মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

১. একত্ববাদ ও দীনের মূল ভিত্তিসমূহের আলোচনা

হাদীস নং: ৪১
আন্তর্জাতিক নং: ২২০০০
একত্ববাদ ও দীনের মূল ভিত্তিসমূহের আলোচনা
(৪) পরিচ্ছেদঃ একত্ববাদী মু’মিনগণের প্রাপ্য নিয়ামতরাজি ও পুরষ্কার এবং মুশরিকদের জন্য নির্ধারিত ভয়াবহ তিরষ্কার ও শাস্তি প্রসঙ্গে
(৪১) হুমাইদ ইবন্ হিলাল থেকে বর্ণিত, তিনি হিস্সান আল-কাইন আল-আদিভী থেকে বর্ণনা করেন।তিনি বলেন, (একদা) এক মজলিসে আমি উপস্থিত ছিলাম, তাতে আব্দুর রহমান বিন সামুরা ছিলেন।তিনি বলেন, হযরাত মুআয বিন জাবাল (রা) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ভূপৃষ্ঠে (বিদ্যমান) যে আত্মা (মানবাত্মা) আল্লাহর সাথে কোন কিছু শরীক না করে এবং আমি আল্লাহর রাসূল এই মর্মে সাহ্ম্য প্রদান করে মৃত্যুবরণ করে, সে আত্মা বিশ্বাসী প্রত্যয়ী হবে তাকে অবশ্যই হ্মমা করে দেয়া হবে।হিস্সান বলেন, আমি বললাম, আপনি (নিজে) মআয থেকে এরূপ শুনেছেন? উপস্থিত লোকজন (আমার প্রশ্ন শ্রবণ করে) আমাকে ভর্ৎসনা করলো।তিনি বললেন, (ওর কথা বাদ দাও, ওত মন্দ কথা বলেনি), হ্যাঁ, আমি নিজেই এটি মুআয (রা)-এর কাছে শুনেছি এবং তিনি তা রাসূল (ﷺ)-এর নিকট থেকে শুনেছেন।
(অন্য বর্ণনায় এসেছে) আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেছেন তাঁর পিতা থেকে, তিনি ইসমাঈল থেকে, তিনি ইউনুস থেকে, তিনি হুমাইদ বিন হিলাল থেকে, তিনি হিস্সান বিন আল-কাহিল থেকে বর্ণনা করেন যে, (একদা) আমি বসরার জামে মসজিদে প্রবেশ করি এবং মাথার কেশ ও শুশ্রূ ধবল সাদা লোকের কাছে বসি; তিনি তখন বলেন, আমাকে মুআয বিন জাবাল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণনা করে শুনিয়েছেন- অতঃপর হাদীসটি বর্ণনা করেন- এতে আরও আছে একে মন্দ বলো না এবং ভর্ৎসনা করো না, একে ছেড়ে দাও।হ্যাঁ, আমি নিজে মুআয (রা) থেকে ঔরূপ শুনেছি- যা তিনি রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন এবং ইসমাঈল (জনৈক বর্ণনাকারী) একবার يذكر -এর পরিবর্তে يأثره عن رسول الله صلى الله عليه وسلم বলেছেন।তখন আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? উত্তর দিল, ইনি হচ্ছেন আব্দুর রহমান বিন সামুরা।
এ হাদীসটি তৃতীয় আরেকটি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে এভাবে) আব্দুল্লাহ তাঁর পিতা থেকে তিনি আব্দুল আ‘ল থেকে, তিনি ইউনুস থেকে তিনি হুমাইদ বিন হিলাল থেকে তিনি হিস্সান বিন আল-কাহেল থেকে (তাঁর পিতা জাহিলী যুগে একজন গণক ছিলেন) বর্ণনা করেন তিনি বলেন,আমি হযরত উছমান বিন আফ্ফান-এর শাসনামলে মসজিদে প্রবেশ করি এবং একজন সাদা কেশ ও দাড়ি ওয়ালা বৃদ্ধকে পেয়েছি যিনি মুআযের বরাতে রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন। (হাকিম)
كتاب التوحيد
(4) باب فيما جاء في نعيم الموحدين وثوابهم ووعيد المشركين وعقابهم
(41) وعن حميد بن هلال حدثنا (1) هصان الكاهن العدوى قال جلست مجلسا فيه عبدالرحمن بن سمرة قال حدثنا معاذ بن جبل (رضى الله) قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ما على الارض نفس تموت لا تشرك بالله شيئاً تشهد انى رسول الله يرجع ذاكم الى قلب موقن إلا غفر له قال قلت انت سمعت هذا من معاذ قال القوم فعنفنى فقال دعوه فإنه لم يسئ القول، نعم أنا سمعته من معاذ زعم انه سمعه من رسول الله صلى الله عليه وسلم
(ومن طريق اخر) حدثنا عبدالله حدثنى ابى ثنا اسماعيل (3) ثنا يونس عن حميد بن هلاب عن هصان بن الكاهل قال دخلت المسجد الجامع بالبصرة فجلست الى شيخ ابيض الرأس واللحية فقال حدثنى معاذ بن جبل عن رسول الله صلى الله عليه وسلم فذكر الحديث وفيه قال لا تعنفوه (4) ولا تؤنبوه دعوه، نعم انا سمعت ذلك من معاذ يذكرعن رسول الله صلى الله عليه وسلم وقال إسماعيل (1) مرة يأثره عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال قلت لبعضهم من هذا قال هذا عبدالرحمن بن سمرة (2)
(ومن طريق ثالث) (3) حدثنا عبدالله حدثنى ابى ثنا عبد الاعلى عن يونس عن حميد بن هلال عن هصان بن الكاهل قال وكان ابوه كاهنا فى الجاهلية قال دخلت المسجد فى امارة عثمان فإذا شيخ ابيض الرأس واللحية يحدث عن معاذ عن رسول الله صلى الله عليه وسلم فذكر الحديث

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীছে তারপর বলা হয়েছে- فَسَدِّدُوا 'তোমরা মধ্যপন্থা অবলম্বন কর।سَدِّدُوا শব্দটি السداد থেকে গঠিত। এর অর্থ ইস্তিকামাত। অর্থাৎ সঠিক ও বিশুদ্ধ হওয়া এবং স্থায়িত্বলাভ করা। বোঝানো হচ্ছে- তোমরা দীনের ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর ও তাতে স্থির থাক। কোনও অবস্থায়ই মধ্যপন্থা পরিত্যাগ করো না। কেউ কেউ বলেন, السداد অর্থ কথা, কাজ ও উদ্দেশ্য সঠিক হওয়া। এ তিনওটি সঠিক হলে তাকে বলা হয় ইস্তিকামাত। এগুলো সঠিক হওয়া মানে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক হওয়া।

তারপর বলা হয়েছে-وقاربوا সাধ্যানুযায়ী আমল কর'। قاربوا এর উৎপত্তি قرب থেকে, যার অর্থ নৈকট্য। সুতরাং قاربوا এর আক্ষরিক অর্থ- কাছাকাছি থাক অর্থাৎ তোমরা বিশুদ্ধতার কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা কর। অর্থাৎ তোমরা যতই চেষ্টা করো না কেন, শরী'আতের যাবতীয় বিধান ঠিক যেভাবে বলা হয়েছে শতভাগ সেভাবে মধ্যমপন্থায় পালন করতে পারবে না, কিছু না কিছু ত্রুটি হয়েই যাবে। হয়তো তাতে বাড়াবাড়ি ঘটবে, নয়তো শিথিলতা দেখা দেবে। ঠিক মাঝখানে অর্থাৎ শরী'আত যেভাবে বলেছে হুবহু সেভাবে পারবে না। তবে সতর্ক থাকবে যাতে হুবহু না পারলেও বেশি দূরে সরে না যাও। যথাসম্ভব বিশুদ্ধতার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবে। মোটকথা, মানুষের প্রতি শরী'আতের আদেশ হচ্ছে- সকল বিধানে যথাসম্ভব কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক আমলের চেষ্টা করা, ইচ্ছাকৃতভাবে তাতে বাড়াবাড়ি ও শিথিলতা না করা।

وَاسْتَعِينُوا بِالْغَدْوَةِ وَالرَّوْحَةِ، وَشَيْءٍ مِنْ الدُّلْجَةِ

এবং সকাল, সন্ধ্যা ও রাতের কিছু অংশ দ্বারা সাহায্য গ্রহণ কর'। الغَدْوَةِ এর অর্থ দিনের প্রথম অংশের যাত্রা। الرَّوْحَةِ এর অর্থ দিনের শেষভাগের যাত্রা। الدُّلْجَةِ এর অর্থ রাতের শেষভাগ। বলা হচ্ছে, তোমরা এই তিন বেলার 'ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা বাকি সব 'ইবাদত-বন্দেগী নিয়মিতভাবে করে যাওয়ার পক্ষে সাহায্য গ্রহণ কর। অর্থাৎ এ সময়গুলোতে নিয়মিত ইবাদত করতে থাকাটা অন্যান্য ইবাদত চালিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক হয়। কেননা এই তিনটি সময় পরিবেশ শান্ত থাকে, সেইসঙ্গে শরীর-মন থাকে চাঙ্গা। ফলে পূর্ণ আগ্রহ ও মনোনিবেশের সাথে 'ইবাদত করা সম্ভব হয়। এভাবে নিয়মিত করতে থাকলে 'ইবাদতের অভ্যাস গড়ে উঠে এবং তার প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। ইবাদতের প্রতি যখন মহব্বত সৃষ্টি হয়ে যায়, তখন আর সময়-কাল ও পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রতিকূলতা তাতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। বান্দা তখন সব বাধা অগ্রাহ্য করে সর্বপ্রকার ইবাদতে যত্নবান থাকতে পারে। 'ইবাদতের সঙ্গে বান্দার এ পর্যায়ের গভীর সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে যেহেতু উল্লিখিত তিন সময়ের 'ইবাদত সহায়ক হয়, সেজন্যই এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

মূলত এ বাক্যটি রূপকালঙ্কারস্বরূপ। এতে রূহানী ও আধ্যাত্মিক অভিযাত্রাকে বাহ্যিক সফরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মানুষ সফরের জন্য সাধারণত এ তিন সময়কে বেছে নিয়ে থাকে। কেননা এ সময় পরিবেশ অনুকূল হওয়ায় ও শরীর-মন চাঙ্গা থাকায় যাত্রা আনন্দদায়ক ও উপভোগ্য হয়। ইবাদত-বন্দেগী যেহেতু এক রূহানী সফর, যা দ্বারা বান্দা ধাপে ধাপে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যের স্তরসমূহ অতিক্রম করে থাকে, তাই এর জন্যও পরিবেশ অনুকূল ও শরীর-মন চাঙ্গা থাকা দরকার, যা এ তিন সময় হয়ে থাকে। ফলে এ সময়ের ইবাদত-বন্দেগীতে অনেক বেশি আস্বাদ পাওয়া যায় এবং এতে করে রূহানী সফর আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। এ কারণেই বিশেষভাবে ওই তিন সময়কে বেছে নিতে বলা হয়েছে।

বুখারী শরীফের অপর যে বর্ণনাটি এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তার শেষবাক্য হচ্ছে- وَالْقَصْدَ الْقَصْدَ تَبْلُغُوا মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে'। অর্থাৎ তোমরা যদি মধ্যপন্থা রক্ষা করে আমল করতে থাক, তবে এই "ইবাদত-বন্দেগীতে নিরবচ্ছিন্ন থাকতে পারবে। ফলে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টিলাভে সক্ষম হবে, যা কিনা মু'মিন বান্দার পরম লক্ষ্যবস্তু।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দীন যেহেতু সহজ, তাই সহজভাবেই তার অনুসরণ বাঞ্ছনীয়। অহেতুক বাড়াবাড়ি করে কোনও আমলকে কঠিন করে তোলা উচিত নয়।

খ. নফল ইবাদত যতটুকু নিয়মিতভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে হবে ততটুকুই ধরা উচিত, তার বেশি নয়।

গ. ইবাদতে মধ্যপন্থা রক্ষায় সচেষ্ট থাকা উচিত। কোনও ক্ষেত্রে তা পুরোপুরি রক্ষা করতে না পারলেও সতর্ক থাকা উচিত যাতে বেশি দূরে সরে যাওয়া না হয়।

ঘ. ইবাদতকারীর মনে আশা রাখা উচিত যে, আল্লাহ নিজ মেহেরবানীতে তা কবুল করবেন এবং তার প্রতিশ্রুত ছাওয়াব ও প্রতিদানও নিজ রহমতে দান করবেন।

ঙ. হাদীছে বর্ণিত তিনটি সময়ের ব্যাপারে বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত, যাতে এ সময়ের করণীয় 'ইবাদত অবশ্যই আদায় করা হয় এবং কিছুতেই গাফলাতি না হয়ে যায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান