প্রবন্ধ

শরীয়তের উপর অবিচলতা

২০ জানুয়ারী, ২০২২
২০২১

ঈমান আনার পর আলল্লাহ পাকের পক্ষ হতে একজন মুমিনের উপর যত দায়িত্ব বর্তায়, তার মধ্যে একটি বড় দায়িত্ব হলো, পূর্ণ মানসিক শক্তি ও প্রশান্তির সঙ্গে দ্বীন ও শরীয়তের উপর অটল-অবিচল থাকা। সময় যত সঙ্গীন হোক, পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক, কোনো অবস্থাতেই দ্বীন ও শরীয়ত থেকে বিচ্যুত না হওয়া। এর নাম হলো ‘ইস্তেকামাত’। আল্লাহ পাক এমন লোকের প্রশংসায় ইরশাদ করেন,

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ. نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ .نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ

নিশ্চই যারা আন্তরিকভাবে স্বীকার করে, আল্লাহ আমাদের রব ও প্রতিপালক, অতঃপর এর দাবীর উপর অটল-অবিচল থাকে, তাদের নিকট একটি সময় ফেরেশতাদলের আগমন হবে। তারা বলবে, তোমরা শংকিত হয়ো না, দুঃখ করো না, বরং প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো এবং প্রফুল্ল থাকো। দুনিয়া ও আখেরাতের উভয় জীবনে আমরা তোমাদের সঙ্গী। আর তোমাদের কাংখিত ও প্রার্থিত সবকিছু তোমাদের জন্য জান্নাতে প্রস্তুত রয়েছে, পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল আল্লাহর পক্ষ হতে আতিথেয়তা স্বরূপ, যা চাবে যত চাবে তার সবই তোমাদের জন্য উপস্থিত থাকবে। সূরা হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩০-৩২

সুবহানাল্লাহ! শরীয়তের উপর অবিচল ব্যক্তিদের জন্য কত বড় সুসংবাদ! নিজের জানমাল সবকিছু কোরবান করেও যদি এই মর্তবা হাসিল করা যায়, তবে তাই হবে বড় সৌভাগ্যের বিষয়। হাদীস শরীফে এসেছে,

يَا رَسُولَ اللهِ، قُلْ لِي فِي الْإِسْلَامِ قَوْلًا لَا أَسْأَلُ عَنْهُ أَحَدًا بَعْدَكَ – وَفِي حَدِيثِ أَبِي أُسَامَةَ غَيْرَكَ – قَالَ: قُلْ: آمَنْتُ بِاللهِ، فَاسْتَقِمْ

এক সাহাবী নবীজীর কাছে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ উপদেশ দান করুন, যাতে আপনার পর আর কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন না হয়। নবীজী ইরশাদ করলেন, বলো, আমার রব আল্লাহ! এবার এই কথার দাবীর উপর অবিচল থাকো এবং তোমার বন্দেগী ও যিন্দেগী সেমতে গড়ে তোলো। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৮

আল্লাহ পাকের অনুগত বান্দারা বড় বড় প্রলোভন ও ভয় ভীতি উপেক্ষা করে দ্বীনের উপর অবিচল থাকেন। আল্লাহ তাআলা কোরআন শরীফে তাদের কিছু ঘটনা আমাদের হেদায়েতের জন্য উল্লেখ করেছেন। যেমন যাদুকরদের ঈমান আনার ঘটনা। ফেরআউন যাদেরকে মুসা আলাইহিস সালামের মোকাবেলার জন্য একত্রিত করেছিলো। তাদেরকে অনেক পুরস্কার ও সম্মানের ওয়াদা দিয়েছিল। কিন্তু যখন মুসা আলাইহিস সালামের দাওয়াতের সত্যতা তাদের সামনে খুলে গেলো, তখন তারা ফেরআউনের বড় বড় পুরস্কার দু’পায়ে দলে তার কঠিন শাস্তি থেকে সম্পূর্ণ বেপরোয়া হয়ে বলে উঠলো,

قَالُوا آمَنَّا بِرَبِّ هَارُونَ وَمُوسَى

হারুন ও মুসা যে পালনকর্তার ইবাদতের দাওয়াত দেয়, আমরা তাঁর উপর ঈমান আনলাম। সূরা ত্বহা ২০/৭০

এরপর যখন ফেরআউন তাদেরকে কঠোর শাস্তির কথা শোনালো, বিপরীত দিক থেকে হাত-পা কেটে শূলিতে চড়ানোর হুমকি দিলো, তখন তারা ঈমানী সাহস নিয়ে ফেরআউনের মুখের উপর বলে দিলো,

قَالُوا لَنْ نُؤْثِرَكَ عَلَى مَا جَاءَنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالَّذِي فَطَرَنَا فَاقْضِ مَا أَنْتَ قَاضٍ إِنَّمَا تَقْضِي هَذِهِ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا. إِنَّا آمَنَّا بِرَبِّنَا لِيَغْفِرَ لَنَا خَطَايَانَا

তোমার যা ইচ্ছে হুকুম দিতে পারো। (আল্লাহ না করুন) তোমার হুকুম তো শুধু এই দুনিয়াতে বাস্তবায়িত হতে পারে। (যদি হয়, তাতেও কিছু আসে যায় না) আমরা তো আমাদের প্রকৃত রবের উপর এই আশায় ঈমান এনেছি যে, পরকালে তিনি আমাদের গুনাহগুলি মাফ করে দেবেন। সূরা ত্বহা ২০/৭২-৭৩

খোদ ফেরআউনের স্ত্রীর ঘটনা আরও শিক্ষণীয়। ফেরআউন ছিলো মিশরের একচ্ছত্র অধিপতি! স্ত্রী আছিয়া ছিলো তার হৃদয়রাণী। এ-থেকেই আন্দাজ করা যায়, আছিয়া কত সুখ-সম্মান আর প্রতিপত্তির মালিক ছিলো! কিন্তু যখন মুসা আলাইহিস সালামের দাওয়াত তাঁর অন্তরে আলো দান করলো তখন তিনি নির্ভীক কণ্ঠে ঈমানের ঘোষণা দিয়ে দিলেন! একটুও বিচলিত হননি যে, পরিণামে তো রাজকীয় আরাম-আয়েশের এই জীবন তাকে ছেড়ে দিতে হবে। ফেরআউনের পাশবিক জুলুমনির্যাতনও তাকে সইতে হবে। অনন্তর এই মহিয়ষী নারী ফেরআউনের এমন সব নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করে ঈমানের উপর অবিচল ছিলেন, যা শুনলেও কলজে শুকিয়ে যায়। কোরআন শরীফে আললাহ পাক তাঁর ত্যাগ-তিতীক্ষাকে মুমিন নরনারীর জন্য আদর্শরূপে উল্লেখ করে ইরশাদ করেন,

وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِلَّذِينَ آمَنُوا امْرَأَتَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِنْدَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِنْ فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ

মুমিনদের জন্য ফেরআউনের স্ত্রী আছিয়ার ঘটনা আল্লাহ পাক উদাহরণরূপে উল্লেখ করছেন । (চরম নির্যাতনের সময়) তিনি শুধু এই দুআ করতেন যে, হে আমার প্রতিপালক আল্লাহ! জান্নাতে তোমার নিকটতম স্থানে আমার নিবাস বানিয়ে দাও। ফেরআউনের অনিষ্ট থেকে তুমি আমাকে হেফাজত করো, এই জালিম সম্প্রদায়ের জুলুম থেকে আমাকে তুমি মুক্তি দাও। সূরা তাহরীম ৬৬/১১

সুবহানাল্লাহ! কতবড় সৌভাগ্য! কত বড় মর্যাদা! পুরো উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য, হযরত আবু বকর থেকে নিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মুমিন নরনারীর জন্য হযরত আছিয়ার এস্তেকামত ও দৃঢ়তাকে আল্লাহ পাক আদর্শ স্থির করেছেন!

একবার মক্কার জীবনের সাহাবায়ে কেরাম নবীজীর কাছে আরজ করলেন,

أَلاَ تَدْعُو اللَّهَ لَنَا؟ قَالَ: كَانَ الرَّجُلُ فِيمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِي الأَرْضِ، فَيُجْعَلُ فِيهِ، فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الحَدِيدِ مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ

(হে আল্লাহর রাসুল! এই জালিমদের জুলুম সীমা ছাড়িয়ে গেছে।) এদের উপর বদ্দুআ করুন, অভিশাপ করুন। নবীজী বলেন, আহা! তোমরা এত তাড়াতাড়ি ভয় পেয়ে যাচ্ছো, অধৈর্য হয়ে পড়ছো! আগের কালের হকপন্থীদের সঙ্গে তো এ পর্যন্ত হয়েছে যে, গর্ত করে তাতে ঈমানদারকে আবক্ষ গেড়ে ফেলা হতো। এরপর লোহার চিরুনি দিয়ে মস্তক দ্বিখ-িত করে ফেলা হতো। তাদের হাড় থেকে গোশত আলাদা করে ফেলা হতো। কিন্তু এমন পাশবিক জুলুম সত্ত্বেও তারা দ্বীন থেকে পিছু হটতো না, ধৈর্যহারা হতো না। সহীহ বোখারী, হাদীস নং ৩৬১২

আল্লাহ পাক ঐ সকল মর্দে মুমিনের হিম্মত ও ইস্তেকামতের সামান্য অংশ আমাদের মতো কমজোরদেরও দান করুন, যদি ত্যাগের কোনো মুহূর্ত সামনে আসে, তাহলে তাদের পদাংক অনুসরণ করার শক্তি নসীব করুন, আমীন।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলাম : বিভ্রান্তি নিরসনে মুসলমানদের যা জানা দরকার

...

আল্লামা উবায়দুর রহমান খান নদভী
১০ নভেম্বর, ২০২৪
১০২৪০ বার দেখা হয়েছে

তাহাফফুযে খতমে নবুওত ও কাদিয়ানী সম্প্রদায়

...

মুফতী আবুল কাসেম নোমানী
৯ নভেম্বর, ২০২৪
২০৩০ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

বিবিধ

মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ দাঃ

শাইখ মুহাম্মাদ আওয়ামা

মাওলানা ইমদাদুল হক

আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.

মাওলানা মুহাম্মদ গিয়াসুদ্দীন হুসামী

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

মাওলানা মাহমুদ বিন ইমরান

আল্লামা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম দাঃ

মাওলানা ইনআমুল হাসান রহ.

মাওলানা যাইনুল আবিদীন

আবদুল্লাহ আল মাসউদ

শাইখুল ইসলাম আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.

মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

আল্লামা ইকবাল

হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান

মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

শাইখ আলী তানতাভী

মাওলানা আতাউল কারীম মাকসুদ