আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৬৬- দুআ - যিকরের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৩২৯
৩৩৬১. নামাযের পরের দুআ।
৫৮৯০। ইসহাক (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, (একদা গরীব) সাহাবীগণ বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! ধনী লোকেরা তো উচ্চমর্যাদা ও চিরস্থায়ী নিআমত নিয়ে আমাদের থেকে এগিয়ে গেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ তা কেমন করে? তারা বললেনঃ আমরা যেরকম নামায আদায় করি, তারাও সেরকম নামায আদায় করেন। আমরা যেরূপ জিহাদ করি, তারাও সেরূপ জিহাদ করেন এবং তারা তাদের অতিরিক্ত মাল থেকে সাদ্কা-খায়রাত করেন; কিন্তু আমাদের কাছে তো সম্পদ নেই। তিনি বললেনঃ আমি কি তোমাদের একটি আমল বাতলে দেবনা, যে আমল দ্বারা তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের মর্যাদা অর্জন করতে পারবে, আর তোমাদের পরবর্তীদের চাইতে এগিয়ে যেতে পারবে, আর তোমাদের অনুরূপ আমল কেউ করতে পারবে না, কেবলমাত্র যারা তোমাদের ন্যায় আমল করবে তারা ব্যতীত। সে আমল হলোঃ তোমরা প্রত্যেক নামাযের পর ১০ বার সুবহানাল্লাহ, ১০ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ১০ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
১. এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, ফরয নামাযের পরে ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৩ বার আল্লাহ আকবার বলা অনেক ফযীলতপূর্ণ আমল। সুতরাং এটা গুরুত্ব সহকারে করা উচিত। এটাই হানাফী মাযহাবের মত। মাযহাবের কিতাবে আরো বর্ণিত আছে যে, তিন প্রকারের তাসবীহ মিলে ৯৯বার হয়। এটাকে শতবার পূর্ণ করতে শেষবার لاإله الا الله বলবে। (শামী: ১/৫৩০) আর যে সকল নামাযের পরে সুন্নাত আছে সে সকল নামাযের পরে প্রথমে সুন্নাত পড়ে তারপরে উক্ত তাসবীহ পাঠ করবে। যেহেতু নামাযের পরে সুন্নাত থাকলে রসূল স. দেরি করতেন না। বরং সংক্ষিপ্ত দুআ’ করে সুন্নাতের জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন। (মুসলিম-১২১৩) উপরন্তু হাদীসে ব্যবহৃত خَلْفَ كُلِّ صَلاَةٍ বা دُبُرِ كُلِّ صَلَاةٍ ‘প্রতি নামাযের পর’ শব্দ দু’টির মধ্যে অনেক ব্যাপকতা রয়েছে। দু’রাকাত সুন্নাত পড়ার মত সময়ে হাদীসে বর্ণিত ফযীলত হাত ছাড়া হওয়ার কথা নয়। এভাবে করা হলে সুন্নাত আদায়ে দেরি না করা এবং নামাযের পরে তাসবীহ পড়া উভয় প্রকারের হাদীসের উপর একত্রে আমল করা সম্ভব।
২. সাহাবায়ে কেরামের জীবনদৃষ্টি ছিল আখিরাতমুখী। আখিরাতের নাজাত লাভই ছিল তাদের মূল লক্ষ্যবস্তু। তাই বেশি বেশি ছাওয়াব হাসিল করার প্রতি তাদের আগ্রহ ছিল অদম্য। যেসব কাজে বেশি বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়, পূর্ণ আগ্রহের সঙ্গে তারা তা করতেন। করতে না পারলে তাদের খুব আক্ষেপ হতো।
দান-খয়রাত করলে খুব বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়। অনেক সাহাবী ছিলেন খুব গরীব। তাদের পক্ষে ধনীদের মতো দান-খয়রাত করা সম্ভব হতো না। তাই এ উপায়ে ছাওয়াব হাসিলের ক্ষেত্রে তারা পেছনে ছিলেন। এজন্য তাদের আক্ষেপ ছিল। একদল গরীব মুহাজির সে আক্ষেপ নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলেন। তারা বললেন-
(সম্পদশালীগণ উচ্চমর্যাদা ও স্থায়ী নি‘আমত নিয়ে গেল)। এটা আক্ষেপের ভাষা। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যলাভের যে উচ্চতর স্থান এবং জান্নাতের যে অনন্ত ও অফুরন্ত নি'আমত, তা তো ধনীরা নিয়ে গেল; আমরা নিতে পারলাম না! তাদের দৃষ্টি আখিরাতের দিকে। ধনীগণ তাদের ধন-দৌলত দ্বারা দুনিয়ায় মানুষের কাছে যে ইজ্জত-সম্মান পায় সেদিকে তাদের কোনও দৃষ্টি নেই। তারা যে আরাম-আয়েশে থাকে, সহজে সুখের সামগ্রী অর্জন করতে পারে, সেজন্যও তারা লালায়িত নন। তারা ধন-সম্পদ সঞ্চয় করতে পারে কিন্তু আমরা পারি না, এ কারণে ধনীদের প্রতি তাদের কোনও হিংসা নেই। তাদের লক্ষ্যবস্তু কেবল আখিরাত। দৃষ্টি কেবলই আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও জান্নাতের অফুরন্ত নি'আমতের দিকে। সে ক্ষেত্রে তারা যে ধনীদের থেকে পেছনে পড়ে গেল! তাদের সে আক্ষেপের ছবি অপর এক আয়াতে এভাবে আঁকা হয়েছে-
وَلَا عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوْا وَأَعْيُنُهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلَّا يَجِدُوا مَا يُنْفِقُونَ (92)
‘সেইসকল লোকেরও (কোনও গুনাহ) নেই, যাদের অবস্থা এই যে, তুমি তাদের (যুদ্ধে যাওয়ার) জন্য কোনও বাহনের ব্যবস্থা করবে, যখন এই আশায় তারা তোমার কাছে আসল আর তুমি বললে, আমার কাছে তো তোমাদেরকে দেওয়ার মতো কোনও বাহন নেই, তখন তাদের কাছে খরচ করার মতো কিছু না থাকার দুঃখে তারা এভাবে ফিরে গেল যে, তাদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল।(সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৯২)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বললেন- يُصَلُّوْنَ كَمَا نُصَلِّي، وَيَصُوْمُوْنَ كَمَا نَصُوْمُ ، وَيَتَصَدَّقُوْنَ وَلَا نَتَصَدَّقُ، وَيَعْتِقُوْنَ وَلَا نَعْتِقُ (তারা নামায পড়ে, যেমন আমরা নামায পড়ি। তারা রোযা রাখে, যেমন আমরা রোযা রাখি। তারা দান-খয়রাত করে, অথচ আমরা দান-খয়রাত করতে পারি না। তারা গোলাম আযাদ করে, অথচ আমরা আযাদ করতে পারি না)। অর্থাৎ ছাওয়াবের কাজ দু'রকম। কিছু আছে সকলের জন্য সাধারণ, যা ধনী-গরীব সকলেই করতে পারে। যেমন নামায ও রোযা। আবার কিছু আছে এমন, যা কেবল ধনীরাই করতে পারে। যেমন দান-খয়রাত করা, গোলাম আযাদ করা ইত্যাদি। আমরা গরীব হওয়ায় এসব করতে পারি না। ফলে এসব করার মাধ্যমে ধনীগণ আল্লাহ তা'আলার যে নৈকট্য অর্জন করতে পারে এবং জান্নাতের স্থায়ী যেসকল নি'আমত তাদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব, আমাদের পক্ষে তা কীভাবে সম্ভব? সুতরাং আমরা তো এ ক্ষেত্রে তাদের থেকে পেছনে থেকে যাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
(তোমাদের এমন একটা বিষয় শেখাব না, যা দ্বারা তোমরা তাদের ধরতে পারবে, যারা তোমাদের অগ্রগামী হয়ে গেছে এবং যারা তোমাদের পরের, তোমরা তাদের অগ্রগামী থাকতে পারবে)? অর্থাৎ ধনীগণ আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ খরচ করার দ্বারা তোমাদের পেছনে ফেলে সামনে চলে গেছে বলে তোমরা আক্ষেপ করো না। এমন মর্যাদাপূর্ণ কাজও আছে, যা করলে তোমরা তাদের ধরে ফেলতে পারবে। আবার তা দ্বারা তোমরা এতদূর পৌঁছে যেতে পারবে যে, যারা তোমাদের পেছনে আছে তারা তোমাদের ধরতে পারবে না। ফলে আল্লাহর কাছে মর্যাদায় তোমাদের উপরে কেউ থাকবে না। হাঁ, এটা ভিন্ন কথা যে, সে কাজ যদি তোমাদের মতো অন্য কেউও করে, তবে তারা তোমাদের সমমর্যাদার অধিকারী হবে।
এ কথা শুনে সেই গরীব মুহাজিরগণ খুব আশান্বিত হলেন। তারা সে আমল সম্পর্কে জানার আগ্রহ ব্যক্ত করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
تُسَبِّحُونَ، وَتُكَبِّرُونَ، وَتَحْمَدُونَ، دُبُرَ كُلِّ صَلَاةٍ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ مَرَّةً (তোমরা প্রত্যেক নামাযের পর ৩৩ বার করে সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও আলহামদুলিল্লাহ বলবে)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার এ যিকির এত মর্যাদাপূর্ণ আমল যে, এর মাধ্যমে তোমরা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যলাভের ক্ষেত্রে বিত্তবান দানশীলদেরও ছাড়িয়ে যেতে পারবে। অর্থাৎ এটা আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করার উত্তম বিকল্প। কোনও কোনও হাদীছে এসব যিকিরকে সরাসরি দান-খয়রাত (সদাকা) নামেও অভিহিত করা হয়েছে। এক হাদীছে আছে-
يُصْبِحُ عَلَى كُلِّ سُلَامَى مِنْ أَحَدِكُمْ صَدَقَةٌ: فَكُلُّ تَسْبِيحَةٍ صَدَقَةٌ وَكُلُّ تَحْمِيدَةٍ صَدَقَةٌ وَكُلُّ تَهْلِيلَةٍ صَدَقَةٌ وَكُلُّ تَكْبِيرَةٍ صَدَقَةٌ، وَأَمْرٌ بِالْمَعْرُوْفِ صَدَقَةٌ وَنَهْيٌ عَنِ الْمُنكَرِ صَدَقَةٌ، وَيُجْزِي مِنْ ذَلِكَ رَكْعَتَانِ يَرْكَعُهُمَا مِنَ الضُّحَى
‘প্রতিদিন ভোরে তোমাদের শরীরের প্রতিটি জোড়ার বিনিময়ে সদাকা আবশ্যিক হয়ে যায়। তো প্রতিটি তাসবীহ একটি সদাকা; প্রতিটি তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ বলা) একটি সদাকা; প্রতিটি তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা) একটি সদাকা; প্রতিটি তাকবীর একটি সদাকা; একবার সৎকাজের আদেশ করা একটি সদাকা; একবার অসৎকাজে নিষেধ করা একটি সদাকা। আর এ সমুদয়ের পরিবর্তে চাশতের দু' রাক'আত নামায পড়াই যথেষ্ট হয়ে যায়।(সহীহ মুসলিম: ৭২০: সুনানে আবূ দাউদ: ১২৮৫; মুসনাদে আহমাদ: ২১৪৭৪; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৪৮৯৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১০০৭)
এর দ্বারা বোঝা যায়, দান-খয়রাত অপেক্ষা আল্লাহ তা'আলার যিকিরের ফযীলত বেশি এবং যিকিরই শ্রেষ্ঠতম আমল। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ
‘আর আল্লাহর যিকিরই তো সর্বাপেক্ষা বড় জিনিস।(সূরা আনকাবুত (২৯), আয়াত ৪৫)
হযরত আবুদ দারদা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرِ أَعْمَالِكُمْ، وَأَزْكَاهَا عِنْدَ مَلِيْكِكُمْ، وَأَرْفَعِهَا فِي دَرَجَاتِكُمْ وَخَيْرٌ لَكُمْ مِنْ إِنْفَاقِ الذَّهَبِ وَالْوَرِقِ، وَخَيْرٌ لَكُمْ مِنْ أَنْ تَلْقَوْا عَدُوَّكُمْ فَتَضْرِبُوا أَعْنَاقَهُمْ وَيَضْرِبُوا أَعْنَاقَكُمْ؟ قَالُوْا : بَلَى قَالَ: ذِكْرُ اللَّهِ تَعَالَى
আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব না এমন আমল সম্পর্কে, যা তোমাদের যাবতীয় আমলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তোমাদের মালিক আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি পবিত্র, তোমাদের মর্যাদার পক্ষে সর্বাপেক্ষা বেশি উঁচু, (আল্লাহর পথে) সোনা-রুপা খরচ করার চেয়েও উত্তম এবং তোমাদের পক্ষে এরচে'ও বেশি কল্যাণকর যে, তোমরা তোমাদের শত্রুর মুখোমুখি হবে আর তোমরা তাদের হত্যা করবে, তারাও তোমাদের হত্যা করবে? সাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই বলে দিন ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, আল্লাহ তা'আলার যিকির।(জামে' তিরমিযী: ৩৩৭৭: সুনানে ইবন মাজাহ ৩৭৯০; মুআত্তা মালিক: ৭১৬; হাকিম, আল-মুসতাদরাক: ১৮২৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১২৪৪)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আখিরাতের নি'আমত ও মর্যাদালাভের প্রতি সাহাবীদের বিপুল আগ্রহ ছিল।
খ. আখিরাতের নি'আমত ও মর্যাদাই মানুষের জন্য আসল কাম্যবস্তু।
গ. আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ খরচ করার দ্বারা আখিরাতের উচ্চমর্যাদা লাভ হয়।
ঘ. উদ্বৃত্ত সম্পদ বিলাসিতায় খরচ না করে নেককাজে খরচ করা উচিত।
ঙ. প্রত্যেক ফরয নামাযের পর ৩৩ বার করে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ও আল্লাহ আকবার পড়া চাই।
চ. আল্লাহ তা'আলার যিকির সর্বশ্রেষ্ঠ আমল।
২. সাহাবায়ে কেরামের জীবনদৃষ্টি ছিল আখিরাতমুখী। আখিরাতের নাজাত লাভই ছিল তাদের মূল লক্ষ্যবস্তু। তাই বেশি বেশি ছাওয়াব হাসিল করার প্রতি তাদের আগ্রহ ছিল অদম্য। যেসব কাজে বেশি বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়, পূর্ণ আগ্রহের সঙ্গে তারা তা করতেন। করতে না পারলে তাদের খুব আক্ষেপ হতো।
দান-খয়রাত করলে খুব বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়। অনেক সাহাবী ছিলেন খুব গরীব। তাদের পক্ষে ধনীদের মতো দান-খয়রাত করা সম্ভব হতো না। তাই এ উপায়ে ছাওয়াব হাসিলের ক্ষেত্রে তারা পেছনে ছিলেন। এজন্য তাদের আক্ষেপ ছিল। একদল গরীব মুহাজির সে আক্ষেপ নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলেন। তারা বললেন-
(সম্পদশালীগণ উচ্চমর্যাদা ও স্থায়ী নি‘আমত নিয়ে গেল)। এটা আক্ষেপের ভাষা। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যলাভের যে উচ্চতর স্থান এবং জান্নাতের যে অনন্ত ও অফুরন্ত নি'আমত, তা তো ধনীরা নিয়ে গেল; আমরা নিতে পারলাম না! তাদের দৃষ্টি আখিরাতের দিকে। ধনীগণ তাদের ধন-দৌলত দ্বারা দুনিয়ায় মানুষের কাছে যে ইজ্জত-সম্মান পায় সেদিকে তাদের কোনও দৃষ্টি নেই। তারা যে আরাম-আয়েশে থাকে, সহজে সুখের সামগ্রী অর্জন করতে পারে, সেজন্যও তারা লালায়িত নন। তারা ধন-সম্পদ সঞ্চয় করতে পারে কিন্তু আমরা পারি না, এ কারণে ধনীদের প্রতি তাদের কোনও হিংসা নেই। তাদের লক্ষ্যবস্তু কেবল আখিরাত। দৃষ্টি কেবলই আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও জান্নাতের অফুরন্ত নি'আমতের দিকে। সে ক্ষেত্রে তারা যে ধনীদের থেকে পেছনে পড়ে গেল! তাদের সে আক্ষেপের ছবি অপর এক আয়াতে এভাবে আঁকা হয়েছে-
وَلَا عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوْا وَأَعْيُنُهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلَّا يَجِدُوا مَا يُنْفِقُونَ (92)
‘সেইসকল লোকেরও (কোনও গুনাহ) নেই, যাদের অবস্থা এই যে, তুমি তাদের (যুদ্ধে যাওয়ার) জন্য কোনও বাহনের ব্যবস্থা করবে, যখন এই আশায় তারা তোমার কাছে আসল আর তুমি বললে, আমার কাছে তো তোমাদেরকে দেওয়ার মতো কোনও বাহন নেই, তখন তাদের কাছে খরচ করার মতো কিছু না থাকার দুঃখে তারা এভাবে ফিরে গেল যে, তাদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল।(সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৯২)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বললেন- يُصَلُّوْنَ كَمَا نُصَلِّي، وَيَصُوْمُوْنَ كَمَا نَصُوْمُ ، وَيَتَصَدَّقُوْنَ وَلَا نَتَصَدَّقُ، وَيَعْتِقُوْنَ وَلَا نَعْتِقُ (তারা নামায পড়ে, যেমন আমরা নামায পড়ি। তারা রোযা রাখে, যেমন আমরা রোযা রাখি। তারা দান-খয়রাত করে, অথচ আমরা দান-খয়রাত করতে পারি না। তারা গোলাম আযাদ করে, অথচ আমরা আযাদ করতে পারি না)। অর্থাৎ ছাওয়াবের কাজ দু'রকম। কিছু আছে সকলের জন্য সাধারণ, যা ধনী-গরীব সকলেই করতে পারে। যেমন নামায ও রোযা। আবার কিছু আছে এমন, যা কেবল ধনীরাই করতে পারে। যেমন দান-খয়রাত করা, গোলাম আযাদ করা ইত্যাদি। আমরা গরীব হওয়ায় এসব করতে পারি না। ফলে এসব করার মাধ্যমে ধনীগণ আল্লাহ তা'আলার যে নৈকট্য অর্জন করতে পারে এবং জান্নাতের স্থায়ী যেসকল নি'আমত তাদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব, আমাদের পক্ষে তা কীভাবে সম্ভব? সুতরাং আমরা তো এ ক্ষেত্রে তাদের থেকে পেছনে থেকে যাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
(তোমাদের এমন একটা বিষয় শেখাব না, যা দ্বারা তোমরা তাদের ধরতে পারবে, যারা তোমাদের অগ্রগামী হয়ে গেছে এবং যারা তোমাদের পরের, তোমরা তাদের অগ্রগামী থাকতে পারবে)? অর্থাৎ ধনীগণ আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ খরচ করার দ্বারা তোমাদের পেছনে ফেলে সামনে চলে গেছে বলে তোমরা আক্ষেপ করো না। এমন মর্যাদাপূর্ণ কাজও আছে, যা করলে তোমরা তাদের ধরে ফেলতে পারবে। আবার তা দ্বারা তোমরা এতদূর পৌঁছে যেতে পারবে যে, যারা তোমাদের পেছনে আছে তারা তোমাদের ধরতে পারবে না। ফলে আল্লাহর কাছে মর্যাদায় তোমাদের উপরে কেউ থাকবে না। হাঁ, এটা ভিন্ন কথা যে, সে কাজ যদি তোমাদের মতো অন্য কেউও করে, তবে তারা তোমাদের সমমর্যাদার অধিকারী হবে।
এ কথা শুনে সেই গরীব মুহাজিরগণ খুব আশান্বিত হলেন। তারা সে আমল সম্পর্কে জানার আগ্রহ ব্যক্ত করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
تُسَبِّحُونَ، وَتُكَبِّرُونَ، وَتَحْمَدُونَ، دُبُرَ كُلِّ صَلَاةٍ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ مَرَّةً (তোমরা প্রত্যেক নামাযের পর ৩৩ বার করে সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও আলহামদুলিল্লাহ বলবে)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার এ যিকির এত মর্যাদাপূর্ণ আমল যে, এর মাধ্যমে তোমরা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যলাভের ক্ষেত্রে বিত্তবান দানশীলদেরও ছাড়িয়ে যেতে পারবে। অর্থাৎ এটা আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করার উত্তম বিকল্প। কোনও কোনও হাদীছে এসব যিকিরকে সরাসরি দান-খয়রাত (সদাকা) নামেও অভিহিত করা হয়েছে। এক হাদীছে আছে-
يُصْبِحُ عَلَى كُلِّ سُلَامَى مِنْ أَحَدِكُمْ صَدَقَةٌ: فَكُلُّ تَسْبِيحَةٍ صَدَقَةٌ وَكُلُّ تَحْمِيدَةٍ صَدَقَةٌ وَكُلُّ تَهْلِيلَةٍ صَدَقَةٌ وَكُلُّ تَكْبِيرَةٍ صَدَقَةٌ، وَأَمْرٌ بِالْمَعْرُوْفِ صَدَقَةٌ وَنَهْيٌ عَنِ الْمُنكَرِ صَدَقَةٌ، وَيُجْزِي مِنْ ذَلِكَ رَكْعَتَانِ يَرْكَعُهُمَا مِنَ الضُّحَى
‘প্রতিদিন ভোরে তোমাদের শরীরের প্রতিটি জোড়ার বিনিময়ে সদাকা আবশ্যিক হয়ে যায়। তো প্রতিটি তাসবীহ একটি সদাকা; প্রতিটি তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ বলা) একটি সদাকা; প্রতিটি তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা) একটি সদাকা; প্রতিটি তাকবীর একটি সদাকা; একবার সৎকাজের আদেশ করা একটি সদাকা; একবার অসৎকাজে নিষেধ করা একটি সদাকা। আর এ সমুদয়ের পরিবর্তে চাশতের দু' রাক'আত নামায পড়াই যথেষ্ট হয়ে যায়।(সহীহ মুসলিম: ৭২০: সুনানে আবূ দাউদ: ১২৮৫; মুসনাদে আহমাদ: ২১৪৭৪; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৪৮৯৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১০০৭)
এর দ্বারা বোঝা যায়, দান-খয়রাত অপেক্ষা আল্লাহ তা'আলার যিকিরের ফযীলত বেশি এবং যিকিরই শ্রেষ্ঠতম আমল। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ
‘আর আল্লাহর যিকিরই তো সর্বাপেক্ষা বড় জিনিস।(সূরা আনকাবুত (২৯), আয়াত ৪৫)
হযরত আবুদ দারদা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرِ أَعْمَالِكُمْ، وَأَزْكَاهَا عِنْدَ مَلِيْكِكُمْ، وَأَرْفَعِهَا فِي دَرَجَاتِكُمْ وَخَيْرٌ لَكُمْ مِنْ إِنْفَاقِ الذَّهَبِ وَالْوَرِقِ، وَخَيْرٌ لَكُمْ مِنْ أَنْ تَلْقَوْا عَدُوَّكُمْ فَتَضْرِبُوا أَعْنَاقَهُمْ وَيَضْرِبُوا أَعْنَاقَكُمْ؟ قَالُوْا : بَلَى قَالَ: ذِكْرُ اللَّهِ تَعَالَى
আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব না এমন আমল সম্পর্কে, যা তোমাদের যাবতীয় আমলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তোমাদের মালিক আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি পবিত্র, তোমাদের মর্যাদার পক্ষে সর্বাপেক্ষা বেশি উঁচু, (আল্লাহর পথে) সোনা-রুপা খরচ করার চেয়েও উত্তম এবং তোমাদের পক্ষে এরচে'ও বেশি কল্যাণকর যে, তোমরা তোমাদের শত্রুর মুখোমুখি হবে আর তোমরা তাদের হত্যা করবে, তারাও তোমাদের হত্যা করবে? সাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই বলে দিন ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, আল্লাহ তা'আলার যিকির।(জামে' তিরমিযী: ৩৩৭৭: সুনানে ইবন মাজাহ ৩৭৯০; মুআত্তা মালিক: ৭১৬; হাকিম, আল-মুসতাদরাক: ১৮২৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১২৪৪)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আখিরাতের নি'আমত ও মর্যাদালাভের প্রতি সাহাবীদের বিপুল আগ্রহ ছিল।
খ. আখিরাতের নি'আমত ও মর্যাদাই মানুষের জন্য আসল কাম্যবস্তু।
গ. আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ খরচ করার দ্বারা আখিরাতের উচ্চমর্যাদা লাভ হয়।
ঘ. উদ্বৃত্ত সম্পদ বিলাসিতায় খরচ না করে নেককাজে খরচ করা উচিত।
ঙ. প্রত্যেক ফরয নামাযের পর ৩৩ বার করে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ও আল্লাহ আকবার পড়া চাই।
চ. আল্লাহ তা'আলার যিকির সর্বশ্রেষ্ঠ আমল।
