আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

ইমামের পিছনে দাড়ানোর হকদার/উপযুক্ত কে?

প্রশ্নঃ ১০৩১১৪. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, ইমামের পিছনে কারা দাড়াতে পারবে?হাদিস এবং মাসআলা সহ জানতে চাই।

১৩ মে, ২০২৫
কালিগঞ্জ

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


প্রিয় প্রশ্নকারী দ্বীনি ভাই! ইমামের পিছনে কে দাঁড়াবে বিষয়টি সুস্পষ্ট আকারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " لِيَلِيَنِي مِنْكُمْ أُولُو الأَحْلاَمِ وَالنُّهَى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ وَلاَ تَخْتَلِفُوا فَتَخْتَلِفَ قُلُوبُكُمْ وَإِيَّاكُمْ وَهَيْشَاتِ الأَسْوَاقِ " .
আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন তোমাদের মধ্যে যারা অধিক জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান তাঁরা আমার কাছে দাঁড়াবে। এরপর তাদের অনুরূপ যে ক্রম অনুসারে দাঁড়াবে। কাতার করতে আঁকা বাঁকা করবে না এতে তোমাদের হৃদয়েও অনৈক্যের সৃষ্টি হয়ে পড়বে। সাবধান, বাজরের মত শোরগোল করা থেকে বেঁচে থাকবে।
জামে' তিরমিযী
হাদীস নং: ২২৮আন্তর্জাতিক নং: ২২৮
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এ হাদীছে বলা হয়েছে- لِيَلِني مِنكُمْ أُولوا الأَحْلامِ والنُّهَى (তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী, তারা যেন আমার কাছাকাছি দাঁড়ায়)। أَحْلامِ শব্দটি حلم এর বহুবচন। এর অর্থ বুদ্ধি, ধীরস্থিরতা, অবিচলতা। أُولوا الأَحْلامِ অর্থ সাবালক, স্থিতপ্রজ্ঞ, বিচক্ষণ ও জ্ঞানী লোক। نهَى অর্থ স্থিরতা, আবদ্ধতা। বুদ্ধিকেও نهَى বলে, যেহেতু বুদ্ধি মানুষকে ভালো কাজের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ রাখে ও মন্দ কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে আটকে রাখে। শব্দটি نهية এর বহুবচন।

এখানে, أُولوا الأَحْلامِ والنُّهَى বলে প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের বোঝানো উদ্দেশ্য। এ স্তরের লোকদেরকে প্রথম কাতারে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। অনেক সময় ইমামের বিশেষ কারণবশত নামাযের মাঝখানে কাউকে খলীফা (নিজের স্থলাভিষিক্ত) বানানোর দরকার পড়ে, যাতে সে মুসল্লীদের নিয়ে অবশিষ্ট নামায সমাপ্ত করে। প্রথম কাতারে প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানসম্পন্ন লোক দাঁড়ালে খলীফা বানানো সহজ হয়। তাছাড়া যাদের বয়স বেশি এবং জ্ঞানবুদ্ধিতেও অগ্রগামী, অন্যদের তুলনায় তাদের মর্যাদাও বেশি। তাই প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর অগ্রাধিকারও তাদেরই। তারপর বয়স ও জ্ঞানের পর্যায়ক্রম অনুযায়ী এক কাতারের পর আরেক কাতার দাঁড়াতে থাকবে।

সুতরাং বয়স্ক ও আলেমগণ দাঁড়াবে প্রথম কাতারে। তারপর যারা বয়স্ক কিন্তু আলেম নয়, তারা তাদের পেছনে। তারপর দাঁড়াবে যুবকগণ। তাদের পেছনে শিশুরা। জামাতে মহিলাগণ শামিল হলে তারা শিশুদের পেছনে দাঁড়াবে। এটা নামাযের পবিত্রতা ও শুচিশুদ্ধতা রক্ষার উদ্দেশ্যে। অন্যথায় শয়তান ও নফসের সুযোগ নেওয়ার আশঙ্কা থাকে।

উল্লেখ্য, বয়স্ক ও জ্ঞানীজনদেরকে সম্মুখে স্থান দেওয়ার এ নীতি নামাযের জন্যই নির্দিষ্ট নয়; বরং নামাযের বাইরেও যে-কোনও মজলিস ও লোকসমাবেশে তাদেরকে সামনে স্থান দেওয়া চাই।

هَيْشَاتِ শব্দটি هَيْشَة এর বহুবচন। এর অর্থ ছত্রভঙ্গ অবস্থা, হট্টগোল, উচ্চ আওয়াজ, তর্ক-বিতর্ক। এ হাদীছে মসজিদে বাজারের মত অবস্থা সৃষ্টি করতে নিষেধ করা হয়েছে। বাজারে আসা লোকজনের মধ্যে কোনও শৃঙ্খলা থাকে না। আপন আপন প্রয়োজন অনুযায়ী যার যেখানে সুবিধা সে সেখানে থাকে। বড়-ছোট, নবীন-প্রবীণ, আলেম-বেআলেম প্রভৃতির কোনও ভেদাভেদ বাজারে থাকে না। তা থাকা সম্ভবও নয়। এমনিভাবে বাজারে মানুষের কথাবার্তার আওয়াজেরও কোনও মাত্রা থাকে না। সকলেই কথা বলে এবং যাকে উদ্দেশ্য করে বলে সে যাতে শুনতে পায় সেজন্য উচ্চ আওয়াজে বলে। ফলে সমগ্র বাজারে হইচই, হট্টগোল লেগে থাকে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে এরূপ করতে নিষেধ করেছেন। মসজিদে যতক্ষণ থাকবে সুশৃঙ্খলভাবে থাকবে। অহেতুক কথা বলবে না। যা বলার প্রয়োজন হবে, সংযত আওয়াজে বলবে।
যখন নামাযে দাঁড়াবে, কাতার সোজা করে দাঁড়াবে। কাতারবন্দী হওয়ার ক্ষেত্রে বয়স ও জ্ঞানবুদ্ধির পর্যায়ক্রম রক্ষা করবে। ইমাম কিরাআত পড়বে, বাকিরা নীরব থাকবে ও মনোযোগ সহকারে শুনবে। ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)

মাসআলা:
ফতোয়ায়ে দারুল উলূম দেওবন্দ (খণ্ড: ৩, পৃ: ২৩৬, প্রকাশনায়: دار الإشاعت, করাচি) -তে বলা হয়েছে:

ইমামের নিকটবর্তী হওয়ার ক্ষেত্রে জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের দাঁড়ানো উত্তম; তবে যদি সাধারণ কোনো ব্যক্তি ইমামের নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, তাহলে তাকে সরানোর প্রয়োজন নেই; কারণ যে কোনো অবস্থাতেই নামায সহীহ হয়ে যায়।

قال ابن عابدین: مطلب فی جواز الإیثار بالقرب وفی حاشیة الأشباہ للحموی عن المضمرات عن النصاب: وإن سبق أحد إلی الصف الأول فدخل رجل أکبر منہ سنا أو أہل علم ینبغی أن یتأخر ویقدمہ تعظیما لہ اہ فہذا یفید جواز الإیثار بالقرب بلا کراہة خلافا للشافعیة. وقال فی الأشباہ: لم أرہ لأصحابنا. ونقل العلامة البیری فروعا تدل علی عدم الکراہة، ویدل علیہ قولہ تعالی {ویوٴثرون علی أنفسہم ولو کان بہم خصاصة} [الحشر: وما فی صحیح مسلم من أنہ - علیہ الصلاة والسلام - أتی بشراب فشرب منہ وعن یمینہ أصغر القوم وہو ابن عباس وعن یسارہ أشیاخ، فقال - علیہ الصلاة والسلام - للغلام: أتأذن لی فی أن أعطی ہوٴلاء؟ فقال الغلام لا واللہ، فأعطاہ الغلام إذ لا ریب أن مقتضی طلب الإذن مشروعیة ذلک بلا کراہة وإن جاز أن یکون غیر أفضل. اہ.أقول: وینبغی تقیید المسألة بما إذا عارض تلک القربة ما ہو أفضل منہا؛ کاحترام أہل العلم والأشیاخ، کما أفادہ الفرع السابق والحدیث فإنہما یدلان علی أنہ أفضل من القیام فی الصف الأول، ومن إعطاء الإناء لمن لہ الحق وہو من علی الیمین، فیکون الإیثار بالقربة انتقالا من قربة إلی ما ہو أفضل منہا وہو الاحترام المذکور. أما لو آثرہ علی مکانہ فی الصف مثلا من لیس کذلک یکون أعرض عن القربة بلا داع، وہو خلاف المطلوب شرعا ۔ ( الدر المختار مع رد المحتار: ۵۶۹/۱، دار الفکر، بیروت )

ইবনে আবেদীন (রহ.) বলেন:
কাতারে (বিশেষ করে প্রথম কাতারে) কাউকে সম্মান দেখিয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া (ইসার) শরিয়তসম্মত। যেমন: যদি কেউ প্রথম সারিতে আগে পৌঁছে যায় এবং পরে কোনো আলেম বা বয়সে বড় ব্যক্তি আসেন, তবে প্রথমজনের উচিত নিজে সরে গিয়ে তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

এতে কোনো অনুচিত কাজ নেই — যদিও শাফেয়ী মাযহাব ভিন্নমত পোষণ করে। এই বিধান কুরআনের আয়াত {তারা নিজেদের উপর অন্যদের অগ্রাধিকার দেয়...} (সূরা হাশর: ৯) ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদীস দ্বারা সমর্থিত, যেখানে তিনি ইবনে আব্বাসের অনুমতি নিয়ে প্রবীণ সাহাবিদের পান করাতে চেয়েছিলেন।

এই সব প্রমাণ করে যে, যদি কাউকে ইবাদতের এমন একটি কাজের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যা সম্মান ও আদবের দিক থেকে শ্রেষ্ঠতর, তাহলে তা প্রশংসনীয়। তবে এমন কাউকে অগ্রাধিকার দেওয়া, যার মর্যাদা নেই, তা অনুচিত।
(আল-দুররুল মুখতার মা’আর রদ্দুল মুখতার, ১/৫৬৯)

والله اعلم بالصواب

শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী মুফতী, ফাতাওয়া বিভাগ, মুসলিম বাংলা গবেষক, হাদীস বিভাগ, মুসলিম বাংলা খতীব, রৌশন আলী মুন্সীবাড়ী জামে মসজিদ, ফেনী

মন্তব্য (0)

কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!

মন্তব্য করতে লগইন করুন