রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين

ভূমিকা অধ্যায় - এর পরিচ্ছেদসমূহ

মোট হাদীস ৬৭৯ টি

হাদীস নং: ২৪১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ মুসলিম ব্যক্তিবর্গের দোষত্রুটি গোপন রাখা প্রসঙ্গ এবং বিনা প্রয়োজনে তা প্রচার করার প্রতি নিষেধাজ্ঞা।
প্রকাশ্যে গুনাহ করা ও নিজ থেকে নিজের গুনাহ প্রকাশ করার ব্যাপারে সতর্কবাণী
হাদীছ নং : ২৪১

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, আমার উম্মতের প্রত্যেকেই ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে, কিন্তু প্রকাশ্যে গুনাহকারীগণ নয়। এটাও প্রকাশ্য গুনাহের অন্তর্ভুক্ত যে, কোনও ব্যক্তি রাতের বেলা কোনও (পাপের) কাজ করে তারপর এ অবস্থায় তার ভোর হয় যে, আল্লাহ তা'আলা তার কাজটি গোপন রাখেন, কিন্তু সে নিজেই বলে, হে অমুক! (শোন) আমি গতরাতে এই এই কাজ করেছি। অথচ সে রাত যাপন করেছিল এ অবস্থায় যে, তার প্রতিপালক তার দোষ আড়ালে রেখেছিলেন। আর সে সকালবেলা আল্লাহর আড়াল উন্মোচন করে দেয় -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৯০; বায়হাকী, আস্-সুনানুনল কুবরা, হাদীছ নং ১৭৫৯৯; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৯২২৫; তাবারানী, আল-মুজামুল আওসাত, হাদীছ নং ৪৪৯৮; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ৪৫৩)
مقدمة الامام النووي
28 - باب ستر عورات المسلمين والنهي عن إشاعتها لغير ضرورة
241 - وعنه، قَالَ: سمعت رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «كُلُّ أُمَّتِي مُعَافَى إلاَّ المُجَاهِرِينَ (1)، وَإنَّ مِنَ المُجَاهَرَةِ أَنْ يَعْمَلَ الرَّجُلُ بِاللَّيلِ عَمَلًا، ثُمَّ يُصْبحُ وَقَدْ سَتَرَهُ اللهُ عَلَيهِ، فَيقُولُ: يَا فُلانُ، عَمِلتُ البَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا، وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُهُ رَبُّهُ، وَيُصبحُ يَكْشِفُ ستْرَ اللهِ عَنْه». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2)
হাদীস নং: ২৪২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ মুসলিম ব্যক্তিবর্গের দোষত্রুটি গোপন রাখা প্রসঙ্গ এবং বিনা প্রয়োজনে তা প্রচার করার প্রতি নিষেধাজ্ঞা।
দাস-দাসী বারবার ব্যভিচার করলে
হাদীছ নং : ২৪২

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনও দাসী যিনা করলে এবং তার যিনা প্রমাণিত হলে তার উপর চাবুক মারার হদ কার্যকর করা হবে। কিন্তু তাকে ভর্ৎসনা করা যাবে না। সে দ্বিতীয়বার যিনা করলে তার উপর চাবুক মারার হদ কার্যকর করা হবে, কিন্তু তাকে ভর্ৎসনা করা যাবে না। তৃতীয়বার যিনা করলে তাকে বিক্রি করে দেবে, যদিও তা পশমের একটি রশির বিনিময়ে হয় -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২২৩৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৭০৩; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৪৭১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১০৪০৫; বায়হাকী, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭০৮৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীছ নং ৭৩৯০; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ১৩৫৯৯; বাগাবী, শারহুস্সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৫৮৮)
مقدمة الامام النووي
28 - باب ستر عورات المسلمين والنهي عن إشاعتها لغير ضرورة
242 - وعنه، عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «إِذَا زَنَتِ الأَمَةُ فَتَبيَّنَ زِنَاهَا فَلْيَجْلِدْهَا الحَدَّ، وَلاَ يُثَرِّبْ عَلَيْهَا، ثُمَّ إنْ زَنَتِ الثَّانِيَةَ فَلْيَجْلِدْهَا الحَدَّ، وَلا يُثَرِّبْ عَلَيْهَا، ثُمَّ إنْ زَنَتِ الثَّالِثَةَ فَلْيَبِعْهَا وَلَوْ بِحَبْل مِنْ شَعَر». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
«التثريب»: التوبيخ.
হাদীস নং: ২৪৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ মুসলিম ব্যক্তিবর্গের দোষত্রুটি গোপন রাখা প্রসঙ্গ এবং বিনা প্রয়োজনে তা প্রচার করার প্রতি নিষেধাজ্ঞা।
দণ্ডিতকে অভিশাপ দেওয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা
হাদীছ নং : ২৪৩

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তিকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে আসা হল। সে মদপান করেছিল । তিনি বললেন, তাকে মার। আবূ হুরায়রা রাযি. বলেন, আমাদের মধ্যে কেউ তাকে হাত দিয়ে মারছিল, কেউ জুতা দিয়ে মারছিল এবং কেউ মারছিল কাপড় দিয়ে। যখন সে ফিরে যাচ্ছিল তখন উপস্থিত লোকদের কেউ বলল, আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করুন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এরকম বলো না। তার বিরুদ্ধে শয়তানকে সাহায্য করো না -বুখারী।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৭৭৭; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৪৭৭; বায়হাকী, আস্- সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭৪৯৪; নাসাঈ, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৫২৬৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৯৮৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৫৭৩০; মুসনাদে আবূ ইয়ালা, হাদীছ নং ৫৯৮৪; বাগাবী, শারহুস্সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৬০৭)
مقدمة الامام النووي
28 - باب ستر عورات المسلمين والنهي عن إشاعتها لغير ضرورة
243 - وعنه، قَالَ: أُتِيَ النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - برجل قَدْ شَرِبَ خَمْرًا، قَالَ: «اضْربُوهُ»
قَالَ أَبُو هريرة: فَمِنَّا الضَّارِبُ بِيَدِهِ، والضَّارِبُ بِنَعْلِهِ، وَالضَّارِبُ بِثَوبِهِ. فَلَمَّا انْصَرَفَ، قَالَ بَعضُ القَومِ: أخْزَاكَ الله، قَالَ: «لا تَقُولُوا هكَذَا، لاَ تُعِينُوا عَلَيهِ الشَّيْطَانَ». رواه البخاري. (1)
হাদীস নং: ২৪৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ২৯

মুসলমানদের প্রয়োজন সমাধা করা

কুরআন-হাদীছের শিক্ষা অনুযায়ী এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। তাদের কর্তব্য ভাই-ভাই হিসেবে থাকা এবং ঐক্য ও সম্প্রীতির সঙ্গে সমাজবদ্ধ হয়ে চলা। মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই সামাজিক জীব। ইসলামও প্রকৃতিসম্মত দীন। তাই ইসলামী শিক্ষায় সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা এবং ঐক্য ও সম্প্রীতির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে মুসলিম সাধারণের অন্তরে ভ্রাতৃত্ববোধের উজ্জীবন অতি জরুরি। আল্লাহর কালাম ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ সে বোধ চেতনার জিয়নকাঠি। পেছনের অধ্যায়সমূহে আমরা তা লক্ষ করে এসেছি। সে শিক্ষারই একটা অঙ্গ মুসলিম-সাধারণের একের দ্বারা অন্যের প্রয়োজন সমাধার চেষ্টা। এক মুসলিম যখন অপর মুসলিমের ভাই আর সে হিসেবে তাদেরকে পারস্পরিক সম্প্রীতির সঙ্গে জীবনযাপন করতে হবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই এ দায়িত্ব-কর্তব্যও তাদের কাঁধে চেপে যায় যে, তারা একে অন্যের প্রয়োজন সমাধায় ঝাঁপিয়ে পড়বে।
দুনিয়ায় কারও পক্ষেই নিজের সব প্রয়োজন নিজে নিজে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। নিজের কোনও না কোনও প্রয়োজন পূরণে আমরা প্রত্যেকেই অন্যের কাছে ঠ্যাকা। কাজেই যে ব্যক্তি অন্যের প্রয়োজন পূরণে ভূমিকা রাখবে না, তার নিজ প্রয়োজনেও অন্যকে পাশে পাবে না। এর অনিবার্য পরিণতি সম্প্রীতি নষ্ট হওয়া, হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হওয়া ও জুলুম-নিপীড়নের বিস্তার ঘটা। সে পরিণতি যাতে দেখা দিতে না পারে, তাই ইসলাম একে অন্যের প্রয়োজন পূরণে ভূমিকা রাখার জোর তাগিদ করেছে। এটা যেমন পার্থিব জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলা ও ঐক্য-সম্প্রীতি রক্ষায় সহায়ক, তেমনি আখেরাতের নাজাত লাভেরও অনেক বড় অসিলা। এটা উচ্চপর্যায়ের এক নেক আমল। এর ফযীলতও অনেক বেশি। ইমাম নববী রহ. আলোচ্য অধ্যায়ে এ বিষয়ক কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।


‘মুসলমানদের প্রয়োজন সমাধা করা' সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত


এক নং আয়াত

وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

অর্থ : (হে মুমিনগণ! রুকূ কর, সিজদা কর, তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর) এবং সৎকর্ম কর, যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পার।১৮৬

ব্যাখ্যা : আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে রুকূ-সিজদা ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগীর আদেশদানের পর সাধারণভাবে সৎকর্ম করার হুকুম দিয়েছেন। তিনি বলেন- وَافْعَلُوا الْخَيْرَ (এবং সৎকর্ম কর)। الْخَيْرَ অর্থ ভালো, উৎকৃষ্ট, কল্যাণ, ন্যায়, অর্থ-সম্পদ ইত্যাদি এমনসব বিষয়, যার প্রতি সকলেই আগ্রহ বোধ করে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. এস্থলে এর অর্থ করেছেন আত্মীয়তা রক্ষা ও উন্নত চরিত্রপ্রসূত কাজ করা। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য ফরয ও অবশ্যপালনীয় কাজের বাইরেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অতিরিক্ত ইবাদত-বন্দেগী ও দান-খয়রাত করতে থাকা। যেমন আত্মীয়-স্বজনের হক আদায়ের পরও বাড়তি খোঁজখবর রাখা, তাদের প্রয়োজনীয় সেবা করা, মানুষের দুঃখ-কষ্টে পাশে দাঁড়ানো, দুস্থ ও আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকা ইত্যাদি। আয়াতটির শেষে বলা হয়েছে- لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পার)। সফলতা বলতে পার্থিব শান্তি-নিরাপত্তা ও আখেরাতের মুক্তি বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তোমরা যদি দুনিয়ায় শান্তি ও আখেরাতে মুক্তি পেতে চাও, তবে আল্লাহ তাআলা যেসকল ইবাদত-বন্দেগী ফরয করেছেন তা আদায়ে ক্ষান্ত না থেকে আপন আপন হিম্মত ও সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব বাড়তি আমলও কর। বিশেষত আল্লাহর পথে যতসম্ভব খরচ করতে থাক। অধীনস্থদের হক আদায়ের পর অতিরিক্ত যে অর্থ-সম্পদ থাকে, তা থেকে অকৃপণভাবে দান-খয়রাত করে যাও। তারপরও নিজ ফরয ও নফল আমলের উপর নির্ভর না করে আল্লাহর রহমতের আশাবাদী থাক। আশা রাখ যে, এসব আমলের অসিলায় আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি রহমত করবেন। তিনি নিজ দয়ায় তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতে দাখিল করবেন।

দুই নং আয়াত

وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ

অর্থ : 'আর তোমরা কল্যাণকর যে কাজই কর না কেন, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত।১৮৭

ব্যাখ্যা

এ আয়াতের শুরুতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, ইয়াতীম-মিসকীন ও অন্যান্য প্রয়োজনগ্রস্ত লোকদেরকে আপন সাধ্য অনুযায়ী অর্থসাহায্য করার নির্দেশনা দান করেছেন। তারপর এর প্রতি উৎসাহদানের লক্ষ্যে ইরশাদ করছেন- তোমরা কল্যাণকর যে কাজই কর না কেন, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত। এ কল্যাণকর কাজ দ্বারা বিশেষভাবে আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ খরচ করাও বোঝানো হতে পারে, যেহেতু অর্থ-সম্পদ ব্যয় প্রসঙ্গে এ কথাটি বলা হয়েছে। আবার ব্যাপক অর্থে এর দ্বারা যে-কোনও সৎকর্মই বোঝানো উদ্দেশ্য হতে পারে।
আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা হোক বা অন্য কোনও সৎকর্ম, আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য বান্দা যা-কিছুই করুক না কেন, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। অর্থাৎ বান্দার সে আমল বৃথা যাওয়ার নয়। আল্লাহ তার পূর্ণ প্রতিদান দান করবেন। যেন তিনি বলছেন, বান্দা তুমি যত পার দান-খয়রাত ও অন্যান্য নেক আমল করতে থাক, আমি তা নিষ্ফল যেতে দেব না, দুনিয়া ও আখেরাতে আমার ইচ্ছামত তার পুরস্কার তোমাদেরকে অবশ্যই দেব।
এ উভয় আয়াতে যে সৎকর্মের প্রতি উৎসাহ দান করা হয়েছে, মুসলিম সাধারণের প্রয়োজন সমাধা করাও তার একটি। সে হিসেবেই ইমাম নববী রহ. আয়াতদু'টি এ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।

১৮৬. সূরা হজ্জ (২২), আয়াত নং ৭৭

১৮৭. সূরা বাকারা (২), আয়াত নং ২১৫
মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধার ফযীলত
হাদীছ নং : ২৪৪

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না এবং তাকে (শত্রুর হাতে অসহায়ভাবে) পরিত্যাগ করবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধায় রত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের কোনও একটি বিপদ দূর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমকে গোপন রাখে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে গোপন রাখবেন -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৪৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৮০; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৮৯৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৪২৬; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২২৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৫৬৪৬; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১৫১২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭২০৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৫৩৩)
مقدمة الامام النووي
29 - باب قضاء حوائج المسلمين

قَالَ الله تَعَالَى: {وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ} [الحج: 77].
244 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما: أنَّ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «المُسْلِمُ أخُو المُسْلِمِ، لاَ يَظْلِمُهُ، وَلاَ يُسْلِمُهُ. مَنْ كَانَ في حَاجَةِ أخِيه، كَانَ اللهُ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً، فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ بِهَا كُرْبَةً مِنْ كرَبِ يَومِ القِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ يَومَ القِيَامَةِ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীস নং: ২৪৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ মুসলমানদের প্রয়োজন সমাধা করা।
মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করা, ইলম অন্বেষণ করা এবং সম্মিলিতভাবে কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত ও পঠন-পাঠনে মশগুল থাকার ফযীলত
হাদীছ নং : ২৪৫

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনও মুমিনের দুনিয়ার কষ্টসমূহ থেকে একটি কষ্ট দূর করে দেয়, আল্লাহ তার কিয়ামত দিবসের কষ্টসমূহ হতে একটি কষ্ট দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনও অভাবগ্রস্তের অর্থকষ্ট লাঘব করে দেয়, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার কষ্ট লাঘব করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের দোষ গোপন রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে লেগে থাকে, আল্লাহ ততক্ষণ তার সাহায্য করতে থাকেন। যে ব্যক্তি ইলমের সন্ধানে কোনও পথে চলে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতগামী পথ সুগম করে দেন। কোনও লোকসমষ্টি আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোনও একটি ঘরে একত্র হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত এবং নিজেদের মধ্যে তার পঠন-পাঠনে মশগুল থাকলে তাদের উপর সাকীনা নাযিল হয়, রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়, ফিরিশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখেন এবং আল্লাহ তাঁর কাছে উপস্থিত (ফিরিশতা)-দের মধ্যে তাদের উল্লেখ করেন। যাকে তার আমল পিছিয়ে দেয়, তাকে তার বংশমর্যাদা এগিয়ে দিতে পারে না -মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৯৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৯৪৫; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৭৩৭; আল-মাদখাল ইলা সুনানিল কুবরা, হাদীছ নং ৩৪৬; আল-আদাব : ৯২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ২২৫; বাগাবী, শারহুস্সুন্নাহ, হাদীছ নং ১২৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৪২৭
مقدمة الامام النووي
29 - باب قضاء حوائج المسلمين
245 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنيَا، نَفَّسَ اللهُ عَنْهُ كُربَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ القِيَامَةِ، وَمَنْ يَسَّر عَلَى مُعْسِرٍ يَسَّرَ الله عَلَيهِ في الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ الله في الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ، واللهُ في عَونِ العَبْدِ مَا كَانَ العَبْدُ في عَونِ أَخِيهِ، وَمَنْ سَلَكَ طَريقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ طَريقًا إِلَى الجَنَّةِ. وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ في بَيت مِنْ بُيُوتِ اللهِ تَعَالَى، يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ، وَغَشِيتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَحَفَّتْهُمُ المَلاَئِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ الله فِيمَنْ عِندَهُ. وَمَنْ بَطَّأ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِع بِهِ نَسَبُهُ (1)». رواه مسلم (2).
হাদীস নং: ২৪৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৩০

সুপারিশ করার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য

শাফাআত (الشفاعة) অর্থ সুপারিশ করা। কারও কোনও হাজত নিজে পূরণ করতে না পারলে যে ব্যক্তি তা পূরণ করতে পারে, তাকে তা পূরণ করে দেওয়ার অনুরোধ জানানোকে শাফাআত বা সুপারিশ বলে। সুপারিশ করা একটি মহৎ কাজ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এটা করতেন। তিনি এটা আখেরাতেও করবেন। আখেরাতে সবচে' বড় সুপারিশ তাঁর জন্যই সংরক্ষিত। হাশরের ময়দানে সমস্ত মানুষ আল্লাহর পক্ষ থেকে বিচারকার্য শুরুর অপেক্ষা করতে করতে যখন অতিষ্ঠ হয়ে যাবে, তখন তারা একের পর এক নবী-রাসূলকে সুপারিশের জন্য ধরবেন। কেউ বাদ যাবে না। সবশেষে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাজি হবেন এবং আরশের তলে সিজদায় পড়ে যাবেন। আল্লাহ তাআলা বলবেন إرفع رأسك وسل تعطه، وقل يسمع واشفع تشفع “হে মুহাম্মাদ! মাথা তোল। চাও, দেওয়া হবে। বল, শোনা হবে এবং সুপারিশ কর, সুপারিশ গৃহীত হবে।২০৪
তিনি শাফী'উল মুযনিবীন- গুনাহগারদের সুপারিশকারী। তাঁর সুপারিশ হবে আল্লাহ তাআলার দরবারে। আল্লাহ তাআলা বেনিয়ায। তিনি সুপারিশ ছাড়াই সবকিছু করার ক্ষমতা রাখেন। তা সত্ত্বেও যখন তাঁর সমীপে তাঁকে সুপারিশ করতে বলা হচ্ছে, তখন মানুষের কাছে সুপারিশ করাটা যে একটি মহৎ কাজ হবে তা স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়।
অনেক কাজ এমন আছে, যা মানুষ এমনিতে করে না বা করতে চায়ই না, কিন্তু যখন আকর্ষণীয়ভাবে সুপারিশ করা যায়, তখন তার মন নরম হয় এবং কাজটি করতে সে প্রস্তুত হয়ে যায়। বাস্তবে তা করেও ফেলে। যদি সুপারিশ করা না হত, তবে সে তা করত না। আর কাজটি না হওয়ায় যার সেটি প্রয়োজন ছিল, সে সংকটেই পড়ে থাকত। অনেক সময় সে প্রয়োজন এত কঠিন হয়ে থাকে যে, তা না মিটলে জীবন অচল হয়ে যায়। এটা শরীআতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। মানুষকে কোনও দুর্মোচনীয় সংকটে ফেলে রাখা শরীআতের কাম্য নয়। সেজন্যই সুপারিশের ব্যবস্থা।
সুপারিশ করা একটি ফযীলতপূর্ণ কাজ। এতে অনেক ছাওয়াব পাওয়া যায়। সরাসরি নিজে কারও সংকট মোচন করার দ্বারা যে ছাওয়াব পাওয়া যায়, সেরকম ছাওয়াব সুপারিশ দ্বারাও লাভ হয়। অর্থাৎ নিজের পক্ষে কারও সংকট মোচন করা সম্ভব না হলে যার তা মোচনের সামর্থ্য আছে, তার কাছে সে ব্যাপারে সুপারিশ করলেও সমপরিমাণ ছাওয়াবের আশা থাকে।
প্রকাশ থাকে যে, সুপারিশ করা নেককাজরূপে গণ্য হয় কেবল তখনই, যখন তা করা হয় কোনও বৈধ বিষয়ে। অবৈধ বিষয়ে সুপারিশ করা জায়েয নয়। ছাওয়াবের তো প্রশ্নই আসে না। কাজেই কাউকে কোনও অবৈধ সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা যাবে না। শরীআত যে কাজের অনুমোদন করে না, যেমন যাত্রা, থিয়েটার, সঙ্গীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, ক্যাসিনো বা এ জাতীয় কোনও জুয়ার আসর ইত্যাদি, সুপারিশ করে কারও পক্ষে এসব ব্যাপারে সরকারি অনুমোদন লাভ করিয়ে দেওয়া যাবে না।
ছাওয়াব পাওয়ার জন্য সুপারিশকে সুপারিশের পর্যায়ে রাখাও জরুরি। অর্থাৎ যার কাছে সুপারিশ করা হবে তাকে তা মানতে বাধ্য করা যাবে না। নিজ ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির চাপ থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হবে। কেননা সুপারিশ রক্ষা করা শরীআতের বাধ্যতামূলক বিধান নয়। শরীআত যা বাধ্যতামূলক করেনি তাকে বাধ্যতামূলক বানানো একরকম সীমালঙ্ঘন। সুপারিশ করতে গিয়ে সীমালঙ্ঘনে লিপ্ত হলে ছাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হওয়ারই আশঙ্কা। সুতরাং সুপারিশ করার সময় সুপারিশকারীর কর্তব্য এ বিষয়টাও মাথায় রাখা।
সুপারিশের ছাওয়াব পাওয়ার জন্য এটাও শর্ত যে, তা করতে হবে কেবলই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে, দুনিয়াবী কোনও স্বার্থে নয়। কাজেই সুপারিশের বিনিময়ে কোনওরকম উৎকোচ গ্রহণ করা যাবে না, তা আর্থিকরূপে হোক বা অন্য কোনও সুযোগ-সুবিধা আকারে। সুপারিশ করার পরও ইখলাস ও সহীহ নিয়ত রক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ যার পক্ষে সুপারিশ করা হল তার কাছ থেকে অপ্রীতিকর কোনও আচরণ পাওয়া গেলেও সুপারিশের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাকে খোঁটা দেওয়া চলবে না।
(২০৪. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৪৭৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৯৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪৩৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪৩১২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬৪৬৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮৫১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩০৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৩৩২)

‘সুপারিশ করার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য’ সম্পর্কিত একটি আয়াত

مَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً يَكُنْ لَهُ نَصِيبٌ مِنْهَا

অর্থ : 'যে ব্যক্তি কোনও ভালো সুপারিশ করে, তার তাতে অংশ থাকে।২০৫

ব্যাখ্যা

ভালো সুপারিশ করার অর্থ যে বিষয়ে সুপারিশ করা হয় সেটি শরীআতসম্মত হওয়া এবং যে পন্থায় সুপারিশ করা হয় তাও বিধিসম্মত হওয়া। যে সুপারিশের মধ্যে এ উভয় শর্ত রক্ষা করা হয়, সেটি ভালো সুপারিশ আর এরূপ সুপারিশ দ্বারা পুণ্য লাভ হয়। ‘তাতে অংশ থাকে বলে পুণ্যলাভই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যার কাছে সুপারিশ করা হয় সে সুপারিশ রক্ষা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাজটি করে দিলে যে ছাওয়াব পাবে, অনুরূপ ছাওয়াব সুপারিশকারীর আমলনামায়ও লেখা হবে।
প্রকাশ থাকে যে, সুপারিশের ছাওয়াব সুপারিশ করুলের উপর নির্ভরশীল নয়। যার কাছে সুপারিশ করা হয় সে সুপারিশ মঞ্জুর না করলেও সুপারিশকারী ছাওয়াব পেয়ে যাবে। কবুল না করার কারণে সেই ব্যক্তি ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকবে। কিন্তু সুপারিশ করা যেহেতু একটি নেক আমল আর সে যেহেতু তা করেছে, তাই সে অবশ্যই ছাওয়াব পাবে।
যার কাছে সুপারিশ করা হয়, সুপারিশ কবুল না করার কারণে সেও ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকবে কেবল তখনই, যখন কবুল করাটাই সমীচীন হয়। পক্ষান্তরে সে যদি মনে করে তা কবুল করাটা সমীচীন নয় আর সে কারণে আল্লাহর সন্তুষ্টি সামনে রেখেই সে তা কবুল করা থেকে বিরত থাকে, তবে এ বিরত থাকার দ্বারাও ছাওয়াবের আশা রয়েছে।
আয়াতে যে 'ভালো সুপারিশ বলা হয়েছে, এর দ্বারা বোঝা যায় কোনও কোনও সুপারিশ মন্দও হতে পারে। আলোচ্য আয়াতেই শেষে ইরশাদ হয়েছে-

وَمَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً سَيِّئَةً يَكُنْ لَهُ كِفْلٌ مِنْهَا

‘আর যে ব্যক্তি কোনও মন্দ সুপারিশ করে, তারও তাতে অংশ থাকে।২০৬

অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোনও নাজায়েয কাজে কিংবা বৈধ কাজেই নাজায়েয পন্থায় সুপারিশ করে সে গুনাহগার হয়। সে এজন্য আখেরাতে শাস্তির সম্মুখীন হবে। তাই সুপারিশকারীর কর্তব্য কোন্ বিষয়ে সুপারিশ করা হচ্ছে সেদিকে লক্ষ রাখা, যাতে কোনও অবৈধ বিষয়ে সুপারিশ না হয়ে যায়। এমনিভাবে এদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি যে, যে পন্থায় সুপারিশ করা হয় তা যেন বৈধ হয়। অন্যথায় বিষয়টি বৈধ হওয়া সত্ত্বেও সুপারিশের পন্থা অবৈধ হওয়ার কারণে ছাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হয়ে যাবে। তাই তো আল্লাহ তাআলা এই বলে আয়াতের উপসংহার টানছেন যে-

وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقِيتًا

‘আর আল্লাহ সব বিষয়ে নজর রাখেন।'

مُقِيتًا শব্দটির এক অর্থ সতর্ক দৃষ্টিদানকারী বা তত্ত্বাবধায়ক। আরেক অর্থ ক্ষমতাবান। এর তৃতীয় অর্থ হচ্ছে রিযিকদাতা।
প্রথম অর্থ হিসেবে এ বাক্যটির ব্যাখ্যা এরকম যে, তিনি দেখেন তোমরা বৈধ কাজে সুপারিশ কর না অবৈধ কাজে। তিনি এটাও দেখেন যে, তোমরা সুপারিশের ক্ষেত্রে বৈধ পন্থা অবলম্বন কর না অবৈধ পন্থা। এমনিভাবে ছাওয়াবের আশায় তোমরা ভালো সুপারিশ কর নাকি সুপারিশ করা হতে গা বাঁচিয়ে রাখ, তাও তিনি লক্ষ করেন। তিনি এসব লক্ষ করেন কাজ অনুযায়ী তোমাদের প্রতিদান দেওয়ার জন্য। সুতরাং তিনি সে হিসেবে তোমাদের প্রতিদান দান করবেন।
দ্বিতীয় অর্থ হিসেবে এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, তিনি তোমাদেরকে তোমাদের সুপারিশের ধরন অনুযায়ী প্রতিদান দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। কাজেই সুপারিশ ভালো হলে তিনি ভালো প্রতিদান দেবেন এবং সুপারিশ মন্দ হলে সেজন্য মন্দ প্রতিদান তথা শাস্তিদান করবেন। সুতরাং তোমাদের কর্তব্য সুপারিশ করার আগ্রহও রাখা, সেইসঙ্গে পূর্ণ সতর্কতাও অবলম্বন করা।
তৃতীয় অর্থ অনুযায়ী ব্যাখ্যা হবে এরকম- আল্লাহ তাআলাই যেহেতু তোমাদের একমাত্র রিযিকদাতা, সেহেতু তিনি তোমাদের যার জন্য যে পরিমাণ রিযিক নির্দিষ্ট করেছেন সে তা পাবেই। কারও সুপারিশ করার দ্বারা তাতে কিছুমাত্র কমবেশি হবে না। কারও সুপারিশ তিনি মানতে বাধ্য নন যে, সে অনুযায়ী তাঁর নির্ধারণের কোনও নড়চড় হবে। তা সত্ত্বেও তিনি সুপারিশের হুকুম দিয়েছেন কেবল তোমাদেরই স্বার্থে। সুপারিশ দ্বারা তাঁর সিদ্ধান্তের নড়চড় না হোক, কিন্তু তোমরা ছাওয়াব পেয়ে যাবে। কাজেই সে উদ্দেশ্যেই তোমরা এ কাজটি করবে।

২০৫. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৮৫

২০৬. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৮৫
সুপারিশের জন্য ছাওয়াবের ওয়াদা
হাদীছ নং : ২৪৬

হযরত আবূ মূসা আশআরী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কোনও হাজত পূরণের আকাঙ্ক্ষী আসলে তিনি উপস্থিত লোকদের লক্ষ্য করে বলতেন, সুপারিশ করো, প্রতিদান পাবে। আল্লাহ যা পসন্দ করেন, তাঁর নবীর জবানিতে তারই ফয়সালা করবেন -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৪৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬২৭; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৫৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯৫৮৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৩১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৬৬৭৯
مقدمة الامام النووي
30 - باب الشفاعة

قَالَ الله تَعَالَى: {مَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً يَكُنْ لَهُ نَصِيبٌ مِنْهَا} [النساء: 85].
246 - وعن أَبي موسى الأشعري - رضي الله عنه - قَالَ: كَانَ النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - إِذَا أتاهُ طَالِبُ حَاجَةٍ أقبَلَ عَلَى جُلَسَائِهِ، فَقَالَ: «اشْفَعُوا تُؤْجَرُوا، وَيَقْضِي الله عَلَى لِسَانِ نَبِيِّهِ مَا أحَبَّ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
وفي رواية: «مَا شَاءَ».
হাদীস নং: ২৪৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ সুপারিশ করার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য।
হযরত বারীরা রাযি.-এর ঘটনা
হাদীছ নং : ২৪৭

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বারীরা ও তার স্বামীর ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে (বারীরাকে) বললেন, তুমি যদি তাকে (তোমার স্বামীকে) পুনরায় গ্রহণ করতে? বারীরা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি আমাকে হুকুম করছেন? তিনি বললেন, আমি কেবল সুপারিশই করছি। বারীরা বললেন, তাকে আমার প্রয়োজন নেই -বুখারী।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫২৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৮৪৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২০৭৫; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৪২৬৮; সুনানে দারা কুতনী, হাদীছ নং ২১৪০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২২৯৯
مقدمة الامام النووي
30 - باب الشفاعة
247 - وعن ابن عباس رضي الله عنهما في قِصَّةِ برِيرَةَ وَزَوْجِهَا، قَالَ: قَالَ لَهَا النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم: «لَوْ رَاجَعْتِهِ؟» قَالَتْ: يَا رَسُولَ اللهِ تَأمُرُنِي؟ قَالَ: «إنَّمَا أَشْفَع» قَالَتْ: لاَ حَاجَةَ لِي فِيهِ. رواه البخاري. (1)
হাদীস নং: ২৪৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়: ৩১

মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার গুরুত্ব ও ফযীলত

আমাদের এ দীনে মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। ইসলামী শরীআতের যাবতীয় বিধানেও সমাজবদ্ধতার বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ রাখা হয়েছে। এমন কোনও বিধান দেওয়া হয়নি, যা দ্বারা মানুষের সমাজবদ্ধতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বরং ইসলামী বিধি-বিধান পরিপূর্ণভাবে মেনে চললে মানবসমাজ আরও বেশি সুসংগঠিত ও শান্তিপূর্ণ হয়। আবার সমাজ যতবেশি সম্প্রীতিপূর্ণ হয়, ততই সকলের পক্ষে দীন ও শরীআত মেনে চলাও বেশি সহজসাধ্য হয়। যাতে করে মানুষের দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই সাফল্যমণ্ডিত হয়। বোঝা যাচ্ছে সমাজের সদস্যগণের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দীন ও দুনিয়া উভয় বিচারেই জরুরি। যদি দুই ব্যক্তির মধ্যে কলহ দেখা দেয়, তবে সে কলহ দ্বারা কেবল সে দুজনই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না; ক্রমান্বয়ে গোটা সমাজই ক্ষতির শিকার হয়ে যায়। দুই ব্যক্তির কলহের পরিণামে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দুনিয়া ও আখেরাত বরবাদ যাওয়ার উপক্রম হয়। কাজেই কলহ দেখা দেওয়ামাত্র তা মিটমাট করে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া একান্ত জরুরি। এটা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজও বটে। কুরআন ও হাদীছ আমাদেরকে এ কাজের প্রতি বিপুল উৎসাহ দান করেছে। এটা করার জন্য জোর তাগিদও দিয়েছে। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করেছেন। আমরা নিছে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলাই তাউফীকদাতা।

মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া

সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত

لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ

অর্থ : 'মানুষের বহু গোপন কথায় কোনও কল্যাণ নেই। তবে কোনও ব্যক্তি দান- সদাকা বা কোনও সৎকাজের কিংবা মানুষের মধ্যে মীমাংসার আদেশ করলে, সেটা ভিন্ন কথা।২০৯

ব্যাখ্যা

এ আয়াতের দুটি অংশ। প্রথম অংশে বহু গোপন কথা সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, তাতে কোনও কল্যাণ নেই। এর দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কোনও কোনও গোপন কথা ব্যতিক্রম। তার মধ্যে কল্যাণ আছে। সে কথাই আয়াতের পরের অংশে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে- إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ (তবে কোনও ব্যক্তি দান-সদাকা বা কোনও সৎকাজের কিংবা মানুষের মধ্যে মীমাংসার আদেশ করলে সেটা ভিন্ন কথা)। এখানে তিনটি বিষয়কে ব্যতিক্রম সাব্যস্ত করা হয়েছে। তা হচ্ছে দান-সদাকার আদেশ করা, সৎকাজের আদেশ করা ও মীমাংসার আদেশ করা। এগুলো প্রকাশ্যেও করা যায়। তবে অনেক সময় পরিবেশ-পরিস্থিতি প্রকাশ্যে করার অনুকূল হয় না। তখন গোপনে করাই সমীচীন।
দান-খয়রাত করা একটি বড় নেক আমল। সাধারণত এ কাজ গোপনে করা উত্তম। প্রকাশ্যে দান-খয়রাত করার দ্বারা যেমন অন্তরে রিয়া ও মানুষকে দেখানোর মানসিকতা পয়দা হয়, তেমনি যাকে দেওয়া হয় তার জন্যও তা অমর্যাদাকর হয়। গোপনে দান করলে এ উভয়দিকই রক্ষা হয়। এমনিভাবে কাউকে এ কাজে উৎসাহিত করাটাও সাধারণত গোপনেই ভালো। প্রকাশ্যে করার দ্বারা তার আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগতে পারে। তাছাড়া ব্যক্তিবিশেষকে অর্থসাহায্যের পরামর্শ দিলে সে ব্যক্তির একরকম অসম্মান হয় । তাই গোপনীয়তাই বাঞ্ছনীয়।
দ্বিতীয়ত সৎকাজের আদেশকেও ব্যতিক্রম বলা হয়েছে। অর্থাৎ এটাও গোপনে করা কল্যাণকর। আয়াতে যে مَعْرُوفٍ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, এর দ্বারা এমন যে- কোনও কাজ বোঝানো হয়, যা শরীআতে পসন্দনীয় এবং যা পসন্দনীয় কাজ হিসেবে সুপরিচিত। এর বিপরীত শব্দ হল منكر (মুনকার)। মুনকার বলা হয় এমনসব কাজকে, যা শরীআতে অপসন্দনীয় এবং উম্মতের কাছেও অপরিচিত ও আপত্তিকর।
যাহোক সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার কাজটিও সাধারণত গোপনেই ভালো। গোপনে করার দ্বারাই সংশোধনের আশা বেশি থাকে। এ কাজ প্রকাশ্যে করার দ্বারা অনেক সময় অন্তরে জিদ দেখা দেয়। ফলে সৎকাজ পরিত্যাগে আগের চেয়ে আরও বেশি গোঁ ধরে বসে এবং অসৎকাজেও অধিকতর স্পর্ধিত হয়। তাছাড়া প্রকাশ্যে নিষেধ করার দ্বারা অন্যায়-অপরাধের একরকম প্রচারণাও হয়ে যায়। তাই এর থেকে বিরত থাকা উচিত। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে প্রকাশ্যেও করতে হয়। গোপনে অনেক বোঝানো সত্ত্বেও যখন সংশোধন হয় না, একাধারে সৎকাজ পরিত্যাগ করতেই থাকে, অসৎকাজও ছাড়ার কোনও লক্ষণ দেখা যায় না, তখন প্রকাশ্যেই আদেশ-উপদেশ দেওয়ার পালা এসে যায়।
এ আয়াতে যে তিনটি ব্যতিক্রম বিষয়ের কথা বলা হয়েছে, তার তৃতীয় হচ্ছে মানুষের মধ্যে ইসলাহ তথা আপস-রফা ও মীমাংসা করে দেওয়া। অর্থাৎ দুই ভাই, দুই আত্মীয়, দুই প্রতিবেশী, দুই বন্ধু, স্বামী-স্ত্রী এবং এরকম যে-কোনও দুই পক্ষের মধ্যে মনোমালিন্য বা ঝগড়া-ফাসাদ দেখা দিলে অন্যদের কর্তব্য তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া এবং চেষ্টা করা যাতে তারা ফের আগের মতই মিল-মহব্বতের সঙ্গে দিন কাটায়। এটা অনেক বড় ফযীলতের কাজ। ইনশাআল্লাহ সামনে আমরা এ ফযীলত জানতে পারব
লক্ষণীয় যে, দান-সদাকা ও ইসলাহের কাজটি যদিও সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের অন্তর্ভুক্ত, তারপরও এ দু'টিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা এ দু'টির বিশেষ গুরুত্ব বোঝা যায়। বাস্তবিকই এ দু'টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেননা একটি শান্তিপূর্ণ ও উৎকৃষ্ট সমাজগঠনে দান-সদাকা ও ইসলাহী কার্যক্রম গভীর ভূমিকা রাখে।
সমাজগঠনের জন্য মৌলিকভাবে দু'টি কাজ প্রয়োজন। এক প্রয়োজন মানুষকে যাবতীয় ক্ষতি থেকে রক্ষা করা, দ্বিতীয় প্রয়োজন তাদেরকে তাদের কল্যাণকর বিষয়াবলী সরবরাহ করা।
মানুষের কল্যাণসাধনের পক্ষে দান-খয়রাত এক উত্তম ব্যবস্থা। যথাযথভাবে যাকাত ও অবশ্যপ্রদেয় অর্থ (যেমন ফিত্রা, কাফ্ফারা, মানত ইত্যাদি) বিতরণ করা এবং আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী নফল দান-খয়রাত করার দ্বারা সমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়ে থাকে। এর দ্বারা মানুষের দীনী ও দুনিয়াবী নানা প্রয়োজন সমাধা হয়। আর এর মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতিও প্রতিষ্ঠিত হয়।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ দ্বারা ব্যক্তি ও সমাজকে যাবতীয় ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যায়। এ কাজ বন্ধ থাকলে বহুমুখী অনিষ্ট ও অন্যায়-অনাচারের ক্রমবিস্তার ঘটে। একপর্যায়ে গোটা সমাজ অশান্তির অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায় । বর্তমান বিশ্ব যে সর্বগ্রাসী অন্যায়-অনাচারের বিষবাষ্পে খাবি খাচ্ছে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্ব পালনে চরম শৈথিল্যই কি এর জন্য মূল দায়ী নয়?
এ আয়াতের শিক্ষা এটাই যে, আমরা কথাবার্তা বলব হুঁশিয়ারীর সঙ্গে। কোনওক্রমেহ যাতে আমাদের কথা আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের পক্ষে অকল্যাণকর না হয়, সেদিকে লক্ষ করেই যা বলার বলব। অন্যথায় প্রকাশ্য-গোপন সব কথাই আমাদের দুনিয়া ও আখেরাত বরবাদির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু হাবীবা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

كُلُّ كَلَام ابْنِ آدَمَ عَلَيْهِ لَا لَهُ إِلَّا أَمْرٌ بِمَعْرُوفٍ أَوْ نَهْي عَنْ مُنْكَرٍ أَوْ ذِكْرُ اللَّهِ

‘আদমসন্তানের সব কথাই তার জন্য ক্ষতিকর, কল্যাণকর নয়। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজে নিষেধ ও আল্লাহর যিকর।২১০

দুই নং আয়াত

وَالصُّلْحُ خَيْرٌ

অর্থ : ‘আর আপস-নিষ্পত্তিই উত্তম।২১১

ব্যাখ্যা
এ আয়াতাংশ মূলত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার অসদ্ভাব নিরসন-সম্পর্কিত। আয়াতে এর আগে আছে-

وَإِنِ امْرَأَةٌ خَافَتْ مِنْ بَعْلِهَا نُشُوزًا أَوْ إِعْرَاضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلْحًا
‘কোনও নারী যদি তার স্বামীর পক্ষ হতে দুর্ব্যবহার বা উপেক্ষার আশঙ্কা করে, তবে তাদের জন্য এতে কোনও অসুবিধা নেই যে, তারা পারস্পরিক সম্মতিক্রমে কোনও রকমের আপস-নিষ্পত্তি করবে।'
এতে স্বামী-স্ত্রীকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যে, তাদের উভয়পক্ষ বা কোনও একপক্ষ আপন অধিকারে ছাড় দিয়ে হলেও যেন আপস-নিষ্পত্তি করে নেয়। কোনও প্রকার ছাড় দিতে প্রস্তুত না হলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। নিরন্তর ঝগড়া- ফাসাদের সাথে কতদিন একসঙ্গে থাকা যায়? পরিণাম দাঁড়ায় বিবাহবিচ্ছেদ। বিবাহবিচ্ছেদ সর্বশেষ ব্যবস্থা। যতদিন এটি এড়ানো যায়, এড়ানোই উচিত। কেননা সাধারণভাবে এটা উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকর, বিশেষত যদি ছেলেমেয়ে থাকে। কাজেই সে ক্ষতিকর পর্যায়ে যাতে উপনীত হতে না হয়, সে লক্ষ্যে ছাড় দিয়ে হলেও আপস- রক্ষা করা চাই। সে কথাই আয়াতের এ অংশে বলা হয়েছে যে- وَالصُّلْحُ خَيْرٌ (আর আপস-নিষ্পত্তিই উত্তম)।
যদিও আয়াতটি স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কিত, কিন্তু সাধারণ শব্দে বলা হয়েছে- আপস- নিষ্পত্তিই উত্তম। ফলে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া-ফাসাদ যেমন এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, তেমনি পারিবারিক ও সামাজিক যে-কোনওরকম দ্বন্দ্ব-কলহ এর মধ্যে এসে যায়। কাজেই যে- কোনও দ্বন্দ্ব-কলহে জিদ্ ও হঠকারিতার পন্থা অবলম্বন না করে সকল পক্ষের উচিত সন্ধিতে আসা ও আপস নিষ্পত্তির পথে অগ্রসর হওয়া। আল্লাহ তাআলা সেটিকেই উত্তম বলেছেন। দ্বন্দ্ব-কলহ কোনও কল্যাণ বয়ে আনে না। তা যত দীর্ঘস্থায়ী হয়, ক্ষতিও তত বেশিই হয়। সে ক্ষতি থেকে বাঁচার লক্ষ্যে আপস-নিষ্পত্তির পন্থাই অবলম্বন করা চাই। তবে সন্ধিস্থাপন ও আপস-নিষ্পত্তিতে শরীআতের নির্দিষ্ট মূলনীতিও আছে। সে মূলনীতি রক্ষা করেই তা সম্পাদন করতে হবে। এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে—

الصُّلْحُ جَائِزٌ بَيْنَ الْمُسْلِمِينَ إِلَّا صُلْحًا أَحَلَّ حَرَامًا ، أَوْ حَرَّمَ حَلَالًا

‘মুসলিমদের মধ্যে সন্ধিস্থাপন জায়েয, তবে ওই সন্ধি নয়, যা হারামকে হালাল করে বা হালালকে হারাম করে।২১২

অন্য এক হাদীছে ইরশাদ-

الْمُسْلِمُونَ عَلَى شُرُوطِهِمْ فِيْمَا وَافَقَ الْحَقَّ

‘মুসলিমদের পারস্পরিক (সন্ধি ও আপস-নিষ্পত্তিতে আরোপিত) সব শর্তই অবশ্যপালনীয়, যখন তা ন্যায়ানুগ (অর্থাৎ শরীআতসম্মত) হয়।২১৩
বোঝা গেল সন্ধিতে কোনও শরীআতবিরোধী শর্ত আরোপ করা হলে সে শর্ত রক্ষা করা জরুরি নয়; বরং তা রক্ষা করা জায়েযই নয়। যেমন, বিবদমান দুই পক্ষের এক পক্ষ বিবাদ মিটিয়ে ফেলার জন্য এই শর্ত দিল যে, আমি তোমার সঙ্গে মিলতে রাজি আছি, যদি তুমি তোমার অমুক আত্মীয়কে ত্যাগ কর। এমনিভাবে স্বামী-স্ত্রীর কলহ মিটমাটের জন্য স্বামী শর্ত দিল- আমি তোমাকে নিয়ে ঘর-সংসার করতে রাজি আছি, যদি তুমি পর্দাপুশিদা পরিত্যাগ কর, কিংবা স্ত্রী শর্ত দিল- আমি তোমার ঘর করতে রাজি আছি, যদি তুমি আমাকে আমার ইচ্ছামত ঘোরাফেরা করতে দাও; চাইলে আমি পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণও করব। এসবই অবৈধ শর্ত। এসব শর্ত মানা জায়েয নয়। যদি এসব শর্তের ভিত্তিতে মীমাংসা হয়ে যায়, তবে পরে এ শর্ত রক্ষা করাও জায়েয নয়।

তিন নং আয়াত

فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ

অর্থ : 'সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক শুধরে নাও।২১৪

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে আদেশ করা হয়েছে যে, মুসলিমদের মধ্যে যদি কোনও বিষয়ে মনোমালিন্য দেখা দেয়, তবে তা দূর করে পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক করে নেওয়া চাই। কেননা পারস্পরিক মনোমালিন্য দেখা দিলে যদি তা যথাশীঘ্র মিটমাট করা না হয়, তবে তা বহুদূর পর্যন্ত গড়ায়। দুই ব্যক্তির মধ্যকার কলহ দুই পরিবারকেও স্পর্শ করে। এমনকি অনেক সময় তা পাড়ায় পাড়ায় দাঙ্গা সংঘর্ষেরও পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সে পর্যায়ে পৌঁছার আগেই পরস্পরের মধ্যে মিটমাট করে নেওয়া চাই। নিজেরা তা করতে না পারলে অন্যদের কর্তব্য তাতে ভূমিকা রাখা। এটা অনেক বড় ছাওয়াবেরও কাজ। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَلَا أُخبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصَّيَامِ وَالصَّلاةِ وَالصَّدَقَةِ؟ قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ الله! قَالَ: إِصْلَاحُ ذَاتِ الْبَيْنِ، وَفَسَادُ ذَاتِ الْبَيْنِ الْحَالِقَة

‘আমি কি তোমাদেরকে এমন আমল সম্পর্কে অবহিত করব না, যা রোযা, নামায ও সদাকা অপেক্ষাও উত্তম? সাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি বললেন, তা হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে সন্ধি-মীমাংসা করে দেওয়া। কেননা পারস্পরিক অমিল-অশান্তি ধ্বংসকর।২১৫
পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়াকে ধ্বংসকর বলা হয়েছে এ কারণে যে, এর ফলে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি হয়ে যায়। তখন একে অন্যের ক্ষতি করার জন্য নানারকম অবৈধ কাজকর্ম করা হয়- মিথ্যা কথা বলা হয়, গীবত করা হয়, অপবাদ দেওয়া হয়, জান-মালের ক্ষতিসাধনের জন্য বিভিন্ন অবৈধ পন্থা অবলম্বন করা হয়। এমনকি নামায-রোযা পর্যন্ত নষ্ট করা হয়। এভাবে পারস্পরিক কলহ-বিবাদ মানুষের দুনিয়া ও আখেরাত সবই বরবাদ যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরস্পরের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার দ্বারা যেহেতু উভয়পক্ষকে সে পরিণতি থেকে রক্ষা করা যায়, তাই এটা নফল ইবাদত-বন্দেগী অপেক্ষাও বেশি ফযীলতের কাজ।

চার নং আয়াত

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ

অর্থ : ‘প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।২১৬

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে মুমিনদের পরস্পরের মধ্যে কলহ দেখা দিলে তা মিটমাট করে দেওয়ার আদেশ করা হয়েছে। সে আদেশের পূর্বে বলা হয়েছে মুমিনগণ ভাই-ভাই। অর্থাৎ ভ্রাতৃত্বের দাবি হল মিলেমিশে থাকা ও কলহ-বিবাদে লিপ্ত না হওয়া। দুর্ঘটনাক্রমে কখনও কলহ দেখা দিলে যথাশীঘ্র মিলেমিশে যাওয়া চাই। মিলেমিশে যাওয়ার চেষ্টা প্রথমত তাদেরই করা উচিত, যাদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হয়েছে। যদি তাদের মধ্যে সে উদ্যোগ পরিলক্ষিত না হয়, তবে অন্যদের এগিয়ে আসা উচিত। কেননা যে দুই ব্যক্তির মধ্যে কলহ দেখা দিয়েছে তারা তাদের ভাই। দুই ভাইয়ের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হলে অপর ভাই তার নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারে না। তার কর্তব্য তাদেরকে নিবৃত্ত করার উদ্যোগ নেওয়া। আল্লাহ তাআলা বলছেন-
فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ (তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও)। অর্থাৎ ভাই হিসেবে তোমার কাছে তাদের এটা প্রাপ্য যে, তুমি তাদের দ্বন্দ্ব নিরসনে ভূমিকা রাখবে।
বস্তুত দুই মুসলিম ভাইয়ের মধ্যে আত্মকলহ দেখা দিলে অপর মুসলিম ভাইয়ের তা নিরসন করার চেষ্টা কেবল তাদের স্বার্থেই নয়; বরং নিজ স্বার্থেও করা উচিত। কেননা দ্বন্দ্ব-কলহ প্রথমেই নিরসন করা না হলে আগুনের মত তা ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে তা অন্যদেরও গ্রাস করে নেয়। তার থাবা থেকে নীরব দর্শকও রেহাই পায় না। এজন্যই তারা নিজেরা মিটমাট না করলেও অন্যদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তাদের মধ্যে মিটমাট করে দেওয়া উচিত।
আত্মকলহের একটা বড় ক্ষতি এইও যে, তাতে শত্রু সুযোগ পায়। শত্রু চায় কলহ দীর্ঘস্থায়ী হোক। আত্মকলহে যেমন আত্মিক শক্তি নষ্ট হয়, তেমনি অর্থবল ও পেশীশক্তিরও ক্রমক্ষয় ঘটে। শত্রু তো সেটাই চায়, যাতে করে মুমিনগণ নিজেরা মারামারি করে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আর সে অবকাশে তারা নির্বিঘ্নে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে। আমরা শত্রুকে সে সুযোগ দেব কেন? ইতোমধ্যে সে সুযোগ আমরা তাদের অনেক দিয়ে ফেলেছি। একদিন যারা আমাদের দ্বারা শাসিত ছিল, আজ বিশ্বব্যাপী তাদেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসনের যাতাকলে আমরা পিষ্ট হচ্ছি। এ আমাদের আত্মকলহেরই পরিণাম। ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বৃহৎ পরিসরে আমাদের আত্মকলহের সুযোগ তারা হরদমই নিয়ে যাচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের প্রকৃষ্ট উপায় আত্মকলহ ভুলে পরস্পর ঐক্য-ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সুদৃঢ় থাকা। যেখানেই যখন কোনও দ্বন্দ্ব-কলহ দেখা দেয়, যথাশীঘ্র তা মিটমাট করে ফেলা- বিবদমান দু'ভাই নিজেই কিংবা তৃতীয় ভাইয়ের উদ্যোগে।

২০৯. সূরা নিসা (৪), আয়াত ১১৪

২১০. সুনানে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪১২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৭৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৪৮৪; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৫১১; মুসনাদ আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৭১৩২

২১১. সূরা নিসা (৪), আয়াত ১২৮

২১২. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৫৯৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৪৪৩২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩০; তহাবী, শারহু মাআনিল আছার, হাদীছ নং ৫৮৪৯

২১৩. মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ১৫৬০৯; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১৪২৯; বায়হাকী, আস্ সুনানুস্ সাগীর, হাদীছ নং ২১০৫; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪০৩৯; সুনানে দারা কুতনী, হাদীছ নং ২৮৯৪

২১৪. সূরা আনফাল (৮), আয়াত ১

২১৫. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯১৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫০৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৭৫০৮; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫০৯২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৫৩৮; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৫৭৮

২১৬. সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১০
মানবদেহের জোড়াসমূহের বিপরীতে বিভিন্নরকম সদাকা আদায়ের নির্দেশনা
হাদীছ নং : ২৪৮

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, সূর্য উদিত হয় এমন প্রতিটি দিনে মানবদেহের প্রতিটি জোড়ার উপর সদাকা আবশ্যিক হয়। কেউ দুই ব্যক্তির মধ্যে ন্যায্যভাবে মীমাংসা করে দিলে তা একটি সদাকা। কোনও ব্যক্তিকে সওয়ারিতে চড়তে সাহায্য করলে বা তার উপর তার মাল-সামানা তুলে দিলে তাও একটি সদাকা। উৎকৃষ্ট কথাও একটি সদাকা । কেউ নামাযে যাওয়ার জন্য যে পথ চলে, তার প্রতিটি কদম ফেলা একেকটি সদাকা। তুমি যদি রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দাও, তাও একটি সদাকা -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৭০৭; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০০৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩৮১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮১৬৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৮২০; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩০৫৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৬৪৫)
مقدمة الامام النووي
31 - باب الإصلاح بَيْنَ الناس

قَالَ الله تَعَالَى: {لا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلاَّ مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلاحٍ بَيْنَ النَّاسِ} [النساء: 114]، وَقالَ تَعَالَى: {وَالصُّلْحُ خَيْرٌ} [النساء: 128]، وَقالَ تَعَالَى: {فَاتَّقُوا اللهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ} [الأنفال: 1]، وَقالَ تَعَالَى: {إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ} [الحجرات: 10].
248 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «كُلُّ سُلاَمَى مِنَ النَّاسِ عَلَيهِ صَدَقَةٌ، كُلَّ يَوْمٍ تَطْلُعُ فِيهِ الشَّمْسُ: تَعْدِلُ بَيْنَ الاثْنَينِ صَدَقَةٌ، وَتُعينُ الرَّجُلَ في دَابَّتِهِ فَتَحْمِلُهُ عَلَيْهَا، أَوْ تَرْفَعُ لَهُ عَلَيْهَا مَتَاعَهُ صَدَقَةٌ، وَالكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ صَدَقةٌ، وَبِكُلِّ خَطْوَةٍ تَمشِيهَا إِلَى الصَّلاةِ صَدَقَةٌ، وَتُميطُ الأَذى عَنِ الطَّريقِ صَدَقَةٌ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
ومعنى «تَعدِلُ بينهما»: تُصْلِحُ بينهما بالعدل.
হাদীস নং: ২৪৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার গুরুত্ব ও ফযীলত।
মীমাংসার লক্ষ্যে প্রয়োজনে মিথ্যা বলার অবকাশ
হাদীছ নং : ২৪৯

হযরত উম্মে কুলছুম বিনতে উকবা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দেয় আর তা করতে গিয়ে সে কোনও ভালো কথা কানে লাগায় বা ভালো কথা বলে, সে মিথ্যুক নয় -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৬৯২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬০৫; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৩৮৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৭২৭২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৭৩২; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৮৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২০৮৩২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৪৫৬)
مقدمة الامام النووي
31 - باب الإصلاح بَيْنَ الناس
249 - وعن أمِّ كُلْثُوم بنت عُقْبَة بن أَبي مُعَيط رضي الله عنها، قَالَتْ: سمِعتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم [ص:102] يَقُولُ: «لَيْسَ الكَذَّابُ الَّذِي يُصْلِحُ بَيْنَ النَّاسِ فَيَنْمِي خَيرًا، أَوْ يقُولُ خَيْرًا». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
وفي رواية مسلم زيادة، قَالَتْ: وَلَمْ أَسْمَعْهُ يُرَخِّصُ في شَيْءٍ مِمَّا يَقُولُهُ النَّاسُ إلاَّ في ثَلاثٍ، تَعْنِي: الحَرْبَ، وَالإِصْلاَحَ بَيْنَ النَّاسِ، وَحَدِيثَ الرَّجُلِ امْرَأَتَهُ، وَحَدِيثَ المَرْأةِ زَوْجَهَا. (2)
হাদীস নং: ২৫০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার গুরুত্ব ও ফযীলত।
পাওনাদার ও দেনাদারের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা
হাদীছ নং : ২৫০

উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দরজায় বাদ-বিবাদকারীদের আওয়াজ শুনতে পেলেন। তাদের আওয়াজ চড়া। লক্ষ করে দেখা গেল তাদের একজন অন্যজনের কাছে ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমানোর অনুরোধ করছে এবং তার কাছে সদয় আচরণ কামনা করছে। অপরদিকে সে বলছে, আল্লাহর কসম! আমি তা করতে পারব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে বের হয়ে এসে বললেন, কে সেই ব্যক্তি যে সৎকর্ম করবে না বলে আল্লাহর নামে কসম করছে ? সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি । এখন সে যা কামনা করে তাই হবে-বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৭০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৫৫৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১০৬২৬; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৭২৭)
مقدمة الامام النووي
31 - باب الإصلاح بَيْنَ الناس
250 - وعن عائشة رضي الله عنها، قَالَتْ: سَمِعَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - صَوْتَ خُصُومٍ بِالبَابِ عَاليةً أصْوَاتُهُمَا، وَإِذَا أَحَدُهُمَا يَسْتَوْضِعُ الآخَر وَيَسْتَرْفِقُهُ في شَيءٍ، وَهُوَ يَقُولُ: واللهِ لاَ أفْعَلُ، فَخَرجَ عَلَيْهِمَا رسولُ اللهِ - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: «أيْنَ المُتَأَلِّي عَلَى اللهِ لاَ يَفْعَلُ المَعْرُوفَ؟»، فَقَالَ: أَنَا يَا رسولَ اللهِ، فَلَهُ أيُّ ذلِكَ أحَبَّ. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
معنى «يَسْتَوضِعُهُ»: يَسْأَلهُ أَنْ يَضَعَ عَنْهُ بَعضَ دَيْنِهِ. «وَيَسْتَرفِقُهُ»: يَسأَلُهُ الرِّفْقَ. «وَالمُتَأَلِّي»: الحَالِفُ.
হাদীস নং: ২৫১
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার গুরুত্ব ও ফযীলত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক এক বিরোধ নিষ্পত্তিতে গমন ও আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর ইমামত
হাদীছ নং : ২৫১

হযরত সাহল ইবন সা'দ আস-সাইদী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সংবাদ পৌঁছল যে, বনু আওফ ইবন আমিরের লোকদের মধ্যে কলহ দেখা দিয়েছে। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতিপয় সাহাবীকে নিয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য বের হয়ে পড়লেন। সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিলম্ব হয়ে গেল। এদিকে নামাযেরও সময় হয়ে গেল। তখন হযরত বিলাল রাযি. আবূ বকর রাযি.-এর কাছে এসে বললেন, হে আবূ বকর! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আটকা পড়ে গেছেন। এদিকে নামাযের সময় হয়ে গেছে। আপনি কি মানুষের নামাযে ইমামত করবেন? তিনি বললেন, হাঁ, তুমি যদি চাও। সুতরাং বিলাল রাযি. নামাযের ইকামত দিলেন এবং আবূ বকর রাযি. সামনে এগিয়ে গেলেন। তিনি আল্লাহু আকবার বললেন। লোকেরাও আল্লাহু আকবার বলল। এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এসে পড়লেন। তিনি কাতারের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনের কাতারে এসে দাঁড়ালেন। লোকেরা হাতে তালি দিতে শুরু করল। কিন্তু আবূ বকর রাযি. নামাযে কোনওদিকে লক্ষ করতেন না। যখন লোকজন খুব বেশি তালি বাজাতে থাকল, তখন তিনি ফিরে তাকালেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখতে পেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইশারায় তাঁকে নিজ স্থানে থাকতে বললেন। আবূ বকর রাযি. তাঁর হাত তুলে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করলেন এবং পেছন দিকে সরে আসলেন। তিনি এসে প্রথম কাতারে দাঁড়ালেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামনে এগিয়ে গিয়ে লোকদের নিয়ে নামায পড়লেন। নামায শেষে তিনি লোকজনের দিকে মুখ করে বললেন, হে লোকসকল! তোমাদের কী হল যে, নামাযের মধ্যে কোনওকিছু ঘটলে তোমরা তালি বাজাতে শুরু কর? হাততালি দেওয়ার কাজটি তো মহিলাদের জন্য। কারও যদি নামাযের মধ্যে কিছু ঘটে, তবে সে যেন সুবহানাল্লাহ বলে। কেননা সে যখন সুবহানাল্লাহ বলবে, তখন যে তা শুনবে সে অবশ্যই তার দিকে লক্ষ করবে। হে আবূ বকর! আমি যখন তোমাকে ইশারা করলাম, তখন কোন্ জিনিস তোমাকে লোকদের নিয়ে নামায পড়তে বাধা দিল? আবূ বকর রাযি. বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দাঁড়িয়ে লোকদের নিয়ে নামায পড়বে, এটা আবূ কুহাফার পুত্রের পক্ষে সমীচীন নয় -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৮৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪২১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৭৮৪; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৯৪০; সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীছ নং ৮৭০; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৬৯৩: বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৩৩২৯; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৭৪৯
مقدمة الامام النووي
31 - باب الإصلاح بَيْنَ الناس
251 - وعن أَبي العباس سهل بن سَعد الساعِدِيّ - رضي الله عنه: أنَّ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - بَلَغَهُ أنَّ بَني عَمرو بن عَوْفٍ كَانَ بَيْنَهُمْ شَرٌّ، فَخَرَجَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - يُصْلِحُ بَينَهُمْ في أُنَاس مَعَهُ، فَحُبِسَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - وَحَانَتِ الصَّلاة، فَجَاءَ بِلالٌ إِلَى أَبي بكر رضي الله عنهما، فَقَالَ: يَا أَبا بَكْر، إنَّ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - قَدْ حُبِسَ وَحَانَتِ الصَّلاةُ فَهَلْ لَكَ أَنْ تَؤُمَّ النَّاس؟ قَالَ: نَعَمْ، إنْ شِئْتَ، فَأقَامَ بِلالٌ الصَّلاةَ، وتَقَدَّمَ أَبُو بَكْرٍ فَكَبَّرَ وَكَبَّرَ النَّاسُ، وَجَاءَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يَمشي في الصُّفُوفِ حَتَّى قَامَ في الصَّفِّ، فَأَخَذَ النَّاسُ في التَّصْفيقِ، وَكَانَ أَبُو بكرٍ - رضي الله عنه - لاَ يَلْتَفِتُ في الصَّلاةِ، فَلَمَّا أكْثَرَ النَّاسُ في التَّصْفيقِ الْتَفَتَ، فإِذَا رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - فَأَشَارَ إِلَيْه رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - فَرَفَعَ أَبُو بَكْر - رضي الله عنه - يَدَهُ فَحَمِدَ اللهَ، وَرَجَعَ القَهْقَرَى (1) وَرَاءهُ حَتَّى قَامَ في الصَّفِّ، فَتَقَدَّمَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - فَصَلَّى للنَّاسِ، فَلَمَّا فَرَغَ أقْبَلَ عَلَى النَّاسِ، فَقَالَ: «أيُّهَا النَّاسُ، مَا لَكُمْ حِينَ نَابَكُمْ شَيْءٌ في الصَّلاةِ أخَذْتُمْ في التَّصفيق؟! إِنَّمَا التَّصفيق [ص:103] للنِّساء. مَنْ نَابَهُ شَيْءٌ في صَلاتِهِ فَلْيَقُلْ: سُبْحَانَ الله، فَإِنَّهُ لاَ يَسْمَعُهُ أحدٌ حِينَ يقُولُ: سُبْحَانَ الله، إلاَّ الْتَفَتَ. يَا أَبَا بَكْر: مَا مَنَعَكَ أَنْ تُصَلِّي بالنَّاسِ حِينَ أشَرْتُ إلَيْكَ؟»، فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ: مَا كَانَ يَنْبَغي لابْنِ أَبي قُحَافَةَ أَنْ يُصَلِّي بالنَّاسِ بَيْنَ يَدَيْ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2)
معنى «حُبِسَ»: أمْسَكُوهُ لِيُضِيفُوهُ.
হাদীস নং: ২৫২
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৩২

দুর্বল, গরীব ও অখ্যাত-গুরুত্বহীন মুসলিমদের মর্যাদা

ضعفة শব্দটি ضعيف -এর বহুবচন। এর অর্থ দুর্বল। এর দ্বারা এমনসব লোককে বোঝানো হয়, যারা তেমন অর্থ-বিত্তের মালিক নয়, যাদের নেই প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং যারা পদ ও ক্ষমতা থেকেও দূরে থাকে।
الفقراء শব্দটি فقير -এর বহুবচন। এর অর্থ গরীব ও দরিদ্র, যাদের উল্লেখযোগ্য অর্থ-সম্পদ নেই এবং যাদের উপর যাকাত ফরয হয় না; বরং তারাই যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত।
الخاملين শব্দটি خامل -এর বহুবচন। এটা এমন লোককে বলে, যারা প্রচার ও খ্যাতিবিমুখ এবং সমাজচোখে যারা বিশেষ গুরুত্ব রাখে না। এর জন্য গরীব হওয়া শর্ত নয়। যে বিত্তবান প্রচার ও খ্যাতি থেকে আত্মরক্ষা করে চলে, সেও এর অন্তর্ভুক্ত।
দুনিয়ায় সাধারণত এ তিন শ্রেণীর লোককে অবজ্ঞা করা হয়। কেননা মানুষের কাছে অর্থবিত্ত ও শক্তি-ক্ষমতাই মর্যাদার মাপকাঠি। তাদের তা না থাকায় মানুষের দৃষ্টিতে তাদের বিশেষ মর্যাদাও নেই। সুতরাং তাদের গুরুত্ব দেওয়া হবে কেন? অধিকাংশ মানুষ ইজ্জত-সম্মানের বড় কাঙ্গাল, আর তা যেহেতু পাওয়া যায় শক্তি ক্ষমতা ও অর্থবিত্ত দ্বারা, তাই তারা এসব খুব পসন্দ করে। কাজেই তারা এগুলোর অর্জনকেই জীবনের সাধনা বানিয়ে নেয়। এর জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। সে প্রতিযোগিতা মানুষকে কলহ-বিবাদ ও নানারকম অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত করে। এর পরিণামে মানুষের পার্থিব জীবনও বিপর্যস্ত হয় এবং পরকালীন জীবন হয় ক্ষতিগ্রস্ত। সে ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার সহজ উপায় এ প্রতিযোগিতা এড়িয়ে চলা। অন্তর থেকে বিত্ত, ক্ষমতা ও খ্যাতির মোহ দূর করা গেলে এ প্রতিযোগিতা আপনিই খতম হয়ে যায়।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রিয় সাহাবীদের অন্তর থেকে এ মোহ দূর করার বহুমুখী চেষ্টা করেছেন। ফলে তারা এসবের মোহমুক্ত আদর্শ মানবরূপে গড়ে উঠেছিলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে নির্মোহ করার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তার একটা এইও যে, আল্লাহ তা'আলা দুর্বল, গরীব ও প্রচারবিমুখ মুসলিমকে যে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন, তিনি তাদের সামনে তা তুলে ধরতেন। যেমন এ সম্পর্কিত একটি হাদীছ লক্ষ করুন-

عن أبي الدرداء قال: سمعت رسول اللہ ﷺ یقول: أبغوني ضعفاءكم، فإنكم إنما ترزقون وتنصرون بضعفائكم

'হযরত আবুদ দারদা রাযি. বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা আমার জন্য তোমাদের মধ্যে যারা দুর্বল তাদের সন্ধান কর। তোমরা তো তোমাদের দুর্বলদের অসিলায়ই (আল্লাহর পক্ষ থেকে) রিযিক ও সাহায্য লাভ করে থাক।২৩৮
অর্থাৎ তাদের খুঁজে পেতে তোমরা আমাকে সাহায্য কর এবং তাদেরকে আমার কাছে নিয়ে আস। কেননা, আমার মজলিসে তারাই বসার বেশি হকদার এবং তারাই আমার ঘনিষ্ঠতালাভের বেশি উপযুক্ত। কুরআন মাজীদ দ্বারাও এ বক্তব্য সমর্থিত, যেমন সামনে আসছে।
বলাবাহুল্য সাহাবায়ে কেরাম প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশনা সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতেন এবং সে অনুযায়ী জীবনগঠনের চেষ্টা করতেন। সে প্রচেষ্টায় তারা পুরোপুরি সফলও হয়েছিলেন। এটাই তাদের শ্রেষ্ঠতম মানুষে পরিণত হওয়ার মূল রহস্য। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জন্য। তাই আমাদের উচিত অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সে শিক্ষা জানা ও তার অনুসরণ করা, বিশেষত গরীব ও সামাজিকভাবে গুরুত্বহীন দীনদার শ্রেণীর ব্যাপারে ইসলাম যে দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষা দিয়েছে তা আত্মস্থ করা অতীব জরুরি। এতে করে নিজেদের অন্তর থেকে যেমন দুনিয়ার মোহ ঘুচবে, তেমনি গরীব দীনদারদের অবহেলা করার কারণে আমরা যে নানাবিধ আখলাকী ও কর্মগত অন্যায় অপরাধে লিপ্ত হচ্ছি তা থেকেও বাঁচতে পারব।

২৩৮. সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩১৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৭৩১; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৭০২; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৫৯৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৪৭৬৭; মুস্তাদরাকে হাকিম, হাদীছ নং ২৫০৯; বায়হাকী, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৩৮৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪০৬২

‘দুর্বল, গরীব ও অখ্যাত-গুরুত্বহীন মুসলিমদের মর্যাদা’ সম্পর্কিত একটি আয়াত

এক নং আয়াত

وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ

অর্থ : ধৈর্য-স্থৈর্যের সাথে নিজেকে সেই সকল লোকের সংসর্গে রাখ, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে এ কারণে ডাকে যে, তারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।২৩৯

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হুকুম দিয়েছেন, তিনি যেন ওইসব লোকের সঙ্গে ধৈর্য সহকারে থাকেন, যারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে পরিপূর্ণ ইখলাসের সঙ্গে সর্বদা ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকে। তারা সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তাআলাকে ডাকে। অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত আদায় করে, আল্লাহ তাআলার যিকর করে, কুরআন তিলাওয়াত করে, হালাল-হারাম বিচার করে চলে, মানুষের সঙ্গে আচার-আচরণে আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ রাখে, আল্লাহ তাআলার হক আদায়ের পাশাপাশি মাখলুকের হক আদায়েও যত্নবান থাকে। তারা গরীব কিসিমের লোক হতে পারে, কিন্তু তাদের অন্তর ঐশ্বর্যে ভরা। দুনিয়ার প্রতি তাদের কোনও লোভ-লালসা নেই। দুনিয়াদারদের যা আছে সেজন্য তারা লালায়িতও নয় এবং নয় সে কারণে তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত।
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি. হযরত সুহায়ব রাযি., হযরত বিলাল রাযি., হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. প্রমুখ সাহাবী এসকল গুণের অধিকারী ছিলেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এসকল গরীব আল্লাহওয়ালাদের সঙ্গে ধৈর্যসহকারে থাকতে বলেছেন।
বাহ্যত বোঝা যাচ্ছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের সাহচর্যে থাকার হুকুম দেওয়া হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে বোঝানো উদ্দেশ্য- আপনি ধৈর্যসহকারে তাদেরকে নিজ সাহচর্যে থাকতে দিন এবং আপনার সাহচর্যে থেকে তারা যাতে নিজেদেরকে আল্লাহর খাঁটি বান্দারূপে গড়ে তুলতে পারে আর এভাবে আখেরাতের সাফল্য অর্জনে সক্ষম হতে পারে, সে সুযোগ তাদেরকে দান করুন।
যদিও আয়াতের মূল উদ্দেশ্য গরীব সাহাবীদেরকে নিজ সাহচর্যে রাখার হুকুম দান করা, কিন্তু বাকভঙ্গি অবলম্বন করা হয়েছে এর বিপরীত। অর্থাৎ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের সাহচর্যে থাকতে বলা হচ্ছে। তা বলার কারণ সম্ভবত আমাদেরকে সবক দেওয়া যে, আমরা যেন উল্লিখিত গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাহচর্যে থাকি। এভাবেও বলা যায় যে, আমাদেরকে আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য অবলম্বনের হুকুম দেওয়া হয়েছে আর কিভাবে চিনব কে সত্যিকারের আল্লাহওয়ালা, সেজন্য তাদের গুণাবলীও উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে যাতে করে কোনও আল্লাহওয়ালা গরীব হলে সে কারণে যেন তাদের সাহচর্য পরিত্যাগ না করি। আল্লাহওয়ালা চেনার মাপকাঠি যেন ধন-সম্পদ না হয়; বরং তা যেন হয় উল্লিখিত গুণাবলী। যাদের মধ্যে এসব গুণ নেই, পার্থিব দিক থেকে তারা যতই সুপ্রতিষ্ঠিত হোক, প্রকৃতপক্ষে তারা এর উপযুক্ত নয় যে, তাদের সাহচর্য গ্রহণ করা যেতে পারে। তা করতে পারে কেবল এমন লোক, যাদের উদ্দেশ্য পার্থিব ভোগ-উপভোগ। আয়াতের পরের অংশে সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে-

وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا

‘পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায় তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।’

অর্থাৎ মুখলিস গরীবদের ছেড়ে বিত্তবান অহংকারীদের দিকে নজর দিও না। তুমি হয়তো এই উদ্দেশ্যে তাদের দিকে নজর দেবে যে, তারা মুসলিম হয়ে গেলে ইসলাম শক্তিশালী হবে। এ চিন্তা ভুল। ইসলামের প্রকৃত শক্তি ও মর্যাদা অর্থবিত্তের মধ্যে নিহিত নয়; বরং তার উৎস হচ্ছে খাঁটি ঈমান, তাকওয়া-পরহেযগারী ও উন্নত আখলাক-চরিত্র। এটাই প্রকৃত সম্পদ, যা ওই গরীব মুমিনদের মধ্যে আছে। অহংকারী বিত্তবানেরা এর থেকে বঞ্চিত। কাজেই তাদের জন্য অতিরিক্ত আশাবাদী না হয়ে বরং ওই গরীব আল্লাহওয়ালাদের সঙ্গেই নিজেকে জুড়ে রাখা চাই।
এ প্রসঙ্গে আয়াতের পরবর্তী অংশও উল্লেখযোগ্য। বলা হয়েছে-

وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا

(এমন কোনও ব্যক্তির কথা মানবে না, যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে রেখেছি, যে নিজ খেয়াল-খুশির পেছনে পড়ে রয়েছে এবং যার কার্যকলাপ সীমা ছাড়িয়ে গেছে)। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কুরায়শ গোত্রীয় কোনও কোনও মোড়ল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রস্তাব পেশ করেছিল যে, আপনি ওই নিম্নস্তরের লোকগুলোকে সরিয়ে দিন, তাহলে আমরা অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণী আপনার কাছে বসতে পারব এবং আপনি কী বলেন তা শুনব। তারা নিম্নস্তরের লোক বলেছিল গরীব মুমিনদেরকে আর অভিজাত বলেছিল বিত্তবান কাফেরদেরকে। হয়তো বা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিন্তা করেছিলেন আমার গরীব সাহাবীগণ তো খাঁটি মুমিনই। তাদের ঈমান পরিপক্ক। কাজেই সাময়িকভাবে যদি তাদেরকে মজলিসে না আসতে বলা হয়, তাতে কোনও ক্ষতি নেই, তারা মনে কষ্ট পাবে না। এ অবকাশে এসব মোড়লকে দীনের কথা শোনানো যাবে। হয়তো তারা ঈমানও আনবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয় এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, আপনি এ উদ্যত শ্রেণীর কথায় কান দেবেন না। এরা শুধু শুধুই এ প্রস্তাব করছে। আসলে তাদের ঈমান আনার ইচ্ছাই নেই। ঈমান আনতে চাইলে তারা এতদিনে তা এনেই ফেলত। তাদের সামনে সত্যদীন পরিস্ফুট হতে কিছু বাকি নেই। আসলে তাদের অন্তর দুনিয়ার নেশায় মত্ত। তারা আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল। তারা সর্বক্ষণ মনের খাহেশ পূরণে ব্যস্ত। আল্লাহর আনুগত্য করতে গেলে তারা তাদের মনের অসৎ চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। তাই মনের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আল্লাহর আনুগত্য পাশ কাটিয়ে চলছে এবং কুফর ও অবাধ্যতায় লিপ্ত থেকে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এহেন নফসের পূজারীদের কথায় বিলকুল কর্ণপাত করবেন না।
মোটকথা তিনটি অসৎগুণ যাদের মধ্যে আছে, কিছুতেই তাদের আনুগত্য করা যাবে না, এমনকি তাদের সঙ্গ ও সাহচর্যও অবলম্বন করা উচিত হবে না। সে অসৎ গুণগুলো হচ্ছে-

ক. অন্তরের গাফলাত এবং আল্লাহর যিকর ও স্মরণ থেকে বিমুখ থাকা;

খ. নফসের আনুগত্য তথা মনের অসৎ চাহিদা পূরণে লিপ্ত থাকা এবং

গ. সত্য ও ন্যায়ের সীমা লঙ্ঘন করা ও বাড়াবাড়িতে লিপ্ত থাকা।
যে-কারও বদ্দীন হওয়ার জন্য এ তিনটি স্বভাবের যে-কোনও একটিই যথেষ্ট। কারও মধ্যে তিনওটি থাকার অর্থ সে চরম পর্যায়ের বেদীন। এরূপ লোকের কথায় চলা বা তাদের সাহচর্য অবলম্বন করার পরিণাম নিজেরও গোমরাহ হয়ে যাওয়া, যা কোনও মুমিন-মুসলিমের কাম্য হতে পারে না।
আয়াতটির শুরুতে ধৈর্যসহকারে আল্লাহওয়ালা লোকের সাহচর্যে থাকতে বলা হয়েছে, তাতে তারা গরীবই হোক না কেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে সতর্ক করা হয়েছে যেন দুনিয়ার ভোগ-উপভোগের আশায় গরীব আল্লাহওয়ালাদের ছেড়ে দুনিয়াদারদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে না পড়া হয় । তৃতীয় পর্যায়ে নফসের পূজারী গাফেল সীমালঙ্ঘনকারীদের অনুসরণ ও আনুগত্য করতে নিষেধ করা হয়েছে।
এ আয়াতটি সাহাবায়ে কেরামের উচ্চমর্যাদার এক সুস্পষ্ট দলীল। আয়াতটি নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বলে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করেন-

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَمْ يُمِثْنِي حَتَّى أَمَرَنِي أَنْ أَصْبِرَ نَفْسِي مَعَ قَوْمٍ مِنْ أُمَّتِي، مَعَكُمْ الْمَحْيَا وَمَعَكُمُ الْمَمَاتُ

‘আল্লাহ তাআলার শোকর, তিনি আমার উম্মতেরই একদল লোকের সঙ্গে আমাকে ধৈর্যসহকারে থাকার আদেশ দান না করা পর্যন্ত আমার মৃত্যু ঘটাননি। (ওহে আমার সাহাবীগণ!) তোমাদেরই সঙ্গে আমার জীবন এবং তোমাদেরই সঙ্গে মরণ।২৪০

২৩৯. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত নং ২৮

২৪০. শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০০১২; তাবারানী, আল-মুজামুস সগীর, হাদীছ নং ১০৭৪
জান্নাতবাসী ও জাহান্নামীদের পরিচয়
হাদীছ নং : ২৫২

হযরত হারিছা ইবুন ওয়াহব রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, জান্নাতবাসী কারা সে সম্পর্কে কি আমি তোমাদের অবহিত করব না? তারা হচ্ছে প্রত্যেক দুর্বল ব্যক্তি, যে মানুষের কাছেও দুর্বল গণ্য, যে আল্লাহর নামে শপথ করলে আল্লাহ অবশ্যই তার শপথ রক্ষা করেন। আমি কি তোমাদের অবহিত করব না কারা জাহান্নামী? তারা হচ্ছে প্রত্যেক রূঢ়, উদ্ধত, অহংকারী ব্যক্তি -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৯১৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৮৫৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬০৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৪১১৬; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৫৬৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৮৭২৮; বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২০৮০৫; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৮২৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩২৫৫
مقدمة الامام النووي
32 - باب فضل ضعفة المسلمين والفقراء والخاملين

قَالَ الله تَعَالَى: {وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ} [الكهف: 28].
252 - وعن حارثة بن وهْبٍ - رضي الله عنه - قَالَ: سمعت رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يقولُ: «ألاَ أُخْبِرُكُمْ بِأهْلِ الجَنَّةِ؟ كُلُّ ضَعِيف مُتَضَعَّف (1)، لَوْ أقْسَمَ عَلَى اللهِ لأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأهْلِ النَّارِ؟ كُلُّ عُتُلٍّ جَوّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2)
«العُتُلُّ»: الغَلِيظُ الجَافِي. «وَالجَوَّاظُ»: بفتح الجيم وتشديد الواو وبالظاء المعجمة: وَهُوَ الجَمُوعُ المَنُوعُ، وَقِيلَ: الضَّخْمُ المُخْتَالُ في مِشْيَتِهِ، وَقِيلَ: القَصِيرُ البَطِينُ.
হাদীস নং: ২৫৩
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ দুর্বল, গরীব ও অখ্যাত–গুরুত্বহীন মুসলিমদের মর্যাদা।
কে প্রকৃত মর্যাদাবান- সম্ভ্রান্ত দুনিয়াদার, না গরীব দীনদার
হাদীছ নং : ২৫৩

হযরত সাহল ইবনে সা'দ আস-সা'ইদী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তিনি তাঁর কাছে বসা এক ব্যক্তিকে বললেন, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? সে বলল, ইনি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের একজন। আল্লাহর কসম! তিনি এর উপযুক্ত যে, বিবাহের প্রস্তাব দিলে তা কবুল করা হবে এবং কারও সম্পর্কে সুপারিশ করলে তা গৃহীত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ করে থাকলেন। তারপর অপর এক ব্যক্তি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (কাছে বসে থাকা) সেই ব্যক্তিকে বললেন, এই লোক সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ লোকটি দরিদ্র মুসলিমদের একজন। এ এরই উপযুক্ত যে, বিবাহের প্রস্তাব দিলে তা কবুল করা হবে না এবং কারও সম্পর্কে সুপারিশ করলে তা গৃহীত হবে না। আর যদি কথা বলে তবে তার কথায় কর্ণপাত করা হবে না। এবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই ব্যক্তি ওই লোকের মত দুনিয়াভরা মানুষ অপেক্ষাও উত্তম -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫০৯১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৪১২০; তাবারানী, আল- মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৮৮৩; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৯৯৯৮; বাগাবী, শারহুস্সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪০৬৯
مقدمة الامام النووي
32 - باب فضل ضعفة المسلمين والفقراء والخاملين
253 - وعن أَبي عباس سهل بن سعد الساعِدِيِّ - رضي الله عنه - قَالَ: مَرَّ رَجُلٌ عَلَى النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ لرَجُلٍ عِنْدَهُ جَالِسٌ: «مَا رَأيُكَ في هَذَا؟»، فَقَالَ: رَجُلٌ مِنْ أشْرَافِ النَّاسِ، هَذَا واللهِ حَرِيٌّ إنْ خَطَبَ أَنْ يُنْكَحَ، وَإنْ شَفَعَ أَنْ يُشَفَّعَ. فَسَكَتَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - ثُمَّ مَرَّ رَجُلٌ آخَرُ، فَقَالَ لَهُ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم: «مَا رَأيُكَ في هَذَا؟» فَقَالَ: يَا رَسُولَ الله، هَذَا رَجُلٌ مِنْ فُقَراءِ المُسْلِمِينَ، هَذَا حَرِيٌّ إنْ خَطَبَ أَنْ لا يُنْكَحَ، وَإنْ شَفَعَ أَنْ لا يُشَفَّعَ، وَإنْ قَالَ أَنْ لاَ يُسْمَعَ لِقَولِهِ. فَقَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «هَذَا خَيْرٌ مِنْ مِلءِ الأرْضِ مِثْلَ هَذَا». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1) [ص:104]
قوله: «حَرِيٌّ» هُوَ بفتح الحاءِ وكسر الراء وتشديد الياءِ: أي حَقيقٌ. وقوله: «شَفَعَ» بفتح الفاءِ.
হাদীস নং: ২৫৪
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ দুর্বল, গরীব ও অখ্যাত–গুরুত্বহীন মুসলিমদের মর্যাদা।
জান্নাত ও জাহান্নামের বিতর্ক যা নিয়ে
হাদীছ নং : ২৫৪

হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রযি. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, জান্নাত ও জাহান্নাম পরস্পর বিতর্কে লিপ্ত হল । জাহান্নাম বলল, আমার মধ্যে আছে যত প্রচণ্ড শক্তিধর ও অহংকারী লোক। জান্নাত বলল, আমার মধ্যে আছে এমনসব লোক যারা মানুষের মধ্যে দুর্বল ও গরীব। আল্লাহ তা'আলা তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দিলেন যে, (হে জান্নাত!) তুমি হলে আমার রহমত। তোমার দ্বারা আমি যার প্রতি ইচ্ছা রহম করি। আর (হে জাহান্নাম!) তুমি হলে আমার আযাব। আমি তোমার দ্বারা যাকে ইচ্ছা আযাব দেই। আমারই যিম্মায় তোমাদের প্রত্যেককে পরিপূর্ণ করে দেওয়া -মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৮৪৬; সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৮৫০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫৬১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৭৪৭৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৭১৮, আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৫৫৪; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ১১৭১; বাগাবী, শারহুস-সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৪২২; মুসনাদ আবূ ইয়ালা, হাদীছ নং ৬২৯০
مقدمة الامام النووي
32 - باب فضل ضعفة المسلمين والفقراء والخاملين
254 - وعن أَبي سعيد الخدري - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «احْتَجَّتِ الجَنَّةُ والنَّارُ، فقالتِ النَّارُ: فِيَّ الجَبَّارُونَ وَالمُتَكَبِّرُونَ. وَقَالتِ الجَنَّةُ: فِيَّ ضُعَفَاءُ النَّاسِ وَمَسَاكِينُهُمْ، فَقَضَى اللهُ بَيْنَهُمَا: إنَّكِ الجَنَّةُ رَحْمَتِي أرْحَمُ بِكِ مَنْ أشَاءُ، وَإنَّكِ النَّارُ عَذَابِي أُعَذِّبُ بِكِ مَنْ أشَاءُ، وَلِكلَيْكُمَا عَلَيَّ مِلْؤُهَا». رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ২৫৫
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ দুর্বল, গরীব ও অখ্যাত–গুরুত্বহীন মুসলিমদের মর্যাদা।
আখেরাতে তাকওয়াবিহীন মোটাতাজা ব্যক্তির মশার ডানা পরিমাণও ওজন না হওয়া
হাদীছ নং : ২৫৫

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন বিশালাকার মোটাতাজা ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যার ওজন আল্লাহর কাছে মশার ডানার সমানও হবে না -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৭২৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৭৮৫; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৯৯৯৫; তাবারানী, আল-মুজামুল আওসাত, হাদীছ নং ১৯২; বাগাবী, শারহুস - সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৩২৭
مقدمة الامام النووي
32 - باب فضل ضعفة المسلمين والفقراء والخاملين
255 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - عن رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «إنَّهُ لَيَأتِي الرَّجُلُ السَّمِينُ العَظِيمُ يَوْمَ القِيَامَةِ لاَ يَزِنُ عِنْدَ اللهِ جَناحَ بَعُوضَةٍ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীস নং: ২৫৬
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ দুর্বল, গরীব ও অখ্যাত–গুরুত্বহীন মুসলিমদের মর্যাদা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মসজিদের এক ঝাড়ুদারের মর্যাদা
হাদীছ নং : ২৫৬

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, কালো বর্ণের এক মহিলা অথবা (তিনি বলেছেন) এক যুবক মসজিদ ঝাড়ু দিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে না পেয়ে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তারা বললেন, সে মারা গেছে। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে তার সম্পর্কে জানালে না কেন? তারা যেন তার বিষয়টা তুচ্ছ মনে করেছিলেন। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে তার কবর দেখিয়ে দাও।
তারা তাঁকে দেখিয়ে দিলেন। তিনি তার জানাযা পড়লেন। তারপর ইরশাদ করলেন, এ কবরগুলো তার বাসিন্দাদের নিয়ে অন্ধকারে পরিপূর্ণ থাকে। আল্লাহ তাআলা আমার দু'আর বরকতে তাদের জন্য তা আলোকিত করে দেন -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৬৩১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯৫৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ১৫২৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩০৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৯০৩৭; বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭০১৪; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১১৯৩৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৪৯৯
مقدمة الامام النووي
32 - باب فضل ضعفة المسلمين والفقراء والخاملين
256 - وعنه: أنَّ امْرَأَةً سَوْدَاءَ كَانَتْ تَقُمُّ المَسْجِدَ، أَوْ شَابًّا، فَفَقَدَهَا، أَوْ فَقَدَهُ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - فَسَأَلَ عَنْهَا، أو عنه، فقالوا: مَاتَ. قَالَ: «أَفَلا كُنْتُمْ آذَنْتُمُونِي» فَكَأنَّهُمْ صَغَّرُوا أمْرَهَا، أَوْ أمْرهُ، فَقَالَ: «دُلُّونِي عَلَى قَبْرِهِ» فَدَلُّوهُ فَصَلَّى عَلَيْهَا، ثُمَّ قَالَ: «إنَّ هذِهِ القُبُورَ مَمْلُوءةٌ ظُلْمَةً عَلَى أهْلِهَا، وَإنَّ اللهَ تعالى. يُنَوِّرُهَا لَهُمْ بِصَلاتِي عَلَيْهِمْ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
قوله: «تَقُمُّ» هُوَ بفتح التاءِ وضم القاف: أي تَكْنُسُ. «وَالقُمَامَةُ»: الكُنَاسَةُ، «وَآذَنْتُمُونِي» بِمد الهمزة: أيْ: أعْلَمْتُمُونِي.
হাদীস নং: ২৫৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ দুর্বল, গরীব ও অখ্যাত–গুরুত্বহীন মুসলিমদের মর্যাদা।
আল্লাহর কাছে কোনও কোনও হতদারদের মাকবূলিয়াত
হাদীছ নং : ২৫৭

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনও কোনও উশকোখুশকো চুলবিশিষ্ট ধুলো-ধূসরিত লোক আছে, যাদেরকে মানুষের দরজাসমূহ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়; তারা যদি আল্লাহর নামে কসম করে তবে আল্লাহ তাদের কসম রক্ষা করেন -মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬২২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৬৪৮৩; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৯৯৯৯; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৭৯৩২; বাগাবী, শারহুস-সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪০৬৯
مقدمة الامام النووي
32 - باب فضل ضعفة المسلمين والفقراء والخاملين
257 - وعنه، قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «رُبَّ أشْعَثَ أغبرَ مَدْفُوعٍ بِالأبْوابِ لَوْ أقْسَمَ عَلَى اللهِ لأَبَرَّهُ». رواه مسلم. (1)
হাদীস নং: ২৫৮
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ দুর্বল, গরীব ও অখ্যাত–গুরুত্বহীন মুসলিমদের মর্যাদা।
অধিকাংশ জান্নাতবাসীর গরীবশ্রেণী থেকে হওয়া
হাদীছ নং : ২৫৮

হযরত উসামা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি জান্নাতের দরজায় দাঁড়ালাম, দেখি কি তাতে প্রবেশকারী অধিকাংশ লোকই গরীব-মিসকীন। আর বিত্তবানদের আটকে রাখা হয়েছে। অবশ্য যারা জাহান্নামী তাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি জাহান্নামের দরজায় দাঁড়ালাম, দেখি কি তাতে প্রবেশকারীদের অধিকাংশই নারী -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫১৯৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৭৩৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৭৮২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৬৯২; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৪২১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪০৬৩
مقدمة الامام النووي
32 - باب فضل ضعفة المسلمين والفقراء والخاملين
258 - وعن أسامة - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «قُمْتُ عَلَى بَابِ الجَنَّةِ، فَإِذَا عَامَّةُ مَنْ دَخَلَهَا المَسَاكِينُ، وَأصْحَابُ الجَدِّ مَحْبُوسُونَ، غَيْرَ أنَّ أصْحَابَ النَّارِ قَدْ أُمِرَ بِهِمْ إِلَى النَّارِ. وَقُمْتُ عَلَى بَابِ النَّارِ فَإِذَا عَامَّةُ مَنْ دَخَلَهَا النِّسَاءُ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
«وَالْجَدُّ»: بفتح الجيم: الحَظُّ وَالغِنَى. وَقوله: «مَحْبُوسُونَ» أيْ: لَمْ يُؤْذَنْ لَهُمْ بَعْدُ في دُخُولِ الجَنَّةِ.
হাদীস নং: ২৫৯
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ দুর্বল, গরীব ও অখ্যাত–গুরুত্বহীন মুসলিমদের মর্যাদা।
যে শিশুরা দোলনার বয়সে কথা বলেছে
হাদীছ নং : ২৫৯

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, দোলনায় কেবল তিনজনই কথা বলেছে— ঈসা ইবন মারয়াম ও জুরাইজ-এর ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিশু (তৃতীয়জনের কথা সামনে আসছে)। জুরাইজ ছিলেন একজন আবেদ লোক। তিনি একটি উপাসনালয় তৈরি করে সেখানেই থাকতেন। একদিন তিনি নামায পড়ছিলেন, এ অবস্থায় তার মা তার কাছে আসলেন এবং ডাক দিলেন- হে জুরাইজ! তিনি (মনে মনে) বললেন, হে আমার রব! আমার মা ও আমার নামায। তারপর তিনি নামাযেই রত থাকলেন। তার মা ফিরে গেলেন। পরদিন আবার আসলেন। তখনও তিনি নামায পড়ছিলেন। তিনি ডাক দিলেন- হে জুরাইজ ! তিনি (মনে মনে) বললেন, হে আমার রব! আমার মা ও আমার নামায । তারপর তিনি নামাযেই রত থাকলেন। তার মা ফিরে গেলেন। তারপরের দিন আবারও তার মা আসলেন। তখনও তিনি নামায পড়ছিলেন। তিনি ডাক দিলেন- হে জুরাইজ! তিনি (মনে মনে) বললেন, হে আমার রব! আমার মা ও আমার নামায। তারপর তিনি নামাযেই রত থাকলেন। এবার তার মা বললেন- হে আল্লাহ! তুমি একে মৃত্যু দিও না, যাবৎ না সে যিনাকারীদের চেহারা দেখে।
বনী ইসরাঈল জুরাইজ ও তার ইবাদত-বন্দেগীর গুণগান করতে লাগল। (তাদের মধ্যে) ছিল এক ব্যভিচারী নারী, যার রূপ ছিল অসাধারণ। সে একদিন বলল, তোমরা চাইলে আমি তাকে ফিতনায় ফেলতে পারি। তারপর সে নিজেকে তার সামনে পেশ করল। কিন্তু তিনি তার দিকে ভ্রুক্ষেপই করলেন না। অগত্যা সে চলে গেল এক রাখালের কাছে, যে জুরাইজের ইবাদতখানার কাছাকাছি অবস্থান করত। সে তাকে নিজের ব্যাপারে সুযোগ দিল। রাখাল তাতে লিপ্ত হল। ফলে সে গর্ভবতী হয়ে পড়ল। সে শিশুর জন্মদানের পর বলল, এটি জুরাইজের। অমনি তারা তার কাছে চলে আসল এবং তাকে টেনে হেঁচড়ে নামিয়ে তার ইবাদতখানাটি ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। তারা তাকে মারধর করতে থাকল। তিনি বললেন, তোমাদের কী হল? তারা বলল, তুমি এই ব্যভিচারীনীর সঙ্গে ব্যভিচার করেছ। ফলে সে তোমার ঔরসে বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। তিনি বললেন, শিশুটি কই? তারা শিশুটি নিয়ে আসল। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে সুযোগ দাও, আমি নামায পড়ে নিই। তিনি নামায পড়লেন। নামায শেষে তিনি শিশুটির কাছে আসলেন এবং তার পেটে খোঁচা দিয়ে বললেন, এই ছেলে! তোমার পিতা কে? শিশুটি বলল, অমুক রাখাল। অমনি তারা জুরাইজের কাছে এসে তাকে চুমু দিতে লাগল এবং ভক্তি শ্রদ্ধার সঙ্গে তার গায়ে হাত বুলাতে থাকল । তারপর তারা বলল, আমরা আপনার উপাসনালয়টি স্বর্ণ দিয়ে নির্মাণ করে দেব। তিনি বললেন, না, আগে যেমন ছিল ফের মাটি দ্বারা তেমনি বানিয়ে দাও। তারা তাই করল।
একদিন এক শিশু তার মায়ের দুধ পান করছিল। এসময় উৎকৃষ্ট ও সুন্দর দৃষ্টিনন্দন পশুতে সওয়ার এক ব্যক্তি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। শিশুটির মা বলল, হে আল্লাহ! আমার পুত্রকে এ ব্যক্তির মত বানাও। শিশুটি মায়ের স্তন ছেড়ে দিল এবং ওই ব্যক্তির দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকে লক্ষ করল। তারপর বলল, হে আল্লাহ! আমাকে তার মত বানিও না। তারপর সে আবার মায়ের দুধ খেতে শুরু করল। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর শাহাদাত আঙ্গুল মুখের ভিতর দিয়ে চুষতে থাকলেন আর এভাবে ওই শিশুটি কিভাবে দুধ খাচ্ছিল তা অনুকরণ করে দেখাচ্ছিলেন। আমি যেন তাঁকে এখনও সেই রূপে দেখতে পাচ্ছি।
তারপর তিনি ইরশাদ করেন, আরেকবার লোকজন একটি দাসীকে মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছিল। তারা বলছিল, তুই যিনা করেছিস, চুরি করেছিস। আর সে বলছিল- حَسْبُي اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ 'আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট । তিনিই উত্তম কর্ম সম্পাদনকারী'। এসময় শিশুটির মা বলল, হে আল্লাহ! তুমি আমার ছেলেকে ওর মত বানিও না। শিশুটি দুধপান ছেড়ে দিয়ে ওই দাসীর প্রতি লক্ষ করল। তারপর বলল, হে আল্লাহ! আমাকে তার মত বানিও। এবার মা ও শিশু কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হল। মা বলল- "সুন্দর অবস্থাসম্পন্ন একটি লোক যাচ্ছিল। আমি বললাম, হে আল্লাহ! তুমি আমার ছেলেকে ওর মত বানিও। আর তুমি বললে, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তার মত বানিও না। আবার লোকজন ওই দাসীকে মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছিল। তারা বলছিল, তুই যিনা করেছিস, চুরি করেছিস। আমি বললাম, হে আল্লাহ! তুমি আমার ছেলেকে ওর মত বানিও না। আর তুমি বললে, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তার মত বানিও”?! সে এর উত্তরে বলল- “ওই লোকটি ছিল এক অত্যাচারী। তাই আমি বলেছি, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ওর মত বানিও না। অপরদিকে এই যে দাসী, তারা তো তাকে বলছিল তুই যিনা করেছিস, অথচ সে যিনা করেনি। তারা বলছিল তুই চুরি করেছিস, অথচ সে চুরি করেনি। তাই আমি বলেছি, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তার মত বানিও” -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৪৩৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৫০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮০৫৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৬৪৮৯; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৫৮; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪৯৫
مقدمة الامام النووي
32 - باب فضل ضعفة المسلمين والفقراء والخاملين
259 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لَمْ يَتَكَلَّمْ في المَهْدِ إلاَّ ثَلاثَةٌ: عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ، وَصَاحِبُ جُرَيْجٍ، وَكَانَ جُرَيْجٌ رَجُلًا عَابِدًا، فَاتَّخَذَ صَوْمَعَةً فَكَانَ فِيهَا، فَأَتَتْهُ أُمُّهُ وَهُوَ يُصَلِّي، فَقَالَتْ: يَا جُرَيْجُ، فَقَالَ: يَا رَبِّ أُمِّي وَصَلاتِي فَأَقْبَلَ عَلَى صَلاتِهِ فَانْصَرَفَتْ. فَلَمَّا كَانَ مِنَ الغَدِ أتَتْهُ وَهُوَ يُصَلِّي، فَقَالَتْ: يَا جُرَيْجُ، فَقَالَ: أيْ رَبِّ أمِّي وَصَلاتِي، فَأقْبَلَ عَلَى صَلاتِهِ، فَلَمَّا كَانَ مِنْ الغَدِ أتَتْهُ وَهُوَ يُصَلِّي، فَقَالَتْ: يَا جُرَيْجُ، فَقَالَ: أيْ رَبِّ أمِّي وَصَلاتِي، فَأقْبَلَ عَلَى صَلاَتِهِ، فَقَالَتْ: اللَّهُمَّ لاَ تُمِتْهُ حَتَّى يَنْظُرَ إِلَى وُجُوهِ المُومِسَاتِ. فَتَذَاكَرَ بَنُو إسْرائِيل جُرَيْجًا وَعِبَادَتَهُ، وَكَانَتِ امْرَأةٌ بَغِيٌّ يُتَمَثَّلُ بحُسْنِهَا، فَقَالَتْ: إنْ شِئْتُمْ لأَفْتِنَنَّهُ، فَتَعَرَّضَتْ لَهُ، فَلَمْ يَلْتَفِتْ إِلَيْهَا، فَأتَتْ رَاعِيًا كَانَ يَأوِي إِلَى صَوْمَعَتِهِ، فَأَمْكَنَتْهُ مِنْ نَفْسِهَا فَوقَعَ عَلَيْهَا، فَحَمَلَتْ، فَلَمَّا وَلَدَتْ، قَالَتْ: هُوَ مِنْ جُريج، فَأتَوْهُ فَاسْتَنْزَلُوهُ وَهَدَمُوا صَوْمَعَتَهُ، وَجَعَلُوا يَضْرِبُونَهُ، فَقَالَ: مَا شَأنُكُمْ؟ قَالُوا: زَنَيْتَ بهذِهِ البَغِيِّ فَوَلَدَتْ مِنْكَ. قَالَ: أيْنَ الصَّبيُّ؟ فَجَاؤُوا بِهِ فَقَالَ: دَعُوني حَتَّى أصَلِّي، فَصَلَّى فَلَمَّا انْصَرفَ أتَى الصَّبيَّ فَطَعنَ في بَطْنِهِ، وَقالَ: يَا غُلامُ مَنْ أبُوكَ؟ قَالَ: فُلانٌ الرَّاعِي، فَأَقْبَلُوا عَلَى جُرَيْجٍ يُقَبِّلُونَهُ وَيَتَمَسَّحُونَ بِهِ، وَقَالُوا: نَبْنِي لَكَ صَوْمَعَتَكَ مِنْ ذَهَب. قَالَ: لاَ، أعِيدُوهَا مِنْ طِينٍ كَمَا كَانَتْ، فَفَعلُوا. وبَينَا صَبِيٌّ يَرْضَعُ منْ أُمِّهِ فَمَرَّ رَجُلٌ رَاكِبٌ عَلَى دَابَّةٍ فَارِهَةٍ وَشَارَةٍ حَسَنَةٍ، فَقَالَتْ أُمُّهُ: اللَّهُمَّ اجْعَل ابْنِي مِثْلَ هَذَا، فَتَرَكَ الثَّدْيَ وَأقْبَلَ إِلَيْهِ فَنَظَرَ إِلَيْهِ، فَقَالَ: اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلْنِي مِثْلَهُ، ثُمَّ أقْبَلَ عَلَى ثَدْيه فَجَعَلَ يَرتَضِعُ»، فَكَأنِّي أنْظُرُ إِلَى رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - وَهُوَ يَحْكِي ارْتضَاعَهُ بِأصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ في فِيه، فَجَعَلَ يَمُصُّهَا، قَالَ: «وَمَرُّوا بِجَارِيَةٍ وَهُم يَضْرِبُونَهَا، ويَقُولُونَ: زَنَيْتِ سَرَقْتِ، وَهِيَ تَقُولُ: حَسْبِيَ اللهُ ونِعْمَ الوَكِيلُ. فَقَالَتْ أمُّهُ: اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَل ابْنِي مِثْلَهَا، فَتَركَ الرَّضَاعَ ونَظَرَ إِلَيْهَا، فَقَالَ: اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مثْلَهَا، فَهُنَالِكَ تَرَاجَعَا الحَديثَ، فَقَالَتْ: مَرَّ رَجُلٌ حَسَنُ الهَيْئَةِ، فَقُلْتُ: اللَّهُمَّ اجْعَلْ ابْنِي مِثْلَهُ، فَقُلْتَ: اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلْنِي مِثْلَهُ، وَمَرُّوا بهذِهِ الأمَةِ وَهُمْ يَضْرِبُونَهَا وَيَقُولُونَ: زَنَيْتِ سَرَقْتِ، فقلتُ: اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلِ ابْنِي مِثْلَهَا، فَقُلْتَ: اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِثْلَهَا؟! قَالَ: إنَّ ذلك الرَّجُل كَانَ جَبَّارًا، فَقُلْتُ: اللَّهُمَّ لا تَجْعَلْنِي مِثْلَهُ، وَإنَّ هذِهِ يَقُولُونَ: زَنَيْتِ، وَلَمْ تَزْنِ وَسَرقْتِ، وَلَمْ تَسْرِقْ، فَقُلْتُ: اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِثْلَهَا» (1) مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2) [ص:106]
«المُومسَاتُ» بِضَمِّ الميمِ الأُولَى، وَإسكان الواو وكسر الميم الثانية وبالسين المهملة؛ وهُنَّ الزَّواني. وَالمُومِسَةُ: الزَّانِيَةُ. وقوله: «دَابَّةٌ فَارِهَةٌ» بِالفَاءِ: أي حَاذِقَةٌ نَفيسةٌ. «وَالشَّارَةُ» بالشين المعجمة وتخفيف الرَّاءِ: وَهيَ الجَمَالُ الظَّاهِرُ في الهَيْئَةِ والمَلبَسِ. ومعنى «تَراجَعَا الحَديث» أي: حَدَّثت الصبي وحَدَّثها، والله أعلم.
হাদীস নং: ২৬০
ভূমিকা অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ অধ্যায়ঃ ৩৩

ইয়াতীম, কন্যাসন্তান, সর্বপ্রকার দুর্বল, গরীব-মিসকীন ও দুস্থ লোকদের প্রতি সদয় আচরণ,
তাদের প্রতি অনুগ্রহ ও মায়া-মমতা প্রদর্শন এবং তাদের সঙ্গে নম্র-কোমল আচরণ প্রসঙ্গ

ইয়াতীম, মিসকীন, দুস্থ ও দুর্বল শ্রেণীর লোক সমাজেরই অংশ। একটি পূর্ণাঙ্গ ও সুষ্ঠু সমাজ গঠনের লক্ষ্যে তাদেরকে বৃহত্তর সমাজের করে রাখা এবং সমাজনির্মাণে তাদেরকেও ভূমিকা রাখার সুযোগ দান করা জরুরি। এটা জরুরি কেবল দুনিয়াবী শান্তি-শৃঙ্খলার জন্যই নয়, তারচে'ও বেশি আখেরাতের নাজাত ও মুক্তির জন্য।
বলাবাহুল্য, এ দায়িত্ব বর্তায় সমাজের সচ্ছল ও সামর্থ্যবান অংশের উপর। তাদেরই কর্তব্য এদের মৌলিক অধিকারসমূহ সংরক্ষণের পাশাপাশি তাদের জীবনরক্ষা ও মানবিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর সুবন্দোবস্ত করে দেওয়া। এ কর্তব্য পালনের উদ্যোগ কেবল তখনই গ্রহণ করা যায়, যখন অন্তরে তাদের প্রতি দয়ামায়া, সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। তাই ইসলাম বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে মানুষের অন্তরে এসব গুণ সঞ্চারের চেষ্টা করেছে। ইসলামী শিক্ষায় এর এতবেশি গুরুত্ব যে, পরিপূর্ণ মুমিন ও মুসলিম হওয়ার জন্য এসব গুণ অর্জনকে অপরিহার্য করা হয়েছে এবং একে অতি বড় ছাওয়াবের বিষয় বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ইয়াতীম ও বিধবা প্রভৃতির সাহায্য-সহযোগিতা করাকে জান্নাত লাভেরও একটি উপায় বলা হয়েছে। মোটকথা এরকম অসহায় শ্রেণীর প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা ও তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা আমাদের মহান দীনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক আমল। যেমন কুরআন মাজীদ, তেমনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছসমগ্র এ সম্পর্কিত শিক্ষায় ভরপুর।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে।
প্রকাশ থাকে যে, ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ের শিরোনামে ‘কন্যাসন্তান’-এর কথাও উল্লেখ করেছেন। তাদেরকে ইয়াতীম, বিধবা প্রমুখের সারিতে উল্লেখ করা কারণ একশ্রেণীর মানুষ কন্যাসন্তানকে যথার্থ মর্যাদা দেয় না। তাদেরকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে। তাদের লালন-পালনে পুত্রসন্তানের মত গুরুত্ব দেয় না। জাহিলী যুগে তো তাদেরকে মানুষরূপেই গণ্য করা হত না । সে জাহিলিয়াত এখনও পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। তাই আজও বহুলাংশে তাদেরকে অবহেলা করা হয়ে থাকে। সে হিসেবেই তাদেরকে দুর্বল শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। না হয় ইসলামী শিক্ষায় তারা দুর্বল ও অবহেলিত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত নয়। মাতৃজাতির অংশ হিসেবে ইসলামে তাদের অনেক গুরুত্ব। গুরুত্ব দিয়েই তাদের প্রতিপালন করা উচিত। তাই এ অধ্যায়ে তাদের প্রতিপালনের ফযীলত সম্পর্কেও হাদীছ উদ্ধৃত হয়েছে।

ইয়াতীম, কন্যাসন্তান..এর প্রতি নম্র-কোমল আচরণ সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত

وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ

অর্থ : ‘আর যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য তোমার (বাৎসল্যের) ডানা নামিয়ে দাও ।২৭১

ব্যাখ্যা

অর্থাৎ আপনি অহংকারী দুনিয়াদারদের জন্য অতবেশি চিন্তা করবেন না। তাদের কাছে সত্যদীন পৌঁছানোর দায়িত্ব আপনি পালন করেছেন। এখন আপনার কর্তব্য যারা আপনার ডাকে সাড়া দিয়ে ঈমান এনেছে এবং কাফের-মুশরিকদের পক্ষ থেকে নানারকম জুলুম-নির্যাতন ভোগ করেছে, তাদের দিকে লক্ষ করা। তারাই আপনার স্নেহ-মমতা লাভের বেশি হকদার। সুতরাং তাদের প্রতি নম্র-কোমল আচরণ করতে থাকুন।
جَنَاح অর্থ ডানা অর্থাৎ পাখির ডানা। পাখিরা যখন তাদের ছানাদের আদর-সোহাগ করে বা শত্রু থেকে রক্ষার চেষ্টা করে, তখন প্রথমে ডানা ছড়িয়ে দেয়, তারপর ছানারা তাদের ডানার নিচে চলে আসলে তাদের উপর ডানা নামিয়ে দেয়। তাই রূপক অর্থে ডানা নামানো দ্বারা আশ্রয়দান ও আদর-সোহাগ করা বোঝানো হয়ে থাকে। এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাহাবায়ে কেরামের প্রতি সে আচরণেরই হুকুম করা হচ্ছে। পূর্ণ আয়াতটি এরূপ-

لَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْهُمْ وَلَا تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ (88)

‘আমি তাদের (অর্থাৎ কাফেরদের) বিভিন্ন লোককে মজা লোটার যে উপকরণ দিয়েছি, তুমি তার দিকে চোখ তুলে তাকিও না এবং তাদের প্রতি মনোক্ষুণ্ণ হয়ো না। আর যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য তোমার (বাৎসল্যের) ডানা নামিয়ে দাও।'
এ আয়াতে প্রথমে কাফের-মুশরিকদেরকে ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার যে ধন-দৌলত ও শান-শওকত দেওয়া হয়েছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সেদিকে তাকাতে নিষেধ করা হয়েছে। তা নিষেধ করা হয়েছে এ কারণে যে, তাকে এরচে আরও বড় ঐশ্বর্য দান করা হয়েছে, আর তা হচ্ছে মহান কুরআন ও সূরা ফাতিহা। যেমন এর পূর্বের আয়াতে বর্ণিত হয়েছে-

وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا مِنَ الْمَثَانِي وَالْقُرْآنَ الْعَظِيمَ (87)

‘আমি তোমাকে এমন সাতটি আয়াত দিয়েছি, যা বারবার পড়া হয় এবং দিয়েছি মর্যাদাপূর্ণ কুরআন।২৭২
অধিকাংশ মুফাস্সিরের মতে সাত আয়াত দ্বারা সূরা ফাতিহা বোঝানো উদ্দেশ্য । মর্যাদাপূর্ণ কুরআনও সূরা ফাতিহাকেই বলা হয়েছে। সূরা ফাতিহাকে ‘মর্যাদাপূর্ণ কুরআন' নামে অভিহিত করার কারণ এ সূরাটি সমগ্র কুরআনের সারসংক্ষেপ। সূরা বাকারা থেকে সূরা নাস পর্যন্ত গোটা কুরআন যেন এ সূরারই ব্যাখ্যা। তো বলা হচ্ছে- আপনাকে যখন সূরা ফাতিহার মত মহা মর্যাদাপূর্ণ সম্পদ দান করা হয়েছে, তখন আর অন্যকিছুর দিকে ফিরে তাকানো আপনার জন্য শোভনীয় নয়। কাফের-মুশরিকদেরকে যে সম্পদ দেওয়া হয়েছে তা কেবল ক্ষণস্থায়ীই নয়; ফিতনাও বটে। তাদেরকে এসব দেওয়া হয়েছে পার্থিব জীবনে তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। দীন ও ঈমানের সম্পদ যাদের নেই, ধন-দৌলত তাদের জন্য শাস্তিই বটে। এটা যেমন জীবনের আরাম হারাম করে দেয়, তেমনি আখলাক-চরিত্রও ধ্বংস করে। সুতরাং ওদিকে না তাকিয়ে এবং যারা সত্য বোঝা সত্ত্বেও তা পরিহার করে ওই ক্ষণস্থায়ী সম্পদের মোহে মত্ত হয়ে আছে, তাদের জন্য অতবেশি দুঃখ না করে ওইসকল মুমিনদের প্রতি নম্র-কোমল মনোযোগ ধরে রাখুন, যারা সকল জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে আপনার ও কুরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এটাই আপনার মহান দায়িত্বের সঙ্গে বেশি সঙ্গতিপূর্ণ।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মূলত এ নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশ করা হয়েছে বাড়তি তাকিদস্বরূপ। মূলত এর মধ্যে তাঁর উম্মত ও অনুসারীদের জন্য এই হিদায়াত রয়েছে যে, তারা যেন সম্পদশালীদের অর্থবিত্তের দিকে নজর না দেয়। তাদেরও কর্তব্য নিজেদেরকে দীনের খেদমতের জন্য নিবেদিত রাখা এবং দীনের নিসবতে (সূত্রে) আপন আপন সম্পৃক্তজনদের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করা।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাওয়ার পর কোনও সম্পদশালীর অর্থবিত্তকে তারচে' উত্তম মনে করে, প্রকৃতপক্ষে সে মহামূল্যবান সম্পদকে তুচ্ছ এবং তুচ্ছ সম্পদকে মহামূল্যবান সাব্যস্ত করল।

এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

لا تَغْبَطَنَّ فَاجِرًا بِنِعْمَةٍ، إِنَّ لَهُ عِنْدَ اللهِ قَائِلًا لَا يَمُوتُ

‘কোনও পাপিষ্ঠের ঐশ্বর্য দেখে ঈর্ষা করো না। কেননা আল্লাহ তাআলার কাছে তার এমন ঘাতক আছে, যার মৃত্যু নেই।২৭৩
ওয়াহাব ইবন মুনাব্বিহ রহ. এ হাদীছটি শোনার পর আবু দাউদ আল আ'ওয়ার রহ.-কে হাদীছটির বর্ণনাকারী ইবন আবী মারয়াম রহ.-এর কাছে পাঠালেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে সেই ঘাতক, যার মৃত্যু নেই? তিনি বললেন, জাহান্নামের আগুন।
উল্লেখ্য, সাহাবায়ে কেরামের অধিকাংশই ছিলেন গরীব। কাজেই তাদের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মমত্বপূর্ণ আচরণের নির্দেশদান দ্বারা পরোক্ষভাবে উম্মতকে হুকুম করা হচ্ছে তারা যেন গরীব ও অসহায় শ্রেণীর প্রতি সদয় আচরণ করে।

দুই নং আয়াত

وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا

অর্থ : ‘ধৈর্য-স্থৈর্যের সাথে নিজেকে সেইসকল লোকের সংসর্গে রাখ, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে এ কারণে ডাকে যে, তারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায় তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।২৭৪

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ধৈর্যসহকারে তাঁর গরীব ও দুস্থ সাহাবীদের সঙ্গে থাকতে বলা হয়েছে। আয়াতে তাদের বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে যে, তারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে। সকাল ও সন্ধ্যা দিবারাত্রের মূল অংশ। এ মূল অংশ বলে গোটা দিন-রাত বোঝানো হয়েছে। কাজেই এর অর্থ হচ্ছে, তারা সর্বদাই আল্লাহ তাআলাকে ডাকে। তাদের অন্তরে আল্লাহ তাআলার স্মরণ সর্বদা জাগ্রত থাকে। ফলে যখন যেই কাজ করে, আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেক করে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুনিয়াবী কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলেও অন্তর থাকে আল্লাহর অভিমুখী।
অথবা আয়াতে সুনির্দিষ্টভাবে সকাল ও সন্ধ্যাই বোঝানো হয়েছে। এই দুই সময় মানুষের কাজের ব্যস্ততা থাকে বেশি। তো এই ব্যস্ততাকালেই যখন তারা আল্লাহ তাআলাকে ডাকে এবং তাঁর থেকে গাফেল হয় না, তখন অন্যান্য সময় যে তাঁকে আরও বেশি ডাকবে এটাই স্বাভাবিক।
সেইসঙ্গে আয়াতে জানানো হয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহ তাআলাকে ডাকতেন ও তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করতেন পূর্ণ ইখলাসের সঙ্গে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কেবলই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভ, পার্থিব কোনও স্বার্থ নয়।
তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হুকুম করা হয়েছে তিনি যেন এই গরীব সাহাবীদের থেকে চোখ সরিয়ে অবস্থাসম্পন্ন কুরায়শ নেতৃবর্গের দিকে নজর না দেন। কেননা তাদের সামনে সত্য পরিষ্কার হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও তারা তা মানছে না; হঠকারিতাপূর্ণ আচরণ করছে। কাজেই তাদের ঈমানের কোনও আশা নেই। এ অবস্থায় তাদের দিকে বেশি তাকানোর অর্থ হবে অর্থবিত্ত ও দুনিয়াবী শান- শওকতের কারণে তাদেরকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, যা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়। সুতরাং তাদের দিকে না তাকিয়ে এই গরীব সাহাবীদের প্রতি মনোনিবেশ করুন ও তাদের ব্যক্তিগঠনের কাজে লেগে থাকুন।
উল্লেখ্য, এর আগের অধ্যায়ে হুবহু এ আয়াতটি গত হয়েছে। সেখানে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আগ্রহী পাঠক তা দেখে নিতে পারেন।

তিন নং আয়াত

فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ (9) وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ (10)

অর্থ : ‘সুতরাং যে ইয়াতীম, তুমি তার প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করো না। এবং যে সওয়াল করে, তাকে দাবড়ি দিও না। ১২৭৫

ব্যাখ্যা

এ সূরার ৬ নং আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্মরণ করানো হয়েছে যে, তিনি একসময় ইয়াতীম ছিলেন। আমরা সবাই জানি তাঁর জন্মের আগেই তার পিতা আব্দুল্লাহর ইন্তিকাল হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং ইয়াতীম অবস্থা দাদা আব্দুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধানে তার লালন-পালন হয়েছিল। মাকেও হারিয়েছিলেন শৈশবেই। তখন তাঁর বয়স ছিল ৬ বছর। দাদা আব্দুল মুত্তালিবও তাঁর ৮ বছর বয়সকালে ইন্তিকাল করেন। তারপর তাঁর লালন-পালনের ভার পড়ে চাচা আবূ তালিবের উপর। আবূ তালিবও তেমন সচ্ছল ছিলেন না। কাজেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইয়াতীম অবস্থাটাও ছিল উপর্যুপরি কঠিন থেকে কঠিনতর। আবার ছিলেন গরীবও, যেমনটা এ সূরার ৮ম আয়াতে বলা হয়েছে। তো এক সময়কার ইয়াতীম পরবর্তীকালে নবুওয়াত লাভ করলেন। বরিত হলেন শ্রেষ্ঠতম নবীরূপে। নবুওয়াতী জীবনের শুরুটা কেটেছে মক্কার কাফেরদের ঘোর শত্রুতার মুখে। পরে ইয়াছরিবের আওস ও খাযরাজ গোত্র তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়। তিনি তাদের কাছে চলে যান। সেখানকার সমস্ত মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে। ইয়াছরিব পরিণত হয় সমগ্র পৃথিবীর দীন ও ঈমানের রাজধানীতে। অভিহিত হয় মদীনা মুনাউওয়ারা নামে। পবিত্র মদীনার আনসারগণ তাঁর আত্মনিবেদিত সেবক। মক্কার ইয়াতীম ও গরীব বালককে আল্লাহ তাআলা এভাবেই পবিত্র মদীনায় এনে এমন ঠাঁই-ই দান করলেন যে, এখানকার জনগণ নিজেরাও তাঁর জন্য উৎসর্গিত এবং উৎসর্গিত তাদের যা-কিছু আছে সব। এভাবে আল্লাহ তা'আলা ইয়াতীম অবস্থা দূর করে তাঁকে দান করেন সুপ্রতিষ্ঠা এবং অর্থাভাব দূর করে দান করেন ঐশ্বর্য, যদিও আমৃত্যু তিনি যুহদ ও কৃচ্ছ্রতার জীবনই যাপন করেছেন।
যেহেতু এক সময় তিনি ইয়াতীম ছিলেন এবং ছিলেন অভাবগ্রস্তও, তাই তার শোকর আদায়ার্থে তাঁকে আদেশ করা হয়েছে যেন ইয়াতীম ও গরীবদের প্রতি দুর্ব্যবহার না করে মমত্বপূর্ণ আচরণ করেন।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন রহমাতুল-লিল-আলামীন। তিনি স্বভাবতই গরীব-দুঃখী ও বিধবা-ইয়াতীমের প্রতি সদয় আচরণ করতেন। তা সত্ত্বেও তাঁকে এ আদেশ করা হয়েছে বিষয়টার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরোপের জন্য, যাতে তাঁর উম্মত এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অবহেলা না করে।
যারা কোনওকালে ইয়াতীম ও গরীব ছিল, তাদের কর্তব্য অতীতদিনের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতাবোধে উজ্জীবিত হওয়া এবং সে কৃতজ্ঞতার প্রকাশস্বরূপ ইয়াতীম ও গরীবদের প্রতি সহমর্মী থাকা। যারা অতীতে ইয়াতীম ও গরীব ছিল না, তাদেরও পিতা-মাতার আশ্রয়ে প্রতিপালিত হওয়া ও অভাবমুক্ত অবস্থায় বেড়ে ওঠার জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা কর্তব্য। সে শোকরের একটা অংশ এইও যে, তারা ইয়াতীম ও গরীবদের প্রতি সদা সহানুভূতিশীল থাকবে।
বস্তুত ইয়াতীম ও গরীবদের প্রতি সদয় আচরণ করা ঈমানেরও দাবি। যারা আখেরাত ও কর্মফল দিবসের উপর ঈমান রাখে না, তারাই এ শ্রেণীর দুর্বলদের প্রতি দুর্ব্যবহার করতে পারে, ঈমানদারগণ কিছুতেই নয়, যেমনটা পরবর্তী আয়াতসমূহ দ্বারা বোঝা যায়।

চার নং আয়াত

أَرَأَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ (1) فَذَلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ (2) وَلَا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ (3)

অর্থ : 'তুমি কি দেখেছ তাকে, যে দীন অস্বীকার করে? সে তো সে-ই, যে ইয়াতীমকে ধাক্কা দেয় এবং মিসকীনকে খাদ্য দানে উৎসাহ দেয় না।২৭৬

ব্যাখ্যা

এ আয়াতগুলো সূরা মা'উনের। এতে 'দীন' দ্বারা হয়তো কর্মফল বোঝানো হয়েছে, অথবা দীনে ইসলাম। বোঝানো হচ্ছে— এমন লোকও আছে, যে কর্মফল দিবস বিশ্বাস করে না। সে মনে করে বিচারদিবস বলতে কিছু নেই এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ভালোমন্দ কর্মের প্রতিফলও দেওয়া হবে না। পরের আয়াতদু'টিতে যে ইয়াতীমকে ধাক্কা দেওয়া ও মিসকীনকে খাদ্যদানে উৎসাহিত না করার কথা বলা হয়েছে তা তার সে অবিশ্বাসেরই ফল। কর্মফল ও বিচারদিবসে যার বিশ্বাস নেই সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এ স্বেচ্ছাচারিতারই পরিণাম যে, সে অসহায় ইয়াতীম বাচ্চাকে গলাধাক্কা দিতে দ্বিধাবোধ করে না। আর মিসকীনকে নিজে খাদ্য দেবে কি, অন্য কেউ দিক তাও সে কামনা করে না। এ নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা এমনসব লোকের অন্তরেই থাকতে পারে, যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না। সুতরাং যারা মুমিন এবং যারা আখেরাত আছে বলে বিশ্বাস করে, তাদের কিছুতেই এরকম চরিত্র থাকা উচিত নয়। তারা হবে ইয়াতীমের প্রতি সদয়। তারা মিসকীনকে নিজেও খাদ্যদান করবে, অন্যকেও খাদ্যদানে উৎসাহ দেবে।
দীন অর্থ যদি ইসলাম হয়ে থাকে, তবে আয়াতে বোঝানো হচ্ছে যে, এমন লোকও আছে, যে দীন-ধর্ম মানে না। সত্যধর্ম ইসলামের উপর তার বিশ্বাস নেই। জানা কথা যে, সব যুগেরই মূল ধর্ম ছিল ইসলামই। সে হিসেবে সব ধর্মেই উন্নত আখলাক- চরিত্রের শিক্ষা ছিল। এখনও পুরোনো আসমানী ধর্মসমূহের ধর্মীয় গ্রন্থে সচ্চরিত্রের শিক্ষা পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও এমন লোকও আছে, যারা আসমানী ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করা সত্ত্বেও মানুষের প্রতি উন্নত আখলাক-চরিত্রের পরিচয় দেয় না। না ইয়াতীমের প্রতি সদ্ব্যবহার করে, আর না ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে। কাজেই এরা যে ধর্মেরই দাবিদার হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তারা কোনও ধর্মই মানে না। এ অবস্থার যারা ইসলাম ধর্মের সত্যতা স্বীকার করে না, তাদের মধ্যে উন্নত আখলাক-চরিত্রের অস্তিত্ব থাকবে বলে কিভাবে আশা করা যায়? যারা ইসলামের প্রকৃত অনুসারী, তাদের মধ্যে আগেও উন্নত চরিত্র ছিল, এখনও আছে। যাদের মধ্যে এর ঘাটতি আছে, মূলত তারা পূর্ণাঙ্গ মুসলিম নয়। সুতরাং যারা মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ইয়াতীমের প্রতি দুর্ব্যবহার করে বা গরীব-মিসকীনকে খাদ্যদানে কুণ্ঠিত থাকে, তাদের আত্মসমালোচনা করা উচিত। তাদের কর্তব্য পরিপূর্ণ মুসলিম হয়ে ওঠার জন্য এ জাতীয় আচরণ পরিহার করা এবং সমাজের দুর্বল শ্রেণীর প্রতি সহমর্মী হয়ে থাকা।

২৭১. সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৮৮

২৭২. সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৮৭

২৭৩. বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪২২২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪১০৩; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৪০৬৭

২৭৪. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ২৮

২৭৫. সূরা দুহা (৯৩), আয়াত ৯-১০

২৭৬, সূরা মা'উন (১০৭), আয়াত ১-৩
মুশরিকদের পক্ষ থেকে দুর্বল মুসলিমদের তাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব ও সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
হাদীছ নং : ২৬০

হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে আমরা ছয়জন লোক ছিলাম। মুশরিকগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলল, আপনি এদেরকে তাড়িয়ে দিন, যাতে তারা আমাদের উপর স্পর্ধা না দেখাতে পারে। (তাঁর সঙ্গে) ছিলাম আমি, ইবনে মাসউদ, হুযাইল গোত্রের এক ব্যক্তি, বিলাল এবং অপর দুই ব্যক্তি যাদের নাম আমি বলতে পারছি না। (তাদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় যা উদয় হওয়ার তা উদয় হল । তিনি আপন মনে (তা নিয়ে) ভাবলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেন-
وَلَا تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ
(যারা তাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সকাল ও সন্ধ্যায় তাকে ডাকে, তাদেরকে তুমি তাড়িয়ে দিও না -সূরা আনআম : ৫২) - মুসলিম।
সহীহ মুসিলম, হাদীছ নং ২৪১৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬৫৭৩; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৮১৮০
مقدمة الامام النووي
33 - باب ملاطفة اليتيم والبنات وسائر الضعفة والمساكين والمنكسرين والإحسان إليهم والشفقة عليهم والتواضع معهم وخفض الجناح لهم

قَالَ الله تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ} [الحجر: 88]، وَقالَ تَعَالَى: {وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا} [الكهف: 28]، وَقالَ تَعَالَى: {فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلا تَقْهَرْ وَأَمَّا السَّائِلَ فَلا تَنْهَرْ} [الضحى: 9 - 10]، وَقالَ تَعَالَى: {أَرَأَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ فَذَلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ وَلا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ} [الماعون: 6].
260 - وعن سعد بن أَبي وَقَّاص - رضي الله عنه - قَالَ: كُنَّا مَعَ النَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - سِتَّةَ نَفَرٍ، فَقَالَ المُشْرِكُونَ للنَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم: اطْرُدْ هؤلاء لا يَجْتَرِئُونَ عَلَيْنَا، وَكُنْتُ أنَا وَابْنُ مَسْعُودٍ. وَرَجُلٌ مِنْ هُذَيْلٍ وَبِلالٌ وَرَجُلاَنِ لَسْتُ أُسَمِّيهِمَا، فَوَقَعَ في نفس رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - مَا شَاءَ اللهُ أَنْ يَقَعَ فَحَدَّثَ نَفسَهُ، فَأنْزَلَ اللهُ تعالى: {وَلا تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ} [الأنعام: 52] رواه مسلم. (1)