প্রবন্ধ
আল্লাহ তাআলা প্রভুত্বের আসনে নেই : হেযবুত তওহীদ। পর্ব-১
মহান আল্লাহ নিজ ক্ষমতায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তাঁর ক্ষমতা সর্বসময়ের জন্য চিরস্থায়ী। কখনও সামান্য সময়ের জন্য তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন না। এটাই কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রতিয়মান চিরন্তন সত্য বিষয়।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
বাংলাদেশে গড়ে ওঠা নতুন উগ্রবাদী কুফরী দল হেযবুত তওহীদের অনেকগুলো মনগড়া ও বিভ্রান্তিকর বিশ্বাসের মধ্যে একটি হলো- ‘আল্লাহ তাআলা বর্তমানে তাঁর প্রভুত্বের আসনে নেই’। নাউযুবিল্লাহ। দেখুন তারা কী লিখেছে,
আজ সমস্ত পৃথিবীতে কোথাও স্রষ্টার, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নেই, মানবজাতির সমষ্টিগত জীবনে আজ মানুষেরই সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হোয়েছে। –দাজ্জাল, পৃ. ৯০
দাজ্জাল আল্লাহকে তার সার্বভৌমত্বের (উলুহিয়াতের) আসন থেকে চ্যুত কোরে নিজে সে আসনে বোসতে চায়। -দাজ্জাল : পৃ. ৯০
আজ সমস্ত পৃথিবীতে কোথাও স্রষ্টার, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নেই, মানবজাতির সমষ্টিগত জীবনে আজ মানুষেরই সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হোয়েছে, আর এটাই হোচ্ছে দাজ্জালের দাবী । রাজতন্ত্র (Monarchy), সমাজতন্ত্র (Socialism), গণতন্ত্র (Democracy), সাম্যবাদ (Communism), একনায়কতন্ত্র (Fascism) এগুলো সবই দাজ্জালের বিভিন্ন রূপ। -দাজ্জাল, পৃ. ৯০
একনায়কতন্ত্র ও সাম্যবাদের এই পরাজয়ের পর থেকে ধনতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক শক্তিই আজ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে সার্বভৌমত্বের অধিকারী এবং এই শক্তিই আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে পরাজিত কোরে নিজে প্রতিষ্ঠিত হোয়েছে। -দাজ্জাল, পৃ. ৯১
দাজ্জালের হাত থেকে পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব ছিনিয়ে নিয়ে আল্লাহর হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই সংগ্রাম করে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদ। -ধর্মবিশ্বাস, পৃ. ২০
সমস্ত পৃথিবী যার করতলগত সেই মহা শক্তিধর দাজ্জালকে হটিয়ে দিয়ে প্রভুত্বের আসনে আল্লাহ তায়ালাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার মতো আপাতঃ দৃষ্টিতে অসম্ভব কাজটি করার দায়িত্বে তোমরা (হেযবুত তওহীদ) নিজেদের নিয়োজিত করেছো। -আসমাঈ ওয়া আত্তাবেয়্যু, পৃ. ৬
অর্থাৎ তাদের দাবি হলো–
১. বর্তমানে আল্লাহপাক তাঁর প্রভুত্বের আসনে নেই।
২. আল্লাহকে হারিয়ে সার্বভৌমত্বের আসনে দাজ্জাল বসে আছে।
৩. আল্লাহ তাআলাকে তাঁর প্রভুত্বের আসন ফিরিয়ে দিতে হেযবুত তওহীদ দায়িত্ব নিয়েছে।
ইসলাম কী বলে?
তাদের উপরোক্ত বক্তব্যগুলোর বিষয়ে বুঝতে হলে, আগে আমাদের দু’টি বিষয় জানতে হবে।
ক. ‘প্রভুত্ব’ অর্থ কী?
খ. ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠিত’ অর্থ কী?
প্রভুত্ব অর্থ কী?
প্রভু আর প্রভুত্বের মাঝে বিস্তর তফাৎ আছে। যেহেতু এটা বাংলা শব্দ সেহেতু বাংলা অভিধান থেকে জেনে নেওয়া উচিৎ। চলুন কী লেখা আছে,
‘প্রভু’ অর্থ হলো- আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবান, মনিব, পূজনীয় সত্তা। আর ‘প্রভুত্ব’ অর্থ হলো- আল্লাহ তাআলার কর্তৃত্ব, আধিপত্য, প্রভুশক্তি, এক কথায় বলি আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা। -আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃ. ৮৭১
অর্থাৎ বাংলা অভিধান থেকে জানতে পারলাম, প্রভুত্ব মানে ক্ষমতা। তাহলে হেযবুত তওহীদের বক্তব্য অনুসারে বুঝা গেলো, আল্লাহ তাঁর প্রভুত্বের আসনে তথা নিজের ক্ষমতার আসনে এখন নেই। তাই তাঁকে পূনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
‘পুনঃপ্রতিষ্ঠিত’ অর্থ কী?
হেযবুত তওহীদের বইয়ে উল্ল্যেখিত ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠিত’ শব্দটির অর্থ হলো – কোনো জিনিস আগে প্রতিষ্ঠিত ছিলো, কিন্তু এখন নেই, ফলে পরবর্তীতে আবার প্রতিষ্ঠিত হলে, তাকেই বলে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত। যেমনঃ প্রচার-পুনঃপ্রচার, প্রবেশ – পুনঃপ্রবেশ। ঠিক তেমনি প্রতিষ্ঠিত – পুনঃপ্রতিষ্ঠিত। বাংলায় ‘পুনঃ’ শব্দটি, পুনরায়/দ্বিতীয়বার অর্থে ব্যবহারিত হয়’। -বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃ. ৮৩০
তাহলে তাদের বক্তব্য থেকে বুঝা গেলো, আল্লাহ পাক তাঁর ক্ষমতার আসনে আগে ছিলেন, কিন্তু এখন নেই। তাই পুনরায় সে আসনে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অথচ পবিত্র কুরআন মাজীদে অসংখ্য জায়গায় বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ পাকের ক্ষমতা চিরস্থায়ী। এ সম্পর্কে নিন্মে কয়েকটি আয়াত পেশ করা হলো। মহান রব বলেন,
اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ ۚ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ۚ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ
আল্লাহ তিনি, যিনি ছাড়া কোনও মাবুদ নেই, যিনি চিরঞ্জীব, (সমগ্র সৃষ্টির) নিয়ন্ত্রক, যাঁর কখনও তন্দ্রা পায় না এবং নিদ্রাও নয়, আকাশমণ্ডলে যা-কিছু আছে (তাও) এবং পৃথিবীতে যা-কিছু আছে (তাও) সব তাঁরই। -সুরা বাকারা : ২৫৫
প্রিয় পাঠক, এই আয়াতে যে ’القيوم’ (চিরনিয়ন্ত্রক) শব্দটি এসেছে, এর ব্যাখ্যায় সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
الَّذِي لَا يَحُولُ وَلَا يَزُولُ
যিনি পরিবর্তন বা বিলীন হন না। -তাফসীরে কুরতুবী, খ. ৪ পৃ. ২৬৮
অর্থাৎ القيوم শব্দের অর্থ হলো, সৃষ্টির তত্ত্বাবধান ও রক্ষনাবেক্ষনের জন্য যে সত্ত্বা অনাদি ও অনন্তকালব্যাপী বিরাজমান, আপন সত্তার জন্য যিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। সুতরাং বর্তমানে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আছেন, এমন দাবি করা কী কুফরি নয়?
তাছাড়া অপর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
মহিমাময় সেই সত্তা, যার হাতে গোটা রাজত্ব। তিনি সবকিছুর উপর পরিপূর্ণ শক্তিমান। -সুরা মুলক : ১
وَمَا مِن دَآبَّةٍ فِي الأَرْضِ إِلاَّ عَلَى اللّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ
ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোনও প্রাণী নেই, যার রিযক আল্লাহ নিজ দায়িত্বে রাখেননি। তিনি তাদের স্থায়ী ঠিকানাও জানেন এবং সাময়িক ঠিকানাও। সব কিছুই সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। -সুরা হুদ : ৬
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَن يَقُولَ لَهُ كُن فَيَكُونُ فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
তাঁর ব্যাপার তো এই যে, তিনি যখন কোনো কিছুর ইচ্ছা করেন, তখন কেবল বলেন, ‘হয়ে যাও’। অমনি তা হয়ে যায়। অতএব পবিত্র সেই সত্তা, যার হাতে প্রতিটি জিনিসের শাসন-ক্ষমতা এবং তাঁরই কাছে তোমাদের সকলকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। –সুরা ইয়াসিন : ৮২-৮৩
وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَيَخْتَارُ ۗ مَا كَانَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ ۚ سُبْحَانَ اللَّهِ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ
তোমার প্রতিপালক যা চান, তা সৃষ্টি করেন এবং (যা চান) বেছে নেন। তাদের কোনো এখতিয়ার নেই। আল্লাহ তাদের শিরক হতে পবিত্র ও সমুচ্চ। -সুরা কাসাস : ৬৮
فَعَّالٌ لِّمَا يُرِيدُ
যা-কিছু ইচ্ছা করেন, তা করে ফেলেন। –সুরা বুরুজ : ১৬
এই আয়াতগুলোর মাধ্যমেই প্রমাণিত হলো, আল্লাহ পাক যখন যা ইচ্ছা তাই করেন এবং করতে সক্ষম। যদি আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রভুত্ব তথা ক্ষমতার আসনে না থাকেন, তাহলে আল্লাহ যা ইচ্ছা তা সৃষ্টি করেন কীভাবে? সুতরাং আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা চিরস্থায়ী ও সর্বসময়ে চলমান। সাময়িক সময়ের জন্য আল্লাহ তাআলা ক্ষমতাবিহীন থাকবেন, এটা কল্পনা করাও অসম্ভব। সুতরাং আল্লাহর ক্ষমতা চিরস্থায়ী কেউ তাঁকে তাঁর ক্ষমতার আসন থেকে হটাতে পারে না। তাহলে মহান আল্লাহ নিজ আসনে, আপন হালতে বিদ্যমান থাকার পরও তাঁকে ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠিত’ করার তো প্রশ্নই আসে না! এমন বিশ্বাস যারা রাখে, তারা নিশ্চিত মুসলমান হতে পারে না।
হেযবুত তওহীদ কী আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দিতে চায়?
ক. উপরোল্লিখিত আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রভুত্ব তথা ক্ষমতার আসনে সর্বদার জন্য ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। তিনি যেহেতু তাঁর ক্ষমতার আসন থেকে সামান্য সময়ের জন্যও বিচ্যুৎ নন, সেহেতু হেযবুত তওহীদ সে আসন ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করছে বলে এ দাবিটা চরম উদ্ভব, বানোয়াট, মিথ্যা এবং আল্লাহপাকের নামে সর্বৈব মিথ্যাচার। এদের ব্যাপারেই মহান রব বলেন,
لَّعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ
যারা মিথ্যাবাদী, তাদের প্রতি আল্লাহর লানত পাঠাই। -সুরা আলে ইমরান : ৬১
খ. তাছাড়া হেযবতু তওহীদ তাদের বইয়ে সুস্পষ্টভাবে একটি দাবি করেছে যে, আল্লাহপাকের দিকে মানুষকে আহ্বান করা তাদের কাজই নয়। তারা লিখেছে,
আমরা বলি না যে, আপনারা আল্লাহ বিশ্বাসী হয়ে যান, মো’মেন হয়ে যান, পরকালে বিশ্বাসী হয়ে যান, আল্লাহর প্রতি কে ঈমান আনবে কে আনবে না সেটা তারা আল্লাহর সঙ্গে বুঝবে। সুতরাং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করানো আমাদের কাজ নয়। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৫২
এখন আপনারাই বলুন, যারা আল্লাহ-র প্রতি ঈমান আনতে কোনো মেহনতই নিজেদের কাজ মনে করে না, তারা ‘দাজ্জালকে হটিয়ে আল্লাহকে তাঁর সার্বভৌমত্বের আসন ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে’ বলে যে দাবি তারা করেছে, সেটা কী জলজ্যান্ত মিথ্যাচার নয়। আল্লাহর প্রতি ঈমানের মিশনই যাদের কাজ নয়, তারা কীভাবে হেযবুত তওহীদ নাম দিতে পারে? এটা কী উম্মাহর সাথে ধোকা নয়?
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ (৩য় পর্ব)
মানুষ যাতে তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ির স্বীকার না হয় সেজন্য তিনি নিজেও নিজের প্রকৃত অবস্থা স্পষ্ট করে দ...
আল্লামা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম দাঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
১৩৯৬ বার দেখা হয়েছে
খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ (৬ষ্ঠ পর্ব)
তাওরাত সম্পর্কে পৌলের অভিমত কিন্তু সেন্ট পৌলের অভিমত এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি তাওরাতকে একখানি বাতিল ...
আল্লামা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম দাঃ
৭ নভেম্বর, ২০২৪
৮৪৬ বার দেখা হয়েছে
প্রসঙ্গ মুয়াবিয়া রাজিআল্লাহু আনহুঃ সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কিত ইতিহাস পাঠের মূলনীতি
...
মুফতী লুৎফুর রহমান ফরায়েজী হাফি.
৯ নভেম্বর, ২০২৪
৪২৫১ বার দেখা হয়েছে
খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ (৭ম ও শেষ পর্ব)
খৃষ্টধর্ম কি কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী ধর্ম কোন ধর্মের দাওয়াত ও প্রচারের জন্য ধর্মের কার্যকরিতা জরুরি...
আল্লামা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম দাঃ
৭ নভেম্বর, ২০২৪
২০০১ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন