প্রশ্নঃ ২০৭৬৫. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আমার স্ত্রী আমার পরিবারের সাথে থাকতে চাই না সে আলাদা হতে চাই সে ওর বাপের বাড়ি চলে গেছে আমি যতো দিন আলাদা না হবো ও আমার বাড়ি আসবেনা বলেছে এখন আমার কি করনীয়
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
দাম্পত্য জীবনে আলাদা সংসার গড়া নারীর অধিকার। এবং তার সুযোগ করে দেওয়াও স্বামীর জন্য কর্তব্য। কিন্তু আমাদের সমাজ এটা সহজে মেনে নিতে পারে না। একজন স্বামী কিংবা স্ত্রীর কতটুকু দায়িত্ব ও করণীয় বিস্তারিত জানতে নিচের রেফারেন্স্ উত্তরটি দেখুন। তারপরও কোনো প্রশ্ন থাকলে লিখুন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
বাইতুল কুরআন মাদারাসা , মোহাম্মাদপুর
রেফারেন্স উত্তর :
প্রশ্নঃ ৯৫৭৯. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আমার শ্বশুর-শাশুড়ির যেকোনো একজন যদি মারা যায় তাহলে ওনাকে বাড়িতে একা থাকতে হবে, এই অবস্থায় ওনাকে আমরা আমাদের সাথে ভাড়া বাসায় চলে আসতে বললে উনি রাজি হয় না উনি ওখানে উনার বাড়িতে থাকতে চায় কারন উনি উনার বাড়ি ফেলে আসতে চায় না,আর ওনার মেয়ে বেড়াতে আসবে তাই আসতে চায় না,আবার ছেলের চাকরি ওখানে গিয়ে থাকাও সম্ভব না, কিন্তু আমি ওখানে যেতে চাই না কারণ উনি এবং উনার আত্মীয়-স্বজন আশেপাশের সবাই আমাকে নানা ধরনের নির্যাতন করে, ওনার ১ ছেলে, এই অবস্থায় আমরা এখন কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে? আমি ওখানে যেতে চাই না কারণ উনারা আমাকে মারে ও নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হই আমি এখানে যেতে কোন ভাবেই রাজী না।
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক— আবহমানকাল থেকে চলমান। আর বউ-শাশুড়ীর ব্যাপারটা যেনো আল্লাহ তায়ালার কুদরাতেরই একটি বহিঃপ্রকাশ। আজ যিনি কণ্যা কাল তিনি বধু। পরশু তিনিই হয়ে যান পরম মমতাময়ী মা। কিছুদিন যেতে না যেতেই তিনি আরেকজন নারীর মা হিসেবে আবির্ভূত হন। সমাজ যাকে শাশুড়ী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। মানবসভ্যতার শুরু থেকেই এই ব্যবস্থা। কালের ঘুর্ণাবর্তে এতে ব্যাত্যয় ঘটেনি। ব্যাপারটা নিয়ে নতুন ও আলাদা করে পরিচয় দিতে হয় না। তবে সমাজে সমস্যাটা যেখানে সৃষ্টি হয় সেটা হলো, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা কি স্ত্রীর দায়িত্ব? এই এই প্রশ্নটা এজন্যই সৃষ্টি হয়েছে যে, বর্তমানে অধিকাংশ মানুষের মাঝে স্বার্থপরতা, জুলুম, অন্যের ক্ষতিসাধনের মনসিকতা তৈরী হয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের প্রাপ্তি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার দাবী করেন। কিন্তু অন্যের পাওনা-দেনার ব্যাপ্যারে ধোড়াই কেয়ার করেন!! ভাবখানা এমন “নিজের বেলায় ষোল আনা-পরের বেলায় শুন্য আনা”।
আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াসে বিষয়টি সমাধানের চেষ্ট করব।
وَمَا تَوْفِيقِي إِلَّا بِاللَّهِ ۚ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য:
দেখুন সুরা বানিইসরাইল, আয়াত:23-24
وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ۚ إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا وَقُل لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا 23 وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرً 24
অর্থ : তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা। তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলঃ হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বান্দাদের স্বীয় ইবাদাতের সাথে সাথে পিতামাতার সাথে সদাচরণ এবং তাদের জন্য দোয়া করতে নির্দেশ দিয়েছে। এই আয়াত ছাড়া আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমের সুরা নিসা-এর ৩৬ নং আয়াত, সুরা লোকমান ১৪ নং আয়াত, সুরা আনকাবুত ৮ নং আয়াত, সুরা নূহ এর ২৮ নং আয়াতে এবং বুখারি মুসলিমের হাদিসসহ অসংখ্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. সন্তাতকে পিতামাতার খেদমত এবং তাদের সাথে সদ্ব্যহারের আদেশ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। ইসলাম এক্ষেত্রে বিষয়গুলো সন্তনের ওপরই সীমাবদ্ধ রেখেছে।কুরআন হাদিসের কোথাও পুত্রবধুকে শশুর-শাশুড়ী, ননদ-দেবর কিংবা স্বামীর আত্মীয়দের সেবাযত্ন করা বা তাদের কাজে সহেযোগিতা করার ব্যাপারে নির্দেশনা অবতীর্ণ হয়নি।
কিন্তু বর্তমান সমাজে বিষয়টাকে এমনভাবে দেখা হয় যে, যেন এটা তার অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। বরং এটিই যেন তার প্রধান দায়িত্ব! বিভিন্ন পরিবারের অবস্থা তো এমন যে, ছেলের জন্য বউ আনা হয় কেবল শ্বশুর-শাশুড়ির সেবার জন্য। এমনকি কোনো স্ত্রী যদি শারীরিকভাবে কর্মঠ না হয় কিংবা অনভিজ্ঞ হয় এই অজুহাতে তাকে শশুর বাড়ীর লোকজনের কটু কথা শোনতে হয়। ইসলামের সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই। মা-বাবার সেবা-শুশ্রূষা করা সন্তানের দায়িত্ব— কোনোভাবেই পুত্রবধূর নয়। (আল-বাহরুর রায়েক : ৪/১৯৩; কিফায়াতুল মুফতি : ৫/২৩০)
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, পুত্রবধু ও শ্বশুর-শাশুড়ির সম্পর্ক এবং প্রাপ্তিগুলো কখনো একপক্ষীয় নয় বরং দ্বিপাক্ষিক। শশুর-শাশুড়ীকে এখানে নিজেদের কর্তব্য ও অধিকারের সীমারেখা সম্পর্কে অনুভব থাকতে হবে। তাদের এটা অনুধাবন করতে হবে যে, আমাদের সকল পাওনা-দেনা আমাদের সন্তানের সাথে।স্বামীর মা-বাবার খেদমতের প্রয়োজন দেখা দিলে, স্বামী নিজ কর্তব্যে তাদের সেবা-যত্ন করবেন। নিজে না পারলে প্রয়োজনে পারিশ্রমিক দিয়ে লোক ঠিক করে নিবেন।
তাহলে কি স্ত্রী শশুর-শাশুড়ী কিংবা তার আত্মীয়-স্বজনকে দূরে ঠেলে দিবে? তার কোনো করণীয় নেই?
উত্তর। না, সে শশুর-শাশুড়ীকে দূরে ঠেলে দিবে না। বরং তার অবশ্যই কিছু করণীয় আছে। তার হৃদয়ে শশুর-শাশুড়ীর পরিচয় জানা থাকতে হবে। তার এই অনুভূতি থাকতে হবে যে এরা আমার জীবনসঙ্গী স্বামীর জন্মদাতা পিতা এবং গর্বধারীণী মাতা।যেভাবে আমিও কোনো বাবা-মায়ের সন্তান। এভাবে আমার স্বামীও এদেরই সন্তান। কাজেই আমার হৃদয়ে যেভাবে আমার পিতামাতার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা রয়েছে এমনিভাবে তাঁরও একটি হৃদয় আছে যেখানে তার পিতা-মাতা বসবাস করেন। স্ত্রীকে সবথেকে বেশী যে জিনিসটি খেয়াল রাখতে হবে যে, আজকে যেভাবে তাঁরা আমার খেদমতের মুখাপেক্ষী হয়েছেন, বেঁচে থাকলে আমাকেও একদিন শাশুড়ী হতে হবে। আজ যদি আমি তাদের খেতমতে নিজেকে ধন্য করি তাহলে কাল আমি কিছুটা হলেও খেদমত লাভের আশা করতে পারব।
ইসলাম ও নৈতিকতার দাবী:
ইসলাম ও নৈতিকতাবোধের দাবি এটা যে, স্ত্রী স্বামীর বাবা-মাকে নিজের মা-বাবার মতো সম্মান দেবেন। তাদের প্রতি সমীহের চোখে দেখবেন। মনেপ্রাণে তাদের ভালোবাসবেন। তাদের সেবা-যত্নকে নিজের জন্য পরম সৌভাগ্য মনে করবেন। অনুরূপ শ্বশুর-শাশুড়িরও কর্তব্য হলো- পুত্রবধূকে নিজের মেয়ের মতো আদর ও মমতায় আবদ্ধ করা। তার সুখ, আনন্দ ও সুবিধার প্রতি সবিশেষ মনোযোগ দেওয়া।
কিন্তু শশুর-শাশুড়ী যদি পুত্রবধুর ওপর জুলুম করে?
উপরে আমরা পুত্রবধু থেকে শশুর-শাশুড়ীর প্রাপ্তির সীমারেখা উল্লেখ করেছি।সুতরাং জুলুম-নির্যাতন করা তো দূরের বিষয়-যদি কোনো শাশুড়ী উক্ত সীমা অতিক্রম করেন এবং পুত্রবধু ওই সংসারে (শশুর-শাশুড়ীর সাথে) থাকতে রাজী না হয় তাহলে স্বামীর জন্য আবশ্যক হলো, স্ত্রীকে আলাদা বাসস্থানে ব্যবস্থা করে দেওয়া। কেননা, ইসলামী শরিয়ত স্ত্রী জন্য স্বামীর ওপর যে হকগুলো আবশ্যক করেছে তার মধ্যে অন্যতম হক হলো, বাসস্থানের হক। স্বামীর কর্তব্য হলো, যদি স্ত্রী দাবী করে এবং এতেই সে সাচ্ছ্যন্দবোধ করে আর স্বামীরও সামর্থ্য থাকে তবে স্ত্রীর জন্য নিজের সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী পৃথক বাড়ী বা বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যেখানে স্বামীর বাবা, মা, ভাই, বোন থাকবে না। আর স্বামীর যদি পৃথক বাড়ির সামর্থ্য না থাকে সেক্ষেত্রে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য হলো, অন্তত একই বাড়ির এক অংশে একটা পৃথক কামরা, রান্না ঘর ও বাথরুমের ব্যবস্থা করা যেটাতে স্বামীর বাবা, মা, ভাই, বোন বা অন্য কারও অধিকার থাকবে না। কেননা স্বামীকে নিয়ে নিরিবিলি ও একান্তে বসবাস করা এটা শরিয়ত কর্তৃক স্ত্রীর অধিকার। এই অধিকার খর্ব করার কারও জন্য জায়েজ নাই। চাই সে স্বামী নিজেই হোক কিংবা তার পরিবারস্থ কোনো মানুষ হোক। কোনো স্বামী যদি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীর এই অধিকার ক্ষুণ্ণ করে তাহলে তাকে হাশরের ময়দানে আল্লাহ তায়ালার আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
সারকথা:
প্রিয় বোন! আশা করছি দীর্ঘ আলোচনা থেকে আপনি আপনার উত্তরটি পেয়ে গেছেন। তবে পুত্রবধু এবং শশুড়ীদের জন্য আমরা ওই পরামর্শই দিই যা ইসলাম ও নৈতিকতার দাবী শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে কবুল করুন। প্রত্যেকের মাঝে কুরবানী, ত্যাগ, পরোপকার এবং অন্যের হকের ব্যাপারে সজাগ-সচেতন থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
বাইতুল কুরআন মাদারাসা , মোহাম্মাদপুর
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন