আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
১২- দুই ঈদের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৯৬৯
৬১২. তাশরীকের দিনগুলোতে আমলের ফযীলত।
ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, وَاذْكُرُوا اللَّهَ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ দ্বারা (যিলহজ্জ মাসের) দশ দিন বুঝায় এবং وَالأَيَّامُ الْمَعْدُودَاتُ দ্বারা আইয়ামুত তাশরীক বুঝায়।
ইবনে উমর ও আবু হুরায়রা (রাযিঃ) এই দশদিন তাকবীর বলতে বলতে বাজারের দিকে যেতেন এবং তাদের তাকবীরের সঙ্গে অন্যরাও তাকবীর বলত।
মুহাম্মাদ ইবনে আলী (রাহঃ) নফল নামাযের পরেও তাকবীর বলতেন।*
* এ তাঁর নিজস্ব মত। অন্যান্য ইমামগণের মতে শুধু ফরয সালাতের পরেই তাকবীর বলতে হয়।
ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, وَاذْكُرُوا اللَّهَ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ দ্বারা (যিলহজ্জ মাসের) দশ দিন বুঝায় এবং وَالأَيَّامُ الْمَعْدُودَاتُ দ্বারা আইয়ামুত তাশরীক বুঝায়।
ইবনে উমর ও আবু হুরায়রা (রাযিঃ) এই দশদিন তাকবীর বলতে বলতে বাজারের দিকে যেতেন এবং তাদের তাকবীরের সঙ্গে অন্যরাও তাকবীর বলত।
মুহাম্মাদ ইবনে আলী (রাহঃ) নফল নামাযের পরেও তাকবীর বলতেন।*
* এ তাঁর নিজস্ব মত। অন্যান্য ইমামগণের মতে শুধু ফরয সালাতের পরেই তাকবীর বলতে হয়।
৯১৮। মুহাম্মাদ ইবনে আরআরা (রাহঃ) ......... ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশদিনের আমল, অন্যান্য দিনের আমলের তুলনায় উত্তম। তারা জিজ্ঞাসা করলেন, জিহাদও কি (উত্তম) নয় ? নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা স্বতন্ত্র, যে নিজের জান ও মালের ঝুঁকি নিয়েও জিহাদ করে এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না ।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
কুরআন-সুন্নাহে আশরায়ে যিলহজ্বের এই আলাদা গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্যের দরুণ এ দশটি দিন হল অর্জনের ভরপুর মৌসুম। এই দিনগুলোতে করা ইবাদত-বন্দেগী আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয়।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত এই হাদীস দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়, আশরায়ে যিলহজ্বের যে কোনো নেক আমলের চাইতে উত্তম কোনো আমল হতে পারে না। যেহেতু সাহাবায়ে কেরাম জানতেন যে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের চেয়ে উত্তম কোনো আমল নেই তাই আশরায়ে যিলহজ্বের আমলের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা শোনার পর তারা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘জিহাদও কি এই দশ দিনের আমলের চেয়ে উত্তম নয়?’ নবীজী জবাব দিলেন, না। জিহাদও উত্তম নয়। তবে হ্যাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদ এই দশদিনের আমলের চেয়ে উত্তম হতে পারে যে স্বীয় জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস-ায় জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হল। অতঃপর জিহাদের ময়দানে জান-মাল সবকিছু বিসর্জন করে দিয়ে কিছু নিয়েই ঘরে ফিরে এল না।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৯৬৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৪৩৮; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৫৮; ফাতহুল বারী ২/৫৩১-৫৩২
এর দ্বারা স্পষ্ট বোঝা গেল যে, এই দশ দিনে করা যে কোনো নেক আমল সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোত্তম আমল। পুণ্য অর্জনের এর চেয়ে উপযোগী সময় আর কী হতে পারে? এখন প্রশ্ন হল, মুমিনরা কী কী আমল দ্বারা এই দশ দিনকে জীবন- ও প্রণবন- করে তুলতে পারে?
আশরায়ে যিলহজ্বের আমল
আমরা আগেই বলেছি এবং হাদীসের দ্বারা বুঝা যায় যে, এই দশ দিনের যে কোনো আমল চাই নফল নামায-রোযা হোক বা যিকির-তাহাজ্জুদ, তা আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয় ও অতি পছন্দনীয়। তাই যে কোনো নফল ইবাদত যেমন নামায-রোযা, যিকির-তাহাজ্জুদ, দান-খয়রাত ইত্যাদি এই দশ দিনে করা হলে তার ফযীলত ও মর্যাাদা বছরের অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যাবে। তাই এই ক’দিন সাধ্যমতো নফল ইবাদতের প্রতিও মনোযোগী হওয়া উচিত। এছাড়া বিভিন্ন হাদীসে এই দশ দিনের বিশেষ কিছু আমলের কথাও বলা হয়েছে। যেমন-
ক) যিলহজ্বের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করার আগ পর্যন্ত- স্বীয় নখ ও চুল না কাটা। এটি মুস্তাহাব।
হযরত উম্মে সালমা রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা যদি যিলহজ্বের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ যদি কুরবানী করার ইচ্ছা করে থাকে তবে সে যেন স্বীয় চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৯৭৭; মুসনাদে আহমদ ৬/২৮৯
আল্লাহ তাআলা এই দিনগুলোতে হজ্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও মহিমান্বিত একটি ইবাদত মুসলমানের উপর ফরয করেছেন। সামর্থ্যবান ‘আশিকে রব’ এই দিনে ইহরামের শুভ্র লেবাস পরিধান করে যখন বাইতুল্লাহ অভিমুখী হয় তখন তার উপর বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়। তন্মধ্যে চুল ও নখ কাটতে না পারাও একটি। কিন' বাইতুল্লাহর যিয়ারতের সৌভাগ্য যারা অর্জন করতে পারেনি, পারেনি কাবার কালো গিলাফের ছায়ার কাছে যেতে, পৃথিবীর দূর-দূরানে- ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব ‘অভাগা’ মুমিনদের প্রতিও আল্লাহর রহমত ও মেহেরবানীকে আকৃষ্ট করতে আদেশ করা হয়েছে যে, তোমরা ‘ভাগ্যবান’ হাজ্বীদের সাদৃশ্য অবলম্বন কর। তোমরাও নখ-চুল কেটো না। আল্লাহর রহমতের বারিধারা তোমাদেরও স্নাত করে তুলতে পারে।-ইসলাহী খুতবাত ২/১২৪-১২৫
খ) আশরায়ে যিলহজ্বের দ্বিতীয় বিশেষ আমলটি হল, ঈদুল আযহার দিন ব্যতীত প্রথম নয় দিন রোযা রাখা। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিনগুলোতে রোযা রাখতেন।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৪৩৭; মুসনাদে আহমদ ৬/২৮৭, হাদীস : ২৫৯২০; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ২৪১৬; মাআরিফুস সুনান ৫/৪১-৪৪
অন্য দুটি যয়ীফ বর্ণনায় এসেছে যে, এই দিনগুলোর একেকটি রোযায় রয়েছে এক বছরের রোযার সমান ছওয়াব।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৫৮; বায়হাকী-শুআবুল ঈমান ৩/৩৫৬ হাদীস : ৩৭৫৮; তারগীব হাদীস : ১৭৩১; আত তা’রীফ ৫/৫১৫-৫১৭ হাদীস : ৮৩৫
গ) এই নয়দিনের রোযার মধ্যে নবম তারিখ বা আরাফার দিনের রোযা সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ। অতএব পুরো নয়টি রোযা রাখতে না পারলে এই একটি রোযা থেকে কারো বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়। সহীহ হাদীসে হযরত আবু কাতাদা রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আরাফার দিন অর্থাৎ নবম তারিখের রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ মিটিয়ে দেবেন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৬২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৪৯
তবে মনে রাখা উচিত, অনেক ওলামায়ে কেরামের মতে হাজীদের জন্য এই দিনে আরাফার ময়দানে ওকূফ ও মুজাহাদার শক্তি অর্জনের নিমিত্তে রোযা না রাখা উত্তম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীন হজ্বের মধ্যে এই দিনের রোযা রাখতেন না।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১২৩, ১১২৪; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৫০-৭৫১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৪১৯; মাআরিফুস সুনান ৫/৪৩০-৪৩১
যিকর ও তাকবীর প্রসঙ্গ
আশরায়ে যিলহজ্বের পরবর্তী তিন দিন অর্থাৎ এগার, বার ও তের তারিখকে পরিভাষায় ‘আইয়ামে তাশরীক’ বলে। আশরায়ে যিলহজ্বের দশ দিন ও আইয়ামে তাশরীকের তিনদিন সর্বমোট যিলহজ্বের এই প্রথম তের দিনের একটি আমল রয়েছে। তা হচ্ছে বেশি বেশি আল্লাহর যিকির ও তাকবীর পাঠ। আল্লাহ তাআলার যিকির এবং তাওহীদের চেতনায় সর্বদা উজ্জীবিত থাকা এবং শিরকের পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত তাওহীদের শিক্ষায় উদ্ভাসিত ঈমানী যিন্দেগী গঠনের লক্ষ্যে সম্ভব সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করা প্রত্যেক মুমিনের সার্বক্ষণিক কর্তব্য। কারণ দ্বীন-ধর্ম ও আমল আখলাক সবকিছুর মূল হল, নির্ভেজাল তাওহীদ। আল্লাহর একত্ব ও মহত্বের উপর সকল মুমিনের বিশ্বাস হতে হবে সুদৃঢ় ও মজবুত। এই বিশ্বাসে খুঁত থাকলে পর্বতসম আমলেরও কোনো মূল্য নেই। তাইতো মুমিনের দিলে তাওহীদের শিক্ষাকে আরো মজবুত আরো শাণিত করতেই এই দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকির করতে বারবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিশ্বাসের সবটুকু মিশিয়ে মুমিন বলবে আল্লাহু আকবার, ওয়াহদাকা লা-শারীকা লাকা।
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন- (তরজমা) তোমরা কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহকে (বেশি বেশি) স্মরণ কর।-সূরা বাকারা : ২০৩
অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন- (তরজমা) ‘যাতে তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে।’-সূরা হজ্ব : ২৮
এই আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলির দ্বারা প্রায় সকলের মতে আশরায়ে যিলহজ্ব ও আইয়ামে তাশরীকের এই তেরটি দিনই উদ্দেশ্য। বিশেষ করে এই দিনগুলোতে আল্লাহর যিকিরের প্রতি আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ সম্পর্কে আল্লামা খাত্তাবী রাহ. বলেন, জাহেলী যুগের লোকেরা যুগ যুগ ধরে তাদের কথিত প্রভুদের নামে পশু-প্রাণী উৎসর্গ করত। এর প্রতি উত্তরে মুমিনদের প্রতি আদেশ করা হয়েছে তারা যেন আল্লাহর যিকির ও তাকবীরের মাধ্যমে তাওহীদ ও আনুগত্যের ঘোষণা দান করে। আল্লাহই একমাত্র ইলাহ। তাঁর কোনো শরীক নেই। তিনি ছাড়া কারো নামে প্রাণী উৎসর্গ করা যাবে না। কারণ তা সুস্পষ্ট শিরক।-ফাতহুল বারী ২/৫৩৫
সাহাবায়ে কেরাম এই দিনগুলোতে সর্বদা আল্লাহু আকবারের ধ্বনি তুলতেন। হযরত ইবনে উমর রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বাজারে গিয়ে তাকবীরের আওয়াজ তুলতেন। শুনে শুনে লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীরের সুর তুলত। ইবনে ওমর রা. পথে-ঘাটে, হাঁটা-বসায়, বাজারে-ঘরে এবং নামাযের পরে শুধুই তাকবীর বলতে থাকতেন। মিনার দিনগুলোতো তার তাকবীরের সাথে সমস্বরে মানুষের তাকবীরে মিনার পুরো অঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠত। মহিলারাও (নিচু স্বরে) তাকবীর বলতে থাকতেন।-বুখারী-ফাতহুল বারী ২/৫৩০-৫৩৬
সার্বক্ষণিক যিকির ও তাকবীরের আমল ছাড়াও এই তের দিনের প্রায় প্রতিটি ইবাদত ও আমলের সাথে যিকির ও তাকবীরকে এমনভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যেন সব আমল-ইবাদতের মূল কথা হল যিকরুল্লাহ, তাকবীর ও তাওহীদ। বাস-বেও তাই। এজন্য সকল ইবাদতের পরতে পরতে রয়েছে তাওহীদে খালেসের উপসি'তি। তবে যে কোনো ধরনের যিকির এই সময়গুলোর সার্বক্ষণিক ওযীফা হলেও ক্ষেত্র বিশেষে এর ধরন ও নিয়ম রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন। যেমন-
১। হাজীরা হজ্বের ইহরাম বাঁধার সময় হতে সার্বক্ষণিক জপবেন তালবিয়া ধ্বনি-লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারীকা লাকা লাব্বাইক ...।
২। আশরায়ে যিলহজ্বের শুরু হতে বেশি বেশি যিকিরের যে আদেশ কুরআনে এসেছে এ ব্যাপারে হযরত ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর নিকট আমলের দিক থেকে আশরায়ে যিলহজ্ব হতে শ্রেষ্ঠ ও অধিক প্রিয় কোনো দিন নেই। অতএব তোমরা এতে তাহলীল, তাকবীর, তাহমীদ ও তাসবীহ বেশি বেশি করো।-মুসনাদে আহমদ ২/৭৫ হাদীস : ৫৪৪৬; তাবারানী মুজামে কাবীর, হাদীস : ১১১১৬
তাসবীহ, তাহমীদ, তাহলীল ও তাকবীর এক সাথে আদায় করতে বলা যায়-সুবহানাল্লাহ, ওয়াল হামদুলিল্লাহ, ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ এই দিনগুলোতে এ ওযীফা বেশি বেশি জপা যায়।
৩। কুরবানীর পশু জবাইয়ের সময়ও বলতে হবে : বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার।
৪। হাজীরা জামরায় কংকর নিক্ষেপের সময় দরাজ কণ্ঠে বলবেন : আল্লাহু আকবার।
৫। এই দিনগুলোর মধ্যে আরেকটি অবশ্য করণীয় আমল হল, তাকবীরে তাশরীকের আমল।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত এই হাদীস দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়, আশরায়ে যিলহজ্বের যে কোনো নেক আমলের চাইতে উত্তম কোনো আমল হতে পারে না। যেহেতু সাহাবায়ে কেরাম জানতেন যে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের চেয়ে উত্তম কোনো আমল নেই তাই আশরায়ে যিলহজ্বের আমলের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা শোনার পর তারা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘জিহাদও কি এই দশ দিনের আমলের চেয়ে উত্তম নয়?’ নবীজী জবাব দিলেন, না। জিহাদও উত্তম নয়। তবে হ্যাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদ এই দশদিনের আমলের চেয়ে উত্তম হতে পারে যে স্বীয় জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস-ায় জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হল। অতঃপর জিহাদের ময়দানে জান-মাল সবকিছু বিসর্জন করে দিয়ে কিছু নিয়েই ঘরে ফিরে এল না।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৯৬৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৪৩৮; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৫৮; ফাতহুল বারী ২/৫৩১-৫৩২
এর দ্বারা স্পষ্ট বোঝা গেল যে, এই দশ দিনে করা যে কোনো নেক আমল সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোত্তম আমল। পুণ্য অর্জনের এর চেয়ে উপযোগী সময় আর কী হতে পারে? এখন প্রশ্ন হল, মুমিনরা কী কী আমল দ্বারা এই দশ দিনকে জীবন- ও প্রণবন- করে তুলতে পারে?
আশরায়ে যিলহজ্বের আমল
আমরা আগেই বলেছি এবং হাদীসের দ্বারা বুঝা যায় যে, এই দশ দিনের যে কোনো আমল চাই নফল নামায-রোযা হোক বা যিকির-তাহাজ্জুদ, তা আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয় ও অতি পছন্দনীয়। তাই যে কোনো নফল ইবাদত যেমন নামায-রোযা, যিকির-তাহাজ্জুদ, দান-খয়রাত ইত্যাদি এই দশ দিনে করা হলে তার ফযীলত ও মর্যাাদা বছরের অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যাবে। তাই এই ক’দিন সাধ্যমতো নফল ইবাদতের প্রতিও মনোযোগী হওয়া উচিত। এছাড়া বিভিন্ন হাদীসে এই দশ দিনের বিশেষ কিছু আমলের কথাও বলা হয়েছে। যেমন-
ক) যিলহজ্বের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করার আগ পর্যন্ত- স্বীয় নখ ও চুল না কাটা। এটি মুস্তাহাব।
হযরত উম্মে সালমা রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা যদি যিলহজ্বের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ যদি কুরবানী করার ইচ্ছা করে থাকে তবে সে যেন স্বীয় চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৯৭৭; মুসনাদে আহমদ ৬/২৮৯
আল্লাহ তাআলা এই দিনগুলোতে হজ্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও মহিমান্বিত একটি ইবাদত মুসলমানের উপর ফরয করেছেন। সামর্থ্যবান ‘আশিকে রব’ এই দিনে ইহরামের শুভ্র লেবাস পরিধান করে যখন বাইতুল্লাহ অভিমুখী হয় তখন তার উপর বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়। তন্মধ্যে চুল ও নখ কাটতে না পারাও একটি। কিন' বাইতুল্লাহর যিয়ারতের সৌভাগ্য যারা অর্জন করতে পারেনি, পারেনি কাবার কালো গিলাফের ছায়ার কাছে যেতে, পৃথিবীর দূর-দূরানে- ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব ‘অভাগা’ মুমিনদের প্রতিও আল্লাহর রহমত ও মেহেরবানীকে আকৃষ্ট করতে আদেশ করা হয়েছে যে, তোমরা ‘ভাগ্যবান’ হাজ্বীদের সাদৃশ্য অবলম্বন কর। তোমরাও নখ-চুল কেটো না। আল্লাহর রহমতের বারিধারা তোমাদেরও স্নাত করে তুলতে পারে।-ইসলাহী খুতবাত ২/১২৪-১২৫
খ) আশরায়ে যিলহজ্বের দ্বিতীয় বিশেষ আমলটি হল, ঈদুল আযহার দিন ব্যতীত প্রথম নয় দিন রোযা রাখা। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিনগুলোতে রোযা রাখতেন।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৪৩৭; মুসনাদে আহমদ ৬/২৮৭, হাদীস : ২৫৯২০; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ২৪১৬; মাআরিফুস সুনান ৫/৪১-৪৪
অন্য দুটি যয়ীফ বর্ণনায় এসেছে যে, এই দিনগুলোর একেকটি রোযায় রয়েছে এক বছরের রোযার সমান ছওয়াব।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৫৮; বায়হাকী-শুআবুল ঈমান ৩/৩৫৬ হাদীস : ৩৭৫৮; তারগীব হাদীস : ১৭৩১; আত তা’রীফ ৫/৫১৫-৫১৭ হাদীস : ৮৩৫
গ) এই নয়দিনের রোযার মধ্যে নবম তারিখ বা আরাফার দিনের রোযা সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ। অতএব পুরো নয়টি রোযা রাখতে না পারলে এই একটি রোযা থেকে কারো বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়। সহীহ হাদীসে হযরত আবু কাতাদা রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আরাফার দিন অর্থাৎ নবম তারিখের রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ মিটিয়ে দেবেন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৬২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৪৯
তবে মনে রাখা উচিত, অনেক ওলামায়ে কেরামের মতে হাজীদের জন্য এই দিনে আরাফার ময়দানে ওকূফ ও মুজাহাদার শক্তি অর্জনের নিমিত্তে রোযা না রাখা উত্তম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীন হজ্বের মধ্যে এই দিনের রোযা রাখতেন না।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১২৩, ১১২৪; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৫০-৭৫১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৪১৯; মাআরিফুস সুনান ৫/৪৩০-৪৩১
যিকর ও তাকবীর প্রসঙ্গ
আশরায়ে যিলহজ্বের পরবর্তী তিন দিন অর্থাৎ এগার, বার ও তের তারিখকে পরিভাষায় ‘আইয়ামে তাশরীক’ বলে। আশরায়ে যিলহজ্বের দশ দিন ও আইয়ামে তাশরীকের তিনদিন সর্বমোট যিলহজ্বের এই প্রথম তের দিনের একটি আমল রয়েছে। তা হচ্ছে বেশি বেশি আল্লাহর যিকির ও তাকবীর পাঠ। আল্লাহ তাআলার যিকির এবং তাওহীদের চেতনায় সর্বদা উজ্জীবিত থাকা এবং শিরকের পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত তাওহীদের শিক্ষায় উদ্ভাসিত ঈমানী যিন্দেগী গঠনের লক্ষ্যে সম্ভব সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করা প্রত্যেক মুমিনের সার্বক্ষণিক কর্তব্য। কারণ দ্বীন-ধর্ম ও আমল আখলাক সবকিছুর মূল হল, নির্ভেজাল তাওহীদ। আল্লাহর একত্ব ও মহত্বের উপর সকল মুমিনের বিশ্বাস হতে হবে সুদৃঢ় ও মজবুত। এই বিশ্বাসে খুঁত থাকলে পর্বতসম আমলেরও কোনো মূল্য নেই। তাইতো মুমিনের দিলে তাওহীদের শিক্ষাকে আরো মজবুত আরো শাণিত করতেই এই দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকির করতে বারবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিশ্বাসের সবটুকু মিশিয়ে মুমিন বলবে আল্লাহু আকবার, ওয়াহদাকা লা-শারীকা লাকা।
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন- (তরজমা) তোমরা কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহকে (বেশি বেশি) স্মরণ কর।-সূরা বাকারা : ২০৩
অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন- (তরজমা) ‘যাতে তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে।’-সূরা হজ্ব : ২৮
এই আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলির দ্বারা প্রায় সকলের মতে আশরায়ে যিলহজ্ব ও আইয়ামে তাশরীকের এই তেরটি দিনই উদ্দেশ্য। বিশেষ করে এই দিনগুলোতে আল্লাহর যিকিরের প্রতি আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ সম্পর্কে আল্লামা খাত্তাবী রাহ. বলেন, জাহেলী যুগের লোকেরা যুগ যুগ ধরে তাদের কথিত প্রভুদের নামে পশু-প্রাণী উৎসর্গ করত। এর প্রতি উত্তরে মুমিনদের প্রতি আদেশ করা হয়েছে তারা যেন আল্লাহর যিকির ও তাকবীরের মাধ্যমে তাওহীদ ও আনুগত্যের ঘোষণা দান করে। আল্লাহই একমাত্র ইলাহ। তাঁর কোনো শরীক নেই। তিনি ছাড়া কারো নামে প্রাণী উৎসর্গ করা যাবে না। কারণ তা সুস্পষ্ট শিরক।-ফাতহুল বারী ২/৫৩৫
সাহাবায়ে কেরাম এই দিনগুলোতে সর্বদা আল্লাহু আকবারের ধ্বনি তুলতেন। হযরত ইবনে উমর রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বাজারে গিয়ে তাকবীরের আওয়াজ তুলতেন। শুনে শুনে লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীরের সুর তুলত। ইবনে ওমর রা. পথে-ঘাটে, হাঁটা-বসায়, বাজারে-ঘরে এবং নামাযের পরে শুধুই তাকবীর বলতে থাকতেন। মিনার দিনগুলোতো তার তাকবীরের সাথে সমস্বরে মানুষের তাকবীরে মিনার পুরো অঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠত। মহিলারাও (নিচু স্বরে) তাকবীর বলতে থাকতেন।-বুখারী-ফাতহুল বারী ২/৫৩০-৫৩৬
সার্বক্ষণিক যিকির ও তাকবীরের আমল ছাড়াও এই তের দিনের প্রায় প্রতিটি ইবাদত ও আমলের সাথে যিকির ও তাকবীরকে এমনভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যেন সব আমল-ইবাদতের মূল কথা হল যিকরুল্লাহ, তাকবীর ও তাওহীদ। বাস-বেও তাই। এজন্য সকল ইবাদতের পরতে পরতে রয়েছে তাওহীদে খালেসের উপসি'তি। তবে যে কোনো ধরনের যিকির এই সময়গুলোর সার্বক্ষণিক ওযীফা হলেও ক্ষেত্র বিশেষে এর ধরন ও নিয়ম রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন। যেমন-
১। হাজীরা হজ্বের ইহরাম বাঁধার সময় হতে সার্বক্ষণিক জপবেন তালবিয়া ধ্বনি-লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারীকা লাকা লাব্বাইক ...।
২। আশরায়ে যিলহজ্বের শুরু হতে বেশি বেশি যিকিরের যে আদেশ কুরআনে এসেছে এ ব্যাপারে হযরত ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর নিকট আমলের দিক থেকে আশরায়ে যিলহজ্ব হতে শ্রেষ্ঠ ও অধিক প্রিয় কোনো দিন নেই। অতএব তোমরা এতে তাহলীল, তাকবীর, তাহমীদ ও তাসবীহ বেশি বেশি করো।-মুসনাদে আহমদ ২/৭৫ হাদীস : ৫৪৪৬; তাবারানী মুজামে কাবীর, হাদীস : ১১১১৬
তাসবীহ, তাহমীদ, তাহলীল ও তাকবীর এক সাথে আদায় করতে বলা যায়-সুবহানাল্লাহ, ওয়াল হামদুলিল্লাহ, ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ এই দিনগুলোতে এ ওযীফা বেশি বেশি জপা যায়।
৩। কুরবানীর পশু জবাইয়ের সময়ও বলতে হবে : বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার।
৪। হাজীরা জামরায় কংকর নিক্ষেপের সময় দরাজ কণ্ঠে বলবেন : আল্লাহু আকবার।
৫। এই দিনগুলোর মধ্যে আরেকটি অবশ্য করণীয় আমল হল, তাকবীরে তাশরীকের আমল।
