প্রবন্ধ
হজ্ব কোনো ইবাদত নয়, বরং মুসলিম প্রতিনিধিদের বার্ষিক সম্মেলন? হেযবুত তওহীদ। পর্ব–৮৮
হজ্ব নিছক একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও ইসলামের ৫ স্তম্ভের একটি। এটাকে নিছক একটি সম্মেলনের সাথে তুলনা করা ইসলাম বিকৃতির শামিল।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
হেযবুত তওহীদ সেই বিকৃতিটাই করে বসেছে। তারা লিখেছে–
প্রকৃতপক্ষে হজ্ব কোনো ব্যক্তিগত উপাসনা নয়, একে মুসলিম উম্মাহর একটি জাতীয় বা সামষ্টিক অনুষ্ঠান বা মহাসম্মেলন বলা যেতে পারে। –বিশ্বনবী মোহাম্মাদ (দ.) এর ভাষণ, পৃ. ১৯৩
সেই হজ্ব কিন্তু বর্তমানের বিকৃত আকীদার শুধু আধ্যাত্মিক সফর বা তীর্থযাত্রা ছিল না, সেটা ছিল উম্মাহর বাৎসরিক মহা-সম্মেলন। সেখানে একত্র হোয়ে জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ইত্যাদি বিষয়ে সর্বরকম সমস্যা, নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত হোত। হজ্ব ছিল একটি মহাজাতিকে ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখার একটি সুন্দর প্রক্রিয়া৷ –আসুন সিস্টেমটাকেই পাল্টাই, পৃ. ১৪ (পিডিএফ পৃ. ১৮)
আজ যে ব্যক্তিগত 'এবাদতের' আকীদায় হজ্ব করা হয় তা যে আল্লাহর ও তার রসূলের উদ্দেশ্য নয় তার আর এক প্রমাণ হোলো মক্কা ও আরাফাতের চারদিক দিয়ে বহু কিলোমিটার জুড়ে একটি এলাকাকে অমোসলেমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা। এই নিষিদ্ধ করণের উদ্দেশ্য কি? মোসলেমদের হজ্ব করার দৃশ্য অমোসলেমদের দেখাতে মোসলেমদের ক্ষতি কি? মোসলেমদের জামাতের সালাতের দৃশ্য সাম্যের, মানুষের ভ্রাতৃত্বের, ঐক্য ও শৃংখলার এক অপূর্ব দৃশ্য। সালাতের দৃশ্য দেখেই বহু অমোসলেম মুগ্ধ হয়ে এসলাম সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়ে পড়াশোনা করে মোসলেম হোয়ে গেছে। তাহলে এই নিষিদ্ধ করণের কি অর্থ? এক কথায় এর অর্থ রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা (state secret)। যে জাতিটি দুনিয়ার অন্য সব রকম জীবন ব্যবস্থা ভেঙে আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামরত সে জাতির বার্ষিক মহাসম্মেলনে অবশ্যই বহু বিষয়ে আলোচনা, পরামর্শ হবে, সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যেগুলো অতি গোপনীয়। এই গোপনীয়তাকে অমোসলেমদের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য এই সতর্কতা। নইলে যে জীবন ব্যবস্থা, দীনকে সমস্ত পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেওয়ার কথা সেটার কেন্দ্রস্থলকে আড়াল কোরে রাখার কোন মানে হয় না। হজ্ব যদি জাতীয়, রাজনৈতিক সামরিক ইত্যাদি গোপনীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার না হতো, শুধু আধ্যাত্মিক, ব্যক্তিগত ব্যাপার হোতো তবে ঐ নিষিদ্ধকরণ উদ্দেশ্যহীন, অর্থহীন। –বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দ:) এর ভাষণ, পৃ. ১৯০
অর্থাৎ তারা হজ্বকে শুধু বিশ্বসম্মেলন হিশাবেই গণ্য করে থাকে। এবং ইসলামী রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের কাজ বলে বুঝাতে চাচ্ছে।
ইসলাম কী বলে?
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন,
وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالاً وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ، لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ
এবং মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পদযোগে এবং দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রমকারী উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যেগুলো (দীর্ঘ সফরের কারণে) রোগা হয়ে গেছে। যাতে তারা তাদের জন্য স্থাপিত কল্যাণসমূহ প্রত্যক্ষ করে এবং নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে সেই সকল পশুতে যা তিনি তাদেরকে দিয়েছেন। –সুরা হজ্ব : ২৭
উক্ত আয়াতসহ যেসকল আয়াতের মাধ্যমে হজ্ব ফরজ করা হয়েছে, কোনো আয়াত বা হাদিসে ‘মুসলিম রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের জন্যই হজ্ব ফরজ’ এমন কোনো কথা বলা হয়নি। সুতরাং مطلق (শর্তহীন) আয়াতকে مقيد (শর্তারোপ) করা আয়াতের অপব্যাখ্যার শামিল।
উপরন্তু হজ্ব যদি বার্ষিক সম্মেলন হতো, তাহলে প্রতি বছর মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য সেখানে উপস্থিত হওয়া বাধ্যতামূলক বা ফরজ করা হতো। কিন্তু হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ الْأَقْرَعَ بْنَ حَابِسٍ، سَأَلَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، الْحَجُّ فِي كُلِّ سَنَةٍ أَوْ مَرَّةً وَاحِدَةً قَالَ: بَلْ مَرَّةً وَاحِدَةً، فَمَنْ زَادَ فَهُوَ تَطَوُّعٌ
হযরত আকরা’ ইবনু হাবিস রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, হজ্ব কী প্রতি বছরই ফরয, নাকি জিবনে মাত্র একবার? তিনি বললেন, বরং জিবনে একবারই। তবে কেউ অধিক করলে সেটা তার জন্য নফল। –সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং : ১৭২১
উক্ত হাদিস থেকে জানা গেলো, হজ্ব মুসলিমদের কোনো বার্ষিক সম্মেলনের নাম নয়, তাই যদি হতো তাহলে প্রতিবছর প্রত্যেক মুসলিম জনপ্রতিনিধির উপর ফরজ করা হতো। কিন্তু জিবনে একবার ফরজ করা হয়েছে, তাও আবার সামর্থবানদের উপরে। সুতরাং বুঝা গেলো, হজ্ব কোনো বার্ষিক সম্মেলন নয় এবং শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়, বরং এটা সবার ব্যক্তিগত পালনীয় বিষয়।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
খ্রিস্টানদের মহাসভা : খ্রিস্টধর্ম বিকৃতির এক প্রকৃষ্ট প্রমাণ
ভূমিকা প্রচলিত খ্রিস্টবাদ বিকৃত ধর্ম হওয়া একটি সাধারণ বাস্তবতা। তেমনি বাইবেল বা প্রচলিত ‘ইঞ্জিল শরীফ...
খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ (৬ষ্ঠ পর্ব)
তাওরাত সম্পর্কে পৌলের অভিমত কিন্তু সেন্ট পৌলের অভিমত এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি তাওরাতকে একখানি বাতিল ...
কুরআন-হাদীসের ভুল বা অপব্যাখ্যার ব্যাপারে শরী‘আতের নির্দেশ
হিদায়াত কাকে বলে ? আল্লাহ তা ‘ আলা দুনিয়াতে দুটি রাস্তা চালু করেছেন , একটি হিদায়াত এবং জান্নাতের রাস...
উপমহাদেশে নামধারী সুন্নী যারা
ভূমিকা ইসলাম এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যার আকীদা ও আমল নির্ভর করে কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামে...
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন