ঈসা আ. কী নতুন কোনো ধর্ম আনেননি? হেযবুত তওহীদ। পর্ব–২৮
ঈসা আ. কী নতুন কোনো ধর্ম আনেননি? হেযবুত তওহীদ। পর্ব–২৮
আল্লাহ পাক, হযরত ঈসাকে আ. নতুন শরীয়ত ও কিতাব দিয়ে বনী ইসরাঈলের কাছে প্রেরণ করেন। তাঁর সে শরীয়ত বা ধর্মের নাম ঈসায়ী বা খ্রিষ্টধর্ম। কিন্তু হেযবুত তওহীদ এই ধর্মটিকে অস্বীকার করে থাকে। হেযবুত তওহীদ কী বলে? তাদের দাবি হলো, হযরত ঈসা আ. শুধুমাত্র মুসা আ. এর ধর্মের আধ্যাত্মিক সংশোধনের জন্য এসেছিলেন। নতুন কোনো নিয়ম কানুন বা নতুন কোনো ধর্ম নিয়ে আসেননি। দেখুন তারা লিখেছে, এই নবী রসুল পাঠানোর ধারাবাহিকতায় শেষ রসুল মোহাম্মদ (সা.) এর আগমনের প্রায় ৫০০ বছর আগে আল্লাহ পাঠালেন ঈসাকে (আ.)। তাঁকে পাঠানো হয়েছিল শুধুমাত্র মুসা (আ.) এর অনুসারী ইহুদি জাতির কাছে। তিনি এসেছিলেন মুসা (আ.) এর আনীত দীনকে সত্যায়ন করে শুধু মাত্র দীনের হারিয়ে যাওয়া আত্মিক ভাটাকে যথাস্থানে ফিরিয়ে দিয়ে দীনের ভারসাম্য পুনঃস্থাপনের জন্য। তিনি কখনই খ্রিষ্ট ধর্ম নামে নতুন কোনো ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান নি। তাঁর জীবনী থেকে এ কথার প্রমাণ দেওয়া যায় । ঈসা (আ.) যদি ইহুদিদের বাইরে তার দেখানো পথ অনুসরণ বা গ্রহণ করতে বলতেন তাহলে তা হতো চরম সীমালংঘন ও অনধিকার চর্চা। কারণ স্রষ্টা তাঁর কাজের সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন এবং তা অবশ্যই শুধুমাত্র ইহুদিদের ভেতরে। কোনো নবীর পক্ষেই এই সীমারেখা অতিক্রম করা সম্ভব নয়, এবং ইতিহাস সাক্ষী যে ঈসা (আ.) তা কখনই করেন নি। –শ্রেণিহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ১৫ যাইহোক, মুসার (আঃ) আইন ঠিক ছিলো বোলেই ঈসার মাধ্যমে নতুন আইন পাঠানো হয়নি। ভারসাম্য যথাস্থানে ফিরিয়ে আনার জন্য তার মাধ্যমে শুধু আধ্যাত্মিক দিকটার দিক নির্দেশনা এসেছিলো। –এ ইসলাম ইসলামই নয়, পৃ. ১৩৯-১৪০ অর্থাৎ তারা বলতে চায়, ঈসা আ. কোনো নতুন শরীয়তের বিধান বা ধর্ম নিয়ে আগমন করেননি, বরং মুসা আ.-এর ধর্ম সংস্কার করতেই তাঁর আগমন হয়েছিলো। ইসলাম কী বলে? হযরত ঈসা আ. ছিলেন নতুন শরীয়তধারী নবী। যাঁর ধর্মে তাওরাতের বিপরীত কিছু নতুন নতুন কিছু নিয়ম কানুনও ছিলো। এটার দলীল পবিত্র কুরআনেই রয়েছে। প্রমাণস্বরুপ নিন্মে কয়েকটি আয়াত পেশ করা হলো। মহান রব্ব বলেন, وَقَفَّيْنَا عَلَىٰ آثَارِهِم بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ ۖ وَآتَيْنَاهُ الْإِنجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ وَمُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةً لِّلْمُتَّقِينَ আমি তাদের (নবীগণের) পর মারইয়ামের পুত্র ঈসাকে তার পূর্ববর্তী কিতাব অর্থাৎ তাওরাতের সমর্থকরূপে পাঠিয়েছিলাম এবং আমি তাকে ইনজিল দিয়েছিলাম, যাতে ছিল হিদায়াত ও আলো এবং (তা দিয়েছিলাম) তার পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাতের সমর্থক এবং মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত ও উপদেশরূপে। –সুরা মায়িদা : ৪৬ উক্ত আয়াতে একটি বিষয় লক্ষণীয়, হযরত ঈসা আ. কে নতুন কিতাব ইঞ্জিল শরীফ দেওয়া হয়েছিলো বলে মহান আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন। এবং সেই ইঞ্জিল শরীফে কী ছিলো, সেটাও মহান রব বলে দিলেন যে, তাতে ছিলো বিধিবিধান এবং আলো বলতে আধ্যাতিক পন্থা বুঝানো হয়েছে। আর নতুন শরীয়াত বুঝাতেই هُدًى وَنُورٌ অর্থাৎ হিদায়াত ও আলো শব্দ ব্যবহার করা হয়। এর প্রমাণ হলো, তাওরাত সম্পর্কেও ঠিক এই একই শব্দ আল্লাহ তাআলা ব্যবহার করেছেন, إِنَّا أَنزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ নিশ্চয়ই আমি তাওরাত নাযিল করেছিলাম; তাতে ছিল হিদায়াত ও আলো। –সুরা মায়িদা : ৪৪ সুতরাং বোঝা গেলো, পবিত্র তাওরাতে যেমন আত্মাধিক বিষয়ের পাশাপাশি বিধিবিধানও ছিলো, ঠিক তেমনিভাবে ঈসা আ. এর ইঞ্জিল শরীফেও আত্মাধিক বিষয়ের পাশাপাশি নতুন বিধিবিধানও ছিলো। মহান আল্লাহ ঈসা আ. কে যে নতুন নতুন নিয়ম-কানুন দিয়েছিলেন, তাঁর আরেকটি প্রমাণ হলো নিম্মোক্ত আয়াতে কারীমে। মহান রব্ব বলেন, وَمُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَلِأُحِلَّ لَكُم بَعْضَ الَّذِي حُرِّمَ عَلَيْكُمْ এবং আমার পূর্বে যে কিতাব এসেছে অর্থাৎ তাওরাত, আমি তার সমর্থনকারী এবং (আমাকে এজন্য পাঠানো হয়েছে) যাতে তোমাদের প্রতি যা হারাম করা হয়েছে, তন্মধ্যে কিছু জিনিস তোমাদের জন্য হালাল করি। –সুরা আলে ইমরান : ৫০ উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত কাতাদাহ রহি. বলেন, كان الذي جاء به عيسى ألين مما جاء به موسى، وكان قد حُرّم عليهم فيما جاء به موسى لحومُ الإبل والثُّروب، وأشياء من الطير والحيتان হযরত মুসা আ.-এর আনীত বিধিবিধান থেকে সহজ ছিলো হযরত ঈসা আ. আনীত বিধানগুলো। হযরত মূসা আলাইহিস সালামের শরীয়তে বনী ইসরাঈলের প্রতি উটের গোশত, চর্বি, কোন কোন মাছ ও কয়েক প্রকার পাখি হারাম করা হয়েছিল। –তাফসীরে তাবারী, খ. ৬ পৃ. ৪৩৯ হযরত হাসান বসরী রহি. বলেন, كان حرّم عليهم أشياء فجاءهم عيسى ليحلّ لهم الذي حرّم عليهم، يبتغي بذلك شُكْرهم বনী ইসরাঈলের প্রতি কিছু জিনিষ হারাম করা হয়েছিলো। অতপর হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এসে সেগুলোকে হালাল করে দিয়েছিলেন। এর দ্বারা তাদের কৃতজ্ঞতা কাম্য ছিলো। –তাফসীরে তাবারী, খ. ৬ পৃ. ৪৩৯ আর এজন্যই ইবনে কাসীর রহি. বলেন, وَلِهَذَا كَانَ الْمَشْهُورُ مِنْ قَوْلَيِ الْعُلَمَاءِ أَنَّ الْإِنْجِيلَ نَسَخَ بَعْضَ أَحْكَامِ التَّوْرَاةِ আর এজন্যই উলামায়ে কেরামের কাছে এটা সুপ্রশিদ্ধ মত যে, ইঞ্জিল শরীফ তাওরাতের বেশ কিছু বিধান রহিত করে দেয়। –তাফসীরে ইবনে কাসীর, খ. ৫ পৃ. ২৪৩ সুতরাং বোঝা গেলো, ঈসা আ. নতুন শরীয়ত ও তাওরাতের স্বীকৃতির পাশাপাশি কিছু পরিবর্তনশীল বিধান নিয়ে আগমণ করেছিলেন। এজন্য তাঁকে প্রেরণ করে মহান আল্লাহ তাঁকে অনুসরণ করার নির্দেশও জারি করে দিয়েছিলেন। যা পবিত্র কুরআন থেকেই জানা যায়। হযরত ঈসা আ. বলেছিলেন, وَجِئْتُكُم بِآيَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ এবং আমি তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে নিদর্শন নিয়ে এসেছি। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার কথা মানো। –সুরা আলে ইমরান : ৫০ সুতরাং বোঝা গেলো, ঈসা আ. নতুন এক শরীয়ত নিয়ে আগমন করেছিলেন। হেযবুত তওহীদ এ ব্যাপারে যা বলে তা নিছক মিথ্যাচার। মুসা আ.-এর ধর্মের বিধান অবিকৃত ছিলো! হেযবুত তওহীদের আরেকটি দাবী হলো, খ্রিস্টধর্মে ইহলৌকিক কোন আইন কানুন নেই। সুতরাং অর্থনীতিও নেই। ঈসা (আ.) এসেছিলেন শুধুমাত্র ইহুদীদের আধ্যাত্মিক সংশোধনের জন্য, ইহুদীদের জাতীয় অর্থাৎ রাজনৈতিক আর্থ সামাজিক আইন দন্ড বিধি ইত্যাদি মোটামুটি অবিকৃতই ছিলো। –শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ২২ অর্থাৎ তারা বোঝাতে চায়, ঈসা আ.-এর আগমনের সময়ও মুসা আ.-এর আনীত তাওরাত কিতাবের বিধিবিধান অবিকৃত ছিলো। জবাব : মুসা আ. এর ধর্ম বিকৃত হওয়ার পরই আল্লাহপাক ঈসা আ. কে প্রেরণ করেছিলেন। এটা শুধু আমার কথা নয়, বরং জনাব পন্নীই এটা লিখেছে, মুসার (আ.) দীনকে তাঁর ধর্মের আলেম-যাজকরা বিকৃত, ভারসাম্যহীন করে ফেলায় সেটাকে আবার ভারসাম্যে ফিরিয়ে আনাই ছিল তাঁর (ঈসা আ.) কাজ। –আকিদা, পৃ. ১৪ বোঝা গেলো, জনাব পন্নী নিজেই দাবী করেছে যে, মুসা আ.-এর ধর্ম বিকৃত হওয়ার পরেই ঈসা আ.-এর আগমন ঘটে। আর তাছাড়া যদি ইহুদীদের আইন ও দণ্ডবিধি অবিকৃতই থাকতো, তাহলে নতুন করে আসমানী গ্রন্থ নাযিল করার কী দরকার ছিলো? এতটুকু কমনসেন্স যাদের নেই, সেই হেযবুত তওহীদ ধর্ম নিয়ে আলোচনা করার কী অধিকার রাখে? সুতরাং প্রমাণ হলো, ঈসা আ. ও তাঁর ধর্ম সম্পর্কে হেযবুত তওহীদের মতবাদ চুড়ান্ত পর্যায়ের বিভ্রান্তি ও কুফরী এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মকে অস্বীকার করার নামান্তর।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
কুরআনের চেয়ে মুমিন দামী! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–১৬
পবিত্র কুরআন সরাসরি আল্লাহপাকের কালাম। পৃথিবীর সব কিছু মাখলুক হলেও আল্লাহ-র কালাম মাখলুক নয়। সুতরাং ...
মুফতী রিজওয়ান রফিকী
৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
১৫৬০