রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

৭. রোগীর শুশ্রূষা ও মাইয়্যেতের প্রতি কর্তব্য

হাদীস নং: ৯১২
পরিচ্ছেদ:৫ রোগীর প্রতি তার পরিবারবর্গ ও তার খাদেমদেরকে তার প্রতি সদয় ব্যবহার, সহনশীলতা প্রদর্শন এবং তার যেসব বিষয় কষ্টদায়ক তাতে সবর করার উপদেশদান; এমনিভাবে হদ্দ, কিসাস ইত্যাদির মাধ্যমে যার মৃত্যুর কারণ নিকটবর্তী তার প্রতি সদয় আচরণের উপদেশ
জুহায়না গোত্রের এক নারীর ব্যভিচার ও তার অকল্পনীয় অনুতাপ
হাদীছ নং: ৯১২

হযরত ইমরান ইবনুল হুসায়ন রাযি. থেকে বর্ণিত, জুহায়না গোত্রের এক নারী ব্যভিচার দ্বারা গর্ভবতী অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসল। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হদ্দযোগ্য অপরাধে লিপ্ত হয়েছি। আপনি আমার উপর তা জারি করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অভিভাবককে ডেকে বললেন, তুমি এর প্রতি সদয় আচরণ করো। সন্তান প্রসব করার পর তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। সে তাই করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশে তার গায়ের কাপড় তার উপর শক্ত করে বাঁধা হল। তারপর তার আদেশে তাকে রজম করা হল। তারপর তিনি তার জানাযার নামায পড়লেন। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ১৬৯৬; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৪৪০; জামে তিরমিযী: ১৪৩৫; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৪২৭; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৪৪১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৪৭৫; সুনানে দারা কুতনী: ৩১৬০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৬৯৬৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৫৮৮)
باب استحباب وصية أهل المريض ومن يخدمه بالإحسان إليه واحتماله والصبر عَلَى مَا يشق من أمره وكذا الوصية بمن قرب سبب موته بحد أَوْ قصاص ونحوهما
912 - عن عِمْران بن الحُصَيْنِ رضي الله عنهما: أنَّ أمْرَأَةً مِنْ جُهَيْنَةَ أتَت النَّبِيَّ - صلى الله عليه وسلم - وَهِيَ حُبْلَى مِنَ الزِّنَا، فَقَالَتْ: يَا رسول الله، أصَبْتُ حَدًّا فَأقِمْهُ عَلَيَّ، فَدَعَا رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - وَلِيَّهَا، [ص:277] فَقَالَ: «أحْسِنْ إِلَيْهَا، فَإذَا وَضَعَتْ فَأتِنِي بِهَا» فَفَعَلَ، فَأمَرَ بِهَا النَّبِيُّ - صلى الله عليه وسلم - فَشُدَّتْ عَلَيْهَا ثِيَابُهَا، ثُمَّ أمَرَ بِهَا فَرُجِمَت، ثُمَّ صَلَّى عَلَيْهَا. رواه مسلم. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

আরবের বিখ্যাত জুহায়না গোত্রের এক নারী ব্যভিচার করে ফেলে। তাতে সে গর্ভবতী হয়ে যায়। এ অবস্থায় তার চৈতন্যোদয় হয়। তিনি ছিলেন এক নারী সাহাবী। আল্লাহ তা'আলার প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল। বিশ্বাস ছিল আখিরাতের বিচার ও জান্নাত-জাহান্নামের উপর। শয়তানের ধোঁকায় ও নফসের প্ররোচনায় পাপকর্ম করে ফেললেও পরে তাঁর ঈমানী চেতনা জাগ্রত হয়ে ওঠে। তিনি ভীষণ ভয় পেয়ে যান। এ অবস্থায় মৃত্যু হলে না জানি আখিরাতে কী কঠিন দুর্ভোগ পোহাতে হয়! সে দুর্ভোগ থেকে বাঁচা দরকার। তাঁর জানা ছিল দুনিয়ায় এ পাপকর্মের সুনির্দিষ্ট শাস্তি আছে। সে শাস্তি হল বিবাহিতা হয়ে থাকলে পাথর মেরে হত্যা করা। অবিবাহিতা হলে ১০০টি বেত্রাঘাত। এই নারী বিবাহিতা ছিলেন। তিনি জানতেন তাঁর শাস্তি হল পাথর মেরে মেরে হত্যা করে ফেলা। বড় কঠিন শাস্তি। তা যতই কঠিন হোক না কেন, আখিরাতের শাস্তি আরও বেশি কঠিন। সে শাস্তির তুলনায় দুনিয়ার শাস্তি অনেক সহজ। যদি এ শাস্তি ভোগ করার মাধ্যমে আখিরাতের শাস্তি থেকে নাজাত পাওয়া যায়, তবে তা অনেক ভালো। সুতরাং তিনি ইহকালীন শাস্তিভোগের মাধ্যমে আখিরাতের শাস্তি থেকে নাজাত পাওয়ার আশায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে আসলেন। এসে বললেন–
يَا رَسُوْلَ اللَّهِ، أَصَبْتُ حَدًّا فَأَقِمْهُ عَلَيَّ (ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হদ্দযোগ্য অপরাধে লিপ্ত হয়েছি। আপনি আমার উপর তা জারি করুন)। অর্থাৎ আমি ব্যভিচার করে ফেলেছি। সুতরাং ব্যভিচারের নির্ধারিত শাস্তি আমার উপর আরোপ করুন। 'হদ্দ-এর অর্থ শরী'আতকর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি। বহুবচনে 'হুদূদ'। যেমন চুরির শাস্তি হাত কেটে ফেলা, ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়ার শাস্তি ৮০টি বেত্রাঘাত ইত্যাদি। আর বিচারক যে শাস্তি নিজ বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করে, তাকে বলা হয় তা’যীর। তো এই নারী স্বেচ্ছায় নিজ অপরাধের কথা স্বীকার করে তাঁর উপর হদ্দ আরোপের দাবি করছেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করে আনা হয়নি। কেউ তাঁর অপরাধের কথা জানাত না। নিজে এসে ধরা দিয়েছেন। শাস্তি পেতে চাইছেন। বড় কঠিন ব্যাপার। মানুষ অপরাধ করে গা ঢাকা দেয়। শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়। আর ইনি কিনা স্বেচ্ছায় এসে নিজের প্রতি শাস্তি আরোপের দাবি করছেন। হাঁ, এটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার সুফল। পরিকল্পিতভাবে পাপকর্ম করার কথা না হয় বাদই দিলাম। ক্ষনিকের উত্তেজনাবশে পাপকর্ম অনেকেই করে। কিন্তু হুঁশ ফিরে পাওয়ার পর সেজন্য শাস্তি মাথা পেতে নিতে চায় ক'জন? যে পাপকর্মের কথা প্রকাশ পায় না, সেজন্য খাঁটিমনে তাওবা করার দ্বারাই ক্ষমা পাওয়ার আশা থাকে। কিন্তু এই নারীসাহাবী তারে সন্তুষ্ট নন। তিনি কঠোর-কঠিন শাস্তি বরণ করে নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন। তাতে কতখানি আত্মগ্লানি বোধ হলে এটা সম্ভব। না জানি কী গভীর অনুতাপ তখন তাঁর অন্তরে জেগেছিল! এটা প্রমাণ করে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার তাঁর অন্তরে ঈমান কী পরিমাণ আবাদ হয়েছিল। নিজেকে সংশোধন ও পবিত্র করার এ ব্যাকুলতা সেই ঈমানী পরিপূর্ণতারই পরিচায়ক নয় কি? সমাজচোখে নিজের ইজ্জত- সম্মান ভূলুণ্ঠিত হবে, পাথরের আঘাতে আঘাতে শরীর ক্ষত-বিক্ষত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে, দুর্বিষহ কষ্টের সঙ্গে মৃত্যু ঘটবে, এর কোনওকিছুরই তিনি তোয়াক্কা করছেন না। তাঁর সোজাসাপ্টা কথা- "ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হদ্দযোগ্য অপরাধ করেছি। আপনি আমার উপর তা জারি করুন"। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বারবার এসে একই অনুরোধ জানাতে থাকেন। পরিশেষে তিনি তাঁর অভিভাবককে ডাকেন। তাকে হুকুম দিলেন-
أَحْسِنُ إِلَيْهَا، فَإِذَا وَضَعَتْ فَأْتِنِي بِهَا (তুমি এর প্রতি সদয় আচরণ করো। সন্তান প্রসব করার পর তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে)। রহমতের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে নারীকে তার অভিভাবকের হাতে তুলে দিলেন। কারণ তিনি গর্ভবতী। এ অবস্থায় তার উপর শাস্তি কার্যকর করা যাবে না। তার গর্ভের সন্তানটিকে বাঁচাতে হবে। তার তো কোনও দোষ নেই। মায়ের দোষের কারণে তাকে শাস্তি দেওয়া যায় না। কাজেই তার জন্ম না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিভাবককে হুকুম দিলেন যেন সে ওই নারীর যত্ন নেয়, তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। এ হুকুম নবী কারীম সাল্লাল্লাছ আলাইহি ওয়াসাল্লামের গভীর মমত্ববোধের পরিচয় বহন করে। কেননা আশঙ্কা ছিল অভিভাবক এ নারীর প্রতি মন্দ আচরণ করবে। কথায় ও কাজে তাকে কষ্ট দেবে। কারণ তার দ্বারা অভিভাবক ও তার বংশের মান-সম্মান নষ্ট হয়েছে। সে এক অবৈধ সন্তানের জন্ম দিয়ে স্থায়ীভাবে তাদের মুখে চুনকালি মাখিয়েছে। এখন সে সন্তান প্রসব না কর পর্যন্ত তাদের মধ্যে অবস্থান করবে। তাদেরকে তার কদর্য মুখ দেখে যেতে হবে। এভাবে দিনের পর দিন তাকে সহ্য করে যাওয়া তাদের পক্ষে হয়তো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ফলে তারা অব্যাহতভাবে তাকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা করতে থাকবে। তা যাতে করতে না পারে, সেজন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অভিভাবকরে সতর্ক করে দিলেন।

সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত একটা দীর্ঘ সময়। এ সময়ের ভেতর অভিভাবকের মন ঘুরে যেতে পারে। তার মায়া লেগে যেতে পারে। ফলে সে হয়তো ওই নারীকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। তাকে লুকাতে চাইবে। কিন্তু এখন আর এসব করার কোনও অবকাশ নেই। কেননা স্বীকারোক্তি দ্বারা তার অপরাধ সাব্যস্ত হয়ে গেছে। এখন শাস্তিই তার প্রাপ্য। বিচারকের কর্তব্য তার উপর শরী'আতের শাস্তি আরোপ করা। অভিভাবকদেরও কর্তব্য তাতে সহযোগিতা করা। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুকুম দেন যেন সন্তানপ্রসবের পর সে তাকে নিয়ে আসে।

যাহোক সন্তান প্রসবের পর তাকে নিয়ে আসা হল। কিন্তু এবারও শান্তি কার্যকর করা হল না। কেননা শিশুটির কেবল জন্ম হয়েছে। তাকে দুধপান করাতে হবে। তার যত্ন নিতে হবে। এসব কাজ মায়ের মতো আর কার পক্ষে করা সম্ভব? সুতরাং অন্যান্য বর্ণনায় আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুকুম দিলেন যেন তিনি তার সন্তানকে দুধপান করাতে থাকেন এবং দুধপানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এসে হাজিরা দেন। আল্লাহভীরু সে নারী তাই করলেন। দীর্ঘ দু'বছর তাকে দুধপান করাতে থাকলেন। এটাই শিশুকে দুধপান করানোর মেয়াদ।

শিশুটির দুধপানের মেয়াদ শেষ হল। তারপর সে নারী স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে তার সন্তানকে নিয়ে হাজির হলেন। আল্লাহু আকবার! কী বলিষ্ঠ ঈমান! এ দীর্ঘ সময়েও দুনিয়ার মায়া তাকে তার প্রতিজ্ঞা থেকে টলাতে পারেনি। কৃত অপরাধের শাস্তি তিনি গ্রহণ করবেনই- যদি সে অছিলায় আখিরাতের শাস্তি থেকে নাজাত পাওয়া যায়! কিন্তু তার বাচ্চাটির কী হবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কে এ বাচ্চাটির লালন-পালনের দায়িত্ব নেবে? এক আনসারী সাহাবী উঠে বললেন, আমি। তিনি শিশুটিকে নিজ দায়িত্বে নিয়ে নিলেন।

এবার শাস্তি কার্যকর করার পালা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে তার শরীরের কাপড়-চোপড় তার উপর ভালোভাবে বেঁধে দেওয়া হল, যাতে শাস্তি আরোপের সময় তার সতর খুলে না যায়। তারপর রজম শুরু হল। তিনি ওযূ করে এসেছিলেন। দেহমনে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহ-অভিমুখী। পাথর ছোঁড়া শুরু হল। তিনি সবর করলেন। আল্লাহ তা'আলার কাছে ক্ষমা পাওয়ার আশায় কঠিন ধৈর্যের পরিচয় দিলেন। পাথর ছোঁড়া হচ্ছে। ফিনকি দিয়ে শরীর থেকে রক্ত ছুটছে। সে রক্ত আশেপাশের কারও কারও গায়েও লেগে যাচ্ছে। তা লেগেছিল হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ রাযি.-এর চেহারায়ও। তাতে তিনি একটা বিরূপ মন্তব্য করে বসলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ক্ষান্ত করলেন। বললেন-
مهلا يا خالد، فوالذي نفسي بيده لقد تابت توبة لو تابها صاحب مكس لغفر له
(থামো হে খালিদ! যাঁর হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার কসম! সে এমনই তাওবা করেছে যে, অনুরূপ তাওবা কোনও (জালেম) তহসিলদারও যদি করত, তবে তাকেও ক্ষমা করে দেওয়া হত)। (সহীহ মুসলিম: ১৬৯৫; সুনানে আবু দাউদ: ৪৪৪২; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৭১৫৯; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৮৮০৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৬৯৬৬)

অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাযার নামায পড়লেন। তখন হযরত উমর রাযি. বলেছিলেন, ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ! আপনি তার জানাযা পড়বেন, অথচ সে ব্যভিচার করেছে? তিনি বললেন-
لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ سَبْعِينَ مِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ لَوَسِعَتْهُمْ, وَهَلْ وَجَدْتَ تَوْبَةً أَفْضَلَ مِنْ أَنْ جَادَتْ بِنَفْسِهَا لِلَّهِ تَعَالَى؟
‘সে এমন তাওবা করেছে, যা মদীনার সত্তরজনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হলে তাদের সকলের গুনাহ মাফ হওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়ে যেত। যে নিজেকে আল্লাহর জন্য বিলিয়ে দিয়েছে, তুমি তার চেয়ে উত্তম তাওবাকারী আর কাউকে পেয়েছ’?
(সহীহ মুসলিম : ১৬৯৬; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৪৪০; জামে তিরমিযী: ১৪৩৫: সুনানে নাসাঈ: ১৯৫৭; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ১৩৩৪৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৮৮১০; সুনানে দারিমী: ২৩৭০; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৪২৭; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৪৪৪২)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কখনও কোনও গুনাহ হয়ে গেলে সেজন্য গভীরভাবে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া উচিত।

খ. প্রকৃত মুমিন পাপের পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য কঠিন থেকে কঠিন শাস্তিও খুশিমনে গ্রহণ করে নেয়।

গ. তাওবার সঙ্গে দুনিয়াবী শাস্তি গ্রহণ করে নিলে পাপের পঙ্কিলতা থেকে পবিত্রতা অর্জিত হয়।

ঘ. বিবাহিত নর-নারী ব্যভিচার করলে তার শাস্তি রজম- পাথর মেরে হত্যা করা।

ঙ. গর্ভবতী নারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য তার সন্তান প্রসব হওয়া, তারপর তার দুধপানের মেয়াদ পূরণের অপেক্ষা করা জরুরি।

চ. ব্যভিচারের দায়ে যার মৃত্যুদণ্ড হয়, তারও জানাযা আদায় করতে হবে।

ইসলামে বিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তি
প্রকাশ থাকে যে, বিবাহিত নর-নারী ব্যভিচার করলে তার শাস্তি যে পাথর মেরে হত্যা করা, এটা ইসলামের এক সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। কেবল এই একটি হাদীছই নয়: বরং বহু হাদীছ দ্বারা এটা প্রমাণিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক ব্যক্তির উপর এ শাস্তি কার্যকর করেছেন। তারপর সাহাবায়ে কেরামের যমানায়ও এটা কার্যকর করা হয়েছে। এর বিধিবদ্ধতা সম্পর্কে সাহাবা, তাবি'ঈন এবং উম্মতের উলামায়ে কেরামের ইজমা' রয়েছে।

কুরআন মাজীদে এ শাস্তির উল্লেখ নেই বলে কেউ কেউ এর উপর আপত্তি তুলেছেন। কিন্তু সে আপত্তি বৃথা। কেননা কুরআন মাজীদের মতো হাদীছও শরী'আতের দলীল। বিশুদ্ধ হাদীছ দ্বারা কোনও বিধান প্রমাণিত হলে কোনও ঈমানদারের জন্য তা প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ নেই। রজমের বিধানটি বিশুদ্ধ হাদীছ দ্বারাই প্রমাণিত।

খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ফারূক রাযি. তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা অনুভব করেছিলেন যে,ভবিষ্যতে এক শ্রেণির লোক এ বিধান অস্বীকার করতে পারে। তাই করে তাঁর জীবনের সর্বশেষ হজ্জের সময় এ সম্পর্কে এক সারগর্ভ ভাষণ দেন। তিনি তাতে বলেন, আজ আমি তোমাদের একটি কথা বলতে চাই। জানি না হয়তো এটাই আমার জীবনের শেষ ভাষণ। যে ব্যক্তি আমার এ কথা বুঝতে পারবে এবং মনেও রাখতে সক্ষম হবে, সে যেন তার বাহন যতদূর পৌঁছায় ততদূর এটা পৌঁছে দেয়। আর যার আশঙ্কা সে আমার এ কথা বুঝতে পারবে না, তার জন্য আমার সম্পর্কে মিথা বলার কোনও বৈধতা নেই। আল্লাহ তা'আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্যসহ পাঠিয়েছিলেন। তাঁর প্রতি কিতাব নাযিল করেছিলেন। আল্লাহ তা'আলা যা নাযিল করেছিলেন তার মধ্যে রজমের আয়াতও ছিল। আমরা তা পড়েছি, বুঝেছি এবং সংরক্ষণ করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে রজম করেছেন এবং তাঁর পর আমরাও রজম করেছি। আমার আশঙ্কা, ভবিষ্যৎকালে কোনও ব্যক্তি বলবে, আমরা আল্লাহর কিতাবে রজমের আয়াত পাই না। এই বলে তারা আল্লাহর নাযিলকৃত একটা বিধান পরিত্যাগ করবে আর এভাবে তারা পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। মনে রাখবে, আল্লাহর কিতাবে রজম একটি সত্য বিধান। বিবাহিত নারী-পুরুষ ব্যভিচার করলে তাদের উপর এ বিধান কার্যকর হবে- যদি তা সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণ হয় বা গর্ভসঞ্চার হয় কিংবা স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়।

হযরত উমর রাযি. রজম সম্পর্কিত যে আয়াতের কথা বলেছেন তা হল-
الشيخ والشَّيْخَةُ إِذَا زَنَيَا فَارْجُمُوهُمَا الْبَتَّةَ
‘বিবাহিত নর-নারী ব্যভিচার করলে তাদেরকে অবশ্যই পাথর মেরে হত্যা করবে’। (সুনানে ইবন মাজাহ: ২৫৫৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৮৭৭৬; মুসনাদুল বাযযার : ২৮৬; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৭১১৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ২০২৫; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৪২৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৮৬৭; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৮০৭১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৬৯১০; মুআত্তা মালিক: ৬৯১; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ১৩৩৬৩)

এ আয়াতটি শব্দগতভাবে রহিত হয়ে গেছে। ফলে কুরআন মাজীদে এর উল্লেখ নেই। কিন্তু এর বিধান বহাল আছে। কুরআন মাজীদে 'রহিতকরণ'-এর বিষয়টি একটি বাস্তব সত্য। পরিভাষায় একে নাস্‌খ বলা হয়। যা রহিত করা হয় তাকে বলা হয় মানসূখ। মানসূখ তিন প্রকার। আয়াতের শব্দ ও দ্বৈত শব্দ রহিত হওয়া বিধান রহিত হওয়া, কিন্তু বিধান বহাল থাকা, রজমের বিধানটি এই তৃতীয় প্রকারের।

হযরত উমর রাযি. যখন এ বক্তব্যটি দিয়েছিলেন, তখন তিনি মিম্বরে উপবিষ্ট ছিলেন। সাহাবীগণ সামনে উপস্থিত ছিলেন। তাদের কেউ তাঁর এ কথার প্রতিবাদ করেননি। এটা তাদের ঐকমত্যের প্রমাণ বহন করে। এভাবে তাদের ঐকমত্য বা ইজমা'র দ্বারাও প্রমাণ হয় যে, বিবাহিত নর-নারী ব্যভিচার করলে তাদের শাস্তি হল রজম করা। পরবর্তীকালীন সকল মুহাদ্দিছ ও ফকীহ এ বিষয়ে একমত। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের অন্তর্ভুক্ত কোনও আলেম কখনও এ বিধান অস্বীকার করেনি।

কেউ কেউ বলে থাকে, জীবিত এক ব্যক্তিকে পাথর মারতে মারতে হত্যা করে ফেলা অত্যধিক কঠিন এক শাস্তি। তারা অমানবিক ঠাওরিয়ে এ বিধানকে অকার্যকর করতে চায়। কিন্তু তাদের এসব কথা বেদীনী চিন্তা-ভাবনাপ্রসূত। আল্লাহ তা'আলার প্রতি যার ঈমান আছে, তার ঈমানের দাবি তো এটাই যে, সে আল্লাহপ্রদত্ত বিধান বিনাবাক্যেই মেনে নেবে। কেননা তার বিশ্বাস মানুষের জন্য কোন বিধান উপযুক্ত ও কল্যাণকর তা মানুষের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন। একটু চিন্তা করলেই বুঝে আসে রজমের বিধান মানুষের জন্য শতভাগ উপযুক্ত ও কল্যাণকর। এ বিধানটি আর কোনও ক্ষেত্রে নয়, কেবল বিবাহিত নর-নারীর ব্যভিচারের বেলায়ই দেওয়া হয়েছে।

ব্যভিচার এমনিতেই এক বিপর্যয়কর অপরাধ। এর দ্বারা মানুষের মান-সম্ভ্রম ভূলুণ্ঠিত হয়, বংশপরিচয় লোপ পায়, সমাজে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার বিস্তার ঘটে, নানা দুরারোগ্য রোগ-ব্যাধি জন্ম নেয়, পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে যায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস দানা বাঁধে, এমনকি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে ও ঘর-সংসার ভেঙ্গে যায়, মানুষের মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ জন্ম নেয় এবং মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ে যায়। দুনিয়ায় বহু খুন-খারাবি ও রক্তপাতের ঘটনা ব্যভিচারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে ও ঘটছে। সুতরাং অন্য যে-কোনও অপরাধের তুলনায় এ অপরাধের কুফল অনেক ব্যাপক ও অনেক দূরবিস্তারি। তাই দুনিয়ার প্রত্যেক ধর্ম এটা নিষিদ্ধ করেছে এবং এর জন্য চরম শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছে।

এই ঘৃণিত ও বিপর্যয়কর কর্মটি স্বভাবগতভাবে কেউ পসন্দ করে না। এমনকি ব্যভিচারী নিজেও এটা কামনা করে না যে, তার মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা বা অন্য কোনও আপনজন এ কর্মটি করুক। কোনও ব্যভিচারিণীও তার পিতা, পুত্র, ভাই বা স্বামীর বেলায় এ কাজটি মেনে নিতে পারে না। একবার এক যুবক নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে ব্যভিচার করার অনুমতি দিন। সে এ কথা বলামাত্র উপস্থিত লোকজন চিৎকার করে উঠল এবং তাকে ধমকাতে শুরু করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে থামিয়ে দিলেন এবং ওই যুবকটিকে কাছে ডাকলেন। সে কাছে এসে তাঁর সামনে বসল। তিনি বললেন, তুমি কি তোমার মায়ের জন্য এটা পসন্দ কর? সে বলল, না। তিনি বললেন, লোকেও অনুরূপ তাদের মায়েদের জন্য এটা পসন্দ করে না। তারপর বললেন, তুমি তোমার মেয়ের জন্য এটা পসন্দ কর? সে বলল, না। তিনি বললেন, লোকেও তাদের মেয়েদের জন্য এটা পসন্দ করে না। তুমি কি তোমার বোনের জন্য এটা পসন্দ কর? সে বলল, না। তিনি বললেন, লোকেও তাদের বোনদের জন্য এটা পসন্দ করে না। তুমি কি তোমার ফুফুর জন্য এটা পসন্দ কর? সে বলল, না। লোকেও তাদের ফুফুদের জন্য এটা পসন্দ করে না। তুমি কি তোমার খালার জন্য এটা পসন্দ কর? সে বলল, না। তিনি বললেন, লোকেও তাদের খালাদের জন্য এটা পসন্দ করে না। তখন সেই যুবক বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার জন্য দু'আ করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বুকে হাত রাখলেন। তারপর বললেন, হে আল্লাহ! তার গুনাহ ক্ষমা করুন, তারা অন্তর পবিত্র করুন এবং তার চরিত্র রক্ষা করুন। এরপর সেই যুবক আর কোনওদিকে ভ্রুক্ষেপ করত না। (মুসনাদে আহমাদ: ২২২১১: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান ৫০৩২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৭৬৭৯)

অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামও ব্যভিচার কঠোরভাবে হারাম ও নিষিদ্ধ করেছে। কুরআন মাজীদের স্পষ্ট হুকুম-
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا
‘এবং ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই তা অশ্লীলতা ও বিপথগামিতা’।
(সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ৩২)

কুরআন মাজীদে এ সম্পর্কে আরও বিভিন্ন আয়াত আছে। বহু হাদীছেও এর কদর্যতা ও গুরুতরতা তুলে ধরা হয়েছে। হাদীছের ভাষ্য অনুযায়ী কোনও মুমিন-মুসলিম ব্যভিচার করতেই পারে না। কখনও কোনও মুমিন এতে লিপ্ত হয়ে পড়লে তখন যেন সে মুমিনই থাকে না। যেন তার ঈমান তার থেকে পৃথক হয়ে যায়। কাজেই প্রত্যেক মুসলিমকে অবশ্যই এর থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এর থেকে বাঁচতে হবে মানুষমাত্রকেই।

মানুষ যাতে এমন ভয়ংকর অপরাধ থেকে বাঁচতে পারে, সে লক্ষ্যে শরী'আত নানা ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। যেমন নর-নারীর অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সতর্ক করা হয়েছে যেন দুই নারী-পুরুষ নির্জন কোনও স্থানে অবস্থান না করে। তারা যেন একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে কথা না বলে, যা দ্বারা একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। নারীকে ঘরের বাইরে খোলামেলাভাবে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। পর্দা ও হিজাব-ব্যবস্থার মাধ্যমে অবাধ মেলামেশার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে এমনসব কার্যকলাপ, যা মানুষের ভেতর ব্যভিচারের উস্কানি সৃষ্টি করতে পারে। যেমন নাচ-গান, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি। সেইসঙ্গে নর-নারী উভয়কে নিজেদের চোখও সংযত রাখতে বলা হয়েছে। চোখকে বলা হয়েছে শয়তানের তির। শয়তান এর দ্বারা নর-নারীকে শিকার করে ব্যভিচারে লিপ্ত করার প্রয়াস পায়।

হাঁ, নর-নারীর মধ্যে রয়েছে পরস্পরের প্রতি স্বভাবগত আকর্ষণ। সৃষ্টিগতভাবেই উভয়ের মধ্যে রাখা হয়েছে শারীরিক চাহিদা। সে চাহিদা পূরণের জন্য বিবাহের এক শুদ্ধ ও পবিত্র ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে। সে ব্যবস্থাটিকেও করা হয়েছে অত্যন্ত সহজ ও সুসাধ্য। এসব করা হয়েছে এ উদ্দেশ্যে, যাতে কেউ বৈধ পন্থা ছেড়ে অবৈধ পন্থায় চাহিদা মেটানোর পথ না খোঁজে।

এতদসত্ত্বেও যদি কেউ চরম ঘৃণিত ও জঘন্যতম এ কর্মে লিপ্ত হয়, তবে তো সে কঠিনতম শাস্তির উপযুক্ত হবেই। আবার তা যদি করে কোনও বিবাহিত নর-নারী, তবে বুঝতে হবে তারা তাদের স্বভাব-চরিত্র সম্পূর্ণ বিকৃত করে ফেলেছে। এরকম বিকৃত যৌনাচারী সমাজের জন্য দুরারোগ্য ব্যাধির মতো। তাকে ছাটাই করা জরুরি। এমনভাবে ছাটাই করা উচিত, যা দ্বারা সমাজের অন্যসব লোকও সতর্ক হয়ে যায়। যাতে আর কেউ এরূপ জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হতে সাহস না করে। সেজন্যই হুকুম দেওয়া হয়েছে। রজমের শাস্তি গোপনে নয়; বরং যেন লোকসম্মুখে দেওয়া হয়। লোকসম্মুখে দেওয়া হলে অন্যরা শিক্ষা পাবে এবং সকলের কাছে বার্তা পৌছে যাবে যে, বৈধ পন্থা ছেড়ে অবৈধ পন্থায় চাহিদা মেটানোর পরিণাম এমনই ভয়াবহ হয়ে থাকে।

রজমের শাস্তি কার্যকর করার এখতিয়ার কার এবং কখন
উল্লেখ্য, রজমের এ শাস্তি কেবল বৈধ কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তিই কার্যকর করতে পারে। অর্থাৎ এটা রাষ্ট্রের কাজ। কোনও অভিভাবক, মুফতী, সমাজপতি এবং এমনিভাবে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে না এমন কোনও ব্যক্তি এ শাস্তি কার্যকর করার অধিকার রাখে না। আবার রাষ্ট্রও তা কার্যকর করতে পারে কেবল তখনই, যখন শরী'আতসম্মতভাবে অপরাধ প্রমাণিত হবে। অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য ও প্রত্যক্ষদর্শী চারজন সাক্ষী যখন অপরাধ ব্যভিচারকর্মের সাক্ষ্য প্রদান করবে অথবা ব্যভিচারকারী নিজে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে সুস্পষ্ট ভাষায় অপরাধ স্বীকার করবে, তখনই হুদূদ আইন কার্যকর করা যাবে। সুতরাং সাক্ষী যদি চারজন না হয় অথবা চারজনের কোনও একজন সাক্ষী বিশ্বস্ত না হয় কিংবা একজনের সাক্ষ্যতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পাওয়া যায়, তবে এরূপ আইন কার্যকর করা মোটেই জায়েয নয়।

হুদূদের ক্ষেত্রে নিয়ম হল অপরাধ প্রমাণে কোনওরকম সন্দেহ পাওয়া গেলে হুদূদ কার্যকর করা যায় না। হযরত উমর রাযি. বলেন, সন্দেহের কারণে হুদূদ কার্যকর না করাটা আমার কাছে সন্দেহের ভিত্তিতে তা কার্যকর করার চেয়ে শ্রেয়। (মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৮৪৯৩)

এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
" ادرؤوا الحدود ما استطعتم , فإن وجدتم للمسلمين مخرجا فخلوا سبيله , فإن الإمام أن يخطئ في العفو خير من أن يخطئ في العقوبة "
'তোমরা যতক্ষণ সম্ভব হুদূদ (শরী'আতের নির্ধারিত শাস্তি) টলানোর চেষ্টা করো। যদি মুসলিমদের জন্য নিষ্কৃতির কোনও পথ পাও, তবে তাকে মুক্তি দিয়ে দাও। কেননা ইমাম যদি ভুলবশত ক্ষমা করে দেয়, তবে সেটা ভুলবশত শাস্তি দেওয়ার চেয়ে শ্রেয়’। (বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৮২৯৪)

মোটকথা, রজমের আইনটি কঠিন ও কঠোর বটে, কিন্তু সে কঠিন আইন যে যত্রতত্র কার্যকর করা যাবে এমনও নয়। এটা কার্যকর করার জন্য অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণ করার প্রক্রিয়াটি অনেক কঠিন। কম সংখ্যক অভিযুক্তের ক্ষেত্রেই তা প্রমাণ করা সম্ভব। ফলে এ আইনের আওতায় এনে অতি নগণ্য সংখ্যকের উপরই এটা কার্যকর করা যায়। তবে কার বেলায় অভিযোগ প্রমাণিত হবে আর কার বেলায় প্রমাণিত হবে না, তা তো কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। যদি প্রমাণিত হয়ে যায়, তবে চরম লাঞ্ছনাকর ও নির্মম শাস্তিভোগের মাধ্যমে ইহজীবন সাঙ্গ হয়ে যাবে, এই ভয় প্রত্যেকের মনেই থাকবে। কাজেই রাষ্ট্রের আইন যদি ইসলামী হয় এবং হুদূদব্যবস্থা কার্যকরও হয়, তবে সমাজ থেকে ব্যভিচারের অপরাধ সম্পূর্ণ লোপ না পেলেও মাত্রা যে অনেক কমে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। কেননা কঠোর-কঠিন শাস্তির ভয়ে এ জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হওয়ার সাহস কেউ করবে না।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)