প্রবন্ধ
নবী-রাসুলগণ ব্যার্থ ছিলেন! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–২৩
সকল নবীগণ আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব স্বীয় স্থানে পূর্ণভাবে পালন করেছেন। কেউ তাঁদের দায়িত্বে কোনো ত্রুটি রাখেননি। কোনো নবীই ব্যর্থ হননি। এটাই মুসলিমদের আকিদা। নবীদের শানে কোনও ধরণের প্রশ্ন তোলা ঈমান নষ্ট হওয়ার একটি কারণ। উপরন্তু যে যত বড় নেককার উম্মত হোক না কেন, কোনো নবীর সমমূল্য হতে পারেন না, সম্ভবও নয়। কারণ, নবীরা খোদ আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত নেককার বান্দা।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবী হলো, প্রায় সব নবীরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যার্থ হয়েছেন। এর কারণ হিশাবে তারা বলেছে,
পৃথিবীতে প্রচলিত সমস্ত রকম দীন অর্থাৎ জীবনব্যবস্থাকে পরাজিত করে বা শেষ করে দিয়ে একমাত্র আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা বা দীন ইসলাম প্রতিষ্ঠায়ই আল্লাহর লক্ষ্য এবং বিশ্ব নবীকে পাঠাবার উদ্দেশ্যই তাই। –শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ১২১
পূর্ববর্তী নবীদের যে কারণে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন তাঁর এই শেষ নবীকেও সেই একই উদ্দেশ্যে পাঠালেন- অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের জীবনে শান্তি, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁকে (সা.) নির্দেশ দিলেন- পৃথিবীতে যত রকম জীবনব্যবস্থা আছে সমস্তগুলোকে নিষ্ক্রিয়, বাতিল করে এই শেষ জীবনব্যবস্থা মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে (সুরা তওবা ৩৩, সুরা ফাতাহ ২৮, সুরা সফ ৯)। –বিকৃত সুফিবাদ, পৃ. ৯
অর্থাৎ তাদের দাবী হলো, সকল নবীদের দায়িত্ব ছিলো, বিশ্বময় যত ধর্ম আছে সব বিলুপ্ত করে আল্লাহ-র ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা। যেহেতু সব নবীরা তা পারেননি, সে জন্য সকল নবীরা ব্যার্থ। নাউযুবিল্লাহ। দেখুন তারা কী লিখেছে,
একদম মহাসত্য পেয়েও যেখানে নবী রাসূলদের মধ্যে অনেকে ব্যর্থ হোয়েছেন, পারেন নি, সেখানে আমি কে। আমি তো কেউ না, কিছুই না। কি হবে, কি হবে না – এই সংশয় আমার ২০০৮ সনের ফেব্রুয়ারীরর ২ তারিখ পর্যন্ত, পূর্ণভাবে ছিলো। যদিও সেটা আমাকে দমাতে পারেনি, এজন্য যে আমি চেষ্টা কোরে যাবো, নবী রাসূলরা পারেন নি, আর আমি কে? আমি চেষ্টা কোরে যাবো, মো’জেজার দিনটায় আল্লাহ আমার সব সংশয় অবসান কোরেছেন, জানিয়ে দিলেন নিজে যে- হবে, উনি কোরবেন, আমি না। তোমরাও না, আমিও না, কোরবেন আল্লাহ নিজে, He Himself, সবকিছুই আল্লাহর নিজের করা Actually, সব কিছুই। –আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা, পৃ. ৬৮
বি.দ্র. তাদের বইয়ে লেখা 'মোজেজার দিনটায় আল্লাহ আমার সব সংশয় অবসান কোরেছেন, জানিয়ে দিলেন নিজে যে, 'করো, হবে'। এখানে হেযবুত তওহীদ তাদের বইতে পন্নীর বক্তব্যটা লেখার সময় 'করো' শব্দটা কেটে দিয়েছে। কিন্তু 'করো' এ শব্দটা তার ভিডিওতে রয়েছে। -ভিডিও লিংক: https://youtu.be/Z2gSXhmYWsg
যাইহোক, উক্ত বক্তব্য দিয়ে পন্নী দুটি কথা বলতে চেয়েছে,
১. সকল নবীরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যার্থ ছিলেন!
২. নবীরা যা পারেননি, পন্নীকে দিয়ে আল্লাহ সেটা করাবেন বলে আল্লাহ তাআলা তাকে ওয়াদা দিয়েছেন!
ইসলাম কী বলে?
এক. চলুন প্রথমে নবীদের দায়িত্ব কী সে সম্পর্কে পবিত্র কুরআন থেকেই জেনে নেওয়া যাক। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
আমি তোমার পূর্বে এমন কোন রাসুল পাঠাইনি, যার প্রতি আমি এই ওহী নাযিল করিনি যে, ‘আমি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত করো। –সুরা আম্বিয়া : ২৫
এই তাওহীদের ডাক দেওয়াটাই ছিলো নবীদের দায়িত্ব। এ কথাটাও মহান রব বলে দিয়েছেন,
فَهَلْ عَلَى الرُّسُلِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ
কিন্তু স্পষ্টভাবে বার্তা পৌঁছানো ছাড়া রাসূলগণের আর কোন দায়িত্ব নেই। –সুরা নাহল : ৩৫
এছাড়া খোদ পন্নীই লিখেছে,
আল্লাহ যে তাঁর এক লাখ চব্বিশ হাজার, মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী রসুল (আ.) পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তার উদ্দেশ্য কী? একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে এমন একটা জীবন-বিধান, দীন দেয়া যেটা অনুসরণ করে। মানুষের জীবন পরিচালিত করলে মানুষ অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, ও রক্তপাতহীন, প্রগতিশীল একটা জীবনে বাস করতে পারে। এর প্রধান শর্ত হলো আল্লাহকে একমাত্র জীবন-বিধাতা বলে স্বীকার করে নেওয়া, একমাত্র প্রভু স্বীকার করা, (তওহীদ)। কারণ তা না করলে তার দেয়া জীবন বিধানকে একমাত্র জীবন-বিধান বলে স্বীকার করার প্রশ্ন আসে না। দ্বিতীয়ত, যার মাধ্যমে আল্লাহ ঐ বিধান পাঠালেন তাকে প্রেরিত রসুল বলে স্বীকার করা। –শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ১৩৩
সুতরাং বুঝা গেলো, আল্লাহ কর্তৃক নবীদের ওপর দায়িত্ব ছিলো, শুধুমাত্র দ্বীনের বাণী, তাওহীদের বাণী পৌঁছে দেওয়া। আর এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক নবীদেরকে চুড়ান্ত পর্যায়ের বিপদে পড়তে হয়েছে। কাউকে করাত দিয়ে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে, কাউকে আগুনে ফেলা হয়েছে, কাউকে দেশান্তরিত করা হয়েছে, কাউকে ফাঁসি দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। আর আমাদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্যাতন তো লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। সুতরাং বোঝা গেলো, আম্বিয়ায়ে কেরাম আ. তাঁদের দায়িত্ব পালনে কোনো ত্রুটি রাখেননি, এবং সবাই স্বীয় দায়িত্ব পালনে পরিপূর্ণভাবে নিরলস প্রচেষ্টা করে গেছেন। তাছাড়া পন্নী নিজেও অন্যত্র লিখেছে,
প্রত্যেক নবী তার উপরে দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন তার অনুসারীদের, তার উম্মার সাহায্যে। –বিকৃত সুফিবাদ, পৃ. ১০
যেহেতু জনাব পন্নী নিজেই যখন স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে আম্বিয়া কেরাম আ. তাঁদের দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন, সেখানে সফলতা কতটুকু সেটা তো নবীদের ব্যাপার নয়, বরং সফলতার একমাত্র রব্বের ব্যাপার। জনাব পন্নী লিখেছে,
প্রত্যেককে মনে রাখতে হবে যে, সংগ্রামই তার দায়িত্ব, সাফল্য নয়, কারণ সাফল্য ও ব্যর্থতা মানুষের হাতে নয়, সেটা আল্লাহর হাতে। –এসলামের প্রকৃত রূপরেখা, পৃ. ৬৪
সুতরাং এরপরও জনাব পন্নী কর্তৃক নবীদের ব্যার্থ বলা নবী-রাসুলগণের আ. রিসালাতের উপর মারাত্মক অপবাদ এবং তাঁদের অপমান ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ যে ব্যক্তি কোনো নবীকে হেয় প্রতিপন্ন করবে, সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফের। এ প্রসঙ্গে কাযী ইয়ায রহি. বলেন;
من استخف بنبينا محمد صلى الله عليه وسلم أو بأحد من الأنبياء عليهم الصلاة والسلام أو أزرى عليهم أو آذاهم أو قتل نبيا أو حاربه فهو كافر بإجماع
যে ব্যক্তি তাঁকে (অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে) অপমান করবে, কিংবা অন্য কোনও নবীকে অপমান করবে, কিংবা মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করবে, কিংবা তাদেরকে কষ্ট দিবে, কিংবা কোনও নবীকে হত্যা করবে, কিংবা কোনও নবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, সে ব্যক্তি সর্বসম্মতিক্রমে কাফের। –মানহুল জালীল, খ. ৯ পৃ. ৯৬
তাছাড়া নবী-রাসুলগণের দায়িত্ব কী ছিলো, সে সম্পর্কে হেযবুত তওহীদ আরও লিখেছে,
নবী-রসুলদের দায়িত্ব ছিল মানুষের সামনে ন্যায়-অন্যায় সত্য-মিথ্যা আলাদা করে দেওয়া। –ধর্মব্যবসার ফাঁদে, পৃ. ৩৯
আলহামদুলিল্লাহ। নবীরা আমাদের সত্য-মিথ্যা চেনার রূপরেখা দেখিয়ে গেছেন। আর সে কারণেই আমরা হেযবুত তওহীদকে কুফরী মতবাদ হিশেবে চিনতে পারছি।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলাম : বিভ্রান্তি নিরসনে মুসলমানদের যা জানা দরকার
...
শরীয়তের উপর অবিচলতা
...
ঝাড়ফুঁক-তাবীয : একটি দালীলিক বিশ্লেষণ (২য় পর্ব)
...
ঈমান সুরক্ষায় কুসংস্কার থেকে দূরে থাকুন!
আমাদের সমাজে সামাজিকতা ও নিয়মনীতি পালনের নামে বহু কুপ্রথা ও কুসংস্কার প্রচলন রয়েছে। শরীয়তে এগুলোর কো...
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন