আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

২- ইলমের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ১২৮
৯১। বুঝতে না পারার আশঙ্কায় ইলম শিক্ষায় কোন এক গোত্র ছেড়ে আর এক গোত্র বেছে নেয়া।
১২৮। ইসহাক ইবনে ইবরাহীম (রাহঃ) ......... আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, একবার মুআয (রাযিঃ), নবী (ﷺ) এর পিছনে সওয়ারীতে উপবিষ্ট ছিলেন, তখন তিনি তাঁকে ডাকলেন, হে মুআয ইবনে জাবাল! মুআয (রাযিঃ) উত্তর দিলেন, আমি হাযির ইয়া রাসূলাল্লাহ! এবং (আপনার আদেশ পালনের জন্য) প্রস্তুত। তিনি ডাকলেন, মুআয! মুআয (রাযিঃ) উত্তর দিলেন, আমি হাযির ইয়া রাসূলাল্লাহ এবং প্রস্তুত। তিনি আবার ডাকলেন, মুআয। তিনি উত্তর দিলেন, আমি হাযির ইয়া রাসূলাল্লাহ এবং প্রস্তুত। এরূপ তিনবার করলেন।
এরপর বললেনঃ যে কোন বান্দা আন্তরিকতার সাথে এ সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল’ তার জন্য আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম হারাম করে দেবেন। মুআয (রাযিঃ) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি কি মানুষকে এ খবর দেব না, যাতে তারা সুসংবাদ পেতে পারে?’ তিনি বললেন, ‘তাহলে তারা এর উপর ভরসা করে বসে থাকবে।’ মুআয (রাযিঃ) (জীবনভর এ হাদীসটি বর্ণনা করেন নি) মৃত্যুর সময় এ হাদীসটি বর্ণনা করে গেছেন যাতে (ইলম গোপন রাখার) গুনাহ না হয়।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

বিখ্যাত সাহাবী হযরত মু'আয ইবনে জাবাল রাযি. একই বাহনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহযাত্রী ছিলেন। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে তিন তিনবার ডাক দেন এবং তিনিও প্রতিবার তাঁর ডাকে সাড়া দেন। তিনবার ডাকার উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলা হবে, সেদিকে তাঁর গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করা এবং সে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য তাঁকে সতর্ক ও সচেতন করে তোলা।

তারপর তিনি কালেমায়ে শাহাদাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা তুলে ধরলেন। বললেন, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল— এ সাক্ষ্য যে ব্যক্তি আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে প্রদান করবে, আল্লাহ তা'আলা তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন। অর্থাৎ কবীরা গুনাহ না থাকলে তো সে আদৌ জাহান্নামে যাবে না; প্রথমেই জান্নাতে চলে যাবে। আর যদি কবীরা গুনাহ থাকে এবং আল্লাহ তা'আলা মাফ না করেন, তবে শুরুতে সেই গুনাহ পরিমাণ শাস্তি ভোগ করতে হবে। তারপর ঈমানের বদৌলতে অবশ্যই মুক্তি পাবে এবং জান্নাতের বাসিন্দা হয়ে যাবে।

কালেমায়ে শাহাদাতের এ গুরুত্ব দ্বারা আমলের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয়নি। তাই আমলে অবহেলা করার সুযোগ নেই। এ কারণেই হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি, যখন খুশি হয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি মানুষকে এ সুসংবাদটি কি জানাব না? তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে এই বলে বারণ করলেন যে, না, তাহলে অনেকেই এর উপর ভরসা করে বসে থাকবে। অর্থাৎ তারা মনে করবে যে, কালেমায়ে শাহাদাত পড়লেই যখন জাহান্নাম হারাম হয়ে যায়, তখন আর আমলের প্রয়োজন কী? ব্যস এই ভেবে একদিকে তারা নেক আমল ছেড়ে দেবে, অন্যদিকে পাপকর্ম করতে উৎসাহ পাবে। অথচ পাপকর্ম ত্যাগ করা ও নেক আমলে যত্নবান থাকা অতীব জরুরি। কেননা পাপকর্ম যদি কবীরা গুনাহের পর্যায়ে হয় এবং তাতে লিপ্ত হওয়ার পর তাওবা ছাড়াই মৃত্যু হয়, তবে ঈমান থাকা সত্ত্বেও একটা কাল পর্যন্ত জাহান্নামে থাকার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা না করলে অবশ্যই তাকে শাস্তিভোগ করতে হবে। আর যদি কোনও গুনাহ নাও থাকে, তবুও বেশি বেশি নেক আমল আখিরাতে অনেক কাজে আসবে।

ঈমানের বদৌলতে জান্নাতলাভের পর যার যতো বেশি নেক আমল হবে, তার স্তর ততো বেশি উন্নত হবে। সুতরাং জান্নাতের উচ্চস্তর লাভের জন্য বেশি বেশি নেক আমল অবশ্যই করা চাই। কুরআন ও হাদীছ জান্নাতের উচ্চস্তর লাভের জন্য বিপুল উৎসাহ প্রদান করেছে। জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তর হল জান্নাতুল ফিরদাওস। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আমাদেরকে জান্নাতুল ফিরদাওসই প্রার্থনা করতে উৎসাহ দিয়েছেন।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করার কারণে হযরত মু'আয রাযি. এ হাদীছটি সারা জীবন বর্ণনা করেননি। তবে মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় তিনি এটি বর্ণনা করে যান। এ হাদীছে তার কারণ বলা হয়েছে গুনাহের আশঙ্কা। কেননা দীনের কোনও বিষয় গোপন করা কঠিন গুনাহ । আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন–
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُولَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ 'নিশ্চয়ই যারা আমার নাযিলকৃত উজ্জ্বল নিদর্শনাবলি ও হিদায়াতকে গোপন করে, যদিও আমি কিতাবে তা মানুষের জন্য সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছি, তাদের প্রতি আল্লাহ লানত বর্ষণ করেন এবং অন্যান্য লানতকারীগণও লানত বর্ষণ করে।

এ গুনাহ থেকে বাঁচার জন্যই তিনি মৃত্যুর আগে আগে হাদীছটি বর্ণনা করে যান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে যে এটি প্রচার করতে নিষেধ করেছিলেন তা দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল আমসাধারণের কাছে প্রচার করা, খাস লোকদের কাছে প্রচার করা নয়। কেননা খাস লোকদের কাছে প্রচার করলে তারা এর সত্যিকার মর্ম বুঝতে পারবে, ফলে তাদের দ্বারা আমলে শিথিলতা দেখা দেবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তো হাদীছটি তাঁকে (অর্থাৎ হযরত মু'আয রাযি.-কে) বলেছিলেন। তাই তিনিও এটি আমভাবে প্রচার না করে মৃত্যুর আগে আগে উপস্থিত লোকদের কাছে তা প্রকাশ করে যান।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রকাশ করার আগে উপস্থিত লোকদের মনোযোগ আকর্ষণ করা ও বক্তব্য বিষয়ের প্রতি তাদেরকে চৌকান্না করে তোলা চাই ।

খ. গুরুজনের ডাকে আদবের সঙ্গে সাড়া দেওয়া উচিত, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ডাকে হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি. লাব্বায়কা ওয়া সা'দায়কা বলে সাড়া দিয়েছিলেন।

গ. কালেমায়ে শাহাদাত পাঠের সঙ্গে মৃত্যুবরণ দ্বারা অবশ্যই জাহান্নাম হারাম হয়ে যায়। তবে এই ভরসায় আমলে কিছুতেই গাফলাতি করা উচিত নয়।

ঘ. যে কথার প্রচার দ্বারা মানুষের মধ্যে আমলের প্রতি শৈথিল্য দেখা দিতে পারে, সাধারণভাবে তা কিছুতেই প্রচার করা উচিত নয়।

ঙ. দীনের জানা বিষয় গোপন করা কঠিন গুনাহ।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন