সাহাবারা সত্যের মাপকাঠি নন! মুওদুদী মতবাদ। পর্ব–১
সাহাবারা সত্যের মাপকাঠি নন! মুওদুদী মতবাদ। পর্ব–১
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছোঁয়া পেয়ে যাঁরা ধন্য তাঁরাই হলেন সাহাবা রা.। তাঁরা তাদের জিবন সাজিয়েছেন রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গুনাবলী দিয়ে। মুসলিম উম্মাহ যদি সাহাবাদের মতো অটল-মজবুত ঈমান বানাতে পারে, তাহলে তারা নিশ্চিত হেদায়েতপ্রাপ্ত হওয়ার ঘোষণা খোদ আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই দিয়েছেন।
মওদুদী কী বলে?
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা জনাব মওদুদী সাহাবায়ে কেরাম রা.-কে সত্যের মাপকাঠি মানতে কোনও ক্রমেই রাজি নয়। তার প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর সংবিধানে লিখেছে,
رسول خدا کے سوا کسی انسان کو معیار حق نہ بنائے کسی کو تنقید سے بالاتر نہ سمجھے
আল্লাহর রাসুল ছাড়া অন্য কাউকে সত্যের মাপকাঠি বানাবে না এবং সমালোচনার ঊর্ধ্বে মনে করবে না। –দস্তুরে জামাতে ইসলামী, পৃ. ৭
উক্ত বক্তব্যে জনাব মওদুদী বলেছে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া কাউকে হকের মাপকাঠি মানা যাবে না।
ইসলাম কী বলে?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক ঘোষিত নাজাতপ্রাপ্ত দল তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকিদা হলো, الصحابة كلهم عدول অর্থাৎ -সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম রা. সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ, সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর ঈমানের প্রশংসা আল্লাহ নিজেই করেছেন। মহান রব্ব বলেন,
وَلَٰكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ ۚ أُولَٰئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ
কিন্তু আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের ভালোবাসা সঞ্চার করেছেন এবং তাকে তোমাদের অন্তরে করে দিয়েছেন আকর্ষণীয়। আর তোমাদের কাছে কুফর, গুনাহ ও অবাধ্যতাকে ঘৃণ্য বানিয়ে দিয়েছেন। ৪ এরূপ লোকেরাই সঠিক পথপ্রাপ্ত হয়েছে। –সুরা হুজুরাত : ৭
উক্ত আয়াত থেকে জানতে পারলাম, সাহাবাদের কাছে সবচেয়ে দামী ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের নাম ছিলো ‘ঈমান’। এজন্য সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর ঈমান হিদায়াতের মাপকাঠি হিশাবে খোদ আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন। নিন্মে কয়েতটি আয়াত ও হাদিস পেশ করা হলো–
এক. মহান রব্ব বলেন,
فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنتُم بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوا ۖ وَّإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ ۖ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ ۚ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
অতঃপর তারাও যদি সে রকম ঈমান আনে, যেমন তোমরা ঈমান এনেছো, তবে তারা সঠিক পথ (হিদায়াহ) পেয়ে যাবে। আর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা মূলত শত্রুতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে। সুতরাং শীঘ্রই আল্লাহ তোমার সাহায্যার্থে তাদের দেখে নেবেন এবং তিনি সকল কথা শোনেন ও সবকিছু জানেন। –সুরা বাকারা : ১৩৭
উক্ত আয়াতে ‘তোমাদের মতো ঈমান’ বলতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামকেই রা. বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এ আয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর ঈমানকে উম্মতের জন্য আদর্শ ঈমান ও সত্যের মাপকাঠি সাব্যস্ত করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত ঈমান হচ্ছে সে-ই ঈমান, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রা. অবলম্বন করেছিলেন। সে ঈমান ও বিশ্বাস থেকে যদি কেউ সামান্য চুল পরিমাণও বিচ্ছিন্ন হয়, তাহলে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং উক্ত আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত যে, সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর মতো যারাই ঈমান আনবে, তারা-ই হেদায়েতপ্রাপ্ত।
দুই. এছাড়াও সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর পথ হিদায়াতের পথ হওয়ায়, সে পথে অবিচল থাকার দুআ শিখিয়েছেন আল্লাহ নিজেই। মহান রব্ব বলেন,
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ
আমাদের সরল পথে পরিচালিত করো, সেই সকল লোকের পথে, যাদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছো। –সুরা ফাতিহা : ৬-৭
উপরিউক্ত আয়াতে হিদায়াতের রাস্তা বা সিরাতে মুস্তাকিম হিশাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের রাস্তাকে। সে রাস্তা কোনটা? এর ব্যাখ্যায় মহান রব্ব বলেন,
فَأُولَٰئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ ۚ وَحَسُنَ أُولَٰئِكَ رَفِيقًا
যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, অর্থাৎ নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সালিহগণের সঙ্গে। কতই না উত্তম সঙ্গী তারা! –সুরা নিসা : ৬৯
উক্ত আয়াতে প্রথমত, সিদ্দিকদের পথ অবলম্বন করার কথা বলা হয়েছে। আর সিদ্দিক হলো তারা, যারা নবীর দাওয়াত পাওয়া মাত্র বিনাবাক্যে মেনে নেয়, কোনও রকম গড়িমসি করে না ও কালক্ষেপণ করে না। নিশ্চয় এই গুনাদর্শ সর্বপ্রথম একমাত্র সাহাবায়ে কেরাম রা.-এরই ছিলো।
দ্বিতীয়ত, শহীদদের পথকেও হিদায়াদের পথ হিশাবে বলা হয়েছে, আর সাহাবায়ে কেরাম রা. শাহাদাতের জন্য সর্বদা পাগলপাড়া ছিলেন। অজস্র সাহাবায়ে কেরাম রা. শহীদও হয়েছিলেন। বাকিরাও শাহাদাতের তামান্নায় মরিয়া ছিলেন৷
তৃতীয়ত, নেককারদের পথকে হিদায়াতের পথ বলা হয়েছে। আর সকল সাহাবা যে নেককার ছিলেন, এ ব্যাপারে তো কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। সুতরাং বোঝা গেলো, সাহাবাদের পথ হিদায়াতের পথ, সিরাতে মুস্তাকিমের পথ।
তিন. এছাড়া অতীতে যারা সাহাবাদের ঈমানের পথকে অপছন্দ করেছিলো, তাদের বিরুদ্ধে রাগান্বিত ভাষায় মহান রব্ব বলেন,
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُوا كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاءُ ۗ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاءُ وَلَٰكِن لَّا يَعْلَمُونَ
যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরাও সেই রকম ঈমান আনো, যেমন অন্য লোকে ঈমান এনেছে। তখন তারা বলে, আমরাও কি সেই রকম ঈমান আনবো, যে রকম ঈমান এনেছে নির্বোধ লোকেরা? জেনে রেখো, এরাই নির্বোধ, কিন্তু তারা তা জানে না। –সুরা বাকারা : ১৩
চার. আরও কঠিন ভাষায় সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত জানিয়ে মহান রব বলেন,
وَمَن يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
আর যে ব্যক্তি তার সামনে হিদায়াত স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করবে ও মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য কোনও পথ অনুসরণ করবে, আমি তাকে সেই পথেই ছেড়ে দেবো, যা সে অবলম্বন করেছে। আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো, যা অতি মন্দ ঠিকানা। –সুরা নিসা : ১১৫
উক্ত আয়াতে "وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ এবং যে মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য কোনও পথ অনুসরণ করবে’’ বলে সাহাবাদের পথকে বুঝানো হয়েছে। কারণ, আমরা জানি সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ট মুসলিম হলেন সাহাবায়ে কেরাম রা.। সুতরাং উক্ত আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, যারা সাহাবায়ে কেরামের রা. মত ও পথ যারা মানবে না, তাদের শেষ পরিনতি কুফরি ও জাহান্নাম।
পাঁচ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِي مَا أَتَى عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ حَتَّى إِنْ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ أَتَى أُمَّهُ عَلاَنِيَةً لَكَانَ فِي أُمَّتِي مَنْ يَصْنَعُ ذَلِكَ وَإِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي
বনী ইসরাঈলের যে অবস্থা এসেছিলো, আমার উম্মতও ঠিক তাদেরই অবস্থায় পতিত হবে। এমনকি তাদের কেউ যদি প্রকাশ্যে তার মার সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে থাকে, তবে আমার উম্মতেরও কেউ তাতে লিপ্ত হবে। বনী ইসরাঈল তো বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে, আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে তিহাত্তর দলে। এদের একটি দল ছাড়া সব দলই হবে জাহান্নামী। সাহাবায়ে কেরাম রা. জিজ্ঞাসা করলেন–হে আল্লাহর রাসূল, এরা কোন দল? তিনি বললেন, আমি এবং আমার সাহাবীরা যার উপর প্রতিষ্ঠিত। –জামে তিরমিযি, হাদিস নং : ২৬৪১
উক্ত হাদিসে হিদায়াতের রাস্তা বা জান্নাতের পথ হিশাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পথ এবং সাহাবাদের পথকেও বলা হয়েছে। কারণ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পথ সেটাই ছিলো, যেটা রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পথ ছিলো।
ছয়. হযরত ইরবায ইবনু সারিয়াহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ
তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে তারা অচিরেই প্রচুর মতবিরোধ দেখবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাহগণের সুন্নাত অনুসরণ করবে, তা দাঁত দিয়ে কামড়ে আঁকড়ে থাকবে। –কিতাবুস সুন্নাহ, হাদিস নং : ৪৬০৭
এই হাদিসেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত মানার পাশাপাশি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খোলাফায়ে রাশেদীন সাহাবীদেরকেও মানার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনা থেকে জানতে পারলাম, সাহাবায়ে কেরাম রা. হকের মাপকাঠি। কুরআন এবং সুন্নাহ দ্বারা এটাই চূড়ান্ত। আর জনাব মওদুদী যে বক্তব্য দিয়েছে, তা সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী।
সরল কথা
যারা সাহাবায়ে কেরাম রা.-কে সত্যের মাপকাঠি মানে না, তাদেরকে যদি আপনি প্রশ্ন করেন–নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী সত্যের মাপকাঠি? তারা বলবে, অবশ্যই। আবার প্রশ্ন করুন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কীভাবে সত্যের মাপকাঠি হলেন? তখন তারা জবাবে বলবে–কারন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও সত্য থেকে বিচ্যুৎ হননি। তখন আপনি আবার প্রশ্ন করুন, সাহাবায়ে কেরাম রা. কখনও সত্য থেকে বিচ্যুৎ হয়েছিলেন কী? তারা বলবে, নিশ্চয় না। এবার তাকে সাফ জানিয়ে দিন–সত্য থেকে বিচ্যুৎ না হওয়ার কারণে যদি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্যের মাপকাঠি হতে পারেন, তাহলে সাহাবায়ে কেরামও সত্যের মাপকাঠি।