রাসুলুল্লাহ ﷺ তাওরাত দিয়ে বিচার করেছেন! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–২২
রাসুলুল্লাহ ﷺ তাওরাত দিয়ে বিচার করেছেন! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–২২
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওপর পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়ার পর অতীতের সকল ধর্মগ্রন্থ দিয়ে বিচার কাজ পরিচালনা করা রহিত হয়ে গেছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা পবিত্র কুরআন সামনে রেখেই বিচার কাজ পরিচালনা করেছেন। হেযবুত তওহীদ কী বলে? তাদের দাবী হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের বিচার তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত দিয়ে করতেন। দেখুন, তারা কী লিখেছে, মহানবী মোহাম্মদ (দ:) যখন মদীনায় রাষ্ট্রগঠন করলেন তিনি ইহুদি বা খ্রিস্টানদের উপর কোর’আনের বিধি-বিধান চাপিয়ে দেন নি। এবং ইহুদিরাও আল্লাহর রসুলকে শাসক হিসাবে মেনে নিলেও বিচারক হিসাবে মেনে নিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আল্লাহর রসুলও তাদেরকে তাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী তওরাতের বিধান দিয়েই বিচার করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তওরাতে যে বিধান দিয়েছেন সেই বিধান যদি ইহুদিরা মান্য করে সেটাই যথেষ্ট। বরঞ্চ আল্লাহ সেদিকেই তাদেরকে আহ্বান করেছেন, কোর’আন মানতে হুকুম করেন নি। কারণ তওরাতও আল্লাহরই হুকুম। -হেযবুত তওহীদের ওয়েবসাইটে 'আল্লাহর পছন্দনীয় ধর্ম কোনটি'? শিরোনামে লেখা প্রবন্ধ। অর্থাৎ তারা বোঝাতে চাচ্ছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইহুদীদের বিচার করতেন, তখন তওরাতের বিধান মোতাবেক বিচার করতেন। ইসলাম কী বলে? এক. মহান আল্লাহ তাঁর রাসুল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বিচার কাজ পরিচালনা করার জন্য পবিত্র কুরআনের বিধানকে সামনে রাখার জন্য নির্দেশ দিয়ে বলেন, إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ وَلا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيمًا নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি সত্য-সম্বলিত কিতাব নাযিল করেছি, যাতে আল্লাহ তোমাকে যে উপলব্ধি দিয়েছেন, সে অনুযায়ী মানুষের মধ্যে মীমাংসা করতে পারো। আর তুমি খেয়ানতকারীদের পক্ষাবলম্বনকারী হয়ো না। –সুরা নিসা : ১০৫ অপর আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَن يَفْتِنُوكَ عَن بَعْضِ مَا أَنزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ ۖ فَإِن تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَن يُصِيبَهُم بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ ۗ وَإِنَّ كَثِيرًا مِّنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ এবং (আমি আদেশ করছি যে,) তুমি মানুষের মধ্যে সেই বিধান অনুসারেই বিচার করবে, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবে না। তাদের ব্যাপারে সাবধান থেক, পাছে তারা তোমাকে এমন কোন বিধান থেকে বিচ্যুত করে, যা আল্লাহ তোমার প্রতি নাযিল করেছেন। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রেখ, আল্লাহ তাদের কোনও কোনও পাপের কারণে তাদেরকে বিপদাপন্ন করার ইচ্ছা করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ফাসিক। –সুরা মায়িদা : ৪৯ যেখানে কুরআন দিয়ে বিচার করার দায়িত্ব খোদ আল্লাহপাক তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে নির্দেশ দিয়েছেন, এরপরও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের বিচার তওরাত দিয়ে করেছেন? এটা কী নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আল্লাহ-র অবাধ্য হিশাবে আখ্যায়িত করার নামান্তর নয়? এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য হাদিসে বর্ণিত নিন্মোক্ত ঘটনাটি দেখুন– أن عمر بن الخطاب أتى النبي صلى الله عليه و سلم بكتاب أصابه من بعض أهل الكتاب فقال يا رسول الله إني أصبت كتابا حسنا من بعض أهل الكتاب قال فغضب وقال امتهوكون فيها يا بن الخطاب فوالذي نفسي بيده لقد جئتكم بها بيضاء نقية لا تسألوهم عن شيء فيخبروكم بحق فتكذبوا به أو بباطل فتصدقوا به والذي نفسي بيده لو كان موسى حيا ما وسعه إلا أن يتبعني হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা. নবীজি সাঃ-এর খেদমতে কোন আহলে কিতাব (ইহুদীদের) থেকে একটি কিতাব নিয়ে আসলেন। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি একজন আহলে কিতাব থেকে একটি সুন্দর কিতাব পেয়েছি। বর্ণনাকারী বলেন, নবীজী (হযরত উমর রা. এই কিতাব দেখে) রাগান্বিত হয়ে গেলেন এবং বললেন, হে উমর ইবনে খাত্তাব! তোমরা কি তাতে হয়রান হয়ে পড়েছ? যার কুদরতী হাতে আমার প্রাণ তার কসম! নিশ্চয় আমি তোমাদের নিকট স্বচ্ছ উজ্জ্বল দীন নিয়ে এসেছি। তাদেরকে কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করোনা। তাহলে তারা সত্য সম্পর্কে তোমাদেরকে অবহিত করবে আর তোমরা তা মিথ্যাপ্রতিপন্ন করবে। অথবা মিথ্যা সম্পর্কে অবহিত করবে আর তোমরা তা সত্য বলে মেনে নিবে। যেই সত্ত্বার হাতে আমার প্রাণ সেই যাতের কসম! যদি হযরত মূসা {আ.} জিবিত থাকতেন, তাহলে তাঁর পক্ষেও আমার দীনের অনুসরণ ব্যতীত কোন সুযোগ থাকত না। –মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং : ১৫১৫৬ এই হাদীসের আলোকে বোঝা গেলো–নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য ধর্মের কিতাব দেখে রাগান্বিত হয়েছেন। হাদীসের শেষে একথাও তিনি কসম করে বললেন, لو كان موسى حيا ما وسعه إلا أن يتبعني হযরত মুসা আ. যদি জীবিত থাকতেন, তাহলে তার জন্যও আমাকে অনুসরণ করা ব্যতীত অন্য কোনও সুযোগ থাকতো না। এ হাদিস থেকে কী বোঝা যায়? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের তাওরাত দিয়ে বিচার করতেন? এতটুকু বুঝশক্তিও কী নেই এদের? তাছাড়া খোদ হেযবুত তওহীদই দাবী করেছে–অতীতের কিতাবগুলো বিকৃত হওয়ার পর কুরআন এসেছে। দেখুন তারা কী লিখেছে– ভারত অঞ্চলে আল্লাহ জীবন-বিধান দিয়ে যে সকল নবী রসুল (আঃ) পাঠিয়েছেন, আমরা বিশ্বাস কোরি সেগুলি আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে, কিন্তু কাল পরিক্রমায় সেগুলোর ব্যবহার ও বইগুলি বিকৃত কোরে ফেলা হোয়েছে। একই কাজ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের বেলাতেও করা হোয়েছে। এজন্য সকল প্রাচীন, আঞ্চলিক দীনগুলিকে অনুপযুক্ত ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ ১৪০০ বছর আগে শেষ দীন এসলামের মহাগ্রন্থ আল কোর'আন নাযেল কোরলেন। –এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব, পৃ. ৫৬ হেযবুতের এ বক্তব্য থেকে বোঝা গেলো, তারা নিজেরাও জানে যে, অতীতের ধর্মগ্রন্থগুলো বিকৃত হয়ে যাওয়ার পর পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছিলো। এজন্য হাদিসে এসেছে, হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, لا تسألوا أهلَ الكتابِ عن شيءٍ فإنهم لن يهدوكم وقد ضلُّوا তোমরা আহলে কিতাবদের কাছে কোনও বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না।কারণ, তারা তোমাদের সঠিক তথ্য দিতে পারবে না। তারা নিজেরাই তো পথভ্রষ্ট। –মাজমাউয যাওয়ায়েদ, খ. ১ পৃ. ১৭৯ সুতরাং হেযবুত তওহীদের যে দাবী ছিলো ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওরাত দিয়ে বিচার করেছেন’ এটা যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে এর অর্থ এই দাঁড়াবে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিকৃত ধর্মগ্রন্থ দিয়েও বিচার করেছেন! নাউযুবিল্লাহ। এটা কোনও সুস্থ মানুষ বিশ্বাস করতে পারে? তবে হ্যাঁ, আল্লাহর নাযিলকৃত কোনও বিধান যদি কুরআনসম্মত হয়, তাহলে সে অনুযায়ী যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচার করে থাকেন, তাহলে সেটা নিশ্চয় অন্যায় নয়, বরং কুরআন বর্ণিত বিধান অনুযায়ী তিনি বিচার করেছেন, তাওরাত মেনে নয়। এরপরও যারা ইহুদীদের দালালী করতে গিয়ে বলে ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওরাত দিয়ে বিচার করতেন’ তারা সুস্পষ্ট মিথ্যাবাদী। অভিযোগ : অবশ্য এ ব্যাপারে একটি হাদিসের জবাব দেওয়া প্রয়োজন অনুভব করছি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, أَنَّ الْيَهُوْدَ جَاءُوْا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَذَكَرُوْا لَهُ أَنَّ رَجُلًا مِنْهُمْ وَامْرَأَةً زَنَيَا فَقَالَ لَهُمْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَا تَجِدُوْنَ فِي التَّوْرَاةِ فِيْ شَأْنِ الرَّجْمِ فَقَالُوْا نَفْضَحُهُمْ وَيُجْلَدُوْنَ فَقَالَ عَبْدُ اللهِ بْنُ سَلَامٍ كَذَبْتُمْ إِنَّ فِيْهَا الرَّجْمَ فَأَتَوْا بِالتَّوْرَاةِ فَنَشَرُوْهَا فَوَضَعَ أَحَدُهُمْ يَدَهُ عَلَى آيَةِ الرَّجْمِ فَقَرَأَ مَا قَبْلَهَا وَمَا بَعْدَهَا فَقَالَ لَهُ عَبْدُ اللهِ بْنُ سَلَامٍ ارْفَعْ يَدَكَ فَرَفَعَ يَدَهُ فَإِذَا فِيْهَا آيَةُ الرَّجْمِ فَقَالُوْا صَدَقَ يَا مُحَمَّدُ فِيْهَا آيَةُ الرَّجْمِ فَأَمَرَ بِهِمَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَرُجِمَا قَالَ عَبْدُ اللهِ فَرَأَيْتُ الرَّجُلَ يَجْنَأُ عَلَى الْمَرْأَةِ يَقِيْهَا الْحِجَارَةَ ইয়াহুদীরা আল্লাহ-র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে এসে বললো, তাদের একজন পুরুষ ও একজন মহিলা ব্যভিচার করেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করা সম্পর্কে তাওরাতে কী বিধান পেয়েছো? তারা বলল, আমরা এদেরকে অপমানিত করবো এবং তাদের বেত্রাঘাত করা হবে। আবদুল্লাহ ইবনু সালাম রা. বললেন, তোমরা মিথ্যা বলছো। তাওরাতে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যার বিধান রয়েছে। তারা তাওরাত নিয়ে এসে বাহির করলো এবং প্রস্তর হত্যা করা সম্পর্কীয় আয়াতের উপর হাত রেখে তার আগের ও পরের আয়াতগুলি পাঠ করলো। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা. বললেন, তোমার হাত সরাও। সে হাত সরালো। তখন দেখা গেলো, প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করার আয়াত আছে। তখন ইয়াহুদীরা বললো, হে মুহাম্মাদ! তিনি সত্যই বলছেন। তাওরাতে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যার আয়াতই আছে। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রস্তর নিক্ষেপে দু’জনকে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। আবদুল্লাহ রা. বলেন, আমি ঐ পুরুষটিকে মেয়েটির দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখেছি। সে মেয়েটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। –সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৩৬৩৫ উক্ত হাদিসটা উল্লেখ্য করে হেযবুত তওহীদ বুঝাতে চায়, ইহুদীদেরকে তাওরাতের বিধান দিয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচার করেছেন। জবাব : উপরিউক্ত ঘটনায় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধুমাত্র ইহুদীদেরকে বিবাহিত ব্যাভিচারীদের ব্যাপারে আল্লাহর বিধান রজম তথা পাথর মেরে হত্যা করা হবে, এটা স্বরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। তাওরাত অনুযায়ী বিচার করেননি। কারণ ইসলামী আইনেও বিবাহিত ব্যাভিচারীদের ব্যাপারে রজমের হুকুম বিদ্যমান। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, الشيخُ والشيخةُ إذا زَنَيا فارْجُموهُما البَتَّةَ বিবাহিত ও বিবাহিতা যদি যিনা-ব্যভীচারে লিপ্ত হয়, তাহলে তাদের উভয়কে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলো। –মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং : ২১৫৯৬ সুতরাং এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও ইসলামের বাহিরে গিয়ে অন্য কোনও ধর্মগ্রন্থ দিয়ে তিনি বিচার করেননি, বরং আল্লাহর যে বিধান দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে প্রেরণ করেছেন, সে বিধান মোতাবেকই তিনি বিচার করেছিলেন। তাওরাতের অনুসরণে নয়।