রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৬১৪
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায়: ৭২ অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা
অহংকারের পরিণাম ও অহংকার কাকে বলে
হাদীছ নং: ৬১৪

হযরত আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জান্নাত ও জাহান্নাম বিতর্কে লিপ্ত হল। জাহান্নাম বলল, উদ্ধত ও অহংকারীগণ আমার ভেতর। জান্নাত বলল, মানুষের মধ্যে যারা দুর্বল ও অসহায়, তারা আমার ভেতর। আল্লাহ উভয়ের মধ্যে ফয়সালা করলেন যে, তুমি জান্নাত, আমার রহমত। আমি যাকে চাইব, তোমার দ্বারা তার প্রতি রহমত করব। আর তুমি জাহান্নাম ও আমার আযাব। যাকে চাইব তোমার দ্বারা আযাব দেব। আর তোমাদের প্রত্যেককে পূর্ণ করা আমার দায়িত্ব। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম : ২৮৪৬; জামে তিরমিযী: ২৫৬১; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১১৪৫৮; মুসনাদে আহমাদ: ৭৭০৪; মুসনাদুল হুমায়দী: ১১৭১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৭৪৭৭)
مقدمة الامام النووي
72 - باب تحريم الكبر والإعجاب
614 - وعن أَبي سعيد الخدري - رضي الله عنه - عن النبي - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «احْتَجّتِ الجَنَّةُ وَالنَّارُ، فَقَالَت النَّارُ: فيَّ الْجَبَّارُونَ والمُتَكَبِّرُونَ. وقالتِ الجَنَّةُ: فيَّ ضُعفاءُ الناس ومساكينُهُم، [ص:204] فقضى اللهُ بَينهُما: إنكِ الجنّةُ رَحْمَتِي أرْحَمُ بِك مَنْ أشَاءُ، وَإنَّكِ النَّارُ عَذَابِي أُعَذِّبُ بِكِ مَنْ أشَاءُ، وَلِكِلَيْكُمَا عَلَيَّ مِلْؤُهَا». رواه مسلم. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যে যে বিতর্কের উল্লেখ করেছেন সে বিতর্ক বাস্তবে সংঘটিত হয়ে গেছে অথবা ভবিষ্যতে হবে। বাস্তবে যদি তাদের মধ্যে বিতর্ক হয়ে গিয়ে থাকে তবে প্রশ্ন হয়, কে জান্নাতে যাবে এবং কে জাহান্নামে সে ফয়সালা তো ভবিষ্যতে হবে, তার আগেই তারা কী করে বলে যে, আমার মধ্যে আছে অহংকারীগণ বা আমার মধ্যে আছে দুর্বল শ্রেণী? উত্তর এই যে, কোন্ শ্রেণীর লোক জান্নাতে যাবে এবং কোন্ শ্রেণীর লোক জাহান্নামে তা সাব্যস্ত হয়েই আছে। তারই ভিত্তিতে তাদের মধ্যে এ বিতর্ক। সে হিসেবে 'আমার মধ্যে আছে' মানে আমার ভাগে আছে। অর্থাৎ তারা আমার মধ্যে আসবে।

অথবা এ বিতর্ক ভবিষ্যতে হবে। যেহেতু তা হওয়াটা অবধারিত, তাই অতীত ক্রিয়াপদে احتجت (বিতর্কে লিপ্ত হল) বলা হয়েছে। নিশ্চয়তা জ্ঞাপনের জন্য এভাবে ভবিষ্যতে সংঘটিতব্য বিষয়কে অতীত ক্রিয়াপদে ব্যক্ত করার ব্যাপক প্রচলন আরবী ভাষায় আছে।

প্রশ্ন হতে পারে, তর্ক-বিতর্ক করার জন্য তো বোধ-অনুভূতি থাকা প্রয়োজন। অপরদিকে জান্নাত ও জাহান্নাম বিশেষ বিশেষ স্থানের নাম এবং তা জড়বস্তু। তারা কিভাবে বিতর্কে লিপ্ত হতে পারে?

উত্তর হচ্ছে, জড়বস্তুর যে অনুভূতি নেই তা কিভাবে জানা গেল? কুরআন হাদীছ দ্বারা জানা যায় তারও অনুভূতি আছে। এমনকি তারা তাদের মত করে কথাও বলতে পারে। কুরআন মাজীদে জানানো হয়েছে, আসমান-যমীনের প্রতিটি বস্তু আল্লাহ তাআলার তাসবীহ ও তাঁর গুণগান করে। তাসবীহ ও গুণগান তো শব্দ ও উচ্চারণ দ্বারাই হয়ে থাকে। সুতরাং জান্নাত ও জাহান্নামের যদি এরকম বোধ ও অনুভব থাকে যা দ্বারা কোনও ভাব প্রকাশ সম্ভব, তাতে আশ্চর্যের কী আছে? আধুনিক বিজ্ঞানও জড়পদার্থের বোধ-অনুভব থাকার কথা স্বীকার করে। কাজেই যাদের কাছে বিজ্ঞানই সব, তাদের জন্য তো এটা মানতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। একান্তই যদি কারও মানতে কষ্ট হয়, তবে সে এ বিতর্ককে প্রতিকী অর্থেও নিতে পারে। তখন এর দ্বারা বাস্তব তর্ক- বিতর্ক বোঝানো হবে না; বরং তাদের অবস্থাদৃষ্টে এ বিতর্ককে কল্পনার প্রকাশরূপে ধরা হবে। এরূপ কল্পনাকে বাস্তবরূপে প্রকাশের প্রচলন সব ভাষাতেই আছে।

যাহোক এ হাদীছের মর্মবস্তু হচ্ছে এই যে, বেশিরভাগ জান্নাতবাসী হবে দুর্বল ও গরীব শ্রেণীর দীনদারগণ আর বেশিরভাগ জাহান্নামী হবে স্বেচ্ছাচারী অহংকারীগণ। কেন এরকম বণ্টন, সে সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা বলেন-

إِنَّكِ الْجَنَّةُ رَحْمَتِي أَرْحَمُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ، وَإِنَّكِ النَّارُ عَذَابِي أُعَذِّبُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ

‘(হে জান্নাত!) তুমি হলে আমার রহমত। তোমার দ্বারা আমি যার প্রতি ইচ্ছা রহম করি। আর (হে জাহান্নাম!) তুমি হলে আমার আযাব। আমি তোমার দ্বারা যাকে ইচ্ছা আযাব দেই।'

অর্থাৎ ওহে জান্নাত! তুমি আমার রহমতের প্রকাশস্থল। দুনিয়ায় আমি যাদের অর্থবিত্ত দেইনি, ফলে পার্থিব আরাম-আয়েশ থেকে তারা বঞ্চিত থেকেছে এবং ধনী ও প্রভাবশালীদের পক্ষ থেকে অবজ্ঞা ও অবহেলার শিকার হয়েছে আর তাদের দ্বারা নানাভাবে তাদেরকে অবিচার-অত্যাচারও সহ্য করতে হয়েছে, আজ আমি তোমার মাধ্যমে তাদের প্রতি রহমত করব। পার্থিব বঞ্চনার পরিপূর্ণ বদলা তাদের দেব। দুনিয়ার দুঃখ-কষ্টের বিনিময়ে আজ আমি তাদেরকে অফুরন্ত ও অকল্পনীয় সুখ-শান্তি দান করব।

আর হে জাহান্নাম। তুমি হলে আমার আযাব। আমি তোমার মাধ্যমে ওই সকল লোককে শাস্তিদান করব, যারা দুনিয়ায় স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করেছে, আমার আদেশ মানার পরিবর্তে খেয়ালখুশির বশীভূত হয়ে থেকেছে, অর্থবিত্তের অহমিকায় গরীব ও সাধারণ লোকদের মানুষ বলে গণ্য করেনি এবং নিজেদের অন্যায় স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের উপর জুলুম নির্যাতন চালিয়েছে। আজ আমি তোমার মাধ্যমে শাস্তি দিয়ে তাদেরকে দেখিয়ে দেব তাদের সে অহমিকা কতটা মিথ্যা, তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কেমন ছলনা ও ক্ষণস্থায়ী।

পরিশেষে এ হাদীছে আল্লাহ তাআলার বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে যে, ولكليكما علي ملؤها (আমারই যিম্মায় তোমাদের প্রত্যেককে পরিপূর্ণ করে দেওয়া)। অর্থাৎ জান্নাতে যে অফুরন্ত ও অকল্পনীয় নিআমতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা ভোগ-উপভোগ করার জন্য যে গুণসম্পন্ন ও যে পরিমাণ লোক প্রয়োজন তা যোগান দেওয়ার দায়িত্ব আমারই। আমি এর জন্য রীতিনীতি তৈরি করে রেখেছি আর তা হচ্ছে আমার দেওয়া দীন ও শরীআত। আমার দেওয়া তাওফীকে যারা সে দীন ও শরীআত মেনে চলবে এবং সৎকর্মে লিপ্ত থাকবে, তারাই জান্নাতে স্থান পাবে। এমনিভাবে জাহান্নামের স্থায়ী ও দুর্বিষহ শাস্তিদানের জন্য যেমন লোক প্রয়োজন তাও সরবরাহ করা আমার দায়িত্ব। আমি তারও ব্যবস্থা করে রেখেছি। যারা আমার দীন ও শরীআত অমান্য করবে এবং অন্যায় ও পাপকর্মের ভেতর জীবন কাটাবে, তাদেরই ঠিকানা হবে জাহান্নাম। সেখানে তারা দুর্বিষহ শাস্তি ভোগ করবে। এভাবে উভয়শ্রেণীর লোক জান্নাত ও জাহান্নামে আপন আপন কর্মফল ভোগ করবে। ইরশাদ হয়েছে- فَرِيقٌ فِي الْجَنَّةِ وَفَرِيقٌ فِي السَّعِيرِ (একদল যাবে জান্নাতে এবং একদল প্রজ্বলিত আগুনে)

যারা পরিপূর্ণ মুমিন এবং পাপের চেয়ে পুণ্যের পরিমাণ বেশি হবে তারা তো প্রথম যাত্রায়ই জান্নাতে পৌঁছে যাবে এবং অনন্তকাল সেখানে থাকবে। যারা ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করবে কিন্তু তাদের পুণ্য অপেক্ষা পাপ বেশি হবে, তারা শুরুতে আল্লাহ তা'আলার ক্ষমা না পেলে কিছুকাল জাহান্নামের শাস্তিভোগ করবে, তারপর মুক্তি পেয়ে অনন্তকাল জান্নাতের সুখ-শান্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যারা কাফেররূপে মারা যাবে, তারা শুরু থেকেইে অনন্তকাল জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-

فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ (7) وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ (8)

‘সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করে থাকলে সে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করে থাকলে তাও দেখতে পাবে।২৫৩

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. বাকশক্তি আল্লাহ তা'আলারই দান। তিনি চাইলে জড়বস্তুতেও এ শক্তি দান করতে পারেন।

খ. অহংকার ও দর্প অতি নিন্দনীয় গুণ। এর পরিণাম জাহান্নাম। কাজেই মুমিনদের কর্তব্য এর থেকে বেঁচে থাকা।

গ. গরীব ও দুর্বল বলে কাউকে হেলা করতে নেই। দীনদার হলে তার ঠিকানা হবে জান্নাত, যা কিনা প্রকৃত সৌভাগ্য ও সফলতা।

ঘ. জান্নাত আল্লাহ তা'আলার রহমত প্রকাশের স্থান। সে রহমত লাভের আশায় আমাদের কর্তব্য নেক আমলে লেগে থাকা।

গু. জাহান্নাম আল্লাহ তা'আলার কঠিন আযাবের জায়গা। তা থেকে বাঁচার লক্ষ্যে আল্লাহর আনুগত্য করা ও পাপকর্ম হতে বেঁচে থাকা অবশ্যকর্তব্য।

২৫২. সূরা শূরা (৪২), আয়াত নং ৭

২৫৩. সূরা যিলযাল (৯৯), আয়াত নং ৭, ৮
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)