ওহুদের যুদ্ধে সাহাবীরা নবীজির সা. আনুগত্য লংঘন করেছিলেন! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–৪৭
ওহুদের যুদ্ধে সাহাবীরা নবীজির সা. আনুগত্য লংঘন করেছিলেন! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–৪৭
কোনও সাহাবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অবাধ্য ছিলেন না, বরং তাঁরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছোট থেকে ছোট, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র ইশারাও পালন করতে সচেষ্ট ও আগ্রহী থাকতেন। হেযবুত তওহীদ কী বলে? তাদের দাবী হলো, উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের উপর বিপর্যয় আসার মূল কারণ ছিলো সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অবাধ্যতা। দেখুন তারা কী বলে, ওহুদের যুদ্ধে রসূলাল্লাহর আনুগত্য লংঘন করার কারণে মুসলিম বাহিনীর উপর সাংঘাতিক বিপর্যয় নেমে আসে। –বিকৃত সুফিবাদ, পৃ. ২০ অর্থাৎ তারা বলতে চায়, উহুদ যুদ্ধে মুসলিমতের ওপর যে সাময়ীক বিপর্যয় এসেছিলো, সেটা শুধু সাহাবায়ে কেরাম রা. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্যতা লংঘন করার কারণেই হয়েছিলো। ইসলাম কী বলে? এ বিষয়ে জানতে আগে সংক্ষিপ্তসারে উহুদ যুদ্ধের ইতিহাস দেখা যাক– বদরে পরাজিত হওয়ার সংবাদ যখন মক্কায় পৌঁছুলো, তখন ঘরে ঘরে শুরু হলো শোকের মাতম। যাদের আত্মীয়-স্বজন মারা গেছে, তারা সকলে একত্র হয়ে আবু সুফিয়ানের নিকট এল। তারও নিকটজন বদরে মারা গিয়েছিল। তাছাড়া ঐ সময় তিনি ছিলেন কুরাইশের সরদার। তাই মুসলমানদের প্রতিশোধ নেওয়া ছিল তার মূল লক্ষ্য। তার আদেশে কুরাইশীদের নিকট থেকে চাঁদা তোলা হলো এবং এক মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলো। পরের বছর ৩ হাজার সৈন্য মদীনা অভিমুখে রওনা হলো। এ বাহিনী উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে তাঁবু স্থাপন করল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিষয়টি জানতে পেরে সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন এবং এক হাজার সাথী নিয়ে মোকাবেলার জন্য বের হলেন। পথে মুনাফিকদের এক বিরাট অংশ দলত্যাগ করলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে তখন মাত্র ৭০০ জন রয়ে গেলেন। লড়াইয়ের সময় ঘনিয়ে এলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিছন দিকে (যেদিক দিয়ে কাফেরদের আক্রমণের প্রবল আশঙ্কা ছিলো) পাহারার জন্য আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা.-এর নেতৃত্বে একটি দলকে নিয়োজিত করলেন। এ বিষয়ে সহিহ বুখারীতে এসেছে, جَعَلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَلَى الرَّجَّالَةِ يَوْمَ أُحُدٍ وَكَانُوْا خَمْسِيْنَ رَجُلًا عَبْدَ اللهِ بْنَ جُبَيْرٍ فَقَالَ إِنْ رَأَيْتُمُوْنَا تَخْطَفُنَا الطَّيْرُ فَلَا تَبْرَحُوْا مَكَانَكُمْ هَذَا حَتَّى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ وَإِنْ رَأَيْتُمُوْنَا هَزَمْنَا الْقَوْمَ وَأَوْطَأْنَاهُمْ فَلَا تَبْرَحُوْا حَتَّى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ فَهَزَمُوْهُمْ قَالَ فَأَنَا وَاللهِ رَأَيْتُ النِّسَاءَ يَشْتَدِدْنَ قَدْ بَدَتْ خَلَاخِلُهُنَّ وَأَسْوُقُهُنَّ رَافِعَاتٍ ثِيَابَهُنَّ فَقَالَ أَصْحَابُ عَبْدِ اللهِ بْنِ جُبَيْرٍ الْغَنِيْمَةَ أَيْ قَوْمِ الْغَنِيْمَةَ ظَهَرَ أَصْحَابُكُمْ فَمَا تَنْتَظِرُوْنَ فَقَالَ عَبْدُ اللهِ بْنُ جُبَيْرٍ أَنَسِيْتُمْ مَا قَالَ لَكُمْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالُوْا وَاللهِ لَنَأْتِيَنَّ النَّاسَ فَلَنُصِيْبَنَّ مِنْ الْغَنِيْمَةِ فَلَمَّا أَتَوْهُمْ صُرِفَتْ وُجُوْهُهُمْ فَأَقْبَلُوْا مُنْهَزِمِيْنَ فَذَاكَ إِذْ يَدْعُوْهُمْ الرَّسُوْلُ فِيْ أُخْرَاهُمْ فَلَمْ يَبْقَ مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم غَيْرُ اثْنَيْ عَشَرَ رَجُلًا فَأَصَابُوْا مِنَّا سَبْعِيْنَ وَكَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم وَأَصْحَابُهُ أَصَابُوْا مِنْ الْمُشْرِكِيْنَ يَوْمَ بَدْرٍ أَرْبَعِيْنَ وَمِائَةً سَبْعِيْنَ أَسِيْرًا وَسَبْعِيْنَ قَتِيْلًا فَقَالَ أَبُوْ سُفْيَانَ أَفِي الْقَوْمِ مُحَمَّدٌ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ فَنَهَاهُمْ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَنْ يُجِيْبُوْهُ ثُمَّ قَالَ أَفِي الْقَوْمِ ابْنُ أَبِيْ قُحَافَةَ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ ثُمَّ قَالَ أَفِي الْقَوْمِ ابْنُ الْخَطَّابِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ ثُمَّ رَجَعَ إِلَى أَصْحَابِهِ فَقَالَ أَمَّا هَؤُلَاءِ فَقَدْ قُتِلُوْا فَمَا مَلَكَ عُمَرُ نَفْسَهُ فَقَالَ كَذَبْتَ وَاللهِ يَا عَدُوَّ اللهِ إِنَّ الَّذِيْنَ عَدَدْتَ لَاحْيَاءٌ كُلُّهُمْ وَقَدْ بَقِيَ لَكَ مَا يَسُوءُكَ قَالَ يَوْمٌ بِيَوْمِ بَدْرٍ وَالْحَرْبُ سِجَالٌ إِنَّكُمْ سَتَجِدُوْنَ فِي الْقَوْمِ مُثْلَةً لَمْ آمُرْ بِهَا وَلَمْ تَسُؤْنِيْ ثُمَّ أَخَذَ يَرْتَجِزُ أُعْـلُ هُـبَـلْ أُعْـلُ هُـبَـلْ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَلَا تُجِيْبُوْا لَهُ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ مَا نَقُوْلُ قَالَ قُوْلُوْا اللهُ أَعْلَى وَأَجَلُّ قَالَ إِنَّ لَنَا الْعُزَّى وَلَا عُزَّى لَكُمْ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَلَا تُجِيْبُوْا لَهُ قَالَ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ مَا نَقُوْلُ قَالَ قُوْلُوْا اللهُ مَوْلَانَا وَلَا مَوْلَى لَكُمْ আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদের দিন ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু যুবাইর রা. কে পঞ্চাশ জন পদাতিক যোদ্ধার উপর আমীর নিয়োগ করেন এবং বলেন, তোমরা যদি দেখো যে, আমাদেরকে পাখিরা ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে, তথাপি তোমরা আমার পক্ষ হতে সংবাদ পাওয়া ছাড়া স্বস্থান ত্যাগ করবে না। আর যদি তোমরা দেখো যে, আমরা শত্রু দলকে পরাস্ত করেছি এবং আমরা তাদেরকে পদদলিত করেছি, তখনও আমার পক্ষ হতে সংবাদ প্রেরণ করা ব্যতীত স্ব-স্থান ত্যাগ করবে না। অতঃপর মুসলিমগণ কাফিরদেরকে যুদ্ধে পরাস্ত করে দিল। বারাআ রা. বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি মুশরিকদের নারীদেরকে দেখতে পেলাম তারা নিজ বস্ত্র উপরে উঠিয়ে পলায়ন করছে। যাতে পায়ের অলঙ্কার ও পায়ের নলা উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে। তখন ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু যুবাইর রা. এর সহযোগীরা বলতে লাগলেন, ‘লোক সকল, এখন তোমরা গনীমতের মাল সংগ্রহ করো। তোমাদের সাথীরা বিজয় লাভ করেছে। আর অপেক্ষা কেন?’ তখন ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু যুবাইর রা. বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদেরকে যা বলেছিলেন, তা তোমরা ভুলে গিয়েছো?’ তাঁরা বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমরা লোকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে গানীমাতের মাল সংগ্রহে যোগ দেবো।’ অতঃপর যখন তাঁরা স্বস্থান ত্যাগ করে নিজেদের লোকজনের নিকট পৌঁছলো, তখন তাঁদের মুখ ফিরিয়ে দেওয়া হয়, আর তাঁরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে থাকেন। এটা সে সময় যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পেছন থেকে ডাকছিলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে বারোজন লোক ব্যতীত অপর কেউই বাকী ছিল না। কাফিররা এ সুযোগে মুসলিমদের সত্তর ব্যক্তিকে শহীদ করে ফেলে। এর পূর্বে বদোর যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও তাঁর সাথীগণ মুশরিকদের সত্তরজনকে বন্দী ও সত্তরজনকে নিহত করেন। এ সময় আবূ সুফিয়ান তিনবার আওয়াজ দিলো, ‘লোকদের মধ্যে কি মুহাম্মাদ জীবিত আছে?’ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উত্তর দিতে নিষেধ করেন। পুনরায় তিনবার আওয়াজ দিলো, ‘লোকদের মধ্যে কি আবু কুহাফার পুত্র জীবিত আছে?’ পুনরায় তিনবার আওয়াজ দিলো, ‘লোকদের মধ্যে কি খাত্তাবের পুত্র জীবিত আছে?’ অতঃপর সে নিজ লোকদের নিকট গিয়ে বললো, ‘এরা সবাই নিহত হয়েছে।’ এ সময় ‘উমার রা. ধৈর্যধারণ করতে পারলেন না। তিনি বলে উঠলেন, ‘ওরে আল্লাহর শত্রু, আল্লাহর শপথ, তুই মিথ্যা বলছিস। যাঁদের তুই নাম উচ্চারণ করছিস, তাঁরা সবাই জীবিত আছেন। তোদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে।’ আবু সুফিয়ান বললো, ‘আজ বদরের দিনের প্রতিশোধ। যুদ্ধ তো বালতির মতো। তোমরা তোমাদের লোকদের মধ্যে নাক-কান কাটা দেখবে, আমি এর আদেশ দেইনি কিন্তু তা আমি পছন্দও করিনি।’ অতঃপর বলতে লাগলো, ‘হে হুবাল, তোমার মাথা উঁচু হোক। হে হুবাল, তোমার মাথা উঁচু হোক।’ তখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমরা এর উত্তর দেবে না?’ তাঁরা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমরা কী বলবো?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা বলো, আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে মর্যাদাবান, তিনিই মহা মহিমান্বিত।’ আবু সুফিয়ান বললো, আমাদের জন্য উয্যা রয়েছে, তোমাদের উয্যা নেই।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমরা কি তার উত্তর দেবে না?’ বারাআ রা. বলেন, ‘সাহাবীগণ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমরা কী বলবো?’ আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমরা বলো, আল্লাহ আমাদের সহায়তাকারী বন্ধু, তোমাদের কোনও সহায়তাকারী বন্ধু নেই। –সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৩০৩৯ উপরোক্ত হাদিস থেকে বুঝতে পারলাম, মূলত উহুদ যুদ্ধের সময় কতিপয় সাহাবাগণের নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ বুঝতে ভুল হয়েছিলো। ফলে কিছুটা সময়ের জন্য মুসলমানদের অবস্থা কঠিন হয়ে যায়। অবশ্য পরবর্তীতের সাহাবায়ে কেরাম রা. সঠিকটা বুঝতে পেরে আবার ঘুরে দাঁড়ালে মুসলমানদের বিজয় হয় এবং এর উপর আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করে দিয়ে সেসব সাহাবাগণকে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّ الَّذِينَ تَوَلَّوْا مِنكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ إِنَّمَا اسْتَزَلَّهُمُ الشَّيْطَانُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُوا ۖ وَلَقَدْ عَفَا اللَّهُ عَنْهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ উভয় বাহিনীর পারস্পরিক সংঘর্ষের দিন তোমাদের মধ্য হতে যারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিলো, প্রকৃতপক্ষে শয়তান তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের কারণে পদস্খলনে লিপ্ত করেছিলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম সহিষ্ণু। –সুরা আলে ইমরান : ১৫৫ সুতরাং বোঝা গেলো, সাহাবাদের পারস্পারিক ভুল বুঝাবুঝির কারণে যে বিষয়ের অবতারণা হয়েছিলো, সেসব তাদেরকে আল্লাহ পাক ক্ষমা করে দিয়েছেন। সেই প্রসঙ্গ টেনে উক্ত সাহাবাগণকে দোষারোপ করা কুরআনের বিরোধীতা ছাড়া কিছু নয়। এমন সুষ্পষ্ট ক্ষমার আয়াত নাযিলের পরও উক্ত সাহাবাগণকে নিয়ে বিরোপ মন্তব্যকারীরা বক্র হৃদয়ের অধিকারী ছাড়া আর কী হতে পারে?
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
কুরআনের চেয়ে মুমিন দামী! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–১৬
পবিত্র কুরআন সরাসরি আল্লাহপাকের কালাম। পৃথিবীর সব কিছু মাখলুক হলেও আল্লাহ-র কালাম মাখলুক নয়। সুতরাং ...
মুফতী রিজওয়ান রফিকী
৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
১২৫৬
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন