রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين

ভূমিকা অধ্যায় - এর পরিচ্ছেদসমূহ

মোট হাদীস ৬৭৯ টি

হাদীস নং: ৬৪১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৪ সহনশীলতা, ধীরস্থিরতা ও কোমলতা
জাহান্নাম থেকে নাজাতপ্রাপ্তদের স্বভাব-চরিত্র
হাদীছ নং: ৬৪১

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি কি তোমাদের জানাব না কোন ব্যক্তিকে জাহান্নামের জন্য হারাম করা হয় অথবা কার জন্য জাহান্নামকে হারাম করা হয়? জাহান্নামকে হারাম করা হয় প্রত্যেক ওই ব্যক্তির জন্য, যে (মানুষের) নিকটবর্তী, শান্ত, কোমল ও সহজস্বভাবের। -তিরমিযী
(জামে' তিরমিযী: ২৪৯০; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৭০; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ১৮৫৩ তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১০৫৬২; শু'আবুল ঈমান: ৭৭৭৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫০৫)
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি হাসান হাদীছ।
مقدمة الامام النووي
74 - باب الحلم والأناة والرفق
641 - وعن ابن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «ألاَ أخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَحْرُمُ عَلَى النَّار؟ أَوْ بِمَنْ تَحْرُمُ عَلَيْهِ النَّار؟ تَحْرُمُ عَلَى كُلِّ قَرِيبٍ، هَيّنٍ، لَيِّنٍ، سَهْلٍ». رواه الترمذي، (1) وقال: «حديث حسن».
হাদীস নং: ৬৪২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ ক্ষমা প্রদর্শন করা ও অজ্ঞজনদের আচরণ উপেক্ষা করা

العفو এর আভিধানিক অর্থ মুছে ফেলা, মিটিয়ে দেওয়া। পারিভাষিক অর্থ অপরাধ উপেক্ষা করা, অপরাধের শাস্তি না দেওয়া।
الإعراض এর আভিধানিক অর্থ পাশ কাটানো, উপেক্ষা করা। পরিভাষায় অন্যের দুর্ব্যবহারকে উপেক্ষা করা ও তা গায়ে না মাখানোকে الإِعْرَاضُ বলা হয়।
দু'টি শব্দ দ্বারাই মূলত একই বিষয় বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ কেউ যদি কষ্ট দেয় বা দুর্ব্যবহার করে, তবে সেজন্য ক্ষুব্ধ না হয়ে এবং কোনওরূপ প্রতিশোধ না নিয়ে তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা ও ক্ষমা করে দেওয়া। এটি একটি মহৎ গুণ।
হাসান বসরী রহ. বলেন, ক্ষমাশীলতা মুমিনের শ্রেষ্ঠতম গুণ।
হযরত উমর ইবন আব্দুল আযীয রহ. বলেন, আল্লাহ তা'আলার কাছে তিনটি জিনিস সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয়। শক্তি-সামর্থ্য থাকা অবস্থায় ক্ষমা করা, চেষ্টা-মেহনতে মধ্যপন্থা ও ইবাদতে কোমলতা।
ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ. বলেন, কেউ যদি তোমার কাছে কারও বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে আসে, তবে তুমি তাকে বলবে, হে ভাই! তুমি তাকে ক্ষমা করো। কেননা ক্ষমাশীলতা তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী।
ক্ষমাশীলতার কথা উঠলেই হযরত ইয়ূসুফ আলাইহিস সালামের কথা চলে আসে। তাঁর ভাইয়েরা তাঁর সঙ্গে কেমন আচরণ করেছিল? তারা তাঁকে কুয়ায় ফেলেই ক্ষান্ত হয়নি; তাকে গোলাম হিসেবে বিক্রিও করে দিয়েছিল, যদ্দরুন তাঁকে নারীদের চক্রান্তের শিকার হতে হয়েছিল। ভোগ করতে হয়েছিল দীর্ঘ কারাবাস। এতদসত্ত্বেও তিনি ভাইদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগস্বরূপ একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। সর্বোচ্চ উদারতার সঙ্গে বলে দিয়েছিলেন-
لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللَّهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা হবে না। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সকল দয়ালু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দয়ালু। (সূরা ইয়ূসুফ (১২), আয়াত ৯২)
ইসলাম এ গুণ অবলম্বনের প্রতি বিপুল উৎসাহ দান করেছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত ক্ষমাশীল ছিলেন। হাদীছ ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে তাঁর ক্ষমাশীলতার বহু ঘটনা বর্ণিত আছে। সাহাবায়ে কেরামকেও তিনি এ গুণের উপর গড়ে তুলেছিলেন। তারা প্রত্যেকেই অসাধারণ ক্ষমাশীল ছিলেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি একদিন বাজারে খাদ্যশস্য ক্রয় করেন। তারপর দাম পরিশোধ করতে গিয়ে দেখেন নিজ পাগড়ির যেখানে দিরহাম রেখেছিলেন সেখানে তা নেই। তিনি বললেন, আমি যখন এখানে বসেছি, তখনও তো দিরহামগুলো আমার সঙ্গে ছিল। লোকেরা অনেক খোঁজাখুঁজি করল। কিন্তু পাওয়া গেল না। শেষে তারা বলতে লাগল, হে আল্লাহ! যেই চোর দিরহামগুলো নিয়েছে তার হাত কেটে দাও। হে আল্লাহ! তাকে এই করো, ওই করো ইত্যাদি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. বললেন, হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি সেগুলো নিয়ে গেছে, সে যদি অভাবগ্রস্ত হয় তবে তাকে ওই দিরহামে বরকত দাও। আর যদি সে ধৃষ্টতার সঙ্গে অপরাধ করতেই তা নিয়ে থাকে, তবে এটাকেই তার সর্বশেষ অপরাধে পরিণত করো (অর্থাৎ তুমি তাকে হেফাজত করো, যাতে এরপর সে আর কোনও অপরাধ না করে)।
ক্ষমাশীলতার কল্যাণ বহুবিধ। এর দ্বারা পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়। পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতি গড়ে ওঠে। ক্ষমা করার দ্বারা মনের ভার লাঘব হয়। মানসিক শান্তি লাভের একটি বড় উপায় অন্যকে ক্ষমা করা। যে ব্যক্তি অন্যকে যত বেশি ক্ষমা করতে পারে, সে ততো বেশি স্বস্তিপূর্ণ জীবন কাটাতে পারে। বলা হয়ে থাকে, ক্ষমা করা ব্যক্তির নিজ সত্তার যাকাত। অন্যের উপর ক্রোধ মিটিয়ে যে সুখ পাওয়া যায়, ক্ষমাশীলতার সুখ তারচে' অনেক বেশি। কেননা ক্ষমাশীলতার সুখের সঙ্গে মানুষের প্রশংসা যুক্ত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে অন্যের উপর রাগ মেটানোর দ্বারা যে আরাম পাওয়া যায়, তার সঙ্গে যুক্ত হয় লোকনিন্দা ও মনের অনুতাপ।
সময়ে বরকতলাভ ও জীবনকে কর্মময় করে তোলার পক্ষে ক্ষমাশীলতা অনেক বেশি সহায়ক। কেননা মনের ঝাল মেটানো ও প্রতিশোধ গ্রহণের পেছনে পড়লে বিপুল সময় বৃথা নষ্ট হয়। ক্ষমা করার দ্বারা সে সময়টা বেঁচে যায় এবং তা অনেক ভালো ভালো কাজে লাগানো সম্ভব হয়। তাই বুদ্ধিমান ব্যক্তি প্রতিশোধ গ্রহণের ধান্দা ছেড়ে ক্ষমাশীলতাকেই বেছে নিয়ে থাকে।
ক্ষমা করার দ্বারা অতি সহজে মানুষের মন জয় করা যায়। মানুষের কাছে ক্ষমাশীল ব্যক্তি বিশেষ সমাদর লাভ করে। ব্যক্তির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এ গুণটি অনেক বেশি সহায়ক। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَمَا زَادَ اللَّهُ عَبْدًا بِعَفْو، إِلَّا عِزَّا
‘আল্লাহ তা'আলা ক্ষমাশীলতা দ্বারা বান্দার কেবল সম্মানই বৃদ্ধি করেন।(সহীহ মুসলিম: ২৫৮৮)
হযরত আবুদ দারদা রাযি.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, (প্রতিশোধ নেওয়ার) ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি ক্ষমা করে। সুতরাং তোমরা ক্ষমা করো, আল্লাহ তা'আলা তোমাদের মর্যাদাবান করবেন।
সবচে' বড় কথা, অন্যকে ক্ষমা করার দ্বারা আল্লাহ তা'আলার কাছে ক্ষমা লাভ করা যায় এবং এটা জান্নাত লাভেরও একটি বড় উপায়। সুতরাং কুরআন ও হাদীছ আমাদেরকে ক্ষমাশীলতা অর্জনের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে এবং এর অশেষ ফযীলতও তুলে ধরেছে। এ অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই।

‘ক্ষমা প্রদর্শন করা…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত

خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ

অর্থ: তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করো এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।(সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯)

ব্যাখ্যা
এটি ৭৪ নং অধ্যায়ের ২য় আয়াতরূপে উদ্ধৃত হয়েছে। সেখানে এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

দুই নং আয়াত
فَاصْفَحِ الصَّفْحَ الْجَمِيلَ
অর্থ: সুতরাং (হে নবী! তাদের আচার-আচরণকে) উপেক্ষা করো সৌন্দর্যমণ্ডিত উপেক্ষায়।(সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৮৫)

ব্যাখ্যা
الصفح এর অর্থ উপেক্ষা করা, অভিযোগ করা হতে বিরত থাকা। ইমাম রাগিব রহ. বলেন, এটা ক্ষমার চেয়েও উচ্চস্তরের। এ কারণেই ইরশাদ হয়েছে-
فَاعْفُوا وَاصْفَحُوا
‘সুতরাং তোমরা ক্ষমা করো ও উপেক্ষা করো।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ১০৯)
অর্থাৎ প্রথমে ক্ষমার আদেশ করা হয়েছে, তারপর আরও উচ্চস্তরের আখলাক দেখাতে বলা হয়েছে। আর তা হল অভিযোগ করা হতে বিরত থাকা। অনেক সময় মানুষ ক্ষমা করে ঠিকই, কিন্তু অভিযোগ তুলতে ছাড়ে না। এ আয়াত বলছে, ক্ষমা তো করবেই, সেইসঙ্গে অভিযোগ করা হতেও বিরত থাকবে। হযরত ইয়ূসুফ আলাইহিস সালাম এরূপ উচ্চস্তরের আখলাকই তাঁর ভাইদের সঙ্গে দেখিয়েছিলেন। তারা যখন নিজেদের দোষ স্বীকার করেছিল এবং অনুতপ্ত হয়ে বলেছিল-
تَاللَّهِ لَقَدْ آثَرَكَ اللَّهُ عَلَيْنَا وَإِنْ كُنَّا لَخَاطِئِينَ
‘আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাদের উপর তোমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং আমরা নিশ্চয়ই অপরাধী ছিলাম।(সূরা ইয়ূসুফ (১২), আয়াত ৯১)
তখন তিনি তাদের বলেছিলেন-
لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللَّهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা হবে না। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সকল দয়ালু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দয়ালু।(সূরা ইয়ূসুফ (১২), আয়াত ৯২)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মক্কাবিজয়ের দিন মক্কাবাসীদের প্রতি এরূপ মহানুভবতাই দেখিয়েছিলেন। তিনি তাদের বলেছিলেন-
أَقَوْلُ كَمَا قَالَ أَخِي يُوسُفُ: لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللَّهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
‘আমার ভাই ইয়ূসুফ যেমন বলেছিলেন, আমিও তেমনি তোমাদের বলছি- আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা হবে না। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সকল দয়ালু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দয়ালু।' (-সূরা ইয়ূসুফ: ৯২)
(বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১৮২৭৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৫৮৮; আল-আযরাকী, আখবারু মাক্কাহ, ২ খণ্ড, ১২১ পৃষ্ঠা; ইবনু শাব্বাহ, তারীখুল মাদীনাহ, ২ খণ্ড, ৭২৩ পৃষ্ঠা; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১১২৩৪; ইবনুস সুন্নী, আমালুল ইয়াওম ওয়াল লায়লাহ ৩১৮)

আলোচ্য আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে- فَاصْفَحِ الصَّفْحَ الْجَمِيْلَ 'সুতরাং (হে নবী! তাদের আচার-আচরণকে) উপেক্ষা করো সৌন্দর্যমণ্ডিত উপেক্ষায়'। অর্থাৎ তারা আপনার যে বিরুদ্ধাচরণ করে, নানাভাবে কষ্ট-ক্লেশ দেয়, আপনি তা উপেক্ষা করুন এবং উত্তমরূপে তা উপেক্ষা করুন। অর্থাৎ তাদেরকে ক্ষমা তো করবেনই, সেইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হতে বিরত থাকবেন। যেন তাদের সঙ্গে আপনার কিছু হয়ইনি- এরূপ ভাব দেখাবেন।

উল্লেখ্য, এ আদেশের সম্পর্ক ব্যক্তিগত বিষয়ের সঙ্গে। দীনের দাওয়াতদাতার ব্যক্তিগত কষ্ট-ক্লেশের দিকে তাকালে চলে না। মানুষ তাদের সঙ্গে অপ্রীতিকর যা-কিছুই আচরণ করে, তা উপেক্ষা করা একান্ত জরুরি। অন্যথায় মনের ভেতর ক্ষোভ ও বিদ্বেষ জমা হতে থাকবে। যাদেরকে দীনের দাওয়াত দেওয়া হবে, তাদের প্রতি অন্তরে ক্ষোভ জমা থাকলে দাওয়াতের কাজ আন্তরিকতার সঙ্গে দেওয়া হবে না। ফলে এরূপ দাওয়াতের ভালো সুফলও পাওয়া যাবে না। তাই যথাসম্ভব ব্যক্তিগত বিষয়ে সহনশীল। ও ক্ষমাপ্রবণ হওয়া জরুরি।
আয়াতের আদেশ যদিও সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁর মাধ্যমে উম্মতও এ আদেশের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কাজেই ব্যক্তিগত বিষয়ে তাদেরকেও এ আয়াতের হুকুম মেনে চলতে হবে।

আয়াতটির শিক্ষা
মানুষের দোষত্রুটি ক্ষমা করা ও তাদের অপ্রীতিকর আচরণ উপেক্ষা করা একটি মহৎ গুণ। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই এ গুণের চর্চা করতে হবে।

তিন নং আয়াত
وَلْيَعْفُوا وَلْيَصْفَحُوا أَلَا تُحِبُّونَ أَنْ يَغْفِرَ اللَّهُ لَكُمْ
অর্থ: তারা যেন ক্ষমা করে ও ঔদার্য প্রদর্শন করে। তোমরা কি কামনা কর না আল্লাহ তোমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করুন?(সূরা নূর (২৪), আয়াত ২২)

ব্যাখ্যা
এটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক আয়াত। ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ.-সহ অনেক মনীষীর মতে এ আয়াতটি কুরআন মাজীদের সর্বাপেক্ষা বেশি আশা সঞ্চারী। বলা হয়েছে, তোমরা কি চাও না আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন? অর্থাৎ নিশ্চয়ই তা চাও। যদি তা চাওই, তবে তোমরাও অন্যদের ক্ষমা করো এবং তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি উপেক্ষা করো। যদি তা কর, তবে আল্লাহ তা'আলাও তোমাদের ক্ষমা করবেন।
উল্লেখ্য, এ আয়াত নাযিল হয়েছে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে লক্ষ্য করে। তিনি বিশেষ এক কারণে তাঁর স্নেহভাজন আত্মীয় মিসতাহ রাযি.-এর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং শপথ করেছিলেন তাকে আর কখনও সাহায্য-সহযোগিতা করবেন না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াতটি নাযিল হয় এবং তাঁকে ক্ষমাশীল হতে উৎসাহ দেওয়া হয়। আয়াতটি নাযিল হতেই আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বলে ওঠেন, হে আল্লাহ! অবশ্যই আমি চাই আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। অতঃপর তিনি হযরত মিসতাহ রাযি.-কে ক্ষমা করে দেন এবং আগের মতো তাঁর সাহায্য-সহযোগিতা শুরু করে দেন।
এ আয়াতটি আমাদেরকে আল্লাহ তা'আলার কাছে মাগফিরাতলাভের একটি উত্তম পথ দেখিয়ে দিয়েছে। এমন অনেকই হয়ে থাকে যে, আমরা অন্যের দ্বারা কষ্ট-ক্লেশ পাই এবং তা অন্তরের মধ্যে পুষে রাখি। সহজে ক্ষমা করি না। এতে করে পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট তো হয়ই; বরং হিংসা-বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। তাতে দুনিয়ার শান্তি নষ্ট এবং আখিরাতেরও অশেষ ক্ষতি। সে ক্ষতি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় ক্ষমাশীলতার চর্চা করা। আমরা যদি অন্যকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত হই, তবে দুনিয়ার লাভ তো এই যে, এর মাধ্যমে হিংসা-বিদ্বেষ ঘুচে পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে। পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দ্বারা জীবন বড় শান্তিপূর্ণ হয়। আর আখিরাতের লাভ তো এই যে, আমরা যে যত বেশি অন্যকে ক্ষমা করতে পারব, আল্লাহ তা'আলার কাছেও ততো বেশি ক্ষমা পেয়ে যাব। আল্লাহ তা'আলা যদি পাপরাশি ক্ষমা করে দেন, তবে আখিরাতে জাহান্নাম থেকে নাজাত পাব এবং জান্নাতে স্থান লাভ করব। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে উদার ও ক্ষমাশীল হওয়ার তাওফীক দান করুন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. অন্যের প্রতি ক্ষমাপ্রদর্শন ও উদার আচরণ ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক শিক্ষা। প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য নিজ জীবনে এ শিক্ষা বাস্তবায়ন করা।
খ. অন্যকে ক্ষমা করা আল্লাহর কাছে ক্ষমা লাভ করার মোক্ষম উপায়। সুতরাং নিজ গুনাহের মাগফিরাত লাভের আশায় আমরা অবশ্যই অন্যকে বেশি বেশি ক্ষমা করব।

চার নং আয়াত
وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
অর্থ: এবং যারা মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন।(সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৩৪)

ব্যাখ্যা
এটি ৭৩ নং অধ্যায়ের ২য় আয়াতরূপে উদ্ধৃত হয়েছে। সেখানে এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

পাঁচ নং আয়াত
وَلَمَنْ صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
অর্থ: প্রকৃতপক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করে, তো এটা অবশ্যই অত্যন্ত হিম্মতের কাজ।(সূরা শূরা (৪২), আয়াত ৪৩)

ব্যাখ্যা
এটি ৭৪ নং অধ্যায়ের ৪র্থ আয়াতরূপে উদ্ধৃত হয়েছে। সেখানে এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
তায়েফে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিস্ময়কর ক্ষমাপ্রদর্শন
হাদীছ নং: ৬৪২

হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আপনার উপর কি উহুদের দিন অপেক্ষাও বেশি কঠিন কোনও দিন এসেছে? তিনি বললেন, আমি তোমার কওমের কাছ থেকে আকাবার দিন যে আচরণের সম্মুখীন হয়েছি, তা ছিল সারা জীবন আমি যেসব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা কঠিন। আমি সেদিন নিজেকে আব্দু ইয়ালীল ইবন আব্দু কুলালের পুত্রের সামনে পেশ করেছিলাম। কিন্তু আমি যা চেয়েছিলাম সে তাতে সাড়া দিল না। আমি দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে ফিরে চললাম। যখন কারনুছ-ছা'আলিব নামক স্থানে পৌঁছি, কেবল তখনই আমি চৈতন্যপ্রাপ্ত হই। আমি উপরদিকে মাথা তুলতেই দেখলাম একখণ্ড মেঘ আমার উপর ছায়া বিস্তার করে আছে। তাকিয়ে দেখলাম তার মধ্যে জিবরীল আলাইহিস সালাম রয়েছেন। তিনি আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, আল্লাহ তা'আলা আপনার সঙ্গে আপনার কওমের কথা এবং তারা আপনাকে যে জবাব দিয়েছে তা শুনেছেন। তিনি আপনার কাছে পাহাড়-পর্বতের ফিরিশতাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আপনি তাকে তাদের সম্পর্কে আপনার যা ইচ্ছা হয় আদেশ করতে পারেন। তখন পাহাড়ের ফিরিশতা আমারে ডেকে সালাম দিল। তারপর বলল, হে মুহাম্মাদ! আপনার সম্প্রদায় আপনাকে যে কথা বলেছে, আল্লাহ তা'আলা তা শুনেছেন। আমি পাহাড়-পর্বতের (দায়িত্বে নিয়োজিত) ফিরিশতা। আমার প্রতিপালক আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন, যাতে আপনি আপনার ইচ্ছামতো আমাকে হুকুম করেন। আপনি যদি চান, তাদের দু'দিক থেকে বড় পাহাড়দু'টি পরস্পর মিলিয়ে দেব (যাতে তারা মাঝখানে পড়ে পিষ্ট হয়ে যায়)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি বরং আশা করি আল্লাহ এদের ঔরস থেকে এমন লোকের আবির্ভাব ঘটাবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সঙ্গে কোনও কিছুকে শরীক করবে না। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৩২৩১; সহীহ মুসলিম: ১৭৯৫; মুসনাদুল বাযযার: ১০৩; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৭৬৫৯; সহীহ ইবনে হিব্বান ৬৫৬১; আল-আজুররী, আশ-শারী'আহ: ১০০২: বায়হাকী, আল-আসমা ওয়াস-সিফাত: ৩৮৪; শারহুস সুন্নাহ: ৩৭৪৮; আল-ফাকিহী, আখবারু মাক্কাহ: ২৫৭৮)
مقدمة الامام النووي
75 - باب العفو والإعراض عن الجاهلين
قَالَ الله تَعَالَى: {خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلينَ} [الأعراف: 199]، وقال تَعَالَى: {فَاصْفَحِ الصَّفْحَ الْجَمِيلَ} [الحجر: 85]، وقال تَعَالَى: {وَلْيَعْفُوا وَلْيَصْفَحُوا ألاَ [ص:209] تُحِبُّونَ أَنْ يَغْفِرَ اللهُ لَكُمْ} [النور: 22]، وقال تَعَالَى: {وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنينَ} [آل عمران: 134]، وقال تَعَالَى: {وَلَمَنْ صَبَرَ وَغَفَرَ إنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الأُمُورِ} [الشورى: 43] والآيات في الباب كثيرة معلومة.
642 - وعن عائشة رضي الله عنها: أنها قالت للنبي - صلى الله عليه وسلم: هَلْ أتَى عَلَيْكَ يَوْمٌ كَانَ أشَدَّ مِنْ يَوْمِ أُحُدٍ؟ قَالَ: «لَقَدْ لَقِيتُ مِنْ قَوْمِكِ، وَكَانَ أشَدُّ مَا لَقيتُ مِنْهُمْ يَوْمَ الْعَقَبَةِ، إذْ عَرَضْتُ نَفْسِي عَلَى ابْنِ عَبْدِ يَالِيْلَ بْنِ عَبْدِ كُلاَلٍ، فَلَمْ يُجِبْني إِلَى مَا أرَدْتُ، فَانْطَلَقْتُ وَأنا مَهْمُومٌ عَلَى وَجْهِي، فَلَمْ أسْتَفِقْ إِلاَّ وأنَا بِقَرْنِ الثَّعَالِبِ (1)، فَرَفَعْتُ رَأْسِي، وَإِذَا أنَا بِسَحَابَةٍ قَدْ أظَلَّتْنِي، فَنَظَرْتُ فَإذَا فِيهَا جِبريلُ - عليه السلام - فَنَادَاني، فَقَالَ: إنَّ الله تَعَالَى قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ، وَمَا رَدُّوا عَلَيْكَ، وَقَد بَعَثَ إلَيْكَ مَلَكَ الجِبَالِ لِتَأْمُرَهُ بمَا شِئْتَ فِيهِمْ. فَنَادَانِي مَلَكُ الجِبَالِ، فَسَلَّمَ عَلَيَّ، ثُمَّ قَالَ: يَا مُحَمَّدُ إنَّ اللهَ قَدْ سَمِع قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ، وَأنا مَلَكُ الجِبال، وَقَدْ بَعَثَنِي رَبِّي إلَيْكَ لِتَأْمُرَنِي بِأَمْرِكَ، فَمَا شِئْتَ، إنْ شئْتَ أطْبَقْتُ عَلَيْهِمُ الأَخْشَبَيْنِ». فَقَالَ النبي - صلى الله عليه وسلم: «بَلْ أرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللهُ مِنْ أصْلاَبِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ وَحْدَهُ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا». متفقٌ عَلَيْهِ. (2)
«الأخْشَبَان»: الجَبَلان المُحيطان بمكَّة. وَالأخشبُ: هُوَ الجبل الغليظ.
হাদীস নং: ৬৪৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৫ ক্ষমা প্রদর্শন করা ও অজ্ঞজনদের আচরণ উপেক্ষা করা
ব্যক্তিগত বিষয়ে ক্ষমাশীলতা ও শর‘ঈ বিষয়ে অনমনীয়তা
হাদীছ নং: ৬৪৩

উন্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পথে জিহাদ করা ছাড়া অন্য কখনও কাউকে নিজ হাতে মারেননি। না কোনও স্ত্রীলোককে এবং না কোনও খাদেমকে। এমন কখনও হয়নি যে, তাকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে আর তিনি কষ্টদাতা থেকে প্রতিশোধ নিয়েছেন। তবে আল্লাহ তা'আলার হারামকৃত কোনও বিষয়ে তাঁর বিধান লঙ্ঘন করা হলে তিনি আল্লাহর জন্য প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৩২৮; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৫৪২৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৩৩০২; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৪৩৭৫)
مقدمة الامام النووي
75 - باب العفو والإعراض عن الجاهلين
643 - وعنها، قالت: مَا ضَرَبَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - شَيْئًا قَطُّ بِيَدِهِ، وَلاَ امْرَأةً وَلاَ خَادِمًا، إِلاَّ أَنْ يُجَاهِدَ فِي سَبيلِ اللهِ، وَمَا نِيلَ مِنْهُ شَيْءٌ قَطُّ فَيَنْتَقِمَ مِنْ صَاحِبِهِ، إِلاَّ أن يُنْتَهَكَ شَيْءٌ مِنْ مَحَارِمِ اللهِ تَعَالَى، فَيَنْتَقِمُ للهِ تَعَالَى. رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ৬৪৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৫ ক্ষমা প্রদর্শন করা ও অজ্ঞজনদের আচরণ উপেক্ষা করা
রুক্ষভাষী ও কঠোর আচরণকারী সাহায্যপ্রার্থীর সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ
হাদীছ নং: ৬৪৪

হযরত আনাস রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে হাঁটছিলাম। তিনি মোটা পাড়বিশিষ্ট একটি নাজরানি চাদর পরিহিত ছিলেন। এ অবস্থায় এক বেদুঈন তাঁকে ধরল। সে তাঁর চাদরটি ধরে এমন জোরে টান দিল যে, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘাড়ের পাশে তাকিয়ে দেখলাম তার সজোর টানের কারণে সেখানে চাদরের পাড়ের দাগ বসে গেছে। তারপর সে বলল, হে মুহাম্মাদ! আপনার কাছে আল্লাহর যে মালামাল আছে, তা থেকে আমাকে কিছু দিতে হুকুম করুন। তিনি তার দিকে ফিরে তাকালেন এবং হেসে দিলেন। তারপর তাকে কিছু দেওয়ার আদেশ করলেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৩১৪৯; সহীহ মুসলিম: ১০৫৭; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৭৭৫; হাকিম, আল- মুস্তাদরাক: ৪৩২; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৮১১৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ : ৩৬৭০)
مقدمة الامام النووي
75 - باب العفو والإعراض عن الجاهلين
644 - وعن أنس - رضي الله عنه - قَالَ: كُنْتُ أمشي مَعَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - وَعَلَيْهِ بُرْدٌ نَجْرَانيٌّ غَلِيظُ الحَاشِيَةِ، فأدْرَكَهُ أعْرَابِيٌّ فَجَبذَهُ بِرِدَائِهِ جَبْذَةً شَديدةً، فَنَظَرْتُ إِلَى صَفْحَةِ عَاتِقِ النَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - وَقَدْ أثَّرَتْ بِهَا حَاشِيَةُ الرِّدَاءِ مِنْ شِدَّةِ جَبْذَتِهِ، ثُمَّ قَالَ: يَا مُحَمَّدُ، مُر لِي مِنْ مَالِ اللهِ الَّذِي عِنْدَكَ. فَالتَفَتَ إِلَيْهِ، فَضَحِكَ ثُمَّ أَمَرَ لَهُ بِعَطَاءٍ. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৬৪৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৫ ক্ষমা প্রদর্শন করা ও অজ্ঞজনদের আচরণ উপেক্ষা করা
আঘাতকারীকে ক্ষমা করা এবং তার জন্য মাগফিরাত ও হিদায়াতের দু'আ করা
হাদীছ নং: ৬৪৫

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. বলেন, আমি যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পাচ্ছি, তিনি আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের মধ্যকার কোনও একজন নবী সম্পর্কে বর্ণনা করছিলেন। তাঁকে তাঁর সম্প্রদায় মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছিল আর তিনি চেহারা থেকে রক্ত মুছছিলেন আর বলছিলেন, হে আল্লাহ! আমার সম্প্রদায়কে ক্ষমা করুন। এরা তো জানে না। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৩৪৭৭; সহীহ মুসলিম: ১৭৯২; মুসনাদে আহমাদ: ৪১০৫; সুনানে ইবন মাজাহ : ৪০২৫; মুসনাদুল বাযযার: ১৬৮৬; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৫২০৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৭৪৯)
مقدمة الامام النووي
75 - باب العفو والإعراض عن الجاهلين
645 - وعن ابن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: كأني أنظر إِلَى رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يَحْكِي نَبِيًّا مِنَ الأنبياءِ، صَلَوَاتُ اللهِ وَسَلامُه عَلَيْهِمْ، ضَرَبَهُ قَوْمُهُ فَأدْمَوْهُ، وَهُوَ يَمْسَحُ الدَّمَ عَنْ وَجْهِهِ، ويقول: «اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِقَوْمِي؛ فَإنَّهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৬৪৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৫ ক্ষমা প্রদর্শন করা ও অজ্ঞজনদের আচরণ উপেক্ষা করা
প্রকৃত বীর কে
হাদীছ নং: ৬৪৬

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (প্রকৃত) বীর সে নয় যে অন্যকে ধরাশায়ী করে। প্রকৃত বীর সেই, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী : ৬১১৪; সহীহ মুসলিম: ৬৬০৯; মুসনাদে আহমাদ: ৭২১৮; মুআত্তা মালিক : ১২: মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৩৮৫; মুসনাদুল বাযযার: ৮০৭৯; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১০১৫৬; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৬৪৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১১২৬)
مقدمة الامام النووي
75 - باب العفو والإعراض عن الجاهلين
646 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لَيْسَ الشَّديدُ بِالصُّرَعَةِ، إنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৬৪৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অন্যের দেওয়া কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করার ফযীলত

মানুষ সামাজিক জীব। তাকে পারিবারিক জীবন যাপন করতে হয়। তাকে দশের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হয়। কারও পক্ষেই একাকী জীবনযাপন সম্ভব নয়। অন্যদিকে স্বভাব-চরিত্র, চিন্তা-ভাবনা ও রুচি-প্রকৃতিতে মানুষ বড় বৈচিত্র্যময়। ফলে মিলেমিশে চলার ক্ষেত্রে অনেক সময়ই মানুষকে অন্যের পক্ষ থেকে বিপরীত চিন্তা, ভিন্ন মানসিকতা এমনকি কখনও অপ্রীতিকর আচরণেরও সম্মুখীন হতে হয়।
অনেক সময় মানুষ নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার হয়। নিজ আখলাক-চরিত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে এরূপ লোক অন্যকে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে ফেলে। তা ইচ্ছাকৃতভাবেও দেয়। তারা আপন লোককেও কষ্ট দেয়, পরকেও কষ্ট দেয়। ঘরে-বাইরে, রাস্তাঘাটে তাদের দ্বারা মানুষ বিভিন্ন রকমের কষ্ট-ক্লেশের শিকার হয়।
কখনও মানুষ কষ্ট পায় ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েও। কেউ কোনও কথা বলেছে এক রকম আর সে বুঝেছে অন্যরকম। তার কাছে সে কথা অপ্রীতিকর বোধ হয়েছে। ফলে সে মনে কষ্ট পেয়েছে। কোনও কোনও আচরণও অনেক সময় সঠিকভাবে বুঝতে না পারার দরুন মানুষ মনে কষ্ট পেয়ে বসে।
মোটকথা মানুষের মনোকষ্টের নানা রকমফের আছে। বহুমাত্রিক সে কষ্ট-ক্লেশ যারা সইতে পারে না, তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে যায়। কারণে-অকারণে তারা একের পর এক কষ্টই পেতে থাকে। আর তার প্রতিক্রিয়ায় তারা অন্যের কাছেও পরিণত হয় সাক্ষাৎ যন্ত্রণায়। সে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় জীবনের ভার লাঘব করা।
জীবনের ভার লাঘব হয় অন্যের দেওয়া কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করার দ্বারা। যে ব্যক্তি কথায় কথায় মন খারাপ করে না, কেউ কষ্ট দিলে তা হাসিমুখে অগ্রাহ্য করে, তার জীবন তার নিজের কাছেও সহজ, অন্যদের কাছেও সুখকর।
একটুতেই যে মন খারাপ করে, তার পক্ষে জীবনকে কর্মময় করে তোলা সম্ভব নয়। অথচ মানবজীবন বড় সম্ভাবনাময়। প্রত্যেকের পক্ষেই প্রচুর কাজ করা সম্ভব- কল্যাণময় কাজ। যে কাজ দ্বারা ব্যক্তির নিজের জীবন হয় সার্থক এবং অন্যদের জীবনে সাধিত হয় নানাবিধ কল্যাণ, তারই জন্য তো মানুষের জীবন। সেরূপ কল্যাণকর কাজে জীবন ভরে তোলার জন্য দরকার প্রকাশ্য ও গুপ্ত যাবতীয় সম্ভাবনা ও সক্ষমতার যথোচিত ব্যবহার। কথায় কথায় মন খারাপকারী ব্যক্তির পক্ষে সেরূপ ব্যবহার কীভাবে সম্ভব?
মানুষ পার্থিব জীবনসর্বস্ব কোনও জীব নয়। তার সামনে আছে অনন্ত আখিরাত। আখিরাতের জীবন সফল করার লক্ষ্যেই সীমিত কালের এ পার্থিব জীবন। তার মানে পার্থিব জীবনের একটা মুহূর্তও নষ্ট করার কোনও সুযোগ নেই। তা যাতে নষ্ট না হয়; বরং যথাযথ কাজে প্রতিটি মুহূর্তের যথোচিত ব্যবহার হয়, তারই জন্য প্রত্যেকের সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকা দরকার। সে প্রস্তুতির লক্ষ্যেই দরকার মনের ভার লাঘব করা তথা আপন-পর যার পক্ষ থেকেই কোনও আঘাত আসুক তা উপেক্ষা করে যাওয়া। এককথায় অন্যের দেওয়া কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবজীবন সার্থক করে তোলার রহস্য। কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করার দ্বারা মন ভারমুক্ত থাকে। ফলে নির্ভার মনে আনন্দের সঙ্গে যাবতীয় দরকারি কাজে লেগে থাকা সম্ভব হয়। তাতে করে ইহজীবনও হয় কর্মময় এবং আখিরাতের জীবনও হয় সাফল্যমণ্ডিত।
এর দ্বারা বোঝা গেল প্রত্যেকের জন্য অন্যের দেওয়া কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করা খুব বেশি জরুরি। তা জরুরি বলেই আমাদেরকে এতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْمُسْلِمُ إِذَا كَانَ يُخَالِطُ النَّاسَ وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ خَيْرٌ مِنَ الْمُسْلِمِ الَّذِي لَا يُخَالِطُ النَّاسَ وَلَا يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ
‘কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে আর সে তাদের দেওয়া কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করে, সে ওই মুসলিম অপেক্ষা উত্তম, যে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে না আর তাদের দেওয়া কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করে না।( জামে' তিরমিযী: ২৫০৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪০৩২; মুসনাদে আহমাদ: ৫০২২; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৬২২০; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী: ১৯৮৮; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৫৯৫৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ২০১৭৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ : ৩৫৮৫)
বস্তুত এ বিষয়ে প্রচুর আয়াত ও হাদীছ আছে। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে তার কয়েকটি উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।


‘অন্যের দেওয়া কষ্ট-ক্লেশ…’ সম্পর্কিত দু'টি আয়াত

এক নং আয়াত
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
অর্থ: এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন।(সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৩৪)

ব্যাখ্যা
এটি ৭৩ নং অধ্যায়ের ২য় আয়াতরূপে উদ্ধৃত হয়েছে। সেখানে এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

দুই নং আয়াত
وَلَمَنْ صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
অর্থ: প্রকৃতপক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করে, তো এটা অবশ্যই অত্যন্ত হিম্মতের কাজ।(সূরা শূরা (৪২), আয়াত ৪৩)

ব্যাখ্যা
এটি ৭৪ নং অধ্যায়ের ৪ নং আয়াতরূপে গত হয়েছে। সেখানে এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
অন্যের দুর্ব্যবহার সহ্য করার সুফল
হাদীছ নং: ৬৪৭

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার এমনকিছু আত্মীয় আছে, যাদের সঙ্গে আমি সুসম্পর্ক রক্ষা করি, কিন্তু তারা আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করি, কিন্তু তারা আমার প্রতি দুর্ব্যবহার করে। আমি তাদের দুর্ব্যবহারে সহনশীলতার পরিচয় দিই, কিন্তু তারা আমার প্রতি অসংযত আচরণ করে। তিনি বললেন, তুমি যেমন বললে যদি সেরকমই হয়ে থাক তবে তুমি যেন তাদেরকে উত্তপ্ত ছাই খাওয়াচ্ছ। তুমি যতক্ষণ তোমার এই নীতির উপর থাকবে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে তোমার একজন সাহায্যকারী থাকবে। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৫৫৮; সহীহ ইবনে হিব্বান ৪৫০; মুসনাদে আহমাদ: ৭৯৯২; শুআবুল ঈমান : ৭৫৮৩; তবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত: ২৭৮৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৪৩৭)
مقدمة الامام النووي
76 - باب احتمال الأذى
قَالَ الله تَعَالَى: {وَالْكَاظِمِينَ الغَيْظَ والْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ واللهُ يُحِبُّ المُحْسِنِينَ} [آل عمران: 134]، وقال تَعَالَى: {وَلَمَن صَبَرَ وَغَفَرَ إنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الأُمُورِ} [الشورى: 43] وفي الباب: الأحاديث السابقة في الباب قبله.
647 - وعن أَبي هريرة رضي الله تَعَالَى عنه: أنَّ رَجُلًا، قَالَ: يَا رسول الله، إنّ لي قَرَابةً أصِلُهم وَيَقْطَعُونِي، وَأُحْسِنُ إلَيْهِمْ وَيُسِيئُونَ إلَيَّ، وَأحْلُمُ عَنهم وَيَجْهَلُونَ عَلَيَّ! فَقَالَ: «لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ، فَكأنَّمَا تُسِفُّهُمُ الْمَلَّ، وَلاَ يَزَالُ مَعَكَ مِنَ اللهِ تَعَالَى ظَهيرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ». رواه مسلم. (1)
وقد سَبَقَ شَرْحُهُ في بَابِ صلة الأرحام.
হাদীস নং: ৬৪৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ শরী'আত যা-কিছু নিষিদ্ধ করেছে ও যা-কিছুর মর্যাদা দিয়েছে, তাতে শরী'আত অবমাননায় অসন্তোষপ্রকাশ এবং আল্লাহর দীনের জন্য প্রতিশোধগ্রহণ

পেছনের অধ্যায়টি ছিল অন্যের দেওয়া কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করা সম্পর্কে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত বিষয়ে অন্যের উপর রাগ না করে এবং প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা প্রদর্শন করাই ইসলামের শিক্ষা। তবে আল্লাহ তা'আলা মানবচরিত্রে যে রাগ রেখেছেন তা শুধু শুধুই নয়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনও আছে। বিশেষভাবে এর প্রয়োজন পড়ে দীনের ক্ষেত্রে। কেউ যদি দীন প্রচারে বাধা দেয়, দীনের বিরোধিতা করে বা দীনের অবমাননা করে, সে ক্ষেত্রে রাগ দেখানো ঈমানের দাবি। এ রাগ আল্লাহর জন্য। আল্লাহর জন্য অন্যকে ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য অন্যের প্রতি ক্রোধ ও বিদ্বেষ প্রদর্শন ঈমানের অঙ্গ। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবাসে, সে আল্লাহর শত্রুকে ঘৃণা না করে পারে না। । তিনি মানুষের কল্যাণার্থেই এটা দিয়েছেন।

দীন আল্লাহর দেওয়া ব্যবস্থা অনুসরণ করলে আল্লাহ খুশি হন। বিরোধিতা করলে তিনি নারাজ হন। সুতরাং যে ব্যক্তি দীনের বিরোধিতা করে, সে আল্লাহকে নারাজ করে। তাই আল্লাহপ্রেমিকের কর্তব্য দীনবিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। একে নাহী আনিল মুনকার বলে। অর্থাৎ দীনের দৃষ্টিতে যা আপত্তিকর, কেউ সেরকম কাজ করলে তাকে তা থেকে বিরত করার চেষ্টা করতে হবে। সেজন্য মুখে বোঝানো, শাসন ও ধমকানো এবং প্রয়োজনে শক্তি আরোপেরও হুকুম আছে। বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনও অন্যায় কাজ দেখে, তার কর্তব্য তাতে হাত দিয়ে বাধা দেওয়া। তা না পারলে মুখে বাধা দেওয়া। তাও যদি না পারে,তবে সর্বশেষ কাজ হল অন্তরে ঘৃণা করা। আল্লাহর জন্য যার অন্তরে ক্রোধের সঞ্চার হবে না, তার দ্বারা এই সর্বশেষ কাজ 'ঘৃণা করা'-এর বিষয়টিও আঞ্জাম পাবে না। এর দ্বারা বোঝা গেল, রাগও আল্লাহ তা'আলার একটি দান। দীনের ক্ষেত্রে এটা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে।
রাগ ব্যবহারের একটি বিশেষ ক্ষেত্র হল শরী'আতের অবমাননা। অর্থাৎ শরী'আত যে কাজ করতে নিষেধ করেছে, কেউ যদি সে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে, তবে তার উপর করা একান্ত কর্তব্য। তারপর সে রাগের প্রয়োগ তার উপর কীভাবে করা হবে, তা স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী নিরূপিত হবে। তা যেভাবেই হোক না কেন, সে ক্ষেত্রে রাগের প্রয়োগ জরুরি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তা করেছেন। তাঁর আপত্তিকর কোনও কাজ সংঘটিত হলে তিনি সেজন্য অবশ্যই রাগ করতেন, তা সে কাজটি যে-ই করুক না কেন এবং সে যতই আপনজন হোক না কেন।
এমনিভাবে কেউ যদি দীনের বিরুদ্ধাচরণ করে, তবে তার বিরুদ্ধে জিহাদের ব্যবস্থা রয়েছে। সে জিহাদ মুখে হতে পারে, কলম দিয়ে হতে পারে এবং হতে পারে অস্ত্র দিয়ে। এটা দীনের সাহায্য। কুরআন মাজীদে দীনের সাহায্যকে আল্লাহর সাহায্য বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। এরূপ ক্ষেত্রে ক্ষমাপ্রদর্শন করা ইসলামের বিধান নয়। বরং এরূপ ক্ষেত্রে ইসলাম ঈমানী জোশ দেখাতেই উৎসাহিত করেছে। এটা ভিন্ন কথা যে, সে জোশ দেখানোরও সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি আছে। যার যেমন ইচ্ছা তেমনি দেখাতে গেলে লাভের চেয়ে লোকসানেরই আশঙ্কা বেশি। তাই তা থেকে বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য। তা বিরত থাকা হবে বটে, কিন্তু সর্বাবস্থায় অন্তরে সে জোশ লালন করতে হবে। কোনও কোনও ক্ষেত্র এমন আছে, যেখানে সহজেই এর প্রয়োগ সম্ভব। যদি নিজ সন্তান-সন্ততি, ছাত্র-শিষ্য ও অধীনস্থদের কেউ শরী'আতবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়, তবে সে ক্ষেত্রে শাসন ও ধমকানোতে কিসের বাধা? এরূপ ক্ষেত্রে রাগ না দেখানো ঈমান নিস্তেজ হয়ে যাওয়ারই আলামত বহন করে। কোনও মুমিনেরই ঈমান এরকম নিস্তেজ হয়ে যাওয়া উচিত নয়। কুরআন মাজীদ ও হাদীছ আমাদেরকে উদ্দীপিত করেছে যেন আমরা শরী'আতবিরোধী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় না দিই; বরং আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তার সংশোধন ও দমনে ভূমিকা রাখি এবং আল্লাহর দীনের সম্মান রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ হয়ে থাকি। আলোচ্য অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই।


‘শরী'আত যা-কিছু নিষিদ্ধ করেছে…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত
وَ مَنْ يُعَظِمْ حُرُمَتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ عِنْدَ رَبِّهِ
অর্থ: আর যে ব্যক্তি আল্লাহ যেসব জিনিসকে মর্যাদা দিয়েছেন তার মর্যাদা রক্ষা করবে, তার পক্ষে তার প্রতিপালকের কাছে এ কাজ অতি উত্তম।(সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৩০)

ব্যাখ্যা
حُرُمت শব্দটি حُرْمَةٌ এর বহুবচন। এর অর্থ মর্যাদাপূর্ণ বস্তু বা বিষয়। حُرمت الله এ দ্বারা এমনসব বিষয় বোঝানো উদ্দেশ্য, যার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা জায়েয নয়। আল্লাহ তা'আলার যাবতীয় আদেশ-নিষেধ তথা গোটা শরী'আত এর অন্তর্ভুক্ত। এর মর্যাদা রক্ষা করার একটা দিক তো হল জ্ঞানগত। অর্থাৎ একজন মুসলিম হিসেবে শরী'আতের যেসব বিধান পালন করা জরুরি, তা যথাযথভাবে জানতে হবে। কেউ যদি শরী'আতের বিধান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন না করে, তবে সে জ্ঞানগতভাবে শরী'আতের অমর্যাদা করল।
এর মর্যাদাদানের আরেকটি দিক হল কর্মর্গত। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু করতে আদেশ করেছেন তা সঠিকভাবে করা, যথা নামায পড়া, যাকাত দেওয়া, রোযা রাখা, হজ্জ করা, কুরবানী করা, হালাল খাওয়া, সত্য বলা, ন্যায় ও ইনসাফ করা ইত্যাদি। এমনিভাবে আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু করতে তিনি নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা, যেমন সুদ ও ঘুষের লেনদেন না করা, জুলুম না করা, মিথ্যা না বলা, ধোঁকা না দেওয়া, সর্বপ্রকার অশ্লীলতা পরিহার করা ইত্যাদি। তো আল্লাহ তা'আলার যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে চলা প্রত্যেক মুমিনের একান্ত কর্তব্য। এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি শরী'আতের আদেশ-নিষেধ অমান্য করে, সে বাস্তবিকপক্ষে শরী'আতেরই অমর্যাদা করে।
حُرمت الله দ্বারা যেমন শরী'আতের বিধানাবলি বোঝানো হয়, যথা নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত, তেমনি আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে যা-কিছুর বিশেষ সম্পর্ক আছে তার জন্যও এ শব্দ প্রযোজ্য হয়। কেননা আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের দরুন সেসবেরও পৃথক মর্যাদা রয়েছে। যেমন কা'বাঘর, মক্কানগরী, মদীনা মুনাউওয়ারা,সমস্ত মসজিদ, কুরআন মাজীদ, কুরবানীর জন্তু, হজ্জের স্থানসমূহ, বরকতপূর্ণ দিন ও সময়, যথা রমাযান মাস, জুমু'আর দিন, যুলহিজ্জা মাসের প্রথম ১০ দিন, মুহাররামের ১০ তারিখ ইত্যাদি। আল্লাহর ইবাদত-আনুগত্যের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক থাকার দরুন এসবেরও আছে আলাদা মর্যাদা। সে মর্যাদা রক্ষা করা প্রত্যেক ঈমানদারের কর্তব্য।
এমনিভাবে যারা আল্লাহ তা'আলার দীনের ধারক-বাহক, প্রচারক, সেবক এবং আল্লাহ তা'আলার আদেশ বাস্তবায়ন ও কার্যকর করার দায়িত্বে নিয়োজিত, সেইসকল বিশিষ্ট বান্দাগণও حُرُمَت الله এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন নবী-রাসূল, নায়েবে রাসূল, উলামা, ফুকাহা, সুলাহা (নেককার বান্দাগণ), শুহাদা (যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হয়েছেন) ও সমস্ত ফিরিশতা। আল্লাহর এই খাস বান্দাদেরকেও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা ও তাদের আদব বজায় রাখা প্রত্যেক মুত্তাকী-পরহেযগার ব্যক্তির অবশ্যকর্তব্য।
আল্লাহপ্রদত্ত মর্যাদার কারণে যা-কিছুরই বিশেষ মর্যাদা আছে, এ আয়াত দ্বারা বোঝা গেল তার মর্যাদা রক্ষা করাও বান্দা হিসেবে আমাদের একান্ত কর্তব্য। তা রক্ষা করা হলে তাতে আমাদেরই কল্যাণ। আল্লাহ তা'আলা বলেন- فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ عِندَ رَبِّهِ (তার পক্ষে তার প্রতিপালকের কাছে এ কাজ অতি উত্তম)। এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলা খুশি হন। তাঁর কাছে বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এর প্রত্যেকটির মধ্যে রয়েছে বিপুল ছাওয়াব। তাছাড়া নেককাজ করার একটা বড় ফায়দা পাপমোচনও। আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এসবের মর্যাদা রক্ষা করলে গুনাহ মাফ হওয়ারও যথেষ্ট আশা রয়েছে। মোটকথা, আল্লাহর জন্য কৃত বান্দার কোনও নেক আমলই বৃথা যায় না। কোনও না কোনওভাবে তার সুফল সে পায়ই। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ
‘সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করে থাকলে সে তা দেখতে পাবে।(সূরা যিলযাল (৯৯), আয়াত ৭)

আয়াতটির শিক্ষা
ক. শরী'আত সম্পর্কে জানা ও শরী'আত মেনে চলা প্রত্যেক মুমিনের অবশ্যকর্তব্য। এর দ্বারাই শরী'আতের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়।
খ. আমাদেরকে অবশ্যই সম্মানিত স্থানসমূহ ও সম্মানিত সময়-কালের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে।
গ. আল্লাহ তা'আলার সাথে সম্পর্কের দরুন যারা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী, তাদে মর্যাদা ও আদব রক্ষায় যত্নবান থাকা উচিত।
ঘ. আল্লাহর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে চলাতে বান্দার নিজেরই কল্যাণ।

দুই নং আয়াত
إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ
অর্থ : তোমরা যদি আল্লাহর সাহায্য কর, তবে তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের কদম অবিচলিত রাখবেন।(সূরা মুহাম্মাদ (৪৭), আয়াত ৭)

ব্যাখ্যা
আল্লাহ তা'আলার সাহায্য করার অর্থ তাঁর দীনের সাহায্য করা। এটা বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন দীনের প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখা, সেজন্য বাকশক্তিও লেখনিশক্তির ব্যবহার করা, দীনী বই-পুস্তক লেখা ও প্রকাশ করা, সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা, মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়া, তর্কযুদ্ধ করা এবং প্রয়োজনে সসস্ত্র সংগ্রাম করা।
দীন প্রতিষ্ঠার মেহনত করা এমনকি দীনের কোনও একটি বিধান প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করায় ভূমিকা রাখাও আল্লাহ তা'আলার সাহায্য করার অন্তর্ভুক্ত। কেউ যদি শরী'আতের কোনও আদেশ লঙ্ঘন করে, তবে তাকে সে আদেশ পালনের দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও দীনের সাহায্য করার শামিল। সে আদেশ লঙ্ঘন করার কারণে যদি তার উপর কোনও শর'ঈ শাস্তি অবধারিত হয়, তবে সরকারের পক্ষ থেকে সে শাস্তি কার্যকর করাও আল্লাহর দীনের সাহায্য বলে গণ্য হবে।
আয়াতে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর দীনের সাহায্য করবে, আল্লাহ তা'আলাও তাদের সাহায্য করবেন। অর্থাৎ তারা দীনের যে-কাজই করবে, তাতে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে সাহায্য পাবে। ফলে সে কাজে তারা ব্যর্থ হবে না। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ
‘আল্লাহ অবশ্যই তাদের সাহায্য করবেন, যারা তার সাহায্য করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশক্তিমান, পরাক্রমশালী।(সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৪০)
আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে সাহায্য হয় কখনও মনোবল বৃদ্ধির দ্বারা। কখনও শত্রুর অন্তরে ভীতি সঞ্চার দ্বারা। কখনও তিনি সাহায্য করেন বৃষ্টি দিয়ে, আবার কখনও সাহায্য করেন অনুকূল বায়ু প্রবাহিত করে। কখনও তিনি সাহায্য করেন সরাসরি। আবার কখনও সাহায্য করেন ফিরিশতাদের মাধ্যমে। বদর যুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি ফিরিশতা পাঠিয়ে সাহায্য করেছিলেন। হযরত হাসসান ইবন ছাবিত রাযি. কাফেরদের বিরুদ্ধে নিজ কাব্যশক্তি ব্যবহার করতেন। এ প্রসঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছিলেন-
إِنَّ رُوْحَ الْقُدُسِ لَا يَزَالُ يُؤَيِّدُكَ ، مَا نَافَحْتَ عَنِ اللَّهِ وَرَسُوْلِهِ
‘তুমি যতক্ষণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে (নিজ কবিতার মাধ্যমে শত্রুদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের) জবাব দেবে, ততক্ষণ রূহুল কুদ্‌স্স (জিবরাঈল) তোমার সাহায্য করবে।(সহীহ মুসলিম: ২৪৯০; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৭১৪৭; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর : ৩৫৮২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১১০৬)
তবে আল্লাহ কাকে কীভাবে সাহায্য করবেন তা তিনিই জানেন। এমনিভাবে কখন সাহায্য করবেন তাও তাঁর ইচ্ছাধীন। এটাও একটা পরীক্ষার বিষয়। কাজেই ধৈর্য হারালে চলবে না। আমাদের কর্তব্য কাজে লেগে থাকা। তিনি তাঁর সময়মতো অবশ্যই সাহায্য করবেন, তা শীঘ্র হোক বা বিলম্ব এবং তা যেভাবেই হোক।
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহর দীনের সাহায্য করার দু'টি পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। এক তো হল আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে সাহায্য লাভ করা। আর দ্বিতীয় হল তাঁর পক্ষ থেকে বান্দার কদম অবিচলিত রাখা। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ (এবং তোমাদের কদম অবিচলিত রাখবেন)। এর এক অর্থ তো হল রণক্ষেত্রে অবিচল থাকা, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যুদ্ধ ছেড়ে না পালানো। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিহাদের ময়দানে অবতীর্ণ হবে, আল্লাহ তা'আলা তার অন্তরে সাহস যোগাবেন এবং পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক তাতে তাকে অবিচল রাখবেন। রণক্ষেত্রে শত্রুর আক্রমণের মুখে অবিচল থাকতে পারা নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় দান ও অনেক বড় সাহায্য। যে-কোনও রণক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
তবে কদম অবিচল রাখার বিষয়টা কেবল যুদ্ধক্ষেত্রের জন্যই সীমাবদ্ধ নয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর দীনের সাহায্য করবে, আল্লাহ তা'আলা তাকে তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইবাদত-আনুগত্যে অটল-অবিচল থাকতে সাহায্য করবেন। কোনও প্রলোভনে সে টলবে না। কোনও হুমকি-ধমকিতে সে পেছাবে না। শয়তানের প্ররোচনা হোক বা নফসের উস্কানি কিংবা হোক সমাজের ফুসলানি, বিপথগামী করার যত আয়োজনই হোক, সে কিছুতেই তার শিকার হবে না। আপন পথ তথা শরী'আতের অনুসরণ থেকে সে এক কদমও এদিক-ওদিক সরবে না। সবচে' বড় কথা মৃত্যুকালে যখন শয়তান তাকে ঈমানহারা করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে, তখনও আল্লাহ তা'আলা তারে সাহায্য করবেন, তাকে আপন পথে অবিচল রাখবেন। ফলে শয়তান পরাজিত হবে এবং সে জয়ী হয়ে ঈমান নিয়েই মৃত্যুবরণ করতে পারবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَإِنَّ جُنْدَنَا لَهُمُ الْغَالِبُونَ
‘এবং নিশ্চয়ই আমার বাহিনীই হবে জয়যুক্ত।( সূরা সাফফাত (৩৭), আয়াত ১৭৩)

আয়াতটির শিক্ষা
ক. আপন শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী আল্লাহর দীনের সাহায্য-সহযোগিতা করা প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য।
খ. জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দীনের উপর চলায় এবং নফস, জিন্ন-শয়তান ও মানব- শয়তান থেকে আত্মরক্ষায় আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার বড় উপায় হল তাঁর দীনের সাহায্য করা।
গ. আল্লাহর দীনের সাহায্য করার দ্বারা মৃত্যু পর্যন্ত শরী'আতের অনুসরণ ও ইবাদত- আনুগত্যে অবিচল থাকার তাওফীক লাভ হয়।
ইমাম কর্তৃক নামায বেশি দীর্ঘায়িত করায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাগান্বিত হওয়া
হাদীছ নং: ৬৪৮

হযরত আবূ মাস'ঊদ উকবা ইবন আমর আল-বাদরী রাযি. বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, আমি অমুকের কারণে ফজরের নামায থেকে পিছিয়ে থাকি। কেননা সে আমাদের নিয়ে (নামায) দীর্ঘায়িত করে। (আবু মাস'উদ রাযি. বলেন,) আমি সেদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যেমনটা রাগ করতে দেখেছি, আর কখনও কোনও ওয়াজে সেরকম রাগ করতে দেখিনি। তিনি বললেন, হে লোকসকল! তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে বিতৃষ্ণা সৃষ্টিকারী। তোমাদের মধ্যে কেউ মানুষের ইমামত করলে সে যেন নামায সংক্ষেপ করে। কেননা তার পেছনে বৃদ্ধ, শিশু ও এমন লোক থাকে, যার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী : ৭০২; সহীহ মুসলিম: ৪৬৬; সুনানে ইবন মাজাহ : ৯৮৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৪৬৫৭; সুনানে দারিমী: ১২৯৪; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ৬৪১; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ১৭৯৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২১৩৭; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৫৬)
مقدمة الامام النووي
77 - باب الغضب إِذَا انتهكت حرمات الشّرع والانتصار لدين الله تعالى
قَالَ الله تَعَالَى: {وَمَنْ يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ الله فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ عِنْدَ رَبِّهِ} [الحج: 30]، وقال تَعَالَى: {إنْ تَنْصُرُوْا اللهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ} [محمد: 7].
وفي الباب حديث عائشة السابق في باب العفو (1).
648 - وعن أَبي مسعود عقبة بن عمرو البدري - رضي الله عنه - قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النبيِّ - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: إنِّي لأَتَأخَّرُ عَن صَلاةِ الصُّبْحِ مِنْ أَجْلِ فلانٍ مِمَّا يُطِيلُ بِنَا! فَمَا رَأيْتُ النَّبيَّ - صلى الله عليه وسلم - غَضِبَ في مَوْعِظَةٍ قَطُّ أشَدَّ مِمَّا غَضِبَ يَوْمَئذٍ؛ فَقَالَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إنَّ مِنْكُمْ مُنَفِّرِينَ، فَأيُّكُمْ أَمَّ النَّاسَ فَلْيُوجِزْ؛ فَإنَّ مِنْ وَرَائِهِ الكَبِيرَ وَالصَّغِيرَ وَذَا الحَاجَةِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৬৪৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৭ শরী'আত যা-কিছু নিষিদ্ধ করেছে ও যা-কিছুর মর্যাদা দিয়েছে, তাতে শরী'আত অবমাননায় অসন্তোষপ্রকাশ এবং আল্লাহর দীনের জন্য প্রতিশোধগ্রহণ
ছবিযুক্ত পর্দা দেখে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাগ করা
হাদীছ নং: ৬৪৯

উন্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনও এক সফর থেকে ফিরে আসলেন। আমি আমার ঘরের আঙিনায় ছবিযুক্ত একটি পাতলা পর্দা টানিয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটি দেখামাত্র ছিঁড়ে ফেললেন এবং তাঁর চেহারা রক্তিম হয়ে গেল। তিনি বললেন, হে আয়েশা! কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা কঠোর শাস্তিপ্রাপ্ত হবে তারা, যারা আল্লাহর সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য স্থাপন করে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৫৯৫৪; সহীহ মুসলিম: ২১০৭; সুনানে নাসাঈ ৫৩৫৬; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ৪৭২৩; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৯১৭০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৪৫৭৩; শু'আবুল ঈমান: ৫৮৯৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩২১৫; মুসনাদুল হুমায়দী: ২৫৩)
مقدمة الامام النووي
77 - باب الغضب إِذَا انتهكت حرمات الشّرع والانتصار لدين الله تعالى
649 - وعن عائشة رضي الله عنها، قالت: قَدِمَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - مِنْ سَفرٍ، وَقَدْ سَتَرْتُ سَهْوَةً لِي بِقِرَامٍ فِيهِ تَمَاثيلُ، فَلَمَّا رَآهُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - هتكَهُ وَتَلَوَّنَ وَجهُهُ، وقال: «يَا عائِشَةُ، أشَدُّ النَّاسِ عَذَابًا عِنْدَ اللهِ يَوْمَ القيَامَةِ الَّذِينَ يُضَاهُونَ بخَلْقِ اللهِ!». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
«السَّهْوَةُ»: كَالصُّفَّةِ تَكُونُ بَيْنَ يدي البيت. وَ «القِرام» بكسر القاف: سِتر رقيق، وَ «هَتَكَه»: أفْسَدَ الصُّورَةَ الَّتي فِيهِ.
হাদীস নং: ৬৫০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৭ শরী'আত যা-কিছু নিষিদ্ধ করেছে ও যা-কিছুর মর্যাদা দিয়েছে, তাতে শরী'আত অবমাননায় অসন্তোষপ্রকাশ এবং আল্লাহর দীনের জন্য প্রতিশোধগ্রহণ
শর‘ঈ শাস্তি মওকুফ করার সুপারিশ ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্রোধ
হাদীছ নং: ৬৫০

উন্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, মাখযূম গোত্রের যে মহিলাটি চুরি করেছিল, তার বিষয়ে কুরায়শ গোত্র চিন্তিত হয়ে পড়ল। তারা বলল, তার সম্পর্কে কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে কথা বলবে? কেউ কেউ বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়পাত্র উসামা ইবন যায়দ ছাড়া আর কে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সাহস রাখে? শেষে উসামা ইবন যায়দই তাঁর সঙ্গে কথা বললেন?। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি আল্লাহ তা'আলার নির্ধারিত হদ্দ (শর'ঈ শাস্তি)-সমূহের মধ্যকার এক হদ্দ সম্পর্কে সুপারিশ করছ? তারপর তিনি উঠে ভাষণ দিলেন। তাতে তিনি বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে তো কেবল এ বিষয়টিই ধ্বংস করেছে যে, তাদের মধ্যকার কোনও অভিজাত ব্যক্তি চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত এবং কোনও দুর্বল ব্যক্তি চুরি করলে তার উপর হদ্দ কার্যকর করত। আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করত, আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৩৭৩২; সহীহ মুসলিম: ১৬৮৯; জামে' তিরমিযী: ১৪৩০; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৩৭৩; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৫৪৭; সুনানে নাসাঈ: ৪৮৯১ মুসনাদে আহমাদ: ২৪১৩৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ২৩০৩; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৪০২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৬০৩)
مقدمة الامام النووي
77 - باب الغضب إِذَا انتهكت حرمات الشّرع والانتصار لدين الله تعالى
650 - وعنها: أن قرَيشًا أهَمَّهُمْ شَأنُ المَرأَةِ المخزومِيَّةِ الَّتي سَرَقَتْ، فقالوا: مَنْ يُكَلِّمُ فِيهَا رسول الله - صلى الله عليه وسلم؟ فقالوا: مَنْ يَجْتَرِئُ عَلَيْهِ إِلاَّ أُسَامَةُ بنُ زَيْدٍ حِبُّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم؟ فَكَلَّمَهُ أُسَامَةُ، فَقَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «أَتَشْفَعُ في حَدٍّ مِنْ حُدُودِ الله تَعَالَى؟!» ثُمَّ قامَ فَاخْتَطَبَ، ثُمَّ قَالَ: «إنَّمَا أَهْلَك مَنْ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ، وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أقامُوا عَلَيْهِ الحَدَّ، وَايْمُ الله، لَوْ أَنَّ فَاطمَةَ بِنْتَ مُحمّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعتُ يَدَهَا». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৬৫১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৭ শরী'আত যা-কিছু নিষিদ্ধ করেছে ও যা-কিছুর মর্যাদা দিয়েছে, তাতে শরী'আত অবমাননায় অসন্তোষপ্রকাশ এবং আল্লাহর দীনের জন্য প্রতিশোধগ্রহণ
মসজিদে কফ ফেলা এবং সেজন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্রোধ
হাদীছ নং: ৬৫১

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মসজিদে) কিবলার দিকে কফ দেখতে পেলেন। এটা তাঁকে পীড়া দিল। এমনকি তাঁর চেহারায় তার ছাপ দেখা গেল। তারপর তিনি উঠে নিজ হাতে তা খুটে খুটে পরিষ্কার করলেন। তারপর বললেন, তোমাদের কেউ নামাযে দাঁড়ায়, তখন সে তার প্রতিপালকের সঙ্গে কানাকানি করে। নিশ্চয়ই তার প্রতিপালক তার ও কিবলার মাঝখানে থাকেন। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন কিবলার দিকে থুথু না ফেলে; বরং বামদিকে বা পায়ের নিচে ফেলে। তারপর তিনি নিজ চাদরের একপ্রান্ত ধরলেন এবং তাতে থুথু ফেললেন। তারপর তার একাংশ অন্য অংশের সঙ্গে রগড়ে দিলেন। তারপর বললেন, অথবা এরকম করবে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৪০৫; সহীহ মুসলিম: ৫৪৮; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ১৬৮১; মুসনাদুল হুমায়দী: ১২৫৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৭৪৪১; মুসনাদে আহমাদ: ৪৮৩৭; সুনানে দারিমী: ১৪৩৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ১০২৩; মুসনাদুল বাযযার: ৫৭০৭)
مقدمة الامام النووي
77 - باب الغضب إِذَا انتهكت حرمات الشّرع والانتصار لدين الله تعالى
651 - وعن أنس - رضي الله عنه: أنَّ النبيَّ - صلى الله عليه وسلم - رَأى نُخَامَةً في القبلَةِ، فَشَقَّ ذَلِكَ عَلَيْهِ حَتَّى رُؤِيَ في وَجْهِهِ؛ فَقَامَ فَحَكَّهُ بِيَدِهِ، فَقَالَ: «إن َأحدَكُمْ إِذَا قَامَ فِي صَلاَتِهِ فَإنَّهُ يُنَاجِي رَبَّهُ، وَإنَّ رَبَّهُ بَيْنَهُ وَبيْنَ القِبلْةِ، فَلاَ يَبْزُقَنَّ أحَدُكُمْ قِبَلَ الْقِبْلَةِ، وَلَكِنْ عَنْ يَسَارِهِ، أَوْ تَحْتَ قَدَمِهِ» ثُمَّ أخَذَ طَرَفَ رِدَائِهِ فَبَصَقَ فِيهِ، ثُمَّ رَدَّ بَعْضَهُ عَلَى بَعْضٍ، فَقَالَ: «أَوْ يَفْعَلُ هكذا». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
وَالأمرُ بالبُصَاقِ عَنْ يَسَارِهِ أَوْ تَحْتَ قَدَمِهِ هُوَ فِيما إِذَا كَانَ في غَيْرِ المسجِدِ، فَأمَّا فِي المَسجدِ فَلاَ يَبصُقُ إِلاَّ في ثَوْبِهِ.
হাদীস নং: ৬৫২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ শাসকবর্গকে জনগণের প্রতি নম্রতা দেখানো, তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা ও মমত্ব প্রদর্শনের হুকুম এবং তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, কঠোরতা আরোপ, তাদের কল্যাণকর বিষয়সমূহ উপেক্ষা করা, তাদের প্রতি অমনোযোগিতা ও তাদের প্রয়োজন পূরণে অবহেলা প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞা

ইসলামী শাসনের মূল উদ্দেশ্য জনগণের দীনী ও দুনিয়াবী তত্ত্বাবধান ও কল্যাণসাধন। কাজেই শাসকশ্রেণির কর্তব্য ইসলামের রক্ষণাবেক্ষণ করা, মানুষের মধ্যে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং তাদের মধ্যে ইসলামের বিধানাবলি প্রতিষ্ঠা করা। এটা তাদের কর্তব্যের দীনী দিক। এর দুনিয়াবী দিক হল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। মানুষের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা। সামাজিক অন্যায়-অবিচার দূর করে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। জনজীবনের প্রতিটি দিক সুচারুরূপে পরিচালনার উদ্দেশ্যে সুযোগ্য লোকদের নিয়োগদান করা ও তাদের তত্ত্বাবধান করা। মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণের ব্যবস্থা করা। ইসলামী নীতি অনুযায়ী অর্থ-সম্পদের উন্নয়ন ও সুষম বণ্টন করা ইত্যাদি। বলাবাহুল্য, দুনিয়াবী এ দিকসমূহও মৌলিকভাবে দীনেরই অন্তর্ভুক্ত। কেননা ইসলাম এক পরিপূর্ণ দীন এবং এসব দিক সম্পর্কে ইসলামের রয়েছে সুস্পষ্ট বিধান ও পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা। কাজেই এসব দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করার জন্য শাসকশ্রেণির দীনী চেতনা ও বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস লালন করা জরুরি। যে শাসকের অন্তরে আখিরাতের জবাবদিহিতার ভয় থাকে, তার পক্ষেই এসব দায়িত্ব ও কর্তব্য সুচারুরূপে পালন করা সম্ভব হয়। তখন তার দ্বারা রাষ্ট্রীয় কাজে কোনওরকম অবহেলা হয় না। সে জনগণের শোষক না হয়ে একজন সত্যিকারের কল্যাণকামী হয়। তাদের জন্য যা-কিছু কল্যাণকর তা আঞ্জাম দেওয়ার জন্য সে সর্বদা সজাগ ও তৎপর থাকে। সে হয় তাদের প্রতি সহমর্মী ও দরদী বন্ধু। তার যাবতীয় কাজ হয় মমত্বপূর্ণ। কখনও অহেতুক কঠোরতা প্রদর্শন করে না। তা করা কখনও সমীচীনও নয়। কেননা তাতে রাষ্ট্রীয় শাসন ও নেতৃত্বের মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এ কারণেই কুরআন ও হাদীছ শাসকশ্রেণিকে জনগণের প্রতি মমতাবান ও কল্যাণকামী থাকার প্রতি বিশেষ উৎসাহদান করেছে। সতর্ক করেছে যেন কোনওভাবেই তাদের প্রতি কঠোর আচরণ করা না হয়, তাদের প্রতি দায়িত্বপালনে অবহেলা প্রদর্শন এবং তাদের প্রতি জুলুম-অবিচারকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া না হয়। আলোচ্য অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই।


‘শাসকবর্গকে জনগণের প্রতি নম্রতা দেখানো…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
অর্থ: আর যে মুমিনগণ তোমার অনুসরণ করে, তাদের সঙ্গে বিনয়-নম্র আচরণ করো।(সূরা শু'আরা (২৬), আয়াত ২১৫)

ব্যাখ্যা
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ এর মূল অর্থ- তোমার ডানা নামিয়ে দাও। 'ডানা নামানো' দ্বারা মমত্বপূর্ণ আচরণ বোঝানো হয়। পাখি যখন তার ছানাদেরকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়, তখন প্রথমে ডানা বিস্তার করে দেয়, তারপর ছানারা যখন তার শরীরের সঙ্গে এসে মিশে যায়, তখন তাদের উপর তা নামিয়ে দেয়। এটা ছানাদের প্রতি তার মমত্বের আচরণ। নিজ অনুসারী ও অধীন ব্যক্তিবর্গকে অনুরূপ কাছে নিয়ে আসা ও তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করাকে পাখির এ আচরণের সঙ্গে উপমিত করা হয়েছে এবং সে হিসেবেই পাখির জন্য ব্যবহৃত শব্দমালাকে এস্থলে ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং 'মুমিনদের প্রতি ডানা নামিয়ে দাও'-এর অর্থ হবে- যারা তোমার প্রতি ঈমান এনেছে, তুমি তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করো, যাতে তারা তোমার কাছে কাছে থাকে, দূরে সরে না যায়।
সরাসরি এ আদেশটি করা হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, যাতে তিনি মুমিন-মুসলিমদের প্রতি নম্রকোমল আচরণ বজায় রাখেন। তিনি যেমন নবী ছিলেন, তেমনি ছিলেন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধানও। সুতরাং নবী হিসেবে উম্মতের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করা যেমন এ আয়াতের আদেশের অন্তর্ভুক্ত, তেমনি শাসক হিসেবে জনগণের প্রতি মমত্বের আচরণ করাও এর অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে তিনি এই চরিত্রেরই ছিলেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশদান দ্বারা মূলত প্রত্যেক অভিভাবক বিশেষত পরবর্তীকালের শাসকশ্রেণিকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, তারা যেন জনগণের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করে।
উল্লেখ্য, এ আয়াতটি ৭ম খণ্ডের ৭১ নং অধ্যায়ের ১নং আয়াতরূপে গত হয়েছে। সেখানে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক অভিভাবক ও শাসকের কর্তব্য অধীন ও জনগণের সঙ্গে বিনয়-নম্র। মমত্বপূর্ণ আচরণ করা।

খ. আয়াতটির শব্দসমূহের প্রতি লক্ষ করলে জানা যায় যে, কুরআন মাজীদের কোনও কোনও শব্দ তার প্রকৃত অর্থে নয়; বরং রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।

দুই নং আয়াত
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ, দয়া এবং আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।( সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯০)

ব্যাখ্যা
এটি কুরআন মাজীদের অত্যন্ত সারগর্ভ ও পূর্ণাঙ্গ আয়াত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তা'আলা যাবতীয় ভালো ও মন্দ বিষয়সমূহ সম্পর্কে এক পরিপূর্ণ নির্দেশনা এ আয়াতের ভেতর দান করেছেন। আকীদা, আখলাক, নিয়ত, আমল, লেনদেন ইত্যাদি এমন কোনও বিষয় নেই, যা এ আয়াতটির অধীনে আসেনি। এর মধ্যে যা ভালো তা করতে হুকুম করা হয়েছে আর যা মন্দ তা করতে নিষেধ করা হয়েছে। সম্ভবত এ পরিপূর্ণতার কারণেই হযরত উমর ইবন আব্দুল আযীয রহ. জুমু'আর খুতবায় আয়াতটি যুক্ত করে দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতটি কুরায়শ নেতা ওয়ালীদের সামনে পাঠ করলে সে বলেছিল, ভাতিজা! আবার পড়ো। তিনি ফের পড়লেন। তখন সে বলল, আল্লাহর কসম! এ যে বড় সুমিষ্ট ও সমুজ্জ্বল। এর উপরের অংশ ফলবান, নিচের অংশ সজীব। এটা কিছুতেই মানুষের কথা নয়।
আকছাম ইবন সায়ফী রাযি, এ আয়াতটি শুনে এমনই অভিভূত হয়েছিলেন যে, তিনি নিজ সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে বলেছিলেন, আমি তো দেখছি এ নবী সকল উত্তম চরিত্র ও সাধু আচরণের আদেশ করেন। তিনি হীন ও নীচ কাজকর্ম করতে নিষেধ করেন। সুতরাং তোমরা দেরি করো না; শীঘ্র তাঁর অনুসারী হয়ে যাও। এ ক্ষেত্রে তোমরা মাথা হও, লেজ হয়ো না। অর্থাৎ অগ্রাগামী হও, পেছনে থেকো না।
এ আয়াতে মৌলিকভাবে তিনটি বিষয়ের আদেশ করা হয়েছে এবং তিনটি বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে। যেসব বিষয়ের আদেশ করা হয়েছে তা হল 'আদল, ইহসান ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করা। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ (নিশ্চয়ই আল্লাহ হুকুম দেন ইনসাফ ও দয়া করার)। ‘আদল’-এর অর্থ ইনসাফ করা। অর্থাৎ মানুষের আকীদা-বিশ্বাস, কাজকর্ম, স্বভাব-চরিত্র ও লেনদেনসহ যাবতীয় বিষয় ইনসাফের মানদণ্ডে সম্পন্ন করতে হবে। কোনওরকম বাড়াবাড়ি বা শিথিলতা করা যাবে না। যত ঘোর শত্রুই হোক না কেন, তার প্রতি আচরণেও ইনসাফ রক্ষা করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
‘হে মুমিনগণ! তোমরা হয়ে যাও আল্লাহর (বিধানাবলি পালনের) জন্য সদাপ্রস্তুত (এবং) ইনসাফের সাথে সাক্ষ্যদানকারী এবং কোনও সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে ইনসাফ পরিত্যাগে প্ররোচিত না করে। ইনসাফ অবলম্বন করো। এ পন্থাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী। এবং আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৮)
‘ইহসান’-এর অর্থ যাবতীয় কাজ তার সাধারণ নিয়ম ও আইনের ঊর্ধ্বে উঠে আরও উত্তমরূপে সম্পন্ন করা। ন্যায় ও ইনসাফের স্তর অতিক্রম করে দয়া ও ক্ষমা এবং সহানুভূতি ও সমবেদনার পন্থা অবলম্বন করা। ফরয আদায় করার পর নফলের প্রতিও মনোযোগী হওয়া। এমনিভাবে যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালনে পুরোপুরি নিয়ম-নীতি রক্ষার সঙ্গে অন্তরে এই ধারণাও জাগ্রত রাখা যে, আমি যা করছি তা এ অবস্থায় করছি, যেন আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছি। আর আমি না দেখলেও সর্বাবস্থায় আল্লাহ তো আমাকে দেখছেনই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما الْإِحْسَانُ؟ قَالَ: «أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ
‘ইহসান কী? তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে এমনভাবে, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। আর তুমি তাঁকে না দেখলেও তিনি তো তোমাকে অবশ্যয় দেখছেন।(সহীহ বুখারী: ৫০; সহীহ মুসলিম: ৮; জামে' তিরমিযী: ২৬১০; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৬৯৫; সুনানে নাসাঈ: ৪৯৯০; সুনানে ইবন মাজাহ ৬৪; মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা : ৩০৩০৯; সহীহ ইবনে হিব্বান: ১৫৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০৮৭১)
وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى ‘এবং আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন'।
এমনিতে ইনসাফ ও ইহসান করার যে আদেশ প্রদান করা হয়েছে, আত্মীয়-স্বজনের হক আদায়ের বিষয়টিও তার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তারপরও আলাদাভাবে তাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এ কারণে যে, অন্যদের তুলনায় আত্মীয়-স্বজনের হক অনেক বেশি। তাই যদিও ইনসাফ ও ইহসানের আচরণ সকলের সঙ্গেই করতে হবে, তবুও আত্মীয়-স্বজনের বেলায় এ বিষয়ে আরও বেশি সচেতন থাকতে হবে। বরং তাদের ক্ষেত্রে সর্বদা ইনসাফের ঊর্ধ্বে উঠে ইহসানকেই আঁকড়ে ধরা চাই।
তিনটি বিষয়ের আদেশ করার পর আল্লাহ তা'আলা তিনটি বিষয়ে নিষেধ করেছেন। বলা হয়েছে- وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ (আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন)। الْفَحْشَاء হল যাবতীয় নির্লজ্জতামূলক অশ্লীল ও অশালীন কথা ও কাজ। যেমন ব্যভিচার, নগ্নতা, গালাগালি, নাচ-গান ইত্যাদি। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ
'স্মরণ রেখো, যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার হোক এটা কামনা করে, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি।(সূরা নূর (২৪), আয়াত ১৯)
الْمُنْكَر অর্থ আপত্তিকর কাজ। শরী'আত যা-কিছু করতে নিষেধ করেছে সবই এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন কুফর, শিরক, হিংসা-বিদ্বেষ এবং প্রকাশ্য ও গুপ্ত যাবতীয় পাপকর্ম।
الْبَغْيِ অর্থ সীমালঙ্ঘন। জুলুম অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কারও জান, মাল ও ইজ্জতের উপর আঘাত করা, কাউকে তার জান, মাল ও ইজ্জতের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। কিংবা বলা যায়, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা বা মারধর করা, অন্যায়ভাবে কারও অর্থ-সম্পদ গ্রাস করা এবং কারও অসম্মান ও অমর্যাদা করা। জুলুম যদিও الْمُنْكَر এর অন্তর্ভুক্ত, তথাপি বিশেষ গুরুত্বের কারণে আলাদাভাবেও এটি উল্লেখ করা হয়েছে।কেননা এর দ্বারা মানুষের অধিকার খর্ব করা হয়। অন্যের অধিকার খর্ব করলে তা যতক্ষণ সে ব্যক্তি ক্ষমা না করবে, ততোক্ষণ আল্লাহ তা'আলাও ক্ষমা করেন না। এটা এমন এক পাপ, যার শাস্তি আখিরাতে তো বটেই, দুনিয়াতেও দিয়ে দেওয়া হয়। মজলুমের বদদু'আ অতিদ্রুত কবুল হয়। ফলে আল্লাহ তা'আলা তাকে সাহায্য করেন এবং জালেমের থেকে প্রতিশোধ নিয়ে নেন। তাই জুলুম করা হতে বেঁচে থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি হাদীছে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছে-
يَا عِبَادِي! إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلَا تَظَالَمُوا
‘হে আমার বান্দাগণ! আমি নিজের প্রতি জুলুম হারাম করে রেখেছি এবং একে তোমাদের জন্য হারাম করেছি। কাজেই তোমরা পরস্পর জুলুম করো না।(সহীহ মুসলিম: ২৫৭৭; জামে' তিরমিযী: ২৪৯৫; সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪২৫৭)
يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ (তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ের আদেশ করেন ও বিভিন্ন কাজ করতে নিষেধ করেন এবং ভালো-মন্দে পার্থক্য করে চলতে বলেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. আপন-পর সকলের সঙ্গে সকল বিষয়ে ন্যায় ও ইনসাফ রক্ষা করতে হবে।
খ. মুমিন ব্যক্তি কেবল আইনের উপর চলবে না; বরং ইহসান তথা উত্তম আদর্শের উপর চলবে।
গ. আত্মীয়-স্বজনের অধিকার অন্যদের তুলনায় বেশি। তাই আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সর্বদা ইহসান ও উন্নত আদর্শের অবস্থান থেকে আচরণ করা চাই।
ঘ. সর্বাবস্থায় অশ্লীল ও নির্লজ্জ কথা ও কাজ পরিহার করে চলতে হবে।
৬. যাবতীয় আপত্তিকর কাজ তথা শরী'আতবিরোধী কাজ পরিহার করে চলাই প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
চ. আপন-পর কারও প্রতি কোনও অবস্থায় জুলুম করা যাবে না।
জনগণের প্রতি শাসকবর্গের দায়িত্বশীলতা
হাদীছ নং: ৬৫২

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। পুরুষ তার পরিবারবর্গের উপর দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। নারী তার স্বামীর ঘরে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। খাদেম তার মনিবের অর্থ-সম্পদের উপর দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।- বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৮৯৩; সহীহ মুসলিম: ১৮২৯; জামে তিরমিযী: ১৭০৫; সুনানে আবূ দাউদ। ২৯২৮; মুসনাদে আহমাদ: ৪৪৯৫; সহীহ ইবনে হিব্বান ৪৪৮৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১২৬৮৬; শুআবুল ঈমান: ৪৮৮১; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর: ৪৫০৬)
مقدمة الامام النووي
78 - باب أمر وُلاة الأمور بالرفق برعاياهم ونصيحتهم والشفقة عليهم والنهي عن غشهم والتشديد عليهم وإهمال مصالحهم والغفلة عنهم وعن حوائجهم
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ} [الشعراء: 215]، وقال تَعَالَى: {إنَّ اللهَ يَأمُرُ بِالْعَدْلِ وَالإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ} [النحل: 90].
652 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما، قَالَ: سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتهِ: الإمَامُ رَاعٍ وَمَسؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ في أهلِهِ وَمَسؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ في بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْؤُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا، وَالخَادِمُ رَاعٍ في مال سيِّدِهِ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৬৫৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৮ শাসকবর্গকে জনগণের প্রতি নম্রতা দেখানো, তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা ও মমত্ব প্রদর্শনের হুকুম এবং তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, কঠোরতা আরোপ, তাদের কল্যাণকর বিষয়সমূহ উপেক্ষা করা, তাদের প্রতি অমনোযোগিতা ও তাদের প্রয়োজন পূরণে অবহেলা প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞা
জালেম শাসকের পরিণাম
হাদীছ নং: ৬৫৩

হযরত আবূ ইয়া'লা মা'কিল ইবন ইয়াসার রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাঁর যে বান্দাকেই জনগণের দায়িত্বশীল নিযুক্ত করেন, সে যেদিন মারা যায়, সেদিন যদি এ অবস্থায় মারা যায় যে, সে তার জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭১৫০; সহীহ মুসলিম: ১৪২; সুনানে দারিমী ২৮৩৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৪৯৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৪৭৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১৭৯০২; শু'আবুল ঈমান : ৬৯৭৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৪৭৮; মুসনাদু ইবনুল জা'দ : ৩১৪০)
অপর এক বর্ণনায় আছে, সে যদি তাদের সকলের প্রতি পুরোপুরি কল্যাণকামিতা প্রদর্শন না করে, তবে সে জান্নাতের সুবাসও পাবে না।
মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, যে শাসক মুসলিমদের বিষয়াবলির অভিভাবকত্ব লাভ করে, তারপর সে তাদের অনুকূলে পুরোপুরি চেষ্টা করে না এবং তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা দেখায় না, সে তাদের সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
مقدمة الامام النووي
78 - باب أمر وُلاة الأمور بالرفق برعاياهم ونصيحتهم والشفقة عليهم والنهي عن غشهم والتشديد عليهم وإهمال مصالحهم والغفلة عنهم وعن حوائجهم
653 - وعن أَبي يعلى مَعْقِل بن يَسارٍ - رضي الله عنه - قَالَ: سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «مَا مِنْ عَبْدٍ يَستَرْعِيهِ اللهُ رَعِيَّةً، يَمُوتُ يَوْمَ يَمُوتُ وَهُوَ غَاشٌّ لِرَعِيَّتِهِ، إِلاَّ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الجَنَّة». متفقٌ عليه. (1)
وفي رواية: «فَلَمْ يَحُطْهَا بِنُصْحِهِ لَمْ يَجِدْ رَائِحَةَ الجَنَّة».
وفي رواية لمسلم: «مَا مِنْ أميرٍ يلي أمور المُسْلِمينَ، ثُمَّ لا يَجْهَدُ لَهُمْ وَيَنْصَحُ لَهُمْ، إِلاَّ لَمْ يَدْخُلْ مَعَهُمُ الْجَنَّةَ».
হাদীস নং: ৬৫৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৮ শাসকবর্গকে জনগণের প্রতি নম্রতা দেখানো, তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা ও মমত্ব প্রদর্শনের হুকুম এবং তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, কঠোরতা আরোপ, তাদের কল্যাণকর বিষয়সমূহ উপেক্ষা করা, তাদের প্রতি অমনোযোগিতা ও তাদের প্রয়োজন পূরণে অবহেলা প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞা
কোমল ও কঠোর শাসকের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু'আ ও বদদু'আ
হাদীছ নং: ৬৫৪

উন্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার এ ঘরে বসে বলতে শুনেছি, হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি আমার উম্মতের কোনও বিষয়ের কর্তৃত্ব লাভ করে, তারপর সে তাদের উপর কঠোরতা প্রদর্শন করে, তুমিও তার প্রতি কঠোরতা করো। আর যে ব্যক্তি আমার উম্মতের কোনও বিষয়ে কর্তৃত্ব লাভ করে, তারপর সে তাদের উপর কোমলতা প্রদর্শন করে, তুমি তার প্রতি কোমলতা প্রদর্শন করো। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ১৮২৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫৫৩; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত : ৩৬০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৭৯১৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৪৭২)
مقدمة الامام النووي
78 - باب أمر وُلاة الأمور بالرفق برعاياهم ونصيحتهم والشفقة عليهم والنهي عن غشهم والتشديد عليهم وإهمال مصالحهم والغفلة عنهم وعن حوائجهم
654 - وعن عائشة رضي الله عنها، قالت: سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول في بيتي هَذَا: «اللَّهُمَّ مَنْ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِي شَيْئًا فَشَقَّ عَلَيْهِمْ، فَاشْقُقْ عَلَيْهِ، وَمَنْ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِي شَيْئًا فَرَفَقَ بِهِمْ، فَارْفُقْ بِهِ». رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ৬৫৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৮ শাসকবর্গকে জনগণের প্রতি নম্রতা দেখানো, তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা ও মমত্ব প্রদর্শনের হুকুম এবং তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, কঠোরতা আরোপ, তাদের কল্যাণকর বিষয়সমূহ উপেক্ষা করা, তাদের প্রতি অমনোযোগিতা ও তাদের প্রয়োজন পূরণে অবহেলা প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞা
খলীফার মর্যাদা ও খলীফার প্রতি জনগণের কর্তব্য
হাদীছ নং: ৬৫৫

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, বনী ইসরাঈলকে নেতৃত্বদান করতেন নবীগণ। যখনই কোনও নবীর ওফাত হয়ে যেত, অপর নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। কিন্তু আমার পরে কোনও নবী নেই। আমার পরে আসবে খলীফাগণ। তারা (কখনও একই সময়ে) অনেকজন হবে। সাহাবীগণ বললেন, সে ক্ষেত্রে আপনি আমাদের কী আদেশ করেন? তিনি বললেন, তোমরা পর্যায়ক্রমে প্রথমজনের বায়'আতে বিশ্বস্ততা রক্ষা করবে এবং তাদেরকে তাদের হক প্রদান করবে। আর তোমাদের যা প্রাপ্য তা আল্লাহর কাছে চাইবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে যে বিষয়ে দায়িত্বশীল বানিয়েছেন, সে সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৩৪৫৫; সহীহ মুসলিম: ১৮৪২; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৮৭১; মুসনাদে আহমাদ। ৭৯৪৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৬৫৪৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৪৬৪; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৫৫৫; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৬২১১)
مقدمة الامام النووي
78 - باب أمر وُلاة الأمور بالرفق برعاياهم ونصيحتهم والشفقة عليهم والنهي عن غشهم والتشديد عليهم وإهمال مصالحهم والغفلة عنهم وعن حوائجهم
655 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «كَانَتْ بَنُو إسرَائِيلَ تَسُوسُهُم الأَنبِيَاء، كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٌّ خَلَفَهُ نَبيٌّ، وَإنَّهُ لاَ نَبِيَّ بَعْدِي، وَسَيكُونُ بَعْدِي خُلفَاءُ [ص:213] فَيَكثرُونَ»، قالوا: يَا رسول الله، فَمَا تَأْمُرُنَا؟ قَالَ: «أَوْفُوا بِبَيْعَةِ الأَوَّل فَالأَوَّل، ثُمَّ أعْطُوهُمْ حَقَّهُمْ، وَاسْأَلُوا الله الَّذِي لَكُمْ، فَإنَّ اللهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ». متفقٌ عليه. (1)
হাদীস নং: ৬৫৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৮ শাসকবর্গকে জনগণের প্রতি নম্রতা দেখানো, তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা ও মমত্ব প্রদর্শনের হুকুম এবং তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, কঠোরতা আরোপ, তাদের কল্যাণকর বিষয়সমূহ উপেক্ষা করা, তাদের প্রতি অমনোযোগিতা ও তাদের প্রয়োজন পূরণে অবহেলা প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞা
জনগণের প্রতি শাসকবর্গের নম্র-কোমল হওয়ার উপদেশ
হাদীছ নং: ৬৫৬

হযরত আইয ইবন আমর রাযি. উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ওহে বাছা! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি। সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট রাখাল সেই ব্যক্তি, যে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করে। সুতরাং তুমি তাদের একজন হয়ো না। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ১৮৩০; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৫১১; মুস্তাখরাজ আবূ 'আওয়ানা: ৭০৪৯)
مقدمة الامام النووي
78 - باب أمر وُلاة الأمور بالرفق برعاياهم ونصيحتهم والشفقة عليهم والنهي عن غشهم والتشديد عليهم وإهمال مصالحهم والغفلة عنهم وعن حوائجهم
656 - وعن عائِذ بن عمرو - رضي الله عنه: أَنَّهُ دَخَلَ عَلَى عُبَيْد اللهِ بن زيادٍ، فَقَالَ لَهُ: أيْ بُنَيَّ، إنِّي سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «إنَّ شَرَّ الرِّعَاءِ الحُطَمَةُ»، فإيَاكَ أن تَكُونَ مِنْهُمْ. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৬৫৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৮ শাসকবর্গকে জনগণের প্রতি নম্রতা দেখানো, তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা ও মমত্ব প্রদর্শনের হুকুম এবং তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, কঠোরতা আরোপ, তাদের কল্যাণকর বিষয়সমূহ উপেক্ষা করা, তাদের প্রতি অমনোযোগিতা ও তাদের প্রয়োজন পূরণে অবহেলা প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞা
জনগণের প্রয়োজন পূরণে অবহেলাকারী শাসকের পরিণাম
হাদীছ নং: ৬৫৭

হযরত আবূ মারয়াম আল-আযদী রাযি. একদিন হযরত মু'আবিয়া রাযি-কে লক্ষ্য করে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি আল্লাহ যাকে মুসলিমদের কোনও বিষয়ে কর্তৃত্বদান করেন আর সে তাদের প্রয়োজন, তাদের চাহিদা ও তাদের অভাব-অনটন পূরণ করা হতে বিরত থাকে, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তার প্রয়োজন, তার চাহিদা ও তার অভাবপূরণ হতে বিরত থাকবেন। অতঃপর হযরত মু'আবিয়া রাযি. মানুষের প্রয়োজনাদি দেখভালের জন্য এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেন। -আবু দাউদ ও তিরমিযী
(সুনানে আবু দাউদ: ২৯৪৮; জামে' তিরমিযী: ১৩৮২; মুসনাদে আহমাদ: ১৫৬৫১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৮৩২; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৭০২৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৪৭৯)
مقدمة الامام النووي
78 - باب أمر وُلاة الأمور بالرفق برعاياهم ونصيحتهم والشفقة عليهم والنهي عن غشهم والتشديد عليهم وإهمال مصالحهم والغفلة عنهم وعن حوائجهم
657 - وعن أَبي مريم الأزدِيِّ - رضي الله عنه: أنّه قَالَ لِمعاوية - رضي الله عنه: سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «مَنْ وَلاَّهُ اللهُ شَيْئًا مِنْ أُمُورِ المُسْلِمِينَ، فَاحْتَجَبَ دُونَ حَاجَتِهِمْ وَخَلَّتِهِمْ وَفَقْرِهِمْ، احْتَجَبَ اللهُ دُونَ حَاجَتِهِ وَخَلَّتِهِ وَفَقْرِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ» فجعل معاوية رجلًا عَلَى حوائج النَّاسِ. رواه أَبُو داود والترمذي. (1)
হাদীস নং: ৬৫৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ ন্যায়পরায়ণ শাসক

الْوَالِي শব্দটি উৎপত্তি وِلايَةٌ থেকে। এর অর্থ কর্তৃত্ব, অভিভাবকত্ব, তত্ত্বাবধানকর্ম। এটা সীমিত অর্থেও হতে পারে, ব্যাপক অর্থেও হতে পারে। এতিম ও নাবালকের অভিভাবক, ওয়াকফ সম্পত্তির মুতাওয়াল্লী, আঞ্চলিক প্রশাসক ও রাষ্ট্রের শাসক- এদের সকলকেই الْوَالِي শব্দে ব্যক্ত করা হয়। এদের প্রত্যেকেই আপন আপন পরিমণ্ডলে কর্তৃত্ব ও অভিভাবকত্ব করে থাকে।
عَادِل শব্দটির উৎপত্তি عَدْلٌ থেকে। এর অর্থ বরাবর ও ভারসাম্য। যে-কোনও ক্ষেত্রে ন্যায় ও ইনসাফের অবস্থা ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে থাকে, যেন তা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে পরিমাপকৃত। দাঁড়িপাল্লার কোনও একদিক ঝোঁকা থাকলে তা দ্বারা পরিমাপ সঠিক হয় না। পরিমাপ সঠিক হওয়ার জন্য উভয়দিক সমান থাকা জরুরি। তদ্রূপ বিচারকার্যে বিচারকের দৃষ্টিও উভয়পক্ষের দিকে সমান থাকা জরুরি। অন্যথায় বিচারকর্ম সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে না। এ কারণেই দাঁড়িপাল্লাকে ন্যায়বিচারের প্রতীক গণ্য করা হয়।

ওয়ালী (اَلْوَالِي) অর্থাৎ শাসক-প্রশাসকের প্রতি ইসলামের বিশেষ নির্দেশনা হল তাদেরকে অবশ্যই আপন দায়িত্ব-কর্তব্য ন্যায়নিষ্ঠতার সঙ্গে পালন করতে হবে। এটা তাদের উপর ফরয। আখিরাতে তাদেরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।
ন্যায় ও ইনসাফের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের ভেতর পার্থিব বহু কল্যাণ নিহিত রয়েছে। শাসক-প্রশাসক নিয়োগই করা হয় জনগণের কল্যাণার্থে। তারা ইনসাফের সঙ্গে দায়িত্ব পালন না করলে জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে ব্যাপক অকল্যাণ সাধিত হয়। ফলে শাসক নিয়োগের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়।
শাসক-প্রশাসকের প্রধান দায়িত্ব মানুষের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা। বলাবাহুল্য, এ দায়িত্ব ন্যায়সম্মত শাসনের দ্বারাই পূরণ হওয়া সম্ভব। কেননা শাসন যদি জুলুম-অত্যাচারের সঙ্গে হয়, তবে তার অনিবার্য পরিণাম জননিরাপত্তার বিলুপ্তি। দেখা দেয় নৈরাজ্য ও অস্থিরতা। পরিণামে রাষ্ট্রের অস্তিত্বও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।
ন্যায় ও ইনসাফের শাসন রাষ্ট্রকে কল্যাণকর করে তোলে। রাষ্ট্রপ্রধানের ন্যায়নীতি ক্রমবিস্তার লাভ করে রাষ্ট্রের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায়। তাতে জনগণও আপন আপন পরিমণ্ডলে ইনসাফ বিস্তারে আগ্রহী হয়। এর কল্যাণ প্রকাশ পায় ভূমি, কল-কারখানাসহ উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং উৎপাদনমূলক সকল কর্মকাণ্ডে। এটা আল্লাহর রহমত। ন্যায়শাসনে আল্লাহ খুশি হন। ফলে তিনি সে শাসকের অধীন সকল ক্ষেত্রে কল্যাণধারা বর্ষণ করেন। আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। ভূমি তার উর্বরাশক্তির প্রকাশ ঘটায়। এভাবে জলে-স্থলে সবখানে রহমত ও বরকতের প্রবাহ ছাপিয়ে যায়। এমনই কল্যাণপ্রসূ ইনসাফসম্মত শাসন। তাই তো বলা হয়, একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক মুষলধারার বৃষ্টি অপেক্ষাও উত্তম। শাসকের ন্যায় ও ইনসাফ ফলনমুখর কাল অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট। অপরদিকে জালেম শাসকের জুলুম সর্বাংশে ক্ষতিকর। কেবল জুলুম করাই নয়, জুলুমের নিয়তটুকুও অকল্যাণকর। ইবনুল আযরাক রহ. বলেন, বরকতনাশের জন্য জুলুমের নিয়তই যথেষ্ট। ওয়াহাব ইবন মুনাব্বিহ রহ. বলেন, শাসক যখন ন্যায় ও ইনসাফের ইচ্ছা করে, তখন আল্লাহ তা'আলা রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে এমনকি হাটে-বাজারে পর্যন্ত বরকত দিয়ে দেন। বরকত দেন জীবন ও জীবিকায়। অপরপক্ষে যখন জুলুমের ইচ্ছা করে, তখন আল্লাহ তা'আলা হাট-বাজার, জীবন-জীবিকা ও রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে বেবরকতী ও অভাব-অনটন বিস্তার করে দেন।
সুতরাং জনগণের সঙ্গে শাসকের প্রীতিবন্ধন, জনগণের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সংহতি, দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নতি ও সার্বিক কল্যাণার্থে শাসক-প্রশাসকের একান্ত কর্তব্য ন্যায়-ইনসাফের সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালনা করা। তাতে কেবল পার্থিব উন্নয়নই হয় না, আল্লাহ তা'আলারও সন্তুষ্টি লাভ হয়, যা কিনা একজন মুমিন বান্দার সর্বাপেক্ষা বড় কাম্যবস্তু। তাই কুরআন-হাদীছ অতি গুরুত্বের সঙ্গে এর প্রতি আমীর ও শাসকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই।

'ন্যায়পরায়ণ শাসক' সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ
অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ ও দয়া করার হুকুম দেন।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯০)

ব্যাখ্যা
এটি পূর্ববর্তী অধ্যায়ের ২ নং আয়াতরূপে গত হয়েছে। সেখানে এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

দুই নং আয়াত
وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ
অর্থ: এবং ইনসাফ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালোবাসেন।(সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ৯)

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ দুই পক্ষের মধ্যে আপস-রফা, অন্যায়-অপরাধের বিচার-আচার ও মানুষের প্রতি আচার-ব্যবহারে ইনসাফের পরিচয় দিয়ো। কোনওরকম পক্ষপাতিত্ব করো না। ইনসাফ রক্ষায় যেন আপন-পরের পার্থক্য তোমাদের প্রভাবিত করতে না পারে। এমনকি মুসলিম-অমুসলিমের প্রভেদও নয়। যাদের সঙ্গে কোনওরকম শত্রুতা আছে, তাদের ক্ষেত্রেও ন্যায় ও ইনসাফ থেকে সরে যাওয়ার কোনও অবকাশ নেই। এটা এমনই এক সাধারণ ও সর্বব্যাপী নির্দেশ, যা সকলের ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য। এমনকি পিতারও কর্তব্য সন্তানদের প্রতি সমতাপূর্ণ ব্যবহার করা। অনুরূপ ছাত্রদের প্রতি শিক্ষকেরও। যার দুই স্ত্রী আছে, তার জন্য উভয়ের সঙ্গে সুসম ব্যবহার করা কর্তব্য।
আয়াত হুকুম দিয়েছে যে, সকলের প্রতি ইনসাফ করো। আর এর কারণ বলেছে যে, আল্লাহ তা'আলা ইনসাফকারীদের ভালোবাসেন। বস্তুত আল্লাহর প্রতি যারা বিশ্বাস রাখে, তারা আল্লাহ তা'আলাকে ভালোওবাসে সর্বাপেক্ষা বেশি এবং তা বেশি হওয়াই উচিত। যারা আল্লাহকে ভালোবাসে, তাদের পরম লক্ষ্য তাঁর ভালোবাসা পাওয়া। এ আয়াত জানাচ্ছে, আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার একটি উপায় ন্যায় ও ইনসাফের আচরণ করা। জীবনের সকল ক্ষেত্রে সকলের সঙ্গে যে ব্যক্তি ন্যায় ও ইনসাফ রক্ষা করে দিতে পারবে, সে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা পাবেই। সুতরাং এ লক্ষ্যে প্রত্যেকের র্তব্য একজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিরূপে জীবনযাপন করা।
আল্লাহ তা'আলা যখন ইনসাফকারীদের ভালোবাসেন, তখন এ কথা স্পষ্ট যে, যারা ইনসাফ করে না, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন না। কাজেই যা-কিছু ইনসাফবিরোধী কাজ অবশ্যই তা পরিহার করে চলতে হবে। কুরআন মাজীদে পালকপুত্রদেরকে তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাকতে বলা হয়েছে। কী এর কারণ? আল্লাহ তা'আলা বলেন-
ادْعُوهُمْ لِآبَائِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِنْدَ اللَّهِ
'তোমরা তাদেরকে (পোষ্যপুত্রদেরকে) তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাকো। এ পদ্ধতিই আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ ন্যায়সঙ্গত।(সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৫)
অর্থাৎ কেবল লালন-পালনের কারণে কাউকে পিতা সাব্যস্ত করা আর জন্মদাতা তার সঙ্গে তার পরিচয় ভুলিয়ে দেওয়া কিছুতেই ইনসাফের কাজ নয়। এটা পিতা-পুত্র উভয়ের প্রতি জুলুম। কিন্তু মানুষ সাধারণত এটাকে জুলুম মনে করে না। ফলে এই এক পরাধ তাদেরকে আরও নানা অপরাধে জড়িয়ে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে ন্যায় ও ইনসাফ সর্জন দেওয়ার দ্বারা নানা অপরাধের পথ খুলে যায়। তাই সকল ক্ষেত্রে ইনসাফ রক্ষায় সতর্ক থাকা অতীব জরুরি, বিশেষত শাসকশ্রেণির জন্য। দেশের সব জনগণ শাসকদের অধীন। শাসক ইনসাফ পরিহার করলে তার ভোগান্তি পোহাতে হয় দেশের সকল জনগণকে। ফলে তাকে এ পাপের দরুন সকল জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। দায় থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত জাহান্নাম থেকে তার মুক্তিও আটকে যায়। এ অবস্থায় আখিরাতে মুক্তির কী উপায়? তাই শাসকশ্রেণির খুব সাবধান হওয়া দরকার যাতে কানওভাবেই কোনও ক্ষেত্রে তারা ন্যায় ও ইনসাফের গণ্ডি অতিক্রম করে না ফেলে।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. আমাদেরকে অবশ্যই জীবনের সকল ক্ষেত্রে সকলের সঙ্গে ন্যায় ও ইনসাফ রক্ষা করে চলতে হবে।
খ. শাসকশ্রেণির জন্য ন্যায় ও ইনসাফ রক্ষা করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আখিরাতে তাদের মুক্তিলাভ করা না করার একটা বড় সম্পর্ক এর সঙ্গে রয়েছে।
গ. ন্যায় ও ইনসাফ রক্ষা করার দ্বারা আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যায়।
আল্লাহর রহমতের ছায়ায় সাত শ্রেণির লোকের স্থানলাভ ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের মর্যাদা
হাদীছ নং: ৬৫৮

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সাত ব্যক্তি এমন যাদেরকে আল্লাহ সেই দিন নিজ (আরশের) ছায়ায় স্থান দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া অন্য কোনও ছায়া থাকবে না। তারা হল- ন্যায়পরায়ণ শাসক; ওই যুবক যে মহান আল্লাহর ইবাদতের ভেতর বেড়ে ওঠে; ওই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে ঝুলন্ত; ওই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে একে অন্যকে ভালোবাসে, তাঁরই জন্য একত্র হয় এবং তাঁরই জন্য পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়; ওই ব্যক্তি যাকে কোনও খান্দানি ও সুন্দরী নারী ডাকে আর উত্তরে সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি; ওই ব্যক্তি যে-কোনও দান-সদাকা করে, আর সে তা এমনভাবে গোপন করে যে, তার বাম হাত জানে না ডান হাত কী ব্যয় করে; এবং ওই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে আর তার দুই চোখ অশ্রুপ্লাবিত হয়। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৬৬০; সহীহ মুসলিম: ১০৩১; সুনানে নাসাঈ: ৫৩৮০; জামে তিরমিযী: ২৩৯১ মুসনাদে আহমাদ: ৯৬৬৫; সহীহ ইবন খুজায়মা ৩৫৮; সহীহ ইবন হিব্বান: ৪৪৮৬ তাবারানী, আল-মুজামুল আওসাত: ৬৩২৪; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা: ৪৯৮৭)
مقدمة الامام النووي
79 - باب الوالي العادل
قَالَ الله تَعَالَى: {إنَّ اللهَ يَأمُرُ بِالعَدْلِ وَالإِحْسَانِ} [النحل: 90] الآية، وقال تَعَالَى: {وَأَقْسِطُوا إنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ} [الحجرات: 9].
658 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - عن النبيِّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ الله في ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ: إِمَامٌ عادِلٌ، وَشَابٌ نَشَأ في عِبادة الله تَعَالَى، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ في المَسَاجِدِ، وَرَجُلانِ تَحَابَّا في اللهِ اجتَمَعَا عَلَيْهِ، وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأةٌ ذاتُ مَنْصِبٍ وجَمالٍ، فَقَالَ: إنّي أخافُ اللهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ الله خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৬৫৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৯ ন্যায়পরায়ণ শাসক
ন্যায়-ইনসাফ রক্ষাকারীদের পরকালীন মর্যাদা
হাদীছ নং: ৬৫৯

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই ন্যায়-ইনসাফকারীগণ আল্লাহর কাছে নূরের মিম্বরে আসন গ্রহণ করবে, যারা ইনসাফ রক্ষা করে তাদের বিচার ও শাসনকার্যে, তাদের পরিবার-পরিজনে এবং যা-কিছুর উপর তারা দায়িত্বশীল তাতে। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম : ১৮২৭; জামে' তিরমিযী: ২৫৪৯; সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪৩৩৬; মুসনাদে আহমাদ : ৬৪৯২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৩৪০৩৫; মুসনাদুল বাযযার : ৬১৯৬; সুনানে নাসাঈ : ৫৩৭৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৪৭০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০১৬২)
مقدمة الامام النووي
79 - باب الوالي العادل
659 - وعن عبدِ اللهِ بن عَمرو بن العاص رضي الله عنهما، قَالَ: قَالَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم: «إنَّ المُقْسِطِينَ عِنْدَ اللهِ عَلَى مَنَابِرَ مِنْ نُورٍ: الَّذِينَ يَعْدِلُونَ في حُكْمِهِمْ وأَهْلِيْهِم وَمَا وَلُوْا». رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ৬৬০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭৯ ন্যায়পরায়ণ শাসক
উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট শাসকের পরিচয় এবং জালেম শাসকের ক্ষেত্রে জনগণের করণীয়
হাদীছ নং: ৬৬০

হযরত আওফ ইবন মালিক রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমাদের শ্রেষ্ঠ নেতৃবর্গ তারা, যাদেরকে তোমরা ভালোবাস এবং তারাও তোমাদের ভালোবাসে, তারা তোমাদের জন্য নেক দু'আ করে এবং তাদের জন্যও তোমরা নেক দু'আ কর। আর তোমাদের নিকৃষ্ট নেতৃবর্গ তারা, যাদেরকে তোমরা ঘৃণা কর এবং তারাও তোমাদের ঘৃণা করে, যাদের প্রতি তোমরা লা'নত কর এবং তারাও তোমাদের প্রতি লা'নত করে। আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি তরবারি দ্বারা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করব না? তিনি বললেন, না, যতক্ষণ তারা তোমাদের মধ্যে নামায কায়েম করে। তোমরা যখন তোমাদের শাসকবর্গদের পক্ষ থেকে এমন কিছু দেখবে, যা তোমরা অপসন্দ কর, তখন তোমরা তাদের কাজ অপসন্দ করবে, কিন্তু আনুগত্য থেকে হাত সরিয়ে নেবে না। -মুসলিম
(মুসলিম : ১৮৫৫; মুসনাদুল বাযযার: ২৭৫২; সুনানে দারিমী: ২৮৩৫; মুসনাদে ইসহাক ইবন রাহুয়াহ: ১৮৯৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১১৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৬৬২৩)
مقدمة الامام النووي
79 - باب الوالي العادل
660 - وعن عوفِ بن مَالِكٍ - رضي الله عنه - قَالَ: سَمِعْتُ رسولَ الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «خِيَارُ أئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُحِبُّونَهُمْ وَيُحِبُّونَكُمْ، وَتُصَلُّونَ عَلَيْهِمْ وَيُصَلُّونَ عَلَيْكُمْ. وشِرَارُ أئِمَّتِكُم [ص:214] الَّذِينَ تُبْغِضُونَهُمْ وَيُبْغِضُونَكُمْ، وَتَلعَنُونَهُمْ وَيَلْعَنُونَكُمْ!»، قَالَ: قُلْنَا: يَا رسول اللهِ، أفَلاَ نُنَابِذُهُم؟ قَالَ: «لاَ، مَا أقَامُوا فِيْكُمُ الصَّلاَةَ. لاَ، مَا أقَامُوا فِيكُمُ الصَّلاَةَ». رواه مسلم. (1)
قَوْله: «تصلّون عَلَيْهِمْ»: تدعون لَهُمْ.