প্রবন্ধ
ইসলাম কী বিকৃত হয়ে গেছে? হেযবুত তওহীদ। পর্ব–৩৪
ইসলাম ধর্ম একটি চুড়ান্ত ও শ্বাস্বত, চিরন্তন ধর্ম। যা কিয়ামতের আগ পর্যন্ত অবিকৃত থাকবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এ ইসলাম থেকে জাতিকে বিমুখ করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। কেউ মধ্যযুগীয় বলে ইসলামকে মানুষ থেকে দুরে রাখার চেষ্টা করছে, আবার কেউ একে বর্বর ধর্ম বলে আধুনিক মানুষদের মগজ ধোলাই করতে ব্যস্ত।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তারা 'প্রচলিত ইসলাম বিকৃত হয়ে গেছে' বলে জনসাধারণকে মুরতাদ বানানোর গভীর ষড়যন্ত্র করছে। চলুন ইসলাম সম্পর্কে তাদের কয়েকটা জঘন্য উক্তি নিন্মে দেখে নেওয়া যাক।
ক. প্রচলিত ইসলাম বিকৃত : তারা লিখেছে,
ধর্মব্যবসায়ী কর্তৃক কায়েম করে রাখা বিকৃত এই ধর্মকে দেখে অনেকে আল্লাহ স্রষ্টাকে গালি দেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে ধর্ম মানুষকে শান্তি দিতে পারে না, আরো অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দেয় তা নিঃসন্দেহে মহাপ্রভু আল্লাহর দেওয়া ধর্ম নয়, সেটা অবশ্যই বিকৃত। -মহাসত্যের আহ্বান : পৃ. ১০০
গত ১৩০০ বছর ধোরে রসুলাল্লাহর আনীত দীন বিকৃত হোতে হোতে এখন যেটা এসলাম হিসাবে দুনিয়াময় পালিত হোচ্ছে সেটার সঙ্গে প্রকৃত এসলামের বাহ্যিক কিছু সাদৃশ্য ছাড়া কোন মিলই নেই; ভিতরে, আত্মায়, চরিত্রে সেটা প্রকৃত এসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত। -আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা : পৃ. ২৩
খ. আলেমরা ইসলাম বিকৃত করেছে : তারা লিখেছে,
দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো, আজ সেই প্রচণ্ড গতিশীল আকাশের মত উদার সমুদ্রের মতো বিশাল সহজ-সরল ইসলাম ধর্ম ব্যবসায়ী মোল্লাদের খপ্পরে পড়ে সেটা আজ মসজিদ, মাদ্রাসা আর খানকার চার দেয়ালে বন্দী এবং দাড়ি-টুপি, জোব্বা ইত্যাদিতে আবদ্ধ হয়ে স্থবির, অন্তর্মুখী, বিকৃত ও মরা। আর এই বিকৃত ইসলামটাকেই তারা বিক্রি করে খাচ্ছে। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ১৪৬
গ. প্রচলিত ইসলাম আসল ইসলাম নয় : তারা লিখেছে,
বর্তমানে আমরা যে ধর্মটিকে এসলাম হিসাবে দেখছি,যেটাকে ধর্মপ্রাণ মানুষষ অতি যত্নসহকারে পালন করার চেষ্টা কোরছেন, যে এসলামটাকে সর্বত্র স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় ও পীরের খানকায় শেখানো হোচ্ছে সেটা প্রকৃত এসলাম নয়। -এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ৯
ঘ. প্রচলিত ইসলাম ভুল ইসলাম : তারা লিখেছে,
যে এসলাম চোলছে পৃথিবীতে এটা ভুল। এটা সেই এসলাম নয়। –আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা, পৃ. ৫৪
সত্তরের দশকে এসে আমার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হোয়ে গেল। এভাবে চোলতে চোলতে সত্তরের দশকে এসে আমার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হোয়ে গেল যে, বর্তমানে যে এসলাম চোলছে এটা শুধু যে আল্লাহর এসলাম নয় তাই নয়, তার বিপরীত একটা কিছু। আর এটা - যেটা আমার সামনে একটা Configuration (রূপ, আকৃতি) দাঁড়ালো, এটা সত্য ইসলাম। -আল্লাহর মোজেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা : পৃ. ৫৪-৫৬
ঙ. প্রচলিত ইসলামকে আসল ইসলাম মনে করা ধোকা : তারা লিখেছে,
বর্তমানে যেটাকে এসলাম হিসাবে সর্বত্র মানা হোচ্ছে এবং শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হোচ্ছে সেটাকে এসলাম হিসাবে বিশ্বাস করা আর তিক্ত মাকাল ফলকে সুমিষ্ট আম বোলে বিশ্বাস করার মতই নির্বুদ্ধিতা। অথচ এই বিকৃত বিপরীতমুখী এসলামটিকেই ধর্মব্যবসায়ী আলেম, মোল্লা, পীর, মাশায়েখ শ্রেণী বিক্রি কোরে খাচ্ছে। এটা আল্লাহর দেওয়া এসলাম নয় তাই এর অনুসারীরাও মোসলেম নয়। -এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ৭৫
চ. প্রচলিত ইসলাম মৃত ইসলাম : তারা লিখেছে,
এই ধর্মের পণ্ডিতদের, আলেমদের কাছে দীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নামাজ, রোজা, দাড়ি, তারাবি, টুপি, টাখনু, মিলাদ, মেসওয়াক ইত্যাদি আর জেহাদ একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। এজন্য তাদের এই ইসলাম একটি মৃত, আল্লাহর রসুলের ইসলামের বিপরীতমুখী ধর্ম। -সওমের উদ্দেশ্য : পৃ. ১৫
ইসলামের এ দেহটি তো বহুদিনের মরা,পঁচা, গলে যাওয়া একটি শবদেহ। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ : পৃ. ৬১
কালেমার এই ভুল অর্থ ইসলামের রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে দিয়েছে যার স্বাভাবিক ফল হয়েছে ইসলামের দেহটির মৃত্যু,ক্ষয় ও পচন। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ : পৃ. ৬১
ছ. প্রচলিত ইসলাম দুর্গন্ধময় : তারা লিখেছে,
মরক্কো থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত ইসলামের এই বিশাল বিস্তৃত দেহটি আজ মরা ও দুর্গন্ধময়। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ : পৃ. ৬০
জ. প্রচলিত ইসলাম কঙ্কাল : তারা লিখেছে,
প্রকৃত এসলাম বিকৃত হোতে হোতে এখন আর বিকৃতত কঙ্কালটি ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। -আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা : পৃ. ৯
উল্লেখিত লেখা গুলো থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, হেযবুত তওহীদ প্রচলিত ইসলাম ধর্মকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দিতে একদমই নারাজ, বরং তাদের দাবি অনুযায়ী বর্তমানের প্রচলিত ইসলাম আসল ইসলাম নয়, বরং এটা ভুল ও বিকৃত ইসলাম। আরও কতো জঘন্য ও নোংড়া বাক্য ব্যবহার করেছে, যা আপনারা দেখলেন। তো চলুন, তাদের এ কথাগুলো সম্পর্কে একটু যাচাই করা যাক।
ইসলাম কী বলে?
এক. তাদের এসকল দাবি সর্বৈব মিথ্যা। কারণ আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন ইরশাদ ফরমান,
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ
বস্তুত এ উপদেশ বাণী (কুরআন) আমিই অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর রক্ষাকর্তা। –সুরা হিজর : ৯
উক্ত আয়াতে যেহেতু মহান রব কুরআন হিফাযতের দায়িত্ব নিজে নিয়েছেন, সেহেতু কুরআনের শব্দ ও মর্ম উভয়টি হিফাযত তিনি নিজে করবেন। আর কুরআন ও তার মর্ম (সুন্নাহ) হলো শরীয়াতে ইসলামী। সেটাও তিনি হিফাযত করবেন। এটাও তাঁর ওয়াদার অংশ। কারণ শরীয়াতে ইসলামি বিকৃত হয়ে গেলে কুরআন অবিকৃত থাকার কোনো অর্থ থাকে না। এজন্য এ আয়াতটির ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট তাবেয়ী ও তাফসীর বিশারদ হাসান বসরী রহ. বলেন,
قَالَ الْحَسَن: حِفْظُهُ بِابْقَاء شريعته الي يوم القيامة.
অর্থাৎ হাসান রহ. বলেন, কুরআন হেফাযতের অর্থ হলো শরীয়তে ইসলামীকে কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণের মাধ্যমে হিফাযত করা। -আল-বাহরুল মুহীত : খ. ৬ পৃ. ৪৬৮
সুতরাং এ আয়াত মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতি মতো তিনি এ শরীয়াতে ইসলামকেও সংরক্ষণ করবেন। আল্লাহ যেহেতু অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না, তাই সর্ব যুগেই এ ইসলাম অবিকৃত অবস্থায় সংরক্ষিত থাকবে। পন্নী ও হেযবুত তওহীদের উক্ত ধারণা কুরআনের এ আয়াতের সম্পূর্ণ বিপরীত ।
একটা প্রশ্ন : হ্যাঁ, যদি তারা বলে, কুরআন শুধু শব্দের নাম, অর্থ বা মর্মের নাম নয়। সুতরাং আল্লাহ-র ওয়াদা মোতাবেক তিনি শব্দ সংরক্ষণ করবেন, মর্ম নয়।
জবাব : এটা অযৌক্তিক একটি কথা। শব্দ ও অর্থ বা মর্ম উভয়টার নামই কুরআন। কারণ কুরআনের শব্দ দিয়েই 'মর্ম' বুঝানো হয়ে থাকে। সেই মর্মই যদি ঠিক না থাকে, তাহলে শব্দ ঠিক রাখার কোনো অর্থ থাকে না। সুতরাং বুঝা গেলো, কুরআন হিফাযতের অর্থ হলো, শরীয়াতে ইসলামিকে হিফাযত করা। এটা কেউ বিকৃত করতে পারে না।
হযরত মুআবিয়া রা.থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
وَلَنْ يَزَالَ أَمْرُ هَذِهِ الأُمَّةِ مُسْتَقِيمًا حَتى تَقُومَ السَّاعَةُ
এ উম্মতের দ্বীন ও শরীয়ত কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত থাকবে। -সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৭৩১২
হযরত আবু হুরায়রা ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তাঁরা উভয়ে বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
يَحْمِلُ هَذَا الْعِلْمَ مِنْ كُلِّ خَلَفٍ عُدُولُهُ، يَنْفُونَ عَنْهُ تَحرِيفَ الْغَالِينَ، وَانْتِحَالَ الْمُبْطِلِينَ، وَتَأْوِيلَ الْجَاهِلِينَ
পূর্বসূরীদের কাছ থেকে প্রত্যেক পরবর্তী একটি নির্ভরযোগ্য জামায়াত এ ইলম ধারণ করতে থাকবে তারা চরমপন্থীদের বিকৃতি, বাতিলের অপমিশ্রণ ও মূর্খদের অপব্যাখ্যা খণ্ডন করে দ্বীনকে স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত রাখবে। -তারিখে দিমাশক : খ. ৭ পৃ. ৩৯
এ হাদিস সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, সর্বযুগের বিকৃতিকারীদের হাত থেকে ইসলামকে হিফাযত করার জন্য আল্লাহপাক একদল নির্ভরযোগ্য আলেমদের তৈরি করবেন। তাঁরা ন্যায়সঙ্গতভাবে ইসলাম বিকৃতি থেকে হিফাযত করবেন।
দুই. কোনো মতবাদ বা ধর্ম বিকৃত হতে হলে সর্বপ্রথম সেটার সংবিধান বা মূলগ্রন্থ বিকৃত হতে হয়। যেমন হেযবুত তওহীদের এমাম নিজেই দাবি করেছেন যে, আগের ধর্মগুলো বিকৃত হয়েছিল তাদের ধর্মগ্রন্থ বিকৃত হওয়ার মাধ্যমেই। তারা লিখছে,
আল্লাহ সকল জনগোষ্ঠী ও জনপদে ধর্মগ্রন্থ দিয়ে নবী-রাসূলদের কে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তাদের বিদায়ের পর তাঁর শিক্ষা ও ধর্ম গ্রন্থ বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। ফলে ঐ এলাকার মানুষকে নতুন করে পথ দেখাতে আবির্ভূত হয়েছেন অন্য নবী। যারা পূর্বের বিকৃত গ্রন্থ কে রদ ঘোষনা করেছেন এবং নতুন বিধান জাতিকে প্রদান করেছেন। –শোষণের হাতিয়ার, পৃ. ৭১
অর্থাৎ আগের ধর্মগুলো বিকৃত হওয়ার কারণ হিসাবে পেশ করা হয়েছে, তাদের ধর্মগ্রন্থগুলো বিকৃত হওয়া। এ কথার অর্থ এই দাঁড়ালো যে, যে ধর্মের ধর্মগ্রন্থ বিকৃত, সে ধর্ম বিকৃত, ঠিক এমনিভাবে, যে ধর্মের ধর্মগ্রন্থ অবিকৃত, সে ধর্মও অবিকৃত। এই হিশাবে বুঝা গেলো, ধর্ম বিকৃত হতে হলে আগে ধর্মগ্রন্থ বিকৃত হতে হবে। তেমনি ইসলাম বিকৃত হতে হলেও কুরআন-সুন্নাহ বিকৃত হতে হবে। অর্থাৎ কুরআন-হাদিস যদি বিকৃত হয়, তাহলে ইসলাম বিকৃত হবে, অন্যথায় নয়। আর কুরআন হাদিস যদি অবিকৃত হয়, তাহলে ইসলামও অবিকৃত। তাহলে চলুন, ইসলাম ধর্মের মূলগ্রন্থ 'কুরআন' সম্পর্কে তারা কী লিখেছে দেখা যাক। তারা লিখেছে,
পৃথিবীতে এসলাম ধর্ম ছাড়া অন্যান্য যে ধর্মগুলি রয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই কোন না কোন নবীর (আ:) অনুসারী। তারা তাদের নবীর দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। মোসলেম নামধারী এ জাতিও তাদের নবীর দেখানো, রেখে যাওয়া পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। যতখানি পথভ্রষ্টতা বিবৃতি আসলে পূর্বে আল্লাহ নতুন নবী পাঠিয়েছেন, এই জাতিতে ততখানি বিকৃত বহু পূর্বেই এসে গেছে। এরপরও নতুন নবী আসেননি, কারণ নবুয়াত শেষ হয়ে গেছে এবং শেষ রসূলের (দ:) প্রতিষ্ঠিত পথে প্রকৃত এসলামে আবার ফিরে যাওয়ার জন্য অবিকৃত কোর’আন ও রাসুলের হাদিস আছে যা অন্যান্য ধর্মে নেই। –শোষণের হাতিয়ার, পৃ. ৮৪-৮৫
তাদের দাবি হলো, প্রকৃত ইসলামে ফিরে যেতে অবিকৃত কুরআন-হাদিস রয়েছে। তার মানে তারাও বিশ্বাস করে থাকে, কুরআন-হাদিস বিকৃত হয়নি। তাহলে হেযবুত তওহীদের দাবি অনুযায়ী যদি বিষয়টি এমনই হয় যে, ইসলামের মৌলিক সংবিধান কুরআন-হাদিসে ‘আসল ইসলাম কেমন’ সেটা ঠিকঠাক লেখা থাকে, তাহলে এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, কুরআন-হাদিস আজও অবিকৃত। আর কুরআন-হাদিস যদি এখনও অবিকৃতই থেকে থাকে, তাহলে ইসলাম বিকৃত হলো কীভাবে?
তিন. উপরন্তু যেহেতু পন্নী সাহেব নিজেও কুরআন ও হাদিস থেকে ইসলামের বাস্তব রুপ জেনেছেন এবং বিশ্বাসও করেছেন। তার অর্থ হলো, ইসলামের মূল ধর্মগ্রন্থ আজও অবিকৃত রয়েছে। সুতরাং ইসলামের ধর্মগ্রন্থ যেহেতু অবিকৃত, অতএব ইসলাম ধর্মও অবিকৃত।
আরেকটি প্রশ্ন : হয়তো তারা বলতে পারেন, শুধু কুরআন বিকৃত হয় নি, হাদিসও বিকৃত হয়েছে। তাহলে বিষয়টি আরো ক্লিয়ার হতে আমাদের জানতে হবে শরীয়ত কাকে বলে? এটা জানতে আমরা হেযবুত তওহীদের বই থেকেই দেখি কী বলে তারা? তারা লিখেছে,
শরিয়াহ হোল সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগত জীবন পরিচালনার জন্য নিয়ম-পদ্ধতি আইন-কানুন, দন্ডবিধি, অর্থনীতি ইত্যাদি। অর্থাৎ মানব জীবন পরিচালনার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই শরীয়া'র অন্তর্ভুক্ত। –দাজ্জাল, পৃ. ১৯
অর্থাৎ সার্বিক জিবন পরিচালনার জন্য আবিস্কৃত থিউরী বা নিয়ম-কানুনকে শরীয়ত বলে। এখন দেখতে হবে শরীয়তের এ কানুন কোথায় রয়েছে? হেযবুত তওহীদই লিখছে,
আল্লাহ পর্যায়ক্রমে মুসলিম জাতিকে তাদের ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সমস্যাদি যথা বিয়ে, তালাক, বিচার, দণ্ড,যুদ্ধ, সন্ধি, চুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য সব বিষয়ে এবং সেই জাতির শারীরিক মানসিক আত্মিক প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা বা আমলের হুকুম নাযিল করলেন। এভাবে ২৩ বছর ধরে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের উপর ঐক্যবদ্ধ একটা জাতির প্রতি প্রয়োজন সাপেক্ষে একে একে যে আদেশ,নিষেধ, উপদেশ, ভর্ৎসনা ইত্যাদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে সেগুলোর সংকলিত রূপই হচ্ছে পবিত্র কোর’আন। –হলি আর্টিজান এর পর, পৃ. ১২
তাদের কথা দ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম যে, ইসলামের সমস্ত বিধিবিধান লিপিবদ্ধ হয়েছে পবিত্র কুরআনে। এতএব শরীয়তের সমষ্টি হলো, পবিত্র আল-কুর’আন। যেহেতু তাদের কথানুযায়ী এ কুরআনে শরীয়তের সব বিষয় রয়েছে, সেহেতু এখন আমাদের দেখতে হবে কুরআন বিকৃত না অবিকৃত? যদি বিকৃত হয় তাহলে শরীয়ত (দ্বীন ইসলাম) বিকৃত। আর যদি কুরআন অবিকৃত হয় তাহলে শরীয়ত (ইসলামও) অবিকৃত। চলুন এব্যপারে তাদের ভাষ্য কি দেখা যাক। তারা লিখেছে,
সকল প্রাচীন, আঞ্চলিক দীনগুলিকে অনুপযুক্ত ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ ১৪০০ বছর আগে শেষ দীন এসলামের মহাগ্রন্থ আল কোর'আন নাযেল কোরলেন এবং এটা যেন কেউ বিকৃত না কোরতে পারে তার দায়িত্ব স্রষ্টা নিজেই নিলেন (সূরা/ হেজর ৯)। সেই মহাগ্রন্থ আজও অবিকৃত অবস্থায় আমাদের মধ্যে রোয়েছে। -এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব : পৃ. ৫৬
প্রিয় পাঠক, উক্ত কথা দ্বারা বুঝা গেল, তারাও বিশ্বাস করে যে, পবিত্র কুরআনকে কেউ বিকৃত করতে পারেনি। আর তাদের কথাই 'শরীয়াহ' তথা ইসলামের সমষ্টি হলো আল কুর'আন। সুতরাং তাদের কথা দিয়েই প্রমাণ হচ্ছে, 'শরীয়াতে ইসলামী' তথা দ্বীন ইসলাম আজও অবিকৃত।
চার. এরপরও যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে, ইসলাম বিকৃত হয়েই গেছে, তাহলে আমার প্রশ্ন হলো- যে ধর্মটি শত শত বছর ধরে বিকৃত হয়ে গেছে, সেটার বাস্তব রুপ কেমন ছিলো সেটা ১৪০০ বছর পর এসে পন্নী সাহেব বুঝলেন কিভাবে? নবিজি সাঃ-এর ধর্মটি কেমন ছিল তিনি দেখলেন বা জানলেন কিভাবে? তখন তারা হয়তো জবাব দেবেন যে, আল্লাহ পন্নী সাহেবকে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন। যিনি নবি বা রাসুল নন, এমন কেউ যদি এমন অবান্তর দাবি করে, আর সেটাই যদি বিশ্বাস করে নিতে হয়, তাহলে আজ পর্যন্ত অনেকেই নিজেকে নবি বা মাহদী আ. বলে দাবী করে বসেছেন, তাহলে তাদের দাবিও কী সত্য হিসাবে মেনে নিতে হবে? অথচ সবাই তো আল্লাহ'র রেফারেন্স দিয়েই কথা বলে থাকে। যেখানে কারো মুখে পেয়াজ-রসুনের দুর্গন্ধের কারণে তার কাছে ফিরিস্তারা আসেন না, সেখানে আল্লাহ এক মহাবিড়িখোরকে এ মহান কাজের জন্য সিলেক্ট করলেন? কী হাস্যকর! কী হাস্যকর! এ ধরণের মিথ্যুকদের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا ۚ أُولَٰئِكَ يُعْرَضُونَ عَلَىٰ رَبِّهِمْ وَيَقُولُ الْأَشْهَادُ هَٰؤُلَاءِ الَّذِينَ كَذَبُوا عَلَىٰ رَبِّهِمْ ۚ أَلَا لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ
সেই ব্যক্তি অপেক্ষা বড় জালেম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়? এরূপ লোকদেরকে তাদের প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত করা হবে এবং সাক্ষ্যদাতাগণ বলবে, এরাই তারা, যারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি মিথ্যা আরোপ করত। ১৫ সকলে শুনে নিক, ওই জালেমদের উপর আল্লাহর লানত। –সুরা হুদ : ১৮
পাঁচ. উম্মতে মুসলিমাহ কী বলে? উপরন্তু সকল উম্মদের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত হলো, ইসলাম বিকৃত হয় নি। আর উম্মতের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তও ইসলামি শরীয়াতের দলীলের অন্তুর্ভূক্ত। পবিত্র হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ لَا يَجْمَعُ أُمَّتِي أَوْ قَالَ أُمَّةَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى ضَلَالَةٍ
আমার সকল উম্মতকে আল্লাহ তাআলা কখনও ভ্রান্ত (বিকৃত) বিষয়ের উপর ঐক্যবদ্ধ করবেন না। –জামে তিরমিযি, হাদিস নং : ২১৬৭
আমরা জানি নবিজি সাঃ-এর হাদিস ও আমলে ভিন্নতার কারণে উম্মতের আমলেও ভিন্নতা এসেছ এবং একেক মাযহাবের অনুসারিরা একেক হাদিসের উপর আমল করে যাচ্ছেন। ফলে বেশ কিছু বিষয়ে উম্মতের মধ্যে বাহ্যিকদৃষ্টিতে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও এ ব্যাপারে কিন্তু সবাই একমত যে, ইসলাম আজও আসল এবং অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে, বিকৃত হয় নি। অতএব নবিজির স: এ কথা যদি সত্য হয় অর্থাৎ 'উম্মতকে আল্লাহ তা'আলা কখনও ভ্রান্ত (বিকৃত) কোনো বিষয়ের উপর ঐক্যবদ্ধ করবেন না'। তাহলে এ কথা বলতেই হয় যে, যেহেতু সমস্ত উম্মত ইসলাম ধর্ম বিকৃত না হওয়ার কথার উপর একমত, অতএব ইসলাম ধর্ম অবিকৃত এবং তার আসল রুপেই আমাদের মাঝে আজও বিদ্যমান রয়েছে। অতএব সমস্ত মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে যারা ‘ইসলাম বিকৃত হয়ে গেছে’ ‘এটা ভুল ইসলাম’ ইত্যাদী বলে বক্তব্য দিচ্ছে তারা কি প্রকারান্তেই পরোক্ষভাবে নবিজি সাঃ কে মিথ্যুক বানানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে নি?
ছয়. বিকৃত হবেই যদি মুজাদ্দিদ কেন পাঠান? ইসলাম ধর্ম একটি চিরন্তন ও শ্বাস্বত ধর্ম। এই ধর্ম যেন বিকৃত না হয়, সেজন্য মহান রব প্রতি শতবছরে মুজাদ্দিদ প্রেরণ করেন। যিনি দ্বীনের সঞ্জীবিত করেন। হযরত আবু হুরাইরাহ রা. সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
اللَّهَ يَبْعَثُ لِهَذِهِ الأُمَّةِ عَلَى رَأْسِ كُلِّ مِائَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّدُ لَهَا دِينَهَا
নিশ্চয়ই আল্লাহ এই উম্মাতের জন্য প্রতি একশত বছরের শিরোভাগে এমন লোকের আর্বিভাব ঘটাবেন, যিনি এই উম্মাতের দ্বীনকে তার জন্য সঞ্জীবিত করবেন। -সুনানে আবু দাউদ : হাদিস নং : ৪২৯১
সুতরাং বুঝা গেলো, এই দ্বীন ইসলাম বিকৃত হওয়াে কোনো সুযোগই নেই। যদি বিকৃত হয়েই যায়, তাহলে মুজাদ্দিদ পাঠানোর কোনো অর্থ থাকে কী? এতো সহজ একটি বিষয় কে বুঝাবে হেযবুত তওহীদকে?
সাত. স্ববিরোধিতা : পাশাপাশি আরেকটি প্রশিদ্ধ বাক্য মনে পড়ে গেল, সত্য কখনও লুকিয়ে রাখা যায় না। চোর চুরি করলেও কিন্তু ভুলক্রমে নিশানা কিছু রেখে যায়। তেমনিই হয়েছে হেযবুত তওহীদের বেলায়ও । তারা তাদের চল্লিশোর্ধ্ব কিতাবের সবখানে ‘ইসলাম বিকৃতি হয়ে গেছে’ দাবী করলেও ভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে দুয়েক জায়গায় বলেই ফেলেছে,
আখেরী নবী মোহাম্মদ (দ:) এর উপর অবতীর্ণ এই সত্যদীন আল্লাহর সৃষ্টিজগতের মতই নিঁখুত ও অবিকৃত। আল্লাহর সৃষ্টি কেমন নিখুঁত,.... আল্লাহর দেওয়া সত্যদীনও এমনই নিখুঁত'। –আসুন সিস্টেমটাকে পাল্টাই, পৃ. ১৯-২০
মুক্তির পথ তো রসুল দেখিয়েই গেছেন আর শেষ বিধানও আল্লাহর দয়ায় অবিকৃত ছিল এবং আজও আছে। –ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে? পৃ. ৯
সমস্ত পৃথিবীর খবর আমার জানা নেই, কাজেই পৃথিবীর যে অংশে আমি বাস করি শুধু সেইটুকুর কথাই বলছি। এই দেশে শেষ ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বখতিয়ার খিলজীর তলোয়ারের শক্তিতে। উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশে হয়েছে শাহজালালের (র.) তলোয়ারে, যে তলোয়ার আজ উপেক্ষিত হয়ে পড়ে আছে। দক্ষিণ বাংলায় হয়েছে খান জাহান আলীর (র.) তলোয়ারে। উত্তর বাংলায় হয়েছে সুলতান মাহমুদ শাহী সওয়ারের (রা.) তলোয়ারের শক্তিতে, পশ্চিম বাংলায় হয়েছে শাহ সফী উদ্দিন (র.), শাহ সুলায়মান (র), সৈয়দ দেওয়ান চন্দন শহীদ (র.) ইত্যাদি অনেক মুজাহিদদের তলোয়ারের জোরে। –বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ, পৃ. ৪০
অর্থাৎ তারা নিজেরাই বলে ফেললো, যে, ইসলাম কখনই বিকৃত ছিলো না, আজও অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে এবং ১২-১৩ শতাব্দীর আউলিয়ায়ে কেরামকেও স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি তাদের প্রচারিত ইসলামকেও সঠিক ইসলাম বলে স্বীকার করে নিলো। সুতরাং বোঝা গেলো, এভাবেই সত্য প্রস্ফুটিত হয়, সত্যকে কখনও লুকিয়ে রাখা যায় না, ইসলাম ধর্ম যে অবিকৃত ছিলো এবং আছে, এটা আমাদের আর কোনো দলীল পেশ করা লাগবে না। কারণ হেযবুত তওহীদ নিজেরাই তাদের বইয়ে স্বীকার করে নিয়েছে যে, ‘ইসলাম অবিকৃত’ এরপরও যদি কেউ বলে ইসলাম ১৩০০ বছর আগেই বিকৃত হয়েছে, সে চরম মিথ্যুক ও বিকৃত মস্তিস্কের।
একদিকে তারা বলছে, প্রচলিত ইসলাম নিখুঁত ও অবিকৃত, আবার অন্যদিকে সেই ইসলামের বিরুদ্ধেই এত এত জঘণ্য উক্তি করার পরও তারা মুসলিম না মুরতাদ? পাঠক মহলই এর সমাধান দেবেন বলে আশা করি।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
মূর্তি ও ভাস্কর্য : যুগে যুগে শিরকের সর্ববৃহৎ প্রণোদনা
...
মূর্তি ও ভাস্কর্যপ্রীতি : ইসলাম কী বলে?
ইসলামের যে বিষয়গুলোর নিষিদ্ধতা অকাট্য ও মুতাওয়াতিরভাবে প্রমাণিত তার মধ্যে প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণ ...
ইসলামের মানদন্ডে পহেলা বৈশাখ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও বাংলাদেশের চিত্র
পহেলা বৈশাখ উদযাপন চিত্র: পহেলা বৈশাখ শুরু হয় ভোরে। সূর্যোদয়ের পর পর। মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় অবশ্য ...
কালিমার মর্মবাণী
কালিমায়ে তাওহীদ لا إله إلا الله محمد رسول الله প্রথম অংশ-তাওহীদে ইলাহী لا إله إلا الله (লা-ইলাহা ইল...
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন