প্রবন্ধ
ফিরিস্তারা শুধু প্রাকৃতিক শক্তি মাত্র! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–১১
মহান আল্লাহ-র সম্মানিত এক সৃষ্টির নাম ‘ফেরেশতা’। যাঁদেরকে আল্লাহ-র সৈনিক বলে পবিত্র কুরআনে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যাঁরা প্রাণীজগের অন্তুর্ভূক্ত একটি সৃষ্টি। তবে মহান রবের ঘোষণা অনুযায়ী ফেরেশতারা তাঁর অনুগত ও সম্মানিত বান্দা।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
হেযবুত তওহীদের দাবী মতে, ফেরেশতারা শুধু প্রাকৃতিক শক্তি মাত্র। দেখুন, ফেরেশতাদের সম্পর্কে তারা কী লিখেছে,
মানুষকে বিজ্ঞান শেখাবার পর তিনি (আল্লাহ) তার মালায়েকদের ডেকে সব জিনিষের নাম জিজ্ঞেস কোরলেন- তারা বোলতে পারলেন না। কারণ আগেই বোলেছি মালায়েকরা প্রাকৃতিক শক্তি মাত্র। -এ ইসলাম ইসলামই নয়, পৃ. ১৯
সংখ্যায় এরা (ফেরেস্তারা) অগন্য এবং এরা আসলে প্রাকৃতিক শক্তি- যে শক্তি দিয়ে আল্লাহ তার সমস্ত সৃষ্টিকে শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে পরিচালনা করেন এবং এদের কোন ইচ্ছাশক্তি নেই । আল্লাহ যাকে যে নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন, যাকে যে কর্তব্য নির্ধারণ কোরে দিয়েছেন সে ফেরেশতা সামান্যতম বিচ্যুতি না কোরে তা যথাযথ কোরে যাচ্ছেন। আসলে কোন বিচ্যুতি হোতে পারে না- কারণ প্রাকৃতিক শক্তিগুলির কোন স্বাধীন ইচ্ছাই নেই । যেমন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একটি মালায়েক। এর উপর স্রষ্টা কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন সমস্ত কিছুকে আকর্ষণ কোরে ধোরে রাখার। সৃষ্টির প্রথম থেকে এই ফেরেশতা তার কর্তব্য কোরে যাচ্ছেন এবং শেষ পর্যন্ত কোরে যাবেন। তার এতটুকু ইচ্ছা শক্তি নেই যে, এক মুহূর্তের এক ভগ্নাংশের জন্যও তিনি এই কাজের বিরতি দেন, সে ইচ্ছাশক্তি আল্লাহ তাকে দেননি । এমনি আগুন, বাতাস, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তিগুলি- ফেরেশতা, দেব- দেবী। -এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ. ১৬; বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দ.) এর ভাষণ, পৃ. ২০০
সুতরাং বোঝা গেলো, হেযবুত তওহীদের কাছে ফেরেশতারা আলাদা কোনও সৃষ্টি নয়, বরং শুধু প্রাকৃতিক শক্তি মাত্র।
ইসলাম কী বলে?
ফেরেশতারা হলেন আল্লাহপাকের অসাধারণ এক সৃষ্টির নাম। তাঁদেরকে আল্লাহপাক সৃষ্টি করেছেন, আবার তাঁদেরকে মানুষের মতো মৃত্যুও দেবেন। তাঁরা আল্লাহ-র ইবাদত করেন, কেউ তাসবীহ পাঠে, কেউ সিজদায়, কেউ রুকুতে। তারা আল্লাহ-র কাছে তাঁর সম্মানিত ও অনুগত বান্দা এবং তাঁর সৈনিক। চলুন নিন্মে ফেরেশতাদের সম্পর্কে কিছু আয়াত ও হাদিস দেখি–
এক. ফেরেশতারা নূর দ্বারা সৃষ্ট
আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
خُلِقَتِ الْمَلاَئِكَةُ مِنْ نُورٍ وَخُلِقَ الْجَانُّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ وَخُلِقَ آدَمُ مِمَّا وُصِفَ لَكُمْ
ফেরেশতাদেরকে নূর দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর জ্বীন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে নির্ধুম অগ্নিশিখা হতে এবং আদমকে (মানুষকে) সৃষ্টি করা হয়েছে ঐ বস্তু হতে, যে সম্পর্কে তোমাদেরকে বর্ণনা করা হয়েছে। (অর্থাৎ মাটি থেকে)। –সহিহ মুসলিম, হাদিস নং : ২৯৯৬
দুই. ফেরেশতারা আল্লাহ-র সৈনিক
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে নিজের সৈনিক হিশেবে উল্লেখ্য করেছেন। মহান রব্ব বলেন,
وَمَا يَعْلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ
তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানে না। –সুরা মুদ্দাসসির : ৩১
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَاءَتْكُمْ جُنُودٌ فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا وَجُنُودًا لَّمْ تَرَوْهَا ۚ وَكَانَ اللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا
হে মুমিনগণ, আল্লাহ তোমাদের প্রতি সেই সময় কীরূপ অনুগ্রহ করেছিলেন তা স্বরণ করো, যখন বহু সৈন্য তোমাদের প্রতি চড়াও হয়েছিল, তারপর আমি তাদের বিরুদ্ধে এক ঝড়ো হাওয়া পাঠাই এবং এক বাহিনী, যা তোমরা দেখতে পাওনি। আর তোমরা যা-কিছু করছিলে, আল্লাহ তা দেখছিলেন।। –সুরা আহযাব : ৯
তিন. ফেরেশতারা আল্লাহ-র সম্মানিত বান্দা
আরবের কাফেররা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ তাআলার কন্যা বলে আখ্যায়িত করলে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ফেরেশতাদেরকে ‘নিজের অনুগত ও সম্মানিত বান্দা’ হিশেবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। মহান রব বলেন,
وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَٰنُ وَلَدًا ۗ سُبْحَانَهُ ۚ بَلْ عِبَادٌ مُّكْرَمُونَ
তারা বলে, রহমান (আল্লাহ) সন্তান গ্রহণ করেছেন (আর তাঁর সন্তান হলো ফেরেশতাগণ)। সুবহানাল্লাহ! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। -সুরা আম্বিয়া : ২৬
চার. ফেরেশতারা মানুষের প্রহরী হিশাবে কাজ করেন
ফেরেশতাদের অন্যতম একটি কাজ হলো- তাঁরা আল্লাহ-র হুকুমে তাঁরই মর্জিমত মানুষের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন,
لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِّن بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ
প্রত্যেকের সামনে পিছনে এমন প্রহরী (ফেরেশতা) নিযুক্ত আছে, যারা আল্লাহর নির্দেশে পালাক্রমে তার হেফাজত করে। -সুরা রাদ : ১১
পাঁচ. ফেরেশতারা আল্লাহ-র তাসবীহ পড়েন
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,
وَالْمَلَائِكَةُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِمَن فِي الْأَرْضِ
ফেরেশতাগণ তাদের প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে তাসবীহ পাঠ করে এবং পৃথিবীবাসীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। –সুরা শুরা : ৫
অপর আয়াতে আল্লাহপাক বলেন,
يُسَبِّحُونَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لَا يَفْتُرُونَ
তাঁরা (ফেরেশতাগণ) রাত-দিন তাঁর (আল্লাহর) তাসবীহতে লিপ্ত থাকে, কখনও অবসন্ন হয় না। –সুরা আম্বিয়া : ২০
ছয়. ফেরেশতারা সব সময় আল্লাহ-র অনুগত থাকেন
পবিত্র কুরআনে মহান রব বলেন,
وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مِن دَابَّةٍ وَالْمَلَائِكَةُ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ يَخَافُونَ رَبَّهُم مِّن فَوْقِهِمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে, তারা এবং সমস্ত ফেরেশতা আল্লাহকেই সিজদা করে এবং তারা মোটেই অহংকার করে না। তারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, যিনি তাদের উপরে এবং তারা সেই কাজই করে, যার আদেশ তাদেরকে করা হয়। –সুরা নাহল : ৪৯-৫০
وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَٰنُ وَلَدًا ۗ سُبْحَانَهُ ۚ بَلْ عِبَادٌ مُّكْرَمُونَ لَا يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُم بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَىٰ وَهُم مِّنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ
তারা বলে, রহমান (আল্লাহ) সন্তান গ্রহণ করেছেন (আর তাঁর সন্তান হলো ফেরেশতাগণ)। সুবহানাল্লাহ্! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা তাঁকে ডিঙিয়ে কোন কথা বলে না এবং তারা তাঁর আদেশ মতোই কাজ করে। তিনি তাদের সম্মুখ ও পিছনের সবকিছু জানেন। তারা কারও জন্য সুপারিশ করতে পারে না, কেবল তাদের ছাড়া, যাদের জন্য আল্লাহর পছন্দ হয়। তারা তাঁর ভয়ে থাকে ভীত। –সুরা আম্বিয়া : ২৬-২৮
এ ছাড়াও ফেরেশতাদের ক্ষেত্রে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস রয়েছে। যা থেকে প্রমাণ হয়, ফেরেশতারা আল্লাহ-র সম্মানিত বান্দা। তাঁদের মর্যাদা সমুন্নত ও উচ্চ। কথা ও কাজে তাঁরা আল্লাহ-র পরিপূর্ণ অনুগত। তাঁরা আল্লাহ-র আদেশ অমান্য করেন না। আল্লাহ-র আদেশ মান্য করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকেন, বরং আল্লাহ-র নির্দেশই তাঁদের ক্রিয়াশীল করে এবং তাঁদের কাজের সুযোগ করে দেয়। সৃষ্টিজগতের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন ছাড়াও আল্লাহ-র ইবাদতে নিমগ্ন থাকা ফেরেশতাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়াও ফেরেশতাদেে ব্যাপারে কয়েকজনের নাম বর্ণিত হয়েছে। যেমন-রুহ, জিবরাঈল, মিকাইল, ইসরাফিল, রিজওয়ান, মালেক প্রমুখ। তাঁদের পাখা আছে, তাঁরা আকৃতি পরিবর্তন করতে পারেন, তাঁরা নূরের সৃষ্টি ইত্যাদী। সুতরাং ফেরেশতাদেরকে শুধু প্রাকৃতিক সৃষ্টি বলা চরম অন্যায় ও মারাত্মক ধৃষ্টতা।
তাছাড়া হেযবুত তওহীদ ফেরেশতাদেরকে যে প্রাকৃতিক শক্তি বলে আখ্যায়িত করলো, অথচ প্রাকৃতিক শক্তিগুলির মাঝে কোনো অনুভূতি ও আত্মা নেই। অথচ ফেরেশতারা আল্লাহ তাআলার এমন এক সৃষ্টি, যাঁদের মাঝে প্রাণ ও আত্মা বিদ্যমান রয়েছে। কুরআন-হাদিসে ফেরেশতারাদেরকে এমন অনেক অভিধা ও বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত করা হয়েছে যা তাঁদেরকে প্রাণবিশিষ্ট ও শক্তিশালী সৃষ্টি হিশেবে প্রমাণ করে থাকে। তাঁরা উম্মতের পঠিত দরূদ ও সালাম পাঠকারীদের পক্ষ থেকে আল্লাহ-র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রওজায় পৌঁছে দেওয়ার জন্যেও একদল ফেরেশতা নিয়োজিত রয়েছেন। যাঁরা সর্বদা জমিনে বিচরণ করতে থাকেন। জুমআর দিন মসজিদের দরজায় ফেরেশতারা দণ্ডায়মান হয়ে অগ্রগামী মুসল্লীদের তালিকা প্রস্তুত করার কথাও বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত রয়েছে। এ ছাড়াও ফেরেশতারা আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে নবী-রাসুলগণেরর কাছে ওহী আনতেন। আর এটা জানা কথা যে, কোনো প্রাকৃতিক শক্তির পক্ষে ওহী সরবরাহ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ ধরনের আরও অনেক বিষয় আছে, যা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, পন্নী ও হেযবুত তওহীদের ধারণা অনুযায়ী 'ফেরেশতারা প্রাকৃতিক শক্তি' এটা ডাহা মিথ্যাচার। কারণ প্রাকৃতিক শক্তি কখনও আসা-যাওয়া করতে পারে না। তাছাড়া প্রাকৃতিক শক্তি হলে মানুষের আমলও বা লিপিবদ্ধ করেন কীভাবে তাঁরা?
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
উপমহাদেশে নামধারী সুন্নী যারা
ভূমিকা ইসলাম এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যার আকীদা ও আমল নির্ভর করে কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামে...
খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ (১ম পর্ব)
এক. ‘ ইনজীল ’ : ‘ ইনজীল ’ শব্দটি শুনলেই মনে হয়, এটি সেই আসমানী কিতাবের নাম, যা বনী ইসরাঈলের শেষনবী ...
کمیونزم نہیں، اسلام
نام نہاد کمیونزم میں جس قدر مسکین نوازی ہے اس سے کہیں زیادہ امام ولی اللہ رحمہ اللہ تعالٰی کے فلسفے ...
تحریک استشراق کی حقیقت اور استشراقی لٹریچر کے اثرات
تعارف: استشراق( Orientalism ) اور مستشرق کا لغوی و اصطلاحی معنی استشراق عربی زبان کے مادہ( ش۔ر۔ق) سے...
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন