রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
৭. রোগীর শুশ্রূষা ও মাইয়্যেতের প্রতি কর্তব্য
হাদীস নং: ৯১৩
পরিচ্ছেদ:৬ রোগীর এ কথা বলার বৈধতা যে, আমি অসুস্থ বা প্রচণ্ড অসুস্থ অথবা আমি জ্বরে ভুগছি কিংবা আহা! আমার মাথা গেল ইত্যাদি। ক্ষোভ ও অস্থিরতা প্রকাশের জন্য না হলে এরূপ বলায় কোনও দোষ না থাকা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোগের তীব্রতা
হাদীছ নং: ৯১৩
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. বলেন, একবার আমি নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি জ্বরে ভুগছিলেন। আমি তাঁর গায়ে হাত রাখলাম। বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছেন। তিনি বললেন, হাঁ, আমি তোমাদের মতো দু'জনের সমান জ্বরে ভুগছি। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৫৬৪৮; সহীহ মুসলিম: ২৫৭১: মুসনাদে আহমাদ: ৩৬১৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১০৮০০; সুনানে দারিমী: ২৮১৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৫১৬৪: তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ২২০৯; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৯৩৭)
হাদীছ নং: ৯১৩
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. বলেন, একবার আমি নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি জ্বরে ভুগছিলেন। আমি তাঁর গায়ে হাত রাখলাম। বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছেন। তিনি বললেন, হাঁ, আমি তোমাদের মতো দু'জনের সমান জ্বরে ভুগছি। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৫৬৪৮; সহীহ মুসলিম: ২৫৭১: মুসনাদে আহমাদ: ৩৬১৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১০৮০০; সুনানে দারিমী: ২৮১৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৫১৬৪: তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ২২০৯; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৯৩৭)
باب جواز قول المريض: أنَا وجع، أَوْ شديد الوجع أَوْ مَوْعُوكٌ أَوْ وارأساه ونحو ذلك. وبيان أنَّه لا كراهة في ذلك إِذَا لَمْ يكن عَلَى سبيل التسخط وإظهار الجزع
913 - عن ابن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: دَخَلْتُ عَلَى النَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - وَهُوَ يُوعَكُ، فَمَسَسْتُهُ، فَقلتُ: إنَّكَ لَتُوعَكُ وَعَكًا شَديدًا، فَقَالَ: «أجَلْ، إنِّي أُوعَكُ كَمَا يُوعَكُ رَجُلانِ مِنْكُمْ». متفقٌ عَلَيْهِ (1).
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যন্ত প্রিয় ও ঘনিষ্ঠ সাহাবী ছিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতার খবর পেয়ে তিনি তাঁকে দেখতে আসেন। এসে তাঁর গায়ে হাত রাখেন। এটা রোগী দেখার আদব। মমতাভরে তার কপালে বা হাতে হাত রাখা চাই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তাই করতেন, যেমন বিভিন্ন হাদীছে এসেছে।
হযরত ইবন মাসউদ রাযি. হাত দিয়ে দেখেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীর খুব গরম। তিনি বললেন, আপনার তো প্রচণ্ড জ্বর! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানালেন, তাঁর জ্বরের মাত্রা অন্যান্য লোকের দু'জনের সমান। এখানে হাদীছটি এতটুকুই আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনানুযায়ী হাদীছটি আরও দীর্ঘ। তাতে এর পরে আছে-
قلت: ذلك أن لك أجرين؟ قال: ((أجل، ذلك كذلك، ما من مسلم يصيبه أذى، شوكة فما فوقها إلا كفر الله بها سيئاته، وحُطت عنه ذنوبه كما تَحُطُّ الشجرةُ ورقها))
'বললাম, তা কি এজন্য যে, আপনার দ্বিগুণ ছাওয়াব লাভ হবে? তিনি বললেন, হাঁ, তা এরকমই। কোনও মুসলিম ব্যক্তি যে-কোনও কষ্ট ভোগ করে, তা কাঁটা বিঁধা বা তার বেশি কষ্টদায়ক কিছু হোক না কেন, সে কারণে আল্লাহ অবশ্যই তার পাপ মোচন করেন। আর তার গুনাহসমূহ ঝরে পড়ে, যেমন গাছ তার পাতা ঝেরে ফেলে'।
অর্থাৎ হযরত ইবন মাস'উদ রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত্বনা দিতে চাচ্ছিলেন। সেজন্যই তিনি ছাওয়াবের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। প্রশ্নের ভঙ্গিতে বলেছেন যে, আপনার জ্বর এতবেশি হয় কি এ কারণে যে, আপনাকে দ্বিগুণ এ ছাওয়াব দেওয়া হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা স্বীকার করলেন। অসুখ- বিসুখ ও বালা-মসিবত দ্বারা যে নবীগণকে দ্বিগুণ ছাওয়াব দেওয়া হয়, তা অপর এক হাদীছে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে-
إِنَّا كَذَلِكَ مَعْشَرَ الْأَنْبِيَاءِ، يُضَاعَفُ عَلَيْنَا الْوَجَعُ لَيُضَاعَفُ لَنَا الْأَجْرُ
'আমরা নবীদের জামাত। আমাদেরকে দ্বিগুণ প্রতিদান দেওয়ার জন্য আমাদের অসুখ-বিসুখ দ্বিগুণ দেওয়া হয়ে থাকে’।
(হাকিম, আল-মুস্তাদরাক: ৭৮৪৮; মুসনাদুল বাযযার: ১৬৫৩; জামে' মামার ইবন রাশিদ: ২০৬২৬)
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোগ-ব্যাধির তীব্রতা সম্পর্কে বলেন-
مَا رَأَيْتُ رَجُلًا أَشَدَّ عَلَيْهِ الْوَجَعُ مِنْ رَسُولِ الله صلى الله عليه وسلم
'আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে তীব্র রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে অন্য কাউকে দেখিনি’।
(সহীহ বুখারী: ৫৬৪৬; সহীহ মুসলিম: ২৫৭০; জামে তিরমিযী: ২৩৯৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৬২৩; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৭০৫০; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৯১৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৭৩৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৪৩৪)
রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ফযীলত
আলোচ্য হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুখ-বিসুখের ফযীলত বয়ান করেন যে, তাতে গুনাহ মাফ হয়। গুনাহ মাফের বিষয়টিকে তিনি গাছের পাতা ঝরে পড়ার সঙ্গে তুলনা করলেন। সাধারণত শীতকালে গাছের পাতা ঝরে যায়। তাতে গাছ একদম ন্যাড়া হয়ে যায়। একটি পাতাও থাকে না। এ তুলনা দ্বারা বোঝানো হচ্ছে, অসুখ-বিসুখেও সমস্ত পাপ মোচন হয়ে যায়, একটিও বাকি থাকে না। যেমন এক হাদীছে আছে-
حَتَّى يَمْشِيَ عَلَى الْأَرْضِ وَ مَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ
'ফলে ভূপৃষ্ঠে সে বিচরণ করে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ অবস্থায়’। (জামে' তিরমিযী: ২২৯৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪০২২; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ১৪৮১)
অবশ্য অন্যান্য হাদীছ দ্বারা জানা যায়, এর দ্বারা সগীরা গুনাহ বোঝানো উদ্দেশ্য, যেহেতু কবীরা গুনাহ মাফের জন্য তাওবা প্রয়োজন। আর বান্দার হক মাফের জন্যে বান্দার পক্ষ থেকে ক্ষমালাভও জরুরি।
অসুখ-বিসুখ দ্বারা যখন গুনাহ মাফ হয়, তখন বোঝা যাচ্ছে মুমিন বান্দাদের প্রতি এটা আল্লাহ তা'আলার এক রহমত। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের গুনাহ মাফ করা ও বাড়তি ছাওয়াব দেওয়ার উদ্দেশ্যেই রোগ-ব্যাধি দিয়ে থাকেন। তাই রোগ-ব্যাধি হলে ধৈর্যহারা হওয়া উচিত নয়। আরোগ্যলাভের জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করা হবে বটে, কিন্তু যতদিন না আরোগ্য লাভ হচ্ছে ততোদিন পর্যন্ত অবশ্যই ধৈর্য রক্ষা করতে হবে। ধৈর্যধারণ করা সহজ হয়ে যাবে যদি রোগ-ব্যাধির ছাওয়াব ও ফযীলতের দিকে নজর রাখা হয়। অসুস্থ অবস্থায় চিন্তা করতে হবে যে, আল্লাহ তা'আলা আমাকে পরীক্ষা করছেন। তিনি লক্ষ রাখছেন আমি কতটুকু সবর করছি। সবর করতে পারলে আমার গুনাহ মাফ হবে। বিপুল ছাওয়াবও পাব। অসুখ-বিসুখ কঠিন হলে ভাবতে হবে, যে বান্দা আল্লাহ তা'আলার যতবেশি ঘনিষ্ঠ, অসুখ-বিসুখ ও বালা-মুসিবত দিয়ে তার পরীক্ষাও ততো কঠিন নেওয়া হয়ে থাকে।
বস্তুত আল্লাহ তা'আলার ঘনিষ্ঠ বান্দাদের মধ্যেও শ্রেণিভেদ আছে। তাদের মধ্যে যারা প্রতিদান ও পুণ্যের দিকে তাকায়, তাদের কাছে কঠিন পরীক্ষাও সহজ হয়ে যায়। প্রতিদান ও পুণ্যের প্রতি লক্ষ করার কারণে তাদের হিম্মত ও মনোবল বেড়ে যায়। মনে জোর থাকলে কঠিন শারীরিক কষ্টও সহ্য করা সহজ হয়। যারা আরও উচ্চস্তরের এবং মনে করে সে নিজে আল্লাহর মালিকানাধীন আর মালিক তার মালিকানাধীন বস্তুতে যা মন তাই করতে পারেন, তাদের প্রাণশক্তি থাকে আরও বলিষ্ঠ। ফলে তাদের কাছে বালা-মসিবত সহ্য করা আরও বেশি সহজ হয়ে থাকে। তাদেরচে' উচ্চস্তরের হল ওইসকল লোক, যারা আল্লাহপ্রেমে নিমজ্জিত থাকার কারণে বিপদ-আপদের কষ্টের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না। যারা মর্যাদার সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করেন, তাদের ভাবধারা সম্পূর্ণই স্বতন্ত্র। তারা চিন্তা করেন অসুখ-বিসুখ ও বালা-মসিবত আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। আল্লাহ তা'আলার ইশক ও মহাব্বতে বিভোর থাকায় তারা নিজ ইচ্ছার উপর আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাকেই প্রধান্য দেন, বরং প্রাণাধিক প্রাধান্য দিতে আনন্দবোধ করেন। ফলে অসুখ-বিসুখ তাদের কাছে কষ্টের বিষয় নয়। বরং আত্মিক সুখের কারণ হয়ে থাকে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্দাদের মধ্যে শামিল করে নিন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক . এ হাদীছ দ্বারা রোগ-ব্যাধিতে সবরের ফযীলত জানা গেল।
খ. আরও জানা গেল, যে ব্যক্তি আল্লাহর যত প্রিয় তার পরীক্ষাও ততবেশি কঠিন।
গ. রোগ-ব্যাধি দ্বারা যেমন গুনাহ মাফ হয়, তেমনি মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। নবীগণের রোগ-ব্যাধি দ্বারা তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেত।
ঘ. রোগ-ব্যাধির ফযীলতের প্রতি লক্ষ করলে মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং সবর করা সহজ হয়ে যায়।
ঙ. রোগীর কাছে উপস্থিত হয়ে মমতার সঙ্গে তার কপালে বা হাতে হাত রাখা উচিত।
চ. রোগীকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তার সামনে রোগ-ব্যাধির ফযীলত বয়ান করা চাই।
হযরত ইবন মাসউদ রাযি. হাত দিয়ে দেখেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীর খুব গরম। তিনি বললেন, আপনার তো প্রচণ্ড জ্বর! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানালেন, তাঁর জ্বরের মাত্রা অন্যান্য লোকের দু'জনের সমান। এখানে হাদীছটি এতটুকুই আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনানুযায়ী হাদীছটি আরও দীর্ঘ। তাতে এর পরে আছে-
قلت: ذلك أن لك أجرين؟ قال: ((أجل، ذلك كذلك، ما من مسلم يصيبه أذى، شوكة فما فوقها إلا كفر الله بها سيئاته، وحُطت عنه ذنوبه كما تَحُطُّ الشجرةُ ورقها))
'বললাম, তা কি এজন্য যে, আপনার দ্বিগুণ ছাওয়াব লাভ হবে? তিনি বললেন, হাঁ, তা এরকমই। কোনও মুসলিম ব্যক্তি যে-কোনও কষ্ট ভোগ করে, তা কাঁটা বিঁধা বা তার বেশি কষ্টদায়ক কিছু হোক না কেন, সে কারণে আল্লাহ অবশ্যই তার পাপ মোচন করেন। আর তার গুনাহসমূহ ঝরে পড়ে, যেমন গাছ তার পাতা ঝেরে ফেলে'।
অর্থাৎ হযরত ইবন মাস'উদ রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত্বনা দিতে চাচ্ছিলেন। সেজন্যই তিনি ছাওয়াবের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। প্রশ্নের ভঙ্গিতে বলেছেন যে, আপনার জ্বর এতবেশি হয় কি এ কারণে যে, আপনাকে দ্বিগুণ এ ছাওয়াব দেওয়া হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা স্বীকার করলেন। অসুখ- বিসুখ ও বালা-মসিবত দ্বারা যে নবীগণকে দ্বিগুণ ছাওয়াব দেওয়া হয়, তা অপর এক হাদীছে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে-
إِنَّا كَذَلِكَ مَعْشَرَ الْأَنْبِيَاءِ، يُضَاعَفُ عَلَيْنَا الْوَجَعُ لَيُضَاعَفُ لَنَا الْأَجْرُ
'আমরা নবীদের জামাত। আমাদেরকে দ্বিগুণ প্রতিদান দেওয়ার জন্য আমাদের অসুখ-বিসুখ দ্বিগুণ দেওয়া হয়ে থাকে’।
(হাকিম, আল-মুস্তাদরাক: ৭৮৪৮; মুসনাদুল বাযযার: ১৬৫৩; জামে' মামার ইবন রাশিদ: ২০৬২৬)
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোগ-ব্যাধির তীব্রতা সম্পর্কে বলেন-
مَا رَأَيْتُ رَجُلًا أَشَدَّ عَلَيْهِ الْوَجَعُ مِنْ رَسُولِ الله صلى الله عليه وسلم
'আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে তীব্র রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে অন্য কাউকে দেখিনি’।
(সহীহ বুখারী: ৫৬৪৬; সহীহ মুসলিম: ২৫৭০; জামে তিরমিযী: ২৩৯৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৬২৩; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৭০৫০; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৯১৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৭৩৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৪৩৪)
রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ফযীলত
আলোচ্য হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুখ-বিসুখের ফযীলত বয়ান করেন যে, তাতে গুনাহ মাফ হয়। গুনাহ মাফের বিষয়টিকে তিনি গাছের পাতা ঝরে পড়ার সঙ্গে তুলনা করলেন। সাধারণত শীতকালে গাছের পাতা ঝরে যায়। তাতে গাছ একদম ন্যাড়া হয়ে যায়। একটি পাতাও থাকে না। এ তুলনা দ্বারা বোঝানো হচ্ছে, অসুখ-বিসুখেও সমস্ত পাপ মোচন হয়ে যায়, একটিও বাকি থাকে না। যেমন এক হাদীছে আছে-
حَتَّى يَمْشِيَ عَلَى الْأَرْضِ وَ مَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ
'ফলে ভূপৃষ্ঠে সে বিচরণ করে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ অবস্থায়’। (জামে' তিরমিযী: ২২৯৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪০২২; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ১৪৮১)
অবশ্য অন্যান্য হাদীছ দ্বারা জানা যায়, এর দ্বারা সগীরা গুনাহ বোঝানো উদ্দেশ্য, যেহেতু কবীরা গুনাহ মাফের জন্য তাওবা প্রয়োজন। আর বান্দার হক মাফের জন্যে বান্দার পক্ষ থেকে ক্ষমালাভও জরুরি।
অসুখ-বিসুখ দ্বারা যখন গুনাহ মাফ হয়, তখন বোঝা যাচ্ছে মুমিন বান্দাদের প্রতি এটা আল্লাহ তা'আলার এক রহমত। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের গুনাহ মাফ করা ও বাড়তি ছাওয়াব দেওয়ার উদ্দেশ্যেই রোগ-ব্যাধি দিয়ে থাকেন। তাই রোগ-ব্যাধি হলে ধৈর্যহারা হওয়া উচিত নয়। আরোগ্যলাভের জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করা হবে বটে, কিন্তু যতদিন না আরোগ্য লাভ হচ্ছে ততোদিন পর্যন্ত অবশ্যই ধৈর্য রক্ষা করতে হবে। ধৈর্যধারণ করা সহজ হয়ে যাবে যদি রোগ-ব্যাধির ছাওয়াব ও ফযীলতের দিকে নজর রাখা হয়। অসুস্থ অবস্থায় চিন্তা করতে হবে যে, আল্লাহ তা'আলা আমাকে পরীক্ষা করছেন। তিনি লক্ষ রাখছেন আমি কতটুকু সবর করছি। সবর করতে পারলে আমার গুনাহ মাফ হবে। বিপুল ছাওয়াবও পাব। অসুখ-বিসুখ কঠিন হলে ভাবতে হবে, যে বান্দা আল্লাহ তা'আলার যতবেশি ঘনিষ্ঠ, অসুখ-বিসুখ ও বালা-মুসিবত দিয়ে তার পরীক্ষাও ততো কঠিন নেওয়া হয়ে থাকে।
বস্তুত আল্লাহ তা'আলার ঘনিষ্ঠ বান্দাদের মধ্যেও শ্রেণিভেদ আছে। তাদের মধ্যে যারা প্রতিদান ও পুণ্যের দিকে তাকায়, তাদের কাছে কঠিন পরীক্ষাও সহজ হয়ে যায়। প্রতিদান ও পুণ্যের প্রতি লক্ষ করার কারণে তাদের হিম্মত ও মনোবল বেড়ে যায়। মনে জোর থাকলে কঠিন শারীরিক কষ্টও সহ্য করা সহজ হয়। যারা আরও উচ্চস্তরের এবং মনে করে সে নিজে আল্লাহর মালিকানাধীন আর মালিক তার মালিকানাধীন বস্তুতে যা মন তাই করতে পারেন, তাদের প্রাণশক্তি থাকে আরও বলিষ্ঠ। ফলে তাদের কাছে বালা-মসিবত সহ্য করা আরও বেশি সহজ হয়ে থাকে। তাদেরচে' উচ্চস্তরের হল ওইসকল লোক, যারা আল্লাহপ্রেমে নিমজ্জিত থাকার কারণে বিপদ-আপদের কষ্টের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না। যারা মর্যাদার সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করেন, তাদের ভাবধারা সম্পূর্ণই স্বতন্ত্র। তারা চিন্তা করেন অসুখ-বিসুখ ও বালা-মসিবত আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। আল্লাহ তা'আলার ইশক ও মহাব্বতে বিভোর থাকায় তারা নিজ ইচ্ছার উপর আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাকেই প্রধান্য দেন, বরং প্রাণাধিক প্রাধান্য দিতে আনন্দবোধ করেন। ফলে অসুখ-বিসুখ তাদের কাছে কষ্টের বিষয় নয়। বরং আত্মিক সুখের কারণ হয়ে থাকে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্দাদের মধ্যে শামিল করে নিন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক . এ হাদীছ দ্বারা রোগ-ব্যাধিতে সবরের ফযীলত জানা গেল।
খ. আরও জানা গেল, যে ব্যক্তি আল্লাহর যত প্রিয় তার পরীক্ষাও ততবেশি কঠিন।
গ. রোগ-ব্যাধি দ্বারা যেমন গুনাহ মাফ হয়, তেমনি মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। নবীগণের রোগ-ব্যাধি দ্বারা তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেত।
ঘ. রোগ-ব্যাধির ফযীলতের প্রতি লক্ষ করলে মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং সবর করা সহজ হয়ে যায়।
ঙ. রোগীর কাছে উপস্থিত হয়ে মমতার সঙ্গে তার কপালে বা হাতে হাত রাখা উচিত।
চ. রোগীকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তার সামনে রোগ-ব্যাধির ফযীলত বয়ান করা চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
