কুরআনের কপি উসমান রা. এর আগে ছিলো না! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–১২
কুরআনের কপি উসমান রা. এর আগে ছিলো না! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–১২
পবিত্র কুরআন একটি সার্বজনীন স্বীকৃত সহিহ গ্রন্থ। যাঁর ব্যাপারে পৃথিবীর কোনও মুসলমানের সন্দেহ থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই পবিত্র কুরআনের ব্যাপারে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়ার অনেক ষড়যন্ত্র ইতিপূর্বেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এমনই একটি ষড়যন্ত্র করে চলেছে হেযবুত তওহীদ। অত্যান্ত কৌশলে তারা পবিত্র কুরআনের ব্যাপারে সংশয় ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চলুন, হেযবুত তওহীদের বক্তব্য আগে দেখে নেওয়া যাক।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তারা লিখেছে,
ঐ জাতির কাছে আল্লাহর দেয়া সংবিধান কোর’আনের মাত্র কয়েকটি হাতেলেখা কপি ছিল, তাও খলিফা ওসমান রাযি.- এর সময়ের পরে। -এসলামের প্রকৃত রুপরেখা, পৃ. ১৪ মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ১৭-১৮ যুগসন্ধিক্ষণে আমরা, পৃ. ৮ এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব, পৃ. ৬৪ এসলাম শুধু নাম থাকবে, পৃ. ১৩-১৪
উক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে তারা বুঝাতে চায় যে, পবিত্র কুরআনের লিপিবদ্ধ সংকলন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে ছিলো না, বরং উসমান রা.-এর পর এটার সংকলন করা হয়েছে। এ কথাটা দিয়ে তারা কৌশলে বুঝাতে চায় যে, যে কুরআন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইন্তেকালের দীর্ঘ কয়েক বছর পর একত্রিত করা হয়েছে। সুতরাং সেটার ব্যাপারে কিভাবে সন্দেহমুক্ত থাকা যায়?
ইসলাম কী বলে?
পবিত্র কুরআন ইসলামের মৌলিক ধর্মগ্রন্থ ও সত্য গ্রন্থ। আর পুরো কুরআনের ব্যাখ্যা করেছেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যা হাদিসসমূহে মজুদ রয়েছে। এই পবিত্র কুরআন মজীদ আল্লাহর নিকটে লাওহে মাহফুজে এক নির্দিষ্ট নিয়মে সাজানো ছিলো আগ থেকেই। সেখান থেকে সুদীর্ঘ তেইশ বৎসরে আবশ্যক ও প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে নবীজি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। কখনো একটি আয়াত কখনও একটি সুরা এভাবে। যখনই যে আয়াত বা আয়াতসমূহ নাজিল হয়েছে, তখনই হযরত জিবরাঈল আ. তা লাওহে মাহফুজের তারতীব তথা ক্রমানুসারে কোন সুরায় কোন আয়াতের পরে বা আগে স্থান পাবে, তা স্পষ্টভাবে বলে দিতেন এবং তদনুসারে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথে সাথে মুখস্থ করে নিতেন এবং 'কাতেবে ওহী' তথা ওহী লেখককে সেভাবেই লেখার নির্দেশ দিতেন খোদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। বলে দিতেন, এই আয়াতটিতে অমুক সুরার অমুক আয়াতের পরে লিখে রাখো। কাতেবে ওহীগণও সেভাবে লিখে রাখতেন।
ওহী লেখকগণের নাম :
অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওপরে নাজিলকৃত কুরআনের আয়াত লিখতেন, তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজন সাহাবীর নাম হলো–
হযরত আবু বকর সিদ্দিক, হযরত উমার, হযরত উসমান, হযরত আলী, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবি সারাহ, হযরত জুবায়ের ইবনে আওয়াম, হযরত খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনে আস, হযরত আবান ইবনে সাঈদ ইবনে আস, হযরত হানজালা ইবনে রবি, হযরত মুআইকিব বিন আবু ফাতিমা, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আরকাম আয-যুহুরী, হযরত শুরাহবিল ইবনে হাসানা, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা, হজরত আমির ইবনে ফুহায়রা, হযরত আমের ইবনে আস, হযরত সাবেত ইবনে কায়েস, হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা, হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ, হযরত আবু সুফিয়ান ইবনে মুয়াবিয়া, হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ।
নবীজি সা.-এর যুগে পবিত্র কুরআনের কপির অস্তিত্ব :
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবদ্দশায় পূর্ণ কুরআন একত্রিতভাবে মুসহাফ বা গ্রন্থ আকারে ছিলো না। যেহেতু হুজুরের অন্তর্ধানপূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত কুরআন অবতীর্ণ হচ্ছিলো। তাই এ ধরণের গ্রন্থ আকারে রূপ দেওয়া বা একত্র করা সম্ভবপর হয়নি। তবে ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে অনেকে ঐ সময় পর্যন্ত নাজিলকৃত আয়াতসমূহ একস্থানে লিখে নিয়েছিলেন তিলাওয়াতের উদ্দেশ্যে। কারণ পবিত্র কুরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম রা. সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিতেন যেন কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি না হয়। তাঁরা শুধু মুখস্ত করেই ক্ষ্যান্ত হতেন না, বরং সামর্থ অনুযায়ী হাড়, পাথর, চামড়া ও খেজুরডালা ইত্যাদির উপর লিখে রাখতেন। শুধু সাহাবায়ে কেরাম রা. নন, বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও হযরত জিবরাইল আ. যখন কোনো আয়াত নিয়ে অবতীর্ণ হতেন, তখন তা পাঠ করার সময় সাথে সাথে পাঠ করে নিতেন এবং জিহ্বা নেড়ে নেড়ে এত দ্রুত আবৃত্তি করতেন, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্যে কষ্টকর হয়ে যেতো। ফলে আল্লাহ তাআলা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আশ্বস্ত করার নিমিত্তে ঘোষণা করেন,
لَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ
(হে রাসুল!) তুমি এ কুরআনকে তাড়াতাড়ি মুখস্থ করার জন্য এর সাথে তোমার জিহ্বা নাড়িও না। নিশ্চয়ই একে (তোমার অন্তরে) জমানো ও (মুখ দিয়ে) পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই। –সুরা ক্বিয়ামাহ : ১৬-১৭
উপরন্তু বহুসংখ্যক সাহাবা রা. এমনও ছিলেন যে, যখন কোনো আয়াত অবতীর্ণ হতো, তখন তা হিফজ করে নিতেন। ফলে সাহাবায়ে কেরামদের রা. বড় একটি দল পূর্ণ কুরআনের হাফেজ হিশাবে পরিচিত ছিলেন। আর যারা পূর্ণ কুরআন হিফজ করতে সক্ষম হননি, তারা আংশিক হলেও হিফজ করে নিতেন।
এ ছাড়াও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর কাছে পূর্ণ বা অপূর্ণ কুরআন শরীফের নুসখা থাকার প্রমাণ কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে নিন্মে দুটি হাদিস বর্ণনা করছি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. হতে বর্ণিত,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم نَهَى أَنْ يُسَافَرَ بِالْقُرْآنِ إِلَى أَرْضِ الْعَدُوِّ
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন সঙ্গে নিয়ে শত্রু-দেশে সফর করতে নিষেধ করেছেন। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ২৯৯০
উক্ত হাদিসে যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন শরীফ সঙ্গে নিয়ে শত্রুদের দেশে সফর করতে নিষেধ করেছেন, সেহেতু বোঝা যায়, কুরআন শরীফের কপি সাহাবায়ে কেরামের রা. কাছে ছিলো। না থাকলে তিনি এমনটা কেন বলবেন?
হযরত আওস রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
قِرَاءَةُ الرَّجُلِ الْقُرْآنَ فِي غَيْرِ الْمُصْحَفِ أَلْفُ دَرَجَةٍ وَقِرَاءَتُهُ فِي الْمُصحف تضعف عل ذَلِك إِلَى ألفي دَرَجَة
কোনো ব্যক্তির মুসহাফ ছাড়া (অর্থাৎ- কুরআন দেখা ছাড়া) মুখস্থ কুরআন পড়া এক হাজার গুণ মর্যাদা সম্পন্ন। আর কুরআন মুসহাফে পড়া (অর্থাৎ- কুরআন খুলে দেখে দেখে পড়া) মুখস্থ পড়ার দু’ গুণ থেকে দু’ হাজার গুণ পর্যন্ত মর্যাদা রাখে। -মু‘জামুল কাবীর (ত্ববারানী), হাদিস নং : ৬০১
উপরিউক্ত হাদিসটি থেকে বুঝা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগেই সাহাবায়ে কেরামের রা. কাছে পবিত্র কুরআনের কপি ছিলো। না থাকলে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা কেন বলবেন? সুতরাং ধারণা করা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগেও কিছু সাহাবায়ে কেরামের কাছে কুরআন শরীফের কপি বিদ্যমান ছিল। যদিও সেটা কিতাবের আকারে না থাকলেও শীট আকারে ছিলো।
আবু বকর রা. এর যুগে কুরআনের কপির অস্তীত্ব :
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. ইসলামের প্রথম খলীফা নিযুক্ত হন। তাঁর খেলাফতের সূচনালগ্নেই অভিশপ্ত মিথ্যা নবী দাবীদার ‘মুসাইলামাতুল কাজ্জাব’-এর সাথে যুদ্ধের জন্য সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর বড় একটি জামাত প্রস্তুত করেন সিদ্দিকে আকবার রা.। অবশেষে উভয়পক্ষই যুদ্ধের জন্যে ‘ইয়ামামা’ নামক স্থানে যুদ্ধ করেন। সেজন্য এ যুদ্ধকে ‘ইয়ামামা যুদ্ধ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এ যুদ্ধে সত্তর জন হাফেজে কুরআন সাহাবী শহীদ হন। (উমদাতুল ক্বারীতে এসেছে, ৭০০ জন হাফেজ সাহাবী শহীদ হন।) ফলে হযরত উমর রা. মারত্মক ভাবে মর্মাহত হন এবং ভবিষ্যতে কুরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে ওমর রা. খুব চিন্তিত এবং শংকিত হয়ে পড়েন। অতপর তিনি বিষয়টি খলীফা আবু বকর রা.-এর সাথে পরামর্শ করেন। যার বিস্তারিত ঘটনা সহিহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে। কাতেবে ওহী হযরত যায়দ ইবনে সাবেত রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَرْسَلَ إِلَيَّ أَبُوْ بَكْرٍ مَقْتَلَ أَهْلِ الْيَمَامَةِ وَعِنْدَهُ عُمَرُ فَقَالَ أَبُوْ بَكْرٍ إِنَّ عُمَرَ أَتَانِيْ فَقَالَ إِنَّ الْقَتْلَ قَدْ اسْتَحَرَّ يَوْمَ الْيَمَامَةِ بِالنَّاسِ وَإِنِّيْ أَخْشَى أَنْ يَسْتَحِرَّ الْقَتْلُ بِالْقُرَّاءِ فِي الْمَوَاطِنِ فَيَذْهَبَ كَثِيْرٌ مِنَ الْقُرْآنِ إِلَّا أَنْ تَجْمَعُوْهُ وَإِنِّيْ لَأَرَى أَنْ تَجْمَعَ الْقُرْآنَ قَالَ أَبُوْ بَكْرٍ قُلْتُ لِعُمَرَ كَيْفَ أَفْعَلُ شَيْئًا لَمْ يَفْعَلْهُ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ عُمَرُ هُوَ وَاللهِ خَيْرٌ فَلَمْ يَزَلْ عُمَرُ يُرَاجِعُنِيْ فِيْهِ حَتَّى شَرَحَ اللهُ لِذَلِكَ صَدْرِيْ وَرَأَيْتُ الَّذِيْ رَأَى عُمَرُ قَالَ زَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ وَعُمَرُ عِنْدَهُ جَالِسٌ لَا يَتَكَلَّمُ فَقَالَ أَبُوْ بَكْرٍ إِنَّكَ رَجُلٌ شَابٌّ عَاقِلٌ وَلَا نَتَّهِمُكَ كُنْتَ تَكْتُبُ الْوَحْيَ لِرَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَتَتَبَّعُ الْقُرْآنَ فَاجْمَعْهُ فَوَاللهِ لَوْ كَلَّفَنِيْ نَقْلَ جَبَلٍ مِنَ الْجِبَالِ مَا كَانَ أَثْقَلَ عَلَيَّ مِمَّا أَمَرَنِيْ بِهِ مِنْ جَمْعِ الْقُرْآنِ قُلْتُ كَيْفَ تَفْعَلَانِ شَيْئًا لَمْ يَفْعَلْهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَبُوْ بَكْرٍ هُوَ وَاللهِ خَيْرٌ فَلَمْ أَزَلْ أُرَاجِعُهُ حَتَّى شَرَحَ اللهُ صَدْرِيْ لِلَّذِيْ شَرَحَ اللهُ لَهُ صَدْرَ أَبِيْ بَكْرٍ وَعُمَرَ فَقُمْتُ فَتَتَبَّعْتُ الْقُرْآنَ أَجْمَعُهُ مِنْ الرِّقَاعِ وَالأَكْتَافِ وَالْعُسُبِ وَصُدُوْرِ الرِّجَالِ حَتَّى وَجَدْتُ مِنْ سُوْرَةِ التَّوْبَةِ آيَتَيْنِ مَعَ خُزَيْمَةَ الْأَنْصَارِيِّ لَمْ أَجِدْهُمَا مَعَ أَحَدٍ غَيْرِهِ (لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيْزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيْصٌ) إِلَى آخِرِهِمَا وَكَانَتْ الصُّحُفُ الَّتِيْ جُمِعَ فِيْهَا الْقُرْآنُ عِنْدَ أَبِيْ بَكْرٍ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللهُ
হযরত আবু বকর রা. (তার খিলাফাতের সময়) এক ব্যক্তিকে আমার কাছে ইয়ামামার যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করলেন। (আমি তার কাছে চলে আসলাম) তখন তার কাছে ’উমার রা. বসা ছিলেন। আবু বকর রা. আমাকে বললেন, ’উমার রা. আমার কাছে এসে বললেন যে, ইয়ামামার যুদ্ধ তীব্র গতিতে চলছে, আমার ভয় হচ্ছে, কুরআনের অভিজ্ঞগণ (হাফেজগণ) ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হয়ে যান নাকি! যদি আপনারা তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করেন, তবে কুরআনের অনেক অংশ চলে যেতে পারে এবং (এজন্য আমি) কুরআনকে একত্রিত সংরক্ষণ করা ভাল মনে করি। আবু বকর রা. বলেন, আমি উমার রা. কে বললাম, আমি এ কাজ কীভাবে করতে পারি, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করে যাননি? কিন্তু উমার রা. বললেন, আল্লাহর কসম! এটা কল্যাণকর। উমার রা. তাঁর এ কথার পুনরুক্তি করতে থাকেন, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা এ কাজ করার জন্য আমার অন্তর খুলে দিলেন এবং আমিও উমার রা. এর মতোই মতামত পেশ করলাম। যায়েদ ইবনে সাবিত রা. বলেন, উমার রা. সেখানে নীরবে বসা ছিলেন, কোন কথা বলছিলেন না। এরপর আবু বকর রা. আমাকে বললেন, দেখো, তুমি যুবক এবং জ্ঞানী ব্যক্তি। আমরা তোমার প্রতি কোনরূপ খারাপ ধারণা রাখি না। কেননা, তুমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়ে ওহী লিপিবদ্ধ করতে। সুতরাং তুমি কুরআনের আয়াত সংগ্রহ করে একত্রিত করো।
আল্লাহর কসম! তিনি কুরআন একত্রিত করার যে নির্দেশ আমাকে দিলেন, সেটি আমার কাছে এতো ভারী মনে হলো যে, তিনি যদি কোন একটি পর্বত স্থানান্তর করার আদেশ দিতেন তাও আমার কাছে এমন ভারী মনে হতো না। আমি বললাম, যে কাজটি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করে যাননি, সে কাজটি আপনারা কীভাবে করবেন? তখন আবু বকর রা. বললেন, আল্লাহর কসম! এটাই কল্যাণকর। এরপর আমিও আমার কথার উপর বারবার জোর দিতে লাগলাম।
শেষে আল্লাহ যেটা বুঝার জন্য আবু বকর রা. ও উমার রা. এর অন্তর খুলে দিয়েছিলেন, আমার অন্তরকেও তা বুঝার জন্য খুলে দিলেন। এরপর আমি কুরআন সংগ্রহে লেগে গেলাম এবং হাড়, চামড়া, খেজুর ডাল ও বাকল এবং মানুষের স্মৃতি থেকে তা সংগ্রহ করলাম। অবশেষে খুযাইমাহ আনসারীর কাছে সূরায়ে তাওবার দু’টি আয়াত পেয়ে গেলাম, যা অন্য কারও নিকট হতে সংগ্রহ করতে পারিনি। لَقَدْ جَاءَكُمْ থেকে শেষ পর্যন্ত। এরপর এ একত্রিত কুরআন আবু বকর রা. এর ওফাত পর্যন্ত তাঁর কাছেই জমা ছিল। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৬৭৯
উক্ত বর্ণনায় এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, পবিত্র কুরআনের কপি আকারে সর্বপ্রথম তৈরি করা হয়েছিলো আবু বকর রা. এর যুগেই। কিন্তু হেযবুত তওহীদ এসব বিষয়ে যথেষ্ট অজ্ঞ বলেই দাবী করেছে যে, ‘উসমান রা. এর পরে কুরআনের কপি তৈরি করা হয়েছিলো’।
হযরত ওমর রা. এর যুগে কুরআনের কপির অস্তিত্ব :
হযরত আবু বকর রা. এর ইন্তেকালের পর সেই কপিটি হযরত ওমর রা. এর কাছে সংরক্ষিত ছিলো। যা বুখারী শরীফের বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়।
ثُمَّ عِنْدَ عُمَرَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللهُ ثُمَّ عِنْدَ حَفْصَةَ بِنْتِ عُمَرَ تَابَعَهُ عُثْمَانُ بْنُ عُمَرَ
তারপর (আবু বকর রা. এর ইন্তেকালের পর কুরআনের কপিটি) হযরত উমার রা. এর কাছে সংরক্ষিত ছিলো। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এটি তার কাছেই ছিল। তারপর হাফসাহ বিনতে উমার রা.-এর কাছে ছিলো। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৬৭৯
উসমান রা. এর যুগে কুরআনের কপি :
বর্তমান সারাবিশ্বে যে প্রকারের গ্রন্থ আকারে কুরআন শরীফ বিদ্যমান তাকে মুসহাফে উসমানী বলা হয়। এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হলো–খলীফা হযরত উসমান রা.-এর খেলাফতের শুরু দিকে আর্মেনিয়া ও আজরবাইজানে মুসলমানদের সংগে যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সে যুদ্ধে হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামানও রা. ছিলেন। তিনি সে জিহাদের সফরে হেজায ও শামের বিভিন্ন গোত্রের মুসলমানদের মধ্যে কুরআনের বিভিন্ন পাঠ দেখতে পান। হুজাইফা রা. একজন দূরদর্শী বিচক্ষণ, অভিন্ন এবং গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। যাঁর উপাধী ছিলো, 'ছিররুন নবী' বা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গোপন রহস্যজ্ঞানী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত গোপন কথা, যা কেয়ামত পর্যন্ত সংগঠিত হবে, তা সব হযরত হুজাইফা রা.-কে বলে গেছেন। তিনি এসব বিভিন্ন রীতিতে কুরআন পাঠ দেখে ভীত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। অতপর উসমান রা.-কে বিষয়টি অবহিত করলে খলীফা উসমান রা. মক্কা-মাদীনার আশপাশের সকল সাহাবায়ে কেরাম রা. কে আহ্বান করলে ৫০ হাজার সাহাবীর সম্মতিতে আমাদের সামনে থাকা এই কুরআনের সংকলন করা হয়। এ সম্পর্কে হযরত আনাস রা. বলেন,
أَنَّ حُذَيْفَةَ بْنَ الْيَمَانِ قَدِمَ عَلَى عُثْمَانَ وَكَانَ يُغَازِيْ أَهْلَ الشَّأْمِ فِيْ فَتْحِ إِرْمِيْنِيَةَ وَأَذْرَبِيْجَانَ مَعَ أَهْلِ الْعِرَاقِ فَأَفْزَعَ حُذَيْفَةَ اخْتِلَافُهُمْ فِي الْقِرَاءَةِ فَقَالَ حُذَيْفَةُ لِعُثْمَانَ يَا أَمِيْرَ الْمُؤْمِنِيْنَ أَدْرِكْ هَذِهِ الْأُمَّةَ قَبْلَ أَنْ يَخْتَلِفُوْا فِي الْكِتَابِ اخْتِلَافَ الْيَهُوْدِ وَالنَّصَارَى فَأَرْسَلَ عُثْمَانُ إِلَى حَفْصَةَ أَنْ أَرْسِلِيْ إِلَيْنَا بِالصُّحُفِ نَنْسَخُهَا فِي الْمَصَاحِفِ ثُمَّ نَرُدُّهَا إِلَيْكِ فَأَرْسَلَتْ بِهَا حَفْصَةُ إِلَى عُثْمَانَ فَأَمَرَ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ وَعَبْدَ اللهِ بْنَ الزُّبَيْرِ وَسَعِيْدَ بْنَ الْعَاصِ وَعَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ الْحَارِثِ بْنِ هِشَامٍ فَنَسَخُوْهَا فِي الْمَصَاحِفِ وَقَالَ عُثْمَانُ لِلرَّهْطِ الْقُرَشِيِّيْنَ الثَلَاثَةِ إِذَا اخْتَلَفْتُمْ أَنْتُمْ وَزَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ فِيْ شَيْءٍ مِنَ الْقُرْآنِ فَاكْتُبُوْهُ بِلِسَانِ قُرَيْشٍ فَإِنَّمَا نَزَلَ بِلِسَانِهِمْ فَفَعَلُوْا حَتَّى إِذَا نَسَخُوا الصُّحُفَ فِي الْمَصَاحِفِ رَدَّ عُثْمَانُ الصُّحُفَ إِلَى حَفْصَةَ وَأَرْسَلَ إِلَى كُلِّ أُفُقٍ بِمُصْحَفٍ مِمَّا نَسَخُوْا وَأَمَرَ بِمَا سِوَاهُ مِنَ الْقُرْآنِ فِيْ كُلِّ صَحِيْفَةٍ أَوْ مُصْحَفٍ أَنْ يُحْرَقَ
হযরত হুযাইফাহ ইবনুল ইয়ামান রা. একবার উসমান রা.-এর কাছে এলেন। এ সময় তিনি আরমিনিয়া ও আজারবাইজান বিজয়ের ব্যাপারে সিরীয় ও ইরাকী যোদ্ধাদের জন্য যুদ্ধ-প্রস্তুতির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কুরআন পাঠে তাঁদের মতবিরোধ হুযাইফাকে ভীষণ চিন্তিত করলো। সুতরাং তিনি উসমান রা.-কে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! কিতাব সম্পর্কে ইয়াহুদী ও নাসারাদের মতো মতপার্থক্যে লিপ্ত হবার পূর্বে এই উম্মতকে রক্ষা করুন। তারপর উসমান রা. হযরত হাফসাহ রা.-এর কাছে এক ব্যক্তিকে এ বলে পাঠালেন যে, আপনার কাছে সংরক্ষিত কুরআনের সহীফাসমূহ আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন, যাতে আমরা সেগুলোকে পরিপূর্ণ মুসহাফ আকারে লিপিবদ্ধ করতে পারি। এরপর আমরা তা আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব। হাফসাহ রা. তখন সেগুলো উসমান রা. এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
এরপর উসমান রা. যায়েদ ইবনে সাবিত, আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, সা’ঈদ ইবনুল আস, এবং আবদুর রহমান ইবনে হারিস ইবনে হিশাম রাদিয়াল্লকহু আনহুমকে নির্দেশ দিলেন। তাঁরা মুসহাফে তা লিপিবদ্ধ করলেন। এ সময় উসমান রা. তিনজন কুরাইশী ব্যক্তিকে বললেন, কুরআনের কোনও ব্যাপারে যদি যায়েদ ইবনে সাবিতের সঙ্গে তোমাদের মতভেদ দেখা দেয়, তাহলে তোমরা তা কুরাইশদের ভাষায় লিপিবদ্ধ করবে। কারণ, কুরআন তাদের ভাষায় নাযিল হয়েছে। সুতরাং তাঁরা তাই করলেন। যখন মূল লিপিগুলো থেকে কয়েকটি পরিপূর্ণ গ্রন্থ লেখা হয়ে গেলো, তখন উসমান রা. মুল লিপিগুলো হাফসাহ রা. এর কাছে ফিরিয়ে দিলেন। তারপর তিনি কুরআনের লিখিত মুসহাফসমূহের এক একখানা মুসহাফ এক এক প্রদেশে পাঠিয়ে দিলেন এবং এছাড়া আলাদা আলাদা বা একত্রিত কুরআনের যে কপিসমূহ রয়েছে, তা জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। –সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৯৮৭
সুতরাং বোঝা গেলো, পবিত্র কুরআনের এ সংকলন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহাবায়ে কেরামের রা. অব্যহত ও অবিচ্ছিন্ন ধারায় সংকলিত। যেসকল সাহাবায়ে কেরাম রা. এই মহান কাজে অংশগগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন–হযরত আবু বকর, হযরত ওমর, হযরত উসমান, হযরত আলী, হযরত তালহা, হযরত সা’দ, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান, হযরত আবু হুরায়রা, হযরত সালেম, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার, হযরত আমর ইবনে আস, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েব, হযরত মুয়াবিয়া, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, হযরত আয়েশা, হযরত হাফসা, হযরত হযরত উম্মে সালামা, হযরত উম্মে ওয়ারাকা, হযরত উবাই ইবনে কাব, হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল, হযরত আবু হালিমা মুয়াজ, হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত, হযরত আবু দাহদাহ, হযরত মুজাম্মে ইবনে জারিয়া, হযরত মাসলামা ইবনে মুখাল্লাদ, হযরত আনাস ইবনে মালিক, হযরত উকবা ইবনে আমের, হযরত তামীম আদ-দারী, হযরত আবু মুসা আশআরী, হযরত আবু যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ। এ ব্যাপারে আল্লামা তাক্বী উসমানী সাহেবের ‘উলুমুল কুরআন’ কিতাবটি পড়লে বিস্তারিত জানা যাবে বলে আশা করি।
সুতরাং ‘শুধু উসমান রা. এর পরেই এই কুরআনের কপি এসেছে’ বলে হেযবুত তওহীদের দাবিকৃত বক্তব্যটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট এবং পবিত্র কুরআনের ব্যাপারে সংশয় ঢুকাবার এক গভীর ষড়যন্ত্র। আল্লাহ তাদের ষড়যন্ত্র থেকে আমাদের ঈমানকে হিফাযত করেন। আমীন!