সাহাবাদের প্রধান চরিত্র ছিলো যুদ্ধ করা! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–৫৩
সাহাবাদের প্রধান চরিত্র ছিলো যুদ্ধ করা! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–৫৩
সাহাবায়ে কেরাম রা. ছিলেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদর্শে আদর্শবান। তাঁর উত্তম গুনাবলী সাহাবাদের ভেতরেও ছিলো। হেযবুত তওহীদ কী বলে? তারা জনমনে এই ধারণা দিতে চায় যে, সাহাবাদের রা. মূল কাজই ছিলো যুদ্ধ করা। দেখুন, তারা লিখেছে, আল্লাহ রসুলের এসলাম যে জাতি গঠন কোরেছিল সে জাতির চরিত্রের সর্ব প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যোদ্ধার চরিত্র। –এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব, পৃ. ৬৬ আল্লাহর রাসূলের হাতে গড়া সেই জাতির প্রতিটি সদস্য পরিণত হোয়েছিলেন আল্লাহর রাস্তায় প্রাণোৎসর্গকারী, এমনই ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ যোদ্ধায়। –এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব, পৃ. ৭৮ এ জাতির (সাহাবায়ে কেরাম) মধ্যে কোনো পুরোহিত শ্রেণী ছিল না, সবাই ছিলেন যোদ্ধা। যিনি যতবড় মো’মেন তিনি ছিলেন ততবড় যোদ্ধা। –এসলাম শুধু নাম থাকবে, পৃ. ২৬ উবায়দা (রা.) আর্চ বিশপকে বললেন, “আমাদের বাহিনীতে আমার মত এক হাজার কালো লোক আছে। আমরা শত শত্রু বাহিনীর সাথে একসাথে যুদ্ধ করতে তৈরি আছি। আমরা বেঁচেই আছি শুধু আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার জন্য। আমরা ধন দৌলতের কোনো পরোয়া করি না। আমাদের শুধু পেটের ক্ষুধা মেটানো আর পরার কাপড়ের বেশি আর কিছুই চাই না। এই পৃথিবীর জীবনের আমাদের কাছে কোন দাম নেই এর পরের জীবনই আমাদের সবার কাছে সব। –শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ১৪৫ বিশ্বনবী (সা.) যে জাতিটি সৃষ্টি করলেন সেটার মূল চরিত্র হলো শুধু বহির্মুখী নয়, একেবারে বিস্ফোরনমুখী (Explosive)। -বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ৩৩ মাত্র দশ বছরের মধ্যে আটাত্তরটি যুদ্ধ সংঘটিত করে, একটি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জাতি গঠন করে তিনি তার প্রেরক প্রভুর কাছে চলে গেলেন। –ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা, পৃ. ৩৮ ইসলামের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ঐ আকিদা, ঐ দৃষ্টিভঙ্গি, এবং ঐ আকিদাই তাদের পরিণত করেছিল এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, অপরাজেয় জাতিতে, যাদের নাম শুনলে অত্যাচারী জালেমদের আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠত। –শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ১৪৬ উপরিউক্ত বক্তব্যগুলো দিয়ে তারা বুঝাতে চায় যে, সাহাবাদের রা. মূল শিক্ষা ও কাজই ছিলো যুদ্ধ করা। নাউযুবিল্লাহ। ইসলাম কী বলে? সাহাবায়ে কেরামের রা. চরিত্র কেমন ছিলো, তা পবিত্র কুরআনে পরিস্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاء عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاء بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِم مِّنْ أَثَرِ السُّجُودِ ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল। তাঁর সঙ্গে যারা আছে, তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং আপসের মধ্যে একে অন্যের প্রতি দয়ার্দ্র। তুমি তাদেরকে দেখবে (কখনও) রুকুতে, (কখনও) সিজদায়, আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি সন্ধানে রত। তাদের আলামত তাদের চেহারায় পরিস্ফুট, সিজদার ফলে। এই হল তাদের সেই গুণাবলী, যা তাওরাতে বর্ণিত আছে। –সূরা ফাতহ, আয়াত : ২৯ উপরিউক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ নিজে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের রা. চরিত্র কেমন ছিলো তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। সেখানে কী ‘সাহাবাদের রা. প্রধান চরিত্র ছিলো যোদ্ধার’ এমন কোনও কথা আল্লাহ বলেছেন? নিশ্চয় না, বরং তাঁদের চরিত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে একে অন্যের প্রতি দয়ার্দ্র এবং ইবাদতের চিহ্ন তাঁদের চেহারায় প্রস্ফুটিত। সুতরাং সাহাবাদেরকে শুধু যোদ্ধা বলা কতবড় গোস্তাখি ভেবে দেখেছেন কী? সাহাবারা রা. কী শুধু যুদ্ধ করতেই জিবিত ছিলেন? হেযবুত তওহীদ সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর ব্যাপারে জাতিকে এ মেসেজটা দিতে চেয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরাম রা. শুধু যুদ্ধকেই মূল আমল মনে করতেন। অথচ সাহাবায়ে কেরামের রা. আমলগুলো একটু নজর দিন। ইবনে মাসউদ রা. এর আমল হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর আমল সম্পর্কে ইমাম বাইহাকী রহি. বর্ণনা করেন, وروينا عن بن مسعود أنه كان يختم القرآن في رمضان في ثلاث وفي غير رمضان من الجمعة إلى الجمعة وعن أبي بن كعب أنه كان يختم القرآن في كل ثمان وعن تميم الداري أنه كان يختمه في كل سبع ইবনে মাসউদ রা. এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, তিনি রমাযান মাসে প্রতি তিন দিনে এক খতম কুরআন শরীফ পড়তেন, আর রমাযান মাস ছাড়া অন্য মাসে এক জুম’আ থেকে অন্য জুম’আর মধ্যে এক খতম করতেন। উবাই ইবনে কা’ব রা. প্রতি ৮ দিনে এক খতম করতেন, তামীম দারী রা. প্রতি সপ্তাহে এক খতম পড়তেন। –সুনানে কুবরা (বাইহাকী) বর্ণনা নং : ৪০৫৯ আবু হুরায়রা রা. এর আমল হযরত আবু হুরায়রা রা. এর আমল সম্পর্কে আবু উসমান রহি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, تَضَيَّفْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ سَبْعًا فَكَانَ هُوَ وَامْرَأَتُهُ وَخَادِمُهُ يَعْتَقِبُونَ اللَّيْلَ أَثْلاَثًا يُصَلِّي هَذَا ثُمَّ يُوقِظُ هَذَا একবার আমি সাত দিন পর্যন্ত আবূ হুরায়রার মেহমান ছিলাম। (আমি লক্ষ্য করলাম) তিনি, তার স্ত্রী ও খাদেম পালাক্রমে রাতকে তিনভাগে বিভক্ত করে নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একজন সালাত আদায় করে আরেক জনকে জাগিয়ে দিলেন। –সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৫৪৪১ হযরত ইবনে উমর রা. এর আমল হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. এর ইবাদত সম্পর্কে তাঁর খাদেম হযরত নাফে রহি. বলেন, أنه كان يحيي الليل صلاة ثم يقول يا نافع أسحرنا فأقول لا فيعاود الصلاة إلى أن أقول نعم فيقعد ويستغفر ويدعو حتى يصبح হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. সারা রাত নামায আদায় করতেন। তিনি বলতেন, হে নাফে, ভোর হয়েছে কী? আমি (নাফে) বলতাম, না। এরপর তিনি আবার নামায শুরু করতেন। এভাবে আমি ‘হ্যাঁ’ বলা পর্যন্ত তিনি নামায পড়তে থাকতেন। ফজর হলে তিনি বসে বসে ইস্তেগফার করতেন। এবং সকাল পর্যন্ত দুআ করতেন। –মু’জামে কাবীর (তাবরানী), বর্ণনা নং : ১৩০৪৩ তামীম দারী রা. ও উসমান রা. এর আমল হযরত তামীম দারী রা.-এর আমল সম্পর্কে ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহি. লিখেছেন, وقد كان عثمان وتميم الداري وعلقمة وغيرهم يقرؤون القرآن كله في ركعة وكان سعيد بن جبير وجماعة يختمون القرآن مرتين وأكثر في ليلة হযরত উসমান রা, তামীম দারী রা, হযরত আলকমাসহ অন্যান্যরা এক রাকাতে সম্পূর্ণ কুরআন তেলাওয়াত করতেন। হযরত সাইদ ইবনে জুবাইর ও একদল তাবেয়ী একই রাতে দু’বার বা এর চেয়ে কুরআন খতম করেছেন। –আল-ইস্তেজকার, খ. ২ পৃ. ৪৭৫ এভাবে যদি সাহাবায়ে কেরামের রা. আমল বর্ণনা করতে শুরু করি তাহলে কিতাবটি দীর্ঘ হবে। সে কারণে কয়েকজন সাহাবীর আমল পেশ করলাম। আশা করি বুঝতে পেরেছেন যে, সাহাবাদের একমাত্র চরিত্র হিসাবে যুদ্ধকেই দাঁড় করানো নিতান্তই মিথ্যাচার ও বানোয়াট। তবে হ্যাঁ, সাহাবায়ে কেরাম রা. যখনই জিহাদ ফরজ হতো, তখনই তাঁরা সাড়া দিতেন। কিন্তু জিহাদই তাঁদের মূল কাজ বলে দাবী করা নিতান্তই মূর্খতা ও সাহাবায়ে কেরাম রা.-কে উগ্রপন্থী বানানোর অপকৌশল।