রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৪৬
আল্লাহ তাআলার ভয় ও তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনায় ক্রন্দন করার ফযীলত

চোখের পানি বড় শক্তিশালী জিনিস। এটা অসহায়ের অব্যর্থ অবলম্বন। দুনিয়ায় দেখা যায় কেউ যখন কারও কাছ থেকে তার কাম্যবস্তুটি পেতে চায় আর সেজন্য সর্বপ্রকার উপায় অবলম্বন করেও ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন সে সবশেষে চোখের পানি ফেলে। সে পানিতে দাতার কঠোর মন নরম হয়ে যায়। আর তখন সে তা দিতে রাজি হয়ে যায়।
চোখের পানি ফেলে শিশুরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে কত আবদারই না পূরণ করে নেয়। বিপন্ন ব্যক্তি চোখের পানি দ্বারা কঠোর-কঠিন ও দুর্দান্ত শাসককে পর্যন্ত নরম করে ফেলে। যাচনাকারীর চোখের পানি সাধারণত কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে না। তাই দুনিয়ার সকল ক্ষেত্রেই সকল যাচনাকারী, সকল অসহায় উপায়হীন ব্যক্তি শেষ দাওয়াই হিসেবে চোখের পানি ব্যবহার করে থাকে।
আল্লাহ তাআলা সব অসহায়ের আসল সহায়। তাঁর সহায়তা বিনে পৃথিবীর দুর্বলতম ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রচণ্ড শক্তিমান পর্যন্ত সকলেই সত্যিকারের অসহায়। বিশেষত আল্লাহ তা'আলার আযাব ও গযব থেকে তার নিজের আশ্রয় ছাড়া কারও কোনও আশ্রয়স্থল নেই। এ ক্ষেত্রে কোনও মাখলুক, সে যতো শক্তিশালীই হোক না কেন, কাউকে কিছুমাত্র সহায়তা দিতে পারে না। তিনি কাউকে শাস্তি দিতে চাইলে সে কার কাছে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে? সে কোথায় পালিয়ে বাঁচতে পারে?
এমনিভাবে আল্লাহ তা'আলা যেহেতু সারা জাহানের সবকিছুর মালিক, তাই মানুষ তার যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার বস্তু কেবল তাঁর কাছেই পেতে পারে। তিনি দিলেই পেতে পারে। তিনি দিতে না চাইলে কোথাও হতে তা পাওয়ার সাধ্য কারও নেই। কারও কাছ থেকেই পাওয়ার উপায় নেই। তাঁর কাছ থেকেও পাওয়া যায় কেবল তাঁর দয়াতেই। কেউ জোর করে তাঁর কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারে না। তাঁর কাছে কোনও শক্তিমানের শক্তি চলে না। সুতরাং কামনার বস্তু কেবল তাঁর কাছ থেকেই নিতে হবে। নিতে হবে অনুনয়-বিনয় করেই। চোখের পানি এর সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপায়।
মোটকথা আল্লাহ তা'আলার আযাব থেকে বাঁচতে চাইলে এবং তাঁর দয়া ও রহমত পেতে হলে চাই চোখের পানি ঝরানো। তাঁর কাছে বান্দার চোখের পানির বড় মূল্য।
আল্লাহর সামনে চোখের পানি ফেলার দ্বারা বান্দার অসহায়ত্বের প্রমাণ হয়। প্রকাশ পায় বান্দার বিনয় ও বন্দেগীর রূপ। তিনি অহংকারকে পসন্দ করেন না। বিনয়- বন্দেগীতে বিগলিতপ্রাণকে ভালোবাসেন। চোখের পানি সে বন্দেগী, সে অসহায়ত্ব ও সে বিগলনের নিদর্শন। তাই আল্লাহ তা'আলা এ পানির ফোঁটাকে বড় পসন্দ করেন।
বান্দার পক্ষে তার সর্বশ্রেষ্ঠ কাম্যবস্তু আল্লাহর ভালোবাসা। বরং প্রকৃত অর্থে তাই তো তার একমাত্র মাকসুদ। তার কোনও মাকসুদ নেই আল্লাহ ছাড়া। আল্লাহর কাছে তাঁর প্রিয়বান্দা কেবল তাঁকেই চায়। এ চাওয়া পূরণ হতে পারে কেবল ক্রন্দন ও চোখের পানি দ্বারাই। পার্থিব ভালোবাসার জনকে পাওয়ার জন্য চোখের পানিই তো সর্বাপেক্ষা প্রিয় বিসর্জন। যারা আল্লাহর আশেক-প্রেমিক, তারা তাদের পরম মাহবুবকে পাওয়ার জন্য সর্বাপেক্ষা দামি যে সম্পদ বিসর্জন দিতে পারে তা তার চোখের পানিই। প্রিয় আশেকের কাছে তিনি এটা কামনা করেন। এ পানির বড়ই মহিমা।
যাদের চোখ থেকে এ পানির ফোঁটা পড়ে, তিনি তাদের প্রশংসা করেছেন। সুতরাং এর বড় মূল্য, বড় মাহাত্ম্য। কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে সে মাহাত্ম্যের প্রকাশ ঘটেছে। বহু হাদীছ দ্বারাও তার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা যায়।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা এবার তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা সাহায্য করুন।

‘আল্লাহ তাআলার ভয় ও তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনায় ক্রন্দন করার ফযীলত সম্পর্কিত দুটি আয়াত

• এক নং আয়াত
قال الله تعالى: {ويخرون للأذقان يبكون ويزيدهم خشوعا} [الإسراء: 109]
অর্থ : 'এবং তারা কাঁদতে কাঁদতে থুতনির উপর লুটিয়ে পড়ে এবং এটা (অর্থাৎ কুরআন) তাদের অন্তরের বিনয় আরও বৃদ্ধি করে।

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে প্রকৃত জ্ঞানীজনদের বিশেষত্ব বলা হয়েছে যে, তাদের সামনে যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে, তারা আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে এবং তাদের বিনয় ও নম্রতা বৃদ্ধি পায়। এটা আল্লাহ তা'আলার কালামের মাহাত্ম্য যে, ভক্তি ও আন্তরিকতার সঙ্গে তা শুনলে হৃদয় বিগলিত হয়। অন্তর আল্লাহর আনুগত্যে উদ্দীপিত হয়। চোখে-মুখে কান্না চলে আসে। মাথা আপনিই নুয়ে পড়ে। যারা সত্যিকারের জ্ঞানী, তাদের এ হাল অবশ্যই সৃষ্টি হয় এবং এ কারণে আল্লাহ তাআলা তাদের প্রশংসা করেছেন। আমাদের মত যারা সাধারণ মানুষ, তারা আল্লাহর কালামের মাহাত্ম্য বুঝতে পারে না। তাদের অন্তরও থাকে উদাসীন। তাই তাদের সাধারণত এরকম অবস্থা হয় না। জ্ঞানীজনদের কাতারে শামিল হওয়ার জন্য তাদের উচিত কৃত্রিমভাবে হলেও নিজেদের দেহমনে এরকম ভাব ফুটিয়ে তোলা। কুরআনের তিলাওয়াত শুনবে আদবের সঙ্গে। কুরআন তিলাওয়াতকালে অন্তরে ভক্তি শ্রদ্ধা আনয়ন করবে। চেহারায় কান্নার আভাস ফুটিয়ে তুলবে। আল্লাহ তা'আলার কাছে এ কৃত্রিমতার মূল্য আছে। তিনি দুর্বল বান্দার কৃত্রিমতাকেও অকৃত্রিমরূপে গ্রহণ করে নেন।
কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা যেমন ইবাদত, তেমনি তিলাওয়াত শোনাও একটি ইবাদত। এ ইবাদতকালে যেমন বিনয় ও ভীতি কাম্য, তেমনি অন্যসব ইবাদতের সময়ও এরকম অবস্থা অবলম্বন করা চাই। বরং মহান আল্লাহর সামনে তাঁর একজন বান্দার সার্বক্ষণিক অবস্থাই হওয়া উচিত বিনয় ও ভীতিপূর্ণ। বান্দার প্রতিটি অবস্থাই তাঁর দৃষ্টির সামনে। যে-কোনও বড় ও ক্ষমতাধর ব্যক্তির সামনে মানুষ বিনয়-বিগলিত অবস্থা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে। আল্লাহ তা'আলার বড়ত্ব ও মাহাত্ম্যের সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। আমরা যখন সর্বদা সেই মহান আল্লাহর দৃষ্টির সামনে রয়েছি, তখন প্রতিটি ক্ষনেই বিনীত ও বিগলিতরূপেই থাকা বাঞ্ছনীয়। বান্দার এ বিনীত ও বিগলিতরূপ আল্লাহ তা'আলার পসন্দ। এ কারণেই আল্লাহ তা'আলার প্রিয় বান্দাগণ সর্বদা এই হালেই থাকতেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাদের অনুসরণ-অনুকরণের তাওফীক দান করুন।

• দুই নং আয়াত
{أفمن هذا الحديث تعجبون وتضحكون ولا تبكون} [النجم: 59]
অর্থ : 'তবে কি তোমরা এ কথারই বিস্ময়বোধ করছ? এবং (একে উপহাসের বিষয় বানিয়ে) হাসি-ঠাট্টা করছ এবং কান্নাকাটি করছ না?

ব্যাখ্যা
এখানে সূরা নাজমের দু'টি আয়াত রয়েছে। প্রথম আয়াতে কাফেরগণ যে কথার প্রতি বিস্ময়বোধ করে বলে জানানো হয়েছে, সে কথা দ্বারা হয়তো কুরআন মাজীদ বোঝানো হয়েছে, অথবা পুনরুত্থান দিবস। কাফেরগণ কুরআন মাজীদকে আল্লাহর কালাম বলে বিশ্বাস করত না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একে আল্লাহর কালাম বলে প্রচার করলে তারা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করত। তারা মনে করত তিনি নিজে এসব কথা তৈরি করে আল্লাহর নামে চালাচ্ছেন। তারা বিস্ময় প্রকাশ করে বোঝাতে চাইত, এটা বুঝি আল্লাহর কালাম, যা তোমার প্রতি নাযিল হবে বলে দাবি করছ! এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা তাদের সে বিস্ময় প্রকাশের নিন্দা করেছেন। বোঝানো হচ্ছে, এই যে অলৌকিক ও অসাধারণ বাণী, যার অনুরূপ বাণী রচনা করা কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, তাকে আল্লাহর কালাম বলায় তোমরা বিস্ময় প্রকাশ করছ কেন? তোমাদের তো উচিত এর সত্যতায় বিশ্বাস করা, এতে যা-কিছু বলা হয়েছে তা মেনে নেওয়া এবং এর ভিত্তিতে হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত স্বীকার করে নেওয়া।
অথবা এর দ্বারা পুনরুত্থান দিবস বোঝানো হয়েছে। এর পূর্বে সূরাটির ৫৭ নং আয়াতে পুনরুত্থান দিবসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গলিত, চূর্ণ-বিচূর্ণ ও মাটিতে মিশে যাওয়া অস্থিরাজিকে পূনরায় একত্রিত করে মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা কী করে সম্ভব, তা কাফেরগণ বুঝতে পারছিল না। এ কারণেই তারা পুনরুত্থান দিবসকে অস্বীকার করত এবং পুনরুত্থান দিবসের কথা বললে বিস্ময় প্রকাশ করত। এ আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা তাদের সে আচরণের নিন্দা করেছেন।
দ্বিতীয় আয়াতে জানানো হয়েছে যে, তারা কেবল বিস্ময় প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হতো না; বরং এ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করত ও হাসাহাসিও করত। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা হাসাহাসি করছ? তোমাদের তো উচিত ছিল কান্নাকাটি করা। কুরআন আল্লাহ তা'আলার এমন কালাম, যা শুনে প্রকৃত মুমিনের কান্নাই করা উচিত। পুনরুত্থান দিবসের কথা স্মরণ হলেও ভয়ে ক্রন্দন করা উচিত। কেননা তা হাসাহাসি করার মত তুচ্ছ বিষয় নয়। সে এক মহা বিভীষিকাময় দিন। আল্লাহ তা'আলা ভীষণ ক্রুদ্ধ অবস্থায় থাকবেন। প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হবে। উপযুক্ত জবাব দেওয়ার মত প্রস্তুতি কার আছে? আল্লাহ তা'আলা দয়া না করলে কে রেহাই পাবে? তাই হাসাহাসি নয়; বরং কাঁদো। সেদিন যাতে মুক্তি পেতে পার, সেজন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো।
কুরআন তিলাওয়াতকালে ক্রন্দন করা
হাদীছ নং: ৪৪৬

অর্থ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, আমার সামনে কুরআন তিলাওয়াত করো। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার সামনে কুরআন তিলাওয়াত করব, অথচ কুরআন আপনার প্রতিই অবতীর্ণ হয়েছে? তিনি বললেন, আমি অন্যের মুখে তিলাওয়াত শুনতে ভালোবাসি। সুতরাং আমি তাঁর সামনে সূরা নিসা পড়লাম। যখন এ আয়াতে পৌছলাম-
{فكيف إذا جئنا من كل أمة بشهيد وجئنا بك على هؤلاء شهيدا} [النساء: 41]
(অর্থ) সুতরাং (তারা ভেবে দেখুক)- সেদিন (তাদের অবস্থা) কেমন হবে, যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং (হে নবী), আমি তোমাকে ওইসব লোকের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব? - সূরা নিসা ৪১
তিনি বললেন, বাস, এবার থামো। আমি তাঁর দিকে ফিরে তাকালাম। দেখলাম তাঁর দু'চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে।– বুখারী ও মুসলিম
54 - باب فضل البكاء من خشية الله تَعَالَى وشوقًا إِليه
قَالَ الله تَعَالَى: {وَيَخِرُّونَ لِلأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزيدُهُمْ خُشُوعًا} [الإسراء: 109]، وقال تَعَالَى: {أَفَمِنْ هذَا الْحَدِيثِ تَعْجَبُونَ وَتَضْحَكُونَ وَلا تَبْكُونَ} [النجم: 59].
446 - وعن ابن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ لِي النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم: «اقْرَأْ عليَّ القُرْآنَ» قلت: يَا رسول اللهِ، أقرأُ عَلَيْكَ، وَعَلَيْكَ أُنْزِلَ؟! قَالَ: «إِنِّي أُحِبُّ أَنْ أسْمَعَهُ مِنْ غَيرِي» فَقَرَأْتُ عَلَيْهِ سورةَ النِّسَاءِ، حَتَّى جِئْتُ إِلى هذِهِ الآية: {فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هؤُلاءِ شَهيدًا} [النساء: 41] قَالَ: «حَسْبُكَ الآنَ» فَالَتَفَتُّ إِلَيْهِ فإذا عَيْنَاهُ تَذْرِفَان. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যের মুখে তিলাওয়াত শুনতে পসন্দ করতেন। এর কারণ অন্যের মুখে তিলাওয়াত শুনলে কুরআনের বাণী বোঝা ও তাতে চিন্তা-ফিকির করা সহজ হয়। যেহেতু তখন মন-মস্তিষ্ক কুরআনের বাণী ও মর্মের মধ্যেই নিবিষ্ট থাকে। পক্ষান্তরে নিজে যখন তিলাওয়াত করা হয়, তখন মনোযোগ থাকে শব্দাবলীর বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও যথাযথ পাঠের প্রতি। তাছাড়া নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত শ্রবণেও বিশেষভাবে অভ্যস্ত ছিলেন। হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম পাঠ করতেন আর তিনি শুনতেন। মানুষ যে বিষয়ে অভ্যস্ত থাকে, তার প্রতি আগ্রহ বেশি থাকে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করতে আদেশ করলে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. তাঁর সামনে সূরা নিসা পাঠ করতে থাকেন। তিনি পাঠ করতে করতে সূরা নিসার ৪১ নং আয়াত পর্যন্ত পৌঁছান। তাতে ইরশাদ হয়েছে
{فكيف إذا جئنا من كل أمة بشهيد وجئنا بك على هؤلاء شهيدا} [النساء: 41]
'সুতরাং (তারা ভেবে দেখুক ) - সেদিন (তাদের অবস্থা) কেমন হবে, যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং (হে নবী), আমি তোমাকে ওইসব লোকের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব??

এ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষান্ত হতে বললেন। হযরত ইবন মাস'উদ রাযি. ক্ষান্ত হয়ে যখন তাঁর দিকে তাকালেন, দেখলেন তাঁর চোখ থেকে পানি পড়ছে।

এ আয়াত পাঠকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন কাঁদছিলেন? ইবনুন নাহবী রহ. বলেন, তিনি কাঁদছিলেন এ কারণে যে, আল্লাহ তা'আলা যখন তাঁকে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করবেন, তখন তাঁকে সাক্ষ্য তো দিতেই হবে। নিয়ম হল, সাক্ষীর সাক্ষ্য অনুযায়ী বিচারক ফয়সালা দিয়ে থাকেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন উম্মত সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবেন, তখন আল্লাহ তা'আলা তো সে অনুসারেই ফয়সালা দেবেন। উম্মতের মধ্যে এমন তো কতই আছে, যারা শরী'আত অনুযায়ী আমল করেনি। তাদের সম্পর্কে যখন তিনি সাক্ষ্য দেবেন, তখন তাদের কী পরিণতি হবে? এ কথা ভেবেই তিনি কেঁদেছিলেন।

এ আয়াতে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাক্ষীরূপে হাজির করা হবে, প্রশ্ন হচ্ছে তাঁর সাক্ষ্য হবে কাদের সম্পর্কে? অর্থাৎ এর দ্বারা কাদের বোঝানো হয়েছে? উলামায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, এর দ্বারা নবীগণকে বোঝানো হয়েছে। আয়াতটির অর্থ হল, আমি প্রত্যেক উম্মতের নবীকে হাজির করব এবং সেই নবী নিজ উম্মতের ভালোমন্দ কার্যকলাপ সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবেন। এভাবে প্রত্যেক নবী নিজ নিজ উম্মত সম্পর্কে সাক্ষ্যদান করবেন। সবশেষে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত নবীর সত্যতার পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন।

কেউ কেউ বলেন, এখানে মূলত উম্মতের মুমিনগণকে বোঝানো হয়েছে। তারা নবীগণের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন যে, তারা নিজ নিজ উম্মতের কাছে দাওয়াত পৌঁছিয়েছিলেন আর নবীগণ যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তা সত্য। পরিশেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই মুমিনদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন যে, তারা সত্য সাক্ষ্যই দিয়েছে। নবীগণের পক্ষে এ উম্মতের মুমিনদের সাক্ষ্যদান সম্পর্কে সূরা বাকারায় ইরশাদ হয়েছে-
جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا (হে মুসলিমগণ!) এভাবেই আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি,যাতে তোমরা অন্যান্য লোক সম্পর্কে সাক্ষী হও এবং রাসূল হন তোমাদের পক্ষে সাক্ষী।

অপর এক আয়াতে ইরশাদ-
لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ 'যাতে এই রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হতে পারে আর তোমরা সাক্ষী হতে পার অন্যান্য মানুষের জন্য।

কারও মতে هَؤُلَاءِ এর দ্বারা এ উম্মতকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ অন্যান্য নবী যেমন নিজ নিজ উম্মত সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবেন, তেমনি আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নিজ উম্মত সম্পর্কে সাক্ষ্যদান করবেন। যেমন কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এ আয়াত পাঠ করা হলে তিনি কেঁদে দেন এবং আরয করেন, হে আমার রব্ব, আমি যাদের মধ্যে আছি তাদের সম্পর্কে তো এটা সম্ভব, কিন্তু আমি যাদের দেখিনি তাদের সম্পর্কে কিভাবে সাক্ষ্য দেব? অপর এক বর্ণনা দ্বারা এর উত্তর পাওয়া যায়। তাতে আছে-
ليس من يوم إلا يعرض فيه على النبي صلى الله عليه وسلم أمته غدوة وعشية، فيعرفهم بسيماهم، ليشهد عليهم، يقول الله تبارك وتعالى: «فكيف إذا جئنا من كل أمة بشهيد وجئنا بك على هؤلاء شهيدا
"প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে তাঁর উম্মতকে পেশ করা হয়। তিনি তাদের আলামত দ্বারা তাদেরকে চিনে রাখেন, যাতে তাদের সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে পারেন। আল্লাহ তা'আলা বলছেন- ‘সুতরাং (তারা ভেবে দেখুক)— সেদিন (তাদের অবস্থা) কেমন হবে, যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং (হে নবী), আমি তোমাকে ওইসব লোকের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব? [সূরা নিসা : ৪১]

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অন্যের মুখে কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত শোনা সুন্নত।

খ. বেশি হাসাহাসি ভালো না। এর থেকে বিরত থাকা চাই।

গ. কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত যেমন কান্না বা কান্নার ভাবের সঙ্গে হওয়া চাই, তেমনি কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত শ্রবণকালেও এরকম ভাব থাকা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৪৪৬ | মুসলিম বাংলা