। প্রত্যেকেই মনে করেছিলেন আমি এতে ভাগ না বসিয়ে অন্যদের খেতে দিই। সকলেরই স্বার্থত্যাগের মনোভাব। ফলে কারওই খাওয়া হয়নি। রুটিগুলো যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে।
বিখ্যাত বুযুর্গ বিশর ইবনুল হারিছ রহ.-এর কথা। তিনি তখন মুমূর্ষু রোগী। এ অবস্থায় এক অভাবগ্রস্ত হাজির। তিনি নিজ গায়ের জামাটি খুলে তাকে দিয়ে দিলেন। পরার জন্য তার আর কোনও জামা ছিল না। আরেকজনের কাছ থেকে একটি জামা ধার নিয়ে শরীর ঢাকেন আর সে অবস্থায়ই তাঁর ইন্তিকাল হয়ে যায়।
বস্তুত আমাদের মহান পূর্বসুরীদের সামনে ছিল আখিরাতের মুক্তি ও নাজাতের ভাবনা। দুনিয়ার সর্বস্ব দিয়ে হলেও তারা সে লক্ষ্যই অর্জন করতে চাইতেন। তাই তারা কৃষ্ণতাকে বেছে নিয়েছেন। যা-কিছু অর্থ-সম্পদ অর্জিত হতো, তা অকাতরে আল্লাহ তা'আলার পথে খরচ করেছেন। সর্বদা নিজের স্বার্থ উপেক্ষা করে অন্যের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তারা জীবনভর সহমর্মিতার প্রতিযোগিতায় লেগে থেকেছেন। তারা এ মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন কুরআন-সুন্নাহের শিক্ষা দ্বারা। কুরআন-হাদীছ মানুষকে এ মহান নীতির উপর নানাভাবে উৎসাহদান করেছে। এ অধ্যায়ে ইমাম নাওয়াবী রহ. সেরকমই কিছু আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন।
‘অন্যের জন্য স্বার্থত্যাগ ও সহমর্মিতা’ সম্পর্কিত দু’টি আয়াত
এক নং আয়াত
وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ
অর্থ: এবং তাদেরকে তারা নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের অভাব- অনটন থাকে।(সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ৯)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা হাশরের ৯ নং আয়াতের অংশবিশেষ। এ আয়াতে মদীনার আনসারদের প্রশংসা করা হয়েছে। শুরুতে বলা হয়েছে- وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا ‘যারা পূর্ব থেকেই এ নগরে (অর্থাৎ মদীনায়) ঈমানের সাথে অবস্থানরত আছে, যে-কেউ হিজরত করে তাদের কাছে আসে, তাদেরকে তারা ভালোবাসে এবং যা-কিছু তাদেরকে (অর্থাৎ মুহাজিরদেরকে) দেওয়া হয়, তার জন্য নিজেদের অন্তরে কোনও চাহিদা বোধ করে না'। এতে আনসার সাহাবীদের দু'টি গুণ বলা হয়েছে। এক তো তারা ঈমানের উপর স্থিতিশীল। দ্বিতীয়ত তারা নিঃস্বার্থ। মুহাজিরদের বিশেষ মর্যাদার কারণে তাদের প্রতি তারা ঈর্ষাবোধও করে না এবং গনীমতের সম্পদ থেকে তাদেরকে যা দেওয়া হয় তার প্রতিও চাহিদা বোধ করে না। তারপর বলা হয়েছে-
وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ (এবং তাদেরকে তারা নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের অভাব-অনটন থাকে)। এটা আনসারদের তৃতীয় বিশেষত্ব। তারা কেবল নিঃস্বার্থই নয়; বরং নিজের উপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। এমনকি তারা নিজেদের অর্থ-সম্পদ ও ঘরবাড়িতেও মুহাজিরদের প্রাধান্য দেয়। তাছাড়া যুদ্ধে যে গনীমত অর্জিত হয় তাতেও নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে মুহাজিরদের অগ্রাধিকার দেয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা মুকাররামা ত্যাগ করে যখন মদীনা মুনাউওয়ারায় চলে আসেন, তখন মুহাজিরদেরকে গ্রহণ করার ব্যাপারে আনসারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে যায়। শেষপর্যন্ত লটারী ধরা হয়। তাতে যে মুহাজিরের নাম যে আনসারের ভাগে পড়ে, কেবল তিনিই তার অতিথি হন। এভাবে মুহাজিরগণ আনসারদের বাড়িতে বাড়িতে ভাগ হয়ে যান। আনসারগণ নিজেদের ধন-সম্পত্তিতে তাদেরকে শরীক করে নেন। পরে যখন ইহুদীগোত্র বনু নাযীরের রেখে যাওয়া সম্পদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হস্তগত হয়, তখন তিনি সমস্ত আনসার সাহাবীকে ডাকিয়ে আনেন। প্রথমে তিনি মুহাজিরদের প্রতি আনসারদের ভালোবাসা ও সহমর্মিতার প্রশংসা করেন। তারপর তাদের বলেন, হে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা যদি চাও তবে আমি বনু নাযীরের থেকে প্রাপ্ত সম্পদ তোমাদের ও মুহাজিরদের মধ্যে ভাগ করে দিই। সে ক্ষেত্রে তোমরা তাদেরকে তোমাদের ঘরবাড়ি ও অর্থ-সম্পদের যে অংশ দিয়েছিলে তা যথারীতি তাদের থাকবে। আর তোমরা চাইলে এ সম্পদ তাদের মধ্যেই বণ্টন করে দেব আর তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছিলে তা তারা তোমাদের ফিরিয়ে দেবে। এর উত্তরে আনসারগণ জানান যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ওই সম্পদ মুহাজিরদের মধ্যেই বণ্টন করে দিন। আর আমরা তাদের যা দিয়েছিলাম তাও তাদেরই থাকুক। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়। এতে বলা হয়েছে যে, আনসারগণ নিজেদের অর্থ-সম্পদ ও ঘরবাড়িতে মুহাজিরদের প্রাধান্য দেয়। এমনও বর্ণিত আছে যে, যে আনসারী সাহাবীর দু'জন স্ত্রী ছিল, তিনি তার এক স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে মুহাজির ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন।
বলা হয়েছে- وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ (যদিও তাদের অভাব-অনটন থাকে)। অর্থাৎ যে বিষয়ে আনসারগণ মুহাজিরদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেন, তার অভাব ও প্রয়োজন নিজেদের বেশি থাকলেও তা উপেক্ষা করে মুহাজিরদেরকেই অগ্রাধিকার দেন। হাদীছ ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে এ জাতীয় বহু ঘটনা বর্ণিত আছে। এক বর্ণনায় আছে, একবার এক সাহাবীকে একটি ছাগলের মাথা হাদিয়া দেওয়া হল। সে সাহাবী বললেন, আমার চেয়ে আমার অমুক ভাই ও তার পরিবারেরই প্রয়োজন বেশি। এ বলে তিনি সে মাথাটি তাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেই সাহাবীও একই কথা বলে তৃতীয় এক সাহাবীর বাড়িতে সেটি পাঠিয়ে দেন। এভাবে ছাগলের মাথাটি একের পর এক বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হতে থাকে। সর্বমোট সাতটি বাড়িতে সেটি ঘুরতে থাকে। সবশেষে প্রথম যে সাহাবীকে দেওয়া হয়েছিল তার কাছেই সেটি ফিরে আসে।
অপর এক বর্ণনায় আছে, বাহরায়ন জয় হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানকার ভূ-সম্পত্তি আনসারদের লিখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাতে রাজি হননি। তারা বলেছিলেন, যাবৎ না আমাদের মুহাজির ভাইদেরকেও আমাদের মতো দেবেন, আমরা এতে রাজি হব না।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ঈমান কেবল আনাই যথেষ্ট নয়, তাকে স্থিতিশীল করাও জরুরি। নিজ ঘরবাড়ির মতো ঈমান হতে হবে মুমিনের স্থায়ী ঠিকানা।
খ. অন্যের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব দেখে ঈর্ষান্বিত হতে নেই।
গ. প্রকৃত মুমিন নিজ স্বার্থের উপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
ঘ. এক মুমিনের কর্তব্য অপর মুমিনের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা এবং তার প্রতি ভ্রাতৃসুলভ আচরণ করা।
ঙ. মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের প্রতি ভালোবাসা রাখা ঈমানের দাবি।
দুই নং আয়াত
وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا (8)
অর্থ : তারা তাঁর (আল্লাহর) ভালোবাসায় মিসকীন, এতিম ও বন্দীদেরকে খাবার দান করে।(সূরা দাহর (৭৬), আয়াত ৮)
ব্যাখ্যা
এর আরেক অর্থ হতে পারে- তারা তার (অর্থাৎ খাদ্যের) প্রতি নিজেদের আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকীন, এতিম ও বন্দীদেরকে তা খাওয়ায়। উভয় অর্থ হিসেবেই আয়াতের সারকথা হল, সাহাবীগণ গরীব-দুঃখী ও আর্তমানবতার প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করতেন।
এখানে যে أَسِير (বন্দী)-এর কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা অমুসলিম বন্দী বোঝানো হয়েছে। ইবন জুরায়জ রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও কোনও মুসলিমকে বন্দী করতেন না। এ আয়াত নাযিল হয়েছে মুশরিকদের সম্পর্কে। তারা যুদ্ধে মুমিনদের হাতে বন্দী হতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিনদের আদেশ করতেন তারা যেন সেই অমুসলিম বন্দীদের প্রতি সদয় আচরণ করেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, এ আয়াত নাযিল হয়েছে হযরত আলী রাযি. সম্পর্কে। তিনি একদিন এক ইহুদীর কাজ করে দিয়ে বিনিময়ে কিছু যব পেয়েছিলেন। সেই যবের এক-তৃতীয়াংশ পিষে পরিবারের সদস্যদের জন্য রুটি তৈরি করেন। রুটি তৈরি হতেই এক মিসকীন উপস্থিত। রুটিগুলো তাকে দিয়ে দিলেন। তারপর যবের দ্বিতীয় অংশ দিয়ে আবার রুটি বানানো হল। অমনি এক এতিম এসে হাজির। এবার সে রুটিগুলো সেই এতিমকে দিয়ে দেওয়া হল। তারপর যবের বাকি অংশ দিয়ে আবার রুটি বানানো হল। এবার এক মুশরিক বন্দী খাবার চাইল। রুটিগুলো তাকে দিয়ে দেওয়া হল। সেদিন এ পরিবারের সকলের উপোস দিন কাটল। হযরত আলী রাযি, সম্পর্কে এরকম আরও ঘটনা বর্ণিত আছে।
যাহোক অন্যের প্রতি সহমর্মিতার এ গুণ কেবল হযরত আলী রাযি.-এরই বৈশিষ্ট্য নয়: সব সাহাবীই এরকম ছিলেন। আয়াতে বহুবচনের সঙ্গে বলা হয়েছে যে, তারা অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দীকে আহার্য দান করে।
তাদের এ সহমর্মিতা ছিল কেবলই আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসায়, অন্য কোনও উদ্দেশ্যে নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টিই ছিল তাদের একমাত্র কাম্যবস্তু। এর পরের আয়াতে সে কথা আরও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে- إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا (9) (আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। আমরা তোমাদের কাছে কোনও প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও না)।
প্রকাশ থাকে যে, আয়াতে কেবল খাবার খাওয়ানোর কথা বলা হলেও এর নির্দেশনাটি ব্যাপক। সাহাবীগণ গরীব-দুঃখীকে কেবল আহার্যই দান করতেন না, তাদের অন্য প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ রাখতেন। যার কাপড় নেই তাকে কাপড় দিতেন। যার মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকত না, তার বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিতেন। রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। এমনিভাবে যার যা প্রয়োজন হতো, তারা তা মেটানোর চেষ্টা করতেন। সুতরাং আমাদের কাছে আয়াতটির বার্তা হল, আমরা যেন গরীব-দুঃখী ও আর্তমানবতার প্রতি সহমর্মী হয়ে তাদের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট মোচনে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী ভূমিকা রাখি।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. এতিম, মিসকীন ও অসহায়ের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন ঈমানের দাবি।
খ. বন্দীর প্রতি সদয় আচরণ করা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ।
গ. বিপন্ন-অসহায় ব্যক্তি অমুসলিম হলেও তার প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা চাই।
ঘ. অভুক্তকে খাবার খাওয়ানো অনেক বড় নেকীর কাজ।
ঙ. অন্যকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্য হতে হবে কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন, পার্থিব কোনও স্বার্থ হাসিল করা নয়।
এক আনসারী দম্পতির অপূর্ব আতিথেয়তা
হাদীছ নং: ৫৬৩
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, আমি খুব ক্ষুধার্ত। এ কথা শুনে তিনি তাঁর এক স্ত্রীর কাছে কাউকে পাঠালেন। স্ত্রী বললেন, যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম! আমার কাছে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। তারপর তিনি অপর এক স্ত্রীর কাছে পাঠালেন। তিনিও অনুরূপ বললেন। এভাবে তাঁদের সকলেই একই রকম বললেন যে, যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম! আমার কাছে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ রাতে কে এই ব্যক্তির মেহমানদারি করবে? এক আনসারী ব্যক্তি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি। তারপর তিনি তাকে সঙ্গে নিয়ে নিজ বাড়িতে গেলেন। গিয়ে স্ত্রীকে বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অতিথির সম্মান করো।
অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, তোমার কাছে কিছু আছে কি? স্ত্রী বললেন, না, কেবল আমার বাচ্চাদের খাবারই আছে। আনসারী সাহাবী বললেন, কাদেরকে কোনওকিছু দিয়ে ভুলিয়ে রেখো। আর যখন রাতের খাবার চাবে, তখন ঘুম পাড়িয়ে দিয়ো। যখন আমাদের অতিথি প্রবেশ করবে, বাতি নিভিয়ে দিয়ো আর তাকে দেখিয়ো যেন আমরা খানা খাচ্ছি। তারপর সকলে বসে গেলেন। অতিথি খেলেন আর তারা দু'জন ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত কাটালেন। ভোরবেলা সেই আনসারী সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলে তিনি বললেন, আজ রাতে অতিথির প্রতি তোমাদের আচরণে আল্লাহ খুব খুশি হয়েছেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী : ৩৭৯৮; সহীহ মুসলিম: ২০৫৪; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৬১৬৮; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫২৮৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৭৮০২)
হাদীছ নং: ৫৬৩
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, আমি খুব ক্ষুধার্ত। এ কথা শুনে তিনি তাঁর এক স্ত্রীর কাছে কাউকে পাঠালেন। স্ত্রী বললেন, যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম! আমার কাছে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। তারপর তিনি অপর এক স্ত্রীর কাছে পাঠালেন। তিনিও অনুরূপ বললেন। এভাবে তাঁদের সকলেই একই রকম বললেন যে, যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম! আমার কাছে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ রাতে কে এই ব্যক্তির মেহমানদারি করবে? এক আনসারী ব্যক্তি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি। তারপর তিনি তাকে সঙ্গে নিয়ে নিজ বাড়িতে গেলেন। গিয়ে স্ত্রীকে বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অতিথির সম্মান করো।
অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, তোমার কাছে কিছু আছে কি? স্ত্রী বললেন, না, কেবল আমার বাচ্চাদের খাবারই আছে। আনসারী সাহাবী বললেন, কাদেরকে কোনওকিছু দিয়ে ভুলিয়ে রেখো। আর যখন রাতের খাবার চাবে, তখন ঘুম পাড়িয়ে দিয়ো। যখন আমাদের অতিথি প্রবেশ করবে, বাতি নিভিয়ে দিয়ো আর তাকে দেখিয়ো যেন আমরা খানা খাচ্ছি। তারপর সকলে বসে গেলেন। অতিথি খেলেন আর তারা দু'জন ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত কাটালেন। ভোরবেলা সেই আনসারী সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলে তিনি বললেন, আজ রাতে অতিথির প্রতি তোমাদের আচরণে আল্লাহ খুব খুশি হয়েছেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী : ৩৭৯৮; সহীহ মুসলিম: ২০৫৪; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৬১৬৮; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫২৮৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৭৮০২)
مقدمة الامام النووي
62 - باب الإيثار والمواساة
قَالَ الله تَعَالَى: {وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ} [الحشر: 9]، وقال تَعَالَى: {وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا} [الدهر: 8].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ} [الحشر: 9]، وقال تَعَالَى: {وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا} [الدهر: 8].
563 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النبيِّ - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: إنِّي مَجْهُودٌ (1)، فَأرسَلَ إِلَى بَعْضِ نِسَائِهِ، فَقالت: وَالَّذي بَعَثَكَ بِالحَقِّ مَا عِنْدِي إِلاَّ مَاءٌ، ثُمَّ أرْسَلَ إِلَى أُخْرَى، فَقَالَتْ مِثلَ ذَلِكَ، حَتَّى قُلْنَ كُلُّهُنَّ مِثلَ ذَلِكَ: لا وَالَّذِي بَعَثَكَ بالحَقِّ مَا عِنْدِي إِلاَّ مَاءٌ. فَقَالَ النبي - صلى الله عليه وسلم: «مَنْ يُضيفُ هَذَا اللَّيْلَةَ؟» فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الأنْصَارِ: أنَا يَا رسولَ الله، فَانْطَلَقَ بِهِ إِلَى رَحْلِهِ، فَقَالَ لامْرَأَتِهِ: أكرِمِي ضَيْفَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم.
وفي روايةٍ قَالَ لامْرَأَتِهِ: هَلْ عِنْدَكِ شَيْءٌ؟ فقَالَتْ: لاَ، إِلاَّ قُوتَ صِبيَانِي. قَالَ: فَعَلِّليهم بِشَيْءٍ وَإذَا أرَادُوا العَشَاءَ فَنَوِّمِيهمْ، وَإِذَا دَخَلَ ضَيْفُنَا فَأطْفِئي السِّرَاجَ، وَأريهِ أنَّا نَأكُلُ. فَقَعَدُوا وَأكَلَ الضَّيْفُ وَبَاتَا طَاوِيَيْنِ، فَلَمَّا أصْبَحَ غَدَا عَلَى النَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: «لَقَدْ عَجبَ الله مِنْ صَنِيعِكُمَا بِضَيْفِكُمَا اللَّيْلَةَ». متفقٌ عَلَيْهِ. (2)
وفي روايةٍ قَالَ لامْرَأَتِهِ: هَلْ عِنْدَكِ شَيْءٌ؟ فقَالَتْ: لاَ، إِلاَّ قُوتَ صِبيَانِي. قَالَ: فَعَلِّليهم بِشَيْءٍ وَإذَا أرَادُوا العَشَاءَ فَنَوِّمِيهمْ، وَإِذَا دَخَلَ ضَيْفُنَا فَأطْفِئي السِّرَاجَ، وَأريهِ أنَّا نَأكُلُ. فَقَعَدُوا وَأكَلَ الضَّيْفُ وَبَاتَا طَاوِيَيْنِ، فَلَمَّا أصْبَحَ غَدَا عَلَى النَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: «لَقَدْ عَجبَ الله مِنْ صَنِيعِكُمَا بِضَيْفِكُمَا اللَّيْلَةَ». متفقٌ عَلَيْهِ. (2)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলেছিল- إِنِّي مَجْهُودٌ (আমি খুব ক্ষুধার্ত)। কে সেই ব্যক্তি, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কেউ কেউ বলেন, তিনি হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. নিজেই। কারও মতে তিনি ছিলেন একজন মুহাজির সাহাবী।
مجهود শব্দটির উৎপত্তি جُهْدٌ থেকে। এর অর্থ কষ্ট, অভাব, ক্ষুধা, কষ্টকর জীবন। এখানে ক্ষুধার কষ্ট বোঝানো উদ্দেশ্য। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভ্যাস ছিল, যার যা প্রয়োজন তা প্রথমে নিজের পক্ষ থেকেই পূরণের চেষ্টা করা। কাজেই আগুন্তুক ব্যক্তি নিজ ক্ষুধার কষ্টের কথা জানালে তিনি প্রথমে নিজ ঘরে খোঁজ নিয়ে দেখলেন তাকে খাওয়ানোর মতো কিছু আছে কি না। এক এক করে প্রত্যেক স্ত্রীর ঘরে খোঁজ নেওয়া হল। কিন্তু সেদিন কারও ঘরেই কোনও খাবার ছিল না। এর দ্বারা অনুমান করা যায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গ কেমন অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটাতেন!
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরও অভ্যাস ছিল, অভাবগ্রস্তের অভাব নিজে মেটাতে না পারলে যাদের পক্ষে মেটানো সম্ভব তাদের কাছে সুপারিশ করতেন। অভাবগ্রস্তকে তাদের সামনে তুলে ধরতেন, যাতে তারা তার অভাব পূরণে সহযোগিতা করে। নিজে না পারলে যে খালিহাতে ফিরিয়ে দিতেন এমন নয়। যেভাবেই হোক তার প্রয়োজন যাতে মিটিয়ে দেওয়া যায়, সে চেষ্টাই তিনি সর্বদা করতেন। এ ক্ষেত্রেও তাই করলেন। তিনি উপস্থিত সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন-
مَنْ يُضِيْفُ هَذَا اللَّيْلَةَ؟ (এ রাতে কে এই ব্যক্তির মেহমানদারি করবে)? অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছিলেন- أَلَا رَجُلٌ يُضَيفُهُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ، يَرْحَمُهُ اللهُ؟ (এমন কোনও ব্যক্তি নেই, যে আজ রাতে এর মেহমানদারি করবে, বিনিময়ে আল্লাহ তার প্রতি রহম করবেন?)।(সহীহ বুখারী: ৪৮৮৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৩৩০৩)
فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ: أَنَا يَا رَسُوْلَ اللَّهِ (এক আনসারী ব্যক্তি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি)। এই সাহাবী কে ছিলেন? বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। যেমন হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি., হযরত ছাবিত ইবনে কায়স ইবনে শাম্মাস ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা। আসলে এরূপ ঘটনা বহুবারই ঘটেছিল। মাঝেমধ্যেই ক্ষুধার্ত, অভুক্ত অতিথি এসে হাজির হতো এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার মেহমানদারির ব্যবস্থা করতে হতো। তাই ধারণা করা যায়, এসকল সাহাবীর প্রত্যেকেই কোনও না কোনওবার অভুক্ত অতিথিকে সঙ্গে করে নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
যাহোক সেই সাহাবী অতিথিকে নিয়ে নিজ বাড়ি গেলেন। তারপর স্ত্রীকে বললেন- أَكْرِمِي ضَيْفَ رَسُوْلِ اللَّهِ ﷺ (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অতিথির সম্মান করো)। মূলত সেই ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই অতিথি ছিল। কারণ সে এসেছিল তাঁর কাছেই। এ মেজবান সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেই তার আতিথেয়তা করছিলেন। সে কারণেই স্ত্রীকে এরূপ বলেছেন। এমনিতেই অতিথিকে সম্মান করা জরুরি। অতিথি যেই হোক, ইসলাম তাকে সম্মান করতে বলেছে। আবার এ অতিথি তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের! তাই বাড়তি তার প্রাপ্য। তাকে সম্মান করা হলে প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই সম্মান করা হবে। তাই স্ত্রীকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অতিথির সম্মান করো।
কিন্তু কী দিয়ে অতিথির সেবা করা হবে? ঘরে তো কোনও খাবার নেই? স্বামী-স্ত্রী খাবেন, সেরকম কিছুও নেই। কেবল বাচ্চাদের খাওয়ানোর মতো সামান্য যা আছে। কিন্তু অতিথিকে তো খাওয়াতে হবে! তাই স্ত্রীকে বললেন-
فعَلِّليهم بشيءٍ (তাদেরকে কোনওকিছু দিয়ে ভুলিয়ে রেখো)। এ কথাটি সেই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যখন বাচ্চারা ক্ষুধার্ত না থাকে। অনেক সময় বাচ্চারা ক্ষুধা না থাকলেও খাবার চায়। এরূপ ক্ষেত্রে তাদের খাবার না দিয়ে অন্য কোনও অভুক্ত বা মেহমানকে খাওয়ানো উত্তম। পক্ষান্তরে তারা ক্ষুধার্ত থাকলে তখন তাদেরই অগ্রাধিকার। সে ক্ষেত্রে তাদের ক্ষুধা মেটানো অবশ্যকর্তব্য। তাদেরকে অভুক্ত রেখে অন্যদের খাওয়ানো জায়েয নয়। সুতরাং সাহাবী যে বলছেন তাদেরকে কোনওকিছু দিয়ে ভুলিয়ে রাখো, অর্থাৎ তাদের খাবার আমরা মেহমানকে খাওয়াব, এর দ্বারা তিনি শিশুকে উপোস রেখে মেহমানকে খাওয়ানোর কথা বলেছেন এরূপ ধারণা করা ঠিক হবে না। কারণ তাতে ছাওয়াব নয়; বরং গুনাহই হতো।
وَإِذَا أَرَادُوا الْعَشَاءَ فَنومِيهِمْ (আর যখন রাতের খাবার চাবে, তখন ঘুম পাড়িয়ে দিয়ো)। কারণ তারা সজাগ থাকলে তাদের বাদ দিয়ে মেহমান খেতে চাবে না। আবার তারা সঙ্গে খেলে মেহমানের ক্ষুধা মিটবে না। বাচ্চাদের জন্য রাখা খাবার কতটুকুই বা ছিল!
وَإِذَا دَخَلَ ضَيْفُنَا فَأَطْفِي السّرَاجَ، وَأَرِيْهِ أَنَّا نَأْكُلُ (যখন আমাদের অথিতি প্রবেশ করবে, বাতি নিভিয়ে দিয়ো আর তাকে দেখিয়ো যেন আমরা খানা খাচ্ছি)। অর্থাৎ আমরাও মেহমানের সঙ্গে বসব, হাত নাড়ব, মুখে খাওয়ার আওয়াজ করব, যাতে মেহমান বুঝে আমরাও খাচ্ছি। অন্যথায় সে একা খেতে চাবে না। আবার আমরা খেলে অল্প খাবারে তার ক্ষুধাও মিটবে না। ফলে মেহমানের যথাযথ সেবা করা হবে না। এটা ছিল সে আনসারী দম্পতির চমৎকার ভদ্রতার পরিচায়ক। অতিথিকে একা খেতে বসার সংকোচে ফেললেন না, অধিকন্তু নিজেরা খাওয়ার ভান করে তাকে স্বস্তির সঙ্গে খাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। এভাবে তারা মেহমানকে খাওয়ালেন এবং নিজেরা সে রাত না খেয়ে কাটালেন। ভোরবেলা সে সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে দেখা করলে তিনি বললেন-
لَقَدْ عَجِبَ اللهُ مِنْ صَنِيْعِكُمَا بِضَيْفِكُمَا اللَّيْلَةَ (আজ রাতে অথিতির প্রতি তোমাদের আচরণে আল্লাহ খুব খুশি হয়েছেন)। বোঝাই যাচ্ছে অতিথির প্রতি আনসারী দম্পতি যে মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন। তাই সাহাবী নিজের থেকে কিছু বলার আগেই তিনি তাকে সুসংবাদ শুনিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা'আলা তাদের আচরণে তাদের প্রতি খুশি হয়েছেন। عجب শব্দটির প্রকৃত অর্থ মুগ্ধ হওয়া, বিস্মিত হওয়া। আল্লাহ তা'আলার জন্য এ অর্থ খাটে না। এখানে বোঝানো উদ্দেশ্য তিনি খুশি হয়েছেন বা তিনি তোমাদের কাজের বিনিময়ে ছাওয়াব দান করেছেন কিংবা তিনি তোমাদের এ কাজটিকে মূল্যায়ন করেছেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত কৃচ্ছ্রতাপূর্ণ।
খ. কোনও অতিথি বা অভাবগ্রস্ত লোক আসলে সর্বপ্রথম নিজ গৃহেই তার আতিথেয়তা বা তার প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করা উচিত, যেমনটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন।
গ. কোনও অভাবগ্রস্তের অভাব নিজে পূরণ করতে না পারলে যাদের পক্ষে তা পূরণ করা সম্ভব তাদের কাছে সুপারিশ করা উচিত।
ঘ. অতিথিকে নিজ ঘরে সাদরে গ্রহণ করা চাই।
ঙ. অতিথিসেবায় স্ত্রীর উচিত স্বামীকে সহযোগিতা করা।
চ. নিজেরা অভুক্ত থেকে অতিথির ক্ষুধা নিবারণ করা সাহাবীদের আদর্শ।
ছ. শিশুরা খুব ক্ষুধার্ত না হলে তাদের উপর অতিথি বা অভাবগ্রস্তকে প্রাধান্য দেওয়া মহত্ত্বতার পরিচায়ক।
জ. অতিথির সেবা করলে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন।
ঝ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে অনেক বিষয় আগাম জানতে পারতেন। এটা তাঁর এক মু'জিযা।
مجهود শব্দটির উৎপত্তি جُهْدٌ থেকে। এর অর্থ কষ্ট, অভাব, ক্ষুধা, কষ্টকর জীবন। এখানে ক্ষুধার কষ্ট বোঝানো উদ্দেশ্য। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভ্যাস ছিল, যার যা প্রয়োজন তা প্রথমে নিজের পক্ষ থেকেই পূরণের চেষ্টা করা। কাজেই আগুন্তুক ব্যক্তি নিজ ক্ষুধার কষ্টের কথা জানালে তিনি প্রথমে নিজ ঘরে খোঁজ নিয়ে দেখলেন তাকে খাওয়ানোর মতো কিছু আছে কি না। এক এক করে প্রত্যেক স্ত্রীর ঘরে খোঁজ নেওয়া হল। কিন্তু সেদিন কারও ঘরেই কোনও খাবার ছিল না। এর দ্বারা অনুমান করা যায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গ কেমন অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটাতেন!
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরও অভ্যাস ছিল, অভাবগ্রস্তের অভাব নিজে মেটাতে না পারলে যাদের পক্ষে মেটানো সম্ভব তাদের কাছে সুপারিশ করতেন। অভাবগ্রস্তকে তাদের সামনে তুলে ধরতেন, যাতে তারা তার অভাব পূরণে সহযোগিতা করে। নিজে না পারলে যে খালিহাতে ফিরিয়ে দিতেন এমন নয়। যেভাবেই হোক তার প্রয়োজন যাতে মিটিয়ে দেওয়া যায়, সে চেষ্টাই তিনি সর্বদা করতেন। এ ক্ষেত্রেও তাই করলেন। তিনি উপস্থিত সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন-
مَنْ يُضِيْفُ هَذَا اللَّيْلَةَ؟ (এ রাতে কে এই ব্যক্তির মেহমানদারি করবে)? অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছিলেন- أَلَا رَجُلٌ يُضَيفُهُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ، يَرْحَمُهُ اللهُ؟ (এমন কোনও ব্যক্তি নেই, যে আজ রাতে এর মেহমানদারি করবে, বিনিময়ে আল্লাহ তার প্রতি রহম করবেন?)।(সহীহ বুখারী: ৪৮৮৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৩৩০৩)
فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ: أَنَا يَا رَسُوْلَ اللَّهِ (এক আনসারী ব্যক্তি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি)। এই সাহাবী কে ছিলেন? বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। যেমন হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি., হযরত ছাবিত ইবনে কায়স ইবনে শাম্মাস ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা। আসলে এরূপ ঘটনা বহুবারই ঘটেছিল। মাঝেমধ্যেই ক্ষুধার্ত, অভুক্ত অতিথি এসে হাজির হতো এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার মেহমানদারির ব্যবস্থা করতে হতো। তাই ধারণা করা যায়, এসকল সাহাবীর প্রত্যেকেই কোনও না কোনওবার অভুক্ত অতিথিকে সঙ্গে করে নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
যাহোক সেই সাহাবী অতিথিকে নিয়ে নিজ বাড়ি গেলেন। তারপর স্ত্রীকে বললেন- أَكْرِمِي ضَيْفَ رَسُوْلِ اللَّهِ ﷺ (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অতিথির সম্মান করো)। মূলত সেই ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই অতিথি ছিল। কারণ সে এসেছিল তাঁর কাছেই। এ মেজবান সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেই তার আতিথেয়তা করছিলেন। সে কারণেই স্ত্রীকে এরূপ বলেছেন। এমনিতেই অতিথিকে সম্মান করা জরুরি। অতিথি যেই হোক, ইসলাম তাকে সম্মান করতে বলেছে। আবার এ অতিথি তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের! তাই বাড়তি তার প্রাপ্য। তাকে সম্মান করা হলে প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই সম্মান করা হবে। তাই স্ত্রীকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অতিথির সম্মান করো।
কিন্তু কী দিয়ে অতিথির সেবা করা হবে? ঘরে তো কোনও খাবার নেই? স্বামী-স্ত্রী খাবেন, সেরকম কিছুও নেই। কেবল বাচ্চাদের খাওয়ানোর মতো সামান্য যা আছে। কিন্তু অতিথিকে তো খাওয়াতে হবে! তাই স্ত্রীকে বললেন-
فعَلِّليهم بشيءٍ (তাদেরকে কোনওকিছু দিয়ে ভুলিয়ে রেখো)। এ কথাটি সেই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যখন বাচ্চারা ক্ষুধার্ত না থাকে। অনেক সময় বাচ্চারা ক্ষুধা না থাকলেও খাবার চায়। এরূপ ক্ষেত্রে তাদের খাবার না দিয়ে অন্য কোনও অভুক্ত বা মেহমানকে খাওয়ানো উত্তম। পক্ষান্তরে তারা ক্ষুধার্ত থাকলে তখন তাদেরই অগ্রাধিকার। সে ক্ষেত্রে তাদের ক্ষুধা মেটানো অবশ্যকর্তব্য। তাদেরকে অভুক্ত রেখে অন্যদের খাওয়ানো জায়েয নয়। সুতরাং সাহাবী যে বলছেন তাদেরকে কোনওকিছু দিয়ে ভুলিয়ে রাখো, অর্থাৎ তাদের খাবার আমরা মেহমানকে খাওয়াব, এর দ্বারা তিনি শিশুকে উপোস রেখে মেহমানকে খাওয়ানোর কথা বলেছেন এরূপ ধারণা করা ঠিক হবে না। কারণ তাতে ছাওয়াব নয়; বরং গুনাহই হতো।
وَإِذَا أَرَادُوا الْعَشَاءَ فَنومِيهِمْ (আর যখন রাতের খাবার চাবে, তখন ঘুম পাড়িয়ে দিয়ো)। কারণ তারা সজাগ থাকলে তাদের বাদ দিয়ে মেহমান খেতে চাবে না। আবার তারা সঙ্গে খেলে মেহমানের ক্ষুধা মিটবে না। বাচ্চাদের জন্য রাখা খাবার কতটুকুই বা ছিল!
وَإِذَا دَخَلَ ضَيْفُنَا فَأَطْفِي السّرَاجَ، وَأَرِيْهِ أَنَّا نَأْكُلُ (যখন আমাদের অথিতি প্রবেশ করবে, বাতি নিভিয়ে দিয়ো আর তাকে দেখিয়ো যেন আমরা খানা খাচ্ছি)। অর্থাৎ আমরাও মেহমানের সঙ্গে বসব, হাত নাড়ব, মুখে খাওয়ার আওয়াজ করব, যাতে মেহমান বুঝে আমরাও খাচ্ছি। অন্যথায় সে একা খেতে চাবে না। আবার আমরা খেলে অল্প খাবারে তার ক্ষুধাও মিটবে না। ফলে মেহমানের যথাযথ সেবা করা হবে না। এটা ছিল সে আনসারী দম্পতির চমৎকার ভদ্রতার পরিচায়ক। অতিথিকে একা খেতে বসার সংকোচে ফেললেন না, অধিকন্তু নিজেরা খাওয়ার ভান করে তাকে স্বস্তির সঙ্গে খাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। এভাবে তারা মেহমানকে খাওয়ালেন এবং নিজেরা সে রাত না খেয়ে কাটালেন। ভোরবেলা সে সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে দেখা করলে তিনি বললেন-
لَقَدْ عَجِبَ اللهُ مِنْ صَنِيْعِكُمَا بِضَيْفِكُمَا اللَّيْلَةَ (আজ রাতে অথিতির প্রতি তোমাদের আচরণে আল্লাহ খুব খুশি হয়েছেন)। বোঝাই যাচ্ছে অতিথির প্রতি আনসারী দম্পতি যে মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন। তাই সাহাবী নিজের থেকে কিছু বলার আগেই তিনি তাকে সুসংবাদ শুনিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা'আলা তাদের আচরণে তাদের প্রতি খুশি হয়েছেন। عجب শব্দটির প্রকৃত অর্থ মুগ্ধ হওয়া, বিস্মিত হওয়া। আল্লাহ তা'আলার জন্য এ অর্থ খাটে না। এখানে বোঝানো উদ্দেশ্য তিনি খুশি হয়েছেন বা তিনি তোমাদের কাজের বিনিময়ে ছাওয়াব দান করেছেন কিংবা তিনি তোমাদের এ কাজটিকে মূল্যায়ন করেছেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত কৃচ্ছ্রতাপূর্ণ।
খ. কোনও অতিথি বা অভাবগ্রস্ত লোক আসলে সর্বপ্রথম নিজ গৃহেই তার আতিথেয়তা বা তার প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করা উচিত, যেমনটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন।
গ. কোনও অভাবগ্রস্তের অভাব নিজে পূরণ করতে না পারলে যাদের পক্ষে তা পূরণ করা সম্ভব তাদের কাছে সুপারিশ করা উচিত।
ঘ. অতিথিকে নিজ ঘরে সাদরে গ্রহণ করা চাই।
ঙ. অতিথিসেবায় স্ত্রীর উচিত স্বামীকে সহযোগিতা করা।
চ. নিজেরা অভুক্ত থেকে অতিথির ক্ষুধা নিবারণ করা সাহাবীদের আদর্শ।
ছ. শিশুরা খুব ক্ষুধার্ত না হলে তাদের উপর অতিথি বা অভাবগ্রস্তকে প্রাধান্য দেওয়া মহত্ত্বতার পরিচায়ক।
জ. অতিথির সেবা করলে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন।
ঝ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে অনেক বিষয় আগাম জানতে পারতেন। এটা তাঁর এক মু'জিযা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)