প্রবন্ধ
একদিন নবীজি সা.-এর ঘরে সাহাবারা পাথর ছুড়েছিলেন! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–৪৬
সাহাবায়ে কেরাম রা. ছিলেন আদর্শের মূর্ত প্রতিক। ভদ্রতা, নম্রতা, বিনয়ী চোখ ধাধানো আদর্শে তাঁরা ছিলেন অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবী হলো, সাহাবায়ে কেরাম রা. একবার তারাবীহের সালাতের জন্য নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এন ঘর থেকে বের না হওয়ায় ঘরের দিকে পাথর ছুঁড়েছিলেন। দেখুন, তারা কী লিখেছে,
একবার রমাদান মাসে তিনি এশার পরে নফল সালাহ কায়েম করছেন। বাইরে থেকে তাঁর ক্বেরাতের আওয়াজ শুনে কয়েকজন সাহাবী ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েই রসুলের (সা.) সাথে জামাতে শরীক হয়ে যান। পরদিন এই সংবাদ পেয়ে আরো বেশ কিছু সাহাবী আসেন রসুলের (সা.) সাথে সালাহ কায়েম করার জন্য। কিন্তু সেদিন আর রসুলাল্লাহ সালাতে দাঁড়ান না এবং ঘরের বাইরেও আসেন না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আসহাবগণ উচ্চস্বরে রসুলাল্লাহকে ডাকতে থাকেন এবং তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ঘরের দরজায় ছোট ছোট পাথর ছুঁড়ে মারতে থাকেন। তাঁদের এ আচরণে রাগান্বিত হয়ে রসুলাল্লাহ বেরিয়ে এসে বলেন, ‘তোমরা এখনও আমাকে জোর করছো? আমার আশঙ্কা হয় এই সালাহ তোমাদের জন্য আল্লাহ না ফরদ করে দেন। হে লোকসকল! তোমরা এই সালাহ নিজ নিজ ঘরে গিয়ে কায়েম করো । কারণ কেবলমাত্র ফরদ সালাহ ব্যতীত তোমাদের জন্য সর্বোত্তম সালাহ হচ্ছে সেই সালাহ যা নিজ গৃহে কায়েম করা হয়।” (যায়েদ বিন সাবিত রা. থেকে বোখারী)। –সওমের উদ্দেশ্য, পৃ. ১৮
এই লেখনীর মাধ্যমে তারা সুস্পষ্টভাবে বলল–সাহাবায়ে কেরাম রা. একদিন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঘরে পাথর ছুঁড়েছিলেন।
ইসলাম কী বলে?
কী হাস্যকর দাবী! কতবড় মিথ্যাচারী! কত বড় সাহাবা বিদ্বেষী হলে এমন ডাহা মিথ্যাচার করে সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর সমালোচনা করা যেতে পারে। অথচ পাথর মারার কোনো ঘটনাই সে হাদিসে বর্ণিত নেই। চলুন, আগে হাদিসটি দেখে নেওয়া যাক। হযেত যায়দ ইবনে সাবিত রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم اتَّخَذَ حُجْرَةً قَالَ حَسِبْتُ أَنَّهُ قَالَ مِنْ حَصِيرٍ فِي رَمَضَانَ فَصَلَّى فِيهَا لَيَالِيَ فَصَلَّى بِصَلاَتِهِ نَاسٌ مِنْ أَصْحَابِهِ فَلَمَّا عَلِمَ بِهِمْ جَعَلَ يَقْعُدُ فَخَرَجَ إِلَيْهِمْ فَقَالَ قَدْ عَرَفْتُ الَّذِي رَأَيْتُ مِنْ صَنِيعِكُمْ فَصَلُّوا أَيُّهَا النَّاسُ فِي بُيُوتِكُمْ فَإِنَّ أَفْضَلَ الصَّلاَةِ صَلاَةُ الْمَرْءِ فِي بَيْتِهِ إِلاَّ الْمَكْتُوبَةَ
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাযান মাসে একটি ছোট কামরা বানালেন। তিনি (বুসর ইবনে সায়ীদ রহি.) বলেন, মনে হয়, যায়েদ ইবনে সাবিত রা. কামরাটি চাটাই দিয়ে তৈরি ছিল বলে উল্লেখ্য করেছিলেন। তিনি সেখানে কয়েক রাত সালাত আদায় করেন। আর তাঁর সাহাবীগণের মধ্যে কিছু সাহাবীও তাঁর সঙ্গে সালাত আদায় করেন। তিনি যখন তাঁদের সম্বন্ধে জানতে পারলেন, তখন তিনি বসে থাকলেন। পরে তিনি তাঁদের নিকট এসে বললেন, তোমাদের কার্যকলাপ দেখে আমি বুঝতে পেরেছি। হে লোকেরা! তোমরা তোমাদের ঘরেই সালাত আদায় কর। কেননা, ফরজ সালাত ছাড়া লোকেরা ঘরে যে সালাত আদায় করে তা-ই উত্তম। –সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৭৩১
উক্ত হাদিসে কোথায় আছে যে, সাহাবায়ে কেরাম রা. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঘরের দিকে পাথর মেরেছিলেন? এতবড় ডাহা মিথ্যাচারে শয়তানও কী লজ্জা পায় না? অথচ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শানে যেন বিন্দু পরিমান বেয়াদবী না হয়, সেজন্য মহান আল্লাহপাক আয়াত নাযিল করেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ
হে মুমিনগণ, নিজের আওয়াজকে নবীর আওয়াজ থেকে উঁচু করো না এবং তাঁর সাথে কথা বলতে গিয়ে এমন জোরে বলো না, যেমন তোমরা একে অন্যের সাথে জোরে বলে থাকো, পাছে তোমাদের কর্ম বাতিল হয়ে যায়, তোমাদের অজ্ঞাতসারে। –সুরা হুজুরাত : ২
এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর অবস্থা কেমন ছিলো, তা নিন্মোক্ত দু’টি হাদিস থেকে জানা যায়। হযরত আনাস ইবনু মালিক রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم افْتَقَدَ ثَابِتَ بْنَ قَيْسٍ فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَنَا أَعْلَمُ لَكَ عِلْمَهُ فَأَتَاهُ فَوَجَدَهُ جَالِسًا فِيْ بَيْتِهِ مُنَكِّسًا رَأْسَهُ فَقَالَ لَهُ مَا شَأْنُكَ فَقَالَ شَرٌّ كَانَ يَرْفَعُ صَوْتَهُ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ مِنْ أَهْلِ النَّارِ فَأَتَى الرَّجُلُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَأَخْبَرَهُ أَنَّهُ قَالَ كَذَا وَكَذَا فَقَالَ مُوْسَى فَرَجَعَ إِلَيْهِ الْمَرَّةَ الْآخِرَةَ بِبِشَارَةٍ عَظِيْمَةٍ فَقَالَ اذْهَبْ إِلَيْهِ فَقُلْ لَهُ إِنَّكَ لَسْتَ مِنْ أَهْلِ النَّارِ وَلَكِنَّكَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ
একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাবিত ইবনু কায়স রা. কে খুঁজে পেলেন না। একজন সাহাবী বললেন–হে আল্লাহর রাসুল, আমি আপনার কাছে তাঁর সংবাদ নিয়ে আসছি। তারপর লোকটি তাঁর কাছে গিয়ে দেখলেন যে, তিনি তাঁর ঘরে মাথা নীচু করে বসে আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কী অবস্থা? তিনি বললেন, খারাপ! কারণ এই (অধম) তার আওয়াজ নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আওয়াজের চেয়ে উঁচু করে কথা বলতো। ফলে, তার ’আমল বরবাদ হয়ে গেছে এবং সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে’। তারপর লোকটি নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে ফিরে এসে খবর দিলেন যে, তিনি এমন এমন কথা বলছেন। মুসা বলেন, এরপর লোকটি এক মহাসুসংবাদ নিয়ে তাঁর কাছে ফিরে গেলেন (এবং বললেন) নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন, তুমি যাও এবং তাকে বলো, তুমি জাহান্নামী নও, বরং তুমি জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত। –সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৮৪৬
আরেকটি হাদিস দেখুন, হযরত সায়িব ইবনু ইয়াযীদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كُنْتُ قَائِمًا فِي الْمَسْجِدِ فَحَصَبَنِي رَجُلٌ فَنَظَرْتُ فَإِذَا عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ فَقَالَ اذْهَبْ فَأْتِنِي بِهَذَيْنِ فَجِئْتُهُ بِهِمَا قَالَ مَنْ أَنْتُمَا أَوْ مِنْ أَيْنَ أَنْتُمَا قَالاَ مِنْ أَهْلِ الطَّائِفِ قَالَ لَوْ كُنْتُمَا مِنْ أَهْلِ الْبَلَدِ لَأَوْجَعْتُكُمَا تَرْفَعَانِ أَصْوَاتَكُمَا فِي مَسْجِدِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم
আমি মসজিদে নাববীতে দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় একজন লোক আমার দিকে একটা কংকর নিক্ষেপ করলো। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে, তিনি ‘উমার ইবনুল খাত্তাব রা.। তিনি বললেন, যাও, এ দু’জনকে আমার নিকট নিয়ে এস। আমি তাদের নিয়ে তাঁর নিকট এলাম। তিনি বললেন, তোমরা কারা? অথবা তিনি বললেন, তোমরা কোন স্থানের লোক? তারা বললো, আমরা তায়েফের অধিবাসী। তিনি বললেন, তোমরা যদি মদিনার লোক হতে, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের কঠোর শাস্তি দিতাম। তোমরা দু’জনে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর মসজিদে উচ্চস্বরে কথা বলছো। –সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৭০
সুতরাং বোঝা গেলো, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে উচ্চ গলায় কথা বলাটাও সাহাবাদ রা.-এর কাছে বড় অপরাধ হিশাবে পরিগনিত ছিলো। সেই ‘সাহাবারা রা. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঘরে পাথর ছুঁড়েছেন’ এমন ডাহা মিথ্যাচারীদের উপর আল্লাহর লা’নত।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ (৭ম ও শেষ পর্ব)
খৃষ্টধর্ম কি কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী ধর্ম কোন ধর্মের দাওয়াত ও প্রচারের জন্য ধর্মের কার্যকরিতা জরুরি...
تحریک استشراق کی حقیقت اور استشراقی لٹریچر کے اثرات
تعارف: استشراق( Orientalism ) اور مستشرق کا لغوی و اصطلاحی معنی استشراق عربی زبان کے مادہ( ش۔ر۔ق) سے...
খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ (৫ম পর্ব)
শূলবি দ্ধ হওয়ার বিশ্বাস হযরত ঈসা (আ)-এর সম্পর্কে খ্রিষ্টধর্মের বিশ্বাস হল, ইহুদীরা তাঁকে পন্থীয় পী...
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন