রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين

ভূমিকা অধ্যায় - এর পরিচ্ছেদসমূহ

মোট হাদীস ৬৭৯ টি

হাদীস নং: ৪৪১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫২ আল্লাহর কাছে আশাবাদী থাকার ফযীলত।
মৃত্যুকালে আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা রাখার গুরুত্ব
হাদীছ নং : ৪৪১

হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর ইন্তিকালের তিনদিন আগে বলতে শুনেছেন, তোমাদের কেউ যেন অন্য কোনও অবস্থায় নয়; বরং এ অবস্থায়ই মারা যায় যে, সে মহান আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করছে – মুসলিম।
مقدمة الامام النووي
52 - باب فضل الرجاء
441 - وعن جابر بن عبد الله رضي الله عنهما: أنه سمع رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قبلَ مَوْتِه بثَلاثَةِ أَيّام، يقولُ: «لاَ يَمُوتَنَّ أَحَدُكُمْ إِلاَّ وَهُوَ يُحْسِنُ الظَّنَّ بالله - عز وجل». رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ৪৪২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর কাছে আশাবাদী থাকার ফযীলত
তাওবা-ইস্তিগফার দ্বারা ক্ষমালাভের নিশ্চয়তা
হাদীছ নং: ৪৪২

অর্থ : হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তাআলা বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি যতদিন আমাকে ডাকবে ও আমার কাছে আশা করবে, আমি তোমাকে ক্ষমা করব। তাতে তোমার দ্বারা যা-কিছুই ঘটুক, আমি কোনও পরওয়া করব না। হে আদম সন্তান! তোমার গুনাহ যদি আকাশ পর্যন্তও পৌঁছে যায়, তারপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব। হে আদম সন্তান! তুমি যদি আমার কাছে পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়েও আস এবং এ অবস্থায় আমার সঙ্গে সাক্ষাত কর যে, তুমি আমার সঙ্গে কোনওকিছু শরীক কর না, তবে আমিও পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার কাছে আসব- তিরমিযী।
مقدمة الامام النووي
52 - باب فضل الرجاء
442 - وعن أنس - رضي الله عنه - قَالَ: سمعت رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «قَالَ الله تَعَالَى: يَا ابْنَ آدَمَ، إنَّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ مِنْكَ وَلاَ أُبَالِي. يَا ابْنَ آدَمَ، لَوْ بَلَغَت ذُنُوبُك عَنَانَ السَّماءِ، ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ وَلاَ أُبَالِي. يَا ابْنَ آدَمَ، إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِي بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا، ثُمَّ لَقَيْتَنِي لاَ تُشْرِكُ بِي شَيْئًا، لأَتَيْتُكَ بقُرَابِها مَغْفِرَةً». رواه الترمذي، (1) وقال: «حديث حسن».
«عَنَانُ السَّماءِ» بفتح العين، قيل: هو مَا عَنَّ لَكَ مِنْهَا، أيْ: ظَهَرَ إِذَا رَفَعْتَ رَأَسَكَ، وقيل: هو السَّحَابُ. وَ «قُرابُ الأَرض» بضم القاف، وقيل: بكسرها، والضم أصح وأشهر، وَهُوَ: مَا يقارب مِلأَهَا، والله أعلم.
হাদীস নং: ৪৪৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর ভয় ও আশার সমন্বয়

اعْلَمْ أَنَّ المُخْتَارَ لِلْعَبْدِ في حَالِ صِحَّتِهِ أَنْ يَكُونَ خَائفًا رَاجِيًا، وَيَكُونَ خَوْفُهُ وَرَجَاؤُهُ سَواءً، وفي حَالِ المَرَضِ يُمحَّضُ الرَّجاءُ، وقواعِدُ الشَّرْع مِنْ نصُوصِ الكِتَابِ والسُّنَةِ وغَيْرِ ذَلِكَ مُتظاهِرَةٌ عَلَى ذلك.
‘প্রকাশ থাকে যে, বান্দার জন্য সুস্থতাকালে উত্তম হল ভীত ও আশাবাদী থাকা, এবং তার ভয় ও আশার অবস্থা সমান থাকা। আর অসুস্থ অবস্থায় উত্তম কেবল আশাবাদী থাকা। এটাই শরীআতের মূলনীতি। এ সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহে সুস্পষ্ট বিস্তর নস (মূলপাঠ) রয়েছে।
বান্দার ঈমান ও আমলের হেফাজতের জন্য কর্তব্য অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত রাখার পাশাপাশি তাঁর প্রতি আশাও বজায় রাখা। ভয়হীন আশা ও আশাবিহীন ভয় উভয়ই ক্ষতিকর। কেননা ভয়হীন আশা মানুষকে ধোঁকায় ফেলে দেয়। আর আশাবিহীন ভয় হতাশার সৃষ্টি করে ।
আল্লাহর প্রতি আশা রাখার অর্থ হল কারও দ্বারা কোনও ত্রুটি হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে খাঁটি মনে তাওবা করা আর এই আশা রাখা যে, আল্লাহ তাআলা নিজ দয়ায় তার ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেবেন। এমনিভাবে যেসব সৎকর্ম করা হবে, সেক্ষেত্রে এই আশা রাখা যে আল্লাহ তাআলা তা কবুল করে নেবেন। অপরপক্ষে অন্তরে আল্লাহর ভয় রাখার অর্থ হচ্ছে, না জানি ইবাদত-বন্দেগীর ভেতরে এমন কোনও ত্রুটি হয়ে গেছে, যে কারণে আল্লাহ তা'আলার কাছে তা কবুল হওয়ার উপযুক্ত থাকেনি। এমনিভাবে যেসব পাপকর্ম হয়ে গেছে, তার তাওবাও যথাযথভাবে করা হয়নি। ফলে সে তাওবাও আল্লাহর কাছে কবুল হয়নি। একদিকে পাপের বোঝা, অন্যদিকে ইবাদত-বন্দেগী কবুলের উপযুক্ত না হওয়া- এ দু'টিই তো ধ্বংসের কারণ। না জানি আমি ধ্বংস হয়ে গেলাম!
যার অন্তরে এরূপ আশা ও ভয় বিরাজ করবে, সেই ধ্বংস হতে বাঁচবে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে-
وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَه
"এবং তারা তাঁর রহমতের আশা করে ও তাঁর আযাবকে ভয় করে।"
এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুমূর্ষু যুবককে দেখতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি নিজেকে কেমন পাচ্ছ? যুবক বলেছিল, আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী আবার নিজ গুনাহেরও ভয় করি। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছিলেন-
«لا يجتمعان في قلب عبد في مثل هذا الموطن، إلا أعطاه الله ما يرجو، وآمنه مما يخاف»
'এরূপ অবস্থায় যে বান্দারই অন্তরে এ দুই গুণ বিরাজ করে, আল্লাহ তা'আলা তাকে অবশ্যই দান করেন, যা সে আশা করে। আর তাকে নিরাপত্তা দেন ওই বিষয় হতে, যার সে ভয় করে।
কুরআন ও হাদীছের প্রতি লক্ষ করলে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আশা ও ভয় পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানেই জান্নাতের নিআমতরাজির কথা বর্ণিত হয়েছে, সেখানে পাশাপাশি জাহান্নামের কঠিন আযাবের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে আল্লাহর গযব ও ক্রোধের বর্ণনা এসেছে, সেখানে পাশাপাশি তাঁর রহমত ও দয়ার বিপুলতাও উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে শাস্তির সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে, সেখানে পাশাপাশি মাগফিরাত ও ক্ষমার সুসংবাদও শোনানো হয়েছে। এটা কুরআন- সুন্নাহর ই'তিদাল ও ভারসাম্য। কুরআন-সুন্নাহ'র যাবতীয় শিক্ষার মধ্যেই এ ভারসাম্য বিদ্যমান ।
আযাবের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে বান্দাকে গুনাহ থেকে বিরত রাখা। কিন্তু ভয় যদি সীমা ছাড়িয়ে যায়, অন্তরে আশার কোনও স্থান যদি না থাকে, তবে এরূপ ভয় নিরাশা সৃষ্টি করে। এর ফলে ভয়ের উদ্দেশ্য ব্যহত হয়। কেননা নিরাশ মন অন্যায়- অপরাধ থেকে বিরত না থেকে বরং তা করতে অধিকতর স্পর্ধিত হয়ে ওঠে। অনুরূপ অন্তরে যদি ভয় বিলকুল না থাকে; বরং সেখানে কেবল আশাবাদই বিরাজ করে, তবে সে অন্তর পাপাচার করতে দ্বিধাবোধ করে না এবং সে অন্তরে সৎকর্মেরও বিশেষ উৎসাহ থাকে না। এ কারণেই কুরআন-সুন্নাহ'র এ ভারসাম্য। অন্তরে আল্লাহ তা'আলার রহমতের আশাও রাখতে হবে এবং পাশাপাশি তাঁর আযাব ও গযবের ভয়ে ভীতও থাকতে হবে।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে এ সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। এবার সেসব আয়াত ও হাদীছের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।

*ভয় ও আশার সমন্বয় সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত

{فلا يأمن مكر الله إلا القوم الخاسرون} [الأعراف: 99]
অর্থ : 'আল্লাহপ্রদত্ত অবকাশ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকে কেবল সেইসব লোক, যারা শেষপর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।'

ব্যাখ্যা
ইহজগত পরীক্ষার স্থান। এখানে আল্লাহ তাআলা মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। গরীবকে অভাব-অনটন দ্বারা পরীক্ষা করেন, আর ধনীকে ধন-সম্পদ দিয়ে। অনেক সময় সম্পদশালী লোক নিজ ধন-সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে অহংকারের শিকার হয়ে যায়। চিন্তা করে না যে, ধন-সম্পদ আল্লাহর দান এবং এ কারণে তাঁর শোকর আদায় করা উচিত। উল্টো অহমিকাবশত গরীবদের উপর জুলুম-নির্যাতন চালায় ও নানারকম অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত হয়। অহমিকার কারণে তারা দীন ও শরী'আত উপেক্ষা করে। এ অবস্থায় আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে অবকাশ দেন। তাদেরকে চিন্তা- ভাবনা করার ও দীনের পথে ফিরে আসার সুযোগ দেন। তারা যখন সে সুযোগ কাজে না লাগিয়ে উল্টো আরও বেশি অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে, তখন আল্লাহ তাআলা তাদের ধন-সম্পদ আরও বেশি বৃদ্ধি করে দেন এবং তাদেরকে পাপাচারের পথে আরও বেশি অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দেন। এতবেশি পাপ সত্ত্বেও ধন-সম্পদের প্রবৃদ্ধি হতে দেখে তারা ধোঁকায় পড়ে যায়। মনে করে তারা সঠিক পথেই আছে। আল্লাহ তা'আলা যে যে-কোনও সময় তাদের পাকড়াও করতে পারেন, সে চিন্তা তাদের মাথায় থাকে না। দিনে-রাতে, ঘরে-বাইরে সর্বক্ষণ সব জায়গায় তারা নিজেদেরকে নিরাপদ বোধ করে।
তারা যখন নিজেদেরকে এভাবে নিরাপদ বোধ করতে থাকে এবং আল্লাহর শাস্তি হতে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থেকে পাপকর্ম চালিয়ে যায়, তখন হঠাৎ করেই আল্লাহ তা'আলা তাদের পাকড়াও করেন। তখন আর তাদের তাওবা-ইস্তিগফার করা ও নিজেদের সংশোধন করার কোনও সুযোগ থাকে না।
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা সে ব্যাপারেই সতর্ক করছেন যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে অবকাশ দেওয়ার উদ্দেশ্য মানুষকে তাওবা-ইস্তিগফার করে সুপথে ফিরে আসার সুযোগ করে দেওয়া। সে সুযোগকে কাজে না লাগানো চরম বোকামি। এর ফলে যে ক্ষতি হয়, তার প্রতিকার করার কোনও সুযোগ থাকে না। কেননা এরূপ লোকের তাওবা-ইস্তিগফার করার সুযোগ হয় না। তারা আল্লাহ তা'আলার আকস্মিক পাকড়াওয়ের মধ্যে পড়ে যায়। সুতরাং মুমিনের কাজ হবে সময় ও সুযোগকে কাজে লাগানো, অবকাশকে পরীক্ষার বিষয় মনে করা এবং বাহ্যিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ধোঁকায় না পড়া।

• দুই নং আয়াত

{إنه لا ييأس من روح الله إلا القوم الكافرون} [يوسف: 87]
অর্থ : 'আল্লাহর রহমত থেকে কেবল তারাই নিরাশ হয়, যারা কাফের।'

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার রহমত ও দয়া থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়া কোনও মুমিনের পক্ষে শোভা পায় না। এটা শোভা পায় কেবল কাফেরদের পক্ষেই। কেননা তারা আল্লাহ তাআলার অনন্ত-অসীম রহমত ও কুদরত সম্পর্কে খবর রাখে না। তারা জানেনা যে, আল্লাহর ক্রোধের উপর তাঁর রহমতই প্রবল। তাই একটু বিপদ-আপদেই হতাশ হয়ে পড়ে। হতাশ হয়ে যায় মাগফিরাত লাভের ব্যাপারেও।
ভাবে, আমি এত বড় পাপী, আমাকে কি আর ক্ষমা করা হবে। এর দ্বারা মুমিনদের সতর্ক করা হচ্ছে, তারা যেন কোনও অবস্থায়ই হতাশ না হয়ে যায়। তাদের মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা'আলার রহমত থেকে হতাশ হওয়া কাফের-বেঈমানদের কাজ। কাজেই যত কঠিন বিপদই হোক, তারা যেন আল্লাহর উপর ভরসা রাখে। যত কঠিন পাপীই হোক, যেন মাগফিরাত ও ক্ষমার আশা রাখে এবং সেই আশায় তাওবা- ইস্তিগফার ও আত্মসংশোধনে লিপ্ত হয়ে যায়।

• তিন নং আয়াত
{يوم تبيض وجوه وتسود وجوه} [آل عمران: 106]
অর্থ: 'যেদিন কতক মুখ (ঈমান ও আনুগত্যের আলোয়) উজ্জ্বল হবে এবং কতক মুখ (কুফর ও পাপের কালিমায়) কালো হয়ে যাবে।

ব্যাখ্যা
এটি সূরা আলু ইমরানের ১০৬ নং আয়াতের প্রথম অংশ। এরপর ইরশাদ-
{فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ} [آل عمران: 106]
যাদের মুখ কালো হয়ে যাবে, (তাদেরকে বলা হবে,) তোমরা কি ঈমান আনার পর কুফর অবলম্বন করেছিলে? সুতরাং তোমরা শাস্তি আস্বাদন কর, যেহেতু তোমরা কুফরী করতে।
যারা ঈমান আনার পর সত্যিই কাফের হয়ে যায় এবং ঈমান থেকে পুরোপুরি খারিজ হয়ে যায়, এ আয়াতের সতর্কবাণী তাদের জন্য তো স্পষ্টভাবেই প্রযোজ্য। তবে যারা ঈমান থেকে খারিজ হয়নি, তাদেরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা মুমিন- মুসলিমগণ যদি কোনও ক্ষেত্রে ঈমানের দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়, যদি ইসলামের বিধি- বিধান পালনে সচেষ্ট না থেকে মানবরচিত আইনের অনুসরণ করে যায়, তবে তাও ইসলাম থেকে খানিকটা হলেও সরে যাওয়াই বটে। তারা সরাসরি কাফের না হলেও তাদের কাজকর্ম অনেকটা কাফেরসুলভ বৈকি। এ অবস্থায় আখিরাতে কাফেরদের মত না হলেও কোনও না কোনও পর্যায়ের শাস্তিভোগের ভয় রয়েছে। তাছাড়া এ পশ্চাদমুখিতা কোনও এক পর্যায়ে পুরোপুরি কুফরীতে লিপ্ত হয়ে পড়ারও আশঙ্কা তৈরি করে। সে ক্ষেত্রে তো কাফেররূপে জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়।
তারপর মুমিনদের সম্পর্কে পরবর্তী আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
{ وَأَمَّا الَّذِينَ ابْيَضَّتْ وُجُوهُهُمْ فَفِي رَحْمَةِ اللَّهِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ } [آل عمران: 107]
'পক্ষান্তরে যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে, তারা আল্লাহর রহমতের ভেতর স্থান পাবে এবং তারা তাতেই সর্বদা থাকবে।'
রহমতের ভেতর মানে জান্নাতের ভেতর। জান্নাতকে 'রহমত' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে এ কারণে যে, জান্নাত আল্লাহ তা'আলার রহমতেই লাভ হবে। নেক আমলের উদ্দেশ্য সেই রহমতের অধিকারী হওয়া। আল্লাহ তা'আলার রহমতে একবার জান্নাতে প্রবেশ করা সম্ভব হলে আর কখনও সেখান থেকে বহিষ্কৃত হতে হবে না। অনন্ত-অসীম কাল জান্নাতের অফুরন্ত নি'আমতের ভেতর পরম সুখে জীবন কাটতে থাকবে।

• চার নং আয়াত
إِنَّ رَبَّكَ لَسَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
অর্থ : 'নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক দ্রুত শাস্তিদানকারী এবং নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালুও বটে।

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ অনেক সময় আল্লাহ তা'আলা পাপী ব্যক্তিকে দুনিয়ায়ও তার পাপের শাস্তি দিয়ে থাকেন। অনেক বোঝানো সমঝানোর পরও যখন সে পাপকর্ম থেকে বিরত না হয়, তখন আল্লাহ তা'আলা নিজ হিকমত অনুযায়ী দুনিয়ায়ই তাকে শাস্তি দিয়ে দেন। এটিকেই 'দ্রুত শাস্তিদান' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। আবার পাপী ব্যক্তি যখন খাঁটিমনে তাওবা-ইস্তিগফার করে, তখন তিনি তাকে ক্ষমাও করে দেন। তাঁর ক্ষমাশীলতা ও দয়ামায়া অসীম অফুরন্ত । যত বড় পাপই হোক না কেন, আল্লাহ তা'আলার দিকে সত্যিকারভাবে রুজু হতে পারলে তিনি নিজ দয়ায় অবশ্যই তা ক্ষমা করে দেন।

• পাঁচ নং আয়াত

{إن الأبرار لفي نعيم وإن الفجار لفي جحيم} [الانفطار: 13 - 14]
অর্থ : 'নিশ্চয়ই নেককারগণ প্রভৃত নি'আমতের মধ্যে থাকবে এবং পাপিষ্ঠগণ অবশ্যই জাহান্নামে থাকবে।

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ নেককারগণ অফুরন্ত নি'আমতের স্থান জান্নাতের মধ্যে থাকবে। তারা তাতে থাকবে অনন্তকাল। 'থাকবে' বলে এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তাদেরকে সেখান থেকে কখনও বের হতে হবে না। তাদের সুখ-শান্তিতে কখনও ছেদ ঘটবে না। অপরদিকে পাপীদের স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। সেখানে তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেওয়া হবে। কাফের-বেঈমানগণ অনন্তকাল সে শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। তারা কখনও সেখান থেকে বের হতে পারবে না।

• ছয় নং আয়াত
{فأما من ثقلت موازينه فهو في عيشة راضية وأما من خفت موازينه فأمه هاوية} [القارعة: 6 - 9] .
অর্থ : 'তখন যার পাল্লা ভারী হবে, সে তো সন্তোষজনক জীবনে থাকবে। আর যার পাল্লা হালকা হবে, তার ঠিকানা হবে এক গভীর গর্ত।

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ আখিরাতে আমলের পরিমাপ করার জন্য দাঁড়িপাল্লা স্থাপিত হবে। তাতে বান্দার আমল মাপা হবে। যার আমলের ওজন বেশি হবে, সে মুক্তি পাবে।
আমলের ওজন হয় ঈমান ও ইখলাস দ্বারা। আমলের বাহ্যিক রূপ যতই সুন্দর হোক এবং আকার-আকৃতিতে তার পরিমাণ যত বড় ও বেশিই হোক, যদি ইখলাস না থাকে, তবে তার কোনও ওজনই থাকবে না। তাই আমল করা চাই কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে, পার্থিব কোনও স্বার্থে নয়। ইখলাসপূর্ণ আমল অল্প হলেও তার ওজন হবে অনেক বেশি। এরূপ ওজনওয়ালা আমলের বদৌলতে আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে জান্নাতের এমন জীবন দান করবেন, যা পেয়ে সে সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত হয়ে যাবে।
পক্ষান্তরে যার আমলে ইখলাস থাকবে না তার আমল হবে হালকা। পরিমাণে যত বেশিই হোক না কেন, সেই হালকা আমল দ্বারা কেউ মুক্তিলাভ করতে পারবে না। এরূপ ব্যক্তির পরিণাম হবে জাহান্নাম। জাহান্নাম হল আগুনের গর্ত। যাদের আমলে ইখলাস থাকে না, তাদেরকে সে আগুনের গর্তে নিক্ষেপ করা হবে এবং তারা তাতে অবর্ণনীয় আযাব ভোগ করতে থাকবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করুন - আমীন।
আল্লাহর রহমত ও আযাবের অসীমতা
হাদীছ নং : ৪৪৩

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুমিন ব্যক্তি যদি জানত আল্লাহর কাছে কেমন শাস্তির ব্যবস্থা আছে, তবে কেউ আর জান্নাত লাভের আশা করত না। অপরপক্ষে কাফের ব্যক্তি যদি জানত আল্লাহর কাছে কী পরিমাণ রহমত আছে, তবে কেউ তার জান্নাত থেকে নিরাশ হতো না- মুসলিম।
مقدمة الامام النووي
53 - باب الجمع بين الخوف والرجاء
اعْلَمْ أَنَّ المُخْتَارَ لِلْعَبْدِ في حَالِ صِحَّتِهِ أَنْ يَكُونَ خَائفًا رَاجِيًا، وَيَكُونَ خَوْفُهُ وَرَجَاؤُهُ سَواءً، وفي حَالِ المَرَضِ يُمحَّضُ الرَّجاءُ، وقواعِدُ الشَّرْع مِنْ نصُوصِ الكِتَابِ والسُّنَةِ وغَيْرِ ذَلِكَ مُتظاهِرَةٌ عَلَى ذلك.
قَالَ الله تَعَالَى: {فَلاَ يَأمَنُ مَكْرَ الله إِلاَّ القَوْمُ الخَاسِرونَ} [الأعراف: 99]، وقال تَعَالَى: {إِنَّهُ لاَ يَيْأَسُ مِنْ رَوْحِ اللهِ إِلاَّ القَوْمُ الكافِرُونَ} [يوسف: 87]، وقال تَعَالَى: {يَوْمَ تَبْيَضُّ وَجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ} [آل عمران: 106]، وقال تَعَالَى: {إنَّ رَبَكَ لَسَرِيعُ العِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ} [الأعراف: 167]، وقال تَعَالَى: {إنَّ الأَبْرَارَ لَفِي نَعِيمٍ وَإِنَّ الفُجَّارَ لَفِي جَحِيمٍ} [الانفطار: 13 - 14]، وقال تَعَالَى: {فَأمَّا مَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَاضِيَةٍ وَأمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأمُّهُ هَاوِيَةٌ} [القارعة: 6 - 9] والآيات في هذا المعنى كثيرةٌ. فَيَجْتَمعُ الخَوفُ والرجاءُ في آيَتَيْنِ مُقْتَرِنَتَيْنِ أَو آيات أَو آية.
443 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لَوْ يَعْلَمُ الْمُؤمِنُ مَا عِنْدَ الله مِنَ العُقُوبَةِ، مَا طَمِعَ بِجَنَّتِهِ أَحَدٌ، وَلَوْ يَعْلَمُ الكَافِرُ مَا عِنْدَ الله مِنَ الرَّحْمَةِ، مَا قَنَطَ مِنْ جَنَّتِهِ أحَدٌ». رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ৪৪৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৩ ভয় ও আশার সমন্বয়।
মৃত্যুর পর নেককার ও বদকার মায়্যিতের হালত
হাদীছ নং : ৪৪৪

হযরত আবু সা'ঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন জানাযার লাশ (কবরের দিকে নেওয়ার জন্য) রাখা হয়, তারপর লোকজন তাকে তাদের কাঁধে বহন করে নেয়, তখন সে নেককার হলে বলে, আমাকে এগিয়ে নিয়ে চল, আমাকে এগিয়ে নিয়ে চল। আর যদি সে অসৎকর্মশীল হয়। তবে বলে, হায় দুর্ভোগ! তোমরা একে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? তার আওয়াজ মানুষ ছাড়া সকলেই শুনতে পায়। মানুষ যদি শুনত, তবে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেত - বুখারী।
مقدمة الامام النووي
53 - باب الجمع بين الخوف والرجاء
444 - وعن أَبي سعيد الخدرِيِّ - رضي الله عنه: أنَّ رسولَ الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «إِذَا وُضِعَتِ الجنازةُ واحْتَمَلَهَا النَّاسُ أَوِ الرِّجَالُ عَلَى أَعناقِهِمْ، فَإنْ كَانَتْ صَالِحَةً، قَالَتْ: قَدِّمُونِي قَدِّمُونِي، وَإنْ كَانَتْ غَيْرَ صَالِحَةٍ، قالتْ: يَا وَيْلَهَا! أَيْنَ تَذْهَبُونَ بِهَا؟ يَسْمَعُ صَوْتَها كُلُّ شَيْءٍ إِلاَّ الإنْسانُ، وَلَوْ سَمِعَهُ صَعِقَ». رواه البخاري. (1)
হাদীস নং: ৪৪৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৩ ভয় ও আশার সমন্বয়।
জান্নাত ও জাহান্নামের নৈকট্য
হাদীছ নং : ৪৪৫

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জান্নাত তোমাদের প্রত্যেকের জুতার ফিতার চেয়েও বেশি নিকটবর্তী। জাহান্নামও অনুরূপ - বুখারী।
مقدمة الامام النووي
53 - باب الجمع بين الخوف والرجاء
445 - وعن ابن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «الجَنَّةُ أقْرَبُ إِلَى أَحَدِكُمْ مِنْ شِرَاكِ نَعْلِهِ، وَالنَّارُ مِثْلُ ذلك». رواه البخاري. (1)
হাদীস নং: ৪৪৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহ তাআলার ভয় ও তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনায় ক্রন্দন করার ফযীলত

চোখের পানি বড় শক্তিশালী জিনিস। এটা অসহায়ের অব্যর্থ অবলম্বন। দুনিয়ায় দেখা যায় কেউ যখন কারও কাছ থেকে তার কাম্যবস্তুটি পেতে চায় আর সেজন্য সর্বপ্রকার উপায় অবলম্বন করেও ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন সে সবশেষে চোখের পানি ফেলে। সে পানিতে দাতার কঠোর মন নরম হয়ে যায়। আর তখন সে তা দিতে রাজি হয়ে যায়।
চোখের পানি ফেলে শিশুরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে কত আবদারই না পূরণ করে নেয়। বিপন্ন ব্যক্তি চোখের পানি দ্বারা কঠোর-কঠিন ও দুর্দান্ত শাসককে পর্যন্ত নরম করে ফেলে। যাচনাকারীর চোখের পানি সাধারণত কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে না। তাই দুনিয়ার সকল ক্ষেত্রেই সকল যাচনাকারী, সকল অসহায় উপায়হীন ব্যক্তি শেষ দাওয়াই হিসেবে চোখের পানি ব্যবহার করে থাকে।
আল্লাহ তাআলা সব অসহায়ের আসল সহায়। তাঁর সহায়তা বিনে পৃথিবীর দুর্বলতম ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রচণ্ড শক্তিমান পর্যন্ত সকলেই সত্যিকারের অসহায়। বিশেষত আল্লাহ তা'আলার আযাব ও গযব থেকে তার নিজের আশ্রয় ছাড়া কারও কোনও আশ্রয়স্থল নেই। এ ক্ষেত্রে কোনও মাখলুক, সে যতো শক্তিশালীই হোক না কেন, কাউকে কিছুমাত্র সহায়তা দিতে পারে না। তিনি কাউকে শাস্তি দিতে চাইলে সে কার কাছে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে? সে কোথায় পালিয়ে বাঁচতে পারে?
এমনিভাবে আল্লাহ তা'আলা যেহেতু সারা জাহানের সবকিছুর মালিক, তাই মানুষ তার যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার বস্তু কেবল তাঁর কাছেই পেতে পারে। তিনি দিলেই পেতে পারে। তিনি দিতে না চাইলে কোথাও হতে তা পাওয়ার সাধ্য কারও নেই। কারও কাছ থেকেই পাওয়ার উপায় নেই। তাঁর কাছ থেকেও পাওয়া যায় কেবল তাঁর দয়াতেই। কেউ জোর করে তাঁর কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারে না। তাঁর কাছে কোনও শক্তিমানের শক্তি চলে না। সুতরাং কামনার বস্তু কেবল তাঁর কাছ থেকেই নিতে হবে। নিতে হবে অনুনয়-বিনয় করেই। চোখের পানি এর সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপায়।
মোটকথা আল্লাহ তা'আলার আযাব থেকে বাঁচতে চাইলে এবং তাঁর দয়া ও রহমত পেতে হলে চাই চোখের পানি ঝরানো। তাঁর কাছে বান্দার চোখের পানির বড় মূল্য।
আল্লাহর সামনে চোখের পানি ফেলার দ্বারা বান্দার অসহায়ত্বের প্রমাণ হয়। প্রকাশ পায় বান্দার বিনয় ও বন্দেগীর রূপ। তিনি অহংকারকে পসন্দ করেন না। বিনয়- বন্দেগীতে বিগলিতপ্রাণকে ভালোবাসেন। চোখের পানি সে বন্দেগী, সে অসহায়ত্ব ও সে বিগলনের নিদর্শন। তাই আল্লাহ তা'আলা এ পানির ফোঁটাকে বড় পসন্দ করেন।
বান্দার পক্ষে তার সর্বশ্রেষ্ঠ কাম্যবস্তু আল্লাহর ভালোবাসা। বরং প্রকৃত অর্থে তাই তো তার একমাত্র মাকসুদ। তার কোনও মাকসুদ নেই আল্লাহ ছাড়া। আল্লাহর কাছে তাঁর প্রিয়বান্দা কেবল তাঁকেই চায়। এ চাওয়া পূরণ হতে পারে কেবল ক্রন্দন ও চোখের পানি দ্বারাই। পার্থিব ভালোবাসার জনকে পাওয়ার জন্য চোখের পানিই তো সর্বাপেক্ষা প্রিয় বিসর্জন। যারা আল্লাহর আশেক-প্রেমিক, তারা তাদের পরম মাহবুবকে পাওয়ার জন্য সর্বাপেক্ষা দামি যে সম্পদ বিসর্জন দিতে পারে তা তার চোখের পানিই। প্রিয় আশেকের কাছে তিনি এটা কামনা করেন। এ পানির বড়ই মহিমা।
যাদের চোখ থেকে এ পানির ফোঁটা পড়ে, তিনি তাদের প্রশংসা করেছেন। সুতরাং এর বড় মূল্য, বড় মাহাত্ম্য। কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে সে মাহাত্ম্যের প্রকাশ ঘটেছে। বহু হাদীছ দ্বারাও তার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা যায়।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা এবার তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা সাহায্য করুন।

‘আল্লাহ তাআলার ভয় ও তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনায় ক্রন্দন করার ফযীলত সম্পর্কিত দুটি আয়াত

• এক নং আয়াত
قال الله تعالى: {ويخرون للأذقان يبكون ويزيدهم خشوعا} [الإسراء: 109]
অর্থ : 'এবং তারা কাঁদতে কাঁদতে থুতনির উপর লুটিয়ে পড়ে এবং এটা (অর্থাৎ কুরআন) তাদের অন্তরের বিনয় আরও বৃদ্ধি করে।

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে প্রকৃত জ্ঞানীজনদের বিশেষত্ব বলা হয়েছে যে, তাদের সামনে যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে, তারা আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে এবং তাদের বিনয় ও নম্রতা বৃদ্ধি পায়। এটা আল্লাহ তা'আলার কালামের মাহাত্ম্য যে, ভক্তি ও আন্তরিকতার সঙ্গে তা শুনলে হৃদয় বিগলিত হয়। অন্তর আল্লাহর আনুগত্যে উদ্দীপিত হয়। চোখে-মুখে কান্না চলে আসে। মাথা আপনিই নুয়ে পড়ে। যারা সত্যিকারের জ্ঞানী, তাদের এ হাল অবশ্যই সৃষ্টি হয় এবং এ কারণে আল্লাহ তাআলা তাদের প্রশংসা করেছেন। আমাদের মত যারা সাধারণ মানুষ, তারা আল্লাহর কালামের মাহাত্ম্য বুঝতে পারে না। তাদের অন্তরও থাকে উদাসীন। তাই তাদের সাধারণত এরকম অবস্থা হয় না। জ্ঞানীজনদের কাতারে শামিল হওয়ার জন্য তাদের উচিত কৃত্রিমভাবে হলেও নিজেদের দেহমনে এরকম ভাব ফুটিয়ে তোলা। কুরআনের তিলাওয়াত শুনবে আদবের সঙ্গে। কুরআন তিলাওয়াতকালে অন্তরে ভক্তি শ্রদ্ধা আনয়ন করবে। চেহারায় কান্নার আভাস ফুটিয়ে তুলবে। আল্লাহ তা'আলার কাছে এ কৃত্রিমতার মূল্য আছে। তিনি দুর্বল বান্দার কৃত্রিমতাকেও অকৃত্রিমরূপে গ্রহণ করে নেন।
কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা যেমন ইবাদত, তেমনি তিলাওয়াত শোনাও একটি ইবাদত। এ ইবাদতকালে যেমন বিনয় ও ভীতি কাম্য, তেমনি অন্যসব ইবাদতের সময়ও এরকম অবস্থা অবলম্বন করা চাই। বরং মহান আল্লাহর সামনে তাঁর একজন বান্দার সার্বক্ষণিক অবস্থাই হওয়া উচিত বিনয় ও ভীতিপূর্ণ। বান্দার প্রতিটি অবস্থাই তাঁর দৃষ্টির সামনে। যে-কোনও বড় ও ক্ষমতাধর ব্যক্তির সামনে মানুষ বিনয়-বিগলিত অবস্থা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে। আল্লাহ তা'আলার বড়ত্ব ও মাহাত্ম্যের সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। আমরা যখন সর্বদা সেই মহান আল্লাহর দৃষ্টির সামনে রয়েছি, তখন প্রতিটি ক্ষনেই বিনীত ও বিগলিতরূপেই থাকা বাঞ্ছনীয়। বান্দার এ বিনীত ও বিগলিতরূপ আল্লাহ তা'আলার পসন্দ। এ কারণেই আল্লাহ তা'আলার প্রিয় বান্দাগণ সর্বদা এই হালেই থাকতেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাদের অনুসরণ-অনুকরণের তাওফীক দান করুন।

• দুই নং আয়াত
{أفمن هذا الحديث تعجبون وتضحكون ولا تبكون} [النجم: 59]
অর্থ : 'তবে কি তোমরা এ কথারই বিস্ময়বোধ করছ? এবং (একে উপহাসের বিষয় বানিয়ে) হাসি-ঠাট্টা করছ এবং কান্নাকাটি করছ না?

ব্যাখ্যা
এখানে সূরা নাজমের দু'টি আয়াত রয়েছে। প্রথম আয়াতে কাফেরগণ যে কথার প্রতি বিস্ময়বোধ করে বলে জানানো হয়েছে, সে কথা দ্বারা হয়তো কুরআন মাজীদ বোঝানো হয়েছে, অথবা পুনরুত্থান দিবস। কাফেরগণ কুরআন মাজীদকে আল্লাহর কালাম বলে বিশ্বাস করত না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একে আল্লাহর কালাম বলে প্রচার করলে তারা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করত। তারা মনে করত তিনি নিজে এসব কথা তৈরি করে আল্লাহর নামে চালাচ্ছেন। তারা বিস্ময় প্রকাশ করে বোঝাতে চাইত, এটা বুঝি আল্লাহর কালাম, যা তোমার প্রতি নাযিল হবে বলে দাবি করছ! এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা তাদের সে বিস্ময় প্রকাশের নিন্দা করেছেন। বোঝানো হচ্ছে, এই যে অলৌকিক ও অসাধারণ বাণী, যার অনুরূপ বাণী রচনা করা কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, তাকে আল্লাহর কালাম বলায় তোমরা বিস্ময় প্রকাশ করছ কেন? তোমাদের তো উচিত এর সত্যতায় বিশ্বাস করা, এতে যা-কিছু বলা হয়েছে তা মেনে নেওয়া এবং এর ভিত্তিতে হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত স্বীকার করে নেওয়া।
অথবা এর দ্বারা পুনরুত্থান দিবস বোঝানো হয়েছে। এর পূর্বে সূরাটির ৫৭ নং আয়াতে পুনরুত্থান দিবসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গলিত, চূর্ণ-বিচূর্ণ ও মাটিতে মিশে যাওয়া অস্থিরাজিকে পূনরায় একত্রিত করে মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা কী করে সম্ভব, তা কাফেরগণ বুঝতে পারছিল না। এ কারণেই তারা পুনরুত্থান দিবসকে অস্বীকার করত এবং পুনরুত্থান দিবসের কথা বললে বিস্ময় প্রকাশ করত। এ আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা তাদের সে আচরণের নিন্দা করেছেন।
দ্বিতীয় আয়াতে জানানো হয়েছে যে, তারা কেবল বিস্ময় প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হতো না; বরং এ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করত ও হাসাহাসিও করত। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা হাসাহাসি করছ? তোমাদের তো উচিত ছিল কান্নাকাটি করা। কুরআন আল্লাহ তা'আলার এমন কালাম, যা শুনে প্রকৃত মুমিনের কান্নাই করা উচিত। পুনরুত্থান দিবসের কথা স্মরণ হলেও ভয়ে ক্রন্দন করা উচিত। কেননা তা হাসাহাসি করার মত তুচ্ছ বিষয় নয়। সে এক মহা বিভীষিকাময় দিন। আল্লাহ তা'আলা ভীষণ ক্রুদ্ধ অবস্থায় থাকবেন। প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হবে। উপযুক্ত জবাব দেওয়ার মত প্রস্তুতি কার আছে? আল্লাহ তা'আলা দয়া না করলে কে রেহাই পাবে? তাই হাসাহাসি নয়; বরং কাঁদো। সেদিন যাতে মুক্তি পেতে পার, সেজন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো।
কুরআন তিলাওয়াতকালে ক্রন্দন করা
হাদীছ নং: ৪৪৬

অর্থ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, আমার সামনে কুরআন তিলাওয়াত করো। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার সামনে কুরআন তিলাওয়াত করব, অথচ কুরআন আপনার প্রতিই অবতীর্ণ হয়েছে? তিনি বললেন, আমি অন্যের মুখে তিলাওয়াত শুনতে ভালোবাসি। সুতরাং আমি তাঁর সামনে সূরা নিসা পড়লাম। যখন এ আয়াতে পৌছলাম-
{فكيف إذا جئنا من كل أمة بشهيد وجئنا بك على هؤلاء شهيدا} [النساء: 41]
(অর্থ) সুতরাং (তারা ভেবে দেখুক)- সেদিন (তাদের অবস্থা) কেমন হবে, যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং (হে নবী), আমি তোমাকে ওইসব লোকের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব? - সূরা নিসা ৪১
তিনি বললেন, বাস, এবার থামো। আমি তাঁর দিকে ফিরে তাকালাম। দেখলাম তাঁর দু'চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে।– বুখারী ও মুসলিম
مقدمة الامام النووي
54 - باب فضل البكاء من خشية الله تَعَالَى وشوقًا إِليه
قَالَ الله تَعَالَى: {وَيَخِرُّونَ لِلأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزيدُهُمْ خُشُوعًا} [الإسراء: 109]، وقال تَعَالَى: {أَفَمِنْ هذَا الْحَدِيثِ تَعْجَبُونَ وَتَضْحَكُونَ وَلا تَبْكُونَ} [النجم: 59].
446 - وعن ابن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ لِي النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم: «اقْرَأْ عليَّ القُرْآنَ» قلت: يَا رسول اللهِ، أقرأُ عَلَيْكَ، وَعَلَيْكَ أُنْزِلَ؟! قَالَ: «إِنِّي أُحِبُّ أَنْ أسْمَعَهُ مِنْ غَيرِي» فَقَرَأْتُ عَلَيْهِ سورةَ النِّسَاءِ، حَتَّى جِئْتُ إِلى هذِهِ الآية: {فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هؤُلاءِ شَهيدًا} [النساء: 41] قَالَ: «حَسْبُكَ الآنَ» فَالَتَفَتُّ إِلَيْهِ فإذا عَيْنَاهُ تَذْرِفَان. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৪৪৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৪ আল্লাহ তাআলার ভয় ও তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনায় ক্রন্দন করার ফযীলত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক ভাষণে সাহাবায়ে কেরামের ক্রন্দন
হাদীছ নং: ৪৪৭

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সামনে ভাষণ দেন, যেরকম ভাষণ কখনও শুনিনি। তিনি বললেন, আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে, তবে অবশ্যই খুব কম হাসতে এবং খুব বেশি কাঁদতে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ তাদের মুখমণ্ডল ঢেকে ফেলেন এবং ডুকরে কাঁদতে থাকেন– বুখারী ও মুসলিম।
مقدمة الامام النووي
54 - باب فضل البكاء من خشية الله تعالى وشوقا إليه
447 - وعن أنس - رضي الله عنه - قَالَ: خطب رسول الله - صلى الله عليه وسلم - خُطْبَةً مَا سَمِعْتُ مِثْلَهَا قَطُّ، فقال: «لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أعْلَمُ، لَضَحِكْتُمْ قَليلًا وَلَبَكَيْتُمْ كَثِيرًا» قَالَ: فَغَطَّى أصْحَابُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - وُجُوهَهُمْ، وَلَهُمْ خَنِينٌ. متفقٌ عَلَيْهِ. (1) وَسَبقَ بَيَانُهُ في بَابِ الخَوْفِ.
হাদীস নং: ৪৪৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৪ আল্লাহ তাআলার ভয় ও তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনায় ক্রন্দন করার ফযীলত।
আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন ও জিহাদের ফযীলত
হাদীছ নং : ৪৪৮

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না, যে পর্যন্ত না দুধ ওলানে ফিরে যায়। আর আল্লাহর পথের ধুলাবালি ও জাহান্নামের ধোঁয়া কখনও একত্র হবে না - তিরমিযী।
مقدمة الامام النووي
54 - باب فضل البكاء من خشية الله تعالى وشوقا إليه
448 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «لا يَلِجُ النَّارَ رَجُلٌ بَكَى مِنْ خَشْيَةِ اللهِ حَتَّى يَعُودَ اللَّبَنُ في الضَّرْعِ، وَلاَ يَجْتَمِعُ غُبَارٌ في سبيلِ اللهِ وَدُخَانُ جَهَنَّمَ». رواه الترمذي، (1) وقال: «حديثٌ حَسنٌ صحيحٌ».
হাদীস নং: ৪৪৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৪ আল্লাহ তাআলার ভয় ও তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনায় ক্রন্দন করার ফযীলত।
যে সাত ব্যক্তি আল্লাহর রহমতের ছায়া লাভ করবে
হাদীছ নং : ৪৪৯

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সাত ব্যক্তি এমন যাদেরকে আল্লাহ সেই দিন নিজ (আরশের) ছায়ায় স্থান দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া অন্য কোনও ছায়া থাকবে না। তারা হল- ন্যায়পরায়ণ শাসক;
ওই যুবক যে মহান আল্লাহর ইবাদতের ভেতর বেড়ে উঠে;
ওই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে লটকে থাকে;
ওই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে একে অন্যকে ভালোবাসে, তাঁরই জন্য একত্র হয় এবং তাঁরই জন্য পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়;
ওই ব্যক্তি যাকে কোনও খান্দানী ও সুন্দরী নারী ডাকে আর উত্তরে সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি;
ওই ব্যক্তি যে কোনও দান-সদাকা করে, আর সে তা এমনভাবে গোপন করে যে, তার বাম হাত জানে না ডান হাত কী ব্যয় করে;
এবং ওই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে আর তার দুই চোখ অশ্রুপ্লাবিত হয় - বুখারী ও মুসলিম।
مقدمة الامام النووي
54 - باب فضل البكاء من خشية الله تعالى وشوقا إليه
449 - وعنه، قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ في ظِلِّهِ يَوْمَ لا ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ: إمَامٌ عَادِلٌ، وَشَابٌ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللهِ تَعَالَى، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ بِالمَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابّا في الله اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ، فَقال: إنِّي أَخَافُ الله، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُه مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ الله خَالِيًا ففاضت عَيْنَاهُ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৪৫০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৪ আল্লাহ তাআলার ভয় ও তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনায় ক্রন্দন করার ফযীলত।
নামাযে ক্রন্দন করা
হাদীছ নং: ৪৫০

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে শিক্ষীর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলাম, তখন তিনি নামায পড়ছিলেন আর কান্নার কারণে তাঁর পেট থেকে হাঁড়ির আওয়াজের মত আওয়াজ বের হচ্ছিল– আবু দাউদ ও তিরমিযী।
مقدمة الامام النووي
54 - باب فضل البكاء من خشية الله تعالى وشوقا إليه
450 - وعن عبد الله بن الشِّخِّير - رضي الله عنه - قَالَ: أتيتُ رسولَ الله - صلى الله عليه وسلم وَهُوَ يُصَلِّي ولِجَوْفِهِ أَزِيزٌ (1) كَأَزِيزِ المِرْجَلِ (2) مِنَ البُكَاءِ.
حديث صحيح رواه أَبو داود والترمذي في الشمائل بإسناد صحيح. (3)
হাদীস নং: ৪৫১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৪ আল্লাহ তাআলার ভয় ও তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনায় ক্রন্দন করার ফযীলত।
হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি.-এর বিশেষ মর্যাদা
হাদীছ নং : ৪৫১

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উবাঈ ইবনে কা'ব রাযি.-কে বলেন, মহান আল্লাহ আমাকে তোমার সামনে সূরা বাইয়্যিনা পড়তে আদেশ করেছেন। উবাঈ রাযি. বললেন, আল্লাহ কি আমার নাম নিয়ে বলেছেন? তিনি বললেন, হাঁ। তখন উবাঈ কেঁদে দিলেন - বুখারী ও মুসলিম ।
অপর এক রেওয়ায়েতে আছে, উবাই কাঁদতে লাগলেন ।
مقدمة الامام النووي
54 - باب فضل البكاء من خشية الله تعالى وشوقا إليه
451 - وعن أنس - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - لأُبَي بن كعب - رضي الله عنه: «إنَّ الله - عز وجل - أَمَرَنِي أَنْ أقْرَأَ عَلَيْكَ: {لَمْ يَكُنِ الَّذِينَ كَفَروا ... } قَالَ: وَسَمَّانِي؟ قَالَ: «نَعَمْ» فَبَكَى أُبَيٌّ. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
وفي رواية: فَجَعَلَ أُبَيٌّ يَبْكِي.
হাদীস নং: ৪৫২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৪ আল্লাহ তাআলার ভয় ও তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনায় ক্রন্দন করার ফযীলত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতে ওহীর ধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হযরত উম্মে আয়মান রাযি.-এর কান্না
হাদীছ নং : ৪৫২

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর হযরত আবূ বকর রাযি. উমর রাযি.-কে বললেন, চলুন আমরা উম্মে আয়মানের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাই, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন। যখন তাঁরা তাঁর কাছে পৌঁছলেন, তিনি কেঁদে দিলেন। তাঁরা তাঁকে বললেন, আপনি কাঁদছেন কেন? আপনি জানেন না, আল্লাহর কাছে খা আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য তাই শ্রেয়? তিনি বললেন, আমি এজন্য কাঁদছি না যে, আল্লাহর কাছে যা আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য যে তাই শ্রেয়, তা আমার জানা নেই। বরং আমি কাঁদছি এজন্য যে, আসমান থেকে ওহী নাযিলের ধারা ছিন্ন হয়ে গেল। তিনি এ কথা বলে তাঁদেরও কান্না উস্কে দিলেন । সুতরাং তাঁরাও তাঁর সঙ্গে কাঁদতে লাগলেন- মুসলিম।
مقدمة الامام النووي
54 - باب فضل البكاء من خشية الله تعالى وشوقا إليه
452 - وعنه، قَالَ: قَالَ أَبو بكر لِعُمَرَ، رَضِيَ اللهُ عنهما، بعد وفاة رسول الله - صلى الله عليه وسلم: انْطَلِقْ بِنَا إِلى أُمِّ أيْمَنَ رضي الله عنها نَزورُهَا، كَمَا كَانَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يَزُورُها، فَلَمَّا انْتَهَيَا إِلَيْهَا بَكَتْ، فقالا لها: مَا يُبْكِيكِ؟ أمَا تَعْلَمِينَ أنَّ مَا عِنْدَ الله تَعَالَى خَيرٌ لرسولِ الله - صلى الله عليه وسلم! قالت: مَا أبْكِي أَنْ لاَ أَكُونَ أَعْلَمُ أنَّ مَا عِنْدَ اللهِ خَيْرٌ لرسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - وَلكِنِّي أبكِي أَنَّ الْوَحْيَ قَد انْقَطَعَ مِنَ السَّمَاءِ؛ فَهَيَّجَتْهُما عَلَى البُكَاءِ، فَجَعَلا يَبْكِيَانِ مَعَهَا. رواه مسلم، وقد سبق في بابِ زِيارَةِ أهلِ الخَيْرِ. (1)
হাদীস নং: ৪৫৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৪ আল্লাহ তাআলার ভয় ও তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনায় ক্রন্দন করার ফযীলত।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর মনের কোমলতা
হাদীছ নং : ৪৫৩

অর্থ : হযরত ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোগ যখন তীব্র হয়ে উঠল, তখন তাঁকে নামাযের কথা বলা হলে তিনি বললেন, আবু বকরকে আদেশ করো যেন লোকদের নিয়ে নামায পড়ে। হযরত আয়েশা রাযি. বললেন, আবু বকর নরম মনের মানুষ। যখন তিনি কুরআন পড়বেন, তখন কান্না তাঁর উপর চেপে বসবে। তিনি বললেন, তাকে আদেশ করো যেন লোকদের নিয়ে নামায পড়ে।
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. থেকে অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেন, আমি বললাম, আবু বকর যখন আপনার জায়গায় দাঁড়াবেন, তখন কান্নার কারণে মানুষকে কুরআন শোনাতে পারবেন না - বুখারী ও মুসলিম।
مقدمة الامام النووي
54 - باب فضل البكاء من خشية الله تعالى وشوقا إليه
453 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما، قَالَ: لَمَّا اشْتَدَّ برسول الله - صلى الله عليه وسلم - وَجَعُهُ، قِيلَ له في الصَّلاَةِ، فقال: «مُرُوا أَبَا بَكْرٍ فَلْيُصَلِّ بِالنَّاسِ» فقالت عائشة رضي الله عنها: إنَّ أَبَا بَكْرٍ رَجُلٌ رَقِيقٌ، إِذَا قَرَأَ القُرْآنَ غَلَبَهُ البُكَاءُ، فقال: «مُرُوهُ فَليُصَلِّ».
وفي رواية عن عائشة، رضي الله عنها، قالت: قلت: إنَّ أَبَا بَكْرٍ إِذَا قَامَ مَقَامَكَ لَمْ يُسْمِعِ النَّاسَ مِنَ البُكَاءِ. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৪৫৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৪ আল্লাহ তাআলার ভয় ও তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনায় ক্রন্দন করার ফযীলত।
হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রাযি.-এর আল্লাহভীরুতা
হাদীস নং: ৪৫৪

ইবরাহীম ইবনে আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাঃ থেকে বর্ণিত আছে যে, আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রাযি.-এর সামনে খাবার আনা হল। তিনি ছিলেন রোযাদার। এ সময় তিনি বললেন, মুসআব ইবনে উমায়র শহীদ হয়েছেন এবং তিনি ছিলেন আমার চেয়ে উত্তম। একটি চাদর ছাড়া তাঁকে কাফন দেওয়ার মত কিছু পাওয়া গেল না। তা দ্বারা তাঁর মাথা ঢাকা হলে পা উন্মুক্ত থাকত আর পা ঢাকা হলে মাথা উন্মুক্ত থাকত। তারপর আমাদের জন্য দুনিয়া খুলে দেওয়া হল, যেমনটা
খুলে দেওয়া হয়েছে। অথবা বললেন, আমাদেরকে দুনিয়া দেওয়া হল, যেমনটা দেওয়া হয়েছে। আমাদের ভয় হয়, না জানি আমাদের নেক কাজসমূহের বদলা নগদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে! তারপর তিনি কাঁদতে লাগলেন, এমনকি খাবার রেখে দিলেন - বুখারী।
مقدمة الامام النووي
54 - باب فضل البكاء من خشية الله تعالى وشوقا إليه
454 - وعن إبراهيم بن عبد الرحمان بن عوف: أنَّ عبد الرحمان بن عوف - رضي الله عنه - أُتِيَ بطعام وكان صائِمًا، فقال: قُتِلَ مُصْعَبُ بن عُمَيْر - رضي الله عنه - وَهُوَ خَيْرٌ مِنِّي، فَلَمْ يوجَدْ له مَا يُكَفَّنُ فيهِ إِلاَّ بُرْدَةٌ (1) إنْ غُطِّيَ بِهَا رَأْسُهُ بَدَتْ رِجْلاهُ؛ وَإنْ غُطِّيَ بِهَا رِجْلاَهُ بَدَا رَأْسُهُ، ثُمَّ بُسِطَ لَنَا مِنَ الدُّنْيَا مَا بُسِطَ - أَو قَالَ: أُعْطِينَا مِنَ الدُّنْيَا مَا أُعْطِينَا - قَدْ خَشِينا أَنْ تَكُونَ حَسَنَاتُنَا عُجِّلَتْ لَنَا، ثُمَّ جَعَلَ يَبكِي حَتَّى تَرَكَ الطعَام. رواه البخاري. (2)
হাদীস নং: ৪৫৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৪ আল্লাহ তাআলার ভয় ও তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনায় ক্রন্দন করার ফযীলত।
আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় যে দু'টি ফোঁটা ও দু'টি চিহ্ন
হাদীছ নং : ৪৫৫

হযরত আবু উমামা বাহিলী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'টি বিন্দু ও দু'টি ছাপের চেয়ে বেশি প্রিয় কোনও বস্তু নেই। (বিন্দুদু'টির) একটি হল আল্লাহর ভয়ে নির্গত অশ্রুবিন্দু অপরটি হল আল্লাহর পথে প্রবাহিত রক্তবিন্দু। আর ছাপদু'টি হল আল্লাহর পথ (জিহাদে জখম হওয়া)-এর ছাপ এবং আল্লাহর ফরযসমূহের মধ্য থেকে কোনও ফরয (আদায়)- এর ছাপ - তিরমিযী।

হাদীসঃ ১৫৭ (পুনঃউল্লেখ)
হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া রাযি. বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নসীহত করলেন- এমন মর্মস্পর্শী উপদেশ যে, আমাদের হৃদয় তাতে ভীত-বিগলিত হল এবং চোখ অশ্রুসজল হল। আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা যেন বিদায় গ্রহণকারীর উপদেশ। সুতরাং আপনি আমাদেরকে অসিয়ত করুন। তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি আল্লাহভীতির এবং (আমীরের) পূর্ণ আনুগত্যের, যদিও তোমাদের আমীর হয়ে যায় কোনও হাবশী গোলাম। তোমাদের কেউ জীবিত থাকলে সে অনেক মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমাদের কর্তব্য হবে আমার সুন্নত ও হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নত আঁকড়ে ধরা। তোমরা তা মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরবে (অর্থাৎ শক্তভাবে আঁকড়ে ধরবে)। এবং তোমরা নব উদ্ভাবিত বিষয়সমূহ (অর্থাৎ যাবতীয় বিদ'আত) থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রতিটি বিদ'আতই গোমরাহী - আবু দাউদ ও তিরমিযী।
مقدمة الامام النووي
54 - باب فضل البكاء من خشية الله تعالى وشوقا إليه
455 - وعن أَبي أُمَامَة صُدَيِّ بن عجلان الباهلي - رضي الله عنه - عن النبي - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لَيْسَ شَيْءٌ أحَبَّ إِلى اللهِ تَعَالَى مِنْ قطْرَتَيْنِ وَأثَرَيْنِ: قَطَرَةُ دُمُوع مِنْ خَشْيَةِ اللهِ، وَقَطَرَةُ دَمٍ [ص:161] تُهَرَاقُ في سَبيلِ اللهِ. وَأَمَّا الأَثَرَانِ: فَأَثَرٌ في سَبيلِ اللهِ تَعَالَى، وَأَثَرٌ في فَريضةٍ مِنْ فَرائِضِ الله تَعَالَى». رواه الترمذي، (1) وقال: «حديثٌ حسنٌ».
وفي الباب أحاديث كثيرة منها:
حديث العرباض بن سارية - رضي الله عنه - قَالَ: وعظنا رسول الله - صلى الله عليه وسلم - مَوعظةً وَجلَتْ منها القُلُوبُ، وذرِفت منها الْعُيُونُ. وقد سبق في باب النهي عن البدع (2).
হাদীস নং: ৪৫৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তির ফযীলত, অল্পেতুষ্টির প্রতি উৎসাহদান ও দারিদ্র্যের মাহাত্ম্য

যুহদ অর্থ ত্যাগ করা। তুলনামূলক বেশি লাভজনক বা বেশি আগ্রহের বস্তু পাওয়ার লক্ষ্যে তদপেক্ষা নিম্নস্তরের বস্তু ছেড়ে দেওয়াকে যুহদ বলে। এককথায় একে দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তি বা নির্মোহ শব্দে ব্যক্ত করা হয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীছে বিষয়টি এভাবে স্পষ্ট করা হয়েছে যে-
الزهادة في الدُّنْيَا لَيْسَتْ بِتَحْرِيمُ الْحَلالِ وَلا إضَاعَةِ الْمَالِ، وَلكِنَّ الزَّهَادَةَ فِي الدُّنْيَا أَن لا تَكُونَ بِمَا فِي يَدَبَّكَ أَوْثَقَ مِمَّا فِي يَدِ اللهِ، وَأَنْ تَكُونَ فِي ثَوَابِ الْمُصِيَّة إِذا أنتَ أصِبْتَ بها أرغب فيها أو أنها أبقيت لك.
"দুনিয়ার প্রতি যুহদ বা নিরাসক্তির অর্থ হালালকে হারাম করা ও সম্পদ নষ্ট করে ফেলা নয়। বরং দুনিয়ার প্রতি যুহদ হল আল্লাহর হাতে যা আছে তা অপেক্ষা নিজের হাতে যা আছে তাতে বেশি আস্থাশীল না হওয়া এবং কোনও মুসিবত দেখা দিলে তা দূর হওয়া অপেক্ষা সে মসিবতের ছাওয়াবের প্রতি বেশি আগ্রহ থাকা।
হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. এ হাদীছের আলোকে বলেন, যুহদ হচ্ছে আত্মার একটি গুণ। এ হাদীছে তার আলামত বলে দেওয়া হয়েছে এবং এর দ্বারা যুহদ সম্পর্কে অনেকের ভুল ধারণা শুধরে দেওয়া হয়েছে।
অধিকাংশ আমলোক নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী মনে করে যাহিদ হল সেই লোক, যে দুনিয়ার যাবতীয় আনন্দ ও স্বাদের বস্তু পরিহার করে চলে যেমন হারাম বস্তু পরিহার করা হয়। এবং তাদের কাছে যা-কিছু আসে, সঙ্গে সঙ্গে তা খরচ করে ফেলে, তা ভুল জায়গাতেই হোক না কেন। এমনিভাবে কোনও বালা-মুসিবত দেখা দিলে মুক্তির কোনও ব্যবস্থা করে না। তাদের দৃষ্টিতে এরকম হওয়াই বুযুর্গীর শর্ত।
এ হাদীছ জানাচ্ছে, এসব মোটেই শর্ত নয়। বরং নিজ হাতের অর্থ-সম্পদ অপেক্ষা আল্লাহ তা'আলার উপর বেশি নির্ভরশীল থাকা জরুরি। আর বালা-মুসিবত যদিও কাঙ্ক্ষিত নয়, কিন্তু তার জন্য যে ছাওয়াবের ওয়াদা আছে তা পাওয়ার প্রতি আগ্রহী থাকা চাই। কাজেই মুসিবতের কারণে কেবল এজন্যই খুশি থাকা দরকার যে, তা প্রভৃত ছাওয়াবের কারণ (এর উদ্দেশ্য এ নয় যে, মসিবত থেকে মুক্তির কোনও চেষ্টা করা হবে না) - বাছায়েরে হাকীমুল উম্মত, পৃ. ৪০৮।
উহুদের যুদ্ধে প্রথমে অর্জিত বিজয়ের পর মাঝখানে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল, সে প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
{لِكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ } [الحديد: 23]
“তা এই জন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ, তার জন্য যাতে দুঃখিত না হও এবং যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন তার জন্য উল্লসিত না হও। আল্লাহ এমন কোনও ব্যক্তিকে পসন্দ করেন না, যে দর্প দেখায় ও বড়ত্ব প্রকাশ করে।
এ আয়াত স্পষ্টভাবেই বলছে যে, দুনিয়ার সম্পদ বা অন্য কোনওকিছুই হারানোর কারণে আক্ষেপ করতে নেই এবং অর্জনের দরুন উল্লসিতও হতে নেই। কেননা হারানোতে আক্ষেপ ও অর্জনে উল্লাস দুনিয়ার প্রতি মোহ ও আসক্তির ইঙ্গিত বহন করে, যা মুমিনদের মধ্যে থাকতে নেই।
কোনওকিছু হারালে যদি সবর করা যায় ও তার মধ্যেই কল্যাণ আছে বলে বিশ্বাস করা যায়, তবে তার বিপরীতে আখিরাতে অপরিমিত ছাওয়াব লাভ হয়। এমনিভাবে কোনওকিছু অর্জিত হলে উল্লাসের পরিবর্তে যদি সেজন্য শোকর আদায় করা হয় এবং আখিরাতের প্রতিদান আরও মূল্যবান বিবেচনায় আল্লাহর হুকুমমতো তা ব্যবহার বা খরচ করা হয়, তাতেও আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল হয়। তো সেই ছাওয়ার ও সন্তুষ্টিই হবে মুমিনের লক্ষ্যবস্তু। এটাই আয়াতের সারমর্ম। আর এরই নাম যুহদ।
হাকীমুল উম্মত থানভী রহ. বলেন, বস্তুত যুহদ হল আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে বান্দার অন্তরে প্রদত্ত নূর ও ইলম। সেই নূর ও ইলমের কারণে হৃদয়ের ফোয়ারা খুলে যায় ও সত্য উন্মোচিত হয়। তখন বুঝে আসে দুনিয়ার সাজ-সরঞ্জাম মাছির ডানা অপেক্ষাও তুচ্ছ এবং আখিরাতই উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।
এ নূর যার হাসিল হয়ে যায়, তার কাছে আখিরাতের বিপরীতে দুনিয়া এমনই হীন হয়ে যায় যে, বহুমূল্য মণিমুক্তার বিপরীতে ছেড়া ন্যাকড়ার যে মূল্য, তার চোখে দুনিয়ার ততটুকু মূল্যও থাকে না - বাছায়েরে হাকীমুল উম্মত, পৃ. ৪০৮
যুহদের বিপরীত হল দুনিয়ার মোহ ও আসক্তি। এটা সমস্ত রোগের মূল। এর কারণে মানুষের ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুল দুর্বল হয়ে যায়। তার মধ্যে দেখা দেয় কৃপণতা ও হিংসা-বিদ্বেষ। এক-এক করে অন্তরের সব ভালো গুণ নিঃশেষ হয়ে যায়, তার পরিবর্তে মন্দ খাসলতসমূহ শিকড় গেড়ে বসে। এ কারণেই এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
أول صلاح هذه الأمةِ بِالْيَقِينِ وَالزَّهْدِ، وَأَوَّلُ فَسَادِهَا بِالْبُخْلِ وَالأمل
"এ উম্মতের প্রথম গঠন-সংস্কার হয়েছে ইয়াকীন ও যুহদ দ্বারা। আর এ উম্মতের বিনাশ ও পচনের সূচনা হবে কৃপণতা ও দীর্ঘ আশা দ্বারা।"
প্রকাশ থাকে যে, যুহদ ও বৈরাগ্য এক নয়। ইসলামে বৈরাগ্য নিষেধ। এক দিকে যেমন বলা হয়েছে-
وَمَا الْحَيْوَةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
'আর (জান্নাতের বিপরীতে) পার্থিব জীবন তো প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।'
অপরদিকে ইরশাদ হয়েছে-
{ قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ} [الأعراف: 32]
'বলো, আল্লাহ নিজ বান্দাদের জন্য যে শোভার উপকরণ সৃষ্টি করেছেন, কে তা হারাম করেছে? এবং (এমনিভাবে) উৎকৃষ্ট জীবিকার বস্তুসমূহ? বল, এসব পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্য (এবং) কিয়ামতের দিনে বিশেষভাবে (তাদেরই)।
বস্তুত নিষেধ হচ্ছে দুনিয়ার আসক্তি; দুনিয়ার লিপ্ততা নয়। অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য, দীন, ঈমান ও ইজ্জতের হেফাজতের জন্য দুনিয়ার আসবাব- উপকরণ যতটুকু দরকার, ততটুকু অর্জন করা মোটেই নিষেধ নয়। বরং শরীআত তা অর্জনে উৎসাহিত করেছে। ঘর-সংসার উপেক্ষা করতে বলেনি। বরং সংসারজীবন যাপনের মধ্য দিয়ে হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ আদায়ে অনুপ্রাণিত করেছে।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর খাঁটি অনুসারীগণ সংসারজীবন যাপন করেছেন। তাঁরা স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের মহব্বত করেছেন। তাঁরা বিলাসিতা করেননি বটে, তবে রুচিসম্মত খাবার খেয়েছেন এবং রুচিসম্মত পোশাকও পরেছেন। তাঁরা এ সবই করেছেন আখিরাতমুখিতার সঙ্গে। করেছেন আল্লাহপ্রেমে নিমজ্জিত থাকার সঙ্গে। ফলে তাঁরা কোনওভাবেই যাতে আল্লাহ তা'আলার ও মাখলুকের কোনও হক নষ্ট না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে পেরেছেন। বরং তা আদায় করেছেন পরম নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। বস্তুত এই-ই যুহদ।
এ দৃষ্টিতে একজন ধনী ব্যক্তিও যাহিদ হতে পারে, আবার একজন গরীবও হতে পারে বিষয়াসক্ত ও দুনিয়াপ্রেমী। যে ধনী উপার্জন করে হালাল পথে, উপার্জনচেষ্টার পর যা অর্জিত হয় তাতে খুশি থাকে, অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় না, অর্জিত সম্পদ খরচ করে আল্লাহর হুকুমমতো এবং তা থেকে আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায়ে কার্পণ্য করে না, সে প্রকৃত যাহিদ বটে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো যাহিদ ছিলেনই, তাঁর সব সাহাবীও যাহিদ ছিলেন। ধনী সাহাবী হযরত উছমান গণী রাযি. ও আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযি. যেমন যাহিদ ছিলেন, তেমনি গরীব সাহাবী হযরত বিলাল রাযি., হযরত আম্মার রাযি. প্রমুখও যাহিদ ছিলেন। ইমাম আবূ হানীফা রাহঃ, ও আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. যেমন বড় ধনী ছিলেন, তেমনি বড় যাহিদও ছিলেন। অন্যদিকে যে গরীব ব্যক্তি ধনীর কাছ থেকে পাওয়ার আশায় থাকে, একটুতেই অন্যের কাছে হাত পাতে, হালাল-হারাম নির্বিচারে যখন যা পায় তাই লুফে নেয়, সে গরীব হয়েও পাক্কা দুনিয়াদার বৈকি। বস্তুত যুহুদ অন্তরের শিকড়বদ্ধ গুণ। ধন-সম্পদের কমবেশি দ্বারা তা প্রমাণ হয় না। প্রমাণ হয় আচার-আচরণ ও কর্মপন্থা দ্বারা। ইউনুস ইবন মায়সারা রহ. এর আলামত বলেন-
ليست الزَّهَادَةُ فِي الدُّنْيا بِتَحْرِيمِ الْحَلَالِ وَلا إضَاعَةِ الْمَالِ، وَلكِنِ الزَّهَادَةُ فِي الدُّنْيا أَن تَكُونَ بِمَا فِي بَدِ اللهِ أَولَقَ مِنْكَ مِمَّا فِي يَدَيْكَ، وَأَنْ يَكُونَ حَالُكَ فِي الْمُصِيبَةِ وَحَالُكَ إِذا لَمْ تُصَبُ بهَا سَوَاءَ، وَأَنْ يَكُونَ دَامَكَ وَمَادِحُكَ فِي الْحَقِّ سَوَاء.
“দুনিয়ার প্রতি যুহদ বা নিরাসক্তির অর্থ হালালকে হারাম করা ও সম্পদ নষ্ট করে ফেলা নয়। বরং দুনিয়ার প্রতি যুহদ হল আল্লাহর হাতে যা আছে তা অপেক্ষা নিজের হাতে যা আছে তাতে বেশি আস্থাশীল না হওয়া, বিপদ-আপদকালে তোমার মনের অবস্থা যেমন থাকে, স্বস্তি ও নিরাপত্তার কালেও ঠিক তেমনই থাকা, আর ন্যায়ের ক্ষেত্রে তোমার কাছে নিন্দুক ও প্রশংসাকারী সমান গণ্য হওয়া ।
যুহদের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে বহু আয়াত ও হাদীছ আছে।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন।

দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তির ফযীলত, অল্পেতুষ্টির প্রতি উৎসাহদান ও দারিদ্র্যের মাহাত্ম্য সম্পর্কিত কিছু আয়াত

• এক নং আয়াত

قَالَ الله تَعَالَى: {إِنَّمَا مَثَلُ الحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ والأَنْعَامُ حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيهَا أتَاهَا أمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأنْ لَمْ تَغْنَ بِالأَمْسِ كَذلِكَ نُفَصِّلُ الآياتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ} [يونس: 24]
অর্থ : 'পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত তো কিছুটা এরকম, যেমন আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করলাম, যদ্দরুন ভূমিজ সেইসব উদ্ভিদ নিবিড় ঘন হয়ে জন্মাল, যা মানুষ ও গবাদি পশু খেয়ে থাকে। অবশেষে ভূমি যখন নিজ শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে এবং তার মালিকগণ মনে করে এখন তা সম্পূর্ণরূপে তাদের আয়ত্তাধীন, তখন কোনও এক দিনে বা রাতে তাতে আমার নির্দেশ এসে পড়ে (এই মর্মে যে, তার উপর কোনও দুর্যোগ আপতিত হোক) এবং আমি তাকে কর্তিত ফসলের এমন শূন্য ভূমিতে পরিণত করি, যেন গতকাল তার অস্তিত্বই ছিল না। যেসকল লোক চিন্তা করে তাদের জন্য এভাবেই নিদর্শনাবলি সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করি।

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে পার্থিব জীবনের নশ্বরতাকে তুলনা করা হয়েছে এমন একটি শস্যক্ষেত্রের সঙ্গে, যা বৃষ্টি বর্ষণে সিঞ্চিত হয়ে মানুষ ও গবাদি পশুর খাদ্যোপযোগী ঘন উদ্ভিদরাজিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং দেখতে না দেখতে এক নয়নাভিরাম দৃশ্যে পরিণত হয়ে কৃষকের প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। তারপর যখন ফসল পেকে ওঠে আর কৃষকরা মনে করে সে ফসল তাদের আয়ত্তাধীন, যখন ইচ্ছা তারা তা কেটে ঘরে তুলতে পারবে, অমনি আল্লাহ তা'আলার আযাব ও গযব সম্পর্কিত নির্দেশ এসে পড়ে আর মুহুর্তের মধ্যে কৃষকদের হতাশ করে দিয়ে সেই ভরা ক্ষেত সম্পূর্ণ বিনাশ হয়ে খাঁ খাঁ মাঠে পরিণত হয়ে যায়। দেখলে মনে হয় যেন এখানে কখনও কোনওকিছুর অস্তিত্বই ছিল না।
আল্লাহ তা'আলা বোঝাচ্ছেন দুনিয়ার জীবনটাও এরকমই। তা দেখতে যতই সজীব ও চাকচিক্যপূর্ণ মনে হোক, তার কোনও স্থায়িত্ব নেই। নির্বোধ শ্রেণীর লোক বাহ্যিক চাকচিক্য ও সৌন্দর্য দেখে ধোঁকায় পড়ে যায়। তারা এর মোহে পড়ে আখিরাতের স্থায়ী জীবন ভুলে যায়। কিন্তু তাদের সে মোহ দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না। অনেক সময় বালা-মসিবত এসে মুহুর্তের মধ্যে সবকিছু তছনছ করে দেয়। আর মৃত্যু নামক এক অমোঘ বিধান তো রয়েছেই। যে-কোনও মুহূর্তে হানা দিয়ে সে নিমিষেই জীবনের সব রঙিন স্বপ্ন ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। তাই বুদ্ধিমান লোকের উচিত দুনিয়ার ক্ষণিকের চাকচিক্যে মাতোয়ারা না হয়ে স্থায়ী অবিনশ্বর আখিরাতের জীবন সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার সাধনায় রত হওয়া। এ আয়াত সে আহ্বানই আমাদের জানাচ্ছে।

• দুই নং আয়াত

وقال تَعَالَى: {وَاضْرِبْ لَهُمْ مَثَلَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بهِ نَبَاتُ الأَرْضِ فَأصْبَحَ هَشِيمًا تَذْرُوهُ الرِّيَاحُ وَكَانَ اللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقْتَدِرًا المَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَالبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا} [الكهف: 45 - 46]
অর্থ : 'তাদের কাছে পার্থিব জীবনের এই উপমাও পেশ কর যে, তা পানির মত, যা আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি, ফলে ভূমিজ উদ্ভিদ নিবিড় ঘন হয়ে যায়, তারপর তা এমন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়, যা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ ক্ষমতা রাখেন। সম্পদ ও সন্তান পার্থিব জীবনের শোভা। তবে যে সৎকর্ম স্থায়ী, তোমার প্রতিপালকের নিকট তা ছাওয়াবের দিক থেকেও উৎকৃষ্ট এবং আশা পোষণের দিক থেকেও উৎকৃষ্ট।

ব্যাখ্যা
এখানে দু'টি আয়াত আছে। প্রথম আয়াতটিতে উপরের আয়াতের মত পার্থিব জীবনের ঐশ্বর্য ও চাকচিক্যের ক্ষণস্থায়িত্বকে একটি উদাহরণ দ্বারা স্পষ্ট করা হয়েছে।। শুষ্ক ও মৃত ভূমি বৃষ্টির পানিতে সিঞ্চিত হয়ে বিভিন্ন উপকারী ফসল ও তৃণাদি উদ্‌গত করে। তারপর খুব দ্রুত তা বড় হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে তার সবুজ-শ্যামল দৃশ্য দর্শকের হৃদয়মন মাতিয়ে তোলে। কিন্তু সে সৌন্দর্য বেশি দিন স্থায়ী হয় না। আবার খরা দেখা দেয়। মাঠঘাট সব শুকিয়ে যায়। পানির অভাবে গাছপালাও শুকাতে থাকে। শুকাতে শুকাতে একদম ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। তারপর মনকাড়া সেই সবুজ-শ্যামল ভূমি ফের শুষ্ক মৃত প্রান্তরে পরিণত হয়ে যায়। পার্থিব জীবনের সবকিছুই এরকম। দু'দিনের বাহার। মৃত্যুতে সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরের আয়াতে আল্লাহ বলছেন, সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি পার্থিব জীবনের শোভা মাত্র। মৃত্যুর পর এসব কোনও কাজে আসে না। সেখানে কাজে আসে দুনিয়ায় করে যাওয়া সৎকর্ম। মানুষ যা-কিছু সৎকর্ম করে, তা স্থায়ী সম্পদরূপে থেকে যায়। মৃত্যুতে শেষ হয় না; বরং মৃত্যুর পরও বাকি থাকে এবং মৃত্যুপরবর্তী জীবনে তা-ই কাজে আসে। তাই সৎকর্মকে 'আল-বাকিয়াতুস সালিহাত' অর্থাৎ স্থায়ী পুণ্য বলা হয়েছে।
পুণ্য মাত্রই স্থায়ী, যেহেতু অনন্ত আখিরাতে তা কাজে আসবে। তাই এক হাদীছে
سُبْحانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ لله، ولا إله إلا الله، والله أكبر ولا حول ولا قوة إلا بالله
যিকরকে 'আল-বাকিয়াতুস সালিহাত' বলা হয়েছে।
আবার কোনও কোনও সৎকর্ম এমন, দুনিয়ায় যার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। এরূপ সৎকর্মকে সাধারণত সদকায়ে জারিয়া বলা হয়। যেমন ইলমে দীনের শিক্ষাদান, মসজিদ প্রতিষ্ঠা, ক্ষেত-খামার ওয়াকফ করা ইত্যাদি। এদিকে লক্ষ করলে সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি কেবল পার্থিব শোভা হয়েই থাকে না; স্থায়ী পুণ্যও হতে পারে। অর্থ ও সম্পদ যদি কোনও স্থায়ী সৎকর্মের খাতে ব্যয় করা হয়, তবে মৃত্যুর পরও তার ছাওয়াব জারি থাকে। এমনিভাবে সন্তান-সন্ততিকে নেককাররূপে গড়ে তুললে তাও একটি স্থায়ী পূণ্য। পিতা-মাতার আমলনামায় এর ছাওয়াব লেখা অব্যাহত থাকে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
«إذا مات الإنسان انقطع عنه عمله إلا من ثلاثة: من صدقة جارية، أو علم ينتفع به، أو ولد صالح يدعو له»
“মানুষ মারা গেলে তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল ব্যতিক্রম (অর্থাৎ তার ছাওয়াব জারি থাকে)। তা হচ্ছে- সদাকায়ে জারিয়া; ওই ইলম, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় আর নেককার সন্তান, যে তার জন্য (অর্থাৎ পিতা-মাতার জন্য) দুআ করবে।

তিন নং আয়াত

وقال تَعَالَى: {اعْلَمُوا أَنَّمَا الحَياةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ في الأَمْوَالِ وَالأَوْلاَدِ كَمَثَلِ غَيْثٍ أعْجَبَ الْكُفّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا وَفِي الآخِرَةِ عَذابٌ شَديدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِنَ الله ورِضْوَانٌ وَمَا الحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الغُرُورِ} [الحديد: 20]،
অর্থ : 'জেনে রেখ, পার্থিব জীবন তো কেবল খেলাধুলা, বাহ্যিক সাজসজ্জা, তোমাদের পারস্পরিক অহংকার প্রদর্শন এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে একে অন্যের উপরে থাকার প্রতিযোগিতারই নাম। তার উপমা হল বৃষ্টি, যা দ্বারা উদগত ফসল কৃষকদেরকে মুগ্ধ করে দেয়, তারপর তা তেজস্বী হয়ে ওঠে। তারপর তুমি দেখতে পাও তা হলুদ বর্ণ হয়ে গেছে। অবশেষে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। আর আখিরাতে (এক তো) আছে কঠিন শাস্তি এবং (আরেক আছে) আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে অত্যন্ত চমৎকারভাবে পার্থিব জীবনের হাকীকত তুলে ধরা হয়েছে। পার্থিব জীবনের মোটামুটি তিনটি স্তর শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য। শিশুকালে মানুষ খেলাধুলায় মেতে থাকে। যৌবনকালে সাজসজ্জা ও পারস্পরিক অহমিকা প্রদর্শন মূল লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। বৃদ্ধকালে ধনে-জনে কে কাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে সে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে এ তিনও স্তরের তিনওটি কাজ সম্পূর্ণ অসার ও নিরর্থক। ইহজীবনেই পর্যায়ক্রমে তা স্পষ্ট হতে থাকে।
শৈশবে খেলাধুলাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে হয়। কেউ তাতে ব্যাঘাত ঘটালে শিশুদের কাছে তা মহা ক্ষতিকর মনে হয়। কিন্তু যৌবনকাল আসলে তা নিয়ে হাসি পায়। তখন মনে হয় কী ফালতু কাজেই না মেতে থাকা হয়েছিল। যেই না বার্ধক্য শুরু হয়, অমনি বুঝে আসে অহেতুক সাজসজ্জা ও অহমিকা প্রদর্শনের পেছনে পড়ে জীবনের কত বড়ই না ক্ষতি করা হয়েছে। সে ক্ষতির প্রতিবিধান করার জন্য শুরু হয় প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা। ধনে-জনে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার দৌড়। তারপর হঠাৎ করে যখন মৃত্যু এসে হানা দেয়, তখন বুঝে আসে সে দৌড়ও ছিল নেহাতই আত্মপ্রবঞ্চনা। তখন মনে আক্ষেপ জাগে, কেন দুনিয়াদারীর ধোকায় পড়ে জীবনটা বরবাদ করা হল। আকাঙ্ক্ষা হয়, যদি একটুখানি সময় পাওয়া যেত, তবে মনেপ্রাণে সৎকর্মে লেগে পড়তাম। কিন্তু শেষ সময়ের এ আকাঙ্ক্ষা তো পূরণ হওয়ার নয়।
কুরআন মাজীদ জীবনের এ ক্ষণস্থায়ী চাকচিক্য ও আনন্দ-ফুর্তিকে ক্ষেত-খামারের ক্ষণিকের মনোহারিত্ব, তারপর তার আকস্মিক লোপাট হয়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছে। ফল-ফসলের ভূমিতে যখন বৃষ্টিপাত হয়, তখন উদ্ভিদরাজি সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে। তার নয়নাভিরাম দৃশ্যে মানুষ মুগ্ধ ও মোহিত হয়ে যায়। তারপর যদি খরা দেখা দেয়, তবে আস্তে আস্তে তা শুকাতে শুরু করে। একপর্যায়ে তা শুকিয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। মানুষ এরকমই। শিশুকালে ফুটন্ত ফুলের মত সুন্দর ও মনোহর থাকে। যৌবনকালে তার সৌন্দর্য ও সজীবতা পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয়। তারপর বার্ধক্য আসে। সৌন্দর্য ম্লান হতে শুরু করে। একপর্যায়ে তার রূপ ও শোভা সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়। মু'মিন ও কাফের সকলকেই এ অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তারপর মৃত্যু
আসে। শুরু হয় কবর ও আখিরাতের যিন্দেগী। তখন মানুষ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
কুরআন মাজীদ এ আয়াতে বলছে- "আর আখিরাতে (এক তো) আছে কঠিন শাস্তি এবং (আরেক আছে) আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি”। অর্থাৎ কাফের ও ফাসিকের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। সেখানে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা। মুমিনের ঠিকানা জান্নাত। তা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির স্থান। আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে ক্ষমা পেয়ে তারা অনন্ত সুখের সে ঠিকানায় স্থায়ী হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, كَمَثَلِ غَيْثٍ أعْجَبَ الْكُفّارَ نَبَاتُهُ
এর অর্থ এরকমও করা যায় যে, বৃষ্টিতে উদ্‌গত উদ্ভিদরাজি কাফেরদের মুগ্ধ ও মোহিত করে দেয়। বিশেষভাবে কাফেরদের কথা বলা হয়েছে এজন্য যে, সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে সৃষ্টির সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে পড়া কাফের- মুশরিকদেরই কাজ। যারা প্রকৃত মুমিন, তারা সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখে স্রষ্টার কথা মনে করে এবং তা দ্বারা তাঁর কুদরত ও ক্ষমতা অনুধাবন করে। ফলে তাদের আল্লাহ মুখিতা ও আনুগত্যের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
সবশেষে আল্লাহ বলেন; وَمَا الحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الغُرُورِ (পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়)। অর্থাৎ যারা দুনিয়ার ধন-সম্পদ দ্বারা আখিরাতের সাফল্য সন্ধান না করে বরং এর আসক্তিতেই মত্ত হয়ে যায়, তাদের জন্য দুনিয়া ও দুনিয়ার ধন- সম্পদ পুরোপুরি ধোঁকা। তারা মনে করে দুনিয়ার জীবনই প্রকৃত জীবন, এরপর আর কিছু নেই। কাজেই এখানে যতটা পার ফুর্তি করে নাও। অথচ আখিরাতের বিপরীতে দুনিয়া নিতান্তই তুচ্ছ। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَمَوْضِعُ سَوْطٍ أَحَدِكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا عَلَيْهَا.
“জান্নাতে তোমাদের একটা লাঠি রাখার স্থানও দুনিয়া ও দুনিয়ায় যা-কিছু আছে তারচে' উত্কৃষ্ট।
বস্তুত দুনিয়ার জীবন ও উপকরণের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে যে-কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তি সহজেই বুঝতে পারে যে, এ দুনিয়া ও দুনিয়ার আসবাবপত্র পুরোটাই কেবল ধোঁকা। এর উপর ভরসা রাখা যায় না। এর পেছনে দৌড়ঝাঁপ করা সম্পূর্ণ বেহুদা কাজ। তাই এতে মগ্ন না হয়ে আমাদের কর্তব্য হবে সর্বদা স্থায়ী অনন্ত আখিরাতের কথা মাথায় রাখা এবং সেই অনন্ত-অসীম জীবন যাতে সাফল্যমণ্ডিত হয়, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনকে সে লক্ষ্যে পরিচালনা করা।

চার নং আয়াত

وقال تَعَالَى: {زُيِّنَ لِلْنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالبَنِينَ وَالقَنَاطِيرِ المُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالفِضَّةِ وَالْخَيْلِ المُسَوَّمَةِ وَالأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ المآبِ} [آل عمران: 14]
অর্থ : 'মানুষের জন্য ওই সকল বস্তুর আসক্তিকে মনোরম করা হয়েছে, যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক অর্থাৎ নারী, সন্তান, রাশিকৃত সোনা-রুপা, চিহ্নিত অশ্বরাজি, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামার। এসব ইহজীবনের ভোগসামগ্রী। (কিন্তু) স্থায়ী পরিণামের সৌন্দর্য কেবল আল্লাহরই কাছে।

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে ৬টি জিনিস সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এগুলো মানুষের জন্য মনোরম ও আকর্ষণীয় করা হয়েছে। কে আকর্ষণীয় করেছে তা বলা হয়নি। কারণ এটা জানা কথা যে, তা আল্লাহ তা'আলাই করেছেন। তিনিই যাবতীয় বস্তু ও তার গুণাবলীর স্রষ্টা। এসবকে আকর্ষণীয় করার উদ্দেশ্য মানুষকে পরীক্ষা করা। কুরআন মাজীদের অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا
'নিশ্চিত জেনো, ভূপৃষ্ঠে যা-কিছু আছে আমি সেগুলোকে তার জন্য শোভাকর বানিয়েছি, মানুষকে এ বিষয়ে পরীক্ষা করার জন্য যে, কে তাদের মধ্যে বেশি ভালো কাজ করে।
দুনিয়া ও দুনিয়ার বস্তুরাজিকে সুশোভিত করে তোলার মধ্যে আল্লাহ তা'আলার বহুবিধ হিকমত আছে। এক তো তাদেরকে পরীক্ষা করা যে, কে এই শোভায় মুগ্ধ হয়ে একেই জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নেয় এবং কে একে জীবনের লক্ষ্যবস্তু না বানিয়ে বরং একে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ব্যবহার করে তাঁর সন্তুষ্টিবিধানকে জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানায়।
দ্বিতীয় হিকমত- ব্যক্তি ও সমাজজীবনের স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানব- অস্তিত্বে নিহিত বহুবিধ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানো আর এভাবে স্রষ্টার সঙ্গে তার সম্পর্ক নিবিড় করে তোলা। নারীর প্রতি আকর্ষণ না থাকলে কে অহেতুক সংসারজীবনের ঘানি টানত? কেই বা সোনা-রূপা, হীরা-জহরত ও মণিমুক্তা কুড়ানোর সংগ্রামে জীবনপাত করত, যদি না এসবের আকর্ষণ প্রণোদনা যোগাত? কেই বা ফল-ফসলের বাগান: বিন্যাস ও গবাদি পশুর খামার গড়ার পরিশ্রমে দিনরাত একাকার করত, যদি না এসবের শোভা ও লাভ মনে আনন্দ দান করত? সাধনা-গবেষণার এডভ্যাঞ্চারে অবতীর্ণ হয়ে মানুষ বন বাদাড়, মরুভূমি, সাগরতল ও দূর মহাকাশের কত অজানা রহস্য উদ্ঘাটন করেছে, মানবকল্যাণের নব-অভিনব দুয়ার উন্মোচন করেছে, কত সমৃদ্ধ ও সম্পন্ন আজ মানবসংগ্রহের ভাণ্ডার, সে ওই প্রাণ আকুল করা সৃষ্টিশোভার কল্যাণে নয় কি?
নফসের বিরুদ্ধে নিরন্তন সাধনা-মুজাহাদার মাধ্যমে আত্মা ও আত্মোৎকর্ষেরও এর মোক্ষম ব্যবস্থা এই বিত্ত-বস্তুর আকর্ষণ। আল্লাহর খাঁটি বান্দাগণ এ আকর্ষণ পাশ কাটিয়ে নিজেদের দিল-দেমাগ সর্বক্ষণ আল্লাহপ্রেমে নিমজ্জিত রাখার সাধনায় রত থাকেন। ফলে বিত্ত ও বস্তুর মধ্যে থাকা সত্ত্বেও এর মলিনতা তাদের স্পর্শ করতে পারে না। বরং এর বিরুদ্ধে মুজাহাদা তার আল্লাহপ্রাপ্তির কারণ হয়ে যায়।
আয়াতে বলা হয়েছে, এসব বস্তুর আসক্তি মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আকর্ষণীয় তো করা হয়েছে এসব বস্তু। মূলত 'বস্তুর আকর্ষণ'-এর স্থানে 'বস্তুর আসক্তির আকর্ষণ' বলার উদ্দেশ্য—এ আকর্ষণে নিমজ্জিত হওয়ার নিন্দায় তীব্রতা আনা। ইঙ্গিত করা হচ্ছে যে, মানুষ আকর্ষণীয় বস্তুর আসক্তিতে এত বেশি বিভোর যে, তারা বস্তুর ভালোবাসায় নিমজ্জিত তো বটেই, এমনকি তারা বস্তুর আকর্ষণকে পর্যন্ত ভালোবাসে। এটা কতইনা নিন্দনীয় ব্যাপার। মানুষের তো উচিত ছিল বস্তুর আকর্ষণ উপেক্ষা করে বস্তুর প্রতি সম্পূর্ণ নির্মোহ থাকা। তাদের কর্তব্য ছিল বস্তুর পরিবর্তে বস্তুর স্রষ্টার প্রতি নিবেদিত থাকা। উল্টো তারা বস্তুর আকর্ষণের ভালোবাসায় নিমজ্জিত হয়ে আছে।
আয়াতে সর্বপ্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে নারীর আকর্ষণকে। নারীর আকর্ষণের মধ্যে মানুষের বহুবিধ কল্যাণ নিহিত রয়েছে। কিন্তু আখিরাতবিমুখ মানুষ সে কল্যাণ অর্জনের পরিবর্তে নারীর আকর্ষণ দ্বারা নিজ দুনিয়া ও আখিরাত বরবাদ করে ফেলে।
তাই এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِتْنَةٌ هِيَ أَضَرُّ عَلَى الرِّجَالِ مِنَ النِّسَاءِ
"আমি আমার পরে পুরুষদের জন্য নারীদের চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর পরীক্ষার বিষয় আর কিছু রেখে যাইনি।
এ ক্ষতি হয় তখনই, যখন উদ্দেশ্য থাকে কেবলই দুনিয়া। পক্ষান্তরে উদ্দেশ্য যদি হয় দীন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি, তখন পুরুষের জন্য নারী এবং নারীর জন্য পুরুষ কতইনা উপকারী। সে ক্ষেত্রে উভয়ের জন্য উভয়ে পরম কাম্য। একবার মুহাজির ও আনসারগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমরা কোন সম্পদ গ্রহণ করব? তিনি উত্তরে বলেছিলেন-
لِسَانًا ذَاكِرًا، وَقَلْبًا شَاكِرًا، وَزَوْجَةً مُؤْمِنَةً تُعِيْنُهُ عَلَى إِيْمَانِهِ ‘
যিকরকারী জিহ্বা, শোকরকারী অন্তর ও মুমিনা স্ত্রী, যে তাকে তার ঈমানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।

আয়াতে উল্লেখিত দ্বিতীয় আকর্ষণীয় বস্তু হল সন্তান-সন্তুতি। সন্তান-সন্তুতি মানুষের জন্য আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় দান। এর মাধ্যমে পৃথিবীতে মানুষের বংশবিস্তার হয়, মানবপ্রজন্মের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। সন্তান সুসন্তান হলে তার দ্বারা দুনিয়ায়ও মানুষের মুখ উজ্জ্বল হয় এবং আখিরাতেও মুক্তির ব্যবস্থা হয়। নেককার সন্তান পিতা- মাতার জন্য সদকায়ে জারিয়াস্বরূপ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সন্তান-সন্ততিকে পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখে। ফলে এ ক্ষেত্রে তারা আখিরাত ভূলে যায়। তাদের জন্য সন্তান-সন্ততি আল্লাহ তা'আলার বহু হুকুম-আহকাম পালনে অন্তরায় হয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
إِنَّ الْوَلَدَ مَبْخَلَةٌ مَجْبَنَةٌ
‘সন্তান মানুষের কৃপণতা ও ভীরুতার কারণ।
আয়াতে উল্লেখিত তৃতীয় আকর্ষণীয় বস্তু হল সোনা-রূপা। সোনা-রুপা বলতে যেমন এর মূল ধাতু বোঝায়, তেমনি টাকা-পয়সাও। এর প্রতিও মানুষের আকর্ষণ স্বভাবগত। এর একটা বড় কারণ এর দ্বারা মনের চাহিদা পূরণ করা যায়। মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ইন্দ্রিয়সুখের অধিকাংশ উপকরণ এর দ্বারাই অর্জিত হয়ে থাকে। তাই মানুষ এ সম্পদ অর্জনের জন্য প্রাণের ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়ে ফেলে। এমনিতে এটা অর্জন দোষের নয়। দোষের হয় তখনই, যখন এর মোহে লিপ্ত হয়ে শরীআতের আদেশ-নিষেধ উপেক্ষা করা হয়। অন্যথায় শরীআত মোতাবেক এর আয়-ব্যয় করা হলে তা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে।চতুর্থ আকর্ষণীয় বস্তু দামী ঘোড়া। সেকালে ঘোড়া যেমন চলাফেরার কাজে ব্যবহার হতো, তেমনি এটা যুদ্ধ-বিগ্রহেরও অতি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ছিল। দিগবিজয়ী বীর ও রাজা-বাদশাদের কাছে এটা ছিল অতীব মূল্যবান সম্পদ। গাধা সেকালে একই কাজে ব্যবহৃত হতো। কুরআন মাজীদের অন্য এক আয়াতে এ তিন প্রকারের পশু সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
والْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَ الْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةً وَيَخْلُقُ مَا لَا تَعْلَمُونَ '
এবং ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা তিনিই সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাতে আরোহন করতে পার এবং তা তোমাদের শোভা হয়। তিনি সৃষ্টি করেন এমন বহু জিনিস, যা তোমরা জান না।
বর্তমানকালেও এর গুরুত্ব সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। তবে এখন এর স্থান দখল করে নিয়েছে যান্ত্রিক যানবাহন। একটি সুন্দর বাড়ির পাশাপাশি একটি মূল্যবান গাড়ি এখন মানুষের স্বপ্নের বস্তু। যার যত বেশি সম্পদ, সে তত মূল্যবান গাড়ি সংগ্রহের চেষ্টা করে। এটা অর্জনের জন্য হালাল-হারাম নির্বিচারে টাকা কামাইয়ের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। অন্যের উপর জুলুম-অত্যাচার চালায়। অর্জন হয়ে গেলে অন্যের উপর অহমিকা দেখায়। এগুলো সবই শরীআতবিরোধী। হাঁ, বৈধ উপায়ে যদি গাড়ি-ঘোড়া অর্জিত হয়ে যায় এবং অহংকার-অহমিকা থেকে বিরত থেকে এর সদ্ব্যবহার করা হয়, পাশাপাশি সুযোগমত একে মানবসেবায়ও কাজে লাগানো যায়, তবে এটা ছাওয়াব অর্জনেরও উপকরণ হতে পারে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الخَيْلُ ثَلاثَةٌ هِيَ لِرَجُلٍ وِزْرُ، وَهِيَ لِرَجُلٍ سِتْرُ، وَهِيَ لِرَجُلٍ أَجْرٌ
ঘোড়া তিন প্রকার। তা এক ব্যক্তির জন্য গুনাহ, এক ব্যক্তির জন্য (আত্মসম্মান রক্ষার) আবরণ এবং এক ব্যক্তির জন্য পুণ্য।
পঞ্চম আকর্ষণীয় বস্তু গবাদি পশু তথা উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি। এর কোনওটি পরিবহনের কাজে লাগে, কোনওটি খাদ্যচাহিদা পূরণ করে। আবার এগুলো একরকম শোভাও বটে। কুরআন মাজীদের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ (5) وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ (6) وَتَحْمِلُ أَثْقَالَكُمْ إِلَى بَلَدٍ لَمْ تَكُونُوا بَالِغِيهِ إِلَّا بِشِقِّ الْأَنْفُسِ إِنَّ رَبَّكُمْ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ (7)
তিনিই চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, যার মধ্যে তোমাদের জন্য শীত থেকে বাঁচার উপকরণ এবং তাছাড়া আরও বহু উপকার রয়েছে এবং তা থেকেই তোমরা খেয়েও থাক। তোমরা সন্ধ্যাকালে যখন সেগুলোকে বাড়িতে ফিরিয়ে আন এবং ভোরবেলা যখন সেগুলোকে চারণভূমিতে নিয়ে যাও, তখন তার ভেতর তোমাদের জন্য দৃষ্টিনন্দন শোভাও রয়েছে। এবং তারা তোমাদের ভার বয়ে নিয়ে যায় এমন নগরে, যেখানে প্রাণান্তকর কষ্ট ছাড়া তোমরা পৌঁছতে পারতে না। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের প্রতিপালক অতি মমতাময়, পরম দয়ালু।
বহুবিধ উপকারী এসব পশু সংগ্রহে মৌলিকভাবে কোনও দোষ নেই। এগুলো আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। তাঁর দেওয়া নি'আমতের গুরুত্ব বোঝা ও তার যথাযথ ব্যবহারই কাম্য। শরী'আত এর প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الإِبلُ عِز لِأَهْلِهَا، وَالْعَلَمُ بَرَكَةٌ
উট তার মালিকের পক্ষে মর্যাদা। আর ছাগলে রয়েছে বরকত।
এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাচাতো বোন উম্মে হানীকে লক্ষ্য করে বলেন-
اتَّخِذِي غَنَمًا فَإِنَّ فِيهَا بَرَكَةً
ছাগল প্রতিপালন কর, কেননা এর মধ্যে বরকত আছে।
অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে,
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَمْ يَضَعُ دَاءً إِلَّا وَضَعَ لَهُ شِفَاءٌ، فَعَلَيْكُمْ بِأَلْبَانِ الْبَقَرِ، فَإِنَّهَا تَرُمُّ مِنْ كُل الشجر
"আল্লাহ তা'আলা এমন কোনও রোগ দেননি, যার কোনও শেফা দেননি। তোমরা গরুর দুধ পান করো, কেননা গরু সর্বপ্রকার গাছগাছালি খেয়ে থাকে।"
এসব হাদীছ গবাদি পশু প্রতিপালনে উৎসাহ যোগায়। কাজেই প্রতিপালন ও ব্যবহার দোষের নয়। দোষ হল এর মোহ। এর শরী'আতনির্ধারিত হক আদায় না করা এবং এতে লিপ্ত হয়ে আখিরাত ভুলে যাওয়া হল এর প্রতি মোহমুগ্ধতার আলামত। অন্তরে থাকবে কেবলই আল্লাহর ভালোবাসা। দিল-দেমাগে থাকবে আখিরাতের চিন্তা। কাজকর্ম হবে শরী'আতনিষ্ঠ। এ সিফাতের সঙ্গে গবাদি পশুসহ দুনিয়ার যে-কোনও সম্পদ যত বেশিই অর্জন করা হোক, ইসলাম তাতে আপত্তি করে না। সর্বক্ষেত্রে এটাই মূল লক্ষণীয় বিষয়।
ষষ্ঠ আকর্ষণীয় বস্তু হল শস্যক্ষেত্র। শস্যক্ষেত্র যে কত চিত্তাকর্ষী ও নয়নাভিরাম হয়ে থাকে, এ অধ্যায়ের প্রথম তিন আয়াতে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু কোনও আয়াতেরই উদ্দেশ্য চাষাবাদে অনাগ্রহ সৃষ্টি করা নয়। প্রকৃত উদ্দেশ্য মানুষকে এর প্রতি নির্মোহ করা। মানুষ যাতে এর ব্যতিব্যস্ততায় আখিরাত না ভুলে যায়। এর সৌন্দর্য-শোভা যাতে মানুষকে আল্লাহবিমুখ করে না তোলে। অন্তরে আল্লাহপ্রেম ও আখিরাতের চিন্তা জাগ্রত রেখে চাষাবাদের কাজ করলে তা দুনিয়াদারী হয় না। এরূপ চরিত্রের মানুষ চাষাবাদের কাজ দ্বারাও আখিরাতের সাফল্য অর্জন করতে পারে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
«لا يغرس مسلم غرسا، ولا يزرع زرعا، فيأكل منه إنسان، ولا دابة، ولا شيء، إلا كانت له صدقة»
«لا يغرس رجل مسلم غرسا، ولا زرعا، فيأكل منه سبع أو طائر أو شيء، إلا كان له فيه أجر»
“কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি কোনও গাছ লাগায় বা ফসল বপন করে, তারপর কোনও হিংস্র পশু বা কোনও পাখি কিংবা অন্য কোনও কিছু তা থেকে খায়, তবে তাতে তার জন্য পুণ্য রয়েছে।
পরিশেষে আল্লাহ তা'আলা বলেন- ذَلِكَ مَتَاعُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ المآبِ
(এসব ইহজীবনের ভোগসামগ্রী। (কিন্তু) স্থায়ী পরিণামের সৌন্দর্য কেবল আল্লাহরই কাছে)। অর্থাৎ এর উপকার কেবল এই ক্ষণস্থায়ী ইহজীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই এতে দিল লাগানো উচিত নয়। কেননা তাতে আখিরাত বরবাদ হয় এবং দুনিয়ায় এগুলো উপকারের পাশাপাশি নানারকম ক্ষতিরও কারণ হয়। তাই প্রয়োজনমাফিক এসব ব্যবহার করবে বটে, তবে দিল-দেমাগ নিবিষ্ট রাখবে আল্লাহ তা'আলার স্মরণ ও আখিরাতের প্রতি। তাতে আখিরাতের নিশ্চিত কল্যাণ তো রয়েছেই, সেইসঙ্গে দুনিয়ায়ও এসবের মধ্যে যে উপকার আছে তা অর্জিত হয় আর যতটুকু ক্ষতি আছে তা থেকে বেঁচে থাকা যায়।

পাঁচ নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ فَلاَ تَغُرَّنَّكُمُ الحَياةُ الْدُّنْيَا وَلاَ يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الغَرُورُ} [فاطر: 5]
অর্থ : 'হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং এই পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে এবং আল্লাহর সম্পর্কেও যেন মহা ধোঁকাবাজ (শয়তান) তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে।

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ কিয়ামত সংঘটিত হওয়া ও কিয়ামতের দিন কর্মফল দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তা'আলা দিয়েছেন, তা অমোঘ সত্য। তার অন্যথা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং পার্থিব জীবনের ব্যতিব্যস্ততা যেন তোমাদেরকে আল্লাহর সে প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে। দুনিয়ার আকর্ষণ ও এর মোহমুগ্ধতা যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় ফেলতে না পারে। সেইসঙ্গে মহাপ্রতারক শয়তান তো আছেই। তোমরা যেন কিছুতেই তার ধোঁকায় না পড়ে যাও। আল্লাহ তা'আলা তাকে অবকাশ দিয়ে রেখেছেন। সে তোমাদেরকে ফাঁদে ফেলতে চাইবে। তোমাদেরকে আখিরাতের শাস্তির কথা ভুলিয়ে রেখে দুনিয়ার মোহে অন্ধ করে রাখতে চাইবে, যাতে সে নিজের সঙ্গে তোমাদেরকেও জাহান্নামে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সাবধান, তোমরা তার কুমন্ত্রণায় যেন পড়ে না যাও। সে তোমাদের চিরশত্রু। তাকে শত্রুরূপেই গ্রহণ করো। সর্বদা অন্তরে আল্লাহর ভয় রেখো এবং যাবতীয় কাজে আখিরাতের কথা চিন্তা করো।

ছয় নং আয়াত
{ألْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ المَقَابِرَ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ ثُمَّ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ كَلاَّ لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ} [التكاثر: 1 - 5]،
অর্থ : '(পার্থিব ভোগসামগ্রীতে) একে অন্যের উপর আধিক্য লাভের প্রচেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে পৌঁছ। কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। আবারও (শোন), কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। কক্ষনও নয়। তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের সাথে যদি এ কথা জানতে (তবে এরূপ করতে না)।

ব্যাখ্যা
এ আয়াতসমূহ সূরা তাকাছুরের। এ সূরায় মোট ৮টি আয়াত আছে। প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে-
ألْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ المَقَابِرَ
(একে অন্যের উপর আধিক্য লাভের প্রচেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে)। অর্থাৎ ধনে-জনে ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। তোমরা এসব নিয়ে অহংকার-অহমিকায় লিপ্ত হয়ে পড় আর সে অহমিকা তোমাদেরকে আখিরাত হতে গাফেল করে রাখে। ফলে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন ও শরী'আতের অনুসরণ সম্পর্কে তোমরা উদাসীন হয়ে থাক।
ইবনুল কায়্যিম রহ. পার্থিব আসবাব-উপকরণের পাশাপাশি এমনসব জ্ঞান-বিদ্যা অর্জনের প্রতিযোগিতাকেও এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন, যে জ্ঞান-বিদ্যার উদ্দেশ্য আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভ না। এমনিভাবে তার মতে যে আমল দ্বারা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভ করার উদ্দেশ্য থাকে না এবং যে আমল আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যলাভের দিকে এগিয়ে নেয় না, তাও এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যারা ইলম ও আমলে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় বিভোর, তাদেরও এদিকে লক্ষ রাখা উচিত, যাতে সে প্রচেষ্টা কেবল আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের জন্যই নিবেদিত থাকে।
দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে— ألْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ المَقَابِرَ (যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে পৌঁছ)। এর দুই অর্থ হতে পারে। এক অর্থ আক্ষরিক। আয়াতটির শানে নুযূলের দিকে লক্ষ করে আক্ষরিক অর্থ করারও অবকাশ আছে। অর্থাৎ অহমিকা প্রদর্শনার্থে বাস্তবিকই কবরস্থানে পৌঁছে যাওয়া। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, আনসার বা কুরায়শদের দু'টি গোত্র একে অপরের উপর ধন ও জন নিয়ে গর্ব করত। বলত, তোমাদের মধ্যে কি আমাদের অমুকের মত কেউ আছে? এমনকি কবরস্থানে গিয়ে কোনও কোনও কবরের দিকে ইঙ্গিত করে বলত, এই কবরে যে শুয়ে আছে, তার মত কেউ তোমাদের মধ্যে আছে বা কখনও ছিল? কিংবা বলত, অর্থ-সম্পদ ও লোকসংখ্যায় আমরা তোমাদের উপরে। সংখ্যাধিক্য প্রমাণের জন্য এমনকি তারা কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের সংখ্যাও হিসাব করত। আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে যে, নিজেদের আধিক্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য এমনকি তোমরা কবরস্থানেও হাজির হয়ে যাও।
দ্বিতীয় অর্থ প্রায়োগিক অর্থাৎ ইন্তিকাল করা। বলা হচ্ছে, হে মানুষ! তোমরা অর্থবিত্তে, লোকসংখ্যায় ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে একে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করে থাক। যতক্ষণ না তোমাদের মৃত্যু হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এ বড়াই তোমাদেরকে আখিরাত থেকে উদাসীন করে রাখে। অথচ তোমাদের এ বড়াই সম্পূর্ণ মিছে। যে ধন ও জন নিয়ে তোমরা বড়াই কর, মৃত্যুতে তার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে যায়। মৃত্যুর পর এসব কোনওই কাজে আসে না। মৃত্যুর পর কাজে আসে কেবলই নেক আমল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
يتبع الميت ثلاثة أهلُهُ وَمَالُهُ وَعَمَلُهُ فَيَرْجِعُ اثْنَانِ وَيَبْقَى وَاحِدٌ : يَرْجِعُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ
'মায়্যিতের পেছনে পেছনে যায় তিনটি জিনিস- তার পরিবার-পরিজন, তার সম্পদ ও তার আমল। তারপর দু'টি ফিরে আসে, থেকে যায় একটি। ফিরে আসে তার পরিবার-পরিজন ও সম্পদ আর থেকে যায় তার আমল ।
তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ ثُمَّ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ (কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। আবারও (শোন), কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে)। অর্থাৎ কিছুতেই শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাচুর্যের বড়াই করা উচিত নয়। এ বড়াই ও অহমিকার অশুভ পরিণাম তোমরা অচিরেই জানতে পারবে। মৃত্যু অতি সন্নিকটে। মৃত্যুর পর যখন কবরে পৌঁছবে এবং কবরের শাস্তির সম্মুখীন হবে, তখন জানতে পারবে এ বড়াই কতটা মিছে ছিল এবং ছিল কত অন্যায় ও অনুচিত।
একই কথা দুই আয়াতে দু'বার উচ্চারিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য, এ অনৌচিত্য ও এর অশুভ পরিণাম সম্পর্কিত সতর্কবাণীকে জোরদার করা। কারও কারও মতে এ দুই আয়াতের প্রথম আয়াতে সতর্ক করা হয়েছে মৃত্যুকালীন কষ্ট ও যন্ত্রণা অথবা কবরের আযাব সম্পর্কে। অর্থাৎ যখন মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হবে বা যখন কবরে পৌঁছবে ও কবরের আযাব শুরু হয়ে যাবে, তখন বুঝতে পারবে এ অহমিকা কত অসার ও অনুচিত ছিল। দ্বিতীয় আয়াতে সতর্ক করা হয়েছে পুনরুত্থানের পর হাশর ময়দানের বিভীষিকা সম্পর্কে। সেখানে যখন নিজ নিজ আমলের হিসাব-নিকাশ দিতে হবে, যখন আমলনামা সামনে খুলে দেওয়া হবে এবং দাড়িপাল্লায় নেকী-বদী ওজন করা হবে, তখন পার্থিব জীবনের সবরকম দর্প-অহংকারের হাকীকত খুলে যাবে। তখন বুঝতে পারবে এসব দর্প-অহংকার দেখানো কতটা নির্বুদ্ধিতা ছিল এবং এর পরিবর্তে বিনয়-নম্রতা অবলম্বন করে নেক আমলে যত্নবান থাকা কত জরুরি ছিল।
তারপর ইরশাদ হয়েছে- كَلاَّ لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ
“কক্ষনও নয়। তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের সাথে যদি জানতে (তবে এরূপ করতে না)"। এ আয়াত দ্বারা পূর্বের সতর্কীকরণকে অধিকতর বলিষ্ঠ করা হয়েছে। আয়াতে تَعْلَمُونَ
এর কর্মপদ উহ্য। অর্থাৎ তোমাদের সামনে কবরে ও হাশরে কী আছে এবং কী পরিস্থিতি তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে তা যদি নিশ্চিতভাবে জানতে। জানলে কী হতো তাও অব্যক্ত রাখা হয়েছে, যেহেতু একটু চিন্তা করলেই তা বোঝা যায়। অর্থাৎ নিশ্চিতভাবে তা জানলে তোমরা এসব দৰ্প ও বড়াই করতে না। বরং সবকিছু ভুলে গিয়ে সে চিন্তায় বিভোর থাকতে এবং সেজন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ পালনেই ব্যস্ত থাকতে।
ইমাম নববী রহ. যুহদ প্রসঙ্গে এখানে এ পাঁচটি আয়াতই উল্লেখ করেছেন। অবশিষ্ট তিন আয়াতও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। সুতরাং আমরা সংক্ষেপে সে তিন আয়াতেরও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
لَتَرَوُنَّ الْجَحِيمَ
(তোমরা জাহান্নাম অবশ্যই দেখবে)। অর্থাৎ মৃত্যুর পর কবরে জাহান্নাম দেখতে পাবে। শেষ বিচারের পর পাপীগণ তো জাহান্নামে নিক্ষিপ্তই হবে। কিন্তু তখনকার সে দেখা কোনও কাজে আসবে না। কেননা তখন প্রতিকারের কোনও সুযোগ থাকবে না।
মৃত ব্যক্তি কবরে থাকা অবস্থায় যে জাহান্নাম দেখতে পায়, কুরআন ও হাদীছ দ্বারা তা প্রমাণিত। যেমন ফিরআওন ও তার সম্প্রদায় সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
{ النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ } [غافر: 46]
“আগুন, যার সামনে তাদেরকে প্রতি সকাল-সন্ধ্যায় পেশ করা হয়। আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সে দিন (আদেশ করা হবে) ফিরআওনের সম্প্রদায়কে কঠিনতম শাস্তিতে প্রবেশ করাও ।
এক হাদীছে আছে-
إِذا مَاتَ أَحَدُكُمْ عُرِضَ عَلَيْهِ مَقْعَدُهُ، غُدْوَةً وَعَشِيًّا، إِمَّا النَّارُ وَإِمَّا الْجَنَّةُ، فَيُقَالُ: هَذَا مَفْعَدُكَ حَتَّى تُبْعَثَ إِلَيْهِ
‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন মারা যায়, তখন সকাল ও সন্ধ্যায় তার সামনে তার অবস্থানস্থল প্রকাশ করা হয়। হয় তা জাহান্নাম, নয়তো জান্নাত। তাকে বলা হয়, এই তোমার স্থান। পুনরুত্থানের পর তোমাকে এখানে পৌঁছানো হবে।
অপর এক হাদীছে আছে-
«وإن الكافر» فذكر موته قال: " وتعاد روحه في جسده، ويأتيه ملكان فيجلسانه فيقولان: له من ربك؟ فيقول: هاه هاه هاه، لا أدري، فيقولان له: ما دينك؟ فيقول: هاه هاه، لا أدري، فيقولان: ما هذا الرجل الذي بعث فيكم؟ فيقول: هاه هاه، لا أدري، فينادي مناد من السماء: أن كذب، فأفرشوه من النار، وألبسوه من النار، وافتحوا له بابا إلى النار " قال: «فيأتيه من حرها وسمومها» قال: «ويضيق عليه قبره حتى تختلف فيه أضلاعه» زاد في حديث جرير قال: «ثم يقيض له أعمى أبكم معه مرزبة من حديد لو ضرب بها جبل لصار ترابا» قال: «فيضربه بها ضربة يسمعها ما بين المشرق والمغرب إلا الثقلين فيصير ترابا» قال: «ثم تعاد فيه الروح»
'নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফের ব্যক্তির মৃত্যুর অবস্থা বর্ণনা করার পর ইরশাদ করেন, তার দেহে তার রূহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর তার কাছে দু'জন ফিরিশতা আসে। তারা তাকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমার রব্ব কে? সে বলে, হায় হায়, আমি তো জানি না! তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার দীন কী? সে বলে, হায় হায়, আমি তো জানি না। তারপর তারা জিজ্ঞেস করে, ওই ব্যক্তি কে, যাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল? সে বলে, হায় হায়, আমি তো জানি না! তখন আসমান থেকে এক ঘোষক ঘোষণা করে, সে মিথ্যা বলেছে। তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছাও এবং তাকে জাহান্নামের পোশাক পরাও আর তার জন্য জাহান্নামের দিকে একটা দুয়ার খুলে দাও ।

তারপর আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- لَتَرَوُنَّ الْجَحِيمَ (6) ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ الْيَقِينِمِ
(তোমরা অবশ্যই তা দেখবে চাক্ষুষ প্রত্যয়ে)। এর দ্বারা পূর্বের আয়াতের বক্তব্যকে শক্তিশালী করা হয়েছে। বোঝানো হচ্ছে, দুনিয়ায় ঈমানদারগণ কল্পনার চোখে বা অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা জাহান্নাম দেখতে পায়। তাদের এ দেখা চামড়ার চোখে নয়; বরং এটা তাদের বিশ্বাস ও সন্দেহাতীত জ্ঞান। তারা তাদের জ্ঞান ও বিশ্বাস দ্বারা উপলব্ধি করতে পারে জাহান্নামের শাস্তি কত কঠিন। কিন্তু মৃত্যুর পর এটা কেবল জ্ঞান ও বিশ্বাসের স্থলে থাকবে না; বরং চাক্ষুষ হয়ে যাবে। তারা চর্মচক্ষেই তখন জাহান্নাম দেখতে পাবে। এটা স্পষ্ট করার প্রয়োজন এ কারণেও ছিল যে, الرؤية শব্দটি যেমন 'চোখের দেখা' অর্থে ব্যবহৃত হয়, তেমনি মন-মস্তিষ্কের দেখা তথা 'জানা' অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আখিরাতে জাহান্নাম দেখার বিষয়টি কেবল জানা অর্থে নয়; বরং তা হবে পুরোপুরি চোখের দেখা। কেউ যাতে এটাকে জানা অর্থে না বোঝে, তাই আয়াতে لَتَرَوُنَّ عَيْنَ الْيَقِينِ(চাক্ষুষ প্রত্যয়) শব্দ ব্যবহার করে সে সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
সবশেষে আল্লাহ তা'আলা বলেন- ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ "অতঃপর সেদিন তোমাদেরকে নি'আমতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে (যে, তোমরা তার কী হক আদায় করেছ?)"। অর্থাৎ মানুষ ইহজীবনে যা-কিছু ভোগ করে, তার কৃতজ্ঞতা কে কতটুকু আদায় করেছে কিংবা আদৌ করেছে কি না? সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এটা জিজ্ঞেস করা হবে মুমিন-কাফের নির্বিশেষে সকলকেই।
কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা জানা যায়, আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে দেওয়া স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন যে, এর কী শোকর তারা আদায় করেছে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, শারীরিক সুস্থতা, চোখ ও কান সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা জিজ্ঞাসা করবেন, বান্দা এগুলো কী কাজে ব্যবহার করেছিল?
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, এ আয়াত নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমরা এমন কী নি'আমত ভোগ করছি? আমরা তো সামান্য যবের রুটি খেয়েই দিন কাটাচ্ছি। উত্তরে বলা হল, তোমরা কি জুতা পায়ে দাও না এবং ঠাণ্ডা পানি পান কর না? এটাও নি'আমতের অন্তর্ভুক্ত।
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ও উমর ফারূক রাযি.-কে সঙ্গে নিয়ে আবুল হায়ছাম রাযি.-এর বাড়িতে যান। তিনি তাদের খেজুর ও গোশত খাওয়ান এবং পানি পান করান। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, এটাই সে নি'আমত, যে সম্পর্কে কিয়ামতের দিন তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে।
মানুষের জ্ঞানও অনেক বড় নি'আমত। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা জানা যায়, কিয়ামতের দিন এ সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করা হবে। এমনকি জিজ্ঞেস করা হবে মানুষের প্রভাব- প্রতিপত্তি সম্পর্কে। তাছাড়া জিজ্ঞেস করা হবে আয়ু ও যৌবনকাল সম্পর্কেও। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لا تزول قدم ابن آدم يوم القيامة من عند ربه حتى يسأل عن خمس، عن عمره فيم أفناه، وعن شبابه فيم أبلاه، وماله من أين اكتسبه وفيم أنفقه، وماذا عمل فيما علم.
“কিয়ামতের দিন নিজ প্রতিপালকের সম্মুখ থেকে আদমসন্তানের পা সরতে পারবে না, যাবৎ না তাকে পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। জিজ্ঞেস করা হবে তার আয়ু সম্পর্কে, সে তা কিসে নিঃশেষ করেছে; তার যৌবন সম্পর্কে, সে তা কী কাজে জরাজীর্ণ করেছে; তার অর্থ-সম্পদ সম্পর্কে, সে তা কোথা হতে অর্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে; আর সে যা জানত সে অনুযায়ী কী আমল করেছে।
অবশ্য আল্লাহ তা'আলার এমন অনেক বান্দাও আছে, যারা বিনা হিসেবে জান্নাত লাভ করবে। তাদেরকে এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাদের মধ্যে শামিল করে নিন– আমীন।

সাত নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {وَمَا هذِهِ الحَياةُ الدُّنْيَا إِلاَّ لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا
يَعْلَمُونَ} [العنكبوت: 64]
অর্থ : 'এই পার্থিব জীবন খেলাধুলা ছাড়া কিছুই নয়। বস্তুত আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত।

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ খেলাধুলার যেমন স্থায়িত্ব নেই এবং তা মানুষকে অন্যসব কাজ থেকে গাফেল করে রাখে, তেমনি মানুষের পার্থিব জীবন ও জীবনের উপকরণসমূহেরও কোনও স্থায়িত্ব নেই। আর এতে লিপ্ত মানুষ তার আসল ঠিকানা আখিরাত ভুলে যায়। সে উদাসীন হয়ে পড়ে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের চেষ্টা হতে। সে গাফেল হয়ে যায় শরীআতের বিধান পালন থেকে। মানুষ দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা, পদ ও পদবী, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সুনাম-সুখ্যাতির পেছনে দৌড়ঝাঁপ করে। কিন্তু এসবের স্থায়িত্ব কতটুকু? অথচ এর পেছনে পড়ে আখিরাতের স্থায়ী জীবন বরবাদ করে দেয়! এ আয়াত সতর্ক করছে যে, মানুষ যেন এসবে মাতোয়ারা হয়ে তার আখিরাত ভুলে না যায়। তাকে মনে রাখতে হবে আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন। সে জীবন স্থায়ী। সেখানে কোনও মৃত্যু নেই। জান্নাত চিরসুখের ঠিকানা। সেখানে কোনও কষ্ট-ক্লেশ নেই। তাই মানুষকে সেই প্রকৃত জীবনের সফলতা লাভের জন্যই সচেষ্ট থাকতে হবে।
এর অর্থ এ নয় যে, মানুষ দুনিয়ার সকল উপকরণ থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে যাবে। জীবনরক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ দোষের নয়। বরং সে সংগ্রহ যদি আল্লাহ তা'আলার জন্য হয় এবং হয় শরী'আত মোতাবেক, তবে তা খেলাধুলা বলে গণ্য হবে না । ইসলাম তাকে আখিরাতের কাজ বলেই গণ্য করে। এক হাদীছে ইরশাদ-
ألا إِنَّ الدُّنْيا مَلْعُوْنَةٌ، مَلْعُونٌ مَا فِيهَا، إِلَّا ذِكرُ الله، وَمَا وَالاهُ، وَعَالِم أو مُتَعَلم
“শোন! দুনিয়া অভিশপ্ত। অভিশপ্ত এর সবকিছুই। ব্যতিক্রম কেবল আল্লাহর যিকর এবং ওইসকল কাজ, যা বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। আর ব্যতিক্রম আলেম ও ইলমে দীনের সন্ধানী।”
যেসকল কাজ বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়, তার মধ্যে যেমন আছে নামায-রোযা, তেমনি আছে হালাল উপার্জন, দান-খয়রাত ও সৃষ্টির সেবাও। যেসব কাজ সদকায়ে জারিয়ারূপে গণ্য তার জন্য বিভিন্ন আসবাব-উপকরণের প্রয়োজন হয়। সেগুলো সংগ্রহের চেষ্টা নিশ্চয়ই অভিশপ্ত কাজ নয়; বরং আল্লাহ তা'আলার কাছে প্রশংসনীয় কাজ বলেই গণ্য হবে, যেহেতু তা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের উপলক্ষ্য। ইসলাম যেহেতু বৈরাগ্য ও সন্ন্যাসবাদের দীন নয়, তাই পার্থিব জীবনের জন্য প্রাসঙ্গিক কোনওকিছুই নিন্দনীয় নয়, যদি তা নিছক ভোগের জন্য না হয়। এবং তার অর্জন ও ব্যবহার হয় শরী'আতসম্মতভাবে। দুনিয়ার কাজকর্ম যদি কেবল দুনিয়াদারীর জন্যই হয়, নিছক ভোগাসক্তির জন্য হয়, তবে সেটাই নিন্দনীয়। আয়াত সেটাকেই খেলতামাশা সাব্যস্ত করেছে।
দুনিয়ার প্রাচুর্য নিয়ে উম্মত সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভয়:
হাদীছ নং : ৪৫৬

অর্থ : হযরত আমর ইবন আওফ আনসারী রাযি. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযি.-কে বাহরাইনে পাঠান সেখানকার জিযিয়া নিয়ে আসার জন্য। তিনি বাহরাইন থেকে অর্থ-সম্পদ নিয়ে ফিরে আসলেন। আনসারগণ আবূ উবায়দার আগমনের কথা শুনতে পেলেন। ফলে তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ফজরের নামাযে মিলিত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষ করলে তারা তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন। তাদেরকে দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে দিলেন। তারপর বললেন, আমার মনে হয় তোমরা শুনতে পেয়েছ আবু উবায়দা বাহরাইন থেকে কিছু নিয়ে এসেছে। তারা বললেন, হাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি বললেন, তোমরা সুসংবাদ নাও এবং যা তোমাদের আনন্দিত করবে তার আশা কর। আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের জন্য দারিদ্র্যের ভয় করি না। বরং আমি ভয় করি যে, তোমাদের জন্য দুনিয়া প্রশস্ত করে দেওয়া হবে, যেমনটা প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য। ফলে তোমরা পরস্পর রেষারেষিতে লিপ্ত হবে, যেমনটা তারা রেষারেষিতে লিপ্ত হয়েছিল। পরিণামে তা তোমাদের ধ্বংস করবে, যেমন তাদের ধ্বংস করেছিল - বুখারী ও মুসলিম।
مقدمة الامام النووي
55 - باب فضل الزهد في الدنيا والحث عَلَى التقلل منها وفضل الفقر
قَالَ الله تَعَالَى: {إِنَّمَا مَثَلُ الحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ والأَنْعَامُ حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيهَا أتَاهَا أمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأنْ لَمْ تَغْنَ بِالأَمْسِ كَذلِكَ نُفَصِّلُ الآياتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ} [يونس: 24]، وقال تَعَالَى: {وَاضْرِبْ لَهُمْ مَثَلَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بهِ نَبَاتُ الأَرْضِ فَأصْبَحَ هَشِيمًا تَذْرُوهُ الرِّيَاحُ وَكَانَ اللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقْتَدِرًا المَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَالبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا} [الكهف: 45 - 46]، وقال تَعَالَى: {اعْلَمُوا أَنَّمَا الحَياةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ في الأَمْوَالِ وَالأَوْلاَدِ كَمَثَلِ غَيْثٍ أعْجَبَ الْكُفّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا وَفِي الآخِرَةِ عَذابٌ شَديدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِنَ الله ورِضْوَانٌ وَمَا الحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الغُرُورِ} [الحديد: 20]، وقال تَعَالَى: {زُيِّنَ لِلْنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالبَنِينَ وَالقَنَاطِيرِ المُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالفِضَّةِ وَالْخَيْلِ المُسَوَّمَةِ وَالأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ المآبِ} [آل عمران: 14]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ فَلاَ تَغُرَّنَّكُمُ الحَياةُ الْدُّنْيَا وَلاَ يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الغَرُورُ} [فاطر: 5]، وقال تَعَالَى: {ألْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ المَقَابِرَ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ ثُمَّ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ كَلاَّ لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ} [التكاثر: 1 - 5]، وقال تَعَالَى: {وَمَا هذِهِ الحَياةُ الدُّنْيَا إِلاَّ لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا
يَعْلَمُونَ} [العنكبوت: 64] والآيات في الباب كثيرة مشهورة.
وأما الأحاديث فأكثر مِنْ أن تحصر فننبِّهُ بطرف منها عَلَى مَا سواه.
456 - عن عمرو بن عوف الأنصاري - رضي الله عنه: أنَّ رسولَ الله - صلى الله عليه وسلم - بَعَثَ أَبَا عبيدة بنَ الجَرَّاح - رضي الله عنه - إِلَى الْبَحْرَيْنِ يَأتِي بِجِزْيَتِهَا، فَقَدِمَ بمَالٍ مِنَ الْبَحْرَيْنِ، فَسَمِعَتِ الأَنْصَارُ بقُدُومِ أَبي عُبيْدَةَ، فَوَافَوْا صَلاَةَ الفَجْرِ مَعَ رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - فَلَمَّا صَلَّى رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - انْصَرفَ، فَتَعَرَّضُوا لَهُ، فَتَبَسَّمَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - حِيْنَ رَآهُمْ، ثُمَّ قَالَ: «أَظُنُّكُمْ سَمِعْتُمْ أنَّ أَبَا عُبَيْدَةَ قَدِمَ بِشَيْءٍ مِنَ الْبَحْرَيْنِ؟» فقالوا: أجل، يَا رسول الله، فقال: «أبْشِرُوا وَأَمِّلْوا مَا يَسُرُّكُمْ، فَوالله مَا الفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ، وَلكِنِّي أخْشَى أَنْ تُبْسَط الدُّنْيَا عَلَيْكُمْ كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا، فَتُهْلِكَكُمْ كَمَا أهْلَكَتْهُمْ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৪৫৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৫ দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তির ফযীলত, অল্পেতুষ্টির প্রতি উৎসাহদান ও দারিদ্র্যের মাহাত্ম্য।
৪৫৭। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে বসলেন। আমরা তাঁর চারপাশে বসলাম। তিনি বললেন, আমি আমার পরবর্তীকালে যে ব্যাপারে তোমাদের জন্য ভয় করি, তা হল তোমাদের উপর দুনিয়ার চাকচিক্য ও সৌন্দর্য উন্মোচিত হয়ে যাওয়া - বুখারী ও মুসলিম।
مقدمة الامام النووي
55 - باب فضل الزهد في الدنيا والحث على التقلل منها وفضل الفقر
457 - وعن أَبي سعيد الخدري - رضي الله عنه - قَالَ: جلس رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - عَلَى الْمِنْبَرِ، وَجَلَسْنَا حَوْلَهُ، فقال: «إنَّ ممَّا أَخَافُ عَلَيْكُمْ مِنْ بَعْدِي مَا يُفْتَحُ عَلَيْكُمْ مِنْ زَهْرَةِ الدُّنْيَا وَزِينَتِهَا». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৪৫৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৫ দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তির ফযীলত, অল্পেতুষ্টির প্রতি উৎসাহদান ও দারিদ্র্যের মাহাত্ম্য।
দুনিয়ার রূপ ও শোভা দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা
হাদীছ নং : ৪৫৮

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দুনিয়া সুমিষ্ট ও সুদৃশ্যময় বস্তু। আল্লাহ তা'আলা এখানে তোমাদের প্রতিনিধি বানিয়েছেন। তিনি দেখবেন, তোমরা কেমন আমল কর। সুতরাং তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো দুনিয়া সম্পর্কে এবং তাকওয়া অবলম্বন করো নারীদের সম্পর্কে - মুসলিম।
مقدمة الامام النووي
55 - باب فضل الزهد في الدنيا والحث على التقلل منها وفضل الفقر
458 - وعنه: أن رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «إنَّ الدُّنْيَا حُلْوَةٌ خَضِرَةٌ وَإنَّ الله تَعَالَى مُسْتَخْلِفُكُمْ فِيهَا، فَيَنْظُرُ كَيْفَ تَعْمَلُونَ، فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاءَ». رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ৪৫৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৫ দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তির ফযীলত, অল্পেতুষ্টির প্রতি উৎসাহদান ও দারিদ্র্যের মাহাত্ম্য।
ইসলামী জীবনবোধের চূড়ান্ত কথা
হাদীছ নং : ৪৫৯

অর্থ : হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে আল্লাহ! আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন – বুখারী ও মুসলিম।
مقدمة الامام النووي
55 - باب فضل الزهد في الدنيا والحث على التقلل منها وفضل الفقر
459 - وعن أنس - رضي الله عنه: أن النبي - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «اللَّهُمَّ لاَ عَيْشَ إِلاَّ عَيْشَ الآخِرَةِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীস নং: ৪৬০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫৫ দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তির ফযীলত, অল্পেতুষ্টির প্রতি উৎসাহদান ও দারিদ্র্যের মাহাত্ম্য।
মৃত ব্যক্তি যা সঙ্গে নিয়ে যায়
হাদীছ নং : ৪৬০

আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মায়্যিতের পেছনে পেছনে যায় তিনটি জিনিস- তার পরিবার-পরিজন, তার সম্পদ ও তার আমল। তারপর দু'টি ফিরে আসে, থেকে যায় একটি। ফিরে আসে তার পরিবার-পরিজন ও সম্পদ, আর থেকে যায় কেবল তার আমল - বুখারী ও মুসলিম।
مقدمة الامام النووي
55 - باب فضل الزهد في الدنيا والحث على التقلل منها وفضل الفقر
460 - وعنه، عن رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «يَتْبَعُ الْمَيِّتَ ثَلاَثَةٌ: أهْلُهُ وَمَالُهُ وَعَمَلُهُ: فَيَرْجِعُ اثْنَانِ، وَيَبْقَى وَاحِدٌ: يَرْجِعُ أهْلُهُ وَمَالُهُ وَيبْقَى عَمَلُهُ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)