রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৪৮
অধ্যায়ঃ ৪৪

উলামা, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের
অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
ইসলাম এক মহান ও পরিপূর্ণ দীন। মানবজীবনের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে এর পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা আছে। সমাজ ও সামাজিকতা সম্পর্কেও এর শিক্ষা অতি পূর্ণাঙ্গ। সামাজিক সাধারণ শিষ্টাচার সম্পর্কে শিক্ষাদানের পাশাপাশি জ্ঞান-গরিমা ও বয়সের স্তরভেদ অনুসারে স্বতন্ত্র আচরণ ও বিশেষ শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ রাখাও এ দীনের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
কুরআন-সুন্নাহ'র দৃষ্টিতে সমাজের অন্যান্য লোক অপেক্ষা উলামায়ে কেরামের মর্যাদা অনেক উঁচুতে। উলামায়ে কেরাম বলতে শরীআতের এমন জ্ঞানীজনদের বোঝায়, যারা আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ যারা বিদআতপন্থী নয়। বিদআতপন্থীকে সম্মান দেখানো জায়েয নয়। কেননা তাতে দীনের ক্ষতি।
উলামায়ে কেরাম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়ারিশ। তাঁর সম্মানার্থেই তাদেরকে সম্মান করা কর্তব্য। তারা যে ইলমে দীনের চর্চা করে থাকেন, মানুষের দীন ও ঈমানের জন্য তা অতীব জরুরি। উলামায়ে কেরাম দ্বারা তাদের সে জরুরত পূরণ হয়। এ জরুরত পূরণ করাটা জনমানুষের উপর তাদের অতি মূল্যবান এক সেবা। এর সঙ্গে অন্য কোনও সেবার তুলনা চলে না। সকলেরই এর মূল্য বোঝা উচিত।
উলামায়ে কেরামের মর্যাদা ইলমে দীনের কারণে। এ ক্ষেত্রে বয়স বিবেচ্য নয়। তাই বয়স্ক ব্যক্তিরও কর্তব্য তার তুলনায় অল্পবয়স্ক আলেমকে সম্মান করা।
ইসলাম বয়স্ক ব্যক্তিকে তার বয়োজ্যেষ্ঠতার কারণে বিশেষ সম্মান দিয়েছে। তাই কোনও বয়স্ক ব্যক্তি আলেম না হলেও বয়োজ্যেষ্ঠতার বিবেচনায় তার সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা অবশ্যকর্তব্য। বয়স্ক ও প্রবীণ ব্যক্তি যদি আলেমও হয়, হবে তার দ্বিগুণ মর্যাদা প্রাপ্য।
ইলমে দীন ছাড়াও এমন অনেক বিষয় আছে, যা ব্যক্তিকে মহিমান্বিত করার পাশাপাশি অন্যদেরও প্রভূত কল্যাণ সাধন করে। যেমন নেতৃত্বগুণ, বীরত্ব, বিচক্ষণতা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। এসব গুণের অধিকারী ব্যক্তিবর্গকেও ইসলাম বিশেষ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে। তাই তাদের মর্যাদা রক্ষা করাও এ মহান দীনের অনুসারীদের একান্ত কর্তব্য।
মর্যাদাবান ব্যক্তিদের মর্যাদা দেওয়ার বিভিন্ন পন্থা আছে। যেমন পথচলার ক্ষেত্রে তাদেরকে সামনে রেখে নিজেরা পেছনে চলা, তাদেরকে আগে বসতে দেওয়া ও উঁচু স্থানে বসতে দেওয়া, তাদের সঙ্গে বিনীত ভঙ্গিতে কথা বলা, তাদের আগে আগে কথা বলার চেষ্টা না করা ইত্যাদি। মোটকথা কথায় ও কাজে এমন ভাব ও ভঙ্গি অবলম্বন করা চাই, যা দ্বারা সম্মানী ব্যক্তির সম্মান রক্ষা হয়।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে কুরআন-সুন্নাহ'র এমনসব ভাষ্য উদ্ধৃত করেছেন যা দ্বারা বিশেষ বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষের স্বতন্ত্র মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, আর সে মর্যাদার কারণে তাদের সঙ্গে পৃথক শিষ্টাচার রক্ষা করাও অন্যদের কর্তব্য হয়ে যায়। আমরা নিচে সে ভাষ্যসমূহের বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।

আলোচ্য বিষয় সম্পর্কিত একটি আয়াত

قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ

অর্থ : বল, যারা জানে আর যারা জানে না উভয়ে কি সমান? উপদেশ গ্রহণ তো কেবল বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরাই করে।'

ব্যাখ্যা

এটি একটি আয়াতের শেষাংশ। এর আগে আছে-

أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ

‘তবে কি (এরূপ ব্যক্তি সেই ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে,) যে রাতের মুহূর্তগুলোতে ইবাদত করে, কখনও সিজদাবস্থায়, কখনও দাঁড়িয়ে, যে আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজ প্রতিপালকের রহমতের আশা করে?'
এর আগের কয়েক আয়াতে আখেরাতের সত্যতা প্রমাণ করা হয়েছে। তারপর এ আয়াতে প্রশ্নের আকারে যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, আখেরাতের হিসাব-নিকাশ না থাকলে তার অর্থ দাঁড়ায় মুমিন ও কাফের এবং পুণ্যবান ও পাপী সব সমান। কিন্তু কোনও বিবেকবান লোক এ উভয় শ্রেণীকে সমান বলতে পারে না। প্রত্যেকেই স্বীকার করবে যে, উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। সে পার্থক্য অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রেণীকে তার প্রাপ্য প্রতিদান বুঝিয়ে দেওয়া চাই। সেজন্যই আখেরাত।
আখেরাতের অবশ্যম্ভাবিতা প্রমাণের জন্য এ আয়াতে আরও একটি যুক্তি দেওয়া হয়েছে এই যে, জ্ঞানী ও অজ্ঞানী কি সমান? নিশ্চয়ই প্রত্যেকে স্বীকার করবে জ্ঞানী-অজ্ঞানী সমান নয়। তো জ্ঞানী ও অজ্ঞানী যেমন সমান নয়, তেমনি পুণ্যবান ও পাপীও সমান নয়। আর সে কারণেই আখেরাত প্রয়োজন।
আখেরাতের বাস্তবতা প্রমাণের জন্য জ্ঞানী ও অজ্ঞানী সমান না হওয়ার যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, তা দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অজ্ঞানীর উপর জ্ঞানীর মর্যাদাও প্রতিপন্ন হয়ে গেছে। বলাবাহুল্য সাধারণ জ্ঞানও জ্ঞান বটে, কিন্তু কুরআন-হাদীছের পরিভাষায় জ্ঞানী বা আলেম ওই ব্যক্তিকেই বলে, যে ইলমে দীনের অধিকারী, যে দীন ও শরীআত সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান রাখে। সুতরাং আয়াতটি আমাদের জানাচ্ছে যে, ইলমে দীনের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ তথা উলামায়ে কেরাম অন্যদের মত নয়; তাদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। অন্যদের সে মর্যাদা অনুভব করা উচিত। অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে বিপুল মর্যাদায় উন্নীত করবেন। তোমরা যা-কিছু কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে পরিপূর্ণ অবগত।১৯০
প্রকাশ থাকে যে, উলামায়ে কেরামের মর্যাদা যেহেতু ইলমে দীনের কারণে, তাই তাদেরও উচিত ইলমে দীনের হেফাজত ও প্রচারে সচেষ্ট থাকা। সে প্রচেষ্টা তখনই সফল হবে, যখন ইলমের আলোয় নিজেকে আলোকিত করা হবে। বাস্তবিকপক্ষে আলেম বলাই হয় তাকে, যে ইলম অনুযায়ী আমলেও যত্নবান থাকে। ইলমের সঙ্গে আমলের মিল না থাকলে মানুষের কাছে বিশ্বস্ততা ও আস্থা হারিয়ে যায়। কোনও আলেমের মানুষের কাছে আস্থা হারানো আলেম হিসেবে নিজ অস্তিত্ব হারানোরই নামান্তর। এটা ইলমী আমানতের চরম খেয়ানত। ইমাম রাবী আ আর-রা'য় রহ. বলেন-

لَا يَنْبَغِي لِأَحَدٍ عِنْدَهُ شَيْءٌ مِنَ الْعِلْمِ أَنْ يُضَيِّعَ نَفْسَهُ

‘যার কাছে ইলমের কিছুমাত্রও আছে, তার নিজেকে হারিয়ে ফেলা উচিত নয়।১৯১

১৮৯. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৯

১৯০. সূরা মুজাদালাহ (৫৮), আয়াত ১১

১৯১. সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, অধ্যায় : ইলম, পরিচ্ছেদ : ইলম উঠে যাওয়া ও অজ্ঞতা প্রকাশ পাওয়া।
ইমাম হওয়ার অগ্রাধিকার কার
হাদীছ নং : ৩৪৮

হযরত আবূ মাসউদ উকবা ইবন্ আমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, লোকদের মধ্যে যে ব্যক্তি কুরআন বেশি জানে সে-ই তাদের ইমামত করবে। যদি কুরআন পাঠে সকলে সমান হয়, তবে তাদের মধ্যে সুন্নাহ সম্পর্কে যে বেশি জানে। যদি সুন্নাহ জানায়ও সকলে সমান হয়, তবে তাদের মধ্যে হিজরতে যে সকলের অগ্রগামী। যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে বয়সে যে সকলের বড়। কোনও ব্যক্তি যেন কিছুতেই অপর ব্যক্তির ক্ষমতাবলয়ে অনুমতি ছাড়া তার ইমামত না করে এবং তার বাড়িতে তার আসনে অনুমতি ছাড়া না বসে –মুসলিম।১৯২
অপর এক বর্ণনায় বয়সের স্থলে আছে, যে ব্যক্তি তাদের সকলের আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে।
অপর এক বর্ণনায় আছে, লোকজনের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে বেশি জানে এবং কিতাব পাঠেও তাদের মধ্যে অগ্রগামী সে-ই তাদের ইমামত করবে। যদি আল্লাহর কিতাব পাঠে সকলেই সমান হয়, তবে তাদের ইমামত করবে হিজরতে যে ব্যক্তি তাদের মধ্যে অগ্রগামী। যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে যে ব্যক্তি বয়সে তাদের মধ্যে বড়।
ইমাম নববী রহ. বলেন, سلطانه এর দ্বারা কারও কর্তৃত্বাধীন স্থান বোঝানো উদ্দেশ্য। অথবা এমন স্থান, যা তার জন্য নির্দিষ্ট।
تكرمته এর অর্থ কারও ব্যক্তিগত বিছানা, চেয়ার বা এরকম কোনও স্থান।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৬৭৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৭৮৩; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫৮২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৭৮০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৭০৬৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৪৫১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ২১৩৩; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৫১৩২
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم

قَالَ الله تَعَالَى: {قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الأَلْبَابِ} [الزمر: 9].
348 - وعن أَبي مسعودٍ عقبةَ بن عمرو البدري الأنصاري - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «يَؤُمُّ القَوْمَ أَقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ الله، فَإنْ كَانُوا في القِراءةِ سَوَاءً، فأَعْلَمُهُمْ بِالسُّنَّةِ، فَإنْ كَانُوا في السُّنَّةِ سَوَاءً، فَأَقْدَمُهُمْ هِجْرَةً، فَإنْ كَانُوا في الهِجْرَةِ سَوَاءً، فَأقْدَمُهُمْ سِنًّا، وَلاَ يُؤمّنَّ الرَّجُلُ الرَّجُلَ في سُلْطَانِهِ، وَلاَ يَقْعُدْ في بَيْتِهِ عَلَى تَكْرِمَتِهِ إلاَّ بِإذْنهِ». رواه مسلم. (1)
وفي رواية لَهُ: «فَأقْدَمُهُمْ سِلْمًا» بَدَلَ «سِنًّا»: أيْ إسْلامًا. وفي رواية: «يَؤُمُّ القَومَ أقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ اللهِ، وَأقْدَمُهُمْ قِراءةً، فَإنْ كَانَتْ قِرَاءتُهُمْ سَوَاءً فَيَؤُمُّهُمْ أقْدَمُهُمْ هِجْرَةً، فَإنْ كَانُوا في الهِجْرَةِ سَواء، فَليَؤُمُّهُمْ أكْبَرُهُمْ سِنًّا».
والمراد «بِسلطانهِ»: محل ولايتهِ، أَو الموضعِ الَّذِي يختص بِهِ «وتَكرِمتُهُ» بفتح التاءِ وكسر الراءِ: وهي مَا ينفرد بِهِ من فِراشٍ وسَريرٍ ونحوهِما.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে পর্যায়ক্রমিকভাবে যারা ইমাম হওয়ার অগ্রাধিকার রাখে তাদের নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এতে পর্যায়ক্রমে তিনটি বিষয় বিবেচনায় রাখা হয়েছে— ইলম, হিজরত ও বয়স। বয়স ও হিজরতের ক্ষেত্রে ইলমী যোগ্যতাও বিবেচ্য। অর্থাৎ ইমামতের জন্য ইলম এক অপরিহার্য শর্ত। হিজরত ও বয়স বিবেচ্য হয় তখনই, যখন সমপর্যায়ের একাধিক আলেম থাকে। যদি সুযোগ্য আলেম একজনই হয়, তবে তিনিই ইমামত করবেন। যদি একাধিক হয়, তবে যে আলেম হিজরতের ক্ষেত্রে অগ্রগামী তিনি অগ্রাধিকার পাবেন। ইলমী যোগ্যতায় সমান হওয়ার পাশাপাশি হিজরতের ক্ষেত্রেও যদি তারা সমকালীন হন, তবে সে ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এবারে হাদীছটির দিকে লক্ষ করুন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
يَؤُمُّ الْقَوْمَ أَقْرَؤهُمْ لِكتَابِ اللَّهِ (লোকদের মধ্যে যে ব্যক্তি কুরআন বেশি জানে সে-ই তাদের ইমামত করবে)। কুরআন জানার দু'টি দিক আছে। এক হচ্ছে কুরআনের শব্দাবলী জানা, আরেক হচ্ছে অর্থ ও ব্যাখ্যা জানা। শব্দাবলী জানাও দু'রকম- শব্দ মুখস্থ থাকা ও সহীহ-শুদ্ধভাবে পড়তে জানা। তাহলে ‘কুরআন জানা' কথাটি পুরোপুরিভাবে ওই ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য হয়, যে কুরআন সহীহ-শুদ্ধভাবে পড়তে পারে, যথেষ্ট পরিমাণ মুখস্থও করেছে এবং অর্থ ও ব্যাখ্যাও বোঝে। সুতরাং এ তিনওটি দিক যার মধ্যে তুলনামূলক বেশি থাকবে, ইমামতের অগ্রাধিকারও তার জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তারপর ইরশাদ হয়েছে-
فَإِنْ كَانُوا في الْقِراءَةِ سَواءً، فَأَعْلَمُهُمْ بِالسُّنَّةِ (যদি কুরআন পাঠে সকলে সমান হয়, তবে তাদের মধ্যে সুন্নাহ সম্পর্কে যে বেশি জানে)। সুন্নাহ অর্থ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেখে যাওয়া তরিকা তথা দীন ও শরীআত। একে 'ফিকহ' শব্দেও ব্যক্ত করা হয়। কাজেই ‘সুন্নাহ সম্পর্কে যে বেশি জানে' এর অর্থ দীন ও শরীআতের জ্ঞান যার বেশি আছে, ফিক্হ সম্পর্কে যার জানাশোনা বেশি, এককথায় যিনি ফকীহ ও আলেম হিসেবে অন্যদের তুলনায় উচ্চস্তরের। বলাবাহুল্য এরূপ ব্যক্তির কুরআন সম্পর্কিত জ্ঞানও অন্যদের তুলনায় বেশিই থাকবে। অন্যথায় তার বড় ফকীহ হওয়ার প্রশ্ন আসে না।

এমনিতে বড় আলেম ও বড় ফকীহ'র মর্যাদা বেশি হলেও ইমামতির জন্য 'বেশি কুরআন জানা'-কে প্রথম বিবেচনা করা হয়েছে। তা বিবেচনা করার কারণ হলো, সেকালে নামাযের প্রয়োজনীয় মাসাইল সাধারণভাবে অধিকাংশেরই জানা থাকত। কিন্তু কুরআন মাজীদ জানার ক্ষেত্রে তাদের পরস্পরের মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। কেউ বেশি জানত, কেউ কম। তখন সাধারণত কুরআন মাজীদ নামাযে পড়াও হত বেশি বেশি। তখন কুরআন মাজীদ সংরক্ষণের কাজটি বিশেষভাবে মুখস্থকরণের মাধ্যমে করা হতো। তাই সকলের যাতে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে যায়, সে লক্ষ্যেও নামাযে বেশি বেশি পড়ার প্রয়োজনও ছিল। এসকল কারণে কুরআন বেশি জানা ব্যক্তিকে ইমামতের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

পরবর্তীকালে ইমামতের জন্য ইলম যার বেশি সেরকম লোকের জন্যই অগ্রাধিকার বিবেচনা করা হয়। কেননা নামাযে কেরাত অপেক্ষা ইলমেরই প্রয়োজন বেশি হয়। নামাযের শত শত মাসআলা আছে। এমন বহু কারণ আছে, যাতে নামায নষ্ট হয়ে যায়, যদ্দরুন নামায পুনরায় পড়া জরুরি হয়। এমন অনেক ভুল আছে, সাহু সিজদা দ্বারা যার প্রতিকার হয়ে যায়। যথেষ্ট ইলম না থাকলে এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। আর এটা তো স্পষ্ট কথা যে, একজন আলেমের যথেষ্ট পরিমাণ কুরআনও জানা থাকে এবং তিনি সহীহ-শুদ্ধভাবেই তা পড়ে থাকেন। এসব বিবেচনায় ইমাম আবূ হানীফা রহ.-সহ বহু ফকীহ ইমামতের জন্য কারী অপেক্ষা আলেমকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাঁরা এ সিদ্ধান্ত হাদীছের ভিত্তিতেই নিয়েছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শেষজীবনে ইমামতের জন্য হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে মনোনীত করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টিতে তিনিই ছিলেন তাদের মধ্যে সবচে’ বড় আলেম । কিন্তু কারী হিসেবে বড় ছিলেন হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি.।

যাহোক এ হাদীছে ইমামতের জন্য আলেম ও কারীকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি নামাযের সময় সমমানের একাধিক বড় আলেম একত্র হয়ে যায়, তখন অগ্রাধিকারের জন্য বিবেচ্য বিষয় কী হবে? হাদীছটিতে বলা হয়েছে-
فَإِنْ كَانُوا في السُّنَّةِ سَوَاءً، فَأَقْدمُهُمْ هِجْرَةً (যদি সুন্নাহ জানায়ও সকলে সমান হয় তবে তাদের মধ্যে হিজরতে যে সকলের অগ্রগামী। এর দ্বারা হিজরতের মর্যাদা ও গুরুত্ব পরিস্ফুট হয়। বলাবাহুল্য হিজরত অতি বড় একটি ত্যাগ। নিজের দীন ও ঈমান রক্ষার্থে মাতৃভূমি ছেড়ে অজানা অপরিচিত এক দেশে চলে যাওয়া সহজ কথা নয়। এর জন্য পরিপক্ক ঈমান ও গভীর আখেরাতমুখিতা প্রয়োজন। সাহাবায়ে কেরামের তা ছিল। তাই অকাতরে হিজরতের কত কঠিন ত্যাগ তাঁরা স্বীকার করতে পেরেছিলেন। তাই আজ সম্মানজনক 'মুহাজির' নামে তাঁরা পরিচিত। কিয়ামত পর্যন্ত এ সম্মানজনক অভিধায় তাঁরা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

যাহোক হিজরতের উচ্চমর্যাদার কারণে ইমামতের অগ্রাধিকারেও এটি বিবেচ্য। তবে বর্তমানকালে সাধারণভাবে মুহাজির না থাকায় অগ্রাধিকারদানের এ দিকটি বিবেচনা করা কঠিন। তাই এ পর্যায়ে অগ্রাধিকারের পরবর্তী দিকটি বিবেচ্য। সুতরাং ইরশাদ হয়েছে-
فَإِنْ كانُوا في الهِجْرَةِ سَوَاءً، فَأَقْدَمُهُمْ سِنّاً (যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে বয়সে যে সকলের বড়)। অপর এক বর্ণনায় আছে- فَأَقْدَمُهُمْ سِلما (যে ব্যক্তি তাদের সকলের আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে)। বাহ্যত উভয় বর্ণনার মধ্যে বৈপরিত্য লক্ষ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে বৈপরিত্য নেই। কেননা প্রথম বর্ণনায় যে বয়সে বড় বলা হয়েছে, তা দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য ইসলাম গ্রহণের বয়স। অর্থাৎ যার ইসলাম গ্রহণের বয়স অন্যদের তুলনায় বেশি। তার মানে আগে ইসলাম গ্রহণ করা। বলার অপেক্ষা রাখে না, পরে ইসলাম গ্রহণকারীর তুলনায় আগে ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তির ইবাদত-বন্দেগী বেশি করার সুযোগ হয়েছে এবং সে অধিকতর পুণ্য সঞ্চয় করতে পেরেছে। তাই ইমামতের মর্যাদাদানেও তাকে অগ্রগণ্য মনে করা হবে।

উল্লেখ্য, বেশি বয়স হওয়াকে বাস্তবিক বয়োজ্যেষ্ঠতার অর্থেও ধরা যেতে পারে। যেমন এক রেওয়ায়েতে আছে فَإِنْ كانُوا في الهِجْرَةِ سَوَاءً، فَليَؤُمُّهم اكبرهم سِنّاً (যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে যে ব্যক্তি বয়সে তাদের মধ্যে বড়)। যার বয়স বেশি তার পুণ্যও বেশি হয়ে থাকবে, বিশেষত তিনি যদি আলেমও হন। এস্থলে আলেম হওয়ার শর্ত তো আছেই। এক হাদীছে আছে-

خِيَارُكُمْ أَطْوَلُكُمْ أَعْمَارًا، وَأَحْسَنُكُمْ أَعْمَالَا

‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ, যার বয়স বেশি এবং আমলও উৎকৃষ্ট।'১৯৩
এ অর্থ হিসেবেও উভয় বর্ণনার মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। কেননা বয়স্ক ব্যক্তি জন্মসূত্রে মুসলিম হলে সে অল্পবয়স্ক ব্যক্তি অপেক্ষা আগে ইসলাম গ্রহণকারীই তো হলো। অথবা বলা যায়, আগে ইসলাম গ্রহণ করা অগ্রাধিকার বিবেচনার একটি দিক, আর বয়স বেশি হওয়ার আরেকটি দিক। প্রথমটিতে সবাই সমান হলে দ্বিতীয়টির বিবেচনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

সামাজিক বিশেষ দু'টি শিষ্টাচার
অতঃপর হাদীছে দু'টি বিশেষ সামাজিক নীতির ব্যাপারে সচেতন করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে— وَلا يُؤمَّنَّ الرَّجُلُ الرَّجُلَ في سُلْطَانِهِ (কোনও ব্যক্তি যেন কিছুতেই অপর ব্যক্তির ক্ষমতাবলয়ে অনুমতি ছাড়া তার ইমামত না করে)। ইমাম নববী রহ. বলেন- سُلْطَانِهِ এর দ্বারা কারও কর্তৃত্বাধীন স্থান বোঝানো উদ্দেশ্য (যেমন শাসক, প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি প্রমুখের আওতাধীন অঞ্চল। এমনিভাবে ওই মসজিদ, যেখানে সুনির্দিষ্ট ইমাম আছে)। অথবা এমন স্থান, যা তার জন্য নির্দিষ্ট (যেমন নিজ বাড়ি বা অবস্থানস্থল)। এরূপ স্থানে অতিথি বা আগুন্তুক অপেক্ষা শাসক, ইমাম ও গৃহকর্তারই ইমামত করার অগ্রাধিকার থাকবে। এদিকে লক্ষ রাখা খুবই জরুরি। এটা লঙ্ঘন করার দ্বারা অন্যের অধিকার খর্ব করা হয় এবং তা পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আর দ্বিতীয় নীতিটি হলো- وَلا يَقْعُد في بيْتِهِ عَلَى تَكْرِمتِهِ إِلاَّ بِإِذْنِهِ (এবং তার বাড়িতে তার আসনে অনুমতি ছাড়া না বসে)। ইমাম নববী রহ. বলেন, تَكْرِمتِهِ এর অর্থ কারও ব্যক্তিগত বিছানা, চেয়ার বা এরকম কোনও স্থান। এটাও আদাবুল মু'আশারাত (সামাজিক শিষ্টাচার)-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। অনেক সময় এদিকে লক্ষ করা হয় না। অনুমতি ছাড়াই অন্যের আসনে ও অন্যের বিছানায় শোয়া-বসা করা হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি অসামাজিকতা ও গর্হিত কাজ। এতেও অন্যের অধিকার খর্ব করা হয়। এর দ্বারা অন্যের মনে বিরক্তি ও বিতৃষ্ণারও সঞ্চার হয়, যা পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতির পক্ষে ক্ষতিকর। কাজেই এর থেকে বিরত থাকা অতীব জরুরি।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছের ভেতর বহু মূল্যবান শিক্ষা আছে। তার মধ্যে বিশেষ কয়েকটি উল্লেখ করা গেল ।

ক. কুরআন-হাদীছের ইলম আল্লাহ তাআলার কাছে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। তাই প্রত্যেক মুসলিমের এ ইলম অর্জনে আগ্রহ থাকা চাই।

খ. ইমাম মনোনয়নে সুযোগ্য আলেমকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

গ. হিজরত অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ আমল। এ আমলকারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা একান্ত কর্তব্য।

ঘ. বয়স্ক ব্যক্তিদের সম্মান করা উচিত।

ঙ. অন্যের কর্তৃত্বধীন স্থানে ইমামতি করা বা অন্য কোনওরকম নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বমূলক আচরণ করা অনধিকার চর্চার শামিল। এর থেকে বিরত থাকা উচিত।

চ. অনুমতি ছাড়া অন্যের আসনে বসা বা অন্যের বিছানায় শোয়া একটি গর্হিত কাজ। এর থেকেও বিরত থাকা কর্তব্য।

১৯৩. সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৯৮১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭২১২; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৪৪২২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৫২৭
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)