আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

যে ব্যক্তির একই গুনাহ বার বার হয়ে যায়; তার প্রতি পরামর্শ

প্রশ্নঃ ২৫১৯৮. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ,শায়েখ আমার প্রশ্ন হলো কারো যদি একটি পাপ কাজ করার কোন ইচ্ছা না থাকে এমন অবস্থায় পরিস্থিতির কারণে সেই পাপ কাজটি করে ফেলে আবার তওবা করে আবার পাপ কাজটি হয়ে যায় আবার তওবা করে এভাবেই যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে তাহলে এই পাপ কাজ থেকে চির মুক্তি কিভাবে পাওয়া সম্ভব?

১৫ নভেম্বর, ২০২২
Dhaka

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


এক. প্রিয় প্রশ্নকারী দীনি ভাই, প্রথমত চেষ্টা করতে হবে যেন পুনরায় গুনাহ না হয়। তাওবা করলে গুনাহ মাফ হয় এ কথা নিশ্চিত। কিন্তু গুনাহের একটা তাসির আছে। আর তাহল, গুনাহ গুনাহকে টানে। তাওবা করলে গুনাহ মাফ হয়ে গেলেও এর তাসির থেকে যায়। তাই সতর্কতা হল, সেফ জোনে (Safe Zone) থাকা। আর এটাই হল মূল। এটার চাইতে বড় আমল আর কোন কিছু নাই। নবীজী ﷺ বলেন,
اتَّقِ المَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ
গুনাহ থেকে বেঁচে থাক সবচেয়ে বড় আল্লাহ্‌র অলি হতে পারবে। (তিরমযী ২৩০৫)
দুই. এর পরেও যদি পুনরায় গুনাহ হয়ে যায় তাহলে চিকিৎসা একটাই–সত্যিকার অর্থে তাওবা করা। যখনই অনাকাংখিত গুনাহর চিন্তা মাথা ছাড়া দিয়ে উঠবে এবং আল্লাহর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক দুর্বল করে দিবে তখনই তা তাওবা ও ইসতেগফারের মাধ্যমে মেরামত করে নিবেন। এমনটি বার বার করতে থাকবেন। অন্যথায় -আল্লাহর কাছে পানাহ চাই- এই গুনাহর উপর যদি মরণ চলে আসে তাহলে ভেবে দেখুন, কী হবে তখন?!
হাফেজ ইবনু তাইমিয়া রহ. লিখেছেন, এক ব্যক্তি তাঁর শায়েখকে বলল, আমার গুনাহ হয়ে যায় কী করব? শায়েখ বললেন, তাওবা করবে। লোকটি বলল, তাওবা করার পর যদি আবার গুনাহ হয়? শায়েখ বললেন, তাওবা করবে। লোকটি বলল, যদি আবারও গুনাহ হয়? শায়েখ বললেন, এবারও তাওবা করবে। লোকটি বলল, কত বার তাওবা করব? শায়েখ উত্তর দিলেন, إلى أن تُحْزِنَ الشيطان শয়তানকে পেরেশান করা পর্যন্ত তাওবা করতেই থাকবে।
হাদিস শরিফে এসেছে, আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, হাদিসে কুদসি; রাসুলুল্লাহ ﷺ স্বীয় প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা বলেন,
‏ أَذْنَبَ عَبْدٌ ذَنْبًا فَقَالَ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي ‏.‏ فَقَالَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَذْنَبَ عَبْدِي ذَنْبًا فَعَلِمَ أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِالذَّنْبِ ‏.‏ ثُمَّ عَادَ فَأَذْنَبَ فَقَالَ أَىْ رَبِّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي ‏.‏ فَقَالَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى عَبْدِي أَذْنَبَ ذَنْبًا فَعَلِمَ أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِالذَّنْبِ ‏.‏ ثُمَّ عَادَ فَأَذْنَبَ فَقَالَ أَىْ رَبِّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي ‏.‏ فَقَالَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَذْنَبَ عَبْدِي ذَنْبًا فَعَلِمَ أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِالذَّنْبِ وَاعْمَلْ مَا شِئْتَ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكَ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ عَبْدُ الأَعْلَى لاَ أَدْرِي أَقَالَ فِي الثَّالِثَةِ أَوِ الرَّابِعَةِ ‏”‏ اعْمَلْ مَا شِئْتَ ‏
এক বান্দা গুনাহ করে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমার গুনাহ ক্ষমা করে দাও। তারপর আল্লাহ তাআলা বললেন, আমার বান্দা গুনাহ করেছে এবং সে জানে যে, তার একজন প্রতিপালক আছে, যিনি গুনাহ ক্ষমা করেন এবং গুনাহের কারণে পাকড়াও করেন। এ কথা বলার পর সে পুনরায় গুনাহ করল এবং বলল, হে আমার মনিব! আমার গুনাহ মাফ করে দাও। এরপর আল্লাহ তাআলা বললেন, আমার এক বান্দা গুনাহ করেছে এবং সে জানে যে, তার একজন প্রতিপালক আছে যিনি গুনাহ মাফ করেন এবং গুনাহের কারণে পাকড়াও করেন।
তারপর সে আবারও গুনাহ করে বলল, হে আমার রব! আমার গুনাহ ক্ষমা করে দাও। একথা শুনে আল্লাহ তাআলা আবারও বলেন, আমার বান্দা গুনাহ করেছে এবং সে জানে যে তার একজন মালিক আছে, যিনি বান্দার গুনাহ ক্ষমা করেন এবং গুনাহের কারণে পাকড়াও করেন। তারপর আল্লাহ তাআলা বলেন, হে বান্দা! এখন যা ইচ্ছা তুমি আমল কর। আমি তোমার গুনাহ মাফে করে দিয়েছি। বর্ননাকারী আবদুল আ’লা বলেন, “এখন যা ইচ্ছা তুমি আমল কর” কথাটি (আল্লাহ তাআলা) তৃতীয়বারের পর বলেছেন, না চতুর্থবারের পর বলেছেন, তা আমি জানি না। (সহিহ মুসলিম ৬৭৩২)
ইমাম নববী রহ. উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন,
هَذِهِ الْأَحَادِيثُ ظَاهِرَةٌ فِي الدَّلَالَةِ لَهَا ، وَأَنَّهُ لَوْ تَكَرَّرَ الذَّنْبُ مِائَةَ مَرَّةٍ أَوْ أَلْفَ مَرَّةٍ أَوْ أَكْثَرَ ، وَتَابَ فِي كُلِّ مَرَّةٍ ، قُبِلَتْ تَوْبَتُهُ ، وَسَقَطَتْ ذُنُوبُهُ
এ হাদিসগুলো স্পষ্টভাবে এই বার্তা দেয় যে, বান্দা যদি একটি গুনাহ শত বার, হাজার বার কিংবা এর চাইতেও বেশি করে আর প্রতিবারেই সে তাওবা করে, তাহলে তার তাওবা কবুল করা হয় এবং তার গুনাহগুলো অকেজো হয়ে যায়। (শরহু মুসলিম ১৭/২৩০)
তিন. প্রিয় প্রশ্নকারী দীনি ভাই, যেন বার বার তাওবা করার সুযোগ হয় এবং আপনার তাওবা আক্ষরিক অর্থেই তাওবা হয়; এ উদ্দেশ্যে আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ আমরা আপনাকে দিচ্ছি–
~ আল্লাহওয়ালাদের সোহবত গ্রহণ করুন। তাদের মজলিসে আসা যাওয়া করুন। এতে নফস নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাওবার উপর অটল থাকা আপনার জন্য সহজ হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَكُونُواْ مَعَ الصَّادِقِينَ
হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। (সূরা আত তাওবাহ ১১৯)
~ অধিকহারে ইস্তেগফার করুন। প্রয়োজনে এর জন্য প্রত্যেক নামাজের পর একটা নিয়ম করে নিন। যেমন, প্রত্যেক নামাজের পর ৫০/১০০/২০০ বার أسْتَغْفِرُ اللهَ অথবা أسْتَغْفِرُ اللهَ وَأتُوبُ إلَيهِ অথবা اللَّهُمَّ اغْفِرْ لي পড়ার নিয়ম করে নিতে পারেন। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَا أَصَرَّ مَنِ اسْتَغْفَرَ وَإِنْ عَادَ فِي الْيَوْمِ سَبْعِينَ مَرَّةً
যে ব্যক্তি দিনে সত্তরবার করে একই গুনাহ করার পরও আল্লাহর কাছে গুনাহের জন্য ক্ষমা চাইবে, (ইস্তেগফার করবে) সে যেন প্রকৃতপক্ষে গুনাহ বার বার করে নি। (তিরমিযী ৩৫৫৯)
~ কখনো একাকী নিভৃতে থাকবেন না। কেননা একাকীত্ব গুনাহর চিন্তা করার কারণ হতে পারে। আর আপনার সময়কে উপকারী বিষয়ে ব্যয় করতে সচেষ্ট হোন। যেমন- সৎকাজ, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির, নামাজ ইত্যাদি।
~ প্রত্যেক নামাযের পর দৈনিক অন্তত পাঁচ বার কিছু সময়ের জন্য- দুই থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যের মুরাকাবা করুন। মুরাকাবা এভাবে করবেন- চোখ বন্ধ করবেন। তারপর ভাববেন, ‘আমি যেখানেই থাকি না আল্লাহ আমার সাথে আছেন।’ অথবা এই আয়াতের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করবেন-
هُوَ مَعَكُمْ اَيْنَمَا كُنْتُمْ
‘তোমরা যেখানেই তিনি (আল্লাহ) তোমাদের সঙ্গে আছেন।’
এভাবে নিয়মিত কিছুদিন করতে পারলে -ইনশা আল্লাহ- ধীরে ধীরে আল্লাহর সান্নিধ্যের সার্বক্ষণিক অনুভূতি অন্তরে বসে যাবে এবং বাজে চিন্তা থেকে বের হওয়া সহজ হয়ে যাবে।
নিশ্চয় আল্লাহ তাওফিকদাতা।

والله اعلم بالصواب

শাইখ উমায়ের কোব্বাদী সিনিয়র মুহাদ্দিস, মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর খতীব, বাইতুল ফালাহ জামে মসজিদ, মিরপুর

মন্তব্য (0)

কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!

মন্তব্য করতে লগইন করুন

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

#১৪২৮৮
আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ,
ভাইয়া আমি ১৫ বছর বয়সী এক পথভ্রষ্ট ছেলে, আগে আল্লাহর আনুগত্য অনেক ছিল, জানতাম না বিয়ের আগের সম্পর্ক হারাম ভাবতাম যে শুধু ধরা ছোঁয়াই বোধ হয় গুনাহ, জেনেরাল ছাত্র বলে, সে রাগ হতো, আল্লাহ কে দোষারূপ করতাম, নামাজ ছাড়লাম, পরে বুঝতে পেরেও যে এটি হারাম, তাকে ছাড়তে পারিনি, নেশা করার পর যে নেশা খারাপ জানলাম ছাড়তে কষ্ট তো নিশ্চয়ই তবে চেষ্টা করি, আল্লাহর পথে একবার ফিরি, আবার ঘুরে যাই, আবার ফিরি আবার ঘুরে যাই, এভাবে চলতে থাকে, চোখের জেনাহে লিপ্ত হই, এই ছোট্ট বয়সে কত ধরনের ভয়ানক পাপ করি, আমি বলতেও ভয় করি, কাউকে শেয়ার ও করা যায়না, যদি আল্লাহ আরও ক্রুদ্ধ হন, আপনাকে বলাও যাবেনা আরও নাজানি কত পাপ করি, ধর্মে ফিরি আবার হারাই আবার ফিরি আবার হারাই, ভাই প্রকাশ্যে অগণিত পাপ করি, আমার অজ্ঞতার কারণে অন্যের কষ্টের কারণ হই, কত জুম্মা মিস করি, চুরি করি মিথ্যে বলি পাপে প্রেরণা দেই ঠকাই। তবে শেষ পর্যন্ত, হারাম সম্পর্ক শেষ করি, গানবাজনা ছাড়ারও চেষ্টাও করতেছি, সকল অসৎ সঙ্গ ত্যাগেরও চেষ্টা করছি তবে দুনিয়ার জীবন যেন আমায় ধাওয়া করছে এমন আর আগের মত করতে পারছিনা বোধ হয় মহান রব মহর মেরে দিয়েছেন অন্তরে, নামাজ পড়তেছি আর পড়তেছি, কিন্তু কেনো যেনো ইমান টা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, দুনিয়ার মহ আমায় পাগল করেছে কিছুই বুঝতেছিনা নাও এদিক নাও সেদিক। খুবই দিশেহারা আমি হুজুর, আমার মনে হয় আবার পাপ যখন আমার সামনে আসবে আমি নিজেকে হয়তো, ধরে রাখতে পারবনা, কিছুই ভাল্লাগেনা হুজুর, রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনাও লজ্জাজনক হয়ে গিয়েছে, আখিরি জবানা, আমি আমার জন্যে দুআ করেন হুজুর, বিশ্বাস, কোথায়? কিভাবে। রব কি উনার মহর আমার অন্তর থেকে আর তুলে নিবেন নাহ? কখনোই না? রবের কাছে জান্নাত নহে ঈমান ভিক্ষে চাই, তবে হয়তো কিছু বিষয় মুছে ফেলা যায়না। আমার জন্যে দুআ কইরেন হুজুর আর দয়া করে বলবেন আমি কিকরে আবার নিজের অন্তঃস্থ নফস কে হত্যা করবো কি করে আবার ঈমান সম্পূর্ণ করবো, কি করে অবিশ্বাসী মনকে সান্তনা দিবো? অনেক দিশেহারা হয়ে আপনাদের শরণাপন্ন হলাম, প্রশ্ন বড় আশা করি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। জাজাকাল্লাহ খাইরান
question and answer iconউত্তর দিয়েছেন: মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি
২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
ঢাকা