প্রবন্ধ
যাকাতে গুরুত্ব দেওয়া বিকৃত ইসলামের কাজ! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–৯৫
যাকাতের গুরুত্ব সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে প্রচুর পরিমান আলোচনা এসেছে। ইসলামী কিতাবেও হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবী হলো, যাকাত ইসলামের মৌলিক আমলের অন্তুর্ভূক্ত নয়। তাই এটাকে গুরুত্ব দেয়া আসল ইসলামের কাজ নয়। তারা লিখেছে–
বিকৃত এসলামে নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, আত্মার পরিচ্ছন্নতার জন্য নানারকম ঘষামাজা, আধ্যাত্মিক উন্নতির ওপর গুরুত্ব প্রাধান্য দেয়া হোল। কারণ এরা ঐ এবাদত, উপাসনা নিয়ে যত বেশি ব্যস্ত থাকবে ব্রিটিশরা তত নিরাপদ হবে। –এসলাম শুধু নাম থাকবে, পৃ. ১১২
ইসলাম কী বলে?
যাকাত ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোকন ও ইসলামের স্তম্ভ। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হল নামাজ ও যাকাত। এজন্য কুরআন মাজীদে বহু স্থানে নামাজ ও যাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ সওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ۚ وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنفُسِكُم مِّنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِندَ اللَّهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
এবং সালাত কায়েম করো ও যাকাত আদায় করো এবং (স্মরণ রেখো), তোমরা যে-কোনো সৎকর্ম নিজেদের কল্যাণার্থে সম্মুখে প্রেরণ করবে, আল্লাহর কাছে তা পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যে-কোনো কাজ করো, আল্লাহ তা দেখছেন। –সুরা বাকারা : ১১০
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
নামাজ কায়েম করো, যাকাত আদায় করো এবং রাসুলের আনুগত্য করো, যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়।–সুরা নূর : ৫৬
وَالْمُقِيمِينَ الصَّلاَةَ وَالْمُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالْمُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ أُوْلَـئِكَ سَنُؤْتِيهِمْ أَجْرًا عَظِيمًا
যারা নামাজ কায়েমকারী, যাকাতদাতা এবং আল্লাহ ও আখিরাত দিবসে বিশ্বাসী। এরাই তারা, যাদেরকে আমি মহা প্রতিদান দেব। –সুরা নিসা : ১৬২
এছাড়া কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, সালাত ও যাকাতের পাবন্দী ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রশ্নই অবান্তর। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে, যেখানে খাঁটি মু’মিনের গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে, সেখানে সালাত-যাকাতের কথা এসেছে অপরিহার্যভাবে। উপরন্তু হযরত মুআয রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে (ইয়ামানের শাসকরূপে) পাঠাবার সময় বলেছিলেন,
فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لَكَ بِذَلِكَ فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لَكَ بِذَلِكَ فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لَكَ بِذَلِكَ فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ
যদি তারা তোমার এ কথা মেনে নেয়, তবে তাদের বলবে যে, আল্লাহ তাদের উপর দিনে রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেছেন। যদি তারা এ কথাও মেনে নেয়, তবে তাদের বলবে যে, আল্লাহ তাদের উপর সাদাকা (যাকাত) ফরজ করেছেন- যা তাদের ধনীদের নিকট হতে গ্রহণ করা হবে এবং অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া হবে। তোমার এ কথা যদি তারা মেনে নেয়, তবে (কেবল) তাদের উত্তম মাল গ্রহণ হতে বিরত থাকবে এবং মাজলুমের বদ-দুআকে ভয় করবে। কেননা, তার (বদদুআ) এবং আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না। –সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ১৪৯৬
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ؛ فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إلَّا بِحَقِّ الْإِسْلَامِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ تَعَالَى
আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে লড়াই করতে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ্ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসুল। আর তারা সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়। যদি তারা এরূপ করে তবে তারা আমার হাত থেকে নিজেদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করে নেবে, অবশ্য ইসলামের হক যদি তা দাবী করে, তবে আলাদা কথা; আর তাদের হিসাব নেয়ার দায়িত্ব আল্লাহর উপর ন্যস্ত। –সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ২৫
হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
لَمَّا تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَاسْتُخْلِفَ أَبُو بَكْرٍ بَعْدَهُ كَفَرَ مَنْ كَفَرَ مِنَ الْعَرَبِ فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ لأَبِي بَكْرٍ كَيْفَ تُقَاتِلُ النَّاسَ وَقَدْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَمَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ عَصَمَ مِنِّي مَالَهُ وَنَفْسَهُ إِلاَّ بِحَقِّهِ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ " . قَالَ أَبُو بَكْرٍ وَاللَّهِ لأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الزَّكَاةِ وَالصَّلاَةِ فَإِنَّ الزَّكَاةَ حَقُّ الْمَالِ وَاللَّهِ لَوْ مَنَعُونِي عِقَالاً كَانُوا يُؤَدُّونَهُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهِ فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ فَوَاللَّهِ مَا هُوَ إِلاَّ أَنْ رَأَيْتُ أَنَّ اللَّهَ قَدْ شَرَحَ صَدْرَ أَبِي بَكْرٍ لِلْقِتَالِ فَعَرَفْتُ أَنَّهُ الْحَقُّ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর মৃত্যুর পর আবু বকর রা. যখন খলীফা নির্বাচিত হন, তখন আরবের কিছু সংখ্যক লোক কাফির হয়ে যায়। উমার ইবনুল খাত্তাব রা. আবু বকর রা.-কে বললেন, আপনি এদের বিরুদ্ধে কিভাবে অস্ত্ৰধারণ করবেন, অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মানুষ যে পর্যন্ত না আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আর কোন প্ৰভু নেই" এই কথার স্বীকৃতি দেবে, সেই পর্যন্ত আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি। আর যে ব্যক্তি বললো, “আল্লাহ ব্যতীত আর কোন প্ৰভু নেই" সে আমার থেকে তার মাল ও রক্ত (জীবন) নিরাপদ করে নিল। তবে ইসলামের অধিকার সম্পর্কে ভিন্ন কথা। আর তাদের প্রকৃত হিসাব-নিকাশ রয়েছে আল্লাহ তাআলার দায়িত্বে। আবু বকর রা. বললেন–আল্লাহর শপথ নামাজ ও যাকাতের মধ্যে যে ব্যক্তি পার্থক্য করে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবোই। কেননা, যাকাত সম্পদের হক। কেউ উটের একটি রশি দিতেও যদি অস্বীকার করে, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে দিতো, আল্লাহর কসম! আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবোই। তারপর উমার ইবনুল খত্তাব রা. বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি দেখতে পেলাম আল্লাহ যেন যুদ্ধের জন্য আবূ বকরের অন্তর উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। অতঃপর আমি বুঝতে পারলাম যে, তার সিদ্ধান্তই যথার্থ। –সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৬৯২৪
উপরিউক্ত আয়াত ও হাদিসসহ অসংখ্য দলীল রয়েছে যাকাতের গুরুত্বের ওপর। যে যাকাত ইসলামে ফরজ এবং ৫ স্তম্ভের একটি, যার অস্বীকারদের বিরুদ্ধে সাহাবায়ে কেরাম রা. জিহাদ পর্যন্ত করেছেন, সেই যাকাতে গুরুত্ব দেওয়া বিকৃত ইসলামের কাজ? কতবড় জঘন্যতা! ভাবা যায়? তারা কী শুধু এটা বলেই ক্ষ্যান্ত হয়েছে? না, বরং যাকাতে গুরুত্ব দেওয়া খ্রীস্টানদের শিক্ষা বলেও তারা মন্তব্য করেছে। দেখুন তারা কী বলে–
পাশ্চাত্য প্রভুদের আরবি শিক্ষিত পণ্ডিতরা এই নতুন মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যবস্তু নির্ধারণ করলেন। করলেন অতি সতর্কতার সাথে। অতি সতর্কতার সাথে এই দীনের সামরিক দিকটা বাদ দেয়া হলো...বিশেষভাবে স্থান দেওয়া হলো অপ্রয়োজনীয় কিন্তু বিতর্কিত বিষয়গুলি। নামাজ-রোজা, হজ্ব-যাকাতের, ফারায়েজের, বিবি তালাকের, কাপড়-চোপড়ের, দাড়ি-টুপির অবিশ্বাস্য চুলচেরা বিশ্লেষণ ও বিতর্কিত বিষয়ের বিচার। উদ্দেশ্য হলো, এই শিক্ষায় শিক্ষিতরা যেন ঐ ছোটখাটো বিষয়বস্তুর মধ্যেই সীমিত থাকে, ওর উর্ধ্বে যেন উঠতে না পারে। ব্যক্তিগত এবাদতের সুক্ষতম প্রক্রিয়াও এ পাঠ্যবস্তু থেকে বাদ দেয়া গেল না, কিন্তু জাতীয় ব্যাপারে মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে কোণঠাসা করে দেয়া হলো, সম্ভাব হলে একেবারে বাদ দেওয়া হলো। –শিক্ষাব্যবস্থা, পৃ. ২৩
এ জাতির লোকজন ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর উপাসনা, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, দান-খয়রাত ইত্যাদি নানা উপাসনা কোরতে থাকবে এবং জাতীয় জীবনে ব্রিটিশ প্রভুদের আদেশ পালন কোরতে থাকবে; তাদের অধিকার ও শাসন দৃঢ় ও স্থায়ী হবে। এই উদ্দেশ্যে ঐ বিকৃত এসলামে নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, আত্মার পরিচ্ছন্নতার জন্য নানারকম ঘষামাজা, আধ্যাত্মিক উন্নতির ওপর গুরুত্ব ও প্রাধান্য দেয়া হোল। কারণ এরা ঐ এবাদত, উপসনা নিয়ে যত বেশী ব্যস্ত থাকবে ব্রিটিশরা তত নিরাপদ হবে। –যামানার এমামের পত্রাবলী, পৃ. ১০
অর্থাৎ তারা দাবী করলো–
১. যাকাতে গুরুত্ব দেওয়া খ্রীস্টানদের শিক্ষা।
২. যাকাতের উপর গুরুত্ব দিলে খ্রীস্টানদের সুবিধা।
অথচ উপরোল্লিখিত আয়াত ও হাদিসগুলো থেকে বুঝতে পারলাম, যাকাতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া আল্লাহপাক ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রা.এর শিক্ষা। অথচ হেযবুত তওহীদ দাবী করে বসেছে–যাকাত খ্রীস্টানদের শিক্ষা। এখন আপনারাই বলুন, হেযবুত তওহীদ মুসলমান নাকি সিদ্দিকে আকবারের রা. যামানার মুনকিরিনে যাকাতের পেতাত্মা?
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
تحریک استشراق کی حقیقت اور استشراقی لٹریچر کے اثرات
تعارف: استشراق( Orientalism ) اور مستشرق کا لغوی و اصطلاحی معنی استشراق عربی زبان کے مادہ( ش۔ر۔ق) سے...
ইয়াহুদী-খ্রিস্টানদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র মুসলিম উম্মাহর করণীয়
কুরআন-হাদীসে ইয়াহুদী-খ্রিস্টানের পরিচয় ইয়াহুদী জাতি পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতি। আল্লাহ তা'আলা হযরত নূহ আ...
খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ (২য় পর্ব)
আরবদেশে কেন গিয়েছিলেন দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, তিনি দক্ষিণ দামেস্কে আরব এলাকায় কেন গিয়েছিলেন? ইতিপূর্...
খ্রিস্টানদের মহাসভা : খ্রিস্টধর্ম বিকৃতির এক প্রকৃষ্ট প্রমাণ
ভূমিকা প্রচলিত খ্রিস্টবাদ বিকৃত ধর্ম হওয়া একটি সাধারণ বাস্তবতা। তেমনি বাইবেল বা প্রচলিত ‘ইঞ্জিল শরীফ...
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন