প্রবন্ধ
ব্যক্তিগত জীবনে তাওহীদ মানা শিরক! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–৫৯
প্রিয় পাঠক, ইসলামের মূল স্তম্ভ হলো, 'তাওহীদ' তথা আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাস করা। এই বিশ্বাস দায়েমি তথা সর্বক্ষণের জন্য ফরজ। এক মূহুর্তের জন্য তাওহীদ থেকে বিচ্যূৎ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মুমিন হতে গেলে সর্বপ্রথম নিজের ব্যক্তিগত জিবনে ওয়াহদানিয়াত বা তাওহীদের বিশ্বাস করতে হবে।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবী হলো, ব্যক্তিগত জিবনে তাওহীদ মানা শিরক। দেখুন তারা লিখেছে–
রসূলাল্লাহ আগমনের আসল উদ্দেশ্য সারা পৃথিবীতে সর্বাত্বক সংগ্রামের মাধ্যমে আল্লাহর তাওহীদভিত্তিক সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করা। –শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ৫৩
স্বার্থপরতা আত্মকেন্দ্রিক ভালো মানুষের কোন জান্নাত নাই। –তাকওয়া ও হেদায়া পৃ. ১০
ব্যক্তি ভালোমানুষি দিয়ে কেউ জান্নাতে যাবে না, কারণ জান্নাত সামষ্টিক। ইসলাম মানে শান্তি, তাই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করলে জান্নাতে ঠাঁই পাওয়া যাবে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা একটি সামষ্টিক কাজ সুতরাং জান্নাতও একটি সামষ্টিক কাজের ফল। এর অর্থ কি আপনি ভালো মানুষ হবেন না? সত্যবাদী হবেন না? হ্যাঁ, ভালো হবেন সমাজকে ভালো করার জন্য। অন্য মানুষকে ভালো করার জন্য আপনাকে ভালো হতেই হবে। ব্যক্তি তাকওয়ার কোন মূল্য নেই। সামষ্টিক তাকওয়াই হলো জান্নাতে যাবার পূর্বশর্ত। –তাকওয়া ও হেদায়া, পৃ. ১১
আরবের মোশরেক অধিবাসীরা আল্লাহকে খুবই বিশ্বাস করত, আজ যেমন আমরা করি, কিন্তু আল্লাহর দেয়া দীন জীবন-বিধান মোতাবেক তাদের সমষ্ঠিগত জাতীয় জীবন পরিচালনা করত না। তাদের সামাজিক, জাতীয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, দন্ডবিধি এ সমস্তই পরিচালিত হতো হাবল, লা'ত মানাত ওজ্জা কোরায়েশ পুরোহিতদের তৈরি করা আইন-কানুন ও নিয়ম দিয়ে। তারা বুঝত না যে আল্লাহকে যতই বিশ্বাস করা হোক, ব্যক্তিগতভাবে যতই কঠিন এবাদত করা হোক, যতই তাক্ওয়া করা হোক, জাতীয় জীবন আল্লাহর দেওয়া দীন আইন-কানুন, দন্ডবিধি অর্থনীতি দিয়ে পরিচালিত না হলে সেটা আল্লাহর তওহীদ হবে না, সেটা হবে শেরক ও কুফর। –এসলামের প্রকৃত রুপরেখা, পৃ. ৫৭
আজকের ব্যক্তিগত জীবনের ওয়াহদানিয়াত নয়, পূর্ণ জীবনের ওয়াহদানিয়াত, ব্যক্তিগত ও জাতীয় উভয় জীবনের ওয়াহদানিয়াত। শুধু ব্যক্তিগত জীবনের ওয়াহদানিয়াত হোচ্ছে শেরেক। আজ পৃথিবীর অতি মুসলিমরা নামাজে,রোজায়, হজ্বে, তাহাজ্জুদে, তারাবিতে, দাড়িতে, টুপি-পাগড়িতে, পায়জামায়, কোর্তায় নিখুঁত। শুধু একটি মাত্র ব্যাপারে তারা নেই, সেটা হলো, তাওহীদ, ওয়াহদানিয়াত। যে আংশিক অর্থাৎ ব্যক্তিগত ওয়াহদানিয়াত ঐ অতি মুসলিমদের মধ্যে আছে, তা আল্লাহ আজও যেমন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান কোরে রেখেছেন, হাশরের দিনও তেমনই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান কোরবেন। –এ ইসলাম ইসলামই নয়, পৃ. ১৮৬-১৮৭
অর্থাৎ তাদের দাবী হলো, ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর একাত্ববাদ তথা তাওহীদে বিশ্বাস করা শিরক।
ইসলাম কী বলে?
সামষ্টিকজিবনে ওয়াহদানিয়্যাত প্রতিষ্ঠা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটে। কিন্তু একজন মানুষ ঈমান আনতে গেলে সর্বপ্রথম নিজের মধ্যে তাওহীদের বিশ্বাস আনতে হবে। সেটাও যদি শিরক হয়, তাহলে মানুষের জন্য মুসলমান হওয়ার তো কোনো সুযোগই থাকে না। কী হাস্যকর কথা! কোনো সুস্থ মানুষ কী এসব বলতে পারে?
ব্যক্তিগতজীবনে যারা ওয়াহদানিয়্যাত বা তাওহীদে বিশ্বাস আনে, তাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,
بَلَى مَنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَلَهُ أَجْرُهُ عِندَ رَبِّهِ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ
কেন নয়? (নিয়ম তো এই যে,) যে ব্যক্তিই নিজ চেহারা আল্লাহর সামনে নত করবে এবং সে সৎকর্মশীলও হবে, সে নিজ প্রতিপালকের কাছে তার প্রতিদান পাবে। আর এরূপ লোকদের কোনও ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না।–সূরা বাকারা : ১১২
এ আয়াতে ব্যক্তিজিবনে তাওহীদের বিশ্বাস ও নেক আমলের কথা বলা হয়েছে এবং এমন লোকদের জন্য জান্নাতেরও সু-সংবাদ দেয়া হয়েছে। যদি ব্যক্তিজিবনে তাওহীদের বিশ্বাস শিরক হয়, তাহলে এ আয়াতের অর্থ কী? তাছাড়া অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন,
أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা করো। –সুরা তাহরীম : ৬
এ আয়াতে সর্বপ্রথম নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচার হুকুম করা হয়েছে।
উপরন্তু হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মুয়াজ রা.-কে বলেন,
مَا مِنْ أَحَدٍ يَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ صِدْقًا مِنْ قَلْبِهِ إِلاَّ حَرَّمَهُ اللَّهُ عَلَى النَّارِ
যে কোন বান্দা আন্তরিকতার সাথে এ সাক্ষ্য দেবে যে, ’আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’ তার জন্য আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম হারাম করে দেবেন। –সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ১২৮
এ হাদিসেও ব্যক্তিগত জিবনে তাওহীদের বিশ্বাসের কথা বলে জাহান্নাম হারাম হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
يُوشِكُ أَنْ يَكُونَ خَيْرَ مَالِ الْمُسْلِمِ غَنَمٌ يَتْبَعُ بِهَا شَعَفَ الْجِبَالِ وَمَوَاقِعَ الْقَطْرِ، يَفِرُّ بِدِينِهِ مِنَ الْفِتَنِ
সেদিন দূরে নয়, যেদিন মুসলিমের উত্তম সম্পদ হবে কয়েকটি বকরী, যা নিয়ে সে পাহাড়ের চুড়ায় অথবা বৃষ্টিপাতের স্থানে চলে যাবে। ফিতনা থেকে বাঁচতে সে তার দ্বীন নিয়ে পালিয়ে যাবে। –সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ১৯
হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
سَتَكُونُ فِتَنٌ الْقَاعِدُ فِيهَا خَيْرٌ مِنْ الْقَائِمِ وَالْقَائِمُ خَيْرٌ مِنْ الْمَاشِي وَالْمَاشِي فِيهَا خَيْرٌ مِنْ السَّاعِي مَنْ تَشَرَّفَ لَهَا تَسْتَشْرِفْهُ فَمَنْ وَجَدَ مَلْجَأً أَوْ مَعَاذًا فَلْيَعُذْ بِهِ
শীঘ্রই ফিতনা দেখা দেবে। তখন উপবিষ্ট ব্যক্তি দাঁড়ানো ব্যক্তির চেয়ে ভাল (ফিতনামুক্ত) থাকবে, দাঁড়ানো ব্যক্তি চলমান ব্যক্তির চেয়ে ভাল থাকবে, চলমান ব্যক্তি ধাবমান ব্যক্তির চেয়ে ভাল থাকবে। যে ব্যক্তি সে ফিতনার দিকে তাঁকাবে, ফিতনা তাকে ঘিরে ধরবে। কাজেই, তখন কেউ যদি কোথাও কোনো নিরাপদ আশ্রয়স্থল কিংবা আত্মরক্ষার ঠিকানা পায়, তাহলে সে যেন সেখানে আশ্রয় নেয়। –সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৭০৮২
এ দু'টি হাদিস দ্বারা এটা সুসপষ্টভাবে প্রমাণ হলো যে, সামষ্টিকজিবনে যখন অনৈসলামিক কার্যক্রম ব্যাপক হবে, তখন ঈমানদাররা তাঁদের ঈমান নিয়ে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে দিয়েছেন। তাহলে ফিতনার আমলে এই পালায়নকারী লোকটার তাওহীদের বিশ্বাসও কি শিরক হবে? কতবড় বিভ্রান্তি!
এখানেই শেষ নয়, সাহাবাদের ব্যাপারে খোদ হেযবুত তওহীদই লিখেছে-
মক্কার তেরোটি বছর বিশ্বনবী মানুষকে শুধুমাত্র তাওহীদের দিকেই ডেকে গেছেন এবং কেমন সেই আহ্বান? শত নির্যাতন নিপীড়ন বিদ্রূপ অপমান উপেক্ষা করে, খেয়ে না খেয়ে, গাছের লতা-পাতা খেয়ে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। এই সময় যেসব সাহাবী ইন্তেকাল করেন তারা ইসলাম বলতে কি পেয়েছিলেন? তার নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত ঈদ কোরবানি কিছুই পেয়েছিলেন কি? তারা পেয়েছেন শুধুমাত্র তাওহীদ এবং বলার অপেক্ষা রাখেনা তাওহীদই তাদের সফলকাম হয়ে জান্নাতে প্রবেশের জন্য যথেষ্ট ছিল। –তওহীদ জান্নাতের চাবি, পৃ. ১০
সুতরাং বুঝা গেলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রা. প্রথমত ব্যক্তি জিবনেই তাওহীদের বিশ্বাসী ছিলেন। তাহলে হেযবুত তওহীদের ফাতাওয়ায় আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরামও কী মক্কী জিবনে মুশরিক ছিলেন? নাউযুবিল্লাহ। কতবড় জাহালাত!
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
ঝাড়ফুঁক-তাবীয : একটি দালীলিক বিশ্লেষণ (৩য় পর্ব)
...
উলামায়ে সালাফের উক্তির আলোকে শবে বরাত
মাসিক আলকাউসার-এর শাবান ১৪২৬ হি. (সেপ্টেম্বর ২০০৫ ঈ.) সংখ্যায় ‘বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শাবান ও শবে...
রজব ও শা’বান : প্রেক্ষিত মধ্যপন্থা বনাম প্রান্তিকতা
মহিমান্বিত রমাযান মাসের পূর্বে আমাদের সামনে রয়েছে দুটি মাস; রজব ও শা’বান। বক্ষমান নিবন্ধে আমরা রজব এ...
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন