প্রশ্নঃ ১০৪১১. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আসসালামুয়ালাইকুম
তাবলীগ কি করা যাবে??
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
ইতিমধ্যে এ বিষয়ে উত্তর দেয়া হয়েছে. যে বিষয়ে প্রশ্ন করতে চাচ্ছেন সেটা আগে সার্চ অপশনে খুঁজে দেখুন। উত্তরটি নিচে সংযুক্ত করা হল।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
রেফারেন্স উত্তর :
প্রশ্নঃ ৯৫৮৩. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, তাবলীগ সম্পর্কে আমি জানতে চাই। সাদপন্থী আর আলেম পন্থী। আলেম পন্থীরা দাবি করে সাদ পন্থীরা সঠিক দ্বীনের পথে নাই। এই বিষয়টা সম্পর্কে আমি জানতে চাই আপনার কাছে।
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
ইতিমধ্যে এ বিষয়ে উত্তর দেয়া হয়েছে. যে বিষয়ে প্রশ্ন করতে চাচ্ছেন সেটা আগে সার্চ অপশনে খুঁজে দেখুন। উত্তরটি নিচে সংযুক্ত করা হল।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিআ মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া, মোহাম্মদপুর
প্রশ্নঃ ৮৪৬১. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আমি একটা ওয়াজ শুনেছি যেখানে বাংলাদেশী একজন আলেম কে জিজ্ঞাসা করা হলো , তাবলীগ জামাতের সাথে তিনদিন বা চিল্লায় যাওয়া কি বিদআত? উনি উত্তরে বললেন যে হা বিদআত! কোনো আলেম ছাড়া কেউ সাধারণ মানুষ যাতে না যায় । আমার প্রশ্ন হলো এইটা কি আসলেই বিদআত? যদি বিদআত হয় তাহলে তাদের কোন কাজ গুলা বিদআত হয় টা বলবেন।
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
তাবলীগ জামাতের সাথে ৩ দিন বা চিল্লায় যাওয়া মোটেও বিদআত হিসেবে গন্য হবে না।
আসলে তাবলীগ জামাতে চিল্লাকে কোন শরয়ী বিধান বলা হয় না। একথাও বলা হয় না যে, এটি রাসূল সাঃ থেকে প্রমানিত কোন সুন্নত। বরং এটি দ্বীনভোলা সাধারণ মুসলমানদের প্রশিক্ষণের জন্য নির্ধারিত একটি কোর্স মাত্র। যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দ্বীন বা দুনিয়াবী শিক্ষা অর্জনের জন্য ১২বছর বা ১৪বছর এমন কোর্স চালু করা হয়েছে। এমনকি মাদরাসায়ও এমন পদ্ধতি প্রচলিত। গোটা বিশ্বের দ্বীনী প্রতিষ্ঠানেই এমন সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালার আলোকে পরিচালিত হয়। সুনির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করা বা অবস্থান নেয়া বা প্রশিক্ষণ নেয়ার দ্বারা ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার সার্টিফিকেট দেয়া হয়।
এসব কোনটিই রাসূল সাঃ থেকে প্রমানিত বিষয় নয়। আবার বিদআতও নয়। কারণ এসব পদ্ধতিকে কেউ সুন্নতও বলে না। সেই সাথে এই সংখ্যাটিতে সওয়াব জড়িতও বলা হয় না। বরং প্রশিক্ষণের সুবিধার্তে তা নির্ধারণ করা হয়েছে।
যদি তাবলীগের চিল্লা পদ্ধতি বিদআত হয়, তাহলে মক্কা মদীনা ভার্সিটিসহ পৃথিবীর সকল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দ্বীনী কোর্স সম্পন্ন করার সময়সীমাও বিদআত হবে। কিন্তু কোন ব্যক্তি কি এমন আহমকী প্রশ্ন করে? যদি না করে তাহলে তাবলীগের চিল্লা নিয়ে কেন এ অহেতুক প্রশ্ন?
ইসলামী দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ যোগ্যতা অর্জনের জন্য যে নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এর কোন দূরতম প্রমাণও কুরআনও হাদীসের কোথাও নেই। অথচ তাবলীগের চিল্লার খানিক হলেও প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে।
তাবলীগ জামাতের চিল্লার হিকমত
চল্লিশ দিন পর্যন্ত লাগাতার কোন আমল করলে এর দ্বারা মানুষের আত্মিক অনেক পরিবর্তন সাধিত হয় মর্মে জানা যায়। সেই সাথে এই চল্লিশ সংখ্যাটিও ইসলামী শরীয়তে আলাদা বৈষিষ্টমন্ডিত। এ কারণে কোন সাধনার জন্য এ চল্লিশ সংখ্যাটি আলাদা বৈষিষ্টে রাখে। কয়েকটি দলীল-
১
الَ عَبْدُ اللَّهِ: حَدَّثَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ الصَّادِقُ المَصْدُوقُ، قَالَ: ” إِنَّ أَحَدَكُمْ يُجْمَعُ خَلْقُهُ فِي بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا، ثُمَّ يَكُونُ عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ يَكُونُ مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ يَبْعَثُ اللَّهُ مَلَكًا فَيُؤْمَرُ بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ،
হযরত যায়দ বিন ওহাব রাঃ থেকে বর্ণিত। হযরত আব্দুল্লাহ রাঃ বলেন, সত্যবাদীরূপে স্বীকৃত রাসূল সাঃ আমাদের কাছে হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, নিশ্চয় তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপকরণ নিজ নিজ মাতৃগর্ভে চল্লিশ দিন পর্যন্ত বীর্যরূপে অবস্থান করে, এরপর তা জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয়। অনুরূপভাবে চল্লিশ দিন অবস্থান করে। এরপর তা মাংসপিন্ডে পরিণত হয়ে [আগের মত চল্লিশ দিন] থাকে। এরপর আল্লাহ তাআলা ফিরিশতা প্রেরণ করেন। আর তাকে চারটি বিষয় নির্দেশ দেয়া হয়। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩২০৮, ৩০৩৬, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৬৪৩}
উক্ত হাদীসটিতে লক্ষ্য করুন। মানুষের শারিরিক গঠনপ্রণালীর এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় পরিবর্তিত হতে সময় নির্দিষ্ট হল ৪০দিন। অর্থাৎ এক সূরত থেকে আরেক সূরতে পরিবর্তন হয় ৪০দিনে। এভাবে তিনটি স্তর পেরোতে হয় ৪০দিন করে করে।
এর দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, ৪০দিনে একটি ব্যক্তির মানসিক পরিবর্তন হতে পারে। যেমন জন্মলগ্নের স্তরগুলোতে পরিবর্তিত হয়েছিল।
এমনিভাবে আরেক হাদীসে এসেছে-
عَنْ حُذَيْفَةَ بْنِ أَسِيدٍ الْغِفَارِيِّ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَوْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” يَدْخُلُ الْمَلَكُ عَلَى النُّطْفَةِ بَعْدَمَا تَسْتَقِرُّ فِي الرَّحِمِ بِأَرْبَعِينَ لَيْلَةً – وَقَالَ سُفْيَانُ مَرَّةً: أَوْ خَمْسٍ وَأَرْبَعِينَ لَيْلَةً – فَيَقُولُ: يَا رَبِّ، مَاذَا أَشَقِيٌّ أَمْ سَعِيدٌ؟ أَذَكَرٌ أَمْ أُنْثَى؟ فَيَقُولُ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى، فَيَكْتُبَانِ، فَيَقُولَانِ: مَاذَا؟ أَذَكَرٌ أَمْ أُنْثَى؟ فَيَقُولُ
মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৬১৪২, মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীস নং-৮৪৮, আলমুজামুল কাবীর, হাদীস নং-৩০৩৯}
২
আল্লাহ তাআলা হযরত মুসা আঃ থেকে ৪০দিনের ওয়াদা নিয়েছিলে। ইরশাদ হচ্ছে-
وَإِذْ وَاعَدْنَا مُوسَى أَرْبَعِينَ لَيْلَةً
আর যখন তিনি মুসা থেকে চল্লিশ দিনের ওয়াদা নিলেন। {সূরা বাকারা-৫১}
ইমাম কুরতুবী রহঃ বলেন,
وبهذا استدل الصوفية على الوصال وان أفضله أربعون يوما الخ ((تفسيرالقرطبي ج ۱ ص ۳۹۶))
৩
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ صَلَّى لِلَّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا فِي جَمَاعَةٍ يُدْرِكُ التَّكْبِيرَةَ الأُولَى كُتِبَ لَهُ بَرَاءَتَانِ: بَرَاءَةٌ مِنَ النَّارِ، وَبَرَاءَةٌ مِنَ النِّفَاقِ.
হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি লাগাতার চল্লিশ দিন জামাতের সাথে তাকবীর উলার সাথে নামায পড়বে। তার জন্য দু’টি মুক্তির খোশখবরী রয়েছে। একটি হল জাহান্নাম থেকে মুক্তি আরেকটি হল মুনাফিকী থেকে মুক্তি। {সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৪১, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং-২০২৫৩}
কাছাকাছি বক্তব্য নির্ভর আরেক হাদীসে এসেছে-
عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ: «مَنْ صَلَّى فِي مَسْجِدٍ جَمَاعَةً أَرْبَعِينَ لَيْلَةً، لَا تَفُوتُهُ الرَّكْعَةُ الْأُولَى مِنْ صَلَاةِ الْعِشَاءِ، كَتَبَ اللَّهُ لَهُ بِهَا عِتْقًا مِنَ النَّارِ»
সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৭৯৮, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-২৬১৬।
উল্লেখিত হাদীসের আলোকে একতা স্পষ্ট যে, চল্লিশ দিনের একটি আলাদা বৈশিষ্ট আছে মানুষের মন-মানসিকতা পরিবর্তনের উপর। যেহেতু দ্বীনভোলা মানুষগুলোর মন বিগড়ে গেছে। দিনের পর দিন গোনাহ করতে করতে মন গোনাহে নাপাক হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর ইবাদতের মজা মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে উঠে যেতে বসেছে। এ কারণে এসব আত্মভোলা দ্বীনভোলা মানুষকে চল্লিশ দিনের চিল্লায় পাঠিয়ে লাগাতার চল্লিশ দিন তাকবীরে উলার সাথে নামায পড়ানোর মাধ্যমে যেন তাদের মাঝে আত্মিক পরিবর্তন আসে। তাদের মাঝে যেন মানসিক পরিবর্তন আসে, এ কারণে চল্লিশ দিনের চিল্লা দেয়া হয়। এটিকে শরয়ী কোন দলীল মনে করে করা হয় না। কেবলি হাদীসে বর্ণিত বৈশিষ্টের কারণে ওসীলা হিসেবে তা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। আর নেক আমলের উসীলার বৈধতার প্রমাণ স্বতসিদ্ধ।
হাদীসের ভাষায় বিদআতঃ
عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ
হযরত আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-আমাদের দ্বীনের মাঝে যে ব্যক্তি নতুন বিষয় আবিস্কার করে যা তাতে নেই তাহলে তা পরিত্যাজ্য। {সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৬০৮, সহীহ বুখারী, হাদিস নং-২৫৫০, সহীহ মুসলিম-৪৫৮৯}
এই হাদিসে লক্ষ্য করুন কি কি শর্তে নব আবিস্কৃত বস্তুকে পরিত্যাজ্য বলেছেন নবীজী সাঃ।
১-সম্পূর্ণ নতুন বিষয়। যার কোন সামান্যতম প্রমাণ নবীযুগে বা সাহাবা যুগে নাই এমন বিষয় হতে হবে।
২-দ্বীনী বিষয় হতে হবে। সুতরাং দ্বীনী বিষয় ছাড়া যত নতুন বিষয়ই আবিস্কারই হোকনা কেন তা বিদআত নয়। যেমন বৈজ্ঞানিক আবিস্কার। নতুন নতুন আসবাব ইত্যাদী। এসব বিদআত নয়। কারণ এসব দ্বীনী বিষয় নয়। বরং বৈষয়িক বিষয়।
৩-দ্বীনের মাঝে নতুন আবিস্কার হতে হবে। দ্বীনের জন্য হলে সমস্যা নাই। কারণ দ্বীনের মাঝে নতুন আবিস্কার মানে হল এটা সওয়াবের কাজ। সুন্নাত, ওয়াজিব ইত্যাদী। আর দ্বীনের জন্য হলে সেটা মূলত সওয়াবের কাজ নয়, বরং সওয়াবের কাজের সহায়ক। যেমন মাদরাসা শিক্ষা একাডেমিক পদ্ধতি নববী যুগে ছিলনা। পরবর্তীতে আবিস্কার করা হয়েছে। এই একাডেমিক পদ্ধতিটি দ্বীনের মাঝে নতুন আবিস্কার নয়, বরং দ্বীনী কাজের জন্য সহায়ক হিসেবে আবিস্কার হয়েছে। অর্থাৎ দ্বীন শিখার সহায়ক। আর দ্বীন শিখাটা সওয়াবের কাজ। কিন্তু সিষ্টেমটা মূলত সওয়াবের কাজ নয় বরং সহায়ক। তেমনি তাবলীগের বর্তমান পদ্ধতিটি ইলিয়াস রহঃ আবিস্কার করেছেন দ্বীন প্রচারের সহায়ক হিসেবে। তথা দ্বীনের জন্য আবিস্কার। দ্বীন মাঝে আবিস্কার নয়। তাই এটি বিদআত হওয়ার কোন সুযোগই নেই।
যারা বলেন এ পদ্ধতি বিদআত, তারা মূলত দ্বীন সম্পর্কে চূড়ান্ত অজ্ঞতার পরিচয় দেন এসব কথা বলে।
তাবলীগ জামাআতের কাজ যেহেতু রাসূল সাঃ ও পরবর্তী সাহাবায়ে কিরামের প্রচার করা দ্বীন প্রচারেরই একটি সুসংহত রূপ মাত্র। তাই তাবলীগ জামাআতের কাজের সাথে সেসব ফযীলত শামিল হবে যা কুরআন সুন্নাহে বর্ণিত দ্বীন প্রচারের ফযীলত।
তাবলীগের চল্লিশ দিনের চিল্লা বিদআত হলে প্রথমে বিদআত হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোর্সের দলীলহীন সময়সীমা নির্ধারণ। সেসব যদি বিদআত না হয়, তাহলে চল্লিশ দিনের আলাদা বৈশিষ্ট সম্বলিত হাদীসে পাকে দলীল থাকা সত্বেও চিল্লা কি করে বিদআত হয়?
আল্লাহ্ তাআলা আমাদের বুঝার ও আমল করার তাওফীক দান করেন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
প্রশ্নঃ ৭২৭৩. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, তাবলীগ জামাত সম্পর্কে জানতে চাই। তাবলীগ কাজ করা কী জায়েজ?
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
তাবলীগ জামাত সম্পর্কে কথা হলো,
তাবলীগের কাজ করা অবশ্যই জায়েজ। এটা নবীওয়ালা মেহনত, নবীগন আল্লাহ্ থেকে গাফেল বান্দাদের আল্লাহ্র দিকে ডেকেছেন।
শেষ নবীর সাঃ উম্মতী হিসেবে আমার আপনার সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে, তবে অবশ্যই উলামায়ে কিরামের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মেহনতের সাথে থাকবো এবং নিম্নে উল্লেখিত প্রবন্ধের দিক নির্দেশনা সর্বদা নিজের সামনে রাখবো, তাহলে এ কাজে বরকত হবে।
এ সম্পর্কে একটি তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ পেশ করছি।
দাওয়াত ও তাবলীগ : কয়েকটি সংক্ষিপ্ত কথা
মাওলানা আবু সাবের আব্দুল্লাহ
الحمد لله وكفى وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد :
দাওয়াত ও তাবলীগ দ্বীনের এক বহুত বড় কাজ। এই কাজ যেন সুচারুরূপে শরঈ তরিকায় সম্পন্ন হতে পারে, তজ্জন্য কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা গ্রহণ জরুরি। কাজের সাথে জড়িতদের মানসিকতা গঠনও একান্ত প্রয়োজন। এ সম্পর্কে আজকের অবসরে সংক্ষিপ্ত কয়েকটি কথা।
১. উমুমি ময়দানে শরীয়তের মূল তাকাজা তিনটি- দাওয়াত-তাবলীগ, তালীম-তাযকিয়া, জিহাদ-সিয়াসত। তিনটিই আল্লাহর রাস্তা। হাদীসে এসেছে-
مَنْ خَرَجَ فِي طَلَبِ العِلْمِ فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللهِ حَتّى يَرْجِعَ.
যে ইলম অর্জনে বের হয়, সে ফিরে আসা পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায়। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৪৭
অন্য হাদীসে এসেছে-
مَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةُ اللهِ هِيَ العُلْيَا، فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللهِ عَزّ وَجَلّ.
যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীন বুলন্দ করার জন্য লড়াই করে, সে আল্লাহর রাস্তায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৩
পুরো দ্বীনই বরং সাবীলুল্লাহ, আল্লাহর রাস্তা। আর দাওয়াত ও তাবলীগ হল আল্লাহর রাস্তারই একটি ধাপ। ইরশাদ হয়েছে-
اُدْعُ اِلٰی سَبِیْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَ الْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَ جَادِلْهُمْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ .
আপনি স্বীয় রবের পথে দাওয়াত দিন হেকমত-কৌশল ও সুন্দর নসীহতের মাধ্যমে। আর (প্রয়োজন হলে) ওদের সাথে অধিকতর উত্তম পন্থায় যুক্তিতর্ক করুন। -সূরা নাহল (১৬) : ১২৫
এই তিন কাজকে নবীওয়ালা কাজ বলে। আরেক ভাষায় বলে, নবুওতের কাজ, ফারায়েজে মানসাবে নবুওত, মানসাবে রেসালাতের দায়িত্ব।
২. মানুষের ময়দানে দ্বীনী কাজের সূচনা হয়েছে দাওয়াত-তাবলীগ দ্বারা। দাওয়াত যারা কবুল করেছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে গড়ে তুলেছেন দ্বীনের তালীম-তাযকিয়ার মাধ্যমে। আর জিহাদ ও সিয়াসতের মধ্য দিয়ে নবীজী শরীয়তের বুলন্দি, নেফায (রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োগ) ও হেফাজত নিশ্চিত করেছেন। নবুওতের সূচনালগ্নে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
یٰۤاَیُّهَا الْمُدَّثِّرُ، قُمْ فَاَنْذِرْ.
হে চাদরওয়ালা! উঠুন, মানুষকে সতর্ক করুন। -সূরা মুদ্দাছছির (৭৪) : ১-২
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
اَطِیْعُوا اللهَ وَ اَطِیْعُوا الرَّسُوْلَ، فَاِنْ تَوَلَّوْا فَاِنَّمَا عَلَیْهِ مَا حُمِّلَ وَ عَلَیْكُمْ مَّا حُمِّلْتُمْ، وَ اِنْ تُطِیْعُوْهُ تَهْتَدُوْا، وَ مَا عَلَی الرَّسُوْلِ اِلَّا الْبَلٰغُ الْمُبِیْن.
তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং তোমরা রাসূলের আনুগত্য কর। যদি তারা আনুগত্য-বিমুখ হয়, তবে নবীকে যতটুকু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তার যিম্মাদারি ততটুকুই। আর তোমাদেরকে যত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তার দায় তোমাদের উপর। ‘রাসূলের দায়িত্ব’ কেবল পরিষ্কারভাবে তাবলীগ করা-পৌঁছে দেওয়া। -সূরা নূর (২৪) : ৫৪
আরও ইরশাদ হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْكَ مِنْ رَّبِّكَ، وَ اِنْ لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَه .
হে রাসূল! আপনি পৌঁছে দিন, যা আপনার কাছে আপনার রবের তরফ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। যদি তা না করেন, তবে তো আপনি আল্লাহর রেসালা-পয়গাম পৌঁছালেন না। -সূরা মায়েদা (৫) : ৬৭
আয়াতে উল্লেখিত ‘রাসূলের দায়িত্ব’ শব্দ-বন্ধ থেকেই প্রতীয়মান হয়, দাওয়াত ও তাবলীগ হল নবুওত ও রেসালতের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
আর তালীম ও তরবিয়তকে নবুওতের ফারায়েজে মানসাবি (নবুওতের পদগত দায়িত্ব) হিসাবে ঘোষণা করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اِذْ بَعَثَ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیْهِمْ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَة .
মুমিনদের উপর আল্লাহ বড় অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে এমন একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের সামনে আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত করে শোনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের তালীম প্রদান করেন। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৬৪
আল্লাহ তাআলার দরবারে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কী কী মৌলিক কাজের জন্য একজন নবী পাঠানোর আরজি পেশ করেছেন, তা কুরআন মাজীদে এসেছে এইভাবে-
رَبَّنَا وَ ابْعَثْ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِكَ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ وَ یُزَكِّیْهِمْ ، اِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ.
হে আমাদের রব! তাদের মাঝে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের সামনে আপনার কালাম তিলাওয়াত করে শোনাবেন, কিতাব ও হিকমতের তালীম প্রদান করবেন এবং তাদের তাযকিয়া করবেন। -সূরা বাকারা (২) : ১২৯
নবীজী নিজেই ইরশাদ করেন-
إِنّ اللهَ لَمْ يَبْعَثْنِي مُعَنِّتًا، وَلَا مُتَعَنِّتًا، وَلَكِنْ بَعَثَنِي مُعَلِّمًا مُيَسِّرًا.
কাউকে কষ্টে নিক্ষেপকারী বা কারো পদস্খলনকামী হিসাবে আল্লাহ আমাকে পাঠাননি। আমাকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন সহজকারী ও শিক্ষকরূপে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১০৪
অন্য হাদীসে এসেছে-
خَرَجَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ ذَاتَ يَوْمٍ مِنْ بَعْضِ حُجَرِهِ، فَدَخَلَ الْمَسْجِدَ، فَإِذَا هُوَ بِحَلْقَتَيْنِ، إِحْدَاهُمَا يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ، وَيَدْعُونَ اللهَ، وَالْأُخْرَى يَتَعَلّمُونَ وَيُعَلِّمُونَ، فَقَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: كُلّ عَلَى خَيْرٍ، هَؤُلَاءِ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ، وَيَدْعُونَ اللهَ، فَإِنْ شَاءَ أَعْطَاهُمْ، وَإِنْ شَاءَ مَنَعَهُمْ، وَهَؤُلَاءِ يَتَعَلّمُونَ وَيُعَلِّمُونَ، وَإِنّمَا بُعِثْتُ مُعَلِّمًا فَجَلَسَ مَعَهُمْ.
একবার নবীজী কামরা থেকে বের হয়ে মসজিদে প্রবেশ করলেন, তখন মসজিদে দুটি হালকায় দ্বীনী কাজ হচ্ছিল। এক হালকার লোকেরা কুরআন মাজীদ পাঠ করছিলেন এবং দুআ করছিলেন। আরেক হালকার লোকেরা দ্বীন শিখছিলেন এবং শিক্ষা দিচ্ছিলেন। নবীজী বললেন, উভয় হালকা নেক কাজে রয়েছে। এরা কুরআন পাঠ করছে দুআ করছে। আল্লাহ চাইলে তাদের বাসনা পূরণ করবেন বা করবেন না। আর এরা দ্বীন শিখছে শেখাচ্ছে। ‘আমি তো শিক্ষক হিসাবে প্রেরিত হয়েছি’-এই বলে নবীজী শিক্ষার মজলিসে বসে পড়লেন। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২২৯
আর জিহাদ ও সিয়াসতে মুদুন (সমাজ-পরিচালনা)-কে নবুওতের দায়িত্ব বলে ঘোষণা করে নবীজী ইরশাদ করেন-
كَانَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ تَسُوسُهُمُ الأَنْبِيَاءُ، كُلّمَا هَلَكَ نَبِيّ خَلَفَهُ نَبِيّ، وَإِنّهُ لاَ نَبِيّ بَعْدِي، وَسَيَكُونُ خُلَفَاءُ فَيَكْثُرُونَ.
নবীগণ বনী ইসরাইলকে (রাজনৈতিকভাবেও) পরিচালনা করতেন। এক নবীর প্রস্থান হতেই আরেক নবী আগমন করতেন। কিন্তু আমার পরে কোনো নবী নেই। তবে আমার (ধর্ম-রাজনৈতিক স্থলাভিষিক্ত) খলিফা (আমীরুল মুমিনীন) হবে এবং অনেক হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৫৫
আরও ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ تَرَكَ مَالًا فَلِوَرَثَتِهِ وَمَنْ تَرَكَ كَلّا فَإِلَيْنَا.
যে সম্পদ রেখে মারা যাবে, তার সম্পদ পাবে ওয়ারিশরা। আর যে নির্ধন অবস্থায় ওয়ারিশ রেখে যাবে, তার ওয়ারিশদের দায়িত্ব নেব আমরা। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩৯৮
অর্থাৎ রাষ্ট্র-প্রধান হিসাবে উম্মতের আর্থ-সামাজিক দায়িত্ব নবীজী নিজের যিম্মায় নিয়েছেন। একবার নবীজী ইরশাদ করেন-
أَنَا مُحَمّدٌ، وَأَنَا أَحْمَدُ، وَأَنَا نَبِيّ الرّحْمَةِ، وَنَبِيّ التّوْبَةِ، وَأَنَا الْمُقَفّى، وَأَنَا الْحَاشِرُ، وَنَبِيّ الْمَلَاحِمِ.
আমি মুহাম্মাদ, আমি আহমাদ, আমি নবীয়ে রহমত, তওবার নবী, আমি মুকাফ্ফী (সর্বশেষ আগমনকারী), আমি হাশির (আমার পিছনে পিছনে সকলকে একত্রিত করা হবে), আমি যুদ্ধ-জিহাদের নবী। -শামায়েলে তিরমিযী, হাদীস ৩৬৮
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
هُوَ الَّذِیْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰی وَ دِیْنِ الْحَقِّ لِیُظْهِرَهٗ عَلَی الدِّیْنِ كُلِّهٖ، وَ كَفٰی بِاللهِ شَهِیْدًا.
তিনি সেই সত্ত্বা, যিনি আপন রাসূলকে সুপথ ও দ্বীনে হক দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যেন তিনি এই দ্বীনকে অন্য সব ধর্মের উপর (দালীলিক, প্রায়োগিক ও রাজনৈতিকভাবে) বিজয়ী করেন। -সূরা ফাতহ (৪৮) : ২৮
নবীজী ইরশাদ করেন-
بُعِثْتُ بَيْنَ يَدَيِ السّاعَةِ بِالسّيْفِ حَتّى يُعْبَدَ اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ...
কিয়ামতের পূর্বলগ্নে আমাকে তলোয়ার দিয়ে পাঠানো হয়েছে। যাতে এক আল্লাহর ইবাদত হতে পারে, যার কোনো শরিক নেই।... -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৫১১৫
৩. এই তিন ময়দানের দ্বীনী কাজ সমান গুরুত্বপূর্ণ ও দরকারি। সুতরাং সামর্থ্য অনুযায়ী তিন ময়দানের কাজ চালু রাখা, চালু করার পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া উম্মতের উপর জরুরি দায়িত্ব। বাকি সাময়িকভাবে স্থান-কাল-পাত্রভেদে শর্ত সাপেক্ষে একেক সময় একেক কাজ ও তার নেজাম তারজিহ (প্রাধান্য) পায়। যার তফসিল অনেক দীর্ঘ। তারজিহাত চূড়ান্ত করার জন্য অনেক অনেক ইলম দরকার, অনেক বেশি সতর্কতা ও সমঝদারি প্রয়োজন।
৪. দাওয়াত ও তাবলীগ হল দ্বীনের তলব পয়দা করার জরিয়া (মাধ্যম)। যার ভিতর দ্বীনের তলব নেই, তার ভিতর দ্বীনের তলব পয়দা করা দাওয়াতের কাজ। যখন কারো মাঝে দ্বীনের চাহিদা জাগ্রত হয়, সেই দ্বীনী চাহিদা পুরা করার জন্য তাকে কুরআন-সুন্নাহর শরণাপন্ন হতে হয়, যারা কুরআন-সুন্নাহর তালীমের সাথে জড়িত, তাদের কাছে আসতে হয়। তালীম ও দাওয়াতের হাকীকতের মাঝে এতটুকুই পার্থক্য বলা হয় যে, যার মাঝে দ্বীনের তলব নেই, তার কাছে একটুখানি দ্বীন পৌঁছানোর নাম দাওয়াত। আর যার মাঝে তলব আছে, তাকে সমুদ্বয় দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার নাম তালীম।
মোটকথা, দাওয়াত সাবীলুম মিন সুবুলিল্লাহ (আল্লাহর রাস্তাসমূহের একটি রাস্তা)। তালীম সাবীলুম মিন সুবুলিল্লাহ। সিয়াসতে শরইয়্যাহ (ইসলামী শরীয়া প্রয়োগ ও বিজয়ী করার রাজনীতি) সাবীলুম মিন সুবুলিল্লাহ। এই তিন কাজ একে অপরের অপরিহার্য সহযোগী। এর কোনো একটাকে অবহেলা করলে দ্বীনের স্বরূপ উদ্ভাসিত হয় না। তাই এই তিন কাজের কোনো কাজে অংশ নিতে পেরেই আত্মতৃপ্ত হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। কোনো এক কাজকেই সব কিছু ভাবা উচিত নয়। এইজন্য এক ময়দানের ব্যক্তিকর্তৃক আরেক ময়দানের কর্মীকে তুচ্ছ ভাবা মারাত্মক ‘তাআছ্ছুব’ (অন্যায় পক্ষপাত), যা হারাম! এক ময়দানের গুরুত্ব দিতে গিয়ে আরেক ময়দানকে ছোট করা বড় ধরনের আত্মপ্রতারণা, যা সম্পূর্ণ গর্হিত।
৫. অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াত উম্মতের অতি গুরুত্বপূর্ণ যিম্মাদারি। আর দাওয়াত মুসলিমদের মাঝেও হতে হবে। কোনো খাস আমল ও বিধানের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার জন্যও দাওয়াত হতে পারে, শিরক-বিদআত ও নাস্তিকতার ব্যাপারে সতর্কতা তৈরির জন্য দাওয়াত হতে পারে। দাওয়াতের আরও অনেক ক্ষেত্র আছে। তাছাড়া এই এক ময়দানের কাজও তো কয়েক পদ্ধতিতে কয়েক স্তরে করা যায়। সঠিক নিয়মে যুক্তিতর্ক করা, ওয়ায-নসীহত করা দাওয়াতেরই এক তরিকা, যার কথা কুরআনে এসেছে [সূরা নাহল (১৬) : ১২৫]। নবীজী ঘরেঘরে বাজারে-ঘাটে গিয়ে সরাসরি দাওয়াত দিয়েছেন। চিঠির মাধ্যমেও দাওয়াত দিয়েছেন। দাওয়াত ও তাবলীগের চলমান শেকেলে যুক্তিতর্ক, ওয়াজ মাহফিল ও চিঠির দাওয়াতের চেয়ে গাশতের দাওয়াত অধিক মকবুল। সুতরাং ইলিয়াস রাহ.-এর বাতলানো এই শেকেলকে একটু খাস করে বললে হবে, সাবীলুম মিন সুবুলিদ্ দাওয়াহ (দাওয়াতের কয়েক পদ্ধতির এক পদ্ধতি)। মুজাদ্দিদে আলফে সানী রাহ.-এর দাওয়াতের মূল তরতিব ছিল চিঠি। এই শেকেলের মাধ্যমে সে যুগে দ্বীনী দাওয়াতের বিরাট কাজ আঞ্জাম পেয়েছে এবং সফল হয়েছে। রহমাতুল্লাহ কিরানবী রাহ.-এর দাওয়াত ছিল মোনাযারার শেকেলে। তাঁর এই তরিকার দাওয়াতের ফলে কত মানুষের যে ঈমানের হেফাজত হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তেমনি জুমার মিম্বর ও মওসুমি মাহফিলের মাধ্যমে দাওয়াতের বিরাট কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন বহু আলেম। শরীয়াবিধি বাস্তবায়নে জাতিকে উদ্বুদ্ধকরণের দাওয়াতও রাজনৈতিক শিরোনামে অনেক আগ থেকেই চলে আসছে। বর্তমানে দাওয়াতের প্রয়োজনে প্রায় সবাই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ব্যবহার করছে। সুতরাং দাওয়াতকে বিশেষ কোনো তরতীব ও শেকেলের মাঝে খাস মনে করা ঠিক নয়।
৬. সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তি-উদ্যোগে দাওয়াতের কাজ হয়েছে। এক ব্যক্তি ও তার অল্পসংখ্যক অনুসারীদের দরদী প্রচেষ্টায় বিরাট বিরাট সাফল্য এসেছে। ধারাবাহিকভাবে সব যুগেই দাওয়াতের কাজ হয়েছে। কোনো যুগেই দাওয়াত ও তালীম একেবারে বন্ধ ছিল না। যে যুগে যেমন দরকার ছিল, তার সমস্ত না হলেও কাছাকাছি তাকাজা পুরা হয়েছে। কাজের নেজামে কেবল পরিবর্তন এসেছে। মৌলিক নীতিমালা ঠিক রেখে কিছু এন্তেজামি সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে যুগে যুগে। অতীতের এক একজন দায়ী কী পরিমাণ দাওয়াতের কাজ করেছেন, তা চিন্তা করলে আমাদের কালের সুসংগঠিত বিশাল আয়োজনকেও অতি সামান্য মনে হয়। ইতিহাস বলে, হিন্দুস্তানে এক খাজা মুঈনুদ্দীন আজমিরী রাহ.-এর দাওয়াতে প্রায় কোটি মানুষ দ্বীন কবুল করেছে!
৭. হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. যুগের চাহিদা সামনে রেখে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলাপূর্ণ দাওয়াতী কাজের যে তরতীব ও নেজাম পেশ করেছেন, এই নেজামের কিছু অংশ তো সরাসরি মাসনূন আর কিছু মোবাহ। পুরো শেকেল ‘মাসনূন’ নয় এবং ‘মানসূস’ও নয়। বাকি এই তরতীবের সাফল্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। এই নেজামের দাওয়াতে এখনো খায়র বেশি (যদি নেযাম যথাযথ রক্ষা করা হয় এবং এই নেযামকে অন্যায় পরিবর্তনের হাত থেকে রক্ষা করা যায়)। এরপরও বর্তমান দাওয়াতের কাজ আগেরচে’ও বেশি ফলপ্রসূ হচ্ছে কিংবা আল্লাহ তাআলার কাছে অধিক মকবুল হচ্ছে- বলা মুশকিল। আগে যে পরিমাণ মানুষ মুসলমান হয়েছে, এখন তা কোথায়? আগের দাওয়াতে রাষ্ট্রীয়ভাবেও দ্বীন কায়েম হয়েছে, এখন সেই পরিবর্তিত রাষ্ট্র কোথায়? হাঁ, এর মাধ্যমে সর্বগ্রাসী পতনের গতি কমানো গেছে। যুগের চাহিদা অনুসারে দ্বীনের মৌলিক দাওয়াত গতি লাভ করেছে। দ্বীনের অন্যান্য শো‘বার মতো যুগের চাহিদা সামনে রেখে দাওয়াতের শো‘বাতেও হরকত এসেছে।
৮. দ্বীন হল কুরআন ও হাদীসের সমষ্টি। কুরআন-হাদীসের সমর্থন ছাড়া কোনো কাজ দ্বীনী কাজ হতে পারে না। কুরআন-হাদীসের এই সমর্থন আলেমগণের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়। এইজন্য আহলে ইলমের প্রধান ব্যস্ততা তালীম হলেও তাঁরাই দাওয়াত ও সিয়াসতের প্রধান তত্ত্বাতধায়ক, সমস্ত কাজের ভালো-মন্দ নিরূপক। নবীজী ইরশাদ করেন-
خُذُوا الْعِلْمَ قَبْلَ أَنْ يَذْهَبَ. قَالُوا: وَكَيْفَ يَذْهَبُ الْعِلْمُ يَا نَبِيّ اللهِ، وَفِينَا كِتَابُ اللهِ؟ قَالَ: فَغَضِبَ، ثُمّ قَالَ: ثَكِلَتْكُمْ أُمّهَاتُكُمْ أَوَلَمْ تَكُنِ التّوْرَاةُ وَالْإِنْجِيلُ فِي بَنِي إِسْرَائِيلَ، فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمْ شَيْئًا؟ إِنّ ذَهَابَ الْعِلْمِ أَنْ يَذْهَبَ حَمَلَتُهُ، إِنّ ذَهَابَ الْعِلْمِ أَنْ يَذْهَبَ حَمَلَتُهُ.
ইলম বিদায় হওয়ার আগে অর্জন করে নাও। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর নবী! ইলম আবার বিদায় নিবে কীভাবে? আমাদের কাছে তো আল্লাহর কিতাব রয়ে গেছে! বর্ণনাকারী বলেন, একথা শুনে নবীজী একরকম রাগই করলেন। এরপর বললেন, আরে বোকা! বনী ইসরাঈলের কাছে কি তাওরাত-ইঞ্জিল ছিল না? কিন্তু শুধু কিতাবের বিদ্যমানতা দিয়ে তাদের গোমরাহী ঠেকানো যায়নি। ইলম চলে যাওয়ার অর্থ আহলে ইলম চলে যাওয়া। ইলম চলে যাওয়ার অর্থ আহলে ইলম চলে যাওয়া। -সুনানে দারেমী, হাদীস ২৪৬
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
يَحْمِلُ هَذَا الْعِلْمَ مِنْ كُلِّ خَلَفٍ عُدُولُهُ، يَنْفُونَ عَنْهُ تَحْرِيفَ الْغَالِينَ، وَانْتِحَالَ الْمُبْطِلِينَ، وَتَأْوِيلَ الْجَاهِلِينَ.
প্রত্যেক প্রজন্মের নির্ভরযোগ্য নেককার উত্তরসূরীরা (পূর্বসূরীদের কাছ থেকে) এই দ্বীনী ইলম ধারণ করবে। আর তারা গুলুকারীদের (বাড়াবাড়ির) বিকৃতি, ইসলাম বিরোধী বাতিলপন্থীদের মিথ্যাচার এবং মূর্খ-জাহেলদের অপব্যাখ্যা বিদূরিত করবে (দ্বীনের স্বরূপ সংক্ষরণ করবে)। -শরহু মুশকিলিল আছার, বর্ণনা ৩৮৮৪
এইজন্য আলেমগণ একইসঙ্গে দাওয়াতসহ সকল দ্বীনী কাজের সঠিক দিকগুলোর প্রথম সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক, ভুল দিকগুলোর প্রথম সমালোচক ও সতর্ককারক।
হযরত মাওলানা তাকী উসমানী দা. বা. বলেন, আমার পিতা মুফতি শফী রাহ. হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর সাথে নেযামুদ্দীনে দেখা করতে গেলেন। তখন ইলিয়াস রাহ. অসুস্থ ছিলেন। আব্বাকে পেয়ে হযরত জারজার হয়ে কাঁদতে লাগলেন এবং বললেন, সাধারণ মানুষ এই জামাতে প্রচুর পরিমাণে শরীক হচ্ছে। কিন্তু জামাতে আহলে ইলম সংখ্যায় কম। আমার আশংকা, সাধারণ মানুষের হাতে জামাতের নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে হতে পারে পরবর্তীতে তারা কাজকে ভুল পথে পরিচালিত করবে। এই জামাত যেন বিপথগামী না হয়, এর দায় যেন আমার উপর না বর্তায়, এই জন্য আমার দিল চায়, আহলে ইলম বেশি বেশি এই জামাতে দাখিল হোক এবং এই জামাতের পরিচালনার কাজ আঞ্জাম দিক। -তাকরীরে তিরমিযি ৫/২১৩
৯. এই তিন কাজের প্রত্যেকটিই এমন, যার হক আদায় করার জন্য জীবনের প্রতিটি ক্ষণ ওয়াকফ করাও যথেষ্ঠ নয়। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তির পক্ষে তিন ময়দানেরই হক আদায় করা কী করে সম্ভব? যদিও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাই তিন ময়দানের যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন এবং তিন কাজেরই পূর্ণ তত্ত্বাবধান ও তদারকি করেছেন। নবীজীর কর্মযোগ্যতা ও কর্মস্পৃহা তো এক বিশাল মুজেযা। কিন্তু পরবর্তীদের পক্ষে একসঙ্গে তিন কাজের হক আদায় করা সম্ভব হয়নি। তাই শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও পারিবারিক ইত্যাদি দিক বিবেচনা করে একেকজন একেক ময়দান বেছে নিয়েছেন। অপরাপর ময়দানে সময়-সুযোগ মতো অংশ নিয়েছেন। খালিদ বিন ওয়ালীদ রা. জীবনভর জিহাদের ময়দানে কাজ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর প্রধান শোগল-ব্যস্ততা ছিল তালীম। আবু যর গিফারী রাহ.-এর জীবন কেটেছে দাওয়াত ও আমর বিল মারূফ নাহি আনিল মুনকারের ময়দানে। পরবর্তীদের মাঝে এই কর্মবণ্টন-নীতি আরও পরিষ্কার। কিন্তু তখন এক ময়দান আরেক ময়দানের পূর্ণ সমর্থক ও সহযোগী ছিল। বর্তমানে আমরা এক ময়দানের কর্মীরা অন্য ময়দানের সহীহ তরিকার কর্মীকেও প্রতিপক্ষ ভাবি, তার দিকে বাঁকা চোখে তাকাই। প্রথমে নিজেদের একটা নাম দিই, বিশেষ কিছু প্রতীক নির্ধারণ করে নিই, এর উপর সহযোগিতা-অসহযোগিতা এবং মহব্বত ও দুশমনির ভিত্তি স্থাপন করি। এভাবে আমরা বিভাজনের প্রাচীর খাড়া করি। অথচ এসব কখনো সহযোগিতা-অসহযোগিতা এবং মহব্বত ও দুশমনির ভিত্তি হতে পারে না। সহযোগিতা-অসহযোগিতা এবং মহব্বত ও দুশমনির ভিত্তি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
تَعَاوَنُوْا عَلَی الْبِرِّ وَ التَّقْوٰی وَ لَا تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَانِ .
আর তোমরা নেককাজ ও খোদাভীতির আমলে একে অপরকে সহযোগিতা করো এবং গুনাহ ও সীমালংঘনে কেউ কারো সহযোগী হয়ো না। -সূরা মায়েদা (৫) : ২
সুতরাং যেখানে যতটুকু নেককাজ হচ্ছে, সেখানে ততটুকু সহযোগিতা। আর যতটুকু বদকাজ হচ্ছে, ততটুকু অসহযোগিতা। বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি কাম্য নয়। ইনসাফ-এতেদাল এই উম্মতের বৈশিষ্ট্য।
১০. দাওয়াতের মেহনতে কমতির কারণে আজ আমাদের যে দশা তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? কালিমা, নামায, ইলম ও যিকির, তাসহীহে নিয়ত, ইকরামুল মুসলিমীন, দাওয়াত ও তাবলীগ- এ ছয় শিরোনামে কাজ চলছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আরও বহু শিরোনামের দাওয়াতী ময়দান বলা যায় খালিই পড়ে আছে। আসলে এখন অধঃগতি ও গাফলত সব ময়দানে। ভেবে দেখুন, কুরআন-সুন্নাহর ইলম অর্জনের মেহনত কি খুব সন্তোষজনক? জিহাদ ও সিয়াসতে শারইয়্যারই বা কী অবস্থা! ব্যক্তিগত নেক-আমলে আমাদের উদাসিনতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? সুতরাং আমরা যেমন দাওয়াতের বিভিন্ন ময়দানে পিছিয়ে আছি, সিয়াসতেও পিছিয়ে আছি। মুসলমানদের আসমানী তালীম ও জমিনী তালীমের মান তলায় নেমে গেছে। এমতাবস্থায় সহীহ তরিকায় তিন ময়দানই জিন্দা করার ব্যাপক ফিকির প্রয়োজন।
১১. আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার যৌথভাবে দাওয়াত ও সিয়াসতের শাখা। দাওয়াতের ময়দানে আমর বিল মারূফ বেশি হয়। আর সিয়াসতের ময়দানে নাহি আনিল মুনকার বেশি হয়। আমর বিল মারূফ করলে নাহি আনিল মুনকার আর লাগবে না, এমন ধারণা ঠিক নয়। নবীজী ইরশাদ করেন-
مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ.
তোমাদের কেউ গর্হিত কিছু দেখলে হাত দিয়ে (শক্তি প্রয়োগ করে) পাল্টে দিবে, এই সামর্থ্য না থাকলে জবান দিয়ে চেষ্টা করবে, তাও না পারলে হৃদয় দিয়ে ঘৃণা করবে। আর এটা ঈমানের দুর্বলতম দাবি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৯
এই জন্য বদদ্বীনীর অন্ধকার দূর করতে নবীজী শুধু দাওয়তের আলো ব্যবহার করেছেন তা নয়, যখন সামর্থ্য হয়েছে, তখন অন্ধকার বিদূরণের জন্য জিহাদের তলোয়ার ও সিয়াসতের দোররাও ব্যবহার করেছেন।
১২. দাওয়াতী মেযাজ হল সর্বাবস্থায় ক্ষমা, কোমলতা, মায়া-মমতা, উদারতা ইত্যাদি। কিন্তু সিয়াসী ময়দানের মেযাজ এর থেকে খানিকটা ব্যতিক্রম। সেখানে কড়া-কঠোর সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে হয়। সমালোচনা করে কথা বলা লাগে। মোটকথা শরঈ সীমার ভিতর থেকে সিয়াসতের ময়দানে যা কিছু হয়, তা দাওয়াতের ময়দানের আচরণ থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রম নবীজীর সীরাতেও আছে। যার দাওয়াত গ্রহণের সম্ভাবনা থাকতো, নবীজী তার সাথে দাঈসুলভ আচরণ অব্যাহত রাখতেন। কিন্তু যার ক্ষেত্রে বুঝে গেছেন যে, তার দাওয়াত কবুলের সম্ভাবনা নেই, নবীজী তার সাথে সিয়াসী আচরণ করেছেন। যে ব্যক্তি নবীজীকে একা পেয়ে সরাসরি তরবারি উঁচিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল, নবীজী তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অন্য দিকে ইবনে খতলের ব্যাপারে বলেছেন, ওকে কাবার গিলাফে ঝুলে থাকতে দেখলেও মেরে ফেলবে! শাসক হিসাবে নবীজী কা‘ব ইবনে আশরাফকে নিজে গোয়েন্দা পাঠিয়ে হত্যা করিয়েছেন। একদিকে কাফেরদের সমালোচনায় হাসসান বিন সাবেতকে কবিতা রচনার হুকুম করেছেন, আবার আম্মাজান আয়েশার রূঢ় কথার কারণে নবীজী বলেছেন, থাক্ আয়েশা! ন¤্রভাষী হও, রূঢ় ভাষা বাদ দাও (সহীহ বুখারী, হাদীস ২৯৩৫)। একদিকে তায়েফ থেকে এসে দুআ করছেন, হে আল্লাহ! আমার কওমকে বুঝ দিয়ে দিন, তারা অবুঝ। কিন্তু নবীজী বীরে মাউনার ঘটনার পর এক মাস পর্যন্ত কাফেরদের উপর লানত করেছেন। যারা সেজদারত অবস্থায় নবীজীর পিঠের উপর উটের ভুঁড়ি চাপিয়ে দিয়েছিল, তাদের নাম ধরে ধরে নবীজী অভিশাপ দিয়েছেন। এই দুই ধরনের আচরণের একটা মূলত দাওয়াতের ময়দানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, আরেকটা সিয়াসতের ময়দানের জন্য। দুটোই দ্বীনের তাকাযা, শরঈ সীমার ভিতরে কোনোটাই দ্বীন-বিরোধী নয়।
১৩. স্মরণ রাখতে হবে, যেসমস্ত সোনালি উসূলের কারণে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর এই তরিকা ব্যাপক পরিসরে মকবুল হয়েছে এবং পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, তা সর্বাবস্থায় সংরক্ষণ করা দরকার। এইগুলো লংঘিত হওয়ার কারণে আজ খোদ নেযামুদ্দিনেই ফেতনা আরম্ভ হয়েছে, এই তরিকাটি চরমভাবে তার মকবুলিয়াত ও পৃষ্ঠপোষকতা হারাচ্ছে। সুতরাং সেই বুনিয়াদি উসূলগুলো স্মরণ রেখেই ছয় উসূলের কাজ করতে হবে, কিছুতেই বুনিয়াদি উসূলগুলো বিসর্জন দেওয়া যাবে না। এগুলো সার্বজনীন উসূল। যুগযুগ ধরে তাবলীগের মুরুব্বিগণের মুখে আমরা এই উসূলগুলো শুনে আসছি। মুহতারাম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দা. বা. তাঁর এক বয়ানে মূলনীতিগুলো তুলে ধরেছেন।
এই বুনিয়াদি মূলনীতিগুলোর প্রথমটি হল, যারা এই কাজের নেতৃত্ব দেবে, তারা আকিদা-বিশ্বাসে, চিন্তা-চেতনায় ও আমলে-আখলাকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অনুসারী হবে। সুতরাং এই উসূল অনুসারে অধিকাংশ আলেম যার ব্যাপারে অনাস্থা-আশংকা প্রকাশ করবেন, তার হাতে জামাতের শরঈ যিম্মাদারী সোপর্দ করা যাবে না। যার কথাবার্তা-আচার-আচরণ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বাইরে চলে যায়, তার হাতে বড় ধরনের এন্তেজামি কাজও ন্যাস্ত না করা।
দ্বিতীয় হল, দ্বীনের অন্য হালকা ও তার কর্মপন্থার কোনো সমালোচনা করবে না। তালীম, সিয়াসত, জিহাদ, খানকা, ওয়ায-মোনাযারা ইত্যাদি কাজের লোকজনকে বাঁকা চোখে দেখবে না, পারলে সহযোগিতা করবে এবং মোটের উপর সহীহ তরিকায় কর্মরত ঐ হালকার কোনো ব্যক্তিকে নিজেদের হালকায় আনার জন্য কোনো ধরনের জবরদস্তি করবে না।
তৃতীয় হল, নিজেরা ফিকহি মাসআলা মেনে চলবে। মাসআলা শিখবে আলেমগণের কাছে গিয়ে। কিন্তু এই জামাতের মিম্বর থেকে ফতোয়া বা মাসআলা দেওয়া হবে না। আলেমগণের ইখতেলাফী মাসআলা বলার তো প্রশ্নই আসে না। আর যেহেতু এতদঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ হানাফী মাযহাব মতো কুরআন-সুন্নাহর উপর আমল করে, তাই এই জামাতের কেন্দ্র হানাফী মাযহাব অনুসরণ করবে। কিন্তু অন্য মাযহাব অনুসরণের ব্যাপারে সাধরণ কাউকে বাধা দেওয়া হবে না।
চতুর্থ হল, কেন্দ্র থেকে সাধারণ স্তর পর্যন্ত সবাই মশওয়ারা সাপেক্ষে কাজ করবে। মশওয়ারা ব্যতীত একক সিদ্ধান্তে কোনো কাজ চলবে না।
এগুলো হল উসূলের উসূল। এগুলো লঙ্ঘন হওয়ার কারণে আজ পুরো তরিকা বেবরকতির শিকার। সবাই নিজেকে প্রশ্ন করি, আমার দ্বারা এই নীতিগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে, মারকাযে এর কতটুকু অনুসৃত হচ্ছে। আসুন আমরা সবাই এই উসূলগুলো জিন্দা করি। নিজেদের মানসিকতা পরিশুদ্ধ করি। উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধান কবুল করি। দ্বীনের এই মোবারক জামাতকে আপন করি। কাজ নিয়ে বেশি বেশি বের হওয়ার ফিকির করি। আল্লাহ তাআলা সাবইকে তাওফিক দান করুন। এই কাজকে আল্লাহ তাআলা হেফজত করুন- আমীন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন