ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার প্রচেষ্টা নাজায়েয! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–৯
ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার প্রচেষ্টা নাজায়েয! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–৯
মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের বিভিন্ন পন্থা রয়েছে৷ কিন্তু পুরো বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের কোনও পন্থা অবলম্বন করা যাবে না, এমন দাবী সর্বৈব মিথ্যাচার ও ইসলামের নামে অপব্যাখ্যা।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
প্রশ্ন আসে তবে কি আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভের প্রয়োজনীয়তা এ দ্বীনে নেই? আছে, আগেই বলেছি এ দ্বীন ভারসাম্যযুক্ত, কাজেই দুটোই আছে। কিন্তু প্রথম হলো পৃথিবীতে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত কোরে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা কোরে, তারপর আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা। প্রথমটা ফরজ, দ্বিতীয়টা নফল। ফরদ নামায বাদ দিয়ে শুধু সুন্নত বা নফল নামায পড়লে শরিয়াহ মোতাবেকই তা যেমন নাজায়েয, ঠিক তেমনি বিশ্ব নবীর (দঃ) ওপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্বকে পূর্ণ করার ফরদ কাজ বাদ দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া অর্থাৎ নফল কাজ নিয়ে ব্যস্ত হোলে তা ঐ শরিয়াহ মোতবেকই জায়েয হবে না। প্রথমে ফরজ তারপর ওয়াজেব, তারপর সুন্নাহ, তারপর নফল ও তারপর মুস্তাহাব’। -এ ইসলাম ইসলামই নয়, পৃ. ১১০
অর্থাৎ তাদের দাবী হলো, ‘আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠান আগে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সকল প্রক্রিয়া তথা আমল নাজায়েয’।
ইসলাম কী বলে?
এক. আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের জন্য কোন শর্তারোপ করা হয়নি। মহান রব্ব বলেন,
وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ
এবং সিজদা করো ও নিকটবর্তী হও। -সুরা আলাক : ১৯
উক্ত আয়াতটিতে ‘ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যাবে কী যাবে না, এমন কোনো শর্তারোপ মহান আল্লাহ করেননি। অতএব বুঝা গেলো, আল্লাহর নির্দেশ হলো, সর্বহালতে তাঁর নৈকট্য অর্জন করা লাগবেই। এটা আল্লাহর নির্দেশ, তথা ফরজ। সুতরাং কুরআনে কারীমের مطلق তথা শর্তহীন আয়াতকে مقيد তথা শর্তযুক্ত করার অধিকার পৃথিবীর কারও নেই। অতএব আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রচেষ্টা করার আগে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা করার শর্তারোপ করা কুরআনের অপব্যাখ্যার শামিল। অতএব ‘ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা নাজায়েয’ এটা একটি ডাহা মিথ্যাচার। ও খোদাদ্রোহীতার শামিল।
দুই. তাছাড়া সুরা আলাতের উপরিউক্ত এ আয়াতটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছিলো। তখনও কিন্তু ইসলামি শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এর আগেই এ আয়াত নাজিল হয়েছিলো। সুতরাং আল্লাহ তাআলা নিজেই তাঁর আইন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগেই তাঁর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য সিজদা বা নামাজের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুতরাং বুঝা গেলো, সর্বহালতে আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী তাঁর নৈকট্য অর্জন করা ফরজ। এর বিপরীতে গিয়ে যে কথা হেযবুত তওহীদ দাবী করেছে, এটা উক্ত আয়াতকে অস্বীকার করার অপরাধে তাদের মুসলিম বলার কোনো সুযোগ আছে কী?
তিন. হাদিসে কুদসীতে এসেছে, হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রতিপালক থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
إِذَا تَقَرَّبَ الْعَبْدُ إِلَيَّ شِبْرًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا وَإِذَا تَقَرَّبَ مِنِّي ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ مِنْهُ بَاعًا وَإِذَا أَتَانِي مَشْيًا أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً
আমার বান্দা যখন আমার দিকে এক বিঘত নিকটবর্তী হয়, আমি তখন তার দিকে এক হাত নিকটবর্তী হই। আর সে যখন আমার দিকে এক হাত নিকটবর্তী হয়, আমি তখন তার দিকে দু’হাত নিকটবর্তী হই। সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌঁড়ে যাই। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৭৫৩৬
চার. আরেকটি হাদিসে কুদসীতে এসেছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ قَالَ مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ وَمَا تَقَرَّبَ إِلَىَّ عَبْدِي بِشَىْءٍ أَحَبَّ إِلَىَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَىَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطُشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا وَإِنْ سَأَلَنِي لأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِي لأُعِيذَنَّهُ وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَىْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِي عَنْ نَفْسِ الْمُؤْمِنِ يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَأَنَا أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ
আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যাক্তি আমার কোনও বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা রাখবে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করি। আমার বান্দা আমি যা তার উপর ফরয করেছি, সেই ইবাদতের চাইতে আমার কাছে অধিক প্রিয় কোনও ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করবে না। আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে। এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নিই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে সবকিছু দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যার দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কোনও কিছু সাওয়াল করে, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায়, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি যে-কোনও কাজ করতে চাইলে এটাতে কোন রকম দ্বিধা সংকোচ করি-না যতটা দ্বিধা সংকোচ মুমিন বান্দার প্রাণ হরণে করি। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে, আর আমি তার কষ্ট অপছন্দ করি। -সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৬৫০২
সুবহানাল্লাহ্! আল্লাহর নৈকট্য অর্জনকারীরা কতো প্রিয় মহান রব্বের কাছে। অথচ এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি থেকে দূরে রাখার জন্য তারা কতো ভয়ঙ্কর ছক এঁকেছে।
পাঁচ. প্রিয় পাঠক, আপনার কমনসেন্সসকে একবার প্রশ্ন করুন তো–যিনি আমাদের সৃষ্টি করলেন, নিয়মিত লালন-পালন করে যাচ্ছেন, তাঁর নৈকট্য অর্জন করার জন্য কোনো দলিল প্রয়োজন হয়? এটা তো সর্বজনবিদিত বিষয় যে, গোলাম তাঁর মালিকের নৈকট্য অর্জন করবে, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের নৈকট্য অর্জন করবে এবং করে থাকে। এটা নৈতিকতার দাবি। তাহলে রব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন আবশ্যকীয় নয়, এটা কী কোনো সুস্থ ও বিবেকবান মানুষ বিশ্বাস করবে? আর যারা এমন কথা প্রচার করে যাচ্ছেন, তারা কীভাবে মুমিন-মুসলিম হয়, এটা পাঠকদের বিবেকের কাছে সোপর্দ করলাম।