সন্তানদের দীনদার রূপে গড়তে হলে বাবা মায়ের করণীয়
প্রশ্নঃ ১০৮০০. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আমার ছেলে ও মেয়েকে দ্বীনের খাদেম হিসেবে বড় করতে চাই ইনশাআল্লাহ । শুরু থেকেই ছেলে ও মেয়েকে কোন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় অভ্যস্ত করব ?
মুহতারামের কাছে পরামর্শ চাই ।
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
আজ যারা কচিকাচা আগামীতে তারাই হবে জাতির কর্ণধার। সন্তান মা-বাবার কাছে আল্লাহ তাআলার এক মহা আমানত। এই আমানতের যথাযথ হক আদায় করা মা-বাবা ও অভিভাবকের কর্তব্য। কিন্তু অনেক মা-বাবাই সন্তানের তালীম-তরবিয়তের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এর মূলে রয়েছে : এক. দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং সন্তান যে একটি মহা আমানত-এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব। দুই. বিজাতীয় রীতি-নীতি ও ফ্যাশন প্রীতি। তিন. বৈষয়িক উপার্জনকেই জীবনের সাফল্য হিসেবে মনে করা। এ কারণে সন্তানকে একজন ঈমানদার ও সাচ্চা মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার তাগিদ তারা বোধ করেন না। এ সকল মৌলিক চিন্তাগত ভ্রান্তিই সন্তানের তালীম-তারবিয়াতের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
সন্তান আমানত
সন্তান মা-বাবার নিকট আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আমানত। তাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেওয়া, শরীয়তের প্রয়োজনীয় বিষয়াদি শেখানো এবং একজন ঈমানদার মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা মা-বাবা ও অভিভাবকের কর্তব্য। আজ বৈষয়িক শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং চাকরি ও উপার্জনক্ষম করে গড়ে তোলাকেই শুধু দায়িত্ব মনে করা হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সন্তানকে হালাল ও বৈধ পন্থায় আয়-রোজগার শেখানোও পিতামাতার কর্তব্য। কিন্তু এটিই একমাত্র দায়িত্ব নয়; বরং তাদেরকে ইসলামী সভ্যতা (তাহযীব) শেখানো, দ্বীন ও শরীয়তের মৌলিক বিষয়াদি শেখানো এবং একজন দ্বীনদার-নামাযী ও প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাও মা-বাবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। হাদীস শরীফে এসেছে- ‘জেনে রেখ, তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। পুরুষ তার পরিবারবর্গের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। তাদের ব্যাপারে তাকে জবাবদিহি করতে হবে।’ -সহীহ বুখারী ১/২২২ হাদীস ৮৯৩
সুসন্তান যেমন মা-বাবার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের বড় সম্পদ এবং সদকা জারিয়া তেমনি সন্তান যদি দ্বীন ও শরীয়তের অনুগত না থাকে, দুর্নীতি ও গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায় তাহলে সে উভয় জগতেই মা-বাবার জন্য বিপদ। দুনিয়াতে লাঞ্ছনা, বঞ্চনা ও পেরেশানির কারণ। আর কবরে থেকেও মা-বাবা তার গুনাহর ফল ভোগ করতে থাকবে। আখিরাতে এই আদরের দুলালই আল্লাহ তাআলার দরবারে মা-বাবার বিরুদ্ধে আপিল করবে যে, তারা আমাকে দ্বীন শেখায়নি। তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। তাই এই আমানতের হক আদায়ের প্রতি খুবই যত্নবান হতে হবে।
বিজাতীয় রীতিনীতি ও ফ্যাশন প্রীতি
কুরআন-হাদীসের একটি মৌলিক শিক্ষা হল, আচার-ব্যবহার, সাজসজ্জা, কৃষ্টি-কালচার ইত্যাদিতে ইসলামী স্বাতন্ত্রবোধ থাকা। এসব ক্ষেত্রে বিজাতীয় অনুকরণকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এটা দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এ সম্পর্কে কুরআন-হাদীসে অসংখ্য হেদায়েত রয়েছে।
হাদীস শরীফের ‘কিতাবুল আদব’ অধ্যায়ে এবং অন্যান্য প্রসঙ্গে বিধর্মীদের অনুকরণ না করার এবং কৃষ্টি-কালচারে তাদের বিরোধীতা করার অনেক তাকীদ এসেছে। একটি হাদীসে এসেছে- ‘যে ব্যক্তি কোনো জাতি বা সম্পদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করল সে তাদের অন্তর্ভু&ক্ত।’
সুতরাং শিক্ষা-দীক্ষা, ফ্যাশন ও রীতিনীতিতে বিজাতীয়দের অনুকরণ করা এবং সে অনুযায়ী সন্তানদের গড়ে তোলা বড় ধরনের ভুল। এতে ইসলাম ও ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন থেকে সে ধীরে ধীরে এমনিভাবে বের হয়ে যায় যার উপলব্ধিও থাকে না।
কুরআন মজীদ না শেখানো
একজন মুসলিম তার সন্তানকে আল্লাহর কালাম শেখাবে না এটা কি কল্পনা করাও সম্ভব? কিন্তু এদেশের অধিকাংশ মুসলমানের অবস্থাই এই। ভেবে দেখুন, লাখ লাখ টাকা খরচ করে সন্তানের জন্য বড় বড় ডিগ্রী নেওয়া হচ্ছে কিন্তু কুরআন পড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না। আমার একটি অভিজ্ঞতা আপনাদের শোনাই। রমযান মাসের কথা। মাঝবয়সী একজন ভদ্রলোক মসজিদে বসে কুরআন শরীফ খুলে বুক ভাসিয়ে কাঁদছিলেন। নিজেকে কিছুতেই সংবরণ করতে পারছিলাম না। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, চাচা কী হয়েছে? এ কথা শুনে আরো জোরে কেঁদে উঠলেন। এরপর বললেন, বাবা! আমি তো এই পবিত্র কালাম পড়তে পারি না। আমার জীবন তো শেষ প্রায়। আমার কী হবে। আমার বাবা আমাকে ডাক্তার বানিয়েছেন, কিন্তু কখনও কুরআন পড়াননি।’ বলুন তো এ লোকটির পিতা ঐ সময় কবরে থেকে কী পাচ্ছিলেন? ভেবে দেখুন, দুনিয়াতেই অভিযোগ শুরু হয়ে গেছে। এরপর যারা আখেরাতের ভয়াবহ আযাবের মুখোমুখি হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাযত করুন। তাদের অভিযোগ আরো কত কঠিন হবে!! কার বিরুদ্ধে? যে বাবা সন্তান মোল্লা হয়ে যাবে ভেবে কুরআন শেখাননি তার বিরুদ্ধে। শুধু কি তাই? স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আল্লাহ তাআলার দরবারে এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন। কুরআন মজীদে এসেছে- (তরজমা :) ‘রাসূল বলবেন, হে আমার রব, আমার কওম এই কুরআনকে পরিত্যাগ করেছে!’ (সূরা ফুরকান ৩০)
স্বয়ং কুরআনের অভিযোগ করার কথাও এসেছে। তাই আমাদের অত্যন্ত সচেতন হওয়া কর্তব্য। সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত, এ ব্যাপারে ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদেরকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানান তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু তাদেরকে ঈমানদার বানানোও আপনার কর্তব্য। সন্তান কুরআন পড়তে ও বুঝতে পারে এতটুকু যোগ্যতা তার মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। তাই শুধু ডাক্তার নয়; বরং দ্বীনদার ডাক্তার ও দ্বীনদার ইঞ্জিনিয়ার বানান। আর যদি দ্বীনের খাদেম আলেম বানাতে পারেন তবে তো সোনায় সোহাগা।
দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রা.এর ছেলে আব্দুল্লাহ, যখন সূরা বাকারা সমাপ্ত করেছিলেন তখন বাবা খুশিতে উট যবাই করে সমাজের লোকদেরকে দাওয়াত করেছিলেন। আজ আমরাও মিষ্টিমুখ করি কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয় সন্তান খৃষ্টান মিশনারীদের নামি দামি স্কুলে চান্স পেয়েছে এজন্য। সন্তান স্কলারশিপ পেয়ে ইসলামের জঘন্যতম শত্রু ইহুদীদের ইউনিভার্সিটিতে সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে পড়ার সুযোগ পেয়েছে এজন্য।
তাই কলিজার টুকরা সন্তানের কচি সিনা বিধর্মীদের হাতে সোপর্দ না করে আসুন সাহাবায়ে কেরামের মতো আমরাও সন্তানকে আল্লাহ পাকের কালাম শেখাই। আসমান-জমিনের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র, নূরানী ও সবচেয়ে বরকতময় কালাম কুরআন মজীদ। তাহলে এ থেকে আমার সন্তানকে বঞ্চিত করব কেন? এই কচি মনে যদি আল্লাহর পবিত্র কালাম স্থান পেয়ে যায় তাহলে পরবর্তী জীবনে কখনও যদি সে প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হলেও অন্তরের এই নূর তাকে সৎ পথে চলতে সাহায্য করবে। সে খড়কুটার মতো অন্যায়ের জোয়ারে ভেসে যাবে না ইনশাআল্লাহ।
দ্বীন না শেখানো
সন্তানকে কুরআন শেখায় না এমন মা-বাবার হার যদি শতকরা ৭০ হয়ে থাকে তবে দ্বীন শেখায় না এদের হার শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ। নামায কীভাবে পড়বে তাও শেখায় না। হালাল-হারাম, পাক-নাপাক, অযু-গোসল তো দূরের কথা। অথচ সন্তানকে দ্বীনের প্রয়োজনীয় বিষয়াদি শেখানো পিতা-মাতার উপর ফরয। এটা না শেখানো সন্তানের উপর সবচেয়ে বড় জুলুম।
বাবা-মাকে এ ভুলের জন্য কিয়ামতের দিন চুলচেরা জবাব দিতে হবে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সতর্কবাণী : ‘পুরুষ তার পরিবারবর্গের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। তাকে তাদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে।’ (সহীহ বুখারী ১/২২২, হাদীস ৮৯৩)
সন্তানকে ইসলাম বিদ্বেষী করে গড়ে তোলা
আধুনিকতার লেহাজ করে অনেক মা-বাবাই তাদের সন্তানদেরকে ইসলামের আহকাম ও ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ বিদ্বেষী করে গড়ে তোলেন। টুপি-দাড়ি, আলিম-ওলামা, মাদরাসা-মসজিদ ইত্যাদি বিষয়ে একটা নেতিবাচক ধারণা। তাদের অন্তরে ঠাঁই পায় (নাউযুবিল্লাহ)। শৈশব থেকেই নাস্তিক প্রকৃতির শিক্ষক বাছাই করা হয়। উপরন্তু স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেট এর অবাধ ব্যবহার তো আছেই। সাথে সাথে এ ধরনের লেখকদের বইপত্র পড়তে দেওয়া হয় এবং এই মানসিকতা সম্পন্ন লোকদের পরিবেশেই তাদের বিচরণকে বিচক্ষণতার সাথে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এভাবে শিশুর মন-মানসকে বিষাক্ত করে দেওয়া হয়। এটা মারাত্মক ভুল। এজন্য পিতামাতাকে আল্লাহর দরবারে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
শিশুর প্রথম পাঠশালা
শিশুর প্রথম পাঠশালা হচ্ছে মায়ের কোল। এখানে সে জীবনের অনেক কিছু শেখে। পরবর্তীতে এটাই তার অভ্যাসে পরিণত হয়। শরীয়তে এই পাঠশালার অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় এই যে, শিশুর এই প্রথম শিক্ষা শুরু হয় টিভি দিয়ে। মা-বাবা তাদেরকে সাথে নিয়েই টিভি দেখে, ধীরে ধীরে এই ছোট বাচ্চাটি নাচ-গান থেকে শুরু করে সব ধরনের অশ্লীলতা শিখতে থাকে, বড় পুতুল নিয়ে খেলা করে, ঘুমায়। ফুলের মতো এই বাচ্চার জীবন কী দিয়ে শুরু হচ্ছে একটুও কি তা ভেবে দেখা হয়েছে। এ সবই ভুল। আমানতের খেয়ানত।
শরীয়তের আদেশ হল, ভূমিষ্ট হওয়ামাত্র শিশুর ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত দিবে। যেন তার জীবন শুরু হয় আল্লাহর বড়ত্বের বাণী ‘আল্লাহু আকবার’ দিয়ে এর পর মা-বাবার দায়িত্ব হল সন্তানের ভালো অর্থবোধক নাম রাখা। বাচ্চা কথা বলা শিখলে তাকে সর্বপ্রথম আল্লাহর নাম শেখানোর চেষ্টা করা উচিত। যিনি এই সন্তান দান করলেন এরপর তাকে বাকশক্তি দিলেন তার নাম সর্ব প্রথম শেখানোই কৃতজ্ঞ বান্দার পরিচয়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সন্তানকে প্রথম কথা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শেখাও এবং মৃত্যুর সময় তাদেরকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর তালকীন কর।’ (শুআবুল ঈমান ৬/৩৯৭-৩৯৮, হাদীস ৮৬৪৯)
বাচ্চা বয়সেই অল্প অল্প করে আল্লাহর পরিচয় শেখানো, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম শেখানো, গল্পে গল্পে তাঁর পরিচয় ও আখলাক তুলে ধরা পিতামাতার কর্তব্য। এককথায় তার জীবনের প্রথম পাঠশালা থেকে সে যেন দ্বীনের শিক্ষা অর্জন করে তা আমাদের কাম্য হওয়া উচিত। ছোট ছোট আদব-কায়দা, যেমন ডান হাতে তিন শ্বাসে বসে পানি পান করতে শেখাবে। জুতা পরিধান করতে আগে ডান পা এবং খোলার সময় আগে বাম পা খোলা। বাথরুমে ঢোকার সময় আগে বাম পা, বের হওয়ার সময় ডান পা ইত্যাদি শেখার উত্তম সময় এই শৈশবটাই। ঘুমের দুআ, ঘুম থেকে ওঠার দুআ, খাওয়ার দুআ ইত্যাদি সহজ বিষয়গুলো এবং ছোট ছোট ব্যবহারিক সুন্নতে অভ্যস্ত করে গড়ে তোলার সময় এখনই। আর এটার দায়িত্ব মা-বাবার।
সন্তানের জন্য বিধর্মীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিধর্মী শিক্ষককে প্রাধান্য দেওয়া
ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র খৃষ্টান মিশনারীদের বহু স্কুল রয়েছে। তবে এসব স্কুলের অধিকাংশ ছাত্রই মুসলমান। শিক্ষকদের মধ্যে বিধর্মী এবং মুসলমান উভয় ধরনের রয়েছে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা কারিকুলাম, ড্রেস ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হয় মিশনারী কর্তৃক।
এগুলোতে পড়ার দ্বারা ছাত্রের একদিকে যেমন ধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠে অন্যদিকে সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের ভবিষ্যৎটা ঐভাবেই গড়ে উঠে।
আজকাল এদের অনুকরণে মুসলমানদের তত্ত্বাবধানেও কিছু কিছু স্কুল পরিচালিত হয়। সেখানে বাহ্যিক অশ্লীলতা আরো এক কাঠি বেশি। সন্তানের জন্য এমন স্কুল নির্বাচন করা বড় ধরনের ভুল।
একজন সাধারণ মুসলমানের এটুকু সচেতনতা ও আত্মমর্যাদা বোধ থাকা চাই যে, নিজের সন্তানকে কোনো বিধর্মীর হাতে তুলে দিবে না। লক্ষ করে দেখুন তো কোনো ইহুদী বা খৃষ্টান কি তার সন্তানকে কোনো মুসলিমের হাতে তুলে দেয়? তারা এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারে যে, ছাত্রের উপর তার শিক্ষকের অনেক ধরনের প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে পরিণত বয়সের আগে তো শিক্ষকের অনেক কিছুই ছাত্রের হৃদয়পটে অংকিত হয়ে যায়। তাই সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য দ্বীনী মাদরাসাই সবচেয়ে উপযোগী। কিন্তু কেউ যদি এতটুকু না পারেন তবে অন্তত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন শিক্ষকমন্ডলী এবং ধর্মীয় ভাবধারার স্কুল নির্বাচন করা কর্তব্য। এক্ষেত্রে অভিভাবকের ভুল পদক্ষেপ সন্তানের জন্য বড় ধরনের সর্বনাশ ডেকে আনে। এ পর্যায়ে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক শিশু (ইসলামের) ফিতরতের উপর জন্মলাভ করে। কিন্তু পিতা-মাতা তাকে ইহুদী বানায়, খৃষ্টান বানায়, অগ্নিপূজক বানায়। (সহীহ বুখারী ১/১৮৫, হাদীস ১৩৮৫; সহীহ মুসলিম ২/৩৩৬, হাদীস ২৬৫৮)
উপার্জন কেন্দ্রিক শিক্ষা নির্বাচন
আজকাল শিক্ষাকে পেশা হিসেবে অবলম্বন করা হয়ে থাকে। যে শিক্ষায় বেশি টাকা আয় করা যাবে সেটাই চাই। তা হোক না কেন যতই অসার। আবার যে পড়া পড়ালে এমন চাকরি করা যায় যেখানে মূল বেতনের পাশাপাশি অবৈধ ইনকামের পথ খোলা রয়েছে,সেটাকে সাগ্রহে নির্বাচন করা হয়। অর্থাৎ অভিভাবকগণও সন্তানকে শিক্ষিত বানানোর উদ্দেশ্য থাকে বেশি বেশি আয়। ফলে সন্তান ধীরে ধীরে সেবার মানসিকতা ছেড়ে কমার্শিয়াল মানসিকতার হয়ে গড়ে উঠে।
আমার এক আত্মীয় বড় ইঞ্জিনিয়ার। সে অসৎ আয় করে না। এতে তার বাবা-মা তেমন সন্তুষ্ট নন। কেননা তার গ্রামের অন্যান্য ইঞ্জিনিয়াররা কত বড় বড় বিল্ডিং করল কিন্তু সে কিছুই করতে পারছে না। এই হল অভিভাবকদের শিক্ষা। এসবই ভুল।
শিক্ষাকে মানুষ হওয়ার জন্য, দেশ ও দশের সেবার মানসিকতা নিয়ে শিখতে হবে। তবেই তা হবে শিক্ষা। এই দৃষ্টি ভঙ্গি অর্জন করা গেলে নিজের ও জাতির উপকার হয় এমন বিদ্যা শেখার সুযোগ হবে। সাথে সাথে মানুষ গড়ার আসল শিক্ষা কুরআন ও হাদীস শেখারও সুযোগ বের হয়ে আসবে।
উচ্চ শিক্ষার জন্য অমুসলিম দেশে গমন
অনেক মা-বাবাই সন্তানকে উচ্চ শিক্ষার জন্য অমুসলিম দেশে পাঠিয়ে থাকেন। প্রশ্ন এই যে, এই সন্তান কি সেখান থেকে শুধু উচ্চ ডিগ্রীই নিয়ে আসবে? নাকি সঙ্গে করে ধর্মদ্রোহিতা ও নাস্তিকতাও নিয়ে আসবে, তা কি কখনও ভেবে দেখেছেন তার অভিভাবকগণ? মসজিদে ওই সন্তানের জন্য হুজুরের কাছে দুআ চাওয়া হয় কিন্তু কখনও কি হুজুরের কাছে এ সম্পর্কিত মাসআলা জেনেছেন যে, ওই সব দেশে উচ্চ ডিগ্রী কিংবা উপার্জনের উদ্দেশ্যে যাওয়ার হুকুম কী? মাসআলা হল, বৈরী পরিবেশে গিয়ে যে ব্যক্তি ইসলামী আদর্শের উপর অবিচল থাকতে পারবে না তার জন্য সেখানে যাওয়ার কোনো অনুমতি নেই। সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম। কেননা, এতে ইচ্ছা করেই নিজেকে গুনাহ ও কুফুরীর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।
সন্তানের স্বাধীনতার নামে তাকে মুক্ত ছেড়ে দেওয়া
আজ সুশীল সমাজ সন্তানের ব্যাপক স্বাধীনতার প্রবক্তা। এই নীতি ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আমদানীকৃত। যখন সন্তানের আখলাক চরিত্র গড়ার সময় তখন তাকে স্বাধীন ছেড়ে দেওয়া হয়। সে ভালো-মন্দ পরিবেশে মিশে যখন যার সাথে ইচ্ছা ঘুরাফেরা করে। ইন্টারনেটে সব ধরনের প্রোগ্রাম দেখতে থাকে। ধীরে ধীরে সে নানা ধরনের মন্দ প্রবণতায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই সন্তানই মা-বাবার কষ্টের কারণ হয়ে দাড়াঁয়। সময়মতো শাসন না করার কারণে বড় হয়ে বাবা-মার অবাধ্য হয়ে যায়। তাই এই ধরনের স্বাধীনতা দুনিয়াতেও সন্তান এবং পরিবার কারো জন্য সুখের কারণ হয় না। এর ফলে সমাজে বিশৃংখলা ও অপরাধ বৃদ্ধি পায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এক বৃহৎ অংশ ধ্বংসের মুখে নিপতিত হয়ে যায়।
আজ সমাজে বিভিন্ন ধরনের স্কুল রয়েছে। রয়েছে মাদক নিরাময় স্কুলও। এ জাতীয় স্কুলের সবকটিতে প্রচুর ছাত্র ভর্তি হচ্ছে। এরা ঐ সকল সন্তান, যাদেরকে মা-বাবা সময়মতো নিয়ন্ত্রণ করেননি। সন্তানকে মন্দ ও অসৎকাজ থেকে বাধা দেননি। ফলে সে ধীরে ধীরে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। সুতরাং সন্তানকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া একটি অসুস্থ চিন্তা। ভুল পদক্ষেপ। শরীয়ত বলে, সন্তান মা-বাবার কাছে আল্লাহর আমানত। তার আখলাক-চরিত্র গড়ার দায়িত্ব মা-বাবারই। সময় মতো তাকে শাসন করা, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা, সৎ ও দ্বীনী পরিবেশে রাখা তাদের নৈতিক দায়িত্ব।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ... সন্তানের বয়স সাত বছর হলে তাদের নামাযের আদেশ দাও, দশ বছর বয়সে নামাযের জন্য শাসন কর এবং এ বয়সে তাদের বিছানা পৃথক করে দাও।’ (মুসনাদে আহমদ ২/২১৮, হাদীস ৬৭৫৬; সুনানে আবু দাউদ ১/৭১, হাদীস ৪৯৪)
সন্তানকে একেবারে স্বাধীন ছেড়ে দেওয়া যাবে না; বরং বুঝের বয়স হওয়া থেকেই তাকে পরিমিত শাসনের মধ্যে রাখার ব্যাপারে এ হাদীস সুস্পষ্ট দলীল। এছাড়া সাহাবা, তাবেঈন থেকে বহু বর্ণনা রয়েছে যে, মা-বাবার দায়িত্ব এবং কর্তব্য হল, সন্তানকে দ্বীন শেখানো, মন্দ কাজ ও মন্দ পরিবেশ থেকে দূরে রাখা। শুধু কি তাই? সন্তানের পরিণত বয়সে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করাও তাদের দায়িত্ব। যেন তারা কোনো পাপাচারে লিপ্ত না হয়ে যায়। অভিভাবকদের শীথিলতার কারণে সন্তান যদি কোনো গুনাহে জড়িয়ে পড়ে তবে এর জন্য দায়ী হবেন অভিভাবকগণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যার সন্তান রয়েছে সে যেন তার সুন্দর নাম রাখে এবং তাকে উত্তম চরিত্র শেখায়। যখন সে বালেগ হবে তখন তার বিয়ে দেয়। বালেগ হওয়ার পরও যদি বিয়ে না দেয় আর সে কোনো গুনাহ করে ফেলে তবে তার এ গুনাহ তার পিতার উপর বর্তাবে।’ (শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৬/৪০১, হাদীস ৮৬৬৬)
সুতরাং বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বাধীতার অজুহাতে সন্তানকে মুক্ত ছেড়ে দেওয়া তাকে ধ্বংস করারই নামান্তর। বিশেষ করে নিম্নোক্ত বিষয়ে উদারতা করা সন্তানের নিশ্চিত ধ্বংসের কারণ :
ক) অসৎ সংশ্রব অবলম্বনে বাধা প্রদান না করা। সহপাঠী হোক কিংবা প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের মধ্যে দুঃশ্চরিত্র ছেলে-মেয়েদের সাথে মেলামেশা করার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া। যখন যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে মিশতে দেওয়া। এতে তাদের খারাপ চরিত্র অতি দ্রুত সন্তানের মধ্যে চলে আসে এবং সেও এক সময় তাদের মতো বা তাদের চেয়ে আরো খারাপ হয়ে যাবে।
খ) ডিশ এন্টিনা, ইন্টারনেট এর অশ্লীল প্রোগ্রাম, সিনেমা, টেলিভিশন, অশ্লীল ছবি, নাচ-গান ইত্যাদি দেখতে বাধা না দেওয়া। এক্ষেত্রে ছাড় দেওয়াও ধ্বংসাত্মক। এতে সন্তান পড়ালেখার পরিবেশ থেকে দূরে সরে যায় এবং তার স্বভাব-চরিত্রে অশ্লীলতা প্রবেশ করতে থাকে। ধীরে ধীরে সে বাবা-মার অবাধ্য হয়ে পড়ে এবং অশ্লীল কাজে জড়িয়ে পড়ে।
গ) পর্দার বিষয়ে ছাড় দেওয়াও ধ্বংসাত্মক। ঘরে-বাইরে সর্বত্র শরয়ী পর্দা রক্ষা করা ফরয। কিন্তু তথাকথিত মডার্ন ফ্যামিলী শরীয়তের এ হুকুমের প্রতি শীথিলতা করে থাকে। নিজেরা যেমনি পর্দা করে না তেমনি সন্তানকেও পর্দায় থাকার আদেশ দেয় না। এর কারণে সমাজের বিভিন্ন স্তরে গুনাহ ব্যাপক হচ্ছে। সন্তানের চরিত্র ধ্বংস হওয়ার এটি একটি বড় কারণ। তাই এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
ঘ) ছেলেদেরকে মাহরাম নয় এমন মেয়েদের সাথে মিশতে দেওয়া এবং মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে একাকী যাওয়ার অনুমতি দেওয়া এবং তাদেরকে এ ব্যাপারে স্বাধীন ছেড়ে দেওয়াও ধ্বংসাত্মক।
আল্লাহ তাআলা সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।#
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
রেফারেন্স উত্তর :
প্রশ্নঃ ১০৬১০. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আমার সন্তান কে কত বছর বয়সে মাদ্রাসায় দিবো ?
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
সম্মানিত আব্দুর রাজ্জাক ভাই, আপনার নেক ইচ্ছাকে আল্লাহ তায়ালা কবুল করুক।
আপনি এবং আপনার সন্তানের পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের কাছে অস্পষ্ট। তাই আপনার উচিত হবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার নিকটস্থ বা পরিচিত কিছু বিজ্ঞ আলেমের সাথে আলোচনা করা। যারা আপনার সন্তানের অবস্থা ভালো ভাবে জানেন ।কারণ আপনার সন্তান ছেলে না মেয়ে ?
তার বয়স কত ?
তার মেধা শক্তি কেমন ?
বুজশক্তি কেমন ?
তার ধৈর্য্য ক্ষমতা বা সহনশীলতা কতটুকু?
এইসব কিছুর উপরে বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কোন সন্তানের জন্য কখন কোন বিষয়টি উপযোগি বা উপকারী হবে।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
প্রশ্নঃ ৯৭৭৯. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, শায়েখ! আমার মেয়ে জেনারেল লাইনে ৮ম শ্রেণিতে পড়ছে, সে এখন ক্বওমি মাদ্রাসায় যেতে চায়, তবে আমাদের পরিবারের সকলে মনে করছে ক্বওমি মাদ্রাসায় পড়লে দুনিয়াবি কোনো জ্ঞান থাকবেনা, ইংলিশ পড়তে পারবেনা। তারা ভাবছে কওমি তে পড়লে দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে আখিরাত কে উপস্থাপন করতে পারবেনা। তারা ভাবে আলিয়া মাদ্রাসাতেই শুধু সম্ভব দুনিয়া এবং আখিরাত দুটিকেই ঠিক রেখে! এখন শায়েখ আমার প্রশ্ন, আমার মেয়ে তো কওমি মাদ্রাসাতেই যেতে চাইছে, সেক্ষেত্রে কওমি মাদ্রাসার এডুকেশন সিস্টেম টা আসলে কেমন সেটা তো আমরা জানিনা যেহেতু আমাদের পরিবারে কেউ নেই যে কিনা মাদ্রাসায় পড়ছেন। শায়েখ, কওমি মাদ্রাসায় কি কি কিতাব পড়ানো হয় কিভাবে পড়ানো হয় সাথে ইংলিশ পড়তে পারবে কিনা, দুনিয়াবি জ্ঞান থাকবে কিনা এ নিয়ে যদি পরামর্শ দিতেন!উপকৃত হবো ইনশাআল্লাহ, ভুল হলে মাফ করবেন শায়েখ। জাযাকাল্লাহ ফিদদুনিয়া ওয়াল আখিরাহ।
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
ওয়ালাইকুম আসসালাম।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
প্রিয় ভাই! আপনার লোকেশান বলে আপনি ঢাকার অদূরেই বসবাস করেন। যেখানে অসংখ্য ওলামায়ে কেরাম এবং শতশত কওমি মাদরাসার উর্বরভূমি।
কওমি মাদরাসার পরিচিত, প্রয়োজনীয়তা, শিক্ষা কারিকুলাম, সিলেবাস, লক্ষ্য উদ্দেশ্য, ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে মেহেরবানি করে যদি একদিন আপনার এলাকার বড় কোনো কওমি মাদরাসায় যেতেন তবে বড়ই উপকৃত হবেন ইনশাআল্লাহ।
(বিস্তারিত জানতে নিচের প্রবন্ধটি দেখতে পারেন।)
কওমী মাদ্রাসা কি ও কেন?
“কওমীমাদ্রাসা” সঠিক সম্ভাবনা ও প্রদীপ্ত আশার আলো, পৃথিবীর বুকেযুগ পরম্পরায় যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছেসেগুলোর মাঝে অন্যতম ও সর্বোত্তমপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে কওমী মাদ্রাসা। যার নির্মাতা ও প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহান স্রষ্টা স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর পক্ষ থেকেপ্রেরিত মানবতার মহান অগ্রদূত হযরত মুহাম্মাদসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যার অমীয় সূধা পানকরে তৃপ্ত হয়েছেন হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ, হযরত ইবনে মাসউদ রাঃ, হযরত আবু হুরায়রা রাঃ। সৃষ্টি হয়েছেন হযরত ইমাম আবু হানিফা,ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালিক, ইমাম আহমদরাহিমাহুমুল্লাহু আলাইহিম প্রমুখ আইম্মায়ে কেরাম।
কওমীমাদ্রাসা প্রকৃত আদর্শ মানব তৈরীর সুনিপুণ কারখানা। যে কারখানা থেকে তৈরী হয়েছেন হযরত ইমাম গাজালী, মুহাদ্দিসেদেহলভী, মুহাজিরে মাক্কী রাহিমাহুমুল্লাহুআলাইহিম এর মত বিখ্যাত ব্যক্তিরা। যারা জাতির ক্রান্তিলগ্নেইংরেজ বেনিয়াদের হাত থেকে ধর্ম দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে গড়ে তুলেন “দারুল উলূম দেওবন্দ” মাদ্রাসা এবং দারুল উলূম দেওবন্দকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে হাজার হাজার কওমী মাদ্রাসা।
দেশও ধর্ম প্রিয় এই আলেমগনের রোনাজারি আহাজারি ও নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এবং নিরলস সাধনা প্রচেষ্টায় তৈরী হয় সেবা প্রিয় এক দল ছাত্র সমাজতাদের মহান আত্মত্যাগ ও বিপ্লবী হুংকারে কেঁপে উঠেছেব্রিটিশ বেনিয়াদের মসনদ ছাড়তে বাধ্যহয়েছে উপমহাদেশ। তাদের তাজা খুনের প্লাবন স্রোতে তরী ভেসেছে ১৯৪৭ সালের মহান স্বাধীনতার। যে তরীর কান্ডারী ছিলেন হযরত কাসিমনানুতুবী, হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী, শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহিমাহুমুল্লাহ সহঅসংখ্য দেওবন্দী ওলামায়ে কেরাম। ধর্মের প্রকৃতরুপায়ন, সঠিক সংরক্ষণ, সকল প্রকার অপব্যাখ্যা ওমনগড়া ধর্ম ব্যবস্থাপত্র থেকে কোরআন ও হাদিস, ইলমে নববীর মূলধারা সুন্নতে রাসূল সাঃ এর রূপরেখা সংরক্ষিত হচ্ছে সুপ্রাচীর কওমী দুর্গে।
কওমীমাদ্রাসা জাতিকে শুধু স্বাধীনতাই উপহার দেয়নি বরং প্রতি বছরই উপহার দেয় স্বার্থত্যাগী সচেতন এক দল কর্মনিষ্ট কর্মী।যারা প্রিয়মাতৃভুমিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী শক্তির আগ্রাসন থেকেরক্ষার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। যারাস্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছেন।
“কওমী শিক্ষারপরিচয়”
কওমীশিক্ষার্থীদের পরিচয় হল তারা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ অনূগত ও আস্থাশীল, সুন্নাতে নববীরপূর্ণ অনুরক্ত ও অনুসারী। এই শিক্ষা ব্যবস্থা মানব গবেষণাপ্রদত্তনয় বরং আল্লাহ প্রদত্ত। যার আবেদন করেছিলেন জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম আঃ সন্তানের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ শান্তি এবং উন্নতি ওসমৃদ্ধির কথা ভেবে। আর পার্থিব সেই শিক্ষা ব্যবস্থারপাঠ্যসূচি ছিল কোরআনের তিলাওয়াত,চরিত্রসংশোধন তথা আত্মশুদ্ধি এবং কিতাব ও হিকমাতের শিক্ষাদান।আল্লাহ্তাআলা এই প্রার্থনা কবুল করলেন এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই পাঠ্যসূচী দিয়ে প্রেরণ করলেন। এরপর সাড়ে চৌদ্দশত বছরের দীর্ঘ পথ অতিক্রমের পর যুগপরম্পরায় এই শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের পর্যন্ত পৌছেদেন সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন তাবে তাবেঈন এবংসালফে সালেহীন রিযওয়ানিল্লাহি আলাইহিম আজমাঈন। সুতরাং বিজ্ঞানের সামনেঅজ্ঞান হয়ে যারা কওমী মাদ্রাসা সম্পর্কে বিজ্ঞান প্রযুক্তিতেপিছিয়ে থাকার অবান্তর অভিযোগ তুলেন তারা মূলত এই শিক্ষা ধারার লক্ষ উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনবগত।
বস্তুতএই শিক্ষা আহরণ করে এবং নববী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে কওমী শিক্ষার্থীরাহয় ভদ্র, সভ্য, নম্র, বিনয়ী এবং মানবিক উন্নত চরিত্রাবলীর অধিকারী। ফলেকওমী শিক্ষার্থীরা ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে পাশ্চাত্বের অন্ধঅনুকরণকরেনা। সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির বেড়াজালে গাঁ ভাসিয়ে দেন না এবং আকাশ মিডিয়াও প্রিন্ট মিডিয়ার নোংরামী, বেহায়াপনা, নগ্নতা ওঅশ্লীলতায় নিমগ্ন হননা। কওমী শিক্ষার্থীরা অল্পে তুষ্ট, পরকল্যাণেসচেষ্ট, দশ ও দেশের জন্য উৎসর্গিত এবং উম্মত ও জাতির প্রতি দরদ, মায়া এবংসম্প্রীতি ও ভালবাসা প্রদর্শনের এক অনুপম দৃষ্টান্ত। তাই অভাব অনটন ও ক্ষুধা, অনাহারে ক্লিষ্ট থাকা সত্বে ও কওমীশিক্ষার্থীরা লোভ-লালসা, সন্ত্রাস, হানাহানি,চাঁদাবাজিও দুর্নীতির কালো বাজার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানকরেন।
আমারও আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস পাশ্চাত্বমুখী আধুনিক শিক্ষায় গর্বিত দেশের ও দেশের বাইরের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ গুলো এর একটি উপমাও পেশ করতে সক্ষমহবেনা। কওমী শিক্ষার্থীরা তাদের হৃদয়ের গহীনে এইবিশ্বাস লালন করে যে অর্থ-সম্পদ, যশ-খ্যাতি এবং ভোগ ও প্রাচুর্যের মধ্যে কোনকামিয়াবী ও সফলতা নেই বরং সততা ওন্যায়নীতি এবং বিশ্বস্ততা ও আমানতদারীর ভিত্তিতেই জীবনে সফলতার সৌধ নির্মিত হয়। তাই দেশ ও জাতির আমানতের খেয়ানত, দুর্নীতি ওইয়াবা কেলেঙ্কারীর দায় থেকে কওমী শিক্ষার্থীরাসম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র।
ন্যায়ইনসাফের কষ্টি পাথরে যাচাই করলে আমরা দেখতে পাই প্রতিটি কওমী মাদ্রাসা দ্বীন ও ইসলামের এক একটি উজ্জ্বল প্রদীপ। স্বাধীনতারস্বপক্ষে সৈনিক তৈরীর আদর্শ প্রতিষ্ঠান এবং দেশ প্রেমিকসুনাগরিক সৃষ্টির নির্মল ঝর্ণাধারা।এখানে বিরাজ করে পারষ্পরিক কলহ বিবাদ মুক্ত এক অন্তরঙ্গ পরিবেশ। দূষিত রাজনীতির পঙ্কিলতা এবং ছাত্র রাজনীতির বিষাক্ততা এখানে নেই।
“কওমী মাদ্রাসাশিক্ষা ও প্রসঙ্গ কর্মসংস্থানঃ”
দ্বীনিশিক্ষার মারকায এই কওমী মাদ্রাসাগুলোকে আজ বাংলাদেশের কোন কোন সমালোচক ভূলবশত অসত্য বিশেষনে বিশেষায়িত করতে চান। তারা এগুলোকে অপ্রয়োজনীয়, বেকার ও বেকারত্ব সৃষ্টিকারী ইত্যাকারকটুবাক্যে কালিমা লেপন করে এগুলোরভাবগাম্ভীর্য বিনষ্ট করতে সচেষ্ট। তারা ইনিয়ে বিনিয়ে, টেনে টোনে, জোড়াতালি দিয়ে বুঝাতে চান যে, এসব মাদ্রাসায়পড়ে কোন চাকরী-নকরী পাওয়া যায়না।ইচ্ছেমত টাকা পয়সা কামাই করা যায়না। বিলাসী জীবন উপভোগ করা যায়না।তাহলে এইসব প্রতিষ্ঠান দিয়ে সমাজের কি লাভ। এসব বুদ্ধিজীবি ভাইদের উদ্দেশ্যে আমরা কিছু আরজ করতে চাই তারা যদি বুদ্ধিরসদ্ব্যবহার করেন এবং নিম্নোক্তকথাগুলোতে একটু চিন্তা করেন তাহলে আশা করি তারা তাদের উপরোক্ত অবস্থানথেকে সরে আসবেন। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিনির্বিশেষে পৃথিবীর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নিছকরুজি-রোজগার ও আর্থিক উন্নতি সাধনকে নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলে ঘোষনা দেয়নি দিতে পারে ও না। বরং ছাত্রদের জ্ঞান ও প্রতিভার উপযুক্ত বিকাশ সাধনই হলো সকলশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভিন্ন উদ্দেশ্য।
তাহলে কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত কোন আলিমকে এ মানদন্ডে কেন বিচার করা হয় যে তিনি তার এই লেখাপড়ার দ্বারা মাসে কত টাকা রোজগার করতে পারেনএটা আমাদের বোধগম্য নয়। চোখে রঙ্গিন চশমা লাগিয়েতাকালে সবকিছুর সঠিক রং অনুমান করাযায়না চশমা খুলে তাকালে তবেই আসল রং বুঝা যায়। যে সব বন্ধু কওমী শিক্ষিতদেরকে বেকার ও অকর্মণ্য দোষে দোষী করতে চান, যদি দয়া করেচোখ থেকে রঙ্গিন চশমাটি সরিয়ে তাকাতেন তাহলেদেখতেন যে, কওমী আলিমগন বেকার তো ননই বরং ভীষনব্যস্ত। মানুষকে দ্বীনের সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে নৈতিকতা ও আদর্শের গুণ অর্জনের প্রতি উৎসাহিত করা এবং তাদেরকেআখেরাতমুখী বানানোর মত ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজেতারা সদা নিয়োজিত। আমাদের অনেক আলেমে দ্বীনরয়েছেন যাদের ডায়রীতে বিপুল পরিমাণ কাজের দীর্ঘ ফিরিস্তি পরে রয়েছে। কিন্তু সময়ের অভাবে তারা তাতে হাত দিতে পারছেননা।
বলাহচ্ছে কওমী আলিমদের কোন কর্মক্ষেত্র নেই আসলেই কি বিষয়টি এরকম, কিছুতেই না। বরংতাদের কর্মক্ষেত্র অসংখ্য ও অগণিত সুবিশাল ও সুবিস্তৃত। তবে এগুলোকেকঠিন পর্দা দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়েছে যা উন্মোচন করতে দেওয়া হচ্ছেনা।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধি মতে প্রতি দশ জন মানুষের দৈহিক সুস্থতারজন্য অন্তত একজন চিকিৎসক এবং একজন আইন উপদেষ্টা বিদ্যমান থাকা একটি মৌলিকঅধিকার এখন আমরা বলতে চাই মানুষ কি শুধু শরীরের নাম। না বরং শরীর ও রুহএ দুইয়ের সমন্বয়ে হল মানুষ। সামান্য শরীরের জন্য যদি বিশ্ববিবেকপ্রতি দশ জনের জন্য একজন চিকিৎসক ও আইন উপদেষ্টার প্রয়োজন মনে করে তাহলে মানুষের রুহ ও আত্মার সুস্থতার জন্য রুহানী চিকিৎসক ওশরয়ী আইন উপদেষ্টার প্রয়োজনীয়তা কিভাবেঅস্বীকার করা যায়।
একজনহক্কানী আলিম হলেন মানুষের রুহ ও আত্মার চিকিৎসক তিনি মানুষের যাবতীয় আমল-আখলাক, কাজকর্ম, লেনদেন ইত্যাদিরআইন উপদেষ্টা। অতএব বিশ্ব বিবেকের নীতি অনুযায়ীযদি চিন্তা করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে কর্ম সংস্থান ও চাহিদার তুলনায়আলিমদের সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। শেষে একটি কথা না বলে পারছিনা কওমীবিদ্বেষী কতিপয় চিন্তাবিদ অযথা এ উক্তি করে থাকেন যে কওমী শিক্ষিতদের অধিকাংশই অভাবী। অভাবের তারনায় তারা সন্ত্রাসের পথ বেছেনেন কিন্তু আমরা অভাবে স্বভাব নষ্ট, এই প্রবাদসর্বক্ষেত্রে সত্য বলে মেনে নিতে পারছিনা। কেবলেছে অভাবের কারনে মানুষ সন্ত্রাসী হয়? অভাবের কারনেমানুষ সন্ত্রাসী হয়না বরং তুলনামূলক বেশি সংযমী হয়।অধিক খোদাভীরু ও আল্লাহ্ওয়ালাইহয়। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় অপকর্ম,
দুর্নীতি,অত্যাচারইত্যাদির ৮০% ঘটে সমাজের ধনী লোকদের দ্বারা আর হয়ত ২০% ঘটে গরীব লোকদের মাধ্যমে। বস্তুত কোন মানুষ যদি সন্ত্রাসী হয় তাহলে সেটা মন্দ সাহচর্য ও মন্দ পরিবেশ এবং অশিক্ষা ও কুশিক্ষার কারণে কিংবা জীবনযাত্রায় মওত ও আখেরাতের ভয় বিদ্যমান না থাকার কারণে।
আসলে রোগের সঠিক কারণ নির্ণয় না করে আমরা জাতিকে ঔষধ সেবন করিয়ে যাচ্ছি। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। চিন্তাবিদ মহলের জন্য বিষয়টি গভীরভাবেচিন্তা করা দরকার মানবতারবাতিঘর এই কওমী মাদ্রাসা গুলো বরাবরই বিশ্বসন্ত্রাস ইহুদী, খ্রিষ্টানদেরপ্রধান শত্রু বিবেচিত হয়ে আসছে। কারণ জালিমের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেঅন্যায়ের প্রতিবাদ করবে যারা তাদেরকেই জন্ম দেয় কওমী মাদ্রাসা। তাইসাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি এ সকল প্রতিষ্ঠানকে নির্মূল করার জন্য সর্বদাই গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কওমী শিক্ষাকে সন্ত্রাস ও বেকারত্ব সৃষ্টিকারী, আধুনিক যুগের উন্নতি-অগ্রগতির পথে বাধা ইত্যাদিদোষে দোষী করে সমাজের সামনে তুলে ধরতে তারা সদাসচেষ্ট। অতএব সর্বস্তরের মুসলিম জনগনের প্রতি আবেদনশ্ত্রুর অপপ্রচারে যেন আমরা বিভ্রান্ত না হই। মনে রাখবেন যেদিন এই কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা থাকবেনা। সেদিন হয়ত বিদ্যুতের ঝলক থাকবে,প্রযুক্তিরগতি থাকবে, মানুষ উড়বে মহাকাশে মহাবেগে, আধুনিকতায়পৃথিবী ঝলমল করবে। কিন্তু সেদিন হয়ত মানুষ আর মানুষথাকবেনা পশুকে ও হার মানাবে।
সুত্রঃদারুল উলূম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার ২০১২ সালের তাফসীর বিভাগের পক্ষ থেকেছাপানো ফয়জুল আজিজ নামক ডায়রী থেকে সংকলিত।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
বাইতুল কুরআন মাদারাসা , মোহাম্মাদপুর
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন