রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين
ভূমিকা অধ্যায় - এর পরিচ্ছেদসমূহ
মোট হাদীস ৬৭৯ টি
হাদীস নং: ১৮১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ নসীহত ও কল্যাণকামনা।
النصيحة (নসীহত) অর্থ কল্যাণকামনা। শব্দটির উৎপত্তি نصح الرجل ثوبه (লোকটি তার কাপড় সেলাই করল)-এর থেকে। মূলত কল্যাণ কামনাকারীর কল্যাণ কামনাকে কাপড় সেলাই করার সাথে তুলনা করা হয়েছে। সেলাই করার দ্বারা যেমন ছেঁড়া-ফাঁড়া কাপড় জোড়া লাগানো হয় তার ফাঁকফোকর বন্ধ করে দেওয়া হয়, তেমনি কল্যাণকামনা দ্বারা মানুষের দোষত্রুটি সংশোধন করা হয়। অথবা এর উৎপত্তি نصحت العسل (আমি মধু পরিশোধন করলাম)-এর থেকে। পরিশোধন দ্বারা মধুকে যেমন মোম ও অন্যান্য ময়লা থেকে মুক্ত করা হয়, তেমনি কল্যাণকামী ব্যক্তি যার কল্যাণ কামনা করে তার প্রতি নিজ আচার-আচরণ ধোঁকা, প্রতারণা থেকে মুক্ত রাখে এবং তাকেও ত্রুটিমুক্ত করা ও সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে।
ওয়াজ ও উপদেশকেও নসীহত বলা হয় এ কারণেই যে, তার মধ্যেও কল্যাণকামিতা থাকে এবং উপদেশদাতা যাকে উপদেশ দেয়, মনেপ্রাণে চায় সে যেন সংশোধন হয়ে যায় এবং অন্যায়-অসৎ পথ ছেড়ে ন্যায় ও সত্যের পথে ফিরে আসে।
বস্তুত নসীহত শব্দটি অতি ব্যাপক অর্থবোধক। যাকে নসীহত করা হয় বা যার কল্যাণ কামনা করা হয়, তার সর্বপ্রকার কল্যাণ ও শুভতা এ শব্দের মধ্যে নিহিত। তাই বলা হয়ে থাকে, আরবীতে এমন কোনও একক শব্দ নেই, যা দ্বারা নসীহত শব্দটির অর্থ পুরোপুরি আদায় হতে পারে।
নসীহত ও কল্যাণকামিতা একটি মহৎ গুণ। সমস্ত নবী-রাসূলের মধ্যেই এ গুণ ছিল। তাঁরা আপন আপন উম্মতের প্রতি অধিক কল্যাণকামী ছিলেন। ফলে তাঁদের উম্মত তাঁদেরকে অবর্ণনীয় কষ্ট দেওয়া সত্ত্বেও কখনও তাদের অমঙ্গল কামনা করেননি এবং বদ্দু'আও দেননি; বরং তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আল্লাহ তা'আলার কাছে তাদের হিদায়াতের দু'আ করেছেন। আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের কত কল্যাণকামী ছিলেন তা সকলেরই জানা। তায়েফের লোমহর্ষক ঘটনায় পর্যন্ত তিনি আল্লাহর কাছে দু'আ করেছেন, হে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দাও,তারা বোঝে না। তাদের শাস্তি দেওয়ার প্রস্তাব করা হলে তিনি বলেছিলেন, এরা না হোক, এদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো ঈমান আনবে। তিনি মহান সাহাবীগণকেও এই গুণে উজ্জীবিত করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। এ ব্যাপারে তাদের থেকে অঙ্গীকারও নিয়েছিলেন। তারা সে অঙ্গীকার রক্ষা করেছিলেন এবং জীবনভর তারা মানুষের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করেছিলেন। ইসলাম চায় তার সকল অনুসারী কল্যাণকামিতার গুণে ভূষিত হোক। কেননা এটা এমনই এক গুণ, যা দ্বারা মানুষ তার মানবিক উন্নতি ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষে এতটা উপরে চলে যেতে পারে, যতটা অন্য কিছুর দ্বারা সম্ভব হয় না।
ইমাম আবূ বকর আল-মুযানী রহ. হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সম্পর্কে বলেন, তিনি যে মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যসব সাহাবীর উপরে চলে গিয়েছিলেন তা কিন্তু নামায-রোযা দ্বারা নয়; বরং এমন কিছুর দ্বারা, যা তাঁর অন্তরে বিরাজ করত। তাঁর অন্তরে ছিল গভীর আল্লাহপ্রেম ও আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি নিখুঁত কল্যাণকামিতা।
বিখ্যাত আল্লাহপ্রেমিক ফুযায়ল ইব্ন ইয়ায রহ. বলেন, আমাদের দৃষ্টিতে যারা পূর্ণতা লাভ করেছিলেন তারা তা অত্যধিক নামায-রোযা দ্বারা লাভ করেছিলেন এমন নয়; বরং তারা তা লাভ করেছিলেন মনের বদান্যতা, হৃদয়ের শুদ্ধতা ও উম্মতের প্রতি কল্যাণকামিতার দ্বারা।*
এ সম্পর্কে আছে বহু আয়াত। আছে অনেক হাদীছও। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা হল।
*ইমাম ইবন রজব হাম্বলী, জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম, পৃ. ৯৮।
নসীহত ও কল্যাণকামনা সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
অর্থ : প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১০
ব্যাখ্যা
এটি সূরা হুজুরাতের দশ নং আয়াত। পূর্ণ আয়াতটি এরকম-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
'প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু' ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত করা হয়।'
অর্থাৎ মু'মিন-মুসলিমগণ পরস্পরে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ কিংবা একই বংশীয় না হলেও তাদের মধ্যে ঈমানী ভ্রাতৃত্ব রয়েছে। তাদের মধ্যে ভাষাগত, স্থানগত ও বংশ- গোত্রগত যত পার্থক্য ও যত দূরত্বই থাকুক না কেন, তারা একে অন্যের ভাই। এক ভাইয়ের কর্তব্য আরেক ভাইয়ের প্রতি কল্যাণকামী থাকা এবং কথায় ও কাজে তার উপকার করার চেষ্টা করা।
এর আগের আয়াতে মুসলমানদের মধ্যে পরস্পরে কলহ-বিবাদ দেখা দিলে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারপর এ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, সমস্ত মুসলিম যখন ভাই-ভাই, তখন দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অর্থাৎ মীমাংসা করে দেওয়াটা ভ্রাতৃত্বের দাবি।
পারস্পরিক কলহ-বিবাদ সবরকম অনিষ্ট ডেকে আনে। আত্মকলহ মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংস করে দেয়। কোনও মুসলিমের সামনে তার দুই মুসলিম ভাই আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে নিজ দুনিয়া-আখিরাত ধ্বংস করবে আর সে তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের পরিপন্থী। তার মানে সে নিজে যথার্থ মুসলিম হতে পারেনি। যথার্থ মুসলিম হলে সে তার অপর মুসলিম ভাইয়ের ক্ষতিকে নিজের ক্ষতি বলেই গণ্য করত। ফলে সে তাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং তাদের কলহ মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত।
এ আয়াতের শেষে বলা হয়েছে- তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত করা হয়। অর্থাৎ ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত ও আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিলে তোমাদের প্রতি আল্লাহ রহমত করবেন। তোমরা পরস্পরে শান্তি- শৃঙ্খলার সাথে জীবনযাপন করতে পারবে এবং নির্বিঘ্নে আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে আখিরাতে মুক্তি লাভের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবে।
দুই নং আয়াত
وَقَالَ تَعَالَى إخْبَارًا عَنْ نُوح ﷺ : وَأَنْصَحُ لَكُمْ
অর্থ : আল্লাহ তা'আলা হযরত নূহ আলাইহিস সালামের বাণী বিবৃত করে বলেন,
আমি তোমাদের কল্যাণ কামনা করি।সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৫২
ব্যাখ্যা
এ কথাটি হযরত নূহ আলাইহিস-সালামের। তিনি নিজ কওমকে যখন এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকছিলেন, তখন তারা উল্টো তাঁকে বিপথগামী সাব্যস্ত করতে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে দেব-দেবীর পূজা করাই সঠিক ছিল। বাপ-দাদার আমল থেকে তারা এটাই দেখে আসছে। সেই দেব-দেবীর পূজা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করাকে তারা মেনে নিতে পারছিল না এবং তারা এটাকে সঠিকও মনে করছিল না। তাই হযরত নূহ আলাইহিস সালামকে বিপথগামী ঠাওরাতে শুরু করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেন, আমি মোটেই বিপথগামী নই। আমি তো রাব্বুল "আলামীনের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে রাসূল হয়ে এসেছি। আমি তোমাদের কাছে তাঁর আদেশ-নিষেধ পৌছিয়ে থাকি। তোমরা বিভ্রান্ত বলেই আমাকে চিনতে পারছ না। বস্তুত আমি তোমাদের পরম হিতাকাঙ্ক্ষী। তোমাদের কল্যাণ চাই এবং তোমাদেরকে ভালো ভালো উপদেশ দিই। সুতরাং তোমাদের কর্তব্য- আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করা এবং আমার উপদেশ অনুযায়ী শিরকের অন্ধকার পরিত্যাগ করে তাওহীদের আলোর দিকে চলে আসা এবং এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করে মানবজীবন সার্থক করে তোলা।
তিন নং আয়াত
وَعَنْ هُودٍ ﷺ : وَانَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِينٌ
অর্থ : আর হুদ আলাইহিস সালামের বাণী বিবৃত করেন- 'এবং আমি তোমাদের এক বিশ্বস্ত কল্যাণকামী । সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৬৮
ব্যাখ্যা
এ কথাটি হযরত হূদ 'আলাইহিস সালামের। তাঁকে 'আদ জাতির কাছে নবী করে পাঠানো হয়েছিল। তারাও এক আল্লাহর পরিবর্তে বহু দেব-দেবীর পূজা করত। তিনি যখন তাদেরকে দেব-দেবীর পূজার বিপরীতে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকলেন, তখন তারা তাঁকে নির্বোধ ও মিথ্যুক সাব্যস্ত করল। এরই জবাবে তিনি তাদেরকে এ কথাটি বলেছিলেন। তিনি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, আমি রাব্বুল 'আলামীনের একজন রাসূল। আমি তোমাদের কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছিয়ে থাকি। আমার কোনও কথাই নির্বুদ্ধিতা নয়। তোমরা আপন নির্বুদ্ধিতার কারণে আমার উপদেশকে নির্বুদ্ধিতা ঠাওরাচ্ছ। তোমাদের উচিত মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনা। আমি তোমাদের এক পরম হিতাকাঙ্ক্ষী। আমি একজন বিশ্বস্ত আমানতদাররূপেই তোমাদের মধ্যে পরিচিত। এমন হিতাকাঙ্ক্ষী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তির কথা বুঝতে চেষ্টা করা উচিত। তোমরা যদি তা বোঝ এবং মানতে চেষ্টা কর তবে তোমাদের কল্যাণ হবে, অন্যথায় তোমরা মহাক্ষতির সম্মুখীন হবে।
النصيحة (নসীহত) অর্থ কল্যাণকামনা। শব্দটির উৎপত্তি نصح الرجل ثوبه (লোকটি তার কাপড় সেলাই করল)-এর থেকে। মূলত কল্যাণ কামনাকারীর কল্যাণ কামনাকে কাপড় সেলাই করার সাথে তুলনা করা হয়েছে। সেলাই করার দ্বারা যেমন ছেঁড়া-ফাঁড়া কাপড় জোড়া লাগানো হয় তার ফাঁকফোকর বন্ধ করে দেওয়া হয়, তেমনি কল্যাণকামনা দ্বারা মানুষের দোষত্রুটি সংশোধন করা হয়। অথবা এর উৎপত্তি نصحت العسل (আমি মধু পরিশোধন করলাম)-এর থেকে। পরিশোধন দ্বারা মধুকে যেমন মোম ও অন্যান্য ময়লা থেকে মুক্ত করা হয়, তেমনি কল্যাণকামী ব্যক্তি যার কল্যাণ কামনা করে তার প্রতি নিজ আচার-আচরণ ধোঁকা, প্রতারণা থেকে মুক্ত রাখে এবং তাকেও ত্রুটিমুক্ত করা ও সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে।
ওয়াজ ও উপদেশকেও নসীহত বলা হয় এ কারণেই যে, তার মধ্যেও কল্যাণকামিতা থাকে এবং উপদেশদাতা যাকে উপদেশ দেয়, মনেপ্রাণে চায় সে যেন সংশোধন হয়ে যায় এবং অন্যায়-অসৎ পথ ছেড়ে ন্যায় ও সত্যের পথে ফিরে আসে।
বস্তুত নসীহত শব্দটি অতি ব্যাপক অর্থবোধক। যাকে নসীহত করা হয় বা যার কল্যাণ কামনা করা হয়, তার সর্বপ্রকার কল্যাণ ও শুভতা এ শব্দের মধ্যে নিহিত। তাই বলা হয়ে থাকে, আরবীতে এমন কোনও একক শব্দ নেই, যা দ্বারা নসীহত শব্দটির অর্থ পুরোপুরি আদায় হতে পারে।
নসীহত ও কল্যাণকামিতা একটি মহৎ গুণ। সমস্ত নবী-রাসূলের মধ্যেই এ গুণ ছিল। তাঁরা আপন আপন উম্মতের প্রতি অধিক কল্যাণকামী ছিলেন। ফলে তাঁদের উম্মত তাঁদেরকে অবর্ণনীয় কষ্ট দেওয়া সত্ত্বেও কখনও তাদের অমঙ্গল কামনা করেননি এবং বদ্দু'আও দেননি; বরং তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আল্লাহ তা'আলার কাছে তাদের হিদায়াতের দু'আ করেছেন। আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের কত কল্যাণকামী ছিলেন তা সকলেরই জানা। তায়েফের লোমহর্ষক ঘটনায় পর্যন্ত তিনি আল্লাহর কাছে দু'আ করেছেন, হে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দাও,তারা বোঝে না। তাদের শাস্তি দেওয়ার প্রস্তাব করা হলে তিনি বলেছিলেন, এরা না হোক, এদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো ঈমান আনবে। তিনি মহান সাহাবীগণকেও এই গুণে উজ্জীবিত করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। এ ব্যাপারে তাদের থেকে অঙ্গীকারও নিয়েছিলেন। তারা সে অঙ্গীকার রক্ষা করেছিলেন এবং জীবনভর তারা মানুষের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করেছিলেন। ইসলাম চায় তার সকল অনুসারী কল্যাণকামিতার গুণে ভূষিত হোক। কেননা এটা এমনই এক গুণ, যা দ্বারা মানুষ তার মানবিক উন্নতি ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষে এতটা উপরে চলে যেতে পারে, যতটা অন্য কিছুর দ্বারা সম্ভব হয় না।
ইমাম আবূ বকর আল-মুযানী রহ. হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সম্পর্কে বলেন, তিনি যে মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যসব সাহাবীর উপরে চলে গিয়েছিলেন তা কিন্তু নামায-রোযা দ্বারা নয়; বরং এমন কিছুর দ্বারা, যা তাঁর অন্তরে বিরাজ করত। তাঁর অন্তরে ছিল গভীর আল্লাহপ্রেম ও আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি নিখুঁত কল্যাণকামিতা।
বিখ্যাত আল্লাহপ্রেমিক ফুযায়ল ইব্ন ইয়ায রহ. বলেন, আমাদের দৃষ্টিতে যারা পূর্ণতা লাভ করেছিলেন তারা তা অত্যধিক নামায-রোযা দ্বারা লাভ করেছিলেন এমন নয়; বরং তারা তা লাভ করেছিলেন মনের বদান্যতা, হৃদয়ের শুদ্ধতা ও উম্মতের প্রতি কল্যাণকামিতার দ্বারা।*
এ সম্পর্কে আছে বহু আয়াত। আছে অনেক হাদীছও। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা হল।
*ইমাম ইবন রজব হাম্বলী, জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম, পৃ. ৯৮।
নসীহত ও কল্যাণকামনা সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
অর্থ : প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১০
ব্যাখ্যা
এটি সূরা হুজুরাতের দশ নং আয়াত। পূর্ণ আয়াতটি এরকম-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
'প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু' ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত করা হয়।'
অর্থাৎ মু'মিন-মুসলিমগণ পরস্পরে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ কিংবা একই বংশীয় না হলেও তাদের মধ্যে ঈমানী ভ্রাতৃত্ব রয়েছে। তাদের মধ্যে ভাষাগত, স্থানগত ও বংশ- গোত্রগত যত পার্থক্য ও যত দূরত্বই থাকুক না কেন, তারা একে অন্যের ভাই। এক ভাইয়ের কর্তব্য আরেক ভাইয়ের প্রতি কল্যাণকামী থাকা এবং কথায় ও কাজে তার উপকার করার চেষ্টা করা।
এর আগের আয়াতে মুসলমানদের মধ্যে পরস্পরে কলহ-বিবাদ দেখা দিলে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারপর এ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, সমস্ত মুসলিম যখন ভাই-ভাই, তখন দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অর্থাৎ মীমাংসা করে দেওয়াটা ভ্রাতৃত্বের দাবি।
পারস্পরিক কলহ-বিবাদ সবরকম অনিষ্ট ডেকে আনে। আত্মকলহ মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংস করে দেয়। কোনও মুসলিমের সামনে তার দুই মুসলিম ভাই আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে নিজ দুনিয়া-আখিরাত ধ্বংস করবে আর সে তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের পরিপন্থী। তার মানে সে নিজে যথার্থ মুসলিম হতে পারেনি। যথার্থ মুসলিম হলে সে তার অপর মুসলিম ভাইয়ের ক্ষতিকে নিজের ক্ষতি বলেই গণ্য করত। ফলে সে তাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং তাদের কলহ মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত।
এ আয়াতের শেষে বলা হয়েছে- তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত করা হয়। অর্থাৎ ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত ও আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিলে তোমাদের প্রতি আল্লাহ রহমত করবেন। তোমরা পরস্পরে শান্তি- শৃঙ্খলার সাথে জীবনযাপন করতে পারবে এবং নির্বিঘ্নে আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে আখিরাতে মুক্তি লাভের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবে।
দুই নং আয়াত
وَقَالَ تَعَالَى إخْبَارًا عَنْ نُوح ﷺ : وَأَنْصَحُ لَكُمْ
অর্থ : আল্লাহ তা'আলা হযরত নূহ আলাইহিস সালামের বাণী বিবৃত করে বলেন,
আমি তোমাদের কল্যাণ কামনা করি।সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৫২
ব্যাখ্যা
এ কথাটি হযরত নূহ আলাইহিস-সালামের। তিনি নিজ কওমকে যখন এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকছিলেন, তখন তারা উল্টো তাঁকে বিপথগামী সাব্যস্ত করতে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে দেব-দেবীর পূজা করাই সঠিক ছিল। বাপ-দাদার আমল থেকে তারা এটাই দেখে আসছে। সেই দেব-দেবীর পূজা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করাকে তারা মেনে নিতে পারছিল না এবং তারা এটাকে সঠিকও মনে করছিল না। তাই হযরত নূহ আলাইহিস সালামকে বিপথগামী ঠাওরাতে শুরু করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেন, আমি মোটেই বিপথগামী নই। আমি তো রাব্বুল "আলামীনের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে রাসূল হয়ে এসেছি। আমি তোমাদের কাছে তাঁর আদেশ-নিষেধ পৌছিয়ে থাকি। তোমরা বিভ্রান্ত বলেই আমাকে চিনতে পারছ না। বস্তুত আমি তোমাদের পরম হিতাকাঙ্ক্ষী। তোমাদের কল্যাণ চাই এবং তোমাদেরকে ভালো ভালো উপদেশ দিই। সুতরাং তোমাদের কর্তব্য- আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করা এবং আমার উপদেশ অনুযায়ী শিরকের অন্ধকার পরিত্যাগ করে তাওহীদের আলোর দিকে চলে আসা এবং এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করে মানবজীবন সার্থক করে তোলা।
তিন নং আয়াত
وَعَنْ هُودٍ ﷺ : وَانَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِينٌ
অর্থ : আর হুদ আলাইহিস সালামের বাণী বিবৃত করেন- 'এবং আমি তোমাদের এক বিশ্বস্ত কল্যাণকামী । সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৬৮
ব্যাখ্যা
এ কথাটি হযরত হূদ 'আলাইহিস সালামের। তাঁকে 'আদ জাতির কাছে নবী করে পাঠানো হয়েছিল। তারাও এক আল্লাহর পরিবর্তে বহু দেব-দেবীর পূজা করত। তিনি যখন তাদেরকে দেব-দেবীর পূজার বিপরীতে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকলেন, তখন তারা তাঁকে নির্বোধ ও মিথ্যুক সাব্যস্ত করল। এরই জবাবে তিনি তাদেরকে এ কথাটি বলেছিলেন। তিনি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, আমি রাব্বুল 'আলামীনের একজন রাসূল। আমি তোমাদের কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছিয়ে থাকি। আমার কোনও কথাই নির্বুদ্ধিতা নয়। তোমরা আপন নির্বুদ্ধিতার কারণে আমার উপদেশকে নির্বুদ্ধিতা ঠাওরাচ্ছ। তোমাদের উচিত মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনা। আমি তোমাদের এক পরম হিতাকাঙ্ক্ষী। আমি একজন বিশ্বস্ত আমানতদাররূপেই তোমাদের মধ্যে পরিচিত। এমন হিতাকাঙ্ক্ষী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তির কথা বুঝতে চেষ্টা করা উচিত। তোমরা যদি তা বোঝ এবং মানতে চেষ্টা কর তবে তোমাদের কল্যাণ হবে, অন্যথায় তোমরা মহাক্ষতির সম্মুখীন হবে।
নসীহত ও কল্যাণকামিতার গুরুত্ব
হাদীছ নং: ১৮১
হযরত আবূ রুকাইয়া তামীম ইবন আওস আদ-দারী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, দীন তো কল্যাণকামনারই নাম। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কার জন্য (কল্যাণকামনা)? তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলিমদের ইমামদের (নেতাদের) জন্য এবং সাধারণ মুসলিমদের জন্য -মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯৪৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯২৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪১৯৭)
হাদীছ নং: ১৮১
হযরত আবূ রুকাইয়া তামীম ইবন আওস আদ-দারী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, দীন তো কল্যাণকামনারই নাম। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কার জন্য (কল্যাণকামনা)? তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলিমদের ইমামদের (নেতাদের) জন্য এবং সাধারণ মুসলিমদের জন্য -মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯৪৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯২৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪১৯৭)
مقدمة الامام النووي
22 - باب في النصيحة
قَالَ تَعَالَى: {إِنَّمَا المُؤْمِنُونَ إخْوَةٌ} [الحجرات: 10]، وَقالَ تَعَالَى: إخبارًا عن نوحٍ - صلى الله عليه وسلم: {وَأنْصَحُ لَكُمْ} [الأعراف: 62]، وعن هود - صلى الله عليه وسلم: {وَأنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أمِينٌ} [الأعراف: 68].
قَالَ تَعَالَى: {إِنَّمَا المُؤْمِنُونَ إخْوَةٌ} [الحجرات: 10]، وَقالَ تَعَالَى: إخبارًا عن نوحٍ - صلى الله عليه وسلم: {وَأنْصَحُ لَكُمْ} [الأعراف: 62]، وعن هود - صلى الله عليه وسلم: {وَأنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أمِينٌ} [الأعراف: 68].
181 - فالأول: عن أَبي رُقَيَّةَ تَمِيم بن أوس الداريِّ - رضي الله عنه: أنَّ النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «الدِّينُ النَّصِيحةُ» قلنا: لِمَنْ؟ قَالَ: «لِلهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُولِهِ وَلأئِمَّةِ المُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ (1)». رواه مسلم. (2)
হাদীস নং: ১৮২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ নসীহত ও কল্যাণ কামনা।
দীনের বিশেষ বিশেষ আমলের ব্যাপারে বাই‘আত গ্রহণের বৈধতা ও নসীহতের গুরুত্ব
হাদীছ নং: ১৮২
হযরত জারীর ইবন 'আব্দুল্লাহ রাযি, বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া ও সকল মুসলিমের কল্যাণকামনার বাইআত গ্রহণ করেছি -বুখারী ও মুসলিম।"
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৭; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯২৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪১৭৫)
হাদীছ নং: ১৮২
হযরত জারীর ইবন 'আব্দুল্লাহ রাযি, বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া ও সকল মুসলিমের কল্যাণকামনার বাইআত গ্রহণ করেছি -বুখারী ও মুসলিম।"
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৭; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯২৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪১৭৫)
مقدمة الامام النووي
22 - باب في النصيحة
182 - الثاني: عن جرير بن عبد الله - رضي الله عنه - قَالَ: بَايَعْتُ رسولَ الله - صلى الله عليه وسلم - عَلَى إقَامِ الصَّلاةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، والنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীস নং: ১৮৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ নসীহত ও কল্যাণ কামনা।
প্রকৃত ঈমানদার হতে হলে
হাদীছ নং: ১৮৩
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্যে তা পসন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী হাদীস নং ১৩: সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৪৫। জামে তিরমিযী হাদীস নং ২৫১৫। সুনানে নাসায়ী হাদীস নং ৫০১৬;)
হাদীছ নং: ১৮৩
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্যে তা পসন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী হাদীস নং ১৩: সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৪৫। জামে তিরমিযী হাদীস নং ২৫১৫। সুনানে নাসায়ী হাদীস নং ৫০১৬;)
مقدمة الامام النووي
22 - باب في النصيحة
183 - الثالث: عن أنس - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لا يُؤمِنُ أحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحبُّ لِنَفْسِهِ» (1) مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2)
হাদীস নং: ১৮৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
মুসলিম জাতির দীনী ও আদর্শিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যেমন ব্যক্তিগতভাবে দীনের বিধানাবলী পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার চেষ্টা অব্যাহত রাখা জরুরি, তেমনি সমগ্র জাতিও যাতে দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে সে ব্যাপারেও আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী ভূমিকা রাখা অবশ্যকর্তব্য। কেবল ব্যক্তিগত আমল জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। সমগ্র জাতি বিপথগামী হয়ে গেলে ব্যক্তিগত আমল-আখলাকও ঝুঁকিতে পড়ে যায়। তাই প্রত্যেক মু'মিনের কর্তব্য নিজ আমল-আখলাক রক্ষায় যত্নবান থাকার পাশাপাশি সমগ্র জাতির আমল-আখলাকের হেফাজতেও ভূমিকা রাখা।
অন্যের আমল-আখলাক রক্ষায় ভূমিকা রাখার উপায় কী? আমাদের দীন এ ব্যাপারে যে উপায় শিক্ষা দিয়েছে তার নাম 'আমর বিল মারূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার'। অর্থাৎ সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা।
প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই কিছু না কিছু গাফলাত ও উদাসীনতা বিদ্যমান থাকে। তাই অনেক সময়ই মানুষ সৎকাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে পারে না। সে প্রস্তুতির জন্য নফসের বিরুদ্ধে মুজাহাদা করতে হয়। যারা নফসের বিরুদ্ধে মুজাহাদা ও সাধনা করে নিজেকে সৎকাজের জন্য অভ্যস্ত করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের পক্ষে সহজেই গাফলাত ও উদাসীনতা ঝেড়ে ফেলে সৎকাজে লিপ্ত হয়ে পড়া সম্ভব হয়। কিন্তু যাদের সে মুজাহাদা ও সাধনা করা হয়নি তাদের দ্বারা সৎকাজে গড়িমসি হয়ে যায়। কিন্তু সৎকাজ তো তাদের করতেই হবে। তারা যাতে তা করতে পারে সে লক্ষ্যে অন্যদের উচিত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। সৎকাজের আদেশই হচ্ছে সে সাহায্য। অন্যরা যদি হিকমতের সাথে তাকে সৎকাজের আদেশ দেয়, তার সামনে সৎকাজের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য তুলে ধরে, সৎকাজ না করার ক্ষতি সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে এবং দরদ ও মমত্বের সাথে এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে, তবে আল্লাহ চাহেন তো তার মনে সৎকাজের আগ্রহ জাগবে এবং একপর্যায়ে তা করতে সে প্রস্তুত হয়ে যাবে। সমাজে এ প্রচেষ্টা পর্যাপ্ত পরিমাণে জারি থাকলে ব্যাপক সুফলের আশা থাকে। এর ধারাবাহিকতার সমাজের অধিকাংশ মানুষ সৎকর্মশীল হয়ে ওঠা অসম্ভব কিছু নয়।
সৎকাজের আদেশ দানের পাশাপাশি অসৎকাজে নিষেধ করতে থাকাও জরুরি। কেননা কাম, ক্রোধ, হিংসা, অহমিকা প্রভৃতি রিপুর কারণে মানুষের দ্বারা নানারকম অসৎকর্ম হয়ে যায়। যারা সাধনা ও মুজাহাদা দ্বারা এসব রিপু দমন বা নিস্তেজ করেনি, তারা হামেশাই এর শিকার হয়ে পাপকার্যে লিপ্ত থাকে। আপন ঈমান-আমল ও জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এই শ্রেণীর লোকের পাশে দাঁড়ানোও একান্ত কর্তব্য। তারা যাতে অসৎকর্ম ছেড়ে সুপথে ফিরে আসতে পারে, সে লক্ষ্যেই 'নাহী আনিল মুনকার' বা 'অসৎকাজে নিষেধ'-এর বিধান। আমরা যদি আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এ বিধান মেনে চলি এবং যখনই কাউকে অসৎকর্মে লিপ্ত দেখি তখন দরদের সাথে তাকে এর অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করতে থাকি, তবে আশা করা যায় আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় সে একপর্যায়ে অসৎকর্ম ছেড়ে নিজেকে সংশোধন করতে সক্ষম হবে।
মোটকথা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা ইসলামের এক অবশ্যপালনীয় বিধান। কুরআন ও হাদীছে এর বিশেষ গুরুত্ব ও বিপুল ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বাংলা অনুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ
সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (104)
অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা চাই, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে, সৎকাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজে বাধা দেবে। এরূপ লোকই সফলতা লাভকারী।সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১০৪
ব্যাখ্যা
এর আগের আয়াতে 'আল্লাহর রশি' অর্থাৎ কুরআন মাজীদকে আঁকড়ে ধরে নিজেদের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার তাগিদ করা হয়েছিল। তারপর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, উম্মতের একটি দল যেন সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব পালনে রত থাকে। তারপর বলা হয়েছে, এরাই সফলকাম। যেন জানানো হচ্ছে, মুসলিম জাতির সামষ্টিক ও জাতীয় সাফল্য দু'টি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এক হচ্ছে আল্লাহর রজ্জু কুরআন মাজীদকে শক্তভাবে ধরে রাখা, আর দ্বিতীয় হচ্ছে প্রত্যেকে যাতে শক্তভাবে তা ধরে রাখতে পারে সেজন্য সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎকাজ করতে নিষেধ করা। বিষয়টা এভাবেও বলা যায় যে, একদিকে নিজের ইসলাহ ও সংশোধনে যত্নবান থাকতে হবে, অন্যদিকে অন্যের সংশোধনকল্পে দাওয়াতী মেহনত জারি রাখতে হবে। এ আয়াতে বিশেষভাবে দ্বিতীয় বিষয়ের প্রতি জোর তাগিদ করা হয়েছে।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের জন্য বিশেষ একটি দলের জরুরত
এমনিতে তো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার সাধারণ দায়িত্ব উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর অর্পিত, যা আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী পালন করা অবশ্যকর্তব্য। সে সম্পর্কে সামনে আলোচনা আসছে। এ আয়াতে দাওয়াত সম্পর্কিত বিশেষ দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ উম্মতের মধ্যে সর্বদা এমন একটা দল থাকা চাই, যাদের কাজই হবে সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজ করতে নিষেধ করা। তারা সর্বদা মানুষকে কুরআন ও হাদীছের হিদায়াতের দিকে ডাকবে। ইসলাম যেসকল সৎকর্মের শিক্ষা দিয়েছে মানুষকে তা অবহিত করবে। গাফেল ও উদাসীন মানুষকে সৎকর্ম করতে উৎসাহ দেবে। আর যখনই মানুষকে অন্যায় ও অসৎকর্মে লিপ্ত দেখবে, তখন তাদেরকে সতর্ক করবে এবং যথাসাধ্য তা থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
বলাবাহুল্য, দাওয়াতের কাজকে একটি স্বতন্ত্র যিম্মাদারী হিসেবে গ্রহণ করে নিজেকে তাতে নিয়োজিত রাখা এবং সে যিম্মাদারী সুচারুরূপে পালন করা যে-কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য কোনটা সৎকাজ আর কোনটা অসৎকাজ তা ভালোভাবে জানা থাকা চাই। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, সামাজিক আদব-কায়দা, অর্থ-সম্পদ সংক্রান্ত মাসাইলসহ ইসলামের পরিপূর্ণ রূপরেখা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছাড়া এ দায়িত্ব পালন করতে গেলে যথেষ্ট ভুল-ভ্রান্তির আশঙ্কা রয়েছে। সে কারণেই দীনের পূর্ণাঙ্গ দাওয়াতের দায়িত্ব সাধারণভাবে সকলের ওপর ন্যস্ত না করে বিশেষ একটি দলের ওপর করা হয়েছে। যেমন অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ (122)
'সুতরাং তাদের প্রতিটি বড় দল থেকে একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দীনের উপলব্ধি অর্জনের চেষ্টা করে এবং সতর্ক করে তাদের কওমকে, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে, ফলে তারা (গুনাহ থেকে) সতর্ক থাকবে। সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১২২
আলোচ্য আয়াতের মত এ আয়াতেও মূলত দাওয়াতের বিশেষ স্তরের কথাই বলা হয়েছে।
আলোচ্য আয়াতে বিশেষ দলটির দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা তিনটি কাজ করবে।
ক. তারা 'খায়র' বা কল্যাণের দিকে ডাকবে;
খ. ‘মারূফ’ বা সৎকাজের আদেশ করবে এবং
গ. মুনকার বা অসৎ ও অন্যায় কাজ করতে নিষেধ করবে।
বিশেষ সে দলটির প্রথম কাজ
সর্বপ্রথম বলা হয়েছে- يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ ডাকবে কল্যাণের দিকে। এক বর্ণনায় আল খায়র এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে الخير هو اتباع القرآن وسنتي খায়র হচ্ছে কুরআন এবং আমার সুন্নতের অনুসরণ করা। তাফসীরে ইবনে কাছীর, খণ্ড ২, পৃ. ৭৮ (উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায়)
এর মধ্যে গোটা দীন ও শরীয়ত এসে যায়। এর দ্বারা বোঝানো হচ্ছে, ওই দলটির কাজ হবে নিরবচ্ছিন্নভাবে দীন ও শরীয়তের দাওয়াত দিতে থাকা। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের জন্য তো বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতি দরকার। অর্থাৎ যখন কাউকে কোনও সৎকাজে গড়িমসি করতে দেখা যায়। তখন তাকে সেই সৎকাজের দিকে ডাকার প্রয়োজন হয়। এমনিভাবে যখন কাউকে কোনও অসৎকাজে লিপ্ত থাকতে দেখা যায় তখন তাকে তাতে নিষেধ করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু খায়র ও কল্যাণ তথা দীনের দিকে ডাকার জন্য এরকম কোনও পরিস্থিতির অপেক্ষা করতে হয় না। বরং এটা সবসময়কার কাজ। সবসময় মানুষকে ইসলামের সৌন্দর্য বোঝানো; ইসলামী বিধিবিধান পালনে উৎসাহ দেওয়া এবং নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাতসহ কর্মগত ও আখলাকী বিধানাবলীর গুরুত্ব ও ফযিলতের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই হচ্ছে খায়রের দিকে আহ্বান। কুরআন মাজীদে এটাকে ওই দলটির দায়িত্ব কর্তব্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, খায়র ও কল্যাণের দিকে ডাকার দুটি স্তর আছে।
ক. অমুসলিমকে ইসলামের দিকে ডাকা। আপন আপন যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী এটা সাধারণভাবে প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব। আর বিশেষভাবে এ আয়াতে বর্ণিত দলটির কাজই হবে কথায় ও কাজে সারাবিশ্বের সমস্ত অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেওয়া।
খ. খায়রের দিকে ডাকার দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে, মুসলিম ভাইদেরকে ইসলামী শিক্ষা অনুসরণের প্রতি উৎসাহিত করা। এটা সাধারণভাবে যেমন প্রত্যেক মুসলিমেরই দীনী দায়িত্ব, তেমনি বিশেষভাবে ওই দলটির একান্ত কর্তব্য যারা ইসলামী শিক্ষায় পর্যাপ্ত যোগ্যতা অর্জনের পর দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত থাকাকে নিজেদের যিম্মাদারী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।
বিশেষ দলটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় কাজ
আয়াতে দলটির দ্বিতীয় কাজ বলা হয়েছে, يامرون بالمعروف "তারা সৎকাজের আদেশ দেবে'। মা'রূফ- এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পরিচিত। অর্থাৎ সকলেই যা জানে। এর দ্বারা ওই সকল নেক কাজকে বোঝানো হয় ইসলাম যা করতে আদেশ করেছে এবং প্রত্যেক যুগের নবীগণ আপন আপন উম্মতকে তা করতে উৎসাহ দিয়েছে। যেমন আল্লাহর ইবাদত করা, নবীর আনুগত্য করা, সত্য বলা, আমানতের হিফাজত করা, ওয়াদা রক্ষা করা, আর্ত ও পীড়িতের সাহায্য করা ইত্যাদি। সাধারণভাবে সকল যুগের মানুষ এগুলোকে সৎকর্মরূপে জানে ও চেনে। তাই একে মা'রূফ বা পরিচিত নামে অভিহিত করা হয়েছে।
আয়াতে বর্ণিত দলটির তৃতীয় কাজ বলা হয়েছে, وينهون عن المنكر তারা অসৎকাজে নিষেধ করে'। এর দ্বারা এমনসব অন্যায় ও মন্দকাজ বোঝানো হয়ে থাকে যা করতে ইসলাম নিষেধ করে দিয়েছে এবং অন্যান্য ধর্মেও যা নিষিদ্ধ ছিল। যেমন আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা, নবীর শিক্ষা অগ্রাহ্য করা, মিথ্যা বলা, চুরি করা, আমানতের খেয়ানত করা, ওয়াদা ভঙ্গ করা, গীবত করা, ঝগড়া ফাসাদে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি। 'মুনকার' অর্থ অপরিচিত ও আপত্তিকর বিষয়। সবযুগে সব দীনে এসকল কাজ ছিল আপত্তিকর এবং দীনদারদের কাছে ছিল অপরিচিত তথা দীন বহির্ভূত। সেকারনেই এগুলোকে মুনকার নামে অভিহিত করা হয়েছে।
এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, নিষেধ ও আপত্তি করা যাবে কেবল এমন কাজেই যা দীন বহির্ভূত বলে জানা আছে। সুতরাং দীন ও শরীয়তে যেকাজের ভিত্তি আছে তাতে বাধা দেওয়া বা আপত্তি করার কোনও সুযোগ নেই। বরং তাতে আপত্তি করাই হবে একটি আপত্তিকর কাজ।
উল্লেখ্য, পূর্ণ দায়িত্বশীলতার সাথে এ তিনটি কাজ করতে হলে জরুরি হচ্ছে ইলমী যোগ্যতার পাশাপাশি উত্তম চরিত্র, তাকওয়া-পরহেযগারী, ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত এবং মানুষকে আকর্ষণ করার মত যোগ্যতারও অধিকারী হওয়া। এ প্রসঙ্গে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ, বলেন, দীনে-ইসলাম ও সত্যের বাণী যারা প্রচার করবে তাদেরকে অবশ্যই উত্তম চরিত্র, উৎকৃষ্ট যোগ্যতা, খালেস নিয়ত, হৃদয়ের প্রশস্ততা, সততা ও সত্যবাদিতা, মিষ্টি ভাষা, উদার চরিত্র, পরহিতৈষণা, কষ্টসহিষ্ণুতা এবং ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করার মত প্রশংসনীয় গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। সেইসঙ্গে তাদেরকে এমনও হতে হবে যে, একমুহূর্তের জন্যও লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, রিয়াকারী এবং দুনিয়া লাভের আগ্রহকে নিজেদের অন্তরে স্থান দেবে না।মালফুযাতে কাশ্মীরী, পৃ. ২৯০
দুই নং আয়াত
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
অর্থ : (হে মুসলিমগণ!) তোমরা সেই শ্রেষ্ঠতম দল, মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের অস্তিত্ব দান করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করে থাক ও অন্যায় কাজে বাধা দিয়ে থাক। সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১১০
ব্যাখ্যা
এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ বলা হয়েছে দু'টি-
ক. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা এবং
খ. আল্লাহর প্রতি ঈমান।
প্রশ্ন হতে পারে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা তথা দাওয়াতের দায়িত্ব তো অন্যান্য উম্মতের ওপরও ছিল, যেমন বিভিন্ন আয়াত ও হাদীস দ্বারা জানা যায়। আর বলাবাহুল্য, আল্লাহ তা'আলার প্রতি ঈমানও তাদের ছিল, তা সত্ত্বেও তাদের অপেক্ষা এ উম্মতকে শ্রেষ্ঠ বলার কারণ কী?
এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ
এর জবাব আয়াতের বাচনভঙ্গির মধ্যেই প্রচ্ছন্ন আছে। বলা হয়েছে, 'তোমরা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করে থাক। এর মধ্যে ইশারা রয়েছে যে,
অন্যান্য উম্মতের ওপর এ দায়িত্ব থাকলেও তারা তা পালনে অবহেলা করত। অবহেলার কারণে কুরআন মাজীদের কোনও কোনও আয়াতে তাদেরকে তিরস্কারও করা হয়েছে। এবং সে অবহেলারই পরিণাম হল, তাদের ধর্ম কালপরিক্রমায় বিকৃত ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অপরপক্ষে এ উম্মতের কোনও না কোনও দল এ দায়িত্ব যথারীতি আদায় করে আসছে এবং হাদীসের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী কিয়ামত পর্যন্ত পালন করে যাবে, যে কারণে দীনে ইসলাম অদ্যাবধি তার স্বরূপে সংরক্ষিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে ইনশাআল্লাহ।
সেইসঙ্গে শ্রেষ্ঠত্বের একটা কারণ হল দাওয়াতের পূর্ণাঙ্গতা ও সার্বজনীনতা। অর্থাৎ এ দীন পরিপূর্ণ ও সার্বজনীন হওয়ায় এ উম্মতের দাওয়াতের মধ্যেও পরিপূর্ণতা ও সার্বজনীনতার গুণ বিদ্যমান, যা অন্য কোনও উম্মতের দাওয়াতে ছিল না।
আর দ্বিতীয় বিষয় অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ঈমানও যে অন্যান্য উম্মতের যথাযথ নয়, তাও এ আয়াতে স্পষ্ট। সুতরাং বলা হয়েছে, “কিতাবীগণ যদি ঈমান আনত' অর্থাৎ তারা যদি শেষ নবী ও কুরআন মাজীদের প্রতি ঈমান আনত! আল্লাহ তা'আলার প্রতি ঈমান আনা কেবল তখনই সাব্যস্ত হতে পারে, যখন শেষ নবীর প্রতি ঈমান আনা হবে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
أَتَدْرُونَ مَا الإِيمَانُ بِاللَّهِ وَحْدَهُ» قَالُوا: اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: «شَهَادَةُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ
"তোমরা কি জান এক আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ কী? তারা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৭: বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৮. মুসনাদ আবূ দাউদ ওয়ালিসী, হাদীছ নং ২৮৭
ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানগণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান না আনার কারণে আল্লাহ তা'আলার প্রতি তাদের ঈমানও যথার্থ হয়নি। এমনকি এ কারণে তাদের আপন-আপন নবী ও কিতাবের প্রতিও ঈমান পূর্ণাঙ্গ থাকেনি। ফলে তাদের ঈমান হয়ে গেছে খণ্ডিত ঈমান। পক্ষান্তরে দাওয়াতের মত এ উম্মতের ঈমানও পূর্ণাঙ্গ। তারা কিছুতে ঈমানে আনে, কিছুতে আনে না—এমন নয়। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত যত কিতাব নাযিল হয়েছে ও যত নবী প্রেরিত হয়েছেন, এরা তার সকলের প্রতিই বিশ্বাস রাখে। তাই বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহর প্রতি (অর্থাৎ তার সমস্ত কিতাব ও সমস্ত নবীর প্রতি) ঈমান রাখ। সুতরাং ঈমানের পরিপূর্ণতা এবং সার্বজনীনতার সাথে দাওয়াতের ধারাবাহিকতা রক্ষার ভিত্তিতেই এ উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলা হয়েছে।
সুতরাং আমরা যদি শ্রেষ্ঠ উম্মতের অন্তর্ভুক্ত থাকতে চাই তবে আমাদেরকে অবশ্যই এসকল গুণের অধিকারী হতে হবে। একবার হযরত উমর ফারূক রাযি. আলোচ্য আয়াতটি পাঠ করার পর বললেন-
من سره أن يكون من تلك الأمة فليؤد شرط الله فيها
“যে ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ উম্মতের দলভুক্ত থাকতে চায়, সে যেন এ আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর শর্তসমূহ পূরণ করে।'
তিন নং আয়াত
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)
অর্থ : (হে নবী!) তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে তিনটি আদেশ করা হয়েছে।
ক. ক্ষমাপরায়ণ হওয়া;
খ. সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও
গ. অজ্ঞজনদের অগ্রাহ্য করা।
الْعَفْوَ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে। তার মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে ক্ষমাপরায়ণতা। এ আয়াতটি যখন নাযিল হয় তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত জিবরীল 'আলাইহিস সালামকে এর অর্থ জিজ্ঞেস করেছিলেন। হযরত জিবরীল "আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা'আলার কাছ থেকে জেনে এসে তাঁকে বললেন, এ আয়াতে আপনাকে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে,- যে ব্যক্তি আপনার ওপর জুলুম করবে, আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। - যে ব্যক্তি আপনাকে বঞ্চিত করবে, আপনি তার প্রতি উদারতা প্রদর্শন করবেন। -আর যে ব্যক্তি আপনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আপনি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবেন।
এর সারকথা হচ্ছে অন্যের প্রতি ক্ষমাশীলতার আচরণ করা। এটি একটি মহৎ গুণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা জীবন মানুষের সঙ্গে ক্ষমাশীল হয়েই থেকেছেন। মানুষ কতভাবে তাকে কষ্ট দিয়েছে, কিন্তু তিনি কখনও কারও থেকে প্রতিশোধ নেননি। বরং ক্ষমা করে দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের দিন তাঁর প্রতিশোধ গ্রহণের অবারিত সুযোগ ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রাণের শত্রুদেরকেও এদিন ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন সাধারণ ক্ষমা!
বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উন্নত চরিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর ক্ষমাশীলতাও ছিল অসাধারণ। তা সত্ত্বেও তাঁকে যে এ আদেশ করা হয়েছে তা মূলত উম্মতকে শেখানোর জন্য। সুতরাং সর্বপ্রথম সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের জীবনে এ শিক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। তারপর তাদের দেখাদেখি তাবিঈগণও ক্ষমাপরায়ণতার উচ্চতর দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এভাবে যুগ পরম্পরায় এ উম্মত ক্ষমাশীলতার ব্যাপক চর্চা করে এসেছে। আমাদেরও কর্তব্য জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণে কুরআন মাজীদের এ আদেশ মেনে চলতে সচেষ্ট থাকা।
দ্বিতীয় হুকুম করা হয়েছে সৎকাজের আদেশ দেওয়া সম্পর্কে। العرف শব্দটি প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে ব্যবহৃত المعروف -এর সমার্থক। সর্বপ্রকার সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। অন্যের দেওয়া কষ্ট ও জুলুম ক্ষমা করার পাশাপাশি হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, তাদেরকে সৎকাজের আদেশও কর। কেননা কেবল ক্ষমা দ্বারা জালিম ও কষ্টদাতার সংশোধন নাও হতে পারে। অথচ তার সংশোধনও কাম্য। কেননা সংশোধন যদি না হয়, তবে সে একের পর এক জুলুম করেই যাবে। ফলে তার জুলুম-অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকবে। আর এভাবে অপরাপর মানুষও তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং জুলুম থেকে ফেরানোর জন্য তাকে ন্যায় ও ইনসাফের শিক্ষা দেওয়াও জরুরি। সেজন্যই আদেশ করা হয়েছে যে, সৎকাজের নির্দেশ দাও। এ আদেশ কেবল দুঃখ-কষ্টদাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং সৎকাজের নির্দেশ সকলের জন্যই প্রয়োজন। যারা অসৎকাজ করে তাদের জন্য প্রয়োজন অসৎকাজ থেকে ফেরানোর লক্ষ্যে, আর যারা সৎকাজ করে তারা যাতে তাতে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং সৎকাজে আরও বেশি উন্নতি লাভ করে, সে লক্ষ্যে সৎকাজের উপদেশ তাদের জন্যও উপকারী। যারা এ দায়িত্ব পালনে রত থাকে, তাদের নিজেদেরও এটা দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণ সাধন করে।
এ আয়াতে তৃতীয় নির্দেশ হচ্ছে- অজ্ঞজনদের অগ্রাহ্য কর। অর্থাৎ যারা জুলুম- অত্যাচার করে তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া এবং তাদেরকে সৎকাজের আদেশ দেওয়ার পরও হয়তো দেখা যাবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ অতি জেদী চরিত্রের হওয়ায় নিজেদের সংশোধন করছে না। এত উন্নত আচরণ করা সত্ত্বেও তাদের জীবনে কোনও পরিবর্তন আসছে না। আগের মতই অন্যায় ও অসৎকাজ করে যাচ্ছে। এরূপ ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলা। তাদের অন্যায় আচরণে উত্তেজিত হয়ে গেলে নিজের আখলাক-চরিত্র ক্ষতিক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই তাদের পাশ কাটিয়ে চলাই শ্রেয়। ইবন কাছীর রহ. পাশ কাটানোর একটা ব্যাখ্যা এরকমও করেছেন যে, তাদের দুর্ব্যবহারের উত্তর দুর্ব্যবহার দ্বারা নয়; বরং সদ্ব্যবহার দ্বারা করা চাই। এমন নয় যে,তাদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সৎকাজের আদেশ করা ছেড়ে দেওয়া হল।
হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর একটি ঘটনা
এ প্রসঙ্গে হযরত 'উমর ফারূক রাযি.-এর একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। হযরত "আব্দুল্লাহ ইবন 'আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'উয়াইনা ইবন হিসন (মদীনায়) আগমন করল এবং তার ভাতিজা হুর্র ইবন কায়স রাযি, এর মেহমান হল। হুর্র ইবন কায়স রাযি. ছিলেন ওইসব লোকের একজন, যাদেরকে হযরত উমর রাযি. (তাঁর মজলিসে) নিজের কাছে বসাতেন। হযরত উমর রাযি.-এর মজলিস ও পরামর্শসভার সদস্য হত কারী 'আলেমগণ, প্রৌঢ় হোক বা যুবক।
“উয়াইনা তার ভাতিজাকে বলল, ওহে ভাতিজা! এই আমীরের দরবারে তোমার বিশেষ মর্যাদা আছে। সুতরাং তুমি আমার জন্য তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাও। তিনি অনুমতি চাইলেন। হযরত উমর রাযি, তাঁকে অনুমতি দিলেন। 'উয়াইনা তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, ওহে খাত্তাবের পুত্র! আল্লাহর কসম! তুমি আমাদেরকে বেশি কিছু দিচ্ছ না। এবং আমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করছ না। এ কথায় 'উমর রাযি. রেগে যান। এমনকি তাকে শাস্তি দিতে উদ্যত হন। তখন হুর্র ইবন কায়স রাযি, তাঁকে বললেন, হে আমীরুল মু'মিনীন! আল্লাহ তা'আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছেন-
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)
অর্থ : (হে নবী!) তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯
আর নিশ্চয়ই এ ব্যক্তি অজ্ঞদের একজন। আল্লাহর কসম! হুর্র যখন এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, 'উমর রাযি. আর তার সামনে বাড়লেন না। (অর্থাৎ আয়াতের নির্দেশ লঙ্ঘন করলেন না)। বস্তুত তিনি আল্লাহর কিতাবের (সীমারেখার ভেতর) অতি স্থিরকদম ছিলেন (অর্থাৎ কুরআনের হুকুমের বাইরে পা ফেলতেন না)। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৬৪২, ৭২৮৬
চার নং আয়াত
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
অর্থ : মুমিন নর ও মুমিন নারী পরস্পরে (একে অন্যের) বন্ধু ও সহযোগী। তারা সৎকাজের আদেশ করে, অসৎ কাজে বাধা দেয় । সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৭১
ব্যাখ্যা
এ আয়াতের আগে মুনাফিকদের চরিত্র বর্ণিত হয়েছে। তাতে জানানো হয়েছিল-
الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُمْ مِنْ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمُنْكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوفِ وَيَقْبِضُونَ أَيْدِيَهُمْ نَسُوا اللَّهَ فَنَسِيَهُمْ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ هُمُ الْفَاسِقُونَ (67)
'মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী সকলেই একে অন্যের মত। তারা মন্দ কাজের আদেশ করে ও ভালো কাজে বাধা দেয় এবং তারা নিজেদের হাত বন্ধ করে রাখে। তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। এরপর আল্লাহও তাদেরকে ভুলে গেছেন। নিঃসন্দেহে মুনাফিকগণ ঘোর অবাধ্য। সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৬৭
এতে মুনাফিকদের তিনটি খাসলত বর্ণিত হয়েছিল।
মুনাফিকদের বিপরীতে এ আয়াতে মুমিন নর-নারীর চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে তা নিম্নরূপ।
এক. মুনাফিকরা তো ভালো কাজে বাধা দিয়ে মন্দ কাজে উৎসাহ দেয়। পক্ষান্তরে মু'মিনগণ মানুষকে সৎকাজের আদেশ দেয় এবং মন্দকাজ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করে।
দুই. মুনাফিকরা কৃপণ। দানের বেলায় হাত বন্ধ করে রাখে। কৃপণতার কারণে ভালো কাজে অর্থব্যয় করতে পারে না। পক্ষান্তরে মু'মিনদের হাত খোলা। তারা আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদ থেকে আল্লাহর পথে অকৃপণভাবে খরচ করে।
তিন. মুনাফিকরা আল্লাহ তা'আলাকে ভুলে গেছে। পক্ষান্তরে মু'মিনগণ সর্বদা আল্লাহ তা'আলাকে স্মরণ রাখে, যে কারণে তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে এবং সর্বদা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে চলে।
মু'মিনদের প্রতি ভালোবাসা রাখা খাঁটি ঈমানের পরিচায়ক
লক্ষণীয় হচ্ছে যে, মুনাফিকদের বেলায় বলা হয়েছিল- মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী সকলেই একে অন্যের মত। আর এ আয়াতে মু'মিনদের বেলায় বলা হচ্ছে- মুমিন নর ও মুমিন নারী পরস্পরে (একে অন্যের) বন্ধু ও সহযোগী। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, মুনাফিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক কেবলই পার্থিব স্বার্থে। উপরে উপরে তারা একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক রেখে চলে, কিন্তু অন্তরে কোনও মহব্বত ও ভালোবাসা নেই। পক্ষান্তরে মু'মিনগণ পরস্পরে সেরকম কপট সম্পর্ক রেখে চলে না। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আন্তরিক ও অকৃত্রিম। আর সে কারণেই তারা একে অন্যকে সৎকাজের আদেশ করে এবং অন্যায় কাজে নিষেধ করে। বোঝা যাচ্ছে সৎকাজে আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা বন্ধুত্বের আলামত এবং খাঁটি ঈমানের পরিচায়ক। খাঁটি ঈমানদার সর্বদা অন্যের প্রতি আন্তরিক মহব্বত রাখবে এবং তার সুখ ও দুঃখে তার পাশে থাকবে। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِن كَالْبُنْيَانِ، يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا
'এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য প্রাচীরস্বরূপ, যার একাংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৮১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৮৫; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯২৮; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৬০; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৭৯০
অপর এক হাদীছে ইরশাদ-
«تَرَى المُؤْمِنِينَ فِي تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ، كَمَثَلِ الجَسَدِ، إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالحُمَّى»
'তুমি মুমিনদেরকে পারস্পরিক দয়ামায়া, ভালোবাসা ও সাহায্য-সহযোগিতায় এক দেহের মত দেখতে পাবে, যার কোনও একটি অঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়লে বাকি সব অঙ্গ অনিদ্রা ও উত্তাপে তার অংশীদার হয়ে যায়। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০১১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৮৬; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭২০৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৫৯
এই ঐক্য ও সম্প্রীতির দাবি সর্বদা একে অন্যকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে থাকা। কেননা এক মু'মিনের জন্য অপর মু'মিনের এটাই সবচে' বড় সহযোগিতা।
এ আয়াত প্রমাণ করে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা কেবল মু'মিন পুরুষের নয়; বরং মু'মিন নারীরও দায়িত্ব।
পাঁচ নং আয়াত
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ (78) كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ (79)
অর্থ : বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল, তাদের প্রতি দাউদ ও ঈসা ইবনে মারয়ামের যবানীতে লা'নত বর্ষিত হয়েছিল। তা এ কারণে যে, তারা অবাধ্যতা করেছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত। তারা যেসব অসৎ কাজ করত, তাতে একে অন্যকে নিষেধ করত না। বস্তুত তাদের কর্মপন্থা ছিল অতি মন্দ।সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৭৮-৭৯
ব্যাখ্যা
এ দুই আয়াতে কোনও জাতির ব্যাপকভাবে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়া এবং তাদের মধ্যে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব পরিত্যাক্ত হয়ে যাওয়া বা সে দায়িত্ব আদায়ে চরম অবহেলা দেখা দেওয়ার পার্থিব পরিণামও কত অশুভ হতে পারে, সে সম্পর্কিত দু'টি ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। একটি ঘটনা হযরত দাউদ 'আলাইহিস সালামের যমানার, অপরটি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের যমানার।
হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের যমানার ঘটনা
হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের যমানায় যে ঘটনা ঘটেছিল, কুরআন মাজীদে সংক্ষেপে তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে এরকম-
وَاسْأَلْهُمْ عَنِ الْقَرْيَةِ الَّتِي كَانَتْ حَاضِرَةَ الْبَحْرِ إِذْ يَعْدُونَ فِي السَّبْتِ إِذْ تَأْتِيهِمْ حِيتَانُهُمْ يَوْمَ سَبْتِهِمْ شُرَّعًا وَيَوْمَ لَا يَسْبِتُونَ لَا تَأْتِيهِمْ كَذَلِكَ نَبْلُوهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (163) وَإِذْ قَالَتْ أُمَّةٌ مِنْهُمْ لِمَ تَعِظُونَ قَوْمًا اللَّهُ مُهْلِكُهُمْ أَوْ مُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا قَالُوا مَعْذِرَةً إِلَى رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ (164) فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ أَنْجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (165) فَلَمَّا عَتَوْا عَنْ مَا نُهُوا عَنْهُ قُلْنَا لَهُمْ كُونُوا قِرَدَةً خَاسِئِينَ (166)
এবং তাদের কাছে সাগর তীরে অবস্থিত জনপদবাসীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর, যখন তারা শনিবারের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করত, যখন তাদের (সাগরের) মাছ শনিবার দিন তো পানিতে ভেসে ভেসে তাদের সামনে আসত; আর যখন তারা শনিবার উদ্যাপন করত না, (অর্থাৎ অন্যান্য দিনে) তা আসত না। এভাবে আমি তাদেরকে তাদের উপর্যুপরি অবাধ্যতার কারণে পরীক্ষা করেছিলাম।
এবং (তাদেরকে সেই সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দাও) যখন (শনিবার মাছ শিকার নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তারা কৌশলে তা শিকার করছিল আর তাদের কিছু লোক তাদেরকে উপদেশ দিচ্ছিল এবং এভাবে মাছ শিকার করতে নিষেধ করছিল। এ অবস্থায়) তাদেরই একটি দল (অন্য দলকে যারা মাছ শিকারকারীদেরকে মাছ শিকার করতে নিষেধ করছিল) বলেছিল, তোমরা এমন সব লোককে কেন উপদেশ দিচ্ছ, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে ফেলবেন কিংবা কঠোর শাস্তি দেবেন? তারা বলল, (আমরা এটা করছি) তোমাদের প্রতিপালকের নিকট দায়িত্বমুক্ত হওয়ার জন্য এবং (এ উপদেশ দ্বারা) হতে পারে, তারা তাকওয়া অবলম্বন করবে (এবং শনিবার মাছ শিকার থেকে বিরত হবে)।
তাদেরকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তা যখন তারা ভুলে গেল, তখন অসৎকাজে যারা বাধা দিচ্ছিল তাদেরকে তো আমি রক্ষা করি। কিন্তু যারা সীমালঙ্ঘন করেছিল, উপর্যুপরি অবাধ্যতার কারণে তাদেরকে এক কঠোর শাস্তি দ্বারা আক্রান্ত করি। সুতরাং তাদেরকে যে কাজ করতে (অর্থাৎ শনিবার মাছ শিকার) নিষেধ করা হয়েছিল, তারা যখন তার বিপরীতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করল, তখন আমি তাদেরকে বললাম, ঘৃণিত বানর হয়ে যাও। সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৬৩-১৬৬
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর যামানার ঘটনা
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর যামানার ঘটনাটি ছিল আসমানী খানা সম্পর্কিত। সে সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذْ أَوْحَيْتُ إِلَى الْحَوَارِيِّينَ أَنْ آمِنُوا بِي وَبِرَسُولِي قَالُوا آمَنَّا وَاشْهَدْ بِأَنَّنَا مُسْلِمُونَ (111) إِذْ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ يَاعِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ هَلْ يَسْتَطِيعُ رَبُّكَ أَنْ يُنَزِّلَ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ قَالَ اتَّقُوا اللَّهَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (112) قَالُوا نُرِيدُ أَنْ نَأْكُلَ مِنْهَا وَتَطْمَئِنَّ قُلُوبُنَا وَنَعْلَمَ أَنْ قَدْ صَدَقْتَنَا وَنَكُونَ عَلَيْهَا مِنَ الشَّاهِدِينَ (113) قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا وَآيَةً مِنْكَ وَارْزُقْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ (114) قَالَ اللَّهُ إِنِّي مُنَزِّلُهَا عَلَيْكُمْ فَمَنْ يَكْفُرْ بَعْدُ مِنْكُمْ فَإِنِّي أُعَذِّبُهُ عَذَابًا لَا أُعَذِّبُهُ أَحَدًا مِنَ الْعَالَمِينَ (115)
(এবং তাদের এ ঘটনার বর্ণনাও শোন যে.) যখন হাওয়ারীগণ বলেছিল, হে ঈসা ইবনে মারয়াম! আপনার প্রতিপালক কি আমাদের জন্য আসমান থেকে (খাদ্যের) একটা খাঞ্চা অবতীর্ণ করতে সক্ষম? ঈসা বলল, আল্লাহকে ভয় কর,যদি তোমরা মুমিন হও।
তারা বলল, আমরা চাই যে, তা থেকে খাব এবং আমাদের অন্তর পরিপূর্ণ প্রশান্তি লাভ করবে এবং আমরা (পূর্বাপেক্ষা অধিক প্রত্যয়ের সাথে) জানতে পারব যে,আপনি আমাদেরকে যা কিছু বলেছেন তা সত্য, আর আমরা এ বিষয়ে সাক্ষ্যদাতাদের অন্তর্ভুক্ত হব।
(সুতরাং) ঈসা ইবনে মারয়াম বলল, হে আল্লাহ, আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য আসমান থেকে একটি খাঞ্চা অবতীর্ণ করুন, যা হবে আমাদের এবং আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য আনন্দ উদযাপনের কারণ এবং আপনার পক্ষ হতে একটি নিদর্শন। আমাদেরকে (এ নে'আমত) অবশ্যই প্রদান করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা।
আল্লাহ বললেন, আমি অবশ্যই তোমাদের প্রতি সে খাঞ্চা অবতীর্ণ করব, কিন্তু তারপর তোমাদের মধ্যে যে-কেউ কুফরী করবে আমি তাকে এমন শাস্তি দেব, যে শাস্তি বিশ্ব জগতের অন্য কাউকে দেব না। সূরা মায়েদা (৫), আয়াত ১১২-১১৫
এ সম্পর্কে তিরমিযী শরীফে হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি. থেকে একটি হাদীছ এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
أُنْزِلَتِ المَائِدَةُ مِنَ السَّمَاءِ خُبْزًا وَلَحْمًا, وَأُمِرُوا أَنْ لاَ يَخُونُوا وَلاَ يَدَّخِرُوا لِغَدٍ, فَخَانُوا وَادَّخَرُوا وَرَفَعُوا لِغَدٍ, فَمُسِخُوا قِرَدَةً وَخَنَازِيرَ.
'আসমান থেকে রুটি ও গোশত ভরা খাঞ্চা পাঠানো হল। আদেশ করা হল, তারা যেন খেয়ানত না করে এবং আগামীকালের জন্য জমা করে না রাখে। কিন্তু তারা খেয়ানত করল, জমা করল এবং পরবর্তী দিনের জন্য তুলে রাখল। ফলে তাদেরকে বানর ও শূকরে পরিণত করে দেওয়া হল। জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩০৬১
অসৎকাজে বাধা না দেওয়ার পরিণাম
আলোচ্য আয়াতে জানানো হয়েছে, এ দুই জাতিকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল হযরত দাউদ ও হযরত ঈসা আলাইহিমুস সালামের পক্ষ থেকে লা'নতের কারণে। তাঁরা তাদের প্রতি লা'নত করেছিলেন এ কারণে যে, তারা চরম পাপাচার ও অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় তাদের উচিত ছিল একে অন্যকে পাপাচারে লিপ্ত হতে নিষেধ করা। প্রথম ঘটনায় কিছু লোক নিষেধ করেছিল বটে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না। পরিণামে তাদের ওপর আল্লাহর আযাব ও গযব নেমে আসে। তাদের মানবাকৃতি সম্পূর্ণ বিকৃত করে দেওয়া হয়। ফলে তারা শূকর ও বানরে পরিণত হয়ে যায়।
তাদের এ বিকৃতি কেবল মনের নয়, বরং বাহ্যিক আকৃতিরও। তাদের চেহারা-সুরত সম্পূর্ণরূপেই শূকর ও বানরের মত হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে পৃথিবীতে যে শূকর ও বানর দেখা যায় এরা আগে থেকেই ছিল। এরা তাদের বংশধর নয়। তারা কিছুদিন বিকৃত অবস্থায় থাকার পর ধ্বংস হয়ে যায়।
আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তাঁর পক্ষে মানুষকে শূকর ও বানর করে ফেলা মোটেই অসম্ভব নয়। সুতরাং এ ঘটনাকে অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই।
এই কঠিন শাস্তির একটি বড় কারণ বলা হয়েছে অন্যায়-অপরাধ করতে দেখেও তাতে বারণ না করা। কুরআন মাজীদে তাদের এ ঘটনার উল্লেখ দ্বারা আমাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে তাদের মত অবহেলা যেন আমরা কিছুতেই না করি। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার যে দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে তা যেন অবশ্যই পালন করি। নয়তো আমাদের ক্ষেত্রেও ভয় আছে যে, ব্যাপক পাপাচারের দরুন পাপী ও অপাপী সকলের ওপরই আযাব নেমে আসবে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ (25)
“এবং সেই বিপর্যয়কে ভয় কর, যা বিশেষভাবে তোমাদের মধ্যে যারা জুলুম করে কেবল তাদেরকেই আক্রান্ত করবে না। জেনে রেখ, আল্লাহর আযাব সুকঠিন।সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৫
ছয় নং আয়াত
وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ
অর্থ : বলে দাও, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তো সত্য এসে গেছে। এখন যার ইচ্ছা ঈমান আনুক এবং যার ইচ্ছা কুফর অবলম্বন করুক।'সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ২৯
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ কুরআন মাজীদ এবং এতে যা-কিছু বলা হয়েছে সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা সত্যবাণী, যা তোমাদের শুনিয়ে দেয়া হলো। এখন এতে ঈমান আনা না আনা এবং এর অনুসরণ করা না করা তোমাদের ব্যাপার। যদি এর প্রতি ঈমান আন তাতে তোমাদেরই লাভ। এর অনুসরণ করে চললে দুনিয়ায় শান্তি এবং আখিরাতে মুক্তিলাভ করবে। আর যদি ঈমান না আন এবং এর অনুসরণ করে না চল তবে দুনিয়ায়ও নানান অশান্তি ভোগ করবে আর আখিরাতেও জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। মোটকথা, এতে ঈমান আনা ও না আনার লাভ-ক্ষতি তোমাদেরই, আল্লাহর কিছু আসে যায় না।
এর দ্বারা মূলত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এবং তাঁর পর সমস্ত দাওয়াতদাতাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, তোমাদের কাজ কেবল আন্তরিকতার সাথে দাওয়াত দেওয়া। কে তা শুনল এবং কে শুনল না তার কোনও দায়-দায়িত্ব তোমাদের ওপর নেই। সুতরাং কেউ যদি তোমাদের দাওয়াতে কর্ণপাত না করে সেজন্য আক্ষেপ করো না এবং মেহনত ব্যৰ্থ গেছে বলে হতাশাবোধ করো না। তোমাদের সফলতা দাওয়াত দেওয়ার ভেতর আর তাদের সফলতা তা মানার ভেতর। কাজেই কারো না মানায় হতোদ্যম হয়ে দাওয়াতের কাজ ছেড়ে দিও না।
সাত নং আয়াত
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ
অর্থ : সুতরাং তোমাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হচ্ছে, তা প্রকাশ্যে মানুষকে শুনিয়ে দাও।সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৯৪
ব্যাখ্যা
এটি সুরা হিজরের ৯৪ নং আয়াত। এর আগের আয়াতসমূহে ইয়াহুদী নাসারা ও কাফির মুশরিকদের বিরুদ্ধাচরণ ও শত্রুতামূলক তৎপরতার বিবরণ দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন যুগে তারা নবীর দাওয়াত অগ্রাহ্য করার পাশাপাশি দাওয়াতী মেহনতকে ব্যর্থ করে দেওয়ার লক্ষ্যে কী-সব কূটকৌশল অবলম্বন করত এবং এখনো তা করে যাচ্ছে তা বর্ণনা করার পর এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হুকুম দেওয়া হচ্ছে যে আপনি শত্রুদের আচার-আচরণ অগ্রাহ্য করে আপন দায়িত্ব পালনে রত থাকুন। তাদেরকে মানতে বাধ্য করা আপনার কাজ নয়। আপনার কাজ কেবল দাওয়াত দেওয়া। ব্যস সেকাজ করতে থাকুন। এর দ্বারা সবযুগের দাওয়াতদাতাগণকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে, তাদেরও কর্তব্য আপন দায়িত্বপালনে রত থাকা। অপরপক্ষ কী আচরণ করছে সেদিকে মন দিয়ে পেরেশান ও অস্থির হয়ে পড়া উচিত নয়।
আট নং আয়াত
أَنْجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (165)
অর্থ : তখন অসৎ কাজে যারা বাধা দিচ্ছিল তাদেরকে তো আমি রক্ষা করি। কিন্তু যারা সীমালঙ্ঘন করেছিল, উপর্যুপরি অবাধ্যতার কারণে তাদেরকে এক কঠোর শাস্তি ধরো আক্রান্ত করি। সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৬৫
ব্যাখ্যা
এ আয়াতের শুরুতে আছে فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ তাদেরকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তা যখন তারা ভুলে গেল'। এর দ্বারা বুঝানো হচ্ছে যে, প্রত্যেক জনগোষ্ঠির মধ্যে একদল উপদেশদাতা থাকা চাই। যাদের কাজ হবে মানুষকে সৎকাজের দিকে ডাকা এবং কেউ অন্যায় ও অসৎকাজ করলে তাকে বুঝিয়ে সমঝিয়ে তা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা। সে চেষ্টায় যদি অন্যায় অপরাধকারীগণ সুপথে ফিরে আসে তবে তো ভালো। পক্ষান্তরে তারা যদি আদেশ-উপদেশে কর্ণপাত না করে বরং উপর্যুপরি অন্যায়-অপরাধ করে যায় আর এভাবে জাতির অধিকাংশ মানুষ তাতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে তবে এর পরিণামে তারা আসমানী আযাব ও গযবে ধ্বংস হলেও উপদেশদাতাগণ সে আযাব থেকে নিস্তার পেয়ে যাবে। আর যদি কোনও উপদেশদাতা না থাকে; বরং অন্যের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দেখেও নীরবতা অবলম্বন করা হয়, তবে সে ক্ষেত্রে আসমানী গযব থেকে কেউ নিস্তার পায় না। কেননা নীরবতাও একরকম অপরাধ। ফলে সরাসরি অপরাধকারীদের সঙ্গে নীরবতা অবলম্বনকারীদেরকেও শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা সতর্ক করছেন-
وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ (25)
"এবং সেই বিপর্যয়কে ভয় কর, যা বিশেষভাবে তোমাদের মধ্যে যারা জুলুম করে কেবল তাদেরকেই আক্রান্ত করবে না। জেনে রেখ, আল্লাহর আযাব সুকঠিন। সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৫
এর দ্বারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
কুরআন মাজীদে এসম্পর্কে আরও বহু আয়াত আছে। শিক্ষাগ্রহণের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
মুসলিম জাতির দীনী ও আদর্শিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যেমন ব্যক্তিগতভাবে দীনের বিধানাবলী পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার চেষ্টা অব্যাহত রাখা জরুরি, তেমনি সমগ্র জাতিও যাতে দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে সে ব্যাপারেও আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী ভূমিকা রাখা অবশ্যকর্তব্য। কেবল ব্যক্তিগত আমল জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। সমগ্র জাতি বিপথগামী হয়ে গেলে ব্যক্তিগত আমল-আখলাকও ঝুঁকিতে পড়ে যায়। তাই প্রত্যেক মু'মিনের কর্তব্য নিজ আমল-আখলাক রক্ষায় যত্নবান থাকার পাশাপাশি সমগ্র জাতির আমল-আখলাকের হেফাজতেও ভূমিকা রাখা।
অন্যের আমল-আখলাক রক্ষায় ভূমিকা রাখার উপায় কী? আমাদের দীন এ ব্যাপারে যে উপায় শিক্ষা দিয়েছে তার নাম 'আমর বিল মারূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার'। অর্থাৎ সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা।
প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই কিছু না কিছু গাফলাত ও উদাসীনতা বিদ্যমান থাকে। তাই অনেক সময়ই মানুষ সৎকাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে পারে না। সে প্রস্তুতির জন্য নফসের বিরুদ্ধে মুজাহাদা করতে হয়। যারা নফসের বিরুদ্ধে মুজাহাদা ও সাধনা করে নিজেকে সৎকাজের জন্য অভ্যস্ত করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের পক্ষে সহজেই গাফলাত ও উদাসীনতা ঝেড়ে ফেলে সৎকাজে লিপ্ত হয়ে পড়া সম্ভব হয়। কিন্তু যাদের সে মুজাহাদা ও সাধনা করা হয়নি তাদের দ্বারা সৎকাজে গড়িমসি হয়ে যায়। কিন্তু সৎকাজ তো তাদের করতেই হবে। তারা যাতে তা করতে পারে সে লক্ষ্যে অন্যদের উচিত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। সৎকাজের আদেশই হচ্ছে সে সাহায্য। অন্যরা যদি হিকমতের সাথে তাকে সৎকাজের আদেশ দেয়, তার সামনে সৎকাজের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য তুলে ধরে, সৎকাজ না করার ক্ষতি সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে এবং দরদ ও মমত্বের সাথে এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে, তবে আল্লাহ চাহেন তো তার মনে সৎকাজের আগ্রহ জাগবে এবং একপর্যায়ে তা করতে সে প্রস্তুত হয়ে যাবে। সমাজে এ প্রচেষ্টা পর্যাপ্ত পরিমাণে জারি থাকলে ব্যাপক সুফলের আশা থাকে। এর ধারাবাহিকতার সমাজের অধিকাংশ মানুষ সৎকর্মশীল হয়ে ওঠা অসম্ভব কিছু নয়।
সৎকাজের আদেশ দানের পাশাপাশি অসৎকাজে নিষেধ করতে থাকাও জরুরি। কেননা কাম, ক্রোধ, হিংসা, অহমিকা প্রভৃতি রিপুর কারণে মানুষের দ্বারা নানারকম অসৎকর্ম হয়ে যায়। যারা সাধনা ও মুজাহাদা দ্বারা এসব রিপু দমন বা নিস্তেজ করেনি, তারা হামেশাই এর শিকার হয়ে পাপকার্যে লিপ্ত থাকে। আপন ঈমান-আমল ও জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এই শ্রেণীর লোকের পাশে দাঁড়ানোও একান্ত কর্তব্য। তারা যাতে অসৎকর্ম ছেড়ে সুপথে ফিরে আসতে পারে, সে লক্ষ্যেই 'নাহী আনিল মুনকার' বা 'অসৎকাজে নিষেধ'-এর বিধান। আমরা যদি আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এ বিধান মেনে চলি এবং যখনই কাউকে অসৎকর্মে লিপ্ত দেখি তখন দরদের সাথে তাকে এর অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করতে থাকি, তবে আশা করা যায় আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় সে একপর্যায়ে অসৎকর্ম ছেড়ে নিজেকে সংশোধন করতে সক্ষম হবে।
মোটকথা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা ইসলামের এক অবশ্যপালনীয় বিধান। কুরআন ও হাদীছে এর বিশেষ গুরুত্ব ও বিপুল ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বাংলা অনুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ
সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (104)
অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা চাই, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে, সৎকাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজে বাধা দেবে। এরূপ লোকই সফলতা লাভকারী।সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১০৪
ব্যাখ্যা
এর আগের আয়াতে 'আল্লাহর রশি' অর্থাৎ কুরআন মাজীদকে আঁকড়ে ধরে নিজেদের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার তাগিদ করা হয়েছিল। তারপর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, উম্মতের একটি দল যেন সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব পালনে রত থাকে। তারপর বলা হয়েছে, এরাই সফলকাম। যেন জানানো হচ্ছে, মুসলিম জাতির সামষ্টিক ও জাতীয় সাফল্য দু'টি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এক হচ্ছে আল্লাহর রজ্জু কুরআন মাজীদকে শক্তভাবে ধরে রাখা, আর দ্বিতীয় হচ্ছে প্রত্যেকে যাতে শক্তভাবে তা ধরে রাখতে পারে সেজন্য সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎকাজ করতে নিষেধ করা। বিষয়টা এভাবেও বলা যায় যে, একদিকে নিজের ইসলাহ ও সংশোধনে যত্নবান থাকতে হবে, অন্যদিকে অন্যের সংশোধনকল্পে দাওয়াতী মেহনত জারি রাখতে হবে। এ আয়াতে বিশেষভাবে দ্বিতীয় বিষয়ের প্রতি জোর তাগিদ করা হয়েছে।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের জন্য বিশেষ একটি দলের জরুরত
এমনিতে তো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার সাধারণ দায়িত্ব উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর অর্পিত, যা আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী পালন করা অবশ্যকর্তব্য। সে সম্পর্কে সামনে আলোচনা আসছে। এ আয়াতে দাওয়াত সম্পর্কিত বিশেষ দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ উম্মতের মধ্যে সর্বদা এমন একটা দল থাকা চাই, যাদের কাজই হবে সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজ করতে নিষেধ করা। তারা সর্বদা মানুষকে কুরআন ও হাদীছের হিদায়াতের দিকে ডাকবে। ইসলাম যেসকল সৎকর্মের শিক্ষা দিয়েছে মানুষকে তা অবহিত করবে। গাফেল ও উদাসীন মানুষকে সৎকর্ম করতে উৎসাহ দেবে। আর যখনই মানুষকে অন্যায় ও অসৎকর্মে লিপ্ত দেখবে, তখন তাদেরকে সতর্ক করবে এবং যথাসাধ্য তা থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
বলাবাহুল্য, দাওয়াতের কাজকে একটি স্বতন্ত্র যিম্মাদারী হিসেবে গ্রহণ করে নিজেকে তাতে নিয়োজিত রাখা এবং সে যিম্মাদারী সুচারুরূপে পালন করা যে-কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য কোনটা সৎকাজ আর কোনটা অসৎকাজ তা ভালোভাবে জানা থাকা চাই। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, সামাজিক আদব-কায়দা, অর্থ-সম্পদ সংক্রান্ত মাসাইলসহ ইসলামের পরিপূর্ণ রূপরেখা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছাড়া এ দায়িত্ব পালন করতে গেলে যথেষ্ট ভুল-ভ্রান্তির আশঙ্কা রয়েছে। সে কারণেই দীনের পূর্ণাঙ্গ দাওয়াতের দায়িত্ব সাধারণভাবে সকলের ওপর ন্যস্ত না করে বিশেষ একটি দলের ওপর করা হয়েছে। যেমন অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ (122)
'সুতরাং তাদের প্রতিটি বড় দল থেকে একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দীনের উপলব্ধি অর্জনের চেষ্টা করে এবং সতর্ক করে তাদের কওমকে, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে, ফলে তারা (গুনাহ থেকে) সতর্ক থাকবে। সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১২২
আলোচ্য আয়াতের মত এ আয়াতেও মূলত দাওয়াতের বিশেষ স্তরের কথাই বলা হয়েছে।
আলোচ্য আয়াতে বিশেষ দলটির দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা তিনটি কাজ করবে।
ক. তারা 'খায়র' বা কল্যাণের দিকে ডাকবে;
খ. ‘মারূফ’ বা সৎকাজের আদেশ করবে এবং
গ. মুনকার বা অসৎ ও অন্যায় কাজ করতে নিষেধ করবে।
বিশেষ সে দলটির প্রথম কাজ
সর্বপ্রথম বলা হয়েছে- يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ ডাকবে কল্যাণের দিকে। এক বর্ণনায় আল খায়র এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে الخير هو اتباع القرآن وسنتي খায়র হচ্ছে কুরআন এবং আমার সুন্নতের অনুসরণ করা। তাফসীরে ইবনে কাছীর, খণ্ড ২, পৃ. ৭৮ (উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায়)
এর মধ্যে গোটা দীন ও শরীয়ত এসে যায়। এর দ্বারা বোঝানো হচ্ছে, ওই দলটির কাজ হবে নিরবচ্ছিন্নভাবে দীন ও শরীয়তের দাওয়াত দিতে থাকা। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের জন্য তো বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতি দরকার। অর্থাৎ যখন কাউকে কোনও সৎকাজে গড়িমসি করতে দেখা যায়। তখন তাকে সেই সৎকাজের দিকে ডাকার প্রয়োজন হয়। এমনিভাবে যখন কাউকে কোনও অসৎকাজে লিপ্ত থাকতে দেখা যায় তখন তাকে তাতে নিষেধ করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু খায়র ও কল্যাণ তথা দীনের দিকে ডাকার জন্য এরকম কোনও পরিস্থিতির অপেক্ষা করতে হয় না। বরং এটা সবসময়কার কাজ। সবসময় মানুষকে ইসলামের সৌন্দর্য বোঝানো; ইসলামী বিধিবিধান পালনে উৎসাহ দেওয়া এবং নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাতসহ কর্মগত ও আখলাকী বিধানাবলীর গুরুত্ব ও ফযিলতের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই হচ্ছে খায়রের দিকে আহ্বান। কুরআন মাজীদে এটাকে ওই দলটির দায়িত্ব কর্তব্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, খায়র ও কল্যাণের দিকে ডাকার দুটি স্তর আছে।
ক. অমুসলিমকে ইসলামের দিকে ডাকা। আপন আপন যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী এটা সাধারণভাবে প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব। আর বিশেষভাবে এ আয়াতে বর্ণিত দলটির কাজই হবে কথায় ও কাজে সারাবিশ্বের সমস্ত অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেওয়া।
খ. খায়রের দিকে ডাকার দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে, মুসলিম ভাইদেরকে ইসলামী শিক্ষা অনুসরণের প্রতি উৎসাহিত করা। এটা সাধারণভাবে যেমন প্রত্যেক মুসলিমেরই দীনী দায়িত্ব, তেমনি বিশেষভাবে ওই দলটির একান্ত কর্তব্য যারা ইসলামী শিক্ষায় পর্যাপ্ত যোগ্যতা অর্জনের পর দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত থাকাকে নিজেদের যিম্মাদারী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।
বিশেষ দলটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় কাজ
আয়াতে দলটির দ্বিতীয় কাজ বলা হয়েছে, يامرون بالمعروف "তারা সৎকাজের আদেশ দেবে'। মা'রূফ- এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পরিচিত। অর্থাৎ সকলেই যা জানে। এর দ্বারা ওই সকল নেক কাজকে বোঝানো হয় ইসলাম যা করতে আদেশ করেছে এবং প্রত্যেক যুগের নবীগণ আপন আপন উম্মতকে তা করতে উৎসাহ দিয়েছে। যেমন আল্লাহর ইবাদত করা, নবীর আনুগত্য করা, সত্য বলা, আমানতের হিফাজত করা, ওয়াদা রক্ষা করা, আর্ত ও পীড়িতের সাহায্য করা ইত্যাদি। সাধারণভাবে সকল যুগের মানুষ এগুলোকে সৎকর্মরূপে জানে ও চেনে। তাই একে মা'রূফ বা পরিচিত নামে অভিহিত করা হয়েছে।
আয়াতে বর্ণিত দলটির তৃতীয় কাজ বলা হয়েছে, وينهون عن المنكر তারা অসৎকাজে নিষেধ করে'। এর দ্বারা এমনসব অন্যায় ও মন্দকাজ বোঝানো হয়ে থাকে যা করতে ইসলাম নিষেধ করে দিয়েছে এবং অন্যান্য ধর্মেও যা নিষিদ্ধ ছিল। যেমন আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা, নবীর শিক্ষা অগ্রাহ্য করা, মিথ্যা বলা, চুরি করা, আমানতের খেয়ানত করা, ওয়াদা ভঙ্গ করা, গীবত করা, ঝগড়া ফাসাদে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি। 'মুনকার' অর্থ অপরিচিত ও আপত্তিকর বিষয়। সবযুগে সব দীনে এসকল কাজ ছিল আপত্তিকর এবং দীনদারদের কাছে ছিল অপরিচিত তথা দীন বহির্ভূত। সেকারনেই এগুলোকে মুনকার নামে অভিহিত করা হয়েছে।
এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, নিষেধ ও আপত্তি করা যাবে কেবল এমন কাজেই যা দীন বহির্ভূত বলে জানা আছে। সুতরাং দীন ও শরীয়তে যেকাজের ভিত্তি আছে তাতে বাধা দেওয়া বা আপত্তি করার কোনও সুযোগ নেই। বরং তাতে আপত্তি করাই হবে একটি আপত্তিকর কাজ।
উল্লেখ্য, পূর্ণ দায়িত্বশীলতার সাথে এ তিনটি কাজ করতে হলে জরুরি হচ্ছে ইলমী যোগ্যতার পাশাপাশি উত্তম চরিত্র, তাকওয়া-পরহেযগারী, ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত এবং মানুষকে আকর্ষণ করার মত যোগ্যতারও অধিকারী হওয়া। এ প্রসঙ্গে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ, বলেন, দীনে-ইসলাম ও সত্যের বাণী যারা প্রচার করবে তাদেরকে অবশ্যই উত্তম চরিত্র, উৎকৃষ্ট যোগ্যতা, খালেস নিয়ত, হৃদয়ের প্রশস্ততা, সততা ও সত্যবাদিতা, মিষ্টি ভাষা, উদার চরিত্র, পরহিতৈষণা, কষ্টসহিষ্ণুতা এবং ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করার মত প্রশংসনীয় গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। সেইসঙ্গে তাদেরকে এমনও হতে হবে যে, একমুহূর্তের জন্যও লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, রিয়াকারী এবং দুনিয়া লাভের আগ্রহকে নিজেদের অন্তরে স্থান দেবে না।মালফুযাতে কাশ্মীরী, পৃ. ২৯০
দুই নং আয়াত
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
অর্থ : (হে মুসলিমগণ!) তোমরা সেই শ্রেষ্ঠতম দল, মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের অস্তিত্ব দান করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করে থাক ও অন্যায় কাজে বাধা দিয়ে থাক। সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১১০
ব্যাখ্যা
এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ বলা হয়েছে দু'টি-
ক. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা এবং
খ. আল্লাহর প্রতি ঈমান।
প্রশ্ন হতে পারে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা তথা দাওয়াতের দায়িত্ব তো অন্যান্য উম্মতের ওপরও ছিল, যেমন বিভিন্ন আয়াত ও হাদীস দ্বারা জানা যায়। আর বলাবাহুল্য, আল্লাহ তা'আলার প্রতি ঈমানও তাদের ছিল, তা সত্ত্বেও তাদের অপেক্ষা এ উম্মতকে শ্রেষ্ঠ বলার কারণ কী?
এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ
এর জবাব আয়াতের বাচনভঙ্গির মধ্যেই প্রচ্ছন্ন আছে। বলা হয়েছে, 'তোমরা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করে থাক। এর মধ্যে ইশারা রয়েছে যে,
অন্যান্য উম্মতের ওপর এ দায়িত্ব থাকলেও তারা তা পালনে অবহেলা করত। অবহেলার কারণে কুরআন মাজীদের কোনও কোনও আয়াতে তাদেরকে তিরস্কারও করা হয়েছে। এবং সে অবহেলারই পরিণাম হল, তাদের ধর্ম কালপরিক্রমায় বিকৃত ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অপরপক্ষে এ উম্মতের কোনও না কোনও দল এ দায়িত্ব যথারীতি আদায় করে আসছে এবং হাদীসের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী কিয়ামত পর্যন্ত পালন করে যাবে, যে কারণে দীনে ইসলাম অদ্যাবধি তার স্বরূপে সংরক্ষিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে ইনশাআল্লাহ।
সেইসঙ্গে শ্রেষ্ঠত্বের একটা কারণ হল দাওয়াতের পূর্ণাঙ্গতা ও সার্বজনীনতা। অর্থাৎ এ দীন পরিপূর্ণ ও সার্বজনীন হওয়ায় এ উম্মতের দাওয়াতের মধ্যেও পরিপূর্ণতা ও সার্বজনীনতার গুণ বিদ্যমান, যা অন্য কোনও উম্মতের দাওয়াতে ছিল না।
আর দ্বিতীয় বিষয় অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ঈমানও যে অন্যান্য উম্মতের যথাযথ নয়, তাও এ আয়াতে স্পষ্ট। সুতরাং বলা হয়েছে, “কিতাবীগণ যদি ঈমান আনত' অর্থাৎ তারা যদি শেষ নবী ও কুরআন মাজীদের প্রতি ঈমান আনত! আল্লাহ তা'আলার প্রতি ঈমান আনা কেবল তখনই সাব্যস্ত হতে পারে, যখন শেষ নবীর প্রতি ঈমান আনা হবে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
أَتَدْرُونَ مَا الإِيمَانُ بِاللَّهِ وَحْدَهُ» قَالُوا: اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: «شَهَادَةُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ
"তোমরা কি জান এক আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ কী? তারা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৭: বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৮. মুসনাদ আবূ দাউদ ওয়ালিসী, হাদীছ নং ২৮৭
ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানগণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান না আনার কারণে আল্লাহ তা'আলার প্রতি তাদের ঈমানও যথার্থ হয়নি। এমনকি এ কারণে তাদের আপন-আপন নবী ও কিতাবের প্রতিও ঈমান পূর্ণাঙ্গ থাকেনি। ফলে তাদের ঈমান হয়ে গেছে খণ্ডিত ঈমান। পক্ষান্তরে দাওয়াতের মত এ উম্মতের ঈমানও পূর্ণাঙ্গ। তারা কিছুতে ঈমানে আনে, কিছুতে আনে না—এমন নয়। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত যত কিতাব নাযিল হয়েছে ও যত নবী প্রেরিত হয়েছেন, এরা তার সকলের প্রতিই বিশ্বাস রাখে। তাই বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহর প্রতি (অর্থাৎ তার সমস্ত কিতাব ও সমস্ত নবীর প্রতি) ঈমান রাখ। সুতরাং ঈমানের পরিপূর্ণতা এবং সার্বজনীনতার সাথে দাওয়াতের ধারাবাহিকতা রক্ষার ভিত্তিতেই এ উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলা হয়েছে।
সুতরাং আমরা যদি শ্রেষ্ঠ উম্মতের অন্তর্ভুক্ত থাকতে চাই তবে আমাদেরকে অবশ্যই এসকল গুণের অধিকারী হতে হবে। একবার হযরত উমর ফারূক রাযি. আলোচ্য আয়াতটি পাঠ করার পর বললেন-
من سره أن يكون من تلك الأمة فليؤد شرط الله فيها
“যে ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ উম্মতের দলভুক্ত থাকতে চায়, সে যেন এ আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর শর্তসমূহ পূরণ করে।'
তিন নং আয়াত
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)
অর্থ : (হে নবী!) তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে তিনটি আদেশ করা হয়েছে।
ক. ক্ষমাপরায়ণ হওয়া;
খ. সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও
গ. অজ্ঞজনদের অগ্রাহ্য করা।
الْعَفْوَ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে। তার মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে ক্ষমাপরায়ণতা। এ আয়াতটি যখন নাযিল হয় তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত জিবরীল 'আলাইহিস সালামকে এর অর্থ জিজ্ঞেস করেছিলেন। হযরত জিবরীল "আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা'আলার কাছ থেকে জেনে এসে তাঁকে বললেন, এ আয়াতে আপনাকে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে,- যে ব্যক্তি আপনার ওপর জুলুম করবে, আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। - যে ব্যক্তি আপনাকে বঞ্চিত করবে, আপনি তার প্রতি উদারতা প্রদর্শন করবেন। -আর যে ব্যক্তি আপনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আপনি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবেন।
এর সারকথা হচ্ছে অন্যের প্রতি ক্ষমাশীলতার আচরণ করা। এটি একটি মহৎ গুণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা জীবন মানুষের সঙ্গে ক্ষমাশীল হয়েই থেকেছেন। মানুষ কতভাবে তাকে কষ্ট দিয়েছে, কিন্তু তিনি কখনও কারও থেকে প্রতিশোধ নেননি। বরং ক্ষমা করে দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের দিন তাঁর প্রতিশোধ গ্রহণের অবারিত সুযোগ ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রাণের শত্রুদেরকেও এদিন ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন সাধারণ ক্ষমা!
বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উন্নত চরিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর ক্ষমাশীলতাও ছিল অসাধারণ। তা সত্ত্বেও তাঁকে যে এ আদেশ করা হয়েছে তা মূলত উম্মতকে শেখানোর জন্য। সুতরাং সর্বপ্রথম সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের জীবনে এ শিক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। তারপর তাদের দেখাদেখি তাবিঈগণও ক্ষমাপরায়ণতার উচ্চতর দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এভাবে যুগ পরম্পরায় এ উম্মত ক্ষমাশীলতার ব্যাপক চর্চা করে এসেছে। আমাদেরও কর্তব্য জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণে কুরআন মাজীদের এ আদেশ মেনে চলতে সচেষ্ট থাকা।
দ্বিতীয় হুকুম করা হয়েছে সৎকাজের আদেশ দেওয়া সম্পর্কে। العرف শব্দটি প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে ব্যবহৃত المعروف -এর সমার্থক। সর্বপ্রকার সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। অন্যের দেওয়া কষ্ট ও জুলুম ক্ষমা করার পাশাপাশি হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, তাদেরকে সৎকাজের আদেশও কর। কেননা কেবল ক্ষমা দ্বারা জালিম ও কষ্টদাতার সংশোধন নাও হতে পারে। অথচ তার সংশোধনও কাম্য। কেননা সংশোধন যদি না হয়, তবে সে একের পর এক জুলুম করেই যাবে। ফলে তার জুলুম-অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকবে। আর এভাবে অপরাপর মানুষও তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং জুলুম থেকে ফেরানোর জন্য তাকে ন্যায় ও ইনসাফের শিক্ষা দেওয়াও জরুরি। সেজন্যই আদেশ করা হয়েছে যে, সৎকাজের নির্দেশ দাও। এ আদেশ কেবল দুঃখ-কষ্টদাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং সৎকাজের নির্দেশ সকলের জন্যই প্রয়োজন। যারা অসৎকাজ করে তাদের জন্য প্রয়োজন অসৎকাজ থেকে ফেরানোর লক্ষ্যে, আর যারা সৎকাজ করে তারা যাতে তাতে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং সৎকাজে আরও বেশি উন্নতি লাভ করে, সে লক্ষ্যে সৎকাজের উপদেশ তাদের জন্যও উপকারী। যারা এ দায়িত্ব পালনে রত থাকে, তাদের নিজেদেরও এটা দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণ সাধন করে।
এ আয়াতে তৃতীয় নির্দেশ হচ্ছে- অজ্ঞজনদের অগ্রাহ্য কর। অর্থাৎ যারা জুলুম- অত্যাচার করে তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া এবং তাদেরকে সৎকাজের আদেশ দেওয়ার পরও হয়তো দেখা যাবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ অতি জেদী চরিত্রের হওয়ায় নিজেদের সংশোধন করছে না। এত উন্নত আচরণ করা সত্ত্বেও তাদের জীবনে কোনও পরিবর্তন আসছে না। আগের মতই অন্যায় ও অসৎকাজ করে যাচ্ছে। এরূপ ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলা। তাদের অন্যায় আচরণে উত্তেজিত হয়ে গেলে নিজের আখলাক-চরিত্র ক্ষতিক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই তাদের পাশ কাটিয়ে চলাই শ্রেয়। ইবন কাছীর রহ. পাশ কাটানোর একটা ব্যাখ্যা এরকমও করেছেন যে, তাদের দুর্ব্যবহারের উত্তর দুর্ব্যবহার দ্বারা নয়; বরং সদ্ব্যবহার দ্বারা করা চাই। এমন নয় যে,তাদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সৎকাজের আদেশ করা ছেড়ে দেওয়া হল।
হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর একটি ঘটনা
এ প্রসঙ্গে হযরত 'উমর ফারূক রাযি.-এর একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। হযরত "আব্দুল্লাহ ইবন 'আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'উয়াইনা ইবন হিসন (মদীনায়) আগমন করল এবং তার ভাতিজা হুর্র ইবন কায়স রাযি, এর মেহমান হল। হুর্র ইবন কায়স রাযি. ছিলেন ওইসব লোকের একজন, যাদেরকে হযরত উমর রাযি. (তাঁর মজলিসে) নিজের কাছে বসাতেন। হযরত উমর রাযি.-এর মজলিস ও পরামর্শসভার সদস্য হত কারী 'আলেমগণ, প্রৌঢ় হোক বা যুবক।
“উয়াইনা তার ভাতিজাকে বলল, ওহে ভাতিজা! এই আমীরের দরবারে তোমার বিশেষ মর্যাদা আছে। সুতরাং তুমি আমার জন্য তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাও। তিনি অনুমতি চাইলেন। হযরত উমর রাযি, তাঁকে অনুমতি দিলেন। 'উয়াইনা তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, ওহে খাত্তাবের পুত্র! আল্লাহর কসম! তুমি আমাদেরকে বেশি কিছু দিচ্ছ না। এবং আমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করছ না। এ কথায় 'উমর রাযি. রেগে যান। এমনকি তাকে শাস্তি দিতে উদ্যত হন। তখন হুর্র ইবন কায়স রাযি, তাঁকে বললেন, হে আমীরুল মু'মিনীন! আল্লাহ তা'আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছেন-
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)
অর্থ : (হে নবী!) তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯
আর নিশ্চয়ই এ ব্যক্তি অজ্ঞদের একজন। আল্লাহর কসম! হুর্র যখন এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, 'উমর রাযি. আর তার সামনে বাড়লেন না। (অর্থাৎ আয়াতের নির্দেশ লঙ্ঘন করলেন না)। বস্তুত তিনি আল্লাহর কিতাবের (সীমারেখার ভেতর) অতি স্থিরকদম ছিলেন (অর্থাৎ কুরআনের হুকুমের বাইরে পা ফেলতেন না)। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৬৪২, ৭২৮৬
চার নং আয়াত
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
অর্থ : মুমিন নর ও মুমিন নারী পরস্পরে (একে অন্যের) বন্ধু ও সহযোগী। তারা সৎকাজের আদেশ করে, অসৎ কাজে বাধা দেয় । সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৭১
ব্যাখ্যা
এ আয়াতের আগে মুনাফিকদের চরিত্র বর্ণিত হয়েছে। তাতে জানানো হয়েছিল-
الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُمْ مِنْ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمُنْكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوفِ وَيَقْبِضُونَ أَيْدِيَهُمْ نَسُوا اللَّهَ فَنَسِيَهُمْ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ هُمُ الْفَاسِقُونَ (67)
'মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী সকলেই একে অন্যের মত। তারা মন্দ কাজের আদেশ করে ও ভালো কাজে বাধা দেয় এবং তারা নিজেদের হাত বন্ধ করে রাখে। তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। এরপর আল্লাহও তাদেরকে ভুলে গেছেন। নিঃসন্দেহে মুনাফিকগণ ঘোর অবাধ্য। সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৬৭
এতে মুনাফিকদের তিনটি খাসলত বর্ণিত হয়েছিল।
মুনাফিকদের বিপরীতে এ আয়াতে মুমিন নর-নারীর চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে তা নিম্নরূপ।
এক. মুনাফিকরা তো ভালো কাজে বাধা দিয়ে মন্দ কাজে উৎসাহ দেয়। পক্ষান্তরে মু'মিনগণ মানুষকে সৎকাজের আদেশ দেয় এবং মন্দকাজ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করে।
দুই. মুনাফিকরা কৃপণ। দানের বেলায় হাত বন্ধ করে রাখে। কৃপণতার কারণে ভালো কাজে অর্থব্যয় করতে পারে না। পক্ষান্তরে মু'মিনদের হাত খোলা। তারা আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদ থেকে আল্লাহর পথে অকৃপণভাবে খরচ করে।
তিন. মুনাফিকরা আল্লাহ তা'আলাকে ভুলে গেছে। পক্ষান্তরে মু'মিনগণ সর্বদা আল্লাহ তা'আলাকে স্মরণ রাখে, যে কারণে তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে এবং সর্বদা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে চলে।
মু'মিনদের প্রতি ভালোবাসা রাখা খাঁটি ঈমানের পরিচায়ক
লক্ষণীয় হচ্ছে যে, মুনাফিকদের বেলায় বলা হয়েছিল- মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী সকলেই একে অন্যের মত। আর এ আয়াতে মু'মিনদের বেলায় বলা হচ্ছে- মুমিন নর ও মুমিন নারী পরস্পরে (একে অন্যের) বন্ধু ও সহযোগী। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, মুনাফিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক কেবলই পার্থিব স্বার্থে। উপরে উপরে তারা একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক রেখে চলে, কিন্তু অন্তরে কোনও মহব্বত ও ভালোবাসা নেই। পক্ষান্তরে মু'মিনগণ পরস্পরে সেরকম কপট সম্পর্ক রেখে চলে না। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আন্তরিক ও অকৃত্রিম। আর সে কারণেই তারা একে অন্যকে সৎকাজের আদেশ করে এবং অন্যায় কাজে নিষেধ করে। বোঝা যাচ্ছে সৎকাজে আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা বন্ধুত্বের আলামত এবং খাঁটি ঈমানের পরিচায়ক। খাঁটি ঈমানদার সর্বদা অন্যের প্রতি আন্তরিক মহব্বত রাখবে এবং তার সুখ ও দুঃখে তার পাশে থাকবে। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِن كَالْبُنْيَانِ، يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا
'এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য প্রাচীরস্বরূপ, যার একাংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৮১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৮৫; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯২৮; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৬০; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৭৯০
অপর এক হাদীছে ইরশাদ-
«تَرَى المُؤْمِنِينَ فِي تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ، كَمَثَلِ الجَسَدِ، إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالحُمَّى»
'তুমি মুমিনদেরকে পারস্পরিক দয়ামায়া, ভালোবাসা ও সাহায্য-সহযোগিতায় এক দেহের মত দেখতে পাবে, যার কোনও একটি অঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়লে বাকি সব অঙ্গ অনিদ্রা ও উত্তাপে তার অংশীদার হয়ে যায়। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০১১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৮৬; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭২০৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৫৯
এই ঐক্য ও সম্প্রীতির দাবি সর্বদা একে অন্যকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে থাকা। কেননা এক মু'মিনের জন্য অপর মু'মিনের এটাই সবচে' বড় সহযোগিতা।
এ আয়াত প্রমাণ করে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা কেবল মু'মিন পুরুষের নয়; বরং মু'মিন নারীরও দায়িত্ব।
পাঁচ নং আয়াত
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ (78) كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ (79)
অর্থ : বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল, তাদের প্রতি দাউদ ও ঈসা ইবনে মারয়ামের যবানীতে লা'নত বর্ষিত হয়েছিল। তা এ কারণে যে, তারা অবাধ্যতা করেছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত। তারা যেসব অসৎ কাজ করত, তাতে একে অন্যকে নিষেধ করত না। বস্তুত তাদের কর্মপন্থা ছিল অতি মন্দ।সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৭৮-৭৯
ব্যাখ্যা
এ দুই আয়াতে কোনও জাতির ব্যাপকভাবে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়া এবং তাদের মধ্যে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব পরিত্যাক্ত হয়ে যাওয়া বা সে দায়িত্ব আদায়ে চরম অবহেলা দেখা দেওয়ার পার্থিব পরিণামও কত অশুভ হতে পারে, সে সম্পর্কিত দু'টি ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। একটি ঘটনা হযরত দাউদ 'আলাইহিস সালামের যমানার, অপরটি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের যমানার।
হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের যমানার ঘটনা
হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের যমানায় যে ঘটনা ঘটেছিল, কুরআন মাজীদে সংক্ষেপে তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে এরকম-
وَاسْأَلْهُمْ عَنِ الْقَرْيَةِ الَّتِي كَانَتْ حَاضِرَةَ الْبَحْرِ إِذْ يَعْدُونَ فِي السَّبْتِ إِذْ تَأْتِيهِمْ حِيتَانُهُمْ يَوْمَ سَبْتِهِمْ شُرَّعًا وَيَوْمَ لَا يَسْبِتُونَ لَا تَأْتِيهِمْ كَذَلِكَ نَبْلُوهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (163) وَإِذْ قَالَتْ أُمَّةٌ مِنْهُمْ لِمَ تَعِظُونَ قَوْمًا اللَّهُ مُهْلِكُهُمْ أَوْ مُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا قَالُوا مَعْذِرَةً إِلَى رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ (164) فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ أَنْجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (165) فَلَمَّا عَتَوْا عَنْ مَا نُهُوا عَنْهُ قُلْنَا لَهُمْ كُونُوا قِرَدَةً خَاسِئِينَ (166)
এবং তাদের কাছে সাগর তীরে অবস্থিত জনপদবাসীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর, যখন তারা শনিবারের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করত, যখন তাদের (সাগরের) মাছ শনিবার দিন তো পানিতে ভেসে ভেসে তাদের সামনে আসত; আর যখন তারা শনিবার উদ্যাপন করত না, (অর্থাৎ অন্যান্য দিনে) তা আসত না। এভাবে আমি তাদেরকে তাদের উপর্যুপরি অবাধ্যতার কারণে পরীক্ষা করেছিলাম।
এবং (তাদেরকে সেই সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দাও) যখন (শনিবার মাছ শিকার নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তারা কৌশলে তা শিকার করছিল আর তাদের কিছু লোক তাদেরকে উপদেশ দিচ্ছিল এবং এভাবে মাছ শিকার করতে নিষেধ করছিল। এ অবস্থায়) তাদেরই একটি দল (অন্য দলকে যারা মাছ শিকারকারীদেরকে মাছ শিকার করতে নিষেধ করছিল) বলেছিল, তোমরা এমন সব লোককে কেন উপদেশ দিচ্ছ, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে ফেলবেন কিংবা কঠোর শাস্তি দেবেন? তারা বলল, (আমরা এটা করছি) তোমাদের প্রতিপালকের নিকট দায়িত্বমুক্ত হওয়ার জন্য এবং (এ উপদেশ দ্বারা) হতে পারে, তারা তাকওয়া অবলম্বন করবে (এবং শনিবার মাছ শিকার থেকে বিরত হবে)।
তাদেরকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তা যখন তারা ভুলে গেল, তখন অসৎকাজে যারা বাধা দিচ্ছিল তাদেরকে তো আমি রক্ষা করি। কিন্তু যারা সীমালঙ্ঘন করেছিল, উপর্যুপরি অবাধ্যতার কারণে তাদেরকে এক কঠোর শাস্তি দ্বারা আক্রান্ত করি। সুতরাং তাদেরকে যে কাজ করতে (অর্থাৎ শনিবার মাছ শিকার) নিষেধ করা হয়েছিল, তারা যখন তার বিপরীতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করল, তখন আমি তাদেরকে বললাম, ঘৃণিত বানর হয়ে যাও। সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৬৩-১৬৬
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর যামানার ঘটনা
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর যামানার ঘটনাটি ছিল আসমানী খানা সম্পর্কিত। সে সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذْ أَوْحَيْتُ إِلَى الْحَوَارِيِّينَ أَنْ آمِنُوا بِي وَبِرَسُولِي قَالُوا آمَنَّا وَاشْهَدْ بِأَنَّنَا مُسْلِمُونَ (111) إِذْ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ يَاعِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ هَلْ يَسْتَطِيعُ رَبُّكَ أَنْ يُنَزِّلَ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ قَالَ اتَّقُوا اللَّهَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (112) قَالُوا نُرِيدُ أَنْ نَأْكُلَ مِنْهَا وَتَطْمَئِنَّ قُلُوبُنَا وَنَعْلَمَ أَنْ قَدْ صَدَقْتَنَا وَنَكُونَ عَلَيْهَا مِنَ الشَّاهِدِينَ (113) قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا وَآيَةً مِنْكَ وَارْزُقْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ (114) قَالَ اللَّهُ إِنِّي مُنَزِّلُهَا عَلَيْكُمْ فَمَنْ يَكْفُرْ بَعْدُ مِنْكُمْ فَإِنِّي أُعَذِّبُهُ عَذَابًا لَا أُعَذِّبُهُ أَحَدًا مِنَ الْعَالَمِينَ (115)
(এবং তাদের এ ঘটনার বর্ণনাও শোন যে.) যখন হাওয়ারীগণ বলেছিল, হে ঈসা ইবনে মারয়াম! আপনার প্রতিপালক কি আমাদের জন্য আসমান থেকে (খাদ্যের) একটা খাঞ্চা অবতীর্ণ করতে সক্ষম? ঈসা বলল, আল্লাহকে ভয় কর,যদি তোমরা মুমিন হও।
তারা বলল, আমরা চাই যে, তা থেকে খাব এবং আমাদের অন্তর পরিপূর্ণ প্রশান্তি লাভ করবে এবং আমরা (পূর্বাপেক্ষা অধিক প্রত্যয়ের সাথে) জানতে পারব যে,আপনি আমাদেরকে যা কিছু বলেছেন তা সত্য, আর আমরা এ বিষয়ে সাক্ষ্যদাতাদের অন্তর্ভুক্ত হব।
(সুতরাং) ঈসা ইবনে মারয়াম বলল, হে আল্লাহ, আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য আসমান থেকে একটি খাঞ্চা অবতীর্ণ করুন, যা হবে আমাদের এবং আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য আনন্দ উদযাপনের কারণ এবং আপনার পক্ষ হতে একটি নিদর্শন। আমাদেরকে (এ নে'আমত) অবশ্যই প্রদান করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা।
আল্লাহ বললেন, আমি অবশ্যই তোমাদের প্রতি সে খাঞ্চা অবতীর্ণ করব, কিন্তু তারপর তোমাদের মধ্যে যে-কেউ কুফরী করবে আমি তাকে এমন শাস্তি দেব, যে শাস্তি বিশ্ব জগতের অন্য কাউকে দেব না। সূরা মায়েদা (৫), আয়াত ১১২-১১৫
এ সম্পর্কে তিরমিযী শরীফে হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি. থেকে একটি হাদীছ এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
أُنْزِلَتِ المَائِدَةُ مِنَ السَّمَاءِ خُبْزًا وَلَحْمًا, وَأُمِرُوا أَنْ لاَ يَخُونُوا وَلاَ يَدَّخِرُوا لِغَدٍ, فَخَانُوا وَادَّخَرُوا وَرَفَعُوا لِغَدٍ, فَمُسِخُوا قِرَدَةً وَخَنَازِيرَ.
'আসমান থেকে রুটি ও গোশত ভরা খাঞ্চা পাঠানো হল। আদেশ করা হল, তারা যেন খেয়ানত না করে এবং আগামীকালের জন্য জমা করে না রাখে। কিন্তু তারা খেয়ানত করল, জমা করল এবং পরবর্তী দিনের জন্য তুলে রাখল। ফলে তাদেরকে বানর ও শূকরে পরিণত করে দেওয়া হল। জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩০৬১
অসৎকাজে বাধা না দেওয়ার পরিণাম
আলোচ্য আয়াতে জানানো হয়েছে, এ দুই জাতিকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল হযরত দাউদ ও হযরত ঈসা আলাইহিমুস সালামের পক্ষ থেকে লা'নতের কারণে। তাঁরা তাদের প্রতি লা'নত করেছিলেন এ কারণে যে, তারা চরম পাপাচার ও অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় তাদের উচিত ছিল একে অন্যকে পাপাচারে লিপ্ত হতে নিষেধ করা। প্রথম ঘটনায় কিছু লোক নিষেধ করেছিল বটে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না। পরিণামে তাদের ওপর আল্লাহর আযাব ও গযব নেমে আসে। তাদের মানবাকৃতি সম্পূর্ণ বিকৃত করে দেওয়া হয়। ফলে তারা শূকর ও বানরে পরিণত হয়ে যায়।
তাদের এ বিকৃতি কেবল মনের নয়, বরং বাহ্যিক আকৃতিরও। তাদের চেহারা-সুরত সম্পূর্ণরূপেই শূকর ও বানরের মত হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে পৃথিবীতে যে শূকর ও বানর দেখা যায় এরা আগে থেকেই ছিল। এরা তাদের বংশধর নয়। তারা কিছুদিন বিকৃত অবস্থায় থাকার পর ধ্বংস হয়ে যায়।
আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তাঁর পক্ষে মানুষকে শূকর ও বানর করে ফেলা মোটেই অসম্ভব নয়। সুতরাং এ ঘটনাকে অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই।
এই কঠিন শাস্তির একটি বড় কারণ বলা হয়েছে অন্যায়-অপরাধ করতে দেখেও তাতে বারণ না করা। কুরআন মাজীদে তাদের এ ঘটনার উল্লেখ দ্বারা আমাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে তাদের মত অবহেলা যেন আমরা কিছুতেই না করি। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার যে দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে তা যেন অবশ্যই পালন করি। নয়তো আমাদের ক্ষেত্রেও ভয় আছে যে, ব্যাপক পাপাচারের দরুন পাপী ও অপাপী সকলের ওপরই আযাব নেমে আসবে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ (25)
“এবং সেই বিপর্যয়কে ভয় কর, যা বিশেষভাবে তোমাদের মধ্যে যারা জুলুম করে কেবল তাদেরকেই আক্রান্ত করবে না। জেনে রেখ, আল্লাহর আযাব সুকঠিন।সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৫
ছয় নং আয়াত
وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ
অর্থ : বলে দাও, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তো সত্য এসে গেছে। এখন যার ইচ্ছা ঈমান আনুক এবং যার ইচ্ছা কুফর অবলম্বন করুক।'সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ২৯
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ কুরআন মাজীদ এবং এতে যা-কিছু বলা হয়েছে সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা সত্যবাণী, যা তোমাদের শুনিয়ে দেয়া হলো। এখন এতে ঈমান আনা না আনা এবং এর অনুসরণ করা না করা তোমাদের ব্যাপার। যদি এর প্রতি ঈমান আন তাতে তোমাদেরই লাভ। এর অনুসরণ করে চললে দুনিয়ায় শান্তি এবং আখিরাতে মুক্তিলাভ করবে। আর যদি ঈমান না আন এবং এর অনুসরণ করে না চল তবে দুনিয়ায়ও নানান অশান্তি ভোগ করবে আর আখিরাতেও জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। মোটকথা, এতে ঈমান আনা ও না আনার লাভ-ক্ষতি তোমাদেরই, আল্লাহর কিছু আসে যায় না।
এর দ্বারা মূলত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এবং তাঁর পর সমস্ত দাওয়াতদাতাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, তোমাদের কাজ কেবল আন্তরিকতার সাথে দাওয়াত দেওয়া। কে তা শুনল এবং কে শুনল না তার কোনও দায়-দায়িত্ব তোমাদের ওপর নেই। সুতরাং কেউ যদি তোমাদের দাওয়াতে কর্ণপাত না করে সেজন্য আক্ষেপ করো না এবং মেহনত ব্যৰ্থ গেছে বলে হতাশাবোধ করো না। তোমাদের সফলতা দাওয়াত দেওয়ার ভেতর আর তাদের সফলতা তা মানার ভেতর। কাজেই কারো না মানায় হতোদ্যম হয়ে দাওয়াতের কাজ ছেড়ে দিও না।
সাত নং আয়াত
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ
অর্থ : সুতরাং তোমাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হচ্ছে, তা প্রকাশ্যে মানুষকে শুনিয়ে দাও।সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৯৪
ব্যাখ্যা
এটি সুরা হিজরের ৯৪ নং আয়াত। এর আগের আয়াতসমূহে ইয়াহুদী নাসারা ও কাফির মুশরিকদের বিরুদ্ধাচরণ ও শত্রুতামূলক তৎপরতার বিবরণ দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন যুগে তারা নবীর দাওয়াত অগ্রাহ্য করার পাশাপাশি দাওয়াতী মেহনতকে ব্যর্থ করে দেওয়ার লক্ষ্যে কী-সব কূটকৌশল অবলম্বন করত এবং এখনো তা করে যাচ্ছে তা বর্ণনা করার পর এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হুকুম দেওয়া হচ্ছে যে আপনি শত্রুদের আচার-আচরণ অগ্রাহ্য করে আপন দায়িত্ব পালনে রত থাকুন। তাদেরকে মানতে বাধ্য করা আপনার কাজ নয়। আপনার কাজ কেবল দাওয়াত দেওয়া। ব্যস সেকাজ করতে থাকুন। এর দ্বারা সবযুগের দাওয়াতদাতাগণকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে, তাদেরও কর্তব্য আপন দায়িত্বপালনে রত থাকা। অপরপক্ষ কী আচরণ করছে সেদিকে মন দিয়ে পেরেশান ও অস্থির হয়ে পড়া উচিত নয়।
আট নং আয়াত
أَنْجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (165)
অর্থ : তখন অসৎ কাজে যারা বাধা দিচ্ছিল তাদেরকে তো আমি রক্ষা করি। কিন্তু যারা সীমালঙ্ঘন করেছিল, উপর্যুপরি অবাধ্যতার কারণে তাদেরকে এক কঠোর শাস্তি ধরো আক্রান্ত করি। সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৬৫
ব্যাখ্যা
এ আয়াতের শুরুতে আছে فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ তাদেরকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তা যখন তারা ভুলে গেল'। এর দ্বারা বুঝানো হচ্ছে যে, প্রত্যেক জনগোষ্ঠির মধ্যে একদল উপদেশদাতা থাকা চাই। যাদের কাজ হবে মানুষকে সৎকাজের দিকে ডাকা এবং কেউ অন্যায় ও অসৎকাজ করলে তাকে বুঝিয়ে সমঝিয়ে তা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা। সে চেষ্টায় যদি অন্যায় অপরাধকারীগণ সুপথে ফিরে আসে তবে তো ভালো। পক্ষান্তরে তারা যদি আদেশ-উপদেশে কর্ণপাত না করে বরং উপর্যুপরি অন্যায়-অপরাধ করে যায় আর এভাবে জাতির অধিকাংশ মানুষ তাতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে তবে এর পরিণামে তারা আসমানী আযাব ও গযবে ধ্বংস হলেও উপদেশদাতাগণ সে আযাব থেকে নিস্তার পেয়ে যাবে। আর যদি কোনও উপদেশদাতা না থাকে; বরং অন্যের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দেখেও নীরবতা অবলম্বন করা হয়, তবে সে ক্ষেত্রে আসমানী গযব থেকে কেউ নিস্তার পায় না। কেননা নীরবতাও একরকম অপরাধ। ফলে সরাসরি অপরাধকারীদের সঙ্গে নীরবতা অবলম্বনকারীদেরকেও শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা সতর্ক করছেন-
وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ (25)
"এবং সেই বিপর্যয়কে ভয় কর, যা বিশেষভাবে তোমাদের মধ্যে যারা জুলুম করে কেবল তাদেরকেই আক্রান্ত করবে না। জেনে রেখ, আল্লাহর আযাব সুকঠিন। সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৫
এর দ্বারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
কুরআন মাজীদে এসম্পর্কে আরও বহু আয়াত আছে। শিক্ষাগ্রহণের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
অন্যায় ও অসৎকাজে বাধাদানের তিনটি স্তর
হাদীছ নং : ১৮৪
হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমাদের মধ্যে কেউ কোনও অন্যায় কাজ হতে দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে তা না পারে, তবে মুখের কথা দ্বারা (প্রতিহত করে)। যদি তাও না পারে, তবে অন্তর দ্বারা। আর এটা হল ঈমানের দুর্বলতম স্তর -মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০১৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩০৭: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭১৫৩)
হাদীছ নং : ১৮৪
হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমাদের মধ্যে কেউ কোনও অন্যায় কাজ হতে দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে তা না পারে, তবে মুখের কথা দ্বারা (প্রতিহত করে)। যদি তাও না পারে, তবে অন্তর দ্বারা। আর এটা হল ঈমানের দুর্বলতম স্তর -মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০১৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩০৭: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭১৫৩)
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
قَالَ الله تَعَالَى: {وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ} [آل عمران: 104]، وَقالَ تَعَالَى: {كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَر} [آل عمران: 110]، وَقالَ تَعَالَى: {خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ} [الأعراف: 199]، وَقالَ تَعَالَى: {وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ} [التوبة:71]، وَقالَ تَعَالَى: {لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرائيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُدَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ كَانُوا لا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ} [المائدة: 78]، وَقالَ تَعَالَى: {وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ} [الكهف:29]، وَقالَ تَعَالَى: {فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَر} [الحجر:94]، وَقالَ تَعَالَى: {فأَنْجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ} [الأعراف: 165] وَالآيات في الباب كثيرة معلومة.
قَالَ الله تَعَالَى: {وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ} [آل عمران: 104]، وَقالَ تَعَالَى: {كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَر} [آل عمران: 110]، وَقالَ تَعَالَى: {خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ} [الأعراف: 199]، وَقالَ تَعَالَى: {وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ} [التوبة:71]، وَقالَ تَعَالَى: {لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرائيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُدَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ كَانُوا لا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ} [المائدة: 78]، وَقالَ تَعَالَى: {وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ} [الكهف:29]، وَقالَ تَعَالَى: {فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَر} [الحجر:94]، وَقالَ تَعَالَى: {فأَنْجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ} [الأعراف: 165] وَالآيات في الباب كثيرة معلومة.
184 - فالأول: عن أبي سعيد الخدري - رضي الله عنه - قَالَ: سَمِعت رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أضْعَفُ (1) الإيمَانِ». رواه مسلم. (2)
হাদীস নং: ১৮৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
নিজ আমলে যত্ন নেওয়া ছাড়া সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের নিন্দা এবং এ শ্রেণীর লোকের বিরুদ্ধে জিহাদের হুকুম
হাদীছ নং: ১৮৫
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার পূর্বে কোনও জাতির কাছে যে নবীকেই পাঠানো হয়েছে, তাঁর উম্মতের মধ্যে তাঁর জন্য একদল 'হাওয়ারী' (সাহায্যকারী) ও সাহাবী থাকত। তারা তাঁর সুন্নত আঁকড়ে ধরত এবং তাঁর আদেশ অনুসরণ করত। অতঃপর তাদের পরবর্তীকালে এমন একদল নিকৃষ্ট উত্তরসূরী তাদের স্থলাভিষিক্ত হত, যারা এমন কথা বলত যা নিজেরা করত না আর এমন কাজ করত যা করার আদেশ তাদের করা হত না। সুতরাং যে হাত দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে সে মুমিন, যে অন্তর দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে সে মু'মিন আর যে মুখ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে সেও মুমিন। এরপর আর সরিষার দানা পরিমাণও ঈমানের স্তর নেই -মুসলিম। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৩৮০; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭১৫৪)
হাদীছ নং: ১৮৫
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার পূর্বে কোনও জাতির কাছে যে নবীকেই পাঠানো হয়েছে, তাঁর উম্মতের মধ্যে তাঁর জন্য একদল 'হাওয়ারী' (সাহায্যকারী) ও সাহাবী থাকত। তারা তাঁর সুন্নত আঁকড়ে ধরত এবং তাঁর আদেশ অনুসরণ করত। অতঃপর তাদের পরবর্তীকালে এমন একদল নিকৃষ্ট উত্তরসূরী তাদের স্থলাভিষিক্ত হত, যারা এমন কথা বলত যা নিজেরা করত না আর এমন কাজ করত যা করার আদেশ তাদের করা হত না। সুতরাং যে হাত দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে সে মুমিন, যে অন্তর দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে সে মু'মিন আর যে মুখ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে সেও মুমিন। এরপর আর সরিষার দানা পরিমাণও ঈমানের স্তর নেই -মুসলিম। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৩৮০; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭১৫৪)
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
185 - الثاني: عن ابن مسعود - رضي الله عنه: أن رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «مَا مِنْ نَبيٍّ بَعَثَهُ اللهُ [ص:83] في أمَّة قَبْلِي إلاَّ كَانَ لَهُ مِنْ أُمَّتِهِ حَوَارِيُّونَ (1) وَأصْحَابٌ يَأخُذُونَ بِسنَّتِهِ وَيَقْتَدُونَ بِأَمْرِهِ، ثُمَّ إِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوفٌ (2) يَقُولُونَ مَا لاَ يَفْعَلُونَ، وَيَفْعَلُونَ مَا لاَ يُؤْمَرونَ، فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلبِهِ فَهُوَ مُؤمِنٌ، وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلسَانِهِ فَهُوَ مُؤمِنٌ، وَلَيسَ وَرَاءَ ذلِكَ مِنَ الإيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَل». رواه مسلم. (3)
হাদীস নং: ১৮৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
শাসকের আনুগত্য করা ও হক কথা বলা প্রসঙ্গ
হাদীছ নং : ১৮৬
হযরত আবুল ওয়ালীদ উবাদা ইবনুস সামিত রাযি. বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বাই'আত গ্রহণ করেছি এই মর্মে যে, সংকটে, স্বাচ্ছন্দ্যে এবং সন্তুষ্টিকালে ও অসন্তুষ্ট অবস্থায় (শাসকবর্গের) কথা শুনব ও মানব, আমাদের ওপর অন্যদের অগ্রাধিকার প্রদানকে মেনে নেব এবং শাসনক্ষমতার ব্যাপারে তার অধিকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হব না। তিনি বলেন, অবশ্য তোমরা যদি (শাসকদের মধ্যে) প্রকাশ্য কুফরী দেখতে পাও, যে ব্যাপারে তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে স্পষ্ট দলীল-প্রমাণ আছে, তবে ভিন্ন কথা। আমরা আরও বাই'আত গ্রহণ করেছি এই মর্মে যে, আমরা যেখানেই থাকি হক কথা বলব। আল্লাহর ব্যাপারে আমরা কোনও নিন্দুকের নিন্দার ভয় করব না -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭১৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৭০৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪১৪৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৪৫৮)
হাদীছ নং : ১৮৬
হযরত আবুল ওয়ালীদ উবাদা ইবনুস সামিত রাযি. বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বাই'আত গ্রহণ করেছি এই মর্মে যে, সংকটে, স্বাচ্ছন্দ্যে এবং সন্তুষ্টিকালে ও অসন্তুষ্ট অবস্থায় (শাসকবর্গের) কথা শুনব ও মানব, আমাদের ওপর অন্যদের অগ্রাধিকার প্রদানকে মেনে নেব এবং শাসনক্ষমতার ব্যাপারে তার অধিকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হব না। তিনি বলেন, অবশ্য তোমরা যদি (শাসকদের মধ্যে) প্রকাশ্য কুফরী দেখতে পাও, যে ব্যাপারে তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে স্পষ্ট দলীল-প্রমাণ আছে, তবে ভিন্ন কথা। আমরা আরও বাই'আত গ্রহণ করেছি এই মর্মে যে, আমরা যেখানেই থাকি হক কথা বলব। আল্লাহর ব্যাপারে আমরা কোনও নিন্দুকের নিন্দার ভয় করব না -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭১৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৭০৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪১৪৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৪৫৮)
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
186 - الثالث: عن أبي الوليدِ عبادة بن الصامِت - رضي الله عنه - قَالَ: بَايَعْنَا رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - عَلَى السَّمْعِ والطَّاعَةِ في العُسْرِ واليُسْرِ، والمَنْشَطِ وَالمَكْرَهِ، وَعَلَى أثَرَةٍ عَلَيْنَا، وَعَلَى أَنْ لاَ نُنَازِعَ الأمْرَ أهْلَهُ إلاَّ أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِنَ اللهِ تَعَالَى فِيهِ بُرْهَانٌ، وَعَلَى أَنْ نَقُولَ بالحَقِّ أيْنَمَا كُنَّا، لاَ نَخَافُ في اللهِ لَوْمَةَ لاَئِمٍ. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
«المَنْشَطُ وَالمَكْرَهُ» بفتح ميمَيْهِما: أي في السهل والصعب. وَ «الأثَرَةُ»: الاختِصاص بالمشترَكِ وقد سبق بيانها. «بَوَاحًا» بفتح الباءِ الموحدة بعدها واو ثُمَّ ألف ثُمَّ حاءٌ مهملة: أي ظاهِرًا لا يحتمل تأويلًا.
«المَنْشَطُ وَالمَكْرَهُ» بفتح ميمَيْهِما: أي في السهل والصعب. وَ «الأثَرَةُ»: الاختِصاص بالمشترَكِ وقد سبق بيانها. «بَوَاحًا» بفتح الباءِ الموحدة بعدها واو ثُمَّ ألف ثُمَّ حاءٌ مهملة: أي ظاهِرًا لا يحتمل تأويلًا.
হাদীস নং: ১৮৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
অসৎকাজে নিষেধ না করার পরিণাম
হাদীছ নং : ১৮৭
হযরত নু'মান ইবন বাশীর রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থানকারী ও সীমালঙ্ঘনকারীর দৃষ্টান্ত হল এরকম যে, একদল লোক লটারি করে একটি জাহাজে উঠল। সে হিসেবে কিছু লোক জাহাজটির ওপরতলায় এবং কিছু লোক নিচতলায় স্থান পেল। যারা নিচতলায় ছিল তাদের পানির প্রয়োজন হলে উপরের তলার লোকদের কাছ দিয়ে আসা- যাওয়া করত (এতে ওপরতলার লোকেরা বিরক্তি বোধ করত)। শেষে নিচতলার লোকেরা বলল, আমরা যদি আমাদের অংশে ফুটো করে নিতাম আর আমাদের ওপরতলার লোকদের কষ্ট না দিতাম, সে ভালো হত। এখন যদি তারা (অর্থাৎ ওপরতলার লোকেরা) তাদেরকে তাদের এ ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে দেয়, তবে তারা এবং অপরাপর সকলেই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তারা তাদের হাত ধরে (এ কাজ থেকে নিবৃত্ত) রাখে, তবে সকলেই রক্ষা পাবে.- বুখারী।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৪৯৩: জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৭৩: বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭১৬৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৯৮)
হাদীছ নং : ১৮৭
হযরত নু'মান ইবন বাশীর রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থানকারী ও সীমালঙ্ঘনকারীর দৃষ্টান্ত হল এরকম যে, একদল লোক লটারি করে একটি জাহাজে উঠল। সে হিসেবে কিছু লোক জাহাজটির ওপরতলায় এবং কিছু লোক নিচতলায় স্থান পেল। যারা নিচতলায় ছিল তাদের পানির প্রয়োজন হলে উপরের তলার লোকদের কাছ দিয়ে আসা- যাওয়া করত (এতে ওপরতলার লোকেরা বিরক্তি বোধ করত)। শেষে নিচতলার লোকেরা বলল, আমরা যদি আমাদের অংশে ফুটো করে নিতাম আর আমাদের ওপরতলার লোকদের কষ্ট না দিতাম, সে ভালো হত। এখন যদি তারা (অর্থাৎ ওপরতলার লোকেরা) তাদেরকে তাদের এ ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে দেয়, তবে তারা এবং অপরাপর সকলেই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তারা তাদের হাত ধরে (এ কাজ থেকে নিবৃত্ত) রাখে, তবে সকলেই রক্ষা পাবে.- বুখারী।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৪৯৩: জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৭৩: বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭১৬৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৯৮)
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
187 - الرابع: عن النعمان بن بشير رضي الله عنهما، عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «مَثَلُ القَائِمِ في حُدُودِ اللهِ وَالوَاقعِ فِيهَا، كَمَثَلِ قَومٍ اسْتَهَمُوا عَلَى سَفِينَةٍ فَصَارَ بَعْضُهُمْ أعْلاهَا وَبَعْضُهُمْ أَسْفَلَهَا، وَكَانَ الَّذِينَ في أَسْفَلِهَا إِذَا اسْتَقَوا مِنَ المَاءِ مَرُّوا عَلَى مَنْ فَوْقهُمْ، فَقَالُوا: لَوْ أنَّا خَرَقْنَا في نَصِيبِنَا خَرْقًا وَلَمْ نُؤذِ مَنْ فَوقَنَا، فَإِنْ تَرَكُوهُمْ وَمَا أرَادُوا هَلَكُوا جَميعًا، وَإنْ أخَذُوا عَلَى أَيدِيهِمْ نَجَوا وَنَجَوْا جَميعًا». رواه البخاري. (1)
«القَائِمُ في حُدُودِ اللهِ تَعَالَى» معناه: المنكر لَهَا، القائم في دفعِها وإزالتِها، وَالمُرادُ بالحُدُودِ: مَا نَهَى الله عَنْهُ. «اسْتَهَمُوا»: اقْتَرَعُوا.
«القَائِمُ في حُدُودِ اللهِ تَعَالَى» معناه: المنكر لَهَا، القائم في دفعِها وإزالتِها، وَالمُرادُ بالحُدُودِ: مَا نَهَى الله عَنْهُ. «اسْتَهَمُوا»: اقْتَرَعُوا.
হাদীস নং: ১৮৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
অন্যায়-অনাচারকারী শাসকদের অধীনে করণীয়
হাদীছ নং: ১৮৮
উম্মুল মু'মিনীন হযরত উম্মু সালামা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের ওপর এমন এমন শাসক নিযুক্ত হবে, যাদের কোনও কোনও কাজ তোমরা চিনতে পারবে এবং কোনও কোনও কাজ তোমাদের অপরিচিত মনে হবে (অর্থাৎ তাদের কিছু কাজ হবে সৎ এবং কিছু কাজ অসৎ)। সুতরাং যে ব্যক্তি (অসৎকর্ম) ঘৃণা করবে, সে (গুনাহ থেকে) মুক্ত থাকবে। যে ব্যক্তি তার প্রতিবাদ করবে, সে (আখিরাতের জিজ্ঞাসাবাদ থেকে) নিরাপদ থাকবে। কিন্তু যে ব্যক্তি তাতে সন্তুষ্ট থাকবে এবং তার অনুগামী হবে, তার কথা আলাদা (অর্থাৎ সে মুক্ত ও নিরাপদ থাকবে না)। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? তিনি বললেন, না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমাদের মধ্যে সালাত কায়েম করবে মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৫৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৪৭৬০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২২৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৬৫৭১)
হাদীছ নং: ১৮৮
উম্মুল মু'মিনীন হযরত উম্মু সালামা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের ওপর এমন এমন শাসক নিযুক্ত হবে, যাদের কোনও কোনও কাজ তোমরা চিনতে পারবে এবং কোনও কোনও কাজ তোমাদের অপরিচিত মনে হবে (অর্থাৎ তাদের কিছু কাজ হবে সৎ এবং কিছু কাজ অসৎ)। সুতরাং যে ব্যক্তি (অসৎকর্ম) ঘৃণা করবে, সে (গুনাহ থেকে) মুক্ত থাকবে। যে ব্যক্তি তার প্রতিবাদ করবে, সে (আখিরাতের জিজ্ঞাসাবাদ থেকে) নিরাপদ থাকবে। কিন্তু যে ব্যক্তি তাতে সন্তুষ্ট থাকবে এবং তার অনুগামী হবে, তার কথা আলাদা (অর্থাৎ সে মুক্ত ও নিরাপদ থাকবে না)। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? তিনি বললেন, না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমাদের মধ্যে সালাত কায়েম করবে মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৫৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৪৭৬০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২২৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৬৫৭১)
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
188 - الخامس: عن أُمِّ المؤمنين أم سلمة هند بنت أَبي أمية حذيفة رضي الله عنها، عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - أنه قَالَ: «إنَّهُ يُسْتَعْمَلُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ فَتَعرِفُونَ وتُنْكِرُونَ، فَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ بَرِئَ، وَمَنْ أنْكَرَ فَقَدْ سَلِمَ، وَلَكِنْ مَنْ رَضِيَ وَتَابَعَ» قَالوا: يَا رَسُول اللهِ، ألا نُقَاتِلهم؟ قَالَ: «لا، مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلاَةَ». رواه مسلم. (1) [ص:84]
معناه: مَنْ كَرِهَ بِقَلْبهِ وَلَمْ يَسْتَطِعْ إنْكَارًا بِيَدٍ وَلا لِسَانٍ فقَدْ بَرِىءَ مِنَ الإِثْمِ، وَأَدَّى وَظيفَتَهُ، وَمَنْ أَنْكَرَ بحَسَبِ طَاقَتِهِ فَقَدْ سَلِمَ مِنْ هذِهِ المَعْصِيَةِ وَمَنْ رَضِيَ بِفِعْلِهِمْ وَتَابَعَهُمْ فَهُوَ العَاصِي.
معناه: مَنْ كَرِهَ بِقَلْبهِ وَلَمْ يَسْتَطِعْ إنْكَارًا بِيَدٍ وَلا لِسَانٍ فقَدْ بَرِىءَ مِنَ الإِثْمِ، وَأَدَّى وَظيفَتَهُ، وَمَنْ أَنْكَرَ بحَسَبِ طَاقَتِهِ فَقَدْ سَلِمَ مِنْ هذِهِ المَعْصِيَةِ وَمَنْ رَضِيَ بِفِعْلِهِمْ وَتَابَعَهُمْ فَهُوَ العَاصِي.
হাদীস নং: ১৮৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
পাপের ব্যাপক বিস্তার ও ইয়াজুজ-মাজুজ প্রসঙ্গ
হাদীছ নং: ১৮৯
উম্মুল মু'মিনীন হযরত যয়নাব বিনত জাহশ রাযি. থেকে বর্ণিত, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদ্বিগ্ন অবস্থায় তাঁর কাছে প্রবেশ করলেন। তিনি বলছিলেন, লা ইলাহা ইল্লাহ! ধ্বংস আরবের, সেই অনিষ্টের কারণে যা কাছে এসে গেছে। আজ ইয়াযুয-মাযুযের প্রাচীর থেকে এই পরিমাণ খুলে দেওয়া হয়েছে। এই বলে তিনি নিজ বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তার পাশের আঙ্গুল (তর্জনি) দ্বারা বৃত্ত বানিয়ে দেখালেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে নেককার লোক থাকা সত্ত্বেও আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। তিনি বললেন, হাঁ, যখন পাপাচার বেড়ে যাবে -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭০৫৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৮৮০: সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২১৮৭; মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৮৪৮২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৩৯৫৩)
হাদীছ নং: ১৮৯
উম্মুল মু'মিনীন হযরত যয়নাব বিনত জাহশ রাযি. থেকে বর্ণিত, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদ্বিগ্ন অবস্থায় তাঁর কাছে প্রবেশ করলেন। তিনি বলছিলেন, লা ইলাহা ইল্লাহ! ধ্বংস আরবের, সেই অনিষ্টের কারণে যা কাছে এসে গেছে। আজ ইয়াযুয-মাযুযের প্রাচীর থেকে এই পরিমাণ খুলে দেওয়া হয়েছে। এই বলে তিনি নিজ বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তার পাশের আঙ্গুল (তর্জনি) দ্বারা বৃত্ত বানিয়ে দেখালেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে নেককার লোক থাকা সত্ত্বেও আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। তিনি বললেন, হাঁ, যখন পাপাচার বেড়ে যাবে -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭০৫৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৮৮০: সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২১৮৭; মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৮৪৮২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৩৯৫৩)
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
189 - السادس: عن أم المؤمنين أم الحكم زينب بنتِ جحش رَضِي الله عنها: أن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - دخل عَلَيْهَا فَزِعًا، يقول: «لا إلهَ إلاّ الله، وَيلٌ للْعَرَبِ مِنْ شَرٍّ قَدِ اقْتَرَبَ، فُتِحَ اليَوْمَ مِنْ رَدْمِ يَأجُوجَ وَمَأجُوجَ مِثلَ هذِهِ»، وحلّق بأُصبُعيهِ الإبهامِ والتي تليها، فقلتُ: يَا رَسُول الله، أنَهْلِكُ وَفِينَا الصَّالِحُونَ؟ قَالَ: «نَعَمْ، إِذَا كَثُرَ الخَبَثُ (1)». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2)
হাদীস নং: ১৯০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
রাস্তার হক আদায় এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের গুরুত্ব প্রসঙ্গ
হাদীছ নং : ১৯০
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা রাস্তাঘাটে বসা থেকে বিরত থেক। সাহাবীগণ আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাস্তাঘাটে বসা ছাড়া তো আমাদের উপায় নেই। কারণ আমরা তাতে বসে (প্রয়োজনীয়) কথাবার্তা বলি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, একান্ত যদি বসতেই চাও, তবে রাস্তার হক আদায় কর। তারা আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাস্তার আবার হক কী? তিনি বললেন, দৃষ্টি সংযত রাখা, কষ্টদায়ক বিষয় থেকে বিরত থাকা, সালামের উত্তর দেওয়া এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬২২৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২১২১; সুনানে আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১১৩০৯ হাদীছ নং ৪৮১৫; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ১১৫০, সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৯৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৬৬৫)
হাদীছ নং : ১৯০
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা রাস্তাঘাটে বসা থেকে বিরত থেক। সাহাবীগণ আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাস্তাঘাটে বসা ছাড়া তো আমাদের উপায় নেই। কারণ আমরা তাতে বসে (প্রয়োজনীয়) কথাবার্তা বলি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, একান্ত যদি বসতেই চাও, তবে রাস্তার হক আদায় কর। তারা আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাস্তার আবার হক কী? তিনি বললেন, দৃষ্টি সংযত রাখা, কষ্টদায়ক বিষয় থেকে বিরত থাকা, সালামের উত্তর দেওয়া এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬২২৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২১২১; সুনানে আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১১৩০৯ হাদীছ নং ৪৮১৫; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ১১৫০, সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৯৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৬৬৫)
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
190 - السابع: عن أَبي سعيد الخُدري - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «إيَّاكُمْ وَالجُلُوسَ في الطُّرُقَاتِ!» فقالوا: يَا رَسُول الله، مَا لنا مِنْ مجالِسِنا بُدٌّ، نتحدث فِيهَا. فَقَالَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم: «فَإذَا أبَيْتُمْ إلاَّ المَجْلِسَ، فَأَعْطُوا الطَّريقَ حَقَّهُ». قالوا: وما حَقُّ الطَّريقِ يَا رسولَ الله؟ قَالَ: «غَضُّ البَصَرِ، وَكَفُّ الأَذَى، وَرَدُّ السَّلامِ، وَالأمْرُ بِالمَعْرُوفِ، والنَّهيُ عن المُنْكَرِ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীস নং: ১৯১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
পুরুষের জন্য স্বর্ণালংকার ব্যবহারের অবৈধতা
হাদীছ নং : ১৯১
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনৈক ব্যক্তির হাতে একটি সোনার আংটি দেখলেন। তিনি সেটি টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন এবং বললেন, তোমাদের একেকজন আগুনের জ্বলন্ত অঙ্গার খুঁজে নিয়ে নিজ হাতে ব্যবহার করে! তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম চলে গেলে সে ব্যক্তিকে বলা হল, তোমার আংটিটি তুলে নাও এবং কাজে লাগাও। সে ব্যক্তি বলল, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে জিনিস ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন তা আমি কখনও ধরব না - মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২০৯০: বায়হাকী, 'শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৫৯২১। মুসনাদুল বাযযার, হাদীছ নং ৫২২৮; মুস্তাখরাজ আবূ 'আওয়ানা, হাদীছ নং ৮৬১০)
হাদীছ নং : ১৯১
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনৈক ব্যক্তির হাতে একটি সোনার আংটি দেখলেন। তিনি সেটি টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন এবং বললেন, তোমাদের একেকজন আগুনের জ্বলন্ত অঙ্গার খুঁজে নিয়ে নিজ হাতে ব্যবহার করে! তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম চলে গেলে সে ব্যক্তিকে বলা হল, তোমার আংটিটি তুলে নাও এবং কাজে লাগাও। সে ব্যক্তি বলল, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে জিনিস ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন তা আমি কখনও ধরব না - মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২০৯০: বায়হাকী, 'শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৫৯২১। মুসনাদুল বাযযার, হাদীছ নং ৫২২৮; মুস্তাখরাজ আবূ 'আওয়ানা, হাদীছ নং ৮৬১০)
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
191 - الثامن: عن ابن عباس رضي الله عنهما: أن رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - رأى خاتَمًا مِنْ ذهبٍ في يدِ رجلٍ فنَزعه فطرحه، وَقالَ: «يَعْمدُ أحَدُكُمْ إِلَى جَمْرَةٍ مِنْ نَارٍ فَيَجْعَلُهَا في يَدِهِ!». فقِيلَ لِلرَّجُلِ بَعْدَمَا ذهب رَسُول اللهِ - صلى الله عليه وسلم: خُذْ خَاتَمَكَ انْتَفِعْ بِهِ. قَالَ: لاَ واللهِ لا آخُذُهُ أبَدًا وَقَدْ طَرَحَهُ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم. رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ১৯২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
শাসককে সদুপদেশদান এবং সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদা
হাদীছ নং: ১৯২
হাসান বসরী রহ. বলেন, হযরত আইয ইবন আমর রাযি. উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ওহে বাছা! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট রাখাল সেই ব্যক্তি, যে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করে। সুতরাং তুমি তাদের একজন হয়ো না। যিয়াদ তাঁকে বলল, বস। তুমি তো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে ভুসিতুল্য। তিনি বললেন, তাদের মধ্যে আবার কেউ ভুসিতুল্য ছিল নাকি? ভুসি তো হয়েছে তাদের পরবর্তীকালে এবং তাদের ছাড়া অন্যদের মধ্যে.- মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৩০; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৫১১; মুস্তাখরাজ আবু "আওয়ানা, হাদীছ নং ৭০৪৯; মুসনাদ ইবনুল জা'দ, হাদীছ নং ১৩৪৯)
হাদীছ নং: ১৯২
হাসান বসরী রহ. বলেন, হযরত আইয ইবন আমর রাযি. উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ওহে বাছা! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট রাখাল সেই ব্যক্তি, যে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করে। সুতরাং তুমি তাদের একজন হয়ো না। যিয়াদ তাঁকে বলল, বস। তুমি তো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে ভুসিতুল্য। তিনি বললেন, তাদের মধ্যে আবার কেউ ভুসিতুল্য ছিল নাকি? ভুসি তো হয়েছে তাদের পরবর্তীকালে এবং তাদের ছাড়া অন্যদের মধ্যে.- মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৩০; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৫১১; মুস্তাখরাজ আবু "আওয়ানা, হাদীছ নং ৭০৪৯; মুসনাদ ইবনুল জা'দ, হাদীছ নং ১৩৪৯)
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
192 - التاسع: عن أَبي سعيد الحسن البصري: أن عائِذَ بن عمرو - رضي الله عنه - دخل عَلَى عُبَيْدِ اللهِ بنِ زياد، فَقَالَ: أي بُنَيَّ، إني سمعت رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «إنَّ شَرَّ الرِّعَاءِ الحُطَمَةُ (1)» فَإِيَّاكَ أَنْ تَكُونَ مِنْهُمْ، فَقَالَ لَهُ: اجلِسْ فَإِنَّمَا أنْتَ مِنْ نُخَالَةِ أصْحَابِ مُحَمَّد - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: وهل كَانَتْ لَهُم نُخَالَةٌ إِنَّمَا كَانَتِ النُّخَالَةُ بَعْدَهُمْ وَفي غَيْرِهِمْ. رواه مسلم. (2)
হাদীস নং: ১৯৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
অসৎকাজে নিষেধ না করা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি নাযিল হওয়া ও দু‘আ কবুল না হওয়ার কারণ
হাদীছ নং : ১৯৩
হযরত হুযায়ফা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ওই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! হয় তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে, নয়তো অচিরেই আল্লাহ তোমাদের ওপর শাস্তি পাঠাবেন। তারপর তোমরা তাঁর কাছে দু'আ করবে, কিন্তু তোমাদের দু'আ কবুল করা হবে না -তিরমিযী।
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি একটি 'হাসান' স্তরের হাদীছ।
(জামে' তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৬৯। বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭১৫২: বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪১৫৪। আত-তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ১৩৭৯ মুসনাদু ইবনুল জা'দ, হাদীছ নং ২৬৯২)
হাদীছ নং : ১৯৩
হযরত হুযায়ফা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ওই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! হয় তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে, নয়তো অচিরেই আল্লাহ তোমাদের ওপর শাস্তি পাঠাবেন। তারপর তোমরা তাঁর কাছে দু'আ করবে, কিন্তু তোমাদের দু'আ কবুল করা হবে না -তিরমিযী।
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি একটি 'হাসান' স্তরের হাদীছ।
(জামে' তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৬৯। বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭১৫২: বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪১৫৪। আত-তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ১৩৭৯ মুসনাদু ইবনুল জা'দ, হাদীছ নং ২৬৯২)
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
193 - العاشر: عن حذيفة - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «وَالَّذِي نَفْسي بِيَدِهِ، لَتَأْمُرُنَّ بِالمَعْرُوفِ، وَلَتَنْهَوُنَّ عَنْ المُنْكَرِ أَوْ لَيُوشِكَنَّ اللهُ أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عِقَابًا مِنْهُ
ثُمَّ تَدْعُوْنَهُ فَلا يُسْتَجَابُ لَكُمْ». رواه الترمذي، (1) وَقالَ: «حديث حسن».
ثُمَّ تَدْعُوْنَهُ فَلا يُسْتَجَابُ لَكُمْ». رواه الترمذي، (1) وَقالَ: «حديث حسن».
হাদীস নং: ১৯৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
জালেম শাসকের সামনে হক কথা বলা
হাদীছ নং : ১৯৪
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, অত্যাচারী শাসকের সামনে ন্যায্য কথা বলা শ্রেষ্ঠতম জিহাদ - আবু দাউদ ও তিরমিযী।
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি একটি 'হাসান' স্তরের হাদীছ।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৪৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৭৫; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০১১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪২০৯; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৬৬২৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭১৭৫)
হাদীছ নং : ১৯৪
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, অত্যাচারী শাসকের সামনে ন্যায্য কথা বলা শ্রেষ্ঠতম জিহাদ - আবু দাউদ ও তিরমিযী।
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি একটি 'হাসান' স্তরের হাদীছ।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৪৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৭৫; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০১১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪২০৯; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৬৬২৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭১৭৫)
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
194 - الحادي عشر: عن أَبي سعيد الخدري - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «أفْضَلُ الجِهَادِ كَلِمَةُ عَدْلٍ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائرٍ». رواه أَبُو داود والترمذي، وَقالَ: «حديث حسن». (1)
হাদীস নং: ১৯৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
জালেম শাসকের সামনে হক কথা বলা
হাদীছ নং : ১৯৪
হযরত আবূ আব্দুল্লাহ তারিক ইবন শিহাব বাজালী রাযি. থেকে বর্ণিত যে, একবার নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সওয়ারীর রেকাবীতে পা রেখেছেন — ঠিক এ অবস্থায় জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, কোন জিহাদ শ্রেষ্ঠ? তিনি বললেন, জালেম শাসকের সামনে হক কথা বলা - নাসাঈ।
(সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪২০৯, আত-তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ১৫৯৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৪৭৪)
হাদীছ নং : ১৯৪
হযরত আবূ আব্দুল্লাহ তারিক ইবন শিহাব বাজালী রাযি. থেকে বর্ণিত যে, একবার নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সওয়ারীর রেকাবীতে পা রেখেছেন — ঠিক এ অবস্থায় জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, কোন জিহাদ শ্রেষ্ঠ? তিনি বললেন, জালেম শাসকের সামনে হক কথা বলা - নাসাঈ।
(সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪২০৯, আত-তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ১৫৯৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৪৭৪)
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
195 - الثاني عشر: عن أَبي عبدِ الله طارِقِ بن شِهاب البَجَليِّ الأَحْمَسِيّ - رضي الله عنه: أنَّ رجلًا سأل النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - وقد وضع رِجله في الغَرْزِ: أيُّ الجِهادِ أَفضلُ؟ قَالَ: «كَلِمَةُ حَقٍّ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائرٍ». رواه النسائي بإسناد صحيح. (1)
«الغرز» بغين معجمة مفتوحة ثُمَّ راء ساكنة ثُمَّ زاي: وَهُوَ ركاب كَوْرِ الجملِ إِذَا كَانَ من جلد أَوْ خشب وقيل: لا يختص بجلد وخشب.
«الغرز» بغين معجمة مفتوحة ثُمَّ راء ساكنة ثُمَّ زاي: وَهُوَ ركاب كَوْرِ الجملِ إِذَا كَانَ من جلد أَوْ خشب وقيل: لا يختص بجلد وخشب.
হাদীস নং: ১৯৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
কারও পাপাচারে লিপ্ততার ক্ষেত্রে বনী ইসরাঈলের কর্মপন্থা ও তার ভয়ংকর পরিণাম
হাদীছ নং : ১৯৬
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, বনী ইসরাঈলের মধ্যে সর্বপ্রথম যে ত্রুটি দেখা দেয় তা ছিল এই যে, তাদের এক ব্যক্তি আরেক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করত আর তাকে বলত, ওহে! আল্লাহকে ভয় কর এবং তুমি যা করছ তা ছেড়ে দাও, কেননা এটা তোমার জন্য বৈধ নয়। পরদিন আবার তার সঙ্গে দেখা হত আর তখনও সে লোকটি আপন অবস্থায় রয়ে গেছে। কিন্তু তার এ অবস্থা তাকে তার সাথে পানাহার ও ওঠা-বসায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখত না। তারা যখন এরূপ করল, তখন আল্লাহ তা'আলা তাদের একের অন্তরকে অন্যের অন্তরের মত করে দিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঠ করলেন-
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ (78) كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ (79) تَرَى كَثِيرًا مِنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنْفُسُهُمْ أَنْ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَفِي الْعَذَابِ هُمْ خَالِدُونَ (80) وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ وَلَكِنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ فَاسِقُونَ (81)
“বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল, তাদের প্রতি দাউদ ও ঈসা ইবনে মারয়ামের যবানীতে লানত বর্ষিত হয়েছিল। তা এ কারণে যে, তারা অবাধ্যতা করেছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত। তারা যেসব অসৎ কাজ করত, তাতে একে অন্যকে নিষেধ করত না। বস্তুত তাদের কর্মপন্থা ছিল অতি মন্দ। তুমি তাদের অনেককেই দেখছ, কাফিরদেরকে নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে। নিশ্চয়ই তারা নিজেদের জন্য যা সামনে পাঠিয়েছে, তা অতি মন্দ। কেননা (সে কারণে) আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তারা সর্বদা শাস্তির ভেতর থাকবে। তারা যদি আল্লাহ, নবী এবং তার প্রতি যা নাযিল হয়েছে তাতে ঈমান রাখত, তবে তাদেরকে (মূর্তিপূজারীদেরকে) বন্ধু বানাত না। কিন্তু (প্রকৃত ব্যাপার হল) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য। সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৭৮-৮১
তারপর তিনি ইরশাদ করেন, কখনও নয়, আল্লাহর শপথ! তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে, জালেমের হাত শক্ত করে ধরবে, তাকে সত্যের দিকে ফিরিয়ে আনবে এবং তাকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখবে। অন্যথায় আল্লাহ তা'আলা তোমাদের অন্তরসমূহ পরস্পর মিশ্রিত করে দেবেন। তারপর তাদের প্রতি যেমন অভিসম্পাত করেছিলেন, তেমনি তোমাদের প্রতিও অভিসম্পাত করবেন। -আবূ দাউদ ও তিরমিযী। সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৩৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩০৫০; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০০৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩৭১৩
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি একটি হাসান স্তরের হাদীছ। এ বর্ণনাটির ভাষা ইমাম আবূ দাউদ রহ.-এর। ইমাম তিরমিযী রহ.-এর ভাষায় তা নিম্নরূপ :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, বনী ইসরাঈল যখন পাপাচারে লিপ্ত হল, তখন তাদের আলেমগণ তাদেরকে নিষেধ করল। কিন্তু তারা ক্ষান্ত হল না। তারপর তারা তাদের মজলিসসমূহে তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে থাকল এবং তাদের সঙ্গে পানাহার অব্যাহত রাখল। ফলে আল্লাহ তা'আলা তাদের অন্তরসমূহ একরকম করে দিলেন এবং হযরত দাউদ ও হযরত ঈসা ইবন মারয়ামের যবানীতে তাদের ওপর অভিসম্পাত করলেন। তা এজন্য যে, তারা নাফরমানী করেছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করছিল। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোজা হয়ে বসলেন। এতক্ষণ তিনি হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন। তারপর বললেন, না, সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ। যতক্ষণ না তোমরা তাদেরকে পুরোপুরিভাবে সত্যের ওপর ফিরিয়ে আন।
হাদীছ নং : ১৯৬
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, বনী ইসরাঈলের মধ্যে সর্বপ্রথম যে ত্রুটি দেখা দেয় তা ছিল এই যে, তাদের এক ব্যক্তি আরেক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করত আর তাকে বলত, ওহে! আল্লাহকে ভয় কর এবং তুমি যা করছ তা ছেড়ে দাও, কেননা এটা তোমার জন্য বৈধ নয়। পরদিন আবার তার সঙ্গে দেখা হত আর তখনও সে লোকটি আপন অবস্থায় রয়ে গেছে। কিন্তু তার এ অবস্থা তাকে তার সাথে পানাহার ও ওঠা-বসায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখত না। তারা যখন এরূপ করল, তখন আল্লাহ তা'আলা তাদের একের অন্তরকে অন্যের অন্তরের মত করে দিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঠ করলেন-
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ (78) كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ (79) تَرَى كَثِيرًا مِنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنْفُسُهُمْ أَنْ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَفِي الْعَذَابِ هُمْ خَالِدُونَ (80) وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ وَلَكِنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ فَاسِقُونَ (81)
“বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল, তাদের প্রতি দাউদ ও ঈসা ইবনে মারয়ামের যবানীতে লানত বর্ষিত হয়েছিল। তা এ কারণে যে, তারা অবাধ্যতা করেছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত। তারা যেসব অসৎ কাজ করত, তাতে একে অন্যকে নিষেধ করত না। বস্তুত তাদের কর্মপন্থা ছিল অতি মন্দ। তুমি তাদের অনেককেই দেখছ, কাফিরদেরকে নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে। নিশ্চয়ই তারা নিজেদের জন্য যা সামনে পাঠিয়েছে, তা অতি মন্দ। কেননা (সে কারণে) আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তারা সর্বদা শাস্তির ভেতর থাকবে। তারা যদি আল্লাহ, নবী এবং তার প্রতি যা নাযিল হয়েছে তাতে ঈমান রাখত, তবে তাদেরকে (মূর্তিপূজারীদেরকে) বন্ধু বানাত না। কিন্তু (প্রকৃত ব্যাপার হল) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য। সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৭৮-৮১
তারপর তিনি ইরশাদ করেন, কখনও নয়, আল্লাহর শপথ! তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে, জালেমের হাত শক্ত করে ধরবে, তাকে সত্যের দিকে ফিরিয়ে আনবে এবং তাকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখবে। অন্যথায় আল্লাহ তা'আলা তোমাদের অন্তরসমূহ পরস্পর মিশ্রিত করে দেবেন। তারপর তাদের প্রতি যেমন অভিসম্পাত করেছিলেন, তেমনি তোমাদের প্রতিও অভিসম্পাত করবেন। -আবূ দাউদ ও তিরমিযী। সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৩৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩০৫০; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০০৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩৭১৩
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি একটি হাসান স্তরের হাদীছ। এ বর্ণনাটির ভাষা ইমাম আবূ দাউদ রহ.-এর। ইমাম তিরমিযী রহ.-এর ভাষায় তা নিম্নরূপ :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, বনী ইসরাঈল যখন পাপাচারে লিপ্ত হল, তখন তাদের আলেমগণ তাদেরকে নিষেধ করল। কিন্তু তারা ক্ষান্ত হল না। তারপর তারা তাদের মজলিসসমূহে তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে থাকল এবং তাদের সঙ্গে পানাহার অব্যাহত রাখল। ফলে আল্লাহ তা'আলা তাদের অন্তরসমূহ একরকম করে দিলেন এবং হযরত দাউদ ও হযরত ঈসা ইবন মারয়ামের যবানীতে তাদের ওপর অভিসম্পাত করলেন। তা এজন্য যে, তারা নাফরমানী করেছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করছিল। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোজা হয়ে বসলেন। এতক্ষণ তিনি হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন। তারপর বললেন, না, সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ। যতক্ষণ না তোমরা তাদেরকে পুরোপুরিভাবে সত্যের ওপর ফিরিয়ে আন।
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
196 - الثالث عشر: عن ابن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «إنَّ أوَّلَ مَا دَخَلَ النَّقْصُ عَلَى بَنِي إسْرَائِيلَ أنَّهُ كَانَ الرَّجُلُ يَلْقَى الرَّجُلَ، فَيَقُولُ: يَا هَذَا، اتَّقِ الله ودَعْ مَا تَصْنَعُ فَإِنَّهُ لاَ يَحِلُّ لَكَ، ثُمَّ يَلْقَاهُ مِنَ الغَدِ وَهُوَ عَلَى حَالِهِ، فَلا يَمْنَعُهُ ذلِكَ أَنْ يَكُونَ أكِيلَهُ وَشَريبَهُ وَقَعيدَهُ، فَلَمَّا فَعَلُوا ذلِكَ ضَرَبَ اللهُ قُلُوبَ بَعْضِهِمْ بِبَعْضٍ» ثُمَّ قَالَ: {لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرائيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُدَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ كَانُوا لا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ تَرَى كَثِيرًا مِنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنْفُسُهُمْ} - إِلَى قوله - {فاسِقُونَ} [المائدة: 78 - 81] ثُمَّ قَالَ: «كَلاَّ، وَاللهِ لَتَأمُرُنَّ بالمَعْرُوفِ، وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ المُنْكَرِ، وَلَتَأخُذُنَّ عَلَى يَدِ الظَّالِمِ، وَلَتَأطِرُنَّهُ عَلَى الحَقِّ أطْرًا، وَلَتَقْصُرُنَّه عَلَى الحَقِّ قَصْرًا، أَوْ لَيَضْرِبَنَّ اللهُ بقُلُوبِ بَعْضِكُمْ عَلَى بَعْضٍ، ثُمَّ ليَلْعَننكُمْ كَمَا لَعَنَهُمْ». رواه أَبُو داود والترمذي، وَقالَ: «حديث حسن». (1) [ص:86]
هَذَا لفظ أَبي داود، ولفظ الترمذي، قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «لَمَّا وَقَعَتْ بَنُو إسْرَائِيلَ في المَعَاصي نَهَتْهُمْ عُلَمَاؤهُمْ فَلَمْ يَنْتَهُوا، فَجَالَسُوهُمْ في مَجَالِسِهمْ، وَوَاكَلُوهُمْ وَشَارَبُوهُمْ، فَضَربَ اللهُ قُلُوبَ بَعضِهِمْ بِبعْضٍ، وَلَعَنَهُمْ عَلَى لِسانِ دَاوُد وعِيسَى ابنِ مَرْيَمَ ذلِكَ بما عَصَوا وَكَانُوا يَعتَدُونَ» فَجَلَسَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - وكان مُتَّكِئًا، فَقَالَ: «لا، والَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ حَتَّى تَأطِرُوهُمْ عَلَى الحَقِّ أطْرًا».
قوله: «تَأطِرُوهم»: أي تعطفوهم. «ولتقْصُرُنَّهُ»: أي لتحبِسُنَّه.
هَذَا لفظ أَبي داود، ولفظ الترمذي، قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «لَمَّا وَقَعَتْ بَنُو إسْرَائِيلَ في المَعَاصي نَهَتْهُمْ عُلَمَاؤهُمْ فَلَمْ يَنْتَهُوا، فَجَالَسُوهُمْ في مَجَالِسِهمْ، وَوَاكَلُوهُمْ وَشَارَبُوهُمْ، فَضَربَ اللهُ قُلُوبَ بَعضِهِمْ بِبعْضٍ، وَلَعَنَهُمْ عَلَى لِسانِ دَاوُد وعِيسَى ابنِ مَرْيَمَ ذلِكَ بما عَصَوا وَكَانُوا يَعتَدُونَ» فَجَلَسَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - وكان مُتَّكِئًا، فَقَالَ: «لا، والَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ حَتَّى تَأطِرُوهُمْ عَلَى الحَقِّ أطْرًا».
قوله: «تَأطِرُوهم»: أي تعطفوهم. «ولتقْصُرُنَّهُ»: أي لتحبِسُنَّه.
হাদীস নং: ১৯৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
জালেমকে জুলুম করতে বাধা না দেওয়ার পরিণাম সর্বগ্রাসী শাস্তি
হাদীছ নং: ১৯৭
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বলেন, হে লোকসকল! তোমরা এ আয়াত পড়ে থাক যে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لَا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ
['হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের চিন্তা কর। তোমরা সঠিক পথে থাকলে যারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে, তারা তোমাদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।' -সূরা মায়িদা, আয়াত ১০৫]
অথচ আমি নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, মানুষ যখন কাউকে জুলুম করতে দেখা সত্ত্বেও তার দু'হাত ধরে না রাখে, তবে অচিরেই আল্লাহ তা'আলা তাদের সকলকে সর্বব্যাপী শাস্তিতে নিপতিত করবেন - আবূ দাউদ, তিরমিযী ও নাসাঈ।
(সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৩৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৬৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩১; মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীছ নং ৩ঃ সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩০৪)
হাদীছ নং: ১৯৭
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বলেন, হে লোকসকল! তোমরা এ আয়াত পড়ে থাক যে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لَا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ
['হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের চিন্তা কর। তোমরা সঠিক পথে থাকলে যারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে, তারা তোমাদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।' -সূরা মায়িদা, আয়াত ১০৫]
অথচ আমি নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, মানুষ যখন কাউকে জুলুম করতে দেখা সত্ত্বেও তার দু'হাত ধরে না রাখে, তবে অচিরেই আল্লাহ তা'আলা তাদের সকলকে সর্বব্যাপী শাস্তিতে নিপতিত করবেন - আবূ দাউদ, তিরমিযী ও নাসাঈ।
(সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৩৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৬৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩১; মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীছ নং ৩ঃ সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩০৪)
مقدمة الامام النووي
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
197 - الرابع عشر: عن أَبي بكر الصديق - رضي الله عنه - قَالَ: يَا أيّها النَّاس، إنّكم لتَقرؤُون هذِهِ الآية: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ} [المائدة: 105] وإني سمعت رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «إنَّ النَّاسَ إِذَا رَأَوُا الظَّالِمَ فَلَمْ يأخُذُوا عَلَى يَدَيْهِ أوشَكَ أَنْ يَعُمَّهُمُ اللهُ بِعِقَابٍ مِنْهُ». رواه أَبُو داود والترمذي والنسائي بأسانيد صحيحة. (1)
হাদীস নং: ১৯৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অন্যকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করে
নিজে তার বিপরীত করার কঠিন শাস্তি
'আমর বিল মা'রূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার তথা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব এজন্যই দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষ অসৎকাজ ছেড়ে দিয়ে সৎকাজে লিপ্ত হয়, এককথায় তারা শরী'আতের ওপর চলে। এ দায়িত্ব কোনও বিনোদনমূলক শিল্প নয় যে, কিছু লোক যত্নের সাথে এটা শিখবে, তারপর সুন্দর উপস্থাপনা ও আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গি দ্বারা তা মঞ্চস্থ করে দর্শক ও শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করবে। বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সংশোধন ও তাদের আমল-আখলাকের পরিবর্তন ঘটিয়ে তাদেরকে আল্লাহ তা'আলার প্রকৃত বান্দারূপে গড়ে তোলা, যাতে তারা আখিরাতে জাহান্নাম থেকে নাজাত পেয়ে জান্নাত লাভের উপযুক্ত হতে পারে। আল্লাহ তা'আলার প্রকৃত বান্দা হয়ে ওঠা যেমন দর্শক ও শ্রোতার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বক্তার নিজেরও। যাকে সৎকাজের আদেশ করা হবে তার যেমন সৎকাজ করা দরকার, তেমনি তা দরকার আদেশদাতারও। অসৎকাজ থেকে বিরত থাকা যেমন অসৎ কাজকারীরও দরকার, তেমনি দরকার যে ব্যক্তি তাকে নিষেধ করবে তারও।
সুতরাং যারা 'আমর বিল মারূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার'-এর দায়িত্ব পালন করবে, তাদের নিজেদেরও কর্তব্য সৎকাজ আঞ্জাম দেওয়া ও অসৎকাজ থেকে বিরত থাকায় যত্নবান হওয়া।
এ ব্যাপারে তাদের যত্নবান হওয়ার প্রয়োজন এ কারণেও যে, নিজের আমল ঠিক না থাকলে আদেশ-নিষেধের বিশেষ আছর হয় না। বরং যাদেরকে আদেশ-নিষেধ করা হয় তারা এটাকে তামাশা হিসেবে দেখে এবং মনে মনে তিরস্কার করে যে, এহ্, নিজে আমল করে না আবার অন্যকে নসীহত করে বেড়ায়। এমনকি আমলবিহীন বক্তার বক্তব্যে অন্যরা আমলের প্রতি উৎসাহী তো হয়ই না; উল্টো তাদের অন্তর থেকে আমলের গুরুত্ব হালকা হয়ে যায়। এটা তো অতি গুরুতর ব্যাপার হল যে, যে ওয়াজ-নসীহতের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে আমলওয়ালা বানানো, উল্টো তা তাদের আমলবিমুখ হওয়ার কারণ হয়ে গেল। নিশ্চয়ই এ জাতীয় ওয়াজ-নসীহত করা অপেক্ষা না করাই ভালো। তাই কুরআন ও হাদীছে এ জাতীয় ওয়াজ-নসীহতের কঠোর নিন্দা করা হয়েছে এবং আখিরাতে এরূপ লোকদের কঠিন শাস্তিতে নিপতিত হওয়ার সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, ওয়াজ-নসীহতের জন্য নিজের আমল পুরোপুরি ঠিক থাকা শর্ত নয়। শর্ত হচ্ছে আমলের প্রতি গাফেল না থাকা। যে ব্যক্তি নিজে আমলে সচেষ্ট থাকে, তারপর কিছু ভুলত্রুটিও হয়ে যায়, তার জন্য ওয়াজ-নসীহত ও আদেশ-নিষেধ করা নিষেধ নয়; বরং এরূপ ব্যক্তির আদেশ-নিষেধ অন্যদের সংশোধনের পাশাপাশি নিজ সংশোধনের পক্ষেও সহায়ক হয়। আদেশ-নিষেধ ও ওয়াজ-নসীহতের জন্য পরিপূর্ণ আমলওয়ালা হওয়ার শর্ত করা হলে এ কাজ করার লোকই পাওয়া যাবে না। তাতে শরী'আতের এ গুরুত্বপূর্ণ বিধানটি সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে যাবে। ফলে অন্যায়-অসৎকর্ম বাড়তেই থাকবে। তা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করে নিজে তার বিপরীত করলে সেজন্য যে কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে— সে সম্পর্কিত কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
‘অন্যকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করে নিজে তার বিপরীত করার কঠিন শাস্তি' সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ (44)
অর্থ : তোমরা কি অন্য লোকদেরকে পুণ্যের আদেশ কর আর নিজেদেরকে ভুলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াতও কর। তোমরা কি এতটুকুও বোঝ না? সূরা বাকারা (২), আয়াত ৪৪
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বনী ইসরাঈলকে তাদের কর্মপন্থার কারণে তিরস্কার করেছেন। তারা মানুষকে নেককাজের হুকুম করত। আত্মীয়তা রক্ষা করা, মানুষের প্রতি সদ্ব্যবহার করা, আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা ইত্যাদি বিষয়ে আদেশ-উপদেশ দিত। কিন্তু নিজেরা তা পালন করত না। মানুষকে সৎকর্মের হুকুম দিয়ে নিজে তা পালন না করা যে গর্হিত কাজ তা তারা জানত। কারণ তারা তাদের কিতাব তাওরাত ও ইন্জীল পড়ত। তাতে এরূপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। জেনেশুনে এরূপ গর্হিত কাজ করা অধিকতর নিন্দনীয়। তা সত্ত্বেও তারা এরূপ করত। তাই আল্লাহ তা'আলা তাদের তিরস্কার করেছেন এবং এটাকে একটা নির্বুদ্ধিতা সাব্যস্ত করেছেন। কারণ যে-কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তি বলবে যে, যে কাজটি ভালো, অন্যকে তা করতে বলে নিজে কিভাবে করা হতে বিরত থাকা যায়? কিংবা নিজে তা না করে অন্যকে কিভাবে করতে বলা যায়? বাস্তবিকই তা যদি ভালো হয় তবে তো আগে নিজেরই তা করা উচিত। সর্ববিচারেই অন্যকে ভালো কাজ করতে বলে নিজে তা থেকে বিরত থাকা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।
এ তিরস্কারটি যদিও বনী ইসরাঈলকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে যে-কেউ এরূপ কাজ করবে তার জন্যই এটা প্রযোজ্য। সুতরাং আমরা যাতে এ তিরস্কারের আওতায় না পড়ি, সেজন্য আমাদের উচিত হবে অন্যকে কোনও ভালো কাজ করতে বললে নিজেও তা করতে সচেষ্ট থাকা। আর অন্যকে সৎকাজ করতে বলা তো শরী'আতের এক অবশ্যপালনীয় হুকুম। কাজেই অন্যকে তা বলতেই হবে। অন্যকে যখন বলতেই হবে, তখন নিজেরও সে আমলে যত্নবান থাকার চেষ্টা করতে হবে।
দুই নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ (2) كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ (3)
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না? আল্লাহর কাছে এ বিষয়টা অতি অপসন্দনীয় যে, তোমরা এমন কথা বলবে, যা তোমরা কর না।সুরা সাফ্ (৬১), আয়াত ২-৩
ব্যাখ্যা
বর্ণিত আছে যে, কোনও কোনও মুসলিম বলেছিল- কোন আমলটি আল্লাহর বেশি প্রিয় তা জানতে পারলে আমরা নিজেদের জানমাল তাতে খরচ করতাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা'আলা নাযিল করেন-
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ (4)
"বস্তুত আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন, যারা তাঁর পথে এভাবে সারিবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করে, যেন তারা শিশাঢালা প্রাচীর। সূরা সাফ (৬১), আয়াত ৪
অতঃপর উহুদের যুদ্ধ হল। তখন দেখা গেল কাফেরদের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু হলে কেউ কেউ জান নিয়ে পালাল। এ পলায়ন তাদের কথার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হল না। তাই আল্লাহ তা'আলা আলোচ্য আয়াতে তাদেরকে তিরস্কার করেছেন যে, যা পারবে না তা বল কেন? মুখে তো বলেছিলে আল্লাহ তা'আলার সর্বাপেক্ষা প্রিয় কাজটি সম্পর্কে জানতে পারলে তার জন্য জানমাল দিয়ে দেবে। কই, এখন যে পালালে? সুতরাং আগেভাগে বড় বড় দাবি করে বসো না; বরং যখন জানমাল দেওয়ার পরিস্থিতি আসে, তখন অকাতরে জানমাল দিয়ে দাও।
প্রকাশ থাকে যে, উহুদের যুদ্ধে প্রথমদিকে জয়ের পালা মুসলমানদের পক্ষেই ছিল। পরিস্থিতি অনুকূলে দেখতে পাওয়ায় কোনও কোনও সাহাবীর পক্ষ থেকে সতর্কতার ব্যাপারে কিছুটা শিথিলতা দেখা দিয়েছিল। সে অবকাশে তাদের ওপর কাফেরদের পক্ষ থেকে অতর্কিত আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। অপ্রস্তুত অবস্থার সে আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁরা সম্বিত ফিরে পান এবং পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাতে অনেকেই শহীদ হয়ে যান এবং অনেকে মারাত্মকভাবে আহত হন। ওই যে ক্ষণিকের অসতর্কতা ও জান নিয়ে পলায়ন, এটা তাদের উচ্চমর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না বলেই আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে তিরস্কার করেছেন।
আমাদের মত দুর্বলদের দ্বারা এরচে' অনেক বড় বড় দোষত্রুটি হয়ে যায়। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে তিরস্কার করেছেন বলে আমরাও তাদের তিরস্কার শুরু করে দেব বা তাদের মর্যাদা খাটো করে দেখব, এর কোনও বৈধতা থাকতে পারে না। দীন ও ঈমানের জন্য তাঁরা যে ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করেছেন, যার বদৌলতে আজ আমরা বিনা ত্যাগেই দীন ও ঈমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, সেজন্য জীবনভর তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত এবং আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাদের জন্য উত্তম প্রতিদানের দু'আ করা উচিত।
প্রকৃতপক্ষে এ আয়াত আমাদের জন্যই বেশি প্রযোজ্য। আমরাই মুখে বড় বড় কথা বলি, কিন্তু আমল করি তার সামান্যই। আমাদের কথার সঙ্গে কাজের মিল বড় কম। আদেশ-উপদেশ এমনভাবে দেওয়া হয়, যেন নিজের আমল কত উন্নত। কার্যত সময় কাটে চরম গাফলাতির মধ্যে। তাই 'তোমরা যা কর না তা কেন বল'- এ তিরস্কার বাণী আমাদের বেলায়ই বেশি খাটে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত এবং মুখে যা বলি বাস্তবেও যেন অবশ্যই তা করি, সেই চেষ্টা করা উচিত।
তিন নং আয়াত
وقال تعالى إختبارًا عَنْ شُعَيْبٍ ﷺ وَمَا أُرِيدُ أَنْ أُخَالِفَكُمْ إِلَى مَا أَنْهَاكُمْ عَنْهُ
অর্থ : আল্লাহ তা'আলা হযরত শু'আইব আলাইহিস সালাম-এর বাণী উদ্ধৃত করেন- আমার এমন কোনও ইচ্ছা নেই যে, আমি যেসব বিষয়ে তোমাদেরকে নিষেধ করি, তোমাদের পেছনে গিয়ে নিজেই তা করতে থাকব।সূরা হুদ (১১), আয়াত ৮৮
ব্যাখ্যা
হযরত শুআইব আলাইহিস সালাম একজন উচ্চস্তরের নবী। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে মাদয়ান ও আয়কাবাসীদের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। এ স্থানদু'টি বর্তমান সৌদি আরবের উত্তর দিকে আকাবা উপসাগরের পূর্বে অবস্থিত। এখানকার অধিবাসীরা ছিল মূর্তিপূজারী। তাদের আখলাক-চরিত্র ছিল অত্যন্ত নিম্নপর্যায়ের। তারা দস্যুবৃত্তি করত, মাপে কম দিত এবং মানুষকে ঠকাত। আল্লাহ তা'আলা তাদের হিদায়াতের জন্য হযরত শুআইব আলাইহিস সালামকে নবী করে পাঠান। তিনি তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং দস্যুবৃত্তি পরিত্যাগ ও মানুষের হক নষ্ট করা হতে বিরত থাকার আহ্বান জানান। তিনি একজন সুবক্তা ছিলেন। তাঁকে 'খতীবুল আম্বিয়া' অর্থাৎ নবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বক্তা বলা হয়ে থাকে। তিনি আদেশ-উপদেশদানের একপর্যায়ে তাদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
وَمَا أُرِيدُ أَنْ أُخَالِفَكُمْ إِلَى مَا أَنْهَاكُمْ عَنْهُ
‘আমার এমন কোনও ইচ্ছা নেই যে, আমি যেসব বিষয়ে তোমাদেরকে নিষেধ করি, তোমাদের পেছনে গিয়ে নিজেই তা করতে থাকব।'
অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে যেসব বিষয়ে নিষেধ করি সেগুলো তো মন্দ কাজ। আর তা যখন মন্দ তখন তাতে আমার লিপ্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। হাঁ, যদি তা ভালো কাজ হত, তবে আমি অবশ্যই করতাম। সে ক্ষেত্রে তোমাদেরকে তা করতে নিষেধ করতাম না। মোটকথা আমি তোমাদের বলব একটা আর নিজে করব অন্যটা, সেরকম লোক আমি নই। আমি একজন নবী। আর নবীগণ যা বলেন, নিজেরা তা করেও দেখান, যাতে মানুষ তাদের আমলকে নিজেদের আমলের জন্য আদর্শরূপে গ্রহণ করতে পারে।
হযরত শুআইব আলাইহিস সালামের এ বক্তব্য উল্লেখ করার দ্বারা সবকালের আদেশ-নিষেধকারীকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে, তারাও যেন মানুষকে যা বলে নিজেরা তার বিপরীত না করে; বরং যা বলে, সে ব্যাপারে নিজেদের আমল যেন অন্যদের জন্য নমুনাস্বরূপ হয়।
নিজে তার বিপরীত করার কঠিন শাস্তি
'আমর বিল মা'রূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার তথা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব এজন্যই দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষ অসৎকাজ ছেড়ে দিয়ে সৎকাজে লিপ্ত হয়, এককথায় তারা শরী'আতের ওপর চলে। এ দায়িত্ব কোনও বিনোদনমূলক শিল্প নয় যে, কিছু লোক যত্নের সাথে এটা শিখবে, তারপর সুন্দর উপস্থাপনা ও আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গি দ্বারা তা মঞ্চস্থ করে দর্শক ও শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করবে। বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সংশোধন ও তাদের আমল-আখলাকের পরিবর্তন ঘটিয়ে তাদেরকে আল্লাহ তা'আলার প্রকৃত বান্দারূপে গড়ে তোলা, যাতে তারা আখিরাতে জাহান্নাম থেকে নাজাত পেয়ে জান্নাত লাভের উপযুক্ত হতে পারে। আল্লাহ তা'আলার প্রকৃত বান্দা হয়ে ওঠা যেমন দর্শক ও শ্রোতার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বক্তার নিজেরও। যাকে সৎকাজের আদেশ করা হবে তার যেমন সৎকাজ করা দরকার, তেমনি তা দরকার আদেশদাতারও। অসৎকাজ থেকে বিরত থাকা যেমন অসৎ কাজকারীরও দরকার, তেমনি দরকার যে ব্যক্তি তাকে নিষেধ করবে তারও।
সুতরাং যারা 'আমর বিল মারূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার'-এর দায়িত্ব পালন করবে, তাদের নিজেদেরও কর্তব্য সৎকাজ আঞ্জাম দেওয়া ও অসৎকাজ থেকে বিরত থাকায় যত্নবান হওয়া।
এ ব্যাপারে তাদের যত্নবান হওয়ার প্রয়োজন এ কারণেও যে, নিজের আমল ঠিক না থাকলে আদেশ-নিষেধের বিশেষ আছর হয় না। বরং যাদেরকে আদেশ-নিষেধ করা হয় তারা এটাকে তামাশা হিসেবে দেখে এবং মনে মনে তিরস্কার করে যে, এহ্, নিজে আমল করে না আবার অন্যকে নসীহত করে বেড়ায়। এমনকি আমলবিহীন বক্তার বক্তব্যে অন্যরা আমলের প্রতি উৎসাহী তো হয়ই না; উল্টো তাদের অন্তর থেকে আমলের গুরুত্ব হালকা হয়ে যায়। এটা তো অতি গুরুতর ব্যাপার হল যে, যে ওয়াজ-নসীহতের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে আমলওয়ালা বানানো, উল্টো তা তাদের আমলবিমুখ হওয়ার কারণ হয়ে গেল। নিশ্চয়ই এ জাতীয় ওয়াজ-নসীহত করা অপেক্ষা না করাই ভালো। তাই কুরআন ও হাদীছে এ জাতীয় ওয়াজ-নসীহতের কঠোর নিন্দা করা হয়েছে এবং আখিরাতে এরূপ লোকদের কঠিন শাস্তিতে নিপতিত হওয়ার সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, ওয়াজ-নসীহতের জন্য নিজের আমল পুরোপুরি ঠিক থাকা শর্ত নয়। শর্ত হচ্ছে আমলের প্রতি গাফেল না থাকা। যে ব্যক্তি নিজে আমলে সচেষ্ট থাকে, তারপর কিছু ভুলত্রুটিও হয়ে যায়, তার জন্য ওয়াজ-নসীহত ও আদেশ-নিষেধ করা নিষেধ নয়; বরং এরূপ ব্যক্তির আদেশ-নিষেধ অন্যদের সংশোধনের পাশাপাশি নিজ সংশোধনের পক্ষেও সহায়ক হয়। আদেশ-নিষেধ ও ওয়াজ-নসীহতের জন্য পরিপূর্ণ আমলওয়ালা হওয়ার শর্ত করা হলে এ কাজ করার লোকই পাওয়া যাবে না। তাতে শরী'আতের এ গুরুত্বপূর্ণ বিধানটি সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে যাবে। ফলে অন্যায়-অসৎকর্ম বাড়তেই থাকবে। তা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করে নিজে তার বিপরীত করলে সেজন্য যে কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে— সে সম্পর্কিত কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
‘অন্যকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করে নিজে তার বিপরীত করার কঠিন শাস্তি' সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ (44)
অর্থ : তোমরা কি অন্য লোকদেরকে পুণ্যের আদেশ কর আর নিজেদেরকে ভুলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াতও কর। তোমরা কি এতটুকুও বোঝ না? সূরা বাকারা (২), আয়াত ৪৪
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বনী ইসরাঈলকে তাদের কর্মপন্থার কারণে তিরস্কার করেছেন। তারা মানুষকে নেককাজের হুকুম করত। আত্মীয়তা রক্ষা করা, মানুষের প্রতি সদ্ব্যবহার করা, আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা ইত্যাদি বিষয়ে আদেশ-উপদেশ দিত। কিন্তু নিজেরা তা পালন করত না। মানুষকে সৎকর্মের হুকুম দিয়ে নিজে তা পালন না করা যে গর্হিত কাজ তা তারা জানত। কারণ তারা তাদের কিতাব তাওরাত ও ইন্জীল পড়ত। তাতে এরূপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। জেনেশুনে এরূপ গর্হিত কাজ করা অধিকতর নিন্দনীয়। তা সত্ত্বেও তারা এরূপ করত। তাই আল্লাহ তা'আলা তাদের তিরস্কার করেছেন এবং এটাকে একটা নির্বুদ্ধিতা সাব্যস্ত করেছেন। কারণ যে-কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তি বলবে যে, যে কাজটি ভালো, অন্যকে তা করতে বলে নিজে কিভাবে করা হতে বিরত থাকা যায়? কিংবা নিজে তা না করে অন্যকে কিভাবে করতে বলা যায়? বাস্তবিকই তা যদি ভালো হয় তবে তো আগে নিজেরই তা করা উচিত। সর্ববিচারেই অন্যকে ভালো কাজ করতে বলে নিজে তা থেকে বিরত থাকা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।
এ তিরস্কারটি যদিও বনী ইসরাঈলকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে যে-কেউ এরূপ কাজ করবে তার জন্যই এটা প্রযোজ্য। সুতরাং আমরা যাতে এ তিরস্কারের আওতায় না পড়ি, সেজন্য আমাদের উচিত হবে অন্যকে কোনও ভালো কাজ করতে বললে নিজেও তা করতে সচেষ্ট থাকা। আর অন্যকে সৎকাজ করতে বলা তো শরী'আতের এক অবশ্যপালনীয় হুকুম। কাজেই অন্যকে তা বলতেই হবে। অন্যকে যখন বলতেই হবে, তখন নিজেরও সে আমলে যত্নবান থাকার চেষ্টা করতে হবে।
দুই নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ (2) كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ (3)
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না? আল্লাহর কাছে এ বিষয়টা অতি অপসন্দনীয় যে, তোমরা এমন কথা বলবে, যা তোমরা কর না।সুরা সাফ্ (৬১), আয়াত ২-৩
ব্যাখ্যা
বর্ণিত আছে যে, কোনও কোনও মুসলিম বলেছিল- কোন আমলটি আল্লাহর বেশি প্রিয় তা জানতে পারলে আমরা নিজেদের জানমাল তাতে খরচ করতাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা'আলা নাযিল করেন-
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ (4)
"বস্তুত আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন, যারা তাঁর পথে এভাবে সারিবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করে, যেন তারা শিশাঢালা প্রাচীর। সূরা সাফ (৬১), আয়াত ৪
অতঃপর উহুদের যুদ্ধ হল। তখন দেখা গেল কাফেরদের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু হলে কেউ কেউ জান নিয়ে পালাল। এ পলায়ন তাদের কথার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হল না। তাই আল্লাহ তা'আলা আলোচ্য আয়াতে তাদেরকে তিরস্কার করেছেন যে, যা পারবে না তা বল কেন? মুখে তো বলেছিলে আল্লাহ তা'আলার সর্বাপেক্ষা প্রিয় কাজটি সম্পর্কে জানতে পারলে তার জন্য জানমাল দিয়ে দেবে। কই, এখন যে পালালে? সুতরাং আগেভাগে বড় বড় দাবি করে বসো না; বরং যখন জানমাল দেওয়ার পরিস্থিতি আসে, তখন অকাতরে জানমাল দিয়ে দাও।
প্রকাশ থাকে যে, উহুদের যুদ্ধে প্রথমদিকে জয়ের পালা মুসলমানদের পক্ষেই ছিল। পরিস্থিতি অনুকূলে দেখতে পাওয়ায় কোনও কোনও সাহাবীর পক্ষ থেকে সতর্কতার ব্যাপারে কিছুটা শিথিলতা দেখা দিয়েছিল। সে অবকাশে তাদের ওপর কাফেরদের পক্ষ থেকে অতর্কিত আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। অপ্রস্তুত অবস্থার সে আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁরা সম্বিত ফিরে পান এবং পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাতে অনেকেই শহীদ হয়ে যান এবং অনেকে মারাত্মকভাবে আহত হন। ওই যে ক্ষণিকের অসতর্কতা ও জান নিয়ে পলায়ন, এটা তাদের উচ্চমর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না বলেই আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে তিরস্কার করেছেন।
আমাদের মত দুর্বলদের দ্বারা এরচে' অনেক বড় বড় দোষত্রুটি হয়ে যায়। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে তিরস্কার করেছেন বলে আমরাও তাদের তিরস্কার শুরু করে দেব বা তাদের মর্যাদা খাটো করে দেখব, এর কোনও বৈধতা থাকতে পারে না। দীন ও ঈমানের জন্য তাঁরা যে ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করেছেন, যার বদৌলতে আজ আমরা বিনা ত্যাগেই দীন ও ঈমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, সেজন্য জীবনভর তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত এবং আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাদের জন্য উত্তম প্রতিদানের দু'আ করা উচিত।
প্রকৃতপক্ষে এ আয়াত আমাদের জন্যই বেশি প্রযোজ্য। আমরাই মুখে বড় বড় কথা বলি, কিন্তু আমল করি তার সামান্যই। আমাদের কথার সঙ্গে কাজের মিল বড় কম। আদেশ-উপদেশ এমনভাবে দেওয়া হয়, যেন নিজের আমল কত উন্নত। কার্যত সময় কাটে চরম গাফলাতির মধ্যে। তাই 'তোমরা যা কর না তা কেন বল'- এ তিরস্কার বাণী আমাদের বেলায়ই বেশি খাটে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত এবং মুখে যা বলি বাস্তবেও যেন অবশ্যই তা করি, সেই চেষ্টা করা উচিত।
তিন নং আয়াত
وقال تعالى إختبارًا عَنْ شُعَيْبٍ ﷺ وَمَا أُرِيدُ أَنْ أُخَالِفَكُمْ إِلَى مَا أَنْهَاكُمْ عَنْهُ
অর্থ : আল্লাহ তা'আলা হযরত শু'আইব আলাইহিস সালাম-এর বাণী উদ্ধৃত করেন- আমার এমন কোনও ইচ্ছা নেই যে, আমি যেসব বিষয়ে তোমাদেরকে নিষেধ করি, তোমাদের পেছনে গিয়ে নিজেই তা করতে থাকব।সূরা হুদ (১১), আয়াত ৮৮
ব্যাখ্যা
হযরত শুআইব আলাইহিস সালাম একজন উচ্চস্তরের নবী। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে মাদয়ান ও আয়কাবাসীদের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। এ স্থানদু'টি বর্তমান সৌদি আরবের উত্তর দিকে আকাবা উপসাগরের পূর্বে অবস্থিত। এখানকার অধিবাসীরা ছিল মূর্তিপূজারী। তাদের আখলাক-চরিত্র ছিল অত্যন্ত নিম্নপর্যায়ের। তারা দস্যুবৃত্তি করত, মাপে কম দিত এবং মানুষকে ঠকাত। আল্লাহ তা'আলা তাদের হিদায়াতের জন্য হযরত শুআইব আলাইহিস সালামকে নবী করে পাঠান। তিনি তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং দস্যুবৃত্তি পরিত্যাগ ও মানুষের হক নষ্ট করা হতে বিরত থাকার আহ্বান জানান। তিনি একজন সুবক্তা ছিলেন। তাঁকে 'খতীবুল আম্বিয়া' অর্থাৎ নবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বক্তা বলা হয়ে থাকে। তিনি আদেশ-উপদেশদানের একপর্যায়ে তাদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
وَمَا أُرِيدُ أَنْ أُخَالِفَكُمْ إِلَى مَا أَنْهَاكُمْ عَنْهُ
‘আমার এমন কোনও ইচ্ছা নেই যে, আমি যেসব বিষয়ে তোমাদেরকে নিষেধ করি, তোমাদের পেছনে গিয়ে নিজেই তা করতে থাকব।'
অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে যেসব বিষয়ে নিষেধ করি সেগুলো তো মন্দ কাজ। আর তা যখন মন্দ তখন তাতে আমার লিপ্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। হাঁ, যদি তা ভালো কাজ হত, তবে আমি অবশ্যই করতাম। সে ক্ষেত্রে তোমাদেরকে তা করতে নিষেধ করতাম না। মোটকথা আমি তোমাদের বলব একটা আর নিজে করব অন্যটা, সেরকম লোক আমি নই। আমি একজন নবী। আর নবীগণ যা বলেন, নিজেরা তা করেও দেখান, যাতে মানুষ তাদের আমলকে নিজেদের আমলের জন্য আদর্শরূপে গ্রহণ করতে পারে।
হযরত শুআইব আলাইহিস সালামের এ বক্তব্য উল্লেখ করার দ্বারা সবকালের আদেশ-নিষেধকারীকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে, তারাও যেন মানুষকে যা বলে নিজেরা তার বিপরীত না করে; বরং যা বলে, সে ব্যাপারে নিজেদের আমল যেন অন্যদের জন্য নমুনাস্বরূপ হয়।
হাদীছ নং: ১৯৮
হযরত উসামা ইবন যায়দ ইবন হারিছা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন কোনও ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হবে, তারপর জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তাতে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসবে। সে তার চারদিকে এমনভাবে পাক খেতে থাকবে, যেমন গাধা ঘানির চারদিকে পাক খেয়ে থাকে। এ অবস্থায় জাহান্নামবাসীরা তার কাছে জমা হয়ে যাবে। তারা তাকে বলবে, হে অমুক, তোমার কী হল? তুমি না আমাদেরকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে? তখন সে বলবে, অবশ্যই, আমি সৎকাজের আদেশ করতাম বটে, কিন্তু নিজে তা পালন করতাম না এবং আমি অসৎকাজে নিষেধ করতাম, কিন্তু নিজে তাতে লিপ্ত হতাম -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩২৬৭; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৮৯: বায়হাকী, শুআবুল ঈমান,হাদীছ নং ৭১৬১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪১৫৮; মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীছ নং ৫৫৭)
হযরত উসামা ইবন যায়দ ইবন হারিছা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন কোনও ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হবে, তারপর জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তাতে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসবে। সে তার চারদিকে এমনভাবে পাক খেতে থাকবে, যেমন গাধা ঘানির চারদিকে পাক খেয়ে থাকে। এ অবস্থায় জাহান্নামবাসীরা তার কাছে জমা হয়ে যাবে। তারা তাকে বলবে, হে অমুক, তোমার কী হল? তুমি না আমাদেরকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে? তখন সে বলবে, অবশ্যই, আমি সৎকাজের আদেশ করতাম বটে, কিন্তু নিজে তা পালন করতাম না এবং আমি অসৎকাজে নিষেধ করতাম, কিন্তু নিজে তাতে লিপ্ত হতাম -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩২৬৭; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৮৯: বায়হাকী, শুআবুল ঈমান,হাদীছ নং ৭১৬১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪১৫৮; মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীছ নং ৫৫৭)
مقدمة الامام النووي
24 - باب تغليظ عقوبة من أمر بمعروف أَوْ نهى عن منكر وخالف قوله فعله
قَالَ الله تَعَالَى: {أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلا تَعْقِلُونَ} [البقرة: 44]، وَقالَ تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لا تَفْعَلُونَ كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لا تَفْعَلُونَ} [الصف: 2 - 3]، وَقالَ تَعَالَى إخبارًا عن شعيب - صلى الله عليه وسلم: {وَمَا أُرِيدُ أَنْ أُخَالِفَكُمْ إِلَى مَا أَنْهَاكُمْ عَنْهُ} [هود:88].
قَالَ الله تَعَالَى: {أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلا تَعْقِلُونَ} [البقرة: 44]، وَقالَ تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لا تَفْعَلُونَ كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لا تَفْعَلُونَ} [الصف: 2 - 3]، وَقالَ تَعَالَى إخبارًا عن شعيب - صلى الله عليه وسلم: {وَمَا أُرِيدُ أَنْ أُخَالِفَكُمْ إِلَى مَا أَنْهَاكُمْ عَنْهُ} [هود:88].
198 - وعن أَبي زيد أسامة بن حارثة رضي الله عنهما، قَالَ: سمعت رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «يُؤْتَى بالرَّجُلِ يَوْمَ القيَامَةِ فَيُلْقَى في النَّارِ، فَتَنْدَلِقُ أقْتَابُ بَطْنِهِ فَيدُورُ بِهَا كَمَا يَدُورُ الحِمَارُ في الرَّحَى، فَيَجْتَمِعُ إِلَيْه أهْلُ النَّارِ، فَيَقُولُونَ: يَا فُلانُ، مَا لَكَ؟ أَلَمْ تَكُ تَأمُرُ بالمعْرُوفِ وَتنهَى عَنِ المُنْكَرِ؟ فَيقُولُ: بَلَى، كُنْتُ آمُرُ بِالمَعْرُوفِ وَلا آتِيهِ، وأنْهَى عَنِ المُنْكَرِ وَآتِيهِ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
قوله: «تَنْدلِقُ» هُوَ بالدالِ المهملةِ، ومعناه تَخرُجُ. وَ «الأَقْتَابُ»: الأمعاءُ، واحدها قِتْبٌ.
قوله: «تَنْدلِقُ» هُوَ بالدالِ المهملةِ، ومعناه تَخرُجُ. وَ «الأَقْتَابُ»: الأمعاءُ، واحدها قِتْبٌ.
হাদীস নং: ১৯৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আমানত আদায় প্রসঙ্গ
امانة (আমানত) শব্দটি أمن থেকে নির্গত, যেমন إيمان (ঈমান) শব্দটিও أمن থেকেই নির্গত হয়েছে। উভয়টির মূল হরফ যেমন অভিন্ন, তেমনি বাস্তবেও উভয়টি অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং আমানত ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এটা অতি ব্যাপক। আমরা সাধারণত আমানত বলতে গচ্ছিত অর্থ-সম্পদকেই বুঝে থাকি। অথচ এটা আমানতের একটা দিক মাত্র। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো পরামর্শকেও 'আমানত' সাব্যস্ত করেছেনঃ- المستشار مؤتمن 'যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় তার ওপর আমানত ভার অর্পিত (অর্থাৎ তাকে আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার সঙ্গেই পরামর্শ দিতে হবে, অন্যথায় খেয়ানত হবে)।
(সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১২৮, জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫২৬: সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৭৪৫; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ২১৯৫; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৭১৭৮; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪২৮৪)
অপর এক হাদীছে খাস মজলিসের কথাবার্তাকে আমানত সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন ইরশাদঃ- المجالس بالأمانة ‘মজলিসসমূহ (এর কথাবার্তা ও আলোচনা) আমানতের সাথে সম্পৃক্ত। (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৮৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৪৬৯৩; মুস্তাদরাক হাকিম, ৭৭০৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৬৭৯)
এমনিভাবে কাউকে কোনও পদে নিযুক্ত করার বিষয়টিও আমানত। অযোগ্য ব্যক্তিকে কোনও পদে নিয়োগদান খেয়ানতের অন্তর্ভুক্ত। একবার কিয়ামত সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, যখন (ব্যাপকভাবে)আমানত নষ্ট করা হবে, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করো। জিজ্ঞেস করা হল, আমানত নষ্ট করা হয় কিভাবে? তিনি ইরশাদ করলেনঃ- إذا وسد الأمر إلى غير أهله ‘যখন কোনও দায়িত্ব অনুপযুক্ত ব্যক্তির ওপর অর্পণ করা হবে (অর্থাৎ অনুপযুক্ত ব্যক্তির ওপর দায়িত্ব অর্পণ করাই আমানত নষ্ট করা)। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭১৪ : সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ১০৪)
এসব হাদীছ দ্বারা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, আমানতের বিষয়টি অতি ব্যাপক। দীনী এবং দুনিয়াবী যাবতীয় বিষয়ই এর অন্তর্ভুক্ত। বোঝার সুবিধার্থে সংক্ষেপে আমানতকে এভাবে ভাগ করা যায়
প্রথমত আমানত দুই প্রকার। ক. আল্লাহপ্রদত্ত আমানত এবং খ. মানুষের আমানত। আল্লাহপ্রদত্ত আমানতও দুই প্রকার- জাহেরী বা প্রকাশ্য আমানত এবং বাতেনী বা গুপ্ত আমানত। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে যা-কিছু নি'আমত দিয়েছেন সবই আমানতের অন্তর্ভুক্ত। জাহেরী নি'আমতসমূহ জাহেরী আমানতের অন্তর্ভুক্ত এবং বাতেনী নি'আমতসমূহ বাতেনী আমানতের অন্তর্ভুক্ত।
জাহেরী নি‘আমতের মধ্যে আছে মানুষের নিজের অস্তিত্ব, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, অঙ্গ প্রত্যঙ্গের শক্তিসমূহ, ক্ষমতা ও সক্ষমতা, তার প্রকাশ্য সৌন্দর্য, দুনিয়ায় তার জীবনরক্ষার যাবতীয় আসবাব উপকরণ- যথা আলো, বাতাস, পানি, ঘরবাড়ি, ভূমি, রাস্তাঘাট, নদী-নালা, গাছ-বৃক্ষ, হাজারও রকম খাদ্যসামগ্রী, ফলমূল, পশুপাখি ইত্যাদি। এ সবই আল্লাহর দেওয়া আমানত। এর প্রত্যেকটির হেফাজত জরুরি। এর কোনওটির অপচয় ও অপব্যবহার করা এবং কোনওটি অহেতুক নষ্ট-ধ্বংস করা কঠিন খেয়ানত।
বাতেনী নি'আমতের মধ্যে আছে ঈমান, দীন ও শরী'আত, জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি, উদ্ভাবনীশক্তি, সাহস, উদ্যম-স্ফূর্তি, মায়া-মমতা ইত্যাদি। এগুলো আল্লাহ তা'আলার অপার দান। এগুলোর হেফাজত জরুরি। এর কোনওটি অপচয়-অপব্যবহার করা খেয়ানত ও কঠিন গুনাহ।
মানুষের আমানতও দুই রকম। ক. বৈষয়িক আমানত ও খ. বিমূর্ত আমানত। বৈষয়িক আমানতের মধ্যে আছে টাকা-পয়সা, আসবাবপত্র, জমি-জমা ইত্যাদি। বিমূর্ত আমানত অর্থাৎ এমন আমানত, যার সম্পর্ক সরাসরি কোনও বস্তুর সঙ্গে নয়, এরকম আমানতের মধ্যে আছে অভিভাবকত্ব, পদ ও পদীয় দায়িত্ব, গুপ্ত কথা, পরামর্শ, খাস মজলিসের কথাবার্তা ইত্যাদি।
আল্লাহর দেওয়া আমানত ও মানুষের আমানত- এ উভয় প্রকার আমানতের সমষ্টিই তো দীন ও ঈমান। সুতরাং এ কথা বলা যেতেই পারে যে, আমানত ও ঈমান অভিন্ন বিষয়বস্তুর নাম। তাই তো দেখা যায়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেছেনঃ- لا إيمان لمن لا أمانة له ‘ওই ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানতদারী নেই। (বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪০৪৫. বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৯; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হানীছ নং ২২৯২: সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ১৯৪; সহীহ ইবন মুযাইমা, হাদীছ নং ২৩৩৬: খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ১৬৩)
এর দ্বারা ইসলামী শিক্ষায় আমানত রক্ষার বিষয়টি যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা অনুভব করা যায় । যে ব্যক্তি সর্বপ্রকার আমানত নষ্ট করবে সে তো সম্পূর্ণরূপেই ঈমান হারাবে, আর যে ব্যক্তি ক্ষেত্রবিশেষে আমানতের খেয়ানত করবে তার ঈমান অংশত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং নিজ ঈমানের হেফাজতকল্পে প্রত্যেকের উচিত সর্বপ্রকার আমানতরক্ষায় যত্নবান থাকা। ইমাম নববী রহ. আমানতদারীর গুরুত্ব সম্পর্কে এ অধ্যায়ে কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
আমানত আদায় সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
অর্থ : (হে মুসলিমগণ।) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারকে আদায় করে দেবে। সুনা নিসা (৪), আয়াত ৫৮
ব্যাখ্যা
এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে তাফসীর গ্রন্থসমূহে একটি চমৎকার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি এস্থলে উল্লেখযোগ্য। সে ঘটনাটি কা'বাঘরের চাবিসংক্রান্ত।
ইসলামী যুগের আগে কা'বাঘর সংক্রান্ত একেকটি কাজের দায়িত্ব একেক ব্যক্তির যিম্মায় ছিল। কা'বাঘরের চাবি ছিল উছমান ইবন তালহার কাছে। প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার কা'বাঘর খুলে দেওয়া হত এবং উছমান ইবন তালহা নিজে সে দায়িত্ব পালন করত। একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা'বাঘরে প্রবেশ করতে চাইলেন। কিন্তু উছমান তাঁর জন্য কা'বাঘর খুলতে রাজি হল না। সেদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে উছমানের যে ঘটনা ঘটেছিল, উছমান পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণের পর সে ঘটনা যেভাবে বর্ণনা করেছেন তার সারমর্ম নিম্নরূপ-
একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা'বাঘরে প্রবেশ করতে চাইলে সে তো তাঁকে চাবি দিলই না; উল্টো তাঁর সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করল এবং তাঁকে গালমন্দ করল। কিন্তু তিনি তার আচরণে অশেষ ধৈর্যধারণ করেন। তারপর তিনি উছমানকে লক্ষ্য করে বলেন, হে উছমান! অচিরেই একদিন আসবে, যখন কা'বাঘরের চাবি আমার হাতে দেখতে পাবে। সেদিন আমি যাকে ইচ্ছা এ চাবি প্রদান করব। উছমান বলল, তাহলে সেদিন কুরায়শ বংশ চরম অপদস্থ হবে। তিনি বললেন, না, সেদিন তাদের সত্যিকারের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁর এ কথা উছমানের মনে দাগ কাটল। সে নিশ্চিত হল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বললেন তা অবশ্যই একদিন ঘটবে। তখনই সে ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু তার গোত্রের লোকেরা তা শুনে তাকে খুব গালমন্দ করল এবং ইসলামগ্রহণে তাকে বাধা দিল। ফলে উছমান তার বাপ-দাদার ধর্মেই রয়ে গেল।
তারপর হিজরী ৮ম সালে যেদিন মক্কা বিজিত হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উছমানকে ডেকে পাঠালেন এবং চাবি নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। চাবিটি ছিল তার মায়ের কাছে। প্রথমে তিনি সেটি দিতে রাজি হননি। পরে যখন উছমান তার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করল এবং চাবি না দিলে কী ঘটতে পারে সে ব্যাপারে তাকে সাবধান করল, তখন অগত্যা তিনি চাবিটি দিয়ে দিলেন। উছমান চাবি নিয়ে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে সমর্পণ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা'বাঘর খুলে ভেতরে ঢুকলেন এবং দু' রাক'আত নামায পড়লেন। তারপর কা'বাঘরের ভেতরে থাকা অবস্থায়ই আয়াত
নাযিল হল-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
(হে মুসলিমগণ!) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারকে আদায় করে দেবে।
তিনি কা'বাঘর থেকে বের হয়ে আবার উছমানকে ডাকলেন এবং তার হাতে চাবি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, এটি তুমি স্থায়ীভাবে গ্রহণ কর। এটি স্থায়ীভাবে তোমার ও তোমার বংশধরদের হাতে থাকবে। একমাত্র জালেম ছাড়া আর কেউ এটি ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
উছমান ইবন তালহা এখন একজন সাহাবী। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি যখন কা'বার চাবি নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার তাকে ডাকলেন। উছমান ফিরে আসলেন। এবার তিনি অতীতের সেই ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, হে উছমান! আমি তোমাকে সেদিন যে কথা বলেছিলাম তা কি সত্যে পরিণত হয়নি? উছমান বললেন, হাঁ, অবশ্যই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল।
এমনই ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহৎ চরিত্র। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি উছমান ইবন তালহা থেকে কোনও প্রতিশোধ তো নিলেনই না; উল্টো তাকে ইসলামী যুগেও কা'বাঘরের চাবিরক্ষক হওয়ার মর্যাদা দান করলেন, তাও স্থায়ী মর্যাদা। কিয়ামত পর্যন্ত তার বংশেই চাবি থাকার অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। আজও পর্যন্ত কা'বাঘরের চাবি এ বংশেরই হেফাজতে আছে।
যদিও এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে, কিন্তু এর শব্দ ব্যাপক। বহুবচনে الْأمَانَات শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। জানানো হচ্ছে যে, সর্বপ্রকার আমানতই তার হকদারকে বুঝিয়ে দেবে। আল্লাহপ্রদত্ত আমানত আল্লাহকে বুঝিয়ে দেবে অর্থাৎ শরী'আতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালন করবে। আর বান্দারও যত রকম আমানত আছে তাও পুরোপুরি সংরক্ষণ করবে এবং যথাসময়ে আদায় করবে।
সরাসরি আদেশটি করা হয়েছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও বহুবচনের সর্বনাম كم ব্যবহার দ্বারা অন্য সকলকেও এ আদেশের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আপন আপন স্থান থেকে সকলেই কোনও না কোনও আমানতের ভারবাহী। কাজেই সকলকেই আপন আপন আমানতের হেফাজতে যত্নবান থাকতে হবে এবং সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে যথাযথভাবে তা আদায় করতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে আমানত আদায়ের হুকুম এমনই একটি ব্যাপক বিষয় যে, যদি কেউ এই এক হুকুম যথাযথভাবে পালন করে, তবে তার দ্বারা গোটা দীন ও শরী'আতই পালন হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি সর্বপ্রকার আমানত রক্ষা করে চলবে, সে সত্যিকারের মু'মিন হয়ে যাবে। অতএব আমাদের প্রত্যেকের উচিত এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।
দুই নং আয়াত
إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا (72)
অর্থ : আমি আমানত পেশ করেছিলাম আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও পাহাড়-পর্বতের সামনে। তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল ও তাতে শংকিত হল আর তা বহন করে নিল মানুষ। বস্তুত সে ঘোর জালেম, ঘোর অজ্ঞ।সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৭২
ব্যাখ্যা
এস্থলে আমানত অর্থ 'নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ মেনে চলার যিম্মাদারী গ্রহণ'। বিশ্বজগতে আল্লাহ তাআলার কিছু বিধান তো সৃষ্টিগত বা প্রাকৃতিক (তাকবীনী), যা মেনে চলতে সমস্ত সৃষ্টি বাধ্য। কারও পক্ষে তা অমান্য করা সম্ভবই নয়। যেমন জীবন ও মৃত্যু সংক্রান্ত ফায়সালা। কিন্তু আল্লাহ তাআলা চাইলেন এমন কিছু বিধান দিতে যা সৃষ্টি তার স্বাধীন ইচ্ছা বলে মান্য করবে। এজন্য তিনি তার কোনও-কোনও সৃষ্টির সামনে এই প্রস্তাবনা রাখলেন যে, কিছু বিধানের ব্যাপারে তাদেরকে এখতিয়ার দেওয়া হবে। চাইলে তারা নিজ ইচ্ছায় সেসব বিধান মেনে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করবে কিংবা চাইলে তা অমান্য করবে। মান্য করলে তারা জান্নাতের স্থায়ী নেয়ামত লাভ করবে আর যদি অমান্য করে তবে তাদেরকে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। যখন এ প্রস্তাব আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে রাখা হল, তারা এ যিম্মাদারী গ্রহণ করতে ভয় পেয়ে গেল ফলে তারা এটা গ্রহণ করল না। ভয় পেল এ কারণে যে, এর পরিণতিতে জাহান্নামে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু যখন মানুষকে এ প্রস্তাব দেওয়া হল, তারা এটা গ্রহণ করে নিল।
আসমান, যমীন ও পাহাড় আপাতদৃষ্টিতে যদিও এমন বস্তু, যাদের কোনও বোধশক্তি নেই, কিন্তু কুরআন মাজীদের কয়েকটি আয়াত দ্বারা জানা যায়, তাদের মধ্যে এক পর্যায়ের বোধশক্তি আছে, যেমন সূরা বনী ইসরাঈলে ইরশাদ হয়েছে-
تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَنْ فِيهِنَّ وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَكِنْ لَا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا (44)
“সাত আসমান ও যমীন এবং এদের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সৃষ্টি তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে, এমন কোনও জিনিস নেই, যা তাঁর সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করে না। কিন্তু তোমরা তাদের তাসবীহ বুঝতে পার না। বস্তুত তিনি পরম সহিষ্ণু, অতি ক্ষমাশীল। সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৪৪
এ আয়াতে সুস্পষ্ট অর্থ তো এটাই যে, প্রতিটি বস্তু প্রকৃত অর্থেই তাসবীহ পাঠ করে, কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারি না। কেননা আল্লাহ তাআলা জগতের প্রতিটি জিনিস, এমনকি পাথরের ভেতরও এক রকমের অনুভূতিশক্তি দান করেছেন, যে শক্তি দ্বারা সবকিছুর পক্ষেই তাসবীহ পাঠ সম্ভব। কুরআন মাজীদের বেশ ক'টি আয়াতের আলোকে এ ব্যাখ্যাই বেশি সঠিক মনে হয়। আধুনিক বিজ্ঞানও স্বীকার করে নিয়েছে যে, পাথরের মধ্যেও এক ধরনের অনুভবশক্তি আছে।
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهِيَ دُخَانٌ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ ائْتِيَا طَوْعًا أَوْ كَرْهًا قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِينَ (11)
"তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দান করলেন, যা ছিল ধোঁয়ারূপে। তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা চলে এসো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। উভয়ে বলল, আমরা ইচ্ছাক্রমেই আসলাম। সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ১১
এ আয়াতে দেখা যাচ্ছে আল্লাহ তা'আলা আসমান-যমীনকে লক্ষ্য করে একটি আদেশ করেছেন, তাঁর সে আদেশ তারা বুঝতে পেরেছে এবং সে আদেশ তারা মান্য করেছে বলে সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশও করেছে।
কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলার হুকুমে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে। তাতে মানুষ অবাক হয়ে তাদের প্রশ্ন করবে- তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে কিভাবে সাক্ষ্য দিলে? তার উত্তরে তারা বলবে-
أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ خَلَقَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ (21)
“তারা বলবে, আল্লাহ আমাদেরকে বাকশক্তি দান করেছেন, যিনি বাকশক্তি দান করেছেন প্রতিটি জিনিসকে। তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন প্রথমবার আর তাঁরই কাছে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।'সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ২১
সুতরাং এসব আয়াতের দৃষ্টিতে যদি বলা হয়, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আসমান-যমীন ও পাহাড়-পর্বতকে আমানতগ্রহণের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সেটা প্রতীকী অর্থে নয়; বরং বাস্তব অর্থে এবং তাদের অস্বীকৃতিও ছিল বাস্তব অর্থেই, তাতে আপত্তির কোনও অবকাশ নেই। অবশ্য এটাও সম্ভব যে, আমানত গ্রহণের প্রস্তাব দান ও তাদের প্রত্যাখ্যান প্রতীকী অর্থে হয়েছিল। অর্থাৎ আমানত বহনের যোগ্যতা না থাকাকে প্রত্যাখ্যান শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।
এ আয়াতে আমানতভার গ্রহণ করায় মানুষকে চরম জালেম ও অজ্ঞ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে-
إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا
বস্তুত সে ঘোর জালেম, ঘোর অজ্ঞ।"
কেন তারা জালেম ও অজ্ঞ? 'উলামায়ে কিরামের একদল বলেন, এটা বলা হয়েছে কাফেরদেরকে, যারা এ আমানত রক্ষা করেনি। না তারা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সত্য-সঠিক পথের সন্ধান করেছে, আর না নবী-রাসূলগণের ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। যারা মুমিন ও নেককার, তারা বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে এবং নবী-রাসূলগণের দাওয়াত কবুল করে যেমন জ্ঞানের অধিকারী হয়েছে, তেমনি সত্য-সঠিক পথে চলে ন্যায়-নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে। সুতরাং তারা জালেম ও অজ্ঞ নয়।
আবার অনেকের মতে এ কথা বলা হয়েছে সমস্ত মানুষকে লক্ষ্য করে। সব মানুষের স্বভাবের ভেতরই জুলুম অবিচার ও অজ্ঞতা বিদ্যমান। তবে আল্লাহ তা'আলা মু'মিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেন, ফলে তারা দীন সম্পর্কে জানতে পারে এবং দীনের ওপর চলতে সচেষ্ট থাকে। এভাবে তাদের স্বভাবে জুলুম ও অজ্ঞতা নিহিত থাকলেও কার্যত তারা জ্ঞানী ও ন্যায়-নিষ্ঠ হয়ে যায় এবং আমানতের যে ভার তারা বহন করেছিল তা রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
امانة (আমানত) শব্দটি أمن থেকে নির্গত, যেমন إيمان (ঈমান) শব্দটিও أمن থেকেই নির্গত হয়েছে। উভয়টির মূল হরফ যেমন অভিন্ন, তেমনি বাস্তবেও উভয়টি অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং আমানত ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এটা অতি ব্যাপক। আমরা সাধারণত আমানত বলতে গচ্ছিত অর্থ-সম্পদকেই বুঝে থাকি। অথচ এটা আমানতের একটা দিক মাত্র। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো পরামর্শকেও 'আমানত' সাব্যস্ত করেছেনঃ- المستشار مؤتمن 'যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় তার ওপর আমানত ভার অর্পিত (অর্থাৎ তাকে আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার সঙ্গেই পরামর্শ দিতে হবে, অন্যথায় খেয়ানত হবে)।
(সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১২৮, জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫২৬: সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৭৪৫; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ২১৯৫; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৭১৭৮; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪২৮৪)
অপর এক হাদীছে খাস মজলিসের কথাবার্তাকে আমানত সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন ইরশাদঃ- المجالس بالأمانة ‘মজলিসসমূহ (এর কথাবার্তা ও আলোচনা) আমানতের সাথে সম্পৃক্ত। (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৮৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৪৬৯৩; মুস্তাদরাক হাকিম, ৭৭০৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৬৭৯)
এমনিভাবে কাউকে কোনও পদে নিযুক্ত করার বিষয়টিও আমানত। অযোগ্য ব্যক্তিকে কোনও পদে নিয়োগদান খেয়ানতের অন্তর্ভুক্ত। একবার কিয়ামত সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, যখন (ব্যাপকভাবে)আমানত নষ্ট করা হবে, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করো। জিজ্ঞেস করা হল, আমানত নষ্ট করা হয় কিভাবে? তিনি ইরশাদ করলেনঃ- إذا وسد الأمر إلى غير أهله ‘যখন কোনও দায়িত্ব অনুপযুক্ত ব্যক্তির ওপর অর্পণ করা হবে (অর্থাৎ অনুপযুক্ত ব্যক্তির ওপর দায়িত্ব অর্পণ করাই আমানত নষ্ট করা)। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭১৪ : সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ১০৪)
এসব হাদীছ দ্বারা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, আমানতের বিষয়টি অতি ব্যাপক। দীনী এবং দুনিয়াবী যাবতীয় বিষয়ই এর অন্তর্ভুক্ত। বোঝার সুবিধার্থে সংক্ষেপে আমানতকে এভাবে ভাগ করা যায়
প্রথমত আমানত দুই প্রকার। ক. আল্লাহপ্রদত্ত আমানত এবং খ. মানুষের আমানত। আল্লাহপ্রদত্ত আমানতও দুই প্রকার- জাহেরী বা প্রকাশ্য আমানত এবং বাতেনী বা গুপ্ত আমানত। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে যা-কিছু নি'আমত দিয়েছেন সবই আমানতের অন্তর্ভুক্ত। জাহেরী নি'আমতসমূহ জাহেরী আমানতের অন্তর্ভুক্ত এবং বাতেনী নি'আমতসমূহ বাতেনী আমানতের অন্তর্ভুক্ত।
জাহেরী নি‘আমতের মধ্যে আছে মানুষের নিজের অস্তিত্ব, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, অঙ্গ প্রত্যঙ্গের শক্তিসমূহ, ক্ষমতা ও সক্ষমতা, তার প্রকাশ্য সৌন্দর্য, দুনিয়ায় তার জীবনরক্ষার যাবতীয় আসবাব উপকরণ- যথা আলো, বাতাস, পানি, ঘরবাড়ি, ভূমি, রাস্তাঘাট, নদী-নালা, গাছ-বৃক্ষ, হাজারও রকম খাদ্যসামগ্রী, ফলমূল, পশুপাখি ইত্যাদি। এ সবই আল্লাহর দেওয়া আমানত। এর প্রত্যেকটির হেফাজত জরুরি। এর কোনওটির অপচয় ও অপব্যবহার করা এবং কোনওটি অহেতুক নষ্ট-ধ্বংস করা কঠিন খেয়ানত।
বাতেনী নি'আমতের মধ্যে আছে ঈমান, দীন ও শরী'আত, জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি, উদ্ভাবনীশক্তি, সাহস, উদ্যম-স্ফূর্তি, মায়া-মমতা ইত্যাদি। এগুলো আল্লাহ তা'আলার অপার দান। এগুলোর হেফাজত জরুরি। এর কোনওটি অপচয়-অপব্যবহার করা খেয়ানত ও কঠিন গুনাহ।
মানুষের আমানতও দুই রকম। ক. বৈষয়িক আমানত ও খ. বিমূর্ত আমানত। বৈষয়িক আমানতের মধ্যে আছে টাকা-পয়সা, আসবাবপত্র, জমি-জমা ইত্যাদি। বিমূর্ত আমানত অর্থাৎ এমন আমানত, যার সম্পর্ক সরাসরি কোনও বস্তুর সঙ্গে নয়, এরকম আমানতের মধ্যে আছে অভিভাবকত্ব, পদ ও পদীয় দায়িত্ব, গুপ্ত কথা, পরামর্শ, খাস মজলিসের কথাবার্তা ইত্যাদি।
আল্লাহর দেওয়া আমানত ও মানুষের আমানত- এ উভয় প্রকার আমানতের সমষ্টিই তো দীন ও ঈমান। সুতরাং এ কথা বলা যেতেই পারে যে, আমানত ও ঈমান অভিন্ন বিষয়বস্তুর নাম। তাই তো দেখা যায়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেছেনঃ- لا إيمان لمن لا أمانة له ‘ওই ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানতদারী নেই। (বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪০৪৫. বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৯; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হানীছ নং ২২৯২: সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ১৯৪; সহীহ ইবন মুযাইমা, হাদীছ নং ২৩৩৬: খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ১৬৩)
এর দ্বারা ইসলামী শিক্ষায় আমানত রক্ষার বিষয়টি যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা অনুভব করা যায় । যে ব্যক্তি সর্বপ্রকার আমানত নষ্ট করবে সে তো সম্পূর্ণরূপেই ঈমান হারাবে, আর যে ব্যক্তি ক্ষেত্রবিশেষে আমানতের খেয়ানত করবে তার ঈমান অংশত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং নিজ ঈমানের হেফাজতকল্পে প্রত্যেকের উচিত সর্বপ্রকার আমানতরক্ষায় যত্নবান থাকা। ইমাম নববী রহ. আমানতদারীর গুরুত্ব সম্পর্কে এ অধ্যায়ে কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
আমানত আদায় সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
অর্থ : (হে মুসলিমগণ।) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারকে আদায় করে দেবে। সুনা নিসা (৪), আয়াত ৫৮
ব্যাখ্যা
এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে তাফসীর গ্রন্থসমূহে একটি চমৎকার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি এস্থলে উল্লেখযোগ্য। সে ঘটনাটি কা'বাঘরের চাবিসংক্রান্ত।
ইসলামী যুগের আগে কা'বাঘর সংক্রান্ত একেকটি কাজের দায়িত্ব একেক ব্যক্তির যিম্মায় ছিল। কা'বাঘরের চাবি ছিল উছমান ইবন তালহার কাছে। প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার কা'বাঘর খুলে দেওয়া হত এবং উছমান ইবন তালহা নিজে সে দায়িত্ব পালন করত। একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা'বাঘরে প্রবেশ করতে চাইলেন। কিন্তু উছমান তাঁর জন্য কা'বাঘর খুলতে রাজি হল না। সেদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে উছমানের যে ঘটনা ঘটেছিল, উছমান পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণের পর সে ঘটনা যেভাবে বর্ণনা করেছেন তার সারমর্ম নিম্নরূপ-
একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা'বাঘরে প্রবেশ করতে চাইলে সে তো তাঁকে চাবি দিলই না; উল্টো তাঁর সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করল এবং তাঁকে গালমন্দ করল। কিন্তু তিনি তার আচরণে অশেষ ধৈর্যধারণ করেন। তারপর তিনি উছমানকে লক্ষ্য করে বলেন, হে উছমান! অচিরেই একদিন আসবে, যখন কা'বাঘরের চাবি আমার হাতে দেখতে পাবে। সেদিন আমি যাকে ইচ্ছা এ চাবি প্রদান করব। উছমান বলল, তাহলে সেদিন কুরায়শ বংশ চরম অপদস্থ হবে। তিনি বললেন, না, সেদিন তাদের সত্যিকারের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁর এ কথা উছমানের মনে দাগ কাটল। সে নিশ্চিত হল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বললেন তা অবশ্যই একদিন ঘটবে। তখনই সে ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু তার গোত্রের লোকেরা তা শুনে তাকে খুব গালমন্দ করল এবং ইসলামগ্রহণে তাকে বাধা দিল। ফলে উছমান তার বাপ-দাদার ধর্মেই রয়ে গেল।
তারপর হিজরী ৮ম সালে যেদিন মক্কা বিজিত হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উছমানকে ডেকে পাঠালেন এবং চাবি নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। চাবিটি ছিল তার মায়ের কাছে। প্রথমে তিনি সেটি দিতে রাজি হননি। পরে যখন উছমান তার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করল এবং চাবি না দিলে কী ঘটতে পারে সে ব্যাপারে তাকে সাবধান করল, তখন অগত্যা তিনি চাবিটি দিয়ে দিলেন। উছমান চাবি নিয়ে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে সমর্পণ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা'বাঘর খুলে ভেতরে ঢুকলেন এবং দু' রাক'আত নামায পড়লেন। তারপর কা'বাঘরের ভেতরে থাকা অবস্থায়ই আয়াত
নাযিল হল-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
(হে মুসলিমগণ!) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারকে আদায় করে দেবে।
তিনি কা'বাঘর থেকে বের হয়ে আবার উছমানকে ডাকলেন এবং তার হাতে চাবি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, এটি তুমি স্থায়ীভাবে গ্রহণ কর। এটি স্থায়ীভাবে তোমার ও তোমার বংশধরদের হাতে থাকবে। একমাত্র জালেম ছাড়া আর কেউ এটি ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
উছমান ইবন তালহা এখন একজন সাহাবী। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি যখন কা'বার চাবি নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার তাকে ডাকলেন। উছমান ফিরে আসলেন। এবার তিনি অতীতের সেই ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, হে উছমান! আমি তোমাকে সেদিন যে কথা বলেছিলাম তা কি সত্যে পরিণত হয়নি? উছমান বললেন, হাঁ, অবশ্যই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল।
এমনই ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহৎ চরিত্র। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি উছমান ইবন তালহা থেকে কোনও প্রতিশোধ তো নিলেনই না; উল্টো তাকে ইসলামী যুগেও কা'বাঘরের চাবিরক্ষক হওয়ার মর্যাদা দান করলেন, তাও স্থায়ী মর্যাদা। কিয়ামত পর্যন্ত তার বংশেই চাবি থাকার অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। আজও পর্যন্ত কা'বাঘরের চাবি এ বংশেরই হেফাজতে আছে।
যদিও এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে, কিন্তু এর শব্দ ব্যাপক। বহুবচনে الْأمَانَات শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। জানানো হচ্ছে যে, সর্বপ্রকার আমানতই তার হকদারকে বুঝিয়ে দেবে। আল্লাহপ্রদত্ত আমানত আল্লাহকে বুঝিয়ে দেবে অর্থাৎ শরী'আতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালন করবে। আর বান্দারও যত রকম আমানত আছে তাও পুরোপুরি সংরক্ষণ করবে এবং যথাসময়ে আদায় করবে।
সরাসরি আদেশটি করা হয়েছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও বহুবচনের সর্বনাম كم ব্যবহার দ্বারা অন্য সকলকেও এ আদেশের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আপন আপন স্থান থেকে সকলেই কোনও না কোনও আমানতের ভারবাহী। কাজেই সকলকেই আপন আপন আমানতের হেফাজতে যত্নবান থাকতে হবে এবং সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে যথাযথভাবে তা আদায় করতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে আমানত আদায়ের হুকুম এমনই একটি ব্যাপক বিষয় যে, যদি কেউ এই এক হুকুম যথাযথভাবে পালন করে, তবে তার দ্বারা গোটা দীন ও শরী'আতই পালন হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি সর্বপ্রকার আমানত রক্ষা করে চলবে, সে সত্যিকারের মু'মিন হয়ে যাবে। অতএব আমাদের প্রত্যেকের উচিত এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।
দুই নং আয়াত
إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا (72)
অর্থ : আমি আমানত পেশ করেছিলাম আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও পাহাড়-পর্বতের সামনে। তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল ও তাতে শংকিত হল আর তা বহন করে নিল মানুষ। বস্তুত সে ঘোর জালেম, ঘোর অজ্ঞ।সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৭২
ব্যাখ্যা
এস্থলে আমানত অর্থ 'নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ মেনে চলার যিম্মাদারী গ্রহণ'। বিশ্বজগতে আল্লাহ তাআলার কিছু বিধান তো সৃষ্টিগত বা প্রাকৃতিক (তাকবীনী), যা মেনে চলতে সমস্ত সৃষ্টি বাধ্য। কারও পক্ষে তা অমান্য করা সম্ভবই নয়। যেমন জীবন ও মৃত্যু সংক্রান্ত ফায়সালা। কিন্তু আল্লাহ তাআলা চাইলেন এমন কিছু বিধান দিতে যা সৃষ্টি তার স্বাধীন ইচ্ছা বলে মান্য করবে। এজন্য তিনি তার কোনও-কোনও সৃষ্টির সামনে এই প্রস্তাবনা রাখলেন যে, কিছু বিধানের ব্যাপারে তাদেরকে এখতিয়ার দেওয়া হবে। চাইলে তারা নিজ ইচ্ছায় সেসব বিধান মেনে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করবে কিংবা চাইলে তা অমান্য করবে। মান্য করলে তারা জান্নাতের স্থায়ী নেয়ামত লাভ করবে আর যদি অমান্য করে তবে তাদেরকে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। যখন এ প্রস্তাব আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে রাখা হল, তারা এ যিম্মাদারী গ্রহণ করতে ভয় পেয়ে গেল ফলে তারা এটা গ্রহণ করল না। ভয় পেল এ কারণে যে, এর পরিণতিতে জাহান্নামে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু যখন মানুষকে এ প্রস্তাব দেওয়া হল, তারা এটা গ্রহণ করে নিল।
আসমান, যমীন ও পাহাড় আপাতদৃষ্টিতে যদিও এমন বস্তু, যাদের কোনও বোধশক্তি নেই, কিন্তু কুরআন মাজীদের কয়েকটি আয়াত দ্বারা জানা যায়, তাদের মধ্যে এক পর্যায়ের বোধশক্তি আছে, যেমন সূরা বনী ইসরাঈলে ইরশাদ হয়েছে-
تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَنْ فِيهِنَّ وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَكِنْ لَا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا (44)
“সাত আসমান ও যমীন এবং এদের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সৃষ্টি তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে, এমন কোনও জিনিস নেই, যা তাঁর সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করে না। কিন্তু তোমরা তাদের তাসবীহ বুঝতে পার না। বস্তুত তিনি পরম সহিষ্ণু, অতি ক্ষমাশীল। সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৪৪
এ আয়াতে সুস্পষ্ট অর্থ তো এটাই যে, প্রতিটি বস্তু প্রকৃত অর্থেই তাসবীহ পাঠ করে, কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারি না। কেননা আল্লাহ তাআলা জগতের প্রতিটি জিনিস, এমনকি পাথরের ভেতরও এক রকমের অনুভূতিশক্তি দান করেছেন, যে শক্তি দ্বারা সবকিছুর পক্ষেই তাসবীহ পাঠ সম্ভব। কুরআন মাজীদের বেশ ক'টি আয়াতের আলোকে এ ব্যাখ্যাই বেশি সঠিক মনে হয়। আধুনিক বিজ্ঞানও স্বীকার করে নিয়েছে যে, পাথরের মধ্যেও এক ধরনের অনুভবশক্তি আছে।
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهِيَ دُخَانٌ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ ائْتِيَا طَوْعًا أَوْ كَرْهًا قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِينَ (11)
"তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দান করলেন, যা ছিল ধোঁয়ারূপে। তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা চলে এসো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। উভয়ে বলল, আমরা ইচ্ছাক্রমেই আসলাম। সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ১১
এ আয়াতে দেখা যাচ্ছে আল্লাহ তা'আলা আসমান-যমীনকে লক্ষ্য করে একটি আদেশ করেছেন, তাঁর সে আদেশ তারা বুঝতে পেরেছে এবং সে আদেশ তারা মান্য করেছে বলে সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশও করেছে।
কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলার হুকুমে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে। তাতে মানুষ অবাক হয়ে তাদের প্রশ্ন করবে- তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে কিভাবে সাক্ষ্য দিলে? তার উত্তরে তারা বলবে-
أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ خَلَقَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ (21)
“তারা বলবে, আল্লাহ আমাদেরকে বাকশক্তি দান করেছেন, যিনি বাকশক্তি দান করেছেন প্রতিটি জিনিসকে। তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন প্রথমবার আর তাঁরই কাছে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।'সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ২১
সুতরাং এসব আয়াতের দৃষ্টিতে যদি বলা হয়, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আসমান-যমীন ও পাহাড়-পর্বতকে আমানতগ্রহণের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সেটা প্রতীকী অর্থে নয়; বরং বাস্তব অর্থে এবং তাদের অস্বীকৃতিও ছিল বাস্তব অর্থেই, তাতে আপত্তির কোনও অবকাশ নেই। অবশ্য এটাও সম্ভব যে, আমানত গ্রহণের প্রস্তাব দান ও তাদের প্রত্যাখ্যান প্রতীকী অর্থে হয়েছিল। অর্থাৎ আমানত বহনের যোগ্যতা না থাকাকে প্রত্যাখ্যান শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।
এ আয়াতে আমানতভার গ্রহণ করায় মানুষকে চরম জালেম ও অজ্ঞ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে-
إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا
বস্তুত সে ঘোর জালেম, ঘোর অজ্ঞ।"
কেন তারা জালেম ও অজ্ঞ? 'উলামায়ে কিরামের একদল বলেন, এটা বলা হয়েছে কাফেরদেরকে, যারা এ আমানত রক্ষা করেনি। না তারা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সত্য-সঠিক পথের সন্ধান করেছে, আর না নবী-রাসূলগণের ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। যারা মুমিন ও নেককার, তারা বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে এবং নবী-রাসূলগণের দাওয়াত কবুল করে যেমন জ্ঞানের অধিকারী হয়েছে, তেমনি সত্য-সঠিক পথে চলে ন্যায়-নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে। সুতরাং তারা জালেম ও অজ্ঞ নয়।
আবার অনেকের মতে এ কথা বলা হয়েছে সমস্ত মানুষকে লক্ষ্য করে। সব মানুষের স্বভাবের ভেতরই জুলুম অবিচার ও অজ্ঞতা বিদ্যমান। তবে আল্লাহ তা'আলা মু'মিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেন, ফলে তারা দীন সম্পর্কে জানতে পারে এবং দীনের ওপর চলতে সচেষ্ট থাকে। এভাবে তাদের স্বভাবে জুলুম ও অজ্ঞতা নিহিত থাকলেও কার্যত তারা জ্ঞানী ও ন্যায়-নিষ্ঠ হয়ে যায় এবং আমানতের যে ভার তারা বহন করেছিল তা রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
মুনাফিকের আলামতসমূহ
হাদীছ নং : ১৯৯
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি যখন কথা বলে মিথ্যা বলে; যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং যখন তাদের কাছে আমানত রাখা হয় তাতে খেয়ানত করে -বুখারী ও মুসলিম।
অপর এক বর্ণনায় আছে, যদিও সে রোযা রাখে ও নামায পড়ে এবং মনে করে সে একজন মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬৩১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৫০২১: মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৬৭০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৫)
হাদীছ নং : ১৯৯
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি যখন কথা বলে মিথ্যা বলে; যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং যখন তাদের কাছে আমানত রাখা হয় তাতে খেয়ানত করে -বুখারী ও মুসলিম।
অপর এক বর্ণনায় আছে, যদিও সে রোযা রাখে ও নামায পড়ে এবং মনে করে সে একজন মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬৩১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৫০২১: মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৬৭০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৫)
مقدمة الامام النووي
25 - باب الأمر بأداء الأمانة
قَالَ الله تَعَالَى: {إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا} [النساء: 58]، وَقالَ تَعَالَى: {إِنَّا عَرَضْنَا الأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الإنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا} [الأحزاب: 72].
قَالَ الله تَعَالَى: {إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا} [النساء: 58]، وَقالَ تَعَالَى: {إِنَّا عَرَضْنَا الأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الإنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا} [الأحزاب: 72].
199 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أن رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «آيةُ (1) المُنافقِ ثلاثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعدَ أخْلَفَ (2)، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (3)
وفي رواية (4): «وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أنَّهُ مُسْلِمٌ».
وفي رواية (4): «وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أنَّهُ مُسْلِمٌ».
হাদীস নং: ২০০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আমানত আদায় প্রসঙ্গ।
পর্যায়ক্রমে আমানত উঠে যাওয়া
হাদীছ নং : ২০০
হযরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে দু'টি কথা বলেছেন। তার একটি আমি দেখতে পেয়েছি আর অন্যটির অপেক্ষা করছি। তিনি আমাদেরকে বলেন, প্রথমত মানুষের অন্তরের অন্তস্তলে আমানত নাযিল হয়েছে। তারপর কুরআন নাযিল হয়েছে। অতঃপর লোকে কুরআন শিখেছে এবং সুন্নাহ শিখেছে।
তারপর তিনি আমাদেরকে আমানত তুলে নেওয়ার ব্যাপারে বললেন। তিনি বললেন, মানুষ স্বাভাবিকভাবে ঘুমিয়ে পড়বে। এ অবস্থায় তার অন্তর থেকে আমানত তুলে নেওয়া হবে। তারপর তার অন্তরে তার সামান্য ছাপ থেকে যাবে। তারপর সে স্বাভাবিকভাবে ঘুমিয়ে পড়বে। এ অবস্থায় তার অন্তর থেকে (অবশিষ্ট) আমানত তুলে নেওয়া হবে। ফলে তার অন্তরে ফোস্কার মত তার ছাপ থেকে যাবে। যেমন তুমি তোমার পায়ের ওপর আগুনের স্ফুলিঙ্গ গড়িয়ে দিলে, ফলে তাতে ফোস্কা পড়ে গেল। তুমি সেটি ফোলা অবস্থায় দেখতে পাও। কিন্তু তার ভেতর কিছুই থাকে না। – এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি করে নিয়ে সেটি নিজ পায়ের ওপর গড়িয়ে দিলেন। তারপর মানুষ সকালবেলা বেচাকেনা করবে, কিন্তু কেউ বলতে গেলে আমানত প্রায় আদায়ই করবে না। এমনকি বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন আমানতদার লোক আছে। এমনকি একেকজন লোক সম্পর্কে বলা হবে, সে কতই না হুঁশিয়ার, কতই না চালাক এবং কতই না বুদ্ধিমান। অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান থাকবে না।
(হযরত হুযায়ফা রাযি. বলেন,) আমার ওপর দিয়ে এমন একটা সময় অতিবাহিত হয়েছে, যখন আমি তোমাদের মধ্যে কার সাথে বেচাকেনা করেছি তা নিয়ে কোনও চিন্তাই করতাম না। কেননা সে মুসলিম হলে তার দীন তাকে দিয়ে আমার পাওনা আদায় করিয়ে দেবে, আর সে খ্রিষ্টান বা ইয়াহুদী হলে তার ওপর দায়িত্বশীল ব্যক্তি আমার প্রাপ্য আদায় করিয়ে দেবে। অথচ আজকের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তোমাদের মধ্য থেকে অমুক অমুক ছাড়া অন্য কারও সাথে আমি বেচাকেনা করব না -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৪৯৭, ৭০৮৬, ২৭৭৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৪৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৭৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০৫২: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৮৯০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪২১৭)
হাদীছ নং : ২০০
হযরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে দু'টি কথা বলেছেন। তার একটি আমি দেখতে পেয়েছি আর অন্যটির অপেক্ষা করছি। তিনি আমাদেরকে বলেন, প্রথমত মানুষের অন্তরের অন্তস্তলে আমানত নাযিল হয়েছে। তারপর কুরআন নাযিল হয়েছে। অতঃপর লোকে কুরআন শিখেছে এবং সুন্নাহ শিখেছে।
তারপর তিনি আমাদেরকে আমানত তুলে নেওয়ার ব্যাপারে বললেন। তিনি বললেন, মানুষ স্বাভাবিকভাবে ঘুমিয়ে পড়বে। এ অবস্থায় তার অন্তর থেকে আমানত তুলে নেওয়া হবে। তারপর তার অন্তরে তার সামান্য ছাপ থেকে যাবে। তারপর সে স্বাভাবিকভাবে ঘুমিয়ে পড়বে। এ অবস্থায় তার অন্তর থেকে (অবশিষ্ট) আমানত তুলে নেওয়া হবে। ফলে তার অন্তরে ফোস্কার মত তার ছাপ থেকে যাবে। যেমন তুমি তোমার পায়ের ওপর আগুনের স্ফুলিঙ্গ গড়িয়ে দিলে, ফলে তাতে ফোস্কা পড়ে গেল। তুমি সেটি ফোলা অবস্থায় দেখতে পাও। কিন্তু তার ভেতর কিছুই থাকে না। – এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি করে নিয়ে সেটি নিজ পায়ের ওপর গড়িয়ে দিলেন। তারপর মানুষ সকালবেলা বেচাকেনা করবে, কিন্তু কেউ বলতে গেলে আমানত প্রায় আদায়ই করবে না। এমনকি বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন আমানতদার লোক আছে। এমনকি একেকজন লোক সম্পর্কে বলা হবে, সে কতই না হুঁশিয়ার, কতই না চালাক এবং কতই না বুদ্ধিমান। অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান থাকবে না।
(হযরত হুযায়ফা রাযি. বলেন,) আমার ওপর দিয়ে এমন একটা সময় অতিবাহিত হয়েছে, যখন আমি তোমাদের মধ্যে কার সাথে বেচাকেনা করেছি তা নিয়ে কোনও চিন্তাই করতাম না। কেননা সে মুসলিম হলে তার দীন তাকে দিয়ে আমার পাওনা আদায় করিয়ে দেবে, আর সে খ্রিষ্টান বা ইয়াহুদী হলে তার ওপর দায়িত্বশীল ব্যক্তি আমার প্রাপ্য আদায় করিয়ে দেবে। অথচ আজকের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তোমাদের মধ্য থেকে অমুক অমুক ছাড়া অন্য কারও সাথে আমি বেচাকেনা করব না -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৪৯৭, ৭০৮৬, ২৭৭৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৪৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৭৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০৫২: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৮৯০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪২১৭)
مقدمة الامام النووي
25 - باب الأمر بأداء الأمانة
200 - وعن حذيفة بن اليمان - رضي الله عنه - قَالَ: حدثنا رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - حدِيثَينِ قَدْ رأيْتُ أحَدَهُمَا وأنا أنتظرُ الآخر: حدثنا أن الأمانة نَزلت في جَذرِ قلوبِ الرجال، ثُمَّ نزل القرآن فعلموا مِنَ القرآن، وعلِموا من السنةِ، ثُمَّ حدّثنا عن رفع الأمانة، فَقَالَ: «يَنَامُ الرَّجُلُ النَّوْمَةَ فَتُقْبَضُ الأَمَانَةُ مِنْ قَلْبهِ، فَيَظَلُّ أثَرُهَا مِثلَ الوَكْتِ، ثُمَّ يَنَامُ النَّومَةَ فَتُقْبَضُ الأَمَانَةُ مِنْ قَلْبهِ، فَيَظَلُّ أثَرُهَا مِثلَ أَثَرِ المَجْلِ، كَجَمْرٍ دَحْرَجْتَهُ عَلَى رِجْلِكَ فَنَفِطَ، فَتَرَاهُ مُنْتَبرًا وَلَيسَ فِيهِ شَيءٌ». ثُمَّ أخَذَ حَصَاةً فَدَحْرَجَهُ عَلَى رِجْلِهِ «فَيُصْبحُ النَّاسُ يَتَبَايعُونَ، فَلا يَكَادُ أحدٌ يُؤَدّي الأَمَانَةَ حَتَّى يُقَالَ: إنَّ في بَني فُلان رَجُلًا أمينًا، حَتَّى يُقَالَ لِلرَّجُلِ: مَا أجْلَدَهُ! مَا أَظْرَفَهُ! مَا أعْقَلَهُ! وَمَا في قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّة مِن خَرْدَل مِنْ إيمَان». وَلَقدْ أتَى عَلَيَّ زَمَانٌ وَمَا أُبَالِي أيُّكُمْ بَايَعْتُ: لَئن كَانَ مُسْلِمًا لَيَرُدَّنَّهُ عليَّ دِينهُ، وَإنْ كَانَ نَصْرانِيًّا أَوْ يَهُودِيًا لَيَرُدَّنَّهُ عَلَيَّ سَاعِيهِ، وَأَمَّا اليَوْمَ فَمَا كُنْتُ أُبَايعُ مِنْكُمْ إلاَّ فُلانًا وَفُلانًا (1)». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2) [ص:88]
قوله: «جَذْرُ» بفتح الجيم وإسكان الذال المعجمة: وَهُوَ أصل الشيء
وَ «الوكت» بالتاء المثناة من فوق: الأثر اليسير. وَ «المَجْلُ» بفتح الميم وإسكان الجيم: وَهُوَ تَنَفُّطٌ في اليدِ ونحوها من أثرِ عمل وغيرِهِ. قوله: «مُنْتَبرًا»: مرتفِعًا. قوله: «ساعِيهِ»: الوالي عَلَيهِ.
قوله: «جَذْرُ» بفتح الجيم وإسكان الذال المعجمة: وَهُوَ أصل الشيء
وَ «الوكت» بالتاء المثناة من فوق: الأثر اليسير. وَ «المَجْلُ» بفتح الميم وإسكان الجيم: وَهُوَ تَنَفُّطٌ في اليدِ ونحوها من أثرِ عمل وغيرِهِ. قوله: «مُنْتَبرًا»: مرتفِعًا. قوله: «ساعِيهِ»: الوالي عَلَيهِ.