আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৯- আযান-ইকামতের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৭০৪
৪৫৫. ইমাম নামায দীর্ঘায়িত করলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা।
আবু উসাইদ (র.) তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, বেটা! তুমি আমাদের নামায দীর্ঘায়িত করে ফেলেছ।
৬৬৯। মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ (রাহঃ) ......... আবু মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক সাহাবী এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অমুক ব্যক্তির জন্য আমি ফজরের নামাযে অনুপস্থিত থাকি। কেননা, তিনি আমাদের নামায খুব দীর্ঘায়িত করেন। এ শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাগান্বিত হলেন। আবু মাসউদ (রাযিঃ) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)কে নসীহত করতে গিয়ে সেদিনের ন্যায় এত বেশী রাগান্বিত আর কোন দিন দেখিনি। তারপর তিনি বললেনঃ হে লোকেরা! তোমাদের মাঝে বিতৃষ্ণা সৃষ্টিকারী রয়েছে। তোমাদের মধ্যে যে কেউ লোকদের ইমামতি করে, সে যেন সংক্ষেপ করে। কেননা, তার পিছনে দুর্বল, বৃদ্ধ ও হাজতমন্দ রয়েছে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে ইমামের প্রতি নামায সংক্ষেপ করতে আদেশ করা হয়েছে। এর কারণ বলা হয়েছে- মুসল্লীদের মধ্যে শিশু, দুর্বল ও অসুস্থ লোকও থাকে। দীর্ঘ নামায পড়লে তাদের কষ্ট হবে। ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা মানুষকে কষ্ট দেওয়া শরীআতের উদ্দেশ্য নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ- يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ “আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই চান, তোমাদের জন্য কঠিনতা চান না।
প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্বলদের দিকে লক্ষ করে নামায কী পরিমাণ সংক্ষেপ করা হবে? এর মাপকাঠি কী? অনেক জায়গায় লক্ষ করা যায় ছোট ছোট সূরা দিয়ে ফজরের নামায পড়া হচ্ছে। যোহরের নামায তো অধিকাংশ জায়গায়ই অতি সংক্ষেপে পড়া হয়। রমযান মাসে কোনও কোনও মসজিদে ফজরের নামাযে এমনকি মাগরিবের কিরাআতও পড়া হয়। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলা হয় জামাতে অনেক অসুস্থ লোক থাকে, যোহরের নামাযের সময় মানুষের অনেক ব্যস্ততা থাকে, তখন অফিস-আদাল থাকে, রমযানে মানুষ অনেক ক্লান্ত থাকে ইত্যাদি। এসব যুক্তিতে যেমন কিরাআত ছোট করা হয়, তেমনি রুকূ-সিজদায়ও তাড়াহুড়া করা হয়। দুরূদ শরীফ পড়ে শেষ করা যায় না, তার আগেই সালাম ফেরানো হয়। এটাই কি সংক্ষেপ করার অর্থ?
প্রকৃতপক্ষে সংক্ষেপ করার দ্বারা তাড়াহুড়া করে নামায শেষ করার হুকুম দেওয়া হয়নি। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংক্ষেপ করা বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন সেজন্য আমাদেরকে তাঁর নামাযের দিকে লক্ষ করতে হবে। তিনি নিজের ইমাম ছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর ইমামতিতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতেন। তাঁদের মধ্যেও অসুস্থ, দুর্বল, শিশু ও কর্মব্যস্ত লোক ছিলেন, যাদের প্রতি লক্ষ করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমামদেরকে নামায সংক্ষে করার হুকুম দিয়েছেন। বলাবাহুল্য, এদের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজেও নামায সংক্ষেপ করতেন বৈকি। এটা নবীগণের বৈশিষ্ট্য যে, তাঁরা মানুষকে যে হুকুম করে থাকেন। নিজেরাও তা পালন করেন। সুতরাং তিনি নিজেও নিশ্চয়ই দুর্বলদের দিকে লক্ষ করে নামায সংক্ষেপ করতেন। হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছেঃ- كان رسول اللہ ﷺ من أخف الناس صلاة في تمام “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন পরিপূর্ণতার সাথে সর্বাপেক্ষ সংক্ষিপ্ত সালাত আদায়কারী।
তা কী রকম সংক্ষিপ্ত সালাত তিনি আদায় করতেন? বিভিন্ন রেওয়ায়েত দ্বারা জান যায় তিনি ফজর ও যোহরে তিওয়ালে মুফাস্সাল', আসর ও ইশায় 'আওসাতে মুফাস্‌স্সাল' এবং মাগরিবে 'কিসারে মুফাস্সাল' পড়তেন। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে যে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ নামায অমুক ছাড়া আর কারও পেছনে পড়িনি। বর্ণনাটির শেষে আছেঃ- ويقرأ في المغرب بقصار المفصل، ويقرأ في العشاء بوسط المفصل، ويقرأ في الصبح بطوال المفصل 'তিনি মাগরিবে কিসারে মুফাস্সাল, ইশায় আওসাতে মুফাস্সাল এবং ফজরে তিওয়ালে মুফাস্সাল পড়তেন।
প্রকাশ থাকে যে, ২৬ পারার ৪৯ নং সূরা (অর্থাৎ সূরা হুজুরাত) থেকে কুরআন মাজীদের সর্বশেষ সূরা (সূরা নাস) পর্যন্ত সর্বমোট ৬৬টি সূরাকে মুফাস্সাল বলা হয়। এর মধ্যে প্রথম ৩৬টি অর্থাৎ ৪৯ থেকে ৮৪ (সূরা ইনশিকাক) পর্যন্ত সূরাসমূহকে তিওয়ালে মুফাসসাল বলে। তারপর ৮৫ (সূরা বুরূজ) থেকে ৯৭ (সূরা কদর) পর্যন্ত ১৩টি সূরাকে আওসাতে মুফাস্সাল বলে। তারপর ১৮ (সূরা বায়্যিনাহ) থেকে ১১৪ (সূরা নাস) পর্যন্ত ১৭টি সুরাকে কিসারে মুফাস্সাল বলে। হযরত উমর রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি.-কে হুকুম করেছিলেন যে, ফজরে তিওয়ালে মুফাস্সাল ও যোহরে আওসাতে মুফাস্সাল পড়বে।
হযরত জাবির ইব্ন সামুরা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যোহর ও আসরে সূরা বুরুজ, সূরা তারিক ও অনুরূপ কোনও সূরা পড়তেন। এগুলো আওসাতে মুফাসালের অন্তর্ভুক্ত এবং এগুলো তিনি যোহরেও পড়েছেন।
হযরত বুরায়দা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইশার নামাযে সূরা শাম্স ও এর অনুরূপ সূরা পড়তেন। একই সূত্রে অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি ইশার নামাযে সূরা তীন পড়েছেন। এগুলোও আওসাতে মুফাস্সালের অন্তর্ভুক্ত।
তবে বিভিন্ন রেওয়ায়েতের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম পাঁচও নামাযে মুফাস্সালের সূরাসমূহ ছাড়াও তিলাওয়াত করেছেন। যেমন ফজরের নামাযে সূরা মুমিনূন, সূরা সাফ্ফাত, সূরা রূম ইত্যাদিও পড়েছেন। সাহাবায়ে কেরামের অনেকেও ফজরের নামাযে সূরা ইয়ুনুস, সূরা ইয়ুসুফ, সূরা বনী ইসরাঈল, সূরা কাহফ ইত্যাদিও পড়েছেন। কখনও বড় একটি সূরাকে দু' রাকআতে ভাগ করে পড়েছেন। আবার কখনও বড় বড় সূরা থেকে দুই রাকআতে ১০০ আয়াত বা তার কমবেশিও পড়েছেন। আবার এমনও হয়েছে যে, তিনি মাগরিবে তিওয়ালে মুফাস্সাল থেকে কোনও সূরা পড়েছেন।
সমস্ত রেওয়ায়েতের প্রতি লক্ষ করলে সাধারণ যে ধারণা পাওয়া যায় তা এরকম যে, বেশিরভাগ পাঁচ ওয়াক্ত নামায মুফাস্সালের সূরাসমূহ থেকে পূর্ববর্ণিত তিন ভাগে ভাগ করে পড়া হত। এর বাইরেও প্রচুর পড়া হয়েছে। তবে তাতে মোটামুটিভাবে মুফাস্সালের পরিমাণের দিকে লক্ষ রাখা হত। অর্থাৎ ফজরের নামাযে বড় বড় সূরা থেকে পড়লে এ পরিমাণ পড়া হত, যা তিওয়ালে মুফাসসালের সূরাসমূহের সমপরিমাণ বা কমবেশি তার কাছাকাছি হত। এসব দিকে লক্ষ করে উলামায়ে কেরাম এ ফয়সালা দিয়েছেন যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে মুফাস্সালের সূরাসমূহ থেকে উল্লিখিত তিন ভাগ অনুযায়ী পড়া মুস্তাহাব বা উত্তম। এর বাহির থেকে পড়লেও যদি মোটামুটিভাবে মুফাসসালের সূরাসমূহের পরিমাণ অনুযায়ী পড়া হয়, তাতেও মুস্তাহাব আদায় হয়ে যাবে। নামায়ের মত শ্রেষ্ঠতম ইবাদতে এ মুস্তাহাব আদায়ের প্রতি লক্ষ রাখা চাই। বিশেষ ওজরের কথা আলাদা, যেমন শিশুর কান্না শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায সংক্ষেপ করেছেন।
আলোচ্য হাদীছে-যে ইমামকে বিভিন্ন রকম মুক্তাদীর প্রতি লক্ষ করে নামায সংক্ষেপ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে তার অর্থ এ নয় যে, সাধারণ অবস্থায় সুন্নত মুস্তাহাব ছেড়ে দিয়ে তাড়াহুড়া করে নামায শেষ করে ফেলবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে যেভাবে পড়লে সুন্নত মোতাবেক নামায আদায় হয়ে যায় তারই মধ্যে ক্ষান্ত করবে, এর বেশি লম্বা করবে না। শান্তভাবে রুকূ-সিজদা আদায় করবে, মহব্বতের সাথে দু'আ-দুরূদ পড়বে, সহীহ-শুদ্ধভাবে তারতীলের সঙ্গে কিরাআত পড়বে, পুরোপুরি খুশু-খুযূ' রক্ষার চেষ্টা করবে এবং সুন্নত কিরাআতের যে পরিমাপ বর্ণিত আছে সে অনুযায়ী কিরাআত পড়বে। ব্যস এরই মধ্যে নামায সীমিত রাখবে, এর বেশি লম্বা করবে না। এর বেশি লম্বা করা মাকরূহ। কেননা এতে মুসল্লীদের উপর চাপ পড়ে। অনেকে অতিরিক্ত কষ্ট বোধ করে। ফলে জামাতে নামায পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

তারাবীর নামাযে এ গাফলাতী ও অনাগ্রহ অনেক বেশি লক্ষ করা যায়। অনেক জায়গায় এ গাফলাতীর কারণে তারাবীতে কুরআন মাজীদ খতম করা হয় না। আবার বহু জায়গায় খতম করা হয় বটে, কিন্তু খুবই তাড়াহুড়া করে পড়া হয়। হাফেজ সাহেব কী যে পড়েন তা বোঝার কোনও উপায় থাকে না। এ গাফলাতী অবশ্যই পরিত্যাগ করা উচিত। রমযান মাস কুরআনের মাস। পবিত্র এ মাসে তারাবীতে কুরআন খতমের ফযীলত ও বরকতলাভ থেকে কিছুতেই বঞ্চিত থাকা উচিত নয়। কুরআনের তিলাওয়াত ও শ্রবণ উভয়টাই আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। এ নি'আমত অত্যন্ত মহব্বতের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। তাই তিলাওয়াতে তাড়াহুড়া বাঞ্ছনীয় নয় এবং শ্রবণেও ব্যস্ততা কাঙ্ক্ষিত নয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা উম্মতের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গভীর দয়ামায়ার পরিচয় পাওয়া যায়।

খ. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, নামাযে ইমামের কর্তব্য সুন্নতের সীমার মধ্যেই থাকা, এর বেশি লম্বা না করা।

গ. ইসলামে দুর্বল, বৃদ্ধ ও পীড়িতের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকার কী গুরুত্ব, এ হাদীছ দ্বারা তা অনুমান করা যায়। নামাযের মত সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত আদায়েও তাদের প্রতি লক্ষ রাখার তাগিদ করা হয়েছে। কাজেই অন্যসকল ক্ষেত্রে তাদের প্রতি যে আরও বেশি সময় থাকতে হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন