রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৬৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরকালীন বিষয়ে প্রতিযোগিতা করা এবং বরকতপূর্ণ জিনিস যত বেশি পারা যায় অর্জনের চেষ্টা করা
اَلتّنافُسُ শব্দটির উৎপত্তি اَلْمُنافَسَةُ থেকে, যার অর্থ কোনও বস্তুর প্রতি আগ্রহ এবং একা তা অর্জন করতে চাওয়া। উৎকৃষ্ট ও দামি বস্তুর ক্ষেত্রেই এটা হয়ে থাকে। সত্যিকারের উৎকৃষ্ট ও দামি বস্তু হল আখিরাতের নি‘আমতসমূহ। সে তুলনায় দুনিয়ার বস্তুরাজি লোকে যতই দামি মনে করুক, প্রকৃতপক্ষে তা নিতান্তই তুচ্ছ। প্রকৃত দামি ও উৎকৃষ্ট যখন আখিরাতের নি'আমত, তখন সে নি'আমত অর্জনের জন্য যা-কিছু করা হয় তাও দামি হয়ে যায়। সুতরাং প্রতিটি সৎকর্মই অত্যন্ত দামি। তাহলে দামি বিষয় দাঁড়াল দু'টি- এক হচ্ছে আখিরাতের নি'আমত, আর দ্বিতীয় সে নি'আমত অর্জনের উপায়সমূহ। এ দু'টি বিষয়ই যখন উৎকৃষ্ট ও দামি, তখন মানুষের কর্তব্য কেবল এরই প্রতি আকৃষ্ট থাকা এবং যতবেশি সম্ভব এসব অর্জনের চেষ্টা করা।
এ অধ্যায়টির মূল উদ্দেশ্য আখিরাতের নি'আমত তথা জান্নাতলাভের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করা এবং যেসব উপায়ে তা অর্জন করা যায় তার প্রতি উৎসাহ যোগানো। অর্থাৎ মানুষের কর্তব্য আখিরাতের বিষয়াবলি অর্জনের জন্য লালায়িত হওয়া। তা যেহেতু লাভ করা যায় সৎকর্ম দ্বারা, তাই মানুষের আরও কর্তব্য কে কারচে' বেশি সৎকর্ম করতে পারে সে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া।
প্রকাশ থাকে যে, জান্নাতলাভ ও সৎকর্মের প্রতি উৎসাহ-উদ্দীপনার প্রাণবস্তু হল আল্লাহপ্রেম। আল্লাহ তা'আলার প্রকৃত বান্দাদের প্রাণের ভালোবাসা কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই নিবেদিত থাকে। আর তা থাকে বলে আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে যা-কিছুর সম্পর্ক আছে, সেগুলোকেও তারা ভালোবাসে। সে ভালোবাসা আল্লাহপ্রেমের কারণেই। সুতরাং তারা ভালোবাসে নবী-রাসূলগণকে। ভালোবাসে আল্লাহর ঘর কা'বা ও মসজিদসমূহকে। ভালোবাসে আল্লাহর ওলীদেরকে। তারা ভালোবাসে আল্লাহর কালাম। এমনকি তারা ভালোবাসে আল্লাহর কুলমাখলুককেও। তারা আল্লাহর মাখলুক বলেই সে ভালোবাসা। তারা আল্লাহকে ভালোবাসে বলে যা-কিছুর প্রতি আল্লাহ তা'আলার বিশেষ দৃষ্টি থাকে, যা-কিছুতে তাঁর রহমতের স্পর্শ থাকে, সেগুলোকেও তারা ভালোবাসে এবং সেগুলোকে আলাদা মর্যাদার চোখে দেখে। একে আমরা 'বরকত' শব্দেও ব্যক্ত করে থাকি। এ বরকত বলতে কল্যাণময়তা ও মর্যাদাসম্পন্নতা বোঝানো উদ্দেশ্য। যা-কিছুতে এ জাতীয় বরকত থাকে, তা যতবেশি সম্ভব অর্জন করে নেওয়া চাই। এতে দোষ তো নেই-ই; বরং ইসলামের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয় কাজ বলেই গণ্য। এ অধ্যায়ে বরকতপূর্ণ বিষয় বেশি বেশি অর্জনে উৎসাহ দেওয়াও উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে ইমাম নাওয়াবী রহ. একটি আয়াত ও দু'টি হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন, যদিও এ বিষয়ে বহু আয়াত ও হাদীছ আছে।
‘পরকালীন বিষয়ে প্রতিযোগিতা…’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ (26)
অর্থ: এটাই এমন জিনিস, লুব্ধজনদের উচিত এর প্রতি অগ্রগামী হয়ে লোভ প্রকাশ করা।(সূরা মুতাফফীফীন (৮৩), আয়াত ২৬)
ব্যাখ্যা
এর আগের আয়াতসমূহে পুণ্যবানদের স্থায়ী ঠিকানা জান্নাত ও জান্নাতের নি'আমতসমূহের খানিকটা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তারপর এ আয়াতে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, যারা কোনও লোভনীয় বিষয়ে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে চায়, তারা এ জান্নাত ও তার নি'আমতসমূহ লাভের লক্ষ্যে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হোক।
পার্থিব ভোগসামগ্রীতে প্রতিযোগিতা নিষেধ। তাতে প্রতিযোগিতা করার দ্বারা আমল-আখলাক নষ্ট হয়। মানুষের লোভ ও চাহিদা অনেক বড়। সে তুলনায় ভোগসামগ্রী নিতান্তই কম। সেই অল্প ভোগসামগ্রীতে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলে কাড়াকাড়ি-হানাহানি অনিবার্য। নিজের ভোগলালসা মেটানোর জন্য প্রত্যেকেই চাইবে সবটা সম্পদ একা হস্তগত করতে। আর তাতে যখন বাধা আসবে, তখন জোরজুলুমের আশ্রয় নেবে। বাস্তবে তাই হচ্ছে। দুনিয়ায় হাজারও পাপাচার এ প্রতিযোগিতার পথ ধরেই বিস্তার লাভ করছে। তাই এ প্রতিযোগিতা নিন্দনীয়। এটা আল্লাহ তা'আলা পসন্দ করেন না। কুরআন ও হাদীছ মানুষকে এর থেকে বিরত থাকতে আদেশ করেছে।
পক্ষান্তরে পরকালীন নাজাত ও মুক্তি এবং জান্নাতলাভের উদ্দেশ্যে যে প্রতিযোগিতার কথা বলা হয়েছে তা একটি প্রশংসনীয় কাজ। কেননা তা হানাহানি সৃষ্টি করে না। তা মানুষকে স্বার্থত্যাগে উৎসাহ যোগায়। সে প্রতিযোগিতা মানুষকে পরোপকারী করে তোলে। তা মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিকাশ ঘটায়। তাতে মানুষ সৎকর্মে অনুপ্রাণিত হয়। তাই আয়াত হুকুম করছে- তোমরা জান্নাতলাভের জন্য লালায়িত হও। সে লোভ পূরণে বেশি বেশি সৎকর্ম করো। কে কারচে' বেশি সৎকর্ম করতে পার, সে প্রতিযোগিতায় লেগে পড়ো। প্রতিযোগিতা যদি কোনওকিছু নিয়ে করতে চাও, তবে এ নিয়েই করো। এটাই সত্যিকারের প্রতিযোগিতার বিষয়।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. পার্থিব ভোগসামগ্রী অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে নেই।
খ. পরকালীন সাফল্য লাভে প্রতিযোগিতা করা প্রশংসনীয় কাজ।
গ. পরকালীন সাফল্য লাভ হয় সৎকর্ম দ্বারা। তাই দরকার সৎকর্মে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা।
اَلتّنافُسُ শব্দটির উৎপত্তি اَلْمُنافَسَةُ থেকে, যার অর্থ কোনও বস্তুর প্রতি আগ্রহ এবং একা তা অর্জন করতে চাওয়া। উৎকৃষ্ট ও দামি বস্তুর ক্ষেত্রেই এটা হয়ে থাকে। সত্যিকারের উৎকৃষ্ট ও দামি বস্তু হল আখিরাতের নি‘আমতসমূহ। সে তুলনায় দুনিয়ার বস্তুরাজি লোকে যতই দামি মনে করুক, প্রকৃতপক্ষে তা নিতান্তই তুচ্ছ। প্রকৃত দামি ও উৎকৃষ্ট যখন আখিরাতের নি'আমত, তখন সে নি'আমত অর্জনের জন্য যা-কিছু করা হয় তাও দামি হয়ে যায়। সুতরাং প্রতিটি সৎকর্মই অত্যন্ত দামি। তাহলে দামি বিষয় দাঁড়াল দু'টি- এক হচ্ছে আখিরাতের নি'আমত, আর দ্বিতীয় সে নি'আমত অর্জনের উপায়সমূহ। এ দু'টি বিষয়ই যখন উৎকৃষ্ট ও দামি, তখন মানুষের কর্তব্য কেবল এরই প্রতি আকৃষ্ট থাকা এবং যতবেশি সম্ভব এসব অর্জনের চেষ্টা করা।
এ অধ্যায়টির মূল উদ্দেশ্য আখিরাতের নি'আমত তথা জান্নাতলাভের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করা এবং যেসব উপায়ে তা অর্জন করা যায় তার প্রতি উৎসাহ যোগানো। অর্থাৎ মানুষের কর্তব্য আখিরাতের বিষয়াবলি অর্জনের জন্য লালায়িত হওয়া। তা যেহেতু লাভ করা যায় সৎকর্ম দ্বারা, তাই মানুষের আরও কর্তব্য কে কারচে' বেশি সৎকর্ম করতে পারে সে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া।
প্রকাশ থাকে যে, জান্নাতলাভ ও সৎকর্মের প্রতি উৎসাহ-উদ্দীপনার প্রাণবস্তু হল আল্লাহপ্রেম। আল্লাহ তা'আলার প্রকৃত বান্দাদের প্রাণের ভালোবাসা কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই নিবেদিত থাকে। আর তা থাকে বলে আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে যা-কিছুর সম্পর্ক আছে, সেগুলোকেও তারা ভালোবাসে। সে ভালোবাসা আল্লাহপ্রেমের কারণেই। সুতরাং তারা ভালোবাসে নবী-রাসূলগণকে। ভালোবাসে আল্লাহর ঘর কা'বা ও মসজিদসমূহকে। ভালোবাসে আল্লাহর ওলীদেরকে। তারা ভালোবাসে আল্লাহর কালাম। এমনকি তারা ভালোবাসে আল্লাহর কুলমাখলুককেও। তারা আল্লাহর মাখলুক বলেই সে ভালোবাসা। তারা আল্লাহকে ভালোবাসে বলে যা-কিছুর প্রতি আল্লাহ তা'আলার বিশেষ দৃষ্টি থাকে, যা-কিছুতে তাঁর রহমতের স্পর্শ থাকে, সেগুলোকেও তারা ভালোবাসে এবং সেগুলোকে আলাদা মর্যাদার চোখে দেখে। একে আমরা 'বরকত' শব্দেও ব্যক্ত করে থাকি। এ বরকত বলতে কল্যাণময়তা ও মর্যাদাসম্পন্নতা বোঝানো উদ্দেশ্য। যা-কিছুতে এ জাতীয় বরকত থাকে, তা যতবেশি সম্ভব অর্জন করে নেওয়া চাই। এতে দোষ তো নেই-ই; বরং ইসলামের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয় কাজ বলেই গণ্য। এ অধ্যায়ে বরকতপূর্ণ বিষয় বেশি বেশি অর্জনে উৎসাহ দেওয়াও উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে ইমাম নাওয়াবী রহ. একটি আয়াত ও দু'টি হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন, যদিও এ বিষয়ে বহু আয়াত ও হাদীছ আছে।
‘পরকালীন বিষয়ে প্রতিযোগিতা…’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ (26)
অর্থ: এটাই এমন জিনিস, লুব্ধজনদের উচিত এর প্রতি অগ্রগামী হয়ে লোভ প্রকাশ করা।(সূরা মুতাফফীফীন (৮৩), আয়াত ২৬)
ব্যাখ্যা
এর আগের আয়াতসমূহে পুণ্যবানদের স্থায়ী ঠিকানা জান্নাত ও জান্নাতের নি'আমতসমূহের খানিকটা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তারপর এ আয়াতে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, যারা কোনও লোভনীয় বিষয়ে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে চায়, তারা এ জান্নাত ও তার নি'আমতসমূহ লাভের লক্ষ্যে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হোক।
পার্থিব ভোগসামগ্রীতে প্রতিযোগিতা নিষেধ। তাতে প্রতিযোগিতা করার দ্বারা আমল-আখলাক নষ্ট হয়। মানুষের লোভ ও চাহিদা অনেক বড়। সে তুলনায় ভোগসামগ্রী নিতান্তই কম। সেই অল্প ভোগসামগ্রীতে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলে কাড়াকাড়ি-হানাহানি অনিবার্য। নিজের ভোগলালসা মেটানোর জন্য প্রত্যেকেই চাইবে সবটা সম্পদ একা হস্তগত করতে। আর তাতে যখন বাধা আসবে, তখন জোরজুলুমের আশ্রয় নেবে। বাস্তবে তাই হচ্ছে। দুনিয়ায় হাজারও পাপাচার এ প্রতিযোগিতার পথ ধরেই বিস্তার লাভ করছে। তাই এ প্রতিযোগিতা নিন্দনীয়। এটা আল্লাহ তা'আলা পসন্দ করেন না। কুরআন ও হাদীছ মানুষকে এর থেকে বিরত থাকতে আদেশ করেছে।
পক্ষান্তরে পরকালীন নাজাত ও মুক্তি এবং জান্নাতলাভের উদ্দেশ্যে যে প্রতিযোগিতার কথা বলা হয়েছে তা একটি প্রশংসনীয় কাজ। কেননা তা হানাহানি সৃষ্টি করে না। তা মানুষকে স্বার্থত্যাগে উৎসাহ যোগায়। সে প্রতিযোগিতা মানুষকে পরোপকারী করে তোলে। তা মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিকাশ ঘটায়। তাতে মানুষ সৎকর্মে অনুপ্রাণিত হয়। তাই আয়াত হুকুম করছে- তোমরা জান্নাতলাভের জন্য লালায়িত হও। সে লোভ পূরণে বেশি বেশি সৎকর্ম করো। কে কারচে' বেশি সৎকর্ম করতে পার, সে প্রতিযোগিতায় লেগে পড়ো। প্রতিযোগিতা যদি কোনওকিছু নিয়ে করতে চাও, তবে এ নিয়েই করো। এটাই সত্যিকারের প্রতিযোগিতার বিষয়।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. পার্থিব ভোগসামগ্রী অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে নেই।
খ. পরকালীন সাফল্য লাভে প্রতিযোগিতা করা প্রশংসনীয় কাজ।
গ. পরকালীন সাফল্য লাভ হয় সৎকর্ম দ্বারা। তাই দরকার সৎকর্মে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা।
বরকতপূর্ণ বিষয় অর্জনে নিজ অধিকার রক্ষা করতে চাওয়া
হাদীছ নং: ৫৬৮
হযরত সাহল ইবন সা‘দ রাযি. থেকে বর্ণিত, (একবার) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিছু পানীয় নিয়ে আসা হল। তিনি তা থেকে পান করলেন। তাঁর ডানদিকে ছিল এক বালক এবং তাঁর বামদিকে ছিল কয়েকজন বৃদ্ধ। তিনি বালকটিকে বললেন, তুমি কি এদেরকে দেওয়ার অনুমতি আমাকে দেবে? বালকটি বলল, না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম! আপনার কাছ থেকে পাওয়া আমার অংশে আমি কাউকে অগ্রাধিকার দেব না। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাতে সজোরে তা রাখলেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৫৬২০; সহীহ মুসলিম: ২০৩০; মুআত্তা মালিক: ৩৪২৯; মুসনাদে আহমাদ: ২২৮২৪; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৬৮৩৯; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫৩৩৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৭৬৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৪৬৬৮)
হাদীছ নং: ৫৬৮
হযরত সাহল ইবন সা‘দ রাযি. থেকে বর্ণিত, (একবার) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিছু পানীয় নিয়ে আসা হল। তিনি তা থেকে পান করলেন। তাঁর ডানদিকে ছিল এক বালক এবং তাঁর বামদিকে ছিল কয়েকজন বৃদ্ধ। তিনি বালকটিকে বললেন, তুমি কি এদেরকে দেওয়ার অনুমতি আমাকে দেবে? বালকটি বলল, না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম! আপনার কাছ থেকে পাওয়া আমার অংশে আমি কাউকে অগ্রাধিকার দেব না। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাতে সজোরে তা রাখলেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৫৬২০; সহীহ মুসলিম: ২০৩০; মুআত্তা মালিক: ৩৪২৯; মুসনাদে আহমাদ: ২২৮২৪; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৬৮৩৯; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫৩৩৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৭৬৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৪৬৬৮)
مقدمة الامام النووي
63 - باب التنافس في أمور الآخرة والاستكثار مما يتبرك بِهِ
قَالَ الله تَعَالَى: {وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ} [المطففين: 26].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ} [المطففين: 26].
568 - وعن سَهْلِ بن سَعدٍ - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - أُتِيَ بِشَرابٍ، فَشَرِبَ مِنْهُ وَعَنْ يَمِينِهِ غُلاَمٌ، وَعَنْ يَسَارِهِ الأشْيَاخُ، فَقَالَ لِلغُلاَمِ: «أتَأَذَنُ لِي أَنْ أُعْطِيَ هؤُلاء؟» فَقَالَ الغُلامُ: لاَ وَاللهِ يَا رسولَ الله، لاَ أُوْثِرُ بِنَصِيبي مِنْكَ أحَدًا. فَتَلَّهُ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - في يَدِهِ. متفقٌ عَلَيْهِ (1).
«تَلَّهُ» بالتاءِ المثناة فوق: أيْ وَضَعَهُ. وَهذَا الغُلامُ هُوَ ابنُ عَبَّاسٍ رضي الله عنهما.
«تَلَّهُ» بالتاءِ المثناة فوق: أيْ وَضَعَهُ. وَهذَا الغُلامُ هُوَ ابنُ عَبَّاسٍ رضي الله عنهما.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে বর্ণিত ঘটনাটি ঘটেছিল উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনা রাযি.-এর ঘরে। আল্লামা ইবন হাজার রহ. এরূপ বলেছেন। যে পানীয়ের কথা বলা হয়েছে, তা আসলে কী ছিল, এ বর্ণনায় তার উল্লেখ নেই। তবে এর কাছাকাছি একটি বর্ণনা তিরমিযী শরীফে আছে। তাতে এক পেয়ালা দুধের কথা বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ডানদিকে যে বালকটির থাকার কথা বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি.। কেউ কেউ তাঁর ভাই হযরত ফাযল রাযি.-এর কথাও বলেছেন। বামদিকে যে বৃদ্ধগণ ছিলেন, কারও কারও বর্ণনামতে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-ও তাদের একজন। তিরমিযী শরীফের একটি বর্ণনায় হযরত খালিদ রাযি.-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাত্র থেকে প্রথমে পানীয়ের কিছুটা নিয়ে পান করলেন। তারপর ডানদিকের বালকটিকে বললেন-
أتَأْذَنُ لي أنْ أُعْطِيَ هَؤُلَاءِ؟ (তুমি কি এদেরকে দেওয়ার অনুমতি আমাকে দেবে)? তিরমিযী শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন- فَقَالَ لِي : الشَّرْبَةُ لَكَ ، فَإِنْ شِئْتَ آثَرْتَ بِهَا خَالِدًا (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, এ পানীয় তোমার। তুমি চাইলে এতে খালিদকে অগ্রাধিকার দিতে পার)(জামে' তিরমিযী: ৩৪৫৫)। নিয়ম হচ্ছে, খাদ্যদ্রব্য বা পানীয় বিতরণকালে শুরুটা মজলিসের সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তির মাধ্যমে করা হবে। তা তিনি মজলিসের যেখানেই অবস্থান করুন। তাকে পরিবেশনের পর এবার তারই ডানদিকে যে হবে তাকে অগ্রাধিকার দেবে। আর সে তার ডানের জনকে। এভাবে শেষ পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে বামদিকের লোকদের তুলনায় ডানদিকের লোকদের অধিকার বেশি, যদিও গুরুত্ব ও মর্যাদায় বামদিকের লোকদের তুলনায় ডানদিকের লোকেরা সাধারণ পর্যায়ের হয়। উক্ত ঘটনায় সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তি তো নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি গ্রহণের পর তাঁর ডানে অবস্থান করা ব্যক্তির অধিকারই অগ্রগণ্য। তো তাঁর ডানদিকে ছিলেন একজন বালক। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. হয়ে থাকলে তিনিও তখন বালকই ছিলেন। বয়সে ছোট হলেও নবীজির ডানদিকে থাকায় তাঁর অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে বামদিকে ছিলেন হযরত খালিদ রাযি.-এর মতো একজন বয়স্ক ও গণ্যমান্য ব্যক্তি। ইসলামগ্রহণের আগেও নিজ গোত্রে তাঁর বিশেষ মর্যাদা ছিল। ইসলাম সম্মানী লোককে সম্মান জানানোর শিক্ষা দেয়। আবার হযরত খালিদ রাযি. ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন দেরিতে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর একটু মনোরঞ্জনও করতে চেয়েছিলেন। সে কারণেই তিনি পাত্রের অবশিষ্ট পানি হযরত খালিদ রাযি.-কে দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তা দিতে হলে ডানদিকের বালকের অনুমতি প্রয়োজন। তাই তিনি এ কথা বললেন। অর্থাৎ তুমি যেহেতু ডানদিকে, তাই এতে তোমারই অধিকার বেশি। তবে তুমি চাইলে খালিদের অনুকূলে এ অধিকার ত্যাগও করতে পার।
হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. থেকেও এ জাতীয় এক ঘটনা বর্ণিত আছে। তাতে বলা হয়েছে-
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أُتِيَ بِلَبَنٍ قَدْ شِيبَ بِمَاءٍ وَعَنْ يَمِينِهِ أَعْرَابِيٌّ وَعَنْ شِمَالِهِ أَبُو بَكْرٍ فَشَرِبَ ثُمَّ أَعْطَى الْأَعْرَابِيَّ وَقَالَ الْأَيْمَنَ فَالْأَيْمَنَ
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কিছু দুধ আনা হল। তাতে পানি মেশানো ছিল। তাঁর ডানদিকে ছিল এক বেদুঈন। বামদিকে হযরত আবু বকর সিদ্দীক। তিনি প্রথমে সে দুধ নিজে পান করলেন। তারপর বেদুঈনকে দিলেন এবং বললেন, ডানদিকের জনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তারপর যে ব্যক্তি তার ডানে।(সহীহ বুখারী: ৫২১৯; সহীহ মুসলিম: ২০২৯; জামে তিরমিযী: ১৮৯৩)
এ ঘটনায়ও দেখা যাচ্ছে মজলিসের সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তি তথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে গ্রহণ করার পর তাঁর ডানের জনকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। যদিও সে একজন বেদুঈনই। সুতরাং প্রথমে সর্বাপেক্ষা সম্মানীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তারপর তার ডানকে। যদিও তার ডানে বামের জনের চেয়ে মর্যাদায় অগ্রগামী ব্যক্তি বিদ্যমান থাকে।
যাহোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথার উত্তরে সেই বালক সাহাবী বললেন-
لا واللَّهِ يا رَسولَ اللَّهِ، لا أُوثِرُ بنَصِيبِي مِنْكَ أحَدًا (না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম! আপনার কাছ থেকে পাওয়া আমার অংশে আমি কাউকে অগ্রাধিকার দেব না)। অর্থাৎ আপনি আল্লাহ তা'আলার মহান রাসূল। আপনার কাছ থেকে যা পাওয়া যায়, তাতে বরকতই বরকত। আমি ডানদিকে থাকায় যখন এ বরকতপূর্ণ পানীয়ে আমার অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন এ পানীয়তে আমি অন্য কাউকে প্রাধান্য দেব না। তা এ কারণে নয় যে, এটা খুব মজাদার পানীয়। বরং এ কারণে যে, এর থেকে আপনি পান করায় এটা বরকতপূর্ণ হয়ে গেছে। তাই এতে ছাড় দেওয়া তো বরকতে ছাড় দেওয়ার নামান্তর। তা আমি করতে পারব না।
তিনি বলেছেন, কাউকে অগ্রাধিকার দেব না। অর্থাৎ তিনি যেই হোন। আপন হোক বা পর, কাছের হোক বা দূরের, বয়স্ক হোক বা অল্পবয়স্ক, সম্মানী ব্যক্তি হোন বা সাধারণ ব্যক্তি।
বলাবাহুল্য এটা সেই বালক, আর যদি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. নিজেই হয়ে থাকেন, তবে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক। ওই বালকবয়সেই তিনি বস্তুর মর্যাদা নিরূপণ করতে জানতেন। কোন জিনিসে ছাড় দেওয়া যায় আর কোন জিনিসে দেওয়া যায় না, তা ভালোভাবে বুঝতেন। কেন ছাড় দেওয়া যায় না তা ব্যাখ্যা করতে পারতেন। ছাড় না দেওয়ার কারণও যৌক্তিকভাবে বোঝানোর ক্ষমতা তিনি রাখতেন। বিভিন্ন কাজকর্মে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি.-এর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। এ কারণেই একজন তরুণ হওয়া সত্ত্বেও হযরত উমর রাযি.-এর পরামর্শসভায় তিনি স্থান লাভ করেছিলেন। যাহোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে বালকের আবেগ-অনুভূতি ও তাঁর অধিকারের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন।
فَتَلَّهُ رَسُوْلُ اللَّهِ ﷺ فِي يَدِهِ (ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাতে সজোরে তা রাখলেন)। تَلَّ অর্থ রাখা, সজোরে রাখা। মূলত শব্দটির উৎপত্তি التل থেকে। এর অর্থ টিলা বা উঁচু স্থান। উঁচু স্থান থেকে কোনওকিছু নিক্ষেপ করা অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হতো। পরে এর মধ্যে ব্যাপকতা আসে এবং যে-কোনওভাবে নিক্ষেপ করা বোঝাতে এটি ব্যবহৃত হতে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বালকটির হাতে এমনভাবে পাত্রটি রেখেছিলেন, যেন কিছুটা নিক্ষেপ করার মতো হয়ে গিয়েছিল। সাধারণত আদরমিশ্রিত কৃত্রিম রাগের অবস্থায় এরূপ করা হয়ে থাকে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. অবশিষ্ট খাবার, পানীয় বা অন্য যে-কোনও বস্তু বিতরণকালে সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া। তারপর তার ডানদিক থেকে বিতরণ করা। এটিই সঠিক আদব।
খ. এ ক্ষেত্রে বামদিকের কাউকে দিতে চাইলে ডানদিকে যারা থাকে তাদের অনুমতি নিতে হবে।
গ. অনেক পরিবেশনকারী মনে করে, তার ডানে যেই হবে তার থেকেই আরম্ভ করা হবে। এটা ভুল কর্মপন্থা। সঠিক পদ্ধতি হলো মজলিসে সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তি যিনি হবেন, প্রথমে তার নিকট যাওয়া এবং তার থেকেই বিতরণ আরম্ভ করা। তারপর তারই ডানদিক থেকে। বিতরণকারীর ডানদিক থেকে নয়।
ঘ. বিতরণের বস্তুটি বরকতপূর্ণ হলে তাতে নিজ অধিকার ত্যাগ না করা দূষণীয় নয়।
ঙ. আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির স্পর্শ দ্বারা বরকত ও কল্যাণ লাভ হয়।
চ. বরকতপূর্ণ বস্তুতে স্বার্থত্যাগের জন্য গণ্যমান্য ব্যক্তির অনুরোধ রক্ষা না করাটা বেয়াদবি নয়।
ছ. বরকতপূর্ণ বিষয়ে নিজ অধিকার লাভে আগ্রহ প্রকাশ দীনী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশংসনীয়।
জ. নিজের অধীন কারও উপর এমন কোনও ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়, যা দ্বারা তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাত্র থেকে প্রথমে পানীয়ের কিছুটা নিয়ে পান করলেন। তারপর ডানদিকের বালকটিকে বললেন-
أتَأْذَنُ لي أنْ أُعْطِيَ هَؤُلَاءِ؟ (তুমি কি এদেরকে দেওয়ার অনুমতি আমাকে দেবে)? তিরমিযী শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন- فَقَالَ لِي : الشَّرْبَةُ لَكَ ، فَإِنْ شِئْتَ آثَرْتَ بِهَا خَالِدًا (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, এ পানীয় তোমার। তুমি চাইলে এতে খালিদকে অগ্রাধিকার দিতে পার)(জামে' তিরমিযী: ৩৪৫৫)। নিয়ম হচ্ছে, খাদ্যদ্রব্য বা পানীয় বিতরণকালে শুরুটা মজলিসের সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তির মাধ্যমে করা হবে। তা তিনি মজলিসের যেখানেই অবস্থান করুন। তাকে পরিবেশনের পর এবার তারই ডানদিকে যে হবে তাকে অগ্রাধিকার দেবে। আর সে তার ডানের জনকে। এভাবে শেষ পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে বামদিকের লোকদের তুলনায় ডানদিকের লোকদের অধিকার বেশি, যদিও গুরুত্ব ও মর্যাদায় বামদিকের লোকদের তুলনায় ডানদিকের লোকেরা সাধারণ পর্যায়ের হয়। উক্ত ঘটনায় সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তি তো নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি গ্রহণের পর তাঁর ডানে অবস্থান করা ব্যক্তির অধিকারই অগ্রগণ্য। তো তাঁর ডানদিকে ছিলেন একজন বালক। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. হয়ে থাকলে তিনিও তখন বালকই ছিলেন। বয়সে ছোট হলেও নবীজির ডানদিকে থাকায় তাঁর অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে বামদিকে ছিলেন হযরত খালিদ রাযি.-এর মতো একজন বয়স্ক ও গণ্যমান্য ব্যক্তি। ইসলামগ্রহণের আগেও নিজ গোত্রে তাঁর বিশেষ মর্যাদা ছিল। ইসলাম সম্মানী লোককে সম্মান জানানোর শিক্ষা দেয়। আবার হযরত খালিদ রাযি. ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন দেরিতে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর একটু মনোরঞ্জনও করতে চেয়েছিলেন। সে কারণেই তিনি পাত্রের অবশিষ্ট পানি হযরত খালিদ রাযি.-কে দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তা দিতে হলে ডানদিকের বালকের অনুমতি প্রয়োজন। তাই তিনি এ কথা বললেন। অর্থাৎ তুমি যেহেতু ডানদিকে, তাই এতে তোমারই অধিকার বেশি। তবে তুমি চাইলে খালিদের অনুকূলে এ অধিকার ত্যাগও করতে পার।
হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. থেকেও এ জাতীয় এক ঘটনা বর্ণিত আছে। তাতে বলা হয়েছে-
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أُتِيَ بِلَبَنٍ قَدْ شِيبَ بِمَاءٍ وَعَنْ يَمِينِهِ أَعْرَابِيٌّ وَعَنْ شِمَالِهِ أَبُو بَكْرٍ فَشَرِبَ ثُمَّ أَعْطَى الْأَعْرَابِيَّ وَقَالَ الْأَيْمَنَ فَالْأَيْمَنَ
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কিছু দুধ আনা হল। তাতে পানি মেশানো ছিল। তাঁর ডানদিকে ছিল এক বেদুঈন। বামদিকে হযরত আবু বকর সিদ্দীক। তিনি প্রথমে সে দুধ নিজে পান করলেন। তারপর বেদুঈনকে দিলেন এবং বললেন, ডানদিকের জনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তারপর যে ব্যক্তি তার ডানে।(সহীহ বুখারী: ৫২১৯; সহীহ মুসলিম: ২০২৯; জামে তিরমিযী: ১৮৯৩)
এ ঘটনায়ও দেখা যাচ্ছে মজলিসের সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তি তথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে গ্রহণ করার পর তাঁর ডানের জনকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। যদিও সে একজন বেদুঈনই। সুতরাং প্রথমে সর্বাপেক্ষা সম্মানীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তারপর তার ডানকে। যদিও তার ডানে বামের জনের চেয়ে মর্যাদায় অগ্রগামী ব্যক্তি বিদ্যমান থাকে।
যাহোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথার উত্তরে সেই বালক সাহাবী বললেন-
لا واللَّهِ يا رَسولَ اللَّهِ، لا أُوثِرُ بنَصِيبِي مِنْكَ أحَدًا (না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম! আপনার কাছ থেকে পাওয়া আমার অংশে আমি কাউকে অগ্রাধিকার দেব না)। অর্থাৎ আপনি আল্লাহ তা'আলার মহান রাসূল। আপনার কাছ থেকে যা পাওয়া যায়, তাতে বরকতই বরকত। আমি ডানদিকে থাকায় যখন এ বরকতপূর্ণ পানীয়ে আমার অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন এ পানীয়তে আমি অন্য কাউকে প্রাধান্য দেব না। তা এ কারণে নয় যে, এটা খুব মজাদার পানীয়। বরং এ কারণে যে, এর থেকে আপনি পান করায় এটা বরকতপূর্ণ হয়ে গেছে। তাই এতে ছাড় দেওয়া তো বরকতে ছাড় দেওয়ার নামান্তর। তা আমি করতে পারব না।
তিনি বলেছেন, কাউকে অগ্রাধিকার দেব না। অর্থাৎ তিনি যেই হোন। আপন হোক বা পর, কাছের হোক বা দূরের, বয়স্ক হোক বা অল্পবয়স্ক, সম্মানী ব্যক্তি হোন বা সাধারণ ব্যক্তি।
বলাবাহুল্য এটা সেই বালক, আর যদি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. নিজেই হয়ে থাকেন, তবে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক। ওই বালকবয়সেই তিনি বস্তুর মর্যাদা নিরূপণ করতে জানতেন। কোন জিনিসে ছাড় দেওয়া যায় আর কোন জিনিসে দেওয়া যায় না, তা ভালোভাবে বুঝতেন। কেন ছাড় দেওয়া যায় না তা ব্যাখ্যা করতে পারতেন। ছাড় না দেওয়ার কারণও যৌক্তিকভাবে বোঝানোর ক্ষমতা তিনি রাখতেন। বিভিন্ন কাজকর্মে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি.-এর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। এ কারণেই একজন তরুণ হওয়া সত্ত্বেও হযরত উমর রাযি.-এর পরামর্শসভায় তিনি স্থান লাভ করেছিলেন। যাহোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে বালকের আবেগ-অনুভূতি ও তাঁর অধিকারের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন।
فَتَلَّهُ رَسُوْلُ اللَّهِ ﷺ فِي يَدِهِ (ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাতে সজোরে তা রাখলেন)। تَلَّ অর্থ রাখা, সজোরে রাখা। মূলত শব্দটির উৎপত্তি التل থেকে। এর অর্থ টিলা বা উঁচু স্থান। উঁচু স্থান থেকে কোনওকিছু নিক্ষেপ করা অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হতো। পরে এর মধ্যে ব্যাপকতা আসে এবং যে-কোনওভাবে নিক্ষেপ করা বোঝাতে এটি ব্যবহৃত হতে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বালকটির হাতে এমনভাবে পাত্রটি রেখেছিলেন, যেন কিছুটা নিক্ষেপ করার মতো হয়ে গিয়েছিল। সাধারণত আদরমিশ্রিত কৃত্রিম রাগের অবস্থায় এরূপ করা হয়ে থাকে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. অবশিষ্ট খাবার, পানীয় বা অন্য যে-কোনও বস্তু বিতরণকালে সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া। তারপর তার ডানদিক থেকে বিতরণ করা। এটিই সঠিক আদব।
খ. এ ক্ষেত্রে বামদিকের কাউকে দিতে চাইলে ডানদিকে যারা থাকে তাদের অনুমতি নিতে হবে।
গ. অনেক পরিবেশনকারী মনে করে, তার ডানে যেই হবে তার থেকেই আরম্ভ করা হবে। এটা ভুল কর্মপন্থা। সঠিক পদ্ধতি হলো মজলিসে সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তি যিনি হবেন, প্রথমে তার নিকট যাওয়া এবং তার থেকেই বিতরণ আরম্ভ করা। তারপর তারই ডানদিক থেকে। বিতরণকারীর ডানদিক থেকে নয়।
ঘ. বিতরণের বস্তুটি বরকতপূর্ণ হলে তাতে নিজ অধিকার ত্যাগ না করা দূষণীয় নয়।
ঙ. আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির স্পর্শ দ্বারা বরকত ও কল্যাণ লাভ হয়।
চ. বরকতপূর্ণ বস্তুতে স্বার্থত্যাগের জন্য গণ্যমান্য ব্যক্তির অনুরোধ রক্ষা না করাটা বেয়াদবি নয়।
ছ. বরকতপূর্ণ বিষয়ে নিজ অধিকার লাভে আগ্রহ প্রকাশ দীনী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশংসনীয়।
জ. নিজের অধীন কারও উপর এমন কোনও ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়, যা দ্বারা তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)