রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৭০
ভূমিকা অধ্যায়
কৃতজ্ঞ ধনীর মর্যাদা, যে কিনা সম্পদ অর্জন করে শরী‘আত-নির্দেশিত পন্থায় এবং ব্যয়ও করে শরী‘আত-নির্দেশিত স্থানসমূহে
এ অধ্যায়টি কৃতজ্ঞ ধনীর মর্যাদা সম্পর্কে। কৃতজ্ঞ ধনীর মূল বৈশিষ্ট্য দু'টি। প্রথমত সে অর্থ উপার্জন করে বৈধ পন্থায়। দ্বিতীয়ত সে অর্থব্যয় করে কেবল এমনসব খাতে, যা শরী'আত অনুমোদন করে। অর্থ বৈধ পন্থায় উপার্জন করা জরুরি। কেননা তার প্রকৃত মালিক আল্লাহ তা'আলা। মালিক যেহেতু আল্লাহ তা'আলা, তাই তাঁর কাছ থেকে নিতে হবে তাঁর অনুমতিক্রমেই। দুনিয়াবী দৃষ্টিতেও কোনও সম্পদ তার মালিকের অনুমতি ছাড়া নেওয়া যায় না। নেওয়াটা অপরাধ। তেমনি সারা জাহানের সবকিছুর মালিক যেহেতু আল্লাহ তা'আলা, তাই তা থেকে যে যা নিতে চাইবে তা আল্লাহ তা'আলার অনুমতিক্রমেই নিতে হবে। শরী'আতের বিধান হল আল্লাহ তা'আলার অনুমতিপত্র। শরী'আত মোতাবেক অর্থ উপার্জন করাই আল্লাহ তা'আলার অনুমতিক্রমে উপার্জন করা। এভাবে উপার্জন করার দ্বারা আল্লাহ তা'আলার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। তাঁর থেকে নেওয়া হয় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। এ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে বান্দা যেন মনের এই ভাব প্রকাশ করছে যে, হে আল্লাহ! তুমি কতইনা দয়াময়! তুমি আমার প্রয়োজনে এতকিছুর আয়োজন করেছ, আবার এসব গ্রহণ ও ভোগ করার জন্য অতি সুন্দর ব্যবস্থাও আমাকে দান করেছ! তোমাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।
বৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জনের পর তা ব্যয়ও করতে হবে বৈধ খাতে। এটা কৃতজ্ঞতার দ্বিতীয় ধাপ। আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দাবি হল সে সম্পদ কোনও অবৈধ কাজে ব্যবহার করা হবে না। সে সম্পদকে কোনও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণ বানানো হবে না। বরং তাকে আল্লাহ তা'আলার মর্জিমতো খরচ করা হবে এবং তার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা হবে। তা সম্ভব হয় কেবল তখনই, যখন সম্পদকে শরী'আতসম্মত খাতে ব্যয় করা হয়। যে ব্যক্তি তার অর্জিত সম্পদ এভাবে ব্যয় করে, সম্পদের ক্ষেত্রে সে কৃতজ্ঞ বলে গণ্য হয়। এরূপ ব্যক্তিকে আল্লাহ পসন্দ করেন। আল্লাহ তা'আলা চান বান্দা তাঁর দেওয়া নি'আমতের কৃতজ্ঞতা আদায় করুক। কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে এর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অকৃতজ্ঞদের জন্য ঘোষিত হয়েছে কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী।
সম্পদ সকলেরই কিছু না কিছু থাকে। তাই এ ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কর্তব্যও সকলের উপরই বর্তায়। যার সম্পদ যত বেশি, কৃতজ্ঞতাও তার ততো বেশিই আদায় করা কর্তব্য। যে ব্যক্তি তা আদায় করতে সক্ষম হয়, সে আল্লাহ তা'আলার কাছে অতি উচ্চমর্যাদার অধিকারী হয়। বলাবাহুল্য যার সম্পদ যত বেশি, তার পক্ষে উচ্চমর্যাদা অর্জনের সুযোগও ততো বেশি। সে অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগীর পাশাপাশি যদি তার সম্পদের যথার্থ ব্যবহার করে, তবে তার পক্ষে এত উচ্চতায় পৌঁছা সম্ভব, যেখানে কোনও গরীবের পক্ষে পৌঁছা সম্ভব নয়। এটা কঠিন বটে, যেহেতু মানবকল্যাণ ও দীনের চাহিদাপূরণে অকৃপণভাবে অর্থব্যয় করতে গেলে লোভ সংবরণ করতে হয় এবং নিজের নফসকে দমন করতে হয়। নিঃসন্দেহে তা কঠিন সাধনা ও মুজাহাদার বিষয়। তা যতই কঠিন হোক না কেন, আল্লাহ তা'আলার প্রতি যারা কৃতজ্ঞ, সেই মহান ব্যক্তিবর্গ সে সাধনায় ঠিকই উতরে যায়। আমাদের ইতিহাসে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি., হযরত উছমান ইবন আফফান রাযি., হযরত আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযি., হযরত যুবায়র ইবনুল আউওয়াম রাযি. প্রমুখ মহান সাহাবীগণ তো বটেই, তাঁদের পরেও তাবি'ঈন, তাবে-তাবি'ঈন এবং তাদেরও পরবর্তীকালের বহু আল্লাহপ্রেমিক ও শোকরগুযার ধনী লোক ছিলেন, যাঁরা নিজ অর্থ-সম্পদ আল্লাহর পথে অকাতরে বিলিয়ে দেওয়ার নজির স্থাপন করে গেছেন। তাঁরা সর্বকালের বিত্তবানদের জন্য আল্লাহর পথে অর্থব্যয়ের অনুপ্রেরণা। সম্পদ তো মানবজীবনের কল্যাণের জন্যই। পরকালের কল্যাণই প্রকৃত কল্যাণ। সে লক্ষ্যে যে ব্যক্তি নিজ সম্পদ ব্যয় করে, সে প্রকৃত শোকরগুযার। মানুষ যাতে সেরকম শোকরগুযার বান্দারূপে গড়ে ওঠে, সে লক্ষ্যে কুরআন মাজীদের বহু আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু হাদীছে অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়েছে। এ অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই।

‘কৃতজ্ঞ ধনীর মর্যাদা…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত
فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى (5) وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى (6) فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى (7)
অর্থ: সুতরাং যে ব্যক্তি (আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ) দান করেছে ও তাকওয়া অবলম্বন করেছে এবং সর্বোত্তম বিষয় মনে-প্রাণে স্বীকার করে নিয়েছে, আমি তাকে স্বস্তিময় গন্তব্যে পৌঁছার ব্যবস্থা করে দেব।(সূরা লায়ল (৯২), আয়াত ৫-৭)
‘ব্যবস্থা করে দেওয়া’-এর অর্থ, আল্লাহ তাআলা এমন আমলের তাওফীক দেবেন, যার বদৌলতে জান্নাতে পৌছা যাবে।
প্রকাশ থাকে যে, কুরআন মাজীদে ব্যবহৃত نُيَسِّرُهُ শব্দের অর্থ যে করা হয়েছে ‘ব্যবস্থা করে দেওয়া’, তা করা হয়েছে আল্লামা আলুসী (রহ.)-এর ব্যাখ্যার অনুসরণে। দেখুন (রূহুল মাআনী, ৩০ : ৫১২)। -তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন থেকে সংগৃহীত।

ব্যাখ্যা
এগুলো সূরা লায়লের আয়াত। এ আয়াত তিনটিতে দান-খয়রাত, তাকওয়া- পরহেযগারী ও ঈমানের পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি দান-খয়রাত করে ও তাকওয়া অবলম্বন করে। দান-খয়রাত বলতে যেমন অর্থ-সম্পদ দান করাকে বোঝায়, তেমনি আল্লাহ তা'আলাকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে শারীরিক শক্তি দ্বারা মানুষের উপকার করা, মানুষকে সুপরামর্শ দেওয়া, ইলম ও বিদ্যা-বুদ্ধি বিস্তার করা সবই এর অন্তর্ভুক্ত। যার যে সামর্থ্য আছে, সে যদি তা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে উপযুক্ত স্থানে ব্যয় করে, তার ক্ষেত্রেই এ আয়াত প্রযোজ্য হবে।
তাকওয়া অবলম্বনের অর্থ হল আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা হতে বিরত থাকা। কাজেই কুফর ও শিরক পরিহার করা, সগীরা ও কবীরা গুনাহ বর্জন করা, প্রকাশ্য ও গুপ্ত সকল পাপ থেকে বেঁচে থাকা, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার প্রভৃতি আত্মিক ব্যাধি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা- এ সবই তাকওয়ার অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয় আয়াতে সর্বোত্তম বিষয় মনে-প্রাণে স্বীকার করে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সর্বোত্তম বিষয় (الْحُسْنَى) বলতে কী বোঝানো হয়েছে, এ সম্পর্কে মুফাসসিরগণ বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। কেউ বলেন এর মানে কালেমা তায়্যিবা। কেউ বলেন জান্নাত। কেউ বলেন, আল্লাহ তা'আলার প্রতিশ্রুত পুরস্কার। সবগুলোই কাছাকাছি। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কেননা কালেমা তায়্যিবার বিশ্বাস জান্নাতলাভের উপায়। আর জান্নাত আল্লাহ তা'আলার প্রতিশ্রুত পুরস্কার। কালেমা, জান্নাত ও পরকালীন পুরস্কারে উপর বিশ্বাস রাখার অর্থ ঈমানওয়ালা হওয়া। তো যে ব্যক্তি ঈমানের অধিকারী হবে আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করবে এবং তাকওয়ার পথে চলবে, তার জন্য তৃতীয় আয়াতে পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে-
فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى (আমি তাকে স্বস্তিময় গন্তব্যে পৌঁছার ব্যবস্থা করে দেব)। الْيُسْرَى -এর দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে, তা নিয়েও বিভিন্ন মত আছে। অনেকের মতে এর দ্বারা জান্নাত বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ যে ব্যক্তি উপরিউক্ত তিন গুণের অধিকারী হবে, আল্লাহ তা'আলা তাকে জান্নাতে পৌঁছে দিবেন, যা সকল দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত স্বস্তিময় ও চিরসুখের গন্তব্যস্থান। কেউ বলেন এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য জান্নাতলাভের উপায়- উপকরণ। অর্থাৎ উল্লিখিত তিন গুণ যে ব্যক্তি অর্জন করতে সক্ষম হবে, তার জন্য আল্লাহ তা'আলা সৎকর্মসমূহ সহজ করে দেবেন। তার অন্তরে সৎকাজের প্রতি আগ্রহ জন্মাবে এবং সৎকর্ম করতে তার ভালো লাগবে। ফলে সে ব্যক্তি নিরবচ্ছিন্নভাবে সৎকর্মে নিয়োজিত থেকে চিরসুখের জান্নাতের অধিকারী হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে উভয় ব্যাখ্যার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই।
আয়াতে জান্নাতকে পরকালীন পুরস্কাররূপে ঘোষণা করা হয়েছে এবং কীভাবে তা পাওয়া যাবে তার উপায়ও শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় বান্দা জান্নাতলাভে উৎসাহী হোক, এটা আল্লাহ তা'আলার কাম্য। আল্লাহ তা'আলা বিভিন্ন আয়াতে আরও পরিষ্কারভাবেও এটা বলে দিয়েছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ (133)
‘এবং নিজ প্রতিপালকের পক্ষ হতে মাগফিরাত ও সেই জান্নাত লাভের জন্য একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও, যার প্রশস্ততা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতুল্য। তা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৩৩)

আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলা যাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন, তার কর্তব্য সে ক্ষমতাকে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে মানবকল্যাণে ব্যয় করা।
খ. তাকওয়া অবলম্বন করা তথা সর্বপ্রকার নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বেঁচে থাকা জান্নাতলাভের জন্য জরুরি।
গ. জান্নাতসহ যাবতীয় গায়েবী বিষয়ে বিশ্বাস রাখাই ঈমান। ঈমান জান্নাতের চাবিকাঠি।
ঘ. এ আয়াতসমূহে জান্নাতলাভের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যাবতীয় নেক আমলের বিনিময়ে অন্তরে জান্নাতলাভের আশা রাখা চাই।

দুই নং আয়াত
وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى (17) الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّى (18) وَمَا لِأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى (19) إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَى (20) وَلَسَوْفَ يَرْضَى (21)
অর্থ: এবং তা থেকে দূরে রাখা হবে পরম মুত্তাকীকে, যে আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য নিজ সম্পদ (আল্লাহর পথে) দান করে অথচ তার উপর কারও অনুগ্রহ ছিল না, যার প্রতিদান দিতে হতো। বরং সে (দান করে) কেবল তার মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টির প্রত্যাশায়। নিশ্চয়ই সে অচিরেই খুশি হয়ে যাবে।(সূরা লায়ল (৯২), আয়াত ১৭-২১)

ব্যাখ্যা
এখানে পাঁচটি আয়াত আছে। এগুলো সূরা লায়লের শেষের আয়াত। এ আয়াতগুলোতে উচ্চস্তরের মুত্তাকীর পরিচয় দান করা হয়েছে এবং আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তার জন্য যে পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে সেদিকেও ইশারা করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন- وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى (এবং তা থেকে দূরে রাখা হবে পরম মুত্তাকীকে)। অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এমন ব্যক্তিকে, যে আত্মার পরিশুদ্ধি ও প্রশান্তি অর্জন করেছে, প্রকাশ্য ও গুপ্ত শিরক থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছে, দৈহিক ও আত্মিক অবাধ্যতা পরিহার করেছে এবং মনের খেয়াল-খুশির বিরুদ্ধাচরণে কঠোরতা অবলম্বন করেছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, এর দ্বারা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-কে বোঝানো উদ্দেশ্য। তাফসীরকারকদের মতে তাঁকে উপলক্ষ্য করেই এ আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়েছে। এর দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, নবীগণের পর সমস্ত মানুষের মধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. শ্রেষ্ঠতম মুত্তাকী।
الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّى ‘যে আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য নিজ সম্পদ (আল্লাহর পথে) দান করে'। অর্থাৎ গরীব-দুঃখীর সাহায্য, দাসমুক্তি ও অন্যান্য কল্যাণকর খাতে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে কেবলই আত্মশুদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে। এই উদ্দেশ্যে, যাতে আল্লাহ তা'আলা তাকে প্রকাশ্য ও গুপ্ত সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র করে দেন। এসব কাজের পেছনে তার পার্থিব কোনও চাহিদা থাকে না। আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনই তার মুখ্য উদ্দেশ্য।
বর্ণিত আছে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. খুঁজে খুঁজে দুর্বল দাস ও দাসীদেরকে তাদের মনিবদের কাছ থেকে কিনে আযাদ করে দিতেন। একদিন তাঁর পিতা আবু কুহাফা রাযি. বলেছিলেন, তুমি তো শুধু দুর্বল দাস-দাসীদের মুক্ত করছ। যদি সবল দাসদের মুক্ত করতে, তবে তারা তোমার সাহায্য করতে পারত ও তোমার পাশে দাঁড়াতে পারত! তিনি এর উত্তর দিয়েছিলেন যে, আমি তো আল্লাহর নিকট যা আছে কেবল তাই কামনা করি।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. যেসকল গোলাম কিনে আযাদ করেছিলেন, তাদের মধ্যে হযরত বিলাল রাযি. সর্বাপেক্ষা বেশি পরিচিত। তিনি ছিলেন কুরায়শ সর্দার উমায়্যার মালিকানাধীন। ইসলামগ্রহণের অপরাধে উমায়্যা তাঁকে নির্মমভাবে শাস্তি দিত। দুপুরের প্রচণ্ড রোদে উত্তপ্ত বালুর উপর শুইয়ে দিত। বুকের উপর ভারী পাথর চাপা দিত। তারপর বলত, তুমি মুহাম্মাদকে অস্বীকার করলে ছাড়া পাবে, নয়তো মৃত্যু পর্যন্ত এরূপ শাস্তি দেওয়া হতে থাকবে। কিন্তু তাঁর মুখ থেকে কেবল 'আহাদ' 'আহাদ' উচ্চারিত হতো। একদিন হযরত বিলাল রাযি.-কে এভাবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছিল। এ অবস্থায় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি উমায়্যাকে বললেন, তুমি কি এই নিরীহ লোকটিকে রেহাই দেবে না? উমায়্যা বলল, তুমি চাইলে একে নিয়ে যেতে পার। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. বললেন, আচ্ছা, আমার কাছে আরেকটি গোলাম আছে। সে বেলালের চেয়ে হৃষ্টপুষ্ট ও শক্তিশালী। আমি তাকে দিয়ে বিলালকে তোমার কাছ থেকে নিয়ে নেব। উমায়্যা তাতে সম্মতি জানাল। 'নিসতাস' নামে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর একটি গোলাম ছিল। তিনি তাকে ইসলামগ্রহণের দাওয়াত দিয়েছিলেন। কিন্তু সে তাঁর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে ইসলামগ্রহণে রাজি করানো যায়নি। এ কারণে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তার প্রতি অসন্তোষ ছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. তাঁর সেই নিসতাস নামক গোলামটি উমায়্যাকে দিয়ে দিলেন এবং তার বিনিময়ে হযরত বিলাল রাযি.-কে নিয়ে নিলেন। তারপর তাঁকে মুক্ত করে দিলেন। তিনি এর আগে আরও ৬ জন গোলাম আযাদ করেছিলেন। হযরত বিলাল রাযি. ছিলেন ৭ম ব্যক্তি।
হযরত বিলাল রাযি.-কে আযাদ করে দিলে মুশরিকগণ বলতে লাগল, নিশ্চয়ই আবু বকরের প্রতি বিলালের কোনও অনুগ্রহ ছিল। তার প্রতিদানেই তিনি বিলালকে কিনে মুক্তিদান করেছেন। পরবর্তী আয়াতে এর জবাব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا لِأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى (অথচ তার উপর কারও অনুগ্রহ ছিল না, যার প্রতিদান দিতে হতো)। অর্থাৎ আবু বকর রাযি.-এর উপর বিলাল রাযি.-এর বা অন্য কোনও গোলামের কোনও অনুগ্রহ ছিল না যে, সেই অনুগ্রহের প্রতিদানস্বরূপ তাদেরকে মুক্তিদান করেছেন। বরং এ মুক্তিদানের উদ্দেশ্য কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভ। এটা ভিন্ন কথা যে, কেউ যদি কারও প্রতি অনুগ্রহ করে, তবে যথাসম্ভব তার প্রতিদান দেওয়া চাই। আর কিছু না পারলে অন্ততপক্ষে جَزَاكَ اللهُ (আল্লাহ তোমাকে এর বদলা দিন) বলে দু'আ করা চাই। কিন্তু যারা উচ্চস্তরের মুত্তাকী, তারা এ অপেক্ষায় থাকে না যে, কে কখন তার কোনও উপকার করবে এবং পরে সে তার বদলা দেবে। বরং তারা শুরুতেই পরোপকার করে থাকে। তাদের পরোপকার কোনওকিছুর বিনিময়ে নয়; বরং তা হয় স্বতঃস্ফূর্ত মহানুভবতা। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. এরকমেরই ছিলেন।
إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَى ‘বরং সে (দান করে) কেবল তার মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টির প্রত্যাশায়'। অর্থাৎ কোনও অনুগ্রহের প্রতিদানস্বরূপ নয়; বরং তিনি গরীব-দুঃখীর সাহায্য করেন কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের আশায়।
উল্লেখ্য, যদিও এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে উপলক্ষ্য করে, কিন্তু এর ভাষা ব্যাপক। যে-কোনও মুমিন-মুত্তাকীই এর আওতাভুক্ত। এতে যেসকল গুণের উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যেই তা পাওয়া যাবে তার জন্যই এর বক্তব্যসমূহ প্রযোজ্য হবে এবং শেষের আয়াতে যে পুরস্কারের প্রতি ইশারা করা হয়েছে তা লাভেরও সে উপযুক্ত বলে গণ্য হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَلَسَوْفَ يَرْضَى (নিশ্চয়ই সে অচিরেই খুশি হয়ে যাবে)। অর্থাৎ তার আমলের প্রতিদানে আল্লাহ তা'আলা আখিরাতে তাকে যে জান্নাত ও জান্নাতের অফুরন্ত নি'আমত দান করবেন, তাতে সে আল্লাহর প্রতি খুশি হয়ে যাবে। আয়াতটির এরকম অর্থও করা যায় যে, আল্লাহ তা'আলা তার আমলের বদৌলতে তার প্রতি খুশি হয়ে যাবেন এবং পুরস্কারস্বরূপ তাকে জান্নাতের অপরিমেয় নি'আমত দান করবেন।
প্রকাশ থাকে যে, শানে নুযূল হিসেবে এ আয়াতসমূহ সরাসরি প্রযোজ্য হয় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর প্রতি। এতে তাঁকে الْأَتْقَى (পরম মুত্তাকী বা শ্রেষ্ঠতম মুত্তাকী) বলা হয়েছে। অপরদিকে সূরা হুজুরাতে ইরশাদ হয়েছে- إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ (তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী)। উভয় আয়াত মেলানোর দ্বারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যেহেতু তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী। উম্মতের মধ্যে তিনি যে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান, এ বিষয়ে সকলের ইজমা' ও ঐকমত্য রয়েছে। হযরত উমর রাযি. বলতেন, আবূ বকর আমাদের নেতা। তিনি আমাদের আরেক নেতা (বিলাল রাযি.)-কে আযাদ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কাউকেই আবু বকরের সমতুল্য মনে করতাম না। হযরত আলী রাযি.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর শ্রেষ্ঠ মানুষ কে? তিনি উত্তরে বললেন, আবূ বকর। জিজ্ঞেস করা হল, তারপর? তিনি বললেন, উমর।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. তাকওয়া অবলম্বন করা জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়।
খ. প্রকৃত মুত্তাকী ব্যক্তি নিজ অর্থ-সম্পদ দীনের খেদমত ও মানবসেবায় ব্যয় করে।
গ. আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার দ্বারা আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয়।
ঘ. দীনের খেদমত ও মানবসেবায় অর্থব্যয়ের উদ্দেশ্য হতে হবে কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন।
ঙ. সঠিক খাতে অর্থব্যয় করলে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন এবং তার প্রতিদানে আল্লাহ তা'আলা বান্দাকেও খুশি করেন।
চ. হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. এ উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি।

তিন নং আয়াত
إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيِّئَاتِكُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ (271)
অর্থ : তোমরা দান-সদাকা যদি প্রকাশ্যে দাও, সেও ভালো। আর যদি তা গোপনে গরীবদেরকে দান কর তবে তা তোমাদের পক্ষে কতইনা শ্রেয়! এবং আল্লাহ তোমাদের মন্দকর্মসমূহের প্রায়শ্চিত্ত করে দেবেন। বস্তুত আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৭১)

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে দান-খয়রাত করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। জানানো হয়েছে, তা প্রকাশ্যেও করা যায়, গোপনেও করা যায়। উভয় অবস্থারই প্রশংসা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে এর উপকারিতাও তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমে ইরশাদ হয়েছে-
إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ (তোমরা দান-সদাকা যদি প্রকাশ্যে দাও, সেও ভালো)। অর্থাৎ উদ্দেশ্য যদি হয় কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন করা, মানুষকে দেখানো উদ্দেশ্য না থাকে, তবে প্রকাশ্যে দান করাতে কোনও দোষ নেই। বরং বিভিন্ন কারণে তা ভালো। যেমন এক কারণ হতে পারে তা দেখে অন্যরাও দান করতে উৎসাহী হবে। তাতে তাদের যেমন ছাওয়াব হবে, তেমনি যার দেখাদেখি তারা দান করল, সেও তাদের সমান ছাওয়াবের অধিকারী হবে। এমনিভাবে প্রকাশ্যে দান করার দ্বারা ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের কুধারণা থেকেও বাঁচা যায়। কেননা যাকাত যদি প্রকাশ্যে দেওয়া না হয়, তবে কেউ সন্দেহ করতে পারে সে বুঝি যাকাত দেয়ই না। এতে নিজের দীনী মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। নিজ মর্যাদা রক্ষা করাও জরুরি। তারপর গোপনে দান করা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ (আর যদি তা গোপনে গরীবদেরকে দান কর তবে তা তোমাদের পক্ষে কতইনা শ্রেয়)! বোঝা যাচ্ছে গোপনে দান করাটাই বেশি ভালো। এর দ্বারা রিয়া থেকে বাঁচা যায়। আমলে ইখলাস রক্ষা করা খুব জরুরি। কিন্তু কাজটা খুব সহজ নয়। মন খুব চায় মানুষ জানুক। মানুষ জানলে সুনাম-সুখ্যাতিলাভের আগ্রহ জন্মায়। সুনাম-সুখ্যাতির উদ্দেশ্যে আমল করাটা ইখলাসের পরিপন্থী। আমলে ইখলাস না থাকলে আল্লাহ তা'আলার কাছে তার কোনও মূল্য থাকে না। এ হিসেবে প্রকাশ্যে দান করার চেয়ে গোপনে দান করাটা বেশি নিরাপদ। ইখলাসের অনুকূল হওয়ায় এটাই বেশি ভালো। তাছাড়া গোপনে দান করার দ্বারা যাকে দেওয়া হয় তার পক্ষেও ভালো। কেননা তাতে তার সম্মান রক্ষা পায়। প্রকাশ্যে অন্যের দান-খয়রাত গ্রহণ করার দ্বারা সম্মানহানি ঘটে। সুতরাং বহু হাদীছে গোপনে দান করার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেমন এক হাদীছে হাশরের ময়দানে যে সাত ব্যক্তি আল্লাহর রহমতের ছায়া পাবে, তাদের মধ্যে একজন হল-
وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ
‘ওই ব্যক্তি, যে কোনও দান-সদাকা করে, আর সে তা এমনভাবে গোপন করে যে, তার বাম হাত জানে না ডান হাত কী ব্যয় করে।(সহীহ বুখারী: ৬৬০; সহীহ মুসলিম: ১০৩১; সুনানে নাসাঈ: ৫৩৮০; জামে তিরমিযী: ২৩৯১; মুসনাদে আহমাদ: ৯৬৬৫; সহীহ ইবনে খুজায়মা ৩৫৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৪৮৬)
অপর এক হাদীছে তিন ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তাদেরকে আল্লাহ তা'আলা ভালোবাসেন। তাদের মধ্যে একজন হল-
فرجل أتى قوما فسألهم بالله ولم يسألهم بقرابة بينه وبينهم فمنعوه فتخلف رجل بأعيانهم فأعطاه سرا لا يعلم بعطيته إلا الله والذي أعطاه
‘এক ব্যক্তি কোনও একদল লোকের কাছে গিয়ে আল্লাহর নামেই সাহায্য চাইল, তার এবং তাদের মধ্যকার কোনও আত্মীয়তার ভিত্তিতে নয়। কিন্তু তারা তাকে দিল না। তখন তাদের মধ্য হতে এক ব্যক্তি পেছনে সরে আসল এবং গোপনে তাকে দিল, যা আল্লাহ এবং যাকে সে দিল সে ছাড়া কেউ জানে না।(জামে' তিরমিযী: ২৫৬৮; সুনানে নাসাঈ ১৬১৫; মুসনাদুল বাযযার: ৪০২৭; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১৩১৬; সহীহ ইবন খুযায়মা ২৪৫৬; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩৩৪৯)
এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোপনে দান করার ফযীলত সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-
صَدَقَةُ السِّرِّ تُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ، وَصِلَةُ الرَّحِمِ تَزِيدُ فِي الْعُمُرِ، وَفِعْلُ الْمَعْرُوْفِ بَقِي مَصَارِعَ السُّوْءِ
‘গোপন দান রাব্বুল আলামীনের ক্রোধ নিভিয়ে দেয়। আত্মীয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার আয়ু বৃদ্ধি করে। জনকল্যাণমূলক কাজ অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে।(শু'আবুল ঈমান: ৩১৬৮; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৯৪৩)
উলামায়ে কেরামের অনেকেই বলেন, নফল দান-খয়রাত গোপনে করা ভালো এবং ফরয দান প্রকাশ্যে করা ভালো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, নফল দান-খয়রাত প্রকাশ্যে করা অপেক্ষা গোপনে করলে সত্তর গুণ বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়। আর ফরয দান (যেমন যাকাত) গোপনে না করে প্রকাশ্যে করলে পঁচিশ গুণ বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়। সকল ফরয ও নফল ইবাদতের বেলায়ই এ নিয়ম। এক হাদীছ দ্বারাও এর সমর্থন মেলে। ইরশাদ হয়েছে-
فَصَلُّوا أَيُّهَا النَّاسُ فِي بُيُوتِكُمْ، فَإِنَّ أَفْضَلَ الصَّلَاةِ صَلَاةُ الْمَرْءِ فِي بَيْتِهِ إِلَّا الْمَكْتُوبَةَ
‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের ঘরে নামায পড়ো। কেননা শ্রেষ্ঠ নামায ওই নামায, ব্যক্তি যা নিজ ঘরে পড়ে। তবে ফরয নামায ছাড়া।(সহীহ বুখারী: ৭৩১; সহীহ মুসলিম: ৭৮১; সুনানে আবূ দাউদ: ১০৪৪; সুনানে নাসাঈ: ১৫৯৯; তহাবী, শারহু মাআনিল আছার: ২০৫৭; সহীহ ইবন হিব্বান: ২৪৯১)

অতঃপর আল্লাহ তা'আলা দান-খয়রাত করার উপকার সম্পর্কে ইরশাদ করেন- وَيُكَفِّرُ عَنكُم مِّن سَيِّئَاتِكُمْ (এবং আল্লাহ তোমাদের মন্দকর্মসমূহের প্রায়শ্চিত্ত করে দেবেন)। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে দান-খয়রাত করলে আল্লাহ তা'আলা তার বিনিময়ে বান্দার পাপ ক্ষমা করেন, তাতে দান-খয়রাত প্রকাশ্যে করা হোক বা গোপনে। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الْخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ الْمَاءُ النَّارَ
‘দান-খয়রাত গুনাহ (-এর আগুন) নিভিয়ে দেয়, যেমন পানি আগুন নেভায়।’(জামে' তিরমিযী: ৬১৪; সুনানে ইবন মাজাহ ৩৯৭৩; জামে' মা'মার ইবন রাশিদ: ২১০১৭; মুসনাদুল বাযযার: ৬২১২; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ১১৩৩০; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ১৯৯৯)
وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ (বস্তুত আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে পূর্ণ অবগত)। অর্থাৎ তোমরা গোপনে দান করলে আর কেউ না জানলেও আল্লাহ তা'আলা ঠিকই জানেন। এমনিভাবে তোমরা যে দান-খয়রাত কর, তা কী মনোভাব নিয়ে কর, তাও আল্লাহ তা'আলা জানেন। তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী দানের পরিমাণ সম্পর্কেও তিনি পূর্ণ অবহিত। মোটকথা দান-খয়রাত সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে তিনি সম্যক জ্ঞাত। সেই হিসেবে তিনি তোমাদেরকে দান-খয়রাতের প্রতিদান দেবেন।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. ইখলাসের সঙ্গে প্রকাশ্যে দান করাও ভালো। তার বহুবিধ ফায়দা আছে।
খ. গোপনে দান করা ইখলাস রক্ষার পক্ষে বেশি নিরাপদ। তাই এটাই শ্রেয়।
গ. গোপনে দান করার দ্বারা গ্রহীতার সম্মান রক্ষা হয়। এটা বিবেচনায় রাখা দরকার।
ঘ. দান-খয়রাতের একটা বড় ফায়দা হল এর দ্বারা গুনাহ মাফ হয়।
ঙ. আল্লাহ তা'আলা বান্দার আমল সম্পর্কে পূর্ণ খবর রাখেন। তাই আমল সর্বপ্রযত্নে করা চাই।

চার নং আয়াত
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ (92)
অর্থ: তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে। তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ৯২)

ব্যাখ্যা
الْبِرّ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন সদ্ব্যবহার, অনুগ্রহ, সৎকর্ম, পুণ্য, জান্নাত, পুরস্কার, সততা ও আনুগত্য। সাধারণত এর দ্বারা পরিপূর্ণরূপে অন্যের হক আদায় করা বোঝানো হয়, যা দ্বারা নিজ দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গরূপে সম্পন্ন হয়ে যায়। এভাবে দায়িত্ব পালনকারীকে بر এবং বহুবচনে أَبْرَارٌ বলা হয়। শব্দটি কখনও বান্দার কাজ হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এবং কখনও আল্লাহর কাজ হিসেবেও। বান্দার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে তখন এর অর্থ হবে আনুগত্য, সততা, অনুগ্রহ ইত্যাদি। আর আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে অর্থ হবে সন্তুষ্টি, রহমত ও জান্নাত। কুরআন মাজীদে এ শব্দের বহুল ব্যবহার আছে। এখানে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ (তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না)। এস্থলে الْبِرّ দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য, সে সম্পর্কে মুফাস্সিরগণ বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কারও মতে এর দ্বারা পূর্ণাঙ্গ ছাওয়াব ও প্রতিদান বোঝানো হয়েছে। কেউ বলেন রহমত, কেউ বলেন জান্নাত। এছাড়া যে-কোনও কল্যাণ, আনুগত্য, তাকওয়া, আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি, সত্য ও সততা ইত্যাদি ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। এর সবগুলোই সৎকর্ম বা সৎকর্মের প্রতিদান।
তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না... কথাটির মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে- পুণ্যলাভের চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়; বরং তাই হওয়া উচিত ইহজীবন যাপনের মূল লক্ষ্যবস্তু। বোঝানো হচ্ছে যে, তোমরা তো পুণ্য অর্জন করতে চাওই এবং তা চাওয়াই উচিত। কিন্তু যে-কোনওভাবে দান-খয়রাত করলেই তা পাওয়া যায় না। তা পাওয়া যাবে কেবল তখনই, যখন আল্লাহ তা'আলার নির্দেশিত পন্থায় দান-খয়রাত করবে। কী সে পন্থা, তা পরের বাক্যে শেখানো হয়েছে।
حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ ‘যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে'। অর্থাৎ তোমাদের দ্বারা দান-সদাকার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সৎকর্ম সংঘটিত হবে না, ফলে তার পরিপূর্ণ প্রতিদানও আল্লাহ তা'আলার কাছে লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয়বস্তু থেকে দান কর।
বলা হয়েছে مِمَّا تُحِبُّونَ অর্থাৎ তোমরা যা-কিছু ভালোবাস, যা-কিছুই তোমাদের প্রিয় তা থেকে। বোঝা গেল কেবল প্রিয় অর্থ-সম্পদই নয়, যাবতীয় প্রিয়বস্তু থেকেই দান করতে বলা হয়েছে। সুতরাং অর্থ-সম্পদ দান করা, শক্তি ব্যয় করা, বিদ্যা-বুদ্ধি খরচ করা, মাখলুকের সেবায় নিজ প্রভাব ও ক্ষমতার বৈধ ব্যবহার করা ইত্যাদি সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা'আলার পথে যার যা ব্যয় করার সামর্থ্য আছে, তার মধ্যে সর্বোত্তমটি পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যয় করলেই পূর্ণাঙ্গ প্রতিদান পাওয়া যাবে। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ وَلَسْتُمْ بِآخِذِيهِ إِلَّا أَنْ تُغْمِضُوا فِيهِ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ (267)
‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা-কিছু উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা-কিছু উৎপন্ন করেছি, তার উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ থেকে একটি অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় করো। আর এরূপ মন্দ জিনিস (আল্লাহর নামে) দেওয়ার নিয়ত করো না, যা (অন্য কেউ তোমাদেরকে দিলে ঘৃণার কারণে) তোমরা চক্ষু বন্ধ না করে তা গ্রহণ করবে না। মনে রেখো, আল্লাহ বেনিয়ায়, সর্বপ্রকার প্রশংসা তাঁরই দিকে ফেরে।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৬৭)
প্রিয়বস্তু ব্যয়ের হুকুমের ভেতর ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যে বস্তু যতবেশি প্রিয়, তার দান-খয়রাত ততবেশি উত্তম হবে এবং ততবেশি ছাওয়াব পাওয়া যাবে।
প্রকাশ থাকে যে, এ আয়াতে পরিপূর্ণ প্রতিদানের জন্য প্রিয়বস্তু ব্যয়ের শর্ত করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় যদি প্রিয়বস্তু খরচ করা না হয়, তবু একরকম খরচেরও প্রতিদান অবশ্যই পাওয়া যাবে। কেননা আল্লাহর পথে কোনও খরচই বৃথা যায় না, যদি তা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে।
অবশ্য আল্লাহ চান তাঁর বান্দা তাঁর কাছে সর্বোৎকৃষ্ট পুরস্কার লাভ করুক। সেজন্যই এ আয়াতে প্রিয়বস্তু দান করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
মোটকথা ইখলাসভিত্তিক কোনও দানই বৃথা যায় না। হাঁ, যার দানের মান ও পরিমাণ যেমন হবে, সে সেই অনুপাতেই প্রতিদান লাভ করবে। তাই তো আয়াতের শেষে আছে - وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيْمٌ (তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত)। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর পথে যা ব্যয় কর, তার মান ও পরিমাণ তিনি জানেন এবং সে দানের ক্ষেত্রে তোমাদের আন্তরিকতা কতটুকু, সে সম্পর্কেও তিনি অবগত। তিনি সে অনুসারেই তোমাদেরকে প্রতিদান দেবেন। আবার তিনি যেহেতু সব জানেন, তাই তা প্রকাশ করার কোনও প্রয়োজন নেই। বরং ক্ষতি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্য। গোপনীয়তা রক্ষা করাই শ্রেয়।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. ছাওয়াব ও পুণ্য অর্জন করাই হওয়া উচিত ইহজীবনের যাবতীয় কাজের মুখ্য উদ্দেশ্য।
খ. আল্লাহর দেওয়া অর্থ-সম্পদসহ যাবতীয় নি'আমত থেকে তাঁর পথে খরচ করা চাই।
গ. আল্লাহর পথে যাই খরচ করা হবে, তাতে সর্বোৎকৃষ্ট মান রক্ষা করা চাই।
ঘ. ইখলাসের সঙ্গে যা আল্লাহর পথে দান করা হয়, তার কিছুই বৃথা যায় না।
ঙ. আল্লাহ তা'আলা সর্বজ্ঞানী। তাই ছাওয়াব পাওয়ার জন্য প্রকাশ্যে দান করার কোনও প্রয়োজন নেই।
ঈর্ষণীয় দুই ব্যক্তি
হাদীছ নং: ৫৭০

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দু'টি ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনও ক্ষেত্রে হাসাদ (ঈর্ষা পোষণ) করা যায় না। এক ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং তাকে তা ন্যায় খাতে উজাড় করে দেওয়ার ক্ষমতাও দিয়েছেন। আর ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দিয়েছেন, তারপর সে তার সাহায্যে বিচার-আচার করে এবং তা অন্যকে শিক্ষা দেয়। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭৩; সহীহ মুসলিম: ৮১৫; জামে' তিরমিযী: ১৯৩৬; মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৫১; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২০৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩০২৮১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৩১৬২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা ৭৮২৬; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৩৮)
مقدمة الامام النووي
64 - باب فضل الغَنِيّ الشاكر وهو من أخذ المال من وجهه وصرفه في وجوهه المأمور بِهَا
قَالَ الله تَعَالَى: {فَأَمَّا مَنْ أعْطَى وَاتَّقَى وَصَدَّقَ بِالحُسْنَى فَسَنُيَسِّرُهُ لِليُسْرَى} [الليل: 5 - 7]، وقال تَعَالَى: {وَسَيُجَنَّبُهَا الأَتْقَى الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّى وَمَا لأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى إِلاَّ ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الأَعْلَى وَلَسَوْفَ يَرْضَى} [الليل: 17 - 21]، وقال تَعَالَى: {إنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِي وَإنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الفُقراءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيِّئَاتِكُمْ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ} [البقرة: 271]، وقال تَعَالَى: {لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللهَ بِهِ عَلِيمٌ} [آل عمران: 92] والآيات في فضلِ الإنفاقِ في الطاعاتِ كثيرة معلومة.
570 - وعن عبدِ الله بن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «لاَ حَسَدَ إِلاَّ في اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالًا، فَسَلَّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ فِي الحَقِّ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ حِكْمَةً فَهُوَ يَقضِي بِهَا وَيُعَلِّمُهَا». متفقٌ عَلَيْهِ. (1) وتقدم شرحه قريبًا.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীছটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম বলেছেন- لا حَسَدَ إِلاَّ في اثْنَتَيْنِ (দুই অবস্থা ছাড়া অন্য কোনও অবস্থার প্রতি হাসাদ করা যায় না)। 'হাসাদ' অর্থ ঈর্ষা বা হিংসা। কারও মধ্যে বিশেষ কোনও প্রাপ্তি (অর্থ-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি, ক্ষমতা, সুখ্যাতি প্রভৃতি) দেখে অন্তর্জালা বোধ করা এবং তার থেকে তা লোপ পাওয়ার কামনা করাকে হাসাদ বলে। এটি একটি মন্দ গুণ ও আত্মিক ব্যাধি। মনের ভেতর এ গুণকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়; বরং এর চিকিৎসা জরুরি। কেননা মনের এ অবস্থা যদি অবদমিত হয়ে ওঠে, তবে একে কার্যে পরিণত করারও আশঙ্কা থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত এ অবস্থাকে কার্যে পরিণত করা না হয় বা কার্যে পরিণত করার সংকল্প করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এতে কোনও গুনাহ নেই। যেমন কারও অন্তরে অন্যের ভালো দেখে অন্তর্জালা দেখা দিল এবং কামনা জাগল তার সে ভালোটা যেন দূর হয়ে যায়। কিন্তু তা দূর করার জন্য সে নিজে কোনও চেষ্টা করছে না বা চেষ্টার সংকল্পও করছে না। তবে এ অবস্থায় সে গুনাহগার হবে না। পক্ষান্তরে যদি সেরকম কোনও চেষ্টা করে বা চেষ্টার সংকল্প করে, তবে গুনাহগার হবে। তাই যাতে হাসাদ এ পর্যায়ে পৌঁছতে না পারে, সেজন্য আল্লাহওয়ালাদের পরামর্শ নিয়ে এর চিকিৎসা করা চাই।

আলোচ্য হাদীছে যদিও ‘হাসাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু এর দ্বারা উল্লিখিত অর্থ বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। বরং বোঝানো উদ্দেশ্য ‘গিবতা’ (غِبطَةٌ)। কারও মধ্যে ভালো কিছু দেখে তার বিলুপ্তি কামনা না করে নিজের জন্যও অনুরূপ ভালোর আশা করাকে গিবতা বলে। যেমন কারও সুস্বাস্থ্য দেখে নিজের জন্যও অনুরূপ সুস্বাস্থ্য কামনা করা বা কারও বিদ্যা-বুদ্ধির পরিপক্কতা দেখে নিজের জন্যও অনুরূপ বিদ্যা-বুদ্ধি কামনা করা ইত্যাদি। কুরআনের ভাষায় একে 'মুনাফাসা' বলে। পার্থিব হালাল ও বৈধ বিষয়াবলিতে এটা জায়েয। ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে এটা কাম্য ও প্রশংসনীয়। কুরআন-হাদীছে এর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ (26)
‘এটাই এমন জিনিস, লুব্ধজনদের উচিত এর প্রতি অগ্রগামী হয়ে লোভ প্রকাশ করা।’(সূরা মুতাফফিফীন (৮৩), আয়াত ২৬)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ
‘তোমরা পুণ্যের কাজে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও।’(সূরা বাকারা (২), আয়াত ১৪৮)

হাদীছটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোঝাচ্ছেন, হাসাদ তথা গিবতা যদি করতেই হয়, তবে দু'টি ক্ষেত্রে করবে। কোন দু'টি ক্ষেত্রে করবে, হাদীছের পরবর্তী অংশে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তার একটি হচ্ছে-
رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَسَلَّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ في الحَقّ (এক ঐ ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং তাকে তা ন্যায় খাতে উজাড় করে দেওয়ার ক্ষমতাও দিয়েছেন)। উজাড় করে দেওয়ার অর্থ অকুন্ঠ ও অকৃপণভাবে খরচ করা। তবে তা যে-কোনও ক্ষেত্রে নয়; বরং ন্যায় খাতে। অর্থাৎ এমন কাজে, যাতে ছাওয়াব হয় এবং যা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য লাভ হয়। যেমন আর্ত ও পীড়িতের সেবা, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে সহযোগিতা ইত্যাদি।

প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ তা'আলার পথে খরচ করার জন্য ধনী হওয়া জরুরি নয়। আল্লাহ তা'আলা যাকে যতটুকু মাল দিয়েছেন সে তা থেকেই খরচ করবে, তা বেশি হোক বা কম। সুতরাং অপর এক আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে-
لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا
‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করবে আর যার জীবিকা সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়েছে, (অর্থাৎ যে গরীব) সে, আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকেই খরচ করবে। আল্লাহ যাকে যতটুকু দিয়েছেন তার বেশি ভার তার উপর অর্পণ করেন না।’(সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ৭)

وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ حِكْمَةً فَهُوَ يَقْضِي بِهَا ويُعَلِّمُهَا (আর ওই ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দিয়েছেন, তারপর সে তার সাহায্যে বিচার-আচার করে এবং তা অন্যকে শিক্ষা দেয়)। এখানে জ্ঞান দ্বারা কুরআন-হাদীছের জ্ঞান বোঝানো হয়েছে। যেমন এক বর্ণনায় আছে-
لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِي اثْنَتَيْنِ : رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ القُرْآنَ فَهُوَ يَقُومُ بِهِ آنَاء اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَهُوَ يُنْفِقُهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ
‘দুজন ব্যক্তির অবস্থা ছাড়া অন্য কারও প্রতি হাসাদ (ঈর্ষা পোষণ) করা যায় না। এক ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ কুরআন দিয়েছেন, আর সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তাতে লিপ্ত থাকে। আর ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তা (আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে) খরচ করে।(সহীহ বুখারী : ৭৫২৯; সহীহ মুসলিম: ৮৫১; জামে তিরমিযী: ১৯৩৬; সুনানে ইবন মাজাহ : ৪২০৯; মুসনাদে আহমাদ: ৪৫৫০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৩০২৮২; সহীহ ইবন হিব্বান: ১২৫)

কুরআন নিয়ে লিপ্ত থাকার মানে কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী আমল করা, নামায ও নামাযের বাইরে তিলাওয়াত করা, অন্যকে কুরআন শিক্ষা দেওয়া এবং কুরআন অনুযায়ী ফাতওয়া দেওয়া ও বিচার করা। এ দুই ক্ষেত্রে গিবতা করার অর্থ এরূপ কামনা করা যে, আমারও যদি ওরকম থাকত, তবে আমিও ওইরকম আমল করতাম। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لا حَسَدَ إلَّا في اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ عَلَّمَهُ اللَّهُ القُرْآنَ، فَهو يَتْلُوهُ آناءَ اللَّيْلِ، وآناءَ النَّهارِ، فَسَمِعَهُ جارٌ له، فقالَ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ ما أُوتِيَ فُلانٌ، فَعَمِلْتُ مِثْلَ ما يَعْمَلُ، ورَجُلٌ آتاهُ اللَّهُ مالًا فَهو يُهْلِكُهُ في الحَقِّ، فقالَ رَجُلٌ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ ما أُوتِيَ فُلانٌ، فَعَمِلْتُ مِثْلَ ما يَعْمَلُ.
‘দুজন ব্যক্তির অবস্থা ছাড়া অন্য কারও প্রতি হাসাদ (ঈর্ষা পোষণ) করা যায় না। এক ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ কুরআন দিয়েছেন, আর সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তা তিলাওয়াত করে। এ কথা তার এক প্রতিবেশী শুনল। তখন সে বলল, আমাকেও যদি তার অনুরূপ (কুরআন) দেওয়া হয়, তবে আমিও তার মতো আমল করব। আর ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং সে ন্যায় খাতে তা (আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে) উজাড় করে দেয়। তখন এক ব্যক্তি বলল, আমাকেও যদি তার অনুরূপ (সম্পদ) দেওয়া হয়, তবে আমিও তার মতো আমল করব।(সহীহ বুখারী : ৫০২৬; মুসনাদে আহমাদ: ১০২১৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ৭৮২৭)

বোঝা গেল এরূপ গিবতা করা পসন্দনীয়। অন্য হাদীছ দ্বারা জানা যায়, এর দ্বারাও আমলকারী ব্যক্তির সমান ছাওয়াব পাওয়া যায়। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّمَا الدُّنْيَا لأَرْبَعَةِ نَفَرٍ عَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ مَالاً وَعِلْمًا فَهُوَ يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ وَيَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ وَيَعْلَمُ لِلَّهِ فِيهِ حَقًّا فَهَذَا بِأَفْضَلِ الْمَنَازِلِ وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ عِلْمًا وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالاً فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ يَقُولُ لَوْ أَنَّ لِي مَالاً لَعَمِلْتُ بِعَمَلِ فُلاَنٍ فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ مَالاً وَلَمْ يَرْزُقْهُ عِلْمًا فَهُوَ يَخْبِطُ فِي مَالِهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ لاَ يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ وَلاَ يَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ وَلاَ يَعْلَمُ لِلَّهِ فِيهِ حَقًّا فَهَذَا بِأَخْبَثِ الْمَنَازِلِ وَعَبْدٍ لَمْ يَرْزُقْهُ اللَّهُ مَالاً وَلاَ عِلْمًا فَهُوَ يَقُولُ لَوْ أَنَّ لِي مَالاً لَعَمِلْتُ فِيهِ بِعَمَلِ فُلاَنٍ فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَوِزْرُهُمَا سَوَاءٌ
‘দুনিয়া তো চার ব্যক্তির। (ক) ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ সম্পদ ও ইলম দিয়েছেন। সে তাতে তার প্রতিপালককে ভয় করে, আত্মীয়তা রক্ষা করে, তার ভেতর আল্লাহর হক জেনে নেয় (ও তা আদায় করে)। এটা উচ্চতর স্তর। (খ) ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ ইলম দিয়েছেন, কিন্তু সম্পদ দেননি। সে খাঁটি নিয়তের অধিকারী। সে বলে, আল্লাহ যদি আমাকে সম্পদ দিতেন, তবে অমুকের মতো আমল করতাম। সে তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। এ দুই ব্যক্তির ছাওয়াব ও প্রতিদান সমান। (গ) ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু ইলম দেননি। সে ইলম ব্যতিরেকে তার সম্পদ যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে, তাতে আল্লাহকে ভয় করে না, আত্মীয়তা রক্ষা করে না এবং তাতে আল্লাহর কোনও হক আছে বলে জানে না। এটা নিকৃষ্টতম স্তর। (ঘ) এবং ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ মালও দেননি এবং ইলমও নয়। সে বলে, আমার যদি মাল থাকত, তবে তাতে ওই ব্যক্তির মতো কাজ করতাম। সে তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। এ দুই ব্যক্তির গুনাহ সমান।'(জামে তিরমিযী: ২৩২৫; মুসনাদে আহমাদ: ১৮০৩১; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর : ৮৬৮)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কারও ভালো কিছু দেখে হাসাদ করতে নেই।

খ. গিবতা করা জায়েয। দীনের ক্ষেত্রে তা কাম্য।

গ. সম্পদ আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। ন্যায় খাতে তা খরচ করতে পারা সৌভাগ্যের বিষয়। এ হাদীছ খরচ করতে উৎসাহ যোগায়।

ঘ. সম্পদহীন ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির খাতে ব্যয় করার লক্ষ্যে সম্পদ কামনা করলে তা দূষণীয় নয়।

ঙ. দীনী ইলম আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি'আমত। এ নি'আমত যার আছে তার উচিত আমলে যত্নবান হওয়া।

চ. যার ইলম নেই, তার উচিত আমলের লক্ষ্যে ইলমের আশা করা ও তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করা।

ছ. সঠিক খাতে ইলম ও মালের ব্যবহার আল্লাহ তা'আলার তাওফীকেই সম্ভব। তাই এজন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে তাওফীক প্রার্থনা করা উচিত।

জ. কুরআন শিক্ষা করা, শিক্ষা দেওয়া ও কুরআনের শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখতে পারা বান্দার পক্ষে মহাসৌভাগ্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)