রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين
ভূমিকা অধ্যায় - এর পরিচ্ছেদসমূহ
মোট হাদীস ৬৭৯ টি
হাদীস নং: ৬০১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ যে ব্যক্তি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করতে সক্ষম এবং অন্যকে কষ্ট দেওয়া হতে নিজেকে বিরত রাখে ও নিজে অন্যের থেকে কষ্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে সবর করে তার জন্য মানুষের সঙ্গে মিলামিশে থাকা, জুমু‘আ, জামাত, ভালো কাজের জমায়েত এবং যিকির ও ইলমের মজলিসে উপস্থিত থাকা, রোগী দেখতে যাওয়া, জানাযায় হাজির হওয়া, অভাবগ্রস্তের প্রতি সহমর্মিতা জানানো, অজ্ঞজনদের সঠিক পথ দেখানো ও অন্যান্য কল্যাণকর কাজে অংশগ্রহণ করার ফযীলত
স্বাভাবিক অবস্থায় নির্জন ও নিঃসঙ্গ জীবনযাপন না করে পারিবারিক জীবনযাপন করা ও জনসমাজের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই উত্তম। এর অনেক ফযীলত রয়েছে। কেননা এভাবে জীবনযাপন করলে এমন অনেক নেককাজ করা সম্ভব হয়, যা নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। যেমন-
(ক) জুমু‘আ ও জামাতে অংশগ্রহণ করা। জুমু‘আর নামায সর্বশ্রেষ্ঠ নামায। এর ফযীলত বিপুল। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
الْجُمْعَةُ إِلَى الْجُمْعَةِ، كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُنَّ، مَا لَمْ تُغْشَ الْكَبَائِرُ
‘এক জুমু'আ অপর জুমু'আ পর্যন্ত তার মধ্যবর্তী পাপসমূহের মোচনকারী, যাবৎ না কবীরা গুনাহ করা হয়।(সহীহ মুসলিম: ২৩৩; সুনানে ইবন মাজাহ ৫৯৮; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৫৫৮৮; মুসনাদে আহমাদ: ৭১২৯; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৬৪৮৬; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৩৫০৪)
অপর এক হাদীছে ইরশাদ-
مَنْ غَسَّلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَاغْتَسَلَ، وَبَكَّرَ وَابْتَكَرَ، وَمَشَى وَلَمْ يَرْكَبْ، وَدَنَا مِنَ الْإِمَامِ، فَاسْتَمَعَ وَلَمْ يَلْغُ ، كَانَ لَهُ بِكُلِّ خَطْوَةٍ عَمَلُ سَنَةٍ، أَجْرُ صِيَامِهَا وَقِيَامِهَا
‘জুমু'আর দিন যে ব্যক্তি নিজ মাথা ধোয় ও গোসল করে, আগে আগে মসজিদে যায়, খুতবার শুরু ধরতে পারে, পায়ে হেঁটে যায়, বাহনে চড়ে না, ইমামের কাছে গিয়ে বসে, খুতবা শোনে এবং কোনও নিরর্থক কাজ করে না, সে তার প্রতি কদমে পূর্ণ এক বছর রোযা রাখার ও রাত জেগে নামায পড়ার ছাওয়াব অর্জন করে।(সুনানে ইবন মাজাহ ১০৮৭; সুনানে আবু দাউদ: ৩৪৫; জামে তিরমিযী: ৫০২; মুসনাদে আহমাদ: ১৬১৭৩; সহীহ ইবন হিব্বান ২৭৮১)
বলাবাহুল্য জুমু‘আর নামায একাকী পড়া যায় না। আর পাঁচ ওয়াক্ত নামায একাকী পড়া যায় বটে, কিন্তু জামাতে পড়ার যে বিপুল ছাওয়াব রয়েছে তা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। জামাতে নামায আদায় করা সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ করা হয়েছে-
صَلَاةُ أَحَدِكُمْ فِي جَمَاعَةٍ ، تَزِيدُ عَلَى صَلَاتِهِ فِي سُوْقِهِ وَبَيْتِهِ بِضْعًا وَعِشْرِينَ دَرَجَةً
‘তোমাদের কারও বাজারে বা নিজ ঘরে নামায আদায় অপেক্ষা জামাতে নামায আদায়ের ছাওয়াব বিশ গুণেরও বেশি (অর্থাৎ সাতাশ গুণ) হয়ে থাকে।(সহীহ বুখারী: ২১১৯; সহীহ মুসলিম: ৬৪৯; সুনানে আবু দাউদ: ৫৫৯; সুনানে ইবন মাজাহ: ৭৮৬; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী: ২৫৩৪; মুসনাদে আহমাদ: ৮৩৯০; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ১০১১)
(খ) ভালো কাজের জমায়েতে অংশগ্রহণ। যেমন কোনও পরামর্শসভায় শরীক হওয়া, ঈদ ও সূর্যগ্রহণের নামাযে অংশগ্রহণ করা...- এর প্রত্যেকটিতেই প্রচুর ছাওয়াব পাওয়া যায়। একাকী থাকলে সে ছাওয়াব থেকে মাহরুম থাকতে হয়।
(গ) ইলমের মজলিসে উপস্থিত থাকা। সহীহ নিয়তে ইলমের মজলিসে অংশগ্রহণের অনেক বড় ফযীলত রয়েছে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
وَما اجْتَمع قَوْمٌ في بَيْتٍ مِن بُيُوتِ اللهِ، يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَهُ بيْنَهُمْ؛ إِلَّا نَزَلَتْ عليهمِ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَحَفَّتْهُمُ المَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَن عِنْدَهُ
‘কোনও লোকসমষ্টি আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোনও একটি ঘরে একত্র হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত এবং নিজেদের মধ্যে তার পঠন-পাঠনে মশগুল থাকলে তাদের উপর সাকীনা নাযিল হয়, রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়, ফিরিশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখেন এবং আল্লাহ তার কাছে উপস্থিত (ফিরিশতা)-দের মধ্যে তাদের উল্লেখ করেন।(সহীহ মুসলিম: ২৬৯৯; জামে তিরমিযী: ২৯৪৫; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ১০৭৩৭; সুনানে ইবনে মাজাহ: ২২৫; বাগাবী, শারহুস্সুন্নাহ: ১২৭; মুসনাদে আহমাদ: ৭৪২৭)
(ঘ) যিকিরের মজলিসে উপস্থিত থাকা। যিকিরের মজলিসের ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে আছে, হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
“আল্লাহ তা'আলার একদল বিচরণরত অতিরিক্ত ফিরিশতা আছে। তারা আল্লাহর যিকিরের মজলিসসমূহ সন্ধান করে থাকে। যখনই কোথাও এমন মজলিস পায়, যেখানে আল্লাহ তা'আলার যিকির হয়, তারা যিকিরকারীদের সঙ্গে বসে যায়। তারপর তারা তাদের পরস্পরের ডানা মিলিয়ে সে মজলিস ঘিরে ফেলে। এভাবে তারা তাদের ও প্রথম আকাশের মধ্যবর্তী সবটা স্থান ভরে ফেলে। যখন যিকিরকারীগণ মজলিস ত্যাগ করে, তখন তারা আকাশে উঠে যায়। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন- অথচ তিনিই ভালো জানেন, তোমরা কোথা থেকে এসেছ? তারা বলে, আমরা পৃথিবীতে অবস্থিত আপনার একদল বান্দার কাছ থেকে এসেছি। তারা আপনার সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করছিল আর তারা আপনার কাছে প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা আমার কাছে কী প্রার্থনা করছিল? তারা বলে, আপনার কাছে আপনার জান্নাত প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা কি আমার জান্নাত দেখেছে? তারা বলে, হে প্রতিপালক! তারা দেখেনি। তিনি জিজ্ঞেস করেন, যদি তারা জান্নাত দেখত, তবে কেমন হতো? তারপর তারা বলে, তারা আপনার কাছে আশ্রয়ও প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা আমার কাছে কিসের থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছিল? তারা বলে, হে প্রতিপালক! তারা আপনার জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা কি আমার জাহান্নাম দেখেছে? তারা বলে, না। তিনি বলেন, যদি তারা আমার জান্নাত দেখত, তবে কেমন হতো? তারপর তারা বলে, তারা আপনার কাছে ক্ষমাও প্রার্থনা করছিল। তিনি বলেন, আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। তারা যা চেয়েছে তা তাদেরকে দিলাম এবং তারা যা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে, তা থেকেও আমি তাদেরকে আশ্রয় দান করলাম। তখন তারা বলে, হে প্রতিপালক! তাদের মধ্যে অমুক এক গুনাহগার বান্দাও আছে। সে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তাদের সঙ্গে বসে পড়ে। তিনি বলেন, তাকেও ক্ষমা করে দিলাম। তারা এমন একটি দল, যাদের (মর্যাদার) কারণে তাদের সঙ্গে উপবেসনকারীও বঞ্চিত হয় না।(সহীহ মুসলিম: ২৬৮৯; মুসনাদে আহমাদ: ৭৪২০; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৫৫৬; হাকিম, আল মস্তাদরাক; ১৮২১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১২৪১)
(ঙ) রোগী দেখতে যাওয়া। রোগী দেখতে যাওয়ারও বিপুল ছাওয়াব রয়েছে। এক হাদীছে ইরশাদ-
مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخَا لَهُ فِي اللهِ ، نَادَاهُ مُنَادٍ : بِأَنْ طِبْتَ، وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الْجَنَّةِ مَنْزِلًا
যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোনও রোগী দেখতে যায় বা তার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, এক ঘোষক তাকে ডেকে বলে, তুমি আনন্দিত হও, তোমার চলা কল্যাণকর হোক এবং তুমি জান্নাতে ঠিকানা লাভ করো।(জামে তিরমিযী: ২০০৮; মুসনাদে আহমাদ: ৮৫৩৬; সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৪৪৩; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৯১৬১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৬১০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৪৭২)
(চ) জানাযায় হাজির হওয়া। জানাযায় হাজির হওয়ার ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ صَلَّى عَلَى جَنَازَةٍ فَلَهُ قِيرَاطٌ ، فَإِنْ شَهِدَ دَفْنَهَا فَلَهُ قِيرَاطَانِ ، الْقِيْرَاطُ مِثْلُ أُحُدٍ
‘যে ব্যক্তি কারও জানাযার নামায পড়ে, তার জন্য রয়েছে এক কীরাত ছাওয়াব। আর যে ব্যক্তি তার দাফনেও অংশগ্রহণ করে, তার জন্য রয়েছে দুই কীরাত ছাওয়াব। আর কীরাত হল উহুদ পাহাড় পরিমাণ।(সহীহ মুসলিম: ৯৪৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৫৪১; সুনানে নাসাঈ: ১৯৯৫; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৬২৭০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১১৬১৫; মুসনাদে আহমাদ: ৪৪৫৪)
(ছ) অভাবগ্রস্তের প্রতি সহমর্মিতা জানানো। এক হাদীছে আছে-
مَن كانَ في حاجَةِ أخِيهِ كانَ اللَّهُ في حاجَتِهِ، ومَن فَرَّجَ عن مُسْلِمٍ كُرْبَةً، فَرَّجَ اللَّهُ عنْه بها كُرْبَةً مِن كُرَبِ يَومِ القِيامَةِ
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধায় রত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের কোনও একটি বিপদ দূর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করে দেবেন।(সহীহ বুখারী: ২৪৪২; সহীহ মুসলিম: ২৫৮০; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৮৯৩; জামে তিরমিযী: ১৪২৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ২২৫; মুসনাদে আহমাদ: ৫৬৪৬)
(জ) সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের মাধ্যমে অজ্ঞজনদের সঠিক পথ দেখানো। এটা প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব। আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এ দায়িত্ব পালন করা প্রত্যেকের জরুরি। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَن رَأَى مِنكُم مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بيَدِهِ، فإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسانِهِ، فإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وذلكَ أضْعَفُ الإيمانِ
তোমাদের মধ্যে কেউ কোনও অন্যায় কাজ হতে দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে তা না পারে, তবে মুখের কথা দ্বারা (প্রতিহত করে)। যদি তাও না পারে, তবে অন্তর দ্বারা। আর এটা হল ঈমানের দুর্বলতম স্তর।(সহীহ মুসলিম : ৪৯; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪০১৩; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩০৭; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৭১৫৩; আস সুনানুল কুবরা: ১১৫১৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪১৫৭)
(ঝ) অন্যান্য কল্যাণকর কাজে অংশগ্রহণ করা। জনকল্যাণমূলক প্রতিটি কাজই গুরুত্বপূর্ণ। তার অনেক ছাওয়াব। এরূপ কাজ আছে নানারকম। যেমন রাস্তাঘাট তৈরি করা, সেতু নির্মাণ করা, মানুষের পানির ব্যবস্থা করা, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, পথভোলা লোককে পথ দেখিয়ে দেওয়া, মানুষের মাথায় বোঝা তুলে দেওয়া বা মাথা থেকে নামিয়ে দেওয়া, অন্ধ ও বিকলাঙ্গকে রাস্তা পার করিয়ে দেওয়া, যাদের বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই তাদের খোঁজখবর নেওয়া ইত্যাদি। লোকালয় ছেড়ে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করলে এসব কাজ করার সুযোগ হয় না।
(ঞ) অন্যকে কষ্ট দেওয়া হতে নিজেকে বিরত রাখা। এটাও একটি পুণ্যের কাজ। যে ব্যক্তি অন্যের সেবা করার ক্ষমতা রাখে না, সে যদি অন্ততপক্ষে এতটুকুও করে যে, তার দ্বারা যাতে কেউ কষ্ট না পায় সেদিকে লক্ষ রাখে, তবে তাও অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। লোকসমাজে মিলেমিশে থাকার দ্বারাই এ কাজ করার সুযোগ হয়। হযরত আবূ যার রাযি. থেকে বর্ণিত-
سَأَلْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ العَمَلِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «إِيمَانٌ بِاللَّهِ، وَجِهَادٌ فِي سَبِيلِهِ» ، قُلْتُ: فَأَيُّ الرِّقَابِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «أَعْلاَهَا ثَمَنًا، وَأَنْفَسُهَا عِنْدَ أَهْلِهَا» ، قُلْتُ: فَإِنْ لَمْ أَفْعَلْ؟ قَالَ: «تُعِينُ ضَايِعًا، أَوْ تَصْنَعُ لِأَخْرَقَ» ،: قَالَ: فَإِنْ لَمْ أَفْعَلْ؟ قَالَ: «تَدَعُ النَّاسَ مِنَ الشَّرِّ، فَإِنَّهَا صَدَقَةٌ تَصَدَّقُ بِهَا عَلَى نَفْسِكَ
‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, সর্বোত্তম আমল কী? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর পথে জিহাদ। তারপর বললাম, কোন দাসমুক্তি উত্তম? তিনি বললেন, যার দাম বেশি এবং যে তার মনিবের কাছে বেশি প্রিয়। বললাম, যদি আমি তা না পারি? তিনি বললেন, দুর্বলকে সাহায্য করবে কিংবা যে ভালো কাজ জানে না তার সহযোগিতা করবে। বললাম, যদি তা না পারি? তিনি বললেন, মানুষকে তোমার অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবে। এটাও একটি সদাকা, যা দ্বারা তুমি নিজের প্রতি সদাকা করতে পার।’(সহীহ বুখারী: ২৫১৮; সহীহ মুসলিম: ৮৪; মুসনাদুল বাযযার: ৪০৩৮; সহীহ ইবন হিব্বান: ৪৩১০; শু'আবুল ঈমান: ৪০৩৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৪১৮; মুসনাদুল হুমায়দী: ১৩১)
(ট) অন্যের থেকে কষ্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে সবর করা। অন্য কেউ কষ্ট দিলে তাতে সবর করাও একটি ফযীলতের কাজ। এ কাজ লোকসমাজে মিলেমিশে থাকার দ্বারাই সম্ভব হয়। এর ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
اَلْمُؤْمِنُ اَلَّذِي يُخَالِطُ اَلنَّاسَ, وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ خَيْرٌ مِنْ اَلَّذِي لَا يُخَالِطُ اَلنَّاسَ وَلَا يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ
‘যে মুসলিম মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে এবং তারা কষ্ট দিলে তাতে সবর করে, সে ওই মুসলিম অপেক্ষা উত্তম, যে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে না এবং তারা কষ্ট দিলে তাতে তার সবর করারও অবকাশ হয় না।’(জামে' তিরমিযী: ২৫০৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০১৭৪; শু'আবুল ঈমান: ৯২৭৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৮৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৬২২০; মুসনাদে আহমাদ: ৫০২২)
উক্ত অধ্যায়শিরোনামের পর ইমাম নাওয়াবী রহ. বলেন-
اعْلَمْ: أَنَّ الْاخْتِلَاطَ بِالنَّاسِ عَلَى الْوَجْهِ الَّذِي ذَكَرْتُهُ هُوَ الْمِختَارُ الَّذِي كَانَ عَلَيْهِ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ ، وَسَائِرُ الْأَنْبِيَاءِ صَلَوَاتُ اللهِ وَسَلَامُهُ عَلَيْهِمْ، وَكَذَلِكَ الْخُلَفَاءُ الرَّاشِدُونَ، وَمَنْ بَعْدَهُمْ مِنَ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِيْنَ، وَمَنْ بَعْدَهُمْ مِنْ عُلَمَاءِ الْمُسْلِمِينَ وَأَخْيَارِهِمْ، وَهُوَ مَذْهَبُ أَكْثَرِ التَّابِعِينَ وَمَنْ بَعْدَهُمْ ، وَبِهِ قَالَ الشَّافِعِيُّ وَأَحْمَدُ وَأَكْثَرُ الْفُقَهَاءِ أَجْمَعِينَ
'জ্ঞাতব্য যে, উপরে যেভাবে বললাম, সেভাবে মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই শরী'আতে পসন্দনীয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য নবীগণের এটাই আদর্শ। খুলাফায়ে রাশিদীনসহ অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন ও তাদের পরবর্তী উলামায়ে কেরাম ও শ্রেষ্ঠ মুসলিমগণ এ নীতির উপরই ছিলেন। এটাই অধিকাংশ তাবি'ঈ ও তাদের পরবর্তী মনীষীদের মত। ইমাম শাফি'ঈ, ইমাম আহমাদ ও অধিকাংশ ফকীহ এ মতই ব্যক্ত করেছেন।’
ইমাম নাওয়াবী রহ. এই যে কথা বলেছেন, সামাজিক জীব হিসেবে সাধারণ অবস্থায় মানুষের জন্য এটাই প্রযোজ্য। কেননা প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য আছে।নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করলে সে দায়িত্বপালন সম্ভব হয় না। তবে সমাজজীবনে মিলেমিশে থাকার ভেতর দিয়েও এক রকম নিঃসঙ্গতা রক্ষা জরুরি। তা হল হৃদয়মনের নিঃসঙ্গতা। অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা থাকবে আর অন্তর থাকবে সর্বদা আল্লাহ অভিমুখী। মানুষের পার্থিব ঐশ্বর্য ও চাকচিক্য যাতে অন্তরে প্রভাব বিস্তার না করে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। দুনিয়াদারী ও শরী'আতবিরোধী কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রভাবিত হওয়া তো নয়ই; বরং অন্তরে থাকবে তার প্রতি ঘৃণা ও অসন্তুষ্টি। মানুষ ভালো কাজ করলে তার প্রতি সমর্থন জানানো হবে, অন্যায় করলে প্রতিবাদ করা হবে। তাদের অন্যায়-অপরাধের সঙ্গে কোনওভাবেই নিজেকে যুক্ত রাখা যাবে না। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. বলেন, তুমি যখন মানুষের সঙ্গে থাকবে, তখন মানুষ আল্লাহর যিকিরে রত থাকলে তুমিও তাদের সঙ্গে যিকিরে রত থাকবে। আর তারা অন্য কিছুতে লিপ্ত হলে তুমি তা থেকে পাশ কাটিয়ে চলবে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ (68)
‘যারা আমার আয়াতের সমালোচনায় রত থাকে, তাদেরকে যখন দেখবে তখন তাদের থেকে দূরে সরে যাবে, যতক্ষণ না তারা অন্য বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়। যদি শয়তান কখনও তোমাকে (এটা) ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণ হওয়ার পর জালেম লোকদের সাথে বসবে না।(সূরা আন‘আম (৬), আয়াত ৬৮)
একবার জনৈক ব্যক্তি ওয়াহাব ইবন মুনাব্বিহ রহ.-এর কাছে এসে বলল, মানুষ এখন যা-কিছুতে লিপ্ত তা আপনি দেখছেন। এ অবস্থায় আমি ভাবছি তাদের সঙ্গে আর মেলামেশা করব না। তিনি বললেন, এমনটি করো না। কেননা তোমার মানুষের প্রয়োজন রয়েছে আর মানুষেরও তোমাকে প্রয়োজন রয়েছে। তোমাকে ছাড়া তাদের চলবে না, তাদেরকে ছাড়াও তোমার চলবে না। তুমি বরং তাদের মধ্যে থাকবে (মন্দ কথার ক্ষেত্রে) বধির হয়ে, (ভালো কথার ক্ষেত্রে) শ্রবণশক্তিসম্পন্ন হয়ে। (মন্দ কাজের ক্ষেত্রে) অন্ধ হয়ে আর (ভালো কাজের ক্ষেত্রে) দৃষ্টিমান হয়ে এবং একইভাবে নীরব ও কথক হয়ে।
বস্তুত সমাজজীবন যাপনে এটাই মূলনীতি। ব্যাপক ফিতনা-ফাসাদ না হলে সমাজজীবন যাপন করাই বাঞ্ছনীয়। তবে সে ক্ষেত্রে অন্যের দ্বারা যাতে নিজ ঈমান ও আমল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; বরং নিজ ঈমান ও আমল দ্বারা অন্যে উপকৃত হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। আর এটা উল্লিখিত মূলনীতির অনুসরণ দ্বারাই সম্ভব। সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন, তাবে-তাবি'ঈন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীনসহ প্রতি যুগের অনুসরণীয় উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীন তাঁদের জীবনযাপনে এ নীতিই অনুসরণ করেছেন। তাঁরাই আমাদের আদর্শ। আমাদেরকেও এ অনুসারেই পার্থিব জীবন যাপন করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
‘মানুষের সঙ্গে মিলামিশে... থাকার ফযীলত’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى
অর্থ: তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ২)
ব্যাখ্যা
البر বলা হয় ওই সকল কাজ করাকে, শরী'আতের পক্ষ থেকে যা করতে আদেশ করা হয়েছে, যথা- নামায পড়া, যাকাত দেওয়া, রোযা রাখা, হজ্জ করা, পর্দা করা, হালাল খাওয়া, পিতা-মাতার হুকুম মানা, বড়কে সম্মান করা, ছোটকে স্নেহ করা, আলেমদের মর্যাদা দেওয়া ইত্যাদি।
التقوى হল ওই সকল কাজ থেকে বিরত থাকা, যা করতে শরী'আতে নিষেধ করা হয়েছে, যেমন- জুয়া খেলা, মাদক সেবন করা, চুরি করা, সুদ-ঘুষ খাওয়া, জুলুম করা, অমুসলিমদের অনুকরণ করা, নাচ, গান ও অশ্লীল কাজ করা ইত্যাদি।
শরী'আতের যাবতীয় বিষয় এ দু'টি শব্দের মধ্যে এসে গেছে। এতে আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে, আমরা যেন করণীয় ও বর্জনীয় যাবতীয় বিষয়ে একে অন্যকে সাহায্য করি। এ সাহায্য হয় দীনী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখার দ্বারা, বিশেষত মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, মক্তব ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করা, দীনী পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা ও দাওয়াতী মেহনত পরিচালনা করার দ্বারা। এমনিভাবে নেক আমলের প্রতি উৎসাহ দেওয়া এবং কারও নেক আমলের পক্ষে যা-কিছু বাধা হয় তা অপসারণ করার দ্বারাও সৎকর্ম ও তাকওয়া অবলম্বনে সহযোগিতা করা হয়।
সমাজে এমন অনেক কিছুই চালু আছে, যার সংস্পর্শে এসে মানুষ সৎকর্মের উৎসাহ হারায় এবং অসৎকর্মে লিপ্ত হওয়ার উসকানি পায়। সুতরাং সৎকর্ম ও তাকওয়া- পরহেযগারীতে সহযোগিতা করার জন্য সচেতন মহলের কর্তব্য শরী'আতবিরোধী কর্মকাণ্ডের দুনিয়াবী ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা এবং শরী'আতবিরোধী কার্যকলাপের আখড়া ও কেন্দ্রসমূহ উৎখাতে নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা চালানো। অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের দীনদারীতে পিতা-মাতাও বাধা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে বোঝানোর চেষ্টা করাও অবশ্যকর্তব্য।
এ আয়াতে একে অন্যকে সাহায্য করতে বলা হয়েছে কেবল নেককাজ ও তাকওয়া- পরহেযগারীতে। সুতরাং নির্দেশনা পাওয়া গেল যে, কোনও কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য কেবল তখনই করা যাবে, যখন সে কাজটি শরী'আত মোতাবেক হবে। যদি তা শরী'আত মোতাবেক না হয় তবে কোনও অবস্থাতেই সে কাজে সাহায্য করা যাবে না, তাতে সাহায্যপ্রার্থী যত আপন লোকই হোক না কেন। সুতরাং আলোচ্য আয়াতেরই পরবর্তী অংশে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ
‘গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না।’
যেহেতু এ আয়াতে নেককাজ ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে একে অন্যকে সাহায্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাই আপন আপন শক্তি ও ক্ষমতা অনুযায়ী এটা করা প্রত্যেকের জন্য অবশ্যকর্তব্য। আলেমের কর্তব্য আপন ইলম দ্বারা মানুষের সৎকর্ম ও তাকওয়া অবলম্বনে ভূমিকা রাখা। সমাজের ধনী ও বিত্তবানদের কর্তব্য আপন ধন- সম্পদ দ্বারা সৎকর্ম ও তাকওয়া-পরহেযগারীর বিস্তারে সহযোগিতা করা। যারা সাহসী ও শক্তিমান, তাদের কর্তব্য সৎকর্ম ও তাকওয়ার প্রচার-প্রতিষ্ঠায় আপন শক্তিকে কাজে লাগানো। এভাবে যার যে ক্ষমতা ও সামর্থ্য আছে, তা দ্বারাই পারস্পরিক সৎকর্ম ও তাকওয়ার অর্জন ও সুরক্ষায় সাহায্য-সহযোগিতা করা একান্ত কর্তব্য।
বলাবাহুল্য এসকল দায়িত্ব পালন কেবল তখনই সম্ভব হয়, যখন সমাজ ও সমষ্টির একজনরূপে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা হয়। নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করলে এসব দায়িত্ব পালনের কোনও অবকাশই আসে না। একজন মুমিন ও মুসলিমরূপে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করা, একতাবদ্ধ জীবনযাপন করা, সৎকর্মে পরস্পরে সহযোগিতা করা ও অসৎকর্ম প্রতিরোধ করা যে অবশ্যপালনীয় কর্তব্য, তা কেবল এই এক আয়াতই নয়, কুরআন ও হাদীছের বিভিন্ন বাণী দ্বারা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
‘(হে মুসলিমগণ!) তোমরা সেই শ্রেষ্ঠতম দল, মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের অস্তিত্ব দান করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করে থাক ও অন্যায় কাজে বাধা দিয়ে থাক।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১১০)
সূরা 'আসূরে ইরশাদ হয়েছে-
وَالْعَصْرِ (1) إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ (2) إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (3)
‘কালের শপথ! বস্তুত মানুষ অতি ক্ষতির মধ্যে আছে। তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং একে অন্যকে সত্যের উপদেশ দেয় ও একে অন্যকে সবরের উপদেশ দেয়।’
অন্যত্র ইরশাদ-
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ (33) وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ (34) وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (35)
‘তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে ডাকে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি আনুগত্য স্বীকারকারীদের একজন। ভালো ও মন্দ সমান হয় না। তুমি মন্দকে প্রতিহত করো এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট। ফলে যার ও তোমার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সবর করে এবং এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয় যারা মহাভাগ্যবান।’(সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ৩৩-৩৫)
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
‘আল্লাহর রশিকে (অর্থাৎ তাঁর দীন ও কিতাবকে) দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো এবং পরস্পরে বিভেদ করো না।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১০৩)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. সাধারণ অবস্থায় নিঃসঙ্গ না থেকে অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা বাঞ্ছনীয়।
খ. সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার ক্ষেত্রে পরস্পরে সৎকর্ম ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে সহযোগিতা করা ঈমানের দাবি।
গ. সৎকর্ম ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য কোনটা সৎকর্ম ও কোনটা অসৎকর্ম, তা স্পষ্টভাবে জেনে নিতে হবে।
ঘ. কোনওক্রমেই যাতে শরী'আতবিরোধী কাজে সহযোগিতা না করা হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা খুবই জরুরি।
অধ্যায় : ৭১
মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ
اَلتوَاضُعُ (তাওয়াযু‘) শব্দের উৎপত্তি ضعة থেকে। এর অর্থ হীনতা ও নমনীয়তা। তাওয়াযু'র শাব্দিক অর্থ নিজ ক্ষুদ্রতা, বিনয় ও নমনিয়তা প্রকাশ করা। তাওয়াযু' বা বিনয়ের পারিভাষিক অর্থ হল, নিজের তুলনায় যার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লক্ষ করা যায় তাকে সম্মান করা। কারও মতে যাকে সম্মান দেখানো হয়, তার নিজেকে সে তুলনায় নিম্নস্তরের বলে প্রকাশ করাকে তাওয়াযু' বলে। ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাওয়াযু' কাকে বলে? তিনি বলেন, সত্যের সামনে নতিস্বীকার করা এবং যে-ই তা বলুক না কেন তা গ্রহণ করে নেওয়া।
হাসান বসরী রহ. বলেন, তাওয়াযু‘ হল এই যে, তুমি ঘর থেকে বের হয়ে যে-কোনও মুসলিমের সাক্ষাৎ পাবে, মনে করবে সে কোনও না কোনওভাবে তোমার চেয়ে উত্তম।
আবু ইয়াযীদ বিস্তামী রহ. *বলেন, কোনও বান্দা যতক্ষণ মনে করবে মানুষের মধ্যে তারচে' নিকৃষ্ট কেউ আছে, ততক্ষণ সে একজন অহংকারী।*(লোকমুখে বায়েযীদ বুস্তামী নামে বেশি প্রসিদ্ধ। -সম্পাদক)
বলা হয়ে থাকে, তাওয়াযু‘ ও বিনয়ের মধ্যেই মর্যাদা, তাকওয়ার মধ্যেই শক্তি এবং পরিতুষ্টির মধ্যেই স্বাধীনতা।
প্রকৃতপক্ষে তাওয়াযু‘ ও বিনয় হল অন্তরস্থ গুণ। অন্তরে এ গুণ জন্ম নেয় আল্লাহ তা'আলার ও নিজের প্রতি দৃষ্টিপাত থেকে। বান্দা যখন আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর গুণাবলি, তাঁর গৌরব-মহিমা ও দয়া-ভালোবাসা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে, সেইসঙ্গে নিজ সত্তা, নিজ যোগ্যতা ও গুণাবলির ত্রুটি এবং নিজ কর্ম ও চারিত্রিক মন্দত্ব সম্পর্কে অনুধাবন করে, তখন তার অন্তরে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেটাই তাওয়াযু' ও বিনয়। এটি একটি মহৎ গুণ। নিজ আচার-আচরণ দ্বারা এ গুণের প্রকাশ ঘটে। সুতরাং অন্তরে যখন এ গুণ জন্ম নেয়, তখন বান্দা সত্য গ্রহণ করে নিতে দ্বিধাবোধ করে না, তা যেই বলুক, সে বড় হোক বা ছোট, নারী হোক বা পুরুষ, অভিজাত হোক বা সাধারণ, স্বাধীন হোক বা গোলাম। এমনিভাবে সে কাউকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে না; বরং আল্লাহ তা'আলার যে-কোনও বান্দাকেই স্বচ্ছন্দমনে ভাই বলে গণ্য করতে পারে। সে কারও হক নষ্ট করতে পারে না, তা সে হক তার যত বড় শত্রুরই হোক না কেন। এমনিভাবে সে অতি সহজেই যে-কাউকে ক্ষমা করতে পারে, তা যত বড় অপরাধই হোক না কেন।
বিনয় যখন অন্তরের একটা অবস্থা, তখন বিনয়ী ব্যক্তি কখনও মনে করে না সে একজন বিনয়ী। লোকে তার আচরণকে বিনয় মনে করে। কিন্তু সে নিজে তা বিনয় বলে মনে করে না; বরং মনে করে তা-ই ন্যায্য আচরণ, যা তার করাই উচিত ছিল। উলামায়ে কেরাম বলেন, যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে বিনয় আছে বলে মনে করে, প্রকৃতপক্ষে সে একজন অহংকারী। কেননা সে যখন বিনয় প্রদর্শন করে, তখন মনে করে- যে আচরণটা সে করল, সেই তুলনায় তার মর্যাদা আরও উপরে। আর প্রকৃত বিনয়ী ব্যক্তি যখন বিনয় প্রদর্শন করে, তখন ভাবে সে তুলনায় তার মর্যাদা আরও নিচে।
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, এক বিনয় হল ওয়াজিব ও অবশ্যকর্তব্য। আর তা হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার সম্মুখে বিনয়। এমনিভাবে আল্লাহ তা'আলা যাদের সঙ্গে বিনয় অবলম্বন করতে বলেছেন, তাদের সম্মুখেও। যেমন রাসূল, ইমাম (মুসলিম শাসক), আলেম ও পিতা-মাতা।
এছাড়া অন্যসব মানুষের ক্ষেত্রে বিনয়ের বিধান হল এই যে, যদি কেবল আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে তা করা হয়, তবে তা প্রশংসনীয় ও কাম্য। এ বিনয়ের দ্বারা আল্লাহ তা'আলা মানুষের অন্তরে বিনয়ীর প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করেন এবং তাদের কাছে তার সম্মান বৃদ্ধি করেন।
আরেক বিনয় হচ্ছে দুনিয়াদার ও জালেম অত্যাচারীদের সঙ্গে, যা দ্বারা তাদের সুদৃষ্টি লাভ করা উদ্দেশ্য হয়। এরূপ বিনয় নিন্দনীয় ও গর্হিত। এর দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানে নিজ ইজ্জত-সম্মান নষ্ট হয়। কোনও এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি ধনীর ধনের কারণে বিনয় অবলম্বন করে, তার দীনের দুই-তৃতীয়াংশ বরবাদ হয়ে যায়।
‘বিনয়’ ইসলামের এক মৌলিক চারিত্রিক শিক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম বিনয়ী ছিলেন। সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিভিন্ন সময় অন্যান্য নবী-রাসূলগণের ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন। কখনও কখনও তিনি কোনও কোনও নবীকে নিজেরও উপরে মর্যাদাদান করেছেন। তিনি নিজ উম্মতকেও এ গুণ আয়ত্ত করার প্রতি উৎসাহদান করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম উচ্চতর বিনয়ের অধিকারী ছিলেন। প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বিধবা মহিলাদের বাড়িতে গিয়ে ছাগলের দুধ দুইয়ে দিতেন। হযরত উমর ফারুক রাযি. নিজ কাঁধে পানির মশক বহন করেছেন। হযরত উছমান গনী রাযি, অনেক বড় ধনী হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত সাদামাঠা জীবনযাপন করতেন। হযরত আলী রাযি. বাজার থেকে সওদা কিনে নিজে বয়ে নিয়ে আসতেন। হযরত হাসান রাযি. একবার আরোহী অবস্থায় রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন একদল শিশু তাঁর সামনে পড়ল। তাদের কাছে রুটির টুকরো ছিল। তারা তাঁকে তাদের অতিথি হতে আহ্বান জানাল। তিনি বাহন থেকে নেমে তাদের সঙ্গে সেই রুটি খাওয়ায় শরীক হলেন। পরে তিনি তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে উট বোঝাই করে খাদ্য ও পোশাক পাঠিয়ে দিলেন। এ বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেন যে, মহত্ত্ব তাদেরটাই বড়। কারণ তারা তাদের কাছে যা ছিল সবটা দিয়ে আমার মেহমানদারি করেছে। কিন্তু আমি তো তাদের কাছে পাঠিয়েছি আমার যা আছে তার অংশ মাত্র। একবার এক রাতে খলীফা হযরত উমর ইবন আব্দুল আযীয রহ.-এর কাছে এক অতিথি আসল। অতিথি তাঁর সামনে বসা ছিল। এ অবস্থায় বাতি নিভে গেল। অতিথি নিজে তেল ভরে বাতি জ্বালিয়ে দিতে চাইল। তিনি বললেন, অতিথিকে দিয়ে কাজ করানো ভদ্রতা নয়। অতিথি বলল, তবে খাদেমকে ডেকে দিই? তিনি বললেন, সে মাত্র ঘুমিয়েছে। এখন তাকে জাগানো ঠিক হবে না। এই বলে তিনি নিজেই তেল ভরে বাতি জ্বালিয়ে নিলেন। অতিথি বলল, আপনি আমীরুল মুমিনীন হয়েও নিজে কাজ করলেন? তিনি বললেন, আমি যখন বাতি জ্বালাতে গিয়েছি তখনও উমর ছিলাম, আর যখন ফিরে এসেছি তখনও উমরই আছি। কাজ করাতে আমার কিছুই কমে যায়নি।
বস্তুত সব যুগেই প্রকৃত দীনদারগণ এরূপ বিনয়েরই অধিকারী ছিলেন। কুরআন ও হাদীছে এ গুণটির অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। তারা তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ গুণটি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। আমাদেরও কর্তব্য এ গুণ অর্জনের সাধনা করা। সে উদ্দেশ্যেই বর্তমান অধ্যায়ে ইমাম নাওয়াবী রহ. এ সম্পর্কে কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এসব আয়াত ও হাদীছ বোঝার ও এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
‘মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ (215)
অর্থ: আর যে মুমিনগণ তোমার অনুসরণ করে, তাদের সঙ্গে বিনয়-নম্র আচরণ করো।(সূরা শু'আরা (২৬), আয়াত ২১৫)
ব্যাখ্যা
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ এর মূল অর্থ- তোমার ডানা নামিয়ে দাও। মৌলিকভাবে শব্দটি পাখির ডানার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। মানুষের হাত বোঝানোর জন্যও এর ব্যবহার আছে। যেমন কুরআন মাজীদে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি আল্লাহ তা'আলার এক আদেশ উদ্ধৃত হয়েছে যে-
وَاضْمُمْ إِلَيْكَ جَنَاحَكَ مِنَ الرَّهْبِ
‘ভয় দূর করার জন্য তোমার বাহু নিজ শরীরে চেপে ধরো।(সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৩২)
পিতা-মাতার প্রতি কোমল ব্যবহারের নির্দেশ সম্পর্কিত এক আয়াতে ইরশাদ-
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ
‘তাদের প্রতি মমতায় নম্রতার ডানা নামিয়ে দাও।’(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৪)
পাখি যখন নিচে নামে, তখন সে তার ডানা নামিয়ে দেয়। যখন উড়তে শুরু করে, তখন ডানা উঁচু করে দেয়। তো ডানা নামানো যেহেতু নিচে নামার ইঙ্গিত, তাই রূপকার্থে এর দ্বারা বিনয় ও নম্রতা বোঝানো হয়ে থাকে। সে কারণেই অর্থ করা হয়েছে- বিনয়-নম্র আচরণ করো।
‘ডানা নামানো’ দ্বারা মমত্বপূর্ণ আচরণও বোঝানো হয়। পাখি যখন তার ছানাদেরকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়, তখন প্রথমে ডানা বিস্তার করে দেয়, তারপর ছানারা যখন তার শরীরের সঙ্গে এসে মিশে যায়, তখন তাদের উপর তা নামিয়ে দেয়। এটা ছানাদের প্রতি তার মমত্বের আচরণ। নিজ অনুসারী ও অধীন ব্যক্তিবর্গকে অনুরূপ কাছে নিয়ে আসা ও তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করাকে পাখির এ আচরণের সঙ্গে উপমিত করা হয়েছে এবং সে হিসেবেই পাখির জন্য ব্যবহৃত শব্দমালাকে এস্থলে ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং 'মুমিনদের প্রতি ডানা নামিয়ে দাও'-এর অর্থ হবে- যারা তোমার প্রতি ঈমান এনেছে, তুমি তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করো, যাতে তারা তোমার কাছে কাছে থাকে, দূরে সরে না যায়।
বিনয়-নম্রতা ও মমতা কাছাকাছি বিষয়ই। অন্তরে মমতা থাকলেই বিনয়-নম্র আচরণ করা হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি বিনয়-নম্র আচরণ করে, বোঝা যায় তার অন্তরে মমতা আছে। সুতরাং আয়াতটিতে এ দুই অর্থের যেটিই করা হোক তা সঠিকই হবে।
সরাসরি এ আদেশটি করা হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, যাতে তিনি গরীব মুসলিমদের প্রতি নম্রকোমল আচরণ বজায় রাখেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি এই চরিত্রেরই ছিলেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশদান দ্বারা মূলত আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, আমরা যেন একে অন্যের প্রতি কোমল আচরণ করি ও মায়া-মমতার সঙ্গে মিলেমিশে থাকি। যেমন সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ
‘যারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৫৪)
অপর এক আয়াতে আছে-
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
‘মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। তাঁর সঙ্গে যারা আছে, তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং আপসের মধ্যে একে অন্যের প্রতি দয়ার্দ্র।’(সূরা ফাতহ (৪৮), আয়াত ২৯)
যাদের প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিনয় ও নম্র আচরণ করতে বলেছেন, সেই সাহাবীগণ ছিলেন তাঁর অধীন ও অনুসারী। তাঁর ও তাঁদের মধ্যে মর্যাদাগত পার্থক্য ছিল দুস্তর। তা সত্ত্বেও যখন তাঁকে তাঁদের প্রতি বিনয়-নম্র আচরণ করার আদেশ করা হয়েছে, তখন অন্যদের প্রতি এ আদেশ আরও কত বেশি প্রযোজ্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রত্যেকেরই কর্তব্য অধীন ব্যক্তিবর্গের প্রতি মমতাশীল হয়ে থাকা। তাদের প্রতি অহমিকাপূর্ণ আচরণ সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। তাদের সঙ্গে কথা বলা হবে কোমল। আপন কাজ ও আচরণে প্রকাশ পাবে বিনয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে শিক্ষাই আমাদের জন্য রেখে গেছেন।
তাঁর সে শিক্ষার ফল ছিল এই যে, সাহাবীগণও আপন আচার-আচরণে তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ স্তরের বিনয় রক্ষা করতেন। কথা ও কাজে পরিপূর্ণ আদবের দিকে লক্ষ রাখতেন। অধীনদের পক্ষ থেকে বিনয় ও আদবের আচরণ যেমন অভিভাবক ও অধিকর্তার মমত্বপূর্ণ আচরণের সুফল, তেমনি অধীন ও অনুসারীরূপে এটা তাদের কর্তব্যও বটে। আয়াতে অভিভাবককেই যখন বিনয়-নম্র আচরণের আদেশ করা হয়েছে, তখন অধীন ও অনুসারীদের প্রতি তো এ আদেশ আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বর্তায়।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুরুব্বী ও গুরুজনের কর্তব্য অধীনদের সঙ্গে বিনয়-নম্র আচরণ করা।
খ. প্রত্যেক অধীনকেও অবশ্যই আপন মুরুব্বী ও গুরুজনের প্রতি বিনয়ী হয়ে থাকতে হবে।
গ. ঈমানের সুবাদে প্রত্যেক মুমিন অপরাপর মুমিনদের কাছে বিনয়-নম্র আচরণ পাওয়ার অধিকার রাখে।
ঘ. আয়াতটির শব্দসমূহের প্রতি লক্ষ করলে জানা যায় যে, কুরআন মাজীদের বিভিন্ন শব্দ তার প্রকৃত অর্থে নয়; বরং রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।
দুই নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্য হতে কেউ যদি নিজ দীন থেকে ফিরে যায়, তবে আল্লাহ এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারাও তাকে ভালোবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৫৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা মুমিনদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তারা যেন কিছুতেই নিজেদের দীন পরিত্যাগ না করে। আল্লাহ না করুন, কেউ তা করলে তাতে আল্লাহ তা'আলার কোনও ক্ষতি নেই; সে নিজেই ধ্বংস হবে। আল্লাহ তা'আলা তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মুখাপেক্ষী নন। কাজেই কেউ পিছিয়ে গেলে তিনি এ লক্ষ্যে তাদের পরিবর্তে উন্নত গুণাবলির অধিকারী লোকদের দাঁড় করিয়ে দেবেন। তারা কি কি সগুণের অধিকারী হবে তাও এ আয়াতে বলে দেওয়া হয়েছে।
তাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে- يُحِبُّهُمْ (তিনি তাদের ভালোবাসবেন)। অর্থাৎ যারা ইসলাম পরিত্যাগ করবে, তাদের পরিবর্তে আল্লাহ তা'আলা যাদেরকে দাঁড় করাবেন তাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন। আল্লাহ তা'আলা কাদেরকে ভালোবাসবেন, সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ (31)
(হে নবী! মানুষকে) বলে দাও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ৩১)
সুতরাং বোঝা গেল, তাদের প্রথম গুণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা, যার ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তা'আলা তাদের ভালোবাসবেন।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল- يُحِبُّونَهُ (তারাও তাকে ভালোবাসবে)। অর্থাৎ সে দলটির মধ্যে আল্লাহপ্রেম থাকবে। আর আল্লাহপ্রেমের দাবি হল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা। এ হিসেবে প্রকৃতপক্ষে উভয়টি একই গুণ। কেননা আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবেসে থাকলে কর্তব্য সুন্নতের অনুসরণ করা। আর সুন্নতের অনুসরণ করলে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা পাওয়া যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে সুন্নতের অনুসরণই মূল কথা। এ গুণ যার মধ্যে থাকে, সে সত্যিকারের আল্লাহপ্রেমিকও এবং আল্লাহ তা'আলার মাহবুব ও ভালোবাসার পাত্রও।
তাদের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল- أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ (তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে)। أَذِلَّةٍ শব্দটি ذليل এর বহুবচন। এর উৎপত্তি ذل থেকে। অর্থ সহজতা, বিনয়, নম্রতা। اَعِزَّة শব্দটি عَزِيزٌ এর বহুবচন। এর উৎপত্তি عز থেকে। এর অর্থ শক্তি, ক্ষমতা, প্রতাপ, কঠোরতা। বাক্যটিতে বোঝানো হয়েছে- আল্লাহপ্রেমের দাবিতে তারা ভালোবাসবে মুমিনদেরও। ফলে তাদের প্রতি নম্র-কোমল আচরণ করবে, তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকবে, তাদেরকে নিজ দেহের অংশস্বরূপ মনে করবে, তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে থাকবে, কখনও তাদের সঙ্গে ঝগড়া- ফাসাদ ও হিংসা-বিদ্বেষে লিপ্ত হবে না; বরং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে ও ক্ষমাশীলতার পরিচয় দেবে।
অপরদিকে তারা কাফের ও অমুসলিমদের প্রতি থাকবে কঠোর ও কঠিন। অর্থাৎ পার্থিব বিষয়ে তারা তাদের প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণ করবে বটে, কিন্তু দীনের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কখনও আপোস করবে না। প্রয়োজনে জান-মাল দিয়ে লড়াই করবে।
আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বেরাদার এমনকি পিতা-মাতাও যদি দীনের বিরুদ্ধাচরণ করে, তবে তাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে দ্বিধাবোধ করবে না। এটাই প্রকৃত মুমিনের পরিচায়ক।
এ আয়াতটিতে সেই মুমিনদের আরও দু'টি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছে। তার প্রথমটি হচ্ছে - يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ (তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে)। অর্থাৎ তারা দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠাকল্পে নিজেদের জান-মাল দিয়ে সংগ্রাম করবে। প্রয়োজনে সসস্ত্র যুদ্ধেও অবতীর্ণ হবে।
আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল- وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ (এবং কোনও নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না)। অর্থাৎ দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ ও সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে তারা অমুসলিম ও বেদীন কিসিমের লোকের নিন্দার কোনও তোয়াক্কা করবে না। তারপর আল্লাহ তা'আলা বলেন-
ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ (এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার প্রিয়পাত্র হওয়া, তাঁর প্রেমিক হওয়া, মুমিনদের প্রতি বিনয়ের আচরণ করা, কাফেরদের প্রতি কঠোর হওয়া, আল্লাহর পথে জিহাদ করা এবং দীনের পথে কোনও নিন্দুকের নিন্দার তোয়াক্কা না করা সকলের ভাগ্যে হয় না। এটা আল্লাহ তা'আলার দান। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকেই এসব বৈশিষ্ট্য দিয়ে থাকেন। সুতরাং কেউ যদি নিজের মধ্যে এসব গুণ দেখতে পায়, তার কর্তব্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা এবং তাঁর কাছে আরও বেশি বেশি চাওয়া। যার মধ্যে এসব গুণ অনুপস্থিত, তার কর্তব্য এগুলো অর্জনের জন্য সাধনা ও মুজাহাদা করা এবং এর জন্য আন্তরিকভাবে আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করতে থাকা।
প্রকাশ থাকে যে, এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইশারায় একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ভবিষ্যদ্বাণীটি হল- কখনও কখনও এ উম্মতের কিছু কিছু লোক মুরতাদ হয়ে যাবে। অর্থাৎ দীন ত্যাগ করে বেঈমান হয়ে যাবে। আর যখনই কেউ বা কোনও দল মুরতাদ হবে, আল্লাহ তা'আলা তাদের পরিবর্তে অপর একদল লোককে ঈমানদার বানিয়ে দেবেন। ঈমানে তারা হবে অনেক পাকাপোক্ত এবং তাদের মধ্যে আয়াতে বর্ণিত ৫টি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকবে। সর্বপ্রথম এ ভবিষ্যদ্বাণী পূরণ হয়েছে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর আমলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর আরবের বিভিন্ন এলাকার লোক মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। সে জিহাদে আল্লাহ তা'আলা সাহাবায়ে কেরামকে জয়যুক্ত করেন। তারপর শুরু হয়ে যায় ইসলামের অপ্রতিরোধ্য দিগ্বিজয়। তাতে বহু জাতিগোষ্ঠী ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। নবদীক্ষিত সেসকল মুসলিম পৃথিবীর দিকে দিকে ইসলাম বিস্তারে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। তারা ছিলেন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী। আয়াতে বর্ণিত পাঁচওটি বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষে তাদের জীবন এমন এক উচ্চতায় উপনীত হয়েছিল যে, আজও পর্যন্ত তারা গোটা মানবসাধারণের জীবনগঠনের অনুপম আদর্শ।
এটা কেবল সেই কালের কথাই নয়। তার পর থেকে অদ্যাবধি যখনই কেউ ইসলাম ত্যাগ করেছে, তার পরিবর্তে কেবল একজন নয়; বহু আল্লাহর বান্দা বিপুল উদ্যমে ইসলামের পথে ছুটে এসেছেন। আজও যখন কোনও কোনও হতভাগাকে বেঈমান ও নাস্তিক হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে দেখা যাচ্ছে, তখন পৃথিবীর চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে, হাজারও মানুষ প্রবল আগ্রহের সঙ্গে ইসলাম কবুল করছে এবং নিজেরা ইসলামের দা'ঈ ও আহ্বায়করূপে পথহারা মানুষকে আল্লাহকে পাওয়ার পথ চেনাচ্ছে। কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী তো ব্যর্থ হতে পারে না। ইসলাম আল্লাহ তা'আলার সর্বশেষ মনোনীত দীন। দু'-চারজন মুরতাদের হল্লাচিল্লার কারণে এ দীনের নিরবচ্ছিন্ন গতি থেমে যেতে পারে কি? তা কখনও থামার নয়। কিয়ামত পর্যন্ত এ দীন তার আপন গতিতে চলতে থাকবে। দু'-চারজন বিপথগামীর স্থানে হাজারও সত্যসন্ধানী এর দিকে অটল প্রত্যয়ে এগিয়ে আসতে থাকবে। আল্লাহ তা'আলা মৃত্যু পর্যন্ত আমাদেরকে ঈমানের উপর অবিচল রাখুন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ইসলাম এক জীবন্ত দীন, যা কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে।
খ. ইসলাম আপন স্থায়িত্বের জন্য কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের মুখাপেক্ষী নয়।
গ. ইসলাম থেকে কারও বিমুখ হওয়াটা তার চরম দুর্ভাগ্য।
ঘ. কেউ ইসলাম থেকে বিচ্যুত হলে আরও উৎকৃষ্ট ব্যক্তি দ্বারা তার স্থান পূরণ হয়।
ঙ. আল্লাহপ্রেমিক হওয়া ও আল্লাহর ভালোবাসার পাত্র হতে পারাই একজন মুমিনের জীবনের পরম লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত।
চ. একজন মুমিনের কর্তব্য অপর মুমিনের প্রতি বিনয়ী থাকা ও কোমল আচরণ করা।
ছ. দীন ও ঈমান বিষয়ে মুমিনদেরকে কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর ও কঠিন অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
জ. দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা ও জান-মাল দিয়ে সংগ্রাম করা ঈমানের দাবি।
ঝ. দীনের উপর চলা ও দীনের প্রচার-প্রতিষ্ঠার মেহনত অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে নিন্দুকের নিন্দার তোয়াক্কা করা প্রকৃত মুমিনের কাজ নয়।
ঞ. ঈমান ও ঈমানের গুণাবলি অর্জন আল্লাহ তা'আলার তাওফীকেই সম্ভব। তাই এর জন্য মেহনত করার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে দু'আও অব্যাহত রাখতে হবে।
তিন নং আয়াত
يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
অর্থ: হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সেই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী।(সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১৩)
ব্যাখ্যা
এটি কুরআন মাজীদের অতি মহান এক আয়াত। এটি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এক কঠিন কষাঘাত। এর মাধ্যমে গায়ের রং ও ভাষাভিত্তিক বর্ণবাদ এবং অঞ্চল ও গোষ্ঠী- গোত্রভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। জাহিলী যুগে সর্বত্র বর্ণবৈষম্যের অন্ধকার ছেয়ে ছিল। ইসলাম এ আয়াতের মাধ্যমে তার অনুসারীদের সে অন্ধকার থেকে মুক্ত করেছে। বর্ণিত আছে, মক্কাবিজয়ের দিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত বিলাল রাযি.-কে কা'বাঘরের ছাদের উপর উঠে আযান দেওয়ার হুকুম দেন। তিনি আযান দিতে শুরু করলে মক্কার পুরোনো মোড়লেরা স্তম্ভিত হয়ে ওঠে। একজন কালো কুৎসিৎ লোককে কিনা পবিত্র কা'বাঘরের ছাদের উপর উঠিয়ে দেওয়া হল! নানাজনে নানা মন্তব্য করতে শুরু করল। কেউ কেউ মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও এই ভয়ে মুখে কিছু বলল না, না জানি আল্লাহ তা'আলা ওহীর মাধ্যমে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানিয়ে দেন। তা জানিয়ে দেওয়াও হল। তিনি তাদের ডেকে বললেন, তোমরা এই এই কথা বলাবলি করছিলে না? তারা তা স্বীকার করতে বাধ্য হল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা'আলা আলোচ্য আয়াতটি নাযিল করেন। আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى (হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি)। আয়াতটির সম্বোধন গোটা মানবজাতির প্রতি। আরব হোক বা অনারব, এশিয়ান হোক বা আফ্রিকান, সাদা হোক বা কালো, শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, ধনী হোক বা গরীব, ব্যবসায়ী হোক বা শ্রমজীবী, মূলত সকলেই একই আদি পিতা-মাতার সন্তান। হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হাউওয়া আলাইহাস সালাম থেকেই সকলের সৃষ্টি। হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছিল মাটি দিয়ে। সে হিসেবে সকলেই মাটির মানুষ। আদম আলাইহিস সালামের বংশ পরম্পরায় দুনিয়ার সমস্ত নারী-পুরুষ পিতা-মাতার মধ্য দিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছে। কাজেই এ হিসেবে সকলেই এক। কারও উপর কারও কোনও শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন-
قَدْ أَذْهَبَ اللهُ عَنْكُمْ عُبَيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ وَفَخْرَهَا بِالْآبَاءِ، مُؤْمِنٌ تَقِيُّ، وَفَاجِرٌ شَقِيٌّ وَالنَّاسُ بَنُوْ آدَمَ وَآدَمُ مِنْ تُرَابٍ
‘আল্লাহ তা'আলা তোমাদের থেকে জাহিলিয়াতের অহমিকা ও বাপ-দাদাদের নিয়ে গৌরব-গরিমা খতম করে দিয়েছেন। মানুষ হয় মুমিন-মুত্তাকী, নয়তো ফাসেক ও পাপী। সমস্ত মানুষ আদমসন্তান। আর আদম মাটির তৈরি।(জামে তিরমিযী: ৩৯৫৬; সুনানে আবূ দাউদ: ৫১১৬; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৪৫৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১০৬২; শু'আবুল ঈমান: ৪৭৬৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৪৪)
وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا (এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার)। মানুষকে জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করাটা আল্লাহ তা'আলারই কাজ। কে আরব হবে কে অনারব, তা কোনও ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বিষয় নয়। এমনিভাবে কে সৈয়দ হবে কে চৌধুরী, কে সাদা হবে কে কালো, তাও আল্লাহ তা'আলারই ইচ্ছাধীন। তিনি যাকে যে জাতি-গোষ্ঠীতে পাঠাতে চেয়েছেন, পাঠিয়েছেন। এতে কারও নিজস্ব কৃতিত্ব নেই। তাই এ নিয়ে অহমিকারও সুযোগ নেই। আল্লাহ তা'আলা এ বিভক্তি অহমিকার জন্য করেনইনি। তিনি এটা করেছেন মানুষের পরিচয়দানের সুবিধার্থে।
মানুষ এ বিভক্তি দ্বারা সুবিধা পেয়েও থাকে। বংশপরিচয় দিলেই লোকে সহজে চিনতে পারে। নয়তো চেনা কষ্টকর হয়ে যায়। একই নামের বহু লোক আছে। কেবল নাম বললে পরিচয় পরিষ্কার হয় না। নামের সঙ্গে গোত্রপরিচয় দিলেই বিভ্রম কেটে যায় ও পরিচয় পূর্ণতা লাভ করে। সুতরাং বংশ-গোত্রের ভাগ-বাটোয়ারা আল্লাহ তা'আলার এক নি'আমত। কোনও নি'আমতকে অহমিকার বিষয়ে পরিণত করা কঠিন পাপ। বরং শোকর আদায় করা দরকার যে, আল্লাহ তা'আলা আমাদের পরিচয়দানের সুবিধার্থে বংশ-গোত্র বিভাগের কী চমৎকার এক ব্যবস্থা করেছেন!
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ (প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সেই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার কাছে মানুষের মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা কেবলই তাকওয়া-পরহেযগারীর উপর নির্ভর করে; বিশেষ কোনও বংশ, বিশেষ কোনও বর্ণ, বিশেষ কোনও পেশা বা অঞ্চলের উপর নয়। না এটা কোনও মৌরুসি বিষয় যে, বাপ-দাদা শ্রেষ্ঠ ছিল বলে আমিও শ্রেষ্ঠ। যার অন্তরে তাকওয়া আছে, সে মানুষের মনগড়া আভিজাত্যের মাপকাঠিতে যতই নিম্নস্তরের হোক, আল্লাহ তা'আলার কাছে সে অনেক মর্যাদাবান। অপরদিকে কোনও ব্যক্তি মানুষের দৃষ্টিতে যতই অভিজাত হোক না কেন, মুত্তাকী-পরহেযগার না হলে আল্লাহ তা'আলার কাছে তার কানাকড়িও মূল্য নেই। তাঁর কাছে মূল্য কেবলই তাকওয়ার। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْحَسَبُ الْمَالُ، وَالْكَرَمُ التَّقْوَى
‘হাসাব (দুনিয়াদারদের কাছে মর্যাদা) হল সম্পদ। আর কারাম (আল্লাহর কাছে মর্যাদা) হল তাকওয়া।(জামে' তিরমিযী ৩২৭১; সুনানে ইবন মাজাহ ৪২১৯; মুসনাদে আহমাদ: ২০১০২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৬৯১২; সুনানে দারা কুতনী: ৩৭৯৮; হাকিম, আল- মুস্তাদরাক: ২৬৯০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৩৭৭৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৪৫)
অপর এক হাদীছে আছে-
مَرَّ رَجُلٌ علَى رَسولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ، فَقالَ لرَجُلٍ عِنْدَهُ جَالِسٍ: ما رَأْيُكَ في هذا فَقالَ: رَجُلٌ مِن أشْرَافِ النَّاسِ، هذا واللَّهِ حَرِيٌّ إنْ خَطَبَ أنْ يُنْكَحَ، وإنْ شَفَعَ أنْ يُشَفَّعَ، قالَ: فَسَكَتَ رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ ثُمَّ مَرَّ رَجُلٌ آخَرُ، فَقالَ له رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ: ما رَأْيُكَ في هذا فَقالَ: يا رَسولَ اللَّهِ، هذا رَجُلٌ مِن فُقَرَاءِ المُسْلِمِينَ، هذا حَرِيٌّ إنْ خَطَبَ أنْ لا يُنْكَحَ، وإنْ شَفَعَ أنْ لا يُشَفَّعَ، وإنْ قالَ أنْ لا يُسْمع لِقَوْلِهِ، فَقالَ رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ: هذا خَيْرٌ مِن مِلْءِ الأرْضِ مِثْلَ هذا.
‘এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তিনি তাঁর কাছে বসা এক ব্যক্তিকে বললেন, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? সে বলল, ইনি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের একজন। আল্লাহর কসম! তিনি এর উপযুক্ত যে, বিবাহের প্রস্তাব দিলে তা কবুল করা হবে এবং কারও সম্পর্কে সুপারিশ করলে তা গৃহীত হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ করে থাকলেন। তারপর অপর এক ব্যক্তি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (কাছে বসে থাকা) সেই ব্যক্তিকে বললেন, এই লোক সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ লোকটি দরিদ্র মুসলিমদের একজন। এ এরই উপযুক্ত যে, বিবাহের প্রস্তাব দিলে তা কবুল করা হবে না এবং কারও সম্পর্কে সুপারিশ করলে তা গৃহীত হবে না। আর যদি কথা বলে তবে তার কথায় কর্ণপাত করা হবে না। এবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ ব্যক্তি ওই লোকের মতো দুনিয়াভরা মানুষ অপেক্ষাও উত্তম।(সহীহ বুখারী: ৫০৯১; সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪১২০; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর: ৫৮৮৩; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৯৯৯৮; বাগাবী, শারহুস্সুন্নাহ: ৪০৬৯)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ইসলামে কোনওরূপ বর্ণবৈষম্যের অবকাশ নেই।
খ. সমস্ত মানুষই যেহেতু এক আদি পিতা-মাতার সন্তান, তাই মানুষ হিসেবে কাউকে তুচ্ছ গণ্য করতে নেই।
গ. মানবপ্রজন্মের বিস্তারে নর-নারীর সমান ভূমিকা। উভয়েরই সে ভূমিকা স্বীকার করা উচিত।
ঘ. বংশ-গোত্রীয় বিভক্তি একটি নি'আমত, যেহেতু এর দ্বারা পরস্পরকে চেনা সহজ হয়েছে। কাজেই এ নি'আমতকে অহমিকার বিষয়ে পরিণত করা কিছুতেই সমীচীন নয়।
ঙ. আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদা নিরূপিত হয় কেবলই তাকওয়ার দ্বারা। তাই আমাদেরকে এ গুণ অর্জনে অবশ্যই সচেষ্ট থাকতে হবে।
চ. বংশীয় আভিজাত্য, অর্থ-সম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষা, ক্ষমতা ইত্যাদির বড়াই এক আত্মপ্রবঞ্চনা। তাকওয়া ছাড়া এসবের কোনও মূল্য নেই।
চার নং আয়াত
فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى (32)
অর্থ: সুতরাং তোমরা নিজেদেরকে পবিত্র বলে দাবি করো না। তিনি ভালোভাবেই জানেন মুত্তাকী কে।(সূরা নাজম (৫৩), আয়াত ৩২)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা নাজমের ৩২ নং আয়াতের শেষ অংশ। এর আগে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-
هُوَ أَعْلَمُ بِكُمْ إِذْ أَنْشَأَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَإِذْ أَنْتُمْ أَجِنَّةٌ فِي بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ
‘তিনি তোমাদের সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত আছেন, যখন তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যখন তোমরা তোমাদের মাতৃগর্ভে ভ্রূণরূপে ছিলে।’
অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যখন মাটি থেকে হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেন, তখনও তাঁর বংশধরদের বিস্তারিত অবস্থা তাঁর জানা ছিল। কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে তাঁর সন্তান-সন্ততির সংখ্যা কতজন হবে, কে কতদিন বাঁচবে, কার জীবিকা কেমন হবে, কে সৎকর্মশীল হবে কে অসৎকর্মশীল, কে ঈমানদার হবে কে বেঈমান, কতজন জান্নাতবাসী হবে কতজন জাহান্নামী- এর কোনওকিছুই আল্লাহ তা'আলার অজানা ছিল না। তিনি এসব যেমন জানতেন হযরত আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টিকালে, তেমনি জানতেন ও জানেন মাতৃগর্ভে প্রত্যেকের ভ্রূণ অবস্থায় থাকাকালেও। মোটকথা তাঁর জ্ঞান অনাদি অনন্ত। প্রত্যেকের খুঁটিনাটি যাবতীয় অবস্থা তাঁর সবসময়ই জানা। আর সে কারণেই তিনি বলছেন-
فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ (সুতরাং তোমরা নিজেদেরকে পবিত্র বলে দাবি করো না)। অর্থাৎ কোনও পাপ বা মন্দ কাজ করছ না বলে আত্মপ্রশংসা করো না। কিংবা বেশি বেশি সৎকর্ম করছ বলে বড়াই করো না। কারণ কার শেষ পরিণাম কী হবে, তোমরা কেউ তা জান না। এমনও হতে পারে যে, এখন তো কোনও গুনাহ করছ না, কেবল ভালো ভালো কাজেই লেগে আছ, কিন্তু এ অবস্থা শেষপর্যন্ত অব্যাহত থাকবে না। এক পর্যায়ে দেখা যাবে তোমার অবস্থা বদলে গেছে। আগেকার সব ভালো কাজ জলাঞ্জলি দিয়ে অসৎকর্ম শুরু করে দিয়েছ। আর সে অসৎকর্মে নিমজ্জিত থাকা অবস্থায়ই তোমার মৃত্যু ঘটেছে। এভাবে তুমি একজন পাপীরূপে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়ে জাহান্নামের বাসিন্দা হয়ে গেছ। অপরদিকে এমনও হতে পারে, যারা এখন পাপকর্মে নিমজ্জিত আর সে কারণে তোমরা তাদের ঘৃণা করছ এবং নিজেদেরকে তাদের তুলনায় উত্তম ভাবছ, এক পর্যায়ে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, তাদের মনে অনুশোচনা জেগেছে, ফলে তারা তাওবা করে জীবন বদলে ফেলেছে। এখন তারা পুরোপুরি ভালো মানুষ। তারা পাপকর্মের ধারেকাছেও যায় না। সৎকর্মের ভেতরেই দিবারাত্র পার করছে। আর এভাবে একজন সৎকর্মশীলরূপে কবরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। যদি এভাবেই তাদের মৃত্যু হয়, তবে অবশ্যই তারা জান্নাতবাসী হবে। সুতরাং আত্মপ্রশংসা করা এবং নিজেকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ বলে বড়াই করার কোনওই অবকাশ নেই। বরং দরকার বর্তমান সময়ে সৎকর্মে মশগুল থেকে শেষ পরিণামের ভয়ে ভীত থাকা, যাতে জীবনশেষে শয়তানের ফাঁদে পড়ে দীন ও ঈমান বরবাদ না হয়; বরং একজন প্রকৃত ঈমানদাররূপে মৃত্যু নসীব হয়। তারপর আল্লাহ তা'আলা বলেন-
هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى (তিনি ভালোভাবেই জানেন মুত্তাকী কে)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন তোমাদের মধ্যে কে সত্যিকার তাকওয়ার উপর আছে এবং কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে তাঁর আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে মেনে চলছে। এমনিভাবে তিনিই জানেন কে সারাটা জীবন এরূপ তাকওয়া-পরহেযগারীর সঙ্গে থাকবে আর এভাবেই একজন প্রকৃত ঈমানদাররূপে মৃত্যুবরণ করবে। সুতরাং তিনি তাঁর সে জ্ঞান অনুযায়ী ফয়সালা করবেন। আখিরাতে মুত্তাকী ব্যক্তিকে তার তাকওয়া-পরহেযগারীর পুরোপুরি প্রতিদান দেবেন। আর যেহেতু বিষয়টা কেবল তিনিই জানেন, তাই আত্মপ্রশংসা না করে বরং নেক আমলে মশগুল হও এবং যাতে ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পার, সে আশায় আল্লাহর অভিমুখী বান্দারূপে জীবন পরিচালনা করতে থাকো।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান সর্বব্যাপী। তিনি সমস্ত মানুষের যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত।
খ. কে প্রকৃত মুত্তাকী এবং যথাযথ তাকওয়া-পরহেযগারীর সঙ্গে মৃত্যুবরণ করবে, তা কেবল আল্লাহ তা'আলাই জানেন। অন্য কারও পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়।
গ. নিজ পরিণাম কী হবে এবং কী অবস্থায় মৃত্যু হবে তা যেহেতু কারও জানা নেই, তাই কারও জন্যই আত্মপ্রশংসা করা সাজে না।
পাঁচ নং আয়াত
وَنَادَى أَصْحَابُ الْأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا مَا أَغْنَى عَنْكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ (48) أَهَؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ اللَّهُ بِرَحْمَةٍ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ (49)
অর্থ: আরাফবাসীগণ একদল লোককে, যাদেরকে তারা তাদের চিহ্ন দ্বারা চিনবে, ডাক দিয়ে বলবে, তোমাদের সংগৃহীত সঞ্চয় তোমাদের কোনও কাজে আসল না এবং তোমরা যাদেরকে বড় মনে করতে তারাও না। (অতঃপর জান্নাতবাসীদের প্রতি ইশারা করে বলবে) এরাই কি তারা, যাদের সম্পর্কে তোমরা শপথ করে বলতে, আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতের কোনও অংশ দেবেন না? (তাদেরকে তো বলে দেওয়া হয়েছে,) তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না।(সুরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৪৮-৪৯)
ব্যাখ্যা
আ‘রাফ হচ্ছে জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী প্রাচীর। যাদের পাপ-পুণ্য সমান, তারা এ প্রাচীরের উপর অবস্থান করবে, যতক্ষণ না তাদের সম্পর্কে জান্নাতের ফয়সালা হয়। তারা জান্নাতের আকাঙ্ক্ষায় থাকবে। পরিশেষে আল্লাহ তা'আলা তাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতের ফয়সালা করে দেবেন। তখন তারাও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। তারা যখন আ'রাফ তথা ওই প্রাচীরের উপর অবস্থান করবে, তখন সেখান থেকে জান্নাত ও জাহান্নামবাসীদের দেখতে ও চিনতে পারবে। প্রথমে তারা জান্নাতবাসীদের দেখে খুশি হবে এবং তাদের সালাম জানাবে। তারপর যখন জাহান্নামের দিকে তাকাবে, তখন তাদের লক্ষ্য করে কিছু কথা বলবে। তারা তাদেরকে কী বলবে, সে কথাই আলোচ্য আয়াতদু'টিতে তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَنَادَى أَصْحَابُ الْأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا (আ‘রাফবাসীগণ একদল লোককে ডাক দিয়ে বলবে, যাদেরকে তারা তাদের চিহ্ন দ্বারা চিনবে)। যাদেরকে চিনবে তারা খুবসম্ভব কাফেরদের নেতৃবর্গ। তাদের বিশেষ বিশেষ চিহ্ন দেখে আরাফবাসীগণ চিনতে পারবে যে, তারা অমুক অমুক। তখন তারা তাদের ডাক দেবে। যেমন হে ফেরাউন, হে নমরূদ, হে কারুন, হে আবূ জাল, হে উকবা, হে শায়বা ইত্যাদি।
مَا أَغْنَى عَنْكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ (তোমাদের সংগৃহীত সঞ্চয় তোমাদের কোনও কাজে আসল না এবং তোমরা যাদেরকে বড় মনে করতে তারাও না)। جَمْع এর অর্থ সঞ্চিত ধন-সম্পদ অথবা দলবল। অর্থাৎ তোমরা দুনিয়ায় তোমাদের যে দলবল ও ধন-দৌলতের বড়াই করতে, আজ তা তোমাদের কোনও উপকারে আসল না। যেমন তারা দুনিয়ায় বলত-
وَقَالُوا نَحْنُ أَكْثَرُ أَمْوَالًا وَأَوْلَادًا وَمَا نَحْنُ بِمُعَذَّبِينَ (35)
‘তারা বলেছে, আমরা ধনে-জনে তোমাদের চেয়ে বেশি আর আমরা শাস্তিপ্রাপ্ত হওয়ার নই।’( সূরা সাবা‘ (৩৪), আয়াত ৩৫)
সূরা কাহফে বর্ণিত হয়েছে, এক ধনী ব্যক্তি অপর এক গরীব ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলেছিল-
أَنَا أَكْثَرُ مِنْكَ مَالًا وَأَعَزُّ نَفَرًا (34) وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَنْ تَبِيدَ هَذِهِ أَبَدًا (35) وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَى رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيْرًا مِنْهَا مُنْقَلَبًا (36)
‘আমার অর্থ-সম্পদও তোমার চেয়ে বেশি এবং আমার দলবলও তোমার চেয়ে শক্তিশালী। নিজ সত্তার প্রতি সে জুলুম করছিল আর এ অবস্থায় সে তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমি মনে করি না এ বাগান কখনও ধ্বংস হবে। আমার ধারণা কিয়ামত কখনওই হবে না। আর আমাকে আমার প্রতিপালকের কাছে যদি ফিরিয়ে নেওয়া হয়, তবে আমি নিশ্চিত (সেখানে) আমি এর চেয়েও উৎকৃষ্ট স্থান পাব।(সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ৩৪-৩৬)
أَهَؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ اللَّهُ بِرَحْمَةٍ (এরাই কি তারা, যাদের সম্পর্কে তোমরা শপথ করে বলতে, আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতের কোনও অংশ দেবেন না)? তারা এ কথা বলবে গরীব মুমিনদের দিকে ইশারা করে, যাদেরকে আল্লাহ তা'আলা ঈমান- আমলের বদৌলতে জান্নাতবাসী করেছেন। যেমন হযরত সালমান রাযি., হযরত সুহায়ব রাযি., হযরত বিলাল রাযি., হযরত খাব্বাব রাযি. প্রমুখ গরীব সাহাবায়ে কেরাম ও সকল যুগের ঈমানদার দরিদ্রগণ, কাফের-বেঈমানগণ যাদের সম্পর্কে বলত- ওরা কখনও জান্নাতে যেতে পারবে না; ওরা দুনিয়ায় যেমন কষ্ট করছে, আখিরাতেও তেমনি কষ্টের জীবনই ভোগ করতে হবে। আ'রাফবাসীগণ তাদের দেখিয়ে দেবে যে, দুনিয়ায় তাদের এসব ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও হম্বিতম্বি কতটাই মিথ্যা ছিল। আজ সেই গরীব মুসলিমগণ কেমন চিরসুখের জান্নাত লাভ করেছে আর ওই অহংকারী ধনীগণ কীভাবে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করছে।
ادْخُلُوا الْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ (তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না)। এ কথাটি আ'রাফবাসীরও হতে পারে কিংবা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে আ'রাফবাসীদের লক্ষ্য করেও হতে পারে। আ'রাফবাসীদের কথা হলে তখন এর অর্থ হবে যে, হে দাম্ভিকগণ! তোমরা তো বলেছিলে এ গরীবগণ জান্নাতে যেতে পারবে না। কিন্তু দেখো, তারা জান্নাতে চলে গেছে। তাদের লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলা হুকুম দিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না। আর যদি আ'রাফবাসীদের লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে বলা হয়, তখন এর অর্থ হবে যে, হে আ'রাফবাসীগণ! তোমাদের বিষয়টা তো এ পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল। তোমরা নিজেরা আশা করছিলে যে, তোমাদের জান্নাত দেওয়া হবে। তোমাদের সে আশা পূরণ করা হল। এবার তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. শুরুতে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে কেবল তারাই, যাদের নেক আমলের ওজন বেশি হবে।
খ. পাপ-পুণ্য সমান হলে তাদের জান্নাতলাভ বিলম্বিত হবে। শুরুতে কিছুকাল তাদের আ'রাফে কাটাতে হবে।
গ. ধন ও জনবলের বড়াই করতে নেই। আখিরাতে তা কোনও কাজে আসবে না।
ঘ. জান্নাত চিরসুখের ঠিকানা। সেখানে কোনও ভয় ও দুঃখ থাকবে না।
স্বাভাবিক অবস্থায় নির্জন ও নিঃসঙ্গ জীবনযাপন না করে পারিবারিক জীবনযাপন করা ও জনসমাজের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই উত্তম। এর অনেক ফযীলত রয়েছে। কেননা এভাবে জীবনযাপন করলে এমন অনেক নেককাজ করা সম্ভব হয়, যা নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। যেমন-
(ক) জুমু‘আ ও জামাতে অংশগ্রহণ করা। জুমু‘আর নামায সর্বশ্রেষ্ঠ নামায। এর ফযীলত বিপুল। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
الْجُمْعَةُ إِلَى الْجُمْعَةِ، كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُنَّ، مَا لَمْ تُغْشَ الْكَبَائِرُ
‘এক জুমু'আ অপর জুমু'আ পর্যন্ত তার মধ্যবর্তী পাপসমূহের মোচনকারী, যাবৎ না কবীরা গুনাহ করা হয়।(সহীহ মুসলিম: ২৩৩; সুনানে ইবন মাজাহ ৫৯৮; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৫৫৮৮; মুসনাদে আহমাদ: ৭১২৯; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৬৪৮৬; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৩৫০৪)
অপর এক হাদীছে ইরশাদ-
مَنْ غَسَّلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَاغْتَسَلَ، وَبَكَّرَ وَابْتَكَرَ، وَمَشَى وَلَمْ يَرْكَبْ، وَدَنَا مِنَ الْإِمَامِ، فَاسْتَمَعَ وَلَمْ يَلْغُ ، كَانَ لَهُ بِكُلِّ خَطْوَةٍ عَمَلُ سَنَةٍ، أَجْرُ صِيَامِهَا وَقِيَامِهَا
‘জুমু'আর দিন যে ব্যক্তি নিজ মাথা ধোয় ও গোসল করে, আগে আগে মসজিদে যায়, খুতবার শুরু ধরতে পারে, পায়ে হেঁটে যায়, বাহনে চড়ে না, ইমামের কাছে গিয়ে বসে, খুতবা শোনে এবং কোনও নিরর্থক কাজ করে না, সে তার প্রতি কদমে পূর্ণ এক বছর রোযা রাখার ও রাত জেগে নামায পড়ার ছাওয়াব অর্জন করে।(সুনানে ইবন মাজাহ ১০৮৭; সুনানে আবু দাউদ: ৩৪৫; জামে তিরমিযী: ৫০২; মুসনাদে আহমাদ: ১৬১৭৩; সহীহ ইবন হিব্বান ২৭৮১)
বলাবাহুল্য জুমু‘আর নামায একাকী পড়া যায় না। আর পাঁচ ওয়াক্ত নামায একাকী পড়া যায় বটে, কিন্তু জামাতে পড়ার যে বিপুল ছাওয়াব রয়েছে তা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। জামাতে নামায আদায় করা সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ করা হয়েছে-
صَلَاةُ أَحَدِكُمْ فِي جَمَاعَةٍ ، تَزِيدُ عَلَى صَلَاتِهِ فِي سُوْقِهِ وَبَيْتِهِ بِضْعًا وَعِشْرِينَ دَرَجَةً
‘তোমাদের কারও বাজারে বা নিজ ঘরে নামায আদায় অপেক্ষা জামাতে নামায আদায়ের ছাওয়াব বিশ গুণেরও বেশি (অর্থাৎ সাতাশ গুণ) হয়ে থাকে।(সহীহ বুখারী: ২১১৯; সহীহ মুসলিম: ৬৪৯; সুনানে আবু দাউদ: ৫৫৯; সুনানে ইবন মাজাহ: ৭৮৬; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী: ২৫৩৪; মুসনাদে আহমাদ: ৮৩৯০; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ১০১১)
(খ) ভালো কাজের জমায়েতে অংশগ্রহণ। যেমন কোনও পরামর্শসভায় শরীক হওয়া, ঈদ ও সূর্যগ্রহণের নামাযে অংশগ্রহণ করা...- এর প্রত্যেকটিতেই প্রচুর ছাওয়াব পাওয়া যায়। একাকী থাকলে সে ছাওয়াব থেকে মাহরুম থাকতে হয়।
(গ) ইলমের মজলিসে উপস্থিত থাকা। সহীহ নিয়তে ইলমের মজলিসে অংশগ্রহণের অনেক বড় ফযীলত রয়েছে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
وَما اجْتَمع قَوْمٌ في بَيْتٍ مِن بُيُوتِ اللهِ، يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَهُ بيْنَهُمْ؛ إِلَّا نَزَلَتْ عليهمِ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَحَفَّتْهُمُ المَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَن عِنْدَهُ
‘কোনও লোকসমষ্টি আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোনও একটি ঘরে একত্র হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত এবং নিজেদের মধ্যে তার পঠন-পাঠনে মশগুল থাকলে তাদের উপর সাকীনা নাযিল হয়, রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়, ফিরিশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখেন এবং আল্লাহ তার কাছে উপস্থিত (ফিরিশতা)-দের মধ্যে তাদের উল্লেখ করেন।(সহীহ মুসলিম: ২৬৯৯; জামে তিরমিযী: ২৯৪৫; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ১০৭৩৭; সুনানে ইবনে মাজাহ: ২২৫; বাগাবী, শারহুস্সুন্নাহ: ১২৭; মুসনাদে আহমাদ: ৭৪২৭)
(ঘ) যিকিরের মজলিসে উপস্থিত থাকা। যিকিরের মজলিসের ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে আছে, হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
“আল্লাহ তা'আলার একদল বিচরণরত অতিরিক্ত ফিরিশতা আছে। তারা আল্লাহর যিকিরের মজলিসসমূহ সন্ধান করে থাকে। যখনই কোথাও এমন মজলিস পায়, যেখানে আল্লাহ তা'আলার যিকির হয়, তারা যিকিরকারীদের সঙ্গে বসে যায়। তারপর তারা তাদের পরস্পরের ডানা মিলিয়ে সে মজলিস ঘিরে ফেলে। এভাবে তারা তাদের ও প্রথম আকাশের মধ্যবর্তী সবটা স্থান ভরে ফেলে। যখন যিকিরকারীগণ মজলিস ত্যাগ করে, তখন তারা আকাশে উঠে যায়। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন- অথচ তিনিই ভালো জানেন, তোমরা কোথা থেকে এসেছ? তারা বলে, আমরা পৃথিবীতে অবস্থিত আপনার একদল বান্দার কাছ থেকে এসেছি। তারা আপনার সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করছিল আর তারা আপনার কাছে প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা আমার কাছে কী প্রার্থনা করছিল? তারা বলে, আপনার কাছে আপনার জান্নাত প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা কি আমার জান্নাত দেখেছে? তারা বলে, হে প্রতিপালক! তারা দেখেনি। তিনি জিজ্ঞেস করেন, যদি তারা জান্নাত দেখত, তবে কেমন হতো? তারপর তারা বলে, তারা আপনার কাছে আশ্রয়ও প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা আমার কাছে কিসের থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছিল? তারা বলে, হে প্রতিপালক! তারা আপনার জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা কি আমার জাহান্নাম দেখেছে? তারা বলে, না। তিনি বলেন, যদি তারা আমার জান্নাত দেখত, তবে কেমন হতো? তারপর তারা বলে, তারা আপনার কাছে ক্ষমাও প্রার্থনা করছিল। তিনি বলেন, আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। তারা যা চেয়েছে তা তাদেরকে দিলাম এবং তারা যা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে, তা থেকেও আমি তাদেরকে আশ্রয় দান করলাম। তখন তারা বলে, হে প্রতিপালক! তাদের মধ্যে অমুক এক গুনাহগার বান্দাও আছে। সে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তাদের সঙ্গে বসে পড়ে। তিনি বলেন, তাকেও ক্ষমা করে দিলাম। তারা এমন একটি দল, যাদের (মর্যাদার) কারণে তাদের সঙ্গে উপবেসনকারীও বঞ্চিত হয় না।(সহীহ মুসলিম: ২৬৮৯; মুসনাদে আহমাদ: ৭৪২০; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৫৫৬; হাকিম, আল মস্তাদরাক; ১৮২১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১২৪১)
(ঙ) রোগী দেখতে যাওয়া। রোগী দেখতে যাওয়ারও বিপুল ছাওয়াব রয়েছে। এক হাদীছে ইরশাদ-
مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخَا لَهُ فِي اللهِ ، نَادَاهُ مُنَادٍ : بِأَنْ طِبْتَ، وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الْجَنَّةِ مَنْزِلًا
যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোনও রোগী দেখতে যায় বা তার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, এক ঘোষক তাকে ডেকে বলে, তুমি আনন্দিত হও, তোমার চলা কল্যাণকর হোক এবং তুমি জান্নাতে ঠিকানা লাভ করো।(জামে তিরমিযী: ২০০৮; মুসনাদে আহমাদ: ৮৫৩৬; সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৪৪৩; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৯১৬১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৬১০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৪৭২)
(চ) জানাযায় হাজির হওয়া। জানাযায় হাজির হওয়ার ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ صَلَّى عَلَى جَنَازَةٍ فَلَهُ قِيرَاطٌ ، فَإِنْ شَهِدَ دَفْنَهَا فَلَهُ قِيرَاطَانِ ، الْقِيْرَاطُ مِثْلُ أُحُدٍ
‘যে ব্যক্তি কারও জানাযার নামায পড়ে, তার জন্য রয়েছে এক কীরাত ছাওয়াব। আর যে ব্যক্তি তার দাফনেও অংশগ্রহণ করে, তার জন্য রয়েছে দুই কীরাত ছাওয়াব। আর কীরাত হল উহুদ পাহাড় পরিমাণ।(সহীহ মুসলিম: ৯৪৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৫৪১; সুনানে নাসাঈ: ১৯৯৫; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৬২৭০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১১৬১৫; মুসনাদে আহমাদ: ৪৪৫৪)
(ছ) অভাবগ্রস্তের প্রতি সহমর্মিতা জানানো। এক হাদীছে আছে-
مَن كانَ في حاجَةِ أخِيهِ كانَ اللَّهُ في حاجَتِهِ، ومَن فَرَّجَ عن مُسْلِمٍ كُرْبَةً، فَرَّجَ اللَّهُ عنْه بها كُرْبَةً مِن كُرَبِ يَومِ القِيامَةِ
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধায় রত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের কোনও একটি বিপদ দূর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করে দেবেন।(সহীহ বুখারী: ২৪৪২; সহীহ মুসলিম: ২৫৮০; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৮৯৩; জামে তিরমিযী: ১৪২৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ২২৫; মুসনাদে আহমাদ: ৫৬৪৬)
(জ) সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের মাধ্যমে অজ্ঞজনদের সঠিক পথ দেখানো। এটা প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব। আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এ দায়িত্ব পালন করা প্রত্যেকের জরুরি। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَن رَأَى مِنكُم مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بيَدِهِ، فإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسانِهِ، فإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وذلكَ أضْعَفُ الإيمانِ
তোমাদের মধ্যে কেউ কোনও অন্যায় কাজ হতে দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে তা না পারে, তবে মুখের কথা দ্বারা (প্রতিহত করে)। যদি তাও না পারে, তবে অন্তর দ্বারা। আর এটা হল ঈমানের দুর্বলতম স্তর।(সহীহ মুসলিম : ৪৯; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪০১৩; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩০৭; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৭১৫৩; আস সুনানুল কুবরা: ১১৫১৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪১৫৭)
(ঝ) অন্যান্য কল্যাণকর কাজে অংশগ্রহণ করা। জনকল্যাণমূলক প্রতিটি কাজই গুরুত্বপূর্ণ। তার অনেক ছাওয়াব। এরূপ কাজ আছে নানারকম। যেমন রাস্তাঘাট তৈরি করা, সেতু নির্মাণ করা, মানুষের পানির ব্যবস্থা করা, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, পথভোলা লোককে পথ দেখিয়ে দেওয়া, মানুষের মাথায় বোঝা তুলে দেওয়া বা মাথা থেকে নামিয়ে দেওয়া, অন্ধ ও বিকলাঙ্গকে রাস্তা পার করিয়ে দেওয়া, যাদের বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই তাদের খোঁজখবর নেওয়া ইত্যাদি। লোকালয় ছেড়ে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করলে এসব কাজ করার সুযোগ হয় না।
(ঞ) অন্যকে কষ্ট দেওয়া হতে নিজেকে বিরত রাখা। এটাও একটি পুণ্যের কাজ। যে ব্যক্তি অন্যের সেবা করার ক্ষমতা রাখে না, সে যদি অন্ততপক্ষে এতটুকুও করে যে, তার দ্বারা যাতে কেউ কষ্ট না পায় সেদিকে লক্ষ রাখে, তবে তাও অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। লোকসমাজে মিলেমিশে থাকার দ্বারাই এ কাজ করার সুযোগ হয়। হযরত আবূ যার রাযি. থেকে বর্ণিত-
سَأَلْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ العَمَلِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «إِيمَانٌ بِاللَّهِ، وَجِهَادٌ فِي سَبِيلِهِ» ، قُلْتُ: فَأَيُّ الرِّقَابِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «أَعْلاَهَا ثَمَنًا، وَأَنْفَسُهَا عِنْدَ أَهْلِهَا» ، قُلْتُ: فَإِنْ لَمْ أَفْعَلْ؟ قَالَ: «تُعِينُ ضَايِعًا، أَوْ تَصْنَعُ لِأَخْرَقَ» ،: قَالَ: فَإِنْ لَمْ أَفْعَلْ؟ قَالَ: «تَدَعُ النَّاسَ مِنَ الشَّرِّ، فَإِنَّهَا صَدَقَةٌ تَصَدَّقُ بِهَا عَلَى نَفْسِكَ
‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, সর্বোত্তম আমল কী? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর পথে জিহাদ। তারপর বললাম, কোন দাসমুক্তি উত্তম? তিনি বললেন, যার দাম বেশি এবং যে তার মনিবের কাছে বেশি প্রিয়। বললাম, যদি আমি তা না পারি? তিনি বললেন, দুর্বলকে সাহায্য করবে কিংবা যে ভালো কাজ জানে না তার সহযোগিতা করবে। বললাম, যদি তা না পারি? তিনি বললেন, মানুষকে তোমার অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবে। এটাও একটি সদাকা, যা দ্বারা তুমি নিজের প্রতি সদাকা করতে পার।’(সহীহ বুখারী: ২৫১৮; সহীহ মুসলিম: ৮৪; মুসনাদুল বাযযার: ৪০৩৮; সহীহ ইবন হিব্বান: ৪৩১০; শু'আবুল ঈমান: ৪০৩৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৪১৮; মুসনাদুল হুমায়দী: ১৩১)
(ট) অন্যের থেকে কষ্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে সবর করা। অন্য কেউ কষ্ট দিলে তাতে সবর করাও একটি ফযীলতের কাজ। এ কাজ লোকসমাজে মিলেমিশে থাকার দ্বারাই সম্ভব হয়। এর ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
اَلْمُؤْمِنُ اَلَّذِي يُخَالِطُ اَلنَّاسَ, وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ خَيْرٌ مِنْ اَلَّذِي لَا يُخَالِطُ اَلنَّاسَ وَلَا يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ
‘যে মুসলিম মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে এবং তারা কষ্ট দিলে তাতে সবর করে, সে ওই মুসলিম অপেক্ষা উত্তম, যে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে না এবং তারা কষ্ট দিলে তাতে তার সবর করারও অবকাশ হয় না।’(জামে' তিরমিযী: ২৫০৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০১৭৪; শু'আবুল ঈমান: ৯২৭৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৮৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৬২২০; মুসনাদে আহমাদ: ৫০২২)
উক্ত অধ্যায়শিরোনামের পর ইমাম নাওয়াবী রহ. বলেন-
اعْلَمْ: أَنَّ الْاخْتِلَاطَ بِالنَّاسِ عَلَى الْوَجْهِ الَّذِي ذَكَرْتُهُ هُوَ الْمِختَارُ الَّذِي كَانَ عَلَيْهِ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ ، وَسَائِرُ الْأَنْبِيَاءِ صَلَوَاتُ اللهِ وَسَلَامُهُ عَلَيْهِمْ، وَكَذَلِكَ الْخُلَفَاءُ الرَّاشِدُونَ، وَمَنْ بَعْدَهُمْ مِنَ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِيْنَ، وَمَنْ بَعْدَهُمْ مِنْ عُلَمَاءِ الْمُسْلِمِينَ وَأَخْيَارِهِمْ، وَهُوَ مَذْهَبُ أَكْثَرِ التَّابِعِينَ وَمَنْ بَعْدَهُمْ ، وَبِهِ قَالَ الشَّافِعِيُّ وَأَحْمَدُ وَأَكْثَرُ الْفُقَهَاءِ أَجْمَعِينَ
'জ্ঞাতব্য যে, উপরে যেভাবে বললাম, সেভাবে মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই শরী'আতে পসন্দনীয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য নবীগণের এটাই আদর্শ। খুলাফায়ে রাশিদীনসহ অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন ও তাদের পরবর্তী উলামায়ে কেরাম ও শ্রেষ্ঠ মুসলিমগণ এ নীতির উপরই ছিলেন। এটাই অধিকাংশ তাবি'ঈ ও তাদের পরবর্তী মনীষীদের মত। ইমাম শাফি'ঈ, ইমাম আহমাদ ও অধিকাংশ ফকীহ এ মতই ব্যক্ত করেছেন।’
ইমাম নাওয়াবী রহ. এই যে কথা বলেছেন, সামাজিক জীব হিসেবে সাধারণ অবস্থায় মানুষের জন্য এটাই প্রযোজ্য। কেননা প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য আছে।নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করলে সে দায়িত্বপালন সম্ভব হয় না। তবে সমাজজীবনে মিলেমিশে থাকার ভেতর দিয়েও এক রকম নিঃসঙ্গতা রক্ষা জরুরি। তা হল হৃদয়মনের নিঃসঙ্গতা। অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা থাকবে আর অন্তর থাকবে সর্বদা আল্লাহ অভিমুখী। মানুষের পার্থিব ঐশ্বর্য ও চাকচিক্য যাতে অন্তরে প্রভাব বিস্তার না করে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। দুনিয়াদারী ও শরী'আতবিরোধী কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রভাবিত হওয়া তো নয়ই; বরং অন্তরে থাকবে তার প্রতি ঘৃণা ও অসন্তুষ্টি। মানুষ ভালো কাজ করলে তার প্রতি সমর্থন জানানো হবে, অন্যায় করলে প্রতিবাদ করা হবে। তাদের অন্যায়-অপরাধের সঙ্গে কোনওভাবেই নিজেকে যুক্ত রাখা যাবে না। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. বলেন, তুমি যখন মানুষের সঙ্গে থাকবে, তখন মানুষ আল্লাহর যিকিরে রত থাকলে তুমিও তাদের সঙ্গে যিকিরে রত থাকবে। আর তারা অন্য কিছুতে লিপ্ত হলে তুমি তা থেকে পাশ কাটিয়ে চলবে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ (68)
‘যারা আমার আয়াতের সমালোচনায় রত থাকে, তাদেরকে যখন দেখবে তখন তাদের থেকে দূরে সরে যাবে, যতক্ষণ না তারা অন্য বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়। যদি শয়তান কখনও তোমাকে (এটা) ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণ হওয়ার পর জালেম লোকদের সাথে বসবে না।(সূরা আন‘আম (৬), আয়াত ৬৮)
একবার জনৈক ব্যক্তি ওয়াহাব ইবন মুনাব্বিহ রহ.-এর কাছে এসে বলল, মানুষ এখন যা-কিছুতে লিপ্ত তা আপনি দেখছেন। এ অবস্থায় আমি ভাবছি তাদের সঙ্গে আর মেলামেশা করব না। তিনি বললেন, এমনটি করো না। কেননা তোমার মানুষের প্রয়োজন রয়েছে আর মানুষেরও তোমাকে প্রয়োজন রয়েছে। তোমাকে ছাড়া তাদের চলবে না, তাদেরকে ছাড়াও তোমার চলবে না। তুমি বরং তাদের মধ্যে থাকবে (মন্দ কথার ক্ষেত্রে) বধির হয়ে, (ভালো কথার ক্ষেত্রে) শ্রবণশক্তিসম্পন্ন হয়ে। (মন্দ কাজের ক্ষেত্রে) অন্ধ হয়ে আর (ভালো কাজের ক্ষেত্রে) দৃষ্টিমান হয়ে এবং একইভাবে নীরব ও কথক হয়ে।
বস্তুত সমাজজীবন যাপনে এটাই মূলনীতি। ব্যাপক ফিতনা-ফাসাদ না হলে সমাজজীবন যাপন করাই বাঞ্ছনীয়। তবে সে ক্ষেত্রে অন্যের দ্বারা যাতে নিজ ঈমান ও আমল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; বরং নিজ ঈমান ও আমল দ্বারা অন্যে উপকৃত হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। আর এটা উল্লিখিত মূলনীতির অনুসরণ দ্বারাই সম্ভব। সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন, তাবে-তাবি'ঈন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীনসহ প্রতি যুগের অনুসরণীয় উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীন তাঁদের জীবনযাপনে এ নীতিই অনুসরণ করেছেন। তাঁরাই আমাদের আদর্শ। আমাদেরকেও এ অনুসারেই পার্থিব জীবন যাপন করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
‘মানুষের সঙ্গে মিলামিশে... থাকার ফযীলত’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى
অর্থ: তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ২)
ব্যাখ্যা
البر বলা হয় ওই সকল কাজ করাকে, শরী'আতের পক্ষ থেকে যা করতে আদেশ করা হয়েছে, যথা- নামায পড়া, যাকাত দেওয়া, রোযা রাখা, হজ্জ করা, পর্দা করা, হালাল খাওয়া, পিতা-মাতার হুকুম মানা, বড়কে সম্মান করা, ছোটকে স্নেহ করা, আলেমদের মর্যাদা দেওয়া ইত্যাদি।
التقوى হল ওই সকল কাজ থেকে বিরত থাকা, যা করতে শরী'আতে নিষেধ করা হয়েছে, যেমন- জুয়া খেলা, মাদক সেবন করা, চুরি করা, সুদ-ঘুষ খাওয়া, জুলুম করা, অমুসলিমদের অনুকরণ করা, নাচ, গান ও অশ্লীল কাজ করা ইত্যাদি।
শরী'আতের যাবতীয় বিষয় এ দু'টি শব্দের মধ্যে এসে গেছে। এতে আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে, আমরা যেন করণীয় ও বর্জনীয় যাবতীয় বিষয়ে একে অন্যকে সাহায্য করি। এ সাহায্য হয় দীনী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখার দ্বারা, বিশেষত মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, মক্তব ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করা, দীনী পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা ও দাওয়াতী মেহনত পরিচালনা করার দ্বারা। এমনিভাবে নেক আমলের প্রতি উৎসাহ দেওয়া এবং কারও নেক আমলের পক্ষে যা-কিছু বাধা হয় তা অপসারণ করার দ্বারাও সৎকর্ম ও তাকওয়া অবলম্বনে সহযোগিতা করা হয়।
সমাজে এমন অনেক কিছুই চালু আছে, যার সংস্পর্শে এসে মানুষ সৎকর্মের উৎসাহ হারায় এবং অসৎকর্মে লিপ্ত হওয়ার উসকানি পায়। সুতরাং সৎকর্ম ও তাকওয়া- পরহেযগারীতে সহযোগিতা করার জন্য সচেতন মহলের কর্তব্য শরী'আতবিরোধী কর্মকাণ্ডের দুনিয়াবী ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা এবং শরী'আতবিরোধী কার্যকলাপের আখড়া ও কেন্দ্রসমূহ উৎখাতে নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা চালানো। অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের দীনদারীতে পিতা-মাতাও বাধা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে বোঝানোর চেষ্টা করাও অবশ্যকর্তব্য।
এ আয়াতে একে অন্যকে সাহায্য করতে বলা হয়েছে কেবল নেককাজ ও তাকওয়া- পরহেযগারীতে। সুতরাং নির্দেশনা পাওয়া গেল যে, কোনও কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য কেবল তখনই করা যাবে, যখন সে কাজটি শরী'আত মোতাবেক হবে। যদি তা শরী'আত মোতাবেক না হয় তবে কোনও অবস্থাতেই সে কাজে সাহায্য করা যাবে না, তাতে সাহায্যপ্রার্থী যত আপন লোকই হোক না কেন। সুতরাং আলোচ্য আয়াতেরই পরবর্তী অংশে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ
‘গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না।’
যেহেতু এ আয়াতে নেককাজ ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে একে অন্যকে সাহায্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাই আপন আপন শক্তি ও ক্ষমতা অনুযায়ী এটা করা প্রত্যেকের জন্য অবশ্যকর্তব্য। আলেমের কর্তব্য আপন ইলম দ্বারা মানুষের সৎকর্ম ও তাকওয়া অবলম্বনে ভূমিকা রাখা। সমাজের ধনী ও বিত্তবানদের কর্তব্য আপন ধন- সম্পদ দ্বারা সৎকর্ম ও তাকওয়া-পরহেযগারীর বিস্তারে সহযোগিতা করা। যারা সাহসী ও শক্তিমান, তাদের কর্তব্য সৎকর্ম ও তাকওয়ার প্রচার-প্রতিষ্ঠায় আপন শক্তিকে কাজে লাগানো। এভাবে যার যে ক্ষমতা ও সামর্থ্য আছে, তা দ্বারাই পারস্পরিক সৎকর্ম ও তাকওয়ার অর্জন ও সুরক্ষায় সাহায্য-সহযোগিতা করা একান্ত কর্তব্য।
বলাবাহুল্য এসকল দায়িত্ব পালন কেবল তখনই সম্ভব হয়, যখন সমাজ ও সমষ্টির একজনরূপে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা হয়। নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করলে এসব দায়িত্ব পালনের কোনও অবকাশই আসে না। একজন মুমিন ও মুসলিমরূপে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করা, একতাবদ্ধ জীবনযাপন করা, সৎকর্মে পরস্পরে সহযোগিতা করা ও অসৎকর্ম প্রতিরোধ করা যে অবশ্যপালনীয় কর্তব্য, তা কেবল এই এক আয়াতই নয়, কুরআন ও হাদীছের বিভিন্ন বাণী দ্বারা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
‘(হে মুসলিমগণ!) তোমরা সেই শ্রেষ্ঠতম দল, মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের অস্তিত্ব দান করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করে থাক ও অন্যায় কাজে বাধা দিয়ে থাক।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১১০)
সূরা 'আসূরে ইরশাদ হয়েছে-
وَالْعَصْرِ (1) إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ (2) إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (3)
‘কালের শপথ! বস্তুত মানুষ অতি ক্ষতির মধ্যে আছে। তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং একে অন্যকে সত্যের উপদেশ দেয় ও একে অন্যকে সবরের উপদেশ দেয়।’
অন্যত্র ইরশাদ-
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ (33) وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ (34) وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (35)
‘তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে ডাকে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি আনুগত্য স্বীকারকারীদের একজন। ভালো ও মন্দ সমান হয় না। তুমি মন্দকে প্রতিহত করো এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট। ফলে যার ও তোমার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সবর করে এবং এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয় যারা মহাভাগ্যবান।’(সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ৩৩-৩৫)
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
‘আল্লাহর রশিকে (অর্থাৎ তাঁর দীন ও কিতাবকে) দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো এবং পরস্পরে বিভেদ করো না।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১০৩)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. সাধারণ অবস্থায় নিঃসঙ্গ না থেকে অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা বাঞ্ছনীয়।
খ. সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার ক্ষেত্রে পরস্পরে সৎকর্ম ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে সহযোগিতা করা ঈমানের দাবি।
গ. সৎকর্ম ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য কোনটা সৎকর্ম ও কোনটা অসৎকর্ম, তা স্পষ্টভাবে জেনে নিতে হবে।
ঘ. কোনওক্রমেই যাতে শরী'আতবিরোধী কাজে সহযোগিতা না করা হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা খুবই জরুরি।
অধ্যায় : ৭১
মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ
اَلتوَاضُعُ (তাওয়াযু‘) শব্দের উৎপত্তি ضعة থেকে। এর অর্থ হীনতা ও নমনীয়তা। তাওয়াযু'র শাব্দিক অর্থ নিজ ক্ষুদ্রতা, বিনয় ও নমনিয়তা প্রকাশ করা। তাওয়াযু' বা বিনয়ের পারিভাষিক অর্থ হল, নিজের তুলনায় যার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লক্ষ করা যায় তাকে সম্মান করা। কারও মতে যাকে সম্মান দেখানো হয়, তার নিজেকে সে তুলনায় নিম্নস্তরের বলে প্রকাশ করাকে তাওয়াযু' বলে। ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাওয়াযু' কাকে বলে? তিনি বলেন, সত্যের সামনে নতিস্বীকার করা এবং যে-ই তা বলুক না কেন তা গ্রহণ করে নেওয়া।
হাসান বসরী রহ. বলেন, তাওয়াযু‘ হল এই যে, তুমি ঘর থেকে বের হয়ে যে-কোনও মুসলিমের সাক্ষাৎ পাবে, মনে করবে সে কোনও না কোনওভাবে তোমার চেয়ে উত্তম।
আবু ইয়াযীদ বিস্তামী রহ. *বলেন, কোনও বান্দা যতক্ষণ মনে করবে মানুষের মধ্যে তারচে' নিকৃষ্ট কেউ আছে, ততক্ষণ সে একজন অহংকারী।*(লোকমুখে বায়েযীদ বুস্তামী নামে বেশি প্রসিদ্ধ। -সম্পাদক)
বলা হয়ে থাকে, তাওয়াযু‘ ও বিনয়ের মধ্যেই মর্যাদা, তাকওয়ার মধ্যেই শক্তি এবং পরিতুষ্টির মধ্যেই স্বাধীনতা।
প্রকৃতপক্ষে তাওয়াযু‘ ও বিনয় হল অন্তরস্থ গুণ। অন্তরে এ গুণ জন্ম নেয় আল্লাহ তা'আলার ও নিজের প্রতি দৃষ্টিপাত থেকে। বান্দা যখন আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর গুণাবলি, তাঁর গৌরব-মহিমা ও দয়া-ভালোবাসা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে, সেইসঙ্গে নিজ সত্তা, নিজ যোগ্যতা ও গুণাবলির ত্রুটি এবং নিজ কর্ম ও চারিত্রিক মন্দত্ব সম্পর্কে অনুধাবন করে, তখন তার অন্তরে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেটাই তাওয়াযু' ও বিনয়। এটি একটি মহৎ গুণ। নিজ আচার-আচরণ দ্বারা এ গুণের প্রকাশ ঘটে। সুতরাং অন্তরে যখন এ গুণ জন্ম নেয়, তখন বান্দা সত্য গ্রহণ করে নিতে দ্বিধাবোধ করে না, তা যেই বলুক, সে বড় হোক বা ছোট, নারী হোক বা পুরুষ, অভিজাত হোক বা সাধারণ, স্বাধীন হোক বা গোলাম। এমনিভাবে সে কাউকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে না; বরং আল্লাহ তা'আলার যে-কোনও বান্দাকেই স্বচ্ছন্দমনে ভাই বলে গণ্য করতে পারে। সে কারও হক নষ্ট করতে পারে না, তা সে হক তার যত বড় শত্রুরই হোক না কেন। এমনিভাবে সে অতি সহজেই যে-কাউকে ক্ষমা করতে পারে, তা যত বড় অপরাধই হোক না কেন।
বিনয় যখন অন্তরের একটা অবস্থা, তখন বিনয়ী ব্যক্তি কখনও মনে করে না সে একজন বিনয়ী। লোকে তার আচরণকে বিনয় মনে করে। কিন্তু সে নিজে তা বিনয় বলে মনে করে না; বরং মনে করে তা-ই ন্যায্য আচরণ, যা তার করাই উচিত ছিল। উলামায়ে কেরাম বলেন, যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে বিনয় আছে বলে মনে করে, প্রকৃতপক্ষে সে একজন অহংকারী। কেননা সে যখন বিনয় প্রদর্শন করে, তখন মনে করে- যে আচরণটা সে করল, সেই তুলনায় তার মর্যাদা আরও উপরে। আর প্রকৃত বিনয়ী ব্যক্তি যখন বিনয় প্রদর্শন করে, তখন ভাবে সে তুলনায় তার মর্যাদা আরও নিচে।
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, এক বিনয় হল ওয়াজিব ও অবশ্যকর্তব্য। আর তা হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার সম্মুখে বিনয়। এমনিভাবে আল্লাহ তা'আলা যাদের সঙ্গে বিনয় অবলম্বন করতে বলেছেন, তাদের সম্মুখেও। যেমন রাসূল, ইমাম (মুসলিম শাসক), আলেম ও পিতা-মাতা।
এছাড়া অন্যসব মানুষের ক্ষেত্রে বিনয়ের বিধান হল এই যে, যদি কেবল আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে তা করা হয়, তবে তা প্রশংসনীয় ও কাম্য। এ বিনয়ের দ্বারা আল্লাহ তা'আলা মানুষের অন্তরে বিনয়ীর প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করেন এবং তাদের কাছে তার সম্মান বৃদ্ধি করেন।
আরেক বিনয় হচ্ছে দুনিয়াদার ও জালেম অত্যাচারীদের সঙ্গে, যা দ্বারা তাদের সুদৃষ্টি লাভ করা উদ্দেশ্য হয়। এরূপ বিনয় নিন্দনীয় ও গর্হিত। এর দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানে নিজ ইজ্জত-সম্মান নষ্ট হয়। কোনও এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি ধনীর ধনের কারণে বিনয় অবলম্বন করে, তার দীনের দুই-তৃতীয়াংশ বরবাদ হয়ে যায়।
‘বিনয়’ ইসলামের এক মৌলিক চারিত্রিক শিক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম বিনয়ী ছিলেন। সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিভিন্ন সময় অন্যান্য নবী-রাসূলগণের ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন। কখনও কখনও তিনি কোনও কোনও নবীকে নিজেরও উপরে মর্যাদাদান করেছেন। তিনি নিজ উম্মতকেও এ গুণ আয়ত্ত করার প্রতি উৎসাহদান করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম উচ্চতর বিনয়ের অধিকারী ছিলেন। প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বিধবা মহিলাদের বাড়িতে গিয়ে ছাগলের দুধ দুইয়ে দিতেন। হযরত উমর ফারুক রাযি. নিজ কাঁধে পানির মশক বহন করেছেন। হযরত উছমান গনী রাযি, অনেক বড় ধনী হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত সাদামাঠা জীবনযাপন করতেন। হযরত আলী রাযি. বাজার থেকে সওদা কিনে নিজে বয়ে নিয়ে আসতেন। হযরত হাসান রাযি. একবার আরোহী অবস্থায় রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন একদল শিশু তাঁর সামনে পড়ল। তাদের কাছে রুটির টুকরো ছিল। তারা তাঁকে তাদের অতিথি হতে আহ্বান জানাল। তিনি বাহন থেকে নেমে তাদের সঙ্গে সেই রুটি খাওয়ায় শরীক হলেন। পরে তিনি তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে উট বোঝাই করে খাদ্য ও পোশাক পাঠিয়ে দিলেন। এ বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেন যে, মহত্ত্ব তাদেরটাই বড়। কারণ তারা তাদের কাছে যা ছিল সবটা দিয়ে আমার মেহমানদারি করেছে। কিন্তু আমি তো তাদের কাছে পাঠিয়েছি আমার যা আছে তার অংশ মাত্র। একবার এক রাতে খলীফা হযরত উমর ইবন আব্দুল আযীয রহ.-এর কাছে এক অতিথি আসল। অতিথি তাঁর সামনে বসা ছিল। এ অবস্থায় বাতি নিভে গেল। অতিথি নিজে তেল ভরে বাতি জ্বালিয়ে দিতে চাইল। তিনি বললেন, অতিথিকে দিয়ে কাজ করানো ভদ্রতা নয়। অতিথি বলল, তবে খাদেমকে ডেকে দিই? তিনি বললেন, সে মাত্র ঘুমিয়েছে। এখন তাকে জাগানো ঠিক হবে না। এই বলে তিনি নিজেই তেল ভরে বাতি জ্বালিয়ে নিলেন। অতিথি বলল, আপনি আমীরুল মুমিনীন হয়েও নিজে কাজ করলেন? তিনি বললেন, আমি যখন বাতি জ্বালাতে গিয়েছি তখনও উমর ছিলাম, আর যখন ফিরে এসেছি তখনও উমরই আছি। কাজ করাতে আমার কিছুই কমে যায়নি।
বস্তুত সব যুগেই প্রকৃত দীনদারগণ এরূপ বিনয়েরই অধিকারী ছিলেন। কুরআন ও হাদীছে এ গুণটির অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। তারা তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ গুণটি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। আমাদেরও কর্তব্য এ গুণ অর্জনের সাধনা করা। সে উদ্দেশ্যেই বর্তমান অধ্যায়ে ইমাম নাওয়াবী রহ. এ সম্পর্কে কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এসব আয়াত ও হাদীছ বোঝার ও এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
‘মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ (215)
অর্থ: আর যে মুমিনগণ তোমার অনুসরণ করে, তাদের সঙ্গে বিনয়-নম্র আচরণ করো।(সূরা শু'আরা (২৬), আয়াত ২১৫)
ব্যাখ্যা
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ এর মূল অর্থ- তোমার ডানা নামিয়ে দাও। মৌলিকভাবে শব্দটি পাখির ডানার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। মানুষের হাত বোঝানোর জন্যও এর ব্যবহার আছে। যেমন কুরআন মাজীদে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি আল্লাহ তা'আলার এক আদেশ উদ্ধৃত হয়েছে যে-
وَاضْمُمْ إِلَيْكَ جَنَاحَكَ مِنَ الرَّهْبِ
‘ভয় দূর করার জন্য তোমার বাহু নিজ শরীরে চেপে ধরো।(সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৩২)
পিতা-মাতার প্রতি কোমল ব্যবহারের নির্দেশ সম্পর্কিত এক আয়াতে ইরশাদ-
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ
‘তাদের প্রতি মমতায় নম্রতার ডানা নামিয়ে দাও।’(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৪)
পাখি যখন নিচে নামে, তখন সে তার ডানা নামিয়ে দেয়। যখন উড়তে শুরু করে, তখন ডানা উঁচু করে দেয়। তো ডানা নামানো যেহেতু নিচে নামার ইঙ্গিত, তাই রূপকার্থে এর দ্বারা বিনয় ও নম্রতা বোঝানো হয়ে থাকে। সে কারণেই অর্থ করা হয়েছে- বিনয়-নম্র আচরণ করো।
‘ডানা নামানো’ দ্বারা মমত্বপূর্ণ আচরণও বোঝানো হয়। পাখি যখন তার ছানাদেরকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়, তখন প্রথমে ডানা বিস্তার করে দেয়, তারপর ছানারা যখন তার শরীরের সঙ্গে এসে মিশে যায়, তখন তাদের উপর তা নামিয়ে দেয়। এটা ছানাদের প্রতি তার মমত্বের আচরণ। নিজ অনুসারী ও অধীন ব্যক্তিবর্গকে অনুরূপ কাছে নিয়ে আসা ও তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করাকে পাখির এ আচরণের সঙ্গে উপমিত করা হয়েছে এবং সে হিসেবেই পাখির জন্য ব্যবহৃত শব্দমালাকে এস্থলে ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং 'মুমিনদের প্রতি ডানা নামিয়ে দাও'-এর অর্থ হবে- যারা তোমার প্রতি ঈমান এনেছে, তুমি তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করো, যাতে তারা তোমার কাছে কাছে থাকে, দূরে সরে না যায়।
বিনয়-নম্রতা ও মমতা কাছাকাছি বিষয়ই। অন্তরে মমতা থাকলেই বিনয়-নম্র আচরণ করা হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি বিনয়-নম্র আচরণ করে, বোঝা যায় তার অন্তরে মমতা আছে। সুতরাং আয়াতটিতে এ দুই অর্থের যেটিই করা হোক তা সঠিকই হবে।
সরাসরি এ আদেশটি করা হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, যাতে তিনি গরীব মুসলিমদের প্রতি নম্রকোমল আচরণ বজায় রাখেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি এই চরিত্রেরই ছিলেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশদান দ্বারা মূলত আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, আমরা যেন একে অন্যের প্রতি কোমল আচরণ করি ও মায়া-মমতার সঙ্গে মিলেমিশে থাকি। যেমন সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ
‘যারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৫৪)
অপর এক আয়াতে আছে-
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
‘মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। তাঁর সঙ্গে যারা আছে, তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং আপসের মধ্যে একে অন্যের প্রতি দয়ার্দ্র।’(সূরা ফাতহ (৪৮), আয়াত ২৯)
যাদের প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিনয় ও নম্র আচরণ করতে বলেছেন, সেই সাহাবীগণ ছিলেন তাঁর অধীন ও অনুসারী। তাঁর ও তাঁদের মধ্যে মর্যাদাগত পার্থক্য ছিল দুস্তর। তা সত্ত্বেও যখন তাঁকে তাঁদের প্রতি বিনয়-নম্র আচরণ করার আদেশ করা হয়েছে, তখন অন্যদের প্রতি এ আদেশ আরও কত বেশি প্রযোজ্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রত্যেকেরই কর্তব্য অধীন ব্যক্তিবর্গের প্রতি মমতাশীল হয়ে থাকা। তাদের প্রতি অহমিকাপূর্ণ আচরণ সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। তাদের সঙ্গে কথা বলা হবে কোমল। আপন কাজ ও আচরণে প্রকাশ পাবে বিনয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে শিক্ষাই আমাদের জন্য রেখে গেছেন।
তাঁর সে শিক্ষার ফল ছিল এই যে, সাহাবীগণও আপন আচার-আচরণে তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ স্তরের বিনয় রক্ষা করতেন। কথা ও কাজে পরিপূর্ণ আদবের দিকে লক্ষ রাখতেন। অধীনদের পক্ষ থেকে বিনয় ও আদবের আচরণ যেমন অভিভাবক ও অধিকর্তার মমত্বপূর্ণ আচরণের সুফল, তেমনি অধীন ও অনুসারীরূপে এটা তাদের কর্তব্যও বটে। আয়াতে অভিভাবককেই যখন বিনয়-নম্র আচরণের আদেশ করা হয়েছে, তখন অধীন ও অনুসারীদের প্রতি তো এ আদেশ আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বর্তায়।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুরুব্বী ও গুরুজনের কর্তব্য অধীনদের সঙ্গে বিনয়-নম্র আচরণ করা।
খ. প্রত্যেক অধীনকেও অবশ্যই আপন মুরুব্বী ও গুরুজনের প্রতি বিনয়ী হয়ে থাকতে হবে।
গ. ঈমানের সুবাদে প্রত্যেক মুমিন অপরাপর মুমিনদের কাছে বিনয়-নম্র আচরণ পাওয়ার অধিকার রাখে।
ঘ. আয়াতটির শব্দসমূহের প্রতি লক্ষ করলে জানা যায় যে, কুরআন মাজীদের বিভিন্ন শব্দ তার প্রকৃত অর্থে নয়; বরং রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।
দুই নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্য হতে কেউ যদি নিজ দীন থেকে ফিরে যায়, তবে আল্লাহ এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারাও তাকে ভালোবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৫৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা মুমিনদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তারা যেন কিছুতেই নিজেদের দীন পরিত্যাগ না করে। আল্লাহ না করুন, কেউ তা করলে তাতে আল্লাহ তা'আলার কোনও ক্ষতি নেই; সে নিজেই ধ্বংস হবে। আল্লাহ তা'আলা তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মুখাপেক্ষী নন। কাজেই কেউ পিছিয়ে গেলে তিনি এ লক্ষ্যে তাদের পরিবর্তে উন্নত গুণাবলির অধিকারী লোকদের দাঁড় করিয়ে দেবেন। তারা কি কি সগুণের অধিকারী হবে তাও এ আয়াতে বলে দেওয়া হয়েছে।
তাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে- يُحِبُّهُمْ (তিনি তাদের ভালোবাসবেন)। অর্থাৎ যারা ইসলাম পরিত্যাগ করবে, তাদের পরিবর্তে আল্লাহ তা'আলা যাদেরকে দাঁড় করাবেন তাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন। আল্লাহ তা'আলা কাদেরকে ভালোবাসবেন, সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ (31)
(হে নবী! মানুষকে) বলে দাও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ৩১)
সুতরাং বোঝা গেল, তাদের প্রথম গুণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা, যার ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তা'আলা তাদের ভালোবাসবেন।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল- يُحِبُّونَهُ (তারাও তাকে ভালোবাসবে)। অর্থাৎ সে দলটির মধ্যে আল্লাহপ্রেম থাকবে। আর আল্লাহপ্রেমের দাবি হল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা। এ হিসেবে প্রকৃতপক্ষে উভয়টি একই গুণ। কেননা আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবেসে থাকলে কর্তব্য সুন্নতের অনুসরণ করা। আর সুন্নতের অনুসরণ করলে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা পাওয়া যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে সুন্নতের অনুসরণই মূল কথা। এ গুণ যার মধ্যে থাকে, সে সত্যিকারের আল্লাহপ্রেমিকও এবং আল্লাহ তা'আলার মাহবুব ও ভালোবাসার পাত্রও।
তাদের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল- أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ (তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে)। أَذِلَّةٍ শব্দটি ذليل এর বহুবচন। এর উৎপত্তি ذل থেকে। অর্থ সহজতা, বিনয়, নম্রতা। اَعِزَّة শব্দটি عَزِيزٌ এর বহুবচন। এর উৎপত্তি عز থেকে। এর অর্থ শক্তি, ক্ষমতা, প্রতাপ, কঠোরতা। বাক্যটিতে বোঝানো হয়েছে- আল্লাহপ্রেমের দাবিতে তারা ভালোবাসবে মুমিনদেরও। ফলে তাদের প্রতি নম্র-কোমল আচরণ করবে, তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকবে, তাদেরকে নিজ দেহের অংশস্বরূপ মনে করবে, তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে থাকবে, কখনও তাদের সঙ্গে ঝগড়া- ফাসাদ ও হিংসা-বিদ্বেষে লিপ্ত হবে না; বরং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে ও ক্ষমাশীলতার পরিচয় দেবে।
অপরদিকে তারা কাফের ও অমুসলিমদের প্রতি থাকবে কঠোর ও কঠিন। অর্থাৎ পার্থিব বিষয়ে তারা তাদের প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণ করবে বটে, কিন্তু দীনের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কখনও আপোস করবে না। প্রয়োজনে জান-মাল দিয়ে লড়াই করবে।
আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বেরাদার এমনকি পিতা-মাতাও যদি দীনের বিরুদ্ধাচরণ করে, তবে তাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে দ্বিধাবোধ করবে না। এটাই প্রকৃত মুমিনের পরিচায়ক।
এ আয়াতটিতে সেই মুমিনদের আরও দু'টি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছে। তার প্রথমটি হচ্ছে - يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ (তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে)। অর্থাৎ তারা দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠাকল্পে নিজেদের জান-মাল দিয়ে সংগ্রাম করবে। প্রয়োজনে সসস্ত্র যুদ্ধেও অবতীর্ণ হবে।
আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল- وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ (এবং কোনও নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না)। অর্থাৎ দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ ও সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে তারা অমুসলিম ও বেদীন কিসিমের লোকের নিন্দার কোনও তোয়াক্কা করবে না। তারপর আল্লাহ তা'আলা বলেন-
ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ (এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার প্রিয়পাত্র হওয়া, তাঁর প্রেমিক হওয়া, মুমিনদের প্রতি বিনয়ের আচরণ করা, কাফেরদের প্রতি কঠোর হওয়া, আল্লাহর পথে জিহাদ করা এবং দীনের পথে কোনও নিন্দুকের নিন্দার তোয়াক্কা না করা সকলের ভাগ্যে হয় না। এটা আল্লাহ তা'আলার দান। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকেই এসব বৈশিষ্ট্য দিয়ে থাকেন। সুতরাং কেউ যদি নিজের মধ্যে এসব গুণ দেখতে পায়, তার কর্তব্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা এবং তাঁর কাছে আরও বেশি বেশি চাওয়া। যার মধ্যে এসব গুণ অনুপস্থিত, তার কর্তব্য এগুলো অর্জনের জন্য সাধনা ও মুজাহাদা করা এবং এর জন্য আন্তরিকভাবে আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করতে থাকা।
প্রকাশ থাকে যে, এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইশারায় একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ভবিষ্যদ্বাণীটি হল- কখনও কখনও এ উম্মতের কিছু কিছু লোক মুরতাদ হয়ে যাবে। অর্থাৎ দীন ত্যাগ করে বেঈমান হয়ে যাবে। আর যখনই কেউ বা কোনও দল মুরতাদ হবে, আল্লাহ তা'আলা তাদের পরিবর্তে অপর একদল লোককে ঈমানদার বানিয়ে দেবেন। ঈমানে তারা হবে অনেক পাকাপোক্ত এবং তাদের মধ্যে আয়াতে বর্ণিত ৫টি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকবে। সর্বপ্রথম এ ভবিষ্যদ্বাণী পূরণ হয়েছে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর আমলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর আরবের বিভিন্ন এলাকার লোক মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। সে জিহাদে আল্লাহ তা'আলা সাহাবায়ে কেরামকে জয়যুক্ত করেন। তারপর শুরু হয়ে যায় ইসলামের অপ্রতিরোধ্য দিগ্বিজয়। তাতে বহু জাতিগোষ্ঠী ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। নবদীক্ষিত সেসকল মুসলিম পৃথিবীর দিকে দিকে ইসলাম বিস্তারে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। তারা ছিলেন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী। আয়াতে বর্ণিত পাঁচওটি বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষে তাদের জীবন এমন এক উচ্চতায় উপনীত হয়েছিল যে, আজও পর্যন্ত তারা গোটা মানবসাধারণের জীবনগঠনের অনুপম আদর্শ।
এটা কেবল সেই কালের কথাই নয়। তার পর থেকে অদ্যাবধি যখনই কেউ ইসলাম ত্যাগ করেছে, তার পরিবর্তে কেবল একজন নয়; বহু আল্লাহর বান্দা বিপুল উদ্যমে ইসলামের পথে ছুটে এসেছেন। আজও যখন কোনও কোনও হতভাগাকে বেঈমান ও নাস্তিক হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে দেখা যাচ্ছে, তখন পৃথিবীর চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে, হাজারও মানুষ প্রবল আগ্রহের সঙ্গে ইসলাম কবুল করছে এবং নিজেরা ইসলামের দা'ঈ ও আহ্বায়করূপে পথহারা মানুষকে আল্লাহকে পাওয়ার পথ চেনাচ্ছে। কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী তো ব্যর্থ হতে পারে না। ইসলাম আল্লাহ তা'আলার সর্বশেষ মনোনীত দীন। দু'-চারজন মুরতাদের হল্লাচিল্লার কারণে এ দীনের নিরবচ্ছিন্ন গতি থেমে যেতে পারে কি? তা কখনও থামার নয়। কিয়ামত পর্যন্ত এ দীন তার আপন গতিতে চলতে থাকবে। দু'-চারজন বিপথগামীর স্থানে হাজারও সত্যসন্ধানী এর দিকে অটল প্রত্যয়ে এগিয়ে আসতে থাকবে। আল্লাহ তা'আলা মৃত্যু পর্যন্ত আমাদেরকে ঈমানের উপর অবিচল রাখুন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ইসলাম এক জীবন্ত দীন, যা কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে।
খ. ইসলাম আপন স্থায়িত্বের জন্য কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের মুখাপেক্ষী নয়।
গ. ইসলাম থেকে কারও বিমুখ হওয়াটা তার চরম দুর্ভাগ্য।
ঘ. কেউ ইসলাম থেকে বিচ্যুত হলে আরও উৎকৃষ্ট ব্যক্তি দ্বারা তার স্থান পূরণ হয়।
ঙ. আল্লাহপ্রেমিক হওয়া ও আল্লাহর ভালোবাসার পাত্র হতে পারাই একজন মুমিনের জীবনের পরম লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত।
চ. একজন মুমিনের কর্তব্য অপর মুমিনের প্রতি বিনয়ী থাকা ও কোমল আচরণ করা।
ছ. দীন ও ঈমান বিষয়ে মুমিনদেরকে কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর ও কঠিন অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
জ. দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা ও জান-মাল দিয়ে সংগ্রাম করা ঈমানের দাবি।
ঝ. দীনের উপর চলা ও দীনের প্রচার-প্রতিষ্ঠার মেহনত অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে নিন্দুকের নিন্দার তোয়াক্কা করা প্রকৃত মুমিনের কাজ নয়।
ঞ. ঈমান ও ঈমানের গুণাবলি অর্জন আল্লাহ তা'আলার তাওফীকেই সম্ভব। তাই এর জন্য মেহনত করার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে দু'আও অব্যাহত রাখতে হবে।
তিন নং আয়াত
يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
অর্থ: হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সেই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী।(সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১৩)
ব্যাখ্যা
এটি কুরআন মাজীদের অতি মহান এক আয়াত। এটি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এক কঠিন কষাঘাত। এর মাধ্যমে গায়ের রং ও ভাষাভিত্তিক বর্ণবাদ এবং অঞ্চল ও গোষ্ঠী- গোত্রভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। জাহিলী যুগে সর্বত্র বর্ণবৈষম্যের অন্ধকার ছেয়ে ছিল। ইসলাম এ আয়াতের মাধ্যমে তার অনুসারীদের সে অন্ধকার থেকে মুক্ত করেছে। বর্ণিত আছে, মক্কাবিজয়ের দিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত বিলাল রাযি.-কে কা'বাঘরের ছাদের উপর উঠে আযান দেওয়ার হুকুম দেন। তিনি আযান দিতে শুরু করলে মক্কার পুরোনো মোড়লেরা স্তম্ভিত হয়ে ওঠে। একজন কালো কুৎসিৎ লোককে কিনা পবিত্র কা'বাঘরের ছাদের উপর উঠিয়ে দেওয়া হল! নানাজনে নানা মন্তব্য করতে শুরু করল। কেউ কেউ মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও এই ভয়ে মুখে কিছু বলল না, না জানি আল্লাহ তা'আলা ওহীর মাধ্যমে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানিয়ে দেন। তা জানিয়ে দেওয়াও হল। তিনি তাদের ডেকে বললেন, তোমরা এই এই কথা বলাবলি করছিলে না? তারা তা স্বীকার করতে বাধ্য হল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা'আলা আলোচ্য আয়াতটি নাযিল করেন। আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى (হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি)। আয়াতটির সম্বোধন গোটা মানবজাতির প্রতি। আরব হোক বা অনারব, এশিয়ান হোক বা আফ্রিকান, সাদা হোক বা কালো, শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, ধনী হোক বা গরীব, ব্যবসায়ী হোক বা শ্রমজীবী, মূলত সকলেই একই আদি পিতা-মাতার সন্তান। হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হাউওয়া আলাইহাস সালাম থেকেই সকলের সৃষ্টি। হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছিল মাটি দিয়ে। সে হিসেবে সকলেই মাটির মানুষ। আদম আলাইহিস সালামের বংশ পরম্পরায় দুনিয়ার সমস্ত নারী-পুরুষ পিতা-মাতার মধ্য দিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছে। কাজেই এ হিসেবে সকলেই এক। কারও উপর কারও কোনও শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন-
قَدْ أَذْهَبَ اللهُ عَنْكُمْ عُبَيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ وَفَخْرَهَا بِالْآبَاءِ، مُؤْمِنٌ تَقِيُّ، وَفَاجِرٌ شَقِيٌّ وَالنَّاسُ بَنُوْ آدَمَ وَآدَمُ مِنْ تُرَابٍ
‘আল্লাহ তা'আলা তোমাদের থেকে জাহিলিয়াতের অহমিকা ও বাপ-দাদাদের নিয়ে গৌরব-গরিমা খতম করে দিয়েছেন। মানুষ হয় মুমিন-মুত্তাকী, নয়তো ফাসেক ও পাপী। সমস্ত মানুষ আদমসন্তান। আর আদম মাটির তৈরি।(জামে তিরমিযী: ৩৯৫৬; সুনানে আবূ দাউদ: ৫১১৬; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৪৫৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১০৬২; শু'আবুল ঈমান: ৪৭৬৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৪৪)
وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا (এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার)। মানুষকে জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করাটা আল্লাহ তা'আলারই কাজ। কে আরব হবে কে অনারব, তা কোনও ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বিষয় নয়। এমনিভাবে কে সৈয়দ হবে কে চৌধুরী, কে সাদা হবে কে কালো, তাও আল্লাহ তা'আলারই ইচ্ছাধীন। তিনি যাকে যে জাতি-গোষ্ঠীতে পাঠাতে চেয়েছেন, পাঠিয়েছেন। এতে কারও নিজস্ব কৃতিত্ব নেই। তাই এ নিয়ে অহমিকারও সুযোগ নেই। আল্লাহ তা'আলা এ বিভক্তি অহমিকার জন্য করেনইনি। তিনি এটা করেছেন মানুষের পরিচয়দানের সুবিধার্থে।
মানুষ এ বিভক্তি দ্বারা সুবিধা পেয়েও থাকে। বংশপরিচয় দিলেই লোকে সহজে চিনতে পারে। নয়তো চেনা কষ্টকর হয়ে যায়। একই নামের বহু লোক আছে। কেবল নাম বললে পরিচয় পরিষ্কার হয় না। নামের সঙ্গে গোত্রপরিচয় দিলেই বিভ্রম কেটে যায় ও পরিচয় পূর্ণতা লাভ করে। সুতরাং বংশ-গোত্রের ভাগ-বাটোয়ারা আল্লাহ তা'আলার এক নি'আমত। কোনও নি'আমতকে অহমিকার বিষয়ে পরিণত করা কঠিন পাপ। বরং শোকর আদায় করা দরকার যে, আল্লাহ তা'আলা আমাদের পরিচয়দানের সুবিধার্থে বংশ-গোত্র বিভাগের কী চমৎকার এক ব্যবস্থা করেছেন!
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ (প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সেই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার কাছে মানুষের মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা কেবলই তাকওয়া-পরহেযগারীর উপর নির্ভর করে; বিশেষ কোনও বংশ, বিশেষ কোনও বর্ণ, বিশেষ কোনও পেশা বা অঞ্চলের উপর নয়। না এটা কোনও মৌরুসি বিষয় যে, বাপ-দাদা শ্রেষ্ঠ ছিল বলে আমিও শ্রেষ্ঠ। যার অন্তরে তাকওয়া আছে, সে মানুষের মনগড়া আভিজাত্যের মাপকাঠিতে যতই নিম্নস্তরের হোক, আল্লাহ তা'আলার কাছে সে অনেক মর্যাদাবান। অপরদিকে কোনও ব্যক্তি মানুষের দৃষ্টিতে যতই অভিজাত হোক না কেন, মুত্তাকী-পরহেযগার না হলে আল্লাহ তা'আলার কাছে তার কানাকড়িও মূল্য নেই। তাঁর কাছে মূল্য কেবলই তাকওয়ার। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْحَسَبُ الْمَالُ، وَالْكَرَمُ التَّقْوَى
‘হাসাব (দুনিয়াদারদের কাছে মর্যাদা) হল সম্পদ। আর কারাম (আল্লাহর কাছে মর্যাদা) হল তাকওয়া।(জামে' তিরমিযী ৩২৭১; সুনানে ইবন মাজাহ ৪২১৯; মুসনাদে আহমাদ: ২০১০২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৬৯১২; সুনানে দারা কুতনী: ৩৭৯৮; হাকিম, আল- মুস্তাদরাক: ২৬৯০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৩৭৭৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৪৫)
অপর এক হাদীছে আছে-
مَرَّ رَجُلٌ علَى رَسولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ، فَقالَ لرَجُلٍ عِنْدَهُ جَالِسٍ: ما رَأْيُكَ في هذا فَقالَ: رَجُلٌ مِن أشْرَافِ النَّاسِ، هذا واللَّهِ حَرِيٌّ إنْ خَطَبَ أنْ يُنْكَحَ، وإنْ شَفَعَ أنْ يُشَفَّعَ، قالَ: فَسَكَتَ رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ ثُمَّ مَرَّ رَجُلٌ آخَرُ، فَقالَ له رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ: ما رَأْيُكَ في هذا فَقالَ: يا رَسولَ اللَّهِ، هذا رَجُلٌ مِن فُقَرَاءِ المُسْلِمِينَ، هذا حَرِيٌّ إنْ خَطَبَ أنْ لا يُنْكَحَ، وإنْ شَفَعَ أنْ لا يُشَفَّعَ، وإنْ قالَ أنْ لا يُسْمع لِقَوْلِهِ، فَقالَ رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ: هذا خَيْرٌ مِن مِلْءِ الأرْضِ مِثْلَ هذا.
‘এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তিনি তাঁর কাছে বসা এক ব্যক্তিকে বললেন, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? সে বলল, ইনি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের একজন। আল্লাহর কসম! তিনি এর উপযুক্ত যে, বিবাহের প্রস্তাব দিলে তা কবুল করা হবে এবং কারও সম্পর্কে সুপারিশ করলে তা গৃহীত হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ করে থাকলেন। তারপর অপর এক ব্যক্তি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (কাছে বসে থাকা) সেই ব্যক্তিকে বললেন, এই লোক সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ লোকটি দরিদ্র মুসলিমদের একজন। এ এরই উপযুক্ত যে, বিবাহের প্রস্তাব দিলে তা কবুল করা হবে না এবং কারও সম্পর্কে সুপারিশ করলে তা গৃহীত হবে না। আর যদি কথা বলে তবে তার কথায় কর্ণপাত করা হবে না। এবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ ব্যক্তি ওই লোকের মতো দুনিয়াভরা মানুষ অপেক্ষাও উত্তম।(সহীহ বুখারী: ৫০৯১; সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪১২০; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর: ৫৮৮৩; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৯৯৯৮; বাগাবী, শারহুস্সুন্নাহ: ৪০৬৯)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ইসলামে কোনওরূপ বর্ণবৈষম্যের অবকাশ নেই।
খ. সমস্ত মানুষই যেহেতু এক আদি পিতা-মাতার সন্তান, তাই মানুষ হিসেবে কাউকে তুচ্ছ গণ্য করতে নেই।
গ. মানবপ্রজন্মের বিস্তারে নর-নারীর সমান ভূমিকা। উভয়েরই সে ভূমিকা স্বীকার করা উচিত।
ঘ. বংশ-গোত্রীয় বিভক্তি একটি নি'আমত, যেহেতু এর দ্বারা পরস্পরকে চেনা সহজ হয়েছে। কাজেই এ নি'আমতকে অহমিকার বিষয়ে পরিণত করা কিছুতেই সমীচীন নয়।
ঙ. আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদা নিরূপিত হয় কেবলই তাকওয়ার দ্বারা। তাই আমাদেরকে এ গুণ অর্জনে অবশ্যই সচেষ্ট থাকতে হবে।
চ. বংশীয় আভিজাত্য, অর্থ-সম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষা, ক্ষমতা ইত্যাদির বড়াই এক আত্মপ্রবঞ্চনা। তাকওয়া ছাড়া এসবের কোনও মূল্য নেই।
চার নং আয়াত
فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى (32)
অর্থ: সুতরাং তোমরা নিজেদেরকে পবিত্র বলে দাবি করো না। তিনি ভালোভাবেই জানেন মুত্তাকী কে।(সূরা নাজম (৫৩), আয়াত ৩২)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা নাজমের ৩২ নং আয়াতের শেষ অংশ। এর আগে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-
هُوَ أَعْلَمُ بِكُمْ إِذْ أَنْشَأَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَإِذْ أَنْتُمْ أَجِنَّةٌ فِي بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ
‘তিনি তোমাদের সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত আছেন, যখন তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যখন তোমরা তোমাদের মাতৃগর্ভে ভ্রূণরূপে ছিলে।’
অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যখন মাটি থেকে হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেন, তখনও তাঁর বংশধরদের বিস্তারিত অবস্থা তাঁর জানা ছিল। কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে তাঁর সন্তান-সন্ততির সংখ্যা কতজন হবে, কে কতদিন বাঁচবে, কার জীবিকা কেমন হবে, কে সৎকর্মশীল হবে কে অসৎকর্মশীল, কে ঈমানদার হবে কে বেঈমান, কতজন জান্নাতবাসী হবে কতজন জাহান্নামী- এর কোনওকিছুই আল্লাহ তা'আলার অজানা ছিল না। তিনি এসব যেমন জানতেন হযরত আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টিকালে, তেমনি জানতেন ও জানেন মাতৃগর্ভে প্রত্যেকের ভ্রূণ অবস্থায় থাকাকালেও। মোটকথা তাঁর জ্ঞান অনাদি অনন্ত। প্রত্যেকের খুঁটিনাটি যাবতীয় অবস্থা তাঁর সবসময়ই জানা। আর সে কারণেই তিনি বলছেন-
فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ (সুতরাং তোমরা নিজেদেরকে পবিত্র বলে দাবি করো না)। অর্থাৎ কোনও পাপ বা মন্দ কাজ করছ না বলে আত্মপ্রশংসা করো না। কিংবা বেশি বেশি সৎকর্ম করছ বলে বড়াই করো না। কারণ কার শেষ পরিণাম কী হবে, তোমরা কেউ তা জান না। এমনও হতে পারে যে, এখন তো কোনও গুনাহ করছ না, কেবল ভালো ভালো কাজেই লেগে আছ, কিন্তু এ অবস্থা শেষপর্যন্ত অব্যাহত থাকবে না। এক পর্যায়ে দেখা যাবে তোমার অবস্থা বদলে গেছে। আগেকার সব ভালো কাজ জলাঞ্জলি দিয়ে অসৎকর্ম শুরু করে দিয়েছ। আর সে অসৎকর্মে নিমজ্জিত থাকা অবস্থায়ই তোমার মৃত্যু ঘটেছে। এভাবে তুমি একজন পাপীরূপে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়ে জাহান্নামের বাসিন্দা হয়ে গেছ। অপরদিকে এমনও হতে পারে, যারা এখন পাপকর্মে নিমজ্জিত আর সে কারণে তোমরা তাদের ঘৃণা করছ এবং নিজেদেরকে তাদের তুলনায় উত্তম ভাবছ, এক পর্যায়ে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, তাদের মনে অনুশোচনা জেগেছে, ফলে তারা তাওবা করে জীবন বদলে ফেলেছে। এখন তারা পুরোপুরি ভালো মানুষ। তারা পাপকর্মের ধারেকাছেও যায় না। সৎকর্মের ভেতরেই দিবারাত্র পার করছে। আর এভাবে একজন সৎকর্মশীলরূপে কবরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। যদি এভাবেই তাদের মৃত্যু হয়, তবে অবশ্যই তারা জান্নাতবাসী হবে। সুতরাং আত্মপ্রশংসা করা এবং নিজেকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ বলে বড়াই করার কোনওই অবকাশ নেই। বরং দরকার বর্তমান সময়ে সৎকর্মে মশগুল থেকে শেষ পরিণামের ভয়ে ভীত থাকা, যাতে জীবনশেষে শয়তানের ফাঁদে পড়ে দীন ও ঈমান বরবাদ না হয়; বরং একজন প্রকৃত ঈমানদাররূপে মৃত্যু নসীব হয়। তারপর আল্লাহ তা'আলা বলেন-
هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى (তিনি ভালোভাবেই জানেন মুত্তাকী কে)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন তোমাদের মধ্যে কে সত্যিকার তাকওয়ার উপর আছে এবং কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে তাঁর আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে মেনে চলছে। এমনিভাবে তিনিই জানেন কে সারাটা জীবন এরূপ তাকওয়া-পরহেযগারীর সঙ্গে থাকবে আর এভাবেই একজন প্রকৃত ঈমানদাররূপে মৃত্যুবরণ করবে। সুতরাং তিনি তাঁর সে জ্ঞান অনুযায়ী ফয়সালা করবেন। আখিরাতে মুত্তাকী ব্যক্তিকে তার তাকওয়া-পরহেযগারীর পুরোপুরি প্রতিদান দেবেন। আর যেহেতু বিষয়টা কেবল তিনিই জানেন, তাই আত্মপ্রশংসা না করে বরং নেক আমলে মশগুল হও এবং যাতে ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পার, সে আশায় আল্লাহর অভিমুখী বান্দারূপে জীবন পরিচালনা করতে থাকো।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান সর্বব্যাপী। তিনি সমস্ত মানুষের যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত।
খ. কে প্রকৃত মুত্তাকী এবং যথাযথ তাকওয়া-পরহেযগারীর সঙ্গে মৃত্যুবরণ করবে, তা কেবল আল্লাহ তা'আলাই জানেন। অন্য কারও পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়।
গ. নিজ পরিণাম কী হবে এবং কী অবস্থায় মৃত্যু হবে তা যেহেতু কারও জানা নেই, তাই কারও জন্যই আত্মপ্রশংসা করা সাজে না।
পাঁচ নং আয়াত
وَنَادَى أَصْحَابُ الْأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا مَا أَغْنَى عَنْكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ (48) أَهَؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ اللَّهُ بِرَحْمَةٍ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ (49)
অর্থ: আরাফবাসীগণ একদল লোককে, যাদেরকে তারা তাদের চিহ্ন দ্বারা চিনবে, ডাক দিয়ে বলবে, তোমাদের সংগৃহীত সঞ্চয় তোমাদের কোনও কাজে আসল না এবং তোমরা যাদেরকে বড় মনে করতে তারাও না। (অতঃপর জান্নাতবাসীদের প্রতি ইশারা করে বলবে) এরাই কি তারা, যাদের সম্পর্কে তোমরা শপথ করে বলতে, আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতের কোনও অংশ দেবেন না? (তাদেরকে তো বলে দেওয়া হয়েছে,) তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না।(সুরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৪৮-৪৯)
ব্যাখ্যা
আ‘রাফ হচ্ছে জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী প্রাচীর। যাদের পাপ-পুণ্য সমান, তারা এ প্রাচীরের উপর অবস্থান করবে, যতক্ষণ না তাদের সম্পর্কে জান্নাতের ফয়সালা হয়। তারা জান্নাতের আকাঙ্ক্ষায় থাকবে। পরিশেষে আল্লাহ তা'আলা তাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতের ফয়সালা করে দেবেন। তখন তারাও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। তারা যখন আ'রাফ তথা ওই প্রাচীরের উপর অবস্থান করবে, তখন সেখান থেকে জান্নাত ও জাহান্নামবাসীদের দেখতে ও চিনতে পারবে। প্রথমে তারা জান্নাতবাসীদের দেখে খুশি হবে এবং তাদের সালাম জানাবে। তারপর যখন জাহান্নামের দিকে তাকাবে, তখন তাদের লক্ষ্য করে কিছু কথা বলবে। তারা তাদেরকে কী বলবে, সে কথাই আলোচ্য আয়াতদু'টিতে তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَنَادَى أَصْحَابُ الْأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا (আ‘রাফবাসীগণ একদল লোককে ডাক দিয়ে বলবে, যাদেরকে তারা তাদের চিহ্ন দ্বারা চিনবে)। যাদেরকে চিনবে তারা খুবসম্ভব কাফেরদের নেতৃবর্গ। তাদের বিশেষ বিশেষ চিহ্ন দেখে আরাফবাসীগণ চিনতে পারবে যে, তারা অমুক অমুক। তখন তারা তাদের ডাক দেবে। যেমন হে ফেরাউন, হে নমরূদ, হে কারুন, হে আবূ জাল, হে উকবা, হে শায়বা ইত্যাদি।
مَا أَغْنَى عَنْكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ (তোমাদের সংগৃহীত সঞ্চয় তোমাদের কোনও কাজে আসল না এবং তোমরা যাদেরকে বড় মনে করতে তারাও না)। جَمْع এর অর্থ সঞ্চিত ধন-সম্পদ অথবা দলবল। অর্থাৎ তোমরা দুনিয়ায় তোমাদের যে দলবল ও ধন-দৌলতের বড়াই করতে, আজ তা তোমাদের কোনও উপকারে আসল না। যেমন তারা দুনিয়ায় বলত-
وَقَالُوا نَحْنُ أَكْثَرُ أَمْوَالًا وَأَوْلَادًا وَمَا نَحْنُ بِمُعَذَّبِينَ (35)
‘তারা বলেছে, আমরা ধনে-জনে তোমাদের চেয়ে বেশি আর আমরা শাস্তিপ্রাপ্ত হওয়ার নই।’( সূরা সাবা‘ (৩৪), আয়াত ৩৫)
সূরা কাহফে বর্ণিত হয়েছে, এক ধনী ব্যক্তি অপর এক গরীব ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলেছিল-
أَنَا أَكْثَرُ مِنْكَ مَالًا وَأَعَزُّ نَفَرًا (34) وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَنْ تَبِيدَ هَذِهِ أَبَدًا (35) وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَى رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيْرًا مِنْهَا مُنْقَلَبًا (36)
‘আমার অর্থ-সম্পদও তোমার চেয়ে বেশি এবং আমার দলবলও তোমার চেয়ে শক্তিশালী। নিজ সত্তার প্রতি সে জুলুম করছিল আর এ অবস্থায় সে তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমি মনে করি না এ বাগান কখনও ধ্বংস হবে। আমার ধারণা কিয়ামত কখনওই হবে না। আর আমাকে আমার প্রতিপালকের কাছে যদি ফিরিয়ে নেওয়া হয়, তবে আমি নিশ্চিত (সেখানে) আমি এর চেয়েও উৎকৃষ্ট স্থান পাব।(সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ৩৪-৩৬)
أَهَؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ اللَّهُ بِرَحْمَةٍ (এরাই কি তারা, যাদের সম্পর্কে তোমরা শপথ করে বলতে, আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতের কোনও অংশ দেবেন না)? তারা এ কথা বলবে গরীব মুমিনদের দিকে ইশারা করে, যাদেরকে আল্লাহ তা'আলা ঈমান- আমলের বদৌলতে জান্নাতবাসী করেছেন। যেমন হযরত সালমান রাযি., হযরত সুহায়ব রাযি., হযরত বিলাল রাযি., হযরত খাব্বাব রাযি. প্রমুখ গরীব সাহাবায়ে কেরাম ও সকল যুগের ঈমানদার দরিদ্রগণ, কাফের-বেঈমানগণ যাদের সম্পর্কে বলত- ওরা কখনও জান্নাতে যেতে পারবে না; ওরা দুনিয়ায় যেমন কষ্ট করছে, আখিরাতেও তেমনি কষ্টের জীবনই ভোগ করতে হবে। আ'রাফবাসীগণ তাদের দেখিয়ে দেবে যে, দুনিয়ায় তাদের এসব ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও হম্বিতম্বি কতটাই মিথ্যা ছিল। আজ সেই গরীব মুসলিমগণ কেমন চিরসুখের জান্নাত লাভ করেছে আর ওই অহংকারী ধনীগণ কীভাবে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করছে।
ادْخُلُوا الْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ (তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না)। এ কথাটি আ'রাফবাসীরও হতে পারে কিংবা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে আ'রাফবাসীদের লক্ষ্য করেও হতে পারে। আ'রাফবাসীদের কথা হলে তখন এর অর্থ হবে যে, হে দাম্ভিকগণ! তোমরা তো বলেছিলে এ গরীবগণ জান্নাতে যেতে পারবে না। কিন্তু দেখো, তারা জান্নাতে চলে গেছে। তাদের লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলা হুকুম দিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না। আর যদি আ'রাফবাসীদের লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে বলা হয়, তখন এর অর্থ হবে যে, হে আ'রাফবাসীগণ! তোমাদের বিষয়টা তো এ পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল। তোমরা নিজেরা আশা করছিলে যে, তোমাদের জান্নাত দেওয়া হবে। তোমাদের সে আশা পূরণ করা হল। এবার তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. শুরুতে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে কেবল তারাই, যাদের নেক আমলের ওজন বেশি হবে।
খ. পাপ-পুণ্য সমান হলে তাদের জান্নাতলাভ বিলম্বিত হবে। শুরুতে কিছুকাল তাদের আ'রাফে কাটাতে হবে।
গ. ধন ও জনবলের বড়াই করতে নেই। আখিরাতে তা কোনও কাজে আসবে না।
ঘ. জান্নাত চিরসুখের ঠিকানা। সেখানে কোনও ভয় ও দুঃখ থাকবে না।
অহংকার ও জুলুমের প্রতি নিষেধাজ্ঞা
হাদীছ নং: ৬০১
হযরত ইয়ায ইবন হিমার রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা আমার প্রতি ওহী নাযিল করেছেন যে, তোমরা একে অন্যের প্রতি বিনয় প্রদর্শন করো, যাতে কেউ কারও প্রতি অহমিকা না দেখায় এবং কেউ কারও উপর জুলুম না করে। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৮৬৫; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৮৯৫; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৮০: আল- আদাবুল মুফরাদ: ৪২৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১০৮২; শু'আবুল ঈমান: ৬২৪৫)
হাদীছ নং: ৬০১
হযরত ইয়ায ইবন হিমার রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা আমার প্রতি ওহী নাযিল করেছেন যে, তোমরা একে অন্যের প্রতি বিনয় প্রদর্শন করো, যাতে কেউ কারও প্রতি অহমিকা না দেখায় এবং কেউ কারও উপর জুলুম না করে। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৮৬৫; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৮৯৫; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৮০: আল- আদাবুল মুফরাদ: ৪২৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১০৮২; শু'আবুল ঈমান: ৬২৪৫)
مقدمة الامام النووي
70 - باب فضل الاختلاط بالناس وحضور جمعهم وجماعاتهم، ومشاهد الخير، ومجالس الذكر معهم، وعيادة مريضهم، وحضور جنائزهم، ومواساة محتاجهم، وإرشاد جاهلهم، وغير ذلك من مصالحهم لمن قدر على الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر، وقمع نفسه عن الإيذاء وصبر على الأذى
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ المُؤْمِنِينَ} [الشعراء: 215]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينهِ فَسَوْفَ يَأتِي اللهُ بِقَومٍ يُحِبُّهُم وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى المُؤْمِنينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الكَافِرِينَ} [المائدة: 54]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا النَّاسُ إنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ} [الحجرات: 12]، وقال تَعَالَى: {فَلاَ تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى} [النجم: 32]، وقال تَعَالَى: {وَنَادَى أَصْحَابُ الأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا مَا أَغْنَى عنكم جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ أَهؤُلاَءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لا يَنَالُهُمُ اللهُ بِرَحْمَةٍ ادْخُلُوا الجَنَّةَ لاَ خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلاَ أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ} [الأعراف: 48 - 49].
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ المُؤْمِنِينَ} [الشعراء: 215]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينهِ فَسَوْفَ يَأتِي اللهُ بِقَومٍ يُحِبُّهُم وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى المُؤْمِنينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الكَافِرِينَ} [المائدة: 54]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا النَّاسُ إنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ} [الحجرات: 12]، وقال تَعَالَى: {فَلاَ تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى} [النجم: 32]، وقال تَعَالَى: {وَنَادَى أَصْحَابُ الأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا مَا أَغْنَى عنكم جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ أَهؤُلاَءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لا يَنَالُهُمُ اللهُ بِرَحْمَةٍ ادْخُلُوا الجَنَّةَ لاَ خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلاَ أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ} [الأعراف: 48 - 49].
601 - وعن عِيَاضِ بنِ حمارٍ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «إنَّ اللهَ أوْحَى إِلَيَّ أَنْ تَوَاضَعُوا حَتَّى لاَ يَفْخَرَ أحَدٌ عَلَى أحَدٍ، وَلاَ يَبْغِي أحَدٌ عَلَى أحَدٍ». رواه مسلم. (1)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬০২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৭১ মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ।
অহংকার ও জুলুমের প্রতি নিষেধাজ্ঞা
হাদীছ নং: ৬০২
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দান-খয়রাত সম্পদ কমায় না। ক্ষমাশীলতা দ্বারা আল্লাহ তা'আলা বান্দার ইজ্জত-সম্মানই বৃদ্ধি করেন। যে-কেউ আল্লাহ তা'আলার জন্য বিনয় অবলম্বন করে, আল্লাহ তা'আলা তার মর্যাদা উঁচু করেন। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৫৮৮; জামে' তিরমিযী: ৯০২৯; মুসনাদে আহমাদ: ৯০০৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৯৮১৫; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩২৪৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১২১৫০; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা ৭৮১৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৬৩৪)
হাদীছ নং: ৬০২
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দান-খয়রাত সম্পদ কমায় না। ক্ষমাশীলতা দ্বারা আল্লাহ তা'আলা বান্দার ইজ্জত-সম্মানই বৃদ্ধি করেন। যে-কেউ আল্লাহ তা'আলার জন্য বিনয় অবলম্বন করে, আল্লাহ তা'আলা তার মর্যাদা উঁচু করেন। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৫৮৮; জামে' তিরমিযী: ৯০২৯; মুসনাদে আহমাদ: ৯০০৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৯৮১৫; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩২৪৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১২১৫০; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা ৭৮১৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৬৩৪)
مقدمة الامام النووي
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
602 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ، وَمَا زادَ اللهُ عَبْدًا بعَفْوٍ إِلاَّ عِزًّا، وَمَا تَوَاضَعَ أحَدٌ للهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ». رواه مسلم. (1)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬০৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৭১ মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ।
শিশু-কিশোরদের সালাম দেওয়া
হাদীছ নং: ৬০৩
হযরত আনাস রাযি. একদল শিশুর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি তাদেরকে সালাম দিলেন এবং বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা করতেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৬২৪৭; সহীহ মুসলিম: ২১৬৮; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৭০০)
হাদীছ নং: ৬০৩
হযরত আনাস রাযি. একদল শিশুর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি তাদেরকে সালাম দিলেন এবং বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা করতেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৬২৪৭; সহীহ মুসলিম: ২১৬৮; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৭০০)
مقدمة الامام النووي
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
603 - وعن أنس - رضي الله عنه: أنَّهُ مَرَّ عَلَى صبيَانٍ، فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ، وقال: كَانَ النبيُّ - صلى الله عليه وسلم - يفعله. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬০৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৭১ মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিনয়ের একটা দৃষ্টান্ত
হাদীছ নং: ৬০৪
হযরত আনাস রাযি. বলেন, এমনও হতো যে, মদীনার দাসীদের মধ্যে কোনও দাসী (এসে) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত ধরে তাঁকে যেখানে চাইত নিয়ে যেত। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ৬০৭২; মুসনাদে আহমাদ: ১১৯৪১; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৭৮)
হাদীছ নং: ৬০৪
হযরত আনাস রাযি. বলেন, এমনও হতো যে, মদীনার দাসীদের মধ্যে কোনও দাসী (এসে) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত ধরে তাঁকে যেখানে চাইত নিয়ে যেত। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ৬০৭২; মুসনাদে আহমাদ: ১১৯৪১; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৭৮)
مقدمة الامام النووي
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
604 - وعنه، قَالَ: إن كَانَتِ الأَمَةُ مِنْ إمَاءِ المَدينَةِ لَتَأْخُذُ بِيَدِ النَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - فَتَنْطَلِقُ بِهِ حَيْثُ شَاءتْ. رواه البخاري. (1)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬০৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৭১ মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ।
গার্হস্থ্য কাজে সহযোগিতা করা
হাদীছ নং: ৬০৫
আসওয়াদ ইবন ইয়াযীদ রহ. বলেন, আমি আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে জিজ্ঞেস করলাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঘরে কী করতেন? তিনি বললেন, তিনি পরিবারবর্গের সেবায় থাকতেন। যখন নামাযের সময় হতো, নামাযে বের হয়ে যেতেন। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ৬৭৬; জামে' তিরমিযী: ২৪৮৯; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ১০৮২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৩১৭০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৬৭৮)
হাদীছ নং: ৬০৫
আসওয়াদ ইবন ইয়াযীদ রহ. বলেন, আমি আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে জিজ্ঞেস করলাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঘরে কী করতেন? তিনি বললেন, তিনি পরিবারবর্গের সেবায় থাকতেন। যখন নামাযের সময় হতো, নামাযে বের হয়ে যেতেন। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ৬৭৬; জামে' তিরমিযী: ২৪৮৯; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ১০৮২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৩১৭০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৬৭৮)
مقدمة الامام النووي
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
605 - وعن الأَسْوَدِ بن يَزيدَ، قَالَ: سُئِلَتْ عائشةُ رضي الله عنها مَا كَانَ النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم - يَصْنَعُ فِي بَيْتِهِ؟ قالت: كَانَ يَكُون في مِهْنَةِ أهْلِهِ - يعني: خِدمَة أهلِه - فإذا حَضَرَتِ الصَّلاَةُ، خَرَجَ إِلَى الصَّلاَةِ. رواه البخاري. (1)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬০৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৭১ মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ।
শিক্ষাদানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিনয়-নম্রতা
হাদীছ নং: ৬০৬
হযরত আবূ রিফা‘আ তামীম ইবন আসীদ রাযি. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পৌঁছলাম। তখন তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এক বিদেশী লোক দীন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছে। সে জানে না তার দীন কী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ভাষণ ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন এমনকি আমার পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। তারপর একটি চেয়ার আনা হল। তিনি তাতে বসলেন এবং আল্লাহ তা'আলা তাঁকে যা-কিছু শিখিয়েছেন তা থেকে আমাকে শিক্ষা দিতে লাগলেন। তারপর তিনি তাঁর ভাষণ শুরু করলেন এবং তা শেষ করলেন। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ৮৭৬; সুনানে নাসাঈ ৫৩৭৭; সহীহ ইবন খুযায়মা : ১৮০০; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর: ১২৮৪; হাকিম, আল-মুস্তাদরাক: ১০৫৫; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৫৮১৭)
হাদীছ নং: ৬০৬
হযরত আবূ রিফা‘আ তামীম ইবন আসীদ রাযি. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পৌঁছলাম। তখন তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এক বিদেশী লোক দীন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছে। সে জানে না তার দীন কী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ভাষণ ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন এমনকি আমার পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। তারপর একটি চেয়ার আনা হল। তিনি তাতে বসলেন এবং আল্লাহ তা'আলা তাঁকে যা-কিছু শিখিয়েছেন তা থেকে আমাকে শিক্ষা দিতে লাগলেন। তারপর তিনি তাঁর ভাষণ শুরু করলেন এবং তা শেষ করলেন। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ৮৭৬; সুনানে নাসাঈ ৫৩৭৭; সহীহ ইবন খুযায়মা : ১৮০০; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর: ১২৮৪; হাকিম, আল-মুস্তাদরাক: ১০৫৫; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৫৮১৭)
مقدمة الامام النووي
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
606 - وعن أَبي رِفَاعَةَ تَميم بن أُسَيْدٍ(*) - رضي الله عنه - قَالَ: انْتَهَيْتُ إِلَى رَسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - وَهُوَ يخطب، فقلت: يَا رسول الله، رَجُلٌ غَريبٌ جَاءَ يَسْألُ عن دِينهِ لا يَدْرِي مَا دِينُهُ؟ فَأقْبَلَ عَليَّ رسولُ اللهِ - صلى الله عليه وسلم - وتَرَكَ خُطْبَتَهُ حَتَّى انْتَهَى إلَيَّ، فَأُتِيَ بِكُرْسيٍّ، فَقَعَدَ عَلَيْهِ، وَجَعَلَ يُعَلِّمُنِي مِمَّا عَلَّمَهُ اللهُ، ثُمَّ أَتَى خُطْبَتَهُ فَأتَمَّ آخِرَهَا. رواه مسلم. (1)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬০৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৭১ মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ।
খানা খাওয়ার কয়েকটি সুন্নত
হাদীছ নং: ৬০৭
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খাবার খেতেন, তখন তিনও আঙ্গুল চেটে নিতেন। হযরত আনাস রাযি. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কারও লোকমা পড়ে গেলে তা থেকে ময়লা দূর করে নেবে এবং তা খেয়ে ফেলবে। তা শয়তানের জন্য ফেলে রাখবে না। হযরত আনাস রাযি. বলেন, তিনি পেয়ালা চেটে খাওয়ারও আদেশ করেছেন এবং বলেছেন, তোমরা জান না তোমাদের খাবারের কোন অংশে বরকত থাকে। -মুসলিম
(মুসলিম: ২০৩৪; সুনানে আবূ দাউদ: ৩৮৪৫; জামে তিরমিযী: ১৮০৩; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ৬৭৩২; মুসনাদে আবু ইয়া'লা ৩৩১২; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫২৪৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৪৬১৮; শু'আবুল ঈমান: ৫৪৭২)
হাদীছ নং: ৬০৭
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খাবার খেতেন, তখন তিনও আঙ্গুল চেটে নিতেন। হযরত আনাস রাযি. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কারও লোকমা পড়ে গেলে তা থেকে ময়লা দূর করে নেবে এবং তা খেয়ে ফেলবে। তা শয়তানের জন্য ফেলে রাখবে না। হযরত আনাস রাযি. বলেন, তিনি পেয়ালা চেটে খাওয়ারও আদেশ করেছেন এবং বলেছেন, তোমরা জান না তোমাদের খাবারের কোন অংশে বরকত থাকে। -মুসলিম
(মুসলিম: ২০৩৪; সুনানে আবূ দাউদ: ৩৮৪৫; জামে তিরমিযী: ১৮০৩; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ৬৭৩২; মুসনাদে আবু ইয়া'লা ৩৩১২; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫২৪৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৪৬১৮; শু'আবুল ঈমান: ৫৪৭২)
مقدمة الامام النووي
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
607 - وعن أنس - رضي الله عنه: أن رسول الله - صلى الله عليه وسلم - كَانَ إِذَا أكَلَ طَعَامًا، لَعِقَ أصَابِعَهُ الثَّلاَثَ. قَالَ: وقال: «إِذَا سَقَطَتْ لُقْمَةُ أَحَدِكُمْ فَلْيُمِط عنها الأَذى، وليَأكُلْها وَلاَ يَدَعْها لِلشَّيْطان» وأمرَ أن تُسلَتَ القَصْعَةُ (1)، قَالَ: «فإنَّكُمْ لاَ تَدْرُونَ فِي أَيِّ طَعَامِكُمُ البَرَكَة». رواه مسلم. (2)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬০৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৭১ মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ।
খানা খাওয়ার কয়েকটি সুন্নত
হাদীছ নং: ৬০৮
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ এমন কোনও নবী পাঠাননি, যিনি ছাগল চরাননি। সাহাবীগণ বললেন, আপনিও? তিনি বললেন, হাঁ, আমি মক্কাবাসীদের ছাগল চরাতাম কয়েক কীরাতের বিনিময়ে। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ২২৬২; সুনানে ইবন মাজাহ: ২১৪৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২১৮৬; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১১৬৪১)
হাদীছ নং: ৬০৮
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ এমন কোনও নবী পাঠাননি, যিনি ছাগল চরাননি। সাহাবীগণ বললেন, আপনিও? তিনি বললেন, হাঁ, আমি মক্কাবাসীদের ছাগল চরাতাম কয়েক কীরাতের বিনিময়ে। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ২২৬২; সুনানে ইবন মাজাহ: ২১৪৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২১৮৬; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১১৬৪১)
مقدمة الامام النووي
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
608 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - عن النبيِّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «مَا بَعَثَ الله نَبِيًّا إِلاَّ رَعَى الغَنَمَ» قَالَ أصْحَابُهُ: وَأنْتَ؟ فَقَالَ: «نَعَمْ، كُنْتُ أرْعَاهَا عَلَى قَرَارِيطَ لأَهْلِ مَكَّةَ». رواه البخاري. (1)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬০৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৭১ মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ।
দাওয়াত ও হাদিয়া গ্রহণের প্রতি উৎসাহদান
হাদীছ নং: ৬০৯
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমাকে যদি একটি পায়া বা বাহুর জন্যও দাওয়াত করা হয়, আমি তাতে অবশ্যই সাড়া দেব। যদি আমাকে একটি বাহু বা পায়া হাদিয়া দেওয়া হয়, আমি তা অবশ্যই গ্রহণ করব। -বুখারী
(সহীহ বুখারী : ২৫৬৮; জামে তিরমিযী: ১৩৩৮; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৬৫৭৪; মুসনাদুল বাযযার: ৭০৩৯; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২১৯৮৬; সহীহ ইবন হিব্বান : ৫২৯১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১১২৩৬; শু'আবুল ঈমান : ৮৫৭১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৬০৯)
হাদীছ নং: ৬০৯
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমাকে যদি একটি পায়া বা বাহুর জন্যও দাওয়াত করা হয়, আমি তাতে অবশ্যই সাড়া দেব। যদি আমাকে একটি বাহু বা পায়া হাদিয়া দেওয়া হয়, আমি তা অবশ্যই গ্রহণ করব। -বুখারী
(সহীহ বুখারী : ২৫৬৮; জামে তিরমিযী: ১৩৩৮; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৬৫৭৪; মুসনাদুল বাযযার: ৭০৩৯; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২১৯৮৬; সহীহ ইবন হিব্বান : ৫২৯১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১১২৩৬; শু'আবুল ঈমান : ৮৫৭১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৬০৯)
مقدمة الامام النووي
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
609 - وعنه، عن النبيِّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لَوْ دُعِيتُ إِلَى كُراعٍ أَوْ ذِرَاعٍ لأَجَبْتُ، ولو أُهْدِيَ إِلَيَّ ذراعٌ أَوْ كُراعٌ لَقَبِلْتُ». رواه البخاري. (1)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬১০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায় : ৭১ মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ।
পার্থিব যে-কোনও উন্নতির পর অধঃপতনের অনিবার্যতা
হাদীছ নং: ৬১০
হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘আদবা নামক উটনীটিকে ছাড়িয়ে যাওয়া যেত না অথবা (বর্ণনাকারী বলেছেন) ছাড়িয়ে যাওয়া প্রায় যেতই না। একবার এক বেদুঈন তার উঠতি বয়সী এক উটে চড়ে আসল এবং তা সেটিকে ছাড়িয়ে গেল। এটা মুসলিমদের জন্য কষ্টদায়ক হল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা বুঝতে পারলেন। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর অমোঘ নীতি হল দুনিয়ার যে বস্তুই উপরে উঠে যায়, তিনি অবশ্যই সেটিকে নামিয়ে দেন। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ২৮৭২; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৮০২; মুসনাদুল বাযযার: ৬৫৭৫; সুনানে নাসাঈ: ৩৫৮৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৯০৩; সুনান দারা কুতনী: ৪৮২৯)
হাদীছ নং: ৬১০
হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘আদবা নামক উটনীটিকে ছাড়িয়ে যাওয়া যেত না অথবা (বর্ণনাকারী বলেছেন) ছাড়িয়ে যাওয়া প্রায় যেতই না। একবার এক বেদুঈন তার উঠতি বয়সী এক উটে চড়ে আসল এবং তা সেটিকে ছাড়িয়ে গেল। এটা মুসলিমদের জন্য কষ্টদায়ক হল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা বুঝতে পারলেন। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর অমোঘ নীতি হল দুনিয়ার যে বস্তুই উপরে উঠে যায়, তিনি অবশ্যই সেটিকে নামিয়ে দেন। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ২৮৭২; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৮০২; মুসনাদুল বাযযার: ৬৫৭৫; সুনানে নাসাঈ: ৩৫৮৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৯০৩; সুনান দারা কুতনী: ৪৮২৯)
مقدمة الامام النووي
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
610 - وعن أنس - رضي الله عنه - قَالَ: كَانَتْ ناقةُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - العضْبَاءُ لاَ تُسْبَقُ، أَوْ لاَ تَكَادُ تُسْبَقُ، فَجَاءَ أعْرَابيٌّ عَلَى قَعودٍ لَهُ، فَسَبَقَهَا، فَشَقَّ ذَلِكَ عَلَى الْمُسْلِمِينَ حَتَّى عَرَفَهُ، فَقَالَ: «حَقٌّ عَلَى اللهِ أَنْ لاَ يَرْتَفِعَ شَيْءٌ مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ وَضَعَهُ». رواه البخاري. (1)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬১১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা
এখানে দু‘টি বিষয় আছে : اَلْكِبرُ (কিবর) ও اَلْعُجْبُ (‘উজব) অর্থাৎ অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা। কিবর বা অহংকার হল নিজেকে উত্তম ভাবা এবং অন্যকে তুচ্ছ গণ্য করা ও তাচ্ছিল্য করা। আর ‘উজব হল অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ছাড়া কেবল নিজেকে উত্তম ভাবা।
অহংকার যদি হয় আল্লাহর সঙ্গে, যদ্দরুন তাঁর আনুগত্য পরিত্যাগ করা হয় এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করা হয়, তবে তা কুফর সাব্যস্ত হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে অবজ্ঞা করে, তাঁর আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করে, সে নিশ্চিত কাফের। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে অবজ্ঞা করে না, স্রেফ নিজ গাফলাত ও ইন্দ্রিয়পরবশতার কারণে আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করে, সে একজন পাপী, সে কাফের নয়।
অহংকার যদি হয় মানুষের সঙ্গে, আর তাতে শরী'আত অবজ্ঞা করা না হয়, তবে তা কুফর নয়, কিন্তু কঠিন গুনাহ। যদি শরী'আত অবজ্ঞা করা হয়, তবে কুফর বটে।
অহংকার বহু রোগের মূল। ইমাম গাযালী রহ.-এর ভাষায় ‘উম্মুল আমরায’, সকল আত্মিক রোগের জননী। অর্থাৎ এর থেকে নানা আত্মিক রোগের জন্ম হয়। যেমন হিংসা, বিদ্বেষ, অতিরিক্ত রাগ, গীবত ইত্যাদি। ইবলীস অভিশপ্ত হয়েছিল অহংকার করেই। আল্লাহ তা'আলা হযরত আদম আলাইহিস সালামের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য সিজদার হুকুম করলে ফিরিশতারা সিজদা করেছিলেন, কিন্তু ইবলীস অহংকারবশে সিজদা করতে অপারগতা জানায়। সে বলে ওঠে-
أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ (12)
‘আমি তার চেয়ে উত্তম। তুমি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছ, আর তাকে সৃষ্টি করেছ মাটি দ্বারা।(সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১২)
যে চরিত্রের কারণে ইবলীস মরদুদ ও অভিশপ্ত হয়েছে তা যে কত মন্দ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুফয়ান ইবন উয়ায়না রহ. বলেন, যে ব্যক্তি কোনও লোভ-লালসার কারণে গুনাহ করে ফেলে, তার তাওবার আশা রাখতে পার। কিন্তু যার গুনাহর কারণ হয় অহংকার, তার সম্পর্কে লা'নতের ভয় রাখো। কেননা ইবলীস গুনাহ করেছিল অহংকারবশে। পরিণামে সে লা'নতগ্রস্ত হয়েছে।
অহংকারের কারণে মানুষ যে কেবল গুনাহ করে তাই নয়; সে বহুবিধ কল্যাণ থেকেও বঞ্চিত থাকে। যেমন অহংকারী ব্যক্তি অন্যের উপদেশ গ্রহণ করতে পারে না। সে সম্মানী ব্যক্তির সামনেও বিনয় দেখাতে সক্ষম হয় না। অহংকারী ব্যক্তি সহজে নিজ অজ্ঞতা স্বীকার করতে পারে না, ফলে জ্ঞানী ব্যক্তির কাছ থেকে সে জ্ঞান আহরণ থেকে বঞ্চিত থাকে। এমনকি অহংকার মানুষের ঈমান আনার পক্ষেও বাধা হয়। মনেপ্রাণে সত্য উপলব্ধি করা সত্ত্বেও বহু লোক কেবল অহংকারের কারণেই তা গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে কাফের অবস্থায় তাদের কবরে যেতে হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِينَ (14)
‘তারা সীমালঙ্ঘন ও অহমিকাবশত তা সব অস্বীকার করল, যদিও তাদের অন্তর সেগুলো (সত্য বলে) বিশ্বাস করে নিয়েছিল। সুতরাং দেখে নাও ফাসাদকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছিল!’(সূরা নামল (২৭), আয়াত ১৪)
কিবর বা অহংকারের কাছাকাছি আরেকটি ব্যাধি হল ‘উজব বা আত্মমুগ্ধতা। নিজের ভালো কোনও অবস্থা দেখে সেজন্য অন্যের তুলনায় নিজেকে উত্তম ভাবা হচ্ছে ‘উজব। এটা অহংকারের উৎস। এর থেকেই অহংকার সৃষ্টি হয়। তাই এটাও অতি নিন্দনীয়। কেননা এটা নেক আমল বরবাদ করে দেয়। নেক আমল করার তাওফীক হলে সেজন্য দরকার আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা আর কবুলের আশা রাখা। সেইসঙ্গে এই ভয়ে ভীত থাকাও জরুরি যে, নাজানি আল্লাহ তা'আলা তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু যার অন্তরে ‘উজব থাকে, তার অবস্থা এরূপ হয় না। সে তো মনে করে এই এই আমল করে আমি অন্যের উপরে চলে গেছি। কে কার উপরে যেতে পারে, তা আল্লাহ তা'আলা ছাড়া কেউ জানে না। কেননা তা নির্ভর করে আমল কবুল হওয়ার উপর। আত্মমুগ্ধতা কবুলিয়াতের জন্য বাধা। তাই হাদীছে একে ধ্বংসাত্মক বলা হয়েছে। বিখ্যাত বুযুর্গ মুতাররিফ রহ. বলেন, আমি যদি ঘুমিয়ে থাকি আর ভোরবেলা অনুতপ্ত হয়ে জাগি, তবে এটাই আমার কাছে এরচে' বেশি পসন্দ যে, আমি রাতভর তাহাজ্জুদ পড়ব আর ভোরবেলা নিজের প্রতি মুগ্ধ হয়ে যাব।
‘উজব ও আত্মমুগ্ধতা মানুষের দীনদারীর পথে অগ্রগামিতাও থামিয়ে দেয়। কেউ যখন নিজ আমলের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যায়, তখন শয়তান তার অন্তরে এই ধারণা জন্মে দেয় যে, তুমি যথেষ্ট আমল করছ। এর বেশি আর কী প্রয়োজন? ফলে সে সামনে চলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। সামনে চলা বন্ধ হয়ে গেলে অধঃপতন শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তার আমল তলানিতে নেমে যায়। একই অবস্থা হয় ইলম, আখলাক, দান- খয়রাত, খেদমতে খালকসহ দীনের যাবতীয় ক্ষেত্রে।
বস্তুত দীনের কোনওকিছুই আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সম্ভব হয় না। কিন্তু ব্যক্তির মধ্যে যখন ‘উজব জন্ম নেয়, তখন দৃষ্টি আল্লাহ থেকে সরে নিজ চেষ্টা ও আসবাব-উপকরণের দিকে চলে যায়। ফলে সে আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। তখন তার চেষ্টা- মেহনত ও আসবাব-উপকরণ কোনওকিছুই কাজে আসে না। আল্লাহ তা'আলা হুনায়নের যুদ্ধে এর বাস্তবতা দেখিয়ে দিয়েছেন। সে সম্পর্কে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللَّهُ فِي مَوَاطِنَ كَثِيرَةٍ وَيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئًا وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُمْ مُدْبِرِينَ (25)
‘বস্তুত আল্লাহ বহু ক্ষেত্রে তোমাদের সাহায্য করেছেন এবং (বিশেষ করে) হুনায়নের দিন, যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে আত্মপ্রসাদে লিপ্ত করেছিল। কিন্তু সে সংখ্যাধিক্য তোমাদের কোনও কাজে আসেনি এবং যমীন তার প্রশস্ততা সত্ত্বেও তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে (যুদ্ধক্ষেত্র হতে) পলায়ন করেছিলে।(সূরা তাওবা (৯), আয়াত ২৫)
বোঝা গেল অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা কঠিন আত্মিক ব্যাধি। এর চিকিৎসা অতীব জরুরি। এজন্যই কুরআন ও হাদীছে এ সম্পর্কে কঠিনভাবে সতর্ক করা হয়েছে। এ অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এগুলো বোঝার ও এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন।
‘অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ (83)
অর্থ: ওই পরকালীন নিবাস তো আমি সেই সকল লোকের জন্যই নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে বড়ত্ব দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। শেষ পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই অনুকূলে থাকবে।( সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৮৩)
ব্যাখ্যা
تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ (ওই পরকালীন নিবাস) অর্থাৎ জান্নাত, যা হবে আখিরাতে মুমিনদের স্থায়ী বাসস্থান এবং যার বৈশিষ্ট্য ও বিভিন্ন নি'আমত সম্পর্কে কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে ধারণা দেওয়া হয়েছে।
نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا (তা আমি সে সকল লোকের জন্য নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে বড়ত্ব দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না)। عُلو এর অর্থ উপর, উচ্চতা। কেউ যখন কোনও দিক থেকে কারও উপরে চলে যায়, তখন তার অন্তরে অহমিকা জন্মায়। এ কারণে শব্দটি অহংকার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। فَسَاد অর্থ অশান্তি, বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা। যে-কোনও পাপকর্ম অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাই শব্দটি দ্বারা পাপকর্মও বোঝানো হয়ে থাকে।
আয়াতটির সারমর্ম হল, যারা পার্থিব জীবনে অহংকার পরিত্যাগ করে ও বিনয় অবলম্বন করে এবং সর্বপ্রকার পাপকর্ম পরিহার করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে, আখিরাতে তারা জান্নাতবাসী হবে। বোঝা গেল যারা অহংকার দেখায় ও অশান্তি বিস্তার করে তথা পাপকর্মে লিপ্ত থাকে, জান্নাতের চিরসুখের ঠিকানা তাদের জন্য নয়।
আয়াতটিতে প্রথমে অহংকার এবং তারপর অশান্তি বিস্তার বা পাপকর্মে লিপ্ত থাকার কথা বলা হয়েছে। এর দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, অশান্তি বিস্তার ও পাপকর্ম করার পেছনে অহংকারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাই শান্তিময় জীবন ও পাপকর্ম হতে বিরত থাকার জন্য অন্তর থেকে অহংকার নির্মূল করা অতীব জরুরি। অহংকারের জন্য عُلو বা ‘উপরে ওঠা’ শব্দ ব্যবহারের মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, কেউ যখন কোনও দিক থেকে অন্যের উপরে উঠে যায়, তখন তার সতর্ক থাকা উচিত যাতে উপরে উঠাটা তাকে অহংকারে লিপ্ত করে না বসে। অন্যের উপরে থাকাটা ইলমের দিক থেকে হোক বা আমলের দিক থেকে, সম্পদের দিক থেকে হোক বা ক্ষমতার দিক থেকে, দৈহিক শক্তির দিক থেকে হোক বা অভ্যন্তরীণ গুণাবলিতে হোক, এমনিভাবে রূপ ও সৌন্দর্যে হোক বা প্রতিভার দিক থেকে, তা যেদিক থেকেই হোক না কেন, নিঃসন্দেহে তা আল্লাহ তা'আলারই দান। সেজন্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা উচিত। শোকরের বিষয়কে অহংকারের বিষয়ে পরিণত করা কোনও মুমিনের কাজ হতে পারে না। যে- কোনও নি'আমতকে অহংকারের বিষয়ে পরিণত করা সে নি'আমতের সুস্পষ্ট অকৃতজ্ঞতা। নি'আমতের জন্য শোকর আদায় করলে আল্লাহ তা'আলার কাছে পুরস্কার পাওয়া যায়। অকৃতজ্ঞদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা।
وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ (শেষ পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই অনুকূলে থাকবে)। শেষ পরিণাম মানে শুভ পরিণাম। অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতলাভ। এ সৌভাগ্য কেবল তাদেরই হবে, যারা তাকওয়ার অধিকারী। অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা'আলার যাবতীয় আদেশ পালন করে এবং তিনি যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. জান্নাত মুত্তাকীদের স্থায়ী বাসস্থান।
খ. অহংকার ও অহমিকা জান্নাতলাভের পক্ষে বাধা।
গ. জান্নাতের আশাবাদী ব্যক্তিকে অবশ্যই অশান্তিমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে।
ঘ. জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভ করার জন্য আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ পালন করা অবশ্যকর্তব্য।
দুই নং আয়াত
وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا
অর্থ: ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে চলো না।(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৩৭)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা বনী ইসরাঈলের ৩৭ নং আয়াতের প্রথম অংশ। এতে চালচলনে দম্ভ ও অহংকার দেখাতে নিষেধ করা হয়েছে। মানুষের অহংকার যেমন তার পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় প্রকাশ পায়, তেমনি তা প্রকাশ পায় চালচলনেও। মানুষ আল্লাহর বান্দা। বন্দেগীর দাবি যাবতীয় ক্ষেত্রে বিনয় অবলম্বন করা, এমনকি হাঁটা- চলায়ও। সূরা ফুরকানে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا
‘রহমানের বান্দা তারা, যারা ভূমিতে বিনয়-নম্রভাবে চলাফেরা করে।’(সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৩)
বোঝা গেল যাদের হাঁটা-চলায় বিনয় থাকে না, তারা সৃষ্টিগতভাবে আল্লাহর বান্দা হলেও কর্ম ও চরিত্রের দিক থেকে দয়াময় আল্লাহর বান্দা নয়। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার প্রিয় বান্দা নয়। তারা তাঁর লা'নত ও আযাবের উপযুক্ত।
وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَرِئَاءَ النَّاسِ ……. وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ (48)
‘তোমরা তাদের মতো হবে না, যারা নিজ গৃহ থেকে দম্ভভরে এবং মানুষকে (নিজেদের ঠাটবাট) দেখাতে দেখাতে বের হয়েছিল......এবং আল্লাহর শাস্তি অতি কঠোর।(সূরা আনফাল (৮), আয়াত ৪৭-৪৮)
আলোচ্য আয়াতটির শেষ অংশ হল- إِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولًا (তুমি তো ভূমিকে ফাটিয়ে ফেলতে পারবে না এবং উচ্চতায় পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না)। অর্থাৎ দম্ভভরে চলার উদ্দেশ্য কী? তুমি কি ভূমি ফাটিয়ে ফেলতে চাও, নাকি পাহাড়ের মতো উঁচু হতে চাও? নিশ্চয়ই তা চাও না। কারণ তা তোমার ক্ষমতায় নেই। তাহলে শুধু শুধু এভাবে চলছ কেন? শুধু শুধু কোনওকিছু করা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা। আর যদি তুমি মনে কর এভাবে চলার দ্বারা তুমি মানুষের চোখে বড় হয়ে যাবে, তবে তাও একটা ভুল ধারণা। কেননা দম্ভ-অহংকার দ্বারা কেউ কারও চোখে বড় হয় না। বরং তাতে মানুষ আরও ক্ষুদ্র ভাবে। অহংকারী ব্যক্তি নিজের চোখেই নিজে বড় থাকে, অন্যদের চোখে হয়ে যায় ছোট। সুতরাং এভাবে চলাটা বৃথা প্রয়াস ছাড়া কিছুই নয়। তাই এভাবে না চলে নম্র-কোমল হয়ে চলো। তাতে আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে পারবে। ফলে আল্লাহ তা'আলা মাখলুকের দৃষ্টিতে তোমাকে উঁচু করে দেবেন।
আয়াতটির শিক্ষা
হাঁটা-চলায় আমাদেরকে দম্ভভাব পরিহার করে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করতে হবে।
তিন নং আয়াত
وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (18)
অর্থ: এবং মানুষের সামনে (অহংকারে) নিজ গাল ফুলিয়ো না এবং ভূমিতে দর্পভরে চলো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনও দর্পিত অহংকারীকে পসন্দ করেন না।(সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ১৮)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে দু'টি নিষেধাজ্ঞা আছে। এক নিষেধাজ্ঞা হল – وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ ‘এবং মানুষের সামনে (অহংকারে) নিজ গাল ফুলিয়ো না'। অর্থাৎ মানুষকে তাচ্ছিল্য করে অহংকারীদের মতো মুখ ভার করে কথা বলো না; বরং হাসিমুখে কথা বলো। এর আরেক অর্থ হল, যখন লোকজন তোমার সঙ্গে কথা বলবে, তখন অহংকারবশে তাদের তাচ্ছিল্য করো না এবং তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। বরং নম্রতার সঙ্গে তাদের দিকে মনোযোগী হও এবং তারা কী বলে, আগ্রহের সঙ্গে তা শোনো।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিষেধ করা হয়েছে তা হল- وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا (এবং ভূমিতে দর্পভরে চলো না)। উপরে ২ নং আয়াতে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বস্তুত উভয় নিষেধাজ্ঞাই অহংকার সম্পর্কিত। একটি হল অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ও কথাবার্তায় অহংকার করা। আর দ্বিতীয়টি হল অহংকারের সঙ্গে চলাচল করা। উভয়টিই অত্যন্ত নিন্দনীয়। একজন মুমিনের পক্ষে সম্পূর্ণ অশোভন এবং কাফেরদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। মুমিনের সবকিছুতেই থাকবে বিনয়, যা আল্লাহ পসন্দ করেন। মুমিন ব্যক্তি তার যাবতীয় কাজে লক্ষ রাখবে আল্লাহ তা'আলা কী পসন্দ করেন এবং কী পসন্দ করেন না। অহমিকাপূর্ণ কোনও আচরণ আল্লাহ তা'আলার পসন্দ নয়। সুতরাং আয়াতটির শেষে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনও দর্পিত অহংকারীকে পসন্দ করেন না)। আর এ কারণেই তিনি উল্লিখিত দু'টি কাজ করতে নিষেধ করেছেন। বলাবাহুল্য একজন মুমিন যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহপ্রেমিক হবে, তাই আল্লাহ তা'আলার অপসন্দনীয় এ কাজদু'টি সে কিছুতেই করবে না; করতে পারে না।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. কথাবার্তা ও চলাফেরায় আমাদেরকে অহমিকার ভাব পরিহার করতে হবে।
খ. কেউ যখন কথা বলে, তখন তার প্রতি মনোযোগী থাকা চাই। উপেক্ষাভাব দেখানো উচিত নয়।
গ. অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময় মুখ ভার করে রাখা নয়; বরং হাসিমুখে কথা বলতে হবে।
ঘ. ঔদ্ধত্য ও অহমিকা প্রকাশ পায় এমন যাবতীয় আচরণ পরিত্যাজ্য।
চার নং আয়াত
إِنَّ قَارُونَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوسَى فَبَغَى عَلَيْهِمْ وَآتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوزِ مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّةِ إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لَا تَفْرَحْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفَرِحِينَ (76) وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ (77) قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ أَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهِ مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَأَكْثَرُ جَمْعًا وَلَا يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَ (78) فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ فِي زِينَتِهِ قَالَ الَّذِينَ يُرِيدُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا يَالَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إِنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (79) وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا وَلَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ (80) فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهُ مِنْ فِئَةٍ يَنْصُرُونَهُ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنْتَصِرِينَ (81)
অর্থ : কারূন ছিল মূসার সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। কিন্তু সে তাদেরই প্রতি জুলুম করল। আমি তাকে এমন ধনভাণ্ডার দিয়েছিলাম, যার চাবিগুলি বহন করা একদল শক্তিমান লোকের পক্ষেও কষ্টকর ছিল। যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, বড়াই করো না। যারা বড়াই করে আল্লাহ তাদের পসন্দ করেন না। আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না। আল্লাহ যেমন তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তেমনি তুমিও (অন্যদের প্রতি) অনুগ্রহ করো। আর পৃথিবীতে ফাসাদ বিস্তারের চেষ্টা করো না। জেনে রেখো, আল্লাহ ফাসাদ বিস্তারকারীদের পসন্দ করেন না। সে বলল, এসব তো আমি আমার জ্ঞানবলে লাভ করেছি। সে কি এতটুকুও জানত না যে, আল্লাহ তার আগে এমন বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছিলেন, যারা শক্তিতে তার অপেক্ষা প্রবল ছিল এবং জনসংখ্যায়ও বেশি ছিল? অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেসও করা হয় না। অতঃপর (একদিন) সে তার সম্প্রদায়ের সামনে নিজ জাঁকজমকের সাথে বের হয়ে আসল। যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা (তা দেখে) বলতে লাগল, আহা! কারুনকে যা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ যদি আমাদেরও থাকত! বস্তুত সে মহা ভাগ্যবান। আর যারা (আল্লাহর পক্ষ হতে) জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল, তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে! (তোমরা এরূপ কথা বলছ, অথচ) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ছাওয়াব কতইনা শ্রেয়! আর তা লাভ করে কেবল ধৈর্যশীলগণই। পরিণামে আমি তাকে ও তার বাড়িটি ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম। অতঃপর সে এমন একটি দলও পেল না, যারা আল্লাহর বিপরীতে তার কোনও সাহায্য করতে পারে এবং নিজেও পারল না আত্মরক্ষা করতে।(সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৬-৮১)
ব্যাখ্যা
কারূন ছিল হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় অর্থাৎ বনী ইসরাঈলের লোক। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, সে ছিল হযরত মূসা আলাইহিস সালামের চাচাতো ভাই। সে অনেক বড় ধনী ছিল। হযরত মূসা আলাইহিস সালামের নবুওয়াতলাভের আগে ফেরাউন তাকে বনী ইসরাঈলের নেতা বানিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর যখন হযরত মূসা আলাইহিস সালাম নবুওয়াত লাভ করলেন আর হযরত হারুন আলাইহিস সালামকে তাঁর নায়েব বানানো হল, তখন কারূন ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ল। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, সে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাছে দাবি জানিয়েছিল, তাকে যেন কোনও পদ দেওয়া হয়। কিন্তু তাকে কোনও পদ দেওয়া হোক এটা আল্লাহ তা'আলার পসন্দ ছিল না। তাই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম অপারগতা প্রকাশ করলেন, এতে তার হিংসার আগুন আরও তীব্র হয়ে উঠল এবং তা চরিতার্থ করার জন্য মুনাফিকীর পন্থা অবলম্বন করল। এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা তার সম্পর্কে বলেছেন- فَبَغَى عَلَيْهِمْ (কিন্তু সে তাদেরই প্রতি জুলুম করল)। এর আরেক অর্থ হতে পারে- দম্ভ ও বড়াই করল। বর্ণিত আছে যে, ফেরাউনের পক্ষ থেকে তার উপর যখন বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব-ভার অর্পণ করা হয়, তখন সে তাদের উপর জুলুম করেছিল এবং সকলের উপর নিজ শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করেছিল। একে তো ছিল তার ধন-সম্পদ, তার উপর পেয়েছিল ক্ষমতা। যাদের মনে আল্লাহর ভয় থাকে না, তারা এ দু'টির কারণেই উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে যায়। কারূনেরও তাই হয়েছিল। সে কেমন ধনী ছিল, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَآتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوزِ مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّة (আমি তাকে এমন ধনভাণ্ডার দিয়েছিলাম, যার চাবিগুলি বহন করা একদল শক্তিমান লোকের পক্ষেও কষ্টকর ছিল)। কথিত আছে, কারুন যেখানেই যেত, নিজ ধন-ভাণ্ডারের চাবিসমূহ সঙ্গে নিয়ে যেত। চাবিগুলো ছিল লোহার। ক্রমান্বয়ে তার ধন-সম্পদ বাড়তে থাকলে চাবির সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এতে বোঝা অনেক ভারী হয়ে যায়। ফলে সে কাঠের ছোট ছোট চাবি বানিয়ে নেয়। কিন্তু সংখ্যা প্রচুর হওয়ায় তাও এত ভারী হয়ে যায় যে, তা বহন করতে ৪০টি খচ্চর লাগত। কোনও কোনও বর্ণনা অনুযায়ী তার চাবি বহন করত ৪০ জন শক্তিশালী লোক। তারা যখন সেগুলো বহন করত, তখন তার ভারে তারা নুইয়ে পড়ত। এর দ্বারা অনুমান করা যায় তার সম্পদ কত বিপুল ছিল। ঈমান না থাকায় এ সম্পদের কারণে সে চরম উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে পড়ে। এ কারণে তার সম্প্রদায় তাকে নসীহত করেছিল। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لَا تَفْرَحْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفَرِحِينَ (যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, বড়াই করো না। যারা বড়াই করে আল্লাহ তাদের পসন্দ করেন না)। বস্তুত অন্তরে আল্লাহর ভয় না থাকলে এটাই হয় ঐশ্বর্যের পরিণতি। ধন-দৌলত মানুষের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى (6) أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى (7)
‘বস্তুত মানুষ সীমালঙ্ঘন করছে। কেননা সে নিজেকে অমুখাপেক্ষী মনে করে।’সূরা আলাক (৯৬), আয়াত ৬-৭)
لَا تَفْرَحْ এর আরেক অর্থ হতে পারে- উৎফুল্ল হয়ো না। দুনিয়ার ধন-সম্পদে উৎফুল্ল হওয়া নিন্দনীয়, তাতে অন্তরে অহংকার থাকুক বা নাই থাকুক। কেননা দুনিয়ার সম্পদে উৎফুল্ল হওয়াটা দুনিয়ার প্রতি আসক্তির লক্ষণ। আর সম্পদের আসক্তি দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীনতার নিদর্শন। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্ব ও নশ্বরতা সম্পর্কে উদাসীন হওয়াটা কিছুতেই কাম্য নয়। কেননা তাতে অন্তর আল্লাহ থেকে বিমুখ হয়ে যায়। আল্লাহবিমুখ অন্তর কখনও শোকরগুযার হয় না; বরং অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ তা'আলা শোকরগুযার বান্দাকে ভালোবাসেন এবং অকৃতজ্ঞকে ঘৃণা করেন। এ কারণেই কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে দুনিয়া ও দুনিয়ার সম্পদে উৎফুল্ল ও আসক্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
لِكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (23)
‘যাতে তোমরা যা হারিয়েছ তার জন্য দুঃখিত না হও এবং যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন তার জন্য উল্লসিত না হও। আল্লাহ এমন কোনও ব্যক্তিকে পসন্দ করেন না, যে দর্প দেখায় ও বড়ত্ব প্রকাশ করে।’(সূরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ২৩)
কারূনকে আরো উপদেশ দেওয়া হয়েছিল- وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ (আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো)।অর্থাৎ অর্থ-সম্পদকে আল্লাহ তা'আলার বিধান মোতাবেক ব্যবহার করো। পরিণামে তুমি আখিরাতে পরম শান্তির জান্নাতী নিবাসে পৌঁছতে পারবে। আয়াতে সাধারণভাবে مَا آتَاكَ اللَّهُ (আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন) বলা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় আল্লাহপ্রদত্ত প্রকাশ্য-গুপ্ত যাবতীয় নি'আমত এবং মানুষের শারীরিক ও মেধাগত সকল যোগ্যতা-ক্ষমতা মৌলিকভাবে আখিরাতের নাজাতলাভের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা উচিত।
কারুনকে আরও বলা হয়েছিল- وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا (এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না)। অর্থাৎ আখিরাতের নিবাস সন্ধানের মানে এ নয় যে, দুনিয়ার প্রয়োজনসমূহ বিলকুল অগ্রাহ্য করা হবে। দুনিয়ার প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা ও তা রাখাতে দোষের কিছু নেই। বরং নিজের ও পরিবারবর্গের প্রতি কর্তব্যপালনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও আসবাব-উপকরণ সংগ্রহ করা জরুরি বটে। প্রকৃতপক্ষে তাও ছাওয়াবের কাজই। এতে অবহেলা করা গুনাহ। কেননা তাতে দায়িত্বে অবহেলা হয়। হাঁ, দুনিয়ার কামাই-রোজগারে এভাবে নিমজ্জিত হতে নেই, যদ্দরুন আখিরাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তাকে আরও উপদেশ দেওয়া হয়েছিল- وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ ‘আল্লাহ যেমন তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তেমনি তুমিও (অন্যদের প্রতি) অনুগ্রহ করো’। ইশারা করা হয়েছে যে, দুনিয়ায় তুমি যে অর্থ-সম্পদ লাভ করেছ, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলাই তার মালিক। তিনি অনুগ্রহ করে তোমাকে তা দান করেছেন। তিনি যখন এভাবে তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তখন তুমিও মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করো এবং তাঁর প্রদত্ত অর্থ-সম্পদে তাদেরকে শরীক করো।
অথবা এর অর্থ- আল্লাহ তা'আলা যেহেতু তোমাকে এসব সম্পদ দিয়েছেন, তাই তার শোকর আদায়ের লক্ষ্যে তুমি উত্তমরূপে আল্লাহ তা'আলার ইবাদত করো ও সর্বদা তাঁকে স্মরণ করো।
তাকে বলা হয়েছিল- وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ (আর পৃথিবীতে ফাসাদ বিস্তারের চেষ্টা করো না। জেনে রেখো, আল্লাহ ফাসাদ বিস্তারকারীদের পসন্দ করেন না)। অর্থাৎ এমনসব তৎপরতা থেকে বিরত থেকো, যাতে পৃথিবীর শান্তি নষ্ট হয় এবং বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি দেখা দেয়। ইমাম বাগাবী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানি করে, সে পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তার করে। অর্থাৎ যাবতীয় অশান্তির মূল আল্লাহ তা'আলার নাফরমানি ও পাপকর্ম।
উল্লিখিত নসীহত ও উপদেশের বিপরীতে কারুন বলেছিল - إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي (এসব তো আমি আমার জ্ঞানবলে লাভ করেছি)। অর্থাৎ কারূন দাবি করছিল, আমি এ ধন-সম্পদের মালিক হয়েছি নিজ বিদ্যা-বুদ্ধির বলে। সে যেন বলতে চাচ্ছিল, আল্লাহ আমার প্রতি কোনও অনুগ্রহ করেননি। এ ধন-সম্পদ তিনি আমাকে দান করেননি, তাই তার শোকর আদায় করারও কোনও প্রয়োজন আমার নেই। এসব আমার নিজ চেষ্টার ফল। আমি ব্যবসা-বাণিজ্যের কলা-কৌশল জানি। কৃষিবিজ্ঞানে আমার দখল আছে। অর্থোপার্জনের অন্যসব পদ্ধতি সম্পর্কেও আমি অবহিত। এ কারণেই এত অর্থবিত্ত আমার হাতে এসেছে। এতে আল্লাহর বান্দাদের কোনও অংশ থাকবে কেন? তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা আমার কর্তব্য হবে কেন?
সাহল রহ. বলেন, যে ব্যক্তি কেবল নিজেকে দেখেছে, সে সফল হয়নি। সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি, যে তার নিজের দিকে অহংকারের দৃষ্টিতে তাকায়নি এবং আপন কথা ও কাজে অহংকার প্রকাশ করেনি। ওই ব্যক্তি বড় দুর্ভাগা, যে তার কথা, কাজ ও অবস্থাকে আকর্ষণীয় করেছে এবং সেজন্য অহমিকা দেখিয়েছে। সে চিন্তা করেনি যে, একদিন তাকে ধ্বংস করে ফেলা হবে, যেমন কারূনকে তার অহমিকার কারণে মাটির ভেতর ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কারুনের ওই আত্মম্ভরি বক্তব্যের জবাবে আল্লাহ তা'আলা বলেন- أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ أَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهِ مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَأَكْثَرُ جَمْعًا (সে কি এতটুকুও জানত না যে, আল্লাহ তার আগে এমন বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছিলেন, যারা শক্তিতে তার অপেক্ষা প্রবল ছিল এবং জনসংখ্যায়ও বেশি ছিল)? অর্থাৎ কারূন নিজ জ্ঞানবত্তার দাবি করছে, অথচ তার বক্তব্য দ্বারাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, উচ্চস্তরের জ্ঞান তো দূরের কথা, এই মামুলি জ্ঞানটুকুও তার ছিল না যে, সে যদি নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারাই অর্থোপার্জন করে থাকে, তবে সেই জ্ঞান-বুদ্ধি সে কোথায় পেল? কে তাকে তা দান করেছিল? সেইসঙ্গে সে এ বিষয়টাও অনুধাবন করছে না যে, তার আগেও তো তার মতো, বরং তার চেয়েও ধন-জনে শক্তিমান কত লোক ছিল, আজ তারা কোথায়? তারাও তার মতো দর্প দেখাত এবং তার মতো দাবি করে বেড়াত। পরিণামে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তিনি তো 'আদ জাতিকেও ধ্বংস করেছেন, যারা দৈহিক শক্তি ও অর্থশক্তিতে তারচে' অনেক বলীয়ান ছিল। শাদ্দাদ ছিল কত বড় সম্রাট! কী বিশাল ছিল তার রাজত্ব! তাকেও তিনি ধ্বংস করেছেন। কারূন চিন্তা করছে না যে, আল্লাহ তা'আলা চাইলে একই পরিণতি তারও ঘটাতে পারেন।
তারপর আল্লাহ তা'আলা বলেন- وَلَا يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَ (অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেসও করা হয় না)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা অপরাধীদের অবস্থা ভালো করেই জানেন। কাজেই তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য তাদেরকে তাঁর জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন নেই। হাঁ, আখিরাতে যে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, সেটা তাদের সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে নয়; বরং তাদের অপরাধ তাদের দৃষ্টিতে সপ্রমাণ করার উদ্দেশ্যেই করা হবে।
তারপর কারুনের পরিণতি সম্পর্কে জানানো হচ্ছে- فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ فِي زِينَتِهِ ‘অতঃপর (একদিন) সে তার সম্প্রদায়ের সামনে নিজ জাঁকজমকের সাথে বের হয়ে আসল'। সে কী রকম জাঁকজমকের সঙ্গে বের হয়েছিল, কুরআন মাজীদে তার বিবরণ দেওয়া হয়নি। মুফাসসিরগণ এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন ইবরাহীম নাখা'ঈ রহ. বলেন, কারূন ও তার দলের লোকেরা সবুজ ও লাল পোশাক পরিধান করে বের হয়েছিল। মুজাহিদ রহ. বলেন, তারা সাদা ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে বের হয়েছিল। মুকাতিল রহ. বলেন, তার সঙ্গে ছিল চার হাজার ঘোড়সওয়ার ও তিনশ দাস-দাসী। তার এ জাঁকজমক দেখে এক শ্রেণির লোকের আক্ষেপ হল। তাদের সম্পর্কে আয়াতে জানানো হয়েছে-
قَالَ الَّذِينَ يُرِيدُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا يَالَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إِنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ ‘যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা (তা দেখে) বলতে লাগল, আহা! কারূনকে যা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ যদি আমাদেরও থাকত! বস্তুত সে মহা ভাগ্যবান'। এখানে লক্ষণীয়, তারা এরূপ বলেনি যে, কারূনের ধন-সম্পদ যদি আমাদের হাতে এসে যেত। বরং বলেছে যে, তার মতো ধন-সম্পদ যদি আমাদেরও থাকত! এর দ্বারা বোঝা যায়, তারা দুনিয়াদার হলেও ঈর্ষাপরায়ণ ছিল না। বস্তুত বনী ইসরাঈলের মনে দুনিয়ার আসক্তি থাকলেও তারা ঈমানদারও ছিল বটে। তাই কারুনের সম্পদ দেখে তারা তার প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়নি। কেবল নিজেদের না থাকার দরুন আক্ষেপ প্রকাশ করেছে, যদিও এরূপ আক্ষেপ প্রকাশ করাও একজন মুমিনের পক্ষে কিছুতেই উচিত নয়। প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য আল্লাহ তা'আলা তাকে যা দিয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকা, অন্যকে কী দেওয়া হয়েছে সেদিকে লক্ষ করা নয়। এমনিভাবে 'যে সম্পদশালী সে ভাগ্যবান' এ কথাও বলাও ঠিক নয়, যেমনটা তারা কারূনকে দেখে বলেছিল। কেননা কে ভাগ্যবান আর কে দুর্ভাগা, তার পরিচয় হবে আখিরাতে। সেখানে যে নাজাত পাবে সেই প্রকৃত ভাগ্যবান। নাজাত ধন-সম্পদের উপর নির্ভর করে না। তা নির্ভর করে কেবলই ঈমান ও সৎকর্মের উপর। ঈমান ও সৎকর্ম যেমন একজন ধনী অবলম্বন করতে পারে, তেমনি তা পারে একজন গরীবও। বরং গরীবের পক্ষেই তা অপেক্ষাকৃত সহজ।
বনী ইসরাঈলের মধ্যে কতিপয় লোক সত্যিকারের জ্ঞানীও ছিল। তারা দুনিয়াদারদের আক্ষেপমূলক কথাবার্তা শুনে তাদেরকে আশ্বাসবাণী শোনাল ও নসীহত করল। ইরশাদ হয়েছে- وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ‘আর যারা (আল্লাহর পক্ষ হতে) জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে! (তোমরা এরূপ কথা বলছ, অথচ) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ছাওয়াব কতইনা শ্রেয়'! যাদের মধ্যে দীনের জ্ঞান ছিল, যারা দুনিয়ার হাকীকত বুঝত, আখিরাতের অফুরন্ত নি'আমত সম্পর্কে অবহিত ছিল এবং কীভাবে সেই নি'আমত অর্জিত হবে সে সম্পর্কেও তাদের জানা ছিল, তারা দুনিয়াদারদের ধিক্কার দিয়ে বলল, তোমরা কেন নশ্বর দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সম্পদের প্রতি লালায়িত হচ্ছ! আল্লাহ তা'আলা আখিরাতে মুমিন ও সৎকর্মশীলদের জন্য যে পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছেন, তা এরচে' অনেক অনেক উত্তম। তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না তা মান ও পরিমাণে এরচে' কত শ্রেয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (17)
‘সুতরাং কোনও ব্যক্তি জানে না এরূপ লোকদের জন্য তাদের কর্মফলস্বরূপ চোখ জুড়ানোর কত কী উপকরণ লুকিয়ে রাখা হয়েছে।(সূরা সাজদা (৩২), আয়াত ১৭)
সুতরাং তোমরা ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার এসব অস্থায়ী সম্পদের জন্য আক্ষেপ করো না। আখিরাতের অফুরন্ত নি'আমতলাভের আশা করো আর সেজন্য করণীয় কাজে রত থাকো। সেজন্য একটি করণীয় কর্ম হল সবর করা। ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ (আর তা লাভ করে কেবল ধৈর্যশীলগণই)। 'সবর' শব্দটি কুরআন মাজীদের একটি পরিভাষা। নিজের ইন্দ্রিয় চাহিদা সংযত ও নিয়ন্ত্রিত রেখে আল্লাহ তা'আলার আনুগত্যে অবিচলিত থাকাকে সবর বলা হয়। একজন আল্লাহপ্রেমিক ও আখিরাতের সফলতাকামীর জন্য সবরের প্রয়োজন পদে পদে। দুনিয়ার তুলনায় আখিরাতকে উত্তম মনে করে তা পাওয়ার চেষ্টা-মেহনত করতে পারে কেবল কষ্টসহিষ্ণু ব্যক্তি। এর জন্য সবর অপরিহার্য। যাদের কষ্ট-ক্লেশ করার ধৈর্য নেই, তারা নগদপ্রাপ্তির দুনিয়া উপেক্ষা করে আখিরাতের জন্য সাধনা করতে পারে না। তারা নগদের লোভে পড়ে যায়। এরূপ লোক দুনিয়াদারদের অর্থবিত্ত ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য দেখে মনে করে তারা বড় ভাগ্যবান। তার বিপরীতে নিজের অভাব-অনটন দেখে হতাশায় পড়ে যায়। বনী ইসরাঈলের দুনিয়াদার শ্রেণির সে অবস্থায় হয়েছিল। তাদের মধ্যে সবরের গুণ থাকলে একটুও আক্ষেপ করত না। এ কারণেই তাদের ও তাদের মতো অন্যান্যদের সতর্ক করে বলা হয়েছে যে, আখিরাতের অফুরন্ত নি'আমত লাভ করতে চাইলে তোমাদেরকে অবশ্যই সংযমী হতে হবে, সবরের গুণ অর্জন করতে হবে। এ গুণ যাদের নেই, তারা আখিরাতের নি'আমত লাভ করতে পারে না।
পরিশেষে কারূনের পরিণাম সম্পর্কে বলা হয়েছে- فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهُ مِنْ فِئَةٍ يَنْصُرُونَهُ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنْتَصِرِينَ (পরিনামে আমি তাকে ও তার বাড়িটি ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম। অতঃপর সে এমন একটি দলও পেল না, যারা আল্লাহর বিপরীতে তার কোনও সাহায্য করতে পারে এবং নিজেও পারল না আত্মরক্ষা করতে)।
অর্থাৎ কারূন যখন কারও কোনও উপদেশে কর্ণপাত করল না, উল্টো হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠল এবং তাঁকে নানাভাবে কষ্ট দিতে লাগল, তখন আমি তাকে তার ঘরবাড়ি ও ধন-ভাণ্ডারসহ ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম।
ঘটনার বিবরণ এরকম। কারুন অহংকার ও ঔদ্ধত্য করার পাশাপাশি মূসা আলাইহিস সালামকে সবসময় কষ্ট দিত। কুরআন মাজীদে সেদিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ آذَوْا مُوسَىٰ فَبَرَّأَهُ اللَّهُ مِمَّا قَالُوا ۚ وَكَانَ عِندَ اللَّهِ وَجِيهًا (69)
‘হে মুমিনগণ! তাদের মতো হয়ো না, যারা মূসাকে কষ্ট দিয়েছিল, অতঃপর আল্লাহ তারা যা রটনা করেছিল তা হতে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করেন। সে ছিল আল্লাহর কাছে অত্যন্ত মর্যাদাবান।(সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৬৯)
এর দ্বারা হযরত মূসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে কারূন ও তার সহচরদের একটি ঘটনার প্রতি ইশারা করা হয়েছে। ঘটনা হয়েছিল এই যে, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম একদিন কারূনকে যাকাতের বিধান শোনালে সে তা দিতে অস্বীকৃতি জানাল। একদিন সে বনী ইসরাঈলকে বলল, এই লোকটি তো এতদিন নামাযের কথা বলত। সেইসঙ্গে আরও কিছু বিধানের কথাও প্রচার করত। তোমরা সেসব মেনে নিয়েছ। এখন সে যাকাতের বিধান নিয়ে হাজির হয়েছে। সে তোমাদের অর্থকড়ি হাতিয়ে নিতে চায়। এবার আমরা তাকে জনসম্মুখে অপদস্থ করে ছাড়ব, যাতে কেউ আর তার কথায় কান না দেয়। এ লক্ষ্যে সে ও তার অনুচরেরা এক ভ্রষ্টা মহিলাকে উৎকোচ দিয়ে প্রস্তুত করল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল মহিলা এক ভরা মজলিসে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের উপর ব্যভিচারের অপবাদ দেবে। তারা তাই করল। একদিন তিনি উপস্থিত লোকদের নসীহত করছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, বিবাহিত লোক ব্যভিচার করলে আল্লাহর বিধান হল তাকে পাথর মেরে হত্যা করা। তখন কারুনের এক সমর্থক দাঁড়িয়ে বলল, এ কাজটি যদি আপনি নিজে করেন, তখনও একই বিধান? তিনি বললেন, হাঁ। তখন তারা ওই মহিলাকে ডেকে আনল। মহিলা ভরা মজলিসে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের উপর ব্যভিচারের অপবাদ দিল। মূসা আলাইহিস সালাম মহিলাটিকে বললেন, আমি তোমাকে আল্লাহর শপথ দিয়ে বলছি, সত্য কথা বলো। তাঁর এ কথা মহিলাটির মনে রেখাপাত করল। সে ভয়ে কেঁপে উঠল। তারপর বলল, হে আল্লাহর নবী! আপনি যখন আল্লাহর নামে কসম করেছেন, তখন আমি সত্য প্রকাশ করে দিচ্ছি। কারূন এত পরিমাণ অর্থকড়ি দিয়ে আমাকে ভরা মজলিসে এ কথা বলতে বলেছে। তার কথামতোই আমি এটা বলেছি। প্রকৃতপক্ষে আপনি এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল। মূসা আলাইহিস সালাম তখন সিজদায় পড়ে গেলেন। তিনি আল্লাহর কাছে দু'আ করলেন, হে আল্লাহ! আমি যদি তোমার সত্যনবী হয়ে থাকি, তবে তুমি আমার জন্য এই লোকটির উপর আযাব নাযিল করো। আল্লাহ তা'আলা তাঁর দু'আ কবুল করলেন। তিনি ভূমিকে হুকুম করলেন, মূসা তোমাকে যে আদেশ করবে, সেই মতো কাজ করবে। সেমতে মূসা আলাইহিস সালাম ভূমিকে আদেশ করলেন, তুমি কারূনকে তার ঘরবাড়ি ও ধন-দৌলতসহ গ্রাস করে নাও। সঙ্গে সঙ্গে ভূমি আদেশ পালন করল। সকলের চোখের সামনে কারূন তার ধন-দৌলতসমেত ধসে যেতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে সে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেল। হাদীছে বলা হয়েছে, সে কিয়ামত পর্যন্ত ভূগর্ভে তলিয়ে যেতে থাকবে।
এই হল কারুনের পরিণতি। এ পরিণতি থেকে সে নিজেকে নিজেও রক্ষা করতে পারল না, তার ধন-সম্পদও কোনও কাজে আসল না, তার ভক্ত-অনুরক্ত ও সহচরেরাও তাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারল না। যাকে তার কর্মদোষে আল্লাহ তা'আলা এভাবে ধ্বংস করেন, তাকে কেউ রক্ষা করতে পারে না। ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার কারণে তার প্রচণ্ড অহমিকা ছিল। কিন্তু সে অহমিকা কোনও ফল দিল না। সে তার যাবতীয় অহমিকা নিয়ে ভূগর্ভে বিলীন হয়ে গেল।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. অহংকার ও সীমালঙ্ঘন কঠিন পাপ। এর থেকে মুক্ত হওয়া একান্ত জরুরি।
খ. অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্যে অহংকার করতে নেই।
গ. মানুষ যতই চেষ্টা ও মেহনত করুক না কেন, অর্থ-সম্পদের প্রকৃত দাতা আল্লাহ তা'আলাই। তাই এজন্য তাঁর শোকর আদায় করা উচিত।
ঘ. পার্থিব কোনও প্রাপ্তিতে উল্লাস করতে নেই। যা করতে হবে তা কেবলই শোকরগুযারী।
ঙ. আল্লাহপ্রদত্ত প্রকাশ্য-গুপ্ত যে-কোনও নি'আমত মৌলিকভাবে আখিরাতের সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে ব্যবহার করা চাই।
চ. বৈরাগ্য ইসলামঅনুমোদিত নয়। নিজের ও পারিবারিক প্রয়োজনে যতটুকু দরকার, ততটুকু অর্থ উপার্জন অবশ্যকর্তব্য।
ছ. আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমতের এক শোকর হল সৃষ্টির সেবা করা।
জ. পাপকর্মই যাবতীয় অশান্তির মূল। তাই অশান্তি বিস্তারের কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার লক্ষ্যেও পাপকর্ম থেকে বিরত থাকা জরুরি।
ঝ. সম্পদের মতো ইলমেরও গৌরব দেখাতে নেই।
ঞ. শক্তি ও ক্ষমতার বড়াই করা উচিত নয়। বহু শক্তিমানকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছেন।
ট. রাস্তাঘাটে দম্ভভরে চলতে নেই।
ঠ. অন্যের ঐশ্বর্য দেখে আক্ষেপ করা উচিত নয়।
ড. কারও ঐশ্বর্য থাকলেই সে ভাগ্যবান হয়ে যায় না এবং গরীব হওয়াটাও দুর্ভাগ্য নয়। যে ব্যক্তি আখিরাতে নাজাত পাবে, সেই প্রকৃত ভাগ্যবান।
ঢ. দুনিয়া ও আখিরাতের হাকীকত কেবল সেই বুঝতে পারে, যার দীনী ইলম আছে।
ণ. আখিরাতের পুরস্কার ঈমান ও আমলে সালিহার উপর নির্ভরশীল।
ত. সবর ও সংযম ছাড়া আখিরাতের প্রতিদান পাওয়া সম্ভব নয়।
থ. আল্লাহ কাউকে শাস্তি দিতে চাইলে ধনবল, জনবল, বাহুবল কোনওকিছু দ্বারাই তা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না।
দ. আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিকে কষ্ট দিতে নেই। তার পরিণাম হয় বড় ভয়ংকর।
এখানে দু‘টি বিষয় আছে : اَلْكِبرُ (কিবর) ও اَلْعُجْبُ (‘উজব) অর্থাৎ অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা। কিবর বা অহংকার হল নিজেকে উত্তম ভাবা এবং অন্যকে তুচ্ছ গণ্য করা ও তাচ্ছিল্য করা। আর ‘উজব হল অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ছাড়া কেবল নিজেকে উত্তম ভাবা।
অহংকার যদি হয় আল্লাহর সঙ্গে, যদ্দরুন তাঁর আনুগত্য পরিত্যাগ করা হয় এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করা হয়, তবে তা কুফর সাব্যস্ত হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে অবজ্ঞা করে, তাঁর আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করে, সে নিশ্চিত কাফের। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে অবজ্ঞা করে না, স্রেফ নিজ গাফলাত ও ইন্দ্রিয়পরবশতার কারণে আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করে, সে একজন পাপী, সে কাফের নয়।
অহংকার যদি হয় মানুষের সঙ্গে, আর তাতে শরী'আত অবজ্ঞা করা না হয়, তবে তা কুফর নয়, কিন্তু কঠিন গুনাহ। যদি শরী'আত অবজ্ঞা করা হয়, তবে কুফর বটে।
অহংকার বহু রোগের মূল। ইমাম গাযালী রহ.-এর ভাষায় ‘উম্মুল আমরায’, সকল আত্মিক রোগের জননী। অর্থাৎ এর থেকে নানা আত্মিক রোগের জন্ম হয়। যেমন হিংসা, বিদ্বেষ, অতিরিক্ত রাগ, গীবত ইত্যাদি। ইবলীস অভিশপ্ত হয়েছিল অহংকার করেই। আল্লাহ তা'আলা হযরত আদম আলাইহিস সালামের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য সিজদার হুকুম করলে ফিরিশতারা সিজদা করেছিলেন, কিন্তু ইবলীস অহংকারবশে সিজদা করতে অপারগতা জানায়। সে বলে ওঠে-
أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ (12)
‘আমি তার চেয়ে উত্তম। তুমি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছ, আর তাকে সৃষ্টি করেছ মাটি দ্বারা।(সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১২)
যে চরিত্রের কারণে ইবলীস মরদুদ ও অভিশপ্ত হয়েছে তা যে কত মন্দ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুফয়ান ইবন উয়ায়না রহ. বলেন, যে ব্যক্তি কোনও লোভ-লালসার কারণে গুনাহ করে ফেলে, তার তাওবার আশা রাখতে পার। কিন্তু যার গুনাহর কারণ হয় অহংকার, তার সম্পর্কে লা'নতের ভয় রাখো। কেননা ইবলীস গুনাহ করেছিল অহংকারবশে। পরিণামে সে লা'নতগ্রস্ত হয়েছে।
অহংকারের কারণে মানুষ যে কেবল গুনাহ করে তাই নয়; সে বহুবিধ কল্যাণ থেকেও বঞ্চিত থাকে। যেমন অহংকারী ব্যক্তি অন্যের উপদেশ গ্রহণ করতে পারে না। সে সম্মানী ব্যক্তির সামনেও বিনয় দেখাতে সক্ষম হয় না। অহংকারী ব্যক্তি সহজে নিজ অজ্ঞতা স্বীকার করতে পারে না, ফলে জ্ঞানী ব্যক্তির কাছ থেকে সে জ্ঞান আহরণ থেকে বঞ্চিত থাকে। এমনকি অহংকার মানুষের ঈমান আনার পক্ষেও বাধা হয়। মনেপ্রাণে সত্য উপলব্ধি করা সত্ত্বেও বহু লোক কেবল অহংকারের কারণেই তা গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে কাফের অবস্থায় তাদের কবরে যেতে হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِينَ (14)
‘তারা সীমালঙ্ঘন ও অহমিকাবশত তা সব অস্বীকার করল, যদিও তাদের অন্তর সেগুলো (সত্য বলে) বিশ্বাস করে নিয়েছিল। সুতরাং দেখে নাও ফাসাদকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছিল!’(সূরা নামল (২৭), আয়াত ১৪)
কিবর বা অহংকারের কাছাকাছি আরেকটি ব্যাধি হল ‘উজব বা আত্মমুগ্ধতা। নিজের ভালো কোনও অবস্থা দেখে সেজন্য অন্যের তুলনায় নিজেকে উত্তম ভাবা হচ্ছে ‘উজব। এটা অহংকারের উৎস। এর থেকেই অহংকার সৃষ্টি হয়। তাই এটাও অতি নিন্দনীয়। কেননা এটা নেক আমল বরবাদ করে দেয়। নেক আমল করার তাওফীক হলে সেজন্য দরকার আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা আর কবুলের আশা রাখা। সেইসঙ্গে এই ভয়ে ভীত থাকাও জরুরি যে, নাজানি আল্লাহ তা'আলা তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু যার অন্তরে ‘উজব থাকে, তার অবস্থা এরূপ হয় না। সে তো মনে করে এই এই আমল করে আমি অন্যের উপরে চলে গেছি। কে কার উপরে যেতে পারে, তা আল্লাহ তা'আলা ছাড়া কেউ জানে না। কেননা তা নির্ভর করে আমল কবুল হওয়ার উপর। আত্মমুগ্ধতা কবুলিয়াতের জন্য বাধা। তাই হাদীছে একে ধ্বংসাত্মক বলা হয়েছে। বিখ্যাত বুযুর্গ মুতাররিফ রহ. বলেন, আমি যদি ঘুমিয়ে থাকি আর ভোরবেলা অনুতপ্ত হয়ে জাগি, তবে এটাই আমার কাছে এরচে' বেশি পসন্দ যে, আমি রাতভর তাহাজ্জুদ পড়ব আর ভোরবেলা নিজের প্রতি মুগ্ধ হয়ে যাব।
‘উজব ও আত্মমুগ্ধতা মানুষের দীনদারীর পথে অগ্রগামিতাও থামিয়ে দেয়। কেউ যখন নিজ আমলের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যায়, তখন শয়তান তার অন্তরে এই ধারণা জন্মে দেয় যে, তুমি যথেষ্ট আমল করছ। এর বেশি আর কী প্রয়োজন? ফলে সে সামনে চলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। সামনে চলা বন্ধ হয়ে গেলে অধঃপতন শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তার আমল তলানিতে নেমে যায়। একই অবস্থা হয় ইলম, আখলাক, দান- খয়রাত, খেদমতে খালকসহ দীনের যাবতীয় ক্ষেত্রে।
বস্তুত দীনের কোনওকিছুই আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সম্ভব হয় না। কিন্তু ব্যক্তির মধ্যে যখন ‘উজব জন্ম নেয়, তখন দৃষ্টি আল্লাহ থেকে সরে নিজ চেষ্টা ও আসবাব-উপকরণের দিকে চলে যায়। ফলে সে আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। তখন তার চেষ্টা- মেহনত ও আসবাব-উপকরণ কোনওকিছুই কাজে আসে না। আল্লাহ তা'আলা হুনায়নের যুদ্ধে এর বাস্তবতা দেখিয়ে দিয়েছেন। সে সম্পর্কে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللَّهُ فِي مَوَاطِنَ كَثِيرَةٍ وَيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئًا وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُمْ مُدْبِرِينَ (25)
‘বস্তুত আল্লাহ বহু ক্ষেত্রে তোমাদের সাহায্য করেছেন এবং (বিশেষ করে) হুনায়নের দিন, যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে আত্মপ্রসাদে লিপ্ত করেছিল। কিন্তু সে সংখ্যাধিক্য তোমাদের কোনও কাজে আসেনি এবং যমীন তার প্রশস্ততা সত্ত্বেও তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে (যুদ্ধক্ষেত্র হতে) পলায়ন করেছিলে।(সূরা তাওবা (৯), আয়াত ২৫)
বোঝা গেল অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা কঠিন আত্মিক ব্যাধি। এর চিকিৎসা অতীব জরুরি। এজন্যই কুরআন ও হাদীছে এ সম্পর্কে কঠিনভাবে সতর্ক করা হয়েছে। এ অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এগুলো বোঝার ও এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন।
‘অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ (83)
অর্থ: ওই পরকালীন নিবাস তো আমি সেই সকল লোকের জন্যই নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে বড়ত্ব দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। শেষ পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই অনুকূলে থাকবে।( সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৮৩)
ব্যাখ্যা
تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ (ওই পরকালীন নিবাস) অর্থাৎ জান্নাত, যা হবে আখিরাতে মুমিনদের স্থায়ী বাসস্থান এবং যার বৈশিষ্ট্য ও বিভিন্ন নি'আমত সম্পর্কে কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে ধারণা দেওয়া হয়েছে।
نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا (তা আমি সে সকল লোকের জন্য নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে বড়ত্ব দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না)। عُلو এর অর্থ উপর, উচ্চতা। কেউ যখন কোনও দিক থেকে কারও উপরে চলে যায়, তখন তার অন্তরে অহমিকা জন্মায়। এ কারণে শব্দটি অহংকার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। فَسَاد অর্থ অশান্তি, বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা। যে-কোনও পাপকর্ম অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাই শব্দটি দ্বারা পাপকর্মও বোঝানো হয়ে থাকে।
আয়াতটির সারমর্ম হল, যারা পার্থিব জীবনে অহংকার পরিত্যাগ করে ও বিনয় অবলম্বন করে এবং সর্বপ্রকার পাপকর্ম পরিহার করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে, আখিরাতে তারা জান্নাতবাসী হবে। বোঝা গেল যারা অহংকার দেখায় ও অশান্তি বিস্তার করে তথা পাপকর্মে লিপ্ত থাকে, জান্নাতের চিরসুখের ঠিকানা তাদের জন্য নয়।
আয়াতটিতে প্রথমে অহংকার এবং তারপর অশান্তি বিস্তার বা পাপকর্মে লিপ্ত থাকার কথা বলা হয়েছে। এর দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, অশান্তি বিস্তার ও পাপকর্ম করার পেছনে অহংকারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাই শান্তিময় জীবন ও পাপকর্ম হতে বিরত থাকার জন্য অন্তর থেকে অহংকার নির্মূল করা অতীব জরুরি। অহংকারের জন্য عُلو বা ‘উপরে ওঠা’ শব্দ ব্যবহারের মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, কেউ যখন কোনও দিক থেকে অন্যের উপরে উঠে যায়, তখন তার সতর্ক থাকা উচিত যাতে উপরে উঠাটা তাকে অহংকারে লিপ্ত করে না বসে। অন্যের উপরে থাকাটা ইলমের দিক থেকে হোক বা আমলের দিক থেকে, সম্পদের দিক থেকে হোক বা ক্ষমতার দিক থেকে, দৈহিক শক্তির দিক থেকে হোক বা অভ্যন্তরীণ গুণাবলিতে হোক, এমনিভাবে রূপ ও সৌন্দর্যে হোক বা প্রতিভার দিক থেকে, তা যেদিক থেকেই হোক না কেন, নিঃসন্দেহে তা আল্লাহ তা'আলারই দান। সেজন্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা উচিত। শোকরের বিষয়কে অহংকারের বিষয়ে পরিণত করা কোনও মুমিনের কাজ হতে পারে না। যে- কোনও নি'আমতকে অহংকারের বিষয়ে পরিণত করা সে নি'আমতের সুস্পষ্ট অকৃতজ্ঞতা। নি'আমতের জন্য শোকর আদায় করলে আল্লাহ তা'আলার কাছে পুরস্কার পাওয়া যায়। অকৃতজ্ঞদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা।
وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ (শেষ পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই অনুকূলে থাকবে)। শেষ পরিণাম মানে শুভ পরিণাম। অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতলাভ। এ সৌভাগ্য কেবল তাদেরই হবে, যারা তাকওয়ার অধিকারী। অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা'আলার যাবতীয় আদেশ পালন করে এবং তিনি যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. জান্নাত মুত্তাকীদের স্থায়ী বাসস্থান।
খ. অহংকার ও অহমিকা জান্নাতলাভের পক্ষে বাধা।
গ. জান্নাতের আশাবাদী ব্যক্তিকে অবশ্যই অশান্তিমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে।
ঘ. জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভ করার জন্য আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ পালন করা অবশ্যকর্তব্য।
দুই নং আয়াত
وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا
অর্থ: ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে চলো না।(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৩৭)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা বনী ইসরাঈলের ৩৭ নং আয়াতের প্রথম অংশ। এতে চালচলনে দম্ভ ও অহংকার দেখাতে নিষেধ করা হয়েছে। মানুষের অহংকার যেমন তার পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় প্রকাশ পায়, তেমনি তা প্রকাশ পায় চালচলনেও। মানুষ আল্লাহর বান্দা। বন্দেগীর দাবি যাবতীয় ক্ষেত্রে বিনয় অবলম্বন করা, এমনকি হাঁটা- চলায়ও। সূরা ফুরকানে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا
‘রহমানের বান্দা তারা, যারা ভূমিতে বিনয়-নম্রভাবে চলাফেরা করে।’(সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৩)
বোঝা গেল যাদের হাঁটা-চলায় বিনয় থাকে না, তারা সৃষ্টিগতভাবে আল্লাহর বান্দা হলেও কর্ম ও চরিত্রের দিক থেকে দয়াময় আল্লাহর বান্দা নয়। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার প্রিয় বান্দা নয়। তারা তাঁর লা'নত ও আযাবের উপযুক্ত।
وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَرِئَاءَ النَّاسِ ……. وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ (48)
‘তোমরা তাদের মতো হবে না, যারা নিজ গৃহ থেকে দম্ভভরে এবং মানুষকে (নিজেদের ঠাটবাট) দেখাতে দেখাতে বের হয়েছিল......এবং আল্লাহর শাস্তি অতি কঠোর।(সূরা আনফাল (৮), আয়াত ৪৭-৪৮)
আলোচ্য আয়াতটির শেষ অংশ হল- إِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولًا (তুমি তো ভূমিকে ফাটিয়ে ফেলতে পারবে না এবং উচ্চতায় পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না)। অর্থাৎ দম্ভভরে চলার উদ্দেশ্য কী? তুমি কি ভূমি ফাটিয়ে ফেলতে চাও, নাকি পাহাড়ের মতো উঁচু হতে চাও? নিশ্চয়ই তা চাও না। কারণ তা তোমার ক্ষমতায় নেই। তাহলে শুধু শুধু এভাবে চলছ কেন? শুধু শুধু কোনওকিছু করা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা। আর যদি তুমি মনে কর এভাবে চলার দ্বারা তুমি মানুষের চোখে বড় হয়ে যাবে, তবে তাও একটা ভুল ধারণা। কেননা দম্ভ-অহংকার দ্বারা কেউ কারও চোখে বড় হয় না। বরং তাতে মানুষ আরও ক্ষুদ্র ভাবে। অহংকারী ব্যক্তি নিজের চোখেই নিজে বড় থাকে, অন্যদের চোখে হয়ে যায় ছোট। সুতরাং এভাবে চলাটা বৃথা প্রয়াস ছাড়া কিছুই নয়। তাই এভাবে না চলে নম্র-কোমল হয়ে চলো। তাতে আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে পারবে। ফলে আল্লাহ তা'আলা মাখলুকের দৃষ্টিতে তোমাকে উঁচু করে দেবেন।
আয়াতটির শিক্ষা
হাঁটা-চলায় আমাদেরকে দম্ভভাব পরিহার করে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করতে হবে।
তিন নং আয়াত
وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (18)
অর্থ: এবং মানুষের সামনে (অহংকারে) নিজ গাল ফুলিয়ো না এবং ভূমিতে দর্পভরে চলো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনও দর্পিত অহংকারীকে পসন্দ করেন না।(সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ১৮)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে দু'টি নিষেধাজ্ঞা আছে। এক নিষেধাজ্ঞা হল – وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ ‘এবং মানুষের সামনে (অহংকারে) নিজ গাল ফুলিয়ো না'। অর্থাৎ মানুষকে তাচ্ছিল্য করে অহংকারীদের মতো মুখ ভার করে কথা বলো না; বরং হাসিমুখে কথা বলো। এর আরেক অর্থ হল, যখন লোকজন তোমার সঙ্গে কথা বলবে, তখন অহংকারবশে তাদের তাচ্ছিল্য করো না এবং তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। বরং নম্রতার সঙ্গে তাদের দিকে মনোযোগী হও এবং তারা কী বলে, আগ্রহের সঙ্গে তা শোনো।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিষেধ করা হয়েছে তা হল- وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا (এবং ভূমিতে দর্পভরে চলো না)। উপরে ২ নং আয়াতে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বস্তুত উভয় নিষেধাজ্ঞাই অহংকার সম্পর্কিত। একটি হল অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ও কথাবার্তায় অহংকার করা। আর দ্বিতীয়টি হল অহংকারের সঙ্গে চলাচল করা। উভয়টিই অত্যন্ত নিন্দনীয়। একজন মুমিনের পক্ষে সম্পূর্ণ অশোভন এবং কাফেরদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। মুমিনের সবকিছুতেই থাকবে বিনয়, যা আল্লাহ পসন্দ করেন। মুমিন ব্যক্তি তার যাবতীয় কাজে লক্ষ রাখবে আল্লাহ তা'আলা কী পসন্দ করেন এবং কী পসন্দ করেন না। অহমিকাপূর্ণ কোনও আচরণ আল্লাহ তা'আলার পসন্দ নয়। সুতরাং আয়াতটির শেষে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনও দর্পিত অহংকারীকে পসন্দ করেন না)। আর এ কারণেই তিনি উল্লিখিত দু'টি কাজ করতে নিষেধ করেছেন। বলাবাহুল্য একজন মুমিন যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহপ্রেমিক হবে, তাই আল্লাহ তা'আলার অপসন্দনীয় এ কাজদু'টি সে কিছুতেই করবে না; করতে পারে না।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. কথাবার্তা ও চলাফেরায় আমাদেরকে অহমিকার ভাব পরিহার করতে হবে।
খ. কেউ যখন কথা বলে, তখন তার প্রতি মনোযোগী থাকা চাই। উপেক্ষাভাব দেখানো উচিত নয়।
গ. অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময় মুখ ভার করে রাখা নয়; বরং হাসিমুখে কথা বলতে হবে।
ঘ. ঔদ্ধত্য ও অহমিকা প্রকাশ পায় এমন যাবতীয় আচরণ পরিত্যাজ্য।
চার নং আয়াত
إِنَّ قَارُونَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوسَى فَبَغَى عَلَيْهِمْ وَآتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوزِ مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّةِ إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لَا تَفْرَحْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفَرِحِينَ (76) وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ (77) قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ أَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهِ مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَأَكْثَرُ جَمْعًا وَلَا يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَ (78) فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ فِي زِينَتِهِ قَالَ الَّذِينَ يُرِيدُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا يَالَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إِنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (79) وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا وَلَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ (80) فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهُ مِنْ فِئَةٍ يَنْصُرُونَهُ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنْتَصِرِينَ (81)
অর্থ : কারূন ছিল মূসার সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। কিন্তু সে তাদেরই প্রতি জুলুম করল। আমি তাকে এমন ধনভাণ্ডার দিয়েছিলাম, যার চাবিগুলি বহন করা একদল শক্তিমান লোকের পক্ষেও কষ্টকর ছিল। যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, বড়াই করো না। যারা বড়াই করে আল্লাহ তাদের পসন্দ করেন না। আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না। আল্লাহ যেমন তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তেমনি তুমিও (অন্যদের প্রতি) অনুগ্রহ করো। আর পৃথিবীতে ফাসাদ বিস্তারের চেষ্টা করো না। জেনে রেখো, আল্লাহ ফাসাদ বিস্তারকারীদের পসন্দ করেন না। সে বলল, এসব তো আমি আমার জ্ঞানবলে লাভ করেছি। সে কি এতটুকুও জানত না যে, আল্লাহ তার আগে এমন বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছিলেন, যারা শক্তিতে তার অপেক্ষা প্রবল ছিল এবং জনসংখ্যায়ও বেশি ছিল? অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেসও করা হয় না। অতঃপর (একদিন) সে তার সম্প্রদায়ের সামনে নিজ জাঁকজমকের সাথে বের হয়ে আসল। যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা (তা দেখে) বলতে লাগল, আহা! কারুনকে যা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ যদি আমাদেরও থাকত! বস্তুত সে মহা ভাগ্যবান। আর যারা (আল্লাহর পক্ষ হতে) জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল, তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে! (তোমরা এরূপ কথা বলছ, অথচ) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ছাওয়াব কতইনা শ্রেয়! আর তা লাভ করে কেবল ধৈর্যশীলগণই। পরিণামে আমি তাকে ও তার বাড়িটি ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম। অতঃপর সে এমন একটি দলও পেল না, যারা আল্লাহর বিপরীতে তার কোনও সাহায্য করতে পারে এবং নিজেও পারল না আত্মরক্ষা করতে।(সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৬-৮১)
ব্যাখ্যা
কারূন ছিল হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় অর্থাৎ বনী ইসরাঈলের লোক। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, সে ছিল হযরত মূসা আলাইহিস সালামের চাচাতো ভাই। সে অনেক বড় ধনী ছিল। হযরত মূসা আলাইহিস সালামের নবুওয়াতলাভের আগে ফেরাউন তাকে বনী ইসরাঈলের নেতা বানিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর যখন হযরত মূসা আলাইহিস সালাম নবুওয়াত লাভ করলেন আর হযরত হারুন আলাইহিস সালামকে তাঁর নায়েব বানানো হল, তখন কারূন ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ল। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, সে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাছে দাবি জানিয়েছিল, তাকে যেন কোনও পদ দেওয়া হয়। কিন্তু তাকে কোনও পদ দেওয়া হোক এটা আল্লাহ তা'আলার পসন্দ ছিল না। তাই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম অপারগতা প্রকাশ করলেন, এতে তার হিংসার আগুন আরও তীব্র হয়ে উঠল এবং তা চরিতার্থ করার জন্য মুনাফিকীর পন্থা অবলম্বন করল। এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা তার সম্পর্কে বলেছেন- فَبَغَى عَلَيْهِمْ (কিন্তু সে তাদেরই প্রতি জুলুম করল)। এর আরেক অর্থ হতে পারে- দম্ভ ও বড়াই করল। বর্ণিত আছে যে, ফেরাউনের পক্ষ থেকে তার উপর যখন বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব-ভার অর্পণ করা হয়, তখন সে তাদের উপর জুলুম করেছিল এবং সকলের উপর নিজ শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করেছিল। একে তো ছিল তার ধন-সম্পদ, তার উপর পেয়েছিল ক্ষমতা। যাদের মনে আল্লাহর ভয় থাকে না, তারা এ দু'টির কারণেই উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে যায়। কারূনেরও তাই হয়েছিল। সে কেমন ধনী ছিল, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَآتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوزِ مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّة (আমি তাকে এমন ধনভাণ্ডার দিয়েছিলাম, যার চাবিগুলি বহন করা একদল শক্তিমান লোকের পক্ষেও কষ্টকর ছিল)। কথিত আছে, কারুন যেখানেই যেত, নিজ ধন-ভাণ্ডারের চাবিসমূহ সঙ্গে নিয়ে যেত। চাবিগুলো ছিল লোহার। ক্রমান্বয়ে তার ধন-সম্পদ বাড়তে থাকলে চাবির সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এতে বোঝা অনেক ভারী হয়ে যায়। ফলে সে কাঠের ছোট ছোট চাবি বানিয়ে নেয়। কিন্তু সংখ্যা প্রচুর হওয়ায় তাও এত ভারী হয়ে যায় যে, তা বহন করতে ৪০টি খচ্চর লাগত। কোনও কোনও বর্ণনা অনুযায়ী তার চাবি বহন করত ৪০ জন শক্তিশালী লোক। তারা যখন সেগুলো বহন করত, তখন তার ভারে তারা নুইয়ে পড়ত। এর দ্বারা অনুমান করা যায় তার সম্পদ কত বিপুল ছিল। ঈমান না থাকায় এ সম্পদের কারণে সে চরম উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে পড়ে। এ কারণে তার সম্প্রদায় তাকে নসীহত করেছিল। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لَا تَفْرَحْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفَرِحِينَ (যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, বড়াই করো না। যারা বড়াই করে আল্লাহ তাদের পসন্দ করেন না)। বস্তুত অন্তরে আল্লাহর ভয় না থাকলে এটাই হয় ঐশ্বর্যের পরিণতি। ধন-দৌলত মানুষের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى (6) أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى (7)
‘বস্তুত মানুষ সীমালঙ্ঘন করছে। কেননা সে নিজেকে অমুখাপেক্ষী মনে করে।’সূরা আলাক (৯৬), আয়াত ৬-৭)
لَا تَفْرَحْ এর আরেক অর্থ হতে পারে- উৎফুল্ল হয়ো না। দুনিয়ার ধন-সম্পদে উৎফুল্ল হওয়া নিন্দনীয়, তাতে অন্তরে অহংকার থাকুক বা নাই থাকুক। কেননা দুনিয়ার সম্পদে উৎফুল্ল হওয়াটা দুনিয়ার প্রতি আসক্তির লক্ষণ। আর সম্পদের আসক্তি দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীনতার নিদর্শন। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্ব ও নশ্বরতা সম্পর্কে উদাসীন হওয়াটা কিছুতেই কাম্য নয়। কেননা তাতে অন্তর আল্লাহ থেকে বিমুখ হয়ে যায়। আল্লাহবিমুখ অন্তর কখনও শোকরগুযার হয় না; বরং অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ তা'আলা শোকরগুযার বান্দাকে ভালোবাসেন এবং অকৃতজ্ঞকে ঘৃণা করেন। এ কারণেই কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে দুনিয়া ও দুনিয়ার সম্পদে উৎফুল্ল ও আসক্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
لِكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (23)
‘যাতে তোমরা যা হারিয়েছ তার জন্য দুঃখিত না হও এবং যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন তার জন্য উল্লসিত না হও। আল্লাহ এমন কোনও ব্যক্তিকে পসন্দ করেন না, যে দর্প দেখায় ও বড়ত্ব প্রকাশ করে।’(সূরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ২৩)
কারূনকে আরো উপদেশ দেওয়া হয়েছিল- وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ (আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো)।অর্থাৎ অর্থ-সম্পদকে আল্লাহ তা'আলার বিধান মোতাবেক ব্যবহার করো। পরিণামে তুমি আখিরাতে পরম শান্তির জান্নাতী নিবাসে পৌঁছতে পারবে। আয়াতে সাধারণভাবে مَا آتَاكَ اللَّهُ (আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন) বলা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় আল্লাহপ্রদত্ত প্রকাশ্য-গুপ্ত যাবতীয় নি'আমত এবং মানুষের শারীরিক ও মেধাগত সকল যোগ্যতা-ক্ষমতা মৌলিকভাবে আখিরাতের নাজাতলাভের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা উচিত।
কারুনকে আরও বলা হয়েছিল- وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا (এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না)। অর্থাৎ আখিরাতের নিবাস সন্ধানের মানে এ নয় যে, দুনিয়ার প্রয়োজনসমূহ বিলকুল অগ্রাহ্য করা হবে। দুনিয়ার প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা ও তা রাখাতে দোষের কিছু নেই। বরং নিজের ও পরিবারবর্গের প্রতি কর্তব্যপালনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও আসবাব-উপকরণ সংগ্রহ করা জরুরি বটে। প্রকৃতপক্ষে তাও ছাওয়াবের কাজই। এতে অবহেলা করা গুনাহ। কেননা তাতে দায়িত্বে অবহেলা হয়। হাঁ, দুনিয়ার কামাই-রোজগারে এভাবে নিমজ্জিত হতে নেই, যদ্দরুন আখিরাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তাকে আরও উপদেশ দেওয়া হয়েছিল- وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ ‘আল্লাহ যেমন তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তেমনি তুমিও (অন্যদের প্রতি) অনুগ্রহ করো’। ইশারা করা হয়েছে যে, দুনিয়ায় তুমি যে অর্থ-সম্পদ লাভ করেছ, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলাই তার মালিক। তিনি অনুগ্রহ করে তোমাকে তা দান করেছেন। তিনি যখন এভাবে তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তখন তুমিও মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করো এবং তাঁর প্রদত্ত অর্থ-সম্পদে তাদেরকে শরীক করো।
অথবা এর অর্থ- আল্লাহ তা'আলা যেহেতু তোমাকে এসব সম্পদ দিয়েছেন, তাই তার শোকর আদায়ের লক্ষ্যে তুমি উত্তমরূপে আল্লাহ তা'আলার ইবাদত করো ও সর্বদা তাঁকে স্মরণ করো।
তাকে বলা হয়েছিল- وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ (আর পৃথিবীতে ফাসাদ বিস্তারের চেষ্টা করো না। জেনে রেখো, আল্লাহ ফাসাদ বিস্তারকারীদের পসন্দ করেন না)। অর্থাৎ এমনসব তৎপরতা থেকে বিরত থেকো, যাতে পৃথিবীর শান্তি নষ্ট হয় এবং বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি দেখা দেয়। ইমাম বাগাবী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানি করে, সে পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তার করে। অর্থাৎ যাবতীয় অশান্তির মূল আল্লাহ তা'আলার নাফরমানি ও পাপকর্ম।
উল্লিখিত নসীহত ও উপদেশের বিপরীতে কারুন বলেছিল - إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي (এসব তো আমি আমার জ্ঞানবলে লাভ করেছি)। অর্থাৎ কারূন দাবি করছিল, আমি এ ধন-সম্পদের মালিক হয়েছি নিজ বিদ্যা-বুদ্ধির বলে। সে যেন বলতে চাচ্ছিল, আল্লাহ আমার প্রতি কোনও অনুগ্রহ করেননি। এ ধন-সম্পদ তিনি আমাকে দান করেননি, তাই তার শোকর আদায় করারও কোনও প্রয়োজন আমার নেই। এসব আমার নিজ চেষ্টার ফল। আমি ব্যবসা-বাণিজ্যের কলা-কৌশল জানি। কৃষিবিজ্ঞানে আমার দখল আছে। অর্থোপার্জনের অন্যসব পদ্ধতি সম্পর্কেও আমি অবহিত। এ কারণেই এত অর্থবিত্ত আমার হাতে এসেছে। এতে আল্লাহর বান্দাদের কোনও অংশ থাকবে কেন? তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা আমার কর্তব্য হবে কেন?
সাহল রহ. বলেন, যে ব্যক্তি কেবল নিজেকে দেখেছে, সে সফল হয়নি। সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি, যে তার নিজের দিকে অহংকারের দৃষ্টিতে তাকায়নি এবং আপন কথা ও কাজে অহংকার প্রকাশ করেনি। ওই ব্যক্তি বড় দুর্ভাগা, যে তার কথা, কাজ ও অবস্থাকে আকর্ষণীয় করেছে এবং সেজন্য অহমিকা দেখিয়েছে। সে চিন্তা করেনি যে, একদিন তাকে ধ্বংস করে ফেলা হবে, যেমন কারূনকে তার অহমিকার কারণে মাটির ভেতর ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কারুনের ওই আত্মম্ভরি বক্তব্যের জবাবে আল্লাহ তা'আলা বলেন- أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ أَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهِ مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَأَكْثَرُ جَمْعًا (সে কি এতটুকুও জানত না যে, আল্লাহ তার আগে এমন বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছিলেন, যারা শক্তিতে তার অপেক্ষা প্রবল ছিল এবং জনসংখ্যায়ও বেশি ছিল)? অর্থাৎ কারূন নিজ জ্ঞানবত্তার দাবি করছে, অথচ তার বক্তব্য দ্বারাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, উচ্চস্তরের জ্ঞান তো দূরের কথা, এই মামুলি জ্ঞানটুকুও তার ছিল না যে, সে যদি নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারাই অর্থোপার্জন করে থাকে, তবে সেই জ্ঞান-বুদ্ধি সে কোথায় পেল? কে তাকে তা দান করেছিল? সেইসঙ্গে সে এ বিষয়টাও অনুধাবন করছে না যে, তার আগেও তো তার মতো, বরং তার চেয়েও ধন-জনে শক্তিমান কত লোক ছিল, আজ তারা কোথায়? তারাও তার মতো দর্প দেখাত এবং তার মতো দাবি করে বেড়াত। পরিণামে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তিনি তো 'আদ জাতিকেও ধ্বংস করেছেন, যারা দৈহিক শক্তি ও অর্থশক্তিতে তারচে' অনেক বলীয়ান ছিল। শাদ্দাদ ছিল কত বড় সম্রাট! কী বিশাল ছিল তার রাজত্ব! তাকেও তিনি ধ্বংস করেছেন। কারূন চিন্তা করছে না যে, আল্লাহ তা'আলা চাইলে একই পরিণতি তারও ঘটাতে পারেন।
তারপর আল্লাহ তা'আলা বলেন- وَلَا يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَ (অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেসও করা হয় না)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা অপরাধীদের অবস্থা ভালো করেই জানেন। কাজেই তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য তাদেরকে তাঁর জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন নেই। হাঁ, আখিরাতে যে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, সেটা তাদের সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে নয়; বরং তাদের অপরাধ তাদের দৃষ্টিতে সপ্রমাণ করার উদ্দেশ্যেই করা হবে।
তারপর কারুনের পরিণতি সম্পর্কে জানানো হচ্ছে- فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ فِي زِينَتِهِ ‘অতঃপর (একদিন) সে তার সম্প্রদায়ের সামনে নিজ জাঁকজমকের সাথে বের হয়ে আসল'। সে কী রকম জাঁকজমকের সঙ্গে বের হয়েছিল, কুরআন মাজীদে তার বিবরণ দেওয়া হয়নি। মুফাসসিরগণ এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন ইবরাহীম নাখা'ঈ রহ. বলেন, কারূন ও তার দলের লোকেরা সবুজ ও লাল পোশাক পরিধান করে বের হয়েছিল। মুজাহিদ রহ. বলেন, তারা সাদা ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে বের হয়েছিল। মুকাতিল রহ. বলেন, তার সঙ্গে ছিল চার হাজার ঘোড়সওয়ার ও তিনশ দাস-দাসী। তার এ জাঁকজমক দেখে এক শ্রেণির লোকের আক্ষেপ হল। তাদের সম্পর্কে আয়াতে জানানো হয়েছে-
قَالَ الَّذِينَ يُرِيدُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا يَالَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إِنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ ‘যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা (তা দেখে) বলতে লাগল, আহা! কারূনকে যা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ যদি আমাদেরও থাকত! বস্তুত সে মহা ভাগ্যবান'। এখানে লক্ষণীয়, তারা এরূপ বলেনি যে, কারূনের ধন-সম্পদ যদি আমাদের হাতে এসে যেত। বরং বলেছে যে, তার মতো ধন-সম্পদ যদি আমাদেরও থাকত! এর দ্বারা বোঝা যায়, তারা দুনিয়াদার হলেও ঈর্ষাপরায়ণ ছিল না। বস্তুত বনী ইসরাঈলের মনে দুনিয়ার আসক্তি থাকলেও তারা ঈমানদারও ছিল বটে। তাই কারুনের সম্পদ দেখে তারা তার প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়নি। কেবল নিজেদের না থাকার দরুন আক্ষেপ প্রকাশ করেছে, যদিও এরূপ আক্ষেপ প্রকাশ করাও একজন মুমিনের পক্ষে কিছুতেই উচিত নয়। প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য আল্লাহ তা'আলা তাকে যা দিয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকা, অন্যকে কী দেওয়া হয়েছে সেদিকে লক্ষ করা নয়। এমনিভাবে 'যে সম্পদশালী সে ভাগ্যবান' এ কথাও বলাও ঠিক নয়, যেমনটা তারা কারূনকে দেখে বলেছিল। কেননা কে ভাগ্যবান আর কে দুর্ভাগা, তার পরিচয় হবে আখিরাতে। সেখানে যে নাজাত পাবে সেই প্রকৃত ভাগ্যবান। নাজাত ধন-সম্পদের উপর নির্ভর করে না। তা নির্ভর করে কেবলই ঈমান ও সৎকর্মের উপর। ঈমান ও সৎকর্ম যেমন একজন ধনী অবলম্বন করতে পারে, তেমনি তা পারে একজন গরীবও। বরং গরীবের পক্ষেই তা অপেক্ষাকৃত সহজ।
বনী ইসরাঈলের মধ্যে কতিপয় লোক সত্যিকারের জ্ঞানীও ছিল। তারা দুনিয়াদারদের আক্ষেপমূলক কথাবার্তা শুনে তাদেরকে আশ্বাসবাণী শোনাল ও নসীহত করল। ইরশাদ হয়েছে- وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ‘আর যারা (আল্লাহর পক্ষ হতে) জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে! (তোমরা এরূপ কথা বলছ, অথচ) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ছাওয়াব কতইনা শ্রেয়'! যাদের মধ্যে দীনের জ্ঞান ছিল, যারা দুনিয়ার হাকীকত বুঝত, আখিরাতের অফুরন্ত নি'আমত সম্পর্কে অবহিত ছিল এবং কীভাবে সেই নি'আমত অর্জিত হবে সে সম্পর্কেও তাদের জানা ছিল, তারা দুনিয়াদারদের ধিক্কার দিয়ে বলল, তোমরা কেন নশ্বর দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সম্পদের প্রতি লালায়িত হচ্ছ! আল্লাহ তা'আলা আখিরাতে মুমিন ও সৎকর্মশীলদের জন্য যে পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছেন, তা এরচে' অনেক অনেক উত্তম। তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না তা মান ও পরিমাণে এরচে' কত শ্রেয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (17)
‘সুতরাং কোনও ব্যক্তি জানে না এরূপ লোকদের জন্য তাদের কর্মফলস্বরূপ চোখ জুড়ানোর কত কী উপকরণ লুকিয়ে রাখা হয়েছে।(সূরা সাজদা (৩২), আয়াত ১৭)
সুতরাং তোমরা ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার এসব অস্থায়ী সম্পদের জন্য আক্ষেপ করো না। আখিরাতের অফুরন্ত নি'আমতলাভের আশা করো আর সেজন্য করণীয় কাজে রত থাকো। সেজন্য একটি করণীয় কর্ম হল সবর করা। ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ (আর তা লাভ করে কেবল ধৈর্যশীলগণই)। 'সবর' শব্দটি কুরআন মাজীদের একটি পরিভাষা। নিজের ইন্দ্রিয় চাহিদা সংযত ও নিয়ন্ত্রিত রেখে আল্লাহ তা'আলার আনুগত্যে অবিচলিত থাকাকে সবর বলা হয়। একজন আল্লাহপ্রেমিক ও আখিরাতের সফলতাকামীর জন্য সবরের প্রয়োজন পদে পদে। দুনিয়ার তুলনায় আখিরাতকে উত্তম মনে করে তা পাওয়ার চেষ্টা-মেহনত করতে পারে কেবল কষ্টসহিষ্ণু ব্যক্তি। এর জন্য সবর অপরিহার্য। যাদের কষ্ট-ক্লেশ করার ধৈর্য নেই, তারা নগদপ্রাপ্তির দুনিয়া উপেক্ষা করে আখিরাতের জন্য সাধনা করতে পারে না। তারা নগদের লোভে পড়ে যায়। এরূপ লোক দুনিয়াদারদের অর্থবিত্ত ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য দেখে মনে করে তারা বড় ভাগ্যবান। তার বিপরীতে নিজের অভাব-অনটন দেখে হতাশায় পড়ে যায়। বনী ইসরাঈলের দুনিয়াদার শ্রেণির সে অবস্থায় হয়েছিল। তাদের মধ্যে সবরের গুণ থাকলে একটুও আক্ষেপ করত না। এ কারণেই তাদের ও তাদের মতো অন্যান্যদের সতর্ক করে বলা হয়েছে যে, আখিরাতের অফুরন্ত নি'আমত লাভ করতে চাইলে তোমাদেরকে অবশ্যই সংযমী হতে হবে, সবরের গুণ অর্জন করতে হবে। এ গুণ যাদের নেই, তারা আখিরাতের নি'আমত লাভ করতে পারে না।
পরিশেষে কারূনের পরিণাম সম্পর্কে বলা হয়েছে- فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهُ مِنْ فِئَةٍ يَنْصُرُونَهُ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنْتَصِرِينَ (পরিনামে আমি তাকে ও তার বাড়িটি ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম। অতঃপর সে এমন একটি দলও পেল না, যারা আল্লাহর বিপরীতে তার কোনও সাহায্য করতে পারে এবং নিজেও পারল না আত্মরক্ষা করতে)।
অর্থাৎ কারূন যখন কারও কোনও উপদেশে কর্ণপাত করল না, উল্টো হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠল এবং তাঁকে নানাভাবে কষ্ট দিতে লাগল, তখন আমি তাকে তার ঘরবাড়ি ও ধন-ভাণ্ডারসহ ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম।
ঘটনার বিবরণ এরকম। কারুন অহংকার ও ঔদ্ধত্য করার পাশাপাশি মূসা আলাইহিস সালামকে সবসময় কষ্ট দিত। কুরআন মাজীদে সেদিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ آذَوْا مُوسَىٰ فَبَرَّأَهُ اللَّهُ مِمَّا قَالُوا ۚ وَكَانَ عِندَ اللَّهِ وَجِيهًا (69)
‘হে মুমিনগণ! তাদের মতো হয়ো না, যারা মূসাকে কষ্ট দিয়েছিল, অতঃপর আল্লাহ তারা যা রটনা করেছিল তা হতে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করেন। সে ছিল আল্লাহর কাছে অত্যন্ত মর্যাদাবান।(সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৬৯)
এর দ্বারা হযরত মূসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে কারূন ও তার সহচরদের একটি ঘটনার প্রতি ইশারা করা হয়েছে। ঘটনা হয়েছিল এই যে, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম একদিন কারূনকে যাকাতের বিধান শোনালে সে তা দিতে অস্বীকৃতি জানাল। একদিন সে বনী ইসরাঈলকে বলল, এই লোকটি তো এতদিন নামাযের কথা বলত। সেইসঙ্গে আরও কিছু বিধানের কথাও প্রচার করত। তোমরা সেসব মেনে নিয়েছ। এখন সে যাকাতের বিধান নিয়ে হাজির হয়েছে। সে তোমাদের অর্থকড়ি হাতিয়ে নিতে চায়। এবার আমরা তাকে জনসম্মুখে অপদস্থ করে ছাড়ব, যাতে কেউ আর তার কথায় কান না দেয়। এ লক্ষ্যে সে ও তার অনুচরেরা এক ভ্রষ্টা মহিলাকে উৎকোচ দিয়ে প্রস্তুত করল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল মহিলা এক ভরা মজলিসে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের উপর ব্যভিচারের অপবাদ দেবে। তারা তাই করল। একদিন তিনি উপস্থিত লোকদের নসীহত করছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, বিবাহিত লোক ব্যভিচার করলে আল্লাহর বিধান হল তাকে পাথর মেরে হত্যা করা। তখন কারুনের এক সমর্থক দাঁড়িয়ে বলল, এ কাজটি যদি আপনি নিজে করেন, তখনও একই বিধান? তিনি বললেন, হাঁ। তখন তারা ওই মহিলাকে ডেকে আনল। মহিলা ভরা মজলিসে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের উপর ব্যভিচারের অপবাদ দিল। মূসা আলাইহিস সালাম মহিলাটিকে বললেন, আমি তোমাকে আল্লাহর শপথ দিয়ে বলছি, সত্য কথা বলো। তাঁর এ কথা মহিলাটির মনে রেখাপাত করল। সে ভয়ে কেঁপে উঠল। তারপর বলল, হে আল্লাহর নবী! আপনি যখন আল্লাহর নামে কসম করেছেন, তখন আমি সত্য প্রকাশ করে দিচ্ছি। কারূন এত পরিমাণ অর্থকড়ি দিয়ে আমাকে ভরা মজলিসে এ কথা বলতে বলেছে। তার কথামতোই আমি এটা বলেছি। প্রকৃতপক্ষে আপনি এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল। মূসা আলাইহিস সালাম তখন সিজদায় পড়ে গেলেন। তিনি আল্লাহর কাছে দু'আ করলেন, হে আল্লাহ! আমি যদি তোমার সত্যনবী হয়ে থাকি, তবে তুমি আমার জন্য এই লোকটির উপর আযাব নাযিল করো। আল্লাহ তা'আলা তাঁর দু'আ কবুল করলেন। তিনি ভূমিকে হুকুম করলেন, মূসা তোমাকে যে আদেশ করবে, সেই মতো কাজ করবে। সেমতে মূসা আলাইহিস সালাম ভূমিকে আদেশ করলেন, তুমি কারূনকে তার ঘরবাড়ি ও ধন-দৌলতসহ গ্রাস করে নাও। সঙ্গে সঙ্গে ভূমি আদেশ পালন করল। সকলের চোখের সামনে কারূন তার ধন-দৌলতসমেত ধসে যেতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে সে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেল। হাদীছে বলা হয়েছে, সে কিয়ামত পর্যন্ত ভূগর্ভে তলিয়ে যেতে থাকবে।
এই হল কারুনের পরিণতি। এ পরিণতি থেকে সে নিজেকে নিজেও রক্ষা করতে পারল না, তার ধন-সম্পদও কোনও কাজে আসল না, তার ভক্ত-অনুরক্ত ও সহচরেরাও তাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারল না। যাকে তার কর্মদোষে আল্লাহ তা'আলা এভাবে ধ্বংস করেন, তাকে কেউ রক্ষা করতে পারে না। ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার কারণে তার প্রচণ্ড অহমিকা ছিল। কিন্তু সে অহমিকা কোনও ফল দিল না। সে তার যাবতীয় অহমিকা নিয়ে ভূগর্ভে বিলীন হয়ে গেল।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. অহংকার ও সীমালঙ্ঘন কঠিন পাপ। এর থেকে মুক্ত হওয়া একান্ত জরুরি।
খ. অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্যে অহংকার করতে নেই।
গ. মানুষ যতই চেষ্টা ও মেহনত করুক না কেন, অর্থ-সম্পদের প্রকৃত দাতা আল্লাহ তা'আলাই। তাই এজন্য তাঁর শোকর আদায় করা উচিত।
ঘ. পার্থিব কোনও প্রাপ্তিতে উল্লাস করতে নেই। যা করতে হবে তা কেবলই শোকরগুযারী।
ঙ. আল্লাহপ্রদত্ত প্রকাশ্য-গুপ্ত যে-কোনও নি'আমত মৌলিকভাবে আখিরাতের সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে ব্যবহার করা চাই।
চ. বৈরাগ্য ইসলামঅনুমোদিত নয়। নিজের ও পারিবারিক প্রয়োজনে যতটুকু দরকার, ততটুকু অর্থ উপার্জন অবশ্যকর্তব্য।
ছ. আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমতের এক শোকর হল সৃষ্টির সেবা করা।
জ. পাপকর্মই যাবতীয় অশান্তির মূল। তাই অশান্তি বিস্তারের কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার লক্ষ্যেও পাপকর্ম থেকে বিরত থাকা জরুরি।
ঝ. সম্পদের মতো ইলমেরও গৌরব দেখাতে নেই।
ঞ. শক্তি ও ক্ষমতার বড়াই করা উচিত নয়। বহু শক্তিমানকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছেন।
ট. রাস্তাঘাটে দম্ভভরে চলতে নেই।
ঠ. অন্যের ঐশ্বর্য দেখে আক্ষেপ করা উচিত নয়।
ড. কারও ঐশ্বর্য থাকলেই সে ভাগ্যবান হয়ে যায় না এবং গরীব হওয়াটাও দুর্ভাগ্য নয়। যে ব্যক্তি আখিরাতে নাজাত পাবে, সেই প্রকৃত ভাগ্যবান।
ঢ. দুনিয়া ও আখিরাতের হাকীকত কেবল সেই বুঝতে পারে, যার দীনী ইলম আছে।
ণ. আখিরাতের পুরস্কার ঈমান ও আমলে সালিহার উপর নির্ভরশীল।
ত. সবর ও সংযম ছাড়া আখিরাতের প্রতিদান পাওয়া সম্ভব নয়।
থ. আল্লাহ কাউকে শাস্তি দিতে চাইলে ধনবল, জনবল, বাহুবল কোনওকিছু দ্বারাই তা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না।
দ. আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিকে কষ্ট দিতে নেই। তার পরিণাম হয় বড় ভয়ংকর।
অহংকারের পরিণাম ও অহংকার কাকে বলে
হাদীছ নং: ৬১১
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি বলল, কোনও ব্যক্তি পসন্দ করে তার পোশাক ভালো হোক ও তার জুতা ভালো হোক (এটাও কি অহংকার)? তিনি বললেন, আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন। অহংকার হল সত্য প্রত্যাখ্যান করা ও মানুষকে তাচ্ছিল্য করা। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ৯১; সুনানে আবূ দাউদ: ৪০৯১; জামে তিরমিযী: ১৯৯৯; সুনানে ইবন মাজাহ ৫৯; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার ৫৫৫৭; সহীহ ইবন হিব্বান ৫৪৬৬; মুসনাদে আহমাদ: ৩৯১৪; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ১০৫৩৩; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৫৭৮২)
হাদীছ নং: ৬১১
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি বলল, কোনও ব্যক্তি পসন্দ করে তার পোশাক ভালো হোক ও তার জুতা ভালো হোক (এটাও কি অহংকার)? তিনি বললেন, আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন। অহংকার হল সত্য প্রত্যাখ্যান করা ও মানুষকে তাচ্ছিল্য করা। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ৯১; সুনানে আবূ দাউদ: ৪০৯১; জামে তিরমিযী: ১৯৯৯; সুনানে ইবন মাজাহ ৫৯; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার ৫৫৫৭; সহীহ ইবন হিব্বান ৫৪৬৬; মুসনাদে আহমাদ: ৩৯১৪; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ১০৫৩৩; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৫৭৮২)
مقدمة الامام النووي
72 - باب تحريم الكبر والإعجاب
قَالَ الله تَعَالَى: {تِلْكَ الدَّارُ الآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لاَ يُرِيدُونَ عُلُوًا فِي الأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ} [القصص: 83]، وقال تعالى: {وَلا تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحا} [الإسراء: 37]، وقال تَعَالَى: {وَلاَ تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلاَ تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحًا إنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ} [لقمان: 18].
ومعنى «تُصَعِّر خَدَّكَ لِلنَّاسِ»: أيْ تُمِيلُهُ وتُعرِضُ بِهِ عَنِ النَّاسِ تَكَبُّرًا عَلَيْهِمْ. وَ «المَرَحُ»: التَّبَخْتُرُ. وقال تَعَالَى: {إنَّ قَارُونَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوسَى فَبَغَى عَلَيْهِمْ وَآتَيْنَاهُ مِنَ الكُنُوزِ مَا إنَّ مَفَاتِحَهُ لتَنُوءُ بِالعُصْبَةِ أُولِي القُوَّةِ إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لاَ تَفْرَحْ إنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الفَرِحِينَ} [القصص: 76]، إِلَى قَوْله تَعَالَى: {فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الأَرْضَ} الآيات.
قَالَ الله تَعَالَى: {تِلْكَ الدَّارُ الآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لاَ يُرِيدُونَ عُلُوًا فِي الأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ} [القصص: 83]، وقال تعالى: {وَلا تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحا} [الإسراء: 37]، وقال تَعَالَى: {وَلاَ تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلاَ تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحًا إنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ} [لقمان: 18].
ومعنى «تُصَعِّر خَدَّكَ لِلنَّاسِ»: أيْ تُمِيلُهُ وتُعرِضُ بِهِ عَنِ النَّاسِ تَكَبُّرًا عَلَيْهِمْ. وَ «المَرَحُ»: التَّبَخْتُرُ. وقال تَعَالَى: {إنَّ قَارُونَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوسَى فَبَغَى عَلَيْهِمْ وَآتَيْنَاهُ مِنَ الكُنُوزِ مَا إنَّ مَفَاتِحَهُ لتَنُوءُ بِالعُصْبَةِ أُولِي القُوَّةِ إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لاَ تَفْرَحْ إنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الفَرِحِينَ} [القصص: 76]، إِلَى قَوْله تَعَالَى: {فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الأَرْضَ} الآيات.
611 - وعن عبد الله بن مسعود - رضي الله عنه - عن النبي - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لاَ يَدْخُلُ الجَنَّةَ مَنْ كَانَ في قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّة مِنْ كِبْرٍ!» فَقَالَ رَجُلٌ: إنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا، ونَعْلُهُ حَسَنَةً؟ قَالَ: «إنَّ اللهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الجَمَالَ، الكِبْرُ: بَطَرُ الحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ». رواه مسلم. (1)
«بَطَرُ الحَقِّ»: دَفْعُهُ وَرَدُّهُ عَلَى قَائِلِهِ، وَ «غَمْطُ النَّاسِ»: احْتِقَارُهُمْ.
«بَطَرُ الحَقِّ»: دَفْعُهُ وَرَدُّهُ عَلَى قَائِلِهِ، وَ «غَمْطُ النَّاسِ»: احْتِقَارُهُمْ.
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬১২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭২ অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা
অহংকারের পরিণাম ও অহংকার কাকে বলে
হাদীছ নং: ৬১২
হযরত সালামা ইবনুল আকওয়া' রাযি. বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বসে বাম হাতে খেল। তিনি বললেন, ডান হাতে খাও। সে বলল, আমি পারি না। তিনি বললেন, তুমি যেন নাই পার। তাকে বাধা দিয়েছিল কেবলই তার অহংকার। হযরত সালামা রাযি. বলেন, সে তা আর তার মুখের দিকে তুলতে পারেনি। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২০২১; সুনানে আবূ দাউদ: ৩৭৬৮; সহীহ ইবন হিব্বান : ৬৫১৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১৪৬১১; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৪৪৪৫; সুনানে দারিমী: ২০৭৫)
হাদীছ নং: ৬১২
হযরত সালামা ইবনুল আকওয়া' রাযি. বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বসে বাম হাতে খেল। তিনি বললেন, ডান হাতে খাও। সে বলল, আমি পারি না। তিনি বললেন, তুমি যেন নাই পার। তাকে বাধা দিয়েছিল কেবলই তার অহংকার। হযরত সালামা রাযি. বলেন, সে তা আর তার মুখের দিকে তুলতে পারেনি। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২০২১; সুনানে আবূ দাউদ: ৩৭৬৮; সহীহ ইবন হিব্বান : ৬৫১৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১৪৬১১; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৪৪৪৫; সুনানে দারিমী: ২০৭৫)
مقدمة الامام النووي
72 - باب تحريم الكبر والإعجاب
612 - وعن سلمة بن الأكوع - رضي الله عنه: أنّ رَجُلًا أكَلَ عِنْدَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - بشمالِهِ، فَقَالَ: «كُلْ بيَمِينِكَ» قَالَ: لاَ أسْتَطِيعُ! قَالَ: «لاَ اسْتَطَعْتَ» مَا مَنَعَهُ إِلاَّ الكِبْرُ. قَالَ: فما رفَعها إِلَى فِيهِ. رواه مسلم. (1)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬১৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭২ অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা
অহংকারের পরিণাম ও অহংকার কাকে বলে
হাদীছ নং: ৬১৩
হযরত হারিছা ইবন ওয়াহব রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আমি কি তোমাদের অবহিত করব না কারা জাহান্নামী? তারা হচ্ছে প্রত্যেক রূঢ়, উদ্ধত, অহংকারী ব্যক্তি। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৪৯১৮; সহীহ মুসলিম: ২৮৫৩; জামে তিরমিযী: ২৬০৫; সুনানে ইবন মাজাহ : ৪১১৬; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৭৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৮৭২৮; বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা: ২০৮০৫; শুআবুল ঈমান: ৭৮২৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর ৩২৫৫)
হাদীছ নং: ৬১৩
হযরত হারিছা ইবন ওয়াহব রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আমি কি তোমাদের অবহিত করব না কারা জাহান্নামী? তারা হচ্ছে প্রত্যেক রূঢ়, উদ্ধত, অহংকারী ব্যক্তি। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৪৯১৮; সহীহ মুসলিম: ২৮৫৩; জামে তিরমিযী: ২৬০৫; সুনানে ইবন মাজাহ : ৪১১৬; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৭৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৮৭২৮; বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা: ২০৮০৫; শুআবুল ঈমান: ৭৮২৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর ৩২৫৫)
مقدمة الامام النووي
72 - باب تحريم الكبر والإعجاب
613 - وعن حارثة بن وهْبٍ - رضي الله عنه - قَالَ: سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «ألا أُخْبِرُكُمْ بأهْلِ النَّار: كلُّ عُتُلٍ جَوّاظٍ مُسْتَكْبرٍ». متفقٌ عَلَيْهِ، (1) وتقدم شرحه في بابِ ضعفةِ المسلمين.
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬১৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭২ অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা
অহংকারের পরিণাম ও অহংকার কাকে বলে
হাদীছ নং: ৬১৪
হযরত আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জান্নাত ও জাহান্নাম বিতর্কে লিপ্ত হল। জাহান্নাম বলল, উদ্ধত ও অহংকারীগণ আমার ভেতর। জান্নাত বলল, মানুষের মধ্যে যারা দুর্বল ও অসহায়, তারা আমার ভেতর। আল্লাহ উভয়ের মধ্যে ফয়সালা করলেন যে, তুমি জান্নাত, আমার রহমত। আমি যাকে চাইব, তোমার দ্বারা তার প্রতি রহমত করব। আর তুমি জাহান্নাম ও আমার আযাব। যাকে চাইব তোমার দ্বারা আযাব দেব। আর তোমাদের প্রত্যেককে পূর্ণ করা আমার দায়িত্ব। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম : ২৮৪৬; জামে তিরমিযী: ২৫৬১; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১১৪৫৮; মুসনাদে আহমাদ: ৭৭০৪; মুসনাদুল হুমায়দী: ১১৭১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৭৪৭৭)
হাদীছ নং: ৬১৪
হযরত আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জান্নাত ও জাহান্নাম বিতর্কে লিপ্ত হল। জাহান্নাম বলল, উদ্ধত ও অহংকারীগণ আমার ভেতর। জান্নাত বলল, মানুষের মধ্যে যারা দুর্বল ও অসহায়, তারা আমার ভেতর। আল্লাহ উভয়ের মধ্যে ফয়সালা করলেন যে, তুমি জান্নাত, আমার রহমত। আমি যাকে চাইব, তোমার দ্বারা তার প্রতি রহমত করব। আর তুমি জাহান্নাম ও আমার আযাব। যাকে চাইব তোমার দ্বারা আযাব দেব। আর তোমাদের প্রত্যেককে পূর্ণ করা আমার দায়িত্ব। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম : ২৮৪৬; জামে তিরমিযী: ২৫৬১; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১১৪৫৮; মুসনাদে আহমাদ: ৭৭০৪; মুসনাদুল হুমায়দী: ১১৭১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৭৪৭৭)
مقدمة الامام النووي
72 - باب تحريم الكبر والإعجاب
614 - وعن أَبي سعيد الخدري - رضي الله عنه - عن النبي - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «احْتَجّتِ الجَنَّةُ وَالنَّارُ، فَقَالَت النَّارُ: فيَّ الْجَبَّارُونَ والمُتَكَبِّرُونَ. وقالتِ الجَنَّةُ: فيَّ ضُعفاءُ الناس ومساكينُهُم، [ص:204] فقضى اللهُ بَينهُما: إنكِ الجنّةُ رَحْمَتِي أرْحَمُ بِك مَنْ أشَاءُ، وَإنَّكِ النَّارُ عَذَابِي أُعَذِّبُ بِكِ مَنْ أشَاءُ، وَلِكِلَيْكُمَا عَلَيَّ مِلْؤُهَا». رواه مسلم. (1)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬১৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭২ অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা
টাখনুর নিচে পোশাক পরার নিষেধাজ্ঞা
হাদীছ নং: ৬১৫
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন ওই ব্যক্তির দিকে তাকাবেন না, যে অহংকারবশে তার লুঙ্গি হেঁচড়ায়। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৫৭৮৮; সহীহ মুসলিম: ২০৮৭; সুনানে আবূ দাউদ: ৪০৯৩; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৫৭৭; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ৯৬৩১; মুআত্তা মালিক: ৩৩৯০; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী: ২৬০৯; মুসনাদুল হুমায়দী: ৬৫১; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ২৪৮০৯)
হাদীছ নং: ৬১৫
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন ওই ব্যক্তির দিকে তাকাবেন না, যে অহংকারবশে তার লুঙ্গি হেঁচড়ায়। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৫৭৮৮; সহীহ মুসলিম: ২০৮৭; সুনানে আবূ দাউদ: ৪০৯৩; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৫৭৭; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ৯৬৩১; মুআত্তা মালিক: ৩৩৯০; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী: ২৬০৯; মুসনাদুল হুমায়দী: ৬৫১; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ২৪৮০৯)
مقدمة الامام النووي
72 - باب تحريم الكبر والإعجاب
615 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لاَ يَنْظُرُ اللهُ يَوْمَ القِيَامَةِ إِلَى مَنْ جَرَّ إزَارَهُ بَطَرًا». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬১৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭২ অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা
তিন ব্যক্তির জন্য কঠোর সতর্কবাণী
হাদীছ নং: ৬১৬
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না এবং তাদের দিকে তাকাবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাময় শাস্তি: বৃদ্ধ ব্যভিচারী, মিথ্যুক বাদশা ও অহংকারী গরীব। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ১০৭; মুসনাদুল বাযযার: ৪০২৩; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৪৮৯; বায়হাকী, আল-আসমা ওয়াস-সিফাত: ৪৭৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৯১)
হাদীছ নং: ৬১৬
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না এবং তাদের দিকে তাকাবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাময় শাস্তি: বৃদ্ধ ব্যভিচারী, মিথ্যুক বাদশা ও অহংকারী গরীব। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ১০৭; মুসনাদুল বাযযার: ৪০২৩; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৪৮৯; বায়হাকী, আল-আসমা ওয়াস-সিফাত: ৪৭৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৯১)
مقدمة الامام النووي
72 - باب تحريم الكبر والإعجاب
616 - وعنه، قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «ثَلاَثَةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ القِيَامَة، وَلاَ يُزَكِّيهِمْ، وَلاَ يَنْظُرُ إلَيْهِمْ، وَلَهُمْ عَذَابٌ ألِيمٌ: شَيْخٌ زَانٍ، وَمَلِكٌ كَذَّابٌ، وَعَائِلٌ مُسْتَكْبِرٌ». رواه مسلم. (1)
«العَائِلُ»: الفَقِيرُ.
«العَائِلُ»: الفَقِيرُ.
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬১৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭২ অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা
দর্প ও অহংকারকারীর অনিবার্য পরিণাম
হাদীছ নং: ৬১৭
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা বলেন, মহিমা আমার লুঙ্গি এবং অহংকার আমার চাদর। যে ব্যক্তি এ দু'টির কোনও একটি নিয়ে আমার সঙ্গে টানাটানি করবে, আমি তাকে অবশ্যই শাস্তি দেব। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৬২০; সুনানে আবূ দাউদ: ৪০৯০; মুসনাদে আহমাদ: ৭৩৮২; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩২৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৭৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩৩১)
হাদীছ নং: ৬১৭
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা বলেন, মহিমা আমার লুঙ্গি এবং অহংকার আমার চাদর। যে ব্যক্তি এ দু'টির কোনও একটি নিয়ে আমার সঙ্গে টানাটানি করবে, আমি তাকে অবশ্যই শাস্তি দেব। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৬২০; সুনানে আবূ দাউদ: ৪০৯০; মুসনাদে আহমাদ: ৭৩৮২; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩২৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৭৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩৩১)
مقدمة الامام النووي
72 - باب تحريم الكبر والإعجاب
617 - وعنه، قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «قَالَ الله - عز وجل: العِزُّ إزَاري، والكبرياءُ رِدائي، فَمَنْ يُنَازِعُنِي في وَاحِدٍ منهما فَقَد عَذَّبْتُهُ». رواه مسلم. (1)
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬১৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭২ অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা
দামি পোশাক পরে দর্প দেখানোর পরিণাম
হাদীছ নং: ৬১৮
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, এক ব্যক্তি একজোড়া কাপড়ে নিজের প্রতি মুগ্ধ হয়ে চলছিল। তার মাথা ছিল আঁচড়ানো। চলনে প্রদর্শন করছিল অহংকার। হঠাৎ আল্লাহ তাকে মাটিতে ধসিয়ে দেন। কিয়ামত পর্যন্ত সে মাটির ভেতর দেবে যেতে থাকবে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৩৪৮৫; সহীহ মুসলিম: ২০৮৮; জামে' তিরমিযী: ২৪৯১; সুনানে নাসাঈ : ৫৩২৬; মুসনাদে আহমাদ: ৫৩৩৯; সুনানে দারিমী: ৪৫১; মুসনাদুল বাযযার: ১২৯০; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৬৩৩৪; সহীহ ইবন হিব্বান ৫৬৮৪; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৯১৭৬)
হাদীছ নং: ৬১৮
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, এক ব্যক্তি একজোড়া কাপড়ে নিজের প্রতি মুগ্ধ হয়ে চলছিল। তার মাথা ছিল আঁচড়ানো। চলনে প্রদর্শন করছিল অহংকার। হঠাৎ আল্লাহ তাকে মাটিতে ধসিয়ে দেন। কিয়ামত পর্যন্ত সে মাটির ভেতর দেবে যেতে থাকবে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৩৪৮৫; সহীহ মুসলিম: ২০৮৮; জামে' তিরমিযী: ২৪৯১; সুনানে নাসাঈ : ৫৩২৬; মুসনাদে আহমাদ: ৫৩৩৯; সুনানে দারিমী: ৪৫১; মুসনাদুল বাযযার: ১২৯০; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৬৩৩৪; সহীহ ইবন হিব্বান ৫৬৮৪; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৯১৭৬)
مقدمة الامام النووي
72 - باب تحريم الكبر والإعجاب
618 - وعنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «بَيْنَمَا رَجُلٌ يَمشِي في حُلَّةٍ تُعْجِبُهُ نَفْسُهُ، مُرَجِّلٌ رَأسَهُ، يَخْتَالُ فِي مَشْيَتهِ، إِذْ خَسَفَ اللهُ بِهِ، فَهُوَ يَتَجَلْجَلُ في الأَرضِ إِلَى يَوْمِ القِيَامَةِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
«مُرَجِّلٌ رَأسَهُ»: أيْ مُمَشِّطُهُ، «يَتَجَلْجَلُ» بالجيمين: أيْ يَغُوصُ وَيَنْزِلُ.
«مُرَجِّلٌ رَأسَهُ»: أيْ مُمَشِّطُهُ، «يَتَجَلْجَلُ» بالجيمين: أيْ يَغُوصُ وَيَنْزِلُ.
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬১৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৭২ অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা
একাধারে অহংকার দেখাতে থাকার কুফল
হাদীছ নং: ৬১৯
হযরত সালামা ইবনুল আকওয়া‘ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, লোকে আত্মগৌরব দেখাতে থাকে। পরিশেষে গৌরবকারীদের মধ্যে তার নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলে তাদের যে পরিণাম ভোগ করতে হয়, এরূপ লোকেরও সেই পরিণামই ভোগ করতে হয়। -তিরমিযী
(জামে' তিরমিযী: ২০০০; শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৮৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৬২৫৪)
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি একটি হাসান হাদীছ।
হাদীছ নং: ৬১৯
হযরত সালামা ইবনুল আকওয়া‘ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, লোকে আত্মগৌরব দেখাতে থাকে। পরিশেষে গৌরবকারীদের মধ্যে তার নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলে তাদের যে পরিণাম ভোগ করতে হয়, এরূপ লোকেরও সেই পরিণামই ভোগ করতে হয়। -তিরমিযী
(জামে' তিরমিযী: ২০০০; শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৮৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৬২৫৪)
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি একটি হাসান হাদীছ।
مقدمة الامام النووي
72 - باب تحريم الكبر والإعجاب
619 - وعن سَلَمةَ بنِ الأكْوَعِ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «لاَ يَزَالُ الرَّجُلُ يَذْهَبُ بِنَفْسِهِ حَتَّى يُكْتَبَ في الجبَّارِين، فَيُصيبَهُ مَا أصَابَهُمْ». رواه الترمذي، (1) وقال: «حديث حسن».
«يَذْهَبُ بِنَفْسِهِ» أيْ: يَرْتَفِعُ وَيَتَكبَّرُ.
«يَذْهَبُ بِنَفْسِهِ» أيْ: يَرْتَفِعُ وَيَتَكبَّرُ.
তাহকীক:
হাদীস নং: ৬২০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ উত্তম চরিত্র
উত্তম চরিত্র মানবমনের এমন এক অবস্থা ও ক্ষমতাকে বলে, যার উপর ভিত্তি করে সহজেই ভালো ভালো কাজ করা সম্ভব হয়। ইসলাম মানবমনের এ ক্ষমতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মানুষ যেন এ ক্ষমতার পরিচর্যা করে এবং এর বিকাশ ঘটানোর সাধনা করে, সেজন্য তাকে নানাভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর বিকাশ ঘটানো অতীব জরুরি। কেননা মানুষ সামাজিক জীব। একজন মানুষকে অপরাপর মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করতে হয়। সে ভালো চরিত্রের হলে অন্যের সঙ্গে সহাবস্থান সহজ হয়, শান্তিপূর্ণ হয়। অন্যথায় পরস্পরে কলহ-বিবাদ দেখা দেয় এবং সমাজজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। যখন যেখানে চারিত্রিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, সেখানেই মানুষের শান্তি নষ্ট হয়েছে।
জাহিলিয়াতের যুগ ছিল চারিত্রিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপ। সে অবক্ষয়ের শিকার হয়ে পড়েছিল সারা পৃথিবী। ফলে মানুষ পেশিশক্তির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিল। দুর্বলেরা শক্তিমানদের গ্রাসে পরিণত হয়েছিল। শক্তির মদমত্ততা মানুষের মননশক্তির বিকাশ থামিয়ে দিয়েছিল। ভালো কিছু ভাবা ও ভালো কিছু করার কথা যেন মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। সে এক ভয়াবহ অন্ধকার। তা থেকে উদ্ধারের জন্য দরকার ছিল উত্তম চরিত্রের বিকাশসাধন এবং এর সর্বাত্মক চর্চা। এ লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উত্তম চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম নমুনা করে পাঠান। তিনি এসে ঘোষণা দিলেন-
بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ حُسْنَ الْأَخْلَاقِ
‘আমাকে পাঠানো হয়েছে উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য।(মুআত্তা মালিক ৩৩৫৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা ৩১৭৭৩; আল আদাবুল মুফরাদ : ২৭৩; মুসনাদুল বাযযার ৮৯৪৯; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৪৪৩২; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ১; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৪২২১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০৭৮২)
সুতরাং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় অনুসারী ও সাহাবীদেরকে এক এক করে উত্তম চরিত্র শিক্ষা দিতে শুরু করলেন। সত্য কথা বলা, অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা, দুর্বল, দুস্থ ও অসহায়ের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো, উদারপ্রাণ হওয়া, অতিথিপরায়ণতা, জীবে দয়া, হাসিমুখে কথা বলা, বিনয় প্রদর্শন, কোমল আচরণ প্রভৃতি গুণাবলির চর্চায় তিনি তাঁদের দিয়ে এক আদর্শ সমাজ গড়ে তুললেন। ইসলামী জীবনের আগে তাঁরা কোথায় ছিলেন, তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর্যায়ক্রমিক শিক্ষার বদৌলতে তাঁরা কোথায় পৌঁছে গেলেন! হাদীছের কিতাবসমূহ ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনীগ্রন্থসমূহ পড়লে আমরা তাঁদের সে উদ্ভাসিত জীবনের সন্ধান পাই ভালোভাবেই।
তাঁরা শিখেছিলেন নিজের কাছে অন্যের যা অধিকার তা অবশ্যই আদায় করতে হয়। অন্যের কাছে নিজের যা প্রাপ্য, তার দাবি-দাওয়া তুলতে নেই। কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যেতে হবে। নিজে অসুস্থ হলে কেউ যদি নাও আসে, আপত্তি করতে নেই। মানুষকে সালাম দেবে। কেউ সালাম দিলে তার জবাবও দেবে। তোমার সালামের জবাব কেউ না দিলে দুঃখ করবে না। তোমাকে কেউ সম্মান না করলে আফসোস করবে না। কিন্তু তুমি অবশ্যই অন্যকে সম্মান করবে। তোমার সুপারিশ কেউ গ্রহণ না করলে নাই করুক, তোমার কাছে কেউ সুপারিশ করলে তুমি তার মর্যাদা দেবে। তুমি অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তোমার কথা কেউ অগ্রাহ্য করলে মনে কষ্ট নেবে না। তোমার বিবাহের প্রস্তাব কেউ ফিরিয়ে দিলে তা দিক না। আফসোস করো না। তোমার কাছে কেউ প্রস্তাব নিয়ে আসলে তার অমর্যাদা করো না।কেউ তোমাকে কষ্ট দিলে ক্ষমা করো। তুমি কিন্তু কাউকে কষ্ট দিয়ো না। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন-
لا تَكونوا إمَّعةً، تقولونَ: إن أحسنَ النَّاسُ أحسنَّا، وإن ظلموا ظلَمنا، ولَكن وطِّنوا أنفسَكم، إن أحسنَ النَّاسُ أن تُحسِنوا، وإن أساءوا فلا تظلِموا
‘তোমরা যে যেমন তার সঙ্গে তেমন হবে না যে, এ কথা বলবে- লোকে আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে আমরাও ভালো ব্যবহার করব আর যদি তারা জুলুম করে, আমরাও জুলুম করব। বরং তোমরা নিজেদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখো এ নীতির উপর যে, লোকে ভালো ব্যবহার করলে তো অবশ্যই ভালো ব্যবহার করবে, আর যদি তারা মন্দ ব্যবহার করে, তোমরা কিন্তু জুলুম করবে না।(জামে' তিরমিযী: ২০০৭; মুসনাদুল বাযযার: ২৮০২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৪৪৪)
উন্নত আখলাক-চরিত্রের বীজ প্রত্যেকের মনেই জন্মগতভাবে বোনা রয়েছে। কারও অন্তরে বেশি, কারও অন্তরে কম। সে বীজ অঙ্কুরিত করে তোলা, তারপর তাকে ডালপালা ও ফলে-ফুলে ভরিয়ে তোলার ক্ষমতাও সকলের ভেতরই আছে। হয়তো কারও কম, কারও বেশি। অন্তরভূমি জগৎভূমির মতোই। কোনওটা বেশি উর্বর, কোনওটা কম। ভালো যত্ন নিলে অনুর্বর ভূমিতেও ফসল ফলানো যায়। আর যত্ন না নিলে উর্বর ভূমিও নিষ্ফলা হয়ে থাকে। যত্নটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই যত্ন নেওয়ার তাগিদ ও শিক্ষা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। প্রত্যেকেরই দরকার নিজ আখলাক-চরিত্রকে উন্নত ও বিকশিত করে তোলার জন্য সর্বোচ্চ সাধনা করা। কেননা প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সুন্দর ও ভালো কাজে লাগানোর বিষয়টি এরই উপর নির্ভর করে। যার আখলাক-চরিত্র যত ভালো, তার দ্বারা ততো বেশি সৎকর্ম সম্পন্ন হয়ে থাকে। দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি সৎকর্মের উপর নির্ভরশীল, উত্তম আখলাক-চরিত্র ছাড়া যা সম্ভব নয়। মানুষ যাতে তার উত্তম আখলাক নির্মাণে সচেষ্ট হয়, সেজন্য কুরআন মাজীদে এর ভরপুর শিক্ষা পেশ করা হয়েছে এবং তা গ্রহণে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছও আছে প্রচুর। বর্তমান অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি।
‘উত্তম চরিত্র’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ (4)
অর্থ: এবং নিশ্চয়ই তুমি অধিষ্ঠিত আছ মহান চরিত্রে।(সূরা কলাম (৬৮), আয়াত ৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতটিতে অতি সংক্ষেপে অথচ পূর্ণাঙ্গভাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এতে জানানো হয়েছে যে, তিনি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত ছিলেন। অর্থাৎ মহান চরিত্র যেন একটি আসন, যার উপর তিনি পূর্ণ কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের সঙ্গে অধিষ্ঠিত। কিংবা মহান চরিত্র যেন এমন এক বাহন, যার উপর তিনি চেপে বসা ছিলেন এবং আপন ইচ্ছামতো তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। বোঝানো উদ্দেশ্য- উত্তম চরিত্র কখনও তাঁর হাতছাড়া হতে পারত না। কখনও তিনি সুমহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতেন না। আনন্দ-বিষাদ, রাগ-বিরাগ, প্রকাশ্য-গুপ্ত সর্বাবস্থায় তাঁর উন্নত চরিত্র অটুট থাকত। কোনওরকম ভাবাবেগে তিনি তাঁর মহান চরিত্র থেকে একটুও বিচ্যুত হতেন না। তাঁর গোটা জীবন এ কথার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে।
বস্তুত কুরআন যে চারিত্রিক শিক্ষা দেয়, তাই মহান চরিত্র। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র কুরআন মাজীদ থেকেই নেওয়া। কুরআন মাজীদে যা-কিছু উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই পরিপূর্ণ মাত্রায় তাঁর মধ্যে বিরাজ করত। সততা ও সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, সাহসিকতা, দানশীলতা, দয়া ও সহমর্মিতা, শালীনতা ও লজ্জাশীলতা, আল্লাহনির্ভরতা, ক্ষমাশীলতা, বিনয়, পরার্থপরতা, উদারতা, ন্যায়নিষ্ঠা, গুণগ্রাহিতা, ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রভৃতি সদগুণের এমন কোনটি আছে, যা পরিপূর্ণরূপে তাঁর মধ্যে বিরাজমান ছিল না? আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রতি ওহী নাযিল করেছিলেন এবং তাঁর জীবনকে ওহীর শিক্ষার বাস্তব নমুনা বানিয়েছিলেন। সুতরাং সত্যকথা হচ্ছে কুরআন মাজীদ যে চরিত্রের শিক্ষাদান করে, তিনি ছিলেন তার জীবন্ত রূপ। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে তাঁর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন-
كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ
‘কুরআনই ছিল তাঁর চরিত্র।(মুসনাদে আহমাদ: ২৪৬০১; আল আদাবুল মুফরাদ: ৩০৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৪৪৩৪; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৭২; শু'আবুল ঈমান: ১৩৫৯; শারহুস সুন্নাহ: ৩৪৯৪)
হযরত আলী রাযি. বলেন, خُلُقٍ عَظِيمٍ হল কুরআনের শিক্ষামালা। জুনায়েদ বাগদাদী রহ. বলেন, তাঁর চরিত্রকে মহান চরিত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে এ কারণে যে, আল্লাহ তা'আলা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে তাঁর কোনও চিন্তা-ভাবনা ছিল না। তিনি তাঁর মহান চরিত্র দিয়ে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, কিন্তু তাঁর অন্তর ছিল তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁর প্রকাশ্য দিক ছিল মাখলুকের সঙ্গে, কিন্তু অন্তর্জগৎ ছিল স্রষ্টার সঙ্গে।
আয়াতটির শিক্ষা
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত হিসেবে নিজেদের জীবনে তাঁর মহান চরিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
দুই নং আয়াত
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (134)
অর্থ: এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৩৪)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা আলে-ইমরানের ১৩৪ নং আয়াতের শেষ অংশ। এর আগের আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, জান্নাত মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এ আয়াতে মুত্তাকীদের কয়েকটি গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হল রাগ হজম করা। এখানে বলা হয়েছে-
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ (এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে অভ্যস্ত)। অর্থাৎ রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। যার উপর রাগ ওঠে, তার উপর রাগের আচরণ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা করা হতে নিজেকে বিরত রাখে। এটি একটি মহৎ গুণ। এর অনেক ফযীলত। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَمَنْ كَظَمَ غَيْظَهُ ، وَلَوْ شَاءَ أَنْ يُمْضِيَهُ أَمْضَاهُ ، مَلَأَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ قَلْبَهُ أَمْنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘যে ব্যক্তি রাগ সংবরণ করে, অথচ সে চাইলে তা কার্যকর করতে পারত, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তার অন্তর নিরাপত্তায় ভরে দেবেন।(তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৬০২৬; আল-মুজালাসা ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম: ৩৫৪৩)
অপর এক হাদীছে ইরশাদ-
وَمَنْ كَفَّ غَضَبَهُ كَفَّ اللَّهُ عَنْهُ عَذَابَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘যে ব্যক্তি নিজ ক্রোধ সংবরণ করে, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তার থেকে আযাব দূর করে দেবেন।(শু'আবুল ঈমান: ৭৯৫৮; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৪৩৩৮; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ৩২১)
এ বাক্যে বর্ণিত মুত্তাকীদের দ্বিতীয় গুণ হল ক্ষমতাশীলতা। বলা হয়েছে- وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ (এবং মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত)। অর্থাৎ কেউ বেয়াদবি করলে, আর্থিক ক্ষতি করলে, শারীরিকভাবে কষ্ট দিলে, মানসিক আঘাত করলে, এককথায় অপ্রীতিকর যে আচরণই করুক, মুত্তাকী ব্যক্তি তাকে ক্ষমা করে দেয়। ক্ষমাশীলতা ইসলামের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক শিক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ক্ষমাশীল ছিলেন। তায়েফের দুরাচারদের ক্ষমা করে দেওয়া, এমনিভাবে মক্কাবিজয়ের পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা তাঁর ক্ষমাশীল চরিত্রের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে ক্ষমাশীল হতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ-
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)
‘তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করো এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।’(সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯)
কেউ ভুল করার পর যদি ক্ষমা চায়, তবে তাকে ক্ষমা করা অবশ্যকর্তব্য। ক্ষমা না করা গুনাহ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنِ اعْتَذَرَ إِلَى أَخِيهِ فَلَمْ يَعْذُرْهُ أَوْ يَقْبَلْ عُذْرَهُ كَانَ عَلَيْهِ مِثْلُ خَطِيئَةِ صَاحِبِ مَكْسٍ
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চায়, কিন্তু সে তাকে ক্ষমা না করে বা তার ওজর কবুল না করে, তার গুনাহ হয় (জালেম) কর উসূলকারীর মতো।(সুনানে ইবন মাজাহ ৩৭১৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান ৭৯৮৫; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৮৬৪৪; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ৬৪৯
قال البوصيري في الزوائد : رجاله ثقات إلا أنه مرسل)
আয়াতটিতে সবশেষে বলা হয়েছে- وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন)। অর্থাৎ উল্লিখিত গুণাবলি যাদের মধ্যে আছে, তারা পুণ্যবান। আর আল্লাহ তা'আলা এরূপ পুণ্যবানদের ভালোবাসেন। এর আরেক অর্থ হতে পারে- আল্লাহ তা'আলা অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন। مُحْسِنٌ শব্দটির উৎপত্তি إِحْسَانٌ থেকে।
ইহসান অর্থ দয়া ও অনুগ্রহ করা। এটা ন্যায় ও ইনসাফের পরবর্তী ধাপ। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ ও দয়া করার হুকুম দেন।( সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯০)
ইনসাফ হল যে যেমন ব্যবহার করে, তার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা। আর ইহসান হল অন্যকে তার ন্যায্য অধিকারের চেয়ে আরও বেশি দেওয়া কিংবা যে ব্যক্তি মন্দ আচরণ করে, তার সঙ্গে ভালো আচরণ করা। যেমন কুরআন মাজীদে আদেশ করা হয়েছে-
ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ
‘তুমি মন্দকে প্রতিহত করবে এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট।(সূরা মুমিনূন (২৩), আয়াত ৯৬)
এর দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় হযরত যায়নুল আবিদীন রহ.-এর একটি ঘটনা দ্বারা। তার এক গোলামের আচরণে তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। এতে তার রাগ হল। গোলাম বলে وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ (যারা নিজের ক্রোধ হজম করে)। তিনি রাগ হজম করলেন। গোলাম বলল- وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ (এবং যারা মানুষকে ক্ষমা করে)। তিনি বললেন, তোমাকে ক্ষমা করলাম। শেষে গোলাম বলল- وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন)। তিনি বললেন, যাও তোমাকে আযাদ করে দিলাম।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. রাগ হজম করা একটি মহৎ গুণ। এ গুণ আমাদের অর্জন করতে হবে।
খ. ক্ষমাশীলতা আল্লাহ তা'আলার পসন্দ। প্রত্যেক মুমিনের এ গুণ অর্জনের চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য।
গ. ইহসান ও অনুগ্রহের আচরণ চরিত্রের উচ্চতর স্থান। এ স্তরে পৌঁছার দ্বারা আল্লাহর ভালোবাসা লাভ হয়।
উত্তম চরিত্র মানবমনের এমন এক অবস্থা ও ক্ষমতাকে বলে, যার উপর ভিত্তি করে সহজেই ভালো ভালো কাজ করা সম্ভব হয়। ইসলাম মানবমনের এ ক্ষমতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মানুষ যেন এ ক্ষমতার পরিচর্যা করে এবং এর বিকাশ ঘটানোর সাধনা করে, সেজন্য তাকে নানাভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর বিকাশ ঘটানো অতীব জরুরি। কেননা মানুষ সামাজিক জীব। একজন মানুষকে অপরাপর মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করতে হয়। সে ভালো চরিত্রের হলে অন্যের সঙ্গে সহাবস্থান সহজ হয়, শান্তিপূর্ণ হয়। অন্যথায় পরস্পরে কলহ-বিবাদ দেখা দেয় এবং সমাজজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। যখন যেখানে চারিত্রিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, সেখানেই মানুষের শান্তি নষ্ট হয়েছে।
জাহিলিয়াতের যুগ ছিল চারিত্রিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপ। সে অবক্ষয়ের শিকার হয়ে পড়েছিল সারা পৃথিবী। ফলে মানুষ পেশিশক্তির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিল। দুর্বলেরা শক্তিমানদের গ্রাসে পরিণত হয়েছিল। শক্তির মদমত্ততা মানুষের মননশক্তির বিকাশ থামিয়ে দিয়েছিল। ভালো কিছু ভাবা ও ভালো কিছু করার কথা যেন মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। সে এক ভয়াবহ অন্ধকার। তা থেকে উদ্ধারের জন্য দরকার ছিল উত্তম চরিত্রের বিকাশসাধন এবং এর সর্বাত্মক চর্চা। এ লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উত্তম চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম নমুনা করে পাঠান। তিনি এসে ঘোষণা দিলেন-
بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ حُسْنَ الْأَخْلَاقِ
‘আমাকে পাঠানো হয়েছে উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য।(মুআত্তা মালিক ৩৩৫৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা ৩১৭৭৩; আল আদাবুল মুফরাদ : ২৭৩; মুসনাদুল বাযযার ৮৯৪৯; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৪৪৩২; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ১; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৪২২১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০৭৮২)
সুতরাং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় অনুসারী ও সাহাবীদেরকে এক এক করে উত্তম চরিত্র শিক্ষা দিতে শুরু করলেন। সত্য কথা বলা, অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা, দুর্বল, দুস্থ ও অসহায়ের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো, উদারপ্রাণ হওয়া, অতিথিপরায়ণতা, জীবে দয়া, হাসিমুখে কথা বলা, বিনয় প্রদর্শন, কোমল আচরণ প্রভৃতি গুণাবলির চর্চায় তিনি তাঁদের দিয়ে এক আদর্শ সমাজ গড়ে তুললেন। ইসলামী জীবনের আগে তাঁরা কোথায় ছিলেন, তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর্যায়ক্রমিক শিক্ষার বদৌলতে তাঁরা কোথায় পৌঁছে গেলেন! হাদীছের কিতাবসমূহ ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনীগ্রন্থসমূহ পড়লে আমরা তাঁদের সে উদ্ভাসিত জীবনের সন্ধান পাই ভালোভাবেই।
তাঁরা শিখেছিলেন নিজের কাছে অন্যের যা অধিকার তা অবশ্যই আদায় করতে হয়। অন্যের কাছে নিজের যা প্রাপ্য, তার দাবি-দাওয়া তুলতে নেই। কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যেতে হবে। নিজে অসুস্থ হলে কেউ যদি নাও আসে, আপত্তি করতে নেই। মানুষকে সালাম দেবে। কেউ সালাম দিলে তার জবাবও দেবে। তোমার সালামের জবাব কেউ না দিলে দুঃখ করবে না। তোমাকে কেউ সম্মান না করলে আফসোস করবে না। কিন্তু তুমি অবশ্যই অন্যকে সম্মান করবে। তোমার সুপারিশ কেউ গ্রহণ না করলে নাই করুক, তোমার কাছে কেউ সুপারিশ করলে তুমি তার মর্যাদা দেবে। তুমি অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তোমার কথা কেউ অগ্রাহ্য করলে মনে কষ্ট নেবে না। তোমার বিবাহের প্রস্তাব কেউ ফিরিয়ে দিলে তা দিক না। আফসোস করো না। তোমার কাছে কেউ প্রস্তাব নিয়ে আসলে তার অমর্যাদা করো না।কেউ তোমাকে কষ্ট দিলে ক্ষমা করো। তুমি কিন্তু কাউকে কষ্ট দিয়ো না। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন-
لا تَكونوا إمَّعةً، تقولونَ: إن أحسنَ النَّاسُ أحسنَّا، وإن ظلموا ظلَمنا، ولَكن وطِّنوا أنفسَكم، إن أحسنَ النَّاسُ أن تُحسِنوا، وإن أساءوا فلا تظلِموا
‘তোমরা যে যেমন তার সঙ্গে তেমন হবে না যে, এ কথা বলবে- লোকে আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে আমরাও ভালো ব্যবহার করব আর যদি তারা জুলুম করে, আমরাও জুলুম করব। বরং তোমরা নিজেদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখো এ নীতির উপর যে, লোকে ভালো ব্যবহার করলে তো অবশ্যই ভালো ব্যবহার করবে, আর যদি তারা মন্দ ব্যবহার করে, তোমরা কিন্তু জুলুম করবে না।(জামে' তিরমিযী: ২০০৭; মুসনাদুল বাযযার: ২৮০২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৪৪৪)
উন্নত আখলাক-চরিত্রের বীজ প্রত্যেকের মনেই জন্মগতভাবে বোনা রয়েছে। কারও অন্তরে বেশি, কারও অন্তরে কম। সে বীজ অঙ্কুরিত করে তোলা, তারপর তাকে ডালপালা ও ফলে-ফুলে ভরিয়ে তোলার ক্ষমতাও সকলের ভেতরই আছে। হয়তো কারও কম, কারও বেশি। অন্তরভূমি জগৎভূমির মতোই। কোনওটা বেশি উর্বর, কোনওটা কম। ভালো যত্ন নিলে অনুর্বর ভূমিতেও ফসল ফলানো যায়। আর যত্ন না নিলে উর্বর ভূমিও নিষ্ফলা হয়ে থাকে। যত্নটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই যত্ন নেওয়ার তাগিদ ও শিক্ষা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। প্রত্যেকেরই দরকার নিজ আখলাক-চরিত্রকে উন্নত ও বিকশিত করে তোলার জন্য সর্বোচ্চ সাধনা করা। কেননা প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সুন্দর ও ভালো কাজে লাগানোর বিষয়টি এরই উপর নির্ভর করে। যার আখলাক-চরিত্র যত ভালো, তার দ্বারা ততো বেশি সৎকর্ম সম্পন্ন হয়ে থাকে। দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি সৎকর্মের উপর নির্ভরশীল, উত্তম আখলাক-চরিত্র ছাড়া যা সম্ভব নয়। মানুষ যাতে তার উত্তম আখলাক নির্মাণে সচেষ্ট হয়, সেজন্য কুরআন মাজীদে এর ভরপুর শিক্ষা পেশ করা হয়েছে এবং তা গ্রহণে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছও আছে প্রচুর। বর্তমান অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি।
‘উত্তম চরিত্র’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ (4)
অর্থ: এবং নিশ্চয়ই তুমি অধিষ্ঠিত আছ মহান চরিত্রে।(সূরা কলাম (৬৮), আয়াত ৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতটিতে অতি সংক্ষেপে অথচ পূর্ণাঙ্গভাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এতে জানানো হয়েছে যে, তিনি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত ছিলেন। অর্থাৎ মহান চরিত্র যেন একটি আসন, যার উপর তিনি পূর্ণ কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের সঙ্গে অধিষ্ঠিত। কিংবা মহান চরিত্র যেন এমন এক বাহন, যার উপর তিনি চেপে বসা ছিলেন এবং আপন ইচ্ছামতো তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। বোঝানো উদ্দেশ্য- উত্তম চরিত্র কখনও তাঁর হাতছাড়া হতে পারত না। কখনও তিনি সুমহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতেন না। আনন্দ-বিষাদ, রাগ-বিরাগ, প্রকাশ্য-গুপ্ত সর্বাবস্থায় তাঁর উন্নত চরিত্র অটুট থাকত। কোনওরকম ভাবাবেগে তিনি তাঁর মহান চরিত্র থেকে একটুও বিচ্যুত হতেন না। তাঁর গোটা জীবন এ কথার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে।
বস্তুত কুরআন যে চারিত্রিক শিক্ষা দেয়, তাই মহান চরিত্র। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র কুরআন মাজীদ থেকেই নেওয়া। কুরআন মাজীদে যা-কিছু উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই পরিপূর্ণ মাত্রায় তাঁর মধ্যে বিরাজ করত। সততা ও সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, সাহসিকতা, দানশীলতা, দয়া ও সহমর্মিতা, শালীনতা ও লজ্জাশীলতা, আল্লাহনির্ভরতা, ক্ষমাশীলতা, বিনয়, পরার্থপরতা, উদারতা, ন্যায়নিষ্ঠা, গুণগ্রাহিতা, ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রভৃতি সদগুণের এমন কোনটি আছে, যা পরিপূর্ণরূপে তাঁর মধ্যে বিরাজমান ছিল না? আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রতি ওহী নাযিল করেছিলেন এবং তাঁর জীবনকে ওহীর শিক্ষার বাস্তব নমুনা বানিয়েছিলেন। সুতরাং সত্যকথা হচ্ছে কুরআন মাজীদ যে চরিত্রের শিক্ষাদান করে, তিনি ছিলেন তার জীবন্ত রূপ। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে তাঁর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন-
كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ
‘কুরআনই ছিল তাঁর চরিত্র।(মুসনাদে আহমাদ: ২৪৬০১; আল আদাবুল মুফরাদ: ৩০৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৪৪৩৪; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৭২; শু'আবুল ঈমান: ১৩৫৯; শারহুস সুন্নাহ: ৩৪৯৪)
হযরত আলী রাযি. বলেন, خُلُقٍ عَظِيمٍ হল কুরআনের শিক্ষামালা। জুনায়েদ বাগদাদী রহ. বলেন, তাঁর চরিত্রকে মহান চরিত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে এ কারণে যে, আল্লাহ তা'আলা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে তাঁর কোনও চিন্তা-ভাবনা ছিল না। তিনি তাঁর মহান চরিত্র দিয়ে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, কিন্তু তাঁর অন্তর ছিল তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁর প্রকাশ্য দিক ছিল মাখলুকের সঙ্গে, কিন্তু অন্তর্জগৎ ছিল স্রষ্টার সঙ্গে।
আয়াতটির শিক্ষা
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত হিসেবে নিজেদের জীবনে তাঁর মহান চরিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
দুই নং আয়াত
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (134)
অর্থ: এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৩৪)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা আলে-ইমরানের ১৩৪ নং আয়াতের শেষ অংশ। এর আগের আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, জান্নাত মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এ আয়াতে মুত্তাকীদের কয়েকটি গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হল রাগ হজম করা। এখানে বলা হয়েছে-
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ (এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে অভ্যস্ত)। অর্থাৎ রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। যার উপর রাগ ওঠে, তার উপর রাগের আচরণ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা করা হতে নিজেকে বিরত রাখে। এটি একটি মহৎ গুণ। এর অনেক ফযীলত। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَمَنْ كَظَمَ غَيْظَهُ ، وَلَوْ شَاءَ أَنْ يُمْضِيَهُ أَمْضَاهُ ، مَلَأَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ قَلْبَهُ أَمْنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘যে ব্যক্তি রাগ সংবরণ করে, অথচ সে চাইলে তা কার্যকর করতে পারত, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তার অন্তর নিরাপত্তায় ভরে দেবেন।(তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৬০২৬; আল-মুজালাসা ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম: ৩৫৪৩)
অপর এক হাদীছে ইরশাদ-
وَمَنْ كَفَّ غَضَبَهُ كَفَّ اللَّهُ عَنْهُ عَذَابَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘যে ব্যক্তি নিজ ক্রোধ সংবরণ করে, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তার থেকে আযাব দূর করে দেবেন।(শু'আবুল ঈমান: ৭৯৫৮; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৪৩৩৮; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ৩২১)
এ বাক্যে বর্ণিত মুত্তাকীদের দ্বিতীয় গুণ হল ক্ষমতাশীলতা। বলা হয়েছে- وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ (এবং মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত)। অর্থাৎ কেউ বেয়াদবি করলে, আর্থিক ক্ষতি করলে, শারীরিকভাবে কষ্ট দিলে, মানসিক আঘাত করলে, এককথায় অপ্রীতিকর যে আচরণই করুক, মুত্তাকী ব্যক্তি তাকে ক্ষমা করে দেয়। ক্ষমাশীলতা ইসলামের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক শিক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ক্ষমাশীল ছিলেন। তায়েফের দুরাচারদের ক্ষমা করে দেওয়া, এমনিভাবে মক্কাবিজয়ের পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা তাঁর ক্ষমাশীল চরিত্রের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে ক্ষমাশীল হতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ-
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)
‘তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করো এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।’(সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯)
কেউ ভুল করার পর যদি ক্ষমা চায়, তবে তাকে ক্ষমা করা অবশ্যকর্তব্য। ক্ষমা না করা গুনাহ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنِ اعْتَذَرَ إِلَى أَخِيهِ فَلَمْ يَعْذُرْهُ أَوْ يَقْبَلْ عُذْرَهُ كَانَ عَلَيْهِ مِثْلُ خَطِيئَةِ صَاحِبِ مَكْسٍ
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চায়, কিন্তু সে তাকে ক্ষমা না করে বা তার ওজর কবুল না করে, তার গুনাহ হয় (জালেম) কর উসূলকারীর মতো।(সুনানে ইবন মাজাহ ৩৭১৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান ৭৯৮৫; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৮৬৪৪; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ৬৪৯
قال البوصيري في الزوائد : رجاله ثقات إلا أنه مرسل)
আয়াতটিতে সবশেষে বলা হয়েছে- وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন)। অর্থাৎ উল্লিখিত গুণাবলি যাদের মধ্যে আছে, তারা পুণ্যবান। আর আল্লাহ তা'আলা এরূপ পুণ্যবানদের ভালোবাসেন। এর আরেক অর্থ হতে পারে- আল্লাহ তা'আলা অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন। مُحْسِنٌ শব্দটির উৎপত্তি إِحْسَانٌ থেকে।
ইহসান অর্থ দয়া ও অনুগ্রহ করা। এটা ন্যায় ও ইনসাফের পরবর্তী ধাপ। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ ও দয়া করার হুকুম দেন।( সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯০)
ইনসাফ হল যে যেমন ব্যবহার করে, তার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা। আর ইহসান হল অন্যকে তার ন্যায্য অধিকারের চেয়ে আরও বেশি দেওয়া কিংবা যে ব্যক্তি মন্দ আচরণ করে, তার সঙ্গে ভালো আচরণ করা। যেমন কুরআন মাজীদে আদেশ করা হয়েছে-
ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ
‘তুমি মন্দকে প্রতিহত করবে এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট।(সূরা মুমিনূন (২৩), আয়াত ৯৬)
এর দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় হযরত যায়নুল আবিদীন রহ.-এর একটি ঘটনা দ্বারা। তার এক গোলামের আচরণে তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। এতে তার রাগ হল। গোলাম বলে وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ (যারা নিজের ক্রোধ হজম করে)। তিনি রাগ হজম করলেন। গোলাম বলল- وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ (এবং যারা মানুষকে ক্ষমা করে)। তিনি বললেন, তোমাকে ক্ষমা করলাম। শেষে গোলাম বলল- وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন)। তিনি বললেন, যাও তোমাকে আযাদ করে দিলাম।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. রাগ হজম করা একটি মহৎ গুণ। এ গুণ আমাদের অর্জন করতে হবে।
খ. ক্ষমাশীলতা আল্লাহ তা'আলার পসন্দ। প্রত্যেক মুমিনের এ গুণ অর্জনের চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য।
গ. ইহসান ও অনুগ্রহের আচরণ চরিত্রের উচ্চতর স্থান। এ স্তরে পৌঁছার দ্বারা আল্লাহর ভালোবাসা লাভ হয়।
কেমন ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র
হাদীছ নং: ৬২০
হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চরিত্রের দিক থেকে ছিলেন সর্বোত্তম মানুষ। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৬২০৩; সহীহ মুসলিম: ৬৫৯; সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৭৩; জামে' তিরমিযী: ২০১৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৩৩৬; সহীহ ইবন হিব্বান ৬৪৪৩ )
হাদীছ নং: ৬২০
হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চরিত্রের দিক থেকে ছিলেন সর্বোত্তম মানুষ। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৬২০৩; সহীহ মুসলিম: ৬৫৯; সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৭৩; জামে' তিরমিযী: ২০১৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৩৩৬; সহীহ ইবন হিব্বান ৬৪৪৩ )
مقدمة الامام النووي
73 - باب حسن الخلق
قَالَ الله تَعَالَى: {وَإنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ} [ن: 4]، وقال تَعَالَى: {وَالكَاظِمِينَ الغَيْظَ وَالعَافِينَ عَنِ النَّاسِ} [آل عمران: 134] الآية.
قَالَ الله تَعَالَى: {وَإنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ} [ن: 4]، وقال تَعَالَى: {وَالكَاظِمِينَ الغَيْظَ وَالعَافِينَ عَنِ النَّاسِ} [آل عمران: 134] الآية.
620 - وعن أنس - رضي الله عنه - قال: كَانَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - أحْسَنَ النَّاس خُلُقًا. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
তাহকীক: