রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৩৪৯
উলামায়ে কিরাম, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানীত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
নামাযের প্রথম কাতারে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানদের দাঁড়ানোর নির্দেশ
হাদীছ নং : ৩৪৯
হযরত আবূ মাসউদ উকবা ইবন আমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে (অর্থাৎ নামাযের শুরুতে) আমাদের কাঁধে হাত রেখে বলতেন, সোজা হয়ে দাঁড়াও। আঁকাবাঁকা হয়ে দাঁড়াবে না। তাহলে তোমাদের অন্তরসমূহ অমিল হয়ে যাবে। তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী, তারা যেন আমার কাছাকাছি দাঁড়ায়। তারপর যারা তাদের কাছাকাছি তারা এবং তারপর যারা তাদের কাছাকাছি তারা – মুসলিম।১৯৪
ইমাম নববী রহ. বলেন, النُّهَى এর অর্থ জ্ঞান-বুদ্ধি।
أُولُوا الأَحْلامِ এর অর্থ প্রাপ্তবয়স্ক । কেউ বলেন, বিচক্ষণ ও জ্ঞানী।
১৯৪. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪৩২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২২৮; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৮১২; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৬৭৫; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৩০৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৩৭৩; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০০৪১; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৫১৬১; শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৮২১
হাদীছ নং : ৩৪৯
হযরত আবূ মাসউদ উকবা ইবন আমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে (অর্থাৎ নামাযের শুরুতে) আমাদের কাঁধে হাত রেখে বলতেন, সোজা হয়ে দাঁড়াও। আঁকাবাঁকা হয়ে দাঁড়াবে না। তাহলে তোমাদের অন্তরসমূহ অমিল হয়ে যাবে। তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী, তারা যেন আমার কাছাকাছি দাঁড়ায়। তারপর যারা তাদের কাছাকাছি তারা এবং তারপর যারা তাদের কাছাকাছি তারা – মুসলিম।১৯৪
ইমাম নববী রহ. বলেন, النُّهَى এর অর্থ জ্ঞান-বুদ্ধি।
أُولُوا الأَحْلامِ এর অর্থ প্রাপ্তবয়স্ক । কেউ বলেন, বিচক্ষণ ও জ্ঞানী।
১৯৪. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪৩২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২২৮; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৮১২; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৬৭৫; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৩০৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৩৭৩; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০০৪১; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৫১৬১; শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৮২১
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم
349 - وعنه، قَالَ: كَانَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يَمْسَحُ مَنَاكِبَنَا في الصَّلاةِ، ويَقُولُ: «اسْتَوُوا وَلاَ تَخْتَلِفُوا، فَتَخْتَلِفَ قُلُوبُكُمْ، لِيَلِني مِنْكُمْ أُولُوا الأحْلاَمِ وَالنُّهَى، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ». رواه مسلم. (1)
وقوله - صلى الله عليه وسلم: «لِيَلِني» هُوَ بتخفيف النون وليس قبلها ياءٌ، وَرُوِيَ بتشديد النُّون مَعَ يَاءٍ قَبْلَهَا. «وَالنُّهَى»: العُقُولُ. «وَأُولُوا الأحْلام»: هُم البَالِغُونَ، وقَيلَ: أهْلُ الحِلْمِ وَالفَضْلِ.
وقوله - صلى الله عليه وسلم: «لِيَلِني» هُوَ بتخفيف النون وليس قبلها ياءٌ، وَرُوِيَ بتشديد النُّون مَعَ يَاءٍ قَبْلَهَا. «وَالنُّهَى»: العُقُولُ. «وَأُولُوا الأحْلام»: هُم البَالِغُونَ، وقَيلَ: أهْلُ الحِلْمِ وَالفَضْلِ.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে নামাযের কাতার সম্পর্কে মৌলিকভাবে দু'টি নির্দেশ আছে- ক. কাতার সোজা করে দাঁড়ানো এবং খ. প্রথম কাতারে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানদের দাঁড়ানো।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের কাতার সোজা করাকে খুব গুরুত্ব দিতেন। তিনি সকলকে এক বরাবর দাঁড়ানোর হুকুম তো দিতেনই, সেইসঙ্গে কাতার সোজা হলো কি না সেদিকে লক্ষও রাখতেন। কোথাও বাকা দেখা গেলে তা সোজা করে দিতেন। এ হাদীছে বলা হয়েছে, তিনি সাহাবায়ে কেরামের কাধে হাত রাখতেন। অর্থাৎ কেউ আগে বা পিছে দাঁড়ালে তার কাধে হাত রেখে তাকে অন্যদের বরাবর করে দিতেন। বোঝা গেল কথা ও কাজ দিয়ে নামাযের কাতার সোজা করায় ভূমিকা রাখা ইমামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
নামাযের কাতার সোজা করা সুষ্ঠু নামায আদায়ের অংশ। এ ব্যাপারে অবহেলা করার সুযোগ নেই । এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
سَؤُوا صُفُوفَكُمْ ، فَإِنَّ تَسْوِيَةَ الصُّفُوْفِ مِنْ إِقَامَةِ الصَّلَاةِ
‘তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর। কেননা কাতার সোজা করা নামায কায়েমের অংশ।’
অপর এক বর্ণনায় আছে— من تمام الصلاة (নামাযের পরিপূর্ণতার অংশ)।১৯৫
কাতার সোজা করার দ্বারা যেমন নামায পরিপূর্ণ হয়, তেমনি পরস্পরের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টির পক্ষেও এটা সহায়ক হয়। কাতার সোজা না করলে নামায হয় ত্রুটিপূর্ণ। মানুষের অন্তরেও এর কুফল পড়ে। সে কুফল হচ্ছে পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতি নষ্ট হওয়া এবং কলহ-বিভেদ দেখা দেওয়া। এ সম্পর্কে সতর্ক করার জন্যই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَلا تخْتلِفُوا، فَتَخْتَلِفَ قُلُوبُكُمْ (আঁকাবাঁকা হয়ে দাঁড়াবে না। তাহলে তোমাদের অন্তরসমূহ অমিল হয়ে যাবে)। এর দ্বারা বোঝা গেল বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার সুষ্ঠু না হলে অন্তরে তার কুফল পড়ে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শরীআতবিরোধী ব্যবহার দ্বারা অন্তরে শরীআতের বিরুদ্ধাচরণ করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। তাই অন্তর ভালো রাখার জন্যও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভালো ব্যবহার জরুরি। অন্তর তো ভালো রাখতেই হবে। কারণ এটা অঙ্গসমূহের রাজা। এটা নষ্ট হয়ে গেলে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে নষ্টামী চলে আসে। ফলে তার সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব হয় না। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
أَلَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً : إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّه، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّه، ألا وهي القلب
‘শোন হে! শরীরে একটি মাংসপিণ্ড আছে। সেটি ঠিক থাকলে সারা শরীর ঠিক থাকে, আর সেটি নষ্ট হয়ে গেলে সারা শরীর নষ্ট হয়ে যায়। শোন হে! সেটি হচ্ছে কলব (অন্তর)।১৯৬
প্রকাশ থাকে যে, রাজার ভালোমন্দ কাজকর্মের প্রভাব যেমন প্রজা সাধারণের মধ্যে পড়ে, তেমনি প্রজাদের কর্মকাণ্ডও রাজাকে প্রভাবিত করে থাকে। কাজেই কল্ব নষ্ট হয়ে গেলে যেমন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়, তেমনি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভুল ব্যবহারও অন্তরে প্রভাব ফেলতে পারে। এর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই।
দ্বিতীয় নির্দেশ হলো প্রথম কাতারে কারা দাঁড়াবে সে সম্পর্কে। এ হাদীছে বলা হয়েছে- لِيَلِني مِنكُمْ أُولوا الأَحْلامِ والنُّهَى (তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী, তারা যেন আমার কাছাকাছি দাঁড়ায়)। أَحْلامِ শব্দটি حلم এর বহুবচন। এর অর্থ বুদ্ধি, ধীরস্থিরতা, অবিচলতা। أُولوا الأَحْلامِ অর্থ সাবালক, স্থিতপ্রজ্ঞ, বিচক্ষণ ও জ্ঞানী লোক। نهَى অর্থ স্থিরতা, আবদ্ধতা। বুদ্ধিকেও نهَى বলে, যেহেতু বুদ্ধি মানুষকে ভালো কাজের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ রাখে ও মন্দ কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে আটকে রাখে। শব্দটি نهية এর বহুবচন।
এখানে, أُولوا الأَحْلامِ والنُّهَى বলে প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের বোঝানো উদ্দেশ্য। এ স্তরের লোকদেরকে প্রথম কাতারে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। অনেক সময় ইমামের বিশেষ কারণবশত নামাযের মাঝখানে কাউকে খলীফা (নিজের স্থলাভিষিক্ত) বানানোর দরকার পড়ে, যাতে সে মুসল্লীদের নিয়ে অবশিষ্ট নামায সমাপ্ত করে। প্রথম কাতারে প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানসম্পন্ন লোক দাঁড়ালে খলীফা বানানো সহজ হয়। তাছাড়া যাদের বয়স বেশি এবং জ্ঞানবুদ্ধিতেও অগ্রগামী, অন্যদের তুলনায় তাদের মর্যাদাও বেশি। তাই প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর অগ্রাধিকারও তাদেরই। তারপর বয়স ও জ্ঞানের পর্যায়ক্রম অনুযায়ী এক কাতারের পর আরেক কাতার দাঁড়াতে থাকবে।
সুতরাং বয়স্ক ও আলেমগণ দাঁড়াবে প্রথম কাতারে। তারপর যারা বয়স্ক কিন্তু আলেম নয়, তারা তাদের পেছনে। তারপর দাঁড়াবে যুবকগণ। তাদের পেছনে শিশুরা। জামাতে মহিলাগণ শামিল হলে তারা শিশুদের পেছনে দাঁড়াবে। এটা নামাযের পবিত্রতা ও শুচিশুদ্ধতা রক্ষার উদ্দেশ্যে। অন্যথায় শয়তান ও নফসের সুযোগ নেওয়ার আশঙ্কা থাকে।
উল্লেখ্য, বয়স্ক ও জ্ঞানীজনদেরকে সম্মুখে স্থান দেওয়ার এ নীতি নামাযের জন্যই নির্দিষ্ট নয়; বরং নামাযের বাইরেও যে-কোনও মজলিস ও লোকসমাবেশে তাদেরকে সামনে স্থান দেওয়া চাই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কাতার সোজা করা নামাযের পরিপূর্ণতার অংশ। এদিকে ইমাম সাহেবের বিশেষ লক্ষ রাখা চাই।
খ. নামাযের কাতার সোজা না হলে কেবল নামাযেরই ক্ষতি হয় না; ঐক্য ও সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
গ. এর দ্বারা বোঝা যায় মানুষের অন্তরে তার বাহ্যিক ভালোমন্দ কর্মের আছর পড়ে থাকে।
ঘ. নামাযের কাতারবন্দীতে বয়স ও ইলমের পর্যায়ক্রম রক্ষা করা চাই।
ঙ. যে-কোনও মজলিসে বয়স্কদেরকে সামনে স্থান দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
১৯৫. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭২৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১২৪; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৬৬৮; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৯৯৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২৮১৩; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১২৯৮; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২১৭১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৫১৭৬; সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীছ নং ১৫৪৩
১৯৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৫৯৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৮৩৭৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ২২০০৩; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ২৫৭৩; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৮৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৯৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১০৪০০; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৫৩৫৬
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের কাতার সোজা করাকে খুব গুরুত্ব দিতেন। তিনি সকলকে এক বরাবর দাঁড়ানোর হুকুম তো দিতেনই, সেইসঙ্গে কাতার সোজা হলো কি না সেদিকে লক্ষও রাখতেন। কোথাও বাকা দেখা গেলে তা সোজা করে দিতেন। এ হাদীছে বলা হয়েছে, তিনি সাহাবায়ে কেরামের কাধে হাত রাখতেন। অর্থাৎ কেউ আগে বা পিছে দাঁড়ালে তার কাধে হাত রেখে তাকে অন্যদের বরাবর করে দিতেন। বোঝা গেল কথা ও কাজ দিয়ে নামাযের কাতার সোজা করায় ভূমিকা রাখা ইমামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
নামাযের কাতার সোজা করা সুষ্ঠু নামায আদায়ের অংশ। এ ব্যাপারে অবহেলা করার সুযোগ নেই । এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
سَؤُوا صُفُوفَكُمْ ، فَإِنَّ تَسْوِيَةَ الصُّفُوْفِ مِنْ إِقَامَةِ الصَّلَاةِ
‘তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর। কেননা কাতার সোজা করা নামায কায়েমের অংশ।’
অপর এক বর্ণনায় আছে— من تمام الصلاة (নামাযের পরিপূর্ণতার অংশ)।১৯৫
কাতার সোজা করার দ্বারা যেমন নামায পরিপূর্ণ হয়, তেমনি পরস্পরের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টির পক্ষেও এটা সহায়ক হয়। কাতার সোজা না করলে নামায হয় ত্রুটিপূর্ণ। মানুষের অন্তরেও এর কুফল পড়ে। সে কুফল হচ্ছে পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতি নষ্ট হওয়া এবং কলহ-বিভেদ দেখা দেওয়া। এ সম্পর্কে সতর্ক করার জন্যই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَلا تخْتلِفُوا، فَتَخْتَلِفَ قُلُوبُكُمْ (আঁকাবাঁকা হয়ে দাঁড়াবে না। তাহলে তোমাদের অন্তরসমূহ অমিল হয়ে যাবে)। এর দ্বারা বোঝা গেল বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার সুষ্ঠু না হলে অন্তরে তার কুফল পড়ে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শরীআতবিরোধী ব্যবহার দ্বারা অন্তরে শরীআতের বিরুদ্ধাচরণ করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। তাই অন্তর ভালো রাখার জন্যও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভালো ব্যবহার জরুরি। অন্তর তো ভালো রাখতেই হবে। কারণ এটা অঙ্গসমূহের রাজা। এটা নষ্ট হয়ে গেলে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে নষ্টামী চলে আসে। ফলে তার সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব হয় না। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
أَلَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً : إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّه، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّه، ألا وهي القلب
‘শোন হে! শরীরে একটি মাংসপিণ্ড আছে। সেটি ঠিক থাকলে সারা শরীর ঠিক থাকে, আর সেটি নষ্ট হয়ে গেলে সারা শরীর নষ্ট হয়ে যায়। শোন হে! সেটি হচ্ছে কলব (অন্তর)।১৯৬
প্রকাশ থাকে যে, রাজার ভালোমন্দ কাজকর্মের প্রভাব যেমন প্রজা সাধারণের মধ্যে পড়ে, তেমনি প্রজাদের কর্মকাণ্ডও রাজাকে প্রভাবিত করে থাকে। কাজেই কল্ব নষ্ট হয়ে গেলে যেমন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়, তেমনি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভুল ব্যবহারও অন্তরে প্রভাব ফেলতে পারে। এর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই।
দ্বিতীয় নির্দেশ হলো প্রথম কাতারে কারা দাঁড়াবে সে সম্পর্কে। এ হাদীছে বলা হয়েছে- لِيَلِني مِنكُمْ أُولوا الأَحْلامِ والنُّهَى (তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী, তারা যেন আমার কাছাকাছি দাঁড়ায়)। أَحْلامِ শব্দটি حلم এর বহুবচন। এর অর্থ বুদ্ধি, ধীরস্থিরতা, অবিচলতা। أُولوا الأَحْلامِ অর্থ সাবালক, স্থিতপ্রজ্ঞ, বিচক্ষণ ও জ্ঞানী লোক। نهَى অর্থ স্থিরতা, আবদ্ধতা। বুদ্ধিকেও نهَى বলে, যেহেতু বুদ্ধি মানুষকে ভালো কাজের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ রাখে ও মন্দ কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে আটকে রাখে। শব্দটি نهية এর বহুবচন।
এখানে, أُولوا الأَحْلامِ والنُّهَى বলে প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের বোঝানো উদ্দেশ্য। এ স্তরের লোকদেরকে প্রথম কাতারে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। অনেক সময় ইমামের বিশেষ কারণবশত নামাযের মাঝখানে কাউকে খলীফা (নিজের স্থলাভিষিক্ত) বানানোর দরকার পড়ে, যাতে সে মুসল্লীদের নিয়ে অবশিষ্ট নামায সমাপ্ত করে। প্রথম কাতারে প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানসম্পন্ন লোক দাঁড়ালে খলীফা বানানো সহজ হয়। তাছাড়া যাদের বয়স বেশি এবং জ্ঞানবুদ্ধিতেও অগ্রগামী, অন্যদের তুলনায় তাদের মর্যাদাও বেশি। তাই প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর অগ্রাধিকারও তাদেরই। তারপর বয়স ও জ্ঞানের পর্যায়ক্রম অনুযায়ী এক কাতারের পর আরেক কাতার দাঁড়াতে থাকবে।
সুতরাং বয়স্ক ও আলেমগণ দাঁড়াবে প্রথম কাতারে। তারপর যারা বয়স্ক কিন্তু আলেম নয়, তারা তাদের পেছনে। তারপর দাঁড়াবে যুবকগণ। তাদের পেছনে শিশুরা। জামাতে মহিলাগণ শামিল হলে তারা শিশুদের পেছনে দাঁড়াবে। এটা নামাযের পবিত্রতা ও শুচিশুদ্ধতা রক্ষার উদ্দেশ্যে। অন্যথায় শয়তান ও নফসের সুযোগ নেওয়ার আশঙ্কা থাকে।
উল্লেখ্য, বয়স্ক ও জ্ঞানীজনদেরকে সম্মুখে স্থান দেওয়ার এ নীতি নামাযের জন্যই নির্দিষ্ট নয়; বরং নামাযের বাইরেও যে-কোনও মজলিস ও লোকসমাবেশে তাদেরকে সামনে স্থান দেওয়া চাই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কাতার সোজা করা নামাযের পরিপূর্ণতার অংশ। এদিকে ইমাম সাহেবের বিশেষ লক্ষ রাখা চাই।
খ. নামাযের কাতার সোজা না হলে কেবল নামাযেরই ক্ষতি হয় না; ঐক্য ও সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
গ. এর দ্বারা বোঝা যায় মানুষের অন্তরে তার বাহ্যিক ভালোমন্দ কর্মের আছর পড়ে থাকে।
ঘ. নামাযের কাতারবন্দীতে বয়স ও ইলমের পর্যায়ক্রম রক্ষা করা চাই।
ঙ. যে-কোনও মজলিসে বয়স্কদেরকে সামনে স্থান দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
১৯৫. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭২৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১২৪; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৬৬৮; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৯৯৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২৮১৩; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১২৯৮; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২১৭১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৫১৭৬; সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীছ নং ১৫৪৩
১৯৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৫৯৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৮৩৭৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ২২০০৩; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ২৫৭৩; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৮৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৯৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১০৪০০; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৫৩৫৬
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: