মুসলিম হওয়ার জন্য যে তিনটি জিনিসের কথা বলা হয় তা কি কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত? নাকি মনগড়া?
প্রশ্নঃ ১০১৪২৪. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, একজন আলেম বয়ান করেছিলেন মুসলিম হওয়ার জন্য ৩টি বিষয় শর্ত-১/এক্বরার বিল লিসান ২/তাসদিক বিল জিনান৩/আমল বিল আরকান,জানতে চাচ্ছি এগুলো কি কোরআন হাদিসে কোথাও শর্ত দেওয়া আছে? নাকি মনগড়া?একটু বিস্তারিত দলিলভিত্তিক জানালে খুবই উপকৃত হতাম
১ মে, ২০২৫
Bamatia
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই! মুসলিম হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত কুরআন ও হাদীস দ্বারাই প্রমাণিত। একসাথে পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসে পাওয়া যায়।
১- মুখে স্বীকারোক্তি (الإقرار باللسان), অন্তরে বিশ্বাস (التصديق بالجنان) ও আমলে পরিণত করা (العمل بالأركان) এর দলীল:
قَالَتِ الۡاَعۡرَابُ اٰمَنَّا ؕ قُلۡ لَّمۡ تُؤۡمِنُوۡا وَلٰکِنۡ قُوۡلُوۡۤا اَسۡلَمۡنَا وَلَمَّا یَدۡخُلِ الۡاِیۡمَانُ فِیۡ قُلُوۡبِکُمۡ ؕ وَاِنۡ تُطِیۡعُوا اللّٰہَ وَرَسُوۡلَہٗ لَا یَلِتۡکُمۡ مِّنۡ اَعۡمَالِکُمۡ شَیۡئًا ؕ اِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
বেদুঈনরা বলে আমরা ঈমান এনেছি। তাদেরকে বল, তোমরা ঈমান আননি। তবে এই বল যে, আমরা আত্মসমর্পণ করেছি। ঈমান এখনও তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি। তোমরা যদি সত্যিই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, তবে আল্লাহ তোমাদের কর্মের (সওয়াবের) ভেতর কিছুমাত্র কম করবেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সূরা হুজুরাত, আয়াত নং ১৪)
তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন:
বেদুঈনদের কিছু লোক মৌখিকভাবে কালেমা পড়েই নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবি করছিল, অথচ তারা আন্তরিকভাবে ঈমান আনেনি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কেবল মুসলিমদের মত অধিকার লাভ করা। মদীনা মুনাওয়ারায় এসে তারা রাস্তাঘাটও নষ্ট করে ফেলেছিল। এ আয়াতসমূহে তাদের মুখোশ খুলে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, সাচ্চা মুসলিম হওয়ার জন্য কেবল মুখে কালেমা পড়ে নেওয়া যথেষ্ট নয়। বরং মনে প্রাণে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসসমূহ স্বীকার করে নেওয়া এবং নিজেকে ইসলামী বিধানাবলীর অধীন বানিয়ে নেওয়া জরুরি।
নোট: উল্লেখিত আয়াতের ইসলাম আনায়ন বা ঈমানের স্বীকারোক্তি তিনটি বিষয়ের উপরই বুঝা যায়।
২- অন্তরে বিশ্বাস (التصديق بالجنان)
یُخٰدِعُوۡنَ اللّٰہَ وَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ۚ وَمَا یَخۡدَعُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡفُسَہُمۡ وَمَا یَشۡعُرُوۡنَ ؕ
তারা আল্লাহকে এবং যারা (বাস্তবিক) ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোঁকা দেয় এবং (সত্য কথা এই যে,) তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না। কিন্তু (এ বিষয়ের) কোনও উপলব্ধি তাদের নেই।
(সূরা বাকারা, আয়াত নং ৯) এই আয়াতে অন্তরের বিশ্বাসকে ঈমান বলা হয়েছে। শুধু মুখে স্বীকারোক্তিকে যথেষ্টে বলা হয়নি। যেমনটি মুনাফিকদের চরিত্র।
নোট: এই আয়াতে স্পষ্ট যে, অন্তরে বিশ্বাস ছাড়া ইসলাম পূর্ণ হয় না।
৩-আমলে পরিণত করা (العمل بالأركان)
وَمَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ ۬ۙ حُنَفَآءَ وَیُقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَیُؤۡتُوا الزَّکٰوۃَ وَذٰلِکَ دِیۡنُ الۡقَیِّمَۃِ ؕ
তাদেরকে কেবল এই আদেশই করা হয়েছিল যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে, আনুগত্যকে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই জন্য খালেস রেখে এবং নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে আর এটাই সরল সঠিক উম্মতের দীন। (সূরা বাইয়্যিনাহ, আয়াত নং ৫)
নোট: এই আয়াতে স্পষ্ট যে, আমল ছাড়া ইসলাম পূর্ণ হয় না।
৪-এই হাদীসে মুখে সাক্ষ্য, অন্তরে বিশ্বাস এবং বাহ্যিক আমল (সালাত, যাকাত, সাওম, হজ) সব একত্রে ইসলামের অংশ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে।
أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ قَالَ حَدَّثَنِي عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ قَالَ بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ إِذْ طَلَعَ عَلَيْنَا رَجُلٌ شَدِيدُ بَيَاضِ الثِّيَابِ شَدِيدُ سَوَادِ الشَّعَرِ لَا يُرَى عَلَيْهِ أَثَرُ السَّفَرِ وَلَا يَعْرِفُهُ مِنَّا أَحَدٌ حَتَّى جَلَسَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَسْنَدَ رُكْبَتَيْهِ إِلَى رُكْبَتَيْهِ وَوَضَعَ كَفَّيْهِ عَلَى فَخِذَيْهِ ثُمَّ قَالَ يَا مُحَمَّدُ أَخْبِرْنِي عَنْ الْإِسْلَامِ قَالَ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَتُقِيمَ الصَّلَاةَ وَتُؤْتِيَ الزَّكَاةَ وَتَصُومَ رَمَضَانَ وَتَحُجَّ الْبَيْتَ إِنْ اسْتَطَعْتَ إِلَيْهِ سَبِيلًا قَالَ صَدَقْتَ فَعَجِبْنَا إِلَيْهِ يَسْأَلُهُ وَيُصَدِّقُهُ ثُمَّ قَالَ أَخْبِرْنِي عَنْ الْإِيمَانِ قَالَ أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْقَدَرِ كُلِّهِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ قَالَ صَدَقْتَ قَالَ فَأَخْبِرْنِي عَنْ الْإِحْسَانِ قَالَ أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ قَالَ فَأَخْبِرْنِي عَنْ السَّاعَةِ قَالَ مَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ بِهَا مِنْ السَّائِلِ قَالَ فَأَخْبِرْنِي عَنْ أَمَارَاتِهَا قَالَ أَنْ تَلِدَ الْأَمَةُ رَبَّتَهَا وَأَنْ تَرَى الْحُفَاةَ الْعُرَاةَ الْعَالَةَ رِعَاءَ الشَّاءِ يَتَطَاوَلُونَ فِي الْبُنْيَانِ قَالَ عُمَرُ فَلَبِثْتُ ثَلَاثًا ثُمَّ قَالَ لِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَا عُمَرُ هَلْ تَدْرِي مَنْ السَّائِلُ قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ فَإِنَّهُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَام أَتَاكُمْ لِيُعَلِّمَكُمْ أَمْرَ دِينِكُمْ
উমর ইবনে খাত্তাব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এর নিকট উপস্থিত ছিলাম, এমন সময় এক ব্যক্তি আগমন করলেন, যার কাপড় অত্যধিক সাদা ছিল এবং চুল অধিক কাল ছিল। বুঝা যাচ্ছিল না যে, তিনি সফর হতে এসেছেন; আর আমাদের মধ্যে কেউ তাকে চিনতে পারছিল না। তিনি নিজ হাঁটুদ্বয় তাঁর হাঁটুদ্বয়ের সাথে লাগিয়ে বসলেন, তাঁর হস্তদ্বয় তাঁর উভয় উরুর উপর রাখলেন এবং বললেনঃ হে মুহাম্মাদ! আমাকে বলুন, ইসলাম কি? তিনি বললেনঃ এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, আর মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং নামায আদায় করা, যাকাত দেওয়া, রমযানের রোযা রাখা ও পথ খরচের সামর্থ্য থাকলে হজ্জ করা। সে লোকটি বললোঃ আপনি সত্যই বলেছেন। আমরা আশ্চর্যান্বিত হলাম যে, তিনি প্রশ্ন করলেন এবং বললেনঃ আপনি সত্য বলেছেন।
এরপর তিনি বললেন, ঈমান কী, আমাকে বলুন? তিনি বললেনঃ বিশ্বাস স্থাপন করা আল্লাহর উপর, ফিরিশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ, কিয়ামত দিবস এবং নিয়তির ভাল–মন্দের উপর বিশ্বাস। তিনি বললেনঃ আপনি সত্য বলেছেন।
তারপর বললেনঃ ইহসান কি? তিনি বললেনঃ এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন তুমি আল্লাহকে দেখছাে, যদি তুমি তাকে না দেখতে পাও, তবে তিনি তোমরা তোমাকে দেখছেন।
তারপর বললেনঃ কিয়ামত কখন হবে? তিনি বললেনঃ যার নিকট প্রশ্ন করা হচ্ছে তিনি প্রশ্নকারী হতে অধিক জ্ঞাত নন। সে ব্যক্তি বললোঃ কিয়ামতের নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করুন। তিনি বললেনঃ দাসী তার মুনিবকে প্রসব করবে, নগ্ন পদ, বিবস্ত্র, গরীব, বকরীর রাখালরা বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণে প্রতিযোগিতা করবে।
উমর (রাযিঃ) বলেন, আমি তিন দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, পরে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) আমাকে বললেনঃ হে উমর! তুমি কি অবগত আছ, এই প্রশ্নকারী ব্যক্তি কে? আমি বললামঃ আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রাসূলই সমধিক অবগত। তিনি বললেনঃ তিনি ছিলেন জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম), তিনি তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শিক্ষা দিতে এসেছিলেন। (সুনানে নাসায়ী, আন্তর্জাতিক নং: ৪৯৯০)
والله اعلم بالصواب
শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী
মুফতী, ফাতাওয়া বিভাগ, মুসলিম বাংলা
গবেষক, হাদীস বিভাগ, মুসলিম বাংলা
খতীব, রৌশন আলী মুন্সীবাড়ী জামে মসজিদ, ফেনী
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন
এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর
মাসায়েল-এর বিষয়াদি
আল কুরআনুল কারীম
৪
হাদীস ও সুন্নাহ
৬
তাসাউফ-আত্মশুদ্ধি । ইসলাহী পরামর্শ
৩
শরীআত সম্পর্কিত
১৪
ফিতনাসমুহ; বিবরণ - করণীয়
২
আখিরাত - মৃত্যুর পরে
৩
ঈমান বিধ্বংসী কথা ও কাজ
৬
ফিরাকে বাতিলা - ভ্রান্ত দল ও মত
২
পবিত্রতা অর্জন
৮
নামাযের অধ্যায়
১৯
যাকাত - সদাকাহ
৫
রোযার অধ্যায়
৬
হজ্ব - ওমরাহ
২
কাফন দাফন - জানাযা
৫
কসম - মান্নত
১
কুরবানী - যবেহ - আকীকা
৪
বিবাহ শাদী
৮
মীরাছ-উত্তরাধিকার
২
লেনদেন - ব্যবসা - চাকুরী
৯
আধুনিক মাসায়েল
৬
দন্ড বিধি
২
দাওয়াত ও জিহাদ
৩
ইতিহাস ও ঐতিহ্য
৬
সীরাতুন নবী সাঃ । নবীজীর জীবনচরিত
৩
সাহাবা ও তাবেঈন
৩
ফাযায়েল ও মানাকেব
৩
কিতাব - পত্রিকা ও লেখক
৩
পরিবার - সামাজিকতা
৭
মহিলা অঙ্গন
২
আখলাক-চরিত্র
২
আদব- শিষ্টাচার
১২
রোগ-ব্যধি। চিকিৎসা
২
দোয়া - জিকির
২
নাম। শব্দ জ্ঞান
৩
নির্বাচিত
২
সাম্প্রতিক
১
বিবিধ মাসআলা
১