রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين

ভূমিকা অধ্যায় - এর পরিচ্ছেদসমূহ

মোট হাদীস ৬৭৯ টি

হাদীস নং: ৩৪১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৪২

পিতা-মাতার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, স্ত্রী ও অন্য যেসকল লোককে সম্মান করা কাম্য তাদের প্রতি সদাচরণের ফযীলত

ইসলামে ভদ্রতা ও সৌজন্যমূলক আচরণের পরিধি অনেক ব্যাপক। এক হচ্ছে সাধারণ ভদ্রতা, যা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রেই রক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। আরেক হচ্ছে বিশেষ ভদ্রতা। এর বিভিন্ন স্তর আছে। যেমন, যারা মুসলিম, ঈমান ও ইসলামের সুবাদে অমুসলিম অপেক্ষা তারা সৌজন্যমূলক আচরণের অধিকতর হকদার। মুসলমানদের মধ্যেও যারা আত্মীয় বা প্রতিবেশী, তারা অন্যদের তুলনায় বেশি সদাচরণ পাওয়ার উপযুক্ত। আবার তাদের মধ্যেও নিকটাত্মীয় ও নিকট প্রতিবেশীর অধিকার অন্যদের তুলনায় বেশি। আত্মীয়বর্গের মধ্যে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দের মর্যাদা সবার উপরে। পিতা-মাতার স্বতন্ত্র হক ও মর্যাদা তো আছেই।
পিতা-মাতার অধিকার সরাসরি তাদের পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের সুবাদে। আত্মীয় স্বজনের অধিকারও সরাসরি আত্মীয়তাসূত্রে নির্ধারিত। ইসলাম পিতা-মাতা ও আত্মীয়বর্গের যারা বন্ধুবান্ধব তাদেরও একরকম হক সাব্যস্ত করেছে। তাদের এ হক নির্ধারিত হয়েছে পিতা-মাতা ও আত্মীয়বর্গের সম্মানার্থে। কাজেই আদর্শ সন্তানের কর্তব্য পিতা-মাতার জীবদ্দশায় এবং তাদের মৃত্যুর পরও তাদের বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলা। একই কথা আত্মীয়স্বজনের বন্ধু-বান্ধবের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আত্মীয়তার মর্যাদা রক্ষার খাতিরে প্রত্যেকের কর্তব্য তার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যাদের বন্ধুত্ব আছে তাদের প্রতিও বিশেষ সৌজন্য প্রদর্শন করা।
এমনিভাবে স্বামী-স্ত্রীর বেলায়ও এ নীতি প্রযোজ্য। স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর সম্মানার্থে তার বান্ধবীদেরও সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া। অনুরূপ স্ত্রীরও কর্তব্য স্বামীর মর্যাদা রক্ষার্থে তার বন্ধুবান্ধবের মর্যাদা দেওয়া।
অনুরূপ যে-কোনও সম্মানী ব্যক্তি যেমন উস্‌তায, শায়খ, জনপ্রতিনিধি, ইমাম, শাসক প্রমুখের যথাযথ সম্মান রক্ষার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে যারা সম্পর্ক রাখে, তাদের প্রতিও স্বতন্ত্র শিষ্টাচার প্রদর্শন করা। এ সবই মহান ইসলামের সর্বব্যাপী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য যে শিক্ষা রেখে গেছেন, সে সম্পর্কিত কিছু হাদীছ তুলে ধরাই বর্তমান অধ্যায়ের লক্ষ্য। আমরা এ অধ্যায়ে উদ্ধৃত সেসব হাদীছের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
পিতার বন্ধুবর্গের প্রতি সৌজন্য প্রদর্শন
হাদীছ নং : ৩৪১

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, নেককাজ সমূহের মধ্যে একটি বড় নেককাজ হলো কোনও ব্যক্তির তার পিতার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা -মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৫২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯০৩; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১৪৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৫৬১২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৪৩০; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৭৫০১; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৬৮; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৫১৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৪৫
مقدمة الامام النووي
42 - باب فضل بر أصدقاء الأب والأم والأقارب والزوجة وسائر من يندب إكرامه
341 - عن ابن عمر رضي الله عنهما: أن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «إنّ أَبَرَّ البرِّ أَنْ يَصِلَ الرَّجُلُ وُدَّ أَبيهِ». (1)
হাদীস নং: ৩৪২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী ও অন্য যে সকল লোককে সম্মান করা কাম্য তাদের প্রতি সদাচরণের ফযীলত
পিতার বন্ধুবর্গের প্রতি সৌজন্য প্রদর্শন
হাদীছ নং : ৩৪২

আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণনা করেন যে, জনৈক বেদুঈন মক্কার পথে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর তাকে সালাম দিলেন এবং একটি গাধার পিঠে তাকে তুলে নিলেন, যে গাধাটিতে তিনি নিজে চড়তেন। তার মাথায় যে পাগড়িটি ছিল সেটিও তাকে দিয়ে দিলেন। আব্দুল্লাহ ইবন দীনার বলেন, আমরা তাকে বললাম, আল্লাহ তা'আলা আপনার কল্যা করুন। এরা তো বেদুঈন। সামান্যতেই খুশি হয়ে যায়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর বললেন, এই ব্যক্তির পিতা উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-এর বন্ধু ছিল। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি নেককাজ সমূহের মধ্যে একটি বড় নেককাজ হলো, কোনও ব্যক্তির তার পিতার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা।
অপর এক বর্ণনায় আছে, আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, তার একটি গাধা ছিল। তিনি যখন মক্কা মুকাররামার উদ্দেশে বের হতেন আর উটের পিঠে চড়তে চড়তে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তেন, তখন আরাম পাওয়ার জন্য ওই গাধার পিঠে সওয়ার হতেন। তিনি মাথায় পাগড়িও বেঁধে নিতেন। তো একদিনকার কথা। তিনি অভ্যাসমত গাধাটির উপর সওয়ার আছেন, এ অবস্থায় এক বেদুঈন তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তিনি বললেন, তুমি কি অমুকের পুত্র অমুক নও? সে বলল, হাঁ। তখন তিনি সেই গাধাটি তাকে দিয়ে দিলেন এবং বললেন, তুমি এতে চড়। তিনি পাগড়িটিও তাকে দিয়ে দিলেন এবং বললেন, এটি তোমার মাথায় বাঁধ। তাঁকে তাঁর কোনও এক সঙ্গী বলল, আল্লাহ তাআলা আপনার মাগফিরাত করুন। আপনি এ বেদুঈনকে গাধাটি দিয়ে দিলেন, অথচ এতে চড়ে আপনি আরাম বোধ করতেন। আবার যে পাগড়িটি নিজের মাথায় বাঁধতেন সেটিও তাকে দিয়ে দিলেন। তখন তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, নেককাজসমূহের মধ্যে একটি বড় নেককাজ হলো কোনও ব্যক্তির তার পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা। এই ব্যক্তির পিতা উমর রাযি. এর বন্ধু ছিল -মুসলিম।সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৫২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৫৬৫৩; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৬৮; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৫১৮
مقدمة الامام النووي
42 - باب فضل بر أصدقاء الأب والأم والأقارب والزوجة وسائر من يندب إكرامه
342 - وعن عبد الله بن دينار، عن عبد الله بن عمر رضي الله عنهما: أنَّ رَجُلًا مِنَ الأعْرَابِ لَقِيَهُ بطَريق مَكَّةَ، فَسَلَّمَ عَلَيهِ عبدُ الله بْنُ عُمَرَ، وَحَمَلَهُ عَلَى حِمَارٍ كَانَ يَرْكَبُهُ، وَأَعْطَاهُ عِمَامَةً كَانَتْ عَلَى رَأسِهِ، قَالَ ابنُ دِينَار: فَقُلْنَا لَهُ: أَصْلَحَكَ اللهُ، إنَّهُمُ الأَعرَابُ وَهُمْ يَرْضَوْنَ باليَسِير، فَقَالَ عبد الله بن عمر: إنَّ أَبَا هَذَا كَانَ وُدًّا لِعُمَرَ بنِ الخطاب - رضي الله عنه - وإنِّي سَمِعتُ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «إنَّ أبرَّ البِرِّ صِلَةُ الرَّجُلِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيهِ». (1)

وفي رواية عن ابن دينار، عن ابن عمر: أنَّهُ كَانَ إِذَا خَرَجَ إِلَى مَكّةَ كَانَ لَهُ حِمَارٌ يَتَرَوَّحُ عَلَيهِ إِذَا مَلَّ رُكُوبَ الرَّاحِلةِ، وَعِمَامَةٌ يَشُدُّ بِهَا رَأسَهُ، فَبيْنَا هُوَ يَومًا عَلَى ذلِكَ الحِمَارِ إِذْ مَرَّ بِهِ أعْرابيٌّ، فَقَالَ: ألَسْتَ فُلاَنَ بْنَ فُلاَن؟ قَالَ: بَلَى. فَأَعْطَاهُ الحِمَارَ، فَقَالَ: ارْكَبْ هَذَا، وَأَعْطَاهُ العِمَامَةَ وَقالَ: اشْدُدْ بِهَا رَأسَكَ، فَقَالَ لَهُ بعضُ أصْحَابِهِ: غَفَرَ الله لَكَ أعْطَيْتَ هَذَا الأعْرَابيَّ حِمَارًا كُنْتَ تَرَوَّحُ عَلَيهِ، وعِمَامةً كُنْتَ تَشُدُّ بِهَا رَأسَكَ؟ فَقَالَ: إنِّي سَمِعتُ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يَقُولُ: «إنَّ مِنْ أَبَرِّ البِرِّ أَنْ يَصِلَ الرَّجُلُ أهْلَ وُدِّ أبيهِ بَعْدَ أَنْ يُولِّيَ» وَإنَّ أبَاهُ كَانَ صَديقًا لعُمَرَ - رضي الله عنه.
رَوَى هذِهِ الرواياتِ كُلَّهَا مسلم.
হাদীস নং: ৩৪৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী ও অন্য যে সকল লোককে সম্মান করা কাম্য তাদের প্রতি সদাচরণের ফযীলত
পিতা-মাতার মৃত্যুর পর যা-কিছু করণীয়
হাদীছ নং : ৩৪৩

হযরত আবূ উসায়দ মালিক ইবন রাবী'আ সাইদী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বসা ছিলাম। এ অবস্থায় বনূ সালিমার এক ব্যক্তি এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের প্রতি করণীয় এমন কোনও সৎকর্ম আছে কি, যা দ্বারা আমি তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে পারি? তিনি বললেন, হাঁ, তাদের জন্য দুআ করা, তাদের জন্য (আল্লাহ তা'আলার কাছে) ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাদের (মৃত্যুর) পর তাদের কৃত অঙ্গীকার পূরণ করা, তাদের ওই আত্মীয়স্বজনের প্রতি সদ্ব্যবহার করা, যাদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক তাদের সূত্রেই এবং তাদের বন্ধু-বান্ধবকে সম্মান করা-আবূ দাউদ।
সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৬০৫৯; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৮৯৩; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৫১৪; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৭৯৭৬
مقدمة الامام النووي
42 - باب فضل بر أصدقاء الأب والأم والأقارب والزوجة وسائر من يندب إكرامه
343 - وعن أَبي أُسَيد - بضم الهمزة وفتح السين - مالك بن ربيعة الساعدي - رضي الله عنه - قَالَ: بَيْنَا نَحْنُ جُلُوسٌ عِنْدَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - إذ جَاءهُ رَجُلٌ مِنْ بَنِي سَلَمَةَ،
فَقَالَ: يَا رسولَ اللهِ، هَلْ بَقِيَ مِنْ برِّ أَبَوَيَّ شَيءٌ أَبِرُّهُما بِهِ بَعْدَ مَوتِهمَا؟ فَقَالَ: «نَعَمْ، الصَّلاةُ (1) عَلَيْهِمَا، والاِسْتغْفَارُ لَهُمَا، وَإنْفَاذُ عَهْدِهِمَا مِنْ بَعْدِهِما، وَصِلَةُ الرَّحِمِ الَّتي لا تُوصَلُ إلاَّ بِهِمَا، وَإكرامُ صَدِيقهمَا». رواه أَبُو داود. (2)
হাদীস নং: ৩৪৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী ও অন্য যে সকল লোককে সম্মান করা কাম্য তাদের প্রতি সদাচরণের ফযীলত
উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা রাযি.-এর প্রতি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বতের গভীরতা
হাদীছ নং : ৩৪৪

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্য কোনও স্ত্রীর প্রতি এমন ঈর্ষাবোধ করিনি, যেমনটা ঈর্ষাবোধ করেছি খাদীজা রাযি.-এর প্রতি। অথচ আমি তাকে কখনও দেখিনি। তবে তিনি তার কথা খুব বেশি বলতেন। কখনও কখনও বকরি জবাই করে তার অঙ্গগুলো কেটে আলাদা আলাদা করতেন, তারপর তা খাদীজার বান্ধবীদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। কখনও কখনও আমি তাকে বলতাম, দুনিয়ায় যেন খাদীজা ছাড়া আর কোনও নারী ছিল না! তিনি বলতেন, সে তো এরকম ছিল, এরকম ছিল এবং তার গর্ভে আমার সন্তানও জন্মগ্রহণ করেছিল।
অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বকরি জবাই করে তার গোশত যথেষ্ট পরিমাণে তার বান্ধবীদের কাছে হাদিয়া পাঠাতেন।
অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি যখনই বকরি জবাই করতেন, তখন বলতেন, তোমরা এর গোশত খাদীজার বান্ধবীদের কাছে পাঠাও।
অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেন, খাদীজা রাযি.-এর বোন হালা: বিনত খুওয়াইলিদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাইলে তাঁর খাদীজার অনুমতি চাওয়ার কথা স্মরণ হলো। তিনি আনন্দোৎফুল্ল হলেন। বলে উঠলেন, ইয়া আল্লাহ! হালাঃ বিনত খুওয়ায়লিদ? -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৮২১,৬০০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪৩৫, ২৪৩৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৮৭৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৪৩১; তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৫,১৮; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৪৯৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৯৫৫
مقدمة الامام النووي
42 - باب فضل بر أصدقاء الأب والأم والأقارب والزوجة وسائر من يندب إكرامه
344 - وعن عائشة رضي الله عنها، قَالَتْ: مَا غِرْتُ عَلَى أحَدٍ مِنْ نِسَاءِ النَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - مَا غِرْتُ عَلَى خَدِيجَة رضي الله عنها، وَمَا رَأيْتُهَا قَطُّ، وَلَكِنْ كَانَ يُكْثِرُ ذِكْرَهَا، وَرُبَّمَا ذَبَحَ الشَّاةَ، ثُمَّ يقَطِّعُهَا أعْضَاء، ثُمَّ يَبْعثُهَا في صَدَائِقِ خَديجَةَ، فَرُبَّمَا قُلْتُ لَهُ: كَأَنْ لَمْ يَكُنْ في الدُّنْيَا إلاَّ خَديجَةَ! فَيَقُولُ: «إنَّهَا كَانَتْ وَكَانَتْ وَكَانَ لي مِنْهَا وَلَدٌ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)

وفي رواية: وإنْ كَانَ لَيَذْبَحُ الشَّاءَ، فَيُهْدِي في خَلاَئِلِهَا (2) مِنْهَا مَا يَسَعُهُنَّ.

وفي رواية: كَانَ إِذَا ذبح الشاة، يقولُ: «أَرْسِلُوا بِهَا إِلَى أَصْدِقَاءِ خَديجَةَ».

وفي رواية: قَالَت: اسْتَأذَنَتْ هَالَةُ بِنْتُ خُوَيْلِد أُخْتُ خَدِيجَةَ عَلَى رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - فَعرَفَ اسْتِئذَانَ خَديجَةَ، فَارتَاحَ لِذَلِكَ، فَقَالَ: «اللَّهُمَّ هَالةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ».
قولُهَا: «فَارتَاحَ» هُوَ بالحاء، وفي الجمعِ بَيْنَ الصحيحين للحُميدِي (3): «فارتاع» بالعينِ ومعناه: اهتم بهِ.
হাদীস নং: ৩৪৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী ও অন্য যে সকল লোককে সম্মান করা কাম্য তাদের প্রতি সদাচরণের ফযীলত
মহান ব্যক্তির খাদেমকেও সম্মান করা
হাদীছ নং : ৩৪৫

হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি জারীর ইবন আব্দুল্লাহ আল-বাজালী রাযি.-এর সঙ্গে এক সফরে বের হলাম। তিনি আমার খেদমত করতে থাতেন। আমি তাকে বললাম, এমন করবেন না। তিনি বললেন, আমি আনসারদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য কিছু করতে দেখেছি। ফলে আমি নিজের সম্পর্কে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, তাদের মধ্যে যারই সাহচর্য পাই আমি অবশ্যই তার খেদমত করব -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৮৮৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫১৩; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ২২১৮; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৪৯০;
مقدمة الامام النووي
42 - باب فضل بر أصدقاء الأب والأم والأقارب والزوجة وسائر من يندب إكرامه
345 - وعن أنس بن مالك - رضي الله عنه - قَالَ: خرجت مَعَ جرير بن عبد الله البَجَليّ - رضي الله عنه - في سَفَرٍ، فَكَانَ يَخْدُمُني، فَقُلْتُ لَهُ: لاَ تَفْعَل، فَقَالَ: إِنِّي قَدْ رَأيْتُ الأنْصَارَ تَصْنَعُ برسول الله - صلى الله عليه وسلم - شيئًا آلَيْتُ عَلَى نَفسِي أَنْ لا أصْحَبَ أحَدًا مِنْهُمْ إلاَّ خَدَمْتُهُ. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীস নং: ৩৪৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৪৩

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারবর্গের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন ও তাদের মর্যাদার বর্ণনা

بيت -মানে ঘর। اهل بيت (আহলে বায়ত) মানে গৃহবাসী। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহলে বায়ত দ্বারা প্রথমত তাঁর স্ত্রীগণকেই বোঝায়। তাঁর ঘরে তো তাঁরাই বাস করতেন। তবে পরিভাষায় শব্দটি আরও ব্যাপক। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণের পাশাপাশি হযরত আলী রাযি. হযরত ফাতিমা রাযি. এবং হযরত হাসান রাযি. ও হুসায়ন রাযি. ও আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণনা করেন, একদিন ভোরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালো পশমের কাজ করা একটি চাদর পরে বের হন। এমন সময় আলী রাযি.-এর পুত্র হাসান রাযি. এসে উপস্থিত হন। তিনি তাঁকে চাদরের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন। তারপর হুসায়ন রাযি আসলেন। তাঁকেও চাদরের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন। তারপর ফাতিমা রাযি. আসলেন। তাঁকে চাদরের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন। সবশেষে আসলেন আলী রাযি.। তিনি তাঁকেও চাদরের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর পাঠ করলেন-

إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

“হে নবী পরিবার (আহলে বায়ত)! আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে মলিনতা দূরে রাখতে এবং তোমাদেরকে সর্বতোপ্রকারে পবিত্রতা দান করতে? -সূরা আহযাব, আয়াত ৩৩।১৭২
হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, যখন নাজরানের খ্রীষ্টান প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বিতর্ক হলো এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতা পরিস্ফুট হওয়া সত্ত্বেও তারা সত্যগ্রহণে প্রস্তুত হলো না, ফলে আয়াত নাযিল হলো-

فَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ

[তোমার কাছে (হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ঘটনা সম্পর্কে) যে প্রকৃত জ্ঞান এসেছে, তারপরও যারা এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়, (তাদেরকে) বলে দাও, এস আমরা ডাকি আমাদের সন্তানদেরকে এবং তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে, আমরা আমাদের নারীদেরকে এবং তোমরা তোমাদের নারীদেরকে, আর আমাদের নিজ লোকদেরকে এবং তোমাদের নিজ লোকদেরকে, তারপর আমরা সকলে মিলে (আল্লাহর সামনে) কাকুতি-মিনতি করি এবং যারা মিথ্যাবাদী, তাদের প্রতি আল্লাহর লানত পাঠাই - সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৬১], তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাযি. ফাতিমা রাযি. হাসান রাযি. ও হুসায়ন রাযি.-কে ডাকলেন। তারপর বললেন—

اللهم هؤلاء أهلي

(হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বায়ত)।১৭৩
হযরত উম্মু সালামা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াত—

إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

নাযিল হওয়ার পর হযরত আলী রাযি. ফাতিমা রাযি. হাসান রাযি. ও হুসায়ন রাযি.-কে ডাকলেন। তারপর তাদের সবাইকে একটা চাদরে জড়িয়ে নিলেন। তারপর বললেন-

اللهم هؤلاء أهل بيتي وخاصتي، أذهب عنهم الرجس وطهرهم تطهيرا

“হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বায়ত। আপনি এদের থেকে অপবিত্রতা দূর করুন এবং এদেরকে পরিপূর্ণরূপে পবিত্র করুন।
এরকম আরও অনেক হাদীছ আছে, যা দ্বারা পরিষ্কার বোঝা যায় আলী রাযি. ফাতিমা রাযি. হাসান রাযি. ও হুসায়ন রাযি.-ও আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত।১৭৪
এক শ্রেণীর লোক এসকল হাদীছের দিকে লক্ষ করে কেবল এই চারজনকেই আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত মনে করে থাকেন। তারা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণকে আহলে বায়তের মধ্যে গণ্য করেন না। এটা তাদের এক ভয়ানক বিভ্রান্তি। কেননা কুরআন মাজীদের আয়াত-

إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

এর দ্বারা তো সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদেরকেই আহলে বায়ত বলা হয়েছে। তাছাড়া এ আয়াতের আগে ও পরে সম্পূর্ণ রুকূ'টিতে কেবল তাঁদেরকে লক্ষ্য করেই কথা বলা হয়েছে এবং একাধিক স্থানে ঘরকে তাঁদের সঙ্গেই সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে। এমনিভাবে আহলে বায়ত শব্দটির আক্ষরিক অর্থও তো কেবল তাঁদের জন্যই প্রযোজ্য হয়। সন্তান-সন্ততির জন্য তা প্রযোজ্য হয়। স্ত্রীদের অধীনে, মৌলিকভাবে নয়।
স্ত্রীদের জন্য আহলে বায়ত শব্দটি কুরআন মাজীদের অন্যত্রও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন সূরা হূদে আছে-

أَتَعْجَبِينَ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ رَحْمَتُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ

'আপনি কি আল্লাহর হুকুম সম্বন্ধে বিস্ময়বোধ করছেন? আপনাদের মত সম্মানিত পরিবারবর্গের উপর রয়েছে আল্লাহর রহমত ও প্রভূত বরকত।১৭৫
এ কথাটি ফিরিশতাগণ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্ত্রী সারা রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, যখন পুত্রসন্তান জন্মের সুসংবাদ দেওয়ায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
মোটকথা, কুরআন মাজীদের আয়াতে সরাসরি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণকে 'আহলে বায়ত' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই কোনও বিবেচনায়ই তাঁদেরকে আহলে বায়ত থেকে খারিজ করার সুযোগ নেই; তা করতে যাওয়াটা হবে কুরআন মাজীদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা বা তার অপব্যাখ্যা করার নামান্তর। তবে কুরআন মাজীদে শব্দটিকে তাঁদের জন্য এমনভাবে নির্দিষ্ট করা হয়নি যে, এটি অন্য কারও জন্য প্রযোজ্য হবে না। হাঁ, আয়াতের বাহ্যিক শব্দাবলীর প্রতি লক্ষ করে কেউ শব্দটিকে তাদের জন্যই নির্দিষ্ট বলে ধারণা করতে পারে। বাস্তবিকপক্ষে যেহেতু তাদের জন্য নির্দিষ্ট নয়; বরং এটি আরও ব্যাপক অর্থবোধক, তাই পরিষ্কার করা দরকার ছিল এর মধ্যে আর কারা কারা শামিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। সুতরাং 'আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআত'-এর আকীদা এটাই যে, উম্মাহাতুল মুমিনীনের সঙ্গে হযরত আলী রাযি. ফাতিমা রাযি. হাসান রাযি. হুসায়ন রাযি. ও তাঁদের বংশধরগণও আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত।
যাহোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহলে বায়তের মর্যাদা অতি উচ্চে। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি বজায় রাখা ও তাঁদেরকে ভালোবাসা ঈমানের দাবি। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায় এ সম্পর্কিত কিছু আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।

১৭২. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪২৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩২০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩০৬১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩২১০২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২৮৫৮

১৭৩. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪০৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৯৯৯

১৭৪. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৮৭১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৬৫০৮

১৭৫. সূরা হূদ (১১), আয়াত ৭৩

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারবর্গের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন ও মর্যাদা সম্পর্কিত দুটি আয়াত

এক নং আয়াত

إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

অর্থ : হে নবী পরিবার (আহলে বায়ত)! আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে মলিনতা দূরে রাখতে এবং তোমাদেরকে সর্বতোপ্রকারে পবিত্রতা দান করতে।১৭৬

ব্যাখ্যা

এটি সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতের শেষাংশ। এর মর্ম স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য

পূর্ণ আয়াতটি সামনে রাখা দরকার। এ আয়াতের আগের অংশ হলো-

وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ

নিজ গৃহে অবস্থান কর (পর-পুরুষকে) সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না, যেমন প্রাচীন জাহিলী যুগে প্রদর্শন করা হত এবং নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর।
এ আয়াতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণকে প্রথম হুকুম দেওয়া হয়েছে যে- وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ (নিজ গৃহে অবস্থান কর)। এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, নারীর আসল জায়গা হলো তার ঘর। এর অর্থ এমন নয় যে, ঘর থেকে বের হওয়া তার জন্য একদম জায়েয নয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ দ্বারা পরিষ্কারভাবেই জানা যায়, প্রয়োজনে তারা পর্দার সাথে বাইরে যেতে পারবে, কিন্তু এ আয়াত মূলনীতি বলে দিয়েছে যে, নারীর আসল কাজ তার গৃহে। তার প্রধান দায়িত্ব স্বামীর মনে প্রশান্তি যোগানো, সন্তানের লালন-পালন ও পরিবার গঠন। যেসব তৎপরতা এ দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন ঘটায় তা নারী জীবনের মৌল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী এবং তা দ্বারা সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়। নারী ঘরের বাইরে গেলে শয়তান সুযোগ গ্রহণ করে। শয়তান পুরুষকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে পারিবারিক বন্ধন শিথিল করে দেয় এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটানোর সুযোগ নেয়। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

الْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ، وَإِنَّهَا إِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ، وَإِنَّهَا لَا تَكُونُ إِلَى وَجْهِ الله أَقْرَبَ مِنْهَا فِي قَعْرِ بَيْتِهَا

‘নারীসত্তা আবরণীয়। সে ঘর থেকে বের হলে শয়তান তাকে উকি দিয়ে দেখে। সে তার প্রতিপালকের সর্বাপেক্ষা বেশি সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত হয়, যখন সে নিজ গৃহকোটরে অবস্থান করে।১৭৭
তারপর আয়াতে তাঁদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে- وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى (পর-পুরুষকে) সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না, যেমন প্রাচীন জাহিলী যুগে প্রদর্শন করা হত।
تَبَرُّجَ শব্দটির উৎপত্তি برج থেকে। এর অর্থ প্রকাশ পাওয়া, উন্মুক্ত হওয়া। উঁচু ভবনকে برج বলে। কারণ তা সকলের সামনে উন্মুক্ত থাকে।تَبَرُّجَ অর্থ সৌন্দর্য প্রকাশ করা। সুন্দর পোশাক ও অলংকারসজ্জিত হয়ে লোকসম্মুখে বের হয়ে আসা। ইবন আবু নুজাইহ, মুজাহিদ প্রমুখ বলেন, تَبَرُّجَ অর্থ অহংকার ও আত্মগরিমার সঙ্গে আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গিতে হেলেদুলে চলা।
প্রাচীন জাহিলিয়াত দ্বারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রাক-আবির্ভাব কালকে বোঝানো হয়েছে। সেকালে নারীরা নির্লজ্জ সাজ-সজ্জার সাথে নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াত। ‘প্রাচীন জাহিলিয়াত, শব্দটি ইঙ্গিত করছে নব্য জাহিলিয়াত বলে একটা জিনিসও আছে, যা এক সময় আসবে। অন্ততপক্ষে অশ্লীলতার দিক থেকে তো সেরকমের এক জাহিলিয়াত আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এ নব্য জাহিলিয়াতের অশ্লীলতা এতটাই উগ্র যে, তার সামনে প্রাচীন জাহিলিয়াত কবেই হার মেনেছে।
তারপর এ আয়াতে সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা এবং আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। এসব বিধি-বিধান দেওয়ার পর আহলে বায়তকে সম্বোধন করে ইরশাদ হয়েছে-

إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

'হে নবী পরিবার (আহলে বায়ত)! আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে মলিনতা দূরে রাখতে এবং তোমাদেরকে সর্বতোপ্রকারে পবিত্রতা দান করতে।'
অর্থাৎ এসব বিধি-বিধান দ্বারা উদ্দেশ্য তোমাদেরকে পাপের মলিনতা থেকে দূরে রাখা এবং সকল দিক থেকে তোমাদেরকে পবিত্র করে তোলা। যারা শরীআতের বিধান মোতাবেক চলে, পাপের পঙ্কিলতা তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না। দুর্ঘটনাক্রমে কখনও কোনও পাপ হয়ে গেলেও নামায, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা সে পাপের ময়লা দূর হয়ে যায় এবং ইবাদতকারীর আত্মা পূতঃপবিত্র হয়ে ওঠে।
'আহলে বায়ত' বলতে এস্থলে সরাসরি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণকে বোঝানো হয়েছে, যেহেতু এর আগে-পরে তাঁদেরই সম্পর্কে আলোচনা। কিন্তু শাব্দিক ব্যাপকতার কারণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যাগণ ও তাঁদের সন্তান-সন্ততিও এর অন্তর্ভুক্ত। সহীহ মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার হযরত ফাতিমা, হযরত আলী, হযরত হাসান ও হযরত হুসায়ন (রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম)-কে নিজ চাদর দ্বারা জড়িয়ে নিলেন। তারপর এ আয়াত পাঠ করলেন। কোনও কোনও রেওয়ায়াতে আছে, তিনি তখন এ কথাও বলেছিলেন যে, ‘হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বায়ত’ (ইবনে জারীর)। বিস্তারিত ভূমিকায় দেখুন।
প্রকাশ থাকে যে, পরিপূর্ণ পবিত্রতার অর্থ তারাও নবীগণের মতো মাছুম (নিষ্পাপ) হয়ে যাবেন, তা নয়; বরং এর অর্থ তারা অত্যন্ত তাকওয়া-পরহেযগারীর অধিকারী হয়ে যাবেন। ফলে গুনাহের পঙ্কিলতা তাদের থেকে দূর হয়ে যাবে। এক শ্রেণীর লোক বলে থাকে যে, এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় হযরত আলী রাযি., ফাতিমা রাযি. হাসান রাযি. ও হুসায়ন রাযি. মাসূম ও নিষ্পাপ ছিলেন। কাজেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর তাঁরাই খেলাফত ও ইমামতের হকদার, অন্য কেউ নয়। তাদের মতে ইমাম ও খলীফা হওয়ার জন্য মাসূম হওয়া শর্ত। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা যখন তাদেরকে পাপ থেকে পবিত্র করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তখন নিশ্চয়ই তাঁরা পাপ থেকে পবিত্র অর্থাৎ নিষ্পাপ বা মাসূম হয়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার তো ব্যতিক্রম হতে পারে না।
কিন্তু আলোচ্য আয়াত দ্বারা তাদের এসব দাবি মোটেই প্রমাণ হয় না। কেননা এক তো এ আয়াতে যে আহলে বায়তকে পবিত্র করার কথা বলা হয়েছে, সে আহলে বায়ত দ্বারা কেবল উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গকেই বোঝায় না; বরং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুণ্যবতী স্ত্রীগণও এর অন্তর্ভুক্ত। আয়াতটি তো সরাসরি নাযিলই হয়েছে তাঁদের সম্পর্কে। দ্বিতীয়ত এ আয়াতটি নিষ্পাপতা প্রমাণ করে না। অর্থাৎ আয়াতটি এ কথা বোঝাচ্ছে না যে, উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ মা'সুম ছিলেন। বরং বোঝাচ্ছে এ কথা যে, তোমাদেরকে যে বিধানগুলো দেওয়া হলো এগুলো যদি তোমরা অনুসরণ করে চল, তবে পাপ থেকে বেঁচে থাকতে পারবে এবং কখনও কোনও পাপ হয়ে গেলেও এসব ইবাদতের অছিলায় তা মাফ হয়ে যাবে। বলাবাহুল্য এ কথাটি যে-কোনও মুমিনের বেলায়ই প্রযোজ্য। আলোচনার ধারা যেহেতু নবী-পরিবারকে লক্ষ্য করে চলছিল, তাই সরাসরি কথাটি তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। কিন্তু এর উদ্দেশ্য ব্যাপক। উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ এবং মুসলিম উম্মাহ'র নারী- পুরুষ সকলেই এর আওতাভুক্ত। যে-কেউ নিজ ইচ্ছায় আল্লাহ তাআলার তাওফীকে শরীআত মোতাবেক চলবে, সেই পাপের পঙ্কিলতা থেকে বেঁচে থাকতে পারবে।
তাছাড়া ইমাম ও খলীফা হওয়ার জন্য মাসূম হওয়ার যে শর্ত বলা হয়েছে তারও কোনও ভিত্তি নেই। যে-কোনও নেককার মুসলিমই এ পদে অভিষিক্ত হতে পারে। আল্লাহ তাআলা তো হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ও শামুয়েল আলাইহিস সালামের মত নিষ্পাপ নবীদের বর্তমানেও তালূতকে রাজপদের জন্য মনোনীত করেছিলেন। নবীগণ মাসুম ছিলেন, কিন্তু তিনি তো মাসূম ছিলেন না।

দুই নং আয়াত

وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ

অর্থ : আর কেউ আল্লাহর ‘শাআইর’-কে সম্মান করলে এটা তো অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই অর্জিত হয়।১৭৮

ব্যাখ্যা

আল্লাহর শা‘আইর মানে আল্লাহর দীনের শাআইর।شَعَائِرَ শব্দটি شعيرة বা شعارة এর বহুবচন। এর অর্থ আলামত ও নিদর্শন। পরিভাষায় শাআইর (شَعَائِرَ) বলা হয় এমনসব বিষয় ও বস্তুকে, যা কোনও ধর্ম বা মতাদর্শের একান্ত বিষয় ও তার পরিচায়ক। সুতরাং ‘দীনে ইসলাম'-এর শাআইর বলতে এমনসব বিষয় ও বস্তুকে বোঝাবে, যা এ দীনের পরিচয় বহন করে বা যা একান্তভাবে এ দীনের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। এভাবেও বলা যায় যে, যেসকল বিষয় দেখলে বা শুনলে বোঝা যায় যে, এটা কেবল ইসলামেরই জিনিস, অন্যকিছুর নয়, তাকেই দীনের শাআইর বলে। যেমন ওযূ, আযান, নামায, মসজিদ, বায়তুল্লাহ, হজ্জের স্থানসমূহ, কুরবানীর পশু, কুরআন এবং দীনের প্রকাশ্য বিধানাবলী।
এমনিভাবে যেসকল ব্যক্তিবর্গ দীন ইসলামের বিশেষ কোনও আমলের সঙ্গে এমনভাবে সম্পৃক্ত, যদ্দরুন সেই আমলের বিশেষণে তারা বিশেষিত হয়ে থাকে, তারাও ইসলামের শা'আইরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আযানদাতাকে বলা হয় মুআযযিন। ইমামতকারীকে বলা হয় ইমাম। খেলাফত পরিচালনাকারীকে বলা হয় খলীফা। হজ্জ আদায়ে রত ব্যক্তিকে বলা হয় হাজী। নামায আদায়ে মশগুল ব্যক্তিকে বলা হয় নামাযী । এসকল উপাধি অন্য কোনও ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানকারীর জন্য প্রযোজ্য হয় না। এর যে কোনও উপাধি উচ্চারণ মাত্রই শ্রোতার দৃষ্টি চলে যায় ইসলামের দিকে। সুতরাং এ উপাধিধারীগণ ইসলামের নিদর্শন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইসলামের বিশেষ আমলে ব্যাপৃত ব্যক্তি যখন ইসলামের নিদর্শনরূপে গণ্য, তখন যেই মহান সত্তা ইসলাম নিয়ে এসেছেন, ইসলামের প্রচার করেছেন এবং নিজ জীবনকে ইসলামের বাস্তব নমুনারূপে উম্মতের সামনে পেশ করেছেন, সেই আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শনই হবেন।
এ আয়াতে দীনের শাআইরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ ‘এটা অন্তরের তাকওয়া থেকেই অর্জিত হয়’ অর্থাৎ যার অন্তরে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি আছে, সেই-ই এটা করে। সে হিসেবে এটা তাকওয়ার আলামতও বটে। এ আয়াত দ্বারা জানা গেল, তাকওয়া অন্তরের বিষয়। এক হাদীছেও আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ বুকের দিকে ইশারা করে বলেন,

أَلَا إِنَّ التَّقْوَى ههُنَا
‘জেনে রেখ, তাকওয়া এখানে।

তাকওয়া যেহেতু অন্তরের বিষয়, তাই তা চোখে দেখা যায় না। আলামত দ্বারা বোঝা যায়। শাআইরকে সম্মান করা একটা আলামত। কেউ এটা করলে এর দ্বারা বোঝা যায় তার অন্তরে তাকওয়া আছে।
এ আয়াত দ্বারা মূলত মু'মিন-মুত্তাকীকে তাগিদ করা হয়েছে সে যেন দীনের শা‘আইর ও নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে ও তার আদব বজায় রাখে। সুতরাং মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য মসজিদ ও বায়তুল্লাহর আদব রক্ষা করা, কুরআন ও আযানের তাযীম করা, কুরবানীর পশুকে গুরুত্বদান ও যত্ন করা, দীনী কাজের কেন্দ্রসমূহ ও তাতে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের কদর করা, মুআযযিন ও ইমামকে সম্মান করা, হজ্জ আদায়ে রত ও নামাযরত ব্যক্তিকে সম্মান করা ইত্যাদি।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইসলামের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন, তখন তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করা এবং তাঁকে সর্বাপেক্ষা বেশি ভালোবাসাও এ আয়াতের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে। বরং তাঁর সম্মানার্থে তাঁর আহলে বায়তকে সম্মান করাও এ উম্মতের পক্ষে অবশ্যকর্তব্য বলে গণ্য হবে।
এর আগের আয়াতে শিরকী কর্মকাণ্ডের নিন্দা করা হয়েছে, যার সারকথা হচ্ছে- গায়রুল্লাহকে সম্মান ও শ্রদ্ধাভক্তি করা একটি নিন্দনীয় কাজ এবং সে শ্রদ্ধাভক্তি যদি আল্লাহ তা'আলাকে শ্রদ্ধাভক্তির সমপর্যায়ের হয়ে যায়, তবে তো তা সম্পূর্ণরূপেই বেঈমানী কাজ। এর দ্বারা কেউ মনে করতে পারত যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনওকিছুকে কোনওপর্যায়েই শ্রদ্ধাভক্তি করা যাবে না। এ আয়াত সে ধারণা খণ্ডন করে দিচ্ছে। এতে বলা হয়েছে যে, যে-কোনও গায়রুল্লাহকে যে-কোনও পর্যায়ের শ্রদ্ধাভক্তি করা নিন্দনীয় নয়; বরং যেসকল ব্যক্তি ও বিষয় আল্লাহ তা'আলার সাথে সম্পৃক্ত, শরীআত প্রদর্শিত পন্থায় তার সম্মান রক্ষা করা আল্লাহ তা'আলারই হুকুম এবং এটা করা তাকওয়া ও আল্লাহভীতির অন্তর্ভুক্ত।

১৭৬. সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৩৩

১৭৭. সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৫৯৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৭৬১৬; সুনানে তিরমিযী, হাদীছ নং ১১৭৩; সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীছ নং ১৬৮৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০১১৫

১৭৮. সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৩২
হাদীছ নং : ৩৪৬
ইয়াযীদ ইবন হায়্যান বলেন, আমি, হুসায়ন ইবন্ সাবরাহ ও আমর ইবন মুসলিম হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি. এর কাছে গেলাম। আমরা তাঁর কাছে বসলে হুসায়ন তাঁকে বললেন, হে যায়দ! আপনি বিপুল কল্যাণ লাভ করেছেন। আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন, তাঁর কথা শুনেছেন, তাঁর সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করেছেন এবং তাঁর পেছনে নামায আদায় করেছেন। হে যায়দ। আপনি বিপুল কন্যাগ লাভ করেছেন। হে যায়দ! আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যা শুনেছেন আমাদের কাছে তা বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, হে ভাতিজা। আমার বয়স বেশি হয়ে গেছে। আমার জীবনকাল পুরানো হয়ে গেছে। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা-কিছু মনে রেখেছিলাম তার কিছুটা ভুলেও গেছি। সুতরাং আমি তোমাদের কাছে যা বর্ণনা করব তোমরা তা গ্রহণ করো। আর যা বর্ণনা করব না সেজন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করো না। তারপর বললেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লা আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা ও মদীনার মাঝখানে ‘খুম’ নামক এক জলাশয়ের পাশে আমাদের মধ্যে ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। তিনি আল্লাহ তা'আলার হাম্দ ও গুণগান করার পর আমাদের উপদেশ দিলেন ও নসিহত করলেন। তারপর বললেন, হে লোক সকল! আমি একজন মানুষমাত্র। হয়তো অচিরেই আমার প্রতিপালকের দূত এসে যাবে এবং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দেব। আমি তোমাদের মধ্যে দু'টি ভার রেখে যাচ্ছি। তার প্রথমটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। তাতে আছে হিদায়াত ও আলো। তোমরা আল্লাহর কিতাব ধরে রেখো এবং তা শক্তভাবে ধরো। এভাবে তিনি আল্লাহর কিতাবের প্রতি উৎসাহ দিলেন ও তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করলেন। তারপর বললেন, আর (দ্বিতীয়টি হচ্ছে) আমার আহলে বায়ত (পরিবারবর্গ)। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।'
হুসায়ন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে যায়দ! তাঁর আহলে বায়ত কারা? তাঁর স্ত্রীগণ কি তাঁর আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত নন? তিনি বললেন, তাঁর স্ত্রীগণও আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত। তবে (সাধারণভাবে) আহলে বায়ত বলতে তাদেরকে বোঝানো হয়, তাঁর ওফাতের পর যাদের জন্য সদাকা (খাওয়া) হারাম করা হয়েছে। হুসায়ন জিজ্ঞেস করলেন, তারা কারা? তিনি বললেন, তারা হচ্ছে আলীর বংশধরগণ, আকীলের বংশধরগণ, জাফরের বংশধরগণ এবং আব্বাসের বংশধরগণ। হুসায়ন জিজ্ঞেস করলেন, এদের সকলের প্রতি সদাকা হারাম করা হয়েছে? তিনি বললেন, হাঁ -মুসলিম ।১৭৯
অপর এক বর্ণনায় আছে, শোন হে ! আমি তোমাদের মধ্যে দুটি ভার রেখে যাচ্ছি। তার একটি আল্লাহর কিতাব। আর তা হচ্ছে আল্লাহর রশি। যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে। সে হিদায়াতের উপর থাকবে। আর যে তা পরিত্যাগ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪০৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯২৬৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ১০৭১২; নাসাঈ, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৮১১৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীছ নং ২৩৫৭; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫০২৮; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৩২৩৮
مقدمة الامام النووي
43 - باب إكرام أهل بيت رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - وبيان فضلهم

قَالَ الله تَعَالَى: {إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا} [الأحزاب: 33]، وَقالَ تَعَالَى: {وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ} [الحج: 32].
346 - وعن يزيد بن حَيَّانَ، قَالَ: انْطَلَقْتُ أنَا وحُصَيْنُ بْنُ سَبْرَة، وَعَمْرُو ابن مُسْلِم إِلَى زَيْد بْنِ أرقَمَ - رضي الله عنهم - فَلَمَّا جَلَسْنَا إِلَيْهِ قَالَ لَهُ حُصَيْن: لَقَدْ لقِيتَ يَا زَيْدُ خَيْرًا كَثِيرًا، رَأيْتَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - وسمعتَ حديثَهُ، وغَزوْتَ مَعَهُ، وَصَلَّيْتَ خَلْفَهُ: لَقَدْ لَقِيتَ يَا زَيْدُ خَيْرًا كَثيرًا، حَدِّثْنَا يَا زَيْدُ مَا سَمِعْتَ مِنْ رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: يَا ابْنَ أخِي، وَاللهِ لقد كَبِرَتْ سِنِّي، وَقَدُمَ عَهدِي، وَنَسيتُ بَعْضَ الَّذِي كُنْتُ أَعِي مِنْ رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - فما حَدَّثْتُكُمْ، فَاقْبَلُوا، ومَا لاَ فَلاَ تُكَلِّفُونيهِ. ثُمَّ قَالَ: قام رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يَومًا فينا خَطِيبًا بمَاءٍ يُدْعَى خُمًّا بَيْنَ مَكَّةَ وَالمَدِينَةِ، فَحَمِدَ الله، وَأثْنَى عَلَيهِ، وَوَعَظَ وَذَكَّرَ، ثُمَّ قَالَ: «أمَّا بَعدُ، ألاَ أَيُّهَا النَّاسُ، فَإنَّمَا أنَا بَشَرٌ يُوشِكَ أَنْ يَأتِي رسولُ ربِّي فَأُجِيبَ، وَأنَا تاركٌ فيكم ثَقَلَيْنِ: أوَّلُهُمَا كِتَابُ اللهِ، فِيهِ الهُدَى وَالنُّورُ، فَخُذُوا بِكتابِ الله، وَاسْتَمْسِكُوا بِهِ»، فَحَثَّ عَلَى كِتَابِ الله، وَرَغَّبَ فِيهِ، ثُمَّ قَالَ: «وَأَهْلُ بَيْتِي أُذكِّرُكُمُ اللهُ في أهلِ بَيْتي، أذكرُكُمُ الله في أهل بيتي» فَقَالَ لَهُ حُصَيْنٌ: وَمَنْ أهْلُ بَيتهِ يَا زَيْدُ، أَلَيْسَ نِسَاؤُهُ مِنْ أهْلِ بَيْتِهِ؟ قَالَ: نِسَاؤُهُ مِنْ أهْلِ بَيتهِ، وَلكِنْ أهْلُ بَيتِهِ مَنْ حُرِمَ الصَّدَقَةَ بَعدَهُ، قَالَ: وَمَنْ هُمْ؟ قَالَ: هُمْ آلُ عَلِيٍّ، وَآلُ عقيل، وَآلُ جَعفَرَ، وآلُ عَبَّاسٍ. قَالَ: كُلُّ هؤلاء حُرِمَ الصَّدَقَةَ؟ قَالَ: نَعَمْ. رواه مسلم. (1)
وفي رواية: «ألاَ وَإنّي تَارِكٌ فِيكُمْ ثَقَليْنِ: أحَدُهُما كِتَابُ الله وَهُوَ حَبْلُ الله، مَنِ اتَّبَعَهُ كَانَ عَلَى الهُدَى، وَمَنْ تَرَكَهُ كَانَ عَلَى ضَلاَلَة».
হাদীস নং: ৩৪৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী ও অন্য যে সকল লোককে সম্মান করা কাম্য তাদের প্রতি সদাচরণের ফযীলত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মানার্থে আহলে বায়তকে সম্মান করা
হাদীছ নং : ৩৪৭

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. থেকে তাঁর উক্তি বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, তোমরা আহলে বায়তের মধ্যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা রক্ষা কর -বুখারী।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৭১৩, ৩৭৫১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদীছ নং ৩২১৪০; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৪৯০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৯১১
مقدمة الامام النووي
43 - باب إكرام أهل بيت رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - وبيان فضلهم
347 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما، عن أَبي بكر الصديق - رضي الله عنه - مَوقُوفًا عَلَيهِ - أنَّهُ قَالَ: ارْقَبُوا مُحَمدًا - صلى الله عليه وسلم - في أهْلِ بَيْتِهِ. رواه البخاري. (1)
معنى «ارقبوه»: راعوه واحترموه وأكرموه، والله أعلم.
হাদীস নং: ৩৪৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৪৪

উলামা, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের
অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
ইসলাম এক মহান ও পরিপূর্ণ দীন। মানবজীবনের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে এর পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা আছে। সমাজ ও সামাজিকতা সম্পর্কেও এর শিক্ষা অতি পূর্ণাঙ্গ। সামাজিক সাধারণ শিষ্টাচার সম্পর্কে শিক্ষাদানের পাশাপাশি জ্ঞান-গরিমা ও বয়সের স্তরভেদ অনুসারে স্বতন্ত্র আচরণ ও বিশেষ শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ রাখাও এ দীনের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
কুরআন-সুন্নাহ'র দৃষ্টিতে সমাজের অন্যান্য লোক অপেক্ষা উলামায়ে কেরামের মর্যাদা অনেক উঁচুতে। উলামায়ে কেরাম বলতে শরীআতের এমন জ্ঞানীজনদের বোঝায়, যারা আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ যারা বিদআতপন্থী নয়। বিদআতপন্থীকে সম্মান দেখানো জায়েয নয়। কেননা তাতে দীনের ক্ষতি।
উলামায়ে কেরাম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়ারিশ। তাঁর সম্মানার্থেই তাদেরকে সম্মান করা কর্তব্য। তারা যে ইলমে দীনের চর্চা করে থাকেন, মানুষের দীন ও ঈমানের জন্য তা অতীব জরুরি। উলামায়ে কেরাম দ্বারা তাদের সে জরুরত পূরণ হয়। এ জরুরত পূরণ করাটা জনমানুষের উপর তাদের অতি মূল্যবান এক সেবা। এর সঙ্গে অন্য কোনও সেবার তুলনা চলে না। সকলেরই এর মূল্য বোঝা উচিত।
উলামায়ে কেরামের মর্যাদা ইলমে দীনের কারণে। এ ক্ষেত্রে বয়স বিবেচ্য নয়। তাই বয়স্ক ব্যক্তিরও কর্তব্য তার তুলনায় অল্পবয়স্ক আলেমকে সম্মান করা।
ইসলাম বয়স্ক ব্যক্তিকে তার বয়োজ্যেষ্ঠতার কারণে বিশেষ সম্মান দিয়েছে। তাই কোনও বয়স্ক ব্যক্তি আলেম না হলেও বয়োজ্যেষ্ঠতার বিবেচনায় তার সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা অবশ্যকর্তব্য। বয়স্ক ও প্রবীণ ব্যক্তি যদি আলেমও হয়, হবে তার দ্বিগুণ মর্যাদা প্রাপ্য।
ইলমে দীন ছাড়াও এমন অনেক বিষয় আছে, যা ব্যক্তিকে মহিমান্বিত করার পাশাপাশি অন্যদেরও প্রভূত কল্যাণ সাধন করে। যেমন নেতৃত্বগুণ, বীরত্ব, বিচক্ষণতা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। এসব গুণের অধিকারী ব্যক্তিবর্গকেও ইসলাম বিশেষ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে। তাই তাদের মর্যাদা রক্ষা করাও এ মহান দীনের অনুসারীদের একান্ত কর্তব্য।
মর্যাদাবান ব্যক্তিদের মর্যাদা দেওয়ার বিভিন্ন পন্থা আছে। যেমন পথচলার ক্ষেত্রে তাদেরকে সামনে রেখে নিজেরা পেছনে চলা, তাদেরকে আগে বসতে দেওয়া ও উঁচু স্থানে বসতে দেওয়া, তাদের সঙ্গে বিনীত ভঙ্গিতে কথা বলা, তাদের আগে আগে কথা বলার চেষ্টা না করা ইত্যাদি। মোটকথা কথায় ও কাজে এমন ভাব ও ভঙ্গি অবলম্বন করা চাই, যা দ্বারা সম্মানী ব্যক্তির সম্মান রক্ষা হয়।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে কুরআন-সুন্নাহ'র এমনসব ভাষ্য উদ্ধৃত করেছেন যা দ্বারা বিশেষ বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষের স্বতন্ত্র মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, আর সে মর্যাদার কারণে তাদের সঙ্গে পৃথক শিষ্টাচার রক্ষা করাও অন্যদের কর্তব্য হয়ে যায়। আমরা নিচে সে ভাষ্যসমূহের বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।

আলোচ্য বিষয় সম্পর্কিত একটি আয়াত

قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ

অর্থ : বল, যারা জানে আর যারা জানে না উভয়ে কি সমান? উপদেশ গ্রহণ তো কেবল বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরাই করে।'

ব্যাখ্যা

এটি একটি আয়াতের শেষাংশ। এর আগে আছে-

أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ

‘তবে কি (এরূপ ব্যক্তি সেই ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে,) যে রাতের মুহূর্তগুলোতে ইবাদত করে, কখনও সিজদাবস্থায়, কখনও দাঁড়িয়ে, যে আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজ প্রতিপালকের রহমতের আশা করে?'
এর আগের কয়েক আয়াতে আখেরাতের সত্যতা প্রমাণ করা হয়েছে। তারপর এ আয়াতে প্রশ্নের আকারে যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, আখেরাতের হিসাব-নিকাশ না থাকলে তার অর্থ দাঁড়ায় মুমিন ও কাফের এবং পুণ্যবান ও পাপী সব সমান। কিন্তু কোনও বিবেকবান লোক এ উভয় শ্রেণীকে সমান বলতে পারে না। প্রত্যেকেই স্বীকার করবে যে, উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। সে পার্থক্য অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রেণীকে তার প্রাপ্য প্রতিদান বুঝিয়ে দেওয়া চাই। সেজন্যই আখেরাত।
আখেরাতের অবশ্যম্ভাবিতা প্রমাণের জন্য এ আয়াতে আরও একটি যুক্তি দেওয়া হয়েছে এই যে, জ্ঞানী ও অজ্ঞানী কি সমান? নিশ্চয়ই প্রত্যেকে স্বীকার করবে জ্ঞানী-অজ্ঞানী সমান নয়। তো জ্ঞানী ও অজ্ঞানী যেমন সমান নয়, তেমনি পুণ্যবান ও পাপীও সমান নয়। আর সে কারণেই আখেরাত প্রয়োজন।
আখেরাতের বাস্তবতা প্রমাণের জন্য জ্ঞানী ও অজ্ঞানী সমান না হওয়ার যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, তা দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অজ্ঞানীর উপর জ্ঞানীর মর্যাদাও প্রতিপন্ন হয়ে গেছে। বলাবাহুল্য সাধারণ জ্ঞানও জ্ঞান বটে, কিন্তু কুরআন-হাদীছের পরিভাষায় জ্ঞানী বা আলেম ওই ব্যক্তিকেই বলে, যে ইলমে দীনের অধিকারী, যে দীন ও শরীআত সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান রাখে। সুতরাং আয়াতটি আমাদের জানাচ্ছে যে, ইলমে দীনের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ তথা উলামায়ে কেরাম অন্যদের মত নয়; তাদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। অন্যদের সে মর্যাদা অনুভব করা উচিত। অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে বিপুল মর্যাদায় উন্নীত করবেন। তোমরা যা-কিছু কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে পরিপূর্ণ অবগত।১৯০
প্রকাশ থাকে যে, উলামায়ে কেরামের মর্যাদা যেহেতু ইলমে দীনের কারণে, তাই তাদেরও উচিত ইলমে দীনের হেফাজত ও প্রচারে সচেষ্ট থাকা। সে প্রচেষ্টা তখনই সফল হবে, যখন ইলমের আলোয় নিজেকে আলোকিত করা হবে। বাস্তবিকপক্ষে আলেম বলাই হয় তাকে, যে ইলম অনুযায়ী আমলেও যত্নবান থাকে। ইলমের সঙ্গে আমলের মিল না থাকলে মানুষের কাছে বিশ্বস্ততা ও আস্থা হারিয়ে যায়। কোনও আলেমের মানুষের কাছে আস্থা হারানো আলেম হিসেবে নিজ অস্তিত্ব হারানোরই নামান্তর। এটা ইলমী আমানতের চরম খেয়ানত। ইমাম রাবী আ আর-রা'য় রহ. বলেন-

لَا يَنْبَغِي لِأَحَدٍ عِنْدَهُ شَيْءٌ مِنَ الْعِلْمِ أَنْ يُضَيِّعَ نَفْسَهُ

‘যার কাছে ইলমের কিছুমাত্রও আছে, তার নিজেকে হারিয়ে ফেলা উচিত নয়।১৯১

১৮৯. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৯

১৯০. সূরা মুজাদালাহ (৫৮), আয়াত ১১

১৯১. সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, অধ্যায় : ইলম, পরিচ্ছেদ : ইলম উঠে যাওয়া ও অজ্ঞতা প্রকাশ পাওয়া।
ইমাম হওয়ার অগ্রাধিকার কার
হাদীছ নং : ৩৪৮

হযরত আবূ মাসউদ উকবা ইবন্ আমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, লোকদের মধ্যে যে ব্যক্তি কুরআন বেশি জানে সে-ই তাদের ইমামত করবে। যদি কুরআন পাঠে সকলে সমান হয়, তবে তাদের মধ্যে সুন্নাহ সম্পর্কে যে বেশি জানে। যদি সুন্নাহ জানায়ও সকলে সমান হয়, তবে তাদের মধ্যে হিজরতে যে সকলের অগ্রগামী। যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে বয়সে যে সকলের বড়। কোনও ব্যক্তি যেন কিছুতেই অপর ব্যক্তির ক্ষমতাবলয়ে অনুমতি ছাড়া তার ইমামত না করে এবং তার বাড়িতে তার আসনে অনুমতি ছাড়া না বসে –মুসলিম।১৯২
অপর এক বর্ণনায় বয়সের স্থলে আছে, যে ব্যক্তি তাদের সকলের আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে।
অপর এক বর্ণনায় আছে, লোকজনের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে বেশি জানে এবং কিতাব পাঠেও তাদের মধ্যে অগ্রগামী সে-ই তাদের ইমামত করবে। যদি আল্লাহর কিতাব পাঠে সকলেই সমান হয়, তবে তাদের ইমামত করবে হিজরতে যে ব্যক্তি তাদের মধ্যে অগ্রগামী। যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে যে ব্যক্তি বয়সে তাদের মধ্যে বড়।
ইমাম নববী রহ. বলেন, سلطانه এর দ্বারা কারও কর্তৃত্বাধীন স্থান বোঝানো উদ্দেশ্য। অথবা এমন স্থান, যা তার জন্য নির্দিষ্ট।
تكرمته এর অর্থ কারও ব্যক্তিগত বিছানা, চেয়ার বা এরকম কোনও স্থান।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৬৭৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৭৮৩; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫৮২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৭৮০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৭০৬৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৪৫১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ২১৩৩; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৫১৩২
مقدمة الامام النووي
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم

قَالَ الله تَعَالَى: {قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الأَلْبَابِ} [الزمر: 9].
348 - وعن أَبي مسعودٍ عقبةَ بن عمرو البدري الأنصاري - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «يَؤُمُّ القَوْمَ أَقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ الله، فَإنْ كَانُوا في القِراءةِ سَوَاءً، فأَعْلَمُهُمْ بِالسُّنَّةِ، فَإنْ كَانُوا في السُّنَّةِ سَوَاءً، فَأَقْدَمُهُمْ هِجْرَةً، فَإنْ كَانُوا في الهِجْرَةِ سَوَاءً، فَأقْدَمُهُمْ سِنًّا، وَلاَ يُؤمّنَّ الرَّجُلُ الرَّجُلَ في سُلْطَانِهِ، وَلاَ يَقْعُدْ في بَيْتِهِ عَلَى تَكْرِمَتِهِ إلاَّ بِإذْنهِ». رواه مسلم. (1)
وفي رواية لَهُ: «فَأقْدَمُهُمْ سِلْمًا» بَدَلَ «سِنًّا»: أيْ إسْلامًا. وفي رواية: «يَؤُمُّ القَومَ أقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ اللهِ، وَأقْدَمُهُمْ قِراءةً، فَإنْ كَانَتْ قِرَاءتُهُمْ سَوَاءً فَيَؤُمُّهُمْ أقْدَمُهُمْ هِجْرَةً، فَإنْ كَانُوا في الهِجْرَةِ سَواء، فَليَؤُمُّهُمْ أكْبَرُهُمْ سِنًّا».
والمراد «بِسلطانهِ»: محل ولايتهِ، أَو الموضعِ الَّذِي يختص بِهِ «وتَكرِمتُهُ» بفتح التاءِ وكسر الراءِ: وهي مَا ينفرد بِهِ من فِراشٍ وسَريرٍ ونحوهِما.
হাদীস নং: ৩৪৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ উলামায়ে কিরাম, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানীত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
নামাযের প্রথম কাতারে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানদের দাঁড়ানোর নির্দেশ
হাদীছ নং : ৩৪৯

হযরত আবূ মাসউদ উকবা ইবন আমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে (অর্থাৎ নামাযের শুরুতে) আমাদের কাঁধে হাত রেখে বলতেন, সোজা হয়ে দাঁড়াও। আঁকাবাঁকা হয়ে দাঁড়াবে না। তাহলে তোমাদের অন্তরসমূহ অমিল হয়ে যাবে। তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী, তারা যেন আমার কাছাকাছি দাঁড়ায়। তারপর যারা তাদের কাছাকাছি তারা এবং তারপর যারা তাদের কাছাকাছি তারা – মুসলিম।১৯৪
ইমাম নববী রহ. বলেন, النُّهَى এর অর্থ জ্ঞান-বুদ্ধি।
أُولُوا الأَحْلامِ এর অর্থ প্রাপ্তবয়স্ক । কেউ বলেন, বিচক্ষণ ও জ্ঞানী।
১৯৪. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪৩২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২২৮; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৮১২; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৬৭৫; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৩০৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৩৭৩; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০০৪১; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৫১৬১; শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৮২১
مقدمة الامام النووي
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم
349 - وعنه، قَالَ: كَانَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يَمْسَحُ مَنَاكِبَنَا في الصَّلاةِ، ويَقُولُ: «اسْتَوُوا وَلاَ تَخْتَلِفُوا، فَتَخْتَلِفَ قُلُوبُكُمْ، لِيَلِني مِنْكُمْ أُولُوا الأحْلاَمِ وَالنُّهَى، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ». رواه مسلم. (1)
وقوله - صلى الله عليه وسلم: «لِيَلِني» هُوَ بتخفيف النون وليس قبلها ياءٌ، وَرُوِيَ بتشديد النُّون مَعَ يَاءٍ قَبْلَهَا. «وَالنُّهَى»: العُقُولُ. «وَأُولُوا الأحْلام»: هُم البَالِغُونَ، وقَيلَ: أهْلُ الحِلْمِ وَالفَضْلِ.
হাদীস নং: ৩৫০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ উলামায়ে কিরাম, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানীত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
মসজিদে বিশৃঙ্খলা ও হট্টগোল না করা
হাদীছ নং : ৩৫০

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক ও বুদ্ধিমান তারা যেন আমার কাছাকাছি দাঁড়ায়। তারপর যারা তাদের কাছাকাছি তারা - এ কথাটি তিনি তিনবার বলেন। আর সাবধান, (মসজিদে) বাজারের মত বিশৃঙ্খলা ও হট্টগোল করা হতে বিরত থেকো -মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪৩২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২২৮; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৬৭৫; সহীহ ইবনে খুজায়মা, হাদীছ নং ১৫৭২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ২১৮০; তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০০৪১; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৫১৬১; শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৮২১
مقدمة الامام النووي
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم
350 - وعن عبد الله بن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «لِيَلِني مِنْكُمْ أُولُوا الأحْلام وَالنُّهَى، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ» ثَلاثًا «وَإيَّاكُمْ وَهَيْشَاتِ (1) الأسْوَاق». رواه مسلم. (2)
হাদীস নং: ৩৫১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ উলামায়ে কিরাম, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানীত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
কথা বলায় বয়োজ্যেষ্ঠকে অগ্রাধিকার দেওয়া
হাদীছ নং: ৩৫১

হযরত সাহল ইবন আবূ হাছমা আনসারী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবন সাহল ও মুহায়্যিসাহ ইবন মাস'ঊদ খায়বারে গেলেন। তখন খায়বার (-বাসীগণ) সন্ধিবদ্ধ ছিল। (সেখানে পৌছার পর) তারা দু'জন আলাদা হয়ে গেলেন। পরে মুহায়্যিসাহ আব্দুল্লাহ ইবন সাহলের কাছে এসে দেখেন তিনি রক্তাক্ত দেহে নিহত অবস্থায় পড়ে আছেন। তিনি তাকে দাফন করলেন। তারপর মদীনায় ফিরে আসলেন। তারপর (আব্দুল্লাহ ইবন সাহলের ভাই) আব্দুর রহমান ইবন সাহল এবং মাস'উদের পুত্রদ্বয় মুহায়্যিসাহ ও হুওয়ায়্যিসাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলেন। প্রথমে আব্দুর রহমান কথা বলতে উদ্যত হলে তিনি বললেন, বড়কে বলতে দাও। বড়কে বলতে দাও। আব্দুর রহমান ছিলেন দলের মধ্যে সকলের ছোট। তিনি চুপ করলেন। তারপর মুহায়্যিসাহ ও হুওয়ায়্যিসাহ কথা বললেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি কসম করে তোমাদের (লোকের) হত্যাকারীর (থেকে কিসাস গ্রহণের) অধিকার লাভ করবে? তারপর বর্ণনাকারী সম্পূর্ণ হাদীছটি বর্ণনা করেন -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬১৪২, ৬৮৯৮, ৭১৯২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৬৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৪২২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪৭১২; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৫২০; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ১৮২৫৮; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৬৪৩৩; শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৫৪৫
مقدمة الامام النووي
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم
351 - وعن أَبي يَحيَى، وقيل: أَبي محمد سهلِ بن أَبي حَثْمة - بفتح الحاءِ المهملة وإسكان الثاءِ المثلثةِ - الأنصاري - رضي الله عنه - قَالَ: انطَلَقَ عَبدُ اللهِ بنُ سهْلٍ وَمُحَيِّصَة بن مَسْعُود إِلَى خَيْبَرَ وَهِيَ يَومَئذٍ صُلْحٌ، فَتَفَرَّقَا، فَأتَى مُحَيِّصَةُ إِلَى عبدِ اللهِ ابنِ سهل وَهُوَ يَتشَحَّطُ (1) في دَمِهِ قَتِيلًا، فَدَفَنَهُ، ثُمَّ قَدِمَ المَدِينَةَ فَانْطَلَقَ عَبدُ الرحمان ابنُ سهل وَمُحَيِّصَةُ وحوَيِّصَةُ ابْنَا مَسْعُودٍ إِلَى النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - فَذَهَبَ عَبدُ الرحمن يَتَكَلَّمُ، فَقَالَ: «كَبِّرْ كَبِّرْ» وَهُوَ أحْدَثُ القَوم، فَسَكَتَ، فَتَكَلَّمَا، فَقَالَ: «أتَحْلِفُونَ وتَسْتَحِقُّونَ قَاتِلَكُمْ؟ ... » وذكر تمام الحديث. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2)
وقوله - صلى الله عليه وسلم: «كَبِّرْ كَبِّرْ» معناه: يتكلم الأكبر.
হাদীস নং: ৩৫২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ উলামায়ে কিরাম, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানীত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
একত্রে একাধিক লাশের দাফনে আলেম ও হাফেযকে বিশেষ সম্মান দেখানো
হাদীছ নং : ৩৫২

হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদে নিহতদের দু'-দু'জনকে একত্র করছিলেন। অর্থাৎ কবরে দাফন করার জন্য। তারপর বলছিলেন, এদের মধ্যে কে কুরআনের বেশি ধারক (অর্থাৎ কুরআন কে বেশি জানে)? যখন তাদের কোনও একজনের প্রতি ইঙ্গিত করা হত, তিনি তাকে কবরে সামনে রাখতেন -বুখারী।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৩৪৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২০৯৩; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ১৯৫৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩১৩৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ১৫১৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ১১৬৫৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩১৯৭; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৭৯৫; শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৫০০
مقدمة الامام النووي
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم
352 - وعن جابر - رضي الله عنه: أن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - كَانَ يَجْمَعُ بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ مِنْ قَتْلَى أُحُد يَعْنِي في القَبْرِ، ثُمَّ يَقُولُ: «أيُّهُما أكْثَرُ أخذًا للقُرآنِ؟» فَإذَا أُشيرَ لَهُ إِلَى أحَدِهِمَا قَدَّمَهُ في اللَّحْدِ. رواه البخاري. (1)
হাদীস নং: ৩৫৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ উলামায়ে কিরাম, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানীত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
বয়োজ্যেষ্ঠকে অগ্রাধিকারদান
হাদীছ নং : ৩৫৩

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি স্বপ্নে দেখছিলাম যে, মিসওয়াকের একটি ডালা দিয়ে মিসওয়াক করছি। এ অবস্থায় দুই ব্যক্তি আমার কাছে আসল। তাদের একজন অপরজন অপেক্ষা বড়। আমি মিসওয়াকটি ছোটজনকে দিলাম। আমাকে বলা হলো, বড়জনকে দিন। সুতরাং আমি সেটি তাদের মধ্যে যে বড় তাকে দিলাম -বুখারী ও মুসলিম। ২০০
ইমাম মুসলিম হাদীছটি পূর্ণ সনদে উল্লেখ করেছেন। ইমাম ২০০. বুখারী এটি উল্লেখ করেছেন বিনা সনদে।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৪৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২২৭১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬২২৫; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭১
مقدمة الامام النووي
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم
353 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما: أن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «أرَانِي فِي المَنَامِ أتَسَوَّكُ بِسِوَاكٍ، فَجَاءنِي رَجُلانِ، أحَدُهُما أكبر مِنَ الآخرِ، فَنَاوَلْتُ السِّوَاكَ الأصْغَرَ، فَقِيلَ لِي: كَبِّرْ، فَدَفَعْتهُ إِلَى الأكْبَرِ مِنْهُمَا». رواه مسلم مسندًا والبخاري تعليقًا. (1)
হাদীস নং: ৩৫৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ উলামায়ে কিরাম, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানীত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
বিশেষ তিন ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের গুরুত্ব
হাদীছ নং : ৩৫৪

হযরত আবূ মূসা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্ল আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা, কুরআনের যে বাহক তাতে বাড়াবাড়ি করে না এবং তার প্রতি অবহেলাও প্রদর্শন করে না তাকে সম্মান করা এবং ন্যায়পরায়ণ শাসককে সম্মান করা, আল্লাহ তা'আলাকে সম্মান করার অন্তর্ভুক্ত -আবূ দাউদ। ২০৩
مقدمة الامام النووي
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم
354 - وعن أَبي موسى - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «إنَّ مِنْ إجْلالِ اللهِ تَعَالَى: إكْرَامَ ذِي الشَّيْبَةِ (1) المُسْلِمِ، وَحَامِلِ القُرآنِ غَيْرِ الغَالِي (2) فِيهِ، وَالجَافِي عَنْهُ، وَإكْرَامَ ذِي السُّلْطَانِ المُقْسِط (3)» حديث حسن رواه أَبُو داود. (4)
হাদীস নং: ৩৫৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ উলামায়ে কিরাম, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানীত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
ছোটকে স্নেহ ও বড়কে সম্মান করা
হাদীছ নং : ৩৫৫

আমর ইবন শুআইব থেকে যথাক্রমে তার পিতা ও দাদা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের দয়া করে না এবং বড়দের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন নয়, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয় - আবু দাউদ ও তিরমিযী। ২১৩
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি একটি হাসান সহীহ হাদীছ।
ইমাম আবূ দাউদ রহ.-এর বর্ণনায় আছে, আমাদের বড়দের হক সম্পর্কে সচেতন নয়।
(জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯১৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯৪৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৭৩৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদীছ নং ২৫৩৫৯; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৩৫৩; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭৮৯৫; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৫৯৭; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৪৭১)
مقدمة الامام النووي
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم
355 - وعن عمرو بن شعيب، عن أبيه، عن جده - رضي الله عنهم - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرنَا، وَيَعْرِفْ شَرَفَ كَبيرِنَا». حديث صحيح رواه أَبُو داود والترمذي، وَقالَ الترمذي: «حديث حسن صحيح». (1)
وفي رواية أبي داود: «حَقَّ كَبيرِنَا».
হাদীস নং: ৩৫৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ উলামায়ে কিরাম, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানীত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
মানুষের সঙ্গে তাদের আপন আপন মর্যাদা অনুযায়ী আচরণ করা
হাদীছ নং : ৩৫৬

মায়মুন ইবন আবী শাবীব রহ. থেকে বর্ণিত যে, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর কাছে এক খাদ্যপ্রার্থী আসলে তিনি তাকে এক টুকরো রুটি দিলেন। আরেক ব্যক্তি তাঁর কাছে আসল, যার বেশভূষা ভালো ছিল। তিনি তাকে বসালেন। সে আহার করল। এ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মানুষকে তাদের আপন আপন মর্যাদা অনুযায়ী স্থান দিও -আবূ দাউদ।২১৫
ইমাম আবূ দাঊদ রহ. বলেন, মায়মুন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে পাননি। ইমাম মুসলিম রহ. তার সহীহ গ্রন্থের ভূমিকায় এটি বিনা সনদে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, উম্মুল মূমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে আদেশ করেছেন যেন মানুষকে তাদের আপন আপন মর্যাদা অনুযায়ী স্থান দিই।
হাকিম আবূ আব্দুল্লাহ রহ. তাঁর মা'রিফাতু উলূমিল হাদীছ শীর্ষক গ্রন্থে এ হাদীছটি উল্লেখ করেছেন এবং মন্তব্য করেছেন যে, এটি একটি সহীহ হাদীছ।
সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৮৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ভূমিকা দ্রষ্টব্য; মুসনাদে আবূ ইয়ালা, হাদীছ নং ৪৮২৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৪৮৯
مقدمة الامام النووي
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم
356 - وعن ميمون بن أَبي شَبيب رحمه الله: أنَّ عائشة رَضي الله عنها مَرَّ بِهَا سَائِلٌ، فَأعْطَتْهُ كِسْرَةً، وَمَرَّ بِهَا رَجُلٌ عَلَيهِ ثِيَابٌ وَهَيْئَةٌ، فَأقْعَدَتهُ، فَأكَلَ، فقِيلَ لَهَا في ذلِكَ؟ فقَالتْ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «أنْزِلُوا النَّاسَ مَنَازِلَهُمْ». رواه أبو داود (1). لكن قال: ميمون لم يدرك عائشة. وقد ذكره مسلم في أول صحيحه تعليقًا فقال: وذكر عن عائشة رضي الله عنها قالت: أمرنا رسول الله - صلى الله عليه وسلم - أن ننزل الناس منازلهم، وَذَكَرَهُ الحَاكِمُ أَبُو عبد الله في كتابه «مَعرِفَة عُلُومِ الحَديث» وَقالَ: «هُوَ حديث صحيح».
হাদীস নং: ৩৫৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ উলামায়ে কিরাম, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানীত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
হযরত উমর রাযি.-এর কাছে উলামার মর্যাদা
হাদীছ নং : ৩৫৭

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উয়ায়না ইবন হিসন (মদীনায় এসে) তার ভাতিজা হুর ইবন কায়সের মেহমান হলো। হুর ইবন কায়স ছিলেন উমর রাযি.-এর ঘনিষ্ঠজনদের একজন। কুরআন মাজীদে বেশি অভিজ্ঞজনরাই ছিল উমর রাযি.-এর সভাষদ ও পরামর্শক, তাতে তারা প্রবীণ হোক বা যুবক। উয়ায়না ইবন হিসন তার ভাতিজাকে বললেন, হে ভাতিজা! এই আমীরের কাছে তোমার বিশেষ মর্যাদা আছে। তুমি আমার জন্য তার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি নিয়ে এসো। তিনি তার জন্য অনুমতি চাইলেন। উমর রাযি. তাকে অনুমতি দিলেন। তিনি প্রবেশ করেই বললেন, হুম, হে খাত্তাবের পুত্র! আল্লাহর কসম! না তুমি আমাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে দাও, আর না আমাদের মধ্যে ইনসাফের সঙ্গে শাসন কর। এতে উমর রাযি. রেগে গেলেন। এমনকি তিনি তাকে শাস্তিদানেরও ইচ্ছা করলেন। তখন হুর রাযি. তাকে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ তা'আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন- خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (ক্ষমা অবলম্বন কর, ন্যায়ের আদেশ কর এবং অজ্ঞজনদের উপেক্ষা কর)২১৭ । এই ব্যক্তিও অজ্ঞদেরই একজন। আল্লাহর কসম! উমরের সামনে যখন তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, তখন তিনি এটি পাশ কাটিয়ে গেলেন না। বস্তুত তিনি ছিলেন আল্লাহর কিতাব অনুসরণে বড় অনড় -বুখারী। ২১৮

২১৭. সূরা আ‘রাফ (৭), আয়াত ১৯৯

২১৮. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৬৪২, ৭২৮৬; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৬৬৪৬; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৯৬১
مقدمة الامام النووي
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم
قَالَ الله تَعَالَى: {قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الأَلْبَابِ} [الزمر: 9].
357 - وعن ابن عباس رضي الله عنهما، قَالَ: قَدِمَ عُيَيْنَةُ بنُ حِصْن، فَنَزَلَ عَلَى ابْنِ أخِيهِ الحُرِّ بنِ قَيسٍ، وَكَانَ مِنَ النَّفَرِ الَّذِينَ يُدْنِيهِمْ عُمرُ - رضي الله عنه - وَكَانَ القُرَّاءُ أصْحَاب مَجْلِس عُمَرَ وَمُشاوَرَتِهِ، كُهُولًا كاَنُوا أَوْ شُبَّانًا، فَقَالَ عُيَيْنَةُ لابْنِ أخيهِ: يَا ابْنَ أخِي، لَكَ وَجْهٌ عِنْدَ هَذَا الأمِيرِ، فَاسْتَأذِنْ لِي عَلَيهِ، فاسْتَأذَن له، فَأَذِنَ لَهُ عُمَرُ - رضي الله عنه - فَلَمَّا دَخَلَ قَالَ: هِي يَا ابنَ الخَطَّابِ، فَواللهِ مَا تُعْطِينَا الْجَزْلَ، وَلا تَحْكُمُ فِينَا بالعَدْلِ، فَغَضِبَ عُمَرُ - رضي الله عنه - حَتَّى هَمَّ أَنْ يُوقِعَ بِهِ، فَقَالَ لَهُ الحُرُّ: يَا أَمِيرَ المُؤْمِنِينَ، إنَّ الله تَعَالَى قَالَ لِنَبيِّهِ - صلى الله عليه وسلم: {خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ} [الأعراف: 199]، وَإنَّ هَذَا مِنَ الجَاهِلِينَ. واللهِ مَا جَاوَزَهاَ عُمَرُ حِينَ تَلاَهَا عليه، وكَانَ وَقَّافًا عِنْدَ كِتَابِ اللهِ تَعَالَى. رواه البخاري. (1)
হাদীস নং: ৩৫৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ উলামায়ে কিরাম, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানীত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
প্রবীণ উলামার আদব ও সম্মানরক্ষায় নবীন উলামার করণীয়
হাদীছ নং : ৩৫৮

হযরত আবূ সা'ঈদ সামুরা ইবন জুনদুব রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে আমি ছিলাম একজন বালক। আমি তাঁর কাছ থেকে যা শুনতাম তা মুখস্থ করে রাখতাম। কাজেই আমার কথা বলায় এছাড়া আর কোনও প্রতিবন্ধক নেই যে, এখানে এমন অনেক লোক আছেন যারা আমার চেয়ে বেশি বয়স্ক -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯৬৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২০২১৩: খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ৩৫৮
مقدمة الامام النووي
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم
قَالَ الله تَعَالَى: {قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الأَلْبَابِ} [الزمر: 9].
358 - وعن أَبي سعيد سَمُرة بنِ جُندب - رضي الله عنه - قَالَ: لقد كنتُ عَلَى عَهْدِ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - غُلاَمًا، فَكُنْتُ أَحْفَظُ عَنْهُ، فَمَا يَمْنَعُنِي مِنَ القَوْلِ إلاَّ أنَّ هَاهُنَا رِجَالًا هُمْ أسَنُّ مِنِّي. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীস নং: ৩৫৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ উলামায়ে কিরাম, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানীত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
বয়স্ক ব্যক্তিকে সম্মান করার দুনিয়াবী ফায়দা
হাদীছ নং : ৩৫৯

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনও যুবক কোনও বৃদ্ধকে তার বার্ধক্যের কারণে সম্মান করলে আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই এমন কোনও লোক তার জন্য নিযুক্ত করে দেবেন, যে তার বৃদ্ধাবস্থায় তাকে সম্মান করবে -তিরমিযী।
জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২০২২; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৫৯০৩; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৪৮৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৫৩
مقدمة الامام النووي
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم
قَالَ الله تَعَالَى: {قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الأَلْبَابِ} [الزمر: 9].
359 - وعن أنس - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «مَا أَكْرَمَ شَابٌّ شَيْخًا لِسِنِّهِ إلاَّ قَيَّضَ (1) اللهُ لَهُ مَنْ يُكْرِمُهُ عِنْدَ سِنِّه». رواه الترمذي، (2) وَقالَ: «حديث غريب».
হাদীস নং: ৩৬০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৪৫

নেককার লোকদের সঙ্গে সাক্ষাত করা, তাদের মজলিসে বসা, তাদের সাহচর্য গ্রহণ করা, তাদেরকে ভালোবাসা,তাদের সাক্ষাত প্রার্থনা করা, তাদের কাছে দু'আ চাওয়া

এবং মর্যাদাপূর্ণ স্থানসমূহ যিয়ারত করা আল্লাহওয়ালা ও বুযুর্গ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাত করা, তাদের মজলিসে বসা ও তাদের সাহচর্যে থাকার দ্বারা ঈমান ও আমল-আখলাকে উন্নতি লাভ হয়। তাদেরকে দেখার দ্বারা আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। তাদের কথা শুনলে দীনের বুঝ-সমঝ হাসিল হয়। তাদের আমল দেখলে নিজেরও আমল করার উৎসাহ জাগে এবং আমলের আদব কায়দা শেখা যায়। তাদের আচার-আচরণ দেখার দ্বারা দীনী শিষ্টাচার সম্পর্কে অবগতি লাভ হয়। তাদের আখলাক-চরিত্র দেখার দ্বারা নিজ আখলাক-চরিত্র সংশোধন করা যায়। মোটকথা তাদের কাছে যাওয়া-আসা করার দ্বারা নিজের জাহের-বাতেন ও ভেতর-বাহির আলোকিত হয়, জীবনে উৎকর্ষ আসে। ইসলাম তো জীবনবদলের জন্যই। কাজেই যা-কিছু জীবনবদলের পক্ষে সহায়ক, তা অবশ্যই অবলম্বন করা উচিত। সে হিসেবে বুযুর্গানে দীন ও আল্লাহওয়ালাদের কাছে যাওয়া-আসা করা ও তাদের সাহচর্য গ্রহণ করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তাদের দু'আও অত্যন্ত কার্যকর। তাই গুরুত্বের সঙ্গে তাদের কাছে দু'আও চাওয়া দরকার। এমনিভাবে বরকতপূর্ণ স্থানসমূহের স্পর্শও ঈমান তাজা করে, আমলে উদ্দীপনা যোগায়। দেহমনে আলো সঞ্চার ও নূরানী যিন্দেগী গড়ার লক্ষ্যে এরকম স্থানসমূহের যিয়ারতও কাম্য।
এসবই যে কাম্য ও বাঞ্ছনীয়, সে সম্পর্কিত কিছু আয়াত ও হাদীছ ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। মাল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন।

নেককার লোকদের সঙ্গে সাক্ষাত করা এবং মর্যাদাপূর্ণ স্থানসমূহ যিয়ারত করা -সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত

এক নং আয়াত

وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِفَتَاهُ لَا أَبْرَحُ حَتَّى أَبْلُغَ مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ أَوْ أَمْضِيَ حُقُبًا (60) فَلَمَّا بَلَغَا مَجْمَعَ بَيْنِهِمَا نَسِيَا حُوتَهُمَا فَاتَّخَذَ سَبِيلَهُ فِي الْبَحْرِ سَرَبًا (61) فَلَمَّا جَاوَزَا قَالَ لِفَتَاهُ آتِنَا غَدَاءَنَا لَقَدْ لَقِينَا مِنْ سَفَرِنَا هَذَا نَصَبًا (62) قَالَ أَرَأَيْتَ إِذْ أَوَيْنَا إِلَى الصَّخْرَةِ فَإِنِّي نَسِيتُ الْحُوتَ وَمَا أَنْسَانِيهُ إِلَّا الشَّيْطَانُ أَنْ أَذْكُرَهُ وَاتَّخَذَ سَبِيلَهُ فِي الْبَحْرِ عَجَبًا (63) قَالَ ذَلِكَ مَا كُنَّا نَبْغِ فَارْتَدَّا عَلَى آثَارِهِمَا قَصَصًا (64) فَوَجَدَا عَبْدًا مِنْ عِبَادِنَا آتَيْنَاهُ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنَا وَعَلَّمْنَاهُ مِنْ لَدُنَّا عِلْمًا (65) قَالَ لَهُ مُوسَى هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَى أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا

অর্থ : (সেই সময়ের বৃত্তান্ত শোন) যখন মূসা তার যুবক (শিষ্য)-কে বলেছিল, আমি দুই সাগরের সঙ্গমস্থলে না পৌঁছা পর্যন্ত চলতেই থাকব অথবা আমি চলতে থাকব বছরের পর বছর। সুতরাং তারা যখন দুই সাগরের সঙ্গমস্থলে পৌঁছল, তখন উভয়েই তাদের মাছের কথা ভুলে গেল। সেটি সাগরের ভেতর সুড়ঙ্গের মত পথ তৈরি করে নিল। তারপর তারা যখন সে স্থান অতিক্রম করে গেল, তখন মূসা তার (সঙ্গী) যুবককে বলল, আমাদের নাশতা লও। সত্যি বলতে কি, এ সফরে আমরা বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সে বলল, আপনি কি জানেন (কী আজব কাণ্ড ঘটেছে?) আমরা যখন পাথরের চাঁইয়ের উপর বিশ্রাম করছিলাম, তখন মাছটির কথা (আপনাকে বলতে) ভুলে গিয়েছিলাম। সেটির কথা বলতে শয়তানই আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর সেটি (অর্থাৎ মাছটি) অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে সাগরে নিজের পথ করে নিয়েছিল। মূসা বলল, আমরা তো এটাই সন্ধান করছিলাম। অতএব তারা তাদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চলল। অনন্তর তারা আমার বান্দাদের মধ্য হতে এক বান্দার সাক্ষাত পেল, যাকে আমি আমার বিশেষ রহমত দান করেছিলাম এবং আমার পক্ষ হতে শিক্ষা দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান। মূসা তাকে বলল, আমি কি এই লক্ষ্যে আপনার অনুগমন করতে পারি যে, আপনাকে যে কল্যাণকর জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তা থেকে খানিকটা আমাকে শেখাবেন?২২৫

ব্যাখ্যা

এ আয়াতসমূহে হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সাথে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সাক্ষাৎকারের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দীর্ঘ হাদীছে এ ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বিবৃত করেছেন। বুখারী শরীফে কয়েকটি সনদে তা উদ্ধৃত হয়েছে। হাদীছটির সারসংক্ষেপ এস্থলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও হযরত খাযির আলাইহিস সালামের ঘটনা

একবার কেউ হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করল, বর্তমান বিশ্বে সর্বাপেক্ষা বড় আলেম কে? যেহেতু প্রত্যেক নবী তার সমকালীন বিশ্বে দীনের সর্বাপেক্ষা বড় আলেম হয়ে থাকেন, তাই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম জবাব দিলেন, আমিই সবচেয়ে বড় আলেম। এ জবাব আল্লাহ তাআলার পসন্দ হলো না। আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে অবহিত করা হলো যে, প্রশ্নের সঠিক উত্তর ছিল- আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন কে সবচেয়ে বড় আলেম।
এতদ্‌সঙ্গে আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সামনে জ্ঞানের এমন এক দিগন্ত উন্মোচিত করতে চাইলেন, যে সম্পর্কে এ যাবৎকাল তার কোনও ধারণা ছিল না। সুতরাং তাঁকে হুকুম দেওয়া হলো, তিনি যেন হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। পথ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হলো যে, যেখানে দু'টি সাগর মিলিত হয়েছে, সেটাই হবে তার গন্তব্যস্থল। আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِفَتَاهُ لَا أَبْرَحُ حَتَّى أَبْلُغَ مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ أَوْ أَمْضِيَ حُقُبًا

‘(সেই সময়ের বৃত্তান্ত শোন) যখন মূসা তার যুবক (শিষ্য)-কে বলেছিল, আমি দুই সাগরের সঙ্গমস্থলে না পৌঁছা পর্যন্ত চলতেই থাকব অথবা আমি চলতে থাকব বছরের পর বছর)'। সাগরের সঙ্গমস্থল দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে কোন্ জায়গা বোঝানো হয়েছে সে সম্পর্কে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। অনেকের মতে আকাবা উপসাগর ও লোহিত সাগরের মিলনস্থল। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলকে নিয়ে যখন মিশর ত্যাগ করে সিনাই মরুভূমিতে এসে পৌঁছান, এবং বিভিন্ন কারণে দীর্ঘকাল যাবৎ তাঁকে এ মরুভূমিতে অবস্থান করতে হয়, হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনাটি সেই সময়কার হয়ে থাকলে এ স্থানটি তাদের মিলনস্থল হওয়া সম্ভব। কিন্তু কারও কারও মতে এটি ঘটেছিল তাঁর মিশরে অবস্থানকালে। এক ইসরাঈলী বর্ণনা মোতাবেক তিনি মিশর থেকে হাবশার দিকে সুদীর্ঘ একটি সফর করেছিলেন। সে সফরকালেও এ ঘটনা ঘটা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে দুই সাগরের সঙ্গমস্থল বলতে সুদানের রাজধানী খুরতুমের কাছাকাছি কোনও এক স্থান হয়ে থাকবে, যেখানে 'নীল আযরাক' ও 'নীল আবয়ায' নামক দুই নদ মিলিত হয়েছে। আবার কেউ কেউ জিব্রাল্টার প্রণালীর কোনও স্থান হতে পারে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এ প্রণালী দ্বারা আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে ভূমধ্য সাগর মিলিত হয়েছে। তবে এর কোনওটিই নিশ্চিত নয়। নিশ্চিতভাবে তা জানা জরুরিও নয়। কুরআন মাজীদে যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তা দ্বারা উদ্দেশ্য কেবল নসীহত ও শিক্ষাগ্রহণ করা। স্থান-কাল জানা ছাড়াও সে উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যায়।
যাহোক হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে, দুই সাগরের সঙ্গমস্থলে এমন একটা জায়গা আসবে, যেখানে তার সঙ্গে নেওয়া মাছ হারিয়ে যাবে। মাছ হারানোর সে জায়গাতেই হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সাক্ষাত পাওয়া যাবে। সুতরাং হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর যুবক শিষ্য হযরত ই‍য়ূশা আলাইহিস সালামকে সঙ্গে নিয়ে, যিনি পরবর্তীকালে নবী হয়েছিলেন, সফর শুরু করে দিলেন।
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এক জায়গায় পৌঁছে একটি পাথরের চাঁইয়ের উপর কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, এ সময় সঙ্গে আনা মাছটি ঝুড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে গেল এবং ঘেঁষড়াতে ঘেঁষড়াতে সাগরে গিয়ে পড়ল। যেখানে সেটি পড়েছিল, সেখানে পানিতে সুড়ঙ্গের মত তৈরি হয়ে গেল এবং তার ভেতর সেটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
হযরত ইয়ূশা আলাইহিস সালাম তখন জেগেই ছিলেন। তিনি মাছটির এ বিস্ময়কর কাণ্ড দেখতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ঘুমিয়ে থাকায় তিনি তাঁকে জাগানো সমীচীন মনে করলেন না। তারপর যখন হযরত মূসা আলাইহিস সালামের ঘুম ভাঙল এবং সামনে এগিয়ে চললেন, তখনও হযরত ইয়ুশা আলাইহিস সালাম তাঁকে সে কথা জানাতে ভুলে গেলেন। তাঁর সে কথা মনে পড়ল যখন হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর কাছে নাশতা চাইলেন ।
হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে আলামত বলে দেওয়া হয়েছিল এটাই যে, যেখানে মাছটি হারিয়ে যাবে, সেখানেই হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাত হবে। তাই হযরত ইয়ূশা আলাইহিস সালাম তো ঘটনাটি তাঁকে ভয়ে ভয়ে শুনিয়েছিলেন, কিন্তু হযরত মূসা আলাইহিস সালাম শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি যে গন্তব্যের সন্ধান পেয়ে গেছেন!
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম যখন পাথরের চাঁইটির কাছে ফিরে আসলেন, তখন হযরত খাযির আলাইহিস সালাম সেখানে চাদর মুড়ি দিয়ে শোয়া ছিলেন। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁকে সালাম দিলেন। তিনি জেগে উঠলেন। উভয়ের মধ্যে পরিচয় হলো। তারপর হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন-

هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَى أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا

(আমি কি এই লক্ষ্যে আপনার অনুগমন করতে পারি যে, আপনাকে যে কল্যাণকর জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তা থেকে খানিকটা আমাকে শেখাবেন?)। এটা ছিল তাঁর পক্ষ থেকে হযরত খাযির আলাইহিস সালামের প্রতি এক বিনীত অনুরোধ। এর দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায়, ছাত্রের কর্তব্য উসতাযের সাথে সর্বদা বিনীতভাবে কথা বলা ও বিনীত আচরণ করা। এক বর্ণনায় আছে,

توَاضَعُوْا لِمَنْ تَعَلَّمُونَ مِنْهُ

‘যার কাছে শিক্ষালাভ কর, তার সাথে বিনয় অবলম্বন করবে।২২৬

হযরত খাযির আলাইহিস সালাম তাঁর এ বিনীত অনুরোধ রক্ষা করলেন। তবে শর্ত দিলেন যে, পথে যা-কিছু নজরে আসবে তাতে হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে ধৈর্যধারণ করতে হবে, কোনওরকম আপত্তি করা যাবে না, কোনও প্রশ্নও তোলা যাবে না। তিনি শর্ত মেনে নিয়ে তাঁর সঙ্গে থাকা শুরু করলেন। এ সময়কালে হযরত খাযির আলাইহিস সালাম তিনটি অবাক করা কাজ করলেন। তার কোনওটিই হযরত মূসা আলাইহিস সালামের শরীআতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। যে মাঝি তাদেরকে বিনা ভাড়ায় নদী পার করিয়ে দিয়েছিল, খাযির আলাইহিস সালাম তার নৌকাটি ফুটো করে দিলেন। তিনি শুধু শুধুই একটি বালককে মেরে ফেললেন। এক জনপদের লোকজন তাদের আপ্যায়ন করতে রাজি না হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিনামূল্যে তাদের একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর সোজা করে দিলেন।
যেহেতু কাজগুলো আপত্তিকর ও প্রশ্নসাপেক্ষ ছিল, তাই কথা না বলার শর্ত থাকা সত্ত্বেও হযরত মূসা আলাইহিস সালাম প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রশ্ন তুললেন। তিন তিনবার শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় খাযির আলাইহিস সালাম সফর ও সাহচর্যের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। তারপর তিনি আপাত আপত্তিকর এ কাজ তিনটির ব্যাখ্যা দিলেন। তাতে তিনি স্পষ্ট করে দিলেন যে, তিনি এগুলো আল্লাহর হুকুমেই করেছেন এবং তা করার প্রয়োজন ছিল।
নৌকাটি ফুটো করেছেন এ কারণে যে, সেটি ছিল কয়েকজন গরীব লোকের, যারা সাগরে কাজ করত। তাদের সামনে ছিল এক জালিম রাজা। সে সব ভালো নৌকা কেড়ে নিত। ফুটো করে দেওয়ার কারণে এখন আর সে নৌকাটি নেবে না। ফলে ফুটো করে দেওয়ায় গরীব লোকগুলোর কল্যাণই হয়েছে।
বালকটিকে হত্যা করার কারণ এই যে, তার পিতা-মাতা ছিল মুমিন। আশঙ্কা ছিল সে বড় হয়ে তাদেরকে অবাধ্যতা ও কুফরীতে লিপ্ত করবে। আশা ছিল একে হত্যা করলে তাদেরকে এর পরিবর্তে উৎকৃষ্ট ও নেককার সন্তান দেওয়া হবে।
প্রাচীরটি ছিল শহরে বসবাসকারী দুই ইয়াতীমের। নিচে তাদের গুপ্তধন ছিল। তাদের পিতা ছিল একজন সৎলোক । আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ছিল ছেলে দু'টো বড় হয়ে প্রাচীরের নিচ থেকে নিজেদের গুপ্তধন বের করে নেবে। কিন্তু এখনই যদি প্রাচীরটি পড়ে যায়, তবে সে গুপ্তধন অন্যরা কাড়াকাড়ি করে নিয়ে যাবে এবং তারা বঞ্চিত হবে। সে কারণেই খাযির আলাইহিস সালাম প্রাচীরটি সোজা করে দিয়েছেন।
প্রকাশ থাকে যে, হযরত মুসা আলাইহিস সালামের এ সফরকে সাধারণ কোনও ভ্রমণের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। তার এ সফরের ভেতর আল্লাহ তাআলার বিশেষ উদ্দেশ্য নিহিত ছিল। একটা উদ্দেশ্য তো অতি পরিষ্কার। আল্লাহ তাআলা এর দ্বারা শিক্ষা দিতে চেয়েছেন, নিজেকে নিজে সকলের বড় আলেম বলা কারও পক্ষেই শোভা পায় না। ইলম বা জ্ঞান হচ্ছে কুল-কিনারাহীন এক অথৈ সাগর। এর কোনও দিক সম্পর্কে কে বেশি জানে তা বলা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, আল্লাহ তাআলা নিজ জ্ঞান ও হিকমত দ্বারা মহাবিশ্ব কিভাবে চালাচ্ছেন তার একটা ঝলক হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে চোখে দেখিয়ে দেওয়া।
মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনে দুনিয়ায় বহু ঘটনা ঘটতে দেখে। অনেক সময় এমন কাণ্ড-কারখানাও তার চোখে পড়ে, যার কোনও ব্যাখ্যা সে খুঁজে পায় না এবং যার উদ্দেশ্য তার বুঝে আসে না। অথচ প্রতিটি ঘটনার ভেতরই আল্লাহ তাআলার কোনও না কোনও হিকমত নিহিত থাকে। মানুষের দৃষ্টি যেহেতু সীমাবদ্ধ, তাই সে অনেক সময় তাঁর রহস্য বুঝতে সক্ষম হয় না। কিন্তু যেই সর্বশক্তিমান মালিকের হাতে বিশ্বজগতের বাগডোর, তিনি জানেন কখন কী ঘটনা ঘটা উচিত।

দুই নং আয়াত

وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ

অর্থ : ধৈর্য-স্থৈর্যের সাথে নিজেকে সেই সকল লোকের সংসর্গে রাখ, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে এ কারণে ডাকে যে, তারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।২২৭

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওইসব লোকের সঙ্গে ধৈর্য সহকারে থাকার হুকুম দিয়েছেন, যারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে পরিপূর্ণ ইখলাসের সঙ্গে সর্বদা ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকে। সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তাআলাকে ডাকে। অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত আদায় করে, আল্লাহ তাআলার যিকর করে, কুরআন তিলাওয়াত করে, হালাল-হারাম বিচার করে চলে, মানুষের সঙ্গে আচার-আচরণে আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ রাখে, আল্লাহ তাআলার হক আদায়ের পাশাপাশি মাখলুকের হক আদায়েও যত্নবান থাকে। তারা গরীব কিসিমের লোক হতে পারে, কিন্তু তাদের অন্তর ঐশ্বর্যে ভরা। দুনিয়ার প্রতি তাদের কোনও লোভ-লালসা নেই। দুনিয়াদারদের যা আছে সেজন্য তারা লালায়িতও নয় এবং নয় সে কারণে তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত ।
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি., হযরত সুহায়ব রাযি.. হযরত বিলাল রাযি., হযরত আবূ হুরায়রা রাযি., হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. প্রমুখ সাহাবী এসকল গুণের অধিকারী ছিলেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এসকল গরীব আল্লাহওয়ালাদের সঙ্গে ধৈর্যসহকারে থাকতে বলেছেন।

যাদের সাহচর্য কল্যাণকর

এ আয়াতে বাহ্যত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের সাহচর্যে থাকার হুকুম দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বোঝানো উদ্দেশ্য- আপনি ধৈর্যসহকারে তাদেরকে নিজ সাহচর্যে থাকতে দিন। আপনার সাহচর্যে থেকে তারা যাতে নিজেদেরকে আল্লাহর খাঁটি বান্দারূপে গড়ে তুলতে পারে আর এভাবে আখেরাতের সাফল্য অর্জনে সক্ষম হতে পারে, সে সুযোগ তাদেরকে দান করুন।
এর দ্বারা উদ্দেশ্য সম্ভবত আমাদেরকে সবক দেওয়া যে, আমরা যেন উল্লিখিত গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাহচর্যে থাকি। এভাবেও বলা যায় যে, আমাদেরকে আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য অবলম্বনের হুকুম দেওয়া হয়েছে আর কিভাবে চিনব কে সত্যিকারের আল্লাহওয়ালা, সেজন্য তাদের গুণাবলীও উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে যাতে করে কোনও আল্লাহওয়ালা গরীব হলে সে কারণে তাদের সাহচর্য পরিত্যাগ না করি। কেননা আল্লাহওয়ালা হওয়ার মাপকাঠি ধন-সম্পদ নয়; বরং উল্লিখিত গুণাবলী। যাদের মধ্যে এসব গুণ নেই, পার্থিব দিক থেকে তারা যতই সুপ্রতিষ্ঠিত হোক, প্রকৃতপক্ষে তারা এর উপযুক্ত নয় যে, তাদের সাহচর্য গ্রহণ করা যেতে পারে। তা করতে পারে কেবল এমন লোক, যাদের উদ্দেশ্য পার্থিব ভোগ- উপভোগ। আয়াতের পরের অংশে সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে-

وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا

‘পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায় তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।’

অর্থাৎ মুখলিস গরীবদের ছেড়ে বিত্তবান অহংকারীদের দিকে নজর দিও না। তুমি হয়তো এই উদ্দেশ্যে তাদের দিকে নজর দেবে যে, তারা মুসলিম হয়ে গেলে ইসলাম শক্তিশালী হবে । এ চিন্তা ভুল । ইসলামের প্রকৃত শক্তি ও মর্যাদা অর্থবিত্তের মধ্যে নিহিত নয়; বরং তার উৎস হচ্ছে খাঁটি ঈমান তাকওয়া-পরহেযগারী ও উন্নত আখলাক-চরিত্র। এটাই প্রকৃত সম্পদ, যা ওই গরীব মুমিনদের মধ্যে আছে। অহংকারী বিত্তবানেরা এর থেকে বঞ্চিত।

যাদের সাহচর্য গ্রহণ করতে নেই

এ প্রসঙ্গে আয়াতের পরবর্তী অংশও উল্লেখযোগ্য। বলা হয়েছে-

وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا

(এমন কোনও ব্যক্তির কথা মানবে না, যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে রেখেছি, যে নিজ খেয়াল-খুশির পেছনে পড়ে রয়েছে এবং যার কার্যকলাপ সীমা ছাড়িয়ে গেছে)।
কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কুরায়শ গোত্রীয় কোনও কোনও মোড়ল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রস্তাব পেশ করেছিল, আপনি ওই নিম্নস্তরের লোকগুলোকে সরিয়ে দিন, তাহলে আমরা অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণী আপনার কাছে বসতে পারব এবং আপনি কী বলেন তা শুনব। তারা নিম্নস্তরের লোক বলেছিল গরীব মুমিনদেরকে আর অভিজাত বলেছিল বিত্তবান কাফেরদেরকে।
হয়তোবা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিন্তা করেছিলেন আমার গরীব সাহাবীগণ তো খাঁটি মুমিনই। তাদের ঈমান পরিপক্ক। সাময়িকভাবে তাদেরকে মজলিসে আসতে মানা করলে বিশেষ কোনও ক্ষতি নেই, তারা মনে কষ্ট পাবে না। এ অবকাশে এসব মোড়লকে দীনের কথা শোনানো যাবে। হয়তো তারা ঈমানও আনবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিল হয় এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, আপনি এ উদ্ধত-অহংকারী শ্রেণীর কথায় কান দেবেন না। এরা শুধু শুধুই এ প্রস্তাব করছে। আসলে তাদের ঈমান আনার ইচ্ছাই নেই। ঈমান আনতে চাইলে তারা এতদিনে এনেই ফেলত। তাদের সামনে সত্যদীন পরিস্ফুট হতে কিছু বাকি নেই। আসলে তাদের অন্তর দুনিয়ার নেশায় মত্ত। তারা আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল। তারা সর্বক্ষণ মনের খাহেশ পূরণে ব্যস্ত। আল্লাহর আনুগত্য করতে গেলে তারা তাদের মনের অসৎ চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। তাই মনের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আল্লাহর আনুগত্য পাশ কাটিয়ে চলছে এবং কুফর ও অবাধ্যতায় লিপ্ত থেকে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এহেন নফসের পূজারীদের কথায় বিলকুল কর্ণপাত করবেন না।
মোটকথা তিনটি অসদ্‌গুণ যাদের মধ্যে আছে, কিছুতেই তাদের আনুগত্য করা যাবে না, এমনকি তাদের সঙ্গ ও সাহচর্যও অবলম্বন করা উচিত হবে না। সে অসৎ গুণগুলো হচ্ছে-
ক. অন্তরের গাফলাত এবং আল্লাহর যিকর ও স্মরণ থেকে বিমুখ থাকা। খ. নফসের আনুগত্য তথা মনের অসৎ চাহিদা পূরণে লিপ্ত থাকা। গ. সত্য ও ন্যায়ের সীমা লঙ্ঘন করা ও বাড়াবাড়িতে লিপ্ত থাকা।
যে-কারও বদদীন হওয়ার জন্য এ তিনটি স্বভাবের যে কোনও একটিই যথেষ্ট। কারও মধ্যে তিনওটি থাকার অর্থ সে চরম পর্যায়ের বেদীন। এরূপ লোকের কথায় চলা। বা তাদের সাহচর্য অবলম্বন করার পরিণাম নিজেরও গোমরাহ হয়ে যাওয়া, যা কোনও মুমিন-মুসলিমের কাম্য হতে পারে না।
এ আয়াতটি সাহাবায়ে কেরামের উচ্চমর্যাদার এক সুস্পষ্ট দলীল। আয়াতটি নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করেন-

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَمْ يُمِثْنِي حَتَّى أَمَرَنِي أَنْ أَصْبَرَ نَفْسِي مَعَ قَوْمٍ مِنْ أُمَّتِي، مَعَكُمْ الْمَحْيَا، وَمَعَكُمُ الْمَمَاتُ

‘আল্লাহ তাআলার শোকর, তিনি আমার উম্মতেরই একদল লোকের সঙ্গে আমাকে ধৈর্যসহকারে থাকার আদেশ দান না করা পর্যন্ত আমার মৃত্যু ঘটাননি। (ওহে আমার সাহাবীগণ!) তোমাদেরই সঙ্গে আমার জীবন এবং তোমাদেরই সঙ্গে মরণ।২২৮

২২৫. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ৬০-৬৬

২২৬. এটি হযরত উমর রাযি.-এর বাণী হিসেবে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত। দ্রষ্টব্য : আল আদাবুশ শরইয়্যাহ (ইবনে মুফলিহ) ১/২২৪; তাদরীবুর রাবী, ২/৫৮৯; ফয়যুল কাদীর ৩/২৭৩

২২৭. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত নং ২৮

২২৮. শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০০১২; তাবারানী, আল-মুজামুস্ সগীর, হাদীছ নং ১০৭৪
হযরত উম্মু আয়মান রাযি.-এর সঙ্গে হযরত আবূ বকর রাযি. ও উমর রাযি.-এর সাক্ষাত করতে যাওয়া
হাদীছ নং : ৩৬০

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর হযরত আবূ বকর রাযি. উমর রাযি.কে বললেন, চলুন আমরা উম্মু আয়মানের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাই, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন। যখন তাঁরা তাঁর কাছে পৌঁছলেন, তিনি কেঁদে দিলেন। তাঁরা তাঁকে বললেন, আপনি কাঁদছেন কেন? আপনি জানেন না, আল্লাহর কাছে যা আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য তাই শ্রেয়? তিনি বললেন, আমি এজন্য কাঁদছি না যে, আল্লাহর কাছে যা আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য যে তাই শ্রেয়—তা আমার জানা নেই। বরং আমি কাঁদছি এজন্য যে, আসমান থেকে ওহী নাযিলের ধারা ছিন্ন হয়ে গেল। তিনি এ কথা বলে তাঁদেরও কান্না উথলে দিলেন। সুতরাং তাঁরাও তাঁর সঙ্গে কাঁদতে লাগলেন -মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪৫৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ১৬৩৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৭০২৭; মুসনাদে আবূ ইয়ালা, হাদীছ নং ৬৯, বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৩৫৩৬
مقدمة الامام النووي
45 - باب زيارة أهل الخير ومجالستهم وصحبتهم ومحبتهم وطلب زيارتهم والدعاء منهم وزيارة المواضع الفاضلة

قَالَ الله تَعَالَى: {وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِفَتَاهُ لا أَبْرَحُ حَتَّى أَبْلُغَ مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ أَوْ أَمْضِيَ حُقُبًا} إِلَى قوله تَعَالَى: {قَالَ لَهُ مُوسَى هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَى أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا} [الكهف: 60 - 66]، وَقالَ تَعَالَى: {وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ} [الكهف: 28].
360 - وعن أنس - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ أَبُو بكر لِعُمَرَ رضي الله عنهما بَعْدَ وَفَاةِ رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم: انْطَلِقْ بِنَا إِلَى أُمِّ أَيْمَنَ - رضي الله عنها - نَزُورُهَا كَمَا كَانَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يَزُورُهَا، فَلَمَّا انْتَهَيَا إِلَيْهَا، بَكَتْ، فَقَالاَ لَهَا: مَا يُبْكِيكِ؟ أمَا تَعْلَمِينَ أَنَّ مَا عِنْدَ اللهِ خَيْرٌ لرَسُولِ الله - صلى الله عليه وسلم؟ فَقَالَتْ: مَا أبْكِي أَنْ لاَ أَكُونَ أَعْلَم أنَّ مَا عِنْدَ الله تَعَالَى خَيْرٌ لرسول الله - صلى الله عليه وسلم - ولَكِنْ أَبكي أَنَّ الوَحْيَ قدِ انْقَطَعَ مِنَ السَّماءِ، فَهَيَّجَتْهُمَا عَلَى البُكَاءِ، فَجَعَلاَ يَبْكِيَانِ مَعَهَا. رواه مسلم. (1)