প্রশ্নঃ ১০৩৭৭. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ,
আহলে হাদিস মানবো নাকি হানাফি মাযহাব মানবো?
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
ইতিমধ্যে এ বিষয়ে উত্তর দেয়া হয়েছে. যে বিষয়ে প্রশ্ন করতে চাচ্ছেন সেটা আগে সার্চ অপশনে খুঁজে দেখুন। উত্তরটি নিচে সংযুক্ত করা হল।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
রেফারেন্স উত্তর :
প্রশ্নঃ ৪১২০. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আসসালামু আলাইকুম শায়েখ,আমার এক ফেইসবুক ফ্রেন্ড আমার কাছে জানতে চায়,""আচ্ছা ইসলামে এত বিভাজন কেন,এত দল কেন? যেমন :আহলে হাদিস, হানাফি(৪মাযহাব) ইত্যাদি!""আর আহলে হাদীসদের কে সে হয়তো মোহাম্মদী নামে চিনে।সে কোন দলের এমনটা জানতে চাইলে সে বলে, "আমি মোহাম্মদী"এখন, (ইসলামে এত বিভাজন, এত ইসলামিক দল কেন?) তার এই প্রশ্নের জবাবে তাকে কি বলা উচিত সেটা জানালে অনেক ভালো হতো, অনুগ্রহপূর্বক।জাজাকাল্লাহ খাইরান
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেন:
وَفِی الۡاَرۡضِ اٰیٰتٌ لِّلۡمُوۡقِنِیۡنَ ۙ
(আয-যারিয়াত - ২০)
বিশ্বাসকারীদের জন্যে পৃথিবীতে নিদর্শনাবলী রয়েছে,
وَفِیۡۤ اَنۡفُسِکُمۡ ؕ اَفَلَا تُبۡصِرُوۡنَ
(আয-যারিয়াত - ২১)
এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও, তোমরা কি অনুধাবন করবে না?
পবিত্র কুরআনে কারীমের সূরা যারিয়াত এর ২০ ও ২১ নং আয়াতে ফিকির করলে আপনার এই প্রশ্নের জবাব মিলবে। পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই রয়েছে যাতে বহুত্বের মাঝে রয়েছে ঐক্যের সুর। মহাসড়কগুলোতে ৬-৮টি লেন থাকে। সবগুলো দিয়েই গাড়ি চলে। প্রতিটি লেনের ধাবমান গাড়ির গতি ভিন্ন হলেও সবগুলোর রুট নং থাকে একই।
উদাহরণস্বরূপ আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবেন। এর জন্য আপনার সম্মুখে রয়েছে নেকগুলো মাধ্যম। বিমান, ট্রেন, বাস, প্রাইভেট কার, বাইক অথবা হেঁটেও যেতে পারেন। পরিনাম সবগুলোর একই। যেকোন একটা মাধ্যম গ্রহণ করে আপনি চট্টগ্রামে গিয়ে পৌঁছতে পারবেন। গন্তব্য এক হলেও মাধ্যম হিসেবে নিতে পারেন যেকোন একটিকে।
পবিত্র কুরআনে কারীমে আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন :
وَالَّذِیۡنَ جَاہَدُوۡا فِیۡنَا لَنَہۡدِیَنَّہُمۡ سُبُلَنَا ؕ وَاِنَّ اللّٰہَ لَمَعَ الۡمُحۡسِنِیۡنَ ٪
(আল আনকাবুত - ৬৯)
যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। ( আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথগুলো দেখিয়ে দেব)। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন।
পবিত্র কুরআনে কারীমের এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা পথগুলো (বহুবচন শব্দ) ব্যবহার করেছেন। ইসলামের মধ্যে থেকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেন যেকোন একটি পথ বেয়ে।
পবিত্র কুরআনে কারীমের সূরা তাওবাহ এর ১০০নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
وَالسّٰبِقُوۡنَ الۡاَوَّلُوۡنَ مِنَ الۡمُہٰجِرِیۡنَ وَالۡاَنۡصَارِ وَالَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡہُمۡ بِاِحۡسَانٍ ۙ رَّضِیَ اللّٰہُ عَنۡہُمۡ وَرَضُوۡا عَنۡہُ وَاَعَدَّ لَہُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ تَحۡتَہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَاۤ اَبَدًا ؕ ذٰلِکَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ
(আত তাওবাহ্ - ১০০)
আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনছারদের মাঝে পুরাতন, এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কানন-কুঞ্জ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত প্রস্রবণসমূহ। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই হল মহান কৃতকার্যতা।
এ আয়াতে দুইটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১. সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে দুটি টি জামাআত ছিল।
ক. মুহাজির
খ. আনসার
এখানে কি আপনি প্রশ্ন করবেন যে, এক নবীর অনুসারী দুটি দল কেন?
২. আল্লাহ তা'আলা সকল সাহাবীদের অনুসারীদের জন্য জান্নাতের ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণার আলোকে যেকোন সাহাবীকে আপনি অনুসরণ করে সফলতা তথা জান্নাত পেয়ে যাবেন। সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবু যর গিফারী রদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু যেমন নিভৃত এবাদতে নিমগ্ন বুজুর্গ ছিলেন। বিপরীতে খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর মতো সাহসী বীর সেনানীও ছিলেন। আপনি যেকোনো একজনকে অনুসরণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত অর্জন করতে পারবেন।
আপনি যদি সাহাবায়ে কেরামের জীবনী অধ্যায়ন করে থাকেন তাহলে সেখানে অবশ্যই পেয়ে থাকবেন, সাহাবীদের সময় সকল সাহাবী কুরআনে কারীমের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। কিন্তু ফিক্বহের ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ কয়েকজন সাহাবীর অনুকরণ করে চলতেন। সাধারণ সাহাবীরা চার খলিফা (আবু বকর আল-সিদ্দিক, ওমর বিন আল-খাত্তাব, ওসমান ইবনে আফফান, আলী বিন আবি তালিব), ইবনে মাসউদ, যায়েদ বিন সাবিত, আবু মুসা আল-আশারী, মুয়ায বিন জাবাল, উবাই ইবনে কাআব, আবুদ্দারদা, এবং আয়েশা বিনতে আবী-বাক-আল-সিদ্দিক, ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ বিন উমর, আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর বিন আওয়াম, ও আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আল আস, ইনাদের অনুসরণ করে চলতেন। সাধারণত মাসআলা-মাসায়েলের ক্ষেত্রে যিনি যাকে অনুসরণ করতেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাকেই অনুসরণ করে চলতেন। অন্য ফক্বীহ সাহাবীর কাছ থেকে মাসআলা নিতেন না। এ ধরনের কয়েকটি ঘটনাও প্রসিদ্ধ রয়েছে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, আল্লাহ এক। কুরআন এক। অথচ কুরআনুল কারীম সাতটি হরফে নাযিল হয়েছে।
এক আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন নবীর উপরে একটি কুরআন নাজিল হলো। অথচ কুরআন সাত ভাবে নাযিল হলো। কিন্তু কেন?
এই প্রশ্নের যে উত্তর, ইসলামের মধ্যে চারটি মাযহাবের বিষয়ে একই উত্তর।
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ يُوسُفَ، أَخْبَرَنَا مَالِكٌ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ، عَنْ عُرْوَةَ بْنِ الزُّبَيْرِ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَبْدٍ الْقَارِيِّ، أَنَّهُ قَالَ سَمِعْتُ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ ـ رضى الله عنه ـ يَقُولُ سَمِعْتُ هِشَامَ بْنَ حَكِيمِ بْنِ حِزَامٍ، يَقْرَأُ سُورَةَ الْفُرْقَانِ عَلَى غَيْرِ مَا أَقْرَؤُهَا، وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَقْرَأَنِيهَا، وَكِدْتُ أَنْ أَعْجَلَ عَلَيْهِ، ثُمَّ أَمْهَلْتُهُ حَتَّى انْصَرَفَ، ثُمَّ لَبَّبْتُهُ بِرِدَائِهِ فَجِئْتُ بِهِ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقُلْتُ إِنِّي سَمِعْتُ هَذَا يَقْرَأُ عَلَى غَيْرِ مَا أَقْرَأْتَنِيهَا، فَقَالَ لِي " أَرْسِلْهُ ". ثُمَّ قَالَ لَهُ " اقْرَأْ ". فَقَرَأَ. قَالَ " هَكَذَا أُنْزِلَتْ ". ثُمَّ قَالَ لِي " اقْرَأْ ". فَقَرَأْتُ فَقَالَ " هَكَذَا أُنْزِلَتْ. إِنَّ الْقُرْآنَ أُنْزِلَ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ فَاقْرَءُوا مِنْهُ مَا تَيَسَّرَ ".
‘উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, আমি হিশাম ইবনু হাকীম ইবনু হিযামকে সূরা ফুরকান আমি যেভাবে পড়ি তা হতে ভিন্ন পড়তে শুনলাম। আর যেভাবে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে এ সূরা পড়িয়েছেন। আমি তাড়াতাড়ি তাকে বাধা দিতে চাচ্ছিলাম। কিন্তূ তার সালাত শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। এরপর তার গলায় চাদর পেঁচিয়ে তাকে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে নিয়ে এলাম এবং বললাম, আপনি আমাকে যা পড়তে শিখিয়েছেন, আমি তাকে তা হতে ভিন্ন পড়তে শুনেছি। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন তাকে ছেড়ে দিতে। তারপর তাকে পড়তে বললেন, সে পড়ল। তিনি [নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] বললেন, এরূপ নাযিল হয়েছে। এরপর আমাকে পড়তে বললেন, আমিও তখন পড়লাম। আর তিনি [নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] বললেন, এরূপই নাযিল হয়েছে। কুরআন সাত হরফে নাযিল হয়েছে। তাই যেরূপ সহজ হয় তোমরা সেরূপেই তা পড়।
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৪১৯
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
প্রশ্নঃ ৭১৮৭. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, ১. আচ্ছা আপনারা কি কোন মাজহাবের বিশ্বাস করেন? যেমন সুন্নী, শিয়া, হানাফী ইত্যাদি!! আমি কোনও মাজহাবে বিশ্বাস করি না। আমার কাছে কুরআন, হাদীস যথেষ্ট২. আমি যদি নামাজে প্রথম রাকাতে সূরা ইয়াসিন থেকে ৬ আয়াত পরের রাকাতে সূরা আদ দুহা থেকে ৬ আয়াত পড়লে নামাজ ঠিক হবে । দুই সূরা থেকে একটু একটু করে পড়লে৩. আমাকে কি নামাজের প্রতিটি হাদীস দেওয়া যায় যেমন নামাজে কতটুকু পা ফাঁকা রাখতে হবে, কতটুকু হাত উঠাতে হবে, হাত কিভাবে বাঁধতে হবে, সেজদা কিভাবে দিতে হবে। যেই কয়টা হাদীস আছে নামাজ শিক্ষার। কারণ মাঝে মাঝে মানুষকে ভূল ধরিয়ে দিলে তক বেঁধে যায়। তখন হাদীসগুলো রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যাবে
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
১. মাযহাব মানার অর্থ হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে কুরআন ও হাদীস মানা। মাযহাব নব্য কোন আবিষ্কৃত বিষয় নয়। বরং রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগেও তাকলীদ তথা মাযহাব ছিল। প্রত্যেক সাহাবায়ে কেরামই ছিলেন এক একজন মুজতাহিদ। রাসুলুল্লাহ (সা.)এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম মাসলা-মাসাইলসহ যে কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে রাসূল (সা.)এর কাছে যেতেন এবং সে ব্যাপারে রাসূলকে জিজ্ঞাসা করতেন। রাসূল (সা.) নিজেই হাদীসের মাধ্যমে সব কিছুর সমাধান দিতেন।
পৃথিবীতে যত মাযহাব আছে, সব ক’টি মাযহাবই সৃষ্টি হয়েছে কুরআন-সুন্নাহ থেকে। প্রসিদ্ধ মাযহাব চারটি। চারটি থেকে যে কোন একটি পুরোপুরিভাবেই মানতে হবে। চারটি মাযহাবের মধ্যে চারটিই বিশুদ্ধ। যে কোন একটি মানলেই মাযহাব মানা হয়ে যাবে। মাযহাব মানার মাঝেই রয়েছে সফলতা। না মানার মধ্যে রয়েছে পথভ্রষ্টতা।
মাযহাব পরিচিতিঃ মাযহাব শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পথ, মত, ধর্ম, বিশ্বাস ইত্যাদি। মাযহাব, ইজতিহাদ, তাকলীদ শব্দগুলো আমাদের সমাজে বহুল পরিচিত। বিশেষ করে মাযহাব শব্দটিই সর্বাধিক পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। ইজতিহাদ শব্দটি আরবী। অর্থ হল চেষ্টা করা, উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা।
পরিভাষায় ইজতেহাদ বলা হয়, যে সকল হুকুম-আহকাম কুরআন ও হাদীসের মধ্যে অস্পষ্ট রয়েছে। মুজতাহিদ স্বীয় মেধা ও গবেষণার মাধ্যমে সেগুলো আহরণ করবেন। আর সে আহরণকারীকে বলা হয় মুজতাহিদ বা গবেষক। আর মুজতাহিদদের মত ও পথকেই বলা হয় মাযহাব। মুজতাহিদ গবেষণার মাধ্যমে যা অর্জন করেছেন এবং সে অনুযায়ী আমল করেছেন, তাঁর সেই আমল অনুসরণ করার নামই হল মাযহাব। মাযহাব অনুসরণ কারার নাম হল তাকলীদ। আর যিনি অনুসরণ করেন তিনি হলেন মুকাল্লিদ। নিম্নে তাক্বলীদ সর্ম্পকে আলোকপাত করা হলো-
তাকলীদ পরিচিতিঃ তাক্বলীদের আভিধানিক অর্থ হল ইত্তেবা বা অনুসরণ। পারিভাষিক অর্থ হল, যিনি কুরআন ও হাদিস গবেষণা করে তা থেকে হুকুম-আহকাম গ্রহণ করতে অক্ষম, তার জন্য এমন ব্যক্তি থেকে হুকুম-আহকাম জেনে নেয়া যে ব্যক্তি এ বিষয়ে অধিক জ্ঞানী তথা পারঙ্গম। আর এ ব্যাপারে অধিক জ্ঞানী হলেন ফুক্বাহায়ে কেরাম তথা মুজতাহিদ। উদ্দেশ্য হল সেই ব্যক্তির কাছ থেকে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের হুকুম জেনে নিয়ে সঠিকভাবে দ্বীনের আনুগত্য করা তথা আমল করা। তবে বিষয়টি আবার এমনও নয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পরিবর্তে ঐ ব্যক্তিকে বিধানদাতা রূপে গ্রহণ করা। অতএব, তাক্বলীদ শিরক নয়, বরং ওয়াজিব একটি বিধান।
তাক্বলীদ হচ্ছে, ধর্মীয় অনুসরণের যোগ্য মুত্তাক্বী খাঁটি কোন বুযুর্গ তথা প্রসিদ্ধ মুজতাহিদগণের কথা ও কাজকে এই অবস্থার ভিত্তিতে গ্রহণ করা যে, তিনি কথা বা কাজ অবশ্যই কুরআন ও হাদিসের আলোকেই বলেছেন। সেই মুজতাহিদদের কথা মেনে নেয়া তথা সে অনুযায়ি আমল করাই হল তাকলীদ। (শরহে হুসামী)।
কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে তাকলীদঃ রাসূলের যুগেও তাক্বলীদ ছিল। সাহাবায়ে কেরাম রাসূলের কাছ থেকে তাকলীদ গ্রহণ করেছেন। তাঁরা একে অন্যের তাক্বলীদ করেছেন। সাহাবাদের তাক্বলীদ গ্রহণ করেছেন তাবেয়ীগণ। আর তাবেয়ীগণের তাক্বলীদ গ্রহণ করেছেন তবে-তাবেয়িগণ। বর্তমানেও আমরা তবে-তাবেঈগণের তাক্বলীদ অনুসরণ করছি। পবিত্র কুরআন-কারীমেও তাক্বলীদের কথা এসেছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধে যারা উলিল আমর তথা জ্ঞানী”। (সূরা নহল, আয়াত-৪৩)।
এ আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন ও রাসূল (সা.)এর আনুগত্যের সাথে উলিল আমর তথা জ্ঞানীদের আনুগত্য করার কথাও উল্লেখ করেছেন। ‘উলিল আমর’ শব্দটির দ্বারা কুরআন সুন্নাহর ইলমের অধিকারী, ফক্বিহ ও মুজতাহিদ ইমামগণকেই বুঝানো হয়েছে। রইসুল মুফাসিস্রীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.)সহ সকল মুফাস্সিরে কেরাম এ মতের স্বপক্ষে রয়েছেন।
মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, যদি তোমরা না জান, তবে যারা জানে, অর্থাৎ- জ্ঞানী তথা মুজতাহিদদের কাছে জিজ্ঞাসা কর। (সুরা নাহল, আয়াত- ৪৩ এবং সূরা আম্বিয়া- ৭)। এ আয়াত দ্বারা জানা গেল যে, শরীয়তের বিধি-বিধান জানে না এরূপ মুর্খ ব্যক্তিদের উপর আলেমগণের অনুসরণ করা ওয়াজিব। আর এই অনুসরণ করাকেই তাক্বলীদ বলে। (তাফসিরে কুরতবী)।
হাদীসে তাকলীদঃ হযরত হুযায়ফা (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, জানি না আর কত দিন আমি তোমাদের মাঝে থাকবো; তবে আমার পরে তোমরা হযরত আবু বকর (রাযি.) ও হযরত ওমর (রাযি.) এ দু’জনকে ইত্তেবা (অনুসরণ) করে যাবে। (তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ)।
সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে মাযহাব শব্দটির প্রচলন হলেও তাঁরা মুজতাহিদ সাহাবীদের কাছ তাক্বলীদ করতেন এমন অনেক প্রমাণ রয়েছে। (আহসানুল ফতওয়া- ১/৪১৫ পৃষ্ঠা)।
ইমাম দারেমী রচিত ‘সুনান’ কিতাবে বর্ণিত আছে যে, হযরত উমর (রাযি.) এ আইন জারী করেন, যে মাসয়ালায় রাসূলুলাহ (সা.)এর হাদীস পাওয়া যাবে না, সে ক্ষেত্রে হযরত আবু বকর (রাযি.)এর ফাতওয়ার ওপর আমল করতে হবে। যদি আবু বকর (রাযি.)এর ফাতওয়ায় না পাওয়া যায়, তাহলে আলেমদের পরামর্শের দ্বারা যে রায় গৃহীত হবে সে রায় কার্যকর করতে হবে। অথচ হযরত ওমর (রাযি.)ও ছিলেন একজন মুজতাহিদ এবং যাবতীয় গুণাবলীর পরিপূর্ণ অধিকারী। তা সত্ত্বেও জীবনভর আবু বকর (রাযি.)এর তাক্বলীদ করেছেন এবং তাঁর ফাতওয়া মোতাবেক রায় দিয়েছেন। উক্ত উদহারণ দ্বারা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সাহাবায়ে কেরাম ইজতিহাদী মাসয়ালা-মাসাইলের ক্ষেত্রে সমকালীন খলীফাদের মাযহাব মেনে চলতেন।
মাযহাবের সংখ্যাঃ সারা দুনিয়া জুড়ে প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের অনুসারীদের অস্তিত্বই বেশী পাওয়া যায়। মাযহাবের মধ্যে প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ মাযহাব হল চারটি। যথা-
১. ইমাম আবু হানিফা (রাহ.)এর মাযহাব। (মৃত্যু- ১৫০ হিজরী, বাগদাদ করাগারে)।
২. ইমাম মালিক (রাহ.)এর মালেকী মাযহাব। (মৃত্যু- ১৭৯ হিজরী, মদীনায়)।
৩. ইমাম শাফেয়ী (রাহ.)এর শাফেয়ী মাযহাব। (মৃত্যু- ২০৪ হিজরী, মিশরে)।
৪. ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রাহ.)এর হাম্বলী মাযহাব। (মৃত্যু- ২৪১ হিজরী, বাগদাদে)।
এই চার মাযহাবই উৎসারিত হয়েছে কুরআন সুন্নাহ থেকে। কুরআন এবং হাদীসের মধ্যে যে মাসআলা-মাসায়িলগুলো সরাসরি উল্লেখ নেই, সেই সমস্ত মাসআলা-মাসায়িলগুলোকে মূল উসূলের ওপর ভিত্তি করে কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে চুলচেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন মাযহাবের ইমাম তথা মুজতাহিদগণ। যেহেতু এই চারটি মাযহাব-ই কুরআন এবং হাদিস থেকে উৎপত্তি হয়েছে, তাই চরটিকেই সঠিক ও হক মনে করতে হবে। চার মাযহাবের যে কোন একটিকে অনুসরণ করলেই মাযহাব মানা হয়ে যাবে। চার মাযহাবকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অস্বীকার করা কুরআন এবং হাদিস অস্বীকারের-ই নামান্তর।
আমলের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি মাযহাবঃ আমলের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মাযহাবকে অনুসরণ করতে হবে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেভাবে আমরা কোন নির্দিষ্ট ডাক্তারের কাছে যাই এবং শুধু তার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ি তার দেয়া ঔষধ গ্রহণ করি, তেমনি রুহের চিকিৎসার জন্যও অনেক আলেমের মধ্য থেকে একজন আলেমকেই নির্বাচন করতে হবে। তাই মাযহাব মানার ক্ষেত্রে যার মাযহাবই অনুসরণ করবো, সর্বদা তাঁর মাযহাবই অনুসরণ করতে হবে। সাহবায়ে কেরাম রাসূল (সা.)এর ইন্তিকালের পরে ইজতিহাদী মাসয়ালার ক্ষেত্রে এক খলীফারই তাক্বলীদ করেছেন। হাকিমুল ইসলাম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহ.) বলেন, একাধিক মাযহাব মানলে বা মানার অনুমতি দিলে মানুষের ধর্ম পালন একটা খেলনার বস্তুতে পরিণত হয়ে যেত। কারণ, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সুবিধামত এক এক বিষয়ে এক এক মাযহাব অনুসরণ করবে।
যেমন- হানাফী মাযহাবের এক ব্যক্তি প্রচন্ড শীতের সময় ঠান্ড পানি দিয়ে ফজরের সময় ফজরের নামায পরার জন্য ওযু করে আসলো। নামায আদায়ের আগেই হঠাৎ তার শরীরের ক্ষত থেকে রক্ত বেরিয়ে গড়িয়ে পড়লো। এমতাবস্থায় আমাদের মাযহাব তথা ইমাম আবু হানিফা (রাহ.)এর মতে তার ওযু নষ্ট হয়ে যাবে। পুণরায় ওযু করে এসে নামায পড়তে হবে। তখন সেই ব্যক্তি বললো, আমি এখন ইমাম শাফেয়ী (রাহ.)এর মাযহাব অনুসরণ করবো। অতএব আর ওযুর দরকার নেই। কিছুক্ষণ পরে ব্যক্তিটি আবেগে কোন মহিলার শরীর স্পর্শ করলো। তাকে বলা হলো, এবার তো শাফেয়ী মাযহাব অনুযায়ীই আপনার ওযু ভেঙ্গে গেছে। তখন সেই ব্যক্তি জবাব দিলেন, এখন আমি আবার হানাফী মাযহাব অনুসরণ করবো। সুতরাং এখনও আমার জন্য নতুন ওযুর প্রয়োজন নেই।
এ ধরণের সুবিধাবাদি লোকদের দিক বিবেচনা করেই ফুক্বাহায়ে কেরাম যে কোন একটি মাযহাব অনুসরণ করা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। (তিরমিযি ও ইসলাহুর রুসুম-২১)।
এ প্রসঙ্গে আল্লামা শফি (রাহ.) বলেন, এটা প্রকৃতপক্ষে একটা শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা। এর উদ্দেশ্য দ্বীনি ক্ষেত্রে নিয়ম ঠিক রাখা এবং মানুষকে আত্মপ্রবৃত্তি থেকে বাঁচিয়ে রাখা।
ভিন্ন মাযহাব হওয়ার কারণঃ আসলে ইজতিহাদী মাসলা-মাসায়িল নিয়েই ভিন্ন ভিন্ন মাযহাবের সৃষ্টি হয়েছে। যে মাসআলা-মাসায়িলের ব্যাপারে সরাসরি কুরআন এবং হাদীসে দলীল প্রমাণ রয়েছে অথবা যে সব বিষয়ে সব ওলামাদের ইজমা তথা ঐকমত্য রয়েছে, সে সব বিষয়ে ইজতিহাদের কোন দরকার নেই। এ ক্ষেত্রে মাযহাবের কোন প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে সরাসরি আয়াত বা হাদিসেই বর্ণনা এসেছে।
হাদিস বিশারদ ও ইমামগণও মাযহাব অনুসরণ করেছেনঃ ইমাম বুখারী (রাহ.) শাফেয়ী মাযহাব অনুসরণ করেছেন। ইমাম মুসলিম (রাহ.) শাফেয়ী, ইমাম নাসাই (রাহ.) শাফেয়ী, ইমাম আবু দাউদ (রাহ.) হাম্বলী, পরে শাফেয়ী, মিশকাত প্রণেতা শাফেয়ী, ইমাম নববী (রাহ.) শাফেয়ী, ইমাম বগভী (রাহ.) শাফেয়ী, ইমাম ত্বাহাভী (রাহ.) হানাফী,শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহ.) হানাফী,ইবনে কাইয়্যিম, ইমাম আবদুল বার ও ইমাম বাত্বাল (রাহ.) মালেকী, ইমাম হালাবী ও ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (রাহ.) হানাফি মাযহাবী ছিলেন।
শেষ কথাঃ তাক্বলীদ তথা মাযহাব মানা ওয়াজিব। কাজেই কুরআন-হাদীস মানতে হলে মাযহাব মানতে হবে। মাযহাব মানা মানেই কুরআন মানা, হাদীস মানা। মাযহাব অস্বীকার করা মানেই কুরআন-হাদীস অস্বীকার করা। নব্য সালাফী ও লা-মাযহাবী ভাইদের বলবো, আপনারা মাযহাব নিয়ে সরলমনা মুসলমানদের ধোঁকা না দিয়ে নিজেরা মাযহাব মেনে চলার চেষ্টা করুন এবং অপর মুসলমানদেরকে মাযহাবের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বুঝিয়ে তাদেরকে মাযহাব মানার জন্য উৎসাহিত করুন। লা-মাযহাবী এবং নব্য সালাফীসহ রাহমানুর রাহীম আমাদের সবাইকে মাযহাব অনুসরণ করে চলার তাওফীক দান করুন। আমিন।
২. হবে।
৩. দেয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিআ মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া, মোহাম্মদপুর
প্রশ্নঃ ৬৮১২. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, মাজহাব মানা জরুরি কি ? ইসলামী বিধান মতে সঠিক পথ কোনটি আহলে সুন্নাহ না কী আহলে হাদীস?
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
السلام عليكم ورحمة الله وبركاته
আপনি আমাদের এই অ্যাপে কিতাব সেকশনে গিয়ে
"মাযহাব কি ও কেন"
লেখক: মুফতি মুহাম্মদ তাকী উসমানী।
"মাযহাব ও তাকলীদ"
লেখক মুফতি মনসুরুল হক
এদুটি কিতাব ডাউনলোড করে পড়ে নিন। এরপর কোনো বিষয়ে সংশয় থাকলে পরবর্তীতে প্রশ্ন করুন।
এছাড়া নিচে আরেকটি প্রশ্ন উত্তর সংযুক্ত করে দেয়া হলো। এটিও পড়তে পারেন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিআ মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া, মোহাম্মদপুর
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন