দুআ কবুল হওয়ার বিশেষ কিছু মুহূর্ত
প্রশ্নঃ ৮৮৪৬৫. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, কোন সময় দোয়া কবুল হয়? আর কি পড়লে দোয়া কবুল হয়
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
দুআ কবুল হওয়ার বিশেষ কিছু মুহূর্ত
প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটি কর্মে বান্দা আল্লাহর সাহায্যের মুখাপেক্ষী। তাঁর সাহায্য ছাড়া বান্দার কোনো কাজই সফলতার মুখ দেখে না। আর আল্লাহর মদদ ও সাহায্য লাভের বড় একটি মাধ্যম হল দুআ। দুআ করলে আল্লাহ তাআলা কবুল করেন। বান্দাকে সাহায্য করেন, প্রার্থিত বস্তু দান করেন। বান্দার আশা পূরণ করেন।
যদি রিযিক হালাল হয়, একাগ্রতার সাথে দুআ করা হয় এবং দুআ করার পর ফলাফলের জন্য তাড়াহুড়া না করা হয়, তাহলে আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তিনি অবশ্যই দুআ কবুল করবেন।
ইরশাদ হয়েছে-
وَ قَالَ رَبُّكُمُ ادْعُوْنِیْۤ اَسْتَجِبْ لَكُمْ اِنَّ الَّذِیْنَ یَسْتَكْبِرُوْنَ عَنْ عِبَادَتِیْ سَیَدْخُلُوْنَ جَهَنَّمَ دٰخِرِیْنَ.
তোমাদের প্রতিপালক বলেছেন, আমাকে ডাকো; আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয়ই অহংকারবশে যারা আমার ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। -সূরা মু’মিন (৪০) : ৬০
অন্যত্র ইরশাদ করেছেন-
وَ اِذَا سَاَلَكَ عِبَادِیْ عَنِّیْ فَاِنِّیْ قَرِیْبٌ اُجِیْبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ اِذَا دَعَانِ فَلْیَسْتَجِیْبُوْا لِیْ وَ لْیُؤْمِنُوْا بِیْ لَعَلَّهُمْ یَرْشُدُوْنَ.
(হে নবী!) আমার বান্দাগণ যখন আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন (আপনি তাদেরকে বলুন,) আমি তো নিকটেই। কেউ যখন আমাকে ডাকে, আমি তার ডাকে সাড়া দিই। সুতরাং তারাও আমার (আনুগত্যের) ডাকে সারা দিক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে এসে যায়। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৬
সুতরাং দুআ কবুল করার ব্যাপারে আল্লাহর ওয়াদা রয়েছে। এতে সময়, স্থান ও অবস্থার কোনো ভেদাভেদ নেই। বান্দা যে অবস্থায় এবং যে সময়ই বিনয়ের সাথে আল্লাহর দিকে রুজু হয় এবং কায়মনোবাক্যে তাঁর নিকট নিজের আরজি পেশ করে, আল্লাহ তাআলা তা শোনেন এবং কবুল করেন।
দুআ কবুলের এই প্রতিশ্রুতি দয়াময় আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহকে তিনি আরো বৃদ্ধি করেছেন- দিন-রাতের বিশেষ কিছু অংশকে সম্মানিত করেছেন এবং সে সময়গুলোতে দুআ কবুলের অতিরিক্ত আশ্বাস দিয়েছেন। ফলে এসব মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে আমরা আরো বেশি উপকৃত হতে পারি এবং আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে নিজের প্রয়োজন চেয়ে নিতে পারি।
দুআ কবুলের ১২টি সময়
দিন ও রাতের বিভিন্ন অংশে দুআ কবুলের কথা বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন-
এক. ফরয নামাযের শেষে
আবু উমামা রা. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করলাম-
يَا رَسُولَ اللهِ: أَيُّ الدُّعَاءِ أَسْمَعُ؟
হে আল্লাহর রাসূল! কোন্ সময়ের দুআ সবচেয়ে বেশি কবুল হয়?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন-
جَوْفَ اللَّيْلِ الآخِرَ، وَدُبُرَ الصَّلَوَاتِ الْمَكْتُوبَاتِ.
রাতের শেষ প্রহরে এবং ফরয নামাযের শেষে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৯৯; সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদীস ৯৮৫৬
এই হাদীস থেকে জানা যায়, দুই সময়ে দুআ অধিক কবুল হয়। একটি হল, ফরয নামাযের শেষে দুআ করা। ফরয নামাযের শেষে দুআ করলে তা কবুল করা হয়। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরুত্বের সঙ্গে সে সময় দুআ করতেন। মুগীরা ইবনে শুবা রা. বলেন-
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدْعُوْ فِيْ دُبُرِ صَلَاتِهِ.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের শেষে দুআ করতেন। -আততারীখুল কাবীর, বুখারী ৬/৮০; আদদিরায়া, ইবনে হাজার ১/২২৫
এখানে একটা বিষয় খোলাসা হওয়া দরকার। তা হল, হাদীসটিতে ফরয নামাযের শেষে দুআ কবুলের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ‘নামাযের শেষে’ বলে কোন্ সময় বোঝানো হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর হল- মুহাদ্দিসীনে কেরাম এর দুটি ব্যাখ্যা করেছেন।
১. নামাযের শেষাংশ তথা সালাম ফেরানোর পূর্বের সময়। নামাযের শেষ বৈঠকে তাশাহ্হুদ ও দরূদ শরীফ পড়ার পর এবং সালাম ফেরানোর আগে যে সময় আমরা প্রসিদ্ধ দুআ মাছূরা পড়ি সে সময় দুআ করা।
২. নামায শেষ করার পর তথা ফরয নামাযের সালাম ফেরানোর পরে দ্আু করা।
উভয় ব্যাখ্যা হাদীস শরীফ দ্বারা সমর্থিত। উভয় সময়েই দুআ করার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরুত্ব দিয়েছেন, উম্মতকে এর প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন এবং সে সময় পড়ার জন্য সুসংক্ষিপ্ত ও মর্মসমৃদ্ধ অনেক দুআ তিনি শিক্ষা দিয়েছেন।
যাইহোক, হাদীসটি থেকে জানা গেল, নামাযের শেষে তথা সালাম ফেরানোর আগে এবং সালাম ফেরানোর পর দুআ কবুল হওয়ার বিশেষ একটি সময়।
দুই. রাতের শেষ প্রহরে
উপরে আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, দুই সময়ের দুআ অধিক কবুল হয়। একটি হল-
جَوْفَ اللَّيْلِ الآخِرَ.
রাতের শেষ প্রহরে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৯৯; সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদীস ৯৮৫৬
বিষয়টি আরো একাধিক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেছেন-
قَالَ رَجُلٌ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وَسَلَّم: أَيُّ اللَّيْلِ أَجْوَبُ؟
জনৈক সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, রাতের কোন্ সময়টিতে দুআ করলে অধিক কবুল হয়?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
جَوْفُ اللَّيْلِ الآخِرِ.
রাতের শেষ সময়। -মুসনাদে বায্যার, হাদীস ৬১৬৭; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৫৬৮২; মুজামে আওসাত, তবারানী, হাদীস ৩৪২৮
অনুরূপ হাদীস কা‘ব ইবনে র্মুরা বাহযী রা.-ও বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন-
سَأَلْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَيُّ اللَّيْلِ أَجْوَبُ؟
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, রাতের কোন্ অংশের দুআ বেশি কবুল হয়?
তিনি বলেছেন-
جَوْفُ اللَّيْلِ الْآخِرِ.
রাতের শেষ প্রহরের দুআ। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৮৯৬
এসব হাদীস থেকে স্পষ্ট যে, রাতের শেষ অংশ দুআ কবুলের গুরুত্বপূর্ণ সময়। আর তা হবেই না কেন, তখন যে আল্লাহ তাআলার রহমত ও মাগফেরাতের দুয়ার খুলে যায় এবং তাঁর দয়া ও দানের সাগরে জোয়ার আসে! ঐ সময় আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি রহমতের দৃষ্টি দান করেন। বান্দার দুআ কবুলের জন্য, বান্দার প্রয়োজন পূরণ করার জন্য এবং বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য তিনি ডাকতে থাকেন।
আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ: مَنْ يَدْعُونِي، فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ.
আমাদের রব আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতাআলা প্রত্যেক রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কেউ আছে কি, আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব! কেউ আছে কি, আমার কাছে (প্রয়োজনাদি) চাইবে, আমি তাকে দান করবো! কেউ আছে কি, আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব! -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৮
সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য হাদীসগ্রন্থের বর্ণনায় এও এসেছে যে-
فَلَا يَزَالُ كَذَلِكَ حَتَّى يُضِيءَ الْفَجْرُ.
আল্লাহ তাআলা এভাবে সুবহে সাদেক (ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়া) পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৫৯২; জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৪৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৬৬
তিন. রাতে ঘুম ভাঙলে
আমরা যারা দুর্বল, শেষ রাতে জাগতে পারি না, তাদের জন্যও রয়েছে বিশেষ সুযোগ। প্রায় সকলেরই রাতে কখনো না কখনো ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে অন্য কোনো কথা না বলে সহজ কয়েকটি কালিমা পড়ে এর পর যে দুআই করব আল্লাহ তাআলা কবুল করবেন।
উবাদা ইবনে সামেত রা. বর্ণনা করেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ تَعَارَّ مِنَ اللَّيْلِ، فَقَالَ: لاَ إِلূهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهٗ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، وَهُوَ عَلূى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، الحَمْدُ لِلهِ، وَسُبْحَانَ اللهِ، وَلاَ إِلূهَ إِلَّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ، ثُمَّ قَالَ: اللّূهُمَّ اغْفِرْ لِي، أَوْ دَعَا، اسْتُجِيبَ لَهٗ، فَإِنْ تَوَضَّأَ وَصَلَّى قُبِلَتْ صَلاَتُهُ.
রাতে ঘুম ভাঙলে বা জাগ্রত হয়েই যে ব্যক্তি এই কালিমাগুলি বলবে-
لَا إِلূهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهٗ، لَا شَرِيكَ لَهٗ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلূى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ. سُبْحَانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ لِلهِ، وَلَا إِلূهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ.
[আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব কেবল তাঁরই এবং প্রশংসাও কেবল তাঁর। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করছি। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। আল্লাহ সবার বড়। আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত (গোনাহ ও অমঙ্গল থেকে) কেউ বাঁচতে পারে না এবং কেউ (নেক ও ভালো কাজের) শক্তি রাখে না।]
এরপর বলবে-
اللّهُمَّ اغْفِرْ لِي.
(হে আল্লাহ! আমাকে মাফ করে দিন)
বা অন্য কোনো দুআ করবে, তার দুআ কবুল করা হবে।
এরপর যদি ওযু করে নামায পড়ে তাহলে তার নামায কবুল করা হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৫৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০৬০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৬৭৩
চার. আযানের সময়
সাহ্ল ইবনে সা‘দ রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
ثِنْتَانِ لَا تُرَدَّانِ، أَوْ قَلَّمَا تُرَدَّانِ الدُّعَاءُ عِنْدَ النِّدَاءِ، وَعِنْدَ الْبَأْسِ حِينَ يَلْحَمُ بَعْضُهُمْ بَعْضًا.
দুই সময়ের দুআ ফেরত দেওয়া হয় না অথবা (তিনি বলেছেন,) খুব কমই ফেরত দেওয়া হয়-
১. আযানের সময়।
২. জিহাদের সময়, যখন তুমুল লড়াই চলতে থাকে।
-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৫৪০; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ৪১৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৭২০
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إذا نودي بالصلاة، فتحت أبواب السماء، واستجيب الدعاء.
যখন নামাযের জন্য আযান দেওয়া হয় তখন আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং দুআ কবুল করা হয়। -মুসনাদে আবু দাউদ ত্বয়ালিসী, হাদীস ২২২০; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৪০৭২
জাবের রা. থেকেও বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إذا ثوب بالصلاة، فتحت أبواب السماء، واستجيب الدعاء.
যখন নামাযের জন্য আহ্বান করা হয় তখন আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং দুআ কবুল করা হয়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৬৮৯
পাঁচ. আযানের জবাব দেওয়ার পর
আযানের সময় করণীয় পাঁচটি আমলের কথা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। একটি হল- আযানের জবাব দেওয়া তথা মুআয্যিনের সাথে সাথে আযানের কালিমাসমূহ উচ্চারণ করা। আযানের জবাব দেওয়ার একটি ফযীলত হল- তার পরে দুআ কবুল হয়। আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন-
أَنَّ رَجُلًا، قَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّ الْمُؤَذِّنِينَ يَفْضُلُونَنَا، فَقَالَ: رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قُلْ كَمَا يَقُولُونَ فَإِذَا انْتَهَيْتَ فَسَلْ تُعْطَهْ.
এক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মুআয্যিনগণ (আযান দিয়ে) আমাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে নিচ্ছেন। (আমাদেরও এমন কোনো আমল বলে দিন।)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মুয়ায্যিনেরা যা বলে তোমরাও তা বল। এরপর দুআ কর, তোমার দুআ কবুল করা হবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২৪
ছয়. আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়
দুআ কবুলের বিশেষ একটি মুহূর্ত হল- আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়। হাদীস শরীফের ভাষ্য মতে ঐ সময়ের দুআ ফেরত দেওয়া হয় না। আনাস ইবনে মালেক রা. বর্ণনা করেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إن الدعاء لا يرد بين الأذان والإقامة، فادعوا.
আযান ও ইকামতের মাঝের সময় যে দুআ করা হয় তা ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। তাই (ঐ সময়) তোমরা দুআ করো। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৮৫৫২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৫৪৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ৪২৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৬৯৬
সাত. জিহাদের সময়, যখন তুমুল লড়াই চলতে থাকে
দুআ কবুলের একটি সময় হল, কাফেরদের মোকাবেলায় ভীষণ যুদ্ধ চলাকালে দুআ করা। উপরে সাহ্ল ইবনে সা‘দ রা.-এর হাদীসে পড়েছেন, দুই সময় দুআ করলে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয় না; আযানের সময় এবং রণক্ষেত্রে তুমুল লড়াই চলাকালে। হাদীসটির আরেক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
سَاعَتَانِ تُفْتَحُ فِيهِمَا أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَيُسْتَجَابُ فِيهِمَا الدُّعَاءُ عِنْدَ الْأَذَانِ بِالصَّلَاةِ وَعِنْدَ الصَّفِّ فِي سَبِيلِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ.
দুই সময় আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং দুআ কবুল করা হয়; আযানের সময় এবং জিহাদের ময়দানে সারিবদ্ধ অবস্থায়। -কিতাবুদ দুআ, তবারানী, হাদীস ৪৮৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৭২০, ১৭৬৪
আট. সিজদারত অবস্থায়
আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ، وَهُوَ سَاجِدٌ، فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ.
বান্দা আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় সিজদারত অবস্থায়। তাই তখন বেশি বেশি দুআ করো। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৮৭৫; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১১৩৭
এই ধরনের হাদীস আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকেও বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
أَلَا وَإِنِّي نُهِيتُ أَنْ أَقْرَأَ الْقُرْآنَ رَاكِعًا أَوْ سَاجِدًا، فَأَمَّا الرُّكُوعُ فَعَظِّمُوا فِيهِ الرَّبَّ عَزَّ وَجَلَّ، وَأَمَّا السُّجُودُ فَاجْتَهِدُوا فِي الدُّعَاءِ، فَقَمِنٌ أَنْ يُسْتَجَابَ لَكُمْ.
শুনে রাখো, আমাকে রুকু ও সিজদায় কুরআন পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং রুকুতে তোমরা রবের সম্মানপ্রকাশক তাসবীহ পড়ো আর সিজদায় অধিক পরিমাণে দুআ করো। কেননা, সিজদা অবস্থায় দুআ করলে তা কবুল হওয়ারই অধিক উপযুক্ত। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৭৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৮৭৬
নয় ও দশ. রোযা ও সফর অবস্থায়
মুসাফির যতক্ষণ সফরের হালতে থাকে এবং রোযাদার ব্যক্তি যতক্ষণ রোযা অবস্থায় থাকে, যে দুআ করে আল্লাহ তাআলা কবুল করেন। হাদীস শরীফের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের দুআ ফেরত দেওয়া হয় না। আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
ثلاث دعوات لا ترد: دعوة الوالد، ودعوة الصائم، ودعوة المسافر.
তিনটি দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। পিতার দুআ, রোযাদারের দুআ এবং মুসাফিরের দুআ। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৩/৩৪৫; আলআহাদীসুল মুখতারা ২০৫৭
এগারো. জুমার দিনের বিশেষ মুহূর্তে দুআ করা
জুমার দিন একটি বিশেষ সময় আছে বান্দা তখন যে দুআ করবে আল্লাহ তাআলা তা-ই কবুল করবেন। মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর কাছে যা চাইবে, আল্লাহ তাআলা তা-ই দান করবেন। অনেক হাদীসে এই সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. বলেন-
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَكَرَ يَوْمَ الجُمُعَةِ، فَقَالَ: >فِيهِ سَاعَةٌ، لاَ يُوَافِقُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ، وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي، يَسْأَلُ اللهَ تَعَالَى شَيْئًا، إِلَّا أَعْطَاهُ إِيَّاهُ< وَأَشَارَ بِيَدِهِ يُقَلِّلُهَا.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন জুমার দিনের বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। তখন বলেছেন, এইদিন একটা সময় আছে, কোনো মুসলিম যদি ঐ সময়ে নামায আদায় করে এবং আল্লাহর কাছে কিছু চায় আল্লাহ তাকে অবশ্যই তা দান করবেন।
(আবু হুরায়রা রা. বলেন,) এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত দিয়ে ইশারা করেছেন যে, ঐ মুহূর্তটা অতি অল্প সময়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৫৩
মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় স্পষ্ট এসেছে-
وَهِيَ سَاعَةٌ خَفِيفَةٌ.
সে মুহূর্তটি খুব সামান্য সময়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৫২
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
يَوْمُ الْجُمُعَةِ اثْنَتَا عَشْرَةَ سَاعَةً، وَلَا يُوجَدُ عَبْدٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ اللهَ شَيْئًا إِلَّا آتَاهُ اللهُ...فَالْتَمِسُوهَا آخِرَ السَّاعَةِ بَعْدَ الْعَصْرِ.
জুমার দিনের বারো ভাগ। (এর মধ্যে একটি সময় আছে, যাতে) মুসলিম বান্দা আল্লাহ তাআলার কাছে যা প্রার্থনা করবে আল্লাহ তাআলা তাকে তা-ই দান করবেন। সুতরাং তোমরা সে সময়টি অনুসন্ধান করো আসরের পর দিনের শেষ অংশটিতে। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ১০৩২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৪৮; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১৩৮৯
জুমার দিনের যে সময়টিতে দুআ কবুলের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে সেটা কোন্ সময়? ওপরের হাদীসটিতে আসরের পরের কথা বিবৃত হয়েছে। তবে অন্যান্য হাদীস ও আছার থেকে আরো বিভিন্ন সময়ের কথা জানা যায়। এসব হাদীস ও আছারের ভিত্তিতে ওলামায়ে কেরাম থেকে জুমার দিনের দুআ কবুলের সময় সম্পর্কে অনেক মত বর্ণিত হয়েছে। হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ৪৩টি মত উল্লেখ করেছেন। দ্রষ্টব্য : ফতহুল বারী ২/৪১৬-৪২১
সবগুলো মত উল্লেখ করার পর হাফেয ইবনে হাজার রাহ. বলেন-
وَلَا شَكَّ أَنَّ أَرْجَحَ الْأَقْوَالِ الْمَذْكُورَةِ حَدِيثُ أَبِي مُوسَى وَحَدِيثُ عَبْدِ اللهِ بْنِ سَلَامٍ كَمَا تَقَدَّمَ قَالَ الْمُحِبُّ الطَّبَرِيُّ أَصَحُّ الْأَحَادِيثِ فِيهَا حَدِيثُ أَبِي مُوسَى وَأَشْهَرُ الْأَقْوَالِ فِيهَا قَوْلُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ سَلَامٍ
এখানে হাফেয ইবনে হাজার রাহ. যা বলেছেন এর সারমর্ম হল- এই সব মতের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধতম মত দুইটি :
১. খতীব খুতবা দেওয়ার জন্য মিম্বরে ওঠার পর থেকে নামায শেষ করা পর্যন্ত। এ সময়ের কথা আবু মূসা আশআরী রা.-এর হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে।
২. আসরের নামাযের পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। এ সময়ের কথা আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা.-এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
মুহিব্বুদ্দীন আবুল আব্বাস তবারী রাহ. বলেছেন, আবু মূসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত হাদীসটি সবচে’ বিশুদ্ধ আর আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা. থেকে বর্ণিত মতটি সবচে’ প্রসিদ্ধ। (দ্রষ্টব্য : ফতহুল বারী ২/৪২১)
সুতরাং উচিত হল, জুমার দিন উক্ত দুই সময়েই দুআর এহতেমাম করা। ইমাম আবু উমর ইবনে আবদুল বার রাহ. বলেছেন-
প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, তার দ্বীন-দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ের জন্য কবুলের আশা নিয়ে এই দুই সময়ে গুরুত্বের সাথে দুআ করা। তাহলে ইনশাআল্লাহ সে আশাহত হবে না। -আততামহীদ ১৯/২৪
বারো. মুসলিম যখন অপর মুসলিমের জন্য দুআ করে
আমাদের যখন কোনো জিনিসের দরকার হয় তখন অপর মুসলিম ভাইদের জন্য ঐ জিনিসটার দুআ করব। তাহলে আল্লাহ আমাদের মাথার ওপর একজন ফিরিশতা নিযুক্ত করে দেবেন। সেই ফিরিশতা আমার জন্য দুআ করতে থাকবেন, বলবেন- আল্লাহ তোমাকেও অনুরূপ দান করুন।
আবুদ দারদা রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَدْعُو لِأَخِيهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ إِلَّا قَالَ الْمَلَكُ: وَلَكَ بِمِثْلٍ، وَلَكَ بِمِثْلٍ.
যখন কোনো ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের জন্য তার পশ্চাতে দুআ করে তখন তার সাথে নিযুক্ত ফিরিশতা বলতে থাকেন, আল্লাহ তোমাকেও অনুরূপ দান করুন। আল্লাহ তোমাকেও অনুরূপ দান করুন। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৩২
হাদীসটি থেকে স্পষ্ট, যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ভাইয়ের জন্য তার অনুপস্থিতিতে দুআ করবে, ফিরিশতাগণ তার জন্য দুআ করবেন। আর ফিরিশতাগণ হলেন মাসূম, নিষ্পাপ, আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা। সুতরাং তাদের দুআ কবুল হওয়াই স্বাভাবিক।
আরেক হাদীসে বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। উম্মুদ দারদা রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
دَعْوَةُ الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ لِأَخِيهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ مُسْتَجَابَةٌ، عِنْدَ رَأْسِهِ مَلَكٌ مُوَكَّلٌ كُلَّمَا دَعَا لِأَخِيهِ بِخَيْرٍ، قَالَ الْمَلَكُ الْمُوَكَّلُ بِهِ: آمِينَ وَلَكَ بِمِثْلٍ.
কোনো মুসলিমের জন্য তার অগোচরে যে দুআ করা হয় সে দুআ কবুল। অগোচরে দুআকারীর মাথার নিকট একজন ফিরিশতা নিয়োজিত থাকেন। যখনই সে আপন ভাইয়ের জন্য দুআ করে তখনই নিয়োজিত ফিরিশতা বলেন, আল্লাহ কবুল করুন এবং তোমাকেও অনুরূপ দান করুন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৩৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৮৯৫
[মাসিক আল-কাউসার থেকে সংগৃহিত]
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
উস্তাজ, ইদারাতুত্ তাখাসসুস ফিল উলূমিল ইসলামিয়া, আজিমপুর
রেফারেন্স উত্তর :
প্রশ্নঃ ১৩৯৬৯. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, কিভাবে দু'য়া করলে সাথে সাথে কবুল হয়? বিস্তারিত বলবেন।
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
দোয়ার আদবসমূহ:
১। দোয়াকারীকে আল্লাহর রুবুবিয়্যত, উলুহিয়্যত ও আসমা-সিফাতের প্রতি একত্ববাদী হতে হবে। আল্লাহ তাআলা কর্তৃক দোয়া কবুল করার শর্ত হচ্ছে- বান্দা কর্তৃক আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে নেক কাজ করা ও গুনাহ পরিত্যাগ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (তখন বলে দিন যে) নিশ্চয় আমি অতি নিকটে। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে আমি তার আহ্বানে সাড়া দেই।”[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৮৬]
২। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: আর “তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহ্র ইবাদত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে।”[সূরা বাইয়্যেনা, আয়াত: ০৫] দোয়া হচ্ছে- ইবাদত; যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন। তাই ইখলাস দোয়া কবুলের শর্ত।
৩। আল্লাহ্র সুন্দর নাম ও গুণাবলী দিয়ে তাঁকে ডাকা। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “আর আল্লাহ্র জন্যই রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাক; আর যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন কর।”[সূরা আরাফ, আয়াত: ১৮০]
৪। দোয়া করার পূর্বে আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করা। সুনানে তিরমিযিতে (৩৪৭৬) ফাযালা বিন উবায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে নামায আদায় করল, এরপর দু’আ করল: ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মাফ করে দাও, তুমি আমাকে রহম কর’। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: হে নামাযী! তুমি বেশ তাড়াহুড়া করে ফেললে। তুমি নামায আদায় করে যখন বসবে তখন আগে আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করবে, আমার ওপর দরুদ পড়বে। এরপর আল্লাহর কাছে দু’আ করবে।” অপর এক রেওয়ায়েতে এসেছে (৩৪৭৭) “যখন তোমাদের কেউ নামায শেষ করবে তখন আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতি শুরু করবে। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরুদ পড়বে। অতঃপর যা ইচ্ছা দোয়া করবে” বর্ণনাকারী বলেন: এরপর অপর এক লোক নামায আদায় করল। সে ব্যক্তি আল্লাহর প্রশংসা করল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরুদ পড়ল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “ওহে নামাযী! দোয়া কর, আল্লাহ তোমার দোয়া কবুল করবেন”
—তিরমিযি গ্রন্থে (২৭৬৫), (২৭৬৭)
৫। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরুদ পড়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরুদ না পড়া পর্যন্ত যে কোন দোয়া আটকে থাকে”[আল-মুজাম আল-আওসাত (১/২২০)
৬। কিবলামুখী হয়ে দোয়া করা। সহিহ মুসলিমে (১৭৬৩) উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: বদর যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুশরিকদের দিকে তাকালেন; তাদের সংখ্যা ছিল এক হাজার। আর তাঁর সাথীবর্গের সংখ্যা ছিল তিনশত উনিশ। তখন তিনি কিবলামুখী হয়ে হাত প্রসারিত করলেন, তারপর তাঁর রবকে ডাকতে শুরু করলেন: ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যে ওয়াদা দিয়েছেন সেটা বাস্তবায়ন করে দিন। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটা দান করুন। হে আল্লাহ! আপনি যদি মুসলমানদের এ দলটিকে ধ্বংস করে দেন তাহলে পৃথিবীতে আপনার ইবাদত হবে না’। এভাবে দুই হাত প্রসারিত করে কিবলামুখী হয়ে তাঁর রবকে ডাকতে থাকলেন; এমনকি এক পর্যায়ে তাঁর কাঁধ থেকে চাদরটি পড়ে গেল...।
ইমাম নববী (রহঃ) ‘শারহু মুসলিম’ গ্রন্থে বলেন: এ হাদিসে দোয়াকালে কিবলামুখী হওয়া ও দুই হাত তুলে দোয়া করা মুস্তাহাব হওয়ার পক্ষে প্রমাণ রয়েছে।
৭। দুই হাত তোলা। সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে (১৪৮৮) সালমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “নিশ্চয় আপনাদের সুমহান রব হচ্ছেন লজ্জাশীল ও মহান দাতা। বান্দা যখন তাঁর কাছে দু’হাত তোলে তখন তিনি সে হাতদ্বয় শূন্য ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।”
[আবু দাউদ গ্রন্থে (১৩২০)
হাতের তালু থাকবে আকাশের দিকে; যেভাবে একজন নতজানু দরিদ্র সাহায্যপ্রার্থী কিছু পাওয়ার আশায় হাত পাতে। সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে (১৪৮৬) মালেক বিন ইয়াসার (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যখন তোমরা আল্লাহর কাছে কোন কিছু চাইবে তখন হাতের তালু দিয়ে চাইবে; হাতের পিঠ দিয়ে নয়”
আবু দাউদ গ্রন্থে (১৩১৮)
হাত তোলার সময় দুই হাত কি মিলিয়ে রাখবে; না কি দুই হাতের মাঝে ফাঁক রাখবে?
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) তাঁর ‘আল-শারহুল মুমতি’ গ্রন্থে (৪/২৫) উল্লেখ করেছেন যে, হাত দুইটি মিলিয়ে রাখবে। তাঁর ভাষায়: “দুই হাতের মাঝখানে ফাঁক রাখা ও এক হাত থেকে অন্য হাত দূরে রাখা সম্পর্কে আমি কোন দলিল পাইনি; না হাদিসে; আর না আলেমগণের বাণীতে।” [সমাপ্ত]
৮। আল্লাহর প্রতি এ একীন রাখা যে, আল্লাহ দোয়া কবুল করবেন এবং মনোযোগ দিয়ে দোয়া করা। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “তোমরা দোয়া কবুল হওয়ার একীন নিয়ে দোয়া কর। জেনে রাখ, আল্লাহ তাআলা অবহেলাকারী ও অমনোযোগী অন্তরের দোয়া কবুল করেন না।”
সুনানে তিরমিযি (৩৪৭৯)
৯। বারবার চাওয়া। বান্দা আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর যা ইচ্ছা তা চাইবে, কাকুতি-মিনতি করবে, তবে দোয়ার ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া করবে না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা কোন পাপ নিয়ে কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে দোয়া করে। বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া না করে। জিজ্ঞেস করা হল: ইয়া রাসূলুল্লাহ! তাড়াহুড়া বলতে কী বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেন: বলে যে, আমি দোয়া করেছি, আমি দোয়া করেছি; কিন্তু আমার দোয়া কবুল হতে দেখিনি। তখন সে ব্যক্তি উদ্যম হারিয়ে ফেলে এবং দোয়া ছেড়ে দেয়।[সহিহ বুখারী (৬৩৪০) ও সহহি মুসলিম (২৭৩৫)]
১০। দৃঢ়তার সাথে দোয়া করা। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের কেউ যেন অবশ্যই এভাবে না বলে যে, হে আল্লাহ! আপনি যদি চান আমাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনি যদি চান আমাকে দয়া করুন। কেননা নিশ্চয় আল্লাহর ওপর জবরদস্তি করার কেউ নেই।[সহিহ বুখারী (৬৩৩৯) ও সহিহ মুসলিম(২৬৭৯)]
১১। অনুনয়-বিনয়, আশা ও ভয় প্রকাশ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের রবকে ডাক”[সূরা আরাফ, আয়াত: ৫৫] তিনি আরও বলেন: “তারা সৎকাজে প্রতিযোগিতা করত, আর তারা আমাদেরকে ডাকত আগ্রহ ও ভীতির সাথে এবং তারা ছিল আমাদের নিকট ভীত-অবনত।”[সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৯০] তিনি আরও বলেন: “আর আপনি আপনার রবকে নিজ মনে স্মরণ করুন সবিনয়ে, ভীতচিত্তে ও অনুচ্চস্বরে, সকালে ও সন্ধ্যায়।”[সূরা আরাফ, আয়াত: ২০৫]
১২। তিনবার করে দোয়া করা। সহিহ বুখারী (২৪০) ও সহিহ মুসলিমে (১৭৯৪) আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেন: “একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বায়তুল্লাহ্র কাছে নামায আদায় করছিলেন। সেখানে আবূ জেহেল ও তার সঙ্গীরা বসা ছিল। গতদিন উট জবাই করা হয়েছিল। এমন সময় আবু জেহেল বলে উঠল, ‘তোমাদের মধ্যে কে অমুক গোত্রের উটনীর নাড়ীভুঁড়ি এনে মুহাম্মদ যখন সিজদা করবে তখন তার পিঠের উপর রাখতে পারবে?’ তখন কওমের সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোকটি দ্রুত গিয়ে উটনীর নাড়ীভুঁড়ি নিয়ে এল এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সিজদায় গেলেন তখন এগুলো তাঁর দুই কাঁধের মাঝখানে রেখে দিল। বর্ণনাকারী বলেন: তারা নিজেরা হাসতে থাকল; হাসতে হাসতে একে অন্যের ওপর হেলে পড়ল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। হায়! আমার যদি প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থাকত তাহলে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিঠ থেকে এগুলো ফেলে দিতাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় পড়ে থাকলেন; মাথা উঠালেন না। এক পর্যায়ে এক লোক গিয়ে ফাতিমা (রাঃ) কে খবর দিল। খবর শুনে তিনি ছুটে এলেন। সে সময় ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন ছোট বালিকা। তিনি এসে উটের নাড়ীভুঁড়ি তাঁর পিঠ থেকে ফেলে দিলেন। এরপর লোকদের দিকে মুখ করে তাদেরকে গালমন্দ করলেন। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁর নামায শেষ করলেন তখন তিনি কণ্ঠস্বর উঁচু করলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে বদ দোয়া করলেন। - তিনি যখন দোয়া করতেন তখন তিনবার করতেন এবং যখন প্রার্থনা করতেন তখন তিনবার করতেন- এরপর বললেন: ইয়া আল্লাহ্! আপনি কুরাইশকে ধ্বংস করুন। এভাবে তিনবার বললেন। তারা যখন তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল তাদের হাসি মিলিয়ে গেল এবং তারা তাঁর বদ দোয়াকে ভয় পেল। এরপর তিনি বললেনঃ ইয়া আল্লাহ্! আবূ জেহেল ইবনে হিশাম, ‘উতবা ইবনে রাবী’আ, শায়বা ইবনে রবী’আ, ওয়ালীদ ইবনে ‘উকবা, উমাইয়্যা ইবনে খালাফ ও ‘উকবা ইবনে আবু মু’আইতকে ধ্বংস করুন। (রাবী বলেন, তিনি সপ্তম ব্যক্তির নামও বলেছিলেন কিন্তু আমি স্মরণ রাখতে পারিনি।) সেই সত্তার কসম! যিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের নাম উচ্চারণ করেছিলেন, আমি বদর যুদ্ধের দিন তাদেরকে নিহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি। পরবর্তীতে তাদেরকে টেনেহিঁচড়ে বদরের কূপের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়।”
১৩। ভাল খাবার ও ভাল পোশাক গ্রহণ করা (ভাল হতে হলে হালাল হওয়া জরুরী)। সহিহ মুসলিমে (১০১৫) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “হে লোকসকল! নিশ্চয় আল্লাহ ভাল। তিনি ভাল নয় এমন কিছু গ্রহণ করেন না। তিনি রাসূলদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন একই নির্দেশ মুমিনদের প্রতিও জারী করেছেন। তিনি বলেন: “হে রাসূলগণ! আপনারা ভাল খাবার গ্রহণ করুন এবং নেক আমল করুন। নিশ্চয় আপনারা যা কিছু আমল করেন সে সম্পর্কে আমি সম্যক অবগত”[সূরা মুমিনূন, আয়াত: ৫১] তিনি আরও বলেন: “হে ঈমানদারেরা! তোমাদেরকে যেসব ভাল রিজিক দিয়েছি সেগুলো থেকে খাও।”[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৭২] এরপর তিনি উল্লেখ করেন যে, জনৈক ব্যক্তি লম্বা সফর করে উস্কখুস্ক চুল নিয়ে ধুলিমলিন অবস্থায় দুই হাত আকাশের দিকে তুলে দোয়া করে: ইয়া রব্ব, ইয়া রব্ব! অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, সে পরিপুষ্ট হয়েছে হারাম খেয়ে তাহলে তার দোয়া কিভাবে কবুল হবে?” ইবনে রজব (রহঃ) বলেন: “হালাল খাওয়া, হালাল পান করা, হালাল পরিধান করা ও হালাল খেয়ে পরিপুষ্ট হওয়া দোয়া কবুল হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত।”[সমাপ্ত]
১৪। গোপনে দোয়া করা, শব্দ না করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের রবকে ডাক”[সূরা আরাফ, আয়াত: ৫৫] আল্লাহ তাআলা যাকারিয়া (আলাইহি সালাম) এর প্রশংসা করে বলেন: “যখন তিনি তার রবকে ডেকেছিলেন নিভৃতে”[সূরা মারিয়াম, আয়াত: ০৩]
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিআ মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া, মোহাম্মদপুর
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন