রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين

ভূমিকা অধ্যায় - এর পরিচ্ছেদসমূহ

মোট হাদীস ৬৭৯ টি

হাদীস নং: ৩৮১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর জন্য ভালোবাসার ফযীলত, এর প্রতি উৎসাহদান এবং কেউ কাউকে ভালোবাসলে তাকে সে সম্পর্কে অবহিত করা আর তাকে তা অবহিত করা হলে জবাবে সে যা বলবে।
আল্লাহর জন্য একে অন্যকে মহব্বত করার ঈর্ষণীয় পুরস্কার
হাদীছ নং : ৩৮১

হযরত মুআয রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, মহান আল্লাহ বলেন, যারা আমার গৌরব-মহিমার কারণে একে অন্যকে ভালোবাসে তাদের জন্য থাকবে নূরের মিম্বর। নবী ও শহীদগণও তাদের প্রতি ঈর্ষাবোধ করবেন -তিরমিযী।
জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৯০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২০৮০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৫৭৭: তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩৪৩৪; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৫৮০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৬৪
مقدمة الامام النووي
46 - باب فضل الحب في الله والحث عَلَيهِ وإعلام الرجل من يحبه، أنه يحبه، وماذا يقول لَهُ إِذَا أعلمه
381 - وعن معاذ - رضي الله عنه - قَالَ: سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «قَالَ الله - عز وجل: المُتَحَابُّونَ فِي جَلالِي، لَهُمْ مَنَابِرُ مِنْ نُورٍ يَغْبِطُهُمُ (1) النَّبِيُّونَ وَالشُّهَدَاءُ». رواه الترمذي، (2) وَقالَ: «حديث حسن صحيح».
হাদীস নং: ৩৮২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর জন্য ভালোবাসার ফযীলত, এর প্রতি উৎসাহদান এবং কেউ কাউকে ভালোবাসলে তাকে সে সম্পর্কে অবহিত করা আর তাকে তা অবহিত করা হলে জবাবে সে যা বলবে।
আল্লাহর ভালোবাসা লাভ করার এক প্রকৃষ্ট উপায়
হাদীছ নং : ৩৮২

আবূ ইদরীস খাওলানী রহ. বলেন, আমি দামেশকের মসজিদে প্রবেশ করলাম। সহসা দেখতে পাই ঝকঝকে দাঁতের এক তরুণ বসে আছেন এবং তাঁর সঙ্গে একদল লোক। যখনই তাদের মধ্যে কোনও বিষয়ে মতভিন্নতা দেখা দেয়, তারা সে বিষয়টি তাঁর সামনে পেশ করে এবং তাঁর অভিমত তারা গ্রহণ করে নেয়। আমি তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। বলা হলো, ইনি মু'আয ইবন জাবাল রাযি.। পরদিন আমি আগে আগে (মসজিদে) আসলাম। দেখলাম, তিনি আমারও আগে উপস্থিত হয়েছেন। আমি তাঁকে নামাযরত পেলাম। সুতরাং আমি তাঁর অপেক্ষা করতে থাকলাম। তাঁর নামায শেষ হলে আমি তাঁর সামনে এসে হাজির হলাম। আমি তাঁকে সালাম দিয়ে বললাম, আল্লাহর কসম! আমি আপনাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম? আমি বললাম, আল্লাহর কসম! তিনি আবার বললেন, আল্লাহর কসম? আমি বললাম, আল্লাহর কসম! তারপর তিনি আমার চাদরের এক কোণ ধরে আমাকে নিজের কাছে টেনে নিলেন। তারপর বললেন, সুসংবাদ নাও। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তা'আলা বলেন, ওই সকল লোকের জন্য আমার ভালোবাসা অবধারিত, যারা আমারই জন্য একে অন্যকে ভালোবাসে; আমারই জন্য পরস্পরে ওঠাবসা করে; আমারই জন্য পরস্পরে দেখা-সাক্ষাত করে এবং আমারই জন্য খরচ করে -মুআত্তা মালিক।
মুআত্তা মালিক, হাদীছ নং ১৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২০৩০; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ৩৮৯০; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৫০; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৫৭৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৬৪
مقدمة الامام النووي
46 - باب فضل الحب في الله والحث عَلَيهِ وإعلام الرجل من يحبه، أنه يحبه، وماذا يقول لَهُ إِذَا أعلمه
382 - وعن أَبي إدريس الخولاني رحمه الله، قَالَ: دخَلْتُ مَسْجِدَ دِمَشْقَ، فَإذَا فَتًى بَرَّاق الثَّنَايَا (1) وَإِذَا النَّاسُ مَعَهُ، فَإِذَا اخْتَلَفُوا في شَيْءٍ، أَسْنَدُوهُ إِلَيْه، وَصَدَرُوا عَنْ رَأيِهِ، [ص:138] فَسَأَلْتُ عَنْهُ، فَقيلَ: هَذَا مُعَاذُ بْنُ جَبَل - رضي الله عنه. فَلَمَّا كَانَ مِنَ الغَدِ، هَجَّرْتُ، فَوَجَدْتُهُ قَدْ سَبَقَنِي بالتَّهْجِيرِ، ووَجَدْتُهُ يُصَلِّي، فانْتَظَرتُهُ حَتَّى قَضَى صَلاتَهُ، ثُمَّ جِئْتُهُ مِنْ قِبَلِ وَجْهِهِ، فَسَلَّمْتُ عَلَيهِ، ثُمَّ قُلْتُ: وَاللهِ إنّي لأَحِبُّكَ لِله، فَقَالَ: آلله؟ فَقُلْتُ: اللهِ، فَقَالَ: آللهِ؟ فَقُلْتُ: اللهِ، فَأَخَذَنِي بِحَبْوَةِ رِدَائِي، فجبذني إِلَيْهِ، فَقَالَ: أَبْشِرْ! فإنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «قَالَ الله تَعَالَى: وَجَبَتْ مَحَبَّتي لِلْمُتَحابِّين فِيَّ، وَالمُتَجَالِسينَ فيَّ، وَالمُتَزَاوِرِينَ فيَّ، وَالمُتَبَاذِلِينَ (2) فِيَّ». حديث صحيح رواه مالك في الموطأ بإسناده الصحيح. (3)
قوله: «هَجَّرْتُ» أيْ بَكَّرْتُ، وَهُوَ بتشديد الجيم قوله: «آلله فَقُلْت: الله» الأول بهمزة ممدودة للاستفهام، والثاني بلا مد.
হাদীস নং: ৩৮৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর জন্য ভালোবাসার ফযীলত, এর প্রতি উৎসাহদান এবং কেউ কাউকে ভালোবাসলে তাকে সে সম্পর্কে অবহিত করা আর তাকে তা অবহিত করা হলে জবাবে সে যা বলবে।
কাউকে মহব্বত করলে তাকে তা জানানো
হাদীছ নং: ৩৮৩

হযরত আবূ কারীমাহ মিকদাম ইবন মা'দী কারিব রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনও ব্যক্তি তার ভাইকে ভালোবাসলে সে যেন তাকে জানিয়ে দেয় যে, সে তাকে ভালোবাসে -আবু দাউদ ও তিরমিযী।
সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১২৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৯২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১২৯৪; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৯৯৬৩; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৫৭০; তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৬৬১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৫৯৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৮২
مقدمة الامام النووي
46 - باب فضل الحب في الله والحث عَلَيهِ وإعلام الرجل من يحبه، أنه يحبه، وماذا يقول لَهُ إِذَا أعلمه
383 - وعن أَبي كَرِيمَةَ المقداد (1) بن معد يكرب - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «إِذَا أَحَبَّ الرَّجُلُ أَخَاهُ، فَليُخْبِرْهُ أَنَّهُ يُحِبُّهُ». رواه أَبُو داود والترمذي، (2) وَقالَ: «حديث صحيح».
হাদীস নং: ৩৮৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর জন্য ভালোবাসার ফযীলত, এর প্রতি উৎসাহদান এবং কেউ কাউকে ভালোবাসলে তাকে সে সম্পর্কে অবহিত করা আর তাকে তা অবহিত করা হলে জবাবে সে যা বলবে।
কাউকে মহব্বত করলে তাকে তা জানানো
হাদীছ নং: ৩৮৪

হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত ধরে বললেন, হে মু'আয! আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে ভালোবাসি । অতঃপর হে মু'আয! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, তুমি প্রত্যেক নামাযের পর অবশ্যই বলবে- اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى ذِكْرِكَ، وَشُكْرِكَ، وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ 'হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার যিকর, আপনার শোকর এবং উত্তমরূপে আপনার ইবাদত করতে সাহায্য করুন' – আবূ দাউদ ও নাসাঈ।
সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৫২২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ১৩০৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২১১৯; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৬৯০; সহীহ ইবনে খুজায়মা, হাদীছ নং ৭৫১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ২০২০; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১১০; বায়হাকী, আস্ সুনানুস সগীর, হাদীছ নং ১৮
مقدمة الامام النووي
46 - باب فضل الحب في الله والحث عَلَيهِ وإعلام الرجل من يحبه، أنه يحبه، وماذا يقول لَهُ إِذَا أعلمه
384 - وعن معاذ - رضي الله عنه: أن رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - أخذ بيدهِ، وَقالَ: «يَا مُعَاذُ، وَاللهِ، إنِّي لأُحِبُّكَ، ثُمَّ أُوصِيكَ يَا مُعَاذُ، لاَ تَدَعَنَّ في دُبُرِ كُلِّ صَلاَةٍ تَقُولُ: اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى ذِكْرِكَ، وَشُكْرِكَ، وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ». حديث صحيح، رواه أَبُو داود والنسائي بإسناد صحيح. (1)
হাদীস নং: ৩৮৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর জন্য ভালোবাসার ফযীলত, এর প্রতি উৎসাহদান এবং কেউ কাউকে ভালোবাসলে তাকে সে সম্পর্কে অবহিত করা আর তাকে তা অবহিত করা হলে জবাবে সে যা বলবে।
কাউকে মহব্বত করলে তাকে তা জানানো
হাদীছ নং: ৩৮৫

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত ছিল। এ অবস্থায় এক ব্যক্তি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি এই ব্যক্তিকে ভালোবাসি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি কি তাকে জানিয়েছ? সে বলল, না। তিনি বললেন, তাকে জানাও । সুতরাং সে গিয়ে তাকে ধরল এবং বলল, আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। সে বলল, তুমি যার জন্য আমাকে ভালোবাস, তিনিও তোমাকে ভালোবাসুন -আবূ দাউদ।
সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১২৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২৪৩০; মুসনাদে আবৃ ইয়ালা, হাদীছ নং ৩৪৪২; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৯৯৪০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৫৭১; তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৩৩৬১; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৫৯৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৮৫
مقدمة الامام النووي
46 - باب فضل الحب في الله والحث عَلَيهِ وإعلام الرجل من يحبه، أنه يحبه، وماذا يقول لَهُ إِذَا أعلمه
385 - وعن أنس - رضي الله عنه: أنَّ رَجُلًا كَانَ عِنْدَ النَّبيِّ، - صلى الله عليه وسلم - فَمَرَّ رَجُلٌ بِهِ، فَقَالَ: يَا رَسُول الله، أنِّي لأُحِبُّ هَذَا، فَقَالَ لَهُ النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم: «أأعْلَمْتَهُ؟» قَالَ: لاَ. قَالَ: «أَعْلِمْهُ»، فَلَحِقَهُ، فَقَالَ: إنِّي أُحِبُّكَ في الله، فَقَالَ: أَحَبَّكَ الَّذِي أَحْبَبْتَنِي لَهُ. رواه أَبُو داود بإسناد صحيح. (1)
হাদীস নং: ৩৮৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৪৭

বান্দাকে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসার আলামত
ও তা অর্জনে সচেষ্ট থাকার প্রতি উৎসাহদান

কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, এমন অনেক আমল আছে, যা আল্লাহ তাআলার ভালোবাসার প্রমাণ বহন করে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি সেসব আমল করে, আল্লাহ তাআলা তাকে ভালোবাসেন। এটা তো সত্য যে, মানুষ মাত্রই আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসে, যদি না কোনও কারণে তার মানসিক ও মানবিক বিকৃতি ঘটে গিয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসলেই যে তাঁরও ভালোবাসা পাওয়া যাবে এটা অনিবার্য নয়। তাঁর ভালোবাসা পাওয়া যাবে কেবল তখনই, যখন তাঁর পসন্দমত কাজও করা হবে। বস্তুত শরীআত যেসব কাজের আদেশ করেছে তা করা এবং যা নিষেধ করেছে তা থেকে বিরত থাকাই আল্লাহ তাআলার পসন্দ। সুতরাং কেবল তাঁরই ভালোবাসায় উজ্জীবিত হয়ে যে ব্যক্তি শরীআত পালন করবে, সে আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা পাবেই। তারপরও সুনির্দিষ্টভাবেও কোনও কোনও আমল সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, তাতে লিপ্ত থাকলে আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা পাওয়া যায়। এমনিভাবে কোনও কোনও গুণ সম্পর্কেও স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে যে, তার অধিকারী হতে পারাটা আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা পাওয়ার আলামত। সেগুলো যখন আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা পাওয়ার আলামত, তখন প্রত্যেক আল্লাহপ্রেমিকের উচিত মনেপ্রাণে সেসব আমল করতে সচেষ্ট থাকা, সেসকল গুণ অর্জনের সাধনায় রত থাকা।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম আমল ও গুণের বর্ণনা সম্বলিত কয়েকটি আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
‘বান্দাকে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসার আলামত
ও তা অর্জনে সচেষ্ট থাকার প্রতি উৎসাহদান’

-সম্পর্কিত দু'টি আয়াত

এক নং আয়াত

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ

অর্থ : (হে নবী! মানুষকে) বলে দাও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

ব্যাখ্যা

ইহুদী ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায় বলত- نَحْنُ أَبْنَاءُ اللَّهِ وَأَحِبَّاؤُهُ (আমরা আল্লাহর সন্তান ও তাঁর প্রিয়পাত্র)৩০৫। তারই জবাবে এ আয়াত নাযিল হয়।

এক বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায়, কুরায়শরা হারাম শরীফের ভেতর প্রতিমা স্থাপন করে সেগুলোর উপর উটপাখির ডিম লটকে দিয়েছিল এবং কানে দুল পরিয়ে দিয়েছিল। তারা এগুলোর সামনে সিজদা করত। একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বললেন, আল্লাহর কসম, তোমরা তোমাদের পিতা ইবরাহীম ও ইসমাঈলের ধর্মাদর্শের বিরোধিতা করছ। তারা বলল- مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى 'আমরা তো এগুলোর উপাসনা করি (আল্লাহর ভালোবাসায়), যাতে এগুলো আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। তারই জবাবে এ আয়াত নাযিল হয়েছে।
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হুকুম দিয়েছেন যে- قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي (আপনি তাদেরকে বলুন, তোমরা যদি সত্যিই আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমার অনুসরণ কর)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসার দাবিই হচ্ছে তাঁকে খুশি করার চেষ্টা করা। তাঁকে খুশি করা যায় তাঁর আনুগত্য করার দ্বারা। তাঁর আনুগত্য করার অর্থ হলো তিনি যে কাজ পসন্দ করেন তা করা আর যা অপসন্দ করেন তা ছেড়ে দেওয়া। তিনি কোন কাজ পসন্দ করেন এবং কোন কাজ অপসন্দ করেন তা নিজ জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা জানা যায় না। তা জানা যায় কেবলই আল্লাহপ্রদত্ত শিক্ষা দ্বারা। আল্লাহ তাআলার সে শিক্ষা আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে পেয়েছি। কাজেই আল্লাহ তাআলাকে ভালোবেসে থাকলে তাঁর নবীর অনুসরণ করতে হবে। তাঁর নবীর অনুসরণ না করে। আল্লাহপ্রেমের দাবি করা বৃথা। কেননা এর দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে না। তাঁর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে কেবলই তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ দ্বারা। সুতরাং তিনি এ আয়াতে বলেছেন-

يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ (তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন)। অর্থাৎ তোমাদের আল্লাহপ্রেমের দাবি সত্য হলে তোমরা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ কর অর্থাৎ তার সুন্নত ও তাঁর তরিকা অনুযায়ী চল। তাঁর অনুসরণ করলে তোমাদের আল্লাহপ্রেম বৃথা যাবে না, আল্লাহ তাআলাও তোমাদের ভালোবাসবেন। এর দ্বারা বোঝা যায়, সুন্নতের অনুসরণ খাঁটি আল্লাহপ্রেমের আলামত। এমনিভাবে সুন্নতের অনুসরণ আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা লাভেরও আলামত বটে। যে ব্যক্তি সুন্নতের অনুসরণ করে, তাকে আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন বলে ধরে নেওয়া যায়।
এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে দু'টি পুরস্কার পাওয়া যায় বলে জানানো হয়েছে। একটি হলো আল্লাহর ভালোবাসা। দ্বিতীয়টি আয়াতের পরের অংশে জানানো হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ

(তিনি তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যেহেতু অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু, তখন যে-কেউ তাঁর ভালোবাসায় তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করবে, তিনি দয়াপরবশ হয়ে তাঁর জীবনের পাপরাশিও ক্ষমা করে দেবেন।
প্রকাশ থাকে যে, সুন্নত মোতাবেক জীবনযাপন করলে তার দ্বারা পাপ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কবীরা গুনাহ হয় না বললেই চলে। তারপরও কখনও-কখনও হয়ে গেলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষানুযায়ী সে দ্রুত তাওবা করে নেয়। তাওবার বদৌলতে আল্লাহ তাআলা তার সে গুনাহও ক্ষমা করে দেন। তার বাকি থাকতে পারে কেবল সগীরা গুনাহ। সুন্নত অনুসরণ করার কল্যাণে আল্লাহ তাআলা নিজ মেহেরবানীতে তাও ক্ষমা করে দেন। ফলে তার জীবন হয়ে যায় নিষ্পাপ ও পবিত্র জীবন। সারা জীবন সুন্নত মোতাবেক চললে পবিত্র ও নিষ্পাপরূপেই তার কবরযাত্রা হয়। এরূপ ব্যক্তির জান্নাত লাভের প্রবল আশা তো থাকেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন--

«كُلُّ أُمَّتِي يَدْخُلُونَ الجَنَّةَ إِلَّا مَنْ أَبَى»، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَمَنْ يَأْبَى؟ قَالَ: «مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى»

‘আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে, তবে যে অস্বীকার করে সে নয়। সাহাবীগণ বললেন, কে অস্বীকারকারী ইয়া রাসূলাল্লাহ? তিনি বললেন, যে আমার আনুগত্য করে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্যতা করে সে তো অস্বীকারই করে।৩০৭
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যথার্থ অনুসরণের তাওফীক দান করুন। আমীন।

দুই নং আয়াত

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্য হতে কেউ যদি নিজ দীন থেকে ফিরে যায়, তবে আল্লাহ এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারাও তাকে ভালোবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনও নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে ইচ্ছা করেন দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।৩০৮

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তারা যেন কিছুতেই নিজেদের দীন পরিত্যাগ না করে। আল্লাহ না করুন, কেউ তা করলে তাতে আল্লাহ তাআলার কোনও ক্ষতি নেই; সে নিজেই ধ্বংস হবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ শ্রেণীর লোকদের পরিবর্তে উন্নত গুণাবলীর অধিকারী লোকদের দাঁড় করিয়ে দেবেন। তারা কী কী সদগুণের অধিকারী হবে তাও এ আয়াতে বলে দেওয়া হয়েছে।
তাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে- يُحِبُّهُمْ (তিনি তাদের ভালোবাসবেন)। অর্থাৎ যারা ইসলাম পরিত্যাগ করবে, তাদের পরিবর্তে আল্লাহ তাআলা যাদেরকে দাঁড় করাবেন তাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন। উপরের আয়াত দ্বারা আমরা জানতে পেরেছি, আল্লাহ ভালোবাসেন তাদেরকেই, যারা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করে। বোঝা গেল, তাদের প্রথম গুণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা, যার ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তাআলা তাদের ভালোবাসবেন।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো- يُحِبُّونَهُ (তারাও তাকে ভালোবাসবে)। অর্থাৎ সে দলটির মধ্যে আল্লাহপ্রেম থাকবে। আর আল্লাহপ্রেমের দাবি হলো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা, যেমনটা উপরের আয়াতে বলা হয়েছে। এ হিসেবে প্রকৃতপক্ষে উভয়টিই একই গুণ। কেননা আল্লাহ তাআলাকে ভালোবেসে থাকলে কর্তব্য সুন্নতের অনুসরণ করা। আর সুন্নতের অনুসরণ করলে আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা পাওয়া যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে সুন্নতের অনুসরণই মূল কথা। এ গুণ যার মধ্যে থাকে, সে সত্যিকারের আল্লাহপ্রেমিকও এবং আল্লাহ তাআলার মাহবূব ও ভালোবাসার পাত্রও।
তাদের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো- أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ (তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে)। অর্থাৎ আল্লাহপ্রেমের দাবিতে তারা ভালোবাসবে মুমিনদেরও। ফলে তাদের প্রতি নম্র-কোমল আচরণ করবে, তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকবে, তাদেরকে নিজ দেহের অংশস্বরূপ মনে করবে, তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে থাকবে, কখনও তাদের সঙ্গে ঝগড়া-ফাসাদে লিপ্ত হবে না; বরং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে ও ক্ষমাশীলতার পরিচয় দেবে।
অপরদিকে তারা কাফের ও অমুসলিমদের প্রতি থাকবে কঠোর ও কঠিন। পার্থিব বিষয়ে ছাড় দিলেও দীনের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কখনও আপস করবে না। প্রয়োজনে জান-মাল দিয়ে লড়াই করবে। আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বেরাদার এমনকি পিতা-মাতাও যদি দীনের বিরুদ্ধাচরণ করে, তবে তাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে দ্বিধাবোধ করবে না। এটাই প্রকৃত মুমিনের পরিচায়ক।
তাদের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো- يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ (তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে)। অর্থাৎ দীনের প্রচার-প্রসারকল্পে তারা জিহাদে রত হবে। তারা জিহাদ করবে তাদের মুখ দিয়ে, তারা জিহাদ করবে কলম দিয়ে, অর্থ দিয়ে এবং সর্বপ্রকার ক্ষমতা ও সামর্থ্য দিয়ে। প্রাণ দিতেও কার্পণ্য করবে না। তারা নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে দেবে, নিজেদেরকে আল্লাহর কাছে বিকিয়ে দেবে। যেমনটা আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ

‘বস্তুত আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও তাদের সম্পদ খরিদ করে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে-এর বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। ফলে হত্যা করে ও নিহতও হয়।৩০৯
তাদের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হলো- وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ (কোনও নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না)। অর্থাৎ দীনের অনুসরণ ও দীনের প্রচার-প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় কখনও কারও নিন্দা-তিরস্কারকে গ্রাহ্য করবে না। যারা আল্লাহর পথে চলতে চায়, তাদের কারও নিন্দা-তিরস্কারকে গ্রাহ্য করলে চলে না। যারা তা গ্রাহ্য করে, তাদের পক্ষে আল্লাহর পথে চলা সম্ভব হয় না। সব যুগেই যারা এ পথে চলেছে, তারা ওসব অগ্রাহ্য করেই চলেছে। নবী-রাসূলগণকে তিরস্কার করা হয়েছে, কিন্তু তাঁরা তাতে ভ্রুক্ষেপ করেননি। নিন্দা করা হয়েছে সাহাবায়ে কেরামকেও। তারাও তা অগ্রাহ্য করেছেন। নিন্দা করেছে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং আপন-পর সকলে। গোটা সমাজ তাদেরকে ব্যাঙ্গ- বিদ্রুপ করেছে। পাগল বলেছে, নির্বোধ বলেছে, সমাজচ্যুত বলেছে, পশ্চাদপদ ও সেকেলে ঠাওরিয়েছে, প্রতিক্রিয়াশীল ও অশান্তি সৃষ্টিকারী সাব্যস্ত করেছে। কোনওকিছুই বলতে ছাড়েনি। সর্বাবস্থায় তারা মনোবল অটুট রেখেছেন। সকলের সব মন্তব্য উপেক্ষা করে দীনের উপর অবিচল থেকেছেন। প্রকৃত দীনদারকে এমনই করতে হয়। কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো আমরা সকল মন্তব্যে কান দিই। ‘পাছে লোকে কিছু বলে'-এর পেছনে পড়ে দীনদারীতে অবিচল থাকতে পারি না। আল্লাহ তাআলার পসন্দের বান্দা হতে হলে মনের এ দুর্বলতা ছাড়তে হবে।
আয়াতের শেষে বলা হয়েছে-

ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

(এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে ইচ্ছা করেন দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দা হতে পারা, আল্লাহ তাআলাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা, মুমিনদের সঙ্গে বিনয়ের আচরণ করা, কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর থাকা এবং কোনও নিন্দুকের নিন্দার তোয়াক্কা না করে যে-কোনও পরিবেশ-পরিস্থিতিতে সত্য দীনের উপর অবিচল থাকা ও অন্যদেরকেও অবিচল থাকতে সহযোগিতা করা মানুষের জন্য অনেক বড় সৌভাগ্য, আল্লাহ তাআলার অনেক বড় অনুগ্রহ। এ সৌভাগ্য ও অনুগ্রহ বুদ্ধিবলে বা বাহুবলে পাওয়া যায় না। এটা আল্লাহ তাআলারই দান। আল্লাহ তাআলা যাকে চান দিয়ে থাকেন। তিনি জানেন কে এর উপযুক্ত। সে অনুযায়ীই তিনি দান করেন। কাজেই কেউ নিজের মধ্যে এসব গুণের উপস্থিতি দেখতে পেলে তার কর্তব্য অহংকার-অহমিকায় লিপ্ত না হয়ে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করা। যে বস্তু নিজে অর্জন করেনি; বরং আল্লাহ তাআলাই দান করেছেন, তার জন্য মানুষের গৌরব করা সাজে না। আল্লাহ তাআলা তাঁর এসকল মহা দানের মধ্যে আমাদেরও শামিল রাখুন।
উল্লেখ্য, এ আয়াতে পরোক্ষভাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরবর্তীকাল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, তখন একদল লোক দীন থেকে ফিরে যাবে, তারা মুরতাদ হয়ে যাবে। তখন আল্লাহ তাআলা তাদের পরিবর্তে উল্লিখিত গুণ বিশিষ্ট একদল লোক দাঁড় করিয়ে দেবেন, যারা তাদের বিরুদ্ধে জান-মাল দিয়ে জিহাদ করবে।
স্বঘোষিত নবীদের বিরুদ্ধে সাহাবায়ে কেরামের জিহাদ
এ ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণ হয়েছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর একদল লোক মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকজন ভণ্ড নবীর আবির্ভাব ঘটেছিল। বহুলোক সে ভণ্ড নবীদের অনুসরণ করেছিল। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। নবুওয়াত দাবি করেছিল ইয়ামানের আসওয়াদ আনাসী, ইয়ামামার মুসায়লিমা কাযযাব এবং উত্তর আরবের তুলায়হা ইবন খুওয়ায়লিদ। মূলত এরা নবুওয়াত দাবি করেছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায়ই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসওয়াদ আনাসীর বিরুদ্ধে ইয়ামানের গভর্নর হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি.-কে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। তিনি ফায়রূয দায়লামী রাযি.-কে এ কাজের জন্য নিযুক্ত করেন। তাঁর হাতে আসওয়াদের পতন হয়। কিন্তু আসওয়াদের পতন-সংবাদ মদীনা মুনাউওয়ারায় পৌঁছার আগেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে যায় এবং হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর খেলাফতকাল শুরু হয়ে যায়।
মুসায়লিমা কাযযাব আগে নবুওয়াত দাবি করলেও তার প্রভাব-প্রতিপত্তির বিস্তার ঘটে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তার বিরুদ্ধে খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ রাযি.-এর নেতৃত্বে সেনাভিযান প্রেরণ করেন। উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। তাতে বহু লোক হতাহত হয়। শেষপর্যন্ত হযরত ওয়াহশী রাযি. মুসায়লিমাকে হত্যা করতে সক্ষম হন। ইনি সেই ওয়াহশী, উহুদের যুদ্ধে যার হাতে হযরত হামযা রাযি. শাহাদাত বরণ করেছিলেন। হযরত ওয়াহ্শী রাযি. বলতেন, ইসলাম গ্রহণের আগে আমি সর্বোত্তম মানুষ (হযরত হামযা রাযি.)-কে হত্যা করেছি এবং ইসলাম গ্রহণের পর হত্যা করেছি নিকৃষ্টতম মানুষ মুসায়লিমা কাযযাবকে।
মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার তুলায়হা ইবন খুওয়ায়লিদের পেছনেও বহু লোক জুটে গিয়েছিল। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের বিরুদ্ধেও হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ রাযি.-কে প্রেরণ করেন। তুমুল যুদ্ধের পর তুলায়হার বাহিনী পরাজিত হয়। তুলায়হা প্রাণ নিয়ে পলায়ন করে এবং সিরিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। তারপর সে তাওবা করে পুনরায় ইসলামে ফিরে আসে। তার এ তাওবা খাঁটিমনেই হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে তার দ্বারা ইসলামের উল্লেখযোগ্য খেদমত হয়েছিল।
সাজাহ নামের এক মহিলাও নিজেকে নবী বলে দাবি করেছিল। তারও বিপুল সংখ্যক অনুসারী ছিল। পরে মুসায়লিমার সঙ্গে তার বিবাহ হয়। হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ রাযি. তাদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেছিলেন। সে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর সাজাহ্ তাওবা করে পুনরায় ইসলামে ফিরে আসে।
এসকল ভণ্ড নবী ও তার অনুসারীরা ইসলামের মত মহা নিআমতের কদর করেনি। দুনিয়ার হীন স্বার্থে তারা ইসলাম ছেড়ে দিয়েছিল। আল্লাহ তাআলা তাদের বিরুদ্ধে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর নেতৃত্বে সাহাবায়ে কেরামকে সংগঠিত রাখেন। বিপুল সংখ্যক খাঁটি তাবি'ঈনও তাঁদের সঙ্গে থাকেন। আল্লাহপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে তারা সম্মিলিতভাবে নিজেদের জান-মাল দ্বারা ইসলামের এসকল শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করতে থাকেন। এতে তারা কোনওকিছুর তোয়াক্কা করেননি। তারা নিজেদের রক্তের বিনিময়ে ইসলামের মর্যাদা সমুন্নত রেখেছেন। এভাবে তাদের দ্বারা আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর জমানায় আলোচ্য আয়াতের ভবিষ্যদ্বাণীটি বাস্তবায়িত হয়ে গেলেও আয়াতটির মর্মবাণী ও এর বার্তা কিয়ামত পর্যন্তই কার্যকর থাকবে। সুতরাং যারাই এ আয়াতে বর্ণিত গুণাবলীর অধিকারী হয়ে আল্লাহর দুশমন ও মুরতাদদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম জারি রাখবে, তাদের জন্যই এ আয়াত প্রযোজ্য হবে।

৩০৪. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ৩১

৩০৫. সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ১৮

৩০৬. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৩

৩০৭. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭২৮০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭২৮

৩০৮. সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৫৪

৩০৯. সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১১১
আল্লাহর ওলীকে কষ্ট দেওয়ার পরিণাম এবং ফরয ও নফল ইবাদতের ফযীলত
হাদীছ নং : ৩৮৬

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা বলেন, যে-কেউ আমার বন্ধুর সঙ্গে দুশমনি করে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দিই। আমি আমার বান্দার প্রতি যা ফরয করেছি, সে আমার কাছে তার চেয়ে বেশি প্রিয় কোনওকিছু দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে পারে না। বান্দা নফল ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা আমার নিকটবর্তী হতে থাকে। একপর্যায়ে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। আমি যখন তাকে ভালোবেসে ফেলি তখন আমি হয়ে যাই তার কান, যা দিয়ে সে শোনে; তার চোখ, যা দিয়ে সে দেখে; তার হাত, যা দিয়ে সে ধরে এবং তার পা যা দিয়ে সে চলে। সে আমার কাছে কোনওকিছু চাইলে আমি তাকে তা দিই এবং আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তাকে আশ্রয় দান করি -বুখারী।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৫০২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৮৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩৪৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৩৯৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ১২৪৭
مقدمة الامام النووي
47 - باب علامات حُبِّ الله تَعَالَى للعبد والحث عَلَى التخلق بِهَا والسعي في تحصيلها

قَالَ الله تَعَالَى: {قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ} [آل عمران: 31]، وَقالَ تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَلا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ} [المائدة: 54].
386 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «إنَّ الله تَعَالَى قَالَ: مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا، فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ، وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِي بِشَيءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيهِ، وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ، فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ، كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ، ويَدَهُ الَّتي يَبْطِشُ (1) بِهَا، وَرجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا، وَإنْ سَألَنِي أعْطَيْتُهُ، وَلَئِن اسْتَعَاذَنِي لأعِيذَنَّهُ». رواه البخاري. (2)
معنى «آذنته»: أعلمته بأني محارِب لَهُ. وقوله: «استعاذني» روي بالباءِ وروي بالنون.
হাদীস নং: ৩৮৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ বান্দাকে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসার আলামত ও তা অর্জনে সচেষ্ট থাকার প্রতি উৎসাহদান
কুল মাখলুকাতের কাছে প্রিয়-অপ্রিয় হওয়ার রহস্য
হাদীছ নং : ৩৮৭

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা যখন কোনও বান্দাকে ভালোবাসেন তখন জিবরীলকে ডেকে বলেন, আল্লাহ অমুককে ভালোবাসেন, সুতরাং তুমিও তাকে ভালোবাসো। ফলে জিবরীল তাকে ভালোবাসেন। তারপর তিনি আসমানবাসীদের মধ্যে ঘোষণা করেন, আল্লাহ অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, সুতরাং তোমরাও তাকে ভালোবাসো। ফলে আসমানবাসী তাকে ভালোবাসে। অতঃপর পৃথিবীতে তাকে সমাদৃত করে তোলা হয়। -বুখারী ও মুসলিম।৩১৫
মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা যখন কোনও বান্দাকে ভালোবাসেন তখন জিবরীলকে ডেকে বলেন, আমি অমুককে ভালোবাসি, সুতরাং তুমিও তাকে ভালোবাসো। ফলে জিবরীল তাকে ভালোবাসেন। তারপর তিনি আসমানবাসীদের মধ্যে ঘোষণা করেন, আল্লাহ অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, সুতরাং তোমরাও তাকে ভালোবাসো। ফলে আসমানবাসী তাকে ভালোবাসে। অতঃপর পৃথিবীতে তাকে সমাদৃত করে তোলা হয়। অপরদিকে আল্লাহ যখন কোনও বান্দাকে ঘৃণা করেন, তখন জিবরীলকে ডেকে বলেন, আমি অমুককে ঘৃণা করি, সুতরাং তুমিও তাকে ঘৃণা করো। ফলে জিবরীল তাকে ঘৃণা করেন। তারপর আসমানবাসীর মধ্যে ঘোষণা করে দেন, আল্লাহ তা'আলা অমুককে ঘৃণা করেন, সুতরাং তোমরাও তাকে ঘৃণা করো। ফলে আসমানবাসী তাকে ঘৃণা করে। অতঃপর পৃথিবীতে তাকে ঘৃণিত বানিয়ে দেওয়া হয়।
৩১৫. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০৪০; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১০৬৭৪; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১১৯৩; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ৩৭৮৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩৬৫; তবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৩৬১৪
مقدمة الامام النووي
47 - باب علامات حُبِّ الله تَعَالَى للعبد والحث عَلَى التخلق بِهَا والسعي في تحصيله
387 - وعنه، عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «إِذَا أَحَبَّ اللهُ تَعَالَى العَبْدَ، نَادَى
جِبْريلَ: إنَّ الله تَعَالَى يُحِبُّ فُلانًا، فَأَحْبِبْهُ، فَيُحِبُّهُ جِبريلُ، فَيُنَادِي في أَهْلِ السَّمَاءِ: إنَّ اللهَ يُحِبُّ فُلانًا، فَأَحِبُّوهُ، فَيُحِبُّهُ أَهْلُ السَّمَاءِ، ثُمَّ يُوضَعُ لَهُ القَبُولُ في الأرْضِ». متفق عليه. (1)
وفي رواية لمسلم: قال رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «إنَّ الله تعالى إذا أحَبَّ عبدًا دَعَا جِبريلَ، فقال: إِنّي أُحِبُّ فُلانًا فأَحببهُ، فيُحبُّهُ جبريلُ، ثمَّ يُنادي في السماءِ، فيقول: إنَّ اللهَ يحبُّ فلانًا فأَحبُّوهُ، فيحبُّهُ أهلُ السماءِ، ثُمَّ يُوضعُ لَهُ القَبولُ في الأرضِ، وَإِذَا أَبْغَضَ عَبْدًا دَعَا جِبْريلَ، فَيَقُولُ: إنّي أُبْغِضُ فُلانًا فَأَبْغِضْهُ. فَيُبغِضُهُ جِبريلُ، ثُمَّ يُنَادِي في أَهْلِ السَّمَاءِ: إنَّ الله يُبْغِضُ فُلانًا فَأَبْغِضُوهُ، ثُمَّ تُوضَعُ لَهُ البَغْضَاءُ في الأَرْضِ».
হাদীস নং: ৩৮৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ বান্দাকে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসার আলামত ও তা অর্জনে সচেষ্ট থাকার প্রতি উৎসাহদান
সূরা ইখলাসের প্রতি জনৈক সাহাবীর ভালোবাসা ও তার পুরস্কার
হাদীছ নং : ৩৮৮

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে একটি বাহিনীর অধিনায়ক করে পাঠান। সে তার সঙ্গীদের নিয়ে নামাযে যে কিরাআত পড়ত তা শেষ করত قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ দ্বারা। তারা ফিরে আসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তা উল্লেখ করল। তিনি বললেন, তাকে জিজ্ঞেস কর সে এটা কেন করে? তারা তাকে জিজ্ঞেস করল। সে বলল, এই সূরাটি দয়াময় আল্লাহর পরিচয় (সম্বলিত)। তাই আমি এটি পড়তে ভালোবাসি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে জানিয়ে দাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'আলাও তাকে ভালোবাসেন -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭৩৭৫; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৮১৩; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৯৯৩; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৭৯৩; বায়হাকী, আস্সুনানুস সগীর, হাদীছ নং ৯৭১: শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২৩০৮
مقدمة الامام النووي
47 - باب علامات حُبِّ الله تَعَالَى للعبد والحث عَلَى التخلق بِهَا والسعي في تحصيلها
388 - وعن عائشة رضي الله عنها: أنَّ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - بعثَ رجلًا عَلَى سَريَّةٍ، فَكَانَ يَقْرَأُ لأَصْحَابِهِ في صَلاَتِهِمْ فَيَخْتِمُ بـ {قُل هُوَ اللهُ أَحَدٌ}، فَلَمَّا رَجَعُوا ذَكَرُوا ذلِكَ لرسول الله - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: «سَلُوهُ، لأَيِّ شَيْءٍ يَصْنَعُ ذلِكَ؟»، فَسَألُوهُ، فَقَالَ: لأَنَّهَا صِفَةُ الرَّحْمنِ، فَأَنَا أُحِبُّ أَنْ أَقْرَأ بِهَا. فَقَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «أَخْبِرُوهُ أنَّ اللهَ تَعَالَى يُحِبُّهُ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীস নং: ৩৮৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৪৮

নেককার, দুর্বল ও মিসকীনদের কষ্ট দেওয়া সম্পর্কে সতর্কীকরণ

অন্যায়ভাবে যে-কাউকে কষ্ট দেওয়া সম্পূর্ণ হারাম ও মহাপাপ। শুধু শুধু পশু-পাখিকেও কষ্ট দেওয়া জায়েয নয়। এমনকি পশু যবাহকালে লক্ষ রাখতে বলা হয়েছে যাতে অহেতুক বেশি কষ্ট দেওয়া না হয়। যারা নেককার ও সৎকর্মশীল, তাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমতের দৃষ্টি থাকে। তারা আল্লাহর ওলী। আল্লাহর ওলীকে কষ্ট দেওয়া অধিকতর কঠিন পাপ। এটা আল্লাহ তাআলাকেই কষ্ট দেওয়ার নামান্তর। এমনিভাবে যারা দুঃস্থ ও অসহায়, যাদের আল্লাহ ছাড়া কোনও সাহায্যকারী নেই, তাদেরকে কষ্ট দেওয়াও অপেক্ষাকৃত গুরুতর। কারণ যার কোনও সাহায্যকারী নেই, আল্লাহ তাআলাই তার সাহায্যকারী। আর আল্লাহ তাআলা যার সাহায্যকারী, তাকে কষ্ট দেওয়ার অর্থ নিজেকে আল্লাহর প্রতিপক্ষ বানিয়ে নেওয়া। যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহ তাআলার প্রতিপক্ষ বানাবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তার দুর্গতি কে ঠেকাবে? তাই মেহেরবান আল্লাহ বান্দাদের সাবধান করেছেন তারা যেন কিছুতেই দুঃস্থ, দুর্বল ও অসহায় লোকদের উত্যক্ত না করে, কোনওভাবেই তাদের কষ্ট না দেয়। এ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীছে সুস্পষ্ট সতর্কবাণী আছে। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সে সম্পর্কিত কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে।

নেককার, দুর্বল ও মিসকীনদের কষ্ট দেওয়া সম্পর্কে সতর্কীকরণ বিষয়ক দু'টি আয়াত

এক নং আয়াত

وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا

অর্থ : যারা মুমিন নর ও মুমিন নারীদেরকে বিনা অপরাধে কষ্ট দান করে, তারা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে।৩১৯

ব্যাখ্যা

এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে মুনাফিকদের সম্পর্কে। তারা পেছনে পেছনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, উম্মাহাতুল মুমিনীন এবং অন্যান্য মুসলিম নর-নারীর কুৎসা গাইত, তাদের নামে বিভিন্ন অপবাদ রটনা করত। বিভিন্ন রেওয়ায়েতে আছে, মুসলিম নারীগণ বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে বের হলে মুনাফিকরা তাদের উত্যক্ত করত। এ কারণে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে উত্তর দিত, আমরা তাদেরকে ভদ্র মহিলা বলে বুঝতে পারিনি; মনে করেছিলাম দাসী-বাঁদী হবে।
দাসী-বাঁদী হলেই উত্যক্ত করা যাবে, এটাও একরকম মুনাফিকী চরিত্রই। প্রকৃত মুমিন কাউকেই কষ্ট দেয় না। দাসী হলেও সে তাকে বোনের দৃষ্টিতে দেখে, তাকে মানবিক মর্যাদা দেয়।
যাহোক মুমিন নর-নারীকে কষ্ট দেওয়া কঠিন গুনাহ। অপবাদ রটানো অধিকতর কঠিন পাপ। আয়াতটি যদিও মুনাফিকদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু এর বার্তা সকলের জন্যই সাধারণ। কাজেই যারা নিজেদের খাঁটি মুমিন বলে বিশ্বাস করে, তাদেরও কর্তব্য মুমিন নারীকে কষ্টদান থেকে বিরত থাকা। অন্যথায় আখেরাতে কঠিন দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হবে।

দুই নং আয়াত

فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ (9) وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ (10)

অর্থ : সুতরাং যে ইয়াতীম, তুমি তার প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করো না। এবং যে সওয়াল করে, তাকে দাবড়ি দিও না।৩২০

ব্যাখ্যা

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াতীম ছিলেন। তাঁর জন্মের আগেই তাঁর পিতা আব্দুল্লাহর ইন্তিকাল হয়ে গিয়েছিল। দাদা আব্দুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধানে তাঁর লালন-পালন হয়েছিল। মাকেও হারিয়েছিলেন শৈশবেই । তখন তাঁর বয়স ছিল ৬ বছর। দাদা আব্দুল মুত্তালিবও তাঁর ৮ বছর বয়সকালে ইন্তিকাল করেন। তারপর তাঁর লালন- পালনের ভার পড়ে চাচা আবূ তালিবের উপর। আবূ তালিবও তেমন সচ্ছল ছিলেন না। কাজেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইয়াতীম অবস্থাটাও ছিল উপর্যুপরি কঠিন থেকে কঠিনতর। নবুওয়াতী জীবনের শুরুটা কেটেছে মক্কার কাফেরদের ঘোর শত্রুতার মুখে। মদীনা মুনাউওয়ারার আওস ও খাযরাজ গোত্র তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়। তিনি তাদের কাছে চলে যান। এখন আনসারগণ তাঁর আত্মনিবেদিত সেবক। মক্কার ইয়াতীম ও গরীব বালককে আল্লাহ তাআলা এভাবেই পবিত্র মদীনায় এনে প্রতিষ্ঠা দান করেন এবং অর্থাভাবও দূর করে দেন, যদিও আমৃত্যু তিনি যুহুদ ও কৃচ্ছ্রতার জীবনই যাপন করেছেন।
যেহেতু এক সময় তিনি ইয়াতীম ছিলেন এবং ছিলেন অভাবগ্রস্তও, তাই তার শোকর আদায়ার্থে তাঁকে আদেশ করা হয়েছে যেন ইয়াতীম ও গরীবদের প্রতি দুর্ব্যবহার না করে মমত্বপূর্ণ আচরণ করেন।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন রহমাতুল-লিল-আলামীন। তিনি স্বভাবতই গরীব-দুঃখী ও বিধবা-ইয়াতীমের প্রতি সদয় আচরণ করতেন। তা সত্ত্বেও তাঁকে এ আদেশ করা হয়েছে বিষয়টার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরোপের জন্য, যাতে তাঁর উম্মত এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অবহেলা না করে।
যারা কোনওকালে ইয়াতীম ও গরীব ছিল, তাদের কর্তব্য অতীতদিনের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতাবোধে উজ্জীবিত হওয়া এবং সে কৃতজ্ঞতার প্রকাশস্বরূপ ইয়াতীম ও গরীবদের প্রতি সহমর্মী থাকা। যারা অতীতে ইয়াতীম ও গরীব ছিল না, তাদেরও পিতা- মাতার আশ্রয়ে প্রতিপালিত হওয়া ও অভাবমুক্ত অবস্থায় বেড়ে ওঠার জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা কর্তব্য। সে শোকরের একটা অংশ এইও যে, তারা ইয়াতীম ও গরীবদের প্রতি সদা সহানুভূতিশীল থাকবে।

৩১৯. সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৫৮

৩২০. সূরা দুহা (৯৩), আয়াত ৯, ১০

এ বিষয়ে বহু হাদীছ আছে। তার মধ্যে একটি হলো, পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উদ্ধৃত হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত হাদীছ— “যে-কেউ আমার বন্ধুর সঙ্গে দুশমনি করে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দিই।” এর ব্যাখ্যা পেছনের অধ্যায়ের ৩৮৬ ক্রমিক নম্বরে দেখুন।

আরেকটি হলো ইয়াতীমদের প্রতি সদয় আচরণ সম্পর্কিত অধ্যায়ে উদ্ধৃত হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. থেকে বর্ণিত হাদীছ- “হে আবূ বকর! তুমি যদি তাদেরকে নারাজ করে থাক, তবে তুমি তোমার প্রতিপালককেই নারাজ করলে।” এর ব্যাখ্যা ৪র্থ খণ্ডের ২৬১ ক্রমিক নম্বরে দেখুন।
ফজরের নামায আদায়কারীদেরকে আল্লাহপ্রদত্ত নিরাপত্তা এবং তাদেরকে কষ্ট দেওয়ার পরিণাম
হাদীছ নং : ৩৮৯

হযরত জুনদুব ইবন আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ফজরের নামায আদায় করল, সে আল্লাহর যিম্মাদারীতে এসে যায়। সুতরাং (সাবধান!) আল্লাহ যেন তাঁর যিম্মাদারীর কোনও বিষয়ে তোমাদেরকে তলব না করেন। কেননা, তিনি তাঁর যিম্মাদারীর কোনও বিষয়ে যাকে তলব করবেন তাকে অবশ্যই পাকড়াও করবেন। তারপর তাকে উল্টোমুখী করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন – মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৬৫৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২২২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৮৮১৪; মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, হাদীছ নং ১৮২৫০; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৪৫; আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৬৫৫
مقدمة الامام النووي
48 - باب التحذير من إيذاء الصالحين والضعفة والمساكين
قال الله تعالى: {والذين يؤذون المؤمنين والمؤمنات بغير ما اكتسبوا فقد احتملوا بهتانا وإثما مبينا} [الأحزاب: 58]، وقال تعالى: {فأما اليتيم فلا تقهر وأما السائل فلا تنهر} [الضحى: 9 - 10].

وأما الأحاديث، فكثيرة منها:
حديث (1) أبي هريرة - رضي الله عنه - في الباب قبل هذا: «من عادى لي وليا فقد آذنته بالحرب».
ومنها حديث (2) سعد بن أبي وقاص - رضي الله عنه - السابق في باب ملاطفة اليتيم، وقوله (3) صلى الله عليه وسلم: «يا أبا بكر، لئن كنت أغضبتهم لقد أغضبت ربك».
389 - وعن جندب بن عبد الله - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «مَنْ صَلَّى صَلاةَ الصُّبْحِ، فَهُوَ في ذِمَّةِ اللهِ، فَلاَ يَطْلُبَنَّكُمُ اللهُ مِنْ ذِمَّتِهِ بِشَيْءٍ، فَإنَّهُ مَنْ يَطْلُبُهُ مِنْ ذِمَّتِهِ بِشَيْءٍ يُدْرِكْهُ، ثُمَّ يَكُبُّهُ عَلَى وَجْهِهِ في نَارِ جَهَنَّمَ». رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ৩৯০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৪৯

মানুষের উপর তাদের বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ী শরীআতের বিধান জারী করা এবং তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া

ইসলাম দ্বারা দুনিয়ায়ও মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা লাভ হয়। ইসলাম হলো আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার নবী ও রাসূল বলে সাক্ষ্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যে দীন ও শরীআত নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করে নেওয়া। যে ব্যক্তি মুখে এটা স্বীকার করে নেয় সে-ই মুসলিম। যদি অন্তরে এর প্রতি বিশ্বাস না থাকে, সে মুনাফিক। তবে কার মনে বিশ্বাস আছে আর কার মনে বিশ্বাস নেই তা আল্লাহ তাআলা ছাড়া কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এ হিসেবে কাউকে মুনাফিক সাব্যস্ত করা সম্ভবও নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জমানায় কিছু সংখ্যক লোক মুনাফিক ছিল। তাঁকে ওহীর মাধ্যমে তা জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল। তাই ইতিহাসে তারা মুনাফিকরূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। কিন্তু এখন যেহেতু ওহী নাযিলের ধারা বন্ধ, তাই এখন বাস্তবিকপক্ষে কেউ মুনাফিক হলেও কারও পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। দুনিয়ার বিচারে এখন মানুষ কেবল দু'প্রকার হয় মুসলিম নয়তো কাফের। সুতরাং বাহ্যিকভাবে যাকে মুসলিম মনে হবে, তাকে মুসলিমই গণ্য করতে হবে। আর বাহ্যিকভাবে যাকে কাফের মনে হবে, তাকে কাফেরই গণ্য করা হবে।
এমনিভাবে মুসলিম ব্যক্তির বাহ্যিক আমল ভালো হলে তাকে নেককার গণ্য করা হবে। তার নিয়ত সম্পর্কে সন্দেহ করা যাবে না। আবার বাহ্যিকভাবে পাপাচারে লিপ্ত থাকলে তাকে ফাসেক বলা হবে। মন ভালোর দোহাই দিয়ে তার পাপাচারকে উপেক্ষা করা হবে না। কুরআন ও হাদীছ আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয়। রিয়াযুস সালিহীনের এ অধ্যায়ে সে সম্পর্কিত একটি আয়াত ও কয়েকটি হাদীছ পেশ করা হয়েছে। নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে । আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা।

‘মানুষের উপর তাদের বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ী শরীআতের বিধান জারী করা এবং তাদের অভ্যন্তরীন অবস্থা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া সম্পর্কিত একটি আয়াত

فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

অর্থ : অবশ্য তারা যদি তাওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ ছেড়ে দেবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।৩২৩

ব্যাখ্যা

এটি সূরা তাওবার ৫ম আয়াত। সূরাটি নাযিল হয়েছিল মক্কাবিজয়ের পর। আরবের বহু গোত্র, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কুরাইশ কাফেরদের যুদ্ধ কোন পরিণতিতে পৌছায়——তার অপেক্ষায় ছিল। হিজরী ৬ সনে কুরাইশ গোত্রের সঙ্গে 'হুদায়বিয়া' নামক স্থানে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। হিজরী ৮ সনে তারা সে চুক্তি বাতিল ঘোষণা করে। ফলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা মুকাররামায় হামলা চালান এবং বিশেষ রক্তপাত ছাড়াই জয়লাভ করেন। এটাই ছিল তাদের সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশেষ যুদ্ধ। এতে তাদের পরাজয়ের পর আরবের যেসকল গোত্র কুরাইশের কারণে ইসলাম গ্রহণ করতে ভয় পাচ্ছিল কিংবা যারা যুদ্ধের শেষ পরিণতি দেখার অপেক্ষায় ছিল, তাদের অন্তর থেকে ইসলাম গ্রহণের প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায়। ফলে তারা দলে দলে মদীনা মুনাউওয়ারায় এসে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। এভাবে জাযিরাতুল আরবের অধিকাংশ এলাকায় ইসলামী পতাকা উড়তে শুরু করে।
মক্কাবিজয়ের পর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে জাযিরাতুল আরবকে ইসলামের কেন্দ্রভূমি ঘোষণা করা হলো। মূল উদ্দেশ্য ছিল এই যে, আরব উপদ্বীপে কোনও অমুসলিম সাধারণ নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে পারবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে এ আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেই ইরশাদ করেন-

لَا يَجْتَمِعُ فِي جَزِيرَةِ الْعَرَبِ دِيْنَانِ

(আরব উপদ্বীপে দু'টি দীন একত্রে অবস্থান করতে পারে না)।’৩২৪

এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হয় পর্যায়ক্রমে। সর্বপ্রথম লক্ষ্য স্থির করা হয় মূর্তিপূজার মলোচ্ছেদ, যাতে জাযিরাতুল আরবের কোথাও মূর্তিপূজার চিহ্নমাত্র না থাকে। সুতরাং আরবের যেসকল মূর্তিপূজক অবশিষ্ট ছিল এবং যারা বিশ বছরেরও বেশি কাল যাবৎ মুসলিমদের প্রতি বর্বরোচিত জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছিল, তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে অবকাশ দেওয়া হলো। এ সূরার শুরুতে সেসব মেয়াদের উল্লেখপূর্বক জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তাদের সঙ্গে মুসলমানদের আর কোনও সম্পর্ক থাকল না। তাদেরকে এ সময়ের ভেতর ইসলাম গ্রহণ করতে হবে। আর তা না করলে তাদেরকে জাযিরাতুল আরব ছাড়তে হবে । যদি ইসলাম গ্রহণ না করে এবং জাযিরাতুল আরব ছেড়েও না যায়, তবে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ হবে। এতদ্‌সঙ্গে মসজিদুল হারামকে মূর্তিপূজার সকল চিহ্ন থেকে পবিত্র করারও ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হলো। এ ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল হিজরী ৯ সনের হজ্জের সময়।
জাযিরাতুল আরবে যেসকল মুশরিক বাস করত, তাদের মধ্যে একদল ছিল এরকম, যাদের সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধবিরোধী চুক্তি সম্পন্ন করেছিলেন বটে, কিন্তু তারা সে চুক্তির মর্যাদা রক্ষা না করে বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়েছিল। তাদেরকে বাড়তি কোনও সময় দেওয়া হয়নি, তবে তাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা যেহেতু হজ্জের সময় দেওয়া হয়েছিল, যা এমনিতেই সম্মানিত মাস, যখন যুদ্ধ-বিগ্রহ জায়েয নয় এবং এর পরের মুহাররামও এরকমই একটি মাস, তাই স্বাভাবিকভাবেই মুহাররাম মাসের শেষ পর্যন্ত তারা সময় পেয়ে গিয়েছিল। তাদেরই সম্পর্কে আলোচ্য আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছে-

فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ

‘অতঃপর সম্মানিত মাসসমূহ অতিবাহিত হলে মুশরিকদেরকে (যারা তোমাদের চুক্তি ভঙ্গ করেছিল) যেখানেই পাবে হত্যা করবে। তাদেরকে গ্রেফতার করবে, অবরোধ করবে এবং তাদেরকে ধরার জন্য প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে বসে থাকবে।'
অর্থাৎ সম্মানিত মাসসমূহ গত হওয়ার পরও যদি তারা ঈমান না আনে এবং জাযিরাতুল আরব ত্যাগও না করে, তবে তাদেরকে কতল করা হবে। তারপর এ আয়াতের পরবর্তী অংশে ইরশাদ হয়েছে-

فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

‘অবশ্য তারা যদি তাওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ ছেড়ে দেবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।'
অর্থাৎ তারা যদি প্রকাশ্যে কুফর ও শিরক থেকে তাওবা করে মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যার বড় আলামত হলো নামায পড়া ও যাকাত দেওয়া, তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুমতি নেই। ইসলাম গ্রহণের কারণে তারা তাদের জান ও মালের নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। সুতরাং তোমরা তাদেরকে মুক্ত ও নিরাপদ জীবন যাপন করতে দেবে। তাদের মনে কী আছে বা নেই, তার পেছনে পড়বে না। মনের অবস্থা আল্লাহর উপরই ন্যস্ত থাকবে। তোমরা কেবল তাদের বাহ্যিক অবস্থাই দেখবে। সে হিসেবে তাদের সঙ্গে মুসলিমসুলভ আচরণই করবে।
আয়াতে তাদের মুক্ত ও স্বাধীন জীবনযাপনের জন্য ইসলামগ্রহণের ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি নামায পড়া ও যাকাত দেওয়ার শর্তও যুক্ত করা হয়েছে। বোঝা গেল নিরাপত্তালাভের জন্য কেবল ইসলামগ্রহণের ঘোষণা দেওয়াই যথেষ্ট নয়; নামায পড়া ও যাকাত দেওয়াও জরুরি। বরং ইসলামের জরুরি সমস্ত বিধান মানা জরুরি। যদি কোনও একটি জরুরি বিধান মানতে না চায়, তবে ইসলামী সরকার তাদেরকে তা মানতে বাধ্য করবে। প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর জমানায় একদল লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করলে তিনি তাদের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।

৩২৩. সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৫

৩২৪. বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১৬২৯; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ২৭৬৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩২৯৯২; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৭২০৮
যা দ্বারা জান-মালের নিরাপত্তা লাভ হয়
হাদীছ নং : ৩৯০

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমাকে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, আর নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়। যখন তারা তা করবে তখন আমার পক্ষ হতে তারা নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তা পাবে। তবে ইসলামের হক (এর বিষয়টি) ব্যতিক্রম। আর তাদের হিসাব আল্লাহ তা'আলার উপর ন্যস্ত - বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৫; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২০; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৫৫৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬০৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৪৪৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৭১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৭; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২১৯৯; তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৯২
مقدمة الامام النووي
49 - باب إجراء أحكام الناس عَلَى الظاهر وسرائرهم إِلَى الله تَعَالَى

قَالَ الله تَعَالَى: {فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُم} [التوبة: 5].
390 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما: أنَّ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إلهَ إلاَّ الله، وَأنَّ مُحَمَّدًا رَسُول الله، وَيُقيمُوا الصَّلاةَ، وَيُؤتُوا الزَّكَاةَ، فَإِذَا فَعَلُوا ذلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إلاَّ بحَقِّ الإسْلاَمِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى الله تَعَالَى». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীস নং: ৩৯১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ মানুষের উপর তাদের বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ী শরীআতের বিধান জারী করা এবং তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া।
যা দ্বারা জান-মালের নিরাপত্তা লাভ হয়
হাদীছ নং : ৩৯১

হযরত আবূ আব্দুল্লাহ তারিক ইবন আশয়াম রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি বলে আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ ছাড়া যা-কিছুর উপাসনা করা হয় তা প্রত্যাখ্যান করে, তার জান-মাল (এর উপর অন্যের হস্তক্ষেপ) হারাম হয়ে যায়। আর তার হিসাব আল্লাহর উপর ন্যস্ত -মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫৮৭৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৩০৯৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ১৭১; তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮১৯০
مقدمة الامام النووي
49 - باب إجراء أحكام الناس عَلَى الظاهر وسرائرهم إِلَى الله تَعَالَى
391 - وعن أَبي عبدِ الله طارِق بن أشَيْم - رضي الله عنه - قَالَ: سَمِعْتُ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «مَنْ قالَ لاَ إلهَ إلاَّ الله، وَكَفَرَ بمَا يُعْبَدُ مِنْ دُونِ اللهِ، حَرُمَ مَالُهُ وَدَمُهُ، وَحِسَابُهُ عَلَى الله تَعَالَى». رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ৩৯২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ মানুষের উপর তাদের বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ী শরীআতের বিধান জারী করা এবং তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া।
কালেমা পাঠকারীকে হত্যা করার নিষেধাজ্ঞা
হাদীছ নং : ৩৯২

হযরত আবূ মা'বাদ মিকদাদ ইবন আসওয়াদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, আপনি কী বলেন, যদি আমি কোনও কাফেরের মুখোমুখি হই, তারপর আমরা পরস্পর যুদ্ধে রত হই, একপর্যায়ে সে তরবারি দ্বারা আমার এক হাতে আঘাত করে এবং তা কেটে ফেলে, তারপর সে আমার থেকে বাঁচার জন্য কোনও গাছের আশ্রয় নেয় আর বলে উঠে, আমি আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে এ কথা বলার পর আমি কি তাকে হত্যা করব? তিনি বললেন, তাকে হত্যা করো না। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে তো আমার দু'হাতের একটি কেটে ফেলেছে। সে তা কাটার পরই এ কথা বলেছে। তিনি বললেন, তাকে হত্যা করো না। কেননা তুমি যদি তাকে হত্যা কর, তবে সে তো (ইসলাম ঘোষণা দ্বারা) তোমার ওই স্তরে চলে এসেছিল, যে স্তরে তুমি তাকে হত্যা করার আগে ছিলে। আর তুমি চলে যাবে তার স্তরে, যেখানে সে এ কথা বলার আগে ছিল -বুখারী ও মুসলিম।৩২৯
ইমাম নববী রহ. বলেন, إِنَّهُ بِمَنْزِلَتِكَ এর অর্থ তার রক্ত নিরাপদ। এখন তার সম্পর্কে ফয়সালা হবে তার ইসলাম গ্রহণের দৃষ্টিকোণ থেকে।
إِنَّك بِمَنْزِلَتِه এর অর্থ, তোমার রক্ত হালাল। তার ওয়ারিশগণ তোমার থেকে কিসাস গ্রহণ করতে পারবে। এমন নয় যে, সে আগে যে কুফরীর স্তরে ছিল, তুমিও সেই স্তরে চলে যাবে।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪০১৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৬৪৪; নাসাঈ, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৮৫৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৩৮১১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদীছ নং ২৮৯৪৩; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ১৬৪; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৮৪৬
مقدمة الامام النووي
49 - باب إجراء أحكام الناس عَلَى الظاهر وسرائرهم إِلَى الله تَعَالَى
392 - وعن أَبي معبد المقداد بن الأسْود - رضي الله عنه - قَالَ: قُلْتُ لرسول الله - صلى الله عليه وسلم: أرَأيْتَ إنْ لَقِيتُ رَجُلًا مِنَ الكُفَّارِ، فَاقْتتَلْنَا، فَضَرَبَ إحْدَى يَدَيَّ بِالسَّيْفِ، فَقَطَعَها، ثُمَّ لاَذَ مِنِّي بِشَجَرَةٍ، فَقَالَ: أَسْلَمْتُ لِلهِ، أَأَقْتُلُهُ يَا رَسُول الله بَعْدَ أَنْ قَالَهَا؟ فَقَالَ: «لاَ تَقْتُلهُ» فَقُلْتُ: يَا رَسُول الله، قَطَعَ إحْدَى يَدَيَّ، ثُمَّ قَالَ ذلِكَ بَعْدَ مَا قَطَعَهَا؟! فَقَالَ: «لَا تَقتُلْهُ، فَإِنْ قَتَلْتَهُ فَإنَّهُ بِمَنْزِلَتِكَ قَبْلَ أَنْ تَقْتُلَهُ، وَإنَّكَ بِمَنْزِلَتِهِ قَبْلَ أَنْ يَقُولَ كَلِمَتَهُ التي قَالَ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
ومعنى «أنه بمنزلتك» أي: معصوم الدم محكوم بإسلامه. ومعنى «أنك بمنزلته» أي: مباح الدمِ بالقصاص لورثتهِ لا أنه بمنزلته في الكفر، والله أعلم.
হাদীস নং: ৩৯৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ মানুষের উপর তাদের বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ী শরীআতের বিধান জারী করা এবং তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া।
হযরত উসামা ইবন যায়দ রাযি. কর্তৃক জনৈক কালেমা পাঠকারীকে হত্যা করা সম্পর্কিত একটি ঘটনা
হাদীছ নং: ৩৯৩

হযরত উসামা ইবন যায়দ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে জুহায়না গোত্রের শাখা হুরাকাহ'র বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। আমরা ভোরবেলা তাদের জলাশয়ে পৌঁছে হামলা চালাই। আমি ও জনৈক আনসারী তাদের এক ব্যক্তিকে পেয়ে যাই। আমরা তার উপর চড়াও হতেই সে বলে উঠে لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ ফলে আনসারী ব্যক্তি তার উপর আক্রমণ করা হতে নিবৃত্ত হয়ে যায়। আর আমি তাকে আমার বর্শা দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে ফেলি। আমরা মদীনায় ফিরে আসার পর এ সংবাদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পৌঁছে যায়। তিনি আমাকে বললেন, হে উসামা! সে لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ বলার পরও তুমি তাকে হত্যা করলে? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে তো তা বলেছিল প্রাণ বাঁচানোর জন্য। তিনি বললেন, সে لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ বলার পরও তুমি তাকে হত্যা করলে? তিনি এ কথা বার বার বলতে থাকলেন। শেষপর্যন্ত আমি আকাঙ্ক্ষা করলাম, সেদিনের আগে যদি আমি ইসলাম গ্রহণ না-ই করতাম! বুখারী ও মুসলিম।৩৩৩
অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ বলল আর তুমি তাকে হত্যা করলে?! আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে তো তা বলেছিল অস্ত্রের ভয়ে। তিনি বললেন, তুমি তার অন্তর ফেঁড়ে দেখলে না কেন, যাতে জানতে পার সে তা (অন্তর দিয়ে) বলেছিল কি না? তিনি এ কথা বার বার বলতে থাকলেন। শেষপর্যন্ত আমি আকাঙ্ক্ষা করলাম, আমি যদি আজই ইসলাম গ্রহণ করতাম! ৩৩৪
ইমাম নববী রহ. বলেন, الحرقة হলো প্রসিদ্ধ জুহায়না গোত্রের একটি শাখাগোত্র।
متعوذاএর অর্থ, সে لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ বলেছিল তা দ্বারা হত্যা থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে, এতে বিশ্বাসী হয়ে নয়।
(৩৩৩. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪২৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৭৪৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৮৯৩২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৪৭৫১; নাসাঈ, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৮৫৪০; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ৩২২৮
৩৩৪. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৬৪৩, বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৮৪৭; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৯৩৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৫৬২)
مقدمة الامام النووي
49 - باب إجراء أحكام الناس عَلَى الظاهر وسرائرهم إِلَى الله تَعَالَى
393 - وعن أُسَامة بن زيدٍ رضي الله عنهما، قَالَ: بعثنا رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - إِلَى الْحُرَقَةِ مِنْ جُهَيْنَةَ فَصَبَّحْنَا القَوْمَ عَلَى مِيَاهِهِمْ، وَلَحقْتُ أنَا وَرَجُلٌ مِنَ الأَنْصَارِ رَجُلًا مِنْهُمْ، فَلَمَّا غَشَيْنَاهُ، قَالَ: لاَ إلهَ إلاَّ الله، فَكفَّ عَنْهُ الأَنْصَاري، وطَعَنْتُهُ برُمْحِي حَتَّى قَتَلْتُهُ، فَلَمَّا قَدِمْنَا المَدِينَةَ، بَلَغَ ذلِكَ النَّبيَّ - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ لِي: «يَا أُسَامَة، أقَتَلْتَهُ بَعْدَ مَا قَالَ: لا إلهَ إلاَّ اللهُ؟!» قُلْتُ: يَا رَسُول الله، إِنَّمَا كَانَ متعوِّذًا، فَقَالَ: «أقَتَلْتَهُ بَعْدَ مَا قَالَ: لاَ إلهَ إلاَّ اللهُ؟!» فما زَالَ يُكَرِّرُهَا عَلَيَّ حَتَّى تَمَنَّيْتُ أَنِّي لَمْ أَكُنْ أَسْلَمْتُ قَبْلَ ذلِكَ اليَوْمِ. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1) [ص:142]
وفي رواية: فَقَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «أَقَالَ: لاَ إلهَ إلاَّ اللهُ وقَتَلْتَهُ؟!» قُلْتُ: يَا رَسُول الله، إِنَّمَا قَالَهَا خَوْفًا مِن السِّلاحِ، قَالَ: «أَفَلاَ شَقَقْتَ عَنْ قَلْبِهِ حَتَّى تَعْلَمَ أَقَالَهَا أمْ لاَ؟!» فمَا زَالَ يُكَرِّرُهَا حَتَّى تَمَنَّيْتُ أنِّي أسْلَمْتُ يَوْمَئذٍ.
«الحُرَقَةُ» بضم الحاءِ المهملة وفتح الراءِ: بَطْنٌ مِنْ جُهَيْنَةَ: القَبِيلةُ المَعْرُوفَةُ. وقوله: «مُتَعَوِّذًا»: أيْ مُعْتَصِمًا بِهَا مِنَ القَتْلِ لاَ معْتَقِدًا لَهَا.
হাদীস নং: ৩৯৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ মানুষের উপর তাদের বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ী শরীআতের বিধান জারী করা এবং তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া।
অন্যায়ভাবে নিহত মুমিন ব্যক্তির পক্ষে হাশরের ময়দানে لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ এর ভূমিকা
হাদীছ নং : ৩৯৪

হযরত জুনদুব ইবন আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদল মুশরিকের বিরুদ্ধে একটি মুসলিম বাহিনী পাঠালেন। তারা পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হলো। মুশরিকদের এক ব্যক্তি এমন ছিল যে, সে কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে চাইলে অনায়াসে তাকে আক্রমণ করত ও হত্যা করে ফেলত। মুসলিমদের এক ব্যক্তি তার অসতর্কতার অপেক্ষায় থাকল। আমরা পরস্পর বলাবলি করতাম, তিনি উসামা ইবন যায়দ। যখন তিনি তার উপর তরবারি তুললেন, অমনি বলে উঠল لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ তারপরও তাকে হত্যা করলেন। তারপর সুসংবাদবাহী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পৌঁছল। তিনি তার কাছে খোঁজখবর নিলেন। সে সবই জানাল। এমনকি ওই ব্যক্তির সংবাদও জানাল যে, তিনি কী করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডাকলেন এবং বললেন, তুমি তাকে কেন হত্যা করলে? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে তো মুসলিমদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। সে অমুককে অমুককে হত্যা করেছে। এ বলে তিনি কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেন। অবশেষে আমি তার উপর হামলা করলাম। যেই না সে তরবারি দেখল, অমনি বলে উঠল لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারপর তুমি তাকে হত্যা করলে? তিনি বললেন, হাঁ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কিয়ামতের দিন যখন لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ সামনে আসবে তখন তুমি কী করবে? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কিয়ামতের দিন যখন لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ সামনে আসবে তখন তুমি কী করবে? তিনি আর কিছু নয়, বরাবর এ কথাই বলতে থাকলেন যে, কিয়ামতের দিন যখন لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ সামনে আসবে তখন তুমি কী করবে? -মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯৭; নাসাঈ, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৮৫৪১; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ৩২২৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৫৬২
مقدمة الامام النووي
49 - باب إجراء أحكام الناس عَلَى الظاهر وسرائرهم إِلَى الله تَعَالَى
394 - وعن جندب بن عبد الله - رضي الله عنه: أنَّ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - بَعَثَ بَعْثًا مِنَ المُسْلِمينَ إِلَى قَومٍ مِنَ المُشرِكينَ، وَأنَّهُمْ التَقَوْا، فَكَانَ رَجُلٌ مِنَ المُشْركينَ إِذَا شَاءَ أَنْ يَقْصِدَ إِلَى رَجُل مِنَ المُسْلِمينَ قَصَدَ لَهُ فَقَتَلَهُ، وَأنَّ رَجُلًا مِنَ المُسْلِمِينَ قَصَدَ غَفْلَتَهُ. وَكُنَّا نتحَدَّثُ أنَّهُ أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ، فَلَمَّا رَفَعَ عَلَيهِ السَّيفَ، قَالَ: لاَ إلهَ إلاَّ اللهُ، فَقَتَلهُ، فَجَاءَ البَشيرُ إِلَى رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - فَسَألَهُ وَأخبَرَهُ، حَتَّى أخْبَرَهُ خَبَرَ الرَّجُلِ كَيْفَ صَنَعَ، فَدَعَاهُ فَسَألَهُ، فَقَالَ: «لِمَ قَتَلْتَهُ؟» فَقَالَ: يَا رَسُول اللهِ، أوْجَعَ في المُسلِمِينَ، وَقَتَلَ فُلانًا وفلانًا، وسمى لَهُ نَفرًا، وَإنِّي حَمَلْتُ عَلَيهِ، فَلَمَّا رَأى السَّيفَ، قَالَ: لاَ إلهَ إلاَّ اللهُ. قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «أَقَتَلْتَهُ؟» قَالَ: نَعَمْ. قَالَ: «فَكَيفَ تَصْنَعُ بلاَ إلهَ إلاَّ اللهُ، إِذَا جَاءَتْ يَوْمَ القِيَامَةِ؟» قَالَ: يَا رَسُول الله، اسْتَغْفِرْ لِي. قَالَ: «وكَيفَ تَصْنَعُ بِلا إلهَ إلاَّ الله إِذَا جَاءتْ يَوْمَ القِيَامَةِ؟» فَجَعَلَ لاَ يَزِيدُ عَلَى أَنْ يَقُولَ: «كَيفَ تَصْنَعُ بِلاَ إلهَ إلاَّ الله إِذَا جَاءَتْ يَوْمَ القِيَامَةِ». رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ৩৯৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ মানুষের উপর তাদের বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ী শরীআতের বিধান জারী করা এবং তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া।
মানুষের বাহ্যিক অবস্থাই বিবেচ্য
হাদীছ নং : ৩৯৫

আব্দুল্লাহ ইবন উতবা ইবন মাসউদ রহ. বলেন, আমি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মানুষকে ধরা হত ওহীর দ্বারা। এখন ওহী বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা এখন তোমাদেরকে ধরব তোমাদের বাহ্যিক কাজকর্মের দ্বারা। যে ব্যক্তি আমাদের সামনে ভালো কাজ দেখাবে, আমরা তাকে নিরাপত্তা দেব ও তাকে কাছে জায়গা দেব। তার অভ্যন্তরীণ অবস্থা দিয়ে আমাদের কোনও কাজ নেই। তার অভ্যন্তরীণ অবস্থার হিসাব আল্লাহ নেবেন। আর যে ব্যক্তি আমাদের সামনে মন্দ কাজ করবে, তাকে নিরাপত্তা দেব না ও তাকে বিশ্বাস করব না, যদিও সে বলে, তার ভেতর ভালো -বুখারী।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৬৪১; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৬৮৫; শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৫১০
مقدمة الامام النووي
49 - باب إجراء أحكام الناس عَلَى الظاهر وسرائرهم إِلَى الله تَعَالَى
395 - وعن عبد الله بن عتبة بن مسعود، قَالَ: سَمِعْتُ عمر بن الخطاب - رضي الله عنه - يقولُ: إنَّ نَاسًا كَانُوا يُؤْخَذُونَ بِالوَحْيِ في عَهْدِ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - وَإنَّ الوَحْيَ قَدِ انْقَطَعَ، وإِنَّمَا نَأخُذُكُمُ الآن بما ظَهَرَ لَنَا مِنْ أعمَالِكُمْ، فَمَنْ أظْهَرَ لَنَا خَيْرًا أَمَّنَّاهُ وَقَرَّبْنَاهُ، وَلَيْسَ لَنَا مِنْ سَرِيرَتِهِ شَيْءٌ، اللهُ يُحَاسِبُهُ فِي سَرِيرَتِهِ، وَمَنْ أَظْهَرَ لَنَا سُوءًا لَمْ نَأْمَنْهُ وَلَمْ نُصَدِّقْهُ وَإنْ قَالَ: إنَّ سَرِيرَتَهُ حَسَنَةٌ. رواه البخاري. (1)
হাদীস নং: ৩৯৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৫০

আল্লাহর ভয়

خوف এর আভিধানিক অর্থ ভয়-ভীতি। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনওকিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কায় অন্তরে যে পীড়া বোধ হয়, তাকেই خوف বলে। শরীআতে যে خوف ও ভীতির গুণ অর্জনের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, সে ভীতির সারকথা হলো আযাবভোগের আশঙ্কা। অর্থাৎ নিজের সম্পর্কে এই আশঙ্কা বোধ করা যে, আমার শাস্তি হতে পারে। আখেরাতের শাস্তি সম্পর্কে অন্তরে এ ভয় পোষণ করা অতি জরুরি। এটা ঈমানের অঙ্গ। ভীতির এ গুণ চেষ্টা করলেই অর্জন করা যায়। এটা মানুষের সাধ্যভুক্ত। কাজেই চেষ্টা-সাধনা দ্বারা এ গুণ অবশ্যই অর্জন করা উচিত।
অন্তরে আখেরাতের ভয় থাকলে শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা তা প্রকাশ পায়। এর ফলে অন্তর পরিশুদ্ধ হয় এবং কাজকর্ম পরিশীলিত হয়। আখেরাতের ভয়ে ভীত ব্যক্তি সহজেই দুনিয়ার লোভ-লালসা পরিত্যাগ করতে পারে। তার অন্তরে অহংকার, হিংসা বিদ্বেষ প্রভৃতি রিপু শেকড় ছড়াতে পারে না। সে সহজেই পাপকর্ম হতে বিরত থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ভয় অতীব কল্যাণকর একটি গুণ। আল্লাহওয়ালা বুযুর্গগণ এ গুণটির খুব কদর করতেন। অন্যকেও তারা উৎসাহ দিতেন, যাতে এ গুণ অর্জনে সচেষ্ট হয়।
ইয়াহইয়া ইবন মু'আয রায়ী রহ. বলেন, মানুষ দারিদ্র্যকে যেমনটা ভয় করে, সেরকম ভয় যদি জাহান্নামকে করত, তবে অবশ্যই তারা জান্নাতী হয়ে যেত।
আবূ সুলায়মান দারানী রহ. বলেন, যে অন্তরে আল্লাহর ভয় নেই তা উজাড় হয়ে গেছে।
হাসান বসরী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি বেশি বেশি ভয়ের কথা বলে, তার সাহচর্যে থাক। দুনিয়ায় এরূপ ব্যক্তিদের সাহচর্যে থাকলে আখেরাতে নির্ভয় থাকতে পারবে। যেসব লোক তোমাকে এ জগতে নির্ভয় করে রাখে, তাদের সাহচর্য এড়িয়ে চল।
আবূ হাফস রহ. বলেন, خوف হলো আল্লাহর চাবুক। যারা তার দরজা থেকে পালায়, এ চাবুক দ্বারা তিনি তাদের ফিরিয়ে আনেন। তিনি আরও বলেন, খওফ হলো অন্তরের প্রদীপ। এর দ্বারা ঈমানদার ব্যক্তি কোন্‌টা ভালো কোন্‌টা মন্দ দেখতে পায়। দুনিয়ায় তুমি যাকেই ভয় করে থাক, তুমি তার থেকে পালিয়ে যাও। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, সে অন্য সকলের থেকে পালিয়ে আল্লাহর কাছেই ফিরে আসে। সুতরাং আল্লাহর ভয়ে ভীত ব্যক্তি তাঁর (আযাব) থেকে পালিয়ে তাঁর কাছে আশ্রয় নেয়।
জুন্নুন মিসরী রহ. বলেন, অন্তরে যতক্ষণ খওফ থাকে, ততক্ষণ মানুষ সঠিক পথে থাকে। যেই না খওফ দূর হয়ে যায়, অমনি পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।
মানুষ যাতে আখেরাত ভুলে দুনিয়ার আনন্দ-ফুর্তিতে মত্ত হয়ে না পড়ে, সেজন্য অন্তরে আখেরাতের ভয় জাগানো দরকার। এ লক্ষ্যে কুরআন ও হাদীছে বিভিন্নভাবে আখেরাতের কঠিন পরিস্থিতিসমূহ তুলে ধরা হয়েছে। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। এবার আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।

‘আল্লাহর ভয়' সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত

وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ

অর্থ : আর তোমরা (অন্য কাউকে নয়) কেবল আমাকেই ভয় কর।৩৩৭

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে বনী ইসরাঈলকে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, তারা যেন এক আল্লাহ তাআলাকেই ভয় করে। আয়াতের শুরুতে তাদেরকে ওই সকল নিআমত স্মরণ করতে বলা হয়েছে, যা বিশেষভাবে তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। এবং তাদেরকে ওই অঙ্গীকার পূরণের আদেশ করা হয়েছে, যা তাওরাতের অনুসরণ এবং সর্বশেষ নবীর প্রতি ঈমান আনা সম্পর্কে তাদের থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল। আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ও আল্লাহ তাআলার বিধান পালনের ক্ষেত্রে অনেক সময় বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে, যেমন সমাজের নিন্দা-সমালোচনার ভয়, ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীদের জুলুম- অত্যাচারের ভয় ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে মাখলূককে ভয় করে খালেক ও সৃষ্টিকর্তার হুকুম অমান্য করা কোনও বুদ্ধির কথা নয়। আল্লাহ তাআলা যার সাহায্য করেন, তার ক্ষতি করতে পারে এমন কেউ নেই। আবার আল্লাহ তাআলা কারও ক্ষতি করতে চাইলে তাকে রক্ষা করার মত ক্ষমতাও কারও নেই। অপরদিকে কোনও মাখলুকের দ্বারা কোনও ক্ষতি হলেও তা সীমিত দিনের সীমিত ক্ষতি। সে ক্ষতি স্বীকার করে কেউ যদি আল্লাহর হুকুম পালন করতে প্রস্তুত হয়ে যায়, তবে এর বদলে আখেরাতে অনন্ত দিনের অসীম উপকার সে লাভ করবে। আবার মাখলুকের ভয়ে আল্লাহর হুকুম অমান্য করলে যদি তাতে পার্থিব কোনও উপকার হয়ও, সে উপকারও হয় সীমিত পরিমাণে সীমিত দিনের জন্য। অথচ আল্লাহ তাআলার হুকুম অমান্য করার কারণে যে ক্ষতি হয়ে যায় তা অনন্তকালের অপরিসীম ক্ষতি। তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি ও জাহান্নামের চির শাস্তি। তাই আল্লাহ তাআলা বলছেন, তোমরা অন্য কাউকে নয়; বরং আমাকেই ভয় কর।
প্রকাশ থাকে যে, আয়াতটির হুকুম বনী ইসরাঈলকে লক্ষ্য করে দেওয়া হলেও আমাদের জন্যও এটি সমান প্রযোজ্য। কুরআন মাজীদে বিভিন্ন জাতিকে লক্ষ্য করে যে আদেশ করা হয়েছে তার উদ্দেশ্য এ নয় যে, কেবল তারাই তা পালন করবে। বস্তুত তারা কেবলই উপলক্ষ্য। সে আদেশ প্রযোজ্য সকলের জন্যই।

দুই নং আয়াত

إِنَّ بَطْشَ رَبِّكَ لَشَدِيدٌ

অর্থ : প্রকৃতপক্ষে তোমার প্রতিপালকের ধরা বড়ই কঠিন।৩৩৮

ব্যাখ্যা

এটি সূরা বুরূজের ১২ নং আয়াত। এর আগে ১০ নং আয়াতে জানানো হয়েছে- যারা মুমিন নর-নারীকে উৎপীড়ন করে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে চায় আর এ অবস্থায় তাদের মৃত্যু ঘটে, তাদের জন্য জাহান্নামের কঠিন আযাবের ব্যবস্থা রয়েছে। ১১ নং আয়াতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত্বনাদানের জন্য সুসংবাদ শোনানো হয়েছে যে, আখেরাতে সৎকর্মশীল মুমিনগণ জান্নাতের অধিকারী হবে আর জান্নাত পেয়ে যাওয়াই মহাসাফল্য। তারপর এ আয়াতে তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে যে, আপনি কাফের-মুশরিকদের জুলুম-অত্যাচারে বিচলিত হবেন না; বরং আপন কর্তব্য পালন করতে থাকুন। প্রকৃত সাফল্য আপনার ও আপনার অনুসারীদের জন্যই নির্ধারিত। যারা আপনার বিরুদ্ধাচরণ করছে, তাওবা না করলে তাদেরকে অবশ্যই একদিন ধরা হবে। আপনার প্রতিপালকের ধরা বড়ই কঠিন। তিনি জালিম-অত্যাচারীদেরকে কঠিনভাবেই ধরে থাকেন, যা থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনও সুযোগ থাকে না।
যদিও সতর্কবাণীটি কাফের-মুশরিকদের জন্য, কিন্তু সকলের জন্যই এর মধ্যে কঠিন বার্তা রয়েছে। নাফরমানির কারণে আল্লাহ তাআলা যে-কাউকেই শাস্তি দিতে পারেন। তিনি যেমন ক্ষমাশীল, তেমনি কঠোর শাস্তিদাতাও বটে। কুরআন মাজীদে একেকটি পাপকর্মের উল্লেখের সঙ্গে সে পাপ সম্পর্কে কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। কাজেই প্রত্যেকের উচিত আল্লাহ তাআলাকে ভয় করা এবং যাতে তাঁর সুকঠিন ধরার মধ্যে পড়ে যেতে না হয়, তাই প্রত্যেকের কর্তব্য সর্বপ্রকার পাপ থেকে বিরত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

তিন নং আয়াত

وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ (102) إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً لِمَنْ خَافَ عَذَابَ الْآخِرَةِ ذَلِكَ يَوْمٌ مَجْمُوعٌ لَهُ النَّاسُ وَذَلِكَ يَوْمٌ مَشْهُودٌ (103) وَمَا نُؤَخِّرُهُ إِلَّا لِأَجَلٍ مَعْدُودٍ (104) يَوْمَ يَأْتِ لَا تَكَلَّمُ نَفْسٌ إِلَّا بِإِذْنِهِ فَمِنْهُمْ شَقِيٌّ وَسَعِيدٌ (105) فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ (106)

অর্থ : যেসকল জনপদ জুলুমে লিপ্ত হয়, তোমার প্রতিপালক যখন তাদের ধরেন, তখন তাঁর ধরা এমনই হয়ে থাকে। বাস্তবিকই তাঁর ধরা অতি মর্মন্তুদ, অতি কঠিন। যে ব্যক্তি আখেরাতের শান্তিকে ভয় করে, তার জন্য এসব বিষয়ের মধ্যে বিরাট শিক্ষা রয়েছে। তা এমন দিন, যার জন্য সমস্ত মানুষকে একত্র করা হবে এবং তা এমন দিন, যা হবে (সকলের কাছে) দৃশ্যমান। আমি তা স্থগিত রেখেছি গণা-গুণতি কিছু কালের জন্য। যখন সে দিন আসবে, তখন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না। অতঃপর তাদের মধ্যে কেউ হবে দুর্গতিগ্রস্ত এবং কেউ হবে সদ্‌গতিসম্পন্ন। সুতরাং যারা দুর্গতিগ্রস্ত হবে, তারা থাকবে জাহান্নামে, যেখানে তাদের চিৎকার ও আর্তনাদ শোনা যাবে।৩৩৯

ব্যাখ্যা

এ আয়াতসমূহের আগে এক এক করে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের কওম, 'আদ জাতি, ছামূদ জাতি, লূত আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়, শু‘আয়ব আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় এবং ফিরআউন ও তার জাতির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হয়েছে। এসকল সম্প্রদায়কে আপন আপন নবীর বিরুদ্ধাচরণ করার পরিণামে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। তারপর এ আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলা জানাচ্ছেন যে, কোনও জনপদের বাসিন্দাগণ জুলুম-অত্যাচার ও অন্যায়-অপরাধ চালিয়ে যেতে থাকলে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এভাবেই কঠিন শাস্তি দিয়ে থাকেন। তাদেরকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তা ছিল দুনিয়াবী শাস্তি। সে শাস্তিই যখন এত কঠিন ছিল, তখন আখেরাতের শাস্তি কেমন কঠিন হবে তা কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। সুতরাং আখেরাতকে ভয় করে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত এসব সম্প্রদায়ের পরিণাম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। আর আখেরাতকে তো ভয় করতেই হবে। আখেরাতের সত্যতায় কোনও সন্দেহ নেই। সেদিন আগের-পরের সমস্ত মানুষকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত করা হবে। সকলের থেকে সমস্ত কাজের হিসাব নেওয়া হবে। সেটা ন্যায়বিচারের দিন। অত্যন্ত ভয়াবহ দিন। আল্লাহ তাআলার অনুমতি ছাড়া সেদিন কেউ কথা বলতে পারবে না। মানুষের মুখে বাকশক্তি বন্ধ করে দিয়ে তাদের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কথা বলার শক্তি দেওয়া হবে এবং তাদের থেকে সাক্ষ্য নেওয়া হবে। আমলনামা খুলে দেওয়া হবে। নেকী-বদী বিচার করা হবে। যার নেকীর ওজন বেশি হবে সে হবে ভাগ্যবান, আর যার বদীর ওজন বেশি হবে সে হবে হত্যভাগ্য। হতভাগ্যের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। ভাগ্যবানের ঠিকানা জান্নাত। উভয় দল উভয় ঠিকানায় চিরদিন থাকবে। এমন এক দিনকে ভয় না করে পারা যায় কি? সুতরাং সেদিনের ভয়ে ভীত থেকে প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য সকল পাপকর্ম থেকে দূরে থাকা এবং যতবেশি সম্ভব কর্ম অব্যাহত রাখা।

চার নং আয়াত

وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ

অর্থ : আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ (শাস্তি) সম্পর্কে সাবধান করছেন ।৩৪০

ব্যাখ্যা

এটি সূরা আলে ইমরানের ২৮ নং আয়াতের অংশবিশেষ। পূর্ণ আয়াতটি এরকম-

لَا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ وَإِلَى اللَّهِ الْمَصِيرُ

‘মুমিনগণ যেন মুমিনদেরকে ছেড়ে কাফেরদেরকে (নিজেদের) মিত্র না বানায়। যে এরূপ করবে আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। তবে তাদের (জুলুম) থেকে বাঁচার জন্য যদি আত্মরক্ষামূলক কোনও পন্থা অবলম্বন কর, সেটা ভিন্ন কথা। আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ (শাস্তি) সম্পর্কে সাবধান করছেন আর তাঁরই দিকে (সকলকে) ফিরে যেতে হবে।
এ আয়াতে মুমিনদেরকে কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ এমন বন্ধুত্ব ও আন্তরিক সম্পর্ক, যার ফলে দু'জন লোকের জীবনের লক্ষ্য ও লাভ-লোকসান অভিন্ন হয়ে যায়। মুসলিমদের এ জাতীয় সম্পর্ক কেবল মুসলিমদের সঙ্গেই হতে পারে। অমুসলিমদের সঙ্গে এরূপ সম্পর্ক স্থাপন কঠিন পাপ।
অবশ্য যে অমুসলিম যুদ্ধরত নয়, তার সাথে সদাচরণ, সৌজন্যমূলক ব্যবহার ও তার কল্যাণ কামনা করা কেবল জায়েযই নয়, বরং তাই কাম্য। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ লোকদের সঙ্গে সর্বদা সদয় আচরণই করেছেন।
এমনিভাবে অমুসলিমদের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতামূলক চুক্তি বা ব্যবসায়িক কারবারও করা যেতে পারে। শর্ত হচ্ছে এরূপ চুক্তি ইসলাম ও মুসলিমদের স্বার্থবিরোধী হতে পারবে না এবং তাতে শরীআতের পরিপন্থী কোনও কর্মপন্থাও অবলম্বন করা যাবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর পরে সাহাবায়ে কেরাম এরূপ কারবার ও চুক্তি সম্পাদন করেছেন।
এ আয়াতে অমুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনকে নিষেধ করে দেওয়ার পর যে ইরশাদ হয়েছে— ‘তবে তাদের (জুলুম) থেকে বাঁচার জন্য আত্মরক্ষামূলক কোনও পন্থা অবলম্বন করলে সেটা ভিন্ন কথা', এর অর্থ কাফেরদের জুলুম ও নিপীড়ন থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে যদি এমন কোনও পন্থা অবলম্বন করতে হয়, যা দ্বারা বাহ্যত মনে হয় তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করা হয়েছে, তবে তা করার অবকাশ আছে।
এরপর আল্লাহ তাআলা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন যে, وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ (শাস্তি) সম্পর্কে সাবধান করছেন' । অর্থাৎ মুমিনদের কর্তব্য কেবল আল্লাহ তাআলাকেই ভয় করা। তিনি অসন্তুষ্ট হন এমন কোনও কাজে কিছুতেই লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। তিনি যখন কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, তখন বোঝাই যাচ্ছে এটা করা তাঁর পসন্দ নয়; করলে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন। তাই তাদের সঙ্গে বাহ্যিক বা আন্তরিক বন্ধুত্ব স্থাপন থেকে বেঁচে থাকতে হবে। কখনও যদি বিশেষ কোনও কারণে তাদের সঙ্গে মৈত্রীস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে, তখনও লক্ষ রাখতে হবে যাতে শরীআতের সীমানা অতিক্রম না হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, একদিন সকলকেই আল্লাহ তাআলার সামনে হাজির হতে হবে। তাঁর কাছে প্রতিটি কাজকর্মের কৈফিয়ত দিতে হবে। বন্ধুত্ব সম্পর্কেও তিনি জিজ্ঞেস করবেন তা তাঁর দেওয়া শরীআত মোতাবেক করা হয়েছিল কি না। তখন কোনও মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে বাঁচা যাবে না। সুতরাং তাঁর ভয়ে এবং আখেরাতের শাস্তি হতে বাঁচার উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব করার কাজটিও শরীআতের সীমারেখার মধ্যে রাখতে হবে।

পাঁচ নং আয়াত

يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ (34) وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ (35) وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ (36) لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ (37)

অর্থ : (তা ঘটবে সেইদিন), যেদিন মানুষ তার ভাই থেকেও পালাবে এবং নিজ পিতা-মাতা থেকেও এবং নিজ স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি থেকেও। (কেননা) সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন দুশ্চিন্তা দেখা দেবে, যা তাকে অন্যের থেকে ব্যস্ত করে রাখবে।৩৪১

ব্যাখ্যা

সূরা আবাসা'র এ আয়াতসমূহে কিয়ামতের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। এর সারকথা হচ্ছে, সেদিন প্রত্যেকে আপন চিন্তায় ব্যস্ত থাকবে। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব কেউ কারও দিকে ফিরে তাকানোর অবকাশ পাবে না। বরং প্রত্যেকে একে অন্যের থেকে এই ভয়ে পালাবে যে, না-জানি তার কাছে কোনও নেকী চেয়ে বসে কিংবা দুনিয়ায় যে হক ও অধিকার খর্ব করা হয়েছিল তা দাবি করে বসে, না-জানি ভাই বলে বসে আমি অর্থকষ্টে ভুগছিলাম, তুমি তোমার সম্পদ দিয়ে আমাকে সাহায্য করনি, পিতা-মাতা বলে বসে- তুমি আমাদের সেবাযত্ন করনি ও আমাদের হক আদায় করনি, স্ত্রী বলে বসে- তুমি আমার ভরণপোষণ ঠিকমত দাওনি বা আমাকে তা দিয়েছিলে হারাম উপার্জন থেকে এবং ছেলে-মেয়ে বলে বসে- আমাদেরকে দীন শেখাওনি এবং দীনের পথে চালাওনি। কাজেই আখেরাতের এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যাতে আল্লাহ তাআলার রহমতের ছায়া পাওয়া যায়, সে উদ্দেশ্যে এখনই সতর্ক হয়ে যাওয়া উচিত এবং আল্লাহ ও বান্দার কোনও হক যাতে নষ্ট করা না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে শরীআত মোতাবেক জীবনযাপন করা উচিত।

ছয় নং আয়াত

يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ (1) يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ (2)

অর্থ : হে মানুষ! নিজ প্রতিপালকের (ক্রোধকে ভয় কর। জেনে রেখ, কিয়ামতের প্রকম্পন এক সাংঘাতিক জিনিস। যেদিন তোমরা তা দেখতে পাবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী সেই শিশুকে (পর্যন্ত) ভুলে যাবে, যাকে সে দুধ পান করিয়েছে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত ঘটিয়ে ফেলবে আর মানুষকে তুমি এমন দেখবে, যেন তারা নেশাগ্রস্ত, অথচ তারা নেশাগ্রস্ত নয়; বরং (সেদিন) আল্লাহর শাস্তি হবে অতি কঠোর।৩৪২

ব্যাখ্যা

এ আয়াতদু'টিতে হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম পুনরুত্থান দিবসে শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার পর সকল কবরবাসী যখন কবর থেকে উঠে হাশরের ময়দানে ছুটে যাবে, তখনকার ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে যে বলা হয়েছে স্তন্যদাত্রী তার শিশু থেকে গাফেল হয়ে যাবে এবং গর্ভবর্তী মহিলার গর্ভপাত হয়ে যাবে, তা বলা হয়েছে রূপকার্থে। বাস্তবেই যে এমন ঘটবে তা নয়। বোঝানো হচ্ছে যে, সেদিনের পরিস্থিতি এমনই বিভীষিকাময় হবে যে, তখন কোনও গর্ভবর্তী মহিলা থাকলে তার গর্ভপাত হয়ে যেত, কোনও স্তন্যদাত্রী থাকলে সে তার শিশুর কথা ভুলে যেত।
আল্লাহ তাআলা বিভীষিকাময় সে দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমাদের সাবধান করছেন, যাতে সে কঠিন দিনে তাঁর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইহজীবনে তাঁর দেওয়া শরীআত মোতাবেক জীবনযাপন করি।

সাত নং আয়াত

وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ

অর্থ : (দুনিয়ায়) যে ব্যক্তি নিজ প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোর ভয় রাখত, তার জন্য থাকবে দু'টি উদ্যান। ৩৪৩

ব্যাখ্যা

এটি সূরা আর-রহমানের ৪৬ নং আয়াত। এখান থেকে সূরাটির শেষ পর্যন্ত আয়াতসমূহে জান্নাতের বিভিন্ন নিআমতের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এ আয়াত বলছে, জান্নাতের সে স্থায়ী অফুরন্ত নিআমতরাজি পাবে এমন লোক, যে তার অন্তরে এই ভয় রাখে যে, একদিন তাকে তার প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াতে হবে। সেদিন তাঁর কাছে সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে। এ ভয়ের দাবি হলো কোনও অবস্থায়ই আল্লাহ তাআলার নাফরমানি না করা, সকল ক্ষেত্রে শরীআতের অনুশাসন মেনে চলা এবং তাকওয়া-পরহেযগারীর সঙ্গে জীবনযাপন করা।

আট নং আয়াত

وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ (25) قَالُوا إِنَّا كُنَّا قَبْلُ فِي أَهْلِنَا مُشْفِقِينَ (26) فَمَنَّ اللَّهُ عَلَيْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُومِ (27) إِنَّا كُنَّا مِنْ قَبْلُ نَدْعُوهُ إِنَّهُ هُوَ الْبَرُّ الرَّحِيمُ (28)

অর্থ : তারা একে অন্যের দিকে ফিরে অবস্থাদি জিজ্ঞেস করবে। বলবে, আমরা পূর্বে আমাদের পরিবারবর্গের মধ্যে (অর্থাৎ দুনিয়ায়) বড় ভয়ের ভেতর ছিলাম। অবশেষে আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে রক্ষা করেছেন উত্তপ্ত বায়ুর শাস্তি থেকে। আমরা এর আগে তার কাছে দু'আ করতাম। বস্তুত তিনি অতি অনুগ্রহশীল, পরম দয়ালু।

ব্যাখ্যা

এ আয়াতসমূহে জান্নাতে প্রবেশের পর জান্নাতবাসীদের পরস্পরের মধ্যে যে কথাবার্তা হবে তার একটা অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। তখন তারা একে অন্যকে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে বলবে, আমরা দুনিয়ায় পরিবার-পরিজনের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছিলাম এই ভীতির সঙ্গে যে, না-জানি মৃত্যুর পর আমাদের কী পরিণাম হয়। অর্থাৎ পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে মাতোয়ারা হয়ে আমরা আখেরাতকে ভুলে যাইনি। আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে তাঁর হুকুমমত চলার চেষ্টা করেছি। ফলে আল্লাহ তাআলা আজ আমাদের প্রতি দয়া করেছেন। তিনি আমাদেরকে এমনই নিরাপত্তা দিয়েছেন যে, জাহান্নামের উত্তপ্ত বাতাস পর্যন্ত আমাদের স্পর্শ করে না। দুনিয়ায় আমরা তাঁর ভয়ে ভীত হয়ে তাঁকেই ডাকতাম, তাঁরই ইবাদত করতাম। তিনি আমাদের ডাক শুনেছেন। আমাদের ইবাদত কবুল করেছেন। তাই আজ তিনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তিনি আমাদের সঙ্গে রহমতের আচরণ করছেন।
আল্লাহ তাআলা জান্নাতবাসীদের এ কথোপকথন উল্লেখ করে আমাদেরকে সচেতন করছেন যে, আমরা যেন সর্বাবস্থায় তাঁকে ভয় করে চলি, যেন তাকওয়া ও পরহেযগারীর সঙ্গে জীবনযাপন করি। আমরা যদি অন্তরে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি জাগরূক রেখে আল্লাহর দেওয়া দীন অনুসরণ করে চলতে পারি, তবে আখেরাতে আমরাও জান্নাতের অনন্ত অফুরন্ত সুখ-শান্তি লাভ করতে পারব। তখন আমরাও এরূপ কৃতজ্ঞতার ভাষায় পরস্পরের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে পারব। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।

৩৩৭. সূরা বাকারা (২), আয়াত ৪০

৩৩৮. সূরা বুরূজ (৮৫), আয়াত ১২

৩৩৯. সূরা হুদ (১১), আয়াত ১০২-১০৬

৩৪০. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ২৮

৩৪১. সূরা আবাসা (৮০), আয়াত ৩৪-৩৭

৩৪২. সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ১-২

৩৪৩, সূরা আর-রহমান (৫৫), আয়াত ৪৬
মানবশিশুর সৃজন পরিক্রমা ও তাকদীরের লিখন
হাদীছ নং : ৩৯৬

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহা সত্যবাদী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির সৃজন তার মায়ের গর্ভে চল্লিশ দিন জমা করে রাখা হয় শুক্রাকারে। তারপর তা জমাট বাঁধা রক্ত অবস্থায় থাকে সমান কাল। তারপর তা মাংসপিণ্ড অবস্থায় থাকে সমান কাল। তারপর ফিরিশতা পাঠানো হয়। সে ফিরিশতা তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দেয়। আর তাকে চারটি বিষয় লিখতে আদেশ করা হয়- তার রিযিক, তার আয়ু, তার আমল এবং সে হতভাগ্য হবে না ভাগ্যবান। সেই সত্তার কসম, যিনি ব্যতীত কোনও মা'বূদ নেই, তোমাদের একেকজন সারা জীবন জান্নাতবাসীদের আমলের মত আমল করতে থাকে, এমনকি তার ও জান্নাতের মধ্যে মাত্র এক হাতের দূরত্ব থাকে। ঠিক এ অবস্থায় (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়। তখন সে জাহান্নামবাসীদের আমলের মত আমল করতে শুরু করে। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে। অপরদিকে তোমাদের একেকজন জাহান্নামবাসীদের আমলের মত আমল করতে থাকে, এমনকি তার ও জাহান্নামের মধ্যে মাত্র এক হাতের দূরত্ব থাকে। এ অবস্থায় (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়ে যায়। তখন সে জান্নাতবাসীদের আমলের মত আমল করতে শুরু করে। ফলে সে তাতে প্রবেশ করে -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৫৯৪, ৭৪৫৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৪৩; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৭০৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩১৩৭; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৭৬: মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩৯৩৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬১৭৪ তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০৪৪০
مقدمة الامام النووي
50 - باب الخوف
قَالَ الله تَعَالَى: {وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ} [البقرة: 40]، وَقالَ تَعَالَى: {إِنَّ بَطْشَ رَبِّكَ لَشَدِيدٌ} [البروج: 12]، وَقالَ تَعَالَى: {وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَةً لِمَنْ خَافَ عَذَابَ الآخِرَةِ ذَلِكَ يَوْمٌ مَجْمُوعٌ لَهُ النَّاسُ وَذَلِكَ يَوْمٌ [ص:143] مَشْهُودٌ وَمَا نُؤَخِّرُهُ إِلاَّ لأَجَلٍ مَعْدُودٍ يَوْمَ يَأْتِ لا تَكَلَّمُ نَفْسٌ إِلاَّ بِإِذْنِهِ فَمِنْهُمْ شَقِيٌّ وَسَعِيدٌ فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ} [هود: 102 - 106]، وَقالَ تَعَالَى: {وَيُحَذِّرُكُمُ اللهُ نَفْسَهُ} [آل عمران: 28]، وَقالَ تَعَالَى: {يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ} [عبس: 34 - 37]، وَقالَ تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللهِ شَدِيدٌ} [الحج: 1 - 2]، وَقالَ تَعَالَى: {وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ} [الرحمان: 46]، وَقالَ تَعَالَى: {وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءلُونَ قَالُوا إِنَّا كُنَّا قَبْلُ فِي أَهْلِنَا مُشْفِقِينَ، فَمَنَّ اللهُ عَلَيْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُومِ إِنَّا كُنَّا مِنْ قَبْلُ نَدْعُوهُ إِنَّهُ هُوَ الْبَرُّ الرَّحِيمُ} [الطور: 25 - 28]
وَالآيات في الباب كثيرة جدًا معلومات، والغرض الإشارة إِلَى بعضها وقد حصل:
وأما الأحاديث فكثيرة جدًا فنذكر مِنْهَا طرفًا وبالله التوفيق:
396 - عن ابن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: حدثنا رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - وَهُوَ الصادق المصدوق: «إنَّ أحَدَكُمْ يُجْمَعُ خَلْقُهُ في بَطْنِ أُمِّهِ أربَعِينَ يَومًا نُطْفَةً، ثُمَّ يَكُونُ عَلَقَةً مِثْلَ ذلِكَ، ثُمَّ يَكُونُ مُضْغَةً مِثْلَ ذلِكَ، ثُمَّ يُرْسَلُ المَلَكُ، فَيَنْفُخُ فِيهِ الرُّوحَ، وَيُؤْمَرُ بِأرْبَعِ كَلِمَاتٍ: بِكَتْبِ رِزْقِهِ وَأجَلِهِ وَعَمَلِهِ وَشَقِيٌّ أَوْ سَعِيدٌ. فَوَالَّذِي لاَ إلهَ غَيْرُهُ إنَّ أحَدَكُمْ لَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أهْلِ الجَنَّةِ حَتَّى مَا يَكُونُ بَيْنَهُ وبيْنَهَا إلاَّ ذِرَاعٌ فَيَسْبِقُ عَلَيهِ الكِتَابُ، فَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أهْلِ النَّارِ فَيدْخُلُهَا، وَإنَّ أَحَدَكُمْ لَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أهْلِ النَّارِ حَتَّى مَا يَكُونُ بَيْنَهُ وَبَيْنَهَا إلاَّ ذراعٌ، فَيَسْبِقُ عَلَيهِ الكِتَابُ فَيعْمَلُ بِعَمَلِ أهْلِ الجَنَّةِ فَيَدْخُلُهَا». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীস নং: ৩৯৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর ভয়
জাহান্নামের সত্তর হাজার লাগাম
হাদীছ নং : ৩৯৭

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সেদিন জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে। তার সত্তর হাজার লাগাম থাকবে। প্রতিটি লাগামের সঙ্গে থাকবে সত্তর হাজার ফিরিশতা। তারা সেটি টানতে থাকবে -মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৮৪২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং২৫৭৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা:৩৪১১৭; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০৪২৮)
مقدمة الامام النووي
50 - باب الخوف
397 - وعنه، قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «يُؤتَى بِجَهَنَّمَ يَومَئذٍ لَهَا سَبْعُونَ أَلفَ زِمَامٍ، مَعَ كُلِّ زِمَامٍ سَبعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ يَجُرُّونَهَا». رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ৩৯৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর ভয়
জাহান্নামের সর্বাপেক্ষা লঘু শাস্তি
হাদীছ নং : ৩৯৮

হযরত নু'মান ইবন বাশীর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা লঘু শাস্তিপ্রাপ্ত হবে ওই ব্যক্তি, যার দু' পায়ের খোড়লে দু'টি জ্বলন্ত অঙ্গার রাখা হবে। তাতে তার মগজ উথলাতে থাকবে। সে তারচে' বেশি কঠিন শাস্তিপ্রাপ্ত আর কাউকে মনে করবে না। অথচ জাহান্নামীদের মধ্যে সেই হবে সর্বাপেক্ষা লঘু শাস্তিপ্রাপ্ত -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৫৬১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২১৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬০৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৮৪১৩; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ১৮৪৪৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৪০০
مقدمة الامام النووي
50 - باب الخوف
398 - وعن النعمان بن بشير رضي الله عنهما، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «إنَّ أَهْوَنَ [ص:144] أَهْلِ النَّارِ عَذَابًا يَوْمَ القِيَامَةِ لَرَجُلٌ يُوضعُ في أَخْمَصِ قَدَمَيْهِ جَمْرَتَانِ يَغْلِي مِنْهُمَا دِمَاغُهُ. مَا يَرَى أنَّ أَحَدًا أشَدُّ مِنْهُ عَذَابًا، وَأنَّهُ لأَهْوَنُهُمْ عَذَابًا». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীস নং: ৩৯৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর ভয়
জাহান্নামের শাস্তির মাত্রাভেদ
হাদীছ নং : ৩৯৯

হযরত সামুরা ইবন জুনদুব রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জাহান্নামের আগুন জাহান্নামীদের কারও গোড়ালী পর্যন্ত গ্রাস করবে, কারও হাঁটু পর্যন্ত গ্রাস করবে, কারও কোমর পর্যন্ত গ্রাস করবে এবং কারও গলা পর্যন্ত গ্রাস করবে -মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৮৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২০১৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৪১৭৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৬৮৮৯; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩১২)
مقدمة الامام النووي
50 - باب الخوف
399 - وعن سمرة بن جندب - رضي الله عنه: أنَّ نبيَّ الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «مِنْهُمْ مَنْ تَأخُذُهُ النَّارُ إِلَى كَعْبَيهِ، وَمنْهُمْ مَنْ تَأخُذُهُ إِلَى رُكْبَتَيهِ، وَمنْهُمْ مَنْ تَأخُذُهُ إِلَى حُجزَتِهِ، وَمِنْهُمْ مَنْ تَأخُذُهُ إِلَى تَرْقُوَتِهِ». رواه مسلم. (1)
«الحُجْزَةُ»: مَعْقِدُ الإزار تَحْتَ السُّرَّةِ، وَ «التَّرْقُوَةُ» بفتح التاءِ وضم القاف: هي العَظمُ الَّذِي عِنْدَ ثَغْرَةِ النَّحْرِ، وَللإنْسَانِ تَرْقُوتَانِ في جَانبَي النَّحْرِ.
হাদীস নং: ৪০০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর ভয়
হাশরের ময়দানের বিভীষিকা
হাদীছ নং : ৪০০

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াবে। সেদিন তাদের কেউ কেউ নিজ ঘামের মধ্যে ডুবে যাবে কানের অর্ধেক বরাবর -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৯৩৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৮৬২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৩৩৬; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৬১৩; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১৫৯২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৭৩৩১; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২৫৪; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৩১৬)
مقدمة الامام النووي
50 - باب الخوف
400 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما: أنَّ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ العَالَمينَ حَتَّى يَغِيبَ أَحَدُهُمْ في رَشْحِهِ إِلَى أَنْصَافِ أُذُنَيهِ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
وَ «الرَّشْحُ»: العَرَقُ.