আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৯- আযান-ইকামতের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৭০৩
৪৫৪. একাকী নামায আদায় করলে ইচ্ছানুসারে দীর্ঘায়িত করতে পারে।
৬৬৮। আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের কেউ যখন লোকদের নিয়ে নামায আদায় করে, তখন যেন সে সংক্ষেপ করে। কেননা তাঁদের মাঝে দুর্বল, অসুস্থ ও বৃদ্ধ রয়েছে। আর যদি কেউ একাকী নামায আদায় করে, তখন ইচ্ছামত দীর্ঘ করতে পারে।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে ইমামের প্রতি নামায সংক্ষেপ করতে আদেশ করা হয়েছে। এর কারণ বলা হয়েছে- মুসল্লীদের মধ্যে শিশু, দুর্বল ও অসুস্থ লোকও থাকে। দীর্ঘ নামায পড়লে তাদের কষ্ট হবে। ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা মানুষকে কষ্ট দেওয়া শরীআতের উদ্দেশ্য নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ- يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ “আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই চান, তোমাদের জন্য কঠিনতা চান না।
প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্বলদের দিকে লক্ষ করে নামায কী পরিমাণ সংক্ষেপ করা হবে? এর মাপকাঠি কী? অনেক জায়গায় লক্ষ করা যায় ছোট ছোট সূরা দিয়ে ফজরের নামায পড়া হচ্ছে। যোহরের নামায তো অধিকাংশ জায়গায়ই অতি সংক্ষেপে পড়া হয়। রমযান মাসে কোনও কোনও মসজিদে ফজরের নামাযে এমনকি মাগরিবের কিরাআতও পড়া হয়। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলা হয় জামাতে অনেক অসুস্থ লোক থাকে, যোহরের নামাযের সময় মানুষের অনেক ব্যস্ততা থাকে, তখন অফিস-আদাল থাকে, রমযানে মানুষ অনেক ক্লান্ত থাকে ইত্যাদি। এসব যুক্তিতে যেমন কিরাআত ছোট করা হয়, তেমনি রুকূ-সিজদায়ও তাড়াহুড়া করা হয়। দুরূদ শরীফ পড়ে শেষ করা যায় না, তার আগেই সালাম ফেরানো হয়। এটাই কি সংক্ষেপ করার অর্থ?
প্রকৃতপক্ষে সংক্ষেপ করার দ্বারা তাড়াহুড়া করে নামায শেষ করার হুকুম দেওয়া হয়নি। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংক্ষেপ করা বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন সেজন্য আমাদেরকে তাঁর নামাযের দিকে লক্ষ করতে হবে। তিনি নিজের ইমাম ছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর ইমামতিতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতেন। তাঁদের মধ্যেও অসুস্থ, দুর্বল, শিশু ও কর্মব্যস্ত লোক ছিলেন, যাদের প্রতি লক্ষ করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমামদেরকে নামায সংক্ষে করার হুকুম দিয়েছেন। বলাবাহুল্য, এদের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজেও নামায সংক্ষেপ করতেন বৈকি। এটা নবীগণের বৈশিষ্ট্য যে, তাঁরা মানুষকে যে হুকুম করে থাকেন। নিজেরাও তা পালন করেন। সুতরাং তিনি নিজেও নিশ্চয়ই দুর্বলদের দিকে লক্ষ করে নামায সংক্ষেপ করতেন। হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছেঃ- كان رسول اللہ ﷺ من أخف الناس صلاة في تمام “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন পরিপূর্ণতার সাথে সর্বাপেক্ষ সংক্ষিপ্ত সালাত আদায়কারী।
তা কী রকম সংক্ষিপ্ত সালাত তিনি আদায় করতেন? বিভিন্ন রেওয়ায়েত দ্বারা জান যায় তিনি ফজর ও যোহরে তিওয়ালে মুফাস্সাল', আসর ও ইশায় 'আওসাতে মুফাস্স্সাল' এবং মাগরিবে 'কিসারে মুফাস্সাল' পড়তেন। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে যে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ নামায অমুক ছাড়া আর কারও পেছনে পড়িনি। বর্ণনাটির শেষে আছেঃ- ويقرأ في المغرب بقصار المفصل، ويقرأ في العشاء بوسط المفصل، ويقرأ في الصبح بطوال المفصل 'তিনি মাগরিবে কিসারে মুফাস্সাল, ইশায় আওসাতে মুফাস্সাল এবং ফজরে তিওয়ালে মুফাস্সাল পড়তেন।
প্রকাশ থাকে যে, ২৬ পারার ৪৯ নং সূরা (অর্থাৎ সূরা হুজুরাত) থেকে কুরআন মাজীদের সর্বশেষ সূরা (সূরা নাস) পর্যন্ত সর্বমোট ৬৬টি সূরাকে মুফাস্সাল বলা হয়। এর মধ্যে প্রথম ৩৬টি অর্থাৎ ৪৯ থেকে ৮৪ (সূরা ইনশিকাক) পর্যন্ত সূরাসমূহকে তিওয়ালে মুফাসসাল বলে। তারপর ৮৫ (সূরা বুরূজ) থেকে ৯৭ (সূরা কদর) পর্যন্ত ১৩টি সূরাকে আওসাতে মুফাস্সাল বলে। তারপর ১৮ (সূরা বায়্যিনাহ) থেকে ১১৪ (সূরা নাস) পর্যন্ত ১৭টি সুরাকে কিসারে মুফাস্সাল বলে। হযরত উমর রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি.-কে হুকুম করেছিলেন যে, ফজরে তিওয়ালে মুফাস্সাল ও যোহরে আওসাতে মুফাস্সাল পড়বে।
হযরত জাবির ইব্ন সামুরা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যোহর ও আসরে সূরা বুরুজ, সূরা তারিক ও অনুরূপ কোনও সূরা পড়তেন। এগুলো আওসাতে মুফাসালের অন্তর্ভুক্ত এবং এগুলো তিনি যোহরেও পড়েছেন।
হযরত বুরায়দা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইশার নামাযে সূরা শাম্স ও এর অনুরূপ সূরা পড়তেন। একই সূত্রে অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি ইশার নামাযে সূরা তীন পড়েছেন। এগুলোও আওসাতে মুফাস্সালের অন্তর্ভুক্ত।
তবে বিভিন্ন রেওয়ায়েতের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম পাঁচও নামাযে মুফাস্সালের সূরাসমূহ ছাড়াও তিলাওয়াত করেছেন। যেমন ফজরের নামাযে সূরা মুমিনূন, সূরা সাফ্ফাত, সূরা রূম ইত্যাদিও পড়েছেন। সাহাবায়ে কেরামের অনেকেও ফজরের নামাযে সূরা ইয়ুনুস, সূরা ইয়ুসুফ, সূরা বনী ইসরাঈল, সূরা কাহফ ইত্যাদিও পড়েছেন। কখনও বড় একটি সূরাকে দু' রাকআতে ভাগ করে পড়েছেন। আবার কখনও বড় বড় সূরা থেকে দুই রাকআতে ১০০ আয়াত বা তার কমবেশিও পড়েছেন। আবার এমনও হয়েছে যে, তিনি মাগরিবে তিওয়ালে মুফাস্সাল থেকে কোনও সূরা পড়েছেন।
সমস্ত রেওয়ায়েতের প্রতি লক্ষ করলে সাধারণ যে ধারণা পাওয়া যায় তা এরকম যে, বেশিরভাগ পাঁচ ওয়াক্ত নামায মুফাস্সালের সূরাসমূহ থেকে পূর্ববর্ণিত তিন ভাগে ভাগ করে পড়া হত। এর বাইরেও প্রচুর পড়া হয়েছে। তবে তাতে মোটামুটিভাবে মুফাস্সালের পরিমাণের দিকে লক্ষ রাখা হত। অর্থাৎ ফজরের নামাযে বড় বড় সূরা থেকে পড়লে এ পরিমাণ পড়া হত, যা তিওয়ালে মুফাসসালের সূরাসমূহের সমপরিমাণ বা কমবেশি তার কাছাকাছি হত। এসব দিকে লক্ষ করে উলামায়ে কেরাম এ ফয়সালা দিয়েছেন যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে মুফাস্সালের সূরাসমূহ থেকে উল্লিখিত তিন ভাগ অনুযায়ী পড়া মুস্তাহাব বা উত্তম। এর বাহির থেকে পড়লেও যদি মোটামুটিভাবে মুফাসসালের সূরাসমূহের পরিমাণ অনুযায়ী পড়া হয়, তাতেও মুস্তাহাব আদায় হয়ে যাবে। নামায়ের মত শ্রেষ্ঠতম ইবাদতে এ মুস্তাহাব আদায়ের প্রতি লক্ষ রাখা চাই। বিশেষ ওজরের কথা আলাদা, যেমন শিশুর কান্না শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায সংক্ষেপ করেছেন।
আলোচ্য হাদীছে-যে ইমামকে বিভিন্ন রকম মুক্তাদীর প্রতি লক্ষ করে নামায সংক্ষেপ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে তার অর্থ এ নয় যে, সাধারণ অবস্থায় সুন্নত মুস্তাহাব ছেড়ে দিয়ে তাড়াহুড়া করে নামায শেষ করে ফেলবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে যেভাবে পড়লে সুন্নত মোতাবেক নামায আদায় হয়ে যায় তারই মধ্যে ক্ষান্ত করবে, এর বেশি লম্বা করবে না। শান্তভাবে রুকূ-সিজদা আদায় করবে, মহব্বতের সাথে দু'আ-দুরূদ পড়বে, সহীহ-শুদ্ধভাবে তারতীলের সঙ্গে কিরাআত পড়বে, পুরোপুরি খুশু-খুযূ' রক্ষার চেষ্টা করবে এবং সুন্নত কিরাআতের যে পরিমাপ বর্ণিত আছে সে অনুযায়ী কিরাআত পড়বে। ব্যস এরই মধ্যে নামায সীমিত রাখবে, এর বেশি লম্বা করবে না। এর বেশি লম্বা করা মাকরূহ। কেননা এতে মুসল্লীদের উপর চাপ পড়ে। অনেকে অতিরিক্ত কষ্ট বোধ করে। ফলে জামাতে নামায পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জমানায় এরকম এক ঘটনা ঘটেছিল। হযরত মু'আয ইব্ন জাবাল রাযি. অনেক লম্বা লম্বা সূরা দ্বারা নামায পড়াতেন। এমনকি তিনি ইশার নামাযে সূরা বাকারাও পড়তেন। এ কারণে জনৈক কর্মক্লান্ত মুসল্লী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি হযরত মু'আয রাযি.-কে ডেকে পাঠান এবং এজন্য তাঁকে শক্ত ভাষায় তিরস্কার করেন আর তাঁকে নির্দেশ দেন যে, ইশার নামাযে সূরা আ'লা ও সূরা শাম্স পড়বে।
লক্ষণীয় হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসল্লীর অভিযোগের কারণে কিন্তু হযরত মুআয রাযি.-কে মুস্তাহাব কিরাআত পরিত্যাগ করতে বলেননি; বরং তাঁকে মুস্তাহাব কিরাআতের মধ্যেই থাকার হুকুম করেছিলেন। তিনি তাঁকে যে তিরস্কার করেছিলেন তা নিজ কিরাআত মুস্তাহাবের সীমা ছাড়িয়ে আরও বেশি লম্বা করার কারণে। সুতরাং মুসল্লীদের অভিযোগের কারণে কিছুতেই সুন্নত-মুস্তাহাব ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে কেউ অভিযোগ করলে তার কারণ কেবলই তার গাফলাতী এবং সুন্নত-মুস্তাহাবের উপর আমলে অনাগ্রহ।
তারাবীর নামাযে এ গাফলাতী ও অনাগ্রহ অনেক বেশি লক্ষ করা যায়। অনেক জায়গায় এ গাফলাতীর কারণে তারাবীতে কুরআন মাজীদ খতম করা হয় না। আবার বহু জায়গায় খতম করা হয় বটে, কিন্তু খুবই তাড়াহুড়া করে পড়া হয়। হাফেজ সাহেব কী যে পড়েন তা বোঝার কোনও উপায় থাকে না। এ গাফলাতী অবশ্যই পরিত্যাগ করা উচিত। রমযান মাস কুরআনের মাস। পবিত্র এ মাসে তারাবীতে কুরআন খতমের ফযীলত ও বরকতলাভ থেকে কিছুতেই বঞ্চিত থাকা উচিত নয়। কুরআনের তিলাওয়াত ও শ্রবণ উভয়টাই আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। এ নি'আমত অত্যন্ত মহব্বতের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। তাই তিলাওয়াতে তাড়াহুড়া বাঞ্ছনীয় নয় এবং শ্রবণেও ব্যস্ততা কাঙ্ক্ষিত নয়।
নফল নামায দীর্ঘ করা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছের শেষে ইরশাদ করেছেনঃ- وإذا صلى أحدكم لنفسه فليطول ما شاء (আর তোমাদের মধ্যে কেউ যখন একা নামায় পড়ে, সে যতটা ইচ্ছা দীর্ঘ করুক)।একা নামায পড়ার অর্থ ফরয নামায জামাত ছেড়ে একাকী পড়া নয়। ফরয নামায জামাতেই পড়া চাই। এটাই মুমিন-মুত্তাকীর নামায। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জমানায় জামাত ছাড়ত কেবল প্রকাশ্য মুনাফিকরা। তাদের মত কাজ করা আমাদের কিছুতেই উচিত নয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদের হেফাজত করুন।
একা নামায পড়া বলতে মূলত সুন্নত ও নফল নামায বোঝানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আগ্রহ-উদ্দীপনার সঙ্গে নামায যতটা দীর্ঘ করা যায় ততই ভালো। নফল নামায সম্পর্কে একটি হাদীছে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছেঃ- وما يزال عبدي يتقرب إلي بالنوافل حتى أحبه، فإذا أحببته كنت سمعه الذي يسمع به وبصره الذي يبصر به ويده التي يبطش بها ورجله التي يمشي بها ‘আমার বান্দা নফলসমূহের দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। একপর্যায়ে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। আর আমি যখন তাকে ভালোবেসে ফেলি তখন হয়ে যাই তার কান, যা দ্বারা সে শোনে; তার চোখ, যা দ্বারা সে দেখে; তার হাত, যা দ্বারা সে ধরে এবং তার পা, যা দ্বারা সে চলে।
তো বান্দার যে নামায আল্লাহর এত প্রিয় এবং যে নামাযের কারণে বান্দা আল্লাহর মাহবুব ও প্রিয় হয়ে যায়, সে নামায কতইনা ইশক ও মহব্বতের সঙ্গে পড়া উচিত। নামাযে ইশক ও মহব্বত এবং যত্ন ও উৎসাহ থাকলে নামায আপনিই দীর্ঘ হয়ে যায়। এরকম নামায আশেক বান্দার জন্য হয় নয়নপ্রীতিকর। সে তা যত দীর্ঘ করে ততই প্রাণ জুড়ায়। সে সহজে তা শেষ করতে চায় না। নামাযের বিপরীতে তার কাছে শারীরিক কষ্ট তুচ্ছ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত আনসারী সাহাবী হযরত আব্বাদ ইব্ন বিশর রাযি.-এর ঘটনা উল্লেখ করার মত।
হযরত আব্বাদ ইবনে বিশর্ রাযি.-এর ঘটনা
হি. ৪র্থ বছর যাতুর রিকা'র যুদ্ধাভিযান থেকে ফেরার সময় তাঁর ঘটনাটি ঘটেছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক গিরিপথে হযরত আম্মার ইব্ন ইয়াসির রাযি. ও আব্বাদ ইব্ন বিশর রাযি.-কে পাহারায় নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁরা দু'জন সিদ্ধান্ত নেন যে, রাতের প্রথম অংশে হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি জেগে থাকবেন এবং শেষ অংশে আম্মার ইব্ন ইয়াসির রাযি.। সেমতে হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি. রাতের প্রথম অংশে জাগ্রত থাকেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, শুধু শুধু জেগে সময় পার করবেন? তারচে' সময়টা নামাযে কাটুক। তাতে নামাযও হবে, আবার পাহারার কাজও হয়ে যাবে। সুতরাং তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি নামাযে কুরআন তিলাওয়াতে রত হয়ে গেলেন। লম্বা কিরাআত পড়তে থাকলেন। এ অবস্থায় তাঁর প্রতি এক কাফেরের দৃষ্টি পড়ল। সে তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল, যা তাঁর গায়ে বিদ্ধ হয়ে গেল। তিনি নামায ছাড়লেন না। নামায অবস্থায়ই সেটি টেনে বের করে ফেললেন। শত্রু আবারও তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল। এভাবে তিনবার। শেষটায় তিনি তাড়াতাড়ি সালাম ফেরালেন এবং সঙ্গীকে জাগালেন। সঙ্গী প্রথমে বিষয়টা বুঝে উঠতে পারেননি। পরে তাঁকে রক্তাক্ত দেখে বিচলিত হয়ে উঠলেন এবং বললেন, সুবহানাল্লাহ, ভাই তুমি আগে আমাকে কেন জাগালে না? তিনি বললেন, আমি একটি সূরা পড়ছিলাম, সেটি শেষ না করে ক্ষান্ত হতে আমার মন মানছিল না। কিন্তু সে যখন একের পর এক তীর মেরে যাচ্ছিল, তখন আমি রুকূতে চলে গেলাম, তারপর তোমাকে জাগালাম। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে পাহারাদারীর দায়িত্বে আমাকে নিযুক্ত করেছেন তা ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যদি না থাকত, তবে সে আমাকে হত্যা করে ফেললেও আমি নামায সংক্ষেপ করতাম না।
এ হচ্ছে ইশক ও মহব্বতের নামায। সাহাবায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীনের এ জাতীয় নামায আদায়ের বহু ঘটনা আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও দীর্ঘ সময় লাগিয়ে নফল নামায পড়তেন। হাদীছে বর্ণিত আছেঃ- قام النبي ﷺ حتى تورمت قدماه، فقيل له: غفر الله لك ما تقدم من ذنبك وما تأخر، قال: أفلا أكون عبدا شكورا؟ 'নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযে দাঁড়ালেন দীর্ঘক্ষণ। ফলে তাঁর পা দুটি ফুলে গেল। তাঁকে বলা হল, আপনার আগের পরের সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করা হয়েছে (তারপরও কেন এত কষ্ট করা)? তিনি বললেন, আমি কি একজন শোকরগুযার বান্দা হব না?
কিন্তু আমাদের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। জামাতে নামায আদায়কালে তো বাধ্য হয়েই ইমাম সাহেব যতক্ষণ সালাম না ফেরান ততক্ষণ নামাযে থাকা হয়, কিন্তু যখন একা নামায পড়ি তখন তাড়াহুড়া করে শেষ করে ফেলা হয়। যেন শেষ করার জন্য কেউ তাড়া দিচ্ছে। যে নামায দ্বারা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ হয় এবং তাঁর মাহবূব বান্দায় পরিণত হওয়া যায়, তাতে এতটা তাড়াহুড়া উচিত কি? আল্লাহ তা'আলা আমাদের অন্তরে নামাযের প্রতি আগ্রহ ও মহব্বত সৃষ্টি করে দিন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা উম্মতের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গভীর দয়ামায়ার পরিচয় পাওয়া যায়।
খ. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, নামাযে ইমামের কর্তব্য সুন্নতের সীমার মধ্যেই থাকা, এর বেশি লম্বা না করা।
গ. সুন্নত ও নফল নামায নিজ আগ্রহ-উদ্দীপনা অনুযায়ী দীর্ঘ করা পছন্দনীয়।
ঘ. ইসলামে দুর্বল, বৃদ্ধ ও পীড়িতের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকার কী গুরুত্ব, এ হাদীছ দ্বারা তা অনুমান করা যায়। নামাযের মত সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত আদায়েও তাদের প্রতি লক্ষ রাখার তাগিদ করা হয়েছে। কাজেই অন্যসকল ক্ষেত্রে তাদের প্রতি যে আরও বেশি সময় থাকতে হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্বলদের দিকে লক্ষ করে নামায কী পরিমাণ সংক্ষেপ করা হবে? এর মাপকাঠি কী? অনেক জায়গায় লক্ষ করা যায় ছোট ছোট সূরা দিয়ে ফজরের নামায পড়া হচ্ছে। যোহরের নামায তো অধিকাংশ জায়গায়ই অতি সংক্ষেপে পড়া হয়। রমযান মাসে কোনও কোনও মসজিদে ফজরের নামাযে এমনকি মাগরিবের কিরাআতও পড়া হয়। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলা হয় জামাতে অনেক অসুস্থ লোক থাকে, যোহরের নামাযের সময় মানুষের অনেক ব্যস্ততা থাকে, তখন অফিস-আদাল থাকে, রমযানে মানুষ অনেক ক্লান্ত থাকে ইত্যাদি। এসব যুক্তিতে যেমন কিরাআত ছোট করা হয়, তেমনি রুকূ-সিজদায়ও তাড়াহুড়া করা হয়। দুরূদ শরীফ পড়ে শেষ করা যায় না, তার আগেই সালাম ফেরানো হয়। এটাই কি সংক্ষেপ করার অর্থ?
প্রকৃতপক্ষে সংক্ষেপ করার দ্বারা তাড়াহুড়া করে নামায শেষ করার হুকুম দেওয়া হয়নি। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংক্ষেপ করা বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন সেজন্য আমাদেরকে তাঁর নামাযের দিকে লক্ষ করতে হবে। তিনি নিজের ইমাম ছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর ইমামতিতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতেন। তাঁদের মধ্যেও অসুস্থ, দুর্বল, শিশু ও কর্মব্যস্ত লোক ছিলেন, যাদের প্রতি লক্ষ করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমামদেরকে নামায সংক্ষে করার হুকুম দিয়েছেন। বলাবাহুল্য, এদের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজেও নামায সংক্ষেপ করতেন বৈকি। এটা নবীগণের বৈশিষ্ট্য যে, তাঁরা মানুষকে যে হুকুম করে থাকেন। নিজেরাও তা পালন করেন। সুতরাং তিনি নিজেও নিশ্চয়ই দুর্বলদের দিকে লক্ষ করে নামায সংক্ষেপ করতেন। হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছেঃ- كان رسول اللہ ﷺ من أخف الناس صلاة في تمام “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন পরিপূর্ণতার সাথে সর্বাপেক্ষ সংক্ষিপ্ত সালাত আদায়কারী।
তা কী রকম সংক্ষিপ্ত সালাত তিনি আদায় করতেন? বিভিন্ন রেওয়ায়েত দ্বারা জান যায় তিনি ফজর ও যোহরে তিওয়ালে মুফাস্সাল', আসর ও ইশায় 'আওসাতে মুফাস্স্সাল' এবং মাগরিবে 'কিসারে মুফাস্সাল' পড়তেন। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে যে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ নামায অমুক ছাড়া আর কারও পেছনে পড়িনি। বর্ণনাটির শেষে আছেঃ- ويقرأ في المغرب بقصار المفصل، ويقرأ في العشاء بوسط المفصل، ويقرأ في الصبح بطوال المفصل 'তিনি মাগরিবে কিসারে মুফাস্সাল, ইশায় আওসাতে মুফাস্সাল এবং ফজরে তিওয়ালে মুফাস্সাল পড়তেন।
প্রকাশ থাকে যে, ২৬ পারার ৪৯ নং সূরা (অর্থাৎ সূরা হুজুরাত) থেকে কুরআন মাজীদের সর্বশেষ সূরা (সূরা নাস) পর্যন্ত সর্বমোট ৬৬টি সূরাকে মুফাস্সাল বলা হয়। এর মধ্যে প্রথম ৩৬টি অর্থাৎ ৪৯ থেকে ৮৪ (সূরা ইনশিকাক) পর্যন্ত সূরাসমূহকে তিওয়ালে মুফাসসাল বলে। তারপর ৮৫ (সূরা বুরূজ) থেকে ৯৭ (সূরা কদর) পর্যন্ত ১৩টি সূরাকে আওসাতে মুফাস্সাল বলে। তারপর ১৮ (সূরা বায়্যিনাহ) থেকে ১১৪ (সূরা নাস) পর্যন্ত ১৭টি সুরাকে কিসারে মুফাস্সাল বলে। হযরত উমর রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি.-কে হুকুম করেছিলেন যে, ফজরে তিওয়ালে মুফাস্সাল ও যোহরে আওসাতে মুফাস্সাল পড়বে।
হযরত জাবির ইব্ন সামুরা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যোহর ও আসরে সূরা বুরুজ, সূরা তারিক ও অনুরূপ কোনও সূরা পড়তেন। এগুলো আওসাতে মুফাসালের অন্তর্ভুক্ত এবং এগুলো তিনি যোহরেও পড়েছেন।
হযরত বুরায়দা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইশার নামাযে সূরা শাম্স ও এর অনুরূপ সূরা পড়তেন। একই সূত্রে অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি ইশার নামাযে সূরা তীন পড়েছেন। এগুলোও আওসাতে মুফাস্সালের অন্তর্ভুক্ত।
তবে বিভিন্ন রেওয়ায়েতের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম পাঁচও নামাযে মুফাস্সালের সূরাসমূহ ছাড়াও তিলাওয়াত করেছেন। যেমন ফজরের নামাযে সূরা মুমিনূন, সূরা সাফ্ফাত, সূরা রূম ইত্যাদিও পড়েছেন। সাহাবায়ে কেরামের অনেকেও ফজরের নামাযে সূরা ইয়ুনুস, সূরা ইয়ুসুফ, সূরা বনী ইসরাঈল, সূরা কাহফ ইত্যাদিও পড়েছেন। কখনও বড় একটি সূরাকে দু' রাকআতে ভাগ করে পড়েছেন। আবার কখনও বড় বড় সূরা থেকে দুই রাকআতে ১০০ আয়াত বা তার কমবেশিও পড়েছেন। আবার এমনও হয়েছে যে, তিনি মাগরিবে তিওয়ালে মুফাস্সাল থেকে কোনও সূরা পড়েছেন।
সমস্ত রেওয়ায়েতের প্রতি লক্ষ করলে সাধারণ যে ধারণা পাওয়া যায় তা এরকম যে, বেশিরভাগ পাঁচ ওয়াক্ত নামায মুফাস্সালের সূরাসমূহ থেকে পূর্ববর্ণিত তিন ভাগে ভাগ করে পড়া হত। এর বাইরেও প্রচুর পড়া হয়েছে। তবে তাতে মোটামুটিভাবে মুফাস্সালের পরিমাণের দিকে লক্ষ রাখা হত। অর্থাৎ ফজরের নামাযে বড় বড় সূরা থেকে পড়লে এ পরিমাণ পড়া হত, যা তিওয়ালে মুফাসসালের সূরাসমূহের সমপরিমাণ বা কমবেশি তার কাছাকাছি হত। এসব দিকে লক্ষ করে উলামায়ে কেরাম এ ফয়সালা দিয়েছেন যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে মুফাস্সালের সূরাসমূহ থেকে উল্লিখিত তিন ভাগ অনুযায়ী পড়া মুস্তাহাব বা উত্তম। এর বাহির থেকে পড়লেও যদি মোটামুটিভাবে মুফাসসালের সূরাসমূহের পরিমাণ অনুযায়ী পড়া হয়, তাতেও মুস্তাহাব আদায় হয়ে যাবে। নামায়ের মত শ্রেষ্ঠতম ইবাদতে এ মুস্তাহাব আদায়ের প্রতি লক্ষ রাখা চাই। বিশেষ ওজরের কথা আলাদা, যেমন শিশুর কান্না শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায সংক্ষেপ করেছেন।
আলোচ্য হাদীছে-যে ইমামকে বিভিন্ন রকম মুক্তাদীর প্রতি লক্ষ করে নামায সংক্ষেপ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে তার অর্থ এ নয় যে, সাধারণ অবস্থায় সুন্নত মুস্তাহাব ছেড়ে দিয়ে তাড়াহুড়া করে নামায শেষ করে ফেলবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে যেভাবে পড়লে সুন্নত মোতাবেক নামায আদায় হয়ে যায় তারই মধ্যে ক্ষান্ত করবে, এর বেশি লম্বা করবে না। শান্তভাবে রুকূ-সিজদা আদায় করবে, মহব্বতের সাথে দু'আ-দুরূদ পড়বে, সহীহ-শুদ্ধভাবে তারতীলের সঙ্গে কিরাআত পড়বে, পুরোপুরি খুশু-খুযূ' রক্ষার চেষ্টা করবে এবং সুন্নত কিরাআতের যে পরিমাপ বর্ণিত আছে সে অনুযায়ী কিরাআত পড়বে। ব্যস এরই মধ্যে নামায সীমিত রাখবে, এর বেশি লম্বা করবে না। এর বেশি লম্বা করা মাকরূহ। কেননা এতে মুসল্লীদের উপর চাপ পড়ে। অনেকে অতিরিক্ত কষ্ট বোধ করে। ফলে জামাতে নামায পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জমানায় এরকম এক ঘটনা ঘটেছিল। হযরত মু'আয ইব্ন জাবাল রাযি. অনেক লম্বা লম্বা সূরা দ্বারা নামায পড়াতেন। এমনকি তিনি ইশার নামাযে সূরা বাকারাও পড়তেন। এ কারণে জনৈক কর্মক্লান্ত মুসল্লী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি হযরত মু'আয রাযি.-কে ডেকে পাঠান এবং এজন্য তাঁকে শক্ত ভাষায় তিরস্কার করেন আর তাঁকে নির্দেশ দেন যে, ইশার নামাযে সূরা আ'লা ও সূরা শাম্স পড়বে।
লক্ষণীয় হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসল্লীর অভিযোগের কারণে কিন্তু হযরত মুআয রাযি.-কে মুস্তাহাব কিরাআত পরিত্যাগ করতে বলেননি; বরং তাঁকে মুস্তাহাব কিরাআতের মধ্যেই থাকার হুকুম করেছিলেন। তিনি তাঁকে যে তিরস্কার করেছিলেন তা নিজ কিরাআত মুস্তাহাবের সীমা ছাড়িয়ে আরও বেশি লম্বা করার কারণে। সুতরাং মুসল্লীদের অভিযোগের কারণে কিছুতেই সুন্নত-মুস্তাহাব ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে কেউ অভিযোগ করলে তার কারণ কেবলই তার গাফলাতী এবং সুন্নত-মুস্তাহাবের উপর আমলে অনাগ্রহ।
তারাবীর নামাযে এ গাফলাতী ও অনাগ্রহ অনেক বেশি লক্ষ করা যায়। অনেক জায়গায় এ গাফলাতীর কারণে তারাবীতে কুরআন মাজীদ খতম করা হয় না। আবার বহু জায়গায় খতম করা হয় বটে, কিন্তু খুবই তাড়াহুড়া করে পড়া হয়। হাফেজ সাহেব কী যে পড়েন তা বোঝার কোনও উপায় থাকে না। এ গাফলাতী অবশ্যই পরিত্যাগ করা উচিত। রমযান মাস কুরআনের মাস। পবিত্র এ মাসে তারাবীতে কুরআন খতমের ফযীলত ও বরকতলাভ থেকে কিছুতেই বঞ্চিত থাকা উচিত নয়। কুরআনের তিলাওয়াত ও শ্রবণ উভয়টাই আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। এ নি'আমত অত্যন্ত মহব্বতের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। তাই তিলাওয়াতে তাড়াহুড়া বাঞ্ছনীয় নয় এবং শ্রবণেও ব্যস্ততা কাঙ্ক্ষিত নয়।
নফল নামায দীর্ঘ করা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছের শেষে ইরশাদ করেছেনঃ- وإذا صلى أحدكم لنفسه فليطول ما شاء (আর তোমাদের মধ্যে কেউ যখন একা নামায় পড়ে, সে যতটা ইচ্ছা দীর্ঘ করুক)।একা নামায পড়ার অর্থ ফরয নামায জামাত ছেড়ে একাকী পড়া নয়। ফরয নামায জামাতেই পড়া চাই। এটাই মুমিন-মুত্তাকীর নামায। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জমানায় জামাত ছাড়ত কেবল প্রকাশ্য মুনাফিকরা। তাদের মত কাজ করা আমাদের কিছুতেই উচিত নয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদের হেফাজত করুন।
একা নামায পড়া বলতে মূলত সুন্নত ও নফল নামায বোঝানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আগ্রহ-উদ্দীপনার সঙ্গে নামায যতটা দীর্ঘ করা যায় ততই ভালো। নফল নামায সম্পর্কে একটি হাদীছে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছেঃ- وما يزال عبدي يتقرب إلي بالنوافل حتى أحبه، فإذا أحببته كنت سمعه الذي يسمع به وبصره الذي يبصر به ويده التي يبطش بها ورجله التي يمشي بها ‘আমার বান্দা নফলসমূহের দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। একপর্যায়ে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। আর আমি যখন তাকে ভালোবেসে ফেলি তখন হয়ে যাই তার কান, যা দ্বারা সে শোনে; তার চোখ, যা দ্বারা সে দেখে; তার হাত, যা দ্বারা সে ধরে এবং তার পা, যা দ্বারা সে চলে।
তো বান্দার যে নামায আল্লাহর এত প্রিয় এবং যে নামাযের কারণে বান্দা আল্লাহর মাহবুব ও প্রিয় হয়ে যায়, সে নামায কতইনা ইশক ও মহব্বতের সঙ্গে পড়া উচিত। নামাযে ইশক ও মহব্বত এবং যত্ন ও উৎসাহ থাকলে নামায আপনিই দীর্ঘ হয়ে যায়। এরকম নামায আশেক বান্দার জন্য হয় নয়নপ্রীতিকর। সে তা যত দীর্ঘ করে ততই প্রাণ জুড়ায়। সে সহজে তা শেষ করতে চায় না। নামাযের বিপরীতে তার কাছে শারীরিক কষ্ট তুচ্ছ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত আনসারী সাহাবী হযরত আব্বাদ ইব্ন বিশর রাযি.-এর ঘটনা উল্লেখ করার মত।
হযরত আব্বাদ ইবনে বিশর্ রাযি.-এর ঘটনা
হি. ৪র্থ বছর যাতুর রিকা'র যুদ্ধাভিযান থেকে ফেরার সময় তাঁর ঘটনাটি ঘটেছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক গিরিপথে হযরত আম্মার ইব্ন ইয়াসির রাযি. ও আব্বাদ ইব্ন বিশর রাযি.-কে পাহারায় নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁরা দু'জন সিদ্ধান্ত নেন যে, রাতের প্রথম অংশে হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি জেগে থাকবেন এবং শেষ অংশে আম্মার ইব্ন ইয়াসির রাযি.। সেমতে হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি. রাতের প্রথম অংশে জাগ্রত থাকেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, শুধু শুধু জেগে সময় পার করবেন? তারচে' সময়টা নামাযে কাটুক। তাতে নামাযও হবে, আবার পাহারার কাজও হয়ে যাবে। সুতরাং তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি নামাযে কুরআন তিলাওয়াতে রত হয়ে গেলেন। লম্বা কিরাআত পড়তে থাকলেন। এ অবস্থায় তাঁর প্রতি এক কাফেরের দৃষ্টি পড়ল। সে তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল, যা তাঁর গায়ে বিদ্ধ হয়ে গেল। তিনি নামায ছাড়লেন না। নামায অবস্থায়ই সেটি টেনে বের করে ফেললেন। শত্রু আবারও তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল। এভাবে তিনবার। শেষটায় তিনি তাড়াতাড়ি সালাম ফেরালেন এবং সঙ্গীকে জাগালেন। সঙ্গী প্রথমে বিষয়টা বুঝে উঠতে পারেননি। পরে তাঁকে রক্তাক্ত দেখে বিচলিত হয়ে উঠলেন এবং বললেন, সুবহানাল্লাহ, ভাই তুমি আগে আমাকে কেন জাগালে না? তিনি বললেন, আমি একটি সূরা পড়ছিলাম, সেটি শেষ না করে ক্ষান্ত হতে আমার মন মানছিল না। কিন্তু সে যখন একের পর এক তীর মেরে যাচ্ছিল, তখন আমি রুকূতে চলে গেলাম, তারপর তোমাকে জাগালাম। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে পাহারাদারীর দায়িত্বে আমাকে নিযুক্ত করেছেন তা ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যদি না থাকত, তবে সে আমাকে হত্যা করে ফেললেও আমি নামায সংক্ষেপ করতাম না।
এ হচ্ছে ইশক ও মহব্বতের নামায। সাহাবায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীনের এ জাতীয় নামায আদায়ের বহু ঘটনা আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও দীর্ঘ সময় লাগিয়ে নফল নামায পড়তেন। হাদীছে বর্ণিত আছেঃ- قام النبي ﷺ حتى تورمت قدماه، فقيل له: غفر الله لك ما تقدم من ذنبك وما تأخر، قال: أفلا أكون عبدا شكورا؟ 'নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযে দাঁড়ালেন দীর্ঘক্ষণ। ফলে তাঁর পা দুটি ফুলে গেল। তাঁকে বলা হল, আপনার আগের পরের সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করা হয়েছে (তারপরও কেন এত কষ্ট করা)? তিনি বললেন, আমি কি একজন শোকরগুযার বান্দা হব না?
কিন্তু আমাদের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। জামাতে নামায আদায়কালে তো বাধ্য হয়েই ইমাম সাহেব যতক্ষণ সালাম না ফেরান ততক্ষণ নামাযে থাকা হয়, কিন্তু যখন একা নামায পড়ি তখন তাড়াহুড়া করে শেষ করে ফেলা হয়। যেন শেষ করার জন্য কেউ তাড়া দিচ্ছে। যে নামায দ্বারা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ হয় এবং তাঁর মাহবূব বান্দায় পরিণত হওয়া যায়, তাতে এতটা তাড়াহুড়া উচিত কি? আল্লাহ তা'আলা আমাদের অন্তরে নামাযের প্রতি আগ্রহ ও মহব্বত সৃষ্টি করে দিন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা উম্মতের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গভীর দয়ামায়ার পরিচয় পাওয়া যায়।
খ. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, নামাযে ইমামের কর্তব্য সুন্নতের সীমার মধ্যেই থাকা, এর বেশি লম্বা না করা।
গ. সুন্নত ও নফল নামায নিজ আগ্রহ-উদ্দীপনা অনুযায়ী দীর্ঘ করা পছন্দনীয়।
ঘ. ইসলামে দুর্বল, বৃদ্ধ ও পীড়িতের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকার কী গুরুত্ব, এ হাদীছ দ্বারা তা অনুমান করা যায়। নামাযের মত সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত আদায়েও তাদের প্রতি লক্ষ রাখার তাগিদ করা হয়েছে। কাজেই অন্যসকল ক্ষেত্রে তাদের প্রতি যে আরও বেশি সময় থাকতে হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
